বরফকুচি খামে দূর পাহাড়ের ডাক – ১২

১২

দরজায় খুট করে একটা শব্দ হতেই চমকে উঠল নিশা। শরীর ভীষণ দুর্বল। সকাল থেকে বলতে গেলে কিছুই খাওয়া হয়নি। চোখের সামনে এখন সর্ষে ফুল নেচে বেড়াচ্ছে। বোধবুদ্ধির স্থিরতা নেই। সারাদিন বালিশে মুখ গুঁজে রেখে বুকের সমস্ত কষ্ট আর কান্নাকে সমাধিস্থ করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছে। তন্দ্রার মতো আচ্ছন্নতায় কেটেছে প্রহর। দুর্বিষহ অপমান ধারাল দাঁত দিয়ে কামড়ে কামড়ে হৃৎপিণ্ড ক্ষতবিক্ষত করে তুলেছে। কেন এমন একটা অবিবেচক নিষ্ঠুর মানুষকে ভালোবাসতে গেল এই কথা ভেবে ভেবে নিজেকেই নিজে গঞ্জনা দিয়েছে, গালমন্দ করেছে। কিন্তু যতই সে মানুষটাকে ঘৃণা করার দুর্নিবার প্রয়াসে নিজেকে আকণ্ঠ নিযুক্ত করার চেষ্টা করেছে, ততই যেন পাগল পাগল তারছেঁড়া ভালোবাসার অশরীরী আত্মা আরো বেশি করে ভর করেছে মাথায়। জীবনের সমস্ত অপ্রাপ্তি, অনিশ্চয়তা এবং অবহেলাকে ছাপিয়ে শুধু একটিমাত্র অসহ্য ব্যথার তপ্তশেল তার পঁচিশ বছরের যুবতী হৃদয়কে অনবরত দগ্ধ করে চলেছে। সমস্ত কষ্ট, বেদনা, অপমান সহ্য করতে পারত হাসিমুখে, যদি ওই লোকটা একটাবার তাকে বোঝার চেষ্টা করত। বুঝল তো না, বরং চিরজীবনের জন্য নিজের কাছ থেকে বিচ্যুত করতে চাইল। আর সবেচেয়ে কুৎসিত ব্যাপার হচ্ছে, এতকিছুর পরেও নিশার শুধু একটি কথা চিন্তা করেই মরে যেতে ইচ্ছা করছে যে, এই বাড়ি থেকে চলে গেলে সে মানুষটাকে রোজ একটিবারের জন্য দেখতে পাবে না। নিজের এই হীন বেহায়া মনোভাব তাকে নিজের কাছেই অনেক বেশি রকমের তুচ্ছ এবং নগণ্য করে তুলছে। ভীষণ তিতকুটে একটা নিস্তব্ধ অনুভবে গুম হয়ে আছে অন্তঃকরণ। মরতে ইচ্ছা করছে খুব। জুবিন না থাকলে সত্যিই আজকে মরে যেত নিশা। এই বিশ্রী রকমের জীবন তার আর সহ্য হচ্ছে না। 

দরজায় শব্দ হতেই ঢুলুঢুলু অস্পষ্ট মস্তিষ্কের মাথাটা নিয়ে উঠে বসেছিল সে। ঘরে কোন আলো নেই। করিডরের আবছা আলোয় দেখতে পেল চৌকাঠে শ্বশুরমশাই দাঁড়িয়ে আছেন। নিশা তড়িঘড়ি করে গায়ের ওড়নাটা ঠিকঠাক করল। দ্রুত বিছানা থেকে নেমে এসে বাতি জ্বালাল ঘরের। মুর্তজা সাহেব ধীরস্থির গলায় প্রশ্ন করলেন, ‘আসব?’ 

— ‘জি বাবা আসুন।’ 

— ‘কেমন আছ?’ 

নিশা এলোমেলো চুল হাত দিয়ে ঠিক করে ব্রিবত ভাবে বলল, ‘এইতো…আছি মোটামুটি।’ 

মুর্তজা সাহেব চেয়ারে বসতে বসতে পুত্রবধূকে গম্ভীর চোখে পরখ করলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, ‘অসুস্থ নাকি?’ 

— ‘জি…মাথাটা একটু ধরেছে।’ 

— ‘তোমার শাশুড়ি বললেন, তুমি নাকি আজ সকালে জুবিনকে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলে?’ 

নিশা অপ্রস্তুত বোধ করল। ঘরের মাঝামাঝি জায়গায় কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। মাথাটা নিচু। পরনে সুতির সালওয়ার কামিজ। ওড়নাটা বুকের ওপর চওড়াভাবে ছড়ানো। এলোমেলো চুল ফুলেফেঁপে আছে মুখের চারিধারে। মুর্তজা সাহেব এই মেয়েটিকে অত্যধিক স্নেহ করেন। মেয়েটি শুধু বাহ্যিকভাবেই রূপবতী নয়, এর আত্মার একটা আলাদা সৌন্দর্য আছে। এত মার্জিত, নম্র, সুললিত মেয়ে আজকাল চোখেই পড়ে না। যে অধ্যাবসায়, ধৈর্য এবং সহনশীলতা তিনি নিশার মধ্যে দেখেছেন তা এক কথায় অতুলনীয়। মেয়েটিকে দেখলে তাই মনের মধ্যে একটা অপূর্ব ভক্তির সঞ্চার হয়। মুর্তজা সাহেব স্নেহসিক্ত কণ্ঠে বললেন, ‘দাঁড়িয়ে আছ কেন? বসো। বসে কথা বলো। হঠাৎ এমন কী হয়ে গেল যে তুমি জুবিনকে নিয়ে একলা বেরিয়ে যাচ্ছিলে?’ 

নিশার চোখে কান্নার ঢেউ ঝাপটা মারছিল। নতমুখে বিছানার ওপর বসল সে। কান্নার ঢোক গিলে বলল, ‘বাবা এ বাড়িতে আমার পক্ষে আর থাকা সম্ভব না। তুরিন খুব কষ্ট পাচ্ছে আমার জন্য। শুধু তুরিনই নয়, তুরিনের বাবা-মা কেউ শান্তিতে নেই। এই সমস্ত অশান্তির জন্য শুধু আমিই দায়ী। আপনি আমাকে দ্রুত অন্য কোথাও পাঠাবার ব্যবস্থা করুন। আমার এখানে দম আটকে আসছে।’ 

মুর্তজা সাহেব ব্যথিত স্বরে বললেন, ‘সে আমি খুব ভালোমতোই বুঝতে পারছি মা। তুমি না বললেও বুঝি। আমি তোমার শাশুড়ির সঙ্গে কথা বলেছি। নেক্সট উইকেন্ডেই তোমাকে নিয়ে তোমার শাশুড়ি মুভ করবে। কলোরাডো স্প্রিংসে শহীদের একটা কনডো আছে। গতমাসে টিন্যান্ট চলে গেছে। খালি পড়ে আছে। তোমরা ওখানে গিয়ে থাকো। তবে এই বিষয়ে তোমার স্বামীর মতামত কী? 

নিশার মুখটা আরও বেশি করে লেগে গেল চিবুকের সঙ্গে। অবাধ্য কান্নার জল রুদ্ধ করে তুলল কণ্ঠস্বর। কম্পনরত গলায় সে অনেক কষ্টে বলল, ‘উনি আমাকে চিরতরে মুক্তি দিয়েছেন।’ 

— ‘দুঃখের কথা আর কী বলব মা? ছেলেটাকে আমি মানুষ করতে পারলাম না…মানুষ হলে তোমার মতো একটা মেয়েকে অগ্রাহ্য করতে পারত না।’ 

স্বামী সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য নিশা সহ্য করতে পারে না কখনোই। তার মনটা চকিতে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। শ্বশুরমশাইকে সে ভক্তি করে। কখনো মুখের ওপর কথা বলে না। কিন্তু আজকে চুপ করে থাকতে পারল না। রুষ্ট স্বরে বলে উঠল, ‘মানুষ হিসেবে উনি অত্যন্ত উচ্চশ্রেণির। উনাকে আমি দোষ দিই না। উনি তুরিনকে ভালোবাসেন, উনার স্ত্রীকে ভালোবাসেন, যদিও শুনেছি স্ত্রীর সঙ্গে এখন আর সম্পর্ক আগের মতো নেই। সেই বিচ্ছেদের জন্যও নিশ্চয়ই আমিই দায়ী। আসলে বাবা এই সংসারে আমার আগমনটাই সবচেয়ে বড় ভুল ছিল।’ 

— ‘আমি জানি জাহিদের মতো তুমিও আমাকে মনে মনে এই বিয়ের জন্য দায়ী কর, দোষী কর। কিন্তু মা, তোমাদের বিয়েটার পেছনে আমার একটা গোপন উদ্দেশ্য ছিল। তুমি হয়তো কোন একদিন জানলেও জানতে পারবে। কিন্তু আপাতত একটা বিষয়ে আমি তোমাকে নিশ্চিত করতে চাই যে আমি বেঁচে থাকতে তোমার কোন দুশ্চিন্তা নেই।’ 

— ‘বাবা একটা বিষয় দেখবেন, উনি যেন জুবিনকে আমার কাছ থেকে নিয়ে না যায়। আমি যেখানে থাকব, জুবিনও কিন্তু সেখানেই থাকবে। 

— ‘আলৎ থাকবে। জুবিনকে তোমার কাছ থেকে নিয়ে যাবে, এত সাহস ওই ব্যাটার আছে নাকি?’ 

১৪

‘খুব তো বসে বসে আড্ডা দিচ্ছ। বার্থডে গার্লের জামা কাপড় তো কিছুই কেনা হয়নি। সে খবর আছে?’ নীলিমার উচ্চকণ্ঠের হাঁকডাক জাহিদ আর তুরিনের কথোপকথনে বাধ সাধল। মিসেস মুর্তজা লফটের রেলিংয়ের ধারে তখনো জুবিনকে কোলে নিয়ে উপস্থিত ছিলেন। নীলিমার কথা শুনে নিচতলার লিভিংরুমে বসে থাকা জাহিদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘ভালো কথা মনে করিয়েছে বড় বৌমা। জাহিদ, তুই ওর সঙ্গে গিয়ে বাচ্চার জামা কিনে আন।’ 

নীলিমা বলল, ‘মা আমি যেতে পারব না। অফিসের একগাদা কাজ পড়ে আছে। ঘর সাজানো হয়ে গেলেই আমাকে ল্যাপটপ নিয়ে বসতে হবে।’ 

আনিতা বলল, ‘আমি যেতে পারি চাচ্চুর সঙ্গে।’

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল জাহিদ। জুবিনের জন্মদিনের জন্য ঘর সাজানো হচ্ছে। নতুন জামা কেনাকাটার পরিকল্পনা করা হচ্ছে…এই সমস্ত উৎসব যজ্ঞে যে মানুষটার সবচাইতে বেশি প্রাধান্য থাকার কথা ছিল সেই মানুষটাকেই এরা সমস্ত প্রক্রিয়া থেকে কী সচেতনভাবে বঞ্চিত করে চলেছে। কেউ একটিবার নিশার কথা ভাবছে না। ওর নামটাও উচ্চারণ করছে না। যেন নিশার অস্তিত্বই নেই এদের কাছে। কথাগুলো মনে হতেই জাহিদের বুকের ভেতর দহনজ্বালা ফিরে আসে। পাঁজরে আঘাত হানে যন্ত্রণা। নিশা কেন বলেছিল, ঘৃণা করে? ওই সুতীব্র নির্দয় বাক্যবাণটুকু জাহিদকে আর কোনদিন স্বস্তিতে শ্বাস ফেলতে দেবে কি? কথাটা কেন হাজার চেষ্টা করেও ভোলা যাচ্ছে না? আনিতা সামনে দাঁড়িয়ে কী যেন একটা বলল। জাহিদ শুনেও শুনল না। আশ্চর্য ব্যাপার হলো নিশার সঙ্গে আজ দুপুরেই কথা হয়েছে…দেখা হয়েছে…অথচ এখন এই সন্ধ্যাবেলায় মনে হচ্ছে যেন কতকাল দেখে না! নিশাকে একটুখানি দেখতে পাবার অবাধ্য তৃষ্ণার নির্মম অত্যাচারে বুকের ভেতরটায় জ্বরের মতো একটা ঘোর লেগে গেছে। দোতলার ওই ছোট্ট ঘরে একলা বসে থেকে নিশা এখন কার কথা ভাবছে কে জানে! শাহজিদের কথা? শাহজিদকে কি ও সত্যিই ভালোবাসে? শাহজিদও কি ওকে ভালোবাসে? নিশ্চয়ই বাসে…নিশার মতো মেয়েকে ভালো না বেসে কি থাকা যায়? 

— ‘চাচ্চু!’ ধমকের সুরে ডাক দেয় আনিতা। 

— ‘হুম?’ ঘোর ভাঙে জাহিদের। 

— ‘যাবে এখন?’ 

জাহিদ একটু অপ্রস্তুতভাবে বলল, ‘কোথায় যাওয়া যায় বলো তো?’

— ‘চেরিত্রিক যাবে?’ 

— ‘আমি তো শপিং-টপিং ভালো বুঝি না…’ 

আনিতা অভয় দিল, ‘আমি আছি না? আমি অনেক ভালো বুঝি। চলো তুমি। আমি ড্রাইভ করব কিন্তু!’ 

নীলিমা চিৎকার করে উঠল, ‘সন্ধ্যা হয়ে গেছে। রাস্তায় প্রচণ্ড ট্রাফিক। এখন তুমি ড্রাইভ করতে পারবে না।’ আনিতা মায়ের কথা পাত্তা না দিয়ে জাহিদকে বলল, ‘পাঁচ মিনিট সময় দাও। এখুনি আসছি রেডি হয়ে।’ 

আনিতার পেছন পেছন তুরিনও উঠে পড়ল। তার এখনো হাঁটতে সমস্যা হচ্ছে। নইলে বাবার সঙ্গে শপিংমলে সে নিজেও যেত। তুরিন উঠে পড়তেই নীলিমা এগিয়ে এলো কয়েক পা। অনেকটা চাপা স্বরে বলল, ‘কী ভাই? এমন দেবদাস লুক নিয়ে বসে আছ কেন? বিরহ চলছে? বিরহে থাকলে দেখছি লোকে সুন্দর হয়ে যায়। এই তথ্য জানা ছিল না!’ 

জাহিদ বিদ্রুপের হাসি হাসল, ‘বিরহ জিনিসটা কী? ওটা খেতে হয় নাকি মাথায় দিতে হয়?’ 

নীলিমা পিঠময় ছড়ানো চুলগুলো দু হাত দিয়ে খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে দেবরের পাশে এসে বসল। সকৌতুকে বলল, ‘সে তো তুমিই ভালো জানবে! জাহিদ হঠাৎ অন্য গলায় বলল, ‘ভাবি শোন! 

— ‘বলো শুনছি।’ 

জাহিদ আমতা আমতা করল, ‘নিশাকে একবার জিজ্ঞাসা করবে সে আমাদের সঙ্গে জুবিনের বার্থডের শপিং করতে যাবে কি না?’ 

নীলিমার চোখে ফুটে ওঠা বিস্ময় রেখাটা জাহিদকে লজ্জা দিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামিয়ে সে বলল, ‘না মানে…ভাবছিলাম যে…আফটার অল সে জুবিনের মা…’ 

নীলিমা বুদ্ধিমতী নারী। বিস্ময়টুকু চট করে লুকিয়ে ফেলতে পারল। স্বাভাবিকভাবে বলল, ‘হ্যাঁ নিশ্চয়ই…তুমি বসো। আমি ওর সঙ্গে কথা বলে আসি।’ 

নীলিমা চলে যাওয়ার পর কেন যেন ভীষণ অস্থিরতা কাজ করতে লাগল জাহিদের ভেতর। এক মুহূর্তের জন্য সুস্থির হয়ে বসতে পারল না। বড় বড় শ্বাস টেনে আভ্যন্তরীণ উত্তেজনা দমনের চেষ্টা করল। চিন্তাশক্তি অন্যদিকে ধাবিত করতে চাইল। তুরিনের জন্য একজন সাইকিয়াট্রিস্ট ঠিক করতে হবে খুব দ্রুত। বাবার সঙ্গে কথা বলতে হবে অর্ণবের ব্যাপারে। আর এক পাও যেন অগ্রসর না হয়। মেয়ের মতের বিরুদ্ধে কিছুতেই এই বিয়ে হতে দেবে না জাহিদ। আগামী মাসে ক্যালিফোর্নিয়ায় হোটেলের নতুন একটা ব্রাঞ্চ ওপেন হবে। এই ওপেনিং নিয়ে বিস্তর কাজকর্ম পড়ে আছে। প্রাত্যহিক জীবনের আরো অনেক জরুরি কথা, যা নিয়ে চিন্তা করা, দুশ্চিন্তা করা বড়ই আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেই সব টুকরো টুকরো চিন্তাকে মনের মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে বের করে আনতে চাইছিল জাহিদ। কিন্তু লাভ কিছুই হলো না। সমস্ত দুর্ভাবনা, বিক্ষোভ আর অশান্তি দূরে ঠেলে দিয়ে একটা মাত্র নাম ওর মানসপটের দুর্বল মাটিতে অনেক বেশি উর্বর আর প্রকাশ্য হয়ে ভেসে উঠতে লাগল বারেবারে। অন্যমনস্ক, বিক্ষিপ্ত মনের জাহিদ…নিশার কথা…শুধু নিশার কথাই ভেবে গেল অনবরত। নিশা.. নিশা…নিশা! ভারি ছোট্ট, সুন্দর, মিষ্টি একটা নাম! ডাকতে কী ভীষণ ভালো লাগে! বার বার ডাকতে ইচ্ছে করে! 

— ‘তোমার বৌয়ের মাথা ব্যথা। জ্বরও আছে হালকা। কোথাও যাবে না বলল! আমি বলেছিলাম কথাটা যেন সে সরাসরি তোমাকে এসে বলে। কিন্তু সে বলল, তোমার সঙ্গে কথা বলবে না।’ 

নীলিমার কথাটা হিমঘরের মৃত্যুগন্ধি শীতল বাতাসের মতো ছুঁয়ে দিল জাহিদের শরীর। বুকের কোণে জ্বলতে থাকা সবকটা বাতি নিভে গেল একে একে। খারাপ…ভীষণ খারাপ হয়ে গেল মনটা! নিশা কি সত্যিই অসুস্থ? নাকি নেহাত জাহিদের সঙ্গ এড়িয়ে যাওয়ার জন্য অসুস্থ হওয়ার ভান করছে? 

নীলিমা ওর পাণ্ডুবর্ণ মুখটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আনিতা থাকুক। চলো আমিই যাচ্ছি। কথা আছে তোমার সঙ্গে।’ 

সংসার মানে ব্যর্থ বাসনা, বেদনার জলাভূমি
সংসার মানে সংসার ভাঙা, সংসার মানে তুমি 

—নির্মলেন্দু গুণ 

.

বিরক্তি, উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় মেজাজটা একদম খিঁচড়ে যাচ্ছিল ফারার। অনিমেষের অ্যাপার্টমেন্টে এসেছে প্রায় আধাঘণ্টা হয়ে গেল। সেই বান্দা লাপাত্তা। ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে না। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার সময় অনিমেষ হাজির হলো। কাউচে বসে থাকা ফারার ক্রোধান্বিত মুখখানার দিকে চেয়ে একটা ভাবলেশহীন হাসি দিল সে। ফারা খিঁচড়ে যাওয়া মেজাজটাকে কোনভাবেই বশে আনতে পারল না। চিৎকার করে উঠতে যাচ্ছিল। তার আগেই ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল অনিমেষ। অনেকটা জন্তুর মতো। ফারা দমবন্ধ গলায় বলল, ‘সরো অনি…এখন ভালো লাগছে না। সরে যাও প্লিজ।’ অনিমেষ বড্ড জেদি পুরুষ। কারো আদেশ মেনে চলার ধাত নেই। ফারার কথা ওর কানেই ঢুকল না। এই একগুঁয়ে, দুরন্ত, বুনো স্বভাবটাই অল্পবয়সে ফারার মন কেড়েছিল। এমন নির্ভীক, ছন্নছাড়া জীবনযাপন ওকে এক রহস্যময় দুঃসাহসিক অভিযানের আনন্দ দিত। একদিকে অনিমেষের স্পর্ধিত ডানপিটে পৌরুষ, অন্যদিকে জাহিদের শান্ত, আরামদায়ক, পরিচ্ছন্ন আশ্রয় ফারার প্রথম যৌবনের দিনগুলোকে রোমহর্ষক এক রোমাঞ্চকর সুখে কানায় কানায় পূর্ণ করে তুলেছিল। এই দুজন বিপরীতমুখী পুরুষের কাউকেই সে সবটা দিয়ে ভালোবাসতে পারেনি, তবে এরা দুজনেই তার রোজকার আকাঙ্ক্ষা এবং কামনার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে পড়েছিল। অনিমেষকে ছাড়া সুখ হয় না, আবার জাহিদকে ছাড়াও যে মনের ভেতর স্বস্তি আসে না! ওরা যেন একে অন্যের পরিপূরক! 

কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনিমেষের একগুঁয়েমি যেন সীমা ছাড়াচ্ছে। ফারা শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে অনিমেষের লম্বা চওড়া সুঠাম দেহটা নিজের ওপর থেকে সরানোর ব্যর্থ চেষ্টা করল। পারল না। অনিমেষ ফারার শীতলতা টের পেয়ে বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘হোয়াটস রং?’ 

— ‘সরো।’ 

— ‘কেন?’ 

— ‘এখন মুড নাই।’ 

অনিমেষ উঠে বসল। রুষ্ট স্বরে বলল, ‘মুড অফ কেন?’ 

ফারা পরনের জামার খুলে যাওয়া বোতাম লাগাতে লাগাতে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘বাড়িতে কী চলছে তুমি জানো? কোন আইডিয়া আছে আমি কীসের মধ্যে আছি?’ 

অনিমেষ তার লম্বাটে চাঁছাছোলা ধারাল মুখটা আরো বেশি রকম তীক্ষ্ণ করে তুলে বলল, ‘আছ কেন ওই বাড়িতে? আমি তো সেই কবে থেকেই বলছি তুরিনকে নিয়ে আমার এখানে চলে আসো।’ 

ফারার চোখ থেকে আগুন ঠিকরে বের হয়। ক্যাটক্যাট করে বলে, ‘এই কথাটা আজ থেকে বিশ বছর আগে কেন বললে না? কেন আমাকে তোমার বাচ্চা পেটে নিয়ে জাহিদকে বিয়ে করতে হলো? লজ্জা করে না তোমার?’ 

‘আমি তো বিয়ে করতেই চেয়েছিলাম। তোমার বাবা-মা রাজি হয়নি। তা ছাড়া তুমিও তো আমার জন্য বাবা-মাকে ছাড়তে চাওনি।’ 

— ‘তুমি মুসলিম হলেই তো আর ঝামেলা ছিল না।’ 

— আমি ধর্মে বিশ্বাস করি না। শুধু তোমাকে পাবার জন্য নামমাত্র মুসলিম হওয়ার মতো ভণ্ডামি আমার দ্বারা সম্ভব হয়নি। এটাই আমার দোষ? 

ফারা রাগে গজগজ করতে করতে বলল, ‘জাহিদের মতো একটা সহজ সরল ভালো মানুষকে ঠকাতে হয়েছে শুধু তোমার জন্য!’ 

অনিমেষ রুক্ষ ডাকাবুকো হাসি হাসতে হাসতে বলল, ‘আমি যতই খারাপ হই না কেন ফারা, এই আমি ছাড়া তোমার আর কোন গতি নেই এখন। জাহিদ তোমাকে আর কোনদিন নিজের জীবনে ফিরিয়ে নেবে না।’ 

শেষের কথাটা যেন বারুদ ঘষে দিল ফারার বুকে। গর্জে উঠে বলল, ‘ফিরিয়ে নেয়ার কথা আসছে কেন? ওটা আমার বাড়ি…আমার সংসার…! জাহিদ আমার হাজবেন্ড!’ 

— ‘কিন্তু আমি তোমার মেয়ের বাবা। এটা ভুলে যেও না।’ 

— ‘বাবা হিসেবে কোন দায়িত্বটা পালন করেছ তুমি? মেয়ের গ্র্যাজুয়েশনের খরচটাও তো জাহিদকেই বহন করতে হচ্ছে!’ 

— ‘কোন দায়িত্বটা পালন করতে দিয়েছ তুমি শুনি? আমি তো তুরিনের স্টাডি কস্ট বেয়ার করতে চেয়েছি। তুমিই দাওনি!’ 

— ‘তুমি স্টুডেন্ট লোন নেয়ার কথা বলেছিলে।’ 

অনিমেষের গলার স্বর চড়ে যায়, ‘আর দশটা আমেরিকান ছেলেমেয়ে যা করে তাই করতে হবে তোমার মেয়েকেও। এই দেশে উইদাউট লোন হায়ারস্টাডি করা চাট্টিখানি কথা না। আমি জাহিদের মতো বাপের হোটেলে থাকি না। আমার সেভিংসের একটা লিমিট আছে।’ 

ফারা এই পর্যায়ে কিছু না বলে চুপ করে যায়। ক্রোধ জড়িত ফোঁস ফোঁস শ্বাস পড়তে থাকে। অনিমেষ হাজার চেষ্টা করলেও কখনো আদর্শ বাবা হতে পারত না, এই সত্যটা আর কেউ না জানলেও ফারা হাড়েহাড়ে জানে। তার মেয়েটা জাহিদের মতো একজন পরিপূর্ণ বাবা পেয়েছে বলে মনে মনে তৃপ্ত বোধ করেছে সর্বদা। জীবনে ওই একটুখানি শান্তিই তো ছিল ফারার। মেয়েটাকে একটা সম্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্য হিসেবে বড় করতে পারছে। অনিমেষের উচ্ছন্ন, ভ্রষ্টচারী জীবন ওদের মা-মেয়েকে সেই সম্মান এবং নিরাপত্তা কখনোই দিতে পারত না, যা জাহিদের পরিবার দিয়েছে। সেই উচ্ছিষ্ট সম্মান এবং শান্তিটুকু শ্বশুর-শাশুড়ি ছিনিয়ে নিয়েছে নিশাকে ঘরের বৌ করে এনে। এই অসভ্য মেয়েটাকে হাজার চেষ্টা করেও নিজের জীবন থেকে বিতড়িত করা গেল না। কোন পরিকল্পনাই সফল হচ্ছে না। এর মাঝে অনিমেষের ওই বাড়িতে ঘন ঘন যাওয়াটা যে কতটা বিপজ্জনক তা বোঝাবে কী করে ফারা! বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘তোমাকে একটা জরুরি কথা সামনাসামনি বলব বলে এসেছিলাম। খবরদার ওই বাড়িতে আর যাবে না। আমি যেন তোমার এই মুখ ওখানে আর না দেখি।’ 

অনিমেষ কাষ্ঠহাসি হেসে বলল, ফারা শোন, ‘তুমি তো খুব ভালো মতোই জানো আমি যা চাই তা যেকোন মূল্যে নিজের করে নিই। আমি ঠিক করেছি তোমাকে বিয়ে করব। তুমি জাহিদকে ডিভোর্স দিয়ে আমার কাছে চলে এসো। মেয়েটাকেও নিয়ে এসো সঙ্গে করে।’ 

ফারা দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল, ‘আমি তোমাকে বিয়ে করব না! যখন করতে চেয়েছিলাম তখন তুমি আমাকে আর আমার মেয়েকে দূর দূর করে অন্যের সংসারে ঠেলে দিয়েছিলে।’ 

অনিমেষ হঠাৎ খুব তীব্রভাবে প্রশ্ন করল, ‘তুমি আসলে কাকে ভালোবাসো ফারা? আমাকে? নাকি জাহিদকে?’ 

ফারা প্রশ্নটা শুনে একটু স্তম্ভিত হয়ে পড়ল সেকেন্ডের জন্য। পরমুহূর্তেই সামলে নিয়ে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা দিল, ‘আমি শুধু আমার মেয়েকেই ভালোবাসি!’ কথাটা বলে নিয়েই ত্বরিতপদে বেরিয়ে এলো ফ্ল্যাট থেকে। গাড়ি চালাতে চালাতে সারাটা পথজুড়ে সে একটি কথাই শুধু ভাবল…ভাবল এই ভাঙাচোরা জীবনটাকে আবার কীভাবে সাজিয়ে-গুছিয়ে জোড়াতালি দিয়ে একটু চলনসই করে তোলা যায়। ভাবতে ভাবতে অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে একটি চূড়ান্ত উপলব্ধিতে এসে স্থির হলো মন। জাহিদকে ছাড়া তার কিছুতেই চলবে না। অনিমেষ তার জন্য অন্যতম এক দুঃসাহসিক অভিযান হতে পারে কিন্তু জাহিদ হলো জীবন নামক উত্তাল ঝড়ের মধ্যে একটিমাত্র শান্ত নিবিড় আশ্রয়ের নাম। এই আশ্রয় হারানো যাবে না! 

১৫

তুরিনের বেডরুমের দরজাটায় আলতোভাবে হাত রাখতেই খুলে গেল। এই দেশের বেশির ভাগ বাড়ির শোবার ঘরের দরজায় তালা-চাবির ব্যবস্থা থাকে না। ঘরের ভেতর আলো জ্বলছে। বিছানায় পাশ ফিরে শুয়ে আছে তুরিন। ঘুমাচ্ছে খুব সম্ভবত। ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ ভেসে আসছে। হঠাৎ একটা জায়গায় চোখ আটকে গেল আনিতার। তুরিনের চেক চেক পাজামা সেট একটু অবিন্যস্ত হয়ে আছে। সেই অবিন্যস্ত কাপড়ের ফাঁকে ওর ফরসা কোমরের ক্ষুদ্র অংশ দৃশ্যমান হয়ে আছে স্পষ্টভাবে। ওখানে কালো অক্ষরে কিছু একটা লেখা। তুরিন কি ট্যাটু করিয়েছে? কই কখনো কিছু বলেনি তো এ ব্যাপারে! আনিতা পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল বিছানার দিকে। আলতো হাতে কাপড়টা আরো একটুখানি সরিয়ে নিল। চমকিত বক্ষ নিয়ে আবিষ্কার করল ওখানে ইংরেজিতে টানাটানা অক্ষরে লেখা ‘SHAHZID’। 

চমকটা লুকাতে পারল না। হাতের দশটা আঙুল অনায়াসে চেপে বসল নিজের মুখের ওপর। ভেতর থেকে অতর্কিতে বেরিয়ে এলো এক বিস্ময়সূচক সুতীব্র আর্তনাদ। তুরিনের ঘুম গেল ছুটে। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে ঘুমঘুম চোখদুটি ডাগর করে তুলে বলল, ‘কী ব্যাপার?’ 

আনিতা তখনো হাঁ হয়ে আছে। অনেক কষ্টে আমতা আমতা করে সে বলল, ‘তোমার গায়ে শাহজিদের নাম লেখা কেন?’ 

তুরিনের মুখটা মুহূর্তে পাণ্ডুবর্ণ হয়ে উঠল। ভয় এবং অনিশ্চয়তায় কেঁপে উঠল বুক। 

— ‘তুমি কী করে জানলে? 

— ‘আই স ইট উইদ মাই ওন টু আইজ!’ 

তুরিন পরনের জামাটা টেনেটুনে ঠিকঠাক করতে করতে বিব্রত ভাবে বলল, ‘ফরগেট ইট!’ 

— ‘মানে কী? তুরিন ডু ইউ হ্যাভ এনি ফাকিং আইডিয়া হোয়াট ইউ হ্যাভ ডান টু ইয়োরসেলফ?’ 

তুরিন মুখে জোরপূর্বক একটা নির্বিকারত্ব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে, ‘নো বিগ ডিল!’ 

আনিতার চোখ দুটো বিস্ময়ে কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো, ‘রিয়েলি? ইটস নো বিগ ডিল? তোমার দুদিন পর অর্ণবের সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে আর তুমি তোমার গায়ে শাহজিদের নাম খোদাই করে রেখেছ ফরএভার! তুমি জানো ট্যাটু রিমুভ করা কতটা ঝামেলার কাজ?’ 

তুরিন শ্রাগ করে, ‘রিমুভ করব কেন?’ 

— ‘রিমুভ না করলে অর্ণব এটা দেখে কী ভাববে? তুমি কি পাগল হয়ে গেছ?’

— ‘অর্ণবকে আমি বিয়ে করব না।’ 

আনিতা ঝগড়াটে গলায় বলল, ‘তাই? তাহলে কাকে বিয়ে করবে শুনি? শাহজিদকে?’ 

তুরিন মৃদু হেসে বলল, ‘হুম!’ 

আনিতার কণ্ঠে ঝংকার দিল উপহাস, ‘শাহজিদ তোমাকে বিয়ে করবে? সে বলেছে এই কথা? 

তুরিন আনিতার দিকে একটু কেমন অন্যমনস্কভাবে তাকায়। যেন আশাপাশের কিছুই সে দেখছে না। তার দৃষ্টি যেন ঠেকে গেছে বহুদূরের আবছা কোন অলীক জগতে। 

— ‘ইউ নো হোয়াট আনিতা? উই কিসড!’ 

আনিতা ভীষণ অবাক হয়, ‘মানে?’ 

তুরিনের ঠোঁটে মিটমিট করে সুখী সুখী একটা প্রচ্ছন্ন হাসি। তাড়িয়ে তাড়িয়ে বলে, “হি কিসড মি…সাডেনলি…আউট অফ নো হোয়্যার!’ 

— ‘ওয়াও! সিরিয়াসলি?’ 

— ‘হুম…।’ 

আনিতা তুরিনের পাশে বসে পড়ে। কৌতূহল ফেটে পড়ে কণ্ঠ থেকে, ‘সত্যি? তারপর?…তারপর কী হলো?’ 

— ‘দেন আই কিসড হিম ব্যাক!’ 

‘হলি মলি!’ শব্দদুটো উচ্চারণ করে বিস্ময়ে বুঁদ হয়ে থাকে আনিতা কিছুক্ষণ। তারপর হঠাৎ ব্যথিত স্বরে বলে, ‘কিন্তু অর্ণব বেচারাকে তুমি এভাবে ঠকালে। এটা ঠিক হলো না।’ 

— ‘এত দরদ হলে তুমিই ওকে বিয়ে করে ফ্যালো না!’ বাঁকা কণ্ঠে বলে তুরিন। 

আনিতার চোখে ক্রোধ ঝিলিক দেয়, ‘স্ট্রেঞ্জ! আমি কেন বিয়ে করব? সবসময় তোমার রিজেক্ট করা জিনিসগুলো আমার ওপর চাপিয়ে দেওয়ার অভ্যাসটা ছেড়ে দাও তুরিন! ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি তোমার রিজেক্ট করা অথবা ইউজ করা খেলনা আমাকে দেওয়া হচ্ছে। ওহ তুরিনের পছন্দ হয়নি? তাহলে আনিতাকে দিয়ে দাও! অ্যাজ ইফ, আমার নিজস্ব কোন পছন্দ থাকতে পারে না!’ 

‘আমার খেলনা তোমাকে দেওয়া হয়েছে কারণ তুমি আমার ছোট বোন। কষ্ট লাগলে সেসব জিনিস ট্র্যাশ করলেই তো পারতে। এখন শান্ত হও। এত সিরিয়াস হওয়ার কিছু নাই। অর্ণবকে তোমার বিয়ে করতে হবে না। খুশি?’ 

— ‘শাহজিদ জানে তোমার ট্যাটুর ব্যাপারে?’ 

তুরিন হাসে, ‘নাহ…বাসররাতে সারপ্রাইজ দেব। কেমন হবে বলো তো ব্যাপারটা?’ 

‘আই থিংক শাহজিদের সঙ্গে তোমার খোলামেলা কথা বলা দরকার।’ তুরিন একটা শ্বাস ফেলল, ‘কাল সকালেই ওর সঙ্গে কথা বলব ভাবছি।’ 

১৬

আই টোয়েন্টি ফাইভের রাস্তায় উঠতেই চারপাশটা দূর-দূরান্ত অবধি প্রসারিত হয়ে গেল। কোথাও কোন বাড়িঘর নেই। গাছগাছালির ঘন সন্নিবেশ নেই। দুপাশে বিস্তৃত সমতল ভূমি। দূরের দিগন্তজুড়ে জেগে আছে আলো ঝলমলে রাজধানী ডেনভার। হাইওয়ে থেকে দেখা যায় চোখধাঁধানো সেই শহুরে ঝিকিমিকি। মনে হয় যেন আকাশের তারারা সব ভূখণ্ডে অবতরণ করেছে। 

— ‘নিশাকে খুব আপসেট লাগছিল। কোন ঝামেলা হয়েছে নাকি? স্টিয়ারিংয়ে এক হাত রেখে অপর হাত উঁচিয়ে স্টারবাক্সের কফির কাপে চুমুক দিল নীলিমা। 

— ‘তোমাকে কিছু বলেছে ও?’ 

— ‘বিশেষ কিছু বলেনি তবে চেহারা দেখে মনে হলো সারাদিন কান্নাকাটি করেছে।’ 

কথাটা শুনে জাহিদের বুকটা কেন যে এমনভাবে মুচড়ে উঠল! চমক ঠাসা ব্যথিত স্বরে বলল, ‘তাই?’ 

— ‘হুম…সেরকমই তো মনে হলো।’ 

ভারাক্রান্ত যন্ত্রণাবিদ্ধ মনটা নিয়ে জাহিদ আর কোন কথা বলতে পারল না। চুপ করে রইল। 

— ‘তুমি কি কোন সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছ?’ 

‘কী বিষয়ে?’ 

‘ফারা কিংবা নিশা এদের দুজনের মধ্যে একজনকে তো বেছে নিতে হবে!’

জাহিদ দুদিকে মাথা নাড়ে সজোরে, ‘আমি কাউকেই চাই না। আমি চাই শুধু আর মেয়ে দুটো যেন সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠতে পারে।’ 

 — ‘শুধু সন্তানের কথা ভাবলে তো চলবে না ভাই! নিজের কথাও ভাবতে হবে।’

— ‘নিজের কথা আর ভাবি না।’ 

— ‘ভাবো…আমি তোমাকে অনুরোধ করছি অ্যাটলিস্ট ওয়ান্স ইন ইয়োর লাইফটাইম, নিজের কথা ভাবো।’ 

জাহিদ কিছু বলল না। অন্ধকারে জেগে থাকা দূরের ঝিকিমিকি বিস্তৃত শহরের দিকে চেয়ে রইল নির্বাক। 

— ‘তুমি কি নিশাকে ভালোবাসো?’ 

হঠাৎ ছুটে আসা প্রশ্নটা জাহিদের শিরদাঁড়ায় বিদ্যুতের মতো মৃদু ঝংকার তুলে দিয়ে গেল। একটা দীর্ঘশ্বাস টেনে নিল সে। কিঞ্চিৎ ধাতস্থ হয়ে বলল, ‘নিশা আমার চেয়ে বয়সে কত ছোট! ভেবে দেখেছ একবার?’ 

— ‘তাতে কী? বয়সে ছোট মেয়ের সঙ্গে ফিজিক্যালি ইনভলভ হওয়া যাবে কিন্তু মেন্টালি নয় এটা কোন শাস্ত্রে লেখা আছে?’ 

— ‘ফিজিক্যাল ব্যাপারটা আনইনটেনশনাল ছিল। দিস শুডন’ট হ্যাভ হ্যাপেনড।’ 

— ‘যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। পাস্ট নিয়ে চিন্তা করে তো লাভ নেই। ফিউচার নিয়ে ভাবতে হবে।’ 

— ‘আমি চাই না আমার জন্য নিশার লাইফটা নষ্ট হয়ে যাক। ওর সামনে অনেকটা সময় পড়ে আছে। আমি চাই বাকি জীবনটা সে নিজের খেয়ালখুশি মতো কাটাক। আমার মতো মধ্যবয়স্ক লোকের সংসারে পড়ে না থেকে ওর উচিত সমবয়সি কাউকে খুঁজে নেয়া।’ 

নীলিমা ঠাট্টার সুরে বলল, ‘তুমি মধ্যবয়স্ক নাকি? দেখে তো পুরোদস্তুর যুবক মনে হয় এখনো!’ জাহিদ প্রত্যুত্তর করল না। নীলিমা পূর্বের ঠাট্টার সুরটা গলায় ধরে রেখেই বলল, 

— ‘আমার মনে হয় তুমি নিশাকে ভালোবাসো! মুখ ফুটে শুধু বলতে পারছ না!’ 

