এ ভরা বাদর মাহ ভাদর
শূন্য মন্দির মোর
নিশার মুখ তখনো আরক্ত। চোখজোড়া বাষ্পে ঢাকা। গাড়িতে উঠে বসবার সঙ্গে সঙ্গে রোদচশমার আড়ালে চোখ লুকাল সে। অর্ণব মাথাটা একটু ঝুঁকিয়ে বলল, ‘আপনি ঠিক আছেন? কিছু লাগবে?’
—‘আমি ঠিক আছি।’ নিশা বলল পাশ কাটানো গলায়। অর্ণব আরো কয়েক সেকেন্ড এমনি এমনিই দাঁড়িয়ে রইল। তারপর একটু অমায়িক হাসল,
—‘আমি কাছাকাছি আছি। প্রয়োজন হলে ডাকবেন।’
—‘নিশ্চয়ই।’
ছেলেটির ভদ্রতায় মুগ্ধ হচ্ছে নিশা। এত ভদ্র, এত নরম…আহা তুরিনের সঙ্গে মানাবে কি? একদম পাত্তা দেবে না তো দাম্ভিক মেয়েটা! উঠতে-বসতে কথা শোনাবে। শেষকালে ছেলেটাকে না অপমানিত হয়ে ফিরে যেতে হয়!মনটা খারাপ হয়ে যায় নিশার। অর্ণবের জন্য মায়া হয়…আচ্ছা…! লোকটা কেন বলল জুবিন ওকে মিস করছে? কেন জানতে চাইল নিশা কখন বাড়ি ফিরবে? জুবিনের নাম করে নিজেই যে জানতে চাইল নিশা কি তা বোঝেনি? কিন্তু এই প্রহসনের মানে কী? বলেছিল তো কখনো ভালোবাসবে না, কখনো স্ত্রী হিসেবে স্বীকার করবে না…তাহলে কেন এই মিথ্যে কেয়ার করার অভিনয়? বড় একটা শ্বাস টেনে নিয়ে নিশা চিন্তাগুলোকে বুকের একপাশ থেকে অন্যপাশে সরিয়ে দিল ঠেলে। মনকে কেন্দ্রীভূত করতে চাইল অন্য কোন জায়গায়। চোখ মেলে চাইল অনেক খানি নিচে নেমে আসা আকাশে। এদিকে মেঘ ঘনিয়ে এসেছে। কিন্তু রোদ কাটেনি। মেঘের সিলভার লাইনিংয়ে কড়া ঝিলিক দিয়ে রুপালি রোদ উপচে পড়ছে পৃথিবীতে। বৃষ্টিটা প্রথমে এই উঁচু পাহাড়েই নামবে। তারপর যাবে লোকালয়ে। ভেজা ধূলোর গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। নিশা চোখ বুজে খোলা জানালা দিয়ে উড়ে আসা ভেজা ভেজা হাওয়াটা অনুভব করতে চাইল। চোখ বুজতেই মন দৌড়ে ছুটে গেল পেছনে ফেলে আসা দিনগুলোর পুরনো ক্যালেন্ডারে। অনার্স প্রথম বর্ষের পরীক্ষা চলছে। এর মাঝেই বিয়ের কথাবার্তা পাকা হলো। মা বলেছে পড়াশোনা করার আর প্রয়োজন নেই। বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। এবার সংসার ধর্মে মন বসাও। ছাত্র হিসেবে খুব একটা উন্নত গোছের কখনোই ছিল না নিশা। টেনেটুনে পাশ করত। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে অগামগা সন্তান জন্ম নিলে বাবা-মায়ের দুশ্চিন্তার পাল্লা দ্বিগুণ হয়ে যায়। নিশার পরিবারেও ব্যতিক্রম কিছু হলো না। তার ওপর মেয়ে সুন্দরী। পাড়ার ছেলেরা উত্ত্যক্ত করে দিবানিশি। যত দ্রুত সম্ভব বিয়ে দিয়ে একটা গতি করতে পারলেই দায়িত্ব চুকে যায়।
গান ভালোবাসত। গাইতও দারুণ। জেলা পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় পুরস্কার জিতেছিল দুবার। কিন্তু পরিবারের কেউ এই প্রতিভার কদর করতে জানল না। মা বলল,ভদ্র ঘরের মেয়েরা গান করে না। অতএব ষোলতে পা রাখতে না রাখতেই নিজের সবচাইতে প্রিয় শখটা চিরদিনের জন্য বিসর্জন দিতে হলো। নিশার আরো একটি মেয়েলি গুণ ছিল। তার মনটা অসম্ভব ঘরোয়া ধাঁচে গড়া। বাইরের পৃথিবী তাকে কখনোই সেভাবে হাতছানি দিয়ে ডাকেনি। সংসারের কাজেই যেন আত্মিক মুক্তি মেলে। লোকে বলত, মেয়েটি ভীষণ লক্ষ্মী। যে ঘরে যাবে ভাগ্যলক্ষ্মী ফিরিয়ে আনবে! এমন মেয়ে বাড়ির শ্রী বর্ধন করে।
আঠারো হতে না হতেই বিয়ের প্রস্তাব আসা শুরু হয়েছিল। বাবা বলতেন আমার স্নো-হোয়াইটকে আমি রাজার ঘরে বিয়ে দেব। এই সিদ্ধান্তে অটল হয়েই বুঝি পর পর অনেক প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন। অবশেষে একদিন সত্যি সত্যি দূরের রাজ্য থেকে ডাক এলো। এত ভালো প্রস্তাব, এত ধনী এবং এত শিক্ষিত পাত্র! শুনে-টুনে আত্মীয়-স্বজনরা গুম হয়ে গেল একদম। কেউ কেউ বিশ্বাস করল না, কেউ হিংসা করল, কেউ আবার বলল, বিদেশে বেড়ে ওঠা ছেলেরা ভালো হয় না, ক্যারেক্টারে সমস্যা থাকে।
নিশার মতামত নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি বাবা-মা। শুধু জানানো হলো কাগজে-কলমে একজনের সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে আপাতত। মূল বিয়েটা হবে আমেরিকায় যাওয়ার পর। বালিশের তলায় একটা ছবি রেখে গিয়েছিল মা। নিশা ছবিটা দেখেনি। আসলে দেখা না দেখায় কিছু এসে যায় না। যে লোকটার সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে সে আর যাই হোক না কেন স্বপ্নের নায়ক হবে না। স্বপ্নে দেখা পুরুষ, স্বপ্নেই থাকে! নিশার মতো হেঁজিপেঁজি মেয়ের জীবনে ওরা কল্পলোকের পর্দা সরিয়ে বাস্তবে প্রবেশ করে না। ভবিতব্য যেরকমই হোক না কেন নিশা মনটাকে বেঁধে-ছেঁদে নিয়েছিল মানিয়ে নেবে বলে। অতি অল্প বয়সেই সে জেনে গেছে, এই দুনিয়ায় অল্পবিস্তর মানুষই শুধু বেঁচে থাকে, বাকিরা মানিয়ে নেয়, মানিয়ে চলে। বিয়েটা ঠিক হওয়ার পর থেকে বাবা-মায়ের পোড় খাওয়া চোখে আলাদা রকমের দ্যুতি দেখতে পেয়েছে সে। এই দম্পতির জীবনে যেন ইদ লেগেছে। বহুদিন পর তাদের একঘেয়ে অভাবি সংসারে আনন্দের হাওয়া বইছে। শ্বশুরমশাই মহৎ হৃদয়ের মানুষ। নিশার পরিবারকে ভদ্রলোক যে সম্মান দিচ্ছেন তা অতুলনীয়। নিশা তাই বিয়েটা মন থেকেই গ্রহণ করল। পরিবারের ভালোর জন্য নিজেকে কেটেকুটে পদ্মার জলে ভাসিয়ে দিতেও আপত্তি ছিল না তার।
বিয়ের আগের রাতে বান্ধবীরাই জোর করে ছবিটা দেখাল। পাত্র নাকি রাজপুত্রের মতো সুন্দর। নিশা রাজপুত্র কখনো স্বচক্ষে দেখেনি, কিন্তু একবার তুষারকন্যার গল্প নিয়ে চিত্রিত একটি চলচ্চিত্র দেখেছিল। অবাক হয়ে আবিষ্কার করল শুধু চশমা বাদ দিলে, ছবির মানুষটা দেখতে অনেকটাই সেই সিনেমার প্রিন্সের মতো! ধবধবে ফরসা, নাকটা যেন তুলি দিয়ে আঁকা, মাজা মাজা নিখুঁত চোয়াল…আশ্চর্য! পৃথিবীতে এরকম মানুষও আছে? ভাবতে গিয়ে নিশার মন থেকে বাস্তবতার মেঘ কেটে গেল। স্বপ্ন স্বপ্ন একটা ঘোলা চাঁদোয়া নেমে এলো ওখানে। ঝুম হয়ে বসে রইল। • ঘুম এলো না…কখনো নিজের মনে হাসল…কখনো কাঁদল…কখনো মনে মনে ছবির মানুষটার সঙ্গে কথা বলল…!
স্বপ্ন ভঙ্গের যন্ত্রণা কী ভয়াবহ নিশা তা আগে কখনো জানত না। যখন জানল, তখন সেই মানুষটাকেই সব চেয়ে বেশি ঘৃণা করতে শুরু করল, যাকে একদিন ভালোবাসবে বলে মনে মনে পণ করেছিল। নিজেকেই নিজে গঞ্জনা দিতে লাগল অষ্টপ্রহর। কী লজ্জা! কী লজ্জা! এসেছিল রাজকন্যা হওয়ার বাসনা নিয়ে, কিন্তু হতে হলো দাসী-বাঁদি কিংবা তার চেয়েও অধম। প্রথম কটা দিন উম্মাদের মতো কাটল। চোখে-মুখে পাগলামির চিহ্ন, শরীর নিঃসাড়, খাওয়া দাওয়ায় অরুচি। বুকটা সারাক্ষণ খাঁখাঁ করে। বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুড়ি সবাই তাকে ঠকিয়েছে। পৃথিবীতে কিছু মানুষের জন্মই হয় প্রতারিত হওয়ার আশ্চর্য ক্ষমতা সঙ্গে নিয়ে। এসব লোক জীবনের প্রতি পদে পদে ধোঁকা খায়, ঠকে, তবুও এদের জ্ঞান চক্ষু উন্মীলিত হয় না। শিক্ষা হয় না। দিন শেষে এরা আয়নায় নিজের ভাঙাচোরা, প্রতারিত হওয়া প্রবঞ্চিত মুখের দিকে চেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলার চেষ্টা করে, থাক…আমি নাহয় খারাপই রইলাম…ওরা তো ভালো আছে। ওরা ভালো থাকুক!
বিয়ের কদিন পর একদিন খুব ভোরে মানুষটা ওর ঘরে এলো।
—‘নিশা! ওঠো!’
কাঁচা ঘুম চোখে নিয়ে আধো আলো অন্ধকারে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল নিশা।
— ‘কী হয়েছে?’
—‘দশ মিনিট সময় দিচ্ছি। তোমার ব্যাগ গুছিয়ে নাও।’
—‘কেন?’ উথাল-পাতাল বুক নিয়ে প্রশ্ন করে নিশা।
জাহিদ চাপা গলায় বলল, ‘তোমাকে নিউইয়র্ক রেখে আসব। ওখানে আমার বন্ধুর বাসায় কদিন থাকবে। ওরা আগামী সপ্তাহে দেশে যাচ্ছে। তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে।’
এসব কথার মাথামুণ্ডু বুঝে উঠতে সময় লাগল। নিশা কিয়ৎক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল মানুষটার মুখের দিকে। মানুষটার পরনে কালো জ্যাকেট, মাথায় হুডি, জিন্সের প্যান্টের পকেটে দু হাত রেখে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছে। তাড়া দিয়ে উঠে বলল, ‘দ্রুত তৈরি হয়ে নাও। সময় নেই। বাড়ির লোকে জেগে যাবে।’
নিশা আজ্ঞাধীন ভৃত্যের মতো উঠে দাঁড়াল। স্যুটকেস থেকে খুব বেশি কাপড়চোপর বের করা হয়নি। কিছু টুকটাক জিনিস বাইরে ছিল। যন্ত্রচালিতের মতো সেগুলো স্যুটকেসের ভেতরে পুরল। হাত-মুখ ধুয়ে নিল। মুখ দিয়ে একটা বাক্যও অপচয় করল না। একদিন তার আপন পরিবার মতের মূল্য না দিয়ে স্রেফ একটা কাগজের বৌ বানিয়ে নিজ জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত করেছিল। আজকে কলেমা পড়ে খোদার ওয়াস্তে কবুল করা স্বামী ঠিক একইভাবে তার মতামতের তোয়াক্কা না করে শ্বশুরবাড়ির ভিটা থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু কোথায় যাবে নিশা? সেই বাবার কাছে? যে বাবা কয়টা পয়সার জন্য নিজ কন্যার সঙ্গে মিথ্যাচার করেছে? বিক্রি করে দিয়েছে? মুখ দেখাবে কী করে আত্মীয়-স্বজনকে?
আধো আলো অন্ধকারের শীত জমানো ভোরে একটা মোটা শাল গায়ে দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো সে জাহিদের সঙ্গে। বেরোবার সময় শ্বশুরমশাইয়ের মুখটা বারবার মনে পড়ছিল। এই বৃদ্ধ হাতজোর করে ক্ষমা চেয়েছেন তার কাছে। অনুনয়-বিনয় করে বলেছেন, তোমার ওপর আমার অনেক ভরসা মা! লোকে সৎপাত্রে কন্যা দান করে, আমি সৎপাত্রীতে পুত্র দান করেছি। আমার ছেলের তোমাকে প্রয়োজন। তোমাকে দেখামাত্র বুঝেছি, তুমিই পারবে। মুর্তজা সাহেব কেন বলেছিলেন কথাগুলো তা আজও জানে না নিশা। জাহিদকে তার সব সময় একজন জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন স্বাবলম্বী পুরুষ বলে মনে হয়েছে। এমন পুরুষের কখনোই নিশার মতো অবলা অকর্মণ্য নারীর প্রয়োজন হবে না, এ কথা হলফ করে বলতে পারে সে।
গাড়িতে ওঠার পর জাহিদ ওর থমথমে মুখটা একবার দেখে নিয়ে বলল, ‘তুমি ঠিক আছ নিশা?’
