৭
নিশার প্রশ্নটা শাহজিদকে অপ্রস্তুত করে তুলেছে। হাই-চিকবোন সমৃদ্ধ সবল কাটাকাটা মুখখানায় হঠাৎ একটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাব ফুটে উঠেছে। বিস্ময়- ডুবি চোখ নিয়ে সে নিশার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে। কিছু বলতে পারছে না। নিশা ওই নিরুচ্চার নির্বাক দৃষ্টি থেকেই নিজের প্রশ্নের উত্তরটা খুঁজে নিল। রুদ্ধস্বরে বলল, ‘থাক…তোমার যেতে হবে না। আমি একাই যাচ্ছি।’
কথাটা বলেই বিশাল ব্যাগটা এক হাতে টানতে টানতে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামতে লাগল। জুবিনের কান্না থামেনি। ঘাড় ঘুরিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা জাহিদকে আকুল নয়নে দেখছে সে। ছোট্ট দুটি হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে এখুনি ঝাঁপ দিয়ে বাবার কোলে উঠে যাবে। শাহজিদের বিস্ময়ের ধাক্কাটা তখনো কাটেনি। তবুও কোনরকমে সামলে নিয়ে সে বলল, ‘নিশা…একটু দাঁড়াও…আমি নিশ্চয়ই তোমার সঙ্গে যাব…বাট…এখন হুট করে তুমি কোথায় যাবে?’
মিসেস মুর্তজা হেঁটে এগিয়ে এলেন নিশার কাছে। কোল থেকে কেড়ে নিলেন জুবিনকে ছোঁ মেরে। তারপর শাহজিদের দিকে তাকিয়ে ক্যাটক্যাট করে বললেন, ‘তোমাকে কোথাও যেতে হবে না বৌমার সঙ্গে। তুমি আমাদের পারিবারিক ব্যাপারে নাক গলাবে না। বিষয়টা আমার একেবারেই পছন্দ না!’ শাহজিদের মুখটা অপমানে জমে গেল। লাঞ্ছনার তীরবিদ্ধ আহত চোখজোড়া কোন কারণ ছাড়াই তুরিনের ওপর গিয়ে পড়ল অতর্কিতে। তুরিনও ওর দিকেই চেয়ে ছিল। উপস্থিত লোকজনের কেউই লক্ষ করেনি ওদের এই নির্নিমেষ চেয়ে থাকা। নিশা অধৈর্য গলায় বলল, ‘মা আপনি ওকে কেন অযথা এসব বলছেন? তার তো কোন দোষ নেই…আমিই তাকে…’
—‘চুপ করো বৌমা। তোমার শ্বশুর ফিরে আসার আগ পর্যন্ত কোথাও যাবে না। অপেক্ষা কর। তুমি তো জানো ওই লোকটা জুবিনের জন্মদিন পালনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সবকিছু জেনেশুনেও বাচ্চা কোলে নিয়ে ঢ্যাংচ্যাং করে হাঁটা দিলে। বিবেক বলতে কিছু নেই তোমার?’
নিশার সত্যিই জন্মদিনের বিষয়টা স্মরণে ছিল না। মনে পড়ার পর সামান্য গ্লানি বোধ হলো। শাশুড়ি জুবিনকে নিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। নিশা অপদস্থ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল খানিকক্ষণ। তারপর মাথা হেঁট করে ব্যাগটা টানতে টানতে পরাজিত সৈনিকের মতো বাড়ি ফিরে এলো। সদর দরজার চৌকাঠে তখনো জাহিদ দাঁড়িয়ে ছিল। নিশা ওর দিকে তাকাল না। ভেতরে ঢোকার সময় অনিমেষের মুখোমুখি পড়ে গেল। লোকটাকে সে আগেও দেখেছে। জাহিদের বন্ধু। এই একজন মাত্র বন্ধু, যে কি না নিশার আসল পরিচয় সম্পর্কে সম্যকরূপে জ্ঞাত। একে দেখলে কেন যেন নিশার গা শিউরে ওঠা অস্বস্তি হয়। মনে হয় লোকটা ঠিক সাধারণ নয়। একটু অন্যরকম। লম্বাটে কৃষ্ণাভ ধারালো চেহারার মধ্যে ব্যতিক্রমী সাহসের উদ্ধত ছাপ আছে, যে ছাপটা নিশার সহ্য হয় না। অনিমেষকে পাশ কাটিয়ে নিশা ত্বরিত পদে দোতলার সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। অনিমেষ জাহিদের দিকে চেয়ে কৌতুকের সুরে বলল, ‘শি ইজ সো প্রিটি! হাও ডু ইউ ফিল মেইট? দুইটা সুন্দরী বৌ…একই ছাদের নিচে…সাম পিপল হ্যাভ অল দ্য লাক আই এনভি ইউ ম্যান!’
জাহিদ শীতল একটা দৃষ্টি নিক্ষেপ করল অনিমেষের চতুর হাসিমাখা মুখের ওপর। কোন কথা না বলে সরে এলো জায়গাটা থেকে। অনিমেষ সদর দরজার পার্শ্ববর্তী ক্লজেটের র্যাকে ঝুলিয়ে রাখা কোটখানা প্রসন্নচিত্তে শিস দিতে দিতে গায়ে পরে নিল। হঠাৎ চোখ পড়ল…জাহিদের মা দাঁড়িয়ে আছেন কয়েক হাত দূরে। চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। অনিমেষ নির্বিকার গলায় বলল, ‘কিছু বলবেন আন্টি?’
মিসেস মুর্তজা আদেশের সুরে বললেন, ‘এদিকে এসো। কথা আছে তোমার সঙ্গে।’
৮
পা ফেলতে কষ্ট হচ্ছিল তুরিনের। এই অবস্থায় প্যাটিওর কয়েকধাপ সিঁড়ি ভেঙে নামা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। শাহজিদ সিঁড়ির নিচ বরাবর ক্রাচ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তুরিনকে সাহায্য করার সামর্থ্য তার নেই। তাই চুপচাপ স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকাই এখন একমাত্র কাজ। আনিতা এগিয়ে গেল সাহায্যের জন্য। ফারা আর আনিতার হাতের ওপর শরীরের সমস্ত ভর ছেড়ে দিয়ে সিঁড়িটা পার হওয়ার চেষ্টা করল তুরিন। পারল না। পায়ের তলায় কয়েকটা কাচের টুকরো নিয়েই সে হাঁটতে পারছে না, শাহজিদ কী করে একটা পা ছাড়াই কাটিয়ে দিচ্ছে গোটা জীবন? কথাটা চিন্তা করে তুরিনের মনটা ভয়ংকর খারাপ হয়ে উঠল 1
নিজের আহত পায়ের বেদনা আর পীড়া দিল না তাকে। মনে হলো জীবনে সুস্থভাবে আত্মনির্ভরশীল হয়ে বেঁচে থাকাটাও এক ধরনের সৌভাগ্য। এই সৌভাগ্যটুকু কেন শাহজিদের কপালে জুটল না? যে ছেলেটার পাহাড় জয় করার কথা ছিল, যুদ্ধের ময়দানে বীরদর্পে দেশের জন্য লড়বার কথা ছিল সে কেন আজ অথর্ব বিকলাঙ্গ হয়ে ঘরের কোণে আবর্জনার মতো পড়ে আছে? প্রকৃতির এই নিষ্ঠুর পরিহাসের ব্যাখা কী? ভাবতে ভাবতে তুরিনের বুকটা প্রচণ্ড হতাশায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছিল। অন্যমনস্কভাবে ডান পাটা সিঁড়ির ওপর নামিয়ে দিয়েছিল সে। নামাতেই তীব্র ব্যথায় কনকন করে উঠল পায়ের পাতা। কণ্ঠনালি থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো একটা অনভিপ্রেত আর্তনাদ। সেই আর্তনাদ শাহজিদের অন্তরাত্মায় কঠিন ঝংকার হয়ে বেজে উঠল… বাজতে লাগল অবিরত। নিজের অসহায়, ক্ষমতাহীন অস্তিত্বের ওপর এতটা ঘৃণা এর আগে কখনো হয়নি ওর। অর্ণব এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবটা দেখছিল। এবার দৌড়ে ছুটে এলো। তুরিনের মুখটা যন্ত্রণায় নীল হয়ে গেছে। দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ব্যথা সহ্য করছে সে। অর্ণব ফারার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আপনি সরে দাঁড়ান। আমি দেখছি।’
ফারা উচ্চবাচ্য না করে আদেশ পালন করল। অর্ণব চট করে তুরিনকে কোলে তুলে নিল। সংকোচ হচ্ছিল না যে তা নয়। কিন্তু বিপদের দিনে লজ্জা- শরমের তোয়াক্কা করতে নেই। ঘটনাটা ঘটা মাত্র শাহজিদের মুখ থেকে সবকটা রঙের চিহ্ন উবে গেল। সাদা…ভীষণ সাদা আর বিবর্ণ দেখাতে লাগল ওকে। অর্ণবের হৃষ্টপুষ্ট তাম্রাভ বাহুদ্বয়ের মধ্যে তুরিনের পাখির পালকের মতো নরম পাতলা শরীরটা নেতিয়ে আছে। ধবধবে ফরসা পায়ের পাতা থেকে টপটপ করে ফোঁটায় ফোঁটায় গড়িয়ে পড়ছে লাল টুকটুকে রক্ত। সেই রক্তের দিকে শাহজিদের চোখ আটকায়নি, তার চোখ আটকে গেছে অর্ণবের হাতজোড়ার ওপর। যে হাত এখন তুরিনের সুন্দর শরীরের ওপর গেঁথে আছে। ভয়ংকর এক অগ্নিশিখা শাহজিদের পায়ের তলা থেকে ব্রহ্মরন্ধ্র পর্যন্ত জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভস্ম করে দিল যেন। কষ্টের অসহনীয় ভারী বোঝা নেমে এলো বুকের ওপর। এই অনাকাঙ্ক্ষিত কষ্টের জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। সে কখনো জানত না, এমন অকিঞ্চিৎকর, অর্থহীন ঘটনাও ভেতরটা এভাবে নাড়িয়ে দিতে পারে। তুরিন হঠাৎ ডেকে উঠল ওর নাম ধরে, ‘শাহজিদ!’
সর্বস্বান্ত, নিষ্প্রাণ হৃদয় নিয়ে শাহজিদ এগিয়ে এলো কয়েক পা। নিষ্প্রাণ চোখে দেখল তুরিনকে। তুরিন ব্যাকুল স্বরে বলল, ‘তুমি চলো আমার সঙ্গে।’
কথাটা পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগেই সাপের মতো ছোবল দিয়ে উঠল ফারা, ‘ও এসে কী করবে? হ্যাভ ইউ গন ইনসেইন? সে নিজেই হাঁটতে পারে না, ক্রিপন্ড একটা ছেলে। এই ছেলে আমাদের সঙ্গে গেলে লাভটা কী হবে?’ কথাটা বলতে বলতেই ফারা ড্রাইভিং সিটে এসে বসল। নিষ্ঠুর উক্তিটা তুরিনকে ছিড়েখুঁড়ে ঝুরাঝুরা করে দিল। মনের ভেতরের ভাঙচুরের প্রভাব সুস্পষ্টভাবে ছাপ ফেলল ওর নির্মল শুভ্র মুখশ্রীতে।
গাড়িটা এগিয়ে যাচ্ছিল দুপুরবেলার দুকূল ছাপানো চনমনে রোদের ভেতর দিয়ে। তুরিন গাড়ির জানালার বাইরে মুখ বাড়িয়ে দিল। ক্রাচে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অসহায়, পঙ্গু…অথচ দুর্দান্ত সুদর্শন যুবকটির দিকে অবোধ কিশোরীর মতো অশ্রুসিক্ত করুণ চোখে চেয়ে রইল। একসময় ওর ঝাপসা চোখের তারা থেকে সেই অসহায় ছেলেটার যন্ত্রণাবিদ্ধ বিবর্ণ মুখটা মুছে গেল। ওই মুখে এমন অনির্দেশ্য, অপরিমেয় কষ্টের নকশা তুরিন এর আগে কোনদিন দেখেনি। তার বুকটা মন খারাপের কালো মেঘে মেঘে ছেয়ে গেল একদম!
—‘ওই ছেলেটা গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেই তো পারত! তোমার দাদিটাও না…একটা ডিজগাস্টিং মহিলা! কী দরকার ছিল ওদেরকে আটকানোর?