জাহিদের কানদুটো ঝাঁঝাঁ করে ওঠে। অস্বস্তি চিড়বিড় করে মনে। অপ্রস্তুত গলায় বলে, ‘ভালোবাসা-টাসা…আর হবে না…প্রশ্নই আসে না! তবে হ্যাঁ…আমি ওর ভালো চাই। আমি চাই না আমার ফ্যামিলির জন্য সে বিন্দুমাত্র সাফার করুক।’ 

— ‘খোঁজ নিয়ে দ্যাখো নিশা নির্ঘাত তোমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।’ 

— ‘তুমি কিছুই জানো না ভাবি! ইউ আর সো নাইভ! নিশার মতো একটা মেয়ে আমাকে কেন পছন্দ করবে?’ 

— ‘আমার মনে হয় তোমার ধারণা ভুল।’ 

জাহিদ একটু ম্লান হাসল, ‘সে নিজের মুখে বলেছে।’ 

— ‘কী বলেছে?’ 

জাহিদ দীর্ঘশ্বাস গোপন করল, ‘বলেছে সে আমাকে ঘৃণা করে।’ 

নীলিমা ড্রাইভ করতে করতেই ঘাড় ঘুরিয়ে আশ্চর্য চোখে তাকাল জাহিদের দিকে। বলল না কিছু। চুপ মেরে গেল হঠাৎ। কয়েক মিনিট টানা নীরবতা পালন করার পর গম্ভীরভাবে বলল, 

— ‘এনি ওয়ে। আজকের আলোচনার বটম লাইন হচ্ছে তোমাকে ফারা, নিশার মধ্যে যেকোনো একজনকে বেছে নিতে হবে। দুই-দুইটা বৌ নিয়ে লাইফটা মেস বানানোর কোন মানে হয় না।’ 

জাহিদ নিশ্চুপ। নীলিমা জানে না ফারা এবং নিশা এরা কেউই প্রকৃতভাবে জাহিদের নিজস্ব নারী নয়। ফারার যেমন অনিমেষ আছে, ঠিক তেমনি নিশারও আছে শাহজিদ। কী মর্মান্তিক অথচ হাস্যকর একটা ব্যাপার! নীলিমার মুখনিঃসৃত প্রশ্নটা তবুও ওর মনের সঙ্গে খচখচে বিরক্তিকর আংটার মতো লেগে রইল অনেকক্ষণ ধরে। বিয়ের প্রথম রাত থেকেই নিশাকে ভালো না বাসার যে প্রতিজ্ঞা শিকড়ের মতো মনের জমিনে শক্ত করে গেঁথে নিয়েছিল, সেই শিকড়টা উপড়ে ফেলার আয়োজন কি তবে শুরু হয়ে গেছে? 

ভালোবাসা বলে কিছু নেই এই পৃথিবীতে। পোড় খাওয়া, ভগ্নহৃদয় জাহিদ জীবনে আর কোনদিন হয়তো ভালোবাসার ওপরে সত্যিকারের আস্থা স্থাপন করতে পারবে না, কিন্তু কিছু একটা তো বিশেষত্ব আছে নিশার মধ্যে! নইলে সারাক্ষণ কেন ওকে মনে পড়ে? ভাবতে ভাবতেই ভাবনার গাড়িতে আচমকা ব্রেক কষে জাহিদ। মেয়েটার বয়স কত্ত কম! তুরিনের চেয়ে খুব বেশি হলে পাঁচ কি ছয় বছরের বড় হবে। তার মতো কাপুরুষের কবলে পড়ে অল্পবয়সি এক যুবতী মেয়ের সম্ভাবনাময় জীবন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। 

দায়িত্ববোধ, নৈতিকতা এবং আবেগের বাড়াবাড়ি রকমের বিশৃঙ্খল দৌরাত্ম্যে জাহিদের মস্তিষ্কের শিরা-উপশিরাগুলো ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। নীলিমা ঠিকই বলেছে এবার হয়তো সত্যিই নিজেকে নিয়ে একটু ভাবা উচিত অনেকদিন হয়ে গেল মাঠে নেমে খেলা হয় না, অবসরে খোলা আকাশের নিচে বসে একখানা ভালো বই পড়া হয় না। ভ্যাকেশনেও যাওয়া হয় না! অদ্ভুত এক ভালো না লাগার রোগ হয়েছে তার। কিছুই আর ভালো লাগে না ছাই! 

১৭

জুবিনের গায়ে হালকা একটু লালচে র‍্যাশ দেখা যাচ্ছে। মেয়েটা খাওয়া দাওয়াও করছে না ঠিকমতো। মুর্তজা সাহেব ডাক্তারের সঙ্গে ফোনে কথা বললেন। কোন নির্দিষ্ট খাবার থেকে অ্যালার্জি হয়েছে বলে ধারণা করছেন ডাক্তার। বললেন খাবারের তালিকায় পরিবর্তন আনতে হবে। একটুখানি একটা মানুষ, খায়ই না কিছু বলতে গেলে, তার খাদ্যতালিকায় কী করে পরিবর্তন আনা যায় নিশা তার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝল না। ইংরেজিটা ঠিকঠাক বলতে পারে না বিধায় মেয়ের ডাক্তারের সঙ্গে মা হয়েও সরাসরি কোন ডিসকাশনে যেতে পারে না। এ দেশে থাকতে হলে ইংরেজি বলা শিখতে হবে। নইলে জুবিনকে নিয়ে একা একা টিকে থাকাটা অসম্ভব ব্যাপার হয়ে উঠবে দিনকে দিন। কিন্তু কীভাবে শুরু করবে, কী করে নিজেকে এই সমাজের উপযোগী করে তুলবে তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না সে। খুব অসহায় লাগে। তবে মনে মনে আজকাল একটা জিদ টের পায় নিশা। কে যেন ভেতর থেকে বজ্রকণ্ঠে হুমকি দেয় ক্ষণে ক্ষণে, তোমাকে আত্মনির্ভরশীল হতেই হবে! সেই জিদ থেকেই আজ সন্ধ্যার পর টানা বেশ কিছুক্ষণ অনলাইনে ইংরেজি শেখার বিভিন্ন কোর্সগুলো এক্সপ্লোর করল। ইউটিউবে স্পোকেন ইংলিশের ভিডিওগুলো দেখল। মোবাইল হাতে নিয়েই জুবিনকে ব্রেস্টফিড করাল, ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করল। তারপর এক সময় বাচ্চা ট্যাট্যা করে কেঁদে উঠতেই লক্ষ করল ওই ছোট্ট বাহুদ্বয়ের একটু একটু কুঁচকে থাকা ফরসা চামড়া লালচে ছোপে ভরে গেছে। দেখামাত্র বুকটা কেমন কেঁপে উঠল ভয়ে। মেয়েকে কোলে নিয়ে দ্রুতপদে শ্বশুরের ঘরে এলো সে। মাথাটা ভীষণ ঘুরাচ্ছে। হাঁটুতে ঠকঠকে কাঁপন। এবার কিছু না খেলেই নয়। শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে জুবিনকে রেখে ডাইনিংয়ে এলো। একটা প্লেটে অল্প একটু ভাত আর সবজি নিয়ে কিচেন কাউন্টারের টুলে বসল। এদিকটায় কেউ নেই এখন। নিশা চুপচাপ খাবার খেয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ একটা শব্দ হতেই পেছন ফিরে তাকাল। ফারা এসেছে বাইরে থেকে। ও আসতেই পারফিউমের ঘ্রাণে ভরে গেল চারপাশ। পরনে নীল ব্লাউজ, ব্ল্যাক জিন্স। হাঁটু পর্যন্ত উঠে এসেছে হাই হিল বুট জুতো। পিঠের ওপর সিল্কি চুল ছড়িয়ে, হাইহিল জুতোয় টিকটিক আওয়াজ তুলে, ফারা যখন কোমরে ভারী সুন্দর একটা ছন্দের ঝংকার নিয়ে সামনে দিয়ে হেঁটে যায়, তখন মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। নিশার চোখেও হালকা একটু মুগ্ধতার রেশ পড়ল। ঈর্ষা নামক ঘাতক অনুভূতিকে মনের মাঝে কখনো স্থান দেয়নি সে, কিন্তু আজকে নিজের এই জীর্ণ-শীর্ণ দৈন্য অবয়বের সামনে ফারার জাঁকজমক চোখধাঁধানো উপস্থিতি তার মনের চরাচরকে হীনম্মন্যতার ম্লান অন্ধকারে ডুবিয়ে দিয়ে গেল ক্ষণিকের জন্য। এই বয়সেও ফারা কত সুন্দর! কত আধুনিক! কত স্মার্ট! এমন বৌ ফেলে জাহিদ কেনই বা নিশার মতো সাধারণ, অনাধুনিক, সেকেলে একটা মেয়েকে পছন্দ করবে? ফারা পারফিউমের ঘ্রাণ উড়িয়ে কিচেন কাউন্টার পার হলো। ফ্রিজ থেকে পানির বোতল বের করতে করতে একবার রুক্ষ চোখে দেখল নিশাকে। তারপর কপট স্বগতোক্তির সুরে বেশ স্পষ্টভাবেই বলে উঠল ঝাঁজাল কথাটা, ‘বাড়ির মধ্যে এসব ময়লা- আবর্জনা টাইপ মানুষজন আর কতদিন সহ্য করতে হবে কে জানে! অসহ্য!’ 

কথাটা বলতে বলতে হাতে পানির বোতল নিয়ে হাইহিলে শব্দ তুলে কিচেন থেকে বেরিয়ে গেল। নিশার গলা দিয়ে আর খাবার ঢুকল না। একটা হাহাকার গুমরে উঠল ভেতরে। উঠে পড়ল বসা থেকে। প্লেটের উচ্ছিষ্ট খাবার ট্র্যাশ করল। ঠিক একইভাবে নিজের এই আবর্জনার মতো জীবনটাকেও ডাস্টবিনে ট্র্যাশ করে দেওয়ার এক অবাধ্য অদম্য ইচ্ছা বুনো জন্তুর ধারাল দাঁতের মতো নিশাকে আপাদমস্তক চিবিয়ে চিবিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দিতে লাগল। সদর দরজা খুলেছে কেউ একজন। পায়ের শব্দ এগিয়ে আসছে। নিশা প্লেট ধুয়ে রেখে কিচেন থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। সেই সময় দেখা হলো হঠাৎ! চলতে চলতে থমকে গেল নিশা। থমকে গেল জাহিদও! 

লিভিংয়ের দোরগোড়ায় জাহিদ। নিশা কিচেন কাউন্টারের পাশে। বুকে জ্বলতে থাকা হাহাকারের আগুন নিমেষে ভিজে গেল মন কেমনের এক ফিনফিনে জলের স্রোতে। চশমার আড়ালের নিষ্প্রভ দুটি চোখ নিশার চেরিফুলের মতো গোলাপি গালের ওপর পড়তেই জাহিদের ‘কিছু ভালো না লাগা’ মনের মধ্যে হঠাৎ একটা ভালো লাগার দমকা বাতাস বয়ে গেল। খুলে গেল বদ্ধ জানালার পাল্লা। ফুরফুরে উতলা হাওয়ায় ছেয়ে গেল মন ময়দান। কয়েকটা বিভ্রমের সেকেন্ড কাটল। তৃষ্ণার্ত চারটি চোখ চুম্বকের মতো আটকে রইল। দুই হৃদয়ের মধ্যে এক বাক্যবিহীন অনাবিল শান্তি মাকড়সার জালের মতো ছড়িয়ে পড়তে লাগল ক্রমশ। ফারা সিঁড়ির গোঁড়ায় দাঁড়িয়ে থেকে দৃশ্যটা দেখল। আর দেখামাত্রই দুর্ধর্ষ এক ভয়ের তীব্র আলোড়ন তার অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দিয়ে গেল। জাহিদ এখন…এই মুহূর্তে নিশার দিকে যে সীমাহীন ব্যাকুলতা এবং মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে আছে ঠিক এভাবে, এত ব্যাকুল হয়ে কোনদিন ফারার দিকে তাকায়নি! ভয়ে লাফিয়ে ওঠা হৃৎপিণ্ডটাকে কোন রকমে সামলে নিল সে। হাত-পা জ্বালা করছে। বুকে অদম্য ঈর্ষার আগুন! শেষমেশ নিশার মতো একটা গেঁয়ো ভূতের কাছে হেরে যেতে হবে ফারার মতো প্রগতিশীল নারীকে? হতেই পারে না! 

ফারা দ্রুতপদে এগিয়ে এসে জাহিদের বাদামি ঠোঁটজোড়ায় ঝুপ করে একটা চুমু খেয়ে ফেলল। তারপর আহ্লাদী গলায় বলল, ‘হোয়্যার হ্যাভ ইউ বিন হানি?’ 

একটা প্রবল ধাক্কা এসে লাগল নিশার বুকে। দ্রুত সরে এলো জায়গাটা থেকে। সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠতে লাগল রূদ্ধশ্বাসে। এত দ্রুত উঠতে লাগল যে দেখে মনে হলো বুঝি কোন জংলি ডাকাতদল পেছন থেকে তাড়া করছে। 

লিপস্টিক মাখা একজোড়া আঠালো ঠোঁট নিজের ঠোঁটের ওপর জোরপূর্বক চেপে বসতেই জাহিদ বুঝল ভালোবাসা ছাড়া চুম্বনের মতো রোমান্টিক ব্যাপারটাও যে কী দুর্দান্ত রকমের বিশ্রী হতে পারে! তিতকুটে একটা স্বাদে হাতপা গুলিয়ে উঠল। ফারার কাঁধ ধরে একটু দূরে ঠেলে দিয়ে অস্ফুটে বলল, 

‘সরো!’ 

ফারার চোখ ঝলসে উঠল হিংস্র দীপ্তিতে, ‘এত রুড কেন তুমি?’ 

জাহিদ উত্তর না দিয়ে হেঁটে গেল সামনে। নিশাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। আশ্চর্য! এমন ঝড়ের বেগে উধাও হলো কী করে মেয়েটা! পেছন থেকে ফারার কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, ‘বিয়ে করেছিলে কেন তুমি আমাকে? এভাবে আমার জীবনটা নষ্ট করে দেওয়ার কোন অধিকার নেই তোমার!’ 

জাহিদ ঘুরে তাকাল। বিস্ময় এবং ঘৃণার দ্বৈত রং খেলে গেল ওর মুখে, আলো-ছায়ার মতো। কেটে কেটে বলল, ‘আমি নষ্ট করেছি তোমার জীবন? হাস্যকর কথা বলো না ফারা। তোমার লাইফ তুমি নিজে নষ্ট করেছ অনিমেষকে আমাদের মাঝে টেনে এনে।’ ফারা আচমকা এক বাহ্যজ্ঞানহীন চিৎকারে ফেটে পড়ে, 

— ‘তোমার বাবা-মা বাংলাদেশের বস্তি থেকে মেয়ে তুলে এনে তোমার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেবে আর আমি চুপচাপ বসে থাকব?’ 

জাহিদ কয়েক পা এগিয়ে এসে ফারার মুখোমুখি দাঁড়াল, ‘তোমাকে তো বলেছিলাম আমি নিশাকে ছেড়ে দেব। একটা বছরও অপেক্ষা করতে পারলে না?’ 

ফারা দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘ছেড়ে দেওয়ার নাম করে কী করেছ তুমি? ইউ সেপ্ট উইদ দ্যাট বিচ অ্যান্ড গট হার প্রেগন্যান্ট!’ 

—‘তুমি ভুলে যাচ্ছ এই ঘটনা ঘটেছে তোমাকে আর অনিমেষকে আবিষ্কারের পর।’ 

— ‘তুমিই ঠেলে দিয়েছ আমাকে অন্যদিকে। কেন তোমার বাবা-মা ওই মেয়েটাকে নিয়ে এলো এখানে? কেন বিয়ে দিল তোমার সঙ্গে? আমি যদি কেস করি তোমার চোদ্দগুষ্টির মান-সম্মান ধুলোয় মিশে যাবে তুমি জানো?’ 

জাহিদ একটু বাঁকা হাসল। রুষ্ট স্বরে বলল, ‘আচ্ছা একটা কথা বলো তো? তুমি কেস করোনি কেন? করলেই তো পারতে!’ 

ফারা একটু থতমত খেয়ে গেল এই প্রশ্নে। কেস করার কথা সে ভাবেনি তা নয়। কিন্তু তার বজ্জাত শ্বশুরটা আগেভাগেই বলে দিয়েছিল কোন আইনি ব্যবস্থা নিতে চাইলে তুরিনের জন্মপরিচয় জাহিদের কাছে ফাঁস করে দেবে। এ কারণেই সমস্ত অত্যাচার দাঁতে দাঁত চেপে দিনের পর দিন সহ্য করতে হয়েছে। মিথ্যে বলতে ফারার কখনো কষ্ট হয় না। চট করে বানোয়াট যুক্তি খাঁড়া করায় তার জুড়ি মেলা ভার। দ্বিধাহীন স্পষ্ট গলায় বলল, ‘আমার মেয়েটার দিকে চেয়েই কোন স্টেপ নেইনি। তা ছাড়া আমার শ্বশুর-শাশুড়িকে আমি ভক্তি করি। বুড়ো বয়সে মানুষদুটোর জীবনে একটা হ্যাসেল হোক এটা আমি চাইনি।’ 

জাহিদ তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় ফারার দিকে। ছিপছিপে, ফরসা, চাপা চোয়ালের মুখখানায় কী যেন খুঁটেখুঁটে পরখ করে। কাজলপরা ছোট ছোট দুটি চোখের ওপর স্থির দৃষ্টি রেখে অবিচল গলায় বলে, ‘একটা বিষয় কি জানো? ইদানীং তোমার সবকিছুই আমার কেমন যেন ভেগ লাগে। মনে হয় তোমার মধ্যে এমন কিছু একটা আছে যা আমি এত বছরেও দেখতে পাইনি, বুঝতে পারিনি…মাঝেমধ্যে মনে হয় এই ভেগনেস আর কোনদিন কাটবে না।’ 

ফারার মেরুদণ্ডে ভয়ের একটা লু হাওয়া বয়ে যায়। অনির্ণেয় শঙ্কায় বুক কাঁপে। তবুও মনের দুর্বলতা মুখে প্রকাশ করে না সে। বাইরের খোলসটা শক্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে কঠোর গলায় বলে, ‘আমাকে তো এখন ভেগ মনেই হবে তোমার। খারাপ মনে হবে। বিশ্রী মনে হবে। এসব মনে হওয়ার কারণ হলো তুমি এখন ওই বস্তির মেয়েটার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছ। ছিঃ এত বাজে টেস্ট তোমার! নিশা? রিয়্যালি? শিক্ষাদীক্ষা নাই, ম্যানার্স নাই…অশিক্ষিত একটা জাংক গারবেজ…’ 

— ‘ফারা!’ হঠাৎ ছুটে আসা গর্জনটা চমকে দেয় ফারাকে। ঘুরে তাকিয়ে দেখে জাহিদের চোয়ালজোড়া ইস্পাতের মতো শক্ত হয়ে উঠেছে। গমগমে গলায় বলছে, 

— ‘একটা মানুষ ফ্লুয়েন্টলি ইংরেজি বলতে না পারলেই অশিক্ষিত হয়ে যায় না। স্পেসিফিক কোন ভাষার দক্ষতা কারো শিক্ষার মানদণ্ড হতে পারে না। সত্যিকারের শিক্ষাটা মানুষের আচার-আচরণেই প্রকাশ পায়। আজ পর্যন্ত নিশাকে আমি তোমার বিরুদ্ধে কিছু মুখ ফুটে বলতে দেখিনি। অথচ তুমি…ইট মাইট সাউন্ড হার্শ, বাট দ্য ট্রুথ ইজ তোমার কথা শুনলে তোমাকে আমার ইদানীং মোটেও শিক্ষিত, রুচিশীল বলে মনে হয় না।’ 

ফারার মনে ঈর্ষার সর্বগ্রাসী আগুনটা ভস করে জ্বলে ওঠে নতুন উদ্যমে। ফুঁসতে ফুঁসতে বলে, ‘যত কিছুই তুমি বলো না কেন, শি ডাজন’ট বিলং টু আওয়ার সোসাইটি। এতই যদি সে প্রেশাস জেম হয়ে থাকে তাহলে জুবিনের মা হিসেবে পুরো ফ্যামিলির সামনে তাকে প্রেজেন্ট করো না কেন তোমরা? তোমার বাবা-মা তো তাদের অপকর্ম খুব চমৎকারভাবে আড়াল করে যাচ্ছেন। আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব সবাই আমাকেই জুবিনের মা হিসেবে চেনে। 

— ‘আত্মীয়স্বজন কারো সঙ্গেই আমার তেমন ঘনিষ্ট সম্পর্ক নেই। বন্ধুদের মধ্যে অনিমেষ খুব কাছের ছিল। সে সবটাই জানে। অন্য বন্ধুদের বলতে তুমিই নিষেধ করেছিলে। তুমি বলেছিলে এতে আমাদের ভালোবাসার অপমান হবে। আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব কে কী ভাবল, তাতে কী এসে যায়? আই ডোন্ট গিভ আ ড্যাম টু দেম।’

ফারা মস্তিষ্কের শিরা উপশিরায় বিদ্বেষপূর্ণ ক্রোধের তীব্র হুংকার টের পাচ্ছিল। বড় বড় শ্বাস টেনে নিয়ে রাগটা দমন করার চেষ্টা করল সে। এখন কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণ হারানো যাবে না। জাহিদকে মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে রাখতে হবে। সুন্দরী নারীর মুখের মিষ্টি কথার চেয়ে বড় অস্ত্র দুনিয়ায় আর দ্বিতীয়টি নেই। সেই অস্ত্রই কাজে লাগাতে হবে। 

এগিয়ে এসে দু হাত বাড়িয়ে শিকলের মতো জাহিদের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আচ্ছা শোন, যা হওয়ার হয়ে গেছে। চলো আমরা আবার সবকিছু নতুন করে শুরু করি। তুমি তো জানো আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি। তোমার জন্য জুবিনকেও আমার আপন করে নিতে কোন আপত্তি নেই। চলো আমরা এই বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাই। শুধু তুমি, আমি আর আমাদের দুই মেয়ে। অন্য কেউ না!’ 