নিশা মুখে কোন শব্দ করল না। সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল।
—‘ভয় করছে?’
নিশা নিরুত্তর। বাইরের তুষার ধোয়া আবছা সকালের দিকে চেয়ে আছে ওর নিথর দুটি চোখ। টপটপ করে গড়িয়ে পড়ছে জল। বাঁকা হয়ে নাকের পাশ কাটিয়ে মিশে যাচ্ছে ঠোঁটের ভাঁজে। জাহিদ অস্থিরভাবে বলল, ‘তুমি কাঁদছ কেন? দেশে ফিরে যেতে চাও না?’
নিশা চুপ করে রইল।
—‘আমি যা করছি তোমার ভালোর জন্যই করছি। তুমি এরকম লাইফ ডিজার্ভ কর না। ইউ ডিজার্ভ মাচ বেটার দ্যান দিস।’
নিশা এতক্ষণে কথা বলল, ‘আমি চলে গেলে আপনার খুব সুবিধা হয় তাই না?’
—‘আমার সুবিধার কথা অস্বীকার করছি না। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি তোমার কথা ভাবছি।’
নিশা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল, ডাগর দুটি চোখ ওই চশমা ঘেরা চোখের ওপর রেখে বলল, ‘কেন ভাবছেন আমার কথা?’
জাহিদ পরিষ্কার কণ্ঠে জানিয়ে দিল, ‘আমি চাই না আমার জন্য তোমার জীবনটা নষ্ট হোক। তোমার বয়স এখনো অনেক কম। সামনে পুরো জীবন পড়ে আছে। আচ্ছা, দেশে ফিরতে না চাইলে সমস্যা নেই। এক কাজ করো। তুমি নিউইয়র্কে থাকো কিছুদিন। টাকা-পয়সা নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। আমি দেখছি ব্যাপারটা। তোমার গ্রিনকার্ডের প্রসেসিং চলছে। হয়ে গেলে চাকরি করবে, পড়াশোনা করবে, নিজের পায়ে দাঁড়াবে।’ অনেক কথা একসঙ্গে বলে একটু থামল জাহিদ। তারপর গলায় জোর দিয়ে বলল, ‘আর আমাদের ডিভোর্সের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। ডোন্ট ওরি।’
নিশা অনেকক্ষণ কোন কথা বলল না। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল শুধু। লোকটা হয়তো ঠিক কথাই বলছে। তার চলে যাওয়াই উচিত। মনে হলো জীবনে এই প্রথম কেউ একজন সত্যিকার অর্থে তার মঙ্গল কামনা করছে। এভাবে কেউ কখনো মুক্তি দেয়নি তো! এমনকি সে নিজেও নিজের জন্য এভাবে ভাবেনি কখনো। আজ এক সোনালি ভবিষ্যৎ হাতছানি দিয়ে ডাকছে তাকে। সামনে দুর্লভ স্বাধীনতা, পেছনে কারাবন্দি জীবন। কোনটা বেছে নেবে নিশা? কোনটা? কোনটা বেছে নেওয়া উচিত?…দায়িত্ব! দায়িত্ববোধ কড়া নাড়ল ভেতরে। সব দায়বদ্ধতা ছুড়ে ফেলে দিয়ে শুধু নিজের চলার পথটা আগাছামুক্ত করে এগিয়ে যাওয়া কি স্বার্থপরের কাজ নয়? তার সংস্কারবদ্ধ মন যে কিছুতেই এত স্বার্থপর হওয়ার কথা ভাবতে পারে না! এতদিন মনের মধ্যে শূন্যতা ছিল, এখন ভয় এসে যুক্ত হলো। সেই ভয়ের আদ্যপান্ত নিশা জানে না। না জেনে, না বুঝেই বিশাল কিছু একটা হারিয়ে ফেলার বিপৎসংকেত বাজতে লাগল বুকে। আকুল হয়ে বলল, ‘আমি কোথাও যাব না!’
জাহিদের চশমার আড়ালের চোখ দুটো কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল।
—‘কী বলছো তুমি?’
নিশা গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলল, ‘শুনেছেন তো যা বললাম।’
জাহিদ তড়িঘড়ি করে নেমে এলো গাড়ি থেকে। বাড়ির দিকে ফিরে যাচ্ছিল নিশা। জাহিদ ওর হাত খামচে ধরল। হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে এলো রাস্তার ধারে, একটা বিশাল আকৃতির পাইনগাছের আড়ালে। গাছের নিচে তখনোঝুপসি অন্ধকার। সেই অন্ধকারে নিশার ভেজা ভেজা ডাগর দুটি চোখের দিকে চেয়ে জাহিদ কড়া গলায় প্রশ্ন করল, ‘সমস্যা কী তোমার?’
—‘হাত ছাড়ুন!’
—‘না ছাড়ব না। আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। কেন যেতে চাও না?’
—‘জানি না।’
—‘কী জানো না?’
—‘উফ হাত ছাড়ুন। লাগছে খুব।’
—‘লাগুক। তোমার মতো বোকা মাথামোটা মেয়েদের লাগাই উচিত। তুমি কি বুঝতে পারছ কী অসম্ভব একটা সম্পর্ক আমাদের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে? আমাদের বয়সের কত তফাত, সেটা চিন্তা করে দেখেছ?’
নিশা বলল…কেন যে বোকার মতো কথাটা বলে ফেলল কে জানে, ‘বয়স কোন ব্যাপার নয়। আমার দাদাভাই, দাদিমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়। উনারা এখনো একে অপরকে ভালোবাসে।’
জাহিদ বিহর্ষ বিস্ময়ে থ বনে গেল। পরমুহূর্তেই রাগের একটা তীব্র ঝংকার উঠল ওর মুখে। নিশা সংকুচিতভাবে চোখ নামিয়ে নিল। কথাটা বলার পর বুঝতে পেরেছে, বলা উচিত হয়নি।
—‘শোন মেয়ে! আমি কখনোই তোমাকে ভালোবাসব না…নেভার, এভার!’
অপমানের ঝাপটা এসে লাগল মুখে। নিশা অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে শক্ত গলায় বলল, ‘আমি যেন আপনাকে ভালোবাসার জন্য বসে আছি!’
—‘একজ্যাক্টলি…এটাই আমি বলতে চাইছি…’ হঠাৎ জাহিদের গলার স্বর আটকে গেল। বদলে গেল চোখের দৃষ্টি। বাবা-মা হাঁটতে বেরিয়েছেন। বেরোনো মাত্র দৃশ্যটা তাঁদের নজরে এসেছে। এই সুযোগে নিশা ছুটে পালাল বাড়ির ভেতর। জাহিদ ভীষণ রেগে গিয়েছিল। পরের কয়েকটা মাস নিশার চোখে চোখে তাকাল না পর্যন্ত। এদিকে বাড়ির অন্য সদস্যরাও নিশাকে মানুষ হিসেবে গণ্য করে না। অপমানের জ্বালায় বুক পুড়ে যায়। মুখ বুজে সহ্য করা ছাড়া উপায় নেই। শ্বশুর-শাশুড়ি স্নেহ করেন। সেই স্নেহ আর সম্মানটুকুই নিশাকে অক্সিজেনের জোগান দেয়। একেকদিন মনে হয় জাহিদের প্রস্তাব মেনে নেওয়াই সমীচীন কাজ হবে। চলে যাওয়া উচিত এই বন্দি কারাগার ছেড়ে। সাহস আসে, আবার ঝিমিয়ে যায় মন। কোথায় যেন কী একটা পেছন থেকে টেনে ধরে। যেন এখনোযাওয়ার সময় আসেনি, যেন কী একটা করার আছে, কিছু একটা হওয়ার আছে! এ সংসারে তার কোন জায়গা নেই, তবুও কোন এক অলীক উপায়ে সমস্ত সংসারটা তার চোখের মধ্যে, মনের মধ্যে, শরীরের মধ্যে বিঁধে গেছে! নিশা পারেনি…হতে পারেনি নির্ভীক, হতে পারেনি নারীবাদী, হতে পারেনি যুক্তিবাদী মনন ও চিন্তায় বিশ্বাসী। হেরে গেছে সে। নিজের কাছে, জীবনের কাছে, সমাজের কাছে বিষমভাবে হেরে গেছে!
কিন্তু পৃথিবীতে সমস্ত হারের মধ্যেই মনে হয় একটি করে প্রচ্ছন্ন গোপন বিজয় থাকে। সেই বিজয়টা নিশা টের পেত শ্বশুর-শাশুড়ির স্নেহাশিস প্রীতিপূর্ণ ব্যবহারে। নিজের বাবা-মায়ের তৃপ্তি বিজড়িত, গর্বিত কণ্ঠস্বরে। এসব ছোটখাটো প্রাপ্তি দিনশেষে নিজের বিবেকের চোখের ওপর চোখ রাখার সাহস জোগাতো। স্বস্তি দিত!
এর মাঝে শ্বশুর-শাশুড়ি তাদের প্রত্যাশার ব্যাপারে জানিয়ে দিলেন। তাঁরা চান খুব দ্রুত যেন পরিবারে নতুন সদস্য আসে। এদিকে জাহিদ নিশার দিকে চোখ তুলেও চায় না। যেন নিশা অদৃশ্য, অশরীরী। ফারাকে পতিগর্বে গর্বিত ভাগ্যবতী এক নারী বলে মনে হয় নিশার। যদিও এই রমণী কিছুটা আত্মকেন্দ্রিক। জাহিদ তখন ব্যাংকের চাকরির পাশাপাশি শ্বশুরমশাইয়ের হোটেলের বিজনেস দেখাশোনা করে। প্রায় রাতে ফিরতে ফিরতে দেরি হয়। ফারাকে একদিনও স্বামীর জন্য জেগে থাকতে দেখেনি নিশা। অবশ্য সে নিজেও চাকরিজীবী। নিয়ম মেনে চলতে হয়। স্বামীর পথ চেয়ে রোজ রোজ রাত জেগে অপেক্ষা করা তার শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ফারাকে কোন এক বিশেষ কারণে শ্বশুর-শাশুড়ি খুব একটা পছন্দ করেন না। বড় জা নীলিমা সবার মন জুগিয়ে চললেও চাকরির সুবাদে বাড়িতে থাকা হয় কম। বাড়ির মেয়েদের মধ্যে একমাত্র নিশাই ঘরোয়া। তাই শ্বশুর-শাশুড়ির মনে বিশেষ জায়গা দখল করে নিতে খুব বেশি সময় লাগেনি ওর।
জাহিদের ডিনার ডাইনিং টেবিলে ঢেকে রাখা হয়। মাইক্রো ওয়েভে গরম করে একা বসে খাবার খায় সে। নিশা জেগে থাকে। নিঝুম ঘুমন্ত বাড়িতে নিজের ঘরে বসে ঠিক ঠিক টের পায় নিচে ডাইনিংয়ে ওভেন চালানো হচ্ছে, চেয়ার টানা হচ্ছে, পানির কল ছাড়ার শব্দ হচ্ছে। কিয়ৎক্ষণ বাদে পায়ের শব্দ সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে কাছে এগিয়ে আসে। দরজার ওপারের করিডর পার হয়ে খানিক দূরে ফারার ঘরের সঙ্গে গিয়ে মিলিয়ে যায়। একরাতে নিশা টের পেল দুটি পা তার দরজার সামনে এসে থমকে দাঁড়িয়েছে। নিশা বদ্ধ দরজার দিকে চেয়ে দম আটকে বসে রইল। কয়েক সেকেন্ড কাটার পর দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল জাহিদ। গায়ে অফিসের ফর্মাল শার্ট-প্যান্ট। চিন্তিত, শীর্ণ মুখ। ধবধবে ফরসা গালে কৃষ্ণ রঙের দাড়ির একটা পাতলা আস্তর। ক্লান্তিকর ম্লান ভাবটা যেন তার মুখে আলাদা রকমের শ্রী যুক্ত করেছে। চশমার আড়ালের চোখদুটো ঋষির মতো শান্ত!। নিশা এমনিই একটু লাজুক প্রকৃতির মেয়ে। পুরুষ বন্ধু ছিল না, প্রেমিক ছিল না। তার শরীরের ভাঁজে ভাঁজে সদ্য বয়ঃসন্ধি পেরোনো বালিকার মতো অদম্য জড়তা। জাহিদ সামনে এলে সে আরো বেশি জড়সড়ো আর কুণ্ঠিত হয়ে যায়। শব্দের ঘরে তালা পড়ে। নিজেকে জড়বৎ পদার্থ বলে মনে হয়। আত্মবিশ্বাসের পারদ নেমে যায় অনেক নিচে।
জাহিদ ধপ করে বিছানার ওপর বসে পড়ে অধীর হয়ে বলল, ‘বাবা-মা কী শুরু করেছে বলো তো? দুদিন পর আমি মেয়ের বিয়ে দেব। এই সময়ে নতুন বাবা হওয়া আমাকে মানায়?’
প্রসঙ্গটা বুঝতে পেরে নিশা আরো বেশি কাদা হয়ে গেল সংকোচে। জানালার সামনে দাঁড়িয়েছিল। এত লজ্জা লাগছিল যে মন চাইছিল জানালা টপকে অদৃশ্য হয়ে যায়। ঘরের ভেতর একটা হলুদ রঙের ম্লান আলো জ্বলছে। সেই আলোতে জাহিদ নিশার রাঙা হওয়া মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থেকে বলল, ‘দ্যাখো, তুমি নিঃসন্দেহে সুন্দরী। কিন্তু শুধু দৈহিক সৌন্দৰ্য যথেষ্ট নয়। মেন্টাল অ্যাটাচমেন্ট প্রয়োজন। তুমি কি বুঝতে পারছ?’
নিশা কোন উত্তর দিল না। কাঁচুমাচু হয়ে দাঁত দিয়ে হাতের আঙুলের নখ কাটতে লাগল।
জাহিদ বলল, ‘তোমার শ্বশুর-শাশুড়িকে বোঝাও। প্রতিদিন একই ঘ্যানঘ্যান ভালো লাগে না। আমি এত প্রেশার নিতে পারছি না। প্লিজ! হেল্প মি আউট!’ একটু থেমে বলল, ‘তা ছাড়া…তুমি তো জানো আমি ফারাকে ভালোবাসি!’