তুরিন খুব অবাক হলো, ‘কার গার্লফ্রেন্ড? কীসের কথা বলছো?’
—‘কার গার্লফ্রেন্ড আবার? ওই ল্যাঙড়াটার সঙ্গে নিশার প্রেম চলছে তুমি জানো না?
কথাটা শুনে তুরিনের কান ঝাঁঝাঁ করে উঠল। চাপা একটা ধমক দিয়ে উঠল সে, ‘স্টপ টকিং ননসেন্স মা। তোমার মাথাটা গেছে।’
ফারা ড্রাইভ করতে করতে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনের সিটে বসা মেয়ের সঙ্গে আই কন্ট্যাক্ট করল। ওর ছিপছিপে ফরসা মুখে একযোগে সাঁতার কাটছে বিস্ময়, রাগ এবং উত্তেজনা। মেয়ের চোখে চোখ রেখে সে কড়া গলায় বলল, ‘তুমি আমার কথা বিশ্বাস করছ না?’
তুরিন জানালার বাইরে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। দৃঢ় কণ্ঠে বলে, ‘না বিশ্বাস করছি না…তুমি ভুল বুঝেছ। আর প্লিজ…সামনে তাকাও। ড্রাইভ কেয়ারফুলি। অ্যাকসিডেন্ট করবে।
—তুমি কি দেখোনি দুজনে পুরো ফ্যামিলির নাকের ডগার ওপর দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল? হ্যাঁ? তুমি দেখোনি?’
রোদটা খুব চোখে লাগছিল। সানগ্লাস সঙ্গে নেই। কলোরাডোতে দিনের বেলায় সানগ্লাস ছাড়া ঘুরে বেড়ানো অতি বিপজ্জনক ব্যাপার। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ছয় হাজার ফিট উঁচুতে অবস্থিত এই মালভূমিতে সূর্য তার সমস্ত উত্তাপ অকুণ্ঠচিত্তে উজাড় করে দেয় সারাদিন। আলোর বন্যায় ভাসতে থাকে গোটা রাজ্য। তুরিন মাথাটা গাড়ির সিটে হেলিয়ে দিয়ে করতল দিয়ে চোখ ঢেকে বলল, ‘পালিয়ে যাচ্ছিল না। শাহজিদ জাস্ট হেল্প করতে চেয়েছে। এর চেয়ে বেশি কিছু না।’
ফারার কণ্ঠস্বরে বিস্ময় ফেটে পড়ে, ‘হাও কুড ইউ বি সো শিওর?’
—‘শাহজিদ আমাকে বলেছে।’
—‘কী বলেছে?’
—‘নিশাকে ও বোনের মতো দেখে।’
ফারা অট্টহাসিতে ভেঙে পড়ল, ‘ও বলল আর তুমি বিশ্বাস করলে?’
তুরিন চোখ থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ বিশ্বাস করেছি… বিশ্বাস করেছি কারণ শাহজিদ মিথ্যা কথা বলে না…চেষ্টা করলেও বলতে পারে না।’ কথাটা বলতে বলতে তুরিনের আজ ভোরবেলার কথা মনে পড়ল। শাহজিদ সত্যিই মিথ্যা বলতে পারে না। মিথ্যা বলতে পারে না বলেই ভালোবাসার কথা অস্বীকার করতে ওর কষ্ট হচ্ছিল। একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে তুরিনের। পায়ের ব্যথাটা টনটন করে অস্তিত্বের জানান দেয়। হঠাৎ সেই প্রায়ান্ধকার গিরি- খাঁজের ভেতরকার এক টুকরো স্মৃতি মনের উঠোনে জলোচ্ছ্বাসের মতো আছড়ে পড়ে। একটা উন্মাদ আনন্দ শরীরের কোষে কোষে ছড়িয়ে যায়। সেই উন্মাদ চোরা আনন্দ নিমেষে সমস্ত ব্যথা-বেদনা আর অবসাদকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়। নিঃশ্বাসের ওজন বাড়ে। ভালো না বাসলে কেউ কখনো কাউকে অমন পাগলের মতো আদর করতে পারে? শাহজিদ অন্তত পারে না… তুরিন জানে…খুব ভালো মতোই জানে!
ফারার কর্কশ কণ্ঠস্বরে ঘোর ভাঙল ওর, ‘তোমাকে কেন এসব কথা বলেছে সে?’
তুরিন অধৈর্য গলায় বলল, ‘তুমি ভুলে গেছ ও আমার ফ্রেন্ড ছিল।’
—‘ছিল…এখন তো আর নেই। ল্যাংড়া-খোঁড়া অথর্ব একটা ছেলের সঙ্গে ফ্রেন্ডশিপ রাখার কোন মানেই হয় না।’
তুরিন চিৎকার করে ওঠে হঠাৎ, ‘ফর গড সেক ওয়াচ ইয়োর টাং মা! সেই তখন থেকে ল্যাংড়া, ক্রিপন্ড এসব অফেন্সিভ কথাবার্তা বলে যাচ্ছ। সমস্যা কী?’
ফারা অত্যন্ত গম্ভীর গলায় বলল, ‘শোন তুরিন, আমার মনে হয় তুমি কিছু একটা ভুল করছ। আই অ্যাম মোর দ্যান শিওর দে আর হ্যাভিং অ্যান অ্যাফেয়ার। আর এটা হলেই আমাদের জন্য ভালো হয়। তুমি বুঝতে পারছ?’
তুরিন মুখ ঝামড়ে উঠে বলল, ‘না বুঝতে পারিনি। ইউ আর টকিং রাবিশ।’
—‘আমি প্রমাণ করে ছাড়ব তোমার কাছে আর তোমার বাবার কাছে। আর এটা প্রমাণ করতে পারলেই আমার রাস্তা ক্লিয়ার হয়ে যাবে।’
—‘ইউ ডোন্ট নিড টু প্রুভ এনিথিং। আমিই আমার বাবাকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে আনব। তোমার কোন ডার্টি গেম প্লে করতে হবে না।’
—‘তুমি কিছুই পারবে না। যা করার আমাকেই করতে হবে।’
তুরিন কঠোর গলায় বলল, ‘শাহজিদকে এসব নোংরামিতে ইনভল্ভ করবে না মা! যদি করো…’
ফারা সাপের মতো বিষ-ফণা তুলে বলে, ‘কী হবে করলে?’
—‘খারাপ হবে…খুব খারাপ!’
.
অনেকক্ষণ কান্নাকাটির পর জুবিন এখন একটু শান্ত হয়েছে। কেন ওভাবে গলা ছেড়ে কাঁদছিল? ওর নিষ্পাপ মন কি বাবার সঙ্গে বিচ্ছেদের কোন পূর্বাভাস টের পেয়েছিল? কে জানে! হয়তো শিশুরাও কিছু জিনিস বুঝে যায়, টের পেয়ে যায়, শুধু মুখ ফুটে বলতে পারে না। বাচ্চাকে কোলে নিয়ে ড্রইংরুমের ফ্লোর টু সিলিং উইনডোর সামনে এসে দাঁড়াল জাহিদ। গোটা বাড়ির মধ্যে এই জায়গাটাই জুবিনের সবচাইতে প্রিয়। সাদা কাচের ভেতর দিয়ে উন্মুক্ত লন দেখা যায়। লনের ওপাশে নেইবারহুডের ছিমছাম রাস্তা। একটা খালি উদ্যান। তার ঠিক পরেই লাল পাথরের রকি মাউন্টেন। পাহাড়ের গায়ে গায়ে ছোট ছোট বাড়িঘর। সাপের মতো একটা আঁকাবাঁকা রাস্তা লাল পাহাড়ের গা বেয়ে বহুদূর পর্যন্ত উঠে গেছে। সেই রাস্তায় চলতে থাকা গাড়িগুলোকে দূর থেকে খেলনার মতো মনে হয়। জুবিন খুব মজা পায় এসব দৃশ্য দেখে। জানালার কাচে হাত রেখে নিজস্ব ভাষায় অনেক কথা বলে, হেসে কুটিকুটি হয়। জাহিদ মেয়েকে অনেক আদর করল। মনে হলো জুবিনের চুলেও নিশার চুলের মতো একটা সুঘ্রাণ লেগে আছে। আজ সকালে পাহাড়ের ওপর নিশাকে যখন জড়িয়ে ধরেছিল, ঠিক এমনই একটা সুঘ্রাণ ওর নাকে এসে লেগেছিল। কী নিষ্পাপ…কী সুন্দর…কী কোমল একটা ঘ্রাণ!
অদৃষ্টের খেলা বড়ই বিচিত্র। ভাবতে গেলে অবাক হতে হয়। দুটা বছর আগেও জাহিদ জানত না তার জীবনে জুবিন আসবে। যে অল্পবয়সি, সাধারণ ঘরোয়া মেয়েটির দিকে এক সময় চোখ তুলে তাকায়নি পর্যন্ত, যাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করার কোন নিগূঢ় অভিলাষ তার মনে ঘুনাক্ষরেও ছিল না, যে ছিল জীবনের নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর, অস্বস্তিকর, অপ্রয়োজনীয় এক অধ্যায়… আজ সেই অধ্যায়ের সমাপ্তির কথা ভাবতে গিয়ে জাহিদের বক্ষ-ভূমিতে চিরচির করে ফাটল ধরছে। অথচ সেই মেয়েটি ফারার চেয়ে ব্যতিক্রম কিছু তো নয়! সব মেয়েরাই কি এমন হয়? তার নিজেরও দুটি কন্যাসন্তান আছে। এদের সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারবে তো? নাকি ফারার মতো, নিশার মতো পুরুষের মন নিয়ে, জীবন নিয়ে, অনুভূতি নিয়ে খেলা করা এদের অভ্যাসে পরিণত হবে?
শাহজিদের উদ্দেশ্যে বলা নিশার কথাটা, আকুতি ভরা অনুরোধটা কানে বাজতে থাকে জাহিদের। একটু আগে যে মেয়েটা তার মনের ঘরে আশ্রয় চাইছিল সেই মেয়েটিই ঘণ্টার ব্যাবধানে অন্য একজন পুরুষের সঙ্গ চেয়ে বসল একগাদা লোকের সামনে। কী কাণ্ড! অপমান আর অভিমানের ধোঁয়ায় জাহিদের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। মেয়েটার প্রতি যে সম্মানটুকু এতকাল ধরে তিলতিল করে জমে উঠেছিল, সেই সমাদর এবং মর্যাদার স্তরে যেন ধূলোর আবরণ এসে পড়েছে। জাহিদ বুঝতে পারছে না নিশা আসলে কাকে ব্যাক-আপ হিসেবে ব্যবহার করছে? তাকে নাকি শাহজিদকে? ব্যাপারটা হয়তো এমন…এ বাড়িতে টিকতে পারলে তো টিকেই গেল…নইলে শাহজিদ তো আছেই! যেকোনো মুহূর্তে ওর হাত ধরে বেরিয়ে যাবে…বাহ! কিন্তু মেয়েটার সাহস কত…সে জুবিনকে নিয়ে ওই ছেলের সঙ্গে বেরিয়ে যাচ্ছিল। কী সাংঘাতিক! এসব বিরূপ বিক্ষিপ্ত ভাবনা জাহিদের মনের মধ্যে ক্রমেই ক্রোধের আগুন ছড়িয়ে দিতে লাগল। রক্তে একটা জ্বালা টের পাচ্ছিল সে। জুবিনকে কোলে নিয়ে দ্রুতপায়ে দোতলায় উঠে এলো। নিশার সঙ্গে কিছু জরুরি কথা সেরে নেওয়া দরকার। ওর জানা উচিত শাহজিদ কিংবা অন্য যাকে নিয়েই সে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা গড়ুক না কেন, সেই পরিকল্পনা থেকে জুবিনকে ছাটাই করতে হবে। জাহিদের কাছ থেকে কেউ তার সন্তান ছিনিয়ে নিতে পারবে না। নিশার ঘরের দরজাটা আধখোলা অবস্থায় ছিল। জাহিদ টোকা দিয়ে বলল, ‘আসব?’
ক্ষণিক আলোকে আঁখির পলকে
তোমায় যবে পাই দেখিতে
হারাই-হারাই সদা হয় ভয়,
হারাইয়া ফেলি চকিতে
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
.
কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে জাহিদ দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। ঘরটা ফাঁকা। সতেজ সূর্যকিরণে চারিদিক থইথই করছে। জানালার ধারের ক্র্যাব অ্যাপল-ট্রি ছেয়ে আছে সাদা আর লাল ফুলে। ডালে ডালে লার্ক বান্টিং পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে। ডাকছে গলা ছেড়ে। কালো আর সাদার মিশেলের এই ছোট্ট লার্ক বান্টিং কলোরাডোর জাতীয় পাখি। বসন্তের আগে আগে দূর দেশ থেকে উড়ে আসে ওরা। একটা মেটে রঙের আদুরে কাঠবিড়ালি গাছের ডাল বেয়ে বেয়ে জানালার কার্নিশের ধারে উঠে এসেছে। গোল্লা গোল্লা চোখ মেলে পিটপিট করে দেখছে ঘরের ভেতরটা। ক্র্যাব অ্যাপল গাছ দুটোর ঠিক পেছনেই ফিরোজা রঙের মসৃণ আকাশ। দেখলে মনে হয় যেন আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গাছগুলো। রোদমাখা ফিরোজা আকাশে ভেসে থাকা সাদা ফুলের নিখুঁত আলপনা বসন্তের আমেজের কথা মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু এই রাজ্যে বসন্তের একচ্ছত্র আধিপত্য নেই। শীতের দাপটে ম্লান হয়ে যায় বসন্তের মাধুর্য। জুবিন সোনা ঘুমিয়ে পড়েছিল বাবার কোলে। জাহিদ মেয়েকে বিছানার ওপর শুইয়ে দিল। খুট করে একটা শব্দ হলো হঠাৎ। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই বাথরুমের দরজায় নিশাকে দেখতে পেল। ওর গায়ে একটা সাদা তোয়ালে জড়ানো। মাথার ভেজা চুল ছড়িয়ে আছে পিঠে। একটু অস্বস্তি কাঁটা দিয়ে উঠল জাহিদের মনে। সরিয়ে নিল চোখ। নিশা তাড়াহুড়া করে ঘরের দরজাটা বন্ধ করল প্রথমে। গোসলে যাওয়ার আগে কেন কাজটা করার আক্কেল হলো না, কী করে এমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ভুলে গেল, সেই কথা ভেবে নিজেকেই নিজে ধমকে উঠল হালকা। দরজা লক করে ঘুরে দাঁড়াতেই চোখ পড়ল ঘরের মধ্যিখানে স্থিরচিত্র হয়ে থাকা মূর্তিমানের ওপর। ভূত দেখার মতো চমকে উঠল নিশা। একটা আচমকা আর্তনাদ ছুটে বেরিয়ে এলো মুখ থেকে। সেই আকস্মিক চিৎকারে জুবিনের ঘুম গেল ছুটে। ট্যাট্যা করে কান্না শুরু করল।
জাহিদ বিরক্তিতে কাদা কাদা হয়ে বলল, ‘বাচ্চাটাকে কত কষ্টে ঘুম পাড়ালাম। দিলে তো ঘুমটা ভেঙে!’
নিশার তখনো বুক কাঁপছে ভয় আর লজ্জার দুঃসহ দাপাদাপিতে। শরীরের প্রতিটি রক্তকণা বরফের মতো জমে হিম হয়ে গেছে। নিজেকে কোথায় একটু লুকোনো যায় সেই চিন্তায় পাগল হওয়ার দশা। জাহিদের ধমক শুনে সে আরো বেশি নার্ভাস হয়ে পড়ল। দরজার সঙ্গে ঠেসে দাঁড়িয়ে রইল স্থাণুবৎ হয়ে। কান্নারত বাচ্চা সামলাতে সামলাতে জাহিদ আড়চোখে দেখল একবার ওকে।
— জুবিনকে লাস্ট কখন খাইয়েছ? ইট সিমস লাইক শি ইজ স্টার্ভিং। নিশা কিছু বলতে পারল না। অবাধ্য সংকোচের উৎপীড়ন তার কণ্ঠস্বর রোধ করে দিয়েছে। জাহিদ আলতোভাবে বাচ্চার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ঘুরে দাঁড়াল, তাকাল নিশার দিকে। নিশা অতর্কিতে দুই বাহু বুকের ওপর তুলে এনে মুখ ঝামড়ে উঠে বলল, ‘আমার দিকে তাকাচ্ছেন কেন? অন্যদিকে তাকান!’
জাহিদ ধমক শুনে আজ্ঞাবহ ভৃত্যের মতো দৃষ্টি সরিয়ে নিল। জুবিনের দুনিয়া কাঁপানো কান্নাটা মাথা ধরিয়ে দিচ্ছে। বিগত বেশ কয়েকটা রাত কেটেছে নিদ্রাবিহীন। সকাল থেকে নানাবিধ দুশ্চিন্তা, স্নায়বিক চাপ এবং পারিবারিক কলহের জাঁতাকলে পিষ্ট হতে হতে জাহিদের স্বাভাবিক বোধবুদ্ধি এখন লুপ্তপ্রায়। নিশার ওপর একটা নচ্ছার পাগল পাগল রাগ ক্রমেই জমতে জমতে মহীরুহর আকার ধারণ করছে। শাহজিদকে বাড়িভর্তি লোকের সামনে ওই প্রস্তাবটা দেবার আগে একবার কি ওর ভাবা উচিত ছিল না? এই অদূরদর্শী, হঠকারী কাজে বাড়ির লোকের যে ওর প্রতি বিরূপ ধারণা জন্মাতে পারে এটা বুঝতে না পারার মতো অবুঝ তো সে নয়। নাকি এখন আর কোন রাখঢাক চলবে না। সবাইকে জানিয়ে বুঝিয়েই সব সীমা অতিক্রম করে এই পরিবারের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করার সময় এসে গেছে! এখন তো মনে হচ্ছে ফারার চেয়েও সাহসী এবং সাংঘাতিক এই মেয়ে! অথচ একটু আগে পাহাড়ের ওপর মেয়েটা কত আবেগসর্বস্ব কথা বলছিল। একই মানুষের এত রূপ হয় কী করে? ভাবতে অবাক লাগে!
নিশার দিকে না তাকিয়েই জাহিদ কঠোরভাবে বলল, ‘তুমি সঙের মতো দাঁড়িয়ে আছ কেন?’ নিশার মেজাজ এমনিতেই খুব চড়ে আছে। এই অপ্রীতিকর, অপ্রস্তুত পরিস্থিতি তাকে আরো বেশি বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে। কণ্ঠস্বর উচ্চাঙ্গে তুলে চাঁছাছোলা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল সে, ‘কী করতে হবে তাহলে?’
— ‘বাচ্চার কান্না থামাও…নইলে জামা-কাপড় পর…কিছু একটা তো কর!’
— ‘সব আমিই করব তো, আপনি কী করবেন?’
জুবিনের কান্নার তোড় বেড়ে চলেছে। জাহিদের বিনিদ্র, বিক্ষিপ্ত, ক্লান্ত মস্তিষ্ক ক্রমেই ভারসাম্য হারাচ্ছে। নিশা আগে কখনো মুখে মুখে তর্ক করত না। এখন সেই জড়োসড়ো, অপ্রতিভ, স্বল্পবাক মেয়ের মুখে কথার খই ফুটছে। এই অবস্থা চললে সংসারে জাহিদের টিকে থাকাই দুষ্কর হয়ে উঠবে। ফারা, তুরিন, নিশা…কেউ তাকে মান্য করছে না। সবাই যাচ্ছেতাই ব্যবহার করছে। মন চাইছে সবকিছু ছেড়েছুড়ে কোথাও চলে যায়। সংসার নামক বিভীষণ দায়িত্বের বোঝা সে আর বইতে পারছে না।
— ফর গড সেক নিশা, ডোন্ট আরগু। আই কুডন’ট স্লিপ অল নাইট! ট্ৰাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড।’
— ‘আর আমি তো খুব ভসভস করে ঘুমিয়েছি। এই বেয়াদব মেয়েটা আমাকে সারারাত ঘুমাতে দেয়নি আপনি জানেন?
— ‘রাতে কান্না করেছে?’
— ‘হ্যাঁ।’
— ‘কেন কী সমস্যা?’
— আমি কী জানি! একটা থাপ্পড় মারলে সব কান্নাটান্না লেজ তুলে পালাবে। ঠাস করে একটা চটকানা লাগান।
―শাট আপ। ইউ সাউন্ড টু হার্শ নিশা! তুমি ওর মা। মেয়ে কেন কান্না করছে সেটা তুমি না জানলে কে জানবে? আর মারামারির কথা বলছ কেন? খবরদার আমার মেয়ের গায়ে কখনো হাত তুলবে না।’
— ‘আপনিও তো ওর বাবা…আপনি কিছু জানেন না কেন?’
রাগে নিশার ব্রহ্মতালু জ্বলে যাচ্ছিল। লোকটা একটু আগে তুরিনের সামনে তাকে মানুষ বলে গণ্য করেনি। কখনোই করে না। তুরিনের উদ্ধত, দুর্বিনীত আচরণ মাথা পেতে মেনে নেয় প্রতিবার। মেয়েকে একটা কড়া কথা শোনাতে পারে না। সেই একরত্তি মেয়ে আজ সবার সামনে নিশাকে গালাগাল করেছে। কই তখন এত বড় বড় কথা কোথায় ছিল? নিজের সন্তানকে ন্যূনতম ভদ্রতা- জ্ঞান শিক্ষা দেবার মুরোদ নেই। এখন এসেছে খুব হম্বিতম্বি দেখাতে। ফালতু যত্তসব!
জাহিদ তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল ওর দিকে, তীক্ষ্ণ গলায় বলল, ‘এভাবে কথা
বলছ কেন?’
— ‘আপনি বারবার এদিকে তাকাচ্ছেন কেন? কী আজব!’
অপমানের গরম-জল যেন ছিটকে এসে পুড়িয়ে দিল জাহিদের মুখ, ‘তাকাচ্ছি প্রয়োজনে। তোমাকে দেখার কোন শখ নেই আমার। তোমার কি ধারণা তোমাকে দেখার জন্য মরে যাচ্ছি?’
— ‘যাচ্ছেন নিশ্চয়ই। নইলে বারবার তাকাচ্ছেন কেন?’
জাহিদের চোয়ালজোড়া নিমেষে কঠোর হয়ে ওঠে, ‘তাকালে সমস্যা কী? তাকানো যাবে না?’
— ‘না যাবে না!’ বজ্রনিনাদ কণ্ঠে ঘোষণা দেয় নিশা।
— ‘আশ্চর্য!’ স্বগতোক্তির মতো শব্দটা উচ্চারণ করে জাহিদ।
— ‘আপনার কোন ঠিক আছে নাকি? সেদিনের মতো হুট করে কিছু করে ফেলবেন।’
জাহিদ আকাশ থেকে পড়ল, ‘দ্যাট ওয়াজ অ্যান আক্সিডেন্ট! ইউ ডিডন’ট ইভেন একজিস্ট টু মি। ইউ শুডন’ট হ্যাভ এনি ডাউট অ্যাবাউট ইট।’
নিশা গমগম করে বলল, ‘এত ইংরেজিতে কথা বলবেন না আমার সঙ্গে। বাংলায় বলেন। আমি আপনাদের মতো ফটফট করে ইংরেজি বলতে পারি না।’
জাহিদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘আমি আগেও বলেছি ওটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট ছিল। সব সময় আমাকে ব্লেম কর। এটা ঠিক না।’
নিশার মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। শরীর অত্যধিক দুর্বল। এতক্ষণ রাগে গা জ্বলছিল, এখন সেই রাগের সঙ্গে এসে জুটল অপমান আর লাঞ্ছনা। কেউ যেন অবমাননার ভারী পাথর দিয়ে তার হৃদয়টা মসলা ছেঁচার মতো করে ছেঁচতে লাগল অবারিত। নিশা জানে লোকটা তাকে সেই রাতে ঠিক মতো লক্ষই করেনি। এই অবজ্ঞাটুকুই তার মনের মধ্যে এতকাল ধরে জমে জমে অভিমানের ফেনিল সমুদ্রে রূপান্তরিত হয়েছে। এই অবজ্ঞা তাকে স্বস্তিতে শ্বাস ফেলতে দেয় না, ঘুমাতে দেয় না, বাঁচতে দেয় না…ভয় হয় এই অবজ্ঞা, উপহাস আর অশ্রদ্ধা একদিন তাকে গলা টিপে মেরে না ফেলে!