জাহিদ ফারার লতানো দুটি হাত নিজের গলা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে খুব কঠিনভাবে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই একটা অনাহুত ছায়া উপস্থিত হলো দুজনের মাঝখানে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে আসছে তুরিন। কাছাকাছি এসেই বাবা-মা দুজনকে আনন্দে জাপটে ধরল সে। খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলল, ‘সো হ্যাপি টু সি ইউ বোথ টুগেদার। ইট ব্রিংস প্লেজার টু মাই আইজ!’ 

জাহিদ মেয়ের খুশিতে মাখামাখি পবিত্র মুখখানার দিকে চেয়ে কিছু বলতে পারল না। একটা কষ্ট বিজড়িত আক্ষেপের নিঃশ্বাস পড়ল ওর বুক চিরে। ফারা চঞ্চল গলায় বলল, ‘তুরিন শোন…আমরা যদি তোমার ক্যাম্পাসের কাছাকাছি একটা বাসা নেই তাহলে কেমন হবে?’ 

তুরিন বিভ্রম নিয়ে বলল, ‘এটা কেন বলছ?’ 

ফারা রসিয়ে রসিয়ে বলল, ‘আমি আর তোমার বাবা ডিসাইড করেছি খুব শিগগিরই অন্য কোথাও মুভ করব। শুধু আমাদের ফ্যামিলি। তুমি আমি তোমার বাবা…’ 

তুরিনের ছেলেমানুষি চোখে উপচে পড়ে নিষ্কলুষ হর্ষ। আনন্দে আটখানা হয়ে বলে, ‘রিয়্যালি?’ জাহিদ চশমার ফাঁক দিয়ে আড়চোখে মেয়েকে দেখে। মেয়ের আনন্দে বিঘ্ন ঘটাতে কষ্ট হয় তার। অগত্যা চুপ করে দাঁতে দাঁত চেপে ফারার ধৃষ্টতা সহ্য করে। 

ফারা মেয়ের মাথায় একটা হাত রাখে। সিল্কি সিল্কি রেশমি চুলের গাছি কপাল থেকে সরিয়ে নিয়ে খুব নরম ভাবে বলে, ‘বাট ওয়ান থিংগ হানি…জুবিন কিন্তু তোমার সিস্টার। শি ইজ ফ্যামিলি। সো ওকেও আমাদের সঙ্গে রাখতে হবে। এতে তোমার মন খারাপ করা চলবে না।’ 

তুরিন ফকফকে হাসি হাসে, ‘তাতে কোন সমস্যা নেই…ওয়াও…আমার খুব ভালো লাগছে কথাটা শুনে। কবে যাব আমরা?’ কথাটা বলতে বলতে সে বাবার হাতের ওপর হাত রাখে, ব্যাকুল হয়ে বলে, ‘বলো না বাবা! কবে যাব?’ 

জাহিদ স্তব্ধ চোখে চেয়ে রইল মেয়ের দিকে। একটা দমবন্ধ যন্ত্রণা বুকের ভেতর থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে নিঃশ্বাসের সঙ্গে উঠে আসছে। সেই যন্ত্ৰণা পাশ কাটিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করল। আস্তে করে বলল, ‘এই বিষয়ে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব পরে। কেমন?’ 

.

নিশা সাধারণত আটটার মধ্যেই ব্রেকফাস্ট নিয়ে আসে। সাড়ে আটটার মধ্যে নাশতা সেরে একটু হাঁটতে বের হয় ওরা। বিগত কয়েকদিন ধরে নিশা লাপাত্তা। ফ্রিজে ডিম-রুটি সবই আছে কিন্তু কেন যেন খেতে ইচ্ছে করছে না। ব্রেকফাস্ট স্কিপ করেই ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল শাহজিদ। ব্যাকইয়ার্ডের সামনে ঝোপ-জঙ্গল, তারপর পাথরে ছাওয়া ক্রিক। হুইলচেয়ার নিয়ে ওদিকে যাওয়া খুব কষ্টকর। শাহজিদ তাই ব্যাকইয়ার্ড পার হয়ে সামনের রাস্তায় চলে আসে এক টানে। ভোরের ধোঁয়াশা কেটে সবেমাত্র দুনিয়া কাঁপানো রোদটা চড়ে বসেছে ক্র্যাব অ্যাপল আর পাইন গাছের ডালে ডালে। বাড়ির সামনের রাস্তাটা ভরে আছে লাল, সাদা ফুলের পাপড়িতে। ক্র্যাবঅ্যাপলের ফুলগুলো পুরোপুরি লাল নয়। কিছুটা ম্যাজেন্টা ছাপ আছে। প্রথমে কিছুদিন সাদা থাকে, তারপর ধীরে ধীরে ম্যাজেন্টা হয়। এখন ওদের ম্যাজেন্টা রঙের ঝাঁকড়া মাথায় সকালের তাজা রোদের চকচকে প্রলেপ পড়েছে। বাতাসে দুলছে খুব। আজকে স্নোফল হওয়ার কথা। তুষারের রাজ্যে বসন্ত বড়ই ক্ষণস্থায়ী, ক্ষীণজীবী! তাই তো বাড়ির সামনের এই একটুকরো বসন্তকে এই মুহূর্তে শাহজিদের মনে হচ্ছিল স্বর্গ থেকে উড়ে আসা কোন মূল্যবান উপহার। রাস্তার ওপারের লালচে রকিমাউন্টেনের মাথায় নেমে এসেছে নির্জলা নীল আকাশ। রোদধোয়া ওই আকাশের দিকে তাকালেই মনটা ভালো হয়ে যায়। যদিও রোদচশমা ছাড়া ওই দুর্দান্ত সূর্যর দিকে সরাসরি তাকানো যায় না। তাকালে মাথা ব্যথা হয়। নেই বারহুডের ঘাসগুলো এখন গাঢ় সবুজ। কলোরাডোর বেশির ভাগ সমতল ভূমি স্বল্প বৃষ্টিপাতের কারণে সারা বছর রুক্ষ পিঙ্গল ঘাসে ছেয়ে থাকে। পাণ্ডুর বর্ণ মাঠ প্রান্তর বসন্ত আর গ্রীষ্মের অল্পকটা দিন একটু প্রাণ পায়। সেই ক্ষীণ প্রাণটুকু জিইয়ে রাখার জন্য বসতভূমিতে কৃত্রিম জলসেচনের ব্যবস্থা করা হয়। শাহজিদ বাড়ির সামনের লন পেরিয়ে ওয়াকওয়েতে উঠে এসেছিল। ঠিক তখনই গাঢ় সবুজ ঘাসের কার্পেটের ওপর ওয়াটার স্প্রিংকেলের ফোয়ারা চালু হয়ে গেল। একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর এই ইরিগেশন সিস্টেম কার্যকর হয়। চলে দুই-তিন মিনিট। জলের ফোয়ারা চতুর্দিকে তারার মতো ছড়িয়ে গেল মুহূর্তের মাঝে। গায়ে ছিটা এসে পড়তেই শাহজিদ হুইলচেয়ার নিয়ে একটু দূরে সরে গেল। তারপর ওই সকালবেলার হলুদমাখা কুড়মুড়ে রোদের মাঝে, ঝরনার রুপালি জলের ফুলঝুরির ওপর চোখ দিয়ে দেখল কালো রঙের একটা জ্যাকেট গায়ে দিয়ে ছোট ছোট পা ফেলে হেঁটে আসছে তুরিন। উতলা বাতাসে উড়ছে ওর সিল্কের মতো নরম চুল। ছোট ছোট চোখদুটো রোদ এসে লাগায় আরো বেশি রকম ছোট দেখাচ্ছে। অনেকটা সদ্য ঘুম থেকে ওঠা আদুরে বেড়ালের মতো। 

— ‘হেই শাহজিদ! হোয়াসসাপ?’ 

— ‘তোমার পায়ের কী অবস্থা?’ প্রশ্নের ওপর প্রশ্ন করে শাহজিদ। তুরিন ফোয়ারার রুপালি জল পেরিয়ে, সবুজ ঘাস মাড়িয়ে রাস্তার ধারের ওয়াকওয়েতে দাঁড়িয়ে থাকা শাহজিদের হুইলচেয়ারের সামনে এসে থামল। হাসিমুখে বলল, ‘খুব বেশি ভালো না। তবে হাঁটতে পারছি। তোমার সঙ্গে একটু কথা ছিল। সময় হবে?’ 

শাহজিদ ডান গালে জিব ঠেকিয়ে কী যেন চিন্তা করল মগ্নভাবে। মগ্ন গলায় বলল, ‘কী কথা?’ 

তুরিনকে একটু নার্ভাস দেখাচ্ছিল। জ্যাকেটের পকেটে লুকিয়ে রাখা হাত দুটো বের করে এনে উড়তে থাকা মাথার চুল ঠিক করল সে। ওদের পাশঘেঁষে একজন ব্রুনেট তরুণী বাদামি চামড়ার ফ্রেঞ্চ বুলডগ নিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। শাহজিদ আর তুরিনের দিকে চেয়ে হাত নাড়ল তরুণী। বুলডগ মাথা উঁচিয়ে শাহজিদকে দেখল। তারপর হুইলচেয়ারের চাকার কাছে এসে মুখ ঘষতে লাগল। শাহজিদ ওর পিঠে হাত রাখল। ব্রুনেট মেয়েটা হাতে ধরা দড়িতে হালকা টান দিয়ে ভারি মিষ্টি গলায় কুকুরটাকে বলল, ‘কামঅন সুইটি…..উই আর গেটিং লেইট!’ 

শাহজিদ কুকুরের মাথায় আর গলায় হাত বুলিয়ে অনেক আদর করল। হাসিমুখে বলল, ‘হি ইজ এডরেবল, হোয়াটস হিজ নেইম?’ 

— ‘ইটস অ্যা গার্ল। হার নেইম ইজ রুখি!’ 

— ‘নাইস নেইম!…হেই রুখি… হাও আর ইউ ডুইং?’ 

তুরিনের বিরক্তির মাত্রা চরমে উঠতে সময় লাগল না। কুকুর সে ভালোবাসে। কিন্তু এখন এই রুথি এবং রুথির মনিবকে একটা ফোঁটাও সহ্য হচ্ছে না। হঠাৎ চোখ পড়ল, অনতি দূরে একটা বিশাল আকৃতির কটনউড গাছের গায়ে ঠেস দিয়ে অর্ণব দাঁড়িয়ে আছে। হাতে সেলফোন। কানে গুঁজে রেখেছে এয়ারপড। সম্ভবত কথা বলছে কারো সঙ্গে। তুরিন একটু বিরক্তি নিয়ে শাহজিদকে বলল, ‘তোমাকে বললাম আমার জরুরি কথা আছে। এখনই কেন এদের সঙ্গে গল্প করতে হবে?’ 

তরুণী মেয়েটি বাংলা না বুঝলেও তুরিনের ভাব ভঙ্গি দেখে টের পেল তার উপস্থিতি তুরিন খুব একটা উপভোগ করছে না। সে দ্রুত কুকুরটিকে নিয়ে সরে পড়ল। শাহজিদ বলল, ‘কী বলতে চাও?’ 

তুরিন সরাসরি শাহজিদের দিকে তাকাতে পারল না। মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, ‘তুমি বাবার সঙ্গে কথা বল।’ 

শাহজিদের কপালে কুঞ্চন পড়ল, ‘মানে? কী কথা বলব?’ 

তুরিন মুখ নিচু করে নিজের হাতের নখ দেখতে দেখতে সলজ্জ কণ্ঠে বলল, ‘আমাদের বিয়ের ব্যাপারে।’ 

চূড়ান্ত এক চমকসমৃদ্ধ বিস্ময়ে শাহজিদের মুখটা স্থবির হয়ে গেল। নির্বাক চেয়ে রইল শুধু। কিছু বলতে পারল না। তুরিন আড়চোখে তাকাল ওর দিকে। ভয় ভাসা, বিচলিত, কুণ্ঠিত স্বরে বাধোবাধোভাবে বলল, ‘ইউ হার্ড মি?’ 

শাহজিদ থম ধরা গলায় বলল, ‘আই হার্ড ইউ। জাস্ট প্রসেসিং… বিয়ে মানে…কার বিয়ে?’ 

তুরিন দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে একটা বড় নিঃশ্বাস আড়াল করল। স্খলিত কণ্ঠে বলল, ‘তোমার আর আমার…আমাদের…’ 

একটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাব ভীষণ প্রকটভাবে দৃশ্যমান হয়ে উঠল শাহজিদের হ্যাজেল রঙের চোখের তারায়। অপ্রস্তুতভাবে চোখ সরিয়ে নিল সে। মনের মধ্যে একটা ত্রাস উঠল এই ভেবে যে এই মেয়েটি বোধহয় অন্তর্যামী। শাহজিদের ভাবন-ঘরে বুঝি আড়ি পেতে আছে। ভাবনারও আর কোন স্বাধীনতা রইল না। হাতের আঙুল দিয়ে সুইচ চেপে হুইলচেয়ারের চাকাটা নিমেষে ঘুরিয়ে দিল সে। এগিয়ে যেতে লাগল সাঁই সাঁই করে। তুরিন ওর পাশাপাশি দৌড়তে লাগল। 

— ‘কী হলো? কিছু বললে না?’ 

— ‘তুমি পাগল। পাগলের সঙ্গে কী কথা বলব?’ 

—‘কেন? আমাকে বিয়ে করতে তোমার সমস্যা আছে?’ কথাটা বলতে বলতে তুরিন হুইলচেয়ারের সামনে এসে পথ রোধ করে দাঁড়াল। 

চেয়ারের হাতলের ওপর দুটি হাত রেখে একটু ঝুঁকে এলো শাহজিদের দিকে। শাহজিদ নিজের মাথাটা হেলিয়ে দিল পেছনে। অস্বস্তি নিয়ে বলল, ‘কী চাই?’ 

— ‘তুমি আমার বাবাকে ভয় পাও?’ 

শাহজিদের কণ্ঠে আরো বেশি রকমের অস্বস্তি চারিয়ে উঠল যেন, ‘এই কথাটা বলার জন্য তোমাকে এত কাছে আসতে হবে কেন? দূর থেকেও তো বলা যায়।’ 

প্রশ্নটা শুনে তুরিনের কেন যেন হাসি পেয়ে গেল। ঠোঁটে মুচকি একটা হাসির রেশ ভাসিয়ে আহ্লাদী গলায় বলল, ‘অ…লুক অ্যাট ইউ। ইউ আর ব্লাশিং!’ 

তুরিনের মুখখানায় থইথই করছে সোনালি রোদ। রকিমাউন্টেনের বুক থেকে উড়ে আসা, পাথুরে ঘ্রাণ মেশানো বাতাস হুহু করে উড়িয়ে দিচ্ছে ওর খোলা চুল। ক্র্যাব অ্যাপল ফুলের কয়েকটা ম্যাজেন্টা রঙের পাপড়ি আর কটনউড গাছের গুঁড়ি ফেটে বেরিয়ে আসা সাদা তুলোর আঁশ মৌমাছির মতো প্রদক্ষিণ করছে ওকে। ওর উষ্ণ নিঃশ্বাসের স্নিগ্ধ ছোঁয়া শাহজিদের শীতল অন্তঃকরণের ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা আবেগ, অভীপ্সা এবং প্রবৃত্তির অনুভূতিকে যেন খোঁচা দিয়ে জাগিয়ে তুলতে চাইছে। সে একটু অসহায়ভাবে বলল, ‘তুরিন প্লিজ! ব্যাক অফ!’ 

শাহজিদের ঈষৎ লালচে এলোমেলো চুল হাত দিয়ে সুবিন্যস্ত করে দিতে দিতে তুরিন মৃদু গলায় বলল, ‘আগে বলো তুমি বাবার সঙ্গে কথা বলবে।’ 

—‘এটা সম্ভব না!’ 

তুরিনের চোখে রাগের ঝাঁঝ এসে লাগে। রাগী গলায় বলে, ‘তুমি আমাকে চাও না?’ 

— ‘না চাই না।’ 

— ‘তাহলে সেদিন অমন অসভ্যতা করলে কেন?’ 

শাহজিদ তুরিনের রোেদ ভাসা ছোট চোখ, ছোট নাক, লম্বাটে মুখ আর গোলাপি ঠোঁটের দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টে চেয়ে রইল। তারপর ওর খরগোশের বাচ্চার মতো নরম গালদুটো টেনে দিয়ে নির্বিকার গলায় বলল, ‘তুমি এত সুন্দর কেন? তোমাকে দেখলেই আমার অসভ্যতা করতে ইচ্ছে করে। কী করব বলো? ক্যান্ট হেল্প!’ তুরিনের চোখেমুখে রক্তের আভাস পড়ল। শাহজিদের মাত্র বলা কথাটা আর হাতের স্পর্শ ওর মনের আনাচ-কানাচ ভীষণ রকম এক ভালো লাগার স্রোতে প্লাবিত করে তুলল। শাহজিদ বলল, ‘সরে দাঁড়াও তুরিন, অসভ্য লোকদের কাছে আসতে নেই।’

তুরিন সোজা হয়ে দাঁড়াল। বাষ্প-রুদ্ধ স্বরে বলল, ‘কেন এমন করছ? প্লিজ ডোন্ট প্রিটেন্ড।’ 

শাহজিদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। গম্ভীর শোনাল ওর কণ্ঠস্বর, ‘তুমি কী করে এটা ভাবলে যে তোমার বাবা তার মেয়েকে একজন ডিজেবল মানুষের সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজি হবে? আমার কোন যোগ্যতাই নেই তার কাছ থেকে তোমাকে চেয়ে নেবার।’ 

তুরিনের বুকটা মুচড়ে উঠল কষ্টে। 

— ‘এভাবে বলো না। তুমি ডিজেবল এ কথা কে বলল? ইউ আর গুডলুকিং, ইন্টেলিজেন্ট অ্যান্ড ইউ অলসো হ্যাভ অ্যা সাকসেসফুল ক্যারিয়ার!’ একটু থেমে তুরিন আবার বলল, ‘তুমি প্রস্থেটিক লেগ ইউজ কর না কেন? 

