৪
আনিতা তরতর করে পাহাড় বেয়ে উঠছিল। মেয়েটা বেশ সাহসী। তুরিনের মতো নরম সরম নয়। লম্বা চওড়া শরীরে কমনীয়তার অভাব থাকলেও বেশ টান টান একটা দুরন্ত সৌন্দর্য আছে। পাহাড়ের মাঝামাঝি খাঁজে এসে দাঁড়াল ওরা। এখান থেকে ঝরনার পেছন দিকটা দেখা যায়। এত কাছে যে হাত বাড়িয়ে ছোঁয়া যায়। আনিতা ঝরনার ধারাটার একদম কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল। অর্ণব একটু দূরে একটা বেঞ্চির ওপর বসেছে। পাশেই একটা সরু সুড়ঙ্গ মুখ আছে। ভেতরটা অন্ধকারে ঢাকা। বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় যেন কত শত অমীমাংসিত রহস্য ঘিরে আছে এই সুড়ঙ্গকে। বাতাসে গুঁড়ি গুঁড়ি জলের ছিটা ভেসে বেড়াচ্ছে। ঝরনার জলের মিহিন নেশাড়ু শব্দে থইথই করছে চারিদিক। আনিতা হঠাৎ বলল, ‘আমার একটা ছবি তুলে দিতে পারবেন?’
অর্ণব তটস্থ হলো, ‘জি নিশ্চয়ই।’
আনিতা ওর সেলফোনটা এগিয়ে দিল। তারপর সাদা ফেনীল ঝরনার সামনে, ঝলমলে আলোর নিচে দাঁড়িয়ে নানা ভঙ্গিমায় ছবি তুলল বেশ কিছু। তোলা হয়ে গেলে অর্ণবকে ভদ্র গলায় প্রশ্ন করল, ‘আপনাকে তুলে দেব?’
অর্ণব সজোরে মাথা নাড়ল, ‘না না!আমি ছবি তুলি না।’
—‘কেন?’
—‘এমনিই!’
—‘লজ্জা লাগে?’
আনিতা কথা বলতে বলতে অর্ণবের পাশে এসে বসল। একটু তফাতে। অর্ণব জন্ম থেকেই বেশ লাজুক। মেয়েদের সামনে একটু বেশিই লজ্জায় পড়ে যায়। তবে ছবি তোলায় অনীহার কারণ লজ্জা নয়, বরং আগ্রহের কমতি। সে সবিনয়ে বলল,
—লজ্জা নয়। আসলে ইচ্ছা করে না।
—হুম .. সেই ভালো…মেয়েদের মতো দিন-রাত সেলফি তোলা ছেলেদের আমার বিরক্ত লাগে।’
অর্ণব এই কথার উত্তরে কী বলবে খুঁজে না পেয়ে চুপ করে রইল। আনিতাই কথা বলল আবার,
—দেশে আপনার কে কে আছে?
—বাবা আর ছোট ভাই।
—কী করেন আপনার বাবা?
অর্ণব একটু অপ্রতিভ গলায় বলল, আগে ব্যবসা করতেন এখন কিছু
করেন না।
আনিতা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল একবার অর্ণবকে। শ্যামবরণ লম্বাটে মুখে খচিত ঈষৎ টানা চোখের ওপর অনড়ভাবে নিজের চোখ রেখে বলল,
—একটা কথা বলি কিছু মনে করবেন না। আপনি ভালো ছাত্র। দেখতেও খারাপ নন। তুরিনকে বিয়ে করার জন্য এখানে পড়ে আছেন কেন? আপনার কি ধারণা আমার দাদাজান আপনাকে বিয়ের সময় অনেক যৌতুক দেবেন?
অর্ণব জীবনে শক্ত কথা কম শোনেনি। তার নিজের বাবাই রেগে গেলে গালাগালি দিয়ে আস্ত রাখে না। দেশে বাবার পাওনাদারদের সঙ্গেও দফায় দফায় ঝগড়া হয়েছে। এক পাওনাদার অর্ণবের মাথা পর্যন্ত ফাটিয়ে দিয়েছিল একবার। বাড়িওয়ালার বৌটাও ভাড়া দিতে কদিন দেরি হলেই সোজা বাড়ি
এসে যা তা বলত। অতএব অপমানজনক বাক্যবাণের আঘাত সয়ে নেবার অভ্যাস আছে অর্ণবের। তবুও আনিতার মতো স্মার্ট, সুন্দরী, আধুনিক মেয়ের মুখে এমন অমর্যাদাপূর্ণ কর্কশ সত্য শুনে ভেতরে ভেতরে ভীষণ অপদস্থ বোধ করল সে। মেয়েটা কি তাকে লোভী মনে করছে? তার পিতার মধ্যে লোভের আধিক্য আছে বটে। ভালো থাকা খাওয়ার লোভে মান সম্মান পর্যন্ত বিকিয়ে দিতে রাজি সেই বান্দা। কিন্তু অর্ণবের চক্ষুলজ্জা এখনো পুরোদমে তামাদি হয়ে যায়নি। মুখে একটা ভ্যাবাচ্যাকা ভাব নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সে আনিতার দিকে। তারপর হালকা কেশে নিয়ে বলল, ‘না আসলে…মানে যৌতুক দেবে কেন?’
—‘তাহলে কীসের আশায় তুরিনকে বিয়ে করতে চাইছেন? আপনাকে হিউম্যানিটি গ্রাউন্ডে একটা উপদেশ দিই কেমন? তুরিনের আশা ছেড়ে দিন। ও হচ্ছে আমাদের পরিবারের বখে যাওয়া বড় সন্তান। সব পরিবারেই এমন একজন থাকে যে ছোটবেলা থেকে প্রতিটি জিনিসকে টেকেন ফর গ্র্যান্টেড হিসেবে নেয়। এসব ছেলেমেয়েরা বাস্তবতা কখনো বোঝে না। যা পায় তার দাম দিতে জানে না।’
—‘উনি কি খুব অহংকারী?’
—‘ও বোকা। ওর বোকামিটা এত মারাত্মক হয়ে উঠছে দিনকে দিন যে মনুষ্যত্ব লোপ পাচ্ছে।’
—‘আমি মনে মনে প্রস্তুত হয়ে ছিলাম যে তুরিন আমাকে পছন্দ করবেন না। আমি আসলে কোন দিক দিয়েই উনার যোগ্য নই।’
আনিতা সরু চোখে বলল, ‘আপনি কোন দিক দিয়ে ওর যোগ্য নন? কী বলছেন এসব?’
অর্ণব বিভ্রান্তি নিয়ে বলল, ‘দেশে আমার পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। সত্যি বলতে বিয়েটা আমি করতে চাইছিলাম দ্রুত সিটিজেনশিপ পাবার আশায়। পি-এইচডি করে গ্রিনকার্ডের অ্যাপ্লাই করতে হলে চার-পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হবে। আমার বাবার লিভারে সমস্যা আছে। তিনি আর কতদিন বাঁচবেন জানি না। আমার দ্রুত নিজের পায়ে দাঁড়ানোটা খুব জরুরি। বাবা-ভাইকে এই দেশে নিয়ে আসতে চাই।’
—‘তা সিটিজেন পাত্রীর কি অভাব আছে নাকি? অন্যদিকে চেষ্টা করুন মিস্টার অর্ণব। তুরিন আপনার কপালে নেই।’
অর্ণব একটু সময় কী যেন ভেবে নিয়ে সামান্য লজ্জা মিশ্রিত গলায় বলল, ‘আচ্ছা…আপনাদের বাড়িতে একজন মেয়ে আছেন। উনার নাম নিশা। উনি আপনাদের কী হন?’
আনিতা হো হো করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলল, ‘কেন উনাকে আপনার পছন্দ হয়েছে?’
অর্ণব চোখ নামিয়ে নিল নিচে। আনিতা বলল,
—‘উনার আশাও ছেড়ে দিন। উনি বিবাহিতা।’
অর্ণবের চোখ কপালে উঠে যায়, ‘তাই নাকি?’
—‘জি।’
—‘উনার হাজবেন্ড কোথায় থাকেন?’
আনিতা কণ্ঠে রহস্যের ফোয়ারা তুলে বলে, ‘তা আর আপনার জেনে কাজ নেই।’
৫
এয়ারপোর্টের পার্কিং লটে গাড়ি পার্ক করল। আগামী সাতদিন গাড়িটা এখানেই থাকবে। একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা প্রদান করতে হবে বিনিময়ে। গাড়ি রেখে শাটলে চড়ে টার্মিনালে এলো ওরা। সেলফ চেকইন করে বোর্ডিং পাস আর সিট নাম্বার সংগ্রহ করল। সব কাজ হয়ে যাওয়ার পরেও দেখা গেল প্লেন ছাড়তে আরো এক ঘণ্টা বাকি। খুব বেশিক্ষণ মাস্ক পরে থাকলে জাহিদের শ্বাসকষ্ট হয়। কিন্তু বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে মাস্ক খোলার নিয়ম নেই। সে ফারাকে বলল, ‘তুমি বসো। আমি একটু বাইরে যাচ্ছি।’
ফারা আকুলি বিকুলি গলায় বলল, ‘কোথায় যাবে এখন আবার? প্লিজ যেও না। সিকিউরিটি পার হয়ে গেটের সামনে গিয়ে বসি চলো।’
জাহিদ তাকাল ফারার দিকে। সাদা টি-শার্ট আর মালটিকালারের একটা সুতি কাপড়ের ট্রাউজার পরনে। গলায় রঙিন মালা। চুলগুলো বাঁধা চূড়ো করে। ওর মুখে বয়সের কোন ভাঁজ পড়েনি। বেশ কিছুদিন হলো পাক্কা ভেজিটেরিয়ান হয়ে গেছে। মাছ-মাংস কিছুই খায় না। এই ত্যাগের প্রতিদান দেয়া শুরু করেছে ওর শরীর। যৌবনের দ্যুতি এখনো নিভে যায়নি। বরং নিভে যাওয়ার আগে দুর্দান্ত স্ফুরণে প্রজ্বলিত হয়েছে আরো একবার। জাহিদের পাশে ওকে ভীষণ মানায়। বন্ধু-জগৎ এবং আত্মীয়মহলে এই জুটির বেশ খ্যাতি আছে। অনেকে মনে মনে এদের হিংসে করে, অনুকরণ করে। এই ভ্রমাত্মক ধারণার পেছনে ফারার ছলা-কলাময়ী আচরণই মূল ভূমিকা পালন করে এসেছে। লোকে ভ্রান্তিময় দৃশ্যের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেছে। আশ্চর্য ব্যাপার হলো ফারার চালচলনের এই তঞ্চকতা আজকাল যেন আরো বিশদ এবং প্রকটভাবে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে জাহিদের কাছে। ওর মনের ফাঁকে ফাঁকে জমে থাকা ময়লাগুলো, কালো দাগগুলো যেন সর্বক্ষণ অনায়াসে ভেসে উঠছে চোখের তারায়। অথচ প্রথম যৌবনে এর প্রণয় তাকে অন্ধ করে তুলেছিল। একাধিকবার ওর পায়ের কাছে ভালোবাসার ফুল নিবেদন করেছে। সেই ফুলের পাই-পয়সা পরিমাণ মূল্য দেয়নি ফারা। তবে এই নারীই তার প্রথম সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাতে সক্ষম হয়েছিল! জাহিদ আটপৌরে সাধারণ বাঙালি পুরুষের মতোই ভেবেছিল নিজের প্রথম সন্তানের জন্মদাত্রীকে আজীবন ভালোবাসবে, পাশে থাকবে। অথচ আজ এতগুলো বছর পরে এসে বুঝতে পারছে ভালোবাসা কোন দায়িত্ব কর্তব্যবোধের কাতারে পড়ে না। মানুষ শত চেষ্টা করেও এই অনুভূতিকে বশে আনতে পারে না। বরং এই স্বৈরাচার অনুভূতিই মানুষকে বশ করে, শাসন করে! এমনই সব বিক্ষিপ্ত ভাবনার দোলাচালে দুলতে দুলতে জাহিদ বড় ব্যথিত চোখে চেয়ে ছিল ফারার দিকে। দুনিয়া এক আজব কারখানা। প্রথম প্রেমের সামনে দাঁড়িয়ে আজ বিভ্রান্ত জাহিদের শুধুই মনে হচ্ছে ফারা তার জীবনের প্রথম প্রেম নয় বরং প্রথম ভুল! আরো কত কত ভুল এই জীবনে করার বাকি আছে কে জানে! একটা দীর্ঘশ্বাস চাপা দিয়ে জাহিদ নিঃশব্দে এগিয়ে এসে চেয়ারে বসল। মাথা হেঁট। বসার ভঙ্গিটি বড় ক্লান্ত। সে জানে ফারা তার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। সেই প্রতারণা দাঁতমুখ খিঁচে সহ্য করেছে প্রথম সন্তানের মুখ চেয়ে। তুরিনের জন্যই এই ট্যুরে যেতে হচ্ছে। তুরিনের জন্যই নিশাকে তালাক দিতে হবে। তুরিনের জন্যই মিথ্যে একটা সম্পর্ক জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বয়ে যেতে হবে! দিনশেষে তুরিন আর জুবিনই তার একমাত্র ভালোবাসা। কিন্তু জুবিন যখন বড় হয়ে চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করবে, আমার মায়ের কী দোষ ছিল? কেন তাকে ত্যাগ করা হয়েছিল? বাবা হয়ে জাহিদ তখন সন্তানকে কী জবাব দেবে?
চেয়ারের পিঠে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করল সে। বদ্ধ চোখের দর্পনে সবার প্রথমে নিশার মুখটাই ভেসে উঠল। কী করছে এখন নিশা? জুবিনের দেখাশোনা? ঘরের কাজ? নাকি অন্যকিছু? কর্মব্যস্ততার ফাঁকে ফাঁকে একলা নিশা কার কথা ভাবে বিষণ্ণ অলস দুপুরগুলোয়? ভুল করেও জাহিদকে কখনো মনে পড়ে কি? নাকি ওর সমস্তটাই শাহজিদের দখলে? শাহজিদের নামটা মনে পড়তেই একটা আগুনের হলকা এসে লাগল মনে। অবাক হয়ে আবিষ্কার করল অনিমেষকে সে কখনো ঈর্ষা করেনি, কিন্তু শাহজিদের প্রতি যে প্রলয়ংকরী মনোভাব তার বিচক্ষণ, বিবেচক মস্তিষ্কের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করেও অনায়াসে দাউদাউ করে জ্বলছে বুকের প্রতিটি ইট-কাঠ-পাথরে…সে মনোভাব ঈর্ষা বই অন্যকিছুই নয়। তার হঠাৎ ইচ্ছে হলো ভারি কিছুর আঘাতে মাথাটা চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলে। এক নিমেষে মিটে যাক সব যন্ত্রণা। কিংবা অনেক ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে নিশ্চিন্তে। কতদিন ঘুমায় না শান্তির ঘুম!
ফারা পাশে এসে বসেছে। বলছে কিছু একটা। জাহিদ ওর কথা শুনতে পাচ্ছে না। আচ্ছা নিশাকে তো সে ভালোবাসে না, তাহলে নিশা শাহজিদকে ভালোবাসলে ক্ষতিটা কোথায়? জানে না…! ক্ষতির স্বরূপ অজ্ঞাত। তবে ক্ষতি কিছু একটা হয়ে গেছে। বিশাল ক্ষতি! কেন যেন মনে হচ্ছে জীবনের অন্য সব ক্ষতি পূরণ করা সম্ভব হলেও এই ক্ষতিটুকু কখনোই পূরণ হওয়ার নয়! ফারাকে সে কখনো মিস করেনি। কিন্তু নিশাকে সে মিস করছে। এমনকি একই বাড়িতে থেকেও নিশাকে সে সর্বক্ষণ মিস করে!
হঠাৎ একটা ছায়ামূর্তি ওদের সামনে এসে দাঁড়াল। জাহিদ চোখ তুলে দেখতে পেল অনিমেষকে।
—‘হোয়াসসাপ বাড়ি?’ অনিমেষ হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ওর পাশে বন্ধুজগতের আরো কিছু পরিচিত মুখ দেখা গেল। এই ট্যুরে অনিমেষ যাচ্ছে সেকথা ঘুণাক্ষরেও উল্লেখ করেনি ফারা। জাহিদ কিছুক্ষণ স্থির চোখে অনিমেষের ধারওয়ালা গাঢ় গাত্রবর্ণের মুখের দিকে চেয়ে থেকে নির্জীব গলায় বলল, ‘তুই যাচ্ছিস নাকি?’
—‘হ্যাঁ যাচ্ছি তো!’ কথাটা বলে শেষ করে সে বাড়িয়ে দেয়া হাতটা গুটিয়ে নিল। জাহিদের প্রত্যাখ্যান বুঝতে সময় লাগল না তার। জাহিদ ফারার দিকে তাকাল, ‘তুমি তো বলোনি আমাকে।’
ফারা বিচলিত কণ্ঠে বলল, ‘কী বলব?’
—‘অনিমেষ যাচ্ছে আমাদের সঙ্গে একথা আগে বলোনি কেন?’ অদ্ভুত শীতল শোনাল জাহিদের গলা। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল ফারার। তবুও মুখ- চোখ স্বাভাবিক রেখে সে বলল, ‘আমিও কি জানতাম নাকি?’
মিথ্যাটা খুব সুনিপুণ সত্যের মতো উপস্থাপন করা হলেও জাহিদ বুঝল ওটা সত্য নয়, ডাহা মিথ্যা কথা। অনিমেষ একটু অপ্রস্তুত গলায় বলল, ‘আগে থেকে জানানোটা ম্যান্ডেটরি ছিল নাকি? ফ্রেন্ড সার্কেলের মধ্যে তো আমিও আছি। তোদের কোন সমস্যা আছে আমার প্রেজেন্সে? থাকলে বল, আমি কুইট করছি।’ জাহিদ কয়েক সেকেন্ড নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইল কাঠ হয়ে। তার মনোজগৎমুহূর্তের জন্য সংকটপূর্ণ এক রণক্ষেত্রে পরিণত হলো। তুরিনের উপরোধ আর আত্মসম্মান বোধের মধ্যে একটা নিঃশব্দ লড়াই চলতে লাগল ওখানে। কী করবে জাহিদ? তুরিনের অনুরোধের ঢেঁকি গিলে নিয়ে ফারা, অনিমেষের সঙ্গে নিছক একটা দলগত ভেড়া হয়ে সাতদিনের উদ্দেশ্যে উড়াল দেবে? নাকি নিজের আত্মসম্মান রক্ষা করবে? নাকি বাড়ি ফিরে যাবে, নিশার কাছে? শেষের ভাবনাটা তার বুকে একটা নাড়া দিয়ে গেল। বাড়ি ফিরে যাওয়া মানেই কি নিশার কাছে ফিরে যাওয়া? হ্যাঁ তাই তো! বাড়ি ফিরলেই তো নিশাকে দেখতে পাবে! এমন একটা বাড়ি, যে বাড়িতে মমতাময়ী মা আছে, সেই সঙ্গে ভালোলাগার মানুষ আছে! এমন বাড়িতে ফিরে যাওয়ার চাইতে স্বস্তির আর কী হতে পারে?
—‘তুইই বরং যা। আমার যেতে ইচ্ছা করছে না। আই কুইট।’ পাথরের মতো শক্ত চোয়াল জোড়া নেড়ে হিমায়িত কণ্ঠে বলল জাহিদ।
ফারা আঁতকে উঠল, ‘কী বলছো তুমি এসব?’
জাহিদ বোর্ডিং পাসটা দু হাত দিয়ে ছিঁড়ে বলল, ‘তোমরা যাও। হ্যাভ আ ওয়ান্ডারফুল ভ্যাকেশন গাইজ!’
কথাটা বলেই জাহিদ আর দাঁড়াল না। কাঁধে ব্যাগ নিয়ে হনহনিয়ে হাঁটতে লাগল একজিট বরাবর। নিশাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। মনে হচ্ছে এখুনি ওকে একবার দেখতে না পেলে নির্ঘাত মরে যাবে! ফারা জাহিদের পেছন পেছন পা বাড়াতেই অনিমেষ খপ করে ওর হাত ধরে ফেলল, ‘কোথায় যাচ্ছ?’
—‘কোথায় আবার? জাহিদকে ফিরিয়ে আনতে।’
—‘ফিরিয়ে আনার কী দরকার? ওকে যেতে দাও। আমরা আমরাই ঠিক আছি।’
ফারা চাপা গলায় বলল, ‘অনি তুমি বুঝতে পারছ না এ সময় ওকে আমি একলা ছাড়তে পারব না।’
—‘কেন হঠাৎ কী এমন হলো?’ সন্দেহ উঁকি দেয় অনিমেষের গলায়।
—‘নিশা বিদায় হওয়ার আগের কটা দিন আমাকে জাহিদের সঙ্গে থাকতে হবে। ওই ডাইনিকে আমি বিশ্বাস করি না। তা ছাড়া তুরিন কী ভাববে ওর বাবাকে ফেলে একা একা ভ্যাকেশনে গেলে?’
অনিমেষ তীক্ষ্ণ গলায় বলল, ‘বেশ কিছুদিন ধরে দেখছি জাহিদের জন্য তোমার দরদ বেড়ে গেছে। ব্যাপারটা কী?’
—‘অনিমেষ! লক্ষ্মীটি, প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো। কয়েকটা দিন সময় দাও আমাকে। নিশাকে বিদায় করতে পারলেই সব আগের মতো হয়ে যাবে। ট্রাস্ট মি!’
পাশে একজন বন্ধু এসে দাঁড়িয়েছে। বন্ধুটি জাহিদের ব্যাপারে জানতে চাইলেই ফারা হড়বড় করে মিথ্যে কথার ডালি সাজিয়ে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে ফেলল, ‘আমার শ্বশুর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেছেন তো তাই আমাদের আর ট্যুরে যাওয়া হলো না।’
অনিমেষ কড়া গলায় বলল, ‘জাহিদ তো গেছেই ওর বাবার কাছে। তাছাড়া তোমাদের বাড়িভর্তি মানুষ। দেখাশোনা করার ঢের লোক আছে। তুমি চলো আমাদের সঙ্গে।’ এই কথা বলে অনিমেষ ফারার হাত চেপে ধরে টানতে টানতে নিয়ে যেতে লাগল সিকিউরিটি চেকপয়েন্টের দিকে।
বাইরে বেরোনোর পর জাহিদের মনে হলো আজকের পৃথিবীটা অন্যরকম! রক্তে বারুদের স্ফুরণ ঝলসাচ্ছে। বুদ্ধিভ্রংশের মতো গাড়ির স্টিয়ারিং চেপে ধরে আছে সে। এই মুহূর্তে সাংসারিক বা বৈষয়িক কোন ভাবনা মস্তিষ্কের বিন্দু মাত্র জমিন দখল করতে পারছে না। তুরিনের কথা মনে থাকছে না। এমনকি ট্যুর ক্যান্সেল করে ফিরে যাওয়ার পর বাড়ির লোকে কী ভাববে সেই চিন্তাও নাড়া দিচ্ছে না। একটা অদৃশ্য শক্তি তাকে চুম্বকের মতো টেনে নিয়ে যাচ্ছে নিশার কাছে। আকর্ষণের তীব্রতায় চাপা পড়ে যাচ্ছে নৈতিকতা এবং বাস্তববোধ! গাড়িটা গন্তব্যে এসে থামল প্রকট শব্দে ব্রেক কষে। ঝোপঝাড়ে আর গাছের ডালে লুকিয়ে থাকা পাখিরা শব্দ শুনে সচকিত হয়ে উঠল, ডানা ঝাপটে উড়াল দিল আকাশে। একটা ঘুঘু ডেকে উঠল মন কেমনের সুরে ক্র্যাব অ্যাপল ট্রির কচি সবুজ পাতার ঝালরের ভেতর থেকে। জাহিদের চোখজোড়া রক্তাভ। মুখে একটা প্রচ্ছন্ন উন্মাদনা। কালো দাড়িগোঁফের আঁচড়ওয়ালা ফরসা গালে লালচে আভার বিস্তার। শ্বাস-প্রশ্বাস অস্বাভাবিক। বশীভূতের মতো গাড়ি থেকে নামল। অবিন্যস্ত এলোমেলো পায়ে এগিয়ে গেল প্যাটিওর দিকে। তার বুক অসম্ভব রকমের কাঁপছে!
নিশা সিঁড়ির ওপর বসে ছিল থম ধরে। গাড়ির চাকার প্রকট শব্দটা কানে এসে লেগেছে। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সম্পূর্ণ বিনা কারণে একটা ডঙ্কা বাজিয়ে গেছে বুকের গভীরে। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সে মর্মভেদী দৃষ্টি মেলে অপ্রকৃতস্থের মতো চেয়ে আছে সদর দরজার দিকে। দরজার ওপাশে পায়ের শব্দ এগিয়ে আসছে…দেয়াল ঘড়ির কাঁটা বয়ে চলেছে টিকটিক টিকটিক করে…নিশার স্নায়ু টান টান…শ্বাস আটকানো…সর্বাঙ্গে কম্পন! হঠাৎ দরজাটা খুলে গেল সশব্দে। আলোর ঠিক বিপরীতে একটা দীর্ঘ ছায়ামূর্তি ভেসে উঠল। নিশা সিঁড়ির মাঝবরাবর রেলিং আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। চোখ দিয়ে অশ্রু গড়াচ্ছিল নিঃশব্দে। জাহিদ মুখ উঁচু করে তাকাতেই দুইজোড়া তৃষিত চক্ষু যেন মিলিত হলো শত শতাব্দী পর! বেহেশতি হাওয়া ছুটল দিগ্বদিক মথিত করে। আবছা অন্ধকারে ছাওয়া বদ্ধ বাড়িটা মুহূর্তের মধ্যে নন্দন কাননে রূপান্তরিত হলো। ওরা কেউ নড়ল না, কিছু বললও না। শুধু মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে রইল পরস্পরের দিকে!
কতক্ষণ কাটল কে জানে! নিশা দুরুদুরু বুক নিয়ে এক পা-দুপা করে সিঁড়ি ভাঙল। দূর থেকে হুইসেল বাজিয়ে একটা ট্রেন ধেয়ে আসছে। হৃদয়ের প্ল্যাটফর্ম কাঁপছে প্রবলভাবে!
—‘ফিরে এলেন যে?’ রুদ্ধশ্বাসে প্রশ্ন করে নিশা।
—‘এলাম…মানে আসতেই হলো!’ রুদ্ধশ্বাসে উত্তর দেয় জাহিদ। কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে রাখে সোফায়। নার্ভাসভাবে বলে, ‘নিশা তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল।’
—‘বলুন।’
জাহিদ দেয়ালের দিকে চোখ সরিয়ে নিল,
—‘এভাবে…এখানে নয়। বাইরে চলো।’
নিশা উথাল… পাতাল মনটা কোন রকমে সামলে নিয়ে বলল, ‘বাইরে?’
—‘হ্যাঁ বাইরে।’
—‘বাইরে কোথায়?’ নিশার চোখ কার্পেটের ওপর ঠাঁসা। সংকোচের অত্যাচারে বুজে আসছে কণ্ঠস্বর।
জাহিদের চোখজোড়াও দেয়াল থেকে সরল না। যেন নিশার সঙ্গে নয়, ওই দেয়ালের সঙ্গেই কথা বলছে এমন ভঙ্গিতে বলল, ‘তুমি যেখানে যেতে চাও!’
—‘জুবিনকে সঙ্গে নেব?
—‘না…জুবিন থাক বাসায়। তুমি রেডি হয়ে নাও।’
নিশা বাধ্য মেয়ের মতো ঘাড় নাড়ল, ‘আচ্ছা।’
আড়ষ্ট দুটো পা অনেক কষ্টে চালিত করে ঘুরে দাঁড়াল। তার হৃৎপিণ্ড কি একটু বেশিই জোরে স্পন্দিত হচ্ছে? নিজেই তো শব্দ শুনতে পাচ্ছে! কী মুশকিল! বাড়ির সব লোকের কানে পৌঁছে যাচ্ছে নাকি হৃদয়ের উত্তেজনা?
—‘নিশা!’ হঠাৎ ডাকটা ছুটে এলো পেছন থেকে।
—‘জি?’ নিশা ঘুরে তাকাল।
জাহিদ হাতে ধরা সেলফোনে কিছু একটা টাইপ করতে করতে গম্ভীর মুখে বলল, ‘তোমার নীল রঙের শাড়ি আছে?’
—‘জি আছে।’
জাহিদ তাৎক্ষণিকভাবে কোন প্রত্যুত্তর করল না। কয়েক সেকেন্ড পর ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকেই অস্ফুটে বলল, ‘খুব ভালো!’
নিশা ঠোঁটে মুচকি হাসির একটা রেখা নিয়ে প্রস্থান করল। সিঁড়ি ভেঙে হলওয়েতে এসে দেখল শাশুড়ি দাঁড়িয়ে আছেন। নিশা মাথা নিচু করে নিজের ঘরে দৌড়ে গেল। উত্তেজনায় হাত-পা কাঁপছিল। সুখের কান্না সুড়সুড়ি দিচ্ছে বুকে। মাথাটা পাগল পাগল! উনার সঙ্গে এর আগে কখনো কোথাও যায়নি নিশা। আজকেই প্রথম! ভাবতে গিয়ে ওর গায়ে জ্বর চলে আসার উপক্রম হলো। নীল শাড়ি আছে বেশ কয়েকটা। কিন্তু এখন চিত্ত চাঞ্চল্যের প্রবল দাপাদাপিতে মাথা ব্ল্যাংক হয়ে গেছে। কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না! অন্ধের মতো জামা-কাপড়ে ঠাঁসা ক্লজেটটা হাতিয়ে বেড়াচ্ছে। ওর মুখে চিলতে চাঁদের বাঁকা হাসি লেগে আছে। চোখে উপচে পড়ছে খুশি। মন পাখিটা আনন্দে বাকবাকুম করছে! ঘরের দরজা খুলে শাশুড়ি ঢুকলেন। স্বাভাবিক গলায় বললেন, ‘বৌমা, নীল শাড়ি পরো। নীল রং জাহিদের পছন্দ।’
নিশা চোখ তুলে তাকাতে পারল না শাশুড়ির দিকে। তার খুব লজ্জা করছে…আবার ভীষণ ভালোও লাগছে!
জাহিদ মনে মনে বোকা বনে গিয়ে সেলফোন হাতে নিয়ে বসে আছে। কী করল সে? কেন করল? কী দরকার ছিল বাইরে যাওয়ার প্রস্তাব দেবার? শাড়ির প্রসঙ্গই বা কেন টেনে আনল? মেয়েটা তাকে হ্যাংলা ভাবল নাতো? একটা বড় শ্বাস টেনে নিতে নিতে বুঝতে পারল পাগলামিটা করে ফেলার পর বেশ হালকা লাগছে। বিশাল বড় ভারী পাথর যেন নেমে গেছে বুকের ওপর থেকে। রক্তক্ষরণের মতো যন্ত্রণাটা ব্রেক কষে থেমে গেছে। ফুসফুসে অক্সিজেন ফিরে এসেছে। স্বাস্থ্যকর হাওয়া ছুটোছুটি করছে ঘরময়!
দোতলায় উঠে এসে শাওয়ার নিল সময় নিয়ে। শিস দিয়ে প্রিয় গানের সুর তুলল গলায়। শেভ করল। পছন্দের আফটার শেভ মাখল গালে। স্নানের উষ্ণ জলের স্রোতের সঙ্গে যেন ধুয়ে-মুছে ভেসে গেল সমস্ত রাতজাগা ক্লান্তি আর দুশ্চিন্তা। একটা সাদা রঙের অ্যাথলেটিক ফিট টি-শার্ট আর ব্লু জিন্স পরে নিচে নেমে এলো। একটু পর পর ঘড়ি দেখছিল সে। দুশ্চিন্তা কেটে গেছে, তবে অস্বস্তিটা যায়নি ভেতর থেকে। মন ছটফট করছে। নিশা কখন আসবে? এত দেরি করছে কেন?
জাহিদ বাইরে এসে একটা সিগারেট ধরাল। আকাশে মেঘ ঘনিয়ে এসেছে। দুপুরে বৃষ্টি হওয়ার কথা। হাওয়ায় আসন্ন বৃষ্টির ভেজা স্পর্শ ভেসে বেড়াচ্ছে। মেঘ ডাকছে হঠাৎ হঠাৎ। ভেজা মাটির গন্ধের সঙ্গে বসন্তের কাঁচা ফুলের পরাগায়নের সুখী ঘ্রাণ মিশে গেছে। ক্র্যাব অ্যাপল গাছের থোকা থোকা সাদা ফুলের পাপড়ি উড়ছে হাওয়ায়। জাহিদের চোখ বারবার দরজার দিকে ছুটে যাচ্ছে। মন বড় উচাটন!
নিশা এলো অবশেষে। জাহিদ সরাসরি ওর দিকে তাকাতে পারল না। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে চোখের কিনার দিয়ে দেখল প্যাটিওর দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সন্তর্পণে। পরনে নীল শাড়ি! জাহিদ শিরায় শিরায় একটা নিষ্কলুষ স্নিগ্ধতার আশ্চর্য পরশ টের পাচ্ছিল। রক্তে ছলাৎছলাৎ ঢেউ ভাঙছে মাতাল মাতাল সুখ! এরকম অনুভূতি আগে কখনো হয়েছিল কি না মনে পড়ে না! সে কোন কথা বলল না। কথা বলল না নিশাও। কেউ কারো দিকে তাকাল না পর্যন্ত! দুজনে চুপচাপ নীরবতা পালন করে পরস্পরের অস্তিত্ব অনুভব করল শুধু! জাহিদ আধখাওয়া সিগারেটটা মাটিতে ছুড়ে ফেলে জুতো দিয়ে মাড়িয়ে দিল। তারপর এগিয়ে গেল গাড়ির কাছে। নিশা নতমস্তকে ওকে অনুসরণ করল। এই প্রথম জাহিদের গাড়িতে উঠবে। এর আগে সবসময় শ্বশুরের গাড়ি চড়েই বাইরে গেছে। উঠোনের শেষ প্রান্তে রাস্তার ধারে গাড়িটা রাখা ছিল। জাহিদ ড্রাইভিং সিটের পাশের দরজা খুলে দিল, নিশার জন্য। নিশা ভেবেছিল অন্তত ‘থ্যাংক ইউ’ শব্দ দুটো উচ্চারণ করে ভদ্রতা বজায় রাখবে। কিন্তু ওর গলা দিয়ে কোন স্বর বেরোচ্ছে না। সংকোচ, আনন্দ আর উৎকণ্ঠায় ভেতর বাহিরের সমস্তটা বোবা হয়ে গেছে।
ঠিক সেই সময় আচমকা একটা গাড়ি এসে থামল। মিনিট না গড়াতেই ফারা তড়িঘড়ি করে নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। দৌড়ে ছুটে এসে জাহিদকে জাপটে ধরল। হাঁপ ধরা গলায় বলল, ‘তুমি ভাবলে কী করে আমি তোমাকে ছাড়া ভ্যাকেশনে যাব হানি? এই দ্যাখো আমি চলে এসেছি!’
নিশার মুখ থেকে রক্ত সরে গেল। ভয়ংকর এক স্থবিরতা গ্রাস করল তাকে মুহূর্তের মাঝে। জাহিদ কিংকর্তব্যবিমূঢ়!
JUST GONNA STAND THERE AND
HEAR ME CRY, BUT THAT’S
ALL RIGHT, BECAUSE
I LOVE THE WAY YOU LIE!
— SKYLAR GREY
.
শাহজিদ একটা সিগারেট ধরিয়েছিল। তুরিন হাত পেতে দিয়েছে, ‘আমাকেও দাও।’
শাহজিদ ওর চোখের দিকে না চেয়েই বরফশীতল কণ্ঠে বলেছে, ‘জাস্ট ব্যাক অফ অ্যান্ড লিভ মি এলোন!’
তুরিন বুঝতে পারছে না তার দোষটা কোথায়। সে তো যেচে পড়ে কিছু করেনি। এখন ভাবটা এমন দেখাচ্ছে যেন তুরিনকে চেনেই না! অথচ ঘটনাটা ঘটে যাওয়ার পর তুরিনের কিন্তু মোটেও খারাপ লাগছে না। একটা ফুরফুরে খুশি খুশি ভাব মনটাকে অবশ করে তুলেছে। সে এখন জানে শাহজিদও তাকে চায়। সেই চাওয়ার তীব্রতা কতখানি তা অজ্ঞাত, তবে আকর্ষণ শুধু একতরফা নয় এটুকুমাত্র জ্ঞান আপাতত তাকে স্বর্গসুখে ভাসিয়ে দিয়েছে। কিন্তু শাহজিদ ভুলেও ওর চোখে চোখে তাকাচ্ছে না। যেন ভয়ংকর কোন অপরাধে অভিযুক্ত আসামিসে। মুখে ঘন ঘোর শ্রাবণের কৃষ্ণবরণ মেঘ। চোখের দৃষ্টি অপরাধবোধের প্রাবল্যে ন্যুব্জ হয়ে এসেছে।
অর্ণব আনিতা পার্কিং লটে ফিরে আসার পর শাহজিদ শশব্যস্ত হয়ে বলল, ‘আমাদের এবার ফিরে যাওয়া উচিত।’
—‘এত তাড়াতাড়ি?’ আনিতার প্রশ্ন।
—‘আমার কাজ আছে। ফিরতে হবে।’ শাহজিদ বলল। অর্ণব একটু নিরাসক্ত গলায় মতামত পেশ করল, ‘আমার কিছু বলার নেই। আপনাদের ইচ্ছা।’
শাহজিদ ড্রাইভিং সিটের পাশে উঠে বসতে যাচ্ছিল। তুরিন ওকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে এলো পেছনে।
—‘তুমি আমার পাশে বসো। আনিতা, প্লিজ সামনে যাও।’
আনিতা ত্যাড়া চোখে একবার দেখল তুরিনকে। এই মেয়ের পাগলামি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। কোনদিন বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যায় কে জানে! বিরক্তিতে চিড়বিড় করে উঠল ওর মন। কিন্তু মুখে কিছু বলল না। শাহজিদ অর্ণব আনিতার সামনে কোন উচ্চবাচ্য না করে তুরিনের পাশে এসে বসল। যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে। সারা মুখে গাঢ় বিষণ্নতার ছাপ নিয়ে স্থিরচিত্র হয়ে বসে আছে। তুরিনের বালিকাসুলভ অপরিপক্ব মন এই অগ্রাহ্যতা পাত্তাই দিচ্ছে না। ওর চোখে-মুখে একটি দুষ্টু হাসি পাজি ডাকাতের মতো দর্পিত ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা মনে পড়লেই সারা গায়ে শিহরণ খেলে যাচ্ছে। মনের ভেতরকার মন ক্ষণে ক্ষণে পুলকিত হচ্ছে দুর্দান্ত হর্ষে। সে দুরন্ত চোখে শাহজিদের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ওর হাত আলতো করে ছুঁয়ে দিল। শাহজিদ তাৎক্ষণিকভাবে হাতটা গুটিয়ে নিল। তুরিন এই প্রত্যাখ্যানে মোটেও ব্যথিত হলো না। বরং শক্তপোক্ত ব্যক্তিত্বময় শাহজিদের কাঁচুমাচু মুখটা দেখে মনে একটা গোপন আনন্দ হলো। সে এবার ডান পায়ের আঙুল রাখল শাহজিদের বাঁ পায়ের গোড়ালিতে। হালকা সুড়সুড়ি টের পেল শাহজিদ। আগুন চোখে তাকাল তুরিনের দিকে। তারপর আগুন গলায় অর্ণবকে বলল, ‘অর্ণব ভাই। নেক্সট একজিটে গাড়ি থামাবেন প্লিজ।’
বিরতিহীন হাইওয়ে ধরে আরো ছয় মাইল যাওয়ার পর রাস্তার ডান দিকে একজিট সাইন চোখে পড়ল।
একটা গ্যাস স্টেশনে গাড়ি থামাল অর্ণব। ট্রাংক থেকে শাহজিদের ক্রাচ বের করে দিল। শাহজিদ বাইরে বেরিয়ে এসে তুরিনকে বলল, ‘তোমার সঙ্গে কথা আছে। এদিকে এসো।’
তুরিন ফড়িংয়ের মতো তিড়িংবিড়িং করে উড়ে উড়ে ওকে অনুসরণ করল। অর্ণব আনিতা বসে রইল গাড়িতে। আনিতার একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। অর্ণবের সঙ্গে টানা এতটা সময় থাকতে হবে জানলে সে এই ট্যুরে কখনোই আসত না। পাশাপাশি একটা মানুষ বসে থাকলে টুকটাক কথা তো বলতেই হয়। কিন্তু কতই বা আর বলা যায় কথা? অপরিচিত একজন মানুষের সঙ্গে? অর্ণব ভাবছিল এ বাড়িতে আসবার পর থেকে আনিতার সঙ্গে ওর যতটা কথা হয়েছে, অন্য কারো সঙ্গেই বোধহয় ততটা হয়নি। এখানে সবাই একটু কেমন যেন। আনমনা, কিঞ্চিৎ ছিটিয়াল এবং আত্মকেন্দ্রিক। একমাত্র আনিতাই সাধারণ।
গ্যাসস্টেশনের পেছন দিকের নিরিবিলি জায়গায় এসে দাঁড়াল শাহজিদ। এদিকে ঝোপ-জঙ্গল আছে আর কিছুটা দূরে আছে লাল রঙের পাহাড়। রোদ এখন খুব কড়া। রোদ চশমা ছাড়া চোখ মেলে রাখা দায়। শাহজিদের সঙ্গে এখন সানগ্লাস নেই। সে অর্ধনিমীলিত সরু চোখে তুরিনের খুশি মাখামাখি মুখের দিকে তাকাল।
—‘কী হয়েছে তোমার?’
তুরিন হাসতে হাসতে বলল, ‘আমার আবার কী হবে! হয়েছে তো তোমার!’
—‘আমার কী হয়েছে?’ শাহজিদ বুকের ভেতরকার নরম মাটিটাকে জোর করে শক্ত করার চেষ্টা করে। তার আত্মবিশ্বাসের ভিত নড়ে গেছে। নিজেকেই নিজের ভয় হচ্ছে এখন। তবে সবচেয়ে বেশি ভয় হচ্ছে এই মাথামোটা বেকুব, পাগল মেয়েটাকে।
তুরিন খুশিতে জুলজুল হয়ে বলল, ‘আই থিংক ইউ আর ফলিং ফর মি।’ শাহজিদ ধমকে উঠল, ‘শাট আপ! সব সময় লেইম কথাবার্তা বলো কেন?’
একটু নিভল তুরিন, ‘লেইম কিছু তো বলিনি।’
শাহজিদ চোখ ঘুরিয়ে নিল অন্যদিকে, ‘তুরিন শোনো, আজকের ঘটনাটা ভুলে যাও।’
—‘ভুলে যাব?’
—‘হ্যাঁ ভুলে যাও।’
—‘তুমি ভুলতে পারবে?’
—‘আমার জন্য এটা বিশেষ কিছু নয়।’ যান্ত্রিক কণ্ঠে বলল শাহজিদ।
তুরিনের বুকে একটা তপ্ত শেল এসে বিঁধল। ব্যথিত চোখে তাকাল একবার শাহজিদের হাইচিকবোন সংবলিত বিচক্ষণ, সবল এবং সদম্ভ মুখখানার দিকে।
—‘তোমার জন্য বিশেষ কিছু নয়?’
—‘নাহ! তুমি জানো অ্যাঞ্জেলিনার সঙ্গেও এসব হয়েছিল।’ অবহেলার গলায় বলে শাহজিদ। অবহেলা নিয়ে তাকায় তুরিনের দিকে। অবহেলার সুরে বলে, ‘জানো তো, তাই না?’
তুরিনের বুকে মোচড় দিল তীব্র ব্যথা। বাধোবাধো গলায় বলল, ‘আমাকে যেভাবে আদর করেছ…অ্যাঞ্জেলিনাকেও ঠিক এভাবেই…’
—‘নিজেকে এত স্পেশাল ভাবছ কেন?’ শাহজিদ থামিয়ে দিল তুরিনকে। তুরিন ছোট ছোট বঙ্কিম দুটো চোখ ভারি নিষ্পাপ ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ মেলে রাখল শাহজিদের ওই বিমোহন চক্ষুদ্বয়ের ওপর। তারপর ফাঁপা বাঁশির মতো বেসুরো কণ্ঠে বলল, ‘তুমি মিথ্যে বলছো।’
হাসার চেষ্টা করল শাহজিদ, ‘এক বিন্দুও মিথ্যে বলছি না। শোন, আমি একজন সাধারণ পুরুষ। মেয়েদের আমার ভালো লাগে! ওখানে অন্য কেউ ছিল না। তুমি খুব কাছে ছিলে। সো আই টুক অ্যাডভ্যান্টেজ অফ ইউ।’
—‘এতটাই খারাপ তুমি?’
—‘আমি এর চাইতেও অনেক বেশি খারাপ! ইউ হ্যাভ নো আইডিয়া-আমি কতটা খারাপ হতে পারি। তাছাড়া আমি কখনোই কাউকে ভালোবাসিনি। বাসবও না। আমার জীবনে এসবের কোন জায়গা নেই। ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড? আর তোমার মনে যদি আমার জন্য কিছু থেকে থাকে, খুব দ্রুত সেই ফিলিংস ওয়াইপ আউট করে দাও। এটাই তোমার জন্য ভালো হবে।’
তুরিনের ঠোঁট দুটো কাঁপছিল। চোখে-মুখে মর্মান্তিক যন্ত্রণার ছাপ। কেউ যেন বুলডোজার দিয়ে ওর হৃৎপিণ্ড পিষে দিচ্ছে। শাহজিদ ওর দিকে একবার তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিল। তার ভেতরে মর্মযাতনা হচ্ছে। কথাগুলো তুরিনকে বলার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বলে ফেলার পর মনে হচ্ছে এতটা শক্ত ভাবে না বললেও চলত।
—‘তোমার মনে আমার জন্য কোন ফিলিংস নেই?’
শাহজিদ কপট হাসি হেসে অবহেলার স্বরে বলল, -”ফিলিংস? নো ওয়ে!
—‘আমি অর্ণবকে বিয়ে করলে তোমার কষ্ট হবে না শাহজিদ?’ ব্যাকুল হয়ে প্রশ্ন করে তুরিন।
—‘কষ্ট হবে কেন? স্ট্রেঞ্জ!’
তুরিন আহত এবং পীড়িত চোখে চেয়ে রইল। তার বুকের ভেতর ওলটপালট হচ্ছে…ভাঙচুর হচ্ছে…সর্বনাশা এক প্রলয় ঘটছে!
—‘আমি শেষবারের মতো প্রশ্ন করছি। তুমি আমাকে চাও না?’
শাহজিদ তুরিনের চোখে চোখ রাখল। দৃঢ় কণ্ঠে উত্তর দিল, ‘আমি কাউকে চাই না! কিচ্ছু চাই না!’
তুরিনের চোখ ফেটে গড়িয়ে পড়ল জলের একটা ধারা। রুদ্ধ স্বরে বলল, ‘তুমি মিথ্যেবাদী।’
শাহজিদ কাঠ কাঠ হাসল, ‘তোমার কনফিডেন্স লেভেল আমাকে মুগ্ধ করেছে। হ্যাটস অফ! ‘
—‘তাহলে আজকের পর থেকে তোমার সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই।’ শাহজিদ চুপ করে রইল। তার চোখদুটো শূন্যে নিবদ্ধ। মুখে বিষণ্নতার গহন ছায়া।
তুরিন জায়গাটা থেকে চলে যাওয়ার আগে একবার শুধু উচ্চারণ করল, ‘ভালো থেকো শাহজিদ!’
গাড়িতে ফিরে এসে কান্নারত কণ্ঠে আনিতাকে বলল, ‘তুমি পেছনে যাও। আমি সামনে বসব।’
৬
ফারা খুব সহজে মুক্তি দিল না জাহিদকে। এমন শক্তিশালী ভুজবন্ধনে আটকে ফেলল যে ওই শীর্ণ, কোমল হাত দুখানি নিজের গলা থেকে ছাড়িয়ে নিতে জাহিদের বেশ বেগ পেতে হলো। ফারা আড়চোখে নিশাকে লক্ষ্য করছিল। এই মেয়ে সেজেগুজে সং সেজে জাহিদের গাড়ির কাছে কী করছে? তার বাড়ি ফিরতে অতিরিক্ত বিলম্ব হয়েছে এমন তো নয়, এর মাঝেই এতকাহিনি! অনিমেষটাকে বোঝাতে বোঝাতেই পাক্কা বিশ মিনিট চলে গেল। নইলে আরো আগেই উপস্থিত হওয়া যেত। ভাগ্যিস এসেছিল! তার মন বলছিল ডাইনিটা কোন গুপ্ত চক্রান্ত করে জাহিদকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করছে। হলোও তাই। একটু দেরি হলেই সর্বনাশ হয়ে যেত। এসব ভাবতে ভাবতে মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে অসংখ্যবার ধন্যবাদ জানাল সে যথাসময়ে তাকে ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেবার জন্য।
নিশা বিবর্ণ মুখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখছিল। সে ভুলে গিয়েছিল যে তার জীবনে এক টুকরো হাসির ঋণ শোধ করতে হয় সহস্র অশ্রুজল দিয়ে। ক্ষণিকের আনন্দের হিসেব-নিকেশ চুকিয়ে দিতে হয় অগণিত লাঞ্ছনা আর অপমানের ধূসর আশ্লেষকে বরণ করার মাধ্যমে। সে জানে জাহিদ ফারাকে…শুধু ফারাকেই ভালোবাসে। একথা নিজ মুখে স্বীকার করেছে বহুবার। অতএব ভালোবাসার রমণীর আবির্ভাব নিশার উপস্থিতিকে নিশ্চয়ই ফিকে করে দিয়েছে মুহূর্তের মধ্যেই। জাহিদের কিছু জরুরি কথা আছে বলেছিল, হয়তোফারার উপস্থিতি এখন ওর সমস্ত জরুরি কথা ভুলিয়ে দেবে। নিশা বুঝতে পারে ফারার মধ্যে মানুষকে বশ করার একটা অভূতপূর্ব শক্তি আছে। আর সেই মানুষ যদি পুরুষমানুষ হয়, তবে তো ওর বশীকরণ থেকে নিস্তার লাভ করা সেই পুরুষের জন্য প্রায় অসম্ভব। একটু আগে নিশার চোখে ছিল ঘোর, ছিল সর্বাঙ্গে শিহরণ। এখন সেই স্বপ্নঘোর কেটে গেছে। মনটা ডানা ভাঙা আহত রক্তাক্ত কবুতরের মতো দ্যুলোক থেকে আছড়ে পড়েছে ভূলোকের বাস্তব প্রেক্ষাপটে। কষ্ট হচ্ছে খুব। এত বেশি কষ্ট হচ্ছে যে জীবনে প্রথমবারের মতো একটা বিভীষণ ইচ্ছা মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। মন চাইছে জাহিদকে ফারার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়, তারপর ওর হৃদয়টাকে ছিঁড়েখুঁড়ে দোফালা করে ফারাকে টেনে বের করে আনে চিরকালের জন্য।
—‘তুমি বাইরে কী করছ? চলো ভেতরে চলো!’
জাহিদের মুখে এতক্ষণ একটা বিভ্রম খেলা করছিল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় ছিল চোখের চাউনি। ফারার মাত্র বলা কথাটা শোনার পর কয়েক সেকেন্ড সে বিপন্ন চোখে চেয়ে থাকল ওর দিকে। তারপর অবিচল কণ্ঠে বলল, ‘তুমি ভেতরে যাও। আমার একটু কাজ আছে।’
—‘কী কাজ?’ ফারা উৎসুক হয়ে প্রশ্ন করে। প্রশ্নের মধ্যে একটা আধিপত্যশীল ভাবগাম্ভীর্যের উপস্থিতি ছিল, যেটা জাহিদের একেবারেই মনঃপূত হলো না।
— ‘ভেতরে যাও। রেস্ট নাও। তুরিনকে ফোন করে খোঁজখবর নাও।’
কথাটা বলতে বলতে জাহিদ ড্রাইভিং সিটের দরজার দিকে এগিয়ে এলো। নিশাকে কিছু বলতে হলো না। যন্ত্রচালিতের মতো গাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ল সে, রুদ্ধশ্বাসে! ফারার চোখের দৃষ্টি হিংস্র হয়ে উঠল। দ্রুত পায়ে জাহিদের কাছে এগিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘কী এমন জরুরি কাজ পড়ল তোমার? আগে বলোনি তো!’
জাহিদ ড্রাইভিং সিটে উঠে সিটবেল্ট বেঁধে নিল, শুষ্কং কাষ্ঠং একটা হাসি হেসে বলল, ‘বলার প্রয়োজন বোধ করিনি।’ দড়াম শব্দে গাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে গেল। ক্রোধ এবং অপমানের ভয়ংকর শিখা জ্বলে উঠল ফারার মুখে। আগুন ধরা চোখে দেখতে পেল গাড়িটা মসৃণ পিচঢালা পথের ওপর দিয়ে ধীরেধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। অনিমেষ ফোন করে যাচ্ছিল বিরতিহীনভাবে। ফোন ধরে বিষাক্ত কণ্ঠে ফারা বলল, ‘কী চাই?’
অনিমেষ হাসে, ‘তোমাকে চাই বেবি!’
—‘ঢং করার সময় না এটা। তুমি জানো আমার কত বড় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে?’
—‘কীসের ক্ষতি?’
—‘উফ! তুমি বুঝবে না। ছাড়ছি এখন!’
—‘আমি আসছি তোমার ওখানে।’
—‘আজকে হবে না অনি!’
—‘কেন?’
ফারা বিরক্তিতে কাদা কাদা হয়ে গেল, ‘আমার মুড নেই।’ হঠাৎ করেই অত্যুগ্র হয়ে ওঠে অনিমেষের কণ্ঠস্বর, ‘ফারা শোন, অনেক হয়েছে। এবার তোমাকে আমার সম্পূর্ণভাবে চাই।’
—‘আগে আমার সংসারটা বাঁচাই, কেমন?’
—‘সংসার হবে…নতুন সংসার। তোমার আর আমার। সঙ্গে থাকবে আমাদের মেয়ে।’
—‘তোমার মাথাটা গেছে।’
—‘তুমি জাহিদকে ছাড়তে চাইছ না?’
ফারা বিভ্রান্ত গলায় বলে, ‘জাহিদকে ছাড়ার কথা আসছে কেন?’
—‘তুমি কি আমাকে ভালোবাসো ফারা?’
—‘এটা কেমন প্রশ্ন হলো? আমি তোমাকেই…শুধু তোমাকেই ভালোবাসি অনি!’
—‘তাহলে জাহিদকে ডিভোর্স দাও।’
ফারা একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করল, ‘আমি ছাড়ছি ফোন। মাথাটা খুব ধরেছে।’
—‘এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করো না। প্রয়োজনে আমি জাহিদের সঙ্গে কথা বলব।’
‘কী কথা বলবে?’ আঁতকে ওঠে ফারা।
—‘সত্যটা ওর জানা দরকার।’
ফারা আশপাশটা একবার সতর্ক চোখে দেখে নেয়। গলা খাদে নামিয়ে বলে, ‘খবরদার! জাহিদের কানে যেন একটা কথাও না যায়।’
—‘সরি বেবি! তোমার কথা মতো চুপ করে থাকা আমার পক্ষে আর সম্ভব না। জাহিদকে জানতে হবে ওর স্ত্রী কিংবা সন্তান কোনটাই ওর নিজের নয়। সবটাই আমার।’
এ কথা শুনে ফারার হাত-পা শিউরে উঠল। একটা বিপদ সংকেত ঢংঢং শব্দে বেজে উঠল বুকে। ভয়-টয় সাধারণত সে পায় না। কিন্তু আজকে তার কণ্ঠে ভয়ের উপস্থিতি পরিপূর্ণরূপে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠল।
—‘অনি প্লিজ! একটু ভাবার সময় দাও আমাকে। কোথায় আছ তুমি? আমি আসছি।’
—‘বাসায় আছি। চলে এসো।’
—‘ঠিক আছে।’ ফোনের লাইন কেটে ফারা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। এই মুহূর্তে অনিমেষের সঙ্গে দেখা করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না। কী করে ডাইনিটার জাল থেকে জাহিদকে ছাড়িয়ে আনা যায় সেই প্ল্যানটাই ঠাণ্ডা মাথায় গুছিয়ে নেবে বলে ভেবেছিল। কিন্তু অনিমেষ এমন গোঁয়ার্তুমি শুরু করল…উফ…! ওকে বোঝাতে হবে। ভালোবাসা দিয়ে, আদর দিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় পই পই করে বোঝাতে হবে যে কোন মতেই জাহিদকে তুরিনের জন্মবৃত্তান্ত জানানো যাবে না। বড় বড় দম নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল ফারা। গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করতে করতে ভাবল, তুরিনই এখন তার একমাত্র হাতিয়ার। নিশার সঙ্গে মোকাবেলার জন্য মেয়েটাকে খুব ভালো মতো প্রস্তুত করতে হবে। এমনিতেই মেয়ে যথেষ্ট জেদি আছে। বাবাকে যে করেই হোক ফিরিয়ে আনবে। মা-মেয়ে কোমর বেঁধে নেমে পড়লে নিশা-মুক্ত জীবন লাভে নিশ্চয়ই সফল হবে ওরা। এদিকে শাহজিদের সঙ্গেও একবার কথা বলাটা জরুরি। খুব দ্রুত ওই ল্যাংড়া ছেলেটার সঙ্গে যদি নিশা ডাইনিটাকে জুড়ে দেয়া যায় তাহলেই সব ঝামেলা মিটে যাবে। প্রয়োজনে জুবিনকে নিশার কাছে সঁপে দেয়া হবে। জাহিদের তুরিন আছে, জুবিন না হলেও চলবে! ড্রাইভ করতে করতে নিজের মনে পরিকল্পনাগুলো গুছিয়ে নেয় ফারা। কিন্তু এই অনিমেষ হঠাৎ এত ক্ষেপল কেন? অনিমেষের দেয়া হুমকিটা মনে পড়তেই দুশ্চিন্তায় মাথা ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। গাড়িতে উঁচু ভলিউমে গান বাজিয়ে দিল। পথে কিংসুপারে থামল। অনিমেষের জন্য কিনে নিল এক থোকা গোলাপ ফুল। ফুল উপহার দিয়ে, নানারকম ছলাকলা করে, ওই উদ্ধত, একগুঁয়ে লোকটাকে আপাতত ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখতে হবে।
এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘন ঘোর বরষায়
এমন মেঘস্বরে, বাদল ঝরঝরে
তপনহীন ঘন তমসায়
—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
.
বিস্ময়, বিভ্রান্তি এবং মানসিক বৈকল্যতার দরুন বুক ধড়ফড় করছিল নিশার। ঘটনাটা কি সত্যিই বাস্তবে ঘটেছে? যে মানুষ বাসর রাতে নির্ভেজালভাবে স্বীকার করেছিল, শুধু প্রথম স্ত্রীকেই সে মনে-প্রাণে ভালোবাসে এবং বাসবে…সেই সত্যনিষ্ঠ, দায়িত্ববান মানুষ আজ প্রিয়তমা স্ত্রীকে অগ্রাহ্য করে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে সেই মেয়েটিরই পাশে এসে বসেছে, যে মেয়েটিকে কখনো নিজের জীবনে স্বীকৃতি দেবে না বলে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করেছিল এক সময়। নিশার সঙ্গে কী এমন জরুরি কথা আছে তার? যা ফারার চাইতেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ? তাদের বিয়ে হয়েছে আজ থেকে তিন বছর আগে। এর মাঝে একজন সন্তানও এসেছে। কিন্তু কখনোই একসঙ্গে কোথাও যাওয়া হয়নি। এভাবে পাশাপাশি বসা হয়নি। আজকের দিনটি নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রম। জাহিদের গাড়ির ড্রাইভিং সিটের পাশের জায়গাটা ফারার জন্যই বরাদ্দ ছিল সবসময়। নিজের স্বামীর পাশে একদিন স্ত্রীর অধিকার নিয়ে দাঁড়াবে এমন কিছু কল্পনা করারও সাহস পায়নি কখনো নিশা। তার মনটা অনেক ছোটবেলা থেকেই অভাবে-অনটনে, সাংসারিক টানপোড়েনে সর্বদা সংকীর্ণ হয়ে থাকত। বিয়ের পরেও প্রতি পদে পদে বুঝেছে ভাগ্যক্রমে এই পরিবারের সঙ্গে গাঁটছড়ায় বাঁধা পড়লেও আদতে এমন অভিজাত পরিবারের যোগ্য সে নয়। এভাবেই স্বপ্ন দেখার শৌখিন সাহসটা দিনকে দিন হারিয়ে গেছে কঠোর বাস্তবতার অতল গহ্বরে। তবে আজকের এই ব্যতিক্রম মুহূর্তটিকে তার স্বপ্ন বলে ভ্রম হচ্ছে। হয়তো একটু পরেই জেগে উঠবে ঘুম থেকে জুবিনের কান্নার শব্দে কিংবা শাশুড়ির ডাকে।
জাহিদ একাগ্রচিত্তে গাড়ি চালাচ্ছিল। ভেতরটা এলোমেলো। নিশাকে নিয়ে এই বেরিয়ে আসাটা যেন রণক্ষেত্রে যুদ্ধাহত সৈনিকের লড়ে যাওয়ার মতো কষ্টকর এবং শ্রমসাধ্য ছিল! নিজের অভ্যন্তরীণ সত্তার সঙ্গে যুদ্ধ। ফারার সঙ্গে যুদ্ধ। প্রাণাধিক প্রিয় কন্যার উপরোধ গলা টিপে হত্যা করে নিজ স্বার্থপরতাকে জিতিয়ে দেয়ার দুঃসহ নির্মম যুদ্ধ। কিন্তু কেন? কেন এই মেয়েটিকে একটুখানি পাশে পাবার জন্য এত ব্যাকুলতা? কেন এত দ্বন্দ্ব, সংঘর্ষ এবং লড়াই? জাহিদ একবার তাকাল নিশার দিকে। ভদ্রতার খাতিরে প্রশ্ন করল,
—‘তুমি ঠিক আছ?’
—‘জি।’ নিশার অনেক কষ্টে দেয়া ছোট্ট উত্তর।
—‘কিছু খাবে?’
নিশা চমকালো। উনার সামনে জীবনে কিছু খেয়েছে কি না মনেই পড়ছে না। এখন তো উত্তেজনায় খিদে মরে ভূত হয়ে গেছে। খানা-খাদ্য গলা দিয়ে নামার প্রশ্নই আসে না। সে মিনমিন করে বলল,
—‘আমার খিদে নেই।’
—‘কোথায় যেতে চাও?’ জাহিদের কথার ধরনে মনে হচ্ছে ভাইভা বোর্ডের প্রশ্নকর্তা। নিশা অমন গুমোট প্রশ্নের ধরনে আরো বেশি মিইয়ে যায়। আস্তে করে বলে, ‘কী জানি!’
তারপর কী মনে করে আবার বলে, ‘সেদিন শাহজিদদের সঙ্গে গিয়েছিলাম একটা জায়গায়। ওই জায়গাটা সুন্দর।’
জাহিদ একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করল। শাহজিদকে নিশা ভুলতেই পারে না!
—‘তোমরা সেদিন টেবল মেসা গিয়েছিলে মনে হয়। ওখানেই যাবে?’
—‘জি যাওয়া যায়।’
কথাটা বলে নিশা ডান দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে আকাশ দেখতে লাগল। যেন আকাশে খুব জরুরি কিছু ঘটে যাচ্ছে। তার নিশ্চয়ই আরেকটু স্মার্ট হওয়া উচিত ছিল। জাহিদের পাশে ওর মতো গেঁয়ো মেয়ে বোধহয় একদমই মানায় না। ফারাকে দেখো না কত্ত স্মার্ট! চোখে-মুখে বুদ্ধির ঝিলিক খেলে বেড়ায় সারাক্ষণ। অমন বৌ রেখে জাহিদ কেনই বা নিশার মতো সাধারণ চাকচিক্যবিহীন হাবাগোবা টাইপ মেয়েকে পছন্দ করবে? এসব ভাবতে গিয়ে একটু দুঃখ দুঃখ ভাব হয়। হৃদয় তবুও উদ্বেল। এমন হাঁসফাঁস অনুভূতি আরো কিছুক্ষণ বুকের ওপর চেপে বসে থাকলে নির্ঘাত হৃদরোগে আক্রান্ত হবে। কী মুশকিল! জাহিদ দেখল নিশা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে আছে। মেয়েটাকে সে বোঝে না। আর বোঝে না বলেই ওকে বুঝবার জন্য, জানবার জন্য হয়তো মনটা এমন আনচান করে আজকাল।
বসন্তের আবির্ভাবে গাছপালার রং আগের চাইতে সতেজ হয়েছে। আদিগন্ত আকাশে এখন ঘন তামসিক ফেরারি মেঘের বিচরণ। কিছু ছাই রঙের মেঘ পঙ্খিরাজের মতো নেমে এসেছে মাটির খুব কাছাকাছি। দেখে মনে হয় হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। দুই লেনের রাস্তার মাঝখানে প্রশস্ত ঘাসযুক্ত ডিভাইডার। রাস্তার দুধারে মাইলের পর মাইল ছড়িয়ে আছে সমতল বিরানভূমি। বৃষ্টিপাত কম হয় বিধায় এসব জমির আগাছা আর ঘাস শুকিয়ে গেছে। সবুজ নয়, এই ঘাসের রং রুক্ষ বাদামি। লোকালয়ের ঘাসে কৃত্রিম জলসেচনের ব্যবস্থা করা হয় বলে সবুজ হয়ে ওঠে। বিরানভূমিতে মানুষের বিচরণ নেই। এই ঘাস রোদের তেজে ঝলসে থাকে সারা বছর। দূরের পাহাড় প্রাচীরের মতো পুরো শহরটাকে ঘিরে রেখেছে। যেদিকে চোখ যায় শুধু পাহাড় আর পাহাড়। আশ্চর্য এই পাহাড়ের রহস্য! দেখে দেখে কখনো একঘেয়েমিতে পায় না। আবহাওয়া পাল্টে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এর রূপ পাল্টায়। আজকে পাহাড়ের ওপর এমনভাবে ধোঁয়াটে মেঘ এসে ভিড়েছে যে হঠাৎ তাকালে মনে হয় পুরো আকাশটা নেমে এসে মিশে গেছে পর্বতের চুড়োয়। একটু ভালো মতো লক্ষ করলে আবার মনে হয় কোন আগ্নেয়গিরি থেকে নির্গত ধোঁয়া বুঝি ঊর্ধ্বগতিতে ধাবিত হচ্ছে আকাশে।
—‘গান শুনবে?’ জাহিদের প্রশ্ন।
—‘আপনি গান গাইতে পারেন?’ নিশা অবাক।
জাহিদ হাসল নিঃশব্দে, ‘আমি গান গাইতে পারি না। তুমি শুনতে চাইলে অডিও প্লে করতে পারি। তোমার কী ধরনের গান পছন্দ?’
নিশার কেন যে এমন অস্বস্তি হচ্ছে! জিব জড়িয়ে যাচ্ছে। শব্দ হারিয়ে যাচ্ছে। যাচ্ছেতাই অবস্থা! জানালার বাইরে চোখ রেখে নিম্ন স্বরে বলল, ‘রবীন্দ্রসংগীত।’
—‘তাই?’ প্রশ্নটা করে জাহিদ একটু থামল। তারপর মৃদু আফসোস নিয়ে বলল, ‘আমার কাছে তো রবীন্দ্রসংগীতের কালেকশন নেই। দুঃখিত।’
—‘আপনার কী ধরনের গান পছন্দ?’ নিশার আড়ষ্ট প্রশ্ন।
—‘আমার পছন্দ বোধহয় তোমার পছন্দ হবে না। শুনে দেখবে?’
—‘শোনা যায়।’
আয়রন মেইডেনের একটা হেভি মেটাল গান এয়ারকন্ডিশন্ড বদ্ধ গাড়িতে বেজে উঠতেই নিশার দম আটকে আসার উপক্রম হলো। দাঁত-মুখ খিঁচে বসে রইল সে। মন ভালো থাকলে জাহিদ পছন্দের গান শোনে। আজকে এই মুহূর্তে কী কারণে যেন তার মনটা অত্যধিক ভালো। কিন্তু ক্ষণিক বাদে নিশার বিরক্তিমাখা মুখটা আড়চোখে লক্ষ করে তাৎক্ষণিকভাবে বাজনা বন্ধ করতে বাধ্য হলো সে।
টেবল মেসা ড্রাইভে গাড়ি উঠতেই টিয়া রঙের ঘাসের কার্পেট মোড়ানো ঝকঝকে এক উপত্যকা ভেলকি দিয়ে ভেসে উঠল চোখের সামনে। ঢালু পাহাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা পাইনগাছের সারি অভিবাদন জানাল। ছবির মতো সুন্দর বাড়িঘর পেরিয়ে ধীরে ধীরে আরো উঁচুতে উঠতে লাগল ওরা। পাহাড়ের ওপর হাওয়া বড় বেশি দুরন্ত। মেঘের দাপটও তীক্ষ্ণ। ওয়ার্কিং ডে বলে লোকজনের ভিড় নিতান্তই কম। পার্কিং লটের পিচঢালা রাস্তার ওপারেই সোনালি ঘাসের বহর। আগাছাও আছে। আর আছে রঙিন বুনো ফুলের সমাহার এবং কিছু কাঁটাযুক্ত ক্যাকটাস। জাহিদ এগিয়ে যাচ্ছিল সামনে। নিশা ওকে অনুসরণ করল। ঘাস আর আগাছাযুক্ত সরু এবড়োখেবড়ো মাটির পথ পেরিয়ে ওরা পাহাড়ের কিনারে এসে দাঁড়াল। সামনে বিস্তৃত খোলা আকাশ। নিচে পাহাড়ি উপত্যকার বুকে দাঁড়িয়ে আছে সুসজ্জিত পরিপাটি শহর বোল্ডার। এই শহরকে অষ্টপ্রহর পাহারা দিচ্ছে কোন-আইসক্রিম আকৃতির অগণিত পাইন গাছ।
জাহিদ চোখ রেখেছে দূরের মেঘাচ্ছন্ন আকাশে। নিশা ওর পাশে দাঁড়ানো। কিন্তু নিশার উপস্থিতি যেন সে টের পায়নি। কেমন যেন অন্যমনস্ক ভাব খেলছে চোখে-মুখে। অদ্ভুত আছে কিন্তু লোকটা! নিশার ঠোঁটে অজান্তেই একটা মুচকি হাসির ঢেউ লাগল। এমন অদ্ভুত বলেই হয়তো ও অন্য সবার চাইতে আলাদা। নিশা জানে ওর জায়গায় অন্য কোন পুরুষ হলে এমন রোমান্টিক নির্জন জায়গায় অল্পবয়সি তরুণীর সান্নিধ্য পেয়ে হরেক রকম সস্তা রংঢং করত। প্রেম নিবেদনের সুযোগ হাতছাড়া করত না। কিন্তু এই মানুষটার মধ্যে হ্যাংলামো নেই, উপরন্তু ওর হৃদয়ের রংটা অনেক বেশি শুভ্র! নিশা যখনই মানুষটার আশেপাশে থাকে, ওই শুভ্র হৃদয়ের মনাকাড়া সুগন্ধি পায়।
তবে আজকে জাহিদের যে আচরণকে নিশা অন্যমনস্কতা ভাবছে সেই আচরণটুকু আদতে অন্যমনস্কতা নয়, বরং নার্ভাসনেস। কৃষ্ণাভ মেঘে ঢাকা রহস্যময় আকাশের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে জাহিদ ভাবছিল নিতান্তই অল্পবয়সি একটি মেয়ের সামনে তার এত নার্ভাস কেন লাগছে? স্পষ্ট বুঝতে পারছে নিশার উপস্থিতি রক্তে একটা তরঙ্গের সৃষ্টি করেছে। বুকে তিরতিরে কাঁপন ধরাচ্ছে। স্নায়ু বড় দুর্বল! কথা গুছিয়ে নেওয়া যাচ্ছে না। সবচেয়ে বিপজ্জনক ব্যাপার হলো জরুরি কথাটা সে বারবার অপ্রয়োজনীয় এলোমেলো ভাবনার ভিড়ে হারিয়ে ফেলছে। তার মনে পড়ছে না নিশাকে আসলে ঠিক কী কথা বলার ছিল। হঠাৎ একটা বক্ষচেরা দীর্ঘনিঃশ্বাস তার হৃদয় মথিত করে তুলল। মেয়েটাকে কেন এত বেশি ভালো লাগছে? ও তো চলে যাবে। শাহজিদের মতো কোন টগবগে হিম্মৎদার যুবক ওকে নিশ্চয়ই একদিন নিয়ে যাবে দূরে। ঘাড় ঘুরিয়ে নিশাকে দেখে একবার। নিশা ওকেই দেখছিল। চোখে চোখ পড়তেই অন্যদিকে ঘুরে তাকাল। মেয়েটা অসম্ভব লাজুক। হয়তো এই লাজুক ভাবটাই ওকে আরো বেশি সুন্দর করে তোলে। স্নিগ্ধ করে তোলে। মাতাল বাতাসে নিশার খোলা চুলগুলো উড়ছিল এলোমেলো। মেঘলা আকাশের ছায়া পড়েছে মেঘলা দুটি ডাগর চোখে। নীল শাড়ি পরা নিশার দিকে বিভোর হয়ে চেয়ে থেকে জাহিদের মনে হলো এই মেয়েটি বাড়াবাড়ি রকমের রূপবতী। সে জীবনে কখনোই এত সুন্দরী মেয়ে দেখেনি। এই রূপ যতখানি বাহ্যিক তার চাইতে অনেক বেশি আত্মিক। মানুষের মনের সৌন্দর্য যখন বাইরের আবরণে প্রভাব ফেলে, ছায়া ফেলে, শুধু তখনই সে এমন অতুলনীয় সুন্দর হয়ে উঠতে পারে।
—‘তুমি কেমন আছ নিশা?’ প্রশ্নটা ছুড়ে দিয়ে জাহিদ একটা গোলগাল ছাই রঙের পাথরের ওপর বসল। এই পাথরের চারিধারে গুচ্ছ গুচ্ছ হলুদ রঙের বুনো ফুল ধরে আছে।
—‘ভালো আছি।’ নিশা উত্তর দিল। দূরের মেঘের দিকে চোখ রেখে।
—‘এই জায়গাটা তোমার পছন্দ?’
—‘হুম পছন্দ।’
—‘পছন্দ হওয়ার পেছনে কোন বিশেষ কারণ আছে কি?’ প্রশ্নটা করে জাহিদ একটু তটস্থ হয়ে গেল মনে মনে। নিশা হয়তো সত্যটা বলবে না। কিন্তু জাহিদ জানে শাহজিদের সঙ্গে এসেছিল বলেই নিশার এই জায়গাটি প্রিয়। প্ৰিয় মানুষ পাশে থাকলে যেকোনো স্থান প্রিয় হয়ে ওঠে অনায়াসে। নিশা কাছাকাছি একটি পাথরের ওপর বসতে বসতে বলল, ‘এখানে দাঁড়ালে মনে হয় আমি বুঝি পৃথিবীর ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে আছি। দারুণ লাগে।’ জাহিদ একটু চমকলাগা চোখে তাকাল নিশার দিকে। পৃথিবীর ছাদ! ব্যাপারটা মজার তো!
—‘আপনার কেমন লাগছে?’ কথাটা বলে শেষ করে নিশা ওর ডাগর চোখের পাপড়ি মেলে ধরল জাহিদের মুখের ওপর। ছিপছিপে অথচ মজবুত গড়নের দীর্ঘদেহী মানুষটা ওর দিকেই তাকিয়ে ছিল। মুখে ক্লান্তির রেশ নেই। আছে গভীর বিষণ্নতার ছাপ। ফরসা, শীর্ণ মুখের ভালোমানুষি দুটি চোখে রিমলেস চশমাটা দারুণ মানায়! বাদামি ঠোঁটের কোণের একটুখানি কুঞ্চন যেন চেহারার সুশোভন অবয়বে একটা রহস্যময় তেজের স্ফুরণ ছড়িয়ে দেয়। নিশাকে বোধহয় ওই তেজটুকুই বেশি করে টানে। চুম্বক আকৃষ্টের মতো চেয়ে থাকে সে। জাহিদ একটু হেসে বলে, ‘আমার ভালো লাগছে। জায়গাটা সুন্দর। আমি অবশ্য আগেও এসেছি এখানে।
নিশার একটা কাঁপা কাঁপা শ্বাস পড়ে। অস্ফুটে বলে, হ্যাঁ জায়গাটা সুন্দর, কিন্তু জুবিনের বাবা আরো বেশি সুন্দর! জাহিদ কথাটা স্পষ্ট শুনতে পায় না। কান খাঁড়া করে প্রশ্ন করে,
—‘কিছু বললে?’
—‘না।’
একথার পর কেন যেন দুজনেই চুপ হয়ে যায়। হুহু করে হাওয়া বইতে থাকে। কিন্তু পাইনগাছের শরীর একটুও দোলে না। এসব গাছ প্রলয় মোকাবেলা করার মতো শক্তিশালী। ওরা যেখানে বসেছে তার এক হাত দূরেই মাটি ঢালু হয়ে নেমে গেছে বহু দূর। মিশে গেছে নিম্নভূমির শহরের সঙ্গে। শাহরের পথঘাট যেন পেন্সিলে আঁকা ছবি। রাস্তায় চলতে থাকা গাড়িগুলো খেলনার মতো ঠুনকো। যেন মানবসভ্যতার কোন অংশ নয়, ওটা আসলে পুতুলের সংসার। মেঘের পাতলা প্রাচীরের ওপর সূর্যের রুপালি আলো ঝিকোচ্ছিল। বাতাসে ভেজা মাটির সুন্দর গন্ধ। ওরা কেন চুপ করে আছে কে জানে! দুজনেই মুগ্ধ হয়ে প্রকৃতি দেখছে, কী যেন ভাবছে আর হঠাৎ হঠাৎ তাকাচ্ছে একে অপরের দিকে। এক বৃদ্ধ দম্পতি কাছাকাছি ঘুরে বেড়াচ্ছে অনেকক্ষণ হলো। হঠাৎ ওদের উদ্দেশে বলল, ‘হাই দেয়ার, উড ইউ মাইন্ড টেকিং অ্যা পিকচার অফ আস?’
জাহিদ সবিনয়ে রাজি হলো। সাদা চুলো বৃদ্ধ-বৃদ্ধা পাহাড়ের কিনারে দাঁড়িয়ে পেছনে উপত্যকার জাগ্রত শহর সঙ্গে নিয়ে ফ্রেমবন্দি হলো আইফোনের ক্যামেরায়। ছবি তোলা হলে জাহিদ ওদেরকে ফোন ফিরিয়ে দিল। বৃদ্ধ লোকটি সহাস্যে বলল, ‘তুমি চাইলে আমি তোমার এবং তোমার ওয়াইফের ছবি তুলে দিতে পারি।’
নিশা কথাটা শোনামাত্র একরাশ লজ্জায় ঝুপ করে ভিজে গেল। মুখ ফিরিয়ে নিল অন্যদিকে। জাহিদও একটু লাল হলো। সুন্দর হেসে বলল, ‘হ্যাঁ নিশ্চয়ই। আমাদের ছবি তুলে দিলে খুশি হব।’
আড়ষ্ট নিশা বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। এই প্রথমবারের মতো ওরা দুজন ক্যামেরাবন্দি হতে যাচ্ছে। নিশার চোখে-মুখে উদ্বেগের বিন্দু বিন্দু প্রলেপ পড়ছিল। বুক কাঁপছে খুব! জাহিদের মুখে হাসির উপস্থিতি আছে। কিন্তু সে দাঁড়িয়েছে নিশার কয়েক হাত দূরে। বৃদ্ধ লোকটি হাতের ইশারায় ওদেরকে ক্লোজ হতে বলল। জাহিদ একটু জড়তা নিয়ে নিশার কাছে এগিয়ে গেল। নিশা শক্ত হয়ে আছে। জাহিদ কী মনে করে যেন ওর কাঁধে একটা হাত রাখল। পাশে দাঁড়ানো বৃদ্ধা মহিলাটি ছোট্ট মন্তব্য ছুড়ে দিল, কিপ স্মাইলিং। ইউ বোথ লুক সো গ্রেট টুগেদার।
নিশা হাসল বুকের উত্তেজনার দাপাদাপি কাটিয়ে। সুন্দর দেখাল ওর সলজ্জ হাসিমাখা মুখ। বৃদ্ধ-বৃদ্ধা চলে যাওয়ার পরের কয়েকটা ক্ষণ অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে রইল দুজন। জাহিদ নিজের দিকে চোখ মেলে তাকাতে পারছিল না। একসময় সে পণ করেছিল এই মেয়েটিকে কখনোই স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করবে না। অথচ আজ বৃদ্ধ লোকটি যখন ওদের স্বামী-স্ত্রী বলল, তখন এক মুহূর্তের জন্যও প্রতিবাদ করতে ইচ্ছে করেনি। বরং এই স্বীকৃতি পেয়ে মনের মধ্যে একটা গোপন তৃপ্তির সঞ্চার ঘটে গেছে।
—‘আপনি বলেছিলেন জরুরি কথা আছে।’ নিশা বলল পাহাড়ের কিনার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। জাহিদ ওর কয়েক হাত দূরে দাঁড়ানো। নিশার কথার প্রত্যুত্তরে সে ভদ্র গলায় বলল, ‘আমি কি স্মোক করতে পারি? তুমি মাইন্ড করবে না তো?’
—‘মাইন্ড করব না। কিন্তু এটা তো ভালো অভ্যাস নয়।’
জাহিদ নীরবে হাসল শুধু। কিছু বলল না। পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে আগুন জ্বালাল। শান্ত স্থির গলায় বলল, ‘বাবা বলেছেন তোমাকে আর জুবিনকে একলা ছাড়বেন না। প্রয়োজনে তাঁরাও তোমাদের সঙ্গে থাকবেন।’
—‘তাই?’
—‘হুম। তাই তো বলল।’
—‘আর ডিভোর্সের ব্যাপারে উনাদের কী মতামত?’
জাহিদ সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে সরু চোখে কী যেন চিন্তা করে নিয়ে বলল, ‘আমাদের তো বিয়ের কোন কাগজপত্র নেই। তাই ডিভোর্সটা আসলে তেমন বিগ ইস্যু নয়। যেকোনো মুহূর্তেই হতে পারে।’
একটু থেমে জাহিদ আবার বলল,
—‘তোমার প্ল্যান কী নিশা?’
নিশা একটু দ্বিধা নিয়ে বলে, ‘আমার প্ল্যান?’
—‘হ্যাঁ…মানে ফিউচার নিয়ে কী ভাবছ?’
নিশা শূন্য চোখে চেয়ে থাকে। কী বলবে ভেবে পায় না।
—‘তোমার পড়াশোনা শুরু করা উচিত। তুমি বাংলাদেশে গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করেছিলে?’
নিশা ঘাড় নাড়ে, ‘জি না।’
—‘আনডার গ্র্যাডের সাবজেক্ট কী ছিল?’
—‘বিবিএ শুরু করেছিলাম। শেষ হয়নি।’
—‘এখানেও বিবিএ করতে পারো চাইলে।’
—‘জি।’
—‘কোর্স শুরু করার জন্য খুব সম্ভবত একটা ল্যাংগুয়েজ টেস্টের প্রয়োজন হতে পারে। তোমাকে আমি লিংক পাঠিয়ে দেব। নিজেই দেখবে, এক্সপ্লোর করবে। আর ড্রাইভিংটা শিখে ফেলো। একটা হ্যান্ডনোট পাঠাচ্ছি। ওটা পড়লেই রিটেন টেস্ট পাস করে যাবে। কঠিন কিছু নয়।’ কথা শেষ করে জাহিদ হাত বাড়িয়ে বলল, ‘তোমার মোবাইলটা দাও তো!’
নিশা নির্বাক ম্লান মুখে মোবাইল এগিয়ে দিল। সেপারেশনের কথাটা ওঠার পর থেকেই তার কিছু ভালো লাগছে না। এসব ছাইপাশ শিখে সে করবে কী? যদি লোকটা পাশেই না থাকে?
নিশার সেলফোনের স্ক্রিনে আঙুল চালাতে চালাতে জাহিদ বলল, ‘একটা অ্যাপ ডাউনলোড করে দিচ্ছি। এখানে তুমি প্র্যাক্টিস টেস্ট দিতে পারবে। লার্নার্স হয়ে গেলে ড্রাইভিং স্কুলে ভর্তি করে দেব তোমাকে।’
নিশা গাল ফুলিয়ে তেতো গলায় বলল, ‘ছবিগুলো আমার নাম্বারে পাঠিয়ে দিন।
—‘হ্যাঁ?’ জাহিদ ভ্রু তুলে তাকাতেই নিশা অপ্রতিভ হয়ে নামিয়ে নিল চোখ। কী কাণ্ড! লোকটা বলছে কীসব পড়াশোনার কথা আর নিশার মাথায় কি না অগামগা ছাত্রীর মতো ঘুরছে ঠুনকো কয়েকটা ছবির চিন্তা! সে লাজ-শরমের মাথা খেয়ে নতমুখে বলল, ‘না বলছিলাম যে, আপনার মোবাইলে তোলা ছবিগুলো আমার নাম্বারে পাঠিয়ে দিন।’
কথাটা শুনে জাহিদ একটু হাসল। প্রশ্রয় মিশ্রিত গলায় বলল, ‘হ্যাঁ দিচ্ছি।’ এসময় ওদের চোখাচোখি হলো একবার। সেই একটুখানি চোখাচোখিতে গুচ্ছ গুচ্ছ ভালোলাগার অনুভূতি সদ্য ডানা গজানো প্রজাপতির মতো তিরতির করে পাখা মেলে উড়াল দিল হাওয়ায়। পায়ের তলা শিরশির করে উঠল। জাহিদ কিছুক্ষণ নিশার লাজুক মুখখানার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থেকে বলল,
—‘আমার ওপর তোমার কোন রাগ নেই তো?’
নিশার বুকটা হঠাৎ অদম্য আবেগে টলমল করে ওঠে। কী যেন বলতে গিয়েও আবার থেমে যায়। শুধু চেয়ে থাকে ফ্যালফ্যাল করে। জাহিদ স্পষ্ট গলায় বলল, ‘তুমি আমার পরিবারের জন্য, আমার বাবা-মায়ের জন্য অনেক করেছ। নিজের সন্তানও এতটা করে না। তবে আমার সব সময় মনে হয় এমন জীবন তুমি ডিজার্ভ কর না। এবার নিজেকে নিয়ে, নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে তোমার ভাবা উচিত।’
নিশা চুপ করে থাকে।
—‘আমি চাই তুমি নিজের পছন্দ মতো জীবনটাকে সাজিয়ে নাও। এমনকি জুবিনকে নিয়েও তোমার ভাবনার কারণ নেই। ওর পাশে আমি আছি।’
নিশার চিবুকটা গলার সঙ্গে লেগে গেছে। সংকোচের প্রাবল্যে প্রায় বুজে এসেছে চোখের পাতা। জাহিদ একটা বড় শ্বাস টেনে নিয়ে বলল, ‘ফারা এবং তুরিনের আচার-আচরণ হয়তো তোমাকে নানা সময় কষ্ট দিয়েছে। আমি ওদের হয়ে তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি।’
কান্না কান্না একটা গুমোট হাওয়া নিশার বুকে চেপে বসল। সেতো সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছে। পৃথিবীর কারো প্রতিই তার কোন অভিযোগ নেই। তবুও এতকাল একটা চাপা কষ্ট ছিল। কারণ যে মানুষের জন্য সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করেছে, সেই বিশেষ মানুষটিই এই ত্যাগ এবং সংগ্রাম সম্পর্কে নির্বিকার। কিন্তু আজকের এই ক্ষমা চাওয়ার অমায়িক সুন্দর ভঙ্গিটি এতকালের বুকচাপা কষ্টকে ম্যাজিকের মতো উধাও করে দিল। নিশা ধরা গলায় বলল, ‘তুরিনের ওপর আমার কোন রাগ নেই। ওকে আমি নিজের মেয়ের মতোই দেখি।
জাহিদ স্তম্ভিত চোখে নিশার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। শেষের কথাটা শুনেছে ঠিকই, কিন্তু বোধগম্য হয়নি। অবাক গলায় প্রশ্ন করল, ‘কী বললে?’
নিশা চোখ তুলে তাকাল। দেখতে পেল উত্তাল বাতাসে মানুষটার ছোটছাঁটের কালো চুল উড়ছে। চোখে উপচে পড়ছে দুনিয়াজোড়া বিস্ময়। আকাশে বিদ্যুৎ ঝলসাচ্ছে অবিরত। ভর দুপুরবেলায় পাহাড়ে নেমে এসেছে সন্ধ্যার অন্ধকার। এমন বর্ষণমুখর আশ্চর্য দিনে যেন কোন কথাই গোপন রাখতে নেই। এমন দিনে সব বলা যায়। এমনই ঘন ঘোর বরষায়। এমন মেঘস্বরে, বাদল ঝরঝরে, তপনহীন ঘন তমসায়! নিশা মন্ত্রমুগ্ধের মতো বলল, ‘তুরিন তো আমারও মেয়ে। তাই না? আপনার মতো আমিও তার ভালো চাই। ওর ওপর আমার কোন রাগ নেই।’
জাহিদ স্তব্ধ, সম্মোহিত এবং নির্বাক হয়ে চেয়ে রইল নিশার দিকে অনির্বাচ্য থকথকে তরল অনুভূতিতে ছেয়ে উঠল মন। পুলকস্বর্বস্ব দুর্দমনীয় হর্ষ কেড়ে নিল বাকশক্তি। একটা সময় ভারি আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করল নিশা কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে বুক থেকে একটা পাষাণ ভার নেমে গেছে! এমন কিছু শুনবে বলে স্বপ্নেও আশা করেনি। কিন্তু শোনার পর মনে হচ্ছে যেন এই একটা কথার মধ্যেই তার জীবনের সমস্ত সমস্যার সমাধান নিহিত আছে! স্বার্থপর পৃথিবীতে নিশার মতো স্বার্থহীন মানুষ খুব কমই আছে। মেয়েটা কখনো নিজের কথা না ভেবে অন্যের ভালো-মন্দ নিয়ে উদগ্রীব থাকে বলেই হয়তো ওর সান্নিধ্যে এলে এত ভালো লাগে। জাহিদ কয়েকটা সেকেন্ড আবেগরুদ্ধ হয়ে বসে রইল। তারপর খুব ধীরেধীরে বলল, ‘তুমি আমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে তোমাকে কিছু দিতে চাই। কিন্তু বুঝতে পারছি না কী দেয়া যায়। নিশা দুর্বোধ্য হাসল। পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো জাহিদের কাছে। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
—‘হঠাৎ এই ইচ্ছে হলো কেন?’
—‘তোমাকে কখনো কিছু দেয়া হয়নি…তাই ভাবছিলাম…’
—‘দিয়েছেন।’
—‘দিয়েছি?’
—‘হ্যাঁ। জুবিনকে দিয়েছেন। আমার জীবনের সবচাইতে সুন্দর উপহার!
জাহিদের চোখে মুগ্ধতা ঝিলিক দিল। কত ছোট্ট একটা বাক্য! অথচ কত সুন্দর আর প্রভাবশালী! মন ভরে গেল কানায় কানায়! মেয়েটা এত চমৎকার কথা বলতে পারে জানা ছিল না।
—‘জুবিনের বিষয়টা আলাদা। আমি তোমাকে কিছু কিনে দিতে চাই নিশা। তোমার পছন্দের কোন জিনিস।’
—‘সত্যি?’
জাহিদ হাসল, ‘সত্যি।’
নিশার মুখটা এখন জাহিদের বুক বরাবর। দৃষ্টি উঁচু করে তাক করা। অবাধ্য হাওয়ায় কপালে এসে পড়ছে চূর্ণকুন্তল। চোখে জনম জনমের ঘোর। সে একটা কম্পিত হাত জাহিদের বুকের বাঁপাশে আলতোভাবে রেখে ব্যাকুল স্বরে বলল, ‘এখানে একটু জায়গা দেবেন?’
জাহিদের নিশ্বাস আটকে গেল ক্ষণিকের জন্য। গলার কাছে ভারী কিছু একটা দলা পাকিয়ে উঠল। হঠাৎ মনে হলো বুকের ভেতরের ওই স্থান যেন যুগ যুগ ধরে ফাঁকা পড়ে ছিল শুধু নিশারই অপেক্ষায়। নিশা একদিন আসবে, স্থানটির মালিকানা দাবি করবে, এই বুঝি ছিল জন্ম-জন্মান্তরের মন্ত্রণা!
—‘জায়গা দিয়ে কী হবে?’
নিশার চোখের কার্নিশে চিকচিক করে উঠল অশ্রুবিন্দু। চাপা গলায় বলল,—’একটা বাড়ি বানাব।’
—‘সেই বাড়ি যে ঝড় এসে গুঁড়িয়ে দিয়ে যাবে না তার নিশ্চয়তা আছে কি?’
—‘আপনি শুধু জায়গাটা লিখে দিন আমার নামে। বাদবাকি দায়িত্ব আমার।’
সেই সময় আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঝলসে উঠল বিদ্যুৎ। তারপর বৃষ্টির একটা বড় ফোঁটা এসে পড়ল নিশার মোমে মাজা মসৃণ গালে। যেন সদ্য প্রস্ফুটিত কোন কুসুম পল্লবকে ছুঁয়ে দিল ভোরের নিষ্পাপ শিশির। জাহিদের ঠোঁটে কী কারণে যেন একটা নিগূঢ় হাসির রেখা ফুটে উঠল। সে নিশার গালে এসে পড়া রুপো রঙের জলবিন্দুতে আঙুল রাখল। তারপর ওর সারা মুখে ওই জলটুকু দিয়ে এমনভাবে আঁকিবুকি করতে লাগল যেন পোট্রেট আঁকছে। নিশা চোখ বুজে ফেলল। শিরশিরে এক কাঁপন ধরল সর্বাঙ্গে। নিশার রক্তাভ দুটি ঠোঁট একনিষ্ঠভাবে বৃষ্টির জল দিয়ে আঁকতে আঁকতে জাহিদ বিষাদ ডোবা নেশাগ্রস্ত গলায় বলল, ‘ভালোবাসায় আমার আর বিশ্বাস নেই,জানো নিশা?’
নিশা আঙুলটা খপ করে ধরে ফেলে ডাগর চোখ মেলে গভীরভাবে তাকাতেই রক্তে একটা প্রলয়ের আভাস টের পেল জাহিদ। হৃৎপিণ্ড কেঁপে উঠল। হাত বাড়িয়ে নিশার লতার মতো নরম শরীরটা কাছে টেনে নিল সে। জড়িয়ে ধরল বুকের সঙ্গে শক্ত করে। নিভে এলো সমস্ত যন্ত্রণা আর অতৃপ্তির আর্তনাদ।
বৃষ্টির তেজ বাড়ছে। মেঘ ডাকছে ঘন ঘন। উতলা বাতাসে বুনো ফুলের পাপড়ি উড়ছে এলোমেলো। পাহাড়ের নিচের শহর ক্রমেই আবছা হয়ে আসছে। আবছা হয়ে আসছে সমগ্র বিশ্বচরাচর!
নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ
তুরিনের রক্তবর্ণ চোখ দেখে অর্ণব রীতিমতো ভয় খেয়ে যাচ্ছে। গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে আড়ে আড়ে দেখছিল সে মেয়েটির পাণ্ডুবর্ণ মুখখানা। ওই মুখে এখন কোন রক্তের সঞ্চার নেই। শূন্যগর্ভ দৃষ্টি মেলে চেয়ে আছে সামনে। হঠাৎ তাকালে মনে হয় মরা মানুষ। এদিকে পেছনের সিটে চুপচাপ বসে থেকে শাহজিদের হৃদয় এই ভেবে ভেতরে ভেতরে পীড়িত হচ্ছিল যে আজকের পর থেকে সে অর্ণবের চোখে চোখে তাকাবে কোন সাহসে? তুরিন তো বরাবরই ছেলেমানুষ, অদূরদর্শী এবং কিছুটা ছিটিয়াল। কিন্তু শাহজিদ একজন চিন্তাশীল, বিবেচক মানুষ হয়ে এতবড় ভুল কী করে করল? অর্ণব ছেলেটা সাদামাটা মনের অধিকারী। প্রথম দর্শনেই ভালো মানুষ বলে মনে হয়েছিল। সহজ-সরল ছেলেটার সঙ্গে না চাইতেও এক অমার্জনীয় প্রতারণা করা হয়ে গেল। এই সকণ্টক, পীড়াদায়ক অপরাধ বোধ শাহজিদকে এখন স্বস্তিতে শ্বাস ফেলতে দিচ্ছে না।
বেশ অনেকক্ষণ ধরে ওরা কেউ কোন কথা বলছে না। ঝিমোচ্ছে বসে বসে। আনিতার সেলফোনটা বেজে উঠল হঠাৎ। ধরতেই ওপাশ থেকে ফারা বলল,
—‘তোমরা কোথায়?’
—‘অন দ্য ওয়ে হোম চাচি…তোমার গলা এমন শোনাচ্ছে কেন? ইজ এভরিথিং অলরাইট?’
—‘তুরিন কোথায়? ওকে কল করছি সেই তখন থেকে। ফোন ধরছে না কেন?’
আনিতা একটু দ্বিধা নিয়ে বলল, ‘ফোন ধরছে না কেন তা তো ঠিক বলতে পারলাম না। তুমি ওর সঙ্গে কথা বলবে?’
—‘হ্যাঁ প্লিজ। ফোনটা দাও ওকে।’
আনিতা সামনের দুই সিটের মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থানে হাত গলিয়ে দিয়ে বলল, ‘তুরিন, ফোনটা ধর। চাচি ওয়ান্টস টু টক।’
তুরিন ঝড়ের আঘাতে মটকে যাওয়া গাছের ডালের মতো জীর্ণ ভঙ্গিতে হাতটা বাড়িয়ে দিল। ফোন কানে নিয়ে নিষ্প্রভ গলায় বলল, ‘হ্যালো!’
ফারা ধমকে উঠল ‘কোথায় তুমি? কতবার কল করলাম? ফোন ধরো না কেন?’
—‘নোটিস করিনি। তুমি কোথায়? তোমার তো এখন ফ্লাইটে থাকার কথা!’
ফারা ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘ইউ হ্যাভ নো আইডিয়া হোয়াট আই অ্যাম গোইং ধ্ৰু!’
তুরিন উৎসুক হয়ে উঠল, ‘হোয়াট হ্যাপেন্ড? তোমরা ট্রিপে যাওনি?’
—‘তোমার বাবা যায়নি।’
এ কথা শুনে তুরিনের কণ্ঠস্বর আচমকা ফেটে পড়ল বজ্রপাতের মতো, ‘কেন?’
ফারা বিষাক্ত গলায় বলল, ‘আমাকে এয়ারপোর্টে ফেলে রেখে তোমার বাবা ছুটে এসেছে বাসায়। আমি ওর পিছু পিছু দৌড়ে এসে কী দেখেছি জানো? দেখেছি তোমার বাবা ওই গেঁয়ো আনকালচারড স্লাটটাকে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।’
ভয়ংকর এক ছন্নছাড়া ক্রোধ যেন মুহূর্তের মধ্যে তুরিনের সারা গায়ে আগুন ধরিয়ে দিল। চিৎকার করে বলল, ‘বেরিয়ে যাচ্ছে মানে?’
ফারা একটু কান্নাকান্না ভাব সৃষ্টির চেষ্টা করল গলায়, ‘বেরিয়ে গেছে…তোমার বাবা…আমার চোখের সামনে ওই মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে গেছে। এবার তুমিই কিছু কর!
তুরিনের হাত-পা কাঁপতে লাগল রাগে। অদম্য রোষানলের আদিগন্ত উত্তাপে পুড়তে পুড়তে তার মনে হলো নাক-কান সব বধির হয়ে আসছে। হৃদযন্ত্রটা বোধহয় আরেকটু হলেই বিকল হয়ে যাবে। কেন তার সঙ্গেই প্রকৃতি সবসময় এমন নিষ্ঠুর পরিহাস করে? কেন তার ভালোবাসার মানুষটা কাছে এসেও ধরা দিতে চায় না? কেন তাকে ভালোবাসে না? কেন তার বাবা তার মাকে অন্য মেয়ের সামনে অপমান করে বারবার? জীবনের সমস্ত অপ্রাপ্তি, সমস্ত অপমান যেন হিংস্র দানবের মতো প্রকট আস্ফালনে একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর বুকে। কাঁপতে কাঁপতে বাবার নম্বরে ডায়াল করল সে।
.
সাদা বৃষ্টির ঘেরাটোপের মধ্যে ওরা দুজন দাঁড়িয়ে ছিল। গোটা আকাশটা বুঝি ধসে পড়ছে জনশূন্য সুনসান পাহাড়ের ওপর। বৃষ্টির ছাঁটে চোখের কিনারা ঝাপসা হয়ে এসেছে। সেই ঝাপসা বৃষ্টির পর্দার ভেতর দিয়ে জাহিদ দেখল তুষারকন্যার মতো গোলাপি গালের আশ্চর্য সুন্দর মেয়েটা তার দিকে নেশারু চোখে চেয়ে আছে। উদ্দাম বাতাস তার চুল নিয়ে খেলছে। ঠোঁটে ঝিকমিক করছে রহস্যময় মিষ্টি আহ্বান। জাহিদ এই পাহাড়ি বৃষ্টির কনকনে শীতেও নিজের নিঃশ্বাসে উত্তাপ টের পেল। শরীরের যেসব রক্তকণিকারা বহুদিন ধরে বরফ বিন্দুর মতো থমকে ছিল…জমে ছিল অথর্ব বৃদ্ধের মতো… সেই সব জমাট বাঁধা বরফকুচিতে বসন্তের পেলব রোদের আঁচ এসে লাগল যেন। রোদ- রাঙ্গা আকাশের মতো মস্ত এক উষ্ণ হৃদয় বুকে নিয়ে জাহিদ নিজের ভেতরকার দুর্বলতাটাকে সমগ্র সত্তা দিয়ে অনুভব করতে করতে কেঁপে উঠল অজ্ঞাত, অচেনা এক গা শিউরে ওঠা বিস্ময়ে। তার মনে হলো এত প্রবলভাবে জীবনে কোন মানুষ তাকে টানেনি। যেভাবে এই মেয়েটি টানছে এখন…টানে সব সময়…! নিশা অপেক্ষা করছে…জাহিদের কাটাকাটা মুখশ্রীর দিকে কাঙালের মতো চেয়ে থেকে নিজের সমস্ত স্নিগ্ধতা আর সিক্ততাকে প্রাণপণে উজাড় করে দেবার জন্য মনে মনে ভীষণভাবে অপেক্ষা করছে! অপেক্ষা করেছে রাতের পর রাত…
…দিনের পর দিন…যেভাবে বৃষ্টির আশায় চাতক তৃষিত নয়নে চেয়ে থাকে আকাশ পানে! আতঙ্ক-মেশা তীব্র আনন্দের আভাসে কেমন জ্বর জ্বর লাগছে তার। জাহিদের মুখটা ওর মুখের ওপরে ঝুঁকে আসছিল, ঠিক সেই সময় সেলফোন ঝনঝন করে বেজে উঠল। জাহিদ অপ্রস্তুতভাবে থমকে গেল। প্যান্টের পকেটে বাজতে থাকা ফোন হাতে নিয়ে এক নজর দেখল তুরিনের নম্বরটা। নিশাকে আস্তে করে বলল, ‘তুরিন কল করছে।’ কথাটা শুনে নিশা একটু সরে এলো জাহিদের কাছ থেকে। মনের মধ্যে কাঁটার মতো খচখচ করে বিঁধে রইল একটা অসমাপ্ত, ব্যর্থ এবং পিপাসার্ত চুম্বন।
জাহিদ ফোন ধরে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে তুরিনের কান্নায় ছটফট করা অস্থির কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।
—‘বাবা! তুমি কোথায়?’
জাহিদ খুব বিচলিত হয়ে পড়ল, ‘এইতো আছি…তুমি কোথায়?’
—‘আছি মানে কী? তুমি মায়ের সঙ্গে ট্যুরে যাওনি?’
জাহিদ অপরাধবোধে ন্যুব্জ হয়ে বলল, ‘না…যাওয়া হয়নি!’
—‘কেন বাবা?…কেন?’ তুরিনের গগনবিদারী চিৎকার জাহিদকে উদ্বিগ্ন করে তুলল। মেয়েটা এরকম অপ্রকৃতস্থের মতো চ্যাচাচ্ছে কেন? জাহিদ ত্রস্ত কণ্ঠে বলল, ‘কাম ডাউন মা…শান্ত হও..’
তুরিন কাঁদতে লাগল মানসিক ভারসাম্যহীন রোগীর মতো, ‘হোয়াই আর ইউ ডুইং দিস বাবা? তুমি আমাকে প্রমিজ করছিলে ওই মেয়েটাকে ছেড়ে দেবে। এরপরেও আমার মাকে কষ্ট দিয়ে তুমি ওর হাত ধরে বেরিয়ে গেছ। হাও কুড ইউ ডু দিস টু মাই মম? হাও কুড ইউ বাবা?’
মেয়ের কান্না শুনে জাহিদের বুক মুচড়ে উঠল কষ্টে। দিশাহারা হয়ে বলল, ‘মা শোন, আই নো ইউ আর আপসেট, আই নো আই রংড ইউ বাট আই অ্যাম গননা ফিক্স ইট…ওকে?’
হঠাৎ আনিতার কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, ‘চাচ্চু! তুমি এখন কোথায়?’
—‘আমি বাড়ির ধারে-কাছেই আছি। তোমরা কোথায়?’
—‘আমরাও কাছকাছি চলে এসেছি। তুরিন খুব কান্নাকাটি করছে।’
—‘তুমি ওকে একটু সামলাও। আমি বাড়ি ফিরছি। বাড়ি ফিরে কথা হবে।’
ফোনের লাইন কেটে দিয়ে জাহিদ নিশার দিকে না তাকিয়েই ব্যস্ত গলায় বলল, ‘চলো!’
—‘কী হয়েছে? সব ঠিক আছে তো?’ জাহিদ প্রশ্নটা বোধহয় শুনেও শুনল না। দ্রুতপদে এগিয়ে যেতে লাগল পার্কিং লটের দিকে। নিশা দ্বিতীয়বার কোন প্রশ্ন করার সাহস পেল না। সে জানত স্বপ্নটা ভাঙবে। তার মতো দুর্ভাগা মানুষদের এই পৃথিবীতে স্বপ্নে বসবাস করার অনুমতি নেই। কষ্ট হচ্ছে না, কান্না পাচ্ছে না…শুধু মনে হচ্ছে একটু আগের অদম্য ভালোলাগার অনুভূতিতে ঝপ করে কেউ আলকাতরা ঢেলে দিয়েছে। নিজেকেই নিজের কাছে আলকাতরা মাখা সং সাজা ভূতের মতো হাস্যকর লাগছে। জাহিদ নিঃশব্দে গাড়ি ড্রাইভ করতে লাগল। তার মুখে দুশ্চিন্তা আর উদ্বেগের ভয়াবহ দৌরাত্ম্য! নিশা জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে বিষণ্ন চোখে দেখছে বৃষ্টিভেজা পাহাড়ি উপত্যকা। বুকটা হুহু করছে হতাশায়।
তুরিনের কথা শুনে টাস্কি খেয়ে গেছে অর্ণব। তার মুখে খেলছে ভয়ংকর বিভ্রম এবং কৌতূহল। হবু শ্বশুরের কি তাহলে এক্সট্রা ম্যারিট্যাল অ্যাফেয়ার আছে? তুরিনের কথা শুনে তো সেরকমই মনে হলো। অথচ জাহিদকে সে নিতান্তই ভদ্র মানুষ ভেবেছিল। দেখলে তো মনে হয় লোকটা আগাগোড়া ভালোয় মোড়ানো। এই ভালোত্বের মুখোশের আড়ালে যে এমন কদর্য ব্যক্তিসত্তা লুকিয়ে আছে তা কে জানত! ছিঃ ছিঃ ঘেন্নায় গা গুলিয়ে উঠছে অর্ণবের। তুরিনের জন্য কষ্ট হচ্ছে। বেচারী মেয়েটা কী ভয়ংকর মনঃকষ্টের ভেতর নিয়েই না দিনাতিপাত করছে!
শাহজিদ পেছনের সিটে বসে থেকে তুরিনের কান্নাভেজা অগ্নিশর্মা মুখটা লক্ষ করছিল। রক্তবর্ণ চোখে হিংস্রতা ঝলসে উঠছে। মনে হচ্ছে মেয়েটা এখন মানুষও খুন করতে পারবে। ওই অপ্রকৃতস্থ মুখের দিকে চেয়ে থেকে শাহজিদের ভেতরটা দুশ্চিন্তায় দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। বাড়ি ফিরে পাগলটা নিশার সঙ্গে কী আচরণ করবে আল্লাহ জানে! কোন দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বসবে না তো?
বাড়ির সামনের ড্রাইভওয়েতে জাহিদের গাড়ি দেখতে পেল ওরা। অর্ণবকে গাড়ি পার্ক করার সময় দিল না তুরিন। তাড়া দিয়ে বলে উঠল, ‘থামো, আমি এখানেই নামব!’
অর্ণব এই কঠোর আদেশ শুনে তড়িঘড়ি করে গাড়ি থামাল। ঝড়ের বেগে নেমে পড়ল তুরিন। শাহজিদ জানাল সেও এখানে এই মুহূর্তে নেমে যেতে চায়। অর্ণব গাড়ির ট্রাংক থেকে ক্রাচ বের করল। শাহজিদকে গাড়ি থেকে নামতে সাহায্য করল। তুরিন তখন বাড়ির ভেতর ঢুকে গেছে হনহনিয়ে। শাহজিদ ক্রাচে ভর দিয়ে প্যাটিওর সামনে এসে দাঁড়াল। সিঁড়ি ভেঙে ওপরে ওঠা তার পক্ষে সম্ভব নয়। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল অর্ণব-আনিতা গাড়ির ভেতরে বসে আছে। অর্ণব গাড়ি পার্ক করছে ধীরেসুস্থে। ওদের সাহায্য ছাড়া ভেতরে যাওয়া সম্ভব হবে না। ভেতরে যাওয়া উচিত হবে কি না সেটাও বুঝতে পারছে না। একরাশ দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে অসহায় শাহজিদ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল প্যাটিওর সামনে। হঠাৎ বাড়ির ভেতর থেকে তীব্র ভাঙচুরের আওয়াজ ভেসে এলো। শিউরে উঠল শাহজিদ
বক্ষ হইতে বাহির হইয়া
আপন বাসনা মম
ফিরে মরীচিকা সম!
— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
.
বাড়ির ভেতর থেকে ছুটে আসা ভাঙচুরের শব্দ শুনতে শুনতে শাহজিদ ক্রমেই নিজের অপারগ, ক্ষমতাশূন্য, বলহীন সত্তার কণ্টকিত উপস্থিতি সমূলে অনুভব করছিল। প্যাটিওর চারধাপ সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে ভেতরবাড়িতে তুরিনের কাছে পৌছুনোটাই তার জন্য এক অসম্ভব ব্যাপার! কী ভয়ংকর রকমের অসহায় সে! হঠাৎ আনিতার কণ্ঠস্বর কানে এসে লাগল, ‘ওয়ানা গেট ইনসাইড?’
শাহজিদ একটু অপ্রস্তুত হলো প্রশ্নটা শুনে। ভেতরে যাবে? কী হবে গিয়ে? সেই সময় একটা কালো লম্বা ছিপছিপে দেহের লোক বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। আনিতা হাসল তাকে দেখে, ‘হাই আংকেল! হাউ ইজ গোইং?’
অনিমেষ আনিতাকে আলগাভাবে একটু আলিঙ্গন করে ওর গালের সঙ্গে গাল লাগিয়ে শূন্যে চুমু খেয়ে বলল, ‘আই অ্যাম গ্র্যান্ড। তুমি কেমন আছ?’
—‘গুড সো ফার।’
অনিমেষকে দেখে মনে হলো বেশ তাড়াহুড়ায় আছে। আনিতাকে ছেড়ে দিয়ে তড়িৎপদে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ল সে।
—‘তুমি কি ভেতরে যেতে চাও?’ আনিতার প্রশ্ন, শাহজিদের উদ্দেশে। শাহজিদ দ্বিধা নিয়ে বলল, ‘না…থাক। সিঁড়িতে বসব। একটু হেল্প করবে?’
—‘শিওর!’
শাহজিদ বসল সিঁড়ির প্রথম ধাপে। ক্রাচ দুটো শুইয়ে রাখল মাটিতে। আনিতা বসল এক ধাপ ওপরের সিঁড়িতে। ক্ষণিক বাদে অর্ণবও ওদের সঙ্গে এসে যুক্ত হলো।
ভাঙচুর করার অভ্যাসটা তুরিনের আগে ছিল না। এটা নতুন। জাহিদ স্তম্ভিত চোখে মেয়ের বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড দেখছে। শ্বাস পড়ছে না তার। হৃৎপিণ্ড জমে গেছে রোমহর্ষক বিস্ময়ে। নিশা জাহিদের পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপছে। মুখ সাদা। লিভিং রুমের শোকেজে রাখা সমস্ত কাচের জিনিস একটা একটা করে ডাকিনীর মতো হিংস্র ভঙ্গিতে ছিনিয়ে নিচ্ছে তুরিন। শরীরের সমস্ত বল প্রয়োগ করে ছুড়ে ফেলছে দূরে। ভাঙা কাচের টুকরোতে চৌচির হয়ে যাচ্ছে ঘরের মেঝে। ছোট ছোট দুটি চোখে রক্তের দাপাদাপি। ঘাতকের মতো ক্রুর দৃষ্টি। ফ্যাকাসে গালের চামড়ায় নীল শিরা কাঁপছে কপকপ করে। চিৎকার করে কাঁদছে তুরিন। এমনভাবে কাঁদছে যে দেখে মনে হচ্ছে এই মেয়েটির কোন নিকটজন বুঝি কিয়ৎক্ষণ আগে মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে। অনতিদূরে কিচেন কাউন্টারের টুলে বসে ফারা ভাবলেশহীন চোখে মেয়ের ধ্বংসাত্মক উচ্ছন্ন ক্রিয়াকাণ্ড দেখছে। অরেঞ্জ জ্যুসের গ্লাসে ধীরস্থিরভাবে চুমুক দিচ্ছে। অনিমেষ এসে দাঁড়িয়েছে ওর পাশে। বিস্ময় নিয়ে বলছে, ‘কী ব্যাপার? কী হয়েছে?’
ফারা নিরুত্তাপ গলায় বলল, ‘দেখতেই তো পাচ্ছ!’
—‘তুরিন এরকম করছে কেন?’
ফারা একটা আলগা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘ওদের বাবা-মেয়ের সমস্যার মধ্যে আমরা ইন্টারফেয়ার না করি। কেমন?’
অনিমেষ জ্বলন্ত চোখে তাকাল ফারার দিকে, ‘এভাবে বড় করছ তুমি আমার মেয়েকে? দিন দিন একটা বদ্ধ উন্মাদে পরিণত হচ্ছে এই বাড়িতে থাকতে থাকতে!’
ফারা ঝপ করে উঠে দাঁড়িয়ে অনিমেষের কনুই চেপে ধরে বলল, ‘শশশ…আস্তে…কেউ শুনবে! তুরিন ঠিকই আছে। ওকে নিয়ে তোমার দুশ্চিন্তা করতে হবে না।’
জাহিদ ওই ভাঙচুরের ধ্বংসলীলার মধ্যেই শ্বাসরুদ্ধকর পদক্ষেপ ফেলে এগিয়ে গেল মেয়ের কাছে। পায়ে জুতো আছে বিধায় কাচ বিঁধল না। কিন্তু তুরিনের পা অনাবৃত। এর মাঝেই কাচের টুকরো তার চন্দন রঙের ফুটফুটে সুন্দর পায়ের পাতায় গেঁথে গেছে। মনে হচ্ছে যেন রক্ত দিয়ে আলতা পরেছে মেয়েটা। তুরিন একটা মার্বেল পাথরের বড়সড়ো মোমদানি দেয়ালের দিকে ছুড়ে মারার জন্য উদ্যত হয়েছিল। জাহিদ মেয়ের হাত খপ করে ধরে ফেলে নিরস্ত করার চেষ্টা করল। তুরিনের ছিপছিপে শরীরে রাগের ঝংকার থাকলেও বল তেমন একটা নেই। জাহিদের সঙ্গে ধস্তাধস্তিতে পারল না সে। আত্মসমর্পণ করতে হলো। জাহিদ মোমদানিটা ওর হাত থেকে ছিনিয়ে নিল। রাখল পাশের সোফার ওপর। কাঁপতে থাকা, ফুঁসতে থাকা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘তুমি এমন করছ কেন মা? শান্ত হও। প্লিজ শান্ত হও।’
তুরিনের মুখের ফাঁকে সাদা ফ্যানা ভেসে উঠেছে। শুষ্ক ঠোঁটে অস্বাভাবিক কাঁপন। কান্নার হিক্কা তুলতে তুলতে সে অস্পষ্ট গলায় বলতে লাগল,
—‘ইউ ডোন্ট লাভ মি এনিমোর বাবা! ইউ ডোন্ট লাভ মি…’ এটুকু বলে অনতি দূরে দাঁড়িয়ে থাকা নিশার দিকে শ্বাপদ চোখে চেয়ে তুরিন উন্মাদের মতো চিৎকার করে উঠল, ‘ইউ লাভ হার…ইউ লাভ দ্যাট ব্লাডি বিচ…’ বুকের মধ্যে একরাশ রক্তের তোলপাড় নিয়ে নিশা দেখল জাহিদ দুদিকে মাথা নাড়তে নাড়তে দৃঢ় গলায় বলছে, ‘না না তুমি ভুল বুঝেছ মা…তুমি ভুল বুঝেছ…’
ভুল বুঝেছ! এই দুটি শব্দ মুহূর্তের মধ্যে ছুরির মতো খুরধার হয়ে উঠে নিশার হৃৎপিণ্ডের জমিনটাকে তীব্র রোষের সঙ্গে ফালাফালা করে দিতে লাগল। সমগ্র পৃথিবী যেন ডাকাতিয়া অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে চারধার থেকে তীব্র বিদ্রুপের সঙ্গে একযোগে বলতে লাগল…’ভুল বুঝেছ…ভুল বুঝেছ!’
খণ্ডিত, চূর্ণ-বিচূর্ণ মন নিয়ে নিশা কয়েক পা পিছিয়ে এলো। তারপর এক ছুটে দৌড়ে গেল সিঁড়ির দিকে। দোতলার সিঁড়ির মুখের হলওয়েতে শাশুড়ি দাঁড়িয়ে ছিলেন ঘুমন্ত জুবিনকে কোলে নিয়ে। শাশুড়ির মুখে আতঙ্কের চিহ্ন। নিশাকে দেখামাত্র তিনি উৎসুক গলায় প্রশ্ন করলেন, ‘কী হয়েছে বৌমা?’
নিশা থমকে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ ঝাপসা, ফাটা দৃষ্টিতে শাশুড়ির দিকে চেয়ে থেকে অবরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, ‘আমি এখানে আর থাকব না মা! আমি আজকে এই মুহূর্তে এখান থেকে চলে যাব।’ কথাটা বলে সে পাগলের মতো দপদপ করে নিজের ঘরের দিকে হেঁটে গেল। শাশুড়ি পিছু নিলেন, ‘কী বলছো আবোল তাবোল? তোমার শ্বশুর বাড়িতে নেই এখন। উনি আসুক…তারপর একটা ফয়সালা হবে।’
নিশা শাশুড়ির কথা শুনেও শুনল না। বিষদগ্ধ অগ্নিবাণে সারা শরীর জ্বলে যাচ্ছে তার। ছাই হয়ে যাচ্ছে দেহ-মন-আত্মা। নিজের সমস্ত মান-সম্মান, আত্মমর্যাদা সাঙ্গ করে আজ ওই লোকটার কাছে সমস্ত হৃদয় সমর্পণ করেছিল। এমন স্বার্থশূন্য নিষ্কলুষ সমৰ্পণকে সেই মানুষটা একটু আগে হাস্যকর উপহাসে রূপান্তরিত করে দিয়েছে। দৃঢ় কণ্ঠে মেয়ের কাছে স্বীকার করেছে সে নিশাকে চায় না…ভালোবাসে না। এমন পাষণ্ড জগতে কি আর দ্বিতীয়টি আছে? থাকবে না নিশা এমন কাপুরুষ পাষণ্ড লোকের সংসারে!
জাহিদ তুরিনের মাথাটা বুকের সঙ্গে চেপে রেখেছে। ধীরে ধীরে…থেমে থেমে…বাধো বাধো ভাবে বলছে, ‘তোমাকে ভালোবাসি না এটা ভাবলে কী করে? বোকা মেয়ে!’
—‘আমি জানি তুমি এখন আর আমাকে আগের মতো ভালোবাসো না। তুমি ভালোবাসো জুবিনকে আর জুবিনের মাকে।
জাহিদ মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে খুব সাবধানে বলল, ‘জুবিন তো তোমার সিস্টার…তোমারও কি ওকে ভালোবাসা উচিত না?’
এই কথায় তুরিন আবারও ঝলসে ওঠে। বাবার বুক থেকে মাথাটা ঝট করে তুলে নিয়ে নির্মম গলায় বলে, ‘শী ইজ নট মাই সিস্টার…শী ক্যান্ট বি…!’ এরপর হঠাৎ সে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে আকুল স্বরে বলতে লাগল, ‘বাবা আমি তোমার মেয়ে…আমিই তোমার প্রিন্সেস। তুমি আমার চেয়ে বেশি ভালোবাসতে পারো না কাউকে….!’
অনিমেষ এগিয়ে এসেছে তখন। তুরিনের রক্তাক্ত পায়ের দিকে চেয়ে আহত স্বরে বলছে, ‘লুক অ্যাট হার…শি ইজ ব্লিডিং!’
জাহিদ সেই সময় লক্ষ করল তুরিনের ডান পায়ের পাতা রক্তে ভিজে আছে। অনিমেষ তুরিনকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে সোফার ওপর বসিয়ে দিল। তুরিন তখনো কাঁপছে। চোখমুখ পাংশুটে। কান্নার দাপটে চোখের কোল ফুলে ঢোল। অনিমেষ ওর পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসেছে। রক্তাক্ত পা হাতে তুলে নিয়ে কাচের টুকরো বের করার চেষ্টা করছে। ফারা ফার্স্টএইড বক্স নিয়ে এগিয়ে এসেছে ওদের কাছে। যদিও অনিমেষের বাড়াবাড়িটা ওর মোটেও ভালো লাগছে না। প্রথমেই বলেছিল এসব পারিবারিক কলহ থেকে দূরে থাকতে। এই একরোখা লোকটাকে নিয়ে আর পারা গেল না। জীবনটা নরক বানিয়ে ছাড়ল একদম।
জাহিদ কেমন এলোমেলো চোখে দৃশ্যটা দেখছিল। অনিমেষ কাছে এসে দাঁড়াতেই তুরিনের মুখে একটা নির্ভরতার ছায়া ভর করেছে। ছোটবেলা থেকেই তুরিন অনিমেষের বেশ ন্যাওটা। নিজের আপন চাচার চাইতেও অনিমেষকেই সে বেশি ভালোবাসে। আর ফারার মনের ভেতরে যে অনিমেষের জন্য একটি পাকাপোক্ত স্থান আছে, সে সম্পর্কে জাহিদ সম্যক রূপেই অবগত। ফারাকে নিয়ে সে আর ভাবে না। কিন্তু তুরিনের প্রতি অনিমেষের এই অনাবশ্যক আগ্রহ জাহিদের ইদানীং সহ্য হয় না। আজকের এই ঘটনা তাকে আপাদমস্তক দগ্ধ করে চলেছে। শরীরের কোষে কোষে ছড়িয়ে দিচ্ছে ক্রোধের বিদ্যুৎ। কয়েক পা এগিয়ে এসে পাথরসম কঠিন গলায় সে প্রশ্ন করল, ‘অনি…তুই এখানে এসেছিস কেন?’
অনিমেষ ঘাড় উঁচিয়ে দেখল একবার জাহিদকে, ‘কেন? নিষেধ আছে নাকি?’
জাহিদ বাহ্যজ্ঞানরহিত হয়ে প্রায় চিৎকার করে বলল, ‘হ্যাঁ নিষেধ আছে!’
এই আকস্মিক হুংকারে উপস্থিত সবাই চমকে উঠল। তুরিন বিস্ফারিত চোখে তাকাল বাবার দিকে। ফারার মুখে রক্তের লেশমাত্র নেই। আতঙ্ক ফেটে পড়ছে চোখ দিয়ে। অনিমেষ প্রথমে চমকে গেলেও পরমুহূর্তেই সামলে নিল নিজেকে। ধারালো মুখে একটি চতুর হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘এত রেগে যাচ্ছিস কেন? আমি তো বন্ধু হিসেবে তোদের খোঁজখবর নিতে এলাম।’
জাহিদ এগিয়ে এসে অনিমেষের শার্টের পিঠ খামচে ধরল, ‘বের হ তুই…গেট লস্ট।’
তুরিনের পাগলাটে মুখে ভীষণ রকমের বিভ্রম খেলছে। অনিমেষকে সে বাবার কাছের বন্ধু বলেই জানত। শুধু বাবারই নয় মায়েরও অনেক পুরনো বন্ধু। তুরিনকেও তো কত্ত আদর করে! কত্ত ভালোবাসে! বাবা হঠাৎ এই অসম্ভব ভালো মানুষটার সঙ্গে এমন দুর্ব্যবহার করছে কেন?
অনিমেষ তুরিনের পা সরিয়ে উঠে দাঁড়াল। ঠাণ্ডা চোখে জাহিদের দিকে চেয়ে বলল, ‘হোয়াটস রং মেইট? কী হয়ে গেল হঠাৎ?’
পাগল পাগল এক উচ্ছৃঙ্খল রাগের দাপটে জাহিদের চেতনা বিলুপ্তির পথে। কণ্ঠে বজ্রের ঝংকার তুলে সে বলল, ‘স্টে অ্যাওয়ে ফ্রম মাই ডটার…ইউ জ্যাকঅ্যাস…’
অনিমেষ হঠাৎ অদ্ভুত গা শিউরানো হাসি হাসল, ‘ইয়োর ডটার?’
জাহিদের মাথায় আগুন ধরে যায়। হনহনিয়ে এগিয়ে এসে অনিমেষের বুকে একটা জোর ধাক্কা বসিয়ে দেয় সে। রাগ চাপা বিষাক্ত গলায় বলে, ‘আমার বৌকে দিয়ে হয় না তোর? এখন আমার মেয়েকেও চাই?’
তুরিন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে। বাবার বলা এই অদ্ভুত কথার তাৎপর্য কী হতে পারে তা সে বুঝে উঠতে পারছে না। তার মস্তিষ্ক এখন বড়ই দুর্বল। ফারা চট করে ওর কাছে এসে বলল, ‘চলো তোমাকে আর্জেন্ট কেয়ারে নিয়ে যাই। এখনো ব্লিডিং হচ্ছে পা থেকে। লেটস গো। হারিয়াপ।’ ফারার মুখটা ভয়ে নীল হয়ে গেছে। ভীষণ বুক কাঁপছে তার। অনিমেষ এমন পাগলামো কেন শুরু করেছে হঠাৎ? কেন আগ বাড়িয়ে ঝামেলা বাধাতে চাইছে? আতঙ্কে জমে যাওয়া মন নিয়ে কোনরকমে তুরিনকে ধরে ধরে বাইরে বেরিয়ে এলো ফারা। আনিতা আর অর্ণবের মাখখানে বিমর্ষ মুখে বসে ছিল শাহজিদ। আহত তুরিনকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে মায়ের সঙ্গে বেরিয়ে আসতে দেখে আঁতকে উঠল সে। উত্তেজনার বশে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। আরো একবার নিজের অপারগতা শেলের মতো ধারালো হয়ে বিধল তার সর্বাঙ্গে। তুরিন ওর দিকেই চেয়ে আছে। চোখভর্তি টলমল করছে রুপালি জল। খরগোশের মতো নরম নিষ্পাপ মুখটায় ভয়, দুশ্চিন্তা আর ক্লেশের দাপাদাপি ছিল এতক্ষণ। শাহজিদের দিকে তাকানো মাত্র সেই ক্লেশের চিহ্ন ফিকে হয়ে এসেছে। বুকে এসে মিশে গেছে একগুচ্ছ শান্তির সুবাতাস। তুরিনের মনে হচ্ছিল এই মুহূর্তে শাহজিদকে তার ভীষণ ভীষণ ভীষণ প্রয়োজন ছিল! শাহজিদ নিশ্চয়ই ওর জন্যই অপেক্ষা করছিল। অদ্ভুত একটা ছেলে…মুখে বলবে ভালোবাসে না…কিন্তু দ্যাখো…ভালো যে বাসে তা ওই হ্যাজেল চোখের ঘোর-লাগা চাউনি দেখেই তো দিব্যি টের পায় তুরিন!
ভেতরে তখনো দুই বন্ধু মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। দুজনের চোখেই ক্রোধ, হিংসা এবং বিদ্বেষের চাপা গর্জন। সেই সময় নিশাকে দেখা গেল হনহনিয়ে সদর দরজার দিকে এগিয়ে যেতে। ওর এক হাতে ট্র্যাভেল ব্যাগ, অন্য হাত দিয়ে কোমরের সঙ্গে লটকে রেখেছে জুবিনকে। জুবিন খুব কাঁদছে। গলা ছেড়ে বুক ফাটা কান্না কাঁদছে ছোট্ট মানুষটা। লাল টুকটুকে টমেটোর মতো ফুলে গেছে গাল। একরত্তি গোলাপি ফিনফিনে ঠোঁটে জমে আছে অভিমানের পাহাড়। ওই কান্না শুনে জাহিদের মন কেমন করে উঠল। অনিমেষকে ফেলে সবেগে অগ্রসর হলো সে নিশার দিকে। মা পেছন পেছন ছুটে আসছিলেন। জাহিদকে দেখে বললেন, ‘বৌ তো চলে যাচ্ছে! তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ওকে থামা!’
কথাটা শুনে জাহিদের হাত-পা কেমন অসাড় হয়ে উঠল। বুকের পাঁজরে যন্ত্রণার স্ফীতি টের পেল সে। নিশা চলে যাচ্ছে…তার জীবনে যেটুকু সুখ…যেটুকু উত্তাপ…যেটুকু শান্তি উদ্বৃত্ত ছিল…সেটুকু ছিনিয়ে নিয়ে নিশা চলে যাচ্ছে…নিশাকে হয়তো যেতেই হবে…আজ নয়তো কাল…কিন্তু এত তাড়া কেন? আর কিছুদিন পরে গেলে কী ক্ষতি হয় নিশা? জাহিদ সাড়হীন, অবশ শরীরটাকে কোন রকমে ধাবিত করল নিশার পেছন পেছন। মন থেকে একটা সকরুণ প্রার্থনা ঊর্ধ্বমুখী হয়ে বেরিয়ে আসছে, নিশা যেও না। আরেকটু সময় দাও আমাকে। আর কয়েকটা দিন!
দরজার বাইরে এসে নিশাকে একবার ডাকল অস্ফুটে। নিশা সেই ডাক শুনল কি শুনল না কে জানে, কয়েক সেকেন্ড দিশাহারা চোখে চারপাশটা দেখল। ফারা আর তুরিন তখনো প্যাটিওতে দাঁড়িয়ে আছে। শাহজিদ বসা থেকে উঠে ক্রাচে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছে সবে। নিশা হঠাৎ ওর দিকে চেয়ে অসহায়ভাবে বলল, ‘শাহজিদ! আমি যাচ্ছি…তুমি…তুমি যাবে আমার সঙ্গে?’
নিশার মুখনিঃসৃত প্রস্তাবটা জাহিদের অন্তরাত্মায় একটা ধাক্কা দিয়ে গেল। যে সকরুণ প্রার্থনা এতক্ষণ ধরে বুক থেকে উথলে উঠে নিশার পায়ের কাছে ভিখিরির মতো লুটিয়ে পড়তে চাইছিল, সেই প্রার্থনাটিই যেন এক মর্মান্তিক প্রহসন হয়ে আচমকা তার বুকের মধ্যে ছুরিকাঘাত করে বসল। একটা শোচনীয়, দুঃস্থ দীর্ঘশ্বাস চাপা দিতে দিতে জাহিদের মনে হলো, এই ঘটনার সাক্ষী হওয়ার আগে সে মাটির সঙ্গে মিশে কেন গেল না?