জুবিনের কান্না তখন থেমেছে। ঘুমিয়ে পড়েছে আবার। জাহিদ মেয়েকে শুইয়ে দিয়েছে বিছানায়। নিশা এলোমেলো কণ্ঠে বলল, ‘আমি জানি অ্যাক্সিডেন্ট ছিল। আপনি অনেকবার বলেছেন। সেই রাতেও আপনি আপনার স্ত্রীর নাম নিচ্ছিলেন বারবার। আমার কোন অস্তিত্বই আপনার কাছে ছিল না। আপনি আমাকে জাস্ট ইউজ করেছেন।’
শেষের কথাটা জাহিদের সমস্ত চেতনাকে নাড়িয়ে দিয়ে গেল। চকিতে ঘুরে তাকাল সে নিশার দিকে। পরমুহূর্তেই আবার সরিয়ে নিল চোখ। খুব খারাপ লাগল কথাটা…এত বেশি খারাপ লাগল যে, সেই খারাপ লাগাটা জাহিদের বোধশক্তি এবং যুক্তির পাল্লাকে বড় গোলমেলে এবং বক্র করে তুলল। নিজেকে অত্যন্ত নিকৃষ্ট, ঘৃণ্য এবং জঘন্য বলে মনে হতে লাগল তার। নিশা বারবার কেন এই প্রসঙ্গটা তুলে আনে? ওর কি অনুশোচনা হয়? ওই ঘটনার জন্য…জুবিনকে পৃথিবীতে আনার জন্য ওর কি আফসোস হয়? এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা কি ওর জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ ধ্বংস করে দিয়েছে? হঠাৎ করেই জাহিদের চৈতন্যের আবর্তে যেন একটি নতুন বোধের সঞ্চার হলো। একটি অতীব সহজ-সরল অকাট্য সত্য, যা কিনা এতকাল কোন এক বিচিত্র কারণ বশত জ্ঞানচক্ষুর আড়ালে ছিল, নিদ্রিত ছিল। সেই সত্যটিই যেন আচমকা ধড়ফড় করে জেগে উঠে চোখে চোখ রেখে অকপটে তাকাল ড্যাবড্যাব করে। জাহিদ স্পষ্টভাবে বুঝল…জুবিন না এলে…নিশাকে এই বাড়িতে অষ্টপ্রহর বন্দিনী হয়ে দিন কাটাতে হতো না। জুবিন না আসলে নিশা হয়তো আরো আগেই নিজের জীবন সম্পর্কে কোন সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারত। নিশার জীবনের এই ভরাডুবি এবং অধঃপতনের জন্য পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষ ভাবে জাহিদই দায়ী। এ কারণেই মেয়েটা বারংবার এই প্রসঙ্গ টেনে এনে জাহিদকে দোষারোপ করে। জাহিদ একটা দীর্ঘ নিশ্বাস আড়াল করে ক্লান্ত…ভীষণ ক্লান্ত গলায় বলল, ‘আমার কখনোই মনে হয়নি আমি তোমাকে ইউজ করেছি। তোমারও কনসেন্ট ছিল…তুমি অস্বীকার করতে পারো না। আমি তোমাকে ফোর্স করিনি। এর পরেও…আমি জানি…ভুলটা আমারই। পারহ্যাপস, আই ওয়াজ হ্যাভিং অ্যান আনহ্যাপি সেক্স লাইফ। সো… আই…মেসড ইট আপ। ইউ হ্যাভ নো আইডিয়া হাও সরি আই অ্যাম অ্যাবাউট দ্যাট…’ একটু থেমে যোগ করল জাহিদ, ‘ইংলিশ বলার জন্য দুঃখিত।’
এই কয়েক বছরে নিশা একটু একটু জেনেছে যে উত্তেজিত হলে জাহিদ বাংলা বলতে ভুলে যায়। ব্যাপারটা অনিচ্ছাকৃত। সে অস্বস্তি নিয়ে চুপ করে রইল। তার মনের মধ্যে একটা অপ্রীতিকর সন্দেহ হঠাৎ করেই বিষফোঁড়ার মতো গজিয়ে উঠেছে। খচখচ করছে ভেতরে। একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলল, ‘আপনি সেদিন বলেছিলেন আপনার স্ত্রীর সঙ্গে থাকেন না।
জাহিদ ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘বুঝলাম না।’
নিশা এবার ক্যাটক্যাট করে বলল, ‘আপনার বউয়ের সঙ্গে তো এক বিছানায় থাকেন না, তাহলে আপনার আনহ্যাপি সেক্স লাইফ হ্যাপি হওয়ার তো কোন চান্স নেই…’ একটু চুপ করে থাকে নিশা। তারপর খুব ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে ছুড়ে দেয় প্রশ্নটা, ‘নাকি অন্য কেউ আছে?’
জাহিদ স্তম্ভিত হয়ে গেল প্রশ্নটা শুনে। ওর চশমা পরা ফরসা মুখে বিস্ময়, সংকোচ, অপমানের একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া ঘটে গেল মুহূর্তের জন্য। ওর সম্পর্কে নিশার ধারণা এতটা নিচ, এতটা হীন, এতটাই কদর্য? ঝাঁজাল গলায় বলল ‘আই কুড আস্ক ইউ দ্য সেইম কোয়েশ্চন।’
—‘আমি তো মেয়েমানুষ।’
—‘সো হোয়াট? মেয়েদের কি ফিজিক্যাল নিড থাকতে নেই?’
জাহিদ কথাটা বলতে বলতে কয়েক পা এগিয়ে এসেছে। নিশা দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এখনো। চুল থেকে গড়িয়ে পড়া পানিতে ভিজে গেছে বুকে জড়ানো তোয়ালে। মেঝেতে ছড়িয়ে আছে ফোঁটা ফোঁটা জল। জানালা দিয়ে আসা কুড়মুড়ে রোদের দুনিয়া কাঁপানো আলোয় জাহিদের কন্দৰ্পকান্তি ছিপছিপে মুখখানা এতক্ষণে একবার দেখল নিশা। আর দেখামাত্রই বুঝল এই মানুষটাও আসলে ভালো নেই। স্বার্থপরের মতো শুধু নিজের কথাই ভাবছে সে। এর ওপর দিয়েও তো কম ঝড়-ঝাপটা যাচ্ছে না। নিশা কিছুক্ষণ চুপ করে ওর দিকে চেয়ে রইল। চেয়ে থাকতে থাকতে ভেতরের রাগ, ক্রোধ, অভিমানের সমস্তটাই কেমন ঝাপসা আর ফিকে হয়ে এলো। এতক্ষণের তর্কবিতর্ক, বাদানুবাদ আর কলহকে অকিঞ্চিৎকর, তুচ্ছ বলে হলো। এসবের সত্যিই কোন অর্থ হয় না। এই মানুষটার দিকে শুধু নির্বাক চেয়ে থেকেই সে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে। জাহিদ মেঝের দিকে চোখ নিবদ্ধ করে বলল, ‘নিশা সরে দাঁড়াও। বের হব।’
হঠাৎ হেসে ফেলল নিশা, ‘আল্লাহ! আপনি কী ভীষণ লজ্জা পাচ্ছেন! লজ্জায় লাল হয়ে গেছে মুখ!’
জাহিদ খুব বিরক্ত হলো। কয়েক পা পিছিয়ে এসে অসহায় গলায় বলল, ‘দিস ইজ রিডিকিউলাস। তোমার দিকে তাকানো যাবে না। ঘর থেকে বেরোনো যাবে না…কী করতে হবে তুমিই তাহলে বলে দাও!’
নিশা কয়েক পা এগিয়ে আসে। জাহিদ না তাকিয়েও নিশার অস্তিত্বের আলোড়ন টের পায়। চেরিফুলের মতো হালকা গোলাপি আভাযুক্ত দীর্ঘ কোমল দুটি বাহু…অনাবৃত গ্রীবা…উন্নত বুক…কোমরের নিখুঁত নান্দনিক খাঁজ…..হাতের চুরির রিনিঝিনি…চুল থেকে গড়িয়ে পড়া বিন্দু বিন্দু জলে রোদের বিকিরণ…এই সমস্ত খুঁটিনাটি জাহিদের মেরুদণ্ডে শিরশিরে এক অদম্য শিহরণের সঞ্চার করে। তালাবদ্ধ অনুভূতির ঘরে ডাকাত পড়ে অপ্রত্যাশিত ভাবে। দুয়ারের তালা ঝনঝন শব্দে ভাঙতে থাকে ডাকাতদল। নিশা ওর চোখ থেকে চশমাটা খুলে নেয় আলগোছে। মুহূর্তে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসে।
— ‘কী হলো?’
— ‘আপনার রাতে ঘুম হয়নি। আপনি বরং মেয়ের পাশে শুয়ে ঘুমান। আমি চলে যাচ্ছি ঘর ছেড়ে।’
কথাটা বলতে বলতে নিশা ওর হাত ধরে বিছানার কাছে নিয়ে এলো। জাহিদ বসল বিছানায়। চোখের সামনেটা গাঢ় কুয়াশার মতো সাদা হয়ে আছে। নিশার অবয়ব ঝাপসা। ওর খোলা চুলের উড়াল ঘ্রাণ বসন্ত বনের মৌমাছির মতো জাহিদের বুকের ওপর উড়ে আসছে ঝাঁক বেঁধে।
— ‘আপনি ঘুমান। আমি জুবিনকে নিয়ে যাচ্ছি। নইলে একটু পরেই কান্না করে আপনার ঘুম ভাঙিয়ে দেবে।’
— জুবিন থাকুক। তুমিও চাইলে থাকতে পার।
— ‘না আমি যাচ্ছি… আপনার ঘুমানো দরকার।’
জাহিদ ঠোঁটের দূর কোণে একটা মিটমিটে হাসি টেনে এনে ক্ষীণ গলায় বলল, ‘ঘরের বাইরে গেলে এভাবে যেও না নিশা। গেট ড্রেসড।’
নিশা কথাটা শুনে একটু লাজুক হাসল। বলল না কিছু। ক্লজেট খুলে কাপড় বের করল। জাহিদ শুয়ে পড়েছিল। কী মনে করে আবার উঠে বসল, ‘তুরিনের একটা খবর নেয়া দরকার। এখন ঘুম আসবে না। মেয়েটার জন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছে।’
— ‘দুশ্চিন্তা করবেন না। ওর সঙ্গে ওর মা আছে তো! শাহজিদও আছে নিশ্চয়ই। শাহজিদ ওকে একলা ছাড়বে না বলেই আমার বিশ্বাস।’
নিশার মুখে শাহজিদের নামটা শুনে আবারও রক্তে একটা জ্বালার ভাব টের পায় জাহিদ। মস্তিষ্কের তিতকুটে ভাবটা ঝপ করে ফিরে আসে। চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। মনে পড়ে নিশার সঙ্গে কিছু জরুরি কথা বলার ছিল।
— ‘আমার চশমা কোথায়?’
নিশা এগিয়ে আসে। চশমা খোলার পর জাহিদের চোখজোড়ায় একটু ট্যাড়া ভাব এসে গেছে। দৃষ্টি কোনদিকে স্থির নয়। চোখের কোল ফোলা। চশমার গাঢ় দাগ বসে গেছে সরু, তীক্ষ্ণ নাকের ওপর।
— ‘চশমা লাগবে না। আপনি ঘুমান।’
জাহিদের কণ্ঠস্বর আগের চাইতে কঠোর শোনাল, ‘চশমাটা তুমি কেন নিয়ে নিলে নিশা? যেন আমি তোমাকে দেখতে না পাই? তোমার ধারণা তোমাকে দেখামাত্র আমি তোমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ব? এতটাই খারাপ মনে হয় তোমার আমাকে?’
নিশার বুক চিরে একটা ঘন শ্বাস পড়ে। অস্ফুটে বলে, ‘এত ভালো হওয়ার কী দরকার ছিল? মাঝেমাঝে একটু খারাপ হলেও তো পারেন!’
জাহিদ কান খাড়া করে— ‘কী বললে?’
— ‘না কিছু না।’
— ‘তখন কী বলেছিলে নিশা? পাহাড়ের ওপর? কীসব জায়গা জমির কথা বলছিলে যেন?’