— ‘প্রস্থেটিক লেগ সম্পর্কে তোমার কোন আইডিয়া নেই বলেই কথাটা বলতে পারলে। কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার আগে একটু পড়াশোনা করে এসো তুরিন।’ 

— ‘আচ্ছা লাগবে না ওসব…তুমি যেমন আছ এমনটাই থাকো। ইউ আর মোর দ্যান পারফেক্ট শাহজিদ! জাস্ট স্টপ বিইং সো স্টাবৰ্ন। 

শাহজিদ এক বুকভর্তি গহন বিষণ্নতা নিয়ে বলল, ‘ইউ নো হোয়াট? তোমরা যারা সুস্থভাবে বেঁচে আছ, হেঁটে চলে বেড়াচ্ছ, তারা কখনো বুঝবে না একটা হুইলচেয়ারে আজীবন বন্দি হয়ে থাকার যন্ত্রণাটা ঠিক কীরকম! ওই যে দ্যাখো, অর্ণব হেঁটে আসছে এদিকে। তুমি চাইলেই ওর পাশে হাতে হাত রেখে হাঁটতে পারবে। পাহাড় বাইতে পারবে। ড্যান্স করতে পারবে…অর্ণব হয়তো একদিন বারো হাজার ফিট উঁচু পাহাড়ের চূড়োতে গিয়ে তোমাকে প্রপোজ করবে। যেটা তোমার স্বপ্ন ছিল। কিন্তু আমি…আমি এসব কিছুই কোনদিন তোমাকে দিতে পারব না।’ 

তুরিন ঠোঁট চেপে কান্নার একটা ঢোক গিলল। জল-ঝাপসা চোখে শাহজিদের বিষণ্ণ অবিচল মুখের দিকে চেয়ে বলল, ‘আমার ওসব কিছুই চাই না…।’ 

— ‘ইউ আর নট ম্যাচিওর এনাফ তুরিন…এখনো ছেলেমানুষ রয়ে গেছ।’ 

— ‘আমি ছেলেমানুষ নই। নিজের জীবন সম্পর্কে ডিসিশন নেয়ার মতো যথেষ্ট ম্যাচিওরিটি আমার আছে।’ 

— ‘ম্যাচিওরিটি থাকলে এসব আবোল তাবোল কথা বলতে পারতে না।’ 

— ‘আমি অন্য কাউকে বিয়ে করলে তোমার খারাপ লাগবে না?’ 

শাহজিদ কঠিনভাবে বলল, ‘আমার মধ্যে এসব আবেগ-অনুভূতি নেই তুরিন! প্লিজ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড। আই হ্যাভ উন্ডস দ্যাট নেভার হিলড! আই অ্যাম নট অ্যা নরমাল পারসন। বেসিক হিউম্যান ইমোশনস আর নট মাই স্ট্রং স্যুট।’ 

অর্ণব কাছাকাছি এগিয়ে এসেছে। ওদের দেখে হাত নাড়ল। এক গাল হেসে বলল, ‘গুডমর্নিং!’ 

তুরিন অর্ণবের দিকে তাকাল না। কষ্টের একটা তীক্ষ্ণ ফলা ওর পেঁজাতুলোর মতো সহজ-সরল নরম মনটাকে কেটে-ছিঁড়ে রক্তাক্ত করে তুলছে ক্রমেই। চোখে উপচে পড়ছে লোনা জলের সমুদ্র। সে আর দাঁড়াল না। চট করে ঘুরে দাঁড়িয়ে ছুটে গেল বাড়ির দিকে। শাহজিদ অর্ণবের দিকে চেয়ে একটু অপ্রস্তুত হেসে বলল, ‘গুডমর্নিং অর্ণব ভাই! কী খবর?’ 

অর্ণব টানাটানা কালো দুটি চোখে গভীর হতাশা ফুটিয়ে তুলে বলল, ‘কোন খবর নাই ভাই। চাকরি-বাকরি তো হচ্ছে না। গতকাল একটা অনলাইন ইন্টারভিউ দিলাম। ভালো হয় নাই। মনে হচ্ছে হবে না।’ 

শাহজিদ হালকা হেসে বলল, ‘একটু ধৈর্য ধরুন। হয়ে যাবে। এত তাড়া কীসের?’ 

হঠাৎ তুরিনকে দেখা গেল আবার। রোদচড়া বাতাস আর সোনাবরণ আলো কেটে কেটে দুরন্ত হরিণীর মতো ধাবিত হচ্ছে ওর ছিপছিপে লম্বা শরীরটা। এক দৌড়ে অর্ণবের মুখোমুখি এসে থামল সে। শ্বাস ফেলতে লাগল বড় বড়। অর্ণব বেশ ভড়কে গেছে। বিচলিত, বিস্ফারিত, নার্ভাস চোখে চেয়ে আছে তুরিনের দিকে। এদিকে শাহজিদ ভুলে গেছে শ্বাস নিতে। গভীর এক গা ছমছমে স্তব্ধতা ভর করেছে ওর মুখে। 

কয়েকটা থমকানো সেকেন্ড নির্বিঘ্নে কেটে যাওয়ার পর তুরিন আচমকা অর্ণবের হাত চেপে ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে এলো ম্যাজেন্টা রঙের ফুলে ছাওয়া ঝাঁকড়া মাথার ক্র্যাব অ্যাপল ট্রির নিচে। শাহজিদ চেয়ে আছে। দু চোখে বিস্ফোরণের আভাস, ফরসা চামড়ার ভাঁজে ভাঁজে প্রচ্ছন্ন ভয় এবং অনিশ্চয়তার আঁকিবুকি। সে দেখতে পাচ্ছে কয়েক হাত দূরে গাছের নিচে বাদামি লেদারের জ্যাকেট পরা অর্ণব দাঁড়িয়ে আছে। ওর মুখোমুখি তুরিন। তুরিনকে দেখা যাচ্ছে না। অর্ণবের লম্বা চওড়া শরীরের আড়ালে ঢেকে গেছে ওর ছিপছিপে দেহ। কী হচ্ছে ওখানটায় সেই কৌতূহলে শাহিজদের চামড়ার প্রতিটি রোমকূপ কাঁটা দিয়ে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। মিনিট দুয়েক সময় পার হলো। কৌতূহল বিদ্ধ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত শাহজিদ, অর্ণবকে ফিরে আসতে দেখল। তুরিন যেভাবে দৌড়ে এসেছিল ঠিক সেভাবেই দৌড়ে ছুটে যেতে লাগল বাড়ির দিকে। অর্ণবের মুখের বিচলিত ভাবটা লক্ষ্য করে শাহজিদ অতি সাবধানে প্রশ্ন করল, ‘কী বলল তুরিন?’ 

অর্ণব লজ্জায় লাল টাল হয়ে বলল, ‘তেমন কিছু না।’ 

অর্ণবের মুখের পাল্টে যাওয়া রং দেখে কেন যেন শাহজিদের বুকটা ভীষণ কেঁপে উঠল। মনের বিরূপ অবস্থা একটা বড় নিঃশ্বাসের সঙ্গে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে সে যথাসাধ্য স্বাভাবিক গলায় ছোট একটা শব্দ উচ্চারণ করল, ‘কুল!’ 

— ‘আচ্ছা, উনার পছন্দের ফুল কী আপনি জানেন? 

অযৌক্তিক খাপছাড়া এক অস্থিরতায় শাহজিদের চোখে কেমন অন্ধকার নেমে আসছিল। জোর করে হাসার চেষ্টা করে সে বলল, ‘জানি না।’ 

— ‘পছন্দের রং?’ 

শাহজিদ বিদ্রুপের গলায় বলল, ‘আমি কী করে জানব ভাই? আপনার ফিয়ন্সে, জানবেন তো আপনি।’ 

অর্ণব ঠোঁট উল্টে বলল, ‘না আমি ভাবলাম আপনারা তো অনেক দিনের পুরনো বন্ধু। তাই হয়তো উনার ভালোলাগা মন্দলাগা সম্পর্কে আপনার ধারণা আছে।’ 

শাহজিদ হুইলচেয়ারের চাকা ঘুরিয়ে দিয়ে শক্তভাবে বলল, ‘আমার কোন ধারণা নেই।’ 

অর্ণব ওর পাশাপাশি হাঁটতে থাকে, ‘মনে হচ্ছে বিয়েটা হবে। বুঝলেন ভাই?’ 

শাহজিদ হুইলচেয়ার থামাল, ‘অর্ণব শুনুন, একটা অনুরোধ করব। শুধু সিটিজেনশিপের জন্য আপনি তুরিনকে বিয়ে করবেন না প্লিজ। তুরিন কেন? কাউকেই করা উচিত না। যদি ওকে সত্যিই ভালো লেগে থাকে, এবং সেই ভালোলাগা যদি মিউচুয়াল হয় তবেই এই সম্পর্কে এগোবেন। কেমন?’ 

অর্ণব সুনিশ্চিত সুর যোগ করে বলল, ‘ভালোলাগার বিষয়টা সময়- সাপেক্ষ। আমার বিশ্বাস কিছুদিন পাশাপাশি থাকলে মনের একটা টান হয়েই যায়। তা ছাড়া উনাকে আমার ভালোই লাগে। একটু চঞ্চল, এটাই সমস্যা। তবে এই সমস্যা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ঠিক হয়ে যাবে। 

শাহজিদ ম্লান হাসল, ‘বেশ তো…অল দ্য বেস্ট।’ 

এবার অর্ণব ভীষণ আড়ষ্ট গলায় বলল, ‘তবে মেয়েটা…মানে আপনার বন্ধু মনে হয় একটু পাগল আছে। আজকে আমাকে হুট করে একটা কিস করে ফেলছে…চিন্তা করেন.. কী এম্ব্যার্যাসিং!’ 

শাহজিদ একটা ভাঙনের শব্দ শুনতে পেল কানের কাছে। প্রলয় বাতাস হুহু করে ধেয়ে এসে বুকের জানালার প্রতিটা কাচ ঝনঝন শব্দে ভাঙতে লাগল ক্রমান্বয়ে। অর্ণব অবাক গলায় বলল, ‘আপনি ঠিক আছেন তো?’ 

শাহজিদ ভাঙাচোরা মুখে বিড়বিড় করে কী যেন একটা বলল অস্ফুটে। অর্ণব শুনল না। শুধু দেখল হুইলচেয়ারটা তরতরিয়ে ছুটে যাচ্ছে ওয়াকওয়ে ধরে। অনেকটা দিগ্বিদিক্‌ শূন্য। 

সফেদ বসন্ত

ফ্লোরিডা যাওয়ার জন্য অফিস থেকে কয়েকদিনের ছুটি নিয়েছিল জাহিদ। আজ অবশ্য এমনিতেও রবিবার। ছুটির দিন। তবুও কাজের কোন শেষ নেই। এ বাড়ির নিচতলায় একটা অফিস ঘর আছে। করোনা মহামারির পর প্রতিটি বাড়িতেই অন্তত একটি অফিসরুম আবশ্যক। কারণ বেশির ভাগ লোকেই আজকাল ওয়ার্ক ফ্রম হোম করে। নবদম্পতিরাও তাই বাড়ি কেনার আগে সবার প্রথমে যাচাই করে নেয়, অফিস ঘরটা ঠিক কোথায় এবং কী রকম হলে সবচেয়ে বেশি আরামদায়ক বা মানানসই হবে। এই বাড়ির অফিস ঘরের মাঝ বরাবর বিশাল বড় এক কালো রঙের ভিন্তেজ রোজউড টেবিল রাখা আছে। জাহিদ এই মুহূর্তে সেই টেবিলসংলগ্ন রিভলভিং চেয়ারে বসে আছে। সামনে ল্যাপটপ আর কফির মগ। তার পরনে লাইট অলিভ কালারের পাতলা টি-শার্ট আর কালো ট্রাউজার। ল্যাপটপের স্ক্রিনে নিবদ্ধ চোখজোড়ায় গভীর মনোযোগের ছায়া, কপালে মৃদু কুঞ্চন। হঠাৎ দরজার সামনে একটা ছায়া এসে দাঁড়াল। 

— ‘চাচ্চু!’ 

— ‘হুম?’ প্রচ্ছন্ন গলায় শব্দটা উচ্চারণ করে জাহিদ। 

— ‘দাদু ডাকছে। এখুনি যেতে বলেছে।’ কথাটা বলেই তানিশা অদৃশ্য হয়ে গেল দরজার ওপাশে। জাহিদ সঙ্গে সঙ্গে উঠল না। উঠল আরো মিনিট দশেক পরে। বাবার ঘরে এসে দেখল জুবিন মেঝেতে তুরতুর করে হাঁটছে, দৌড়োবার চেষ্টা করে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে, হামাগুড়ি দিচ্ছে। জানালার সামনে একটু জড়োসড়ো হয়ে নিশা দাঁড়িয়ে আছে। জাহিদ ওর দিকে তাকাল না। কেন যেন বাবার সামনে তাকাতে সংকোচ হলো। কিন্তু মেয়েটির অস্তিত্বের প্রভাব খুব শক্তিশালী। যে মুহূর্তে জানল নিশা এখানে আছে, খুব কাছেই আছে, ঠিক সেই মুহূর্ত থেকেই শ্বাসপ্রশ্বাসের বিচলন অস্বাভাবিক হয়ে উঠল। চেয়ে আছে বাবার দিকে কিন্তু মন-প্রাণ দুরন্ত বেগে ধাবিত হচ্ছে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অবিচল নারী মূর্তিটির দিকে। এই ধাবমান শক্তির সঙ্গে লড়াই করা ভারী কষ্টকর কাজ। দৃষ্টির গতিবিধিতে শক্ত করে শিকল দিয়ে বাবার মুখপানে চেয়ে গম্ভীর ভাবে জাহিদ বলল, ‘ডেকেছিলেন?’ 

— ‘হ্যা…বসো।’ 

জাহিদ বসল। বাবার পাশে। বিছানার ওপর। 

মুর্তজা সাহেব একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বললেন, ‘বৌমা আমাকে সবকিছুই খুলে বলেছে। সমস্যার তো কোন সমাধান হচ্ছে না। দিনকে দিন সমস্যা বেড়েই চলেছে। এভাবে আর চলতে দেওয়া যায় না। শহীদের কনডোতে গিয়ে উঠুক বৌমা। যত দ্রুত সম্ভব। সঙ্গে তোমার মা যাবে। এ বিষয়ে তোমার কোন মতামত আছে?’ 

জাহিদ জুবিনের দিকে চেয়ে বলল, ‘জুবিন কোথায় থাকবে?’ 

— ‘মায়ের সঙ্গেই থাকবে।’ সোজাসাপটা উত্তর দিলেন মুর্তজা সাহেব। জাহিদের মুখে বেদনার নীল রং ছায়াপাত করল, ‘আমার মেয়েকে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিতে চাচ্ছেন আপনারা। এটা কি ঠিক?’ 

— ‘ঠিক-বেঠিকের সংজ্ঞা তোমার কাছ থেকে শিখতে হবে? এইটুকু বাচ্চা মা ছাড়া থাকবে কী করবে? মাথায় কি আক্কেল বলতে কিছুই নেই?’ 

জাহিদ উঠে দাঁড়াল বসা থেকে। অভিমানের বাষ্পে তার কণ্ঠ রোধ হয়ে আসছে। পৃথিবীটা আসলে ভীষণ স্বার্থপর। বাবা-মাও সন্তানের মন বুঝতে ব্যর্থ হয় সময়ে সময়ে। জুবিন তার জীবনের একমাত্র আনন্দের নাম। সেই আনন্দটুকুও এরা ছিনিয়ে নিতে চাইছে। জাহিদ থমথমে গলায় বলল, ‘তাহলে আমার মতামত জানতে চাইছেন কেন? যা ভালো মনে হয় তাই করেন।’ 

মুর্তজা সাহেব বজ্রগম্ভীর স্বরে বললেন, 

— ‘শুনেছি তুমি নাকি নিশার সঙ্গে সেপারেশনের কথা ভাবছ। ঘটনা যদি এরকম হয়ে থাকে তাহলে মেয়েটাকে আমি আবার বিয়ে দেব। আমি চাইলেই কাজটা করতে পারব তুমি জানো।’ এই কথা উঠতেই নিশা ভীষণ আড়ষ্ট হয়ে উঠল। অস্বস্তির কাঁটা ফুটতে লাগল মনে। এদিকে যুক্তিহীন রাগে জাহিদের মাথার রগ টনটন করছিল। সে ত্যাড়া গলায় বলল, ‘তাকে তো আমি নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করিনি। আপনাদের মন রক্ষার্থে করেছিলাম। এখনো আপনাদের যা মনে চায় তাইই করুন। আমাকে কেন এসবে ইনভলভ করছেন?’ 

কথাটা এত কঠিন আর নিষ্ঠুর শোনাল যে নিশার মনে হলো একটা ভারী পাথর দিয়ে কেউ তার বুকের পাঁজরা থেঁতলে দিল এই মাত্র! কথাটা বলেই জাহিদ আর দাঁড়াল না। গটগটিয়ে হেঁটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। অপদস্ত নিশা বেশ কয়েক সেকেন্ড বিনা বাক্য ব্যয়ে শ্বশুরের সামনে মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে রইল। তার চোখে উঁকি দিচ্ছে জল। বুকে অপমানের চিনচিনে ব্যথা। ভাগ্যের নির্মম প্রহসন মেনে নিতে আজকাল তার কষ্ট হয়। অনেক তো মানিয়ে নিল। আর কতকাল চলবে এই মানিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়া? ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছে সে সুন্দর। একটু বড় হওয়ার পর আত্মীয়স্বজনরা বলতে লাগল মেয়ের যেমন রূপ, তেমন গুণ। কী ভালো রান্না করে, কী নিখুঁত ঘর সাজায়, নিশার হাতের ছোঁয়া লাগলেই যেকোনো সাধারণ জিনিস হয়ে ওঠে শিল্প। গানের গলাটাও দারুণ। চর্চা করলে বাংলাদেশের লতা মঙ্গেশকর হবে একদিন। এমন মেয়ে যে বাড়িতে যাবে, সেই বাড়ির শ্রীলক্ষ্মী ফিরে আসবে। ঘর উজালা হবে। বাবা বলত একদিন প্রিন্স চার্মিং আসবে। এসে নিয়ে যাবে তার তুষারকন্যাকে দূরের কোন রাজ্যে। বাবা জানত না সব তুষারকন্যার জীবনে প্রিন্স চার্মিং আসে না। বরং কোন কোন তুষারকন্যাকে হতে হয় সত্মা। দ্য উইকেড ওয়ান! লোকটা কত সহজে বলে দিল কথাটা, আমি তাকে নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করিনি। বলার আগে একটাবার বুক কাঁপল না। একটাবার ভাবল না কথাটা যত বড় সত্যই হোক না কেন নিশার জন্য এই সত্যটি মৃত্যুযন্ত্রণা সম। বাবাকে একদিন ঠান্ডা মাথায় বাস্তবতা বুঝিয়ে দিতে হবে। বলতে হবে, বাবা তোমার মেয়ে তুষারকন্যা নয়, বরং তুষারকন্যার সত্মা। যে সমা তুষারকন্যার সাজানো-গোছানো সুখের পরিবারকে ভেঙেচুরে খান খান করে দিয়েছে। 

.

ভূতগ্রস্তের মতো সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এসেছিল জাহিদ। অফিসঘরে গিয়ে বসল কিছুক্ষণ। মন বসল না। হাঁসফাঁস লাগছিল। সদর দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। ক্রোধের একটা বহ্নিশিখা মনের আনাচকানাচ জ্বালিয়ে দিচ্ছে দাউদাউ করে। নিজের পিতামাতার ওপরেই চড়াও হচ্ছিল রাগটা। কী প্রয়োজন ছিল এই পরিবারে নিশাকে টেনে আনার? নিশা আসার পরেই তো সবকিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। ছারখার হয়ে গেল। তুরিন, ফারা দুজনেই ছিটকে গেল দূরে। এখন সবকিছু শেষ করে দিয়ে নিশাও চলে যাবে জাহিদের জীবনের একমাত্র সুখ, জুবিনকে সঙ্গে নিয়ে। তাহলে এই বাড়িতে অযথা পড়ে থেকে লাভ কী? বাবা মা তো শহীদ আর শহীদের পরিবার নিয়েই দিব্যি ভালো থাকতে পারবে। জাহিদ ঠিক করল তুরিনকে বিয়ে দিয়েই সে কলোরডো ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবে। 

বাইরে ভীষণ ঠান্ডা। আবহাওয়া পূর্বাভাসে বলা হয়েছে আজ সারাদিন তুষারপাত হবে। খানিক বাদেই স্নো-ফল শুরু হবে। পোর্চের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় অস্থির চিত্তে পায়চারি করছিল জাহিদ। হঠাৎ সদর দরজাটা খুলল কেউ একজন। দরজার চৌকাঠ পেরিয়ে বেরিয়ে এলো একজোড়া ফরসা পা। জাহিদ চিন্তামগ্নভাবে নিজের মাথার ছোট ছাটের স্ট্রেইট চুলগুলোতে ডান হাতের আঙুল চালাচ্ছিল। নিশাকে দেখে থমকে গেল ওর হাত, সেই সঙ্গে রহিত হলো চলনপ্রক্রিয়া। অপ্রস্তুত নিশা একবার ভাবল চট করে ভেতরে ঢুকে যায়। এই নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন লোকটার মুখোমুখি হওয়ার মতো কোন রুচিই অবশিষ্ট নেই তার মনে। কিন্তু গত দুদিন ধরে গাছে পানি দেওয়া হয় না। নিশা ছাড়া এই কাজটা বাড়ির অন্য লোকে করবে না। দুপুরের পর এমনিতেও জুবিনের জন্মদিন উপলক্ষে অতিথি সমাগম শুরু হবে। তখন নিশাকে ঘরবন্দি হয়ে বসে থাকতে হবে দোতলার ঘরে। এসব ভাবতে ভাবতে নিশা গম্ভীর মুখে এগিয়ে এলো সামনে। জাহিদের দিকে তাকাল না একবারও। নিঃশব্দে সিঁড়ি ভেঙে নেমে এলো উঠোনে। পানির কল চালু করল। চালু করতেই হলুদ রঙের পাইপের মুখে লাগানো নজেল দিয়ে জলের ফোয়ারা ছুটল। সিঁড়িতে রাখা স্নো ড্রপ, ড্যাফোডিল আর গোলাপের টবে পানি ছড়িয়ে পড়তে লাগল। জল পড়তেই ফুলগুলো কী রকম সতেজ হয়ে উঠছে। যেন নতুন করে লাগছে প্রাণের ছোঁয়া। ফুলের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতেই মনে হলো লোকটা কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে থেকে তাকেই দেখছে একদৃষ্টে। অস্বস্তিতে গা-হাত-পা জ্বালা করতে লাগল। ওখানে দাঁড়িয়ে আছে কেন? হয় ভেতরে ঢুকবে নইলে বাইরে বেরিয়ে যাবে। বারান্দায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকার মানে কী? 