নিশা ছ্যাঁত করে জ্বলে উঠে বলল, ‘জানি…আগেও বলেছেন। বারবার বলতে হবে না। নাকি বলতে খুব ভালো লাগে?’
জাহিদ হেসে ফেলল। কিছুক্ষণ নিশার জ্বলুনিধরা মুখটার দিকে হাসি হাসি চোখে চেয়ে থেকে ধীর গলায় বলল, ‘তুমি কখনো কাউকে ভালবেসেছ নিশা?’
—‘না!’ সোজাসাপ্টা উত্তর দিয়ে জানালার দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল নিশা।
— ‘যেদিন বাসবে সেদিন নিশ্চয়ই বুঝবে ভালোবাসার কথা লোকে বারবার কেন বলে।
বুকের জ্বালাটা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। খানিক বাদেই বুঝতে পারল নিশা, যে এই জ্বালারই অপর নাম ঈর্ষা। ফারাকে তার এই মুহূর্তে ঈর্ষা হচ্ছে। ভয়ংকর ঈর্ষা!
—‘আপনি যান এখান থেকে।’ বলল নিশা মুখ ঝামটা মেরে।
—‘যাচ্ছি। তুমি কিন্তু তোমার শ্বশুর-শাশুড়িকে বোঝাবে। ভরসা করলাম তোমার ওপর।’
—‘বুঝিয়ে বলব উনাদের। চিন্তা করবেন না।’
দু মাস কেটে গেল। ফারা টেক্সাস গেছে বাবার বাড়িতে। থাকবে কিছুদিন। বাবা অসুস্থ। বাধ্য হয়েই থাকতে হচ্ছে। শাশুড়ি নিশাকে বললেন, বৌমা এটাই সময়। বরকে নিজের দিকে টানো। ওই ডাকিনীর কালো জাদু থেকে মুক্ত করো আমার ছেলেকে। নিশা গ্রাহ্য করল না বিষয়টা। ফারার নামে যতই বদনাম করুক ইনারা, তার ছেলে তো ফারা বলতে অজ্ঞান। তা ছাড়া জাহিদকে সে এই একটা কারণে মন থেকে সম্মান করে। কারণ লোকটা আর যাই হোক না কেন, দুশ্চরিত্র অথবা প্রতারক নয়। শাশুড়ির কথায় বিশেষ আমল না করলেও নিশা একটা কাজ করল। নিজে না খেয়ে, খাবার নিয়ে অপেক্ষা করা শুরু করল জাহিদের জন্য। প্রথম দুদিন বিরক্ত হয়েছে জাহিদ। খাবার ছুঁয়ে দেখেনি। কাঠকাঠ গলায় বলেছে, ‘খেয়ে এসেছি। খাবো না।’
তৃতীয় দিন অধৈর্য হয়ে বলল, ‘কেন করছ এসব?’
নিশা ধীরস্বরে উত্তর দিয়েছিল, ‘আপনি রোজ একলা একলা ডিনার করেন। আমার দৃশ্যটা দেখতে ভালো লাগে না।’ জাহিদ স্তম্ভিত চোখে তাকিয়ে ছিল নিশার দিকে। কিছু বলেনি। খানিক বাদে হাত-মুখ ধুয়ে এসে খেতে বসল। কিন্তু জানতে চাইল না ঘুণাক্ষরেও, নিশা খেয়েছে কি না। যন্ত্রের মতো গপাগপ খাবার খেয়ে হাত ধুয়ে শুতে চলে গেল। নিশা বসে ছিল ওর সামনেই। অভুক্ত পেটে। খেতে ইচ্ছে করেনি। কেউ খেতে বলেনি তাই!
পরদিন রাতে একটু তাড়াতাড়িই ফিরে এলো জাহিদ। সেদিন সন্ধ্যে থেকে ঝুম বৃষ্টি। জানালাটা হাট করে খোলা। সারা ঘরে পাগল হাওয়ার মাতামাতি। নিশা জানালার ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল। বৃষ্টির ছাঁট ভিজিয়ে দিচ্ছে শরীর। বুনো ফুলের উগ্র ঘ্রাণে ভরে আছে বাতাস। এমন সময় দড়াম শব্দ করে ঘরের দরজাটা খুলে গেল। জাহিদ হনহন করে ভেতরে ঢুকে বলল, ‘নিশা, এ তোমার ভীষণ অন্যায়। মা বলল, তুমি নাকি নিজে না খেয়ে আমার জন্য অপেক্ষা কর? এসবের মানে কী?’
নিশা উত্তর খুঁজে পেল না। মেঘাচ্ছন্ন চোখে চেয়ে রইল শুধু। এসবের মানে কী? সত্যিই তো এসবের মানে কী? বুকের ভেতর প্রশ্নটা দুলে দুলে, ফুলে ফুলে বিশালাকৃতির ঢেউ হয়ে উঠল। আকাশচুম্বী সেই ঢেউ নিশার চেতনরাজ্যে ছড়িয়ে দিল ধোঁয়াশা। আবছা, অলীক আর অস্পষ্ট হয়ে উঠল চারধার। ঘরে কোন আলো জ্বলছে না। ফাঁকা দরজা দিয়ে হলওয়ে থেকে একটা চৌক আলো এসে পড়েছে মেঝেতে। সেই একটুখানি আশ্চর্য আলোয় ওরা দুজনে পরস্পরের দিকে কয়েক সেকেন্ড চেয়ে রইল নির্বাক। বাইরে বৃষ্টির একটানা ঝমঝম শব্দ। দুর্দান্ত হাওয়ায় নিশার খোলা চুল উড়ছে। জানালায় ঝুলে থাকা পর্দায় শাড়ির আঁচলের মতো ঢেউ ভাঙছে হাওয়া। চশমার পেছনের শান্ত দৃষ্টিটা নিশার নরম সুন্দর মুখে টর্চলাইটের মতো বিঁধে বিধে বুকের একদম তলানিতে গিয়ে ধাক্কা দিল। সে স্বপ্নোত্থিতের মতো ঘুরে দাঁড়াল জানালার দিকে। তার মনে হচ্ছে এটা কোন সাধারণ ক্ষণ নয়। এই ক্ষণ সর্বনাশা! খানিক বাদে টের পেল মানুষটা পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে। ঘাড়ের ওপর উষ্ণ, মসৃণ শ্বাস পড়ল। পারফিউমের সুন্দর একটা ঘ্রাণ এসে লাগল নাকে। পেছন থেকে কোমরের ওপর নেমে এলো দুটি সবল হাত। নিশা প্রতিবাদ করার চেষ্টা করল। কিন্তু পায়ের নিচ থেকে ক্রমই মাটি সরে যাচ্ছিল। কয়েকটা কঠিন শব্দ জোগাড় করে ওঠার আগেই মানুষটা ভীষণ কাব্যিকভাবে ওর ঘাড়ের চুলগুলো সরিয়ে দিল একপাশে। তারপর চুমু খেলো গ্রীবায়, কানে। অন্যায্য, অযাচিত ভালোলাগার অত্যাচারে বুজে এলো নিশার কণ্ঠস্বর।
এই মিথ্যে ঘোর অবশ্য ভাঙতে বেশি সময় লাগল না। বিছানায় যাওয়ার পর ফারার নামটা কয়েকবার কানে এসে লাগল স্পষ্টভাবে। অপমানের বিষ দাঁত আঁচড় কেটে কেটে রক্তাক্ত করে তুলল হৃদয়। অদ্ভুত অভিমান বুকের পাঁজর পিষে দিল। কষ্ট! অনেক কষ্ট পেয়েছে নিশা তার এই ছোট্ট জীবনে। কিন্তু এমন তীব্রভাবে এর আগে কোন কষ্টই যেন ঘায়েল করেনি তাকে। সকালে নিশা জাহিদকে ঠাণ্ডা গলায় বলল, ‘আপনি আর কোনদিন আমাকে ছোঁবেন না!
জাহিদ অপ্রস্তুত হলো, ‘সরি…আসলে…ভুলটা আমারই। ক্ষমা চাই!’ একটু থেমে আবার বলল, ‘কিন্তু তুমি তো আপত্তি করোনি নিশা!’
—‘করিনি। এখন করছি। আপনি আমার ঘরে আসবেন না আর কখনো! মনে থাকে যেন।
জাহিদ কোন উচ্যবাচ্য না করে আদেশটা মেনে নিয়েছিল। জুবিন ওদের জীবনে আসার আগ পর্যন্ত আর একটিবারের জন্যও নিশার ঘরে পা রাখেনি সে।
—‘মিস নিশা! আপনি ঠিক আছেন?’ অর্ণব কখন ড্রাইভিং সিটে এসে বসেছে খেয়াল করেনি নিশা। একটু চমকে উঠে বলল, ‘জি আমি ঠিক আছি!’
—‘একা একা বসে আছেন…ভাবলাম আপনাকে একটু কোম্পানি দিই।’ নিশা ভদ্রতার হাসি হাসল, ‘ধন্যবাদ আপনাকে।’
—‘গান শুনবেন?’
—‘আপনি গান করেন নাকি?’
অর্ণব লজ্জিত গলায় বলল, ‘না না! আমি গান করি না। শুনতে চাইলে অডিও চালাতে পারি।’
—‘ও আচ্ছা। তাই বলুন। হ্যাঁ গান ছাড়ুন। শুনি।’
—‘আপনি কি কোন কারণে আপসেট?’
নিশা একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করল, ‘না আপসেট নই।’
—‘আপনি চাইলে সামনে এসে বসতে পারেন। আশপাশটা ঘুরে দেখি। বাকিরা তো খুব ব্যস্ত! ‘
নিশা আপত্তি করল না। ড্রাইভারের পাশের সিটে এসে বসল। আনিতা অনতিদূরে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছিল। অর্ণব, নিশার প্রস্থানটা সে আড়চোখে দেখল। হাসল একটা অদ্ভুত হাসি। গাড়ি চলতে শুরু করতেই ঠাণ্ডা বাতাসটা অন্তর শান্ত করে দিল। কিন্তু আনিতার হাসিটা একটু কাঁটা হয়ে লাগল নিশার বুকে। অর্ণব বলল আর সেও অমনি রাজি হয়ে গেল। কী দরকার ছিল ছেলেটার পাশে এসে বসার? আচ্ছা বসলেই বা কী এমন ক্ষতি হলো? জাহিদ তো কখনো আপত্তি করবে না। ওই লোকের তো কিছু এসে যায় না! শাহজিদকে নিয়ে বাড়ির লোকে ফিসফিস করে, লোকটা সবই শুনে চুপচাপ। কখনো তো মুখ ফুটে অসন্তোষ জানায় না!
—‘জায়গাটা আসলেই খুব সুন্দর।’ অর্ণব বলল।
—‘জি…খুব সুন্দর! আমরা বেশিদূর না যাই, কেমন?’
—‘দূরে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। পুরো পার্কটায় একবার চক্কর দিই।’ অর্ণব বলল।
গাড়ির স্পিকারে পুরনো দিনের একটা গান বাজছিল। পুরনো গান, নতুন করে গাওয়া।
ভরা বাদর মাহ ভাদর
শূন্য মন্দির মোর
ভরা বাদর…
ভরা বাদর মাহ ভাদর
শূন্য মন্দির মোর
—বিদ্যাপতি
ঢালু রাস্তার দুধারে উঁচুনিচু উপত্যকার নয়নাভিরাম পটভূমি। সারা পাহাড়ে এখন অলৌকিক এক স্বর্ণালি রোদের ছটা। বাতাসে গুঁড়ি গুঁড়ি মেঘ উড়ে এসে লাগছে মুখে। বৃষ্টিটা বুঝি নামবে এবার। নিশা ঝুম চোখে চেয়ে ছিল বাইরে। হঠাৎ কেমন অন্যরকম গলায় বলল, ‘আপনি এই পঙ্ক্তিগুলোর অর্থ জানেন অর্ণব সাহেব?’
অর্ণব মাথা নেড়ে বলল, ‘একটু একটু। আমি অতটা সংস্কৃতিমনা নই। গানটান ভালো বুঝি না।’
নিশা ঘোর-লাগা গলায় বলল, ‘ভরা বর্ষাকাল। বর্ষার অথৈ পানিতে পথ- ঘাট, নদী-নালা, খাল-বিল সর্বত্রই ভরে গেছে। পুকুরগুলো পানিতে টইটুম্বুর। ব্যাঙ ডাকে ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ। এ সময় একলা ঘরে বসে আছে নববধূ। বসে বসে ভাবছে স্বামীর কথা। স্বামীহীন এক নারীর বিরহগাঁথা অঙ্কন করেছেন কবি এ কবিতায়। চারিদিকে উথালপাতাল বর্ষা, কিন্তু সেই মেয়েটির মনমন্দির শূন্যতায় খাঁখাঁ করছে। এমন বর্ষা কেন আসে মানুষের জীবনে?’
বলতে বলতে নিশার চোখে বাষ্পরাশি জমে উঠছিল। কণ্ঠস্বর কাঁপছিল হালকা।
মুগ্ধতার ঝাপটা এসে ভিজিয়ে দিল অর্ণবকে। তার মনে হলো এ কোন সাধারণ মানবী নয়। এই মানবী স্বর্গীয়! এক ফোঁটা রুপালি চোখের জল নিশার মোমে মাজা গালের ওপর এসে পড়তেই অর্ণবের মন কেমন করে উঠল। এই মেয়েটির কী কষ্ট সে জানে না! কিন্তু কেন যেন তার খুব ইচ্ছে হলো কোন এক জাদুমন্ত্র দিয়ে মেয়েটির সমস্ত দুঃখ-কষ্ট মুছে দিতে। পারবে কি অর্ণব? ইশ! যদি পারত!
মন কেমনের দিনগুলো
স্টেলাকেই দেখছিল ওরা। মেয়েটির সাদা শরীরে গাঢ় লাল ব্লাউজটা মোমবাতির কাঁপতে থাকা তিরিতিরে আগুনের মতো চমকাচ্ছে। চোয়াল ভাঙাচোরা হলেও অদ্ভুত চাঁছাছোলা এক শ্রী আছে ওই মুখে। তুরিনকে পাশ কাটিয়ে শাহজিদের সামনে এসে দাঁড়াল স্টেলা।
—‘ক্যান আই বরো ইওর লাইটার ফর আ সেকেন্ড?’
শাহজিদের মনে পড়ল ওর কোলের ওপর সিগারেটের বাক্স এবং লাইটার রাখা আছে। ওগুলোর দিকে একবার চোখ নামিয়েই সে ভদ্র গলায় ছোট করে বলল, ‘শিওর।’ মাটিতে লেপ্টে বসে থাকা অবস্থা থেকে ক্রাচের সাহায্য নিয়ে উঠে দাঁড়ানো তার জন্য কম কসরতের বিষয় নয়। সময় সাপেক্ষও বটে। তাই উঠে দাঁড়াবার বৃথা চেষ্টা না করে হাতে ধরা লাইটারটা সামনে এগিয়ে দিল। স্টেলা লাল লিপস্টিক মাখা পিচ্ছিল ঠোঁটে আলতোভাবে একটা সিগারেট চেপে ধরল। মাথাটা ঝুঁকিয়ে আনল নিচে। ধবল বুকের সন্ধিরেখা মরীচিকার মতো চোখ-ধাঁধানো ঝিলিক দিল। শাহজিদের মুখে উত্তাপের একটা অনভিপ্রেত হলকা এসে লাগল লাইটারের আগুন জ্বলার আগেই। আর ঠিক সেই মুহূর্তে স্টেলার পেছনে ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা তুরিনের ওপর নজর পড়ল। সিগারেটে আগুন তখনো ধরেনি। ঘটনা ঘটল খুব দ্রুত। তুরিন স্টেলার কনুই খামচে ধরেছে। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছে দূরে। চিৎকার করে গালমন্দ করছে। দৃশ্যটা শাহজিদ বিবশ বিধ্বস্ত চোখে তাকিয়ে দেখতে লাগল। কিছু বলার মতো, করার মতো শক্তি বা উদ্যম খুঁজে পেল না। আশপাশের মানুষজন ছুটে এসেছে বিরোধ নিষ্পত্তির উদ্দেশ্যে। বিবাদ মিটে যাওয়ার পর তুরিন আগুন মুখে ফিরে এসেছে।
শাহজিদ বিস্ময়ের ঢোকটা তখনো পুরোপুরি গিলতে পারেনি। অনেক কষ্টে কয়েকটা শব্দ পরপর বসিয়ে একটা বাক্য সাজাতে পারল,
—‘আপনার কী হয়েছে?’
তুরিন হুংকার ছেড়ে বলল, ‘আমার আবার কী হবে?’
শাহজিদ তীব্র চোখে তুরিনের রাগ-ঝলসানো মুখের দিকে চেয়ে কিছু একটা পড়ার চেষ্টা করে বলল, ‘যার-তার সঙ্গে ঝগড়া করছেন, যাকে পাচ্ছেন গালি দিচ্ছেন, সমস্যা কী?’
—‘আমি ঝগড়া করছি?’ ফুঁসে উঠল তুরিন।
—‘তা নয়তো কী?’
—‘বেশ! আমি ঝগড়া করছি কারণ আমি ঝগড়াটে। উত্তর পেয়েছেন? খুশি এখন?’
শাহজিদ একটু নিচু গলায় বলল, ‘আগে তো এমন ছিলেন না আপনি। এত পাল্টালেন কী করে?’
তুরিন কয়েক পা এগিয়ে এলো, ‘আচ্ছা? কেমন ছিলাম আগে? শুনি?’
শাহজিদ এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে স্পষ্ট গলায় বলল, ‘অনেক কিউট, বাচ্চা খরগোশের মতো কিউট!’
তুরিন একটু থমকায়। গলার তেজ কমে আসে। আস্তে করে বলে,
—‘আর এখন? এখন কী রকম মনে হয় তোমার আমাকে?’ নিজের অজান্তেই আপনি থেকে তুমিতে সরে আসে তুরিন।
—‘এখন মনে হয় যেন তোমাকে আমি চিনি না!’
এলোমেলো বাতাসে শাহজিদের কান পর্যন্ত গড়ানো ঈষৎ লালচে চুলগুলো উড়ছিল। মেঘ ছুঁইছুঁই রোদ খেলছিল মুখে। সেদিকে আবছাভাবে চেয়ে তুরিন আবছা গলায় বলল, ‘কেউ কখনো এমনি এমনি পাল্টে যায় না। পাল্টানোর পেছনে কারণ থাকে।’
—‘কারণটা জানতে চাই।’ দৃঢ় শোনাল শাহজিদের গলা। তুরিন কয়েক পা এগিয়ে এসে শাহজিদের পাশে বসল। ক্ষুরধার গলায় বলল, ‘অ্যাঞ্জেলিনার সঙ্গে তোমার প্রেম ছিল। এ কথাটা আগে কখনো বলোনি কেন?’
—‘বলার মতো কোন ঘটনা নাকি?’ শাহজিদ অবাক।
—‘নয়?’
কাঁধ ঝাঁকায় শাহজিদ, ‘তেমন সিরিয়াস কিছু ছিল না। ঘটা করে বলার মতো ব্যাপার না। কম্লিকেটেড ছিল।’
—‘তাই?’
—‘হ্যাঁ তাই।’
—‘তাহলে ওকে কিস করেছিলে কেন?’ বোকা বোকা প্রশ্ন করে তুরিন। বিস্ময় ঝিলিক মারে শাহজিদের চোখে। হেসে ফেলে,
—‘তাতে কী এসে যায়?’
—‘কিছু এসে যায় না?’
—‘না…মানে…ও আমার গার্লফ্রেন্ড ছিল…’
—‘এইমাত্র বললে তুমি শিওর ছিলে না।’
—‘ঠিকই বলেছি…কোনটাই মিথ্যে নয়…কিন্তু এসব কেন জানতে চাইছ? এতদিন পর?’
তুরিন একটা বড় শ্বাস ছেড়ে দূরের আকাশে চোখ সরিয়ে নেয়। কী যেনভাবে বিষণ্ন মুখে। দুটি হাত পিছমোড়া করে দুষ্টু বাতাসে উড়তে থাকা অবাধ্য চুলগুলো পেঁচিয়ে খোঁপা বাঁধতে থাকে। শিরদাঁড়া টানটান হয়,
পিঠটা যেন ছড়িয়ে যায় আরো অনেকখানি, কোমরের বাঁক স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মসৃণ, ঝকঝকে, অনাবৃত কাঁধে আর কণ্ঠাহাড়ে লাফিয়ে পড়ে সূর্যের আলো। সুন্দর দেখায়!
—‘আমি তো কখনো তোমার গার্লফ্রেন্ড ছিলাম না। তাই না?’
শাহজিদের অবাধ্য স্বেচ্ছাচারী চোখজোড়া বন্দি হয়েছিল তুরিনের কণ্ঠাহাড়ের খাঁজের ভেতর। সে কথাটা যেন শুনেও ঠিকমতো শুনল না। বিবশ গলায় প্রশ্ন করল, ‘কী?’
তুরিন তাকাল, ‘আমি কি তোমার গার্লফ্রেন্ড ছিলাম?’ আবারও একটা বোকা প্রশ্ন।
শুনে শাহজিদ এমন অভিনব ভঙ্গি করল মুখের, যেন এর চেয়ে মজার কৌতুক আর হয় না।
—‘মাথা খারাপ!’
তুরিন চোখ সরিয়ে নিল, ‘তাহলে আমি তোমার কে ছিলাম?’
শাহজিদ সহজ গলায় বলল, ‘বন্ধু ছিলে। এমন একজন বন্ধু যাকে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃসময়ে খুব বেশি রকমের প্রয়োজন ছিল।’
—‘আমাকে তোমার প্রয়োজন ছিল?’ যাচাই করার ঢঙে প্রশ্ন করে তুরিন।
—‘ভীষণ প্রয়োজন ছিল।’
—‘কিন্তু কেন শাহজিদ? অ্যাঞ্জেলিনা তো তোমার পাশে ছিল।’
—‘ছিল একরকম। অস্বীকার করব না।’
তুরিনের কণ্ঠে বিষাদ বেজে ওঠে ঝনঝন করে, ‘যখন তুমি অ্যাঞ্জেলিনায় মত্ত হয়ে ছিলে, সেই সময়…সেই সময় আমার জীবনে কী ঘটেছিল জানো শাহজিদ? আমার বাবা…যে বাবা আমার সবাচাইতে প্রিয়…সবচাইতে বেশি ভরসার…সেই বাবা দ্বিতীয়বার বিয়ে করে বাড়িতে একটা অচেনা মেয়ে নিয়ে এসেছিল। আর তুমি…তুমি তখন আমার পাশে না দাঁড়িয়ে আমার বাবার সেই দ্বিতীয় স্ত্রীর দিকেই বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিলে। সন্ধি করলে আমার শত্রুর সঙ্গে। চমৎকার!’
ভীষণ জটিল একটা সমীকরণ যেন সমাধান করতে দেয়া হয়েছে শাহজিদকে। যে সমীকরণের আগামাথা কিছুই বোঝা যায় না। ধাঁধা লাগা চোখে তব্দা মেরে চেয়ে রইল সে তুরিনের দিকে। অগাধ বিস্ময়ে হাবুডুবু খেতে খেতে বলল, ‘কী বলছো এসব? নিশা তোমার শত্রু হবে কেন? ও ভীষণ ভালো একটা মেয়ে। এত ভালো মেয়ে কারো শত্রু হতে পারে না।’
তুরিনের চোখে রক্ত চড়ে যায় অতর্কিতে।
—‘তাই? খুব ভালো মেয়ে?’
শাহজিদ তুরিনের রাগটা প্রত্যক্ষ করল। গম্ভীরভাবে বলল, ‘কথায় কথায় রেগে যাও কেন?’
—‘রাগব না তো কী করব শাহজিদ? যে মহিলা আমার পরিবারটাকে নষ্ট করে দিয়েছে, আমার বন্ধু হয়ে, আমারই সামনে বসে তুমি সেই মহিলার গুণগান গাইছ। বিশ্বাস হচ্ছে না!’
—‘তুরিন শোন, আমি জানি তোমার বাবার সেকেন্ড ম্যারেজ তোমার জন্য একটা বিশাল শক। কিন্তু নিশার এতে কোন দোষ নেই!’
—‘তাই?’
—‘হ্যাঁ তাই তো! তুমি চিন্তা করে দ্যাখো পুরো ঘটনাটায় একমাত্র ভিক্টিম কিন্তু সে। তোমরা নও।’
—‘আমি ভিক্টিম নই? দিনকে দিন আমার বাবা-মায়ের মধ্যে কীভাবে ডিস্টেন্স ক্রিয়েট হচ্ছে তুমি জানো? আমার ওপর দিয়ে কী যায় সেটা কখনো ভেবে দেখেছ? আমার বাবা…যে কি না আমাকে ছাড়া কিছুই বুঝত না। আমাকে সব চাইতে বেশি ভালোবাসত, সে এখন সারাক্ষণ ওই মহিলার বাচ্চা কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।’
—‘বাচ্চাটা উনারও। নিশার একার না। এটা ভুলে যাচ্ছ কেন?’
—‘ওই বাচ্চা আর ওই বাচ্চার মা আমাদের কেউ না। তোমার বন্ধু হতে পারে। তোমার প্রেমিকা হতে পারে…’
—‘কী যা তা বলছো!’ শাহজিদের গলা উঁচুতে উঠল। লোহার মতো শক্ত হয়ে বলল, ‘বাজে বোক না।’ একটু থেমে আবার বলল, ‘নিশা আমার বোনের মতো। তা ছাড়া ও তোমার বাবার স্ত্রী। কথা বলার আগে একটু ভেবে দেখো কী বলছো।’
—‘ও আমার বাবার কিছুই না। বাজে মেয়ে একটা!’
—‘এভাবে বোলো না তুরিন। এতটা নিষ্ঠুরতা তোমাকে মানায় না।’
—‘খুব দরদ তোমার ওর জন্য তাই না? দুনিয়ার সবার জন্যই দরদ উথলে ওঠে তোমার। শুধু আমার জন্যই কিছু নাই! ‘
শাহজিদ হতাশভাবে বলল, ‘গত তিনটা বছর তুমি আমাকে কম জ্বালাওনি। এখনো জ্বালাচ্ছ। এমন কর কেন সব সময়?’
—‘গত তিন বছর আমি তোমার ধারে-কাছেই যাইনি। জ্বালালাম কীভাবে?’ শাহজিদ ঘোলা চোখে চেয়ে থাকে, ঘোলা গলায় বলে, ‘তুমি আমাকে কীভাবে জ্বালাও সেটা একটা রহস্য!’
হঠাৎ আনিতাকে দেখা যায়। কাছাকাছি এসে তুরিনের দিকে সেলফোন বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘চাচিমার ফোন। কথা বলতে চায়।’
ফোনটা লাউড স্পিকারে ছিল। তুরিন হ্যালো বলতেই ফারা ওপাশ থেকে তীক্ষ্ণ স্বরে বলে উঠল, ‘কী করছ?’
তুরিন একটু অপ্রস্তুত বোধ করে, ‘আমি…কিছু করছি না…তেমন কিছু করছি না।’
—‘অর্ণব কোথায়?’
অর্ণবের কথা ভুলেই গিয়েছিল তুরিন। আমতা আমতা করে বলল, ‘আছে।’
ফারা গলায় বিষ উগড়ে দিয়ে বলল, ‘তুমি ওই ল্যাংড়া খোঁড়া ছেলেটার সঙ্গে বসে বসে কী করছ শুনি?’
তুরিন চট করে লাউডস্পিকারটা অফ করে দিল। উঠে দাঁড়াল বসা থেকে। ফোন কানে নিয়ে সরে গেল একটু দূরে। ফারার মন্তব্যটা শুনতে পেয়েছে শাহজিদ। তেমন গায়ে মাখেনি। এসব সয়ে গেছে এখন। অনেকটা সময় একটানা বসে থাকায় পায়ে ঝিঁঝি ধরে গিয়েছিল। পাশে রাখা ক্রাচদুটো কাছে টেনে নিল এবার। উঠে দাঁড়াবার জন্য উদ্যত হতেই আনিতা এগিয়ে এসে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল। শাহজিদ আনিতার হাতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল। সৌজন্যসূচক হাসি হাসল, ‘থ্যাংকস ফর ইওর হেল্প।’
—‘কাল সন্ধ্যায় কী করছ তুমি?’ আনিতার আচমকা নির্ভীক প্রশ্ন।
একটু অবাক গলায় শাহজিদ বলল, ‘কাল সন্ধ্যায়? কোন প্ল্যান নেই তো!’ আনিতা চোরা চোখে দেখল একবার তুরিনকে। তুরিন ফোনে কথা বলতে বলতে এদিকেই চেয়ে আছে।
—‘আমার সঙ্গে ডিনার করবে?’ দ্বিধাহীন প্রস্তাব রাখল আনিতা।
শাহজিদের চোখে একটু কৌতুক খেলে গেল। ডান মাড়িতে জিব ঠেকিয়ে কী যেন ভাবল সে কয়েক সেকেন্ড। সরু হয়ে এলো চোখের দৃষ্টি। দুরন্ত হেসে বলল, ‘আর ইউ আস্কিং মি আউট অন অ্যা ডেট?’
আনিতা স্মার্ট হাসে, স্মার্ট গলায় বলে, ‘কাইন্ড অফ!’
—‘ওয়াও!’ স্বগতোক্তির মতো শব্দটা উচ্চারণ করে শাহজিদ। তারপর একটু আমতা আমতা করে বলে,
—‘সাউন্ডস ফান!’
তুরিন ফোনে কথা বলা শেষ করে ফিরে এসেছে। ওর চোখে প্রশ্ন। তাকানোর ভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছে শাহজিদ আর আনিতার মধ্যকার কথোপকথনের সারমর্ম জানতে চায় সে। আনিতা নিজের সেলফোনটা তুরিনের হাত থেকে তুলে নিয়ে শাহজিদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওকে দেন…সি ইউ টুমরো।’ কথাটা বলেই আর দাঁড়াল না সে। তুরিন হতবাক হয়ে প্রশ্ন করল, ‘কী হবে টুমরো?’
শাহজিদ ফিচেল হাসল, ‘শি অ্যাস্কড মি আউট!’
—‘কী?’ তুরিনের চোখে রক্ত চলকে উঠল আবারও।
—‘হুম।’ আনিতার চলে যাওয়া পথটার দিকে তাকিয়ে থেকে অন্যমনস্ক শাহজিদ বলল।
—‘তুমি কী উত্তর দিয়েছ?’ ঝাঁঝ বেরোচ্ছিল তুরিনের গলা থেকে।
—‘রাজি না হওয়ার তো কোন কারণ নেই!’
—‘ও আচ্ছা! নাচতে নাচতে রাজি হয়ে গেলা?’
—‘সুন্দর একটা মেয়ে ডেটে যেতে চায়। কোন গাধার বাচ্চা রাজি হবে না শুনি?’
রাগে কান গরম হয়ে উঠল তুরিনের। মাথার ভেতর যেন হাজার হাজার ঝিঁঝি পোকা ডেকে চলেছে। একটু দূরে অর্ণব আর নিশা দাঁড়িয়ে আছে। শাহজিদ ক্রাচে ভর দিয়ে কয়েক পা এগিয়ে গেল। তুরিন ওর পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে উত্তেজিতভাবে বলল, ‘ওই যে ছেলেটাকে দেখছ? ওকে তোমার কেমন লাগে?’
একটু থমকাল শাহজিদ। ফতুয়া পরা ছিপছিপে গড়নের অর্ণবের দিকে তীব্র চোখে চেয়ে তীব্র গলায় প্রশ্ন করল, ‘কেন জানতে চাইছ?’
—‘দাদাজান ওর সঙ্গে আমার বিয়ে দিতে চায়।’
—‘ভালো তো!’ গলায় উদাসীনতা ফুটিয়ে তোলার বৃথা চেষ্টা করে শাহজিদ।
—‘ভালো?’
—‘হ্যাঁ, ছেলেটা বেশ ভালো। তোমার কেমন লেগেছে?’
তুরিন অর্ণবের দিকে তাকায়। চোখে চোখ পড়ে। একটু হাসার চেষ্টা করে অর্ণব। তুরিনও হাসে। তারপর গলায় আলাদা একটা সুর নিয়ে বলে, “আই থিংক…হি ইজ অ্যাট্রাক্টিভ!’
কথাটা শুনতে ভালো লাগল না শাহজিদের। বুকে কী যেন একটা খচখচ করে উঠল। চুপ করে গেল বিরক্তিতে। তুরিন শাহজিদের মেঘাচ্ছন্ন মুখটা লক্ষ্য করে রসিয়ে রসিয়ে বলল, ‘বিয়ে করে নিয়ে যাবে আমাকে।’
—‘কোথায় নিয়ে যাবে?’ ত্যাড়া গলায় প্রশ্ন করে শাহজিদ।
—‘দূরে।’
শাহজিদ এবার আর কিছু বলে না। ক্রাচে ভর দিয়ে আগাছাওয়ালা উঁচু- নিচু এবড়োখেবড়ো পথটা অনেক কষ্টে পার হওয়ার চেষ্টা করে। বাতাস এখন রুক্ষ। ঘনঘন বজ্রপাত হচ্ছে। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা সুচের মতো এসে বিঁধছে গায়ে। ভেজা বালির গন্ধে ভরে যাচ্ছে নিঃশ্বাস। একটু আগে তুরিনের বলা ‘দূরে’ শব্দটা মাথার ভেতর বিরক্তিকর মাছির মতো ভনভন করে যাচ্ছে। গত তিন বছর তুরিনের সঙ্গে কথা না হলেও কখনোই সে দূরে ছিল না। মাথার ওপরের ছাদে পায়ের শব্দ হলেই মনে হতো তুরিন বুঝি হাঁটছে। সন্ধ্যায় ডেকের ওপর চুপচাপ বসে বসে তুরিন মোবাইলে গেম খেলে। শাহজিদ টের পায়। ওর সিগারেটের ধোঁয়া উড়ে যায় ওপরে। চাপা রাগের তর্জন-গর্জন ভেসে আসে। প্রায় রাতে হটটাবের উষ্ণ জলে তুরিন গা ডুবিয়ে বসে থাকে। শাহজিদও বসে থাকে ব্যাকইয়ার্ডে। সিগারেট টানে। দুজনে চুপচাপ একে অপরের অস্তিত্ব অনুভব করে। এটাকে কি দূরে থাকা বলে? বলে না! কিন্তু এখন তুরিন বলছে অর্ণব নাকি ওকে বিয়ে করে দূরে নিয়ে যাবে। খুবই সহজ একটা কথা। কিন্তু কেন যেন এই সহজ কথাটাই শাহজিদের বুকের ওপর পাথরের মতো ভার হয়ে চেপে বসেছে। মন খারাপের বাতাসে গুমোট হয়ে উঠেছে ভেতরটা। সবাই চলে যায়…দূরে…বহুদূরে…মা, বাবা, নানিজান…সবাই চলে গেল!
তুরিন জহুরি চোখে তাকায় শাহজিদের দিকে, চোখাভাবে বলে, ‘বিয়েটা করে ফেলব নাকি? কী বলো?’
শাহজিদ একটা বড় শ্বাস গোপন করল, ‘নিশ্চয়ই করবে। আমার মনে হয় অর্ণব ছেলেটা ভালো। তুমি যেন আবার মিসবিহেভ করো না বেচারার সঙ্গে। শেষমেশ ভয়ে পালাবে।’
—‘আমার সম্পর্কে তোমার এই ধারণা?’
—‘কী ধারণা?’
—‘মানে আমাকে ছেলেরা পছন্দ করে না। ভয় পায়?’
—‘নিশ্চয়ই পায়। নইলে তোমার কোন বয়ফ্রেন্ড নেই কেন?’
তুরিন উত্তেজিত হয়ে বলে, ‘বয়ফ্রেন্ড নেই কারণ আমি কাউকে পাত্তা দেই না। নইলে একশ ছেলে আমাকে ভালোবাসে!’
শাহজিদ হাসতে লাগল। হাসতে হাসতে হঠাৎ একটা জটিল অংক যেন ফট করে সমাধান হয়ে গেল। তুরিন সবার চেয়ে অন্যরকম কারণ একটা বয়সে এসে কোন মানুষই ওর মতো ইনোসেন্ট থাকে না। মেয়েটা তাই বলে যা ওর মনে আসে। মনের কথাকে রং চং মেখে সভ্য আর সামাজিক করে তুলতে জানে না সে। এই সাদামাটা দিকটাই ওকে অন্য সবার চেয়ে আলাদা করে। লোকে মনে করে ঠোঁটকাটা, বদরাগী। কিন্তু ঠোঁটকাটা স্বভাবের পেছনের ঝকঝকে পরিষ্কার মনটা কেউ দেখার চেষ্টা করে না।
—‘একশ ছেলে?’
—হ্যাঁ।
—‘তাহলে এই অর্ণব বেচারার কী হবে?’
—কী আবার হবে? তুমিই তো বললে বিয়ে করে ফেলতে।’
—‘হুম…করে ফেলো…কিন্তু তাড়াহুড়া কেন? তুমি তো এখনো বাচ্চা খরগোশই আছ। বড় হওনি তো!’
—‘মায়ের খুব তাড়া।’
—‘কেন?’
তুরিন একটা হতাশ নিঃশ্বাস ছাড়ল –’পরে বলব।’
—‘তুমি ঠিক আছ শাহজিদ?’
নিশা এগিয়ে এসে প্রশ্ন করল। শাহজিদ চমৎকার হেসে বলল, ‘ঠিক আছি। একদম পার্ফেক্ট।
নিশার চোখে চোখ পড়ল তুরিনের। দুজনেই চোখ সরিয়ে নিল। হালকা একটু অনুতাপের হাওয়া এসে লাগল তুরিনের বুকে। নিশাকে নিয়ে সে হয়তো একটু বেশিই ভেবে ফেলেছিল। এখন লজ্জা করছে। তার মনটা এমন নষ্ট হলো কেন কে জানে! কিন্তু এই আনিতার কী হয়েছে হঠাৎ? এত সাহস হয় কী করে ওর? আচ্ছা, আনিতাকে তো সে দেখে নেবে দশ হাত। কিন্তু মূল সমস্যা অন্য জায়গায়। সমস্যা হলো শাহজিদ তাকে বন্ধুর চেয়ে বেশি কিছু কখনোই ভাবেনি। আজকে সেই সত্যটা আরো একবার খোলামেলাভাবে উঠে এলো। আর এটা ভাবতে গিয়ে তুরিনের আর কিছুই ভালো লাগছে না। ভয়ংকর এক বিষাদ ডোবা বাতাস তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছে। ফিরে যাওয়ার সময় গাড়িতে সবাই কেন যেন একটু বিষণ্ণ হয়ে গেল। বদ্ধ গাড়িতে তুরিনের হাঁসফাঁস লাগছিল। এয়ারকন্ডিশন না চালিয়ে জানালার কাচ নামিয়ে দিতে বলল সে। বৃষ্টির ছাঁটে ভরে গেল গাড়ির ভেতরটা।
—‘দ্রুত চালান মিস্টার অর্ণব। আমার স্পিড ভালো লাগে।’ রুদ্ধশ্বাসে বলল তুরিন।
অর্ণব হাসে, ‘টিকিট খাবো তো।’
—‘কিছু হবে না। আশপাশে কপস নেই।’ অভয় দেয় তুরিন। অর্ণব স্পিড বাড়ায়। পাহাড়ি রাস্তায় টাল খেয়ে ছুটতে থাকে গাড়িটা। জানালার বাইরে মাথা বের করে আনে তুরিন। চোখ বুজে বাতাসটা বুক পর্যন্ত শুষে নেয়। বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে মুখে। শনশন হাওয়া ওর চুলের খোঁপা খুলে দেয়। উপত্যকার পাইনগাছের সারিতে যত হাওয়াই লাগুক না কেন ওরা এক বিন্দুও নড়ে না। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে বন্দুকধারী সৈনিকের মতো। মেঘ-ছোঁয়া রোদের উদ্দাম নাচন চলে ওদের ঘিরে। যতদূর চোখ যায় শুধু আকাশ আর আকাশ। তুরিনের হঠাৎ হঠাৎ মনে হয় সে বুঝি আকাশেই ভাসছে। কলোরাডোতে আকাশ এত কাছে! ওরা একরকম আকাশের বুকেই তো থাকে! তুরিন একসময় ম্যাজিক মিররের ভেতর দিয়ে শাহজিদের দিকে তাকায়। হাই চিকবোনে বিদ্যুতের মতো কাঠিন্য চমকাচ্ছে। বিমোহন চোখজোড়ায় থকথক করছে বৈরাগ্য। তুরিনের মনে পড়ে শাহজিদের এক সময় আর্মিতে যোগ দেবার শখ ছিল। আর্মিতে গেলে…ওকে মানাত খুব!
অর্ণব বলছিল, ‘তেলের দাম যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা গরিব লোকেরা দুদিন পর গাড়ি চালাতে পারব কি না সন্দেহ।’
আনিতার চোখ ছিল ফোনের স্ক্রিনে নিবদ্ধ। সে একবার ডান দিকে তাকাল নিশার দিকে। আরেকবার বাঁ দিকে তুরিনের দিকে। দুজনেই নিশ্চুপ, নিথর নিজস্ব চিন্তায় মগ্ন। সামনে বসা শাহজিদও যেন কাষ্ঠপুতুল। অগত্যা আনিতাকেই কথা বলতে হলো, ভদ্রতা রক্ষার্থে।
—‘শুধু তেল কেন? সবকিছুর তো দাম বাড়তি।’
—‘ঠিক বলেছেন। আপনাদের কলোরডো কিন্তু খুব এক্সপেন্সিভ।’
—‘তা তো বটেই। যুদ্ধের কারণে ইনফ্লেশনও হচ্ছে।’
—‘হুম…কিন্তু পুতিন তো বলছে বিশ্বে মূল্যস্ফীতির জন্য ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযান দায়ী নয়। পশ্চিমা দেশগুলো নিজেদের ভুল ঢাকতেই এই দায় মস্কোর ঘাড়ে চাপাচ্ছে।’
—‘হ্যাঁ তার ভাষ্যমতে যুদ্ধের আগে থেকেই জ্বালানির দাম বেড়েছে।’
—‘কোভিডের কারণেও অর্থনীতিতে একটা বড়সড়ো ধস নেমেছে। সামনে আরো খারাপ দিন আসছে, বুঝলেন?’
নিশার মাথা ধরেছিল খুব। পিঠ এলিয়ে দিয়েছিল সিটের গায়ে। বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছুতেই রাস্তার ধারের ওয়াক ওয়েতে মানুষটাকে দেখল। গায়ে অফ হোয়াইট স্পোর্টস টি-শার্ট। হাঁটু-ছোঁয়া কালো রঙের শর্টস। পায়ে স্নিকার। টিপটিপ বৃষ্টিটা মাথায় নিয়ে দৌড়চ্ছে। অ্যাথলেটের মতো ঝরঝরে মেদহীন শরীরটা বৃষ্টির ফোঁড় কেটে কেটে ছুটে চলেছে তীরের বেগে। নিশা সোজা হয়ে বসল। গাড়ির গতি এত বেশি যে ক্রমেই মানুষটা পেছনে পড়ে যাচ্ছে। নিশা বাচ্চা মেয়ের মতো জানালার ধার চেপে ধরল দু হাতে। ঘাড় বাঁকিয়ে দেখতে থাকল ফেলে আসা দৃশ্যপট।
আনিতা হঠাৎ বলে উঠল, ‘আরে চাচ্চু না?…হ্যাঁ চাচ্চুই তো।’
অর্ণব মুখ ঘুরিয়ে দেখে একবার। হালকাভাবে বলে, ‘আঙ্কেল কিন্তু এখনো ফিট। অনেক হ্যান্ডসাম।’
আনিতা হাসে, ‘এখনো শব্দটা দ্বারা কী বুঝাতে চাইছেন? হি ইজ স্টিল ইয়াং!’
—‘তা ঠিক। আপনার বয়সি মহিলার চাচা বললে কেউ বিশ্বাস করবে না।’
—‘আমি মহিলা?’
অর্ণব বাঁকা চোখে পেছন দিকে চায় একবার, ‘মহিলা নন? পুরুষ বলা উচিত ছিল?’
আনিতা ভাবলেশহীন গলায় বলল—‘আপনার কৌতুকটা ঠিক কৌতুকের মতো শোনাচ্ছে না। তাই হাসতে পারলাম না। সরি।’
—‘কী বললেন? কৌতুকটা যৌতুকের মতো লাগছে?’ আনিতা রাগতে গিয়ে হেসে ফেলল।
বাড়ি ফিরে দেখা গেল শ্বশুরমশাই বাজার করে এনেছেন। লিভিং রুমে বাজারের ব্যাগগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা। নিশা ফিরে এসে জুবিনের খোঁজ নিল প্রথমে। দাদির কোলে বহাল তবিয়তে ঘুমাচ্ছে জুবিন রাণী। মেয়েকে দেখে এসে নিশ্চিন্ত মনে কোমরে আঁচল বেঁধে কাজে লেগে গেল নিশা। কার্পেটের ওপর অবিন্যস্তভাবে পড়ে থাকা বাজার-সদাই বয়ে নিয়ে যেতে লাগল কিচেনে। অগোছালো থাকতে তার মোটেই ভালো লাগে না। ঘরের জিনিস টুকটুক করে গুছিয়ে ফেলার মধ্যে নিজের অশান্ত মনকে শান্ত করার আনন্দ পায়। মনে হয় সংসার নয়, নিজের আত্মাটাকেই সাজাচ্ছে। জাহিদ ফিরল কাকভেজা হয়ে। মাথার ছোট ছোট চুলে, চশমার ফ্রেমে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি নিয়ে। নিশা দু হাত ভর্তি প্যাকেট নিয়ে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিল। জাহিদকে দেখতে পেয়ে একটু থামল ক্ষণিকের জন্য। তারপর দ্রুত সরে গেল জায়গাটা থেকে।
জাহিদ টুলে বসে জুতোর ফিতে খুলছিল। অবনত চোখের সামনে একটি ছায়া প্রত্যক্ষ করল। নিশা দাঁড়িয়ে আছে। হাতে তোয়ালে। চোখাচোখি হয়। নিশার কপালে টিপ, চোখের কার্নিশে কাজল, গালে একটু একটু লজ্জার লাল…একবার তাকালে শুধু তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করে। জাহিদ ইচ্ছের বিরুদ্ধাচার করে চোখ সরিয়ে নেয়। মনোযোগ দিয়ে জুতোর ফিতে খুলে। নিশা তোয়ালে হাতে দাঁড়িয়ে থাকে অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে। দূর থেকে ট্রেন আসার আগে স্টেশনের মাটি যেমন করে কাঁপে, ঠিক তেমন করেই কাঁপতে থাকে বুকের ভেতরটা। জুতো ছাড়া হলে জাহিদ নিশার মুখোমুখি দাঁড়ায় নিঃশব্দে। তোয়ালেটা হাতে তুলে নেয়। নিশার দিকে চেয়ে থাকে খানিকক্ষণ, চোখে চাপা হাসির রেশ নিয়ে। নিশা দূরের ট্রেনের শব্দ পায়…মনের স্টেশনের মাটি কাঁপে! জাহিদ মাথার জবজবে ভেজা চুল তোয়ালে দিয়ে ঝাড়ন দেয়। একগুচ্ছ পানির ছিটা এসে পড়ে নিশার চোখেমুখে। চোখ বন্ধ করে হেসে ফেলে সে। হাসে জাহিদও। রান্নাঘর থেকে হঠাৎ ফারার কণ্ঠস্বর ভেসে আসে।
—‘কতবার বলা হয়েছে বাইরে থেকে জিনিস এলে প্ৰথমে ডিসইনফেকটেন্ট স্প্রে ইউজ করতে হবে। এই মেয়ে কথা পাত্তাই দেয় না!’
নিশা চমকে উঠে কয়েক পা পিছিয়ে এলো। তড়িঘড়ি করে দৌড়ে গেল কিচেনে। ফারা কোমরে হাত দিয়ে রণরঙ্গিণী ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। তুরিন আর আনিতা জুসের বোতল নিয়ে বসেছে কিচেন কাউন্টারের টুলে। তানিশাও যোগ দিয়েছে ওদের সঙ্গে। নিশার উপস্থিতি টের পেয়ে ফারার গলার স্বর আরো উঁচুতে উঠে গেল।
—‘প্রতিটা জিনিস আলাদা আলাদাভাবে স্প্রে করতে হয়। করোনা কি নতুন এসেছে পৃথিবীতে? এত দিনেও অভ্যাস হয়নি?’
বাচ্চাদের সামনে বেশ অপদস্ত বোধ করল নিশা। অপমানে মুখ ছোট হয়ে গেল। ভুল যে হয়েছে, তা অস্বীকার করে কী করে? সত্যিই তো জিনিসগুলো রান্নাঘরে আনার আগেই জীবাণু মুক্ত করা বাঞ্ছনীয় ছিল। নিশা পড়িমরি করে স্প্রের বোতল নিয়ে এলো ক্যাবিনেট থেকে। ফারা ওর হাত থেকে বোতলটা ছোঁ মেরে তুলে নিল নিজের হাতে। তারপর ডিমের বাক্স, দুধের কনটেইনার, সবজির প্যাকেট, সমস্ত জিনিস আলাদা আলাদাভাবে স্প্রে করতে লাগল। সেই সঙ্গে গজগজ করে বলতে লাগল, ‘অশিক্ষিত গেঁয়ো মানুষজন ঘরে থাকলে এই অবস্থাই হবে। সবাইকে মারবে! কমনসেন্স নেই কোন।’
মেয়েরা নিজেদের মধ্যে কথা থামিয়ে ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে। নিশা মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে রইল। অপদস্ত মেঘাচ্ছন্ন মুখে। জাহিদ কাউন্টারে এসে মেয়েদের পাশে একটা টুল টেনে নিয়ে বসল। গ্লাসে জ্যুস ঢালতে ঢালতে শান্ত গলায় বলল, ‘ব্যাগগুলো আমি এনেছিলাম কিচেনে। স্প্রে করতে ভুলে গিয়েছিলাম।’ ফারা থমকাল। থমকাল নিশাও। জাহিদ গম্ভীরভাবে বলল, ‘না জেনে-শুনে কাউকে অ্যাকিউজ করা ঠিক না।’
ফারার তেজি মুখটা ভস করে নিভে গেল। অপমানে কাদা হয়ে বলল, তোমার আক্কেলটা কেমন হ্যাঁ? অশিক্ষিত মানুষের সঙ্গে থাকতে থাকতে তুমিও দিন দিন অশিক্ষিত হয়ে যাচ্ছ?’
তুরিন একটা খ্যাক দিয়ে উঠে বলল, ‘উফ মা! চুপ করো তো। সব সময় এসব ভ্যাজর ভ্যাজর ভালো লাগে না!’
নিশা উদ্বেলিত চোখে তাকাল একবার জাহিদের দিকে। জুসের গ্লাসে ঠোঁট ডুবিয়ে জাহিদও শান্ত চোখে দেখল নিশাকে। নিঃশব্দে কী যেন একটা কথা হয়ে গেল চার চোখেতে। কয়েকটা ইতস্তত সেকেন্ড বিনা বাক্য ব্যয়ে পার করার পর নিশা দ্রুত প্রস্থান করল রান্নাঘর থেকে।
তবুও জীবন যাচ্ছে চলে
—‘কী ব্যাপার? তোমরা বাবা-মেয়ে জোট বেঁধে আমাকে অপমান করলে কেন?’
ফারার ঠোঁটজোড়া ছুরির মতো ধারালো হয়ে ওঠে। চোখ থেকে ঠিকরে বেরোয় আগুন।
জাহিদ গলার স্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল, ‘কেউ তোমাকে অপমান করেনি। আমি জাস্ট ফ্যাক্ট বলেছি। এখানে মান-অপমানের প্রশ্ন আসছে না।’
আনিতা আর তানিশা এই পারিবারিক কলহ থেকে রেহাই পেতে দ্রুত উঠে দাঁড়াল। ওরা চলে যাওয়ার পর তুরিন ফারার চোখে চেয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ‘মাঝেমধ্যে তুমি একটু বেশি বলে ফেলো মা! চুপ থাকলেই কিন্তু এত ঝামেলা হয় না!’
—‘চুপ থাকতে হবে আমার?’
—‘থাকতে পারো। মাঝেমধ্যে।’ জুসের গ্লাসে চুমুক দেয় তুরিন।
ফারা অসহায় রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘তোমার জন্য…শুধু তোমার জন্য আমি সব কিছু সহ্য করে এই বাড়িতে পড়ে আছি। আর তুমি আমাকে লেকচার শোনাচ্ছ? উপদেশ দিচ্ছ?’
তুরিন বন্দুক তাক করার মতো স্পর্ধিত ভঙ্গিতে অগ্নিবৎ দুটি চোখ তাক করল ফারার মুখের ওপর, ‘কেন আমার জন্য এত কিছু সহ্য করছ তুমি? কেন কেয়ার করার অভিনয় করছ? সত্যটা হচ্ছে তোমরা শুধু নিজেদের নিয়েই ভাবো। আমাকে নিয়ে কখনোই ভাবোনি তোমরা।’
জাহিদ মেয়ের পেছনে এসে দাঁড়াল। একটা হাত ওর কাঁধে রেখে ঠাণ্ডা গলায় বলল, ‘মায়ের সঙ্গে তর্ক কোর না।’
তুরিন এক ঝটকায় হাতটা সরিয়ে দিল, ‘তুমি আমাদের মাঝে এসো না! যাও এখান থেকে।’
কথাটা শেলের মতো বিঁধল জাহিদের বুকে। মনে পড়ল তুরিন ওর সঙ্গে অনেক দিন ধরে স্বাভাবিক স্বরে কথা বলে না। কাছে আসে না। জুবিনের জন্মের পর থেকেই মেয়েটা পাল্টে গেছে।
ফারা মেয়ের কথার সুরে তাল মিলিয়ে যোগ করল, “ঠিকই বলছে ও। আমাদের মা-মেয়ের মাঝে তোমাকে আসতে হবে না। তুমি বরং তোমার নতুন বউ আর নতুন বাচ্চাকে নিয়ে লুতুপুতু করো গিয়ে। সেটাই তোমাকে মানাবে।’
জাহিদ কথাটা গ্রাহ্য না করে তুরিনকে বলল, ‘তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল মা! সময় হবে?’
তুরিন বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। টুলটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল অনেক দূরে। চড়া গলায় বলল, ‘সরি। আমার সময় নেই…ইচ্ছাও নেই।
বিষাদ আর অপমানের বিভীষণ বাতাস বুকফাটা এক ঝাপটা দিয়ে গেল জাহিদের মনে। শ্রাবণের মেঘ ঘনিয়ে এলো গৌরবর্ণ মুখখানায়। ফারার কথা আজকাল তার আর গায়ে লাগে না। কিন্তু তুরিনের উপেক্ষা আর অবহেলা সহ্য করার শক্তি ফুরিয়ে আসছে দিনকে দিন। ফারা মেয়ের পেছন পেছন ছুটতে লাগল।
—‘অর্ণবের সঙ্গে কথা হয়েছে?
—‘চুপ করো তো!’
—‘চুপ করব কেন? আমার তো ছেলেটাকে ভালোই মনে হচ্ছে।’
সিঁড়ির গোড়ায় পৌঁছে তুরিন ব্রেক কষার মতো ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে পড়ল হঠাৎ। ঘুরে দাঁড়িয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘আমার বিয়ে দিয়ে নিজের রাস্তা ক্লিয়ার করতে চাইছ?’
ফারার মুখে একটা ভ্যাবাচ্যাকা ভাব ফুটে উঠল। চমকে আশপাশটা দেখে নিল একবার। গলার স্বর কয়েক স্কেল নিচে নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলল, ‘কী বলছো এসব?’
ঘেন্নায় মুখ বাঁকায় তুরিন, ‘ঠিকই বলছি। সবই বুঝি আমি। বাই দ্য ওয়ে, তোমরা কি এখন পর্যন্ত ওই ছেলেটার সঙ্গে বাবার সেকেন্ড ম্যারেজ নিয়ে কথা বলেছ?’
ফারার গাল চুপসে যায়, ‘বলিনি। বলব…’
—‘দেরি না করে বলে ফেল। আগে এটা জেনে নাও যে ওই ছেলে তোমাদের মতো স্ক্যান্ডালাস ফ্যামিলির সঙ্গে আদৌ কোন রিলেশন করতে চায় কি না।’
কথাটা ছুড়ে দিয়ে আর দাঁড়াল না তুরিন। গটগটিয়ে সিঁড়ি ভাঙতে লাগল। দোতলার সিঁড়িসংলগ্ন হলওয়েতে মুর্তজা সাহেব দাঁড়িয়ে ছিলেন। ছাই রঙের পাঞ্জাবি-পাজামা তাঁর পরনে। শান্ত মুখ। আতরের খুশবু ম-ম করছে বাতাসে। তিনি নাতনির পথরোধ করে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘দাদুভাই তোমার সঙ্গে আমার একটু কথা আছে। একবার এসো আমার ঘরে।’
—‘তোমাদের কারো সঙ্গেই আমি কোন কথা বলতে চাই না। প্লিজ আমাকে বিরক্ত করো না।’
মুর্তজা সাহেব ব্যথিত স্বরে বললেন, ‘দাদুভাই তোমার বয়স এখনো অল্প। জীবনে কিছু ভুল শোধরাবার জন্য মানুষকে মাঝেমধ্যে উল্টো পথ বেছে নিতে হয়। ধরে নাও আমি সেরকম কিছুই করেছি।’
তুরিন ফুঁসে উঠল, ‘কোনটা ভুল ছিল? আমার বাবা-মায়ের রিলেশন? এটাই বলতে চাও তুমি?’
মুর্তজা সাহেব নাতনির মুখের ওপর অনুকম্পার দৃষ্টি রেখে বললেন, ‘তোমাকে আরেকটু শক্ত হতে হবে দাদুভাই। আরেকটু ম্যাচিওর হতে হবে।’
তুরিন ঘৃণার একটা তির্যক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হাঁটা শুরু করল নিজের ঘরের দিকে। মুর্তজা সাহেব সেলফোন হাতে নিয়ে অর্ণবের নম্বরে ডায়াল করলেন। ছেলেটার সঙ্গে কিছু জরুরি আলাপ সেরে নিতে হবে। তুরিনের পাশে এমন কাউকে দরকার যে শক্ত হাতে ওকে সামলাতে পারবে। ওকে বুঝবে, ভালোবাসবে, কেয়ার করবে। ঝড়ের দিনে মাথার ওপর ছাদ হবে।
.
হনহনিয়ে বেডরুমে ঢুকল ফারা। জানালা খোলা হয়নি। এয়ারকন্ডিশন চলছে না। ভেতরটা ভ্যাপসা। ঘরের কোণে রাখা হিউমিডিফায়ারের জলীয় বাষ্প এঁকেবেঁকে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে সিলিং। আবছা অন্ধকারে দেখতে পেলএকজন অন্ধকার মানুষ ঝিম ধরে শুয়ে আছে সোফায়। বহুদিন হলো ওদের শয্যা আলাদা। জাহিদ সোফায় ঘুমোয়।
—‘তুমি যাবে না? তৈরি হওনি যে?’
জাহিদ অলস চোখে তাকাল একবার ফারার দিকে,
—‘কোথায় যাব?’
—‘কোথায় আবার? অনিমেষের ওখানে।’ বিরক্তিতে কাদা হয়ে বলে ফারা।
—‘আমার শরীর ভালো লাগছে না।’
—‘কী হয়েছে?’
—‘মাথা ব্যথা।’
—‘কোভিড-টোভিড বাঁধালে নাকি আবার?’
—‘কী জানি!’ দায়সারা গলায় বলে জাহিদ। আড়চোখে দেখে ফারাকে। টাওয়েল নিয়ে বাথরুমের দিকে যাচ্ছে। ওর মুখে ক্ষণিক আগের পারিবারিক কলহর লেশমাত্র নেই এখন। কেমন একটু সুখী সুখী ভাব। ও নিজের সুখ নিজের মতো করে খুঁজে নিতে জানে। সেই খুঁজে নেওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে যেন ওর কোন দোষ নেই, বরং যে এর মাঝে দোষ খুঁজে বেড়াবে, আদতে দোষটা তারই।
দীর্ঘ শরীর, মেদহীন মজবুত গঠন, আর দুঃসাহসিক এক চটকদার স্মার্টনেস দেখেই একসময় ওর প্রেমে পড়েছিল জাহিদ। দিনে দিনে এই দুঃসাহসিক ব্যক্তিত্বের গাঁথুনি অনেকটা হিংস্র ইমারতের মতো বেড়ে উঠেছে ফারার চতুর্দিকে। জাহিদ এখন শুধু ওই শক্ত ইমারতই দেখতে পায়। ভেতরের মানুষটা হারিয়ে গেছে। এই মুহূর্তে ফারা নিশ্চয়ই শুধু নিজেকে নিয়েই ভাবছে। না শুধু নিজেকে নিয়ে নয়। হয়তো ওর ভাবনায় অনিমেষও আছে। ছিল সব সময়। সেই কলেজ জীবন থেকে…আজ অবধি! এই থাকাটা যে হঠাৎ ঝড়ে উড়ে আসা অস্থায়ী ধূলোর মতো নয়, বরং মাটির অনেক গভীরে ছড়িয়ে থাকা শক্ত শিকড়ের মতো, সেই বাস্তবতাটুকু বুঝে নিতে জাহিদের বড়ই বিলম্ব হয়ে গেল! একটা বড় শ্বাস ফেলে সে চিন্তাগুলোকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করল। ক্যাবিনেট খুলে অ্যানটিজেন র্যাপিড টেস্ট কিট বের করল। বেশ কয়েকটা টেস্টিং কিট অনলাইনে অর্ডার করে আনিয়ে রেখেছিল। কী একটা সময় এলো, হালকা জ্বর-জারি হলেই করোনা বলে সন্দেহ হয়। মিনিট পনের সময় লাগল নিরীক্ষণ প্রক্রিয়া শেষ হতে। ফলাফল নেগেটিভ। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে একটা আইবুপ্রফেন গিলে নিল পানির সঙ্গে। ততক্ষণে ফারা বেরিয়ে এসেছে গোসল সেরে। পরনে সাদা বাথরোব, মাথায় তোয়ালে। মুখে হালকা হালকা সুখের ছিটা। ও এখন যত্ন করে সাজবে। কার জন্য সাজবে ফারা? অনিমেষের জন্য? নাহ…ও আসলে নিজের জন্যই সাজবে…ভালো…নিজেকে ভালোবাসা নিশ্চয়ই অপরাধ নয়। যারা এই কঠিন কাজটা করতে পারে, তারা নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান।
জাহিদ চোখ বুজে শুয়ে রইল। মাথায় যন্ত্রণা। জ্বর-জ্বর ভাব। মুখ তেতো। বৃষ্টিতে ভেজা ঠিক হয়নি। চোখ বন্ধ করতেই জুবিনের মুখটা উদ্ভাসিত হয়ে উঠল চোখের সামনে। কিন্তু জ্বর ভাব নিয়ে ওর কাছে যাওয়া ঠিক হবে না আপাতত। জুবিনের পাশাপাশি আরো একজনের কথা মনে পড়ল। মনে করতে চায় না। তবুও মনে পড়ে। একটা প্রশ্ন জাহিদের গলায় অনেকদিন ধরে মাছের কাঁটার মতো লেগে আছে। নিশা কেন সেদিন চলে যায়নি? এই বন্দি জীবন, অতি অল্প বয়সে সন্তানের মা হওয়া, দিনরাত এমন এক সংসারের জন্য খেটে যাওয়া যেখানে তাকে মানুষ হিসেবে ন্যূনতম সম্মানটুকুও কেউ দিতে চায় না। এমন একটা জীবন কেন বেছে নিয়েছিল মেয়েটা? জাহিদ তো ওকে মুক্তি দিতে চেয়েছিল। এখনো দিতে চায়। বেজমেন্টে যে ছেলেটা থাকে…বাবার পরিচিত…নামটা ঠিক মনে পড়ছে না এই মুহূর্তে। কেউ কেউ বলে ওর সঙ্গে নাকি নিশার অন্যরকম একটা সম্পর্ক আছে। সত্য-মিথ্যা জানে না জাহিদ। তার আত্মসম্মানবোধ সদা জাগ্রত। নিশার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে খোলামেলা আলাপ করতে আজও কুণ্ঠা হয়। সত্যি বলতে ছেলেটির সঙ্গে নিশার কোন বিশেষ রকমের বোঝাপড়া থেকে থাকলে জাহিদ একরকম বেঁচে যায়। সে মনে-প্রাণে চায় নিশা ভালো থাকুক, সেসব সুখ খুঁজে পাক, যেসব সুখ তাকে এই পরিবার কখনো দিতে পারেনি, পারবেও না।
জীবনের শুরুতে ফারাকে কথা দিয়েছিল, আজীবন ভালোবাসবে, আজীবন পাশে থাকবে। মানুষ একবার বাঁচে, একবার ভালোবাসে। মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে সে কথাগুলো। ফারাকে দেয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে নিজের কাছেই নিজে ভীষণভাবে হেরে যাবে! এই হেরে যাওয়ার ভয়েই নিশাকে সজ্ঞানে এড়িয়ে যেতে হয়। কিন্তু জীবনটা সব সময় হিসাব নিকাশ আর পরিকল্পনার ছক মেনে চলে না। বাড়িভর্তি লোকের মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ জাহিদ যখন ভীষণ একা হয়ে ওঠে আজকাল, যখন তার শূন্য হৃদয় একটা আশ্রয় খোঁজে ভিখিরির মতো, সেই অসহায় মুহূর্তে নিশার মুখটাই ভেসে ওঠে চোখের সামনে। মাঝেমধ্যে মনে হয় ভালোবাসা জিনিসটা বোধহয় অত প্রস্তুতি নিয়ে হয় না। ফারাকে আজীবন ভালোবাসার শপথ নিয়েছিল যখন…বয়স কতই বা তখন? মাত্র বিশ! অত কাঁচা বয়সে বাবা-মা হওয়ার কথা ভাববারও সাহস পায় না কেউ। কিন্তু ওই বয়সেই জাহিদ পুরো জীবনের পরিকল্পনা এঁটে ফেলেছিল। আজকে এত বছর পর এসে বুঝতে পারে পরিকল্পনা মোতাবেক আর যাই হোক না কেন, মনের বোঝাপড়াটা কখনো হয়ে ওঠে না।
মাথায় এলোমেলো ভাবনা নিয়ে বেরিয়ে এলো বেডরুম থেকে। তুরিনের ঘরের দরজাটা আলতো করে লাগানো ছিল। একবার টোকা দিয়ে বলল, ‘কী করছ মা? আসব ভেতরে?’
—‘প্লিজ! লিভ মি এলোন। ডোন্ট ওয়ানা টক।’
প্রত্যাখ্যাত মন নিয়ে সরে এলো জাহিদ। বহুদিন হয়ে গেল, তুরিন তাকে বাবা বলে ডাকে না। তুরিনের মুখ থেকে একবার বাবা ডাক শোনার জন্য আত্মাটা খাঁচাবন্দি পাখির মতো ডানা ঝাপটে যাচ্ছে অনবরত। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে নিশার ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল জাহিদ। ভেতর থেকে জুবিনের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। একবার খুব ইচ্ছে হলো ওকে দেখতে। বলতে নেই, নিশাকেও এই মুহূর্তে খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। প্ৰথম প্ৰথম মেয়েটির দিকে ফিরেও তাকাত না। দুর্দান্ত রূপবতী মেয়ে। ওই মুখের দিকে তাকাতে রীতিমতো ভয় হতো। কিন্তু ক্রমেই বুঝতে পারল শুধু রূপ নয়, মেয়েটির মধ্যে আরো কিছু আছে। এমন কিছু যা অন্য অনেকের মধ্যেই নেই। রূপমুগ্ধতা বেশিদিন টেকে না। টিকে যায় মনের নির্যাসটুকু। নিশাকে…..নিশার মতো ভালো মনের একটা মেয়েকে ভালো না লাগানোর জন্য যত রকম কৌশলের প্রয়োজন ছিল তার সবটাই প্রয়োগ করেছিল নিজের ওপর। তুরিনের ঘরটা হলওয়ের শেষ মাথায়। হঠাৎ দরজা খুলে বেরিয়ে বাবাকে নিশার ঘরে দেখতে পেলে হয়তো মেয়েটা কষ্ট পাবে। কথাটা মনে হতেই জাহিদ নিঃশব্দে সরে এলো। নিজের ঘরে এসে শুয়ে পড়ল সোফায়।
.
বাইরে এখন বৃষ্টির রেশ কাটানো রুপালি রোদ। ঝিরঝির হাওয়া দিচ্ছে চকচকে মেঘমেদুর আকাশ। ফারা বেগুনি সিল্ক শাড়ির আঁচল সামলে ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল। ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে নামিয়ে দিল জানালার কাচ। চাকা ঘুরতে না ঘুরতেই রুপো রঙের রূপবান দুপুরটা ওকে আলিঙ্গন করল দূর পরবাসী প্রেমিকের মতো। গাড়ির অডিওতে চালু করে দিল ব্লুজ মিউজিক। গাড়ি চালানোর সময়টাই ওর ‘মি টাইম’। স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে সাপের মতো মসৃণ আঁকাবাঁকা রাস্তায় চলতে চলতে নিজেকে নিজের সময় দিতে ওর দারুণ লাগে। জীবনে অনেক ঠেকে শিখেছে ফারা, সুখ জিনিসটা এমনই দুর্লভ যে, কেড়ে নিতে না জানলে ওই হতচ্ছাড়া কারো কাছে আত্মসমর্পণ করে না, ধরা দেয় না। চাওয়া-পাওয়ায় কোন সংকোচ নেই ফারার, ভয়ও নেই। জাহিদের মতো কর্তব্যবোধে চালিত, বিবেকের চোখ রাঙানিতে হরহামেশা গুটিয়ে থাকা মানুষেরা জানে না জীবনটাকে কী করে উপভোগ করতে হয় বিবেকের শাসনকে পাশ কাটিয়ে।
নিতান্তই অল্প বয়সে প্রেমটা হয়ে গিয়েছিল। জাহিদ চুপচাপ, ভালো ছাত্র গোছের ছেলে। কাউকে খুব একটা পাত্তা-টাত্তা দেয় না। তেমন বাকপটু নয়। নিজের মতো থাকে। বান্ধবীর সঙ্গে বাজি ধরে ওকে পটাতে গিয়েছিল ফারা। প্রথম কয়েকদিন গ্রাহ্য করল না জাহিদ। খোঁজ নিয়ে জানা গেল জাহিদের ফুটবলে প্রবল আগ্রহ। নিয়মিত খেলাধুলা করে। ফারা প্রতিটা ম্যাচে সশরীরে উপস্থিত থাকতে লাগল। খেলাধুলার আলাপ দিয়েই শুরু হলো বন্ধুত্ব। প্রেমটাও জমে গেল একসময়। জাহিদের মাধ্যমেই অনিমেষের সঙ্গে পরিচয়। অনিমেষ সাহা…গাঢ় গাত্রবর্ণের পোষ-না-মানা ধাঁচের দুর্ধর্ষ পুরুষ। সংকোচহীন, প্রত্যুৎপন্নমতি, সপ্রতিভ এবং রসিক। জাহিদকে পড়ে ফেলা যতটা সহজ, অনিমেষের দুর্বোধ্য ব্যক্তিত্ব ঠাওরে ওঠা তার চাইতে অনেক অনেক কঠিন। গৃহপালিত আস্থাবান নিরীহ প্রাণীর চেয়ে গহিন অরণ্যের বুনো, বর্বর, হিংস্র সিংহই ফারাকে বেশি টানল। তাই সহজলভ্য জাহিদ নয়, বরং দুর্ধর্ষ চরিত্রের অনিমেষের দিকেই দ্রুত ঝুঁকতে লাগল সে। কিন্তু বাড়ির লোকজনের জাহিদকে পছন্দ ছিল। সুদর্শন, ভালো ছাত্র এবং মুসলিম পরিবারের ছেলে। কলেজ শেষ হওয়ার আগেই মা একদিন জানিয়ে দিল, জাহিদ ছেলেটার সঙ্গে তোর যদি প্রেম থাকে বলতে পারিস। কিন্তু সাদা চামড়ার কারো দিকে ভুলেও তাকাবি না। মনে থাকে যেন। অনিমেষ সাদা চামড়ার না হয়েও বিয়ের যোগ্যতার মাপকাঠিতে পিছিয়ে আছে। ধর্মের ফারাকটাই এখানে মুখ্য বাধা।
একদিন জাহিদের অনুপস্থিতিতে দেখা করল ওরা। খোলামেলা কথা বলে জানা গেল আকর্ষণ এক তরফা নয়। দুদিক থেকেই প্রবল। অতএব মেলামেশা থেমে থাকল না। দুর্ঘটনাবশত তুরিন পেটে চলে এলো…নাহ ফারার জীবনে তুরিন ছাড়া আপাতত অন্য কোন দুশ্চিন্তা নেই। এমনকি নিশাকেও বিন্দুমাত্র পাত্তা দেয় না সে। তবে নিশা অসহ্য একটা মেয়ে। ফারার পায়ের নখের সমান যোগ্যতাও তার নেই। জাহিদকে চাইলেই টেনেহিঁচড়ে বাড়ি থেকে বের করে আনতে পারবে ফারা। নিশার মতো লো ক্লাস মেয়ে জাহিদকে বেঁধে রাখতে পারবে না কিছুতেই। এখনো জাহিদ ফারা’র রূপগুণ মুগ্ধ একনিষ্ঠ ভক্ত। এত বছর হয়ে গেল। কই নিশা তো পারল না জাহিদকে কব্জা করতে। পারবেও না। শ্বশুরমশাই ভেবেছে গ্রাম্য একটা অশিক্ষিত মেয়ে ধরে এনে পুত্রের গলায় বেঁধে দিলেই হলো…সব সমস্যার সমাধান! বোকা, মাথামোটা, বৃদ্ধ লোকটা জানে না ফারার ইন্দ্রজাল তার পুত্রের জীবনে গাছের শিকড়ের চাইতেও মজবুতভাবে বিস্তৃত হয়ে আছে। ফারা দড়ি ছেড়ে দিয়েছে দূরে, কিন্তু রাশ টেনে ধরে আছে শক্ত করে। জাহিদ কিংবা অনিমেষ এদের কারো পক্ষেই এই রাশ ছেঁড়া সম্ভব নয়। কিন্তু মেয়েটা হয়েছে বোকার হদ্দ। জীবনকে গুছিয়ে নেওয়ার মতো, নিজের সুখটুকু ছিনিয়ে নেওয়ার মতো ক্ষমতা, সাহস বা বুদ্ধি কোনটাই ওর নেই। ও পারবে না ফারার মতো করে ঠেকে ঠেকে কৌশলে বেঁচে থাকতে। ওকে সবকিছু গড়ে দিতে হবে। সাজিয়ে-গুছিয়ে বানিয়ে দিতে হবে। একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। অর্ণব ছেলেটা নিতান্তই ভদ্র গোছের। শ্বশুরের পছন্দ মেনে নিতে ইচ্ছে করছে না তবে এটুকু ফারা মানে যে লোকটা তুরিনের ভালোর জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে।
.
আনিতা ডেকের ওপর বসে যোগব্যায়াম করছিল। পরনে সবুজ স্পোর্টস ব্রা। কালো টাইটস। ভারী চুলের গোছা উঁচু করে খোঁপা বাঁধা। লম্বাটে কাটা কাটা শ্যামবরণ মুখে দুটি পটোলচেরা আয়ত চক্ষু। এই চোখ দুটোই ওকে অন্যমাত্রার সুন্দরী করে তোলে। তুরিন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
—‘তুমি শাহজিদকে ডিনারে ইনভাইট করেছ?’
আনিতা পদ্মাসনে বসে আছে। চোখ বোজা। সেই অবস্থায়ই বলল, ‘হ্যাঁ।’
— ‘কেন?’
—‘ইচ্ছে হয়েছে তাই।’
—‘হঠাৎ এমন ইচ্ছে হলো কেন?’
—‘অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম মনে মনে।
—‘ক্যান্সেল করো।’
এক চোখ খুলে তাকাল আনিতা তুরিনের মুখের দিকে। প্রচ্ছন্ন হুমকিটা টের পেয়ে বলল, ‘ক্যান্সেল করব কেন?’
—‘আমি বলেছি তাই।’
—‘কেন বলছো? ইউ আর নট মাই মম। আদেশ মানতে বাধ্য নই। তা ছাড়া তোমার তো বিয়ে হচ্ছে ওই দেশি বাবুর সঙ্গে। শাহজিদের সঙ্গে আমি মার্সে যাই কিংবা মুনে তাতে তোমার কী?’
তুরিন উত্তেজিতভাবে বলল, ‘চাচি-মা জানতে পারলে কী হবে?’
‘কিছুই হবে না। আমার মা আমাকে বুঝবে। আমার মা আমার বন্ধুর মতো।’
অপমানের একটা হলকা এসে লাগল তুরিনের মুখে। চাপা ইঙ্গিতটা ধরতে খুব বেশি সমস্যা হলো না। সত্যিই তো তুরিনের কোন বন্ধু নেই। বাবা মা থেকেও নেই। এতদিন জানত আনিতা আছে বোনের মতো। এখন দেখা যাচ্ছে সেই জানায়ও কমতি ছিল। থমথমে গলায় বলল, ‘শাহজিদ তোমাকে পছন্দ করে না।’
হাসল আনিতা, ‘আচ্ছা? তো কাকে পছন্দ করে? তোমাকে?’
তুরিন অসহায় গলায় বলল, ‘প্লিজ আনিতা! ক্যানসেল করো প্রোগ্রামটা।’
—‘ইম্পসিবল!’
তুরিন কিছুক্ষণ স্থিরচিত্র হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে ভাবল কী যেন। বলল, ‘ঠিক আছে। আমিও যাব তোমাদের সঙ্গে।’
—‘আজিব! তুমি কেন যাবা?’
—‘লেটস গো অন আ ডাবল ডেট।’
—‘ডাবল ডেট?’
—‘ইয়াপ।’
—‘কার সঙ্গে যাবে তুমি?’
তুরিন আগপিছ কিছু চিন্তা না করেই বলল, ‘অর্ণব…অর্ণব তো আছেই!’
আনিতা হাসতে লাগল খুব। হাসির ছিটেগুলো উপহাসের ধারালো দাঁত হয়ে বসতে লাগল তুরিনের বুকে। উদ্বেলিত গলায় সে বলল, ‘ঠিক আছে তাহলে? আমরা একসঙ্গে যাচ্ছি।’
আনিতা বাঁকা ঠোঁটে বাঁকা হাসি নিয়ে চুপ করে রইল। বলল না কিছু।
অর্ণব দুপুরে খেয়ে-দেয়ে একটু ভাতঘুম দিচ্ছিল। চোখে দোজাহানের আরামের ঘুম চেতনার দেয়াল বেয়ে অলস বিড়ালের মতো নেমে আসছিল চুপিচুপি। এমন সময় দরজায় পড়ল ধাক্কা। তড়িঘড়ি করে উঠে দরজা খুলতেই দেখল তুরিন দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে গোলাপি টি-শার্ট, সাদা-কালো চেকের কিউট পাজামা। দেখতে কিন্তু বেশ মেয়েটা!
—‘আপনি?’
—‘হ্যাঁ আমি।’ চোখা চোখে লুঙ্গি পরা অর্ণবকে দেখল একবার তুরিন। আলুথালু পাগলের মতো চুল। গাঢ় বাদামি রঙের গায়ে হাতাকাটা সাদা গেঞ্জি গেঞ্জির গলা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে কোঁকড়া রোমশ বুক। ঈষৎ টানা চোখজোড়া ঘুমে লাল। আস্ত একটা চিড়িয়া ধরে এনেছে দাদাজান। কী বিরক্তিকর!
—‘ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন কেন?’
—‘না মানে…আপনাকে এক্সপেক্ট করিনি এই সময়।’ কাঁচুমাচু হয়ে বলল অর্ণব।
—‘শুনুন, কাল সন্ধ্যায় আমার সঙ্গে ডিনারে যাচ্ছেন আপনি। –’হ্যা?’ ভারী চমকায় অর্ণব
—‘অবাক হচ্ছেন কেন?’
—‘না অবাক না…আসলে একটু অবাক লাগছে আরকি।’
—‘সুন্দর পোশাক পরবেন। শ্যাবি ড্রেসআপ করবেন না দয়া করে।
—‘সুন্দর পোশাকটা ঠিক কী রকম?’
—‘এখন পরে আছেন অদ্ভুত এক পোশাক। এসব আমার বাবা-দাদারাও পরে না। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে টাইম ট্র্যাভেল করে এসেছেন উনিশশ আশি সাল থেকে।’
অর্ণব নিজের দিকে চোখ পিটপিট করে তাকাল। ভারি লজ্জা হলো নিজের এই মলিন সাজসজ্জা দেখে।
—‘সাতটার মধ্যে রেডি থাকবেন।’ হুকুম করল তুরিন।
—‘আচ্ছা।’
—‘আমাদের সঙ্গে শাহজিদ আর আনিতাও যাবে।’ শাহজিদের নাম শুনে একটু স্বস্তি পেল অর্ণব।
—‘বেশ ভালো।’
অনেকক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল তুরিন। অর্ণব দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আসুন না। ভেতরে আসুন প্লিজ।’
—‘না। ভেতরে আসব না। আপনার কিছু বলার আছে?’
—‘বলার আছে বলতে…জানতে ইচ্ছে করছিল হঠাৎ আবার ডিনার কেন?’
—‘কেন আপনি চান না?’
—‘চাইব না কেন?’
—‘তাহলে এত প্রশ্ন করছেন কেন?’
অনেক ‘কেন’ তালগোল পাকিয়ে দিল অর্ণবের মাথায়। বিপন্ন গলায় বলল,
—‘আপনি কি সব সময় সবার সঙ্গে এমন উইকেড কুইনের মতো আচরণ করেন?’ সাহস করে কথাটা বলে ফেলল অর্ণব। ঝপ করে রাগের ছায়া পড়ল তুরিনের মুখে।
—‘কীভাবে কথা বলতে হবে আপনার সঙ্গে? একটু শিখিয়ে দিন প্লিজ।’
—‘না না আমি শেখাব কেন? কুইন তো আপনি। শেখানো-টেখানো আপনার কাজ।
তুরিন অপমানের একটা ঢোঁক গিলে বলল,
—‘উইকেড কুইনের সঙ্গে ডেটে যেতে আপনার আপত্তি আছে? নাকি স্নো হোয়াইট লাগবে?’
‘ডেট’ শব্দটা উচ্চারণ করায় অর্ণব বেশ লজ্জা পেল। জীবনে কোনদিন কারো সঙ্গে ডেট-টেট করেনি সে। চোখ নামিয়ে, একটু লাল হয়ে নার্ভাস গলায় বলল, ‘ছি ছি আপত্তি কীসের? স্নো-হোয়াইট কি সবার কপালে জোটে? তা ছাড়া…আপনাকে যদি বিয়ে করতেই হয়…’ফট করে কথাটা বলে ফেলে একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেল অর্ণব। বিয়ের প্রসঙ্গ উঠে আসায় তুরিনও কিঞ্চিৎ অপ্রতিভ হলো। অর্ণব তুরিনের কুণ্ঠিত মুখপানে একবার চেয়ে নিয়ে ভেঙে যাওয়া কথাটাকে জোড়া লাগাল, ‘না মানে বলছিলাম যে বিয়েটা যদি করতেই হয় তো একটু চেনা-জানা হয়ে নিলেই ভালো।’
তুরিন চোখ সরিয়ে নিল। হালকা অস্বস্তি নিয়ে বলল, ‘কাল দেখা হচ্ছে। এখন আসি।’