সংকোচের দরুন নিশার মুখটা একটুখানি হয়ে যায়। চুপ করে থাকে। –’কথা বলছ না কেন?’
নিশার পায়ের তলার মাটি ক্রমেই বড় পিচ্ছিল হয়ে আসে। বুকের ভেতরের ভেঙে যাওয়া, গুঁড়িয়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাস খুঁজে খুঁজে জড়ো করার চেষ্টা করে সে। অপমানের শিলাবৃষ্টি হয় হৃৎপিণ্ডে। মনে পড়ে লোকটা অবিচল কণ্ঠে তুরিনের চোখে চোখ রেখে বলেছিল…ভালোবাসে না নিশাকে।
― ‘তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলিনি…কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কথাটা এখন বলছি, শুনে রাখুন…আমি এই বাড়িতে আর থাকতে পারব না। জুবিন আর আমাকে অন্য কোথাও পাঠাবার ব্যবস্থা করুন দ্রুত।’
জাহিদ খুব উত্তেজিতভাবে বলল, ‘তুমি যেখানে ইচ্ছা যেতে পারো। কিন্তু জুবিনকে সঙ্গে নিতে পারবে না।’
নিশার বুকে একটা জোর ধাক্কা এসে লাগে। উচ্চাঙ্গে উঠে যায় কণ্ঠস্বর, ‘আপনি আমার মেয়েকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে চান? ওই মেয়ে ছাড়া আমার আর আছে কে?’
— ‘নিশা, আমার চশমাটা দাও। তোমার সঙ্গে জরুরি কথা আছে। জরুরি কথা চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে হয়।
নিশা উচ্চবাচ্য না করে চশমাটা ত্বরিত গতিতে গুঁজে দিল জাহিদের হাতে। চশমা চোখে দিতেই চারিদিক রোদের প্লাবনে ঝলসে উঠল। নিশার ডাগর দুটি চোখ…চেরিফুলের গোলাপি আভায় চিকচিক করা গাল আর সুডৌল বাহু, দিঘল গ্রীবায় জমে থাকা বিন্দু বিন্দু রুপালি জল…সাদা টাওয়েল জড়ানো মোমের মতো মসৃণ বুকের নিখুঁত ভাঁজ…সমস্তটাই দৃশ্যমান হয়ে উঠল একযোগে। জাহিদের হৃদযন্ত্র অচল হয়ে পড়ল মুহূর্তের জন্য। শ্বাস নিতে ভুলে গেল সে। চট করে চশমাটা খুলে ফেলল আবার। রুদ্ধশ্বাসে বলল, ‘থাক…চশমা ছাড়াই ভালো আছি!’
এই এক বাক্যের মধ্যে কত দুর্মোচ্য পিপাসা, অতৃপ্তি এবং হতাশা চাপা দেওয়া ছিল তা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, রোষপরবশ নিশা টের পেল না। সে অধৈর্য গলায় বলল, ‘কী জরুরি কথা বলবেন বলেছিলেন? বলে ফেলুন।’
জাহিদ বিছানার হেডবোর্ডে মাথাটা এলিয়ে দিল। চোখজোড়া বুজে নিয়ে বলল, ‘জুবিন আমার সঙ্গেই থাকবে। তুমি যদি শাহজিদের সঙ্গে কোথাও মুভ করতে চাও…করতে পারো। আমার আপত্তি নেই। কিন্তু আমার মেয়েকে আমি ছাড়তে পারব না।’
বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেল নিশা। কয়েক সেকেন্ড হাঁ করে চেয়ে রইল শুধু। কিছু বলতে পারল না। জাহিদ বলে চলল, ‘দ্যাখো আমি তোমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়। এত বয়সের তফাতে সংসার করা যায় না। আমি বিষয়টা বুঝি। শাহজিদকে যদি তোমার ভালো লাগে…এতে দোষের কিছু নেই। তুমি আধুনিক, শিক্ষিতা মেয়ে। সামনে তোমার অনেকটা পথ যেতে হবে। এই পরিবারের জন্য নিজের জীবনটা অযথা কেন নষ্ট করবে? জুবিনের দায়িত্ব তোমাকে নিতে হবে না। শাহজিদ হাই-প্রোফাইল জব করে। সে এই বাড়িতে কেন এতগুলো দিন ধরে আশ্রিত হয়ে পড়ে আছে, তা আমি এখন বুঝতে পারছি। তোমার জন্যই আছে। ওকে আর অপেক্ষায় রেখো না। যত দ্রুত সম্ভব তোমরা সম্পর্কটাকে লিগ্যাল করে নাও।’
নিঃসীম বিস্তৃত একটা আকাশ যেন টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ছিল নিশার মাথার ওপরে। স্তব্ধ, বিহ্বল চোখে চেয়ে আছে সে সামনে বসা মানুষটার দিকে। অভিমানের ঘন বাষ্পে ভরে গেছে বুক। গলা কাঁপছে…এত বেশি কাঁপছে যে সে কোন শব্দ উচ্চারণ করতে পারছে না। তবে জীবনে এই প্রথমবারের মতো সে বুঝতে পারছে ভালোবাসার চাইতেও আত্মসম্মান, আত্মাভিমানের দাম অনেক বেশি। ভালোবাসা ছাড়া বেঁচে থাকা যায়, কিন্তু নিজের প্রতি ন্যূনতম সম্মানটুকুও যে মানুষ হারিয়ে ফেলে, জীবনযুদ্ধের এই অমোঘ পরিক্রমায় মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকা তার জন্য দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। এই লোকটা নিশাকে তাড়ানোর জন্য অন্য একজনের সঙ্গে জোরপূর্বক তার নাম জুড়ে দিতে চাইছে। অপবাদ দিতে চাইছে। পৃথিবীতে এর চেয়ে বড় অবমাননা বোধহয় আর হয় না।
জাহিদের পিঠ তখনো হেডবোর্ডে হেলানো, পা টানটান করে ছড়ানো সামনে। চোখ বুজে রাখা অবস্থায়ই সে ধীরস্থির গলায় বলল, ‘আমি চাই না তুমি মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এই সংসারে টিকে থাকার যুদ্ধ করে যাও। শাহজিদের বাবা-মা নেই। দুর্ঘটনায় পা হারিয়ে পঙ্গু জীবন যাপন করছে। ছেলেটাকে মিছে আশায় রেখ না। ওকে বিয়ে করলে তুমি অনেককিছুই পাবে, যা এই বাড়িতে থেকে পাবে না।’
নিশা একটা দীর্ঘ কণ্টকময় শ্বাস ফেলল, ‘আর কিছু বলার আছে আপনার?’
—‘আর বিশেষ কিছু বলার নেই। তোমাকে এই অভিশপ্ত জীবন থেকে আমি মুক্তি দিলাম নিশা! তুমি নিজের জীবন গুছিয়ে নাও। এতে তোমার মঙ্গল হবে। তুরিনও খুশি হবে। দেখেছ তো মেয়েটা কী পরিমাণ ডেস্পারেট হয়ে উঠছে দিনকে দিন। শুধু একটা অনুরোধ থাকবে…জুবিনকে আমার কাছ থেকে নিয়ে যেও না। আমার জীবনে জুবিন আর তুরিন ছাড়া কেউ নেই। একটু বোঝার চেষ্টা করো প্লিজ।’
নিশা অপ্রকৃতস্থ অট্টহাসি হেসে উঠল হঠাৎ। হাসতে হাসতেই বলল, ‘আর শাহজিদ যদি আমাকে বিয়ে করতে না চায়…তখন কী হবে বলুন তো?’
জাহিদ সোজা হয়ে বসল। গম্ভীর গলায় বলল, ‘বিয়ে করতে চাইবে না কেন? প্রয়োজনে আমি নিজে ওর সঙ্গে কথা বলব এই ব্যাপারে।
নিশা খিলখিল করে হাসতে থাকল পাগলের মতো। চোখে চিকচিক করতে লাগল অশ্রুজল। হাসির মধ্যেও যে কত বেদনা, কত যন্ত্রণা আর ক্ষোভ লুকোনো থাকতে পারে তা নিশার এই অদ্ভুতুড়ে হাসিটা নিজ চোখে না দেখলে বোধহয় কেউ কোনদিন সত্যিকার অর্থে অনুভব করতে পারবে না। সেই সময় ঘরের দরজায় যেন ডাকাত পড়ল। ওপাশ থেকে ভেসে এলো তুরিনের গলা ফাটানো চিৎকার, ‘বাবা!…বাবা!’
এই চিৎকারে ছোট্ট জুবিনটা ভয়ে কেঁপে উঠল থরথরিয়ে। ঘুমের মধ্যেই ঠোঁট ফুলিয়ে, হাত-পা ছুঁড়েকাঁদতে লাগল। জাহিদ চোখে চশমা লাগিয়ে তড়িঘড়ি করে কান্নারত বাচ্চাকে কোলে তুলে নিল। দরজায় তখনো উপর্যুপরি আঘাত চলছে। জাহিদ নিশার দিকে একবার তাকাল। স্থিরচিত্র হয়ে বসে আছে। জুবিনকে কোলে নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল সে। নিশা হঠাৎ ডাকল পেছন থেকে, ‘শুনুন!’
দরজার আঘাতের শব্দ আর জুবিনের কান্নার স্বর সব কিছুকে ছাপিয়ে যাচ্ছে একদম। জাহিদ অস্থির ভাবে বলল, ‘বলো, শুনছি।’
— ‘যতদিন এই বাড়িতে আছি, আপনি আমার সঙ্গে আর একটি কথাও বলবেন না। আমি আপনাকে ঘৃণা করি!’
নিশার মুখনিঃসৃত দৃঢ় বচনখানি জাহিদের বুকের মধ্যে তীক্ষ্ণমুখ শেলের মতো এসে বিঁধল। যন্ত্রণায় নীল হয়ে উঠল ওর মুখ। কী যেন একটা বলতে গিয়েও বলল না আর। নতশিরে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। তুরিন, ফারা আর আনিতা দাঁড়িয়ে আছে দরজার ওপাশে। তুরিন জাহিদকে দেখামাত্র উত্তেজিত গলায় বলল, ‘বাবা হোয়াট দ্য হেল আর ইউ ডুইং হিয়ার?’
জাহিদের মুখে ভয়াবহ ভাঙচুরের ছাপ। মেয়ের দিকে ব্যথিত চোখে চেয়ে রইল শুধু। কোন প্রত্যুত্তর করতে পারল না। এদিকে জুবিন কেঁদে যাচ্ছে আনিতা এগিয়ে এসে জুবিনকে কোলে তুলে নিল। জাহিদ আপত্তি করল না। আনিতার কোলেই বাচ্চাকে গছিয়ে দিল। তুরিন ফারার হাতের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পায়ে ব্যান্ডেজ। জাহিদ এগিয়ে এসে ওর অপর হাতটা ধরল।
তুরিন বলল, ‘বাবা আই ডোন্ট ওয়ানা সি ইউ ইন দিস রুম এনিমোর। জুবিনকে আমরা আমাদের কাছেই রাখতে পারি। আই কুড ইভেন টেক কেয়ার অব দ্যাট কিড। নো বিগডিল!’
জাহিদ এবারেও মেয়ের কথার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বলল না। একটা অনুচ্চার্য, ব্যাখ্যাতীত কষ্টে ওর বুকটা খণ্ড খণ্ড হয়ে যাচ্ছিল। নিশা কথাটা এভাবে না বললেও পারত। জাহিদ তো বুঝেই নিয়েছিল! মুখ ফুটে বলাটা কি খুব বেশি জরুরি ছিল?
৯
নিজেকে এতটা অচেনা এর আগে কোনদিন লাগেনি শাহজিদের। তার জীবনের একমাত্র প্রেম ছিল পাহাড়। যেদিন আকস্মিক দুর্ঘটনায় ডান পা-টা খুইয়ে ফেলল আজীবনের জন্য, ঠিক সেদিন থেকে এই পাহাড়ই হলো সবচাইতে বড় শত্রু…বড় দুঃখ…এবং দীর্ঘশ্বাস! পাহাড়ের বিচ্ছেদ তাকে পীড়ন করে অষ্টপ্রহর। জীবনে আর কোনদিন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মতো তরতর করে পাহাড়ে বাইতে পারবে না, এই একটিমাত্র তিতকুটে সত্য তার আত্মবিশ্বাসের খুঁটিতে আঘাত হেনে যায় অনবরত। শাহজিদের মনে অন্য কোন আক্ষেপ ছিল না, অভিযোগ বা খেদ ছিল না। শুধু এক বুকভর্তি পাহাড়ের বিচ্ছেদের শূন্যতা ছিল। বিরহ ছিল। যে মানুষ কখনো পাহাড়ের প্রেমে পড়েনি, সে মানুষ এই বিরহের যাতনা কোনদিন অনুভব করতে পারবে না। কিন্তু আজ যেন জীবনে প্রথমবারের মতো একটা অন্তর্নিহিত অনির্বচনীয় চৈতন্যর উদয় হলো দ্বিধা, দ্বন্দ্ব এবং বিভ্রমের মেঘে ঢাকা ধূসর মনের আকাশে। ঠিক যে মুহূর্তে অর্ণব তুরিনকে স্পর্শ করেছিল…শাহজিদের আবাল্য চেনাজানা পুরনো পৃথিবীর রংটা যেন ঠিক সেই মুহূর্তেই পাল্টে গেল। গাছের গা থেকে পাতা খসে যাওয়ার মতো, শাহজিদের দেহ আর আত্মা থেকে প্রাণের প্রতিটি স্পন্দন এবং উষ্ণতার অস্তিত্ব যেন একটা একটা করে ঝরে পড়তে লাগল।
বুকের সব উষ্ণ রক্তকণা একপাশে সরে গিয়ে মিশে যেতে লাগল মৃত্যুর মতো কোন এক শীতলতম নিস্তব্ধ হিমঘরে।
আজ একটা অটল সিদ্ধান্তে বদ্ধপরিকর হলো সে। সময় নষ্ট না করে মুর্তজা সাহেবের নম্বরে ডায়াল করল। দুবার রিং পড়তেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো গম্ভীর ভরাট কণ্ঠ।
— ‘হ্যালো।’
— ‘হ্যালো আংকেল!’
— ‘কেমন আছ শাহজিদ?’
— ‘আছি ভালোই। আপনার সঙ্গে একটু কথা ছিল। সময় হবে?’
— ‘আমি তো বাড়ির দিকেই ফিরছি। তুমি কি সামনাসামনি কথা বলতে চাও? নাকি ফোনেই বলবে?’
— ‘যেভাবে আপনার সুবিধা।’
— ‘বলো কী বলতে চাও।’
শাহজিদ একটা বড় শ্বাস টেনে নিল। মনে মনে কথা গুছিয়ে নিয়ে বলল, ‘আংকেল আমি এখানে আর থাকতে চাই না। অন্য কোথাও মুভ করতে চাই। অনেকদিন তো হলো। আপনি আমার জন্য যথেষ্ট করেছেন। তা ছাড়া আপনার প্রতি আমার কোন ক্ষোভ নেই… অভিযোগ নেই।’
মুর্তজা সাহেব একটু সময় চুপ করে ভাবলেন কিছু একটা। চিন্তিত স্বরে বললেন, ‘তুমি বাচ্চা একটা ছেলে, একা একা থাকবে কী করে?’ একথা শুনে শাহজিদ মনে মনে একটু বাঁকা হাসল। মুর্তজা সাহেব নিশ্চয়ই ‘বাচ্চা একটা ছেলে’ কথাটা উল্লেখ করেছেন নেহাত ভদ্রতা রক্ষার খাতিরে। আসলে তার কথার অন্তর্নির্বিষ্ট ভাববস্তু হলো, তুমি পঙ্গু একটা ছেলে একা একা থাকবে কী করে? শাহজিদ মনের বাঁকা হাসিটুকু মনে গচ্ছিত রেখেই মুখে গাম্ভীর্য টেনে এনে বলল
— ‘আপনি তো ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু করেননি। কেন সব সময় গিলটি ফিল করেন আংকেল?’
— ‘তুমি কি অন্য কোন স্টেটে মুভ করার কথা ভাবছ?’
— ‘আপাতত ডেনভারে একটা অ্যাপার্টমেন্ট রেন্ট করব।’
—‘তাহলে ভাড়াটা আমি দেব।’
— ‘না না…প্লিজ! আই ক্যান অ্যাফর্ড মাইসেলফ!’
— ‘আমি জানি তুমি সাবলম্বী এবং সাহসী একজন যুবক। তবুও তোমার জন্য কিছু করতে চাই শাহজিদ!’
কথাটা শোনার পর কেন যে শাহজিদের মানসপটে তুরিনের খরগোশের মতো আদুরে আর ইনোসেন্ট চেহারাটা আচমকা টর্চের আলোর মতো ঠিকরে পড়ল, কে জানে! বুকের আবছা কোণে সম্পূর্ণ অচেনা-অজানা এবং আনকোরা এক আকাঙ্ক্ষার ক্ষীণ বিচ্ছুরণ টের পেল সে। সাবধানে বলল, ‘আমার কিছু প্রয়োজন হলে আমি নিজেই আপনার কাছ থেকে চেয়ে নেব। এই তিন বছর আপনার বাড়িতে বিনামূল্যে থেকেছি, খেয়েছি। আপনি যথেষ্ট করেছেন।’
— ‘আমি তোমার যে ক্ষতি করেছি…সেই ক্ষতি যে কিছুতেই পূরণ হওয়ার নয়!’
শাহজিদ একটা দীর্ঘশ্বাস চাপা দিয়ে বলল, ‘ক্ষতিপূরণের কথা আমি ভাবিই না কখনো! তবে যদি আপনার কাছে সত্যিই কখনো কিছু চাই…আপনি দেবেন তো?’
মুর্তজা সাহেব উৎসুক গলায় বললেন, ‘কীসের কথা বলছ? কী চাও তুমি শাহজিদ?
— ‘কী চাই তা আমি নিজেও এখনো সঠিক জানি না। জানতে পারলে অবশ্যই জানাব। আপাতত এটুকু জেনে রাখুন আমি মুভ করছি। এখানে থাকা আমার পক্ষে আর সম্ভব না।’
— ‘শাহজিদ শোন…তোমার সঙ্গে কি বাড়ির কেউ দুর্ব্যবহার করেছে? শাহজিদ চুপ করে রইল। মুর্তজা সাহেব বললেন, ‘তুমি কেন এই বাড়িতে আছ, কার অনুরোধে আছ-এসব কিছুই বাড়ির লোকে জানে না। হতে পারে এ কারণে অনেকেই তোমাকে সঠিক সম্মানটুকু দেখাতে চায় না। তোমার অ্যাক্সিডেন্টের জন্য আমিই দায়ী। আমার গাড়ির চাকার নিচেই তোমার একটা আস্ত পা পিষে গেছে। এ কারণে আমি তোমার কাছে আজীবন অপরাধী হয়ে থাকব। তোমার দেখাশোনার দায়িত্ব নেয়ার মাঝে নিজের পাপমুক্তির একটা পথ খুঁজে পাই। এটাই আমার স্বস্তি। প্লিজ এই স্বস্তিটুকু থেকে আমাকে বঞ্চিত করো না। তুমি চাইলে আমি বাড়ির সবার সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলতে পারি।’
— ‘না না…আমি আমার ব্যক্তিগত ইস্যু নিয়ে কারো সঙ্গে কথা বলতে চাই না।’
শাহজিদ দেখল স্লাইডিং ডোরের ওপাশে অর্ণব এসে দাঁড়িয়েছে। কথা সংক্ষিপ্ত করে লাইন কেটে দিল। হুইলচেয়ারের চাকা ঘুরিয়ে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। অর্ণব ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ‘সরি শাহজিদ ভাই। ডিস্টার্ব করলাম অসময়ে।’
— ‘আরে না…ডিস্টার্ব কীসের?’
অর্ণবের মুখে একটা ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া ভাব লক্ষ করল শাহজিদ। বিস্মিত গলায় বলল, ‘আপনি ঠিক আছেন?’
অর্ণব ঘরের মাঝামাঝি স্থানে দাঁড়িয়ে হুইলচেয়ারে বসা শাহজিদের দিকে একটু সময় ফাঁকা চোখে চেয়ে রইল। আর ঠিক তখনই গতকাল সকালের সেই গিরিখাদের ভেতরের টুকরো ঘটনাটা মনে পড়ল শাহজিদের। অপরাধ বোধের কাঁটা খচখচ করে উঠল মনে। সেই সঙ্গে একটা অদ্ভুত গা-শিরশিরে অনুভূতি। আশ্চর্য! তুরিনের মতো নেহাত বোকা, হিংসুক, অপরিণত মস্তিষ্কের একটা মেয়েকে মনে করতে গিয়ে শাহজিদের মতো ব্যক্তিত্ববান, বিবেচক যুবকের হৃৎপিণ্ড শিহরিত হবে…এটা কোন যৌক্তিক কথা হলো? নিজের মনের যুক্তিবিরূদ্ধ, অবান্তর আচরণে সীমাহীন বিরক্ত হলো শাহজিদ। অর্ণবের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারল না। অর্ণব বলল, ‘শাহজিদ ভাই, একটা প্রশ্ন ছিল আপনার কাছে।’
— ‘জি বলুন।’ একটু থেমে শাহজিদ যোগ করল, ‘আপনি দাঁড়িয়ে কেন? বসুন না, প্লিজ বসুন।’ বলল ঠিকই। কিন্তু কোথায় বসতে দেবে? বিছানাটা বড্ড এলোমেলো, একটা মাত্র চেয়ার আছে ঘরে, সেই চেয়ারটাও কাপড়- চোপড়ে বোঝাই। নিশা রোজ ঘর গুছিয়ে দেয়, পরিষ্কার করে। কিন্তু গত দুদিন ধরে সে এদিকে আসেনি। তাই ঘরের অবস্থা যাচ্ছেতাই। শাহজিদ একটু লজ্জিত স্বরে বলল, ‘আমার ঘর একদম মেসড আপ হয়ে আছে। সরি…আপনাকে যে কোথায় বসতে দিই…’
অর্ণব এলোমেলো বিছানাটার ওপরেই ধপাস করে বসে পড়ে বলল, ‘আচ্ছা…ওই মেয়েটার সঙ্গে এই বাড়ির সম্পর্ক কী?’
—‘কোন মেয়ে?’
— ‘যে মেয়েটি বাচ্চা কোলে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল।’
শাহজিদ একটু অপ্রস্তুত হলো। নিশার ব্যাপারে অর্ণবকে এখনো কিছু জানানো হয়নি? অথচ ওর সঙ্গে তুরিনের বিয়ের কথা চলছে। পরিবারের আদ্যপান্ত পাত্রপক্ষকে না জানিয়ে ধোঁকা দিয়ে মেয়ে বিয়ে দেবার মতো অবিবেচক মানুষ মুর্তজা সাহেব নন। তাহলে এখন অবধি তিনি নিশার ব্যাপারটা অর্ণবের কাছ থেকে গোপন রেখেছেন কেন? সঠিক সময়ের অপেক্ষায়? শাহজিদ একটু দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বলল, ‘আপনাকে ওর বিষয়ে কিছু বলা হয়নি?’
— ‘না।’
— ‘অন্যের পারিবারিক ব্যাপারে আমার কথা বলাটা ঠিক হবে না। আপনি সরাসরি তুরিনের সঙ্গে কথা বলুন। কিংবা তুরিনের বাবার সঙ্গে।’
অর্ণব একটু ম্লান হেসে বলল, ‘উনারা নিজ থেকে কিছু না জানাতে চাইলে আমি ঘাঁটাব না।’
— ‘তুরিনের সঙ্গে আপনার সবকিছু ঠিকঠাক?’ সাবধানে প্রশ্ন করে শাহজিদ।
— ‘ঠিকঠাক বলতে?’ অর্ণবের সরল প্রশ্ন।
বুকের উৎকণ্ঠা নিবৃত্তের বৃথা চেষ্টা করে শাহজিদ। নিজের বাঁ পায়ের ভাঙা আঙুলের ওপর অস্থির দৃষ্টি রেখে অনেকটা চাপা গলায় বলে, ‘বিয়েটা হচ্ছে?’ অর্ণব হাসল, ‘মনে হয় হচ্ছে না।’
— ‘কেন?’ প্রশ্নটার সঙ্গে কেন যে একটা স্বস্তির শ্বাস অজান্তেই বেরিয়ে এলো শাহজিদের বুক চিরে! উফ…নিজেকে প্রচণ্ড বিরক্ত লাগছে এই মুহূর্তে। অসহ্য!
‘উনার খুব সম্ভবত আমাকে পছন্দ হয়নি। আমার বাবা অবশ্য চাইছেন বিয়েটা যেন হয়ে যায়। আসলে আমার পিতা দারিদ্রতার সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে নৈতিক জ্ঞান হারিয়েছেন। তার ধারণা এই বিয়ে হয়ে গেলেই আমাদের চৌদ্দগুষ্টির অভাব-অনটন দূর হয়ে যাবে।’
— ‘মুর্তজা আংকেলও তো চাইছেন বিয়েটা হয়ে যাক, তাই না?’
— ‘জি। তিনি পাত্র হিসেবে আমাকে খুবই পছন্দ করেছেন।’ একটু লাজুক গলায় বলল অর্ণব।
১০
— ‘কেন এসেছ এ বাড়িতে?’ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে প্রশ্ন করেন মিসেস মুর্তজা।
অনিমেষ গায়ে জ্বালা ধরানো হাসি হাসে। লঘু গলায় বলে, ‘কেন আন্টি? আসা কি নিষেধ নাকি? আমার মেয়েকে দেখতে আমি আসতে পারি না?’
— ‘আস্তে!’ দাঁতে দাঁত চেপে শব্দটা উচ্চারণ করেন মিসেস মুর্তজা। লিভিংরুমের কর্নারের একটা সোফায় বসে আছেন তিনি। অনিমেষ দাঁড়িয়ে আছে সামনে। প্যান্টের পকেটে হাত। মুখে ড্যাম কেয়ার ভাব। চোখে-মুখে ঝিলিক দিচ্ছে নির্লজ্জ হাসি। মিসেস মুর্তজার বয়সের ভারে কুঞ্চিত হয়ে আসা চেহারার ত্বকে ঘৃণা এবং তাচ্ছিল্যের দৌরাত্ম্য। একটি টাঙ্গাইলের সুতির শাড়ি আর ফুলহাত ব্লাউজ তাঁর পরনে। মাথায় আঁচল টানা। চোখে চশমা। সেই চশমার কাচ ভেদ করে এখন ঠিকরে বেরোচ্ছে ক্রোধ। বিষঝরা কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘তোমাকে এই বাড়িতে আসতে অনেকবার নিষেধ করা হয়েছে। এর পরেও বেহায়ার মতো আসো কেন? লজ্জা-শরম বলতে কি কিছুই নাই?’
— ‘আমিও অনেকবার বলেছি আমার মেয়েটাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিন। আপনারা তো এই প্রস্তাবে রাজি হলেন না।’
মিসেস মুর্তজা কঠিন গলায় বললেন, ‘তুরিন এ বাড়ির মেয়ে। তোমার মেয়ে না। খবরদার এমন কথা আর কোনদিন মুখে আনবা না।’
— ‘তুরিন আমার মেয়ে। বিষয়টা আপনি এবং আপনার হাজবেন্ড খুব ভালোমতো জানেন। এর পরেও দিনের পর দিন সত্যটা চাপা দিয়ে যাচ্ছেন। এর চেয়ে বড় অপরাধ কিন্তু আর হয় না।’
— ‘এতো দেখছি ভূতের মুখে রাম-নাম! সত্যটা যদি তোমরা সবার প্রথমেই খোলাসা করে বলতে তাহলে এই দিন দেখতে হতো না। ফারা আমার ছেলেকে বিয়ে করেছে মিথ্যে কথা বলে। এত বড় অপরাধের পর ওকে হজম করছি শুধু আমার ছেলে আর নাতনির মুখের দিকে চেয়ে। এই জঘন্য সত্য যদি তুরিনের জ্ঞান হওয়ার আগেই আমাদের সামনে আসত তাহলে…’
— ‘তাহলে?’
— ‘তাহলে ফারাকে জুতাপেটা করে এই সংসার থেকে বিদায় করতাম। তোমরা যে অপরাধ করেছ তার কোন ক্ষমা হয় না। এই ঘটনা জানতে পারলে আমার ছেলেটা ভয়ংকর কষ্ট পাবে। মরে যাবে সে। তুরিনও সহ্য করতে পারবে না। তুমি কি এই সহজ-সরল বাচ্চা- মেয়েটাকে মেরে ফেলতে চাও?’
— ‘মেরে ফেলতে চাই না, তবে সত্যটা জানাতে চাই।’
মিসেস মুর্তজা ব্যথিত গলায় বললেন, ‘তোমার মনে কি একটু মায়াদয়া নাই? মেয়েটা পাগল হয়ে যাবে এই কথা জানতে পারলে। জাহিদকে সে নিজের জীবনের চাইতেও বেশি ভালোবাসে।’
অনিমেষের মুখটা শক্ত হয়ে ওঠে, ‘সত্য প্রকাশ হবে আজ নয় কাল … তুরিনকে জানতে হবে…জাহিদকেও জানতে হবে।’
মিসেস মুর্তজা ব্যাকুল স্বরে বললেন, ‘আমি হাতজোড় করে অনুরোধ করছি তোমাকে। এত বড় নিষ্ঠুরতা করো না। তুমি ফারাকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাও। এখনো তোমাদের বয়স কম। চাইলেই জীবনটা নতুন করে শুরু করতে পারবে।’
— ‘আপনারা তো আপনাদের ছেলেকে আবার বিয়ে করালেন, সেখানে তার নিজের সন্তান আছে। আমাকে কেন আমার সন্তানের কাছ থেকে দূরে সরাতে চাইছেন?’
— ‘একথা বলতে তোমার লজ্জা করল না? সত্যিই যদি তোমার সন্তানের প্রতি এত মায়া থাকত তাহলে সেই সময় ফারাকে বিয়ে করোনি কেন? কেন আমার ছেলের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছিলে নিজের অপকর্মের বোঝা?’
— ‘কারণটা আপনাকে বলার আমার কোন প্রয়োজন নেই। তবুও বলছি, ফারার বাবা মা অন্য ধর্মের ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে চাননি।’
মিসেস মুর্তজা দুদিকে মাথা নাড়তে নাড়তে গম্ভীর ভাবে বললেন, ‘অনেক বড় পাপ করেছ তোমরা অনিমেষ…অনেক বড় পাপ! এই পাপের ক্ষমা নেই। ‘ অনিমেষ বিরক্ত হয়, ‘আর কিছু বলবেন?’
— ‘তোমাকে বারবার অনুরোধ করছি, প্লিজ সত্যটা চেপে যাও। আমার ছেলের এত বড় সর্বনাশ করো না। তুরিন ওর প্রথম সন্তান। মেয়েটাকে সে মনে প্রাণে ভালোবাসে। এত বড় প্রতারণা ও সহ্য করতে পারবে না।’
— ‘চেষ্টা করব ঘটনা চেপে যাওয়ার। তবে কথা দিতে পারছি না। আপনারা বাংলাদেশ থেকে কোন এক গেঁয়ো ছেলে ধরে এনে আমার মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিতে চাইছেন। এই ব্যাপারে আমার আপত্তি আছে।’
— ‘তুরিন ছেলেটাকে পছন্দ করলেই বিয়ে হবে। নইলে নয়।’
— ‘এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়ার কী দরকার?’
— ‘এই দেশে ছেলেমেয়েদের তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়াই ভালো। নইলে অঘটন ঘটার সম্ভাবনা থাকে। বিধর্মী কাউকে ধরে নিয়ে এসে যদি বলে একে বিয়ে করতে চাই। তখন কী হবে?’
— ‘ধর্মটা আপনাদের কাছে অনেক বড় ইস্যু, তাই না?’
— ‘হ্যাঁ…অনেক বড় ইস্যু।’
১১
বেডরুমে ঢুকতেই ফারা ধারাল কণ্ঠে বলল, ‘তোমার সমস্যাটা কী আমি বুঝলাম না। এত কিছুর পরেও ওই ঘরে গিয়ে বসে ছিলে কেন?’
জাহিদ ক্লান্ত চোখে তাকাল ফারার দিকে, ক্লান্ত গলায় বলল, ‘তাতে তোমার কী?
— ‘মেয়েটাকে তো দেখছ। দিন দিন ডিপ্রেসড হয়ে যাচ্ছে। ডোন্ট ইউ ফিল ব্যাড ফর হার? ওর জন্য কি তোমার কিছুই করার নেই?’
জাহিদ ওয়াক ইন ক্লজেটের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। হ্যাঙ্গারে ঝুলানো তোয়ালে কাঁধে তুলে নিয়ে ভাবলেশহীন গলায় বলল, ‘কী করতে হবে?’
— ‘ওই মেয়েটাকে আর ল্যাংড়া ছেলেটাকে একসঙ্গে কোথাও পাঠিয়ে দিলেই তো পার। আজকে তো চলেই যাচ্ছিল। তোমার মা আটকাতে গেল কেন?
জাহিদ ক্লজেট থেকে বেরিয়ে এলো। ফারার চোখে চোখ রেখে শীতল স্বরে বলল, ‘ইটস নান অব ইয়োর বিজনেস। ডোন্ট এক্সিড ইয়োর লিমিটস।’
‘আমার মেয়েটাকে চোখের সামনে এভাবে শেষ হয়ে যেতে দেখব, কিন্তু কিছুই বলতে পারব না?’
জাহিদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘ফারা শোন, আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে ইন্টারফেয়ার করো না। আর নিশার বিরুদ্ধে তুরিনকে উসকে দিও না। যদি দাও…’
— ‘কী হবে দিলে?’
— ‘অনিমেষের সঙ্গে তোমার অ্যাফেয়ারের ব্যাপারে তুরিন এখনো কিছু জানে না। তুমি নিশাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে আমি কিন্তু তুরিনের কাছে মুখ খুলতে বাধ্য হব।’
ফারার চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে উঠল চকিতে। ভয়ের একটা ঢেউ মুহূর্তের মধ্যে শুষে নিল মুখের সব রক্ত। হতভম্ব গলায় বলল, ‘তুমি আমাকে থ্রেট করছ?’
জাহিদ শ্রাগ করল, ‘সর্ট অফ।’
— ‘এর মানে তুমি ওই অসভ্য মেয়েটাকে ছাড়বে না?’
জাহিদের মুখে একটা অভ্রভেদী কঠোরতা নেমে আসে। চোয়াল হয়ে ওঠে লোহার মতো শক্ত। গমগমে স্বরে বলে, ‘আমি একবারই বলেছি আমার পারসোনাল ব্যাপারে তোমার সঙ্গে কোন কথা বলতে চাই না। তুমি সেই অধিকার হারিয়েছ অনেক আগে। আর একটা বিষয়, সবসময় নিশাকে নিয়ে আজেবাজে কথা বলো কেন? সমস্যা কী?’
— ‘কেন? ওকে নিয়ে বাজে কথা বললে তোমার বুঝি খুব লাগে?’
— ‘হ্যাঁ লাগে।’
— ‘এত লাগে কেন? প্রেমে পড়ে গেছ নাকি?’
‘তুমি কেন এখনো এই সংসারে পড়ে আছ বলো তো? অনিমেষ কি তোমাকে পুরোপুরি চায় না? এখানে থেকে তোমার লাভটা কী হচ্ছে? নাকি অনিমেষ হিন্দু বলে ওকে বিয়ে করা সম্ভব হচ্ছে না?’
রাগে ফারার মুখটা বিকৃত হয়ে উঠল, ‘আমি এখানে আছি শুধু আমার মেয়ের জন্য।’
—‘তাহলে মেয়েকে নিয়েই ভাবো। আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না।’
‘তুমি কি এখনো বিশ্বাস করোনি ওই ক্রিপলড ছেলেটার সঙ্গে তোমার নিশার প্রেম চলছে?’
জাহিদ চুপ করে রইল। ফারা জোরালো গলায় বলল, ‘সকাল বিকাল চব্বিশ ঘণ্টা নিশা বেজমেন্টে গিয়ে বসে থাকে। একটা ব্যাচেলার ছেলের ঘরে সে করেটা কী? বনে-জঙ্গলে দিনে দুপুরে ঘুরে বেড়ায়। আমার কাছে ছবি আছে ওদের ইনটিমেট মোমেন্টের। তুমি কি ছবি দেখতে চাও?’
কথাটা শুনে কান ঝাঁঝাঁ করে উঠল। রক্তে জ্বালা টের পেল জাহিদ। বিষের ছোবল এসে লাগল মনে। শক্ত গলায় বলল, ‘না। আমি কিছুই দেখতে চাই না।’
ফারা এগিয়ে এসে ওর একটা হাত ধরল, ‘জাহিদ লিসেন, আমি অনিমেষকে ছেড়ে দেব। আমার কাছে অনিমেষের চাইতে এই ফ্যামিলি অনেক বেশি ইম্পরট্যান্ট। তুমি…তুমি ফিরে এসো আমার কাছে…ফিরে এসো আমার মেয়ের কাছে…নিশাকে ভুলে যাও।’
জাহিদ হাতটা ছাড়িয়ে নিল। একটা গভীর হতাশার শ্বাস পড়ল ওর। ঝাঁক বাঁধা হতাশায় ডুবে থেকেই বিষণ্নভাবে বলল, ‘তোমার সঙ্গে আমার আর কখনোই কিছুই হবে না ফারা। কারো সঙ্গেই হবে না। বিশ্বাস জিনিসটা আমার মন থেকে পুরোদমে উঠে গেছে!’
কথাটা শুনে কেন যেন ফারার মুখে একটা প্রচ্ছন্ন স্বস্তির আভাস পড়ে। সাবধানে বলে, ‘নিশাকে বিশ্বাস করা ঠিক হবে না। তুমি বরং ওকে ওই ছেলেটার সঙ্গেই থাকতে দাও।’
জাহিদ কঠিন চোখে তাকায়, ‘তুমিও আমাকে আমার মতো থাকতে দাও ফারা! শেষবারের মতো বলছি, আমার ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করো না।’
কালারে কইরো গো মানা
সে যেন আমার কুঞ্জে আসে না।
—অমর পাল বাউল
.
নিশা কেন বলেছিল কথাটা? হঠাৎ…একদম হঠাৎ করে…এতকাল বাদে? জাহিদের প্রতি ওর ঘৃণাটা যদি পুরনোই হয়ে থাকে, তবে নতুন করে সেই উপলব্ধিকে আজ এমন জোরেশোরে স্বীকৃতি দেবার কারণ কী?
— ‘বাবা!’ আচমকা ছুটে আসা ডাকটা জাহিদের ভাবনার জাল ছিন্ন করল। একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে আসছে তুরিন। মুখখানা শীর্ণ। চোখ লালচে। নীল সাদা চেকের পাজামা সেট ওর পরনে। সিল্কি চুলগুলো ছড়িয়ে আছে পিঠে। বাবার পাশে বসে পড়ে বলল, ‘কী ভাবছ?’
জাহিদ চিন্তামগ্ন দুটি বিষণ্ণ চোখ মেলে মেয়েকে দেখল। হাসল সামান্য। মেয়েটা হঠাৎ করেই অনেক বড় হয়ে গেছে। মেয়েরা কি খুব তাড়াতাড়ি বড় হয়? অবশ্য এই বয়সে জাহিদ বাবা হয়েছিল। এইটুকু বয়সে বাবা হওয়ার মতো মানসিক পরিপক্বতা ছেলেদের আসে না। কিন্তু তুরিনের জন্য জাহিদকে রাতারাতি একজন দায়িত্বশীল পিতায় পরিণত হতে হয়েছিল। ছোট্ট একটা তুলার বস্তা ছিল তুরিনটা। জীবনের সবচাইতে প্রিয় খেলনার মতো, প্রিয় অভ্যাসের মতো, সারাদিন, সারাক্ষণ ওই পেঁজা তুলোর পুতুলটাকে বুকের সবটা দিয়ে ভালোবাসত জাহিদ। বাসে এখনো। মুখে কথা ফোটার পর থেকে তুরিনের সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিল বাবা। প্রতিদিনের খুঁটিনাটি ঘটনার বিবরণ বাবার কাছে উজাড় করে দিত সে। অনেক বয়স পর্যন্তও বাবার মুখ থেকে গল্প না শুনে ঘুমাতে পারত না। কিন্তু বয়ঃসন্ধিতে মেয়েদের জীবনে মায়ের প্রয়োজন অনিবার্য হয়ে পড়ে। শিশু থেকে নারী হয়ে ওঠার দুর্বোধ্য সময়টাতে এমন অনেক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়, যা বাবার সঙ্গে শেয়ার করা যায় না, কিন্তু মাকে অনায়াসে বলা যায়। কৈশোরের বেখাপ্পা দিনগুলোতেই বাবার সঙ্গে কিছুটা দূরত্ব তৈরি হলো তুরিনের। তারপর নিশা এ বাড়ির বৌ হয়ে আসার পর থেকে সেই দূরত্বের ভিতটা আরো অনেকখানি মজবুত হলো। আজকে মেয়ের শুকনো, শীর্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে জাহিদ বুকের গভীরে একটা অব্যক্ত ব্যথা অনুভব করল। জুবিনের জন্মের পর থেকে তুরিনকে আর আগের মতো সময় দেওয়া হয় না। অফিসের কাজ, মোটেল বিজনেস, সাংসারিক অশান্তি…যাপিত জীবনের নানা বাস্তবমুখী ডামাডোলে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে থাকে সর্বক্ষণ। মেয়েকে দেবার মতো সময় কোথায়?
জাহিদ হাত বাড়িয়ে তুরিনকে কাছে টেনে নিল। তুরিন বাবার বুকে মুখ লুকিয়ে আদুরে গলায় বলল, ‘কী ভাবছিলে বাবা? কার কথা ভাবছিলে?’
জাহিদ এই প্রশ্নের তাৎক্ষণিক উত্তর দিল না। একটু সময় চুপ করে থেকে বলল, ‘তুমি কেমন আছ মা?’
— ‘ভালোই!’
লিভিংরুমের কাউচে বসে আছে বাবা-মেয়ে। কাল বাদে পরশু জুবিনের জন্মদিন। নীলিমা শাশুড়ির আদেশ মোতাবেক ঘর সাজাচ্ছে। তাকে সাহায্য করছে আনিতা আর তানিশা। একটু আগে শহীদ ডেকোরেশনের জিনিসপত্র কিনে এনেছে। বেশ উৎসব উৎসব একটা আমেজ এসে গেছে বাড়িতে। লিভিং রুমের দেওয়ালে রিং লাইটস লাগাচ্ছে নীলিমা। আনিতা ব্লুটুথ স্পিকারে গান ছেড়ে দিয়েছে। মা-মেয়ে গানের তালে তালে বেশ প্রফুল্ল চিত্তেই জন্মদিনের সাজসজ্জার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ফারা এসবের মধ্যে নেই। সে বলেছে অনুষ্ঠানের সময় সামাজিক দায়বদ্ধতা রক্ষার্থে না পারতে উপস্থিত থাকবে। যেহেতু আত্মীয়স্বজনরা জুবিনকে ফারার সন্তান হিসেবেই চেনে, তাই অনুষ্ঠানে তার উপস্থিতি একান্ত ভাবে কাম্য। লিভিংরুমের গা-ঘেঁষে সিঁড়িটা ঘুরে ঘুরে উঠে গেছে দোতলায়। সিঁড়ির মুখের পার্শ্ববর্তী লফটে মিসেস মুর্তজা বসে আছেন জুবিনকে কোলে নিয়ে। রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে নিচতলার লিভিংরুমে বসে থাকা বাবা-মেয়েকে তীক্ষ্ণ চোখে পরখ করছিলেন তিনি। জাহিদ হঠাৎ করেই প্রশ্নটা করল, ‘অর্ণবকে তোমার কেমন লাগছে?’
তুরিনের মুখে হুড়মুড় করে একগুচ্ছ অস্বস্তি এসে ভিড় করল। আস্তে করে বলল, ‘আই অ্যাম নট ইনটু হিম অ্যাট অল।’
জাহিদ মেয়ের মুখটা একবার দেখার চেষ্টা করল। এমনভাবে বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে রেখেছে যে দেখার উপায় নেই।
—‘মে আই নো হোয়াই?’ জাহিদের কণ্ঠস্বর চিন্তিত শোনাল।
তুরিন আগের চাইতেও নিচু গলায় বলল, ‘নট মাই কাপ অব টি।’
জাহিদ একটু চুপ করে থেকে কণ্ঠে কৌতুকের মৃদু ঝাপটা এনে বলল, ‘তোমার বয়ফ্রেন্ডের নামটা যেন কী?’
তুরিন লজ্জা পায়, ‘আই ডোন্ট হ্যাভ এনি বয়ফ্রেন্ড বাবা! ইউ নো দ্যাট ভেরি ওয়েল।’
জাহিদ মেয়েকে আর একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বুকের সঙ্গে। কপালে একটা আলতো চুমু খেয়ে বলে, ‘আই নো মাই বেবি গার্ল বেটার দ্যান এনিবডি এলস…বাট…টেল মি ওয়ান থিং…ডু ইউ কারেন্টলি হ্যাভ এনি ক্রাশ অন সামওয়ান?’
তুরিন একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করল। অনেকদিন ধরেই ভাবছিল বাবার সঙ্গে কথা বলবে। তার জীবনে সত্যিকারের কোন বন্ধু তো নেই! মাকে সে ভালোবাসে খুব, ভীষণ ভীষণ ভালোবাসে…কিন্তু বড় হওয়ার পর থেকেই তুরিন একটু একটু বোঝে যে, মায়ের মধ্যে ডেপথনেস বলতে কিচ্ছু নেই। ভেতরটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা, জড় পদার্থের মতো অনুভূতিহীন। একজন উঠতি বয়সি তরুণীর হৃদয়বৃত্তান্ত মায়ের মতো শুষ্ক মনের মানুষ কখনো বুঝতে পারবে না বলেই মনে হয়েছে সবসময়। তুরিন বাবার বুকের ওপর একটা হাত রেখে বাধোবাধো অস্পষ্ট স্বরে বলল, ‘একজনকে ভালো লাগে আমার!’
জাহিদ চমকে উঠল, ‘তাই?’
— হুম।’
জাহিদ পুলকিত হয় মনে মনে। সময় কোনদিক দিয়ে যে চোরাস্রোতের মতো কুলকুল করে বয়ে যাচ্ছে! সেদিনের পেঁজাতুলোর পোঁটলা, পুতুল পুতুল তুরিনটারও এখন পছন্দের পুরুষ আছে। ভালোবাসার মানুষ আছে। আশ্চর্য লাগে ভাবতে গেলে!
— ‘নাম কী তার?’
‘বাবা…আই নিড সাম টাইম…এখুনি কিছু বলতে চাইছি না তোমাকে। তবে অর্ণবকে বিয়ে করতে পারব না। তুমি প্লিজ দাদাজানকে বোঝাও।’
— ‘ওয়ান কুইক কোয়েশ্চন…তোমার পছন্দের ছেলেটা কি হোয়াইট?’ – ‘ব্রাউন।’
— ‘কোন ধর্ম?’
— ‘ধর্ম-কর্ম খুব একটা করে বলে তো মনে হয় না।’
— ‘স্টিল…তার ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে তোমার জানতে হবে।’
— ‘বাংলাদেশি অ্যামেরিক্যান।’
— এটা তো গুড নিউজ! তুমি আগে বলোনি কেন?
তুরিন চুপ করে থাকে। বুকের মধ্যে ভয়ের ঢেউ খেলে যায়। উৎকণ্ঠায় কণ্ঠস্বর বুজে আসে। শাহজিদের নাম শোনার পর কি বাবার এই অনুকূল মনোভাব অক্ষুণ্ণ থাকবে? নাকি এই গুড নিউজই নিমেষে ব্যাড নিউজে রূপান্তরিত হবে? জাহিদ বলল, ‘হাও ডাজ হি লুক লাইক? ইজ হি হ্যান্ডসাম?’
তুরিনের মুখটা লজ্জায় একটুখানি হয়ে আসে। আহ্লাদি গলায় বলে, ‘নট অ্যাজ হ্যান্ডসাম অ্যাজ ইউ বাবা!’
জাহিদ মেয়ের কথা শুনে প্রশ্রয় মিশ্রিত হাসি হাসল, ‘তাই?’
— ‘হুম। সে অনেক সুন্দর। কিন্তু তোমার চেয়ে সুন্দর না! ইউ আর দ্য মোস্ট হ্যান্ডসাম ম্যান ইন দ্য হোল ওয়ার্ল্ড!’