নিশার ধারণা সঠিক। চশমার আড়ালের দুটি চোখ তখন প্রখরভাবে লক্ষ করছে তাকে। জাহিদ কাঠের দরজাটার পাশে পোর্চের দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। দেখছিল নিশাকে। ওর পরনে একটা হালকা বেগুনি রঙের সালওয়ার কামিজ। ওড়নাটা কাঁধের একপাশে ঝুলছে। কামিজের হাতটা ছোট। চন্দন-চৰ্চিত ছিপছিপে ফরসা বাহুর মসৃণ চামড়ায় বেগুনি রঙের সুতির কাপড়টা দাঁত কামড়ে পড়ে আছে। পিঠে গুচ্ছের কালো চুল। চুলের গোছা যেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে ঠিক সেখানেই চমৎকার ছন্দে ঢেউ খেলে গেছে কোমর। যেন শিল্পীর হাতে গড়া নিখুঁত কোন ভাস্কর্য। রোদের দাপট তখন কমে এসেছে। 

হাওয়া শীতল। রাস্তার ওপারের রকিমাউন্টেনের মাথায় ভিড় করেছে ছাই রঙের মেঘের লহর। সেই মেঘের সিলভার লাইনিং ভেদ করে নরম পাতলা সূর্যরশ্মি সন্তর্পণে নেমে এসেছে লোকালয়ে। আকাশটা যেন রুপোর পাতে মোড়া! সর্বত্র রুপালি মেঘের ওড়াওড়ি, মাঝেমধ্যে আঁচর কেটে গেছে গাঢ় নীল রং। শীত বাতাস খেলছিল নিশার খোলা চুল নিয়ে, ওড়না নিয়ে…আর ওই খোলা চুল আর ওড়নার কাঁপন নির্বিঘ্নে খেলে যাচ্ছিল জাহিদের দ্বিধাজড়িত, বিভ্রমে ডোবা দুর্বল মনটা নিয়ে। সে এখানে অহেতুক দাঁড়িয়ে আছে কেন? দাঁড়িয়ে থাকার কোন মানে হয় না। এই বয়সে এমন চূড়ান্ত হ্যাংলামো একেবারেই বেমানান। বয়সের কথা বারেবারে জাহিদের মনে টোকা দেয় ঠিকই, কিন্তু চল্লিশ বয়সটা কি খুব বেশি? এই বয়সে তো যেকোনো মানুষ পরিপূর্ণ যুবক বা যুবতীই থাকে। আর যৌবন যে এখনো তল্পিতল্পা গুটিয়ে প্রস্থান করেনি বরং সাড়ম্বরে বিরাজ করছে দেহ, মনের সমস্ত অলি-গলি, আড়াল আবডালে…সেই উপলব্ধি কাঁকড়ার মতো কিলবিল করে নিজ অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে ঠিক তখন থেকে, যখন থেকে নিশাকে ওই লাল পাথরের রকি মাউন্টেনের সামনে…রূপোর পাতে মোড়া চকচকে আকাশের নিচে…সবুজ কার্পেটের মতো ঘাসের ওপর খোলা চুলে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে। এই দৃশ্যটা যেন অপার্থিব! দেখলে বুক খালি খালি হয়ে যায়। তীব্র সুখ আর তীব্র কষ্ট একই সঙ্গে মনের মধ্যে দাপাদাপি করতে থাকে। সেই সময় নিশা একবার তাকাল। ডাগর দুটি চোখের ওপর চোখ পড়তেই জাহিদের মস্তিষ্কের সব রক্তকণিকা ছুটোছুটি করতে লাগল। হাঁটুতে একটা কাঁপন উঠল মৃদু। একটু আগের বিষণ্ন পৃথিবীটা ছাই হয়ে উড়ে গেল হাওয়ায়। ঠিক সেই সময় আকাশ থেকে ঝরতে লাগল সাদা রঙের তুলো। মিহি বরফের ফুলঝুরি হাওয়ায় ভেসে ভেসে উড়ে এসে বসতে লাগল নিশার খোলা চুলে, চেরিপিংক নরম গালে আর রক্তাভ পাতলা ঠোঁটে। নিমেষে সাদায় সাদায় ভরে গেল চারিধার। নিশা হাতে ধরা ওয়াটার নজেল বন্ধ করল। জাহিদ তখনো চেয়ে আছে। নিশার একটুও ইচ্ছে হচ্ছে না ওই নিষ্ঠুর পাষণ্ড লোকটার দিকে তাকাতে। কিন্তু ইচ্ছারাও মাঝেমধ্যে ভারী রহস্যময় আচরণ করে। যে লোকটা ওর জীবনটাকে তছনছ করে দিল, অপমানের কালো কলুষিত জলে ডুবিয়ে দিল আত্মমর্যাদা, মান- সম্মান এবং নারীত্বের অহংকার…সেই অপরাধী, হৃদয়হীন ব্যক্তিটিকে এক নজর দেখার জন্য রহস্যময়, দ্ব্যর্থব্যঞ্জক সব বেইমান ইচ্ছেরা শরীরের কোষে কোষে যেন উতরোল মিছিল চালু করেছে। নিশার অবাধ্য চোখের দুরন্ত দৃষ্টি, মনের সমস্ত প্রতিরোধকে পায়ে ঠেলে টর্চের আলোর মতো ঠিকরে পড়ল পোর্চে দাঁড়ানো মানুষটার মুখের ওপর। কর্ণমূল আরক্ত হলো। 

ভালো লাগার আলপিন ফুটতে লাগল গায়ের চামড়ায়। চোখে চোখ লেগে রইল খানিকক্ষণ। বরফকুচির সাদা ঝালরের ভেতর দিয়ে হঠাৎ জাহিদকে এগিয়ে আসতে দেখল। দেখল ওই রিমলেস চশমার পেছনের শান্ত দুটি চোখ…দেখল তীক্ষ্ণ নাসিকা, বাদামি ঠোঁট, প্রশস্ত কাঁধে টানটান হয়ে লেগে থাকা হালকা অলিভ রঙের স্লিমফিট টি-শার্ট। বুকে হঠাৎ কাঁপন ধরল নিশার। লোকটা এদিকে কেন আসছে? কী উদ্দেশ্যে আসছে? 

লনের সবুজ ঘাসের ওপর নিঃশব্দে ঝরে পড়ছিল তুষারকণা। সবুজাভ কার্পেট ম্যাজিকের মতো শ্বেত শুভ্র রঙে রূপান্তরিত হচ্ছে। ওদের মনের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। কোথাও শীতের রুক্ষতা নেই। বরং দুনিয়াজুড়ে নেমে এসেছে যেন এক সফেদ রঙের শুভ্র বসন্ত। বসন্ত হয় হলুদ। কিন্তু আজকের এই তুষাররাজ্যের অনাহুত বসন্ত ধবধবে সাদা। জাহিদ নিশার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। দুজনের মধ্যে মাত্র কয়েক ইঞ্চির তফাত। হৃৎপিণ্ডে ঘোড়দৌড়! নিশার মুখে বিভ্রমের গভীর ছাপ! দিঘল দুটি চোখে ব্যাকুল সম্মোহন। তুলোর মতো নরম বরফকুচি উড়ে উড়ে এসে পড়ছে ওর রক্তাভ ঠোঁটে। পেলব ঠোঁটজোড়া কাঁপছে তিরতির করে। চোখের বড় বড় পাপড়িতে আটকে গেছে বিন্দু বিন্দু তুষার। কী সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে! জাহিদের উপবাসী চোখ ভিখিরির মতো চেয়ে আছে ওর দিকে। মন চাইছে নিশাকে কাছে টেনে আদর করতে…মন চাইছে অনেক বেশি…অনেক গভীর…অনেক দুর্দান্ত আদরের স্রোতে ওর আত্মার আর শরীরের ইঞ্চি ইঞ্চি জমিন বন্যার মতো ভাসিয়ে দিতে! 

একটু ঝুঁকে মাটিতে লুটিয়ে পড়া ওড়নাটা হাতে তুলে নিল জাহিদ। নিশা ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেল নিজের কাণ্ডজ্ঞানহীনতায়। রাগও হলো প্রচণ্ড। মানুষটাকে দেখতে দেখতে এতই বেহুঁশ হয়ে গেছে সে যে গা থেকে ওড়না কখন খুলে পড়ে গেছে তা খেয়ালই করেনি। ছিঃ কী লজ্জার ব্যাপার! জাহিদ ওড়নাটা ওর গায়ে জড়িয়ে দিল যত্নের সঙ্গে। নিশার কপালে এসে লুটোপুটি খাচ্ছিল কয়েক গাছি চুল। সেই চুলে এখন বরফকুচির প্রলেপ। দেখে মনে হয় যেন বকুল ফুলের মালা! জাহিদ হাত দিয়ে চুলগুলো ওর কানের পিছে গুঁজে দিতে দিতে বলল, ‘তোমার শীত করছে না নিশা?’ শীত তো করছেই না বরং কপালে ওই হাতের একটু স্পর্শ লাগতেই যেন ছ্যাৎ করে আগুন জ্বলে উঠল 1 সেই আগুনের আঁচ বুকে নিয়েই নিশা কোনরকমে বলল, ‘আমি ঠিক আছি।’ 

জাহিদ ওর কাঁধে একটা হাত রাখল, ‘ভেতরে চলো!’ নিশা নিজের বাঁ কাঁধের ওপর নেমে আসা হাতটার দিকে আবিষ্ট চোখে তাকাল একবার। মানুষটা কাছে আসতেই কী সুন্দর একটা ঘ্রাণে ছেয়ে গেছে চারপাশ। নিশার আত্মা রমরম করছে সম্মোহনের অভ্রভেদী সঞ্চালনে। চারপাশটা এখন স্বপ্নের মতো সুন্দর। ভাগ্য বোধহয় এই প্রথম কিঞ্চিৎ প্রসন্ন হলো ওদের ওপর। কারণ বাড়িতে ঢোকামাত্র কারো মুখোমুখি পড়তে হলো না। দরজার সামনে কয়েক সেকেন্ড অকারণেই দাঁড়িয়ে রইল ওরা। একে অন্যের মুখে কী যেন খুঁজল নীরবে। জাহিদ হাত নামাল নিশার কাঁধ থেকে। এখন ওর চোখ অনেক কথা বলছে। সেই কথার দ্ব্যর্থক অর্থ নিশা বুঝতে পারে না। কিন্তু তাকানোটা ভীষণ সুন্দর! নিশা জীবনে অন্য কোন পুরুষকে কখনো এত সুন্দর করে তাকাতে দেখেনি। নিশার মুখের ওপর চোখ নিবদ্ধ রেখেই জাহিদ উল্টো দিকে কয়েক পা পিছিয়ে গেল। করিডরের সামনে গিয়ে থামল। করিডরের মুখে অফিসঘরের দরজা। জাহিদ দরজাটা খুলে এক পাশে সরে দাঁড়াল। এবার নিশা বুঝল কী করতে হবে। কোন কথা না বলে বরফ আর কাদা মাখা নগ্ন দুটি পা নিয়ে এগিয়ে এলো করিডর ধরে। ঢুকল অফিসরুমের ভেতর। জাহিদ ঘরের দরজা বন্ধ করতে করতে মেরুদণ্ডে একটা শিহরণ টের পাচ্ছিল। বুক কাঁপছিল ভীষণ! 

 নিশা, তোমাকে ভালোবাসি! 

দরজাটা শুধু ভিড়িয়ে দিয়েই ক্ষান্ত হলো না জাহিদ। খুব যত্ন করে ছিটকিনিটাও আটকালো। আর তখনই…ঠিক তখনই ভীষণ রকমের একটা উৎকট সংকোচের ঢেউ তেড়ে এসে ওর মাথার চুল থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত আকণ্ঠ ডুবিয়ে দিয়ে গেল। কেন ডাকল নিশাকে? কী দরকার ছিল? ছিঃ মেয়েটা কী ভাবছে কে জানে! এমনিতেই ওর কাছে সে নিছক এক কামুক বা লম্পট পুরুষ ছাড়া অন্য কিছুই তো না! যতবার কথা হয়েছে, নিশা ঘুরেফিরে সেই রাতের প্রসঙ্গই তো টেনে এনেছে …দোষারোপ করেছে… আফসোস করেছে… ঘৃণা করেছে… জাহিদের ভেতরকার মানুষ মনটা তো কোনদিন দেখার চেষ্টা করেনি। শুধু নিশা কেন, জাহিদের মনে হয় সংসারের প্রতিটি সদস্যই তাকে আবেগ-অনুভূতিহীন অচেতন পদার্থ বলে মনে করে। আড়ষ্ট ভাবে একবার নিশার দিকে তাকাল ও। বুকশেলফের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। জাহিদ কয়েক পা হেঁটে টেবিলের কাছে এগিয়ে এলো। বসল চেয়ারে। 

নিশা শেলফ থেকে একটা বই নামিয়ে নিয়েছে। বুঝতে পারছে না এই মুহূর্তে ঠিক কী করা উচিত। বইয়ের অক্ষরগুলোর দিকে সে তাকিয়ে আছে ঠিকই, কিন্তু পড়ছে না কিছুই। মাথাটা পুরাই ফাঁকা…যেন গড়ের মাঠ! জাহিদ নিশ্চয়ই কোন প্রয়োজনেই ডেকেছে। তার কাছে ঠিক কী প্রয়োজন থাকতে পারে মানুষটার, এটা ভাবতে গিয়ে উৎকণ্ঠা, উত্তেজনা আর রোমাঞ্চে শিহরিত হচ্ছিল আত্মা। কিন্তু সেই মানুষ তো কোন কথাই বলছে না! নিশা এবার সাহস করে ঘুরে দাঁড়াল। ঘুরতেই দেখল জাহিদ নিমগ্ন দুটি চোখ পেতে রেখেছে ল্যাপটপের স্ক্রিনে। বাম হাতের করতলে চিবুকটা রাখা, ডান হাতের মুঠোয় ছোট্ট মাউজ। ল্যাপটপের পাশে রাখা প্রিন্টারে ঘড়ঘড় শব্দ হচ্ছে। সেকেন্ডের মধ্যে একের পর এক কাগজ বেরোতে লাগল যন্ত্রটার পেট থেকে। জাহিদ কাগজগুলো হাত দিয়ে কুড়িয়ে নিল, সাজিয়ে নিল ক্রমান্বয়ে। কাণ্ড দেখে নিশা হাসবে বা কাঁদবে বুঝে উঠতে পারল না। কাজই যদি করতে হয় তাহলে ওকে ডেকে আনার কী দরকার ছিল? এত অদ্ভুতও মানুষ হয়? রাগ হলো খুব। পরমুহূর্তেই আবার মনে হলো এটাই ভালো…এটাই স্বস্তির। কাজ করতে থাকা, ব্যস্ত, অভিনিবিষ্ট, গম্ভীর জাহিদের দিকে এমনি এমনি তাকিয়ে থাকতেই বরং বেশি ভালো লাগছে। তবে এই ভালোলাগাটা কেমন যেন! রোমাঞ্চ আছে শিহরণ আছে কিন্তু তৃপ্তি নেই বিন্দুমাত্র। ওই মুখের দিকে চেয়ে থেকে, অলৌকিক ভালো লাগায় ভাসতে ভাসতে, নিশা টের পেল ওর বুকের মধ্যে আসলে কাঠ কয়লার মতো পুড়ছে জনম জনমের তৃষ্ণা! 

হঠাৎ চোখে চোখ পড়তেই চমকে উঠল। চুরি ধরা পড়ে যাওয়া অপরাধীর মতো নিচু করল মুখ। হালকা একটা হাসির রেশ পড়ল জাহিদের ঠোঁটে ঠাট্টার সুরে বলল, ‘আমি ভাবলাম তুমি বই পড়ছ!’ 

নিশা বইয়ের পাতায় চোখ রেখে মনে মনে বলল, নাহ…পড়ছিলাম তো আপনাকে! 

— ‘বই পড়তে তোমার ভালো লাগে?’ ছুটে এলো প্রশ্নটা। 

নিশা বই নামিয়ে রাখল টেবিলে। নিজের হাতের ওপর চোখ পড়তেই মনে হলো হাতটা যেন অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে। চট করে হাতটা ওড়নার আড়ালে লুকিয়ে ফেলে বলল, ‘আগে পড়তাম। 

— ‘কার লেখা পছন্দ তোমার?’ উৎসুক গলায় প্রশ্ন করে জাহিদ। নিশাকে এখনো বসতে বলা হয়নি। তাই সে বসল না। স্কুলছাত্রীর মতো জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বলল, ‘হুমায়ূন আহমেদ। 

জাহিদ চেয়ারের পিঠে মাথাটা হেলিয়ে দিল। হালকা একটু দুলতে লাগল চেয়ারটা। একটা ফাউন্টেন পেন দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে ভ্রু কুঁচকে কী যেন ভাবল। তারপর পেনটা মুখ থেকে সরিয়ে বলল, ‘নাম শুনেছি। উনি কি বাংলাদেশের সবচেয়ে ফেমাস রাইটার? 

— ‘জি। আপনি উনার লেখা পড়েননি?’ 

জাহিদ একটু লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, ‘আমি বাংলা পড়তে পারি না।’ নিশা খুব অবাক হল, ‘তাই?’ 

— ‘হুম…।’ 

— ‘আসলেই?’ 

— ‘এখানকার স্কুলে পড়াশোনা করেছি। বাংলায় লেখাপড়া করার সুযোগ হয়নি।’ 

— ‘কিন্তু আপনি তো খুব ভালো বাংলা বলতে পারেন।’ 

— ‘এটার ক্রেডিট আমার বাবা-মায়ের। আমাদের বাসায় ইংরেজি বলা অ্যালাউড ছিল না। এখনো বাড়িতে ইংরেজিতে কথা বললে বাবা খুব রাগ করেন।’ একটু থেমে জাহিদ আবার বলল, ‘তুমি দাঁড়িয়ে আছ কেন? 

নিশা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল। সামনে তাকাতে পারল না। লজ্জা পাচ্ছে সে। অযথাই লজ্জা পাচ্ছে! অযৌক্তিক লজ্জাটুকু আড়াল করতেই বোধহয় টেবিলের ওপর রাখা বইটা আবারও হাতে তুলে নিল। নামটা দেখল এতক্ষণে, টু কিল আ মকিং বার্ড, হারপার লির লেখা। অস্থিরভাবে পৃষ্ঠা ওল্টাতে লাগল। জাহিদ হাতে ধরা ফাউন্টেন পেনটা দাঁত দিয়ে কামড়ে যাচ্ছিল অনবরত। দেখছিল নিশার আরক্তিম মুখ, একটু একটু ভেজা চুল আর পিটপিট করে নড়তে থাকা বড় বড় চোখের পাপড়ি। জাহিদের ইচ্ছে হলো ওই পাপড়িগুলো হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেয়। ছুঁয়ে দেখে ওটা আসল নাকি নকল। এই সন্দেহটা এর আগেও এসেছে মাথায় বহুবার। আজকাল তো মেয়েরা ফলস ল্যাশ ছাড়া বেডরুমের বাইরেও পা রাখে না। কী অদ্ভুত সব ঠুনকো ভাবনা ভেবে যাচ্ছে সে। আশ্চর্য! সেই সময় নিশা মুখ তুলে প্রশ্নটা করল, হবে?’ 

— ‘সত্যি আপনি বাংলা পড়তে পারেন না?’ 

জাহিদ অতীব লজ্জার সঙ্গে বলল, ‘পারি না…তুমি শেখাবে আমাকে?’ নিশা অপ্রস্তুত হাসল, ‘আমি কী করে শেখাব?’ 

জাহিদ একটা কলম আর নোটপ্যাড এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘লিখো।’ 

— ‘কী লিখব?’ নিশা অবাক। 

— ‘জুবিনের নামটা লিখো বাংলায়।” 

— নিশার ঠোঁটে একটা বঙ্কিম হাসির চিলতে রেখা ভেসে উঠল, ‘লিখে কী হবে? 

— ‘প্র্যাক্টিস করব।’ 

নিশা কাগজের ওপর জুবিনের নামটা লিখল। লেখা শেষ করে কাগজটা মেলে ধরল চোখের সামনে। জাহিদ বলল, ‘ইংরেজিতেও নামটা লিখে রাখো পাশে।’ 

লিখল নিশা। তারপর বলল, ‘আর কী লিখব?’ 

— ‘তোমার নাম লিখো।’ 

নিশা লিখল। লিখে নিয়ে কাগজটা তুলে ধরল সামনে। জাহিদ দেখল সাদা কাগজের ওপর নীল কালিতে চমকাচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দুটি নাম। 

‘আর কী লিখতে হবে?’ নিশার প্রশ্ন। একটুও সময় নষ্ট না করে জাহিদ ভরাট অথচ নির্বিকার গলায় বলল, 

— ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি!’ 

— ‘হ্যাঁ?’ চমকে উঠল নিশা। এতটাই চমকালো যে আঙুলের ফাঁক গলে কলমটা টুপ করে খসে পড়ল মাটিতে। নিশার ওই আঁতকে ওঠা ভীত শঙ্কিত কাঁচুমাচু মুখ দেখে হেসে ফেলল জাহিদ। হাসতে হাসতে বলল, ‘ভয় পেও না। কথাটা তোমার উদ্দেশ্যে বলা হয়নি। যেকোনো নতুন ভাষা শেখার সময় সবার প্রথমে ভালোবাসার বাণী শেখার নিয়ম আছে।’ 

হাসিটা দেখে নিশার গায়ে গরম তেলের ছিটা পড়ল। নিজের বোকামীর কথা চিন্তা করে ব্রহ্মরন্ধ্র জ্বলে উঠল একদম! এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল লোকটা তাকেই কথাটা বলেছে। আরেকটু হলেই প্রাণবায়ু ঠুস করে বেরিয়ে যেত শ্বাসনালি দিয়ে। এতটা হাঁদা কেন সে? এই সব হাঁদাগিরির জন্যই তো জীবনে আজ এত বিপর্যয়। রোষপরবশ থমথমে মুখ নিয়ে চট করে মাটি থেকে কলমটা তুলে নিল নিশা। খসখস করে যন্ত্রের মতো লিখল কাগজে কয়েকটা শব্দ। তারপর কাগজটা জাহিদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘কেন ডেকেছিলেন আমাকে?’ 

মনে মনে থমকে গেল জাহিদ। বিভ্রান্তির একটা অস্ফুট ছায়া পাত ঘটল ওর মুখে। এই প্রশ্নের উত্তর তার নিজেরই জানা নেই। নিশাকে বলবে কী করে? নিশা চেয়ে আছে উত্তরের আশায়। কিছু একটা বলা দরকার। কী বলা যায় ভেবে পাচ্ছে না জাহিদ। একটু নার্ভাস লাগছে। অল্পবয়সি একরত্তি মেয়েটার সামনে…জাহিদের মতো পূর্ণবয়স্ক পুরুষ মানুষের নার্ভাস লাগছে এমন হাস্যকর কথা কেউ কোনদিন শুনেছে? তবে সামলে নিতে খুব একটা সময় লাগল না। সেকেন্ডের মধ্যেই আত্মরক্ষার শক্তি ফিরে পেল মনের ভেতর। ভ্রু উঁচিয়ে ড্যামকেয়ার ভঙ্গিতে বলল, ‘ডেকেছিলাম নাকি?’ 

নিশার মুখে অপমানের তপ্ত রেখা আঁক কেটে গেল ক্ষণিকের জন্য। ঝাঁজ নিয়ে বলল, ‘ডাকেননি?’ 

— ‘মনে পড়ছে না।’ 

নিশা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ‘তাহলে বসে থেকে লাভ নেই। আমি বরং যাই।’ 

জাহিদ একজোড়া প্রখর চোখ নিশার অপমানে লাল হওয়া মুখের ওপর বিছিয়ে দিয়ে বলল, ‘তুমি কি ভয় পাচ্ছ?’ 

ক্ষিপ্রতা এবার চরমে উঠল, ‘ভয় পাব কেন?’ 

— ‘আমি কী জানি! তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে ভয়ে কাঁপছ। 

নিশার একটা দমবন্ধ ভাব হলো। চট করে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আজাইরা কথার সময় নাই আমার। জরুরি কিছু বলার থাকলে বলুন নইলে যেতে দিন।’ জাহিদ কলম দিয়ে কাগজের ওপর আঁকিবুকি করতে করতে শান্ত কণ্ঠে বলল, 

— ‘তোমার কেন মনে হলো আমার কিছু বলার থাকতে পারে?’ 

নিশা বড় একটা শ্বাস টেনে ভেতরকার উত্তেজনা বশে আনার চেষ্টা করল। পারল না। টের পেল অস্থিরতায় বুকটা কাদাজলের মতো থকথক করছে। এগিয়ে গেল দরজার দিকে। মনে হচ্ছিল এই ঘর থেকে বেরোতে না পারলে ব্রেইনস্ট্রোক হবে। 

— ‘নিশা!’ 

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল নিশা। আপনা-আপনিই আটকে গেল শ্বাস। ঘুরে তাকাল। জাহিদ ল্যাপটপের স্ক্রিনে চোখ রেখেই বলল, ‘এক গ্লাস পানি দিও তো।’ আদেশটা শুনে রাগে গা জ্বলতে লাগল। পানির জগ আর গ্লাস বিশাল লম্বা টেবিলটার এক প্রান্তে সযত্নে রাখা আছে। উঠে এসে পানি ঢেলে পান করা যায় অনায়াসে। বসে বসে জমিদারের মতো আদেশ করার কোন মানে হয় না। রাগে গজগজ করতে করতে টেবিলের কাছে ফিরে এলো নিশা। জগ থেকে পানি ঢালল গ্লাসে। তারপর পানিভর্তি গ্লাস নিয়ে জাহিদের পাশে এসে দাঁড়াল। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে। হাত টানটান করে এগিয়ে দিল গ্লাসটা। 

জাহিদ আড়চোখে দেখল নিশাকে। দেখল ওর গা-বাঁচিয়ে দাঁড়াবার আড়ষ্ট ভঙ্গিটা। গ্লাস হাতে নিল। এক চুমুকে পান করল অনেকটা পানি। তারপর নিজের মাথার হালকা ভেজা ভেজা, ছোট ছোট চুলে চমৎকার ভঙ্গিতে পাঁচ আঙুল চালিয়ে দিয়ে অনেকটা হুকুম দেওয়ার স্বরে বলল, ‘এটা দ্যাখো।’ 

নিশা ওর ডাগর ডাগর বশীভূত চোখ মেলে দেখল আঙুল চালানোর পর চুলগুলোতে সুবিন্যস্ত একটা ভাঁজ পড়েছে। এই পাট পরিবর্তনটা সুন্দর। নিশার চোখের ওপর মুগ্ধতার একটা আলগা চাদর ঝুলে পড়েছে। ঠোঁটের দূর প্রান্তে আবছা হয়ে ফুটে উঠেছে সম্মোহিত হাসি। জাহিদ ল্যাপটপের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ‘আমাকে দেখতে বলিনি। এদিকে দ্যাখো।’ নিশা নিভল ভস করে। মুগ্ধতার চাদর চিরে অপদস্ত ভাব ফুটে উঠল সারা মুখে। ব্রিবতভাবে তাকাল ল্যাপটপের স্ক্রিনে। জাহিদ গম্ভীর গলায় বলল, ‘এই অ্যাপে অজস্র বাড়ির বিজ্ঞাপন আছে। দ্যাখো তো কোনটা পছন্দ হয়?’ 

— ‘মানে?’ 

জাহিদ রিভলভিং চেয়ারের পিঠে মাথা হেলিয়ে দিয়ে হাতে ধরা কলমটা দাঁতে চেপে ধরে বলল, ‘বাড়ি কিনব।’ 

নিশার কণ্ঠস্বর থমথম করে উঠল, ‘আপনার বাড়ি আপনি কিনবেন, আমার কী?’ 

— ‘বাড়িটাতে তুমি জুবিনকে নিয়ে থাকবে। তাই তোমার মতামত প্রয়োজন। এটা না বোঝার তো কিছু নেই। ইটস নট রকেট সায়েন্স।’ 

কথাটা কানে প্রবেশ করা মাত্র নিশার নিষ্কলুষ সুন্দর মুখখানায় গঞ্জনা সর্বস্ব ক্রোধ সাপের মতো ছোবল দিয়ে উঠল যেন। বিষাক্ত গলায় কেটে কেটে বলল, ‘আপনার বাড়িতে আমাকে আর আমার মেয়েকে থাকতে হবে কেন? আমি কাজ করব। কাজ পেলেই জুবিনকে নিয়ে আলাদা বাসায় উঠে যাব। আপনাকে এ নিয়ে ভাবতে হবে না। 

— ‘তুমি ভুলে যাচ্ছ আমি জুবিনের বাবা। ওর ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করে তোলা আমার দায়িত্ব।’ 

নিশা গোঁ ধরা গলায় বলল, ‘এসবের প্রয়োজন নেই।’ 

জাহিদের চোখে রোষের অশনি চিলিক কেটে গেল। কঠিন গলায় বলল, ‘আমি আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছি। হেরফের হবে না। আই ওন’ট চেঞ্জ মাই মাইন্ড।’ 

— ‘আমিও জানিয়ে দিলাম আমার সিদ্ধান্ত। আমি আর আমার মেয়ে কিছুতেই আপনার বাড়িতে থাকব না। 

— ‘নিশা, তর্ক কোর না।’ 

— ‘আমার মেয়েকে নিয়ে আমি কোন কম্প্রোমাইজ করতে রাজি নই।’ 

কথাটা শুনে খুব খারাপ লাগল জাহিদের। ইস্পাতের চেয়েও শক্ত হয়ে উঠল চোয়াল। গমগম করে বলল, ‘তাহলে জুবিন আমার সঙ্গেই থাকবে। তুমি তোমার বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে যেখানে খুশি যেতে পার।’ 

নিশার চোখদুটো অতৃপ্ত প্রেতাত্মার মতো ধক করে জ্বলে উঠল, ‘জুবিনকে আমি দেব না! 

— ‘তাহলে আমার কথা মেনে চলতে হবে।’ 

— ‘আমি আপনার দয়ায় থাকতে চাই না।’ 

— ‘এখানে দয়ার কিছু নেই। আর যদি দয়া মনে কর তাহলে…হ্যাঁ, আমার দয়াতেই তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে।’ 

নিশার কেমন পাগল পাগল লাগছিল। মনে হচ্ছিল রাগে, আক্রোশে, অপমানে মাথার রগ ছিঁড়ে যাবে। হঠাৎ একটা কাণ্ড করে বসল সে। ল্যাপটপের পাশে কফির মগ রাখা ছিল। মগের তলানিতে কিছু কালো রঙের তরল কফি মজুদ ছিল তখনো। নিশা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে উন্মাদিনীর মতো কফির মগটা হাতে তুলে নিল। তুলে নিয়েই ত্বরিত গতিতে ভেতরের তরলটা ছুঁড়ে মারল জাহিদের মুখে। গলাফাটা চিৎকারে ভেঙে পড়ে বলল, ‘আমার মেয়ে আমার সঙ্গে থাকবে! এটাই ফাইনাল!’ 

জাহিদের মুখ, কপাল, চুলের কিছু অংশে ব্ল্যাক কফি ছিটকে পড়েছে। অলিভ রঙের টিশার্টটাও অক্ষত নেই। কলারের কাছে কালো কালো ছোপ। মাথাটা হেলে গেছে পেছনে। মুখ কুঞ্চিত। চোখে ভর করেছে এক মর্মান্তিক দানবীয় ক্রোধ। ফরসা গালের গুঁড়ি গুঁড়ি কালচে দাঁড়ির ওপর দিয়ে স্পষ্টভাবে নীল রগ কাঁপতে দেখা যাচ্ছে। হাত হয়ে উঠেছে মুষ্টিবদ্ধ। 

কয়েকটি বিমূর্ত মুহূর্ত কাটার পর নিশা নিজের কৃতকর্ম সম্পর্কে সম্যকরূপে অবগত হলো। কেউ যেন ধাক্কা দিয়ে পাগলামোর চূড়ান্ত শিখর থেকে বিবেকের দ্বারপ্রান্তে নামিয়ে আনল ওকে। ভয়ের একটা কনকনে ঠান্ডা স্রোত দেহের প্রতিটি অণু-পরমাণুকে বরফের মতো জমিয়ে দিয়ে গেল। কৃতকর্মের অনুশোচনায় খণ্ড খণ্ড হয়ে যেতে লাগল হৃৎপিণ্ড। পাগলের প্রলাপ বকার মতো বলতে লাগল, ‘হায় আল্লাহ এ আমি কী করলাম! কী করলাম আমি!’ 

কম্পনরত স্খলিত হাতে রিভলভিং চেয়ারটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল। গায়ে জড়ানো সুতির ওড়নার একটা প্রান্ত দিয়ে জাহিদের মুখ থেকে তরল পদার্থ মুছে নিতে লাগল। চশমা খুলে নিল। দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে আঠালো কফির দাগ মুছতে লাগল চশমার কাচ থেকে। জাহিদ অন্ধ হয়ে বসে রইল খানিকক্ষণ চশমা ফেরত পাবার পর দেখতে পেল, নিশার চোখ উপচে বেয়ে পড়ছে রূপালি জল। ঠোঁট কাঁপছে থরথর করে। বিড়বিড় করে অনবরত কিছু একটা বলে যাচ্ছে। জাহিদ ওর হাতটা ধরল, ‘তুমি কাঁদছ কেন?’ 

এই প্রশ্নের উত্তরে নিশার কান্নার দমক আরো বেড়ে গেল। ফুঁপিয়ে উঠে বলল, ‘আমি খুবই খারাপ একটা কাজ করেছি। এটা আমার করা উচিত হয়নি প্লিজ আমাকে মাফ করে দিন।’ জাহিদ বসা থেকে উঠল। দাঁড়াল নিশার মুখোমুখি। একটু আগে ভয়ংকর রাগে মাথার খুলি উড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। কিন্তু নিশার কান্নাটা যেন রাগের ওপর জলের ছিটা দিল। নিভু নিভু করতে লাগল বুকের খরাময় শুকনো প্রান্তরে জ্বলতে থাকা ক্রোধবহ্নি শিখা। নিশার চোখ ভেসে যাচ্ছে জলে। সরু নাকটার ডগা টকটকে লাল। অশুরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, ‘এমন অসভ্যতা আমি জীবনে এর আগে কোনদিন করিনি বিশ্বাস করুন। আমার বাবা জানতে পারলে ভীষণ কষ্ট পাবে!’ 

— ‘ইটস ওকে। তোমার রাগ হয়েছে তাই একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছ। আই আন্ডারস্ট্যান্ড।’ 

নিশা দুদিকে মাথা নাড়তে নাড়তে নিদারুণ আর্তস্বরে বলল, ‘আমার শাস্তি হওয়া উচিত। আপনি আমাকে শাস্তি দিন। আপনি আমার মেয়ের বাবা। আমি কিন্তু আপনাকে মন থেকে কখনো অসম্মান করিনি। এটা জানেন তো?’ 

শেষের কথাটা স্বস্তি দিল জাহিদকে। শান্তির ছায়াস্নিগ্ধ মনোরম একটা অনুভূতি মুহূর্তের জন্য আরামদায়ক আবহ তৈরি করল মনের মধ্যে। নিশার ডান চোখের কোল উপচে একটা রুপো রঙের জলের ধারা লালচে নাকের পাশ ঘেঁষে গড়িয়ে পড়ছিল, মিলিয়ে যাচ্ছিল ঠোঁটের সঙ্গে। জাহিদ আঙুল দিয়ে সেই অশ্রুজল টুকু মুছে দিয়ে বলল, ‘কান্না করো না। ভয়ের কিছু নেই। আমি রাগ করিনি।’ 

— ‘প্লিজ জুবিনকে আমার কাছ থেকে নিয়ে যাবেন না। আপনার তো সব আছে। আমার যে জুবিন ছাড়া কেউ নেই। এটা আপনি বোঝেন না কেন?’ 

জাহিদ অধৈর্য হয়ে বলল, ‘আচ্ছা বুঝতে পেরেছি। এখন তুমি কান্না থামাও। তোমার কান্না আমার ভালো লাগে না নিশা! কষ্ট হয়!’ 

হঠাৎ ছুটে আসা কথাটা যেন মন্ত্রের মতো কাজ করল। সেকেন্ডের জন্য থমকে গেল নিশার শরীরের সমস্ত স্পন্দন। চমকে…ভীষণ চমকে তাকাল সে সামনে দাঁড়ানো মানুষটার দিকে। কাটল কয়েকটা বিভ্রমের মুহূর্ত। নিশার স্থবির হয়ে আসা মুখ দেখে জাহিদ বুঝল সে নিশ্চয়ই অযাচিত কিছু বলে ফেলেছে। একটু অনুশোচনা হলো…আবার সূক্ষ্মভাবে এটাও টের পেল যে এই অনুশোচনার সঙ্গে একটা গোপন স্বস্তি আছে। কারণ কথাটা এক বিন্দুও মিথ্যে নয়। 

নিশা চুপ করে চেয়ে আছে। সুরের মূর্ছনার মতো স্নিগ্ধ হয়ে এসেছে ওর জলসিক্ত চোখের দৃষ্টি। কত ছোট্ট একটা কথা। অথচ কী দারুণ শক্তিশালী…কী দারুণ সুন্দর…নিশার মনে হলো এত সুন্দর কথা সে অনেক দিন শোনেনি। এত শান্তি…এত প্রশান্তি…বহুদিন ধরে দল বেঁধে বেড়াতে আসে না ওর মনের ঘরে। একটানা দুরূহ ক্লান্তির পর যেন একটু খানি বিশ্রাম মিলল। নিশার সারা শরীরে ঘুমের মতো একটা ঝিরিঝিরি শান্তির আবেশ নেমে এলো। ঠোঁটে ফুটে উঠল প্রচ্ছন্ন হাসি। 

— ‘কেন?’ মাথাটা ডান দিকে হেলিয়ে কৌতূহলী বয়ঃসন্ধির বালিকার মতো আহ্লাদী গলায় প্রশ্ন করে নিশা। জাহিদ চোখ সরিয়ে নেয়। পিছিয়ে আসে কয়েক পা। কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলে, ‘কেন মানে?’ 

নিশা হাসে, ‘আমাকে কাঁদতে দেখলে আপনার ভালো লাগে না কেন?’ 

জাহিদ টেবিলের ওপর ছিটকে পড়া কফি ন্যাপকিন দিয়ে মুছতে মুছতে সাধারণ গলায় বলল, ‘কেউ আমার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে এই দৃশ্যটা দেখতে আমার কেন ভালো লাগবে?’ 

একটা ঝাঁকুনি এসে লাগল নিশার মনে। সংবিৎ ফিরল যেন। তাই তো…মানুষের কান্না দেখতে কারই বা ভালো লাগে! কত সাধারণ একটা কথা থেকে অসাধারণত্বের নির্যাস বের করে আনার ব্যর্থ চেষ্টা করছিল সে। বুকের মধ্যে স্বপ্নভঙ্গের মতো একটা বেদনার উদ্রেক হলো। ভীষণ অবসন্ন আর মলিন দেখাল ওকে মুহূর্তের জন্য। জাহিদ চেয়ারে এসে বসল। চশমাটা খুলে চোখ দুটো হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কচলে নিল একবার। তারপর চশমা পরে নিয়ে খুব গম্ভীর গলায় বলল, ‘শোন…জুবিন তোমার কাছেই থাকবে। এ নিয়ে আমি আর কোন কথা বলতে চাই না। তবে আমার মেয়েটাকে মাঝেমধ্যে আমাকে একটু দেখতে দিও। এটুকুই অনুরোধ রইল।’ 

নিশা কিছু বলল না। কেমন স্থবির চোখে তাকিয়ে রইল শুধু। 

— ‘তোমার কি আর কিছু বলার আছে?’ 

নিশার চোখে তখনো জলের ছাপ লেগে ছিল। ওড়নাটা ঝুলছে বাঁ কাঁধে ও জানালা দিয়ে আসা তুষার দিনের সাদা আলোয় শরীর ঝলসে যাচ্ছে। জাহিদ গালে হাত রেখে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। কলম দিয়ে কাগজের ওপর কী সব আঁকিবুকি করতে করতে বলল, ‘তুমি কি কিছু বলতে চাও?’ 

নিশা মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল। তার মুখে একটা বিমূঢ় ভাব খেলছে। রক্তে বইছে তুষের আগুন। মনে হচ্ছে আজকে একটা ফয়সালা করতে না পারলে এই আগুন নিভবে না। তার ইচ্ছে হলো লোকটার গলা চেপে ধরে প্রশ্ন করে, কেন সে এমন অদ্ভুত? কেন নিশা ওকে এত করে চাওয়ার পরেও নিশাকে সে একটাবারের জন্যও চায় না? 

জাহিদ এগিয়ে এসেছে আবার। সামনে দাঁড়িয়ে ওর মুখের সামনে একটা তুড়ি বাজিয়ে বলছে, ‘কী সমস্যা?’ 

নিশার চোখে ক্রোধ। নিঃশ্বাসে আগুন। জাহিদ বলল, ‘আমি তো বললাম জুবিন তোমার সঙ্গেই থাকবে। খুশি হওনি?’ 

নিশা বলল, ‘আপনাকে আমার বিরক্ত লাগে!’ 

জাহিদ তীক্ষ্ণ চোখে পরখ করল নিশাকে, তীক্ষ্ণ প্রশ্ন করল, ‘কেন? 

— ‘সহ্য করতে পারি না…এইজন্যে।’ 

— ‘তুমি কি স্যাডিস্ট? মানুষকে কষ্ট দিতে তোমার ভালো লাগে?’ 

— ‘মানুষকে কষ্ট দিতে আমার একটুও ভালো লাগে না। কিন্তু আপনাকে কষ্ট দিতে পারলে আমার প্রচণ্ড আনন্দ হয়।’ 

নিশার দিঘল পল্লবঘেরা সুন্দর দুটি চোখের দিকে কিছুক্ষণ বিভ্রান্তভাবে চেয়ে রইল জাহিদ। তারপর হঠাৎ কাঁধ চেপে ধরে ঝড়ের চেয়েও ক্ষিপ্র গতিতে নিজের কাছে টেনে নিয়ে এলো। তীব্র কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ‘আমাকে কষ্ট দিতে তোমার ভালো লাগে কেন?’ 

নিশা খাঁচাবন্দি পাখির মতো ছটফট করে বলল, ‘যেতে দিন। ছাড়ুন। 

— ‘আগে বলো কেন এত কষ্ট দাও আমাকে?’ 

নিশা ঘাড় ঘুরিয়ে নেয় অন্যদিকে, – ‘বললাম তো…আপনাকে কষ্ট দিতে ভালো লাগে।’ 

ওর গাল চেপে ধরে মুখটা নিজের দিকে জোর করে ফিরিয়ে আনে জাহিদ, ‘কেন ভালো লাগে?’ 

নিশা দুরন্ত চোখে তাকিয়ে থাকে শুধু। কিছু বলে না। সামনে দাঁড়ানো মানুষটার উষ্ণ নিঃশ্বাস ওর মুখে এসে পড়ে। শিরশির করে পায়ের পাতা। জাহিদের প্রখর উপবাসী দৃষ্টি নিশার চোখ-নাক পিছলে কোমল রক্তাভ ঠোঁটজোড়ার ওপর লেজার বিমের মতো আটকে পড়ে। হাওয়ায় একটা সম্মোহনের জাল তৈরি হয়। হৃদযন্ত্রে দ্রিম দ্রিম শব্দে বাজতে থাকে বাজনা। নিশা জাহিদের টকটকে গৌরবর্ণের ছিপছিপে, একহারা, তপ্ত চোয়ালে শক্ত করে দুটি হাত চেপে ধরে কাটা কাটা গলায় বলে, ‘এই প্রশ্নের কোন উত্তর আমার জানা নেই। শুধু জানি যতদিন বেঁচে আছি তোমাকে আমি শান্তিতে থাকতে দেব না জাহিদ মুর্তজা! আমার হাত থেকে তোমার নিস্তার নাই!’ 

জাহিদ দেখল ওই চোখে ক্রোধ আছে স্পষ্টতই, কিন্তু ঘৃণার চিহ্নমাত্র নেই! কিছুক্ষণ শ্বাসরোধ করে ওদিকে চেয়ে থেকে সে ক্ষীণ গলায় বলল, ‘কেন?’ 

হঠাৎ আঘাত পড়ল দরজায়। জাহিদ আস্তে করে ছেড়ে দিল নিশাকে। সরে এলো কয়েক পা। টেবিল থেকে এক টুকরো কাগজ তুলে নিল। হাত বাড়িয়ে বলল, ‘তোমার এটা নিয়ে যেও।’ 

নিশা কাগজটা হাতে নিল। কোন প্রশ্ন করতে পারল না। তখনো প্রবল ভাবে বুক কাঁপছিল ওর। দরজার বাইরে শহীদ দাঁড়িয়ে ছিল। নিশা একটা সালাম দিয়েই কেটে পড়ল দ্রুত। লিভিং এ এসে দেখল শ্বশুর-শাশুড়ি, তুরিন, নীলিমা সবাই ফায়ারপ্লেসের সামনে চেয়ার টেনে বসেছে। বাইরে অনবরত তুষার ঝরছে। তাপমাত্রা কমতে কমতে এখন মাইনাস দশে ঠেকেছে। জুবিন দাদার কোলে দোল খাচ্ছিল। ফারা এগিয়ে এসে মুখে ব্যঙ্গের ভাব ফুটিয়ে বলল, ‘নিশা শোন, একটু পরেই গেস্ট আসা শুরু হবে। তুমি এক কাজ কর। তাড়াতাড়ি ঘরের দরজা বন্ধ করে লুকিয়ে যাও। কেউ দেখে ফেললে কী হবে বলো? জুবিনের নার্স বা ন্যানি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। এর চেয়ে কেউ তোমাকে না দেখুক, এটাই ভালো!’ 

নিশা বিষদৃষ্টিতে তাকাল ফারার দিকে। অফিসরুম থেকে জাহিদ বেরিয়ে এসেছে তখন। ফারা জাহিদের দিকে এগিয়ে গেল। সামনে দাঁড়িয়ে কিছু একটা বলতে লাগল চাপা গলায়। ওদের দুজনকে আজকাল একসঙ্গে দেখতে অসহ্য লাগে নিশার। মন বিষিয়ে ওঠে একদম! এখনো রক্তে বিষের জ্বালা টের পাচ্ছিল। শাশুড়ি পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। কী যেন বলছেন উঁচু স্বরে। নিশা শুনতে পাচ্ছে না কিছুই। তার কানের কাছে ঝিঁঝি ডেকে চলেছে অনবরত। ফারা আর জাহিদের দিকে সর্পিল দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সে। শাশুড়িকে দেখল একবার। কথা বলেই যাচ্ছেন। হঠাৎ কী মনে করে যেন নিশা চোখ ফেলল হাতে ধরা কাগজটার ওপর। চোখ পড়া মাত্রই ধক করে উঠল বুক। হৃৎপিণ্ডটা লাফ দিয়ে চলে এলো বুকের কাছে। সাদা কাগজের মাঝ বরাবর নীল কালি দিয়ে গোটা গোটা অক্ষরে বাংলায় লেখা, 

নিশা, তোমাকে ভালোবাসি! 

চমকানো বক্ষ নিয়ে তাকাল জাহিদের দিকে। জাহিদ ফারার সঙ্গে কথা বলতে বলতে নিশাকেই দেখছিল। চোখে চোখ পড়তেই ঠোঁটে দুর্বোধ্য চাপা হাসি নিয়ে ভারী সুন্দর ভঙ্গিতে ডান চোখটা ব্লিংক করল। নিশার মুখে ঝাপটা মারল রক্ত। পিঠে গজিয়ে উঠল অদৃশ্য একজোড়া প্রজাপতির ডানা। অনেক অনেক দিন পর ওর পৃথিবীটা সুখ সুখ…স্বপ্ন স্বপ্ন… অজস্র লাল-নীল দীপাবলিতে আগাপাশতলা ভর-ভরন্ত হয়ে উঠল। সুখের অত্যাচারে আটকে গেল শ্বাস। জল-স্থল-অন্তরীক্ষ একযোগে গলা মিলিয়ে ফিসফিস করে বলতে লাগল একটি মাত্র বাক্য, 

ভালোবাসি…ভালোবাসি…নিশা, তোমাকে ভালোবাসি! 

দুঃস্বপ্নের ঘোর 

নিজের মৃত্যু নিয়ে একটা দুর্ধর্ষ স্বপ্ন আছে শাহজিদের। এই স্বপ্নের উদ্ভব হয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগে। বাবার মৃত্যুর দিন। টানা বত্রিশ ঘণ্টা বিমান যাত্রার পর, বাংলাদেশ থেকে ডেনভার পৌঁছেই উৎকণ্ঠিত শাহজিদ ছুটে গিয়েছিল হাসপাতালে। জানতে পারল মাত্র পাঁচ মিনিট আগে বাবা শেষ নিঃশ্বাস বিসর্জন দিয়েছেন। যন্ত্রণা হলো না, কষ্ট হলো না…বরং প্রকৃতির এই অদ্ভুত প্রহসন তাকে চূড়ান্ত এক অতীন্দ্রিয় বিস্ময়ের উন্মত্ত আস্ফালনে প্রস্তর খণ্ডের মতো নিঃসাড় করে দিয়ে গেল। কিছুতেই বোধগম্য হলো না যে বাবার মৃত্যুর ঘটনাটি আর দশ মিনিট পরে ঘটলে কী এমন ক্ষতি ছিল? তবে কি প্রকৃতি, ঈশ্বর বা আল্লাহ যে নামেই তাঁকে ডাকা হোক না কেন, সেই মহাপরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময় শক্তির কাছে পিতা-পুত্রের শেষ সাক্ষাতের মতো আবেগপ্রবণ, করুণ, এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর বলে প্রতিপন্ন হলো? এই শাস্তি কি শাহজিদের প্রাপ্য ছিল? তার বয়স তখন মোটে ষোল। বিস্তর পাপ জমানোর মতো বয়স সেটা না। বরং পাপ-পুণ্যের সংজ্ঞাটুকুও ঠিকঠাক জানা হয়ে ওঠেনি। তবে বাল্যকাল থেকেই নিজের প্রতি প্রকৃতির এক ধরনের নিষ্ঠুর উদাসীনতা সে লক্ষ করে এসেছে। মায়ের অনুপস্থিতি এবং মাতাল অধঃপতিত চরিত্রের পিতার সান্নিধ্য শৈশবের সহজ- সরল স্বপ্নীল দিনগুলোকে কখনোই শতভাগ বর্ণীল হতে দেয়নি। বাবাকে সে খুব বেশি ভালোবাসেনি। সুযোগ হয়নি। কিন্তু রক্ত এক আশ্চর্য শক্তিশালী জিনিস। ভালোবাসা থাক বা না থাক, টান থাকবেই! রক্তের টান অগ্রাহ্য করা ক্ষমতা মানুষের নেই। 

সেই দুপুরটাও এমনই ছিল…সাদা সাদা অজস্র বরফবিন্দুতে ভরে উঠেছিল রাজধানী। তুষারাবৃত আকাশটা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে ঝরে পড়ছিল সুবিশাল দশ লেন বিশিষ্ট মহাসড়কে। দোচালা বাড়ির ছাদে। গাড়ির পিঠে। শাহজিদ শেষবারের মতো বাবাকে একনজর দেখল। চোখ ঝাপসা হলো না। বুক কাঁপল না। শুধু কয়েকটা ক্ষণ বিষাদগম্ভীর চোখে চেয়ে রইল পিতার নিথর মৃতদেহের দিকে। তারপর বেরিয়ে এলো রাস্তায়। চারিদিকে নিষ্কলুষ শুভ্র তুহিনের ঘেরাটোপ দেখে মনে হয় মশারির জাল। বড় বড় তুষার দানা মুখে এসে বিঁধছে, ভাঙছে, মিশে যাচ্ছে! পৃথিবীটা ক্রমেই সাদা রঙের ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে। সেই আদিগন্ত সাদায় ডুব দিয়ে শাহজিদ রাস্তার ধার ঘেঁষে ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগল। তার ভেতরটা তখন অদ্ভুত রকমের অবশ। কষ্ট নেই, যন্ত্রণা নেই…আছে শুধু দুকূল ছাপানো হুহু শূন্যতা। বুক মথিত হয়ে উঠে আসছে রক্তাক্ত দীর্ঘশ্বাস। বাতাস ফিসফিস করে বলছে, কেউ নেই…কেউ নেই! তুমি একা… তুমি ভীষণ একা! হঠাৎ তুষার ঝড়ের সাদা তাণ্ডবের মধ্যে, দূরের রকি মাউন্টেনের রুপালি বরফের মুকুট পরা সর্বোচ্চ শিখরখানি আয়নার মতো ঝলসে উঠল চোখের সামনে। অমর্ত্য সুন্দর সেই টুকরো দৃশ্যখানি শাহজিদের মনে এক পুলকসমৃদ্ধ আচানক শিহরণের উদ্রেক করল। মনে হলো রূপবতী সেই পাহাড় বরফকুচির সাদা খামে করে তার জন্য পাঠিয়েছে ছুটির আমন্ত্রণপত্র! পাহাড় ডাকছে… হাতছানি দিয়ে ডাকছে তাকে! মুক্তির আনন্দে চনমন করে উঠল রক্ত। ফিরে এলো উত্তাপ। মন চাইল এখুনি ছুটে যায় ওই পর্বত শৃঙ্গে। তারপর আকাশের খুব কাছাকাছি…পাহাড়ের কোলে ভাসতে ভাসতে সাদা ধবধবে খুশিয়াল শুভ্র বরফ গায়ে মেখে…মাথার মগজের মধ্যে পরপর দুটা চকচকে বুলেট গেঁথে দেয় সযত্নে! একটা বিকট শব্দ…পর্বতের আনাচে-কানাচে লুকিয়ে থাকা মাউন্টেন লায়নের সচকিত চিৎকার…তারপর ফুটফুটে ধবল বরফের ওপর এক ঝাঁক টকটকে লাল রক্তের ছিটকে পড়া আলপনা! দেহ নামক খাঁচা থেকে একটা অতৃপ্ত আত্মার মুক্তি। আহ…..কী শান্তি! 

সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়নি। জীবনের অমোঘ বাস্তবতার ঘষা লেগে দুৰ্ধৰ্ষ সেই স্বপ্ন ভোঁতা হয়ে এসেছে দিনকে দিন। তবে পাহাড়কে সে ভালোবেসেছে প্রতিনিয়ত। সব সময় ভেবেছে একদিন পাহাড়েই মরবে। সংগীতশিল্পী জন ডেনভারের দেহের ছাইভস্ম যেভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল সুবিস্তৃত রকি মাউন্টেনের বুকে, ঠিক তেমনি শাহজিদও চায় তার দেহটা মৃত্যুর পর রকি পর্বতমালার প্রস্তর খণ্ডের সঙ্গে মিশে যাক। আজ সেই পুরনো দুর্ধর্ষ স্বপ্নটা আবারও মাথা চারা দিয়ে উঠেছে। নিজের ঘরে ফিরে এসে ক্লজেটের কাপড়ের ভাঁজে লুকিয়ে রাখা রিভলভারটা বের করেছে শাহজিদ। এটা কেনা হয়েছিল করোনা অতিমারির সময়। সুইসাইড করার জন্য নয়, কিনেছিল আত্মরক্ষার খাতিরেই। আত্মরক্ষা বা আত্মহত্যা, যেকোনো প্রয়োজনে এই ছোট্ট জিনিসটাকে মাঝেমধ্যে বড্ড উপকারী মনে হয় শাহজিদের। হাতে ধরা রিভলভারটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে দেখতে শাহজিদের মস্তিষ্কে সেই দুর্ধর্ষ স্বপ্নের ঘোর ঝিলিক দিয়ে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। কতদিন পাহাড়ে যায় না…কত্তদিন! এবার যাবে…যেতেই হবে! লোকালয়ে থেকেই বা আর কাজ কী বলো? লোকালয় ভরে গেছে তুরিন আর তুরিনের মায়ের মতো প্রবঞ্চক চরিত্রহীন মানুষে। তুরিনকে সে অন্যরকম ভেবেছিল। ফারার সঙ্গে প্রথম যেদিন দেখা হয়েছিল মুর্তজা সাহেবের হোটেলের অফিসে, শাহজিদ ভুলেও ভাবতে পারেনি সহজ-সরল বোকা তুরিনের মা হতে পারে ফারার মতো লাস্যময়ী ভ্রষ্টচরিত্র মহিলা। প্রথম সাক্ষাতের দুদিন পরেই রকি মাউন্টেনের এক গিরিখাদসংলগ্ন পার্কে ফারাকে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখেছিল, একজন পুরুষের সঙ্গে। সেই পুরুষ তুরিনের বাবা নয়। 

শাহজিদ খুব একটা সংস্কারবদ্ধ জীব ছিল না কখনো। অ্যাঞ্জেলিনা একাধিক পুরুষের শয্যাসঙ্গীনী হয়েছে, এটা জানার পরেও ওকে ভালোবাসতে চেয়েছিল। লিভ টুগেদারের প্ল্যান করেছিল। মেয়েটা স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড ছিল, আধুনিক ছিল, কিছুটা উদ্ধতও ছিল…কিন্তু মিথ্যুক কখনই ছিল না। শাহজিদ পঙ্গু হওয়ার পর ভালোবাসার মিথ্যে অভিনয় করেনি। খুব দ্রুত ব্রেকআপ করেছে। প্রতারণার আশ্রয় নেয়নি। এ কারণেই মেয়েটাকে মন থেকে ভালোবাসতে না পারলেও সম্মান সব সময় করেছে। কিন্তু তুরিনের মতো মেয়েদেরকে ঠিক কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায় জানে না সে। স্বল্পপরিচিত কোন যুবককে হুট করে চুমু খায় কী করে একজন রুচিশীল বিবেকবান মেয়ে? এটা কী ধরনের অসভ্যতা? ভাবতে ভাবতে বাতাসে বারুদের গন্ধ পায় শাহজিদ। মনে হয় কোথাও একটা বিস্ফোরণ ঘটবে। ধ্বংস হবে সবকিছু। অথচ তুরিনকে নিয়ে সে কখনো কোন দিবাস্বপ্ন দেখেনি। ভালোও বাসেনি। ওর মতো বোকা, হিংসুটে, নিরেট মাথার মেয়েকে ভালোবাসার প্রশ্নই আসে না! কিন্তু আইরনি হচ্ছে তুরিনকে অর্ণবের পাশে দেখতে ওর মোটেও ভালো লাগে না। বুকের মধ্যে বিদ্যুৎ চমকের মতো যন্ত্রণা হয়। অসহ্য লাগে সবকিছু! 

গুলিভরা রিভলভারটা ট্র্যাভেল ব্যাগের ভেতর ঢুকিয়ে রাখল সন্তর্পণে ক্লজেট থেকে কয়েকটা কাপড় এলোমেলোভাবে তুলে নিয়ে ভরল ব্যাগে। অনলাইনে রেন্ট-এ কারের ওয়েবসাইট থেকে একটা গাড়ি ভাড়া করল। ডিজেবল মানুষদের জন্য আলাদা সার্ভিস আছে। রেন্ট-এ কারের অফিস পর্যন্ত যাওয়ার জন্য গাড়ি আসবে বাড়িতে। একটু স্বস্তি বোধ হচ্ছিল। স্বস্তির প্রথম কারণ অনেক দিন পর সে পাহাড়ে যাবে। গাড়ি নিয়ে যতদূর যাওয়া যায়। আর দ্বিতীয় কারণ খুব অল্পদিনের মধ্যেই বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে তার বহু আরাধিত, আকাঙ্ক্ষিত দুর্ধর্ষ সেই স্বপ্ন! 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *