বরফকুচি খামে দূর পাহাড়ের ডাক – ৩.১

নিদ্রাহীনতার রোগ নেই শাহজিদের। নিয়মমাফিক জীবন। সাড়ে সাতটার মধ্যে ডিনারের পাট চুকে যায়। দশটা পর্যন্ত ওই একটু বই টই পড়া…তারপর বিছানায় শোয়া মাত্র ঘুম। বাজারসদাইয়ের প্রয়োজন হলে ডিজেবিলিটি সারভিস সেন্টারে ফোন দেয়, ওরা গাড়ি করে এসে নিয়ে যায়। কাজ শেষ হলে আবার নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দেয়। হাসপাতাল থেকে সপ্তাহে একদিন নার্স আসে। খোঁজখবর নেয়। থেরাপিস্ট আসে রোজ। পঙ্গু হওয়ার কারণে সরকারের কাছ থেকে একটা আলাদা মাসিক ভাতাও পায় সে। সংসারের দায়িত্ব নেই, নিজস্ব মানুষ নেই, নেই কোন দায়বদ্ধতা। দুশ্চিন্তামুক্ত নির্বিঘ্ন সময় কাটানোর অফুরন্ত ফুরসৎ! অ্যাক্সিডেন্টের পর, প্রথম কিছুদিন খুব করে চেয়েছিল আগের মতো স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে। কিন্তু দেখা গেল কাছের বন্ধুরাই তাকে একঘরে করে তুলছে। না করেও উপায় নেই। তাদের দলটা মূলত নানা রকম অ্যাডভেঞ্চারের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। দেখা গেল সেসব দুঃসাহসিক অ্যাডভেঞ্চার গুলো থেকে শাহজিদ সংগত কারণেই বাদ পড়ে যাচ্ছে। ভাঙা পা নিয়ে অ্যাডভেঞ্চার করা সম্ভব না। নকল পা, হুইলচেয়ার বা ক্রাচ নিয়েও হাইকিং সম্ভব, কিন্তু এতে যেন নিজের অক্ষমতাকেই আরো বেশি করে বরণ করে নেওয়া হয়। ঝরঝরে, টগবগে, বেগবান তরুণ দলের মধ্যে একজন উনপাঁজুরে, খুঁড়িয়ে চলা মানুষের উপস্থিতি বড্ড বেমানান। কেউ মুখ ফুটে কখনো কিছু বলেনি, কিন্তু আচার-আচরণই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল যে শাহজিদ এখন অন্য দলের মানুষ। শুনেছে অথর্ব, বিকলাঙ্গ সন্তানের প্রতি এক সময় বাবা-মার ভালোবাসাও ফিকে হয়ে ওঠে। রক্তর সম্পর্কও দুর্দিনে রং বদলায়। তাই বন্ধুদের বদলে যাওয়া চেহারা খুব সাধারণভাবেই মেনে নিয়েছিল। রাগ হয়নি, কিন্তু অভিমান হয়েছিল। সেই নিরর্থক অভিমান বুকের তলায় জমতে জমতে যখন পাহাড় হলো, তখন বুঝতে পারল প্রকৃতি তার মতো ঠুনকো মানুষের ঠুনকো অভিমানের কোন কদর করবে না বলেই পণ করেছে। ধীরেধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিতে শিখল সে। পাহাড় ভালোবেসেছিল একদিন। কিন্তু সেই পাহাড়ই এখন তাকে নিয়ে দিবারাত্রি উপহাস করে। মুর্তজা সাহেব স্নেহের জোরে এ বাড়িতে ধরে না রাখলে, পাহাড় ছেড়ে অনেক দূরে কোথাও চলে যেত নিশ্চয়ই, হয়তো সমুদ্রে! 

নিজেকে নিয়ে ভাবে না বহুদিন। ভাবতে ভালো লাগে না। কাজের মধ্যে, বইয়ের মধ্যে, সংবাদপত্রের খবরের মধ্যে ডুবে থাকতে ইচ্ছে করে দিনরাত ভাবমন্দিরের দুয়ার খুলে দিলেই মোমের মতো পুড়তে থাকে মন। তখন এক ভয়ংকর অসহায়ত্ব বুকের ভেতরটাকে কুরে কুরে খায়। তাই ভাবমন্দিরের দরজা খানি সযতনে বন্ধ রাখে সে। তবুও মাঝেমধ্যে…মাঝেমধ্যে কোত্থেকে যেন দুরন্ত অবশীভূত ঝড়ের দাপট এসে হানা দেয়, খুলে দেয় রুদ্ধ কপাট। তারপর তছনছ হওয়া, বিষাদগ্রস্ত, বিরান মনাঞ্চলে শাহজিদ নিঃস্ব হয়ে বসে থাকে! 

অ্যাঞ্জেলিনা দারুণ স্মার্ট মেয়ে ছিল। বাস্তববুদ্ধি সম্পন্ন, ধীমান, মেধাবী I যেকোনো আলোচনায় তার মতামত দৃঢ় এবং যৌক্তিক। জ্ঞানের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ। আকাশচুম্বী সাহস! মাউন্ট এভারেস্ট জয় করা তার জীবনের ধ্রুব স্বপ্ন। শাহজিদেরও অনেকদিনের শখ একদিন পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বত শিখরে আরোহণ করবে। মানুষ আজীবন স্বপ্ন ভাগ করে নিতে ভালোবাসে। শাহজিদও নিজের স্বপ্ন বণ্টন করতে পেরে আনন্দিত ছিল। আঞ্জেলিনার সঙ্গে সময় কাটানোর মাঝে সে তৃপ্তি খুঁজে পায়। অনেকটা ভালো সিনেমা দেখার পর যেরকম স্যাটিসফ্যাকশন কাজ করে, সেরকম। একদিন আঞ্জেলিনা বলল, দ্যাখো শাহজিদ আমি তোমাকে ভালোবাসতে পারিনি এটা সত্য। বাট আই এঞ্জয় ইওর কোম্পানি। মে বি উই শ্যুড গো আউট সামটাইম। আঞ্জেলিনা এমনই ছিল। প্রেমে পড়েনি, তবুও একজন পুরুষকে বন্ধুর চেয়ে বেশি করে পেতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় ওর কোন কুণ্ঠা নেই। ওর কাছে প্রয়োজনটাই বড়। শাহজিদেরও এই বাস্তববাদী প্রস্তাবে আপত্তি ছিল না। আধুনিক বিশ্ব প্ৰয়োজনে চলে, ভাবাবেগে নয়। সেই দিনগুলোতে, যখন অ্যাঞ্জেলিনার প্রভাব মনের ওপর না হলেও জীবনের ওপর শতভাগ জাজ্বল্যমান…সেই সময়, এক গ্রীষ্মের চনমনে দুপুরে তুরিনের সঙ্গে দেখা হলো অ্যালপাইন সেন্টারে,দূর পাহাড়ের বুকে। শাহজিদ দেখেছিল স্বর্নাভ তেজি রোদের নিচে খরগোশের বাচ্চার মতো আদুরে একটা মেয়েকে। একটা সময় ছিল, যখন প্রায় সব মেয়েরাই কেন যেন তার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের পর দ্বিতীয়বার সাক্ষাতের জন্য আকুলিবিকুলি করত। যে কারো হৃদয়ে চটজলদি নিজের আসন গড়ে নেবার অভিনব দক্ষতা জানা ছিল শাহজিদের। তুরিনও দ্বিতীয়বার সাক্ষাতের সুযোগ হারাতে চাইল না। তবে ওর গায়েপড়া ভাবটাকে কখনো ভাঁড়ামি বা ছ্যাবলামি মনে হয়নি, মনে হয়েছে ছেলেমানুষি। সে একটু অন্যরকম। যেন শুধু মেয়েই নয়, বরং একটা কোমল, সুন্দর ফুল। যে ফুলের সংস্পর্শে এলে মন স্নিগ্ধ হয়ে ওঠে, পবিত্র হয়ে ওঠে! ওই মুখের মধ্যে এমন একটা দৈব উপাদান মিশে আছে যে, তাকালে বোঝা যায় ওখানে শুধু সরলতার ছড়াছড়ি, কোন রকম বক্রতার স্থান নেই। আরো একটি অলংকারের উপস্থিতি ছিল মুখখানিতে। সেই অলংকারের নাম ‘লজ্জা’। লজ্জা পেলে যে মেয়েদের অপরূপ সুন্দর লাগে শাহজিদ তা তুরিনকে দেখার আগে জানত না। অ্যাঞ্জেলিনার মতো যুক্তি-তর্ক দিয়ে কথা বলতে পারত না তুরিন। যা বলত তার শতকরা আশিভাগই বালিকাসুলভ হেঁয়ালি কথাবার্তা। মাঝেমধ্যে বলত তুমি ফোন ধরে রাখো শাহজিদ, লাইন কেটো না। আমি এখন ঘুমাব। ঘুম থেকে উঠে যেন দেখি তুমি লাইনে আছ। তুরিনের মতে স্নো-ফলের মধ্যে আইসক্রিম খাওয়ার মজাই আলাদা, মনে হয় শুধু হাতে ধরা আইসক্রিম বার না, আশেপাশের বরফ জমা পৃথিবীটাকেই খেয়ে ফেলা হচ্ছে। ঝুম তুষারপাতের মধ্যে, হাতে হাত রেখে, পিচ্ছিল সাদা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আইসক্রিম খেত ওরা। আকাশ থেকে ঝরে পড়া বিশুদ্ধ তুষারকণা আইসক্রিমের সঙ্গে জিভের ডগায় মিশে যেত। 

তুরিনের স্বপ্ন ছিল রকি মাউন্টেনের চূড়ায় ওর স্বপ্নের পুরুষ প্রেম নিবেদন করবে। আর নায়াগ্রা জলপ্রপাতে হবে এনগেজমেন্ট। খুবই সাধারণ এবং স্থূল এক রোমান্টিক স্বপ্ন। অ্যাঞ্জেলিনার মতো ধারালো চিন্তাধারার মেয়ে কখনোই ছিল না তুরিন। কিন্তু এই অতি সাধারণ মেয়েটিই অদৃষ্টক্রমে কী করে যেন দিনকে দিন অসাধারণ হয়ে উঠছিল শাহজিদের চোখে। পৃথিবীতে মাঝেমধ্যে এমন কিছু মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়, যে মানুষকে প্রথম দেখায়ই মনে হয় জনম জনমের চেনা! মনে হয় যেন এর সঙ্গে কোথায় একটা গভীরতর যোগাযোগ আছে। বাকি আছে আর জন্মের হিসেব-নিকেশ। শাহজিদের আগে কখনো এমন হয়নি। তবে সেদিন ওই বাচ্চা খরগোশটাকে দেখামাত্র বুকের কোথায় যেন টিকটিক করে একটা সংকেত বেজে উঠেছিল, জল স্থল অন্তরীক্ষ মাতিয়ে কে যেন উদ্দাম স্বরে বলে উঠেছিল ‘তোমায় কোথায় দেখেছি? যেন কোন স্বপনের পাড়া?’ 

সেই মেয়েটা…সেই ফুলের মতো নরম, পবিত্র, খরগোশের বাচ্চার মতো আদুরে মেয়েটা…শাহজিদ যার চোখের ভেতর পৃথিবীর শুভ্রতম রূপ দেখেছিল প্রথম! সেই মেয়েটা হঠাৎ গিরগিটির মতো রং পাল্টে ফেলল। একদিন বলল জরুরিভিত্তিতে দেখা করতে চায়। গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। শাহজিদ অপেক্ষা করেছিল। কিন্তু তুরিন আসেনি। ফোন-টোন বন্ধ করে রীতিমতো উধাও। অ্যাক্সিডেন্টের পর মুর্তজা সাহেবের অনুরোধে এই বাড়িতে আসা হলো। দুর্ঘটনার ব্যাপারে কিছুই জানত না তুরিন। মুর্তজা সাহেবের সঙ্গে প্রথম যেদিন এলো এখানে, সেদিন অ্যাঞ্জেলিনাও সঙ্গে ছিল। তুরিন দাঁড়িয়ে আছে প্যাটিওতে। গাড়ি থেকে হুইলচেয়ার নামানো হলো। সেই হুইলচেয়ারে ধরে ধরে বসানো হলো আহত এবং ভগ্নহৃদয় শাহজিদকে। তার এমন কোন আপন জন নেই যার বুকে মাথা রেখে কদিন আগে ঘটে যাওয়া বীভৎস দুর্ঘটনার ভয়াবহতা কিছুক্ষণের জন্য হলেও ভুলতে পারে। দুর্ঘটনার পর থেকে সে বাবা- মাকে মিস করছে। আর আশ্চর্যজনকভাবে তুরিনকেও মনে পড়ছে। আঞ্জেলিনা হুইলচেয়ার ঠেলেঠুলে ব্যাকইয়ার্ডের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। তুরিন স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শাহজিদ ওর মুখে চোখ রেখেছে। কিন্তু তুরিনের চোখজোড়া থমকে গেছে হুইলচেয়ারে। শাহজিদের একটি পা নেই। অপরটি আছে। সেই থাকাও আবার কেমনতর! দুটো আঙুল অনুপস্থিত। তুরিনের মুখ দেখে মনে হলো এমন বীভৎস দৃশ্য সে জীবনে কখনো দেখেনি। শাহজিদ তবুও আশা করেছিল তুরিন একসময় ছুটে আসবে। আপন জনের বিপদে সাধারণত লোকে যেভাবে আসে। কিন্তু তুরিন আসেনি। কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে ভীত হরিণীর মতো ছুটে পালিয়ে গেছে বাড়ির ভেতর। কাকে ভয় পেয়েছিল সে? দুর্ঘটনাকবলিত, উৎসন্ন, লুণ্ঠিত শাহজিদকে? নাকি ওর অসহায় পঙ্গুত্বকে? তুরিনের কাছ থেকে পাওয়া কষ্টটা কেন যেন দুর্ঘটনার ভয়াবহতাকেও ছাপিয়ে গেল। বিশ্বাস উঠে গেল মনুষ্যত্বের ওপর থেকে। বাবা মারা যাওয়ার পর জীবনে আর কোনদিন কষ্ট পাবে না বলে শপথ নিয়েছিল মনে মনে। ধারণা ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কষ্টের ঝড়টা তার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে এরই মধ্যে। অন্য কোন ঝড়ের সাধ্য নেই এর চেয়ে বেশি শোধ নেবার। কিন্তু শাহজিদ তখনো জানত না মানুষের জীবনে আসা ঝড়গুলো একেকটা একেকরকম ভয়ংকর হয়ে থাকে। দুর্ঘটনার ঝড়, প্রত্যাখ্যানের ঝড়, সমাজ থেকে বিচ্যুত হয়ে একঘরে হওয়ার ঝড়…হরেক রকম ঝড়ের মোকাবেলা করেছে সে মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সি ছোট্ট জীবনটায়। টলেছে, ভীত নড়ে গেছে, কিন্তু ভেঙে পড়েনি কখনো। তুরিন কখনোই আগের মতো স্বাভাবিক হয়নি। মুখোমুখি হলে ভাবটা এমন করে যেন শাহজিদকে সে চেনে না। মুখের ভাঁজে ভাঁজে তাচ্ছিল্য গিজগিজ করে। নিশার সঙ্গে শাহজিদের প্রথম থেকেই খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। একদিন নিশাকে কী ভয়ংকর অপদস্থ করল বাড়ির লোকজনের সামনে! হতভম্ব শাহজিদের চোখে তুরিনের সুন্দর রূপটা যেন মুহূর্তের মধ্যে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল! খরগোশের মতো নরম মেয়েটা কেমন বিষাক্ত কীটের মতো কদর্য হয়ে উঠল রাতারাতি। 

অথচ আজ…এই এখন…তুরিন চলে যাওয়ার ঘণ্টাখানেক পরেও সারাটা ঘর যেন বুনো ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণে ছেয়ে আছে। শাহজিদ সেই মিষ্টি সুবাস বুকে নিয়ে চুপচাপ বসে আছে অন্ধকারে। আচ্ছা! সেই অ্যাক্সিডেন্টে যদি শাহজিদের পা-টা না গিয়ে জানটাই চলে যেত, তুরিন কি ভুল করে হলেও দু ফোটা চোখের জল ফেলত তার জন্য? ওর মরতে একদম ইচ্ছে করে না এইজন্য যে, মরে গেলে কেউ তার জন্য কাঁদবে না, স্মৃতি ধরে রাখবে না। হঠাৎ তুরিনের কোমরের সেই উল্কির কথা মনে পড়ল। কারো নাম শরীরে খোদাই করার মতো বোকা মানুষের অস্তিত্ব কি আজও পৃথিবীতে আছে? নিশ্চয়ই ওটা শাহজিদের ভ্রম ছিল। কিন্তু এমন অদ্ভুত ভ্রম হওয়ার কারণ কী? তার লজিক তো কখনো গোলমাল করে না! 

সেই রাতটা তন্দ্রাচ্ছন্নতায় কেটে গেল। ঘুম এলো ভীষণ ফিকে ভাবে, আবার চলেও গেল। মাথার ভেতর টুকরো মেঘের মতো ভাসতে লাগল ভাবনারা। সকালে নিশা যখন নাশতা নিয়ে এলো, তখন ভুল করে একবার মনে হলো বুঝি তুরিন এসেছে। হয়তো ধার করা জ্যাকেটটা ফেরত দিতে চায়, কিংবা একটা ধন্যবাদ…হ্যাঁ একটা ধন্যবাদ তো শাহজিদের পাওনাই আছে, তাই না? গতরাতে ওই ভয়ংকর দুর্ঘটনার হাত থেকে শাহজিদই তো ওকে বাঁচিয়েছিল। 

ছুটির দিনে 

এপ্রিল মাসে শীতের দাপট পাকাপোক্ত বিষয় নয়। বসন্ত জানে প্রকৃতিতে এ সময় শুধু তারই একচ্ছত্র আধিপত্য গ্রহণযোগ্য। তাই অসময়ের দুর্বল শীতকে হটিয়ে দিয়ে নিজের মালিকানা স্থাপনে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না তার। দুটি ঋতু একই সঙ্গে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার যুদ্ধ করে কিছুদিন। গাছের ডালে ডালে নতুন পাতা গজায়, পাশাপাশি বরফের আবরণও পড়ে। সন্ধের দিকে বাসন্তী হাওয়া ছোটে, আবার পরদিনই হিমেল তুষারপাত! শীত এবং বসন্তর এই বিস্ময়কর সহাবস্থান কলোরাডোকে অন্যান্য অঞ্চল থেকে নিঃসন্দেহে আলাদা করে তোলে। এ বছর প্রথম এপ্রিলের জমানো তুষারটা দুদিনেই কেটে গেল। নির্মল রোদ বসন্তের ঘ্রাণ নিয়ে নেমে এলো পাহাড়ের শুষ্ক বুকে। গাছের ডালের সবুজ পাতায় নতুন প্রাণের সঞ্চারণ হলো। 

সেদিন শনিবার। ছুটির দিন। সকাল থেকেই পাখিরা জানান দিচ্ছে নিজ অস্তিত্ব। উৎসবের আমেজ লেগেছে চারিদিকে। তুরিনদের নেইবারহুডে পুল পার্টি হচ্ছে। বাদ্যবাজনা, হই-হুল্লোড়ে পুরো পাড়া সরগরম। শীতে সুইমিংপুল বন্ধ থাকে। গতকাল এলাকাবাসীর জন্য খুলে দেয়া হয়েছে। তুরিন গত দুটা দিন বাড়ির কারো সঙ্গেই ঠিকমতো কথা বলেনি। সকালে বেরিয়েছে ভার্সিটির উদ্দেশে। ফিরেছে সন্ধ্যায়। ডিনারও করেছে বাইরে। সন্ধে সাতটার মধ্যে তার ডিনার করার অভ্যাস। ফারা এবং জাহিদ মেয়ের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য উদগ্রীব হয়ে ছিল। এমনকি মুর্তজা সাহেবও নাতনিকে জরুরিভিত্তিতে তলব করেছেন। তুরিন সাড়া দেয়নি। সে বলেছে উইকেন্ডের আগে সময় হবে না। অবশেষে উইকেন্ড এলো। আজ বাবা-মা, দাদা-দাদি সবাই একত্রে বৈঠকখানায় অপেক্ষা করছে। তাদের নাকি বিশেষ জরুরি কথা আছে। তুরিন সেই জরুরি কথাটি সম্পর্কে খুব ভালোভাবেই অবগত। কিন্তু মরে গেলেও এখন সে বিয়ে করবে না। কিছুতেই না। মাঝের দুটি দিন কী রকম ঘোরের মধ্যে যে কাটল! শাহজিদের ওই নীল জ্যাকেটটা যেন শুধু জ্যাকেট না, শাহজিদ নিজেই। একলা ঘরে বসে বসে ওই জ্যাকেটের সঙ্গেই কথা বলেছে তুরিন। 

আজ সকাল থেকে কী করে বাবা-মা আর দাদাদাদির সঙ্গে ফিক্স হওয়া মিটিংটা ক্যানসেল করা যায় তাইই ভেবে যাচ্ছিল। কোন উপায় পাচ্ছিল না। বাঁচিয়ে দিল আনিতা। তখন ঘড়িতে সকাল নটা। তুরিন বিছানা ছাড়েনি। এর মাঝেই ঘরে ডাকাত পড়ল যেন। 

‘তুমি এখনো রেডি হওনি?’ ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই আনিতার প্রশ্ন।

তুরিন মাথা চুলকে বলল, ‘রেডি হব কেন? কোন প্ল্যান আছে নাকি?

—‘তোমার হয়েছে কী তুরিন? সব ভুলে যাও আজকাল। আমাদের টিকটকের ভিডিও শ্যুট করার কথা আজ!’ 

তুরিনের মুখটা অতর্কিতে ঝলমল করে উঠল, ‘আরে তাই তো! আমি ভুলেই গিয়েছিলাম!’ 

—‘হ্যাঁ ইদানীং সব কিছুই ভুলে যাচ্ছ। এর কারণ কী?’ 

তুরিন চাপা উচ্ছ্বাসে উদ্ভাসিত হয়ে বলল, ‘এক কাজ কর আনিতা। নিচে গিয়ে দাদাজানকে বল আমরা হাফ অ্যান আওয়ারের মধ্যেই বেরোচ্ছি। আজকে কোন মিটিং হবে না। 

গত দুদিন অর্ণব তুরিনের দেখা পায়নি। মেয়েটা বাড়িতে থাকেই না বলতে গেলে। ডিনারের টেবিলেও রোজ অনুপস্থিত। অবশ্য অর্ণব নিজেও প্রতিবেলা বাড়িতে খায়নি। কিছু বন্ধুবান্ধব আছে ডেনভারে। ওদের সঙ্গে দেখা- সাক্ষাৎ করেছে। রেস্টুরেন্টে খেয়েছে। বিভিন্ন জায়গা এক্সপ্লোর করেছে। আজ সকালে নাশতার পর একটু হাঁটতে বেরিয়েছিল। বাড়ির সামনের উঠোন পেরিয়ে নেইবারহুডের সরু রাস্তায় উঠতেই সকালের ঝলমলে রোদ্দুরে সেই সুন্দর মেয়েটিকে দেখতে পেল সে। কামিজের ওপর একটা বেগুনি রঙের পাতলা সোয়েটার পরনে। গলায় স্কার্ফ। ঘাড়ের ওপর হৃষ্টপুষ্ট খোঁপা। ফুটপাত ধরে হাঁটছিল। একা নয়। হুইলচেয়ারে বসা একজন মানুষ আছে সঙ্গে। জগিং করতে করতে ওদের কাছাকাছি এগিয়ে এলো। ডাক দিল হেঁড়ে গলায়, ‘হ্যালো ম্যাডাম! গুড মর্নিং! কেমন আছেন?’ 

নিশা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। মুখে ঝুলতে থাকা হাসিটা চট করে লুকিয়ে নিয়ে একটু গম্ভীরভাবে উত্তর দিল, ‘গুডমর্নিং! ভালোই আছি।’ 

অর্ণব দেখল হুইলচেয়ারে একজন ভারী সৌম্যদর্শন যুবক বসে আছে। মাথার লম্বা এলোমেলো চুল আর দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল তার সৌন্দর্যকে কিছুমাত্র ম্লান করতে পারেনি। কী কারণে যেন একে প্রথম দেখায় ঠিক বাঙালি বলে মনে হয় না। অর্ণব ইংরেজিতে বলল, ‘হ্যালো ব্রাদার! গুড মর্নিং! হাও আর ইউ?’ 

শাহজিদ হাসল, ‘গুডমর্নিং! আমি ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?’

—‘আপনি বাঙালি?’ 

—‘বাংলাদেশি।’ 

অর্ণব ভারি আন্তরিক হাসি হাসল, ‘বলেন কী ভাই, আপনাকে দেখে তো বোঝাই যায় না আপনি আমাদের মতো গরিব দেশের লোক। ইউরোপের রাজকুমার মনে হয়।’

—‘আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না!’ 

নিশা মনে মনে বিরক্ত বোধ করছিল। হাঁটা থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে এখন। তাকে মিনিট দশেকের মধ্যেই বাড়ি ফিরতে হবে। আজ ছুটির দিন। বাড়ির সব লোক উপস্থিত। আজকের ব্যস্ততা অন্যরকম। আজাইরা আলাপ করার সময় এটা নয়। 

—‘আমার নাম অর্ণব। মেরিল্যান্ড থেকে এসেছি।’ 

নিশা যোগ করল, ‘উনি এ বাড়ির হবু জামাই। ওই যে বলেছিলাম না, তুরিনের ব্যাপারে?’ 

কথাটা শুনে শাহজিদ বিস্ময়ে খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে। ডান গালে জিব ঠেকিয়ে বঙ্কিম মুখে কী যেন ভাবনা ভাবে। ভালোমতো দেখে নেয় একবার অর্ণবকে। বেশ লম্বা। চেহারা-ছবি ভালোই। তুরিনকে মানাবে ওর পাশে। গলায় নকল সন্তুষ্টির সুর টেনে, কাঁধ ঝাঁকিয়ে, সাবলীলভাবে বলার চেষ্টা করে শাহজিদ, ‘নাইস টু মিট ইউ ম্যান!’ অর্ণব লজ্জিত ভঙ্গিতে বলে, ‘লাইকওয়াইজ।’ 

—‘কী করা হয়?’ 

—‘মাস্টার্স কমপ্লিট করলাম। কম্পিউটার সায়েন্স।’ 

—‘কোন স্কুল?’ 

—‘মেরিল্যান্ড।’ 

—‘এখন কী করছেন?’ 

—‘চাকরি খুঁজছি। পি-এইচডি’র অফার আছে ইউনিভার্সিটি থেকে। মানে আমার এক প্রফেসর খুব করে চাইছেন উনার সঙ্গে যেন কাজ করি।’ 

নিশা ফোঁড়ন কাটল, ‘সময় ফুরিয়ে আসছে। চল বাড়ির দিকে ফেরা যাক।’ কথাটা বলতে বলতে সে এগিয়ে গেল কয়েক পা। অর্ণব ওদের পিছু ছাড়ল না। পাশাপাশি হাঁটতে লাগল। একটু নিচু স্বরে শাহজিদকে প্রশ্ন করল,, ‘আপনি কি মুর্তজা সাহেবের বাড়িতেই থাকেন? 

—‘জি।’ 

অর্ণব বোঝার চেষ্টা করল দুজন যুবক-যুবতীর মধ্যকার সম্পর্কটা। ভাই- বোন? বন্ধু? নাকি প্রেমিক-প্রেমিকা? মেয়েটিকে যত দেখছে ততই মুগ্ধ হচ্ছে। কী শান্ত, সুনিবিড়, স্নিগ্ধ একটা আবেশ জড়িয়ে থাকে ওর চারপাশে সর্বক্ষণ। এরকম মেয়ে অর্ণব কখনো দেখেনি, শুধু কবিতায় পড়েছে আর অনুভব করেছে। কবিতা চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠলে কী চমৎকার অনুভূতি হয় তা নিশাকে যে মানুষ দেখবে না, সে বোধহয় কোন দিন জানতে পারবে না! 

মুর্তজা সাহেব প্যাটিওতে দাঁড়িয়ে আছেন। কোলে জুবিন। জাহিদ আর ফারাও উপস্থিত। অর্ণবকে দেখা মাত্র মুর্তজা বললেন, ‘এই যে তুমি। তোমাকেই খুঁজছিলাম! ছিলে কোথায় এতক্ষণ?’ 

অর্নব একটু অপ্রতিভ হলো –’কাছাকাছিই ছিলাম। কোন দরকার?’ 

—‘এই যে দ্যাখো, আমার নাতনিরা কোথায় যেন যাচ্ছে পিকনিক করতে। তুমি এদের নিয়ে যাও। তোমার ওপর দায়িত্ব দিলাম।’ আদেশ করলেন মুর্তজা। আনিতা তৈরি হয়ে উঠোনে দাঁড়িয়ে ছিল। তানিশার সামনে পরীক্ষা। সে যাচ্ছে না। তুরিন তখনো নামেনি। মুর্তজা সাহেবের মাত্র বলা কথাটা আনিতাকে চমকে দিল, সে আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘সিরিয়াসলি দাদাজান? উনি আমাদের সঙ্গে যাবে? আমরা একা যেতে পারব না? আমাদের দুজনেরই আঠারোর ওপর বয়স।’ 

জাহিদ বলল, ‘অর্ণবকে তোমরা সঙ্গে নিয়ে যাও। ওর একটু এক্সপ্লোর করা হবে। নতুন জায়গা দেখা হবে।’ 

শাহজিদ হুইলচেয়ার নিয়ে ব্যাকইয়ার্ডের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। নিশা ওর পিছু ধরল। দরজার সামনে জাহিদ আর ফারা দাঁড়িয়ে আছে। ওদের মুখোমুখি হওয়ার চাইতে শাহজিদের সঙ্গে বেজমেন্টে যাওয়াই উত্তম। মুর্তজা সাহেব বলে উঠলেন, 

—‘তোমরা পালাচ্ছ কেন? এক কাজ করো, তোমরাও যাও আনিতা আর তুরিনের সঙ্গে। একটা দিন সবাই মিলে ঘুরে এসো। ভালো লাগবে।’ 

নিশা অপ্রস্তুতভাবে বলল, ‘না বাবা। আমি কী করে যাই জুবিনকে ফেলে?’

আনিতার মুখে আগ্নেয়োগিরির লাভা চকচক করে উঠল যেন। দাদাজান পারলে বাড়ির সব সদস্যকে তাদের সঙ্গে পাঠিয়ে দেবে। এত শয়তানি বুদ্ধি এই বুড়োর মাথায় কী করে আসে? একটা দিন তাদের স্বাধীনভাবে কাটাতে দেবে না। কী বিরক্তিকর! এখন পারলে বলবে, এক কাজ করি আমি আর তোমার দাদিজানও সঙ্গে যাই। ফুল ফ্যামিলির পিকনিক হয়ে যাবে। 

মুর্তজা সাহেব নিশাকে বললেন, ‘একটা দিন জুবিন আমাদের সঙ্গে থাকবে। কোন সমস্যা নেই। তুমি যাও। একটু ঘুরে এসো মা। তোমার তো বাইরে যাওয়াই হয় না!’ 

নিশা অতর্কিতে একবার জাহিদের দিকে তাকাল। ফারা দাঁড়িয়ে আছে জাহিদের গা ঘেঁষে। নিশার চাউনি লক্ষ করে জাহিদ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ফারার চোখে চোখ পড়তেই সে ঢোক গিলে চুপ করে গেল। কিন্তু বেশিক্ষণ চুপ করে রইল না। কী যেন ভেবে নিয়ে পরমুহূর্তেই বলল, ‘তুমি যাও নিশা। জুবিন আমার সঙ্গে থাকবে। নো ওরিজ।’ 

সেই সময় হাই-হিল জুতোয় টুকটুক শব্দ তুলে তুরিন প্রবেশ করল দৃশ্যপটে। উঠোনের শেষ প্রান্তে শাহজিদের হুইলচেয়ারটা দেখামাত্র তার মুখে রক্তের যে ঝলক এসে লাগল, তা বোধকরি একটু মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করলে উপস্থিত সব সদস্যই টের পেত। শাহজিদের হুইলচেয়ারের পেছনেই নিশা দাঁড়িয়ে আছে। তুরিন ওর অস্থির দুটি চোখ কোথায় রাখবে তা ঠিক মতো ঠাওর করে উঠতে না পেরে অনেকটা দৃষ্টি প্রতিবন্ধীর মতো শূন্যে তাকিয়ে অস্থির গলায় বলল, ‘এখানে কী হচ্ছে? সিনেমা চলছে নাকি?’ 

মুর্তজা সাহেব বললেন, ‘তোমরা একা যেও না দাদুভাই। এদেরও নিয়ে যাও।’ 

তুরিন আঁতকে উঠল, ‘কাদেরকে?’ 

শাহজিদের চোখ গেঁথে গিয়েছিল তুরিনের মুখের ওপর। একটা চেরি পিংক রঙের কোট পরেছে ও। ব্লু জিন্স। মুখে কড়া প্রসাধন। মেয়েটার কথার ধরন এত উদ্ধত আর তেজি যে ওই তেজ রূপের স্নিগ্ধতা ম্লান করে দেয়। তবুও আশ্চর্য মানুষের মন! রাগী, ডাইনির মতো ক্যাটক্যাট করা তুরিনের দিকে চোখ পড়া মাত্রই শাহজিদের হৃদয়তরিতে যেন উল্টো একটা হাওয়া লাগল। গত দুদিন এই মেয়েটির কথা ভেবেছে অসংখ্যবার। আজকে যখন সেই ভাব জগতে থাকা মানুষটা সরাসরি বাস্তবের মাটিতে নেমে এলো, তখন মনের ওপর দিয়ে মনেরই অজান্তে একটা অন্যরকম, অন্য জাতের, অন্য স্বাদের শিহরণ বয়ে গেল নিঃশব্দে! 

মুর্তজা সাহেব একটু ভারী গলায় নাতনিদের বললেন, ‘তোমরা অর্নবের গাড়িতে উঠে যাও।’ 

তুরিন ঝাঁজ ওঠা বিষাক্ত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘ইম্পসিবল!’ 

আনিতা ওর কনুইয়ে একটা চিমটি কেটে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘প্রটেস্ট করার দরকার নাই। বেশি কথা বললে দাদাজান নিজেই আমাদের সঙ্গে যেতে চাইবে।’ কথাটা শেষ করে সে ছদ্ম হাসি হাসল, ‘মিস্টার অর্ণব! আপনার গাড়ি কোনদিকে? 

শাহজিদ এতক্ষণে কথা বলল, ‘নিশা, তুমিও যাও ওদের সঙ্গে। ভালো লাগবে।’ 

—‘তুমিও চলো।’ অকপট আবদার করল নিশা 

—‘আমি যাব না।’ 

—‘তাহলে আমিও যাব না।’ 

—‘মানে কী?’ 

—‘মানে হচ্ছে তুমি না গেলে আমিও যাব না!’ 

ওদের কথোপকথন শুনছিল সবাই। শুনছিল তুরিনও। শুনতে শুনতে তার শরীরের প্রতিটি অণু-পরমাণুতে লাল মরিচের ঝাঁঝ ধরে যাচ্ছিল। নিশা গলায় দুনিয়ার মায়া ঢেলে বলল, ‘চলো শাহজিদ! তুমি না গেলে আমার ভালো লাগবে না!’ 

ফারা ঠোঁটে একটা তেরছা হাসি নিয়ে জাহিদের দিকে তাকাল। জাহিদ চাউনিটা উপেক্ষা করে পা বাড়াল ভেতর বাড়ির দিকে। ফারা ওর পেছন পেছন আসতে আসতে ভর্ৎসনার গলায় বলল, ‘তোমার বউয়ের কী দরদ দেখলে তো ওই খোঁড়া ছেলেটার জন্য? ওদের মধ্যে কিছু চলছে নাকি?’ 

জাহিদ স্ত্রীর কথার প্রত্যুত্তর করল না। 

— ‘চুপ করে আছ কেন? আমার তো মনে হয় দুজনে তলে তলে প্রেম করছে।’ 

জাহিদ প্রসঙ্গ পাল্টে নিল, ‘আজকে কোন প্ল্যান আছে?’ 

—‘নেই আবার! দু-দুটো দাওয়াত। দুপুরে অনিমেষ খাওয়াচ্ছে। ওর প্রমোশন উপলক্ষে। রাতে আনিস ভাইয়ের মেয়ের গ্র্যাজুয়েশন পার্টি।’ 

—‘অনিমেষ আমাকে কিছু বলেনি তো!’ 

—‘জনে জনে বলতে হবে নাকি? আমাকে তো বলেছেই।’ 

—‘তুমি যাও। আমি বাবা-মাকে নিয়ে একটু বেরোব।’ 

—‘কোথায় যাবে?’ 

—দেখি। ভাইয়া-ভাবি তো বাড়িতে নেই। আমরাও বেরিয়ে পড়লে বাবা- মা একদম একা হয়ে যাবে।’ 

—‘মানে তোমার ভাই-ভাবি নিজেদের মতো উইকেন্ড এঞ্জয় করবে আর বাবা-মায়ের দায়িত্বটা সব সময় তোমার ঘাড়েই পড়বে। অসাম!’ 

—‘তুমিও চলো আমাদের সঙ্গে। অনিমেষকে না করে দাও।’ 

—‘মাথা খারাপ? ভীষণ কষ্ট পাবে অনি। বাবা-মাকে বুঝিয়ে বল আজ বন্ধুর পার্টি আছে।’ 

—‘বন্ধু তো তোমার। আমার নয়।’ 

ফারা একটা বড় শ্বাস গোপন করল। কয়েক পা এগিয়ে এসে জাহিদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শান্ত গলায় বলল, ‘বাবা-মাকে নিয়ে লাঞ্চের পর বের হই আমরা, কেমন? আজকে অনির খুব স্পেশাল একটা ডে। আমরা উপস্থিত না থাকলে মন খারাপ করবে। বেচারাকে এভাবে হার্ট করা কি ঠিক হবে বলো?’ 

.

নিশা একটা চাঁপা ফুল রঙের সুতির শাড়ি পরেছে। বাড়ির বাইরে বেরোনো হয় কদাচিৎ। এসব আউটিংয়ে কী ধরনের পোশাক পরা উচিত-সে সম্পর্কে তার ধারণা ক্ষীণ। তুরিন,ফারার মতো খোলামেলা পোশাক গায়ে চড়ানোর কথা ভাবতে গেলে মনে মনে শিউরে ওঠে সে। পশ্চিমা চালচলন রপ্ত করার মতো স্মার্টনেস তার মধ্যে নেই। ইংরেজিটাও ঠিকঠাক বলতে পারে না এখনো। এই আধুনিক উন্নত দেশে তার মতো গেঁয়ো প্রডাক্ট বুঝি একেবারেই বেমানান। সাজগোজ বলতে ওই একটু কাজল আর কপালের মাঝ বরাবর একটা টিপ। শাশুড়িকে জুবিনের খাওয়া-দাওয়া বুঝিয়ে দিয়ে নিচে নামতেই দেখল জাহিদ লিভিংরুমে বসে আছে খবরের কাগজ হাতে নিয়ে। পাশে মুর্তজা সাহেব। টেলিভিশনে ক্রিকেট খেলা চলছে। নিশার হাতভর্তি চুরির ঝিনিঝিনি মিষ্টি শব্দে জাহিদের মনোযোগ বিঘ্ন হলো। মুখ তুলে চাইল সে। চশমার আড়ালের প্রশান্ত দুটি চোখের তারা নিশার লালিত্য ঠাঁসা মুখটায় পড়তে না পড়তেই একটা মন কেমনের ঝড় উঠল নিশার চারপাশে। অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল সে, কী কারণে যেন লজ্জিতও হলো…কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুলতে গিয়ে টের পেল…গলার স্বর বুজে এসেছে। বুক কাঁপছে ধুকপুক করে। লোকটা এভাবে তাকিয়ে আছে কেন? সে কি একটু বেশি সেজে ফেলেছে? 

—’তুমি রেডি?’ 

প্রশ্ন করলেন মুর্তজা সাহেব। নিশা কোন রকমে উত্তর দিল, ‘জি বাবা।’ জাহিদ খবরের কাগজে চোখ নামিয়ে নিয়েছিল। নিশা একটু স্বস্তি ফিরে পেয়ে শ্বশুরকে বলল, জুবিন থাকল বাবা। কিছু দরকার হলে আমাকে ফোন করবেন। 

—তুমি নিশ্চিত থাকো। চিন্তা কোর না। 

বেরোনোর আগে নিশা একবার তাকাল জাহিদের দিকে। ঠিক সেই মুহূর্তে জাহিদও চোখ তুলল। চার চোখেতে মিলন হতেই নিশা লক্ষ করল চশমা পরা ছিপছিপে গড়নের সুন্দর দেখতে ভদ্রলোকটার ফরসা মুখে লালচে রঙের মৃদু আভা চিকচিক করছে। বুকের কোন একটা ঘরের জানালার কপাট যেন বাড়ি খেল দড়াম শব্দে! নিশা চট করে চোখ নামিয়ে নিল নিচে। 

বেরোনোর সময় মনটা হঠাৎ করেই খুব খারাপ হয়ে গেল। জুবিনকে রেখে কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। একা একা বেড়াতে কার ভালো লাগে? নিজের পরিবার ফেলে? পরিবার শব্দটা মাথায় আসতেই তার চোখের সামনে আরো একটি মুখ ভেসে উঠল অতর্কিতে। মন খারাপের পাল্লাটার ঝুপ করে ওজন বেড়ে গেল। অনেকখানি! 

ম্যাজিক মিরর 

দেখতে কোমল হলেও নিশার ব্যক্তিত্ব কিন্তু ভীষণ কড়া। চাইলেই কেউ ওর কাছে ঘেঁষতে পারে না। একটু আগে অর্ণব বেজায় অনুগত ভঙ্গিতে গাড়ির দরজা খুলে দিয়েছে। নিশা এত সম্মান পেয়ে অভ্যস্ত নয়। সে বিব্রতভাবে বলেছে, ‘অর্ণব সাহেব, আপনি বসুন প্লিজ। ব্যস্ত হবেন না।’ অর্ণব নড়ল না। দরজা ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। গাড়িতে ওঠার পর শাড়ির আঁচলটা সামান্য ঝুলে পড়েছিল বাইরে। অর্ণব আঁচলখানি তুলে নিয়ে নিশার হাতে গছিয়ে দিল 1 বিনিময়ে একটা ছোট্ট ‘ধন্যবাদ’ আশা করেছিল সে। কিন্তু নিশা ধন্যবাদ তো দিলই না, উপরন্তু মুখটাকে এমন গম্ভীর বানিয়ে ফেলল যেন অর্ণবের মাত্র করা কাজটা কোন উপকার নয়, বরং অনধিকার চর্চা। 

মধ্যিখানে আনিতা। জানালার পাশে তুরিন। নিশা আনিতার গা বাঁচিয়ে বসল। যেন ছোঁয়া না লেগে যায়। আনিতার আচরণে এমন একটা ভাব আছে যে মাঝে মাঝে মনে হয় নিশা অদ্ভুত। ড্রাইভিং সিটের পাশে শাহজিদ বসেছে। ওর পরনে একটা সাদা রঙের লং স্লিভ টি-শার্ট। ছাই রঙের জিন্স। কানের লতি পর্যন্ত নেমে আসা এলোমেলো ঈষৎ লালচে চুলগুলো আজকে জেল দিয়ে পরিপাটি করে আঁচড়ানো। চোখে কালো রঙের পোলারাইজড সানগ্লাস। মুখে চুইংগাম। নিশা গাড়িতে উঠে বসেই প্রশ্ন করল, “শাহজিদ, তোমার হুইলচেয়ার নিয়েছ?’ 

—‘না লাগবে না। ক্রাচেস শ্যুড বি এনাফ।’ 

নিশা একটু গম্ভীরভাবে, অনেকটা স্বগতোক্তির মতো বলল, ‘হুইলচেয়ারটা নিয়ে নিলেই পারতে!’ 

গাড়ির ভেতর একটা অসহ্য রকমের নৈঃশব্দ্য খাবি খাচ্ছিল। অর্ণবই কথা বলল প্রথম। 

—‘কোথায় যাব?’ 

আনিতা একটু সামনে এগিয়ে এসে অর্ণবের কাঁধের কাছাকাছি মুখ নামিয়ে বলল, ‘আপনার সেলফোনটা দিন। ডেস্টিনেশন সেট করে দিচ্ছি।’ 

আনিতা কাছে আসতেই পারফিউমের কড়া ঘ্রাণ নাকে এসে ধাক্কা খেল। একটু ভড়কে গিয়েছিল অর্ণব। তড়িঘড়ি করে সেলফোন এগিয়ে দিল সে। শাহজিদ জানালার কাচ নামিয়ে দিয়েছে। গাড়ির সিটটা এত বেশি হেলিয়ে দিয়েছে পেছনে যে আরেকটু হলেই ওটা তুরিনের গায়ের ওপর ধসে পড়বে। হাঁসফাঁস লাগছিল তুরিনের। না পারছে কিছু বলতে, না পারছে সইতে। শাহজিদের কোন বিকার নেই। গদিতে প্রায় অর্ধশয়নে শায়িত হয়ে, মনের তৃপ্তি নিয়ে রোদের উত্তাপ খাচ্ছে সে। এপ্রিলের এই শীত কাটানো নরম নরম গরম রোদটা ওর দারুণ লাগে। 

গাড়ি চলতে শুরু করতেই ঝাপটা বাতাস ছুঁয়ে দিল সবাইকে। বাতাসটা ভারি মসৃণ। নাতিশীতোষ্ণ ভাব আছে এর মধ্যে। খুব বেশিক্ষণ গায়ে লাগলে অবশ্য শীত শীত করে। তবে ওই শীতটা সহনীয় এবং আরামদায়ক। নিশা আর তুরিন দুজনে দুদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে মূর্তির মতো বসে আছে। যেন পরস্পরের দিকে তাকানো বারণ। 

—‘কেমন লাগছে আপনার? আমাদের কলোরাডো?’ শাহজিদের প্রশ্ন। 

অর্ণবের ভাড়া করা কালো রঙের টয়টা এসইউভি তখন রোদ তাতানো চকচকে রাস্তা দিয়ে মসৃণভাবে এগিয়ে যাচ্ছিল। স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে সামনের দিকে মুখ তাক করেই সে উত্তর দিল, ‘এখনো বুঝতে পারছি না ভাই। অনেক ড্রাই। আমার চামড়া ফেটে যাচ্ছে। মেয়েদের মতো লোশন মাখতে হচ্ছে দিন রাত।’ 

শাহজিদ একটু হেসে বলল, ‘লোশন জিনিসটা কি শুধু মেয়েদের জন্যই বরাদ্দ নাকি? পুরুষদেরও শরীরে চামড়া আছে। পুরুষরাও মানুষ! ‘ 

—‘আমার যে ত্বক বা চামড়া বলে কিছু আছে তা কলোরাডো এসে টের পেলাম। চামড়া ফেটে ফেটে জানান দিচ্ছে, আমি আছি! আমি আছি! 

এই কথায় সবাই হেসে উঠল। হাসল না শুধু তুরিন। কেমন অন্যমনস্ক হয়ে চেয়ে রইল জানালার বাইরে। 

—‘আপনার ঘরে হিউমিডিফায়ার আছে?’ 

—‘খেয়াল করিনি।’ 

নিশা ফোড়ন কাটল পেছন থেকে, ‘না নেই। এটিকে একটা এক্সট্রা রাখা আছে। দেখি বাড়ি ফিরে নামিয়ে দেব।’ 

—‘মনে করে একটু নামিয়ে নিও নিশা। বেচারা কষ্ট পাচ্ছে।’ নিশাকে কথাগুলো বলে নিয়ে একটু থামল শাহজিদ। তারপর অর্ণবের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, ‘এখানে সারা বছর ওই একটা যন্ত্র অপরিহার্য, বুঝলেন? নইলে গায়ের চামড়া কেটে ছিঁড়ে একাকার হয়ে যায়।’ 

—‘হুম…আর আমার তো ব্রিদিং প্রব্লেমও হচ্ছে। হাই এলেভেশনের কারণেই হচ্ছে বুঝতে পারছি। তবে এর প্রতিকার কী? মানে আপনাদেরও কি হয় এরকম?’ 

—‘প্রথম প্রথম একটু ব্রিদিং প্রব্লেম, মোশন সিকনেস কাজ করা স্বাভাবিক। ধীরেধীরে ঠিক হয়ে যাবে। আপনার ড্রাইভ করতে কোন সমস্যা হচ্ছে না তো?’ 

অর্ণব দুদিকে মাথা নেড়ে বলল, ‘একেবারেই না।’ 

—‘আপনি কোস্টাল এরিয়ার মানুষ। সমুদ্র দেখে অভ্যস্ত। বিরান পাহাড়ে মানিয়ে নিতে একটু সময় লাগবে।’ কথা বলতে বলতে, চশমার তলা দিয়ে ব্যাক মিররের ওপর চোখ রেখেছিল শাহজিদ। তুরিনের চোখে রোদ চশমা নেই। মিষ্টি, মিহি মুখখানায় রোদের সোনালি ছোপ এসে পড়েছে। বাতাসে উড়ছে চুল। ছোট ছোট বঙ্কিম চোখদুটি আলোর তেজে যেন আরো বেশি ছোট হয়ে গেছে। খরগোশের বাচ্চা চোখ ভালো মতো ফোটার আগে যেমন কুঁইকুঁই করে চারিদিকে চায়, ঠিক তেমন ভঙ্গিতেই খোলা জানালা দিয়ে বাইরেটা দেখছে তুরিন। ওই ভঙ্গিটা চকলেটের মতো একটা তুলতুলে স্বাদের উদ্রেক করছিল শাহজিদের মনের মধ্যে। ফুরফুরে বাতাসে রোদের ঝাপটা মেশানো উত্তাপ আর মনের মধ্যে চকলেটের মিষ্টি স্বাদ…সবটা মিলিয়ে দারুণ উপভোগ করছিল সে! 

—‘এখানে ডাইভার্সিটি একেবারে নেই বলা চলে।’ অর্ণব বলল। 

—‘কথা সত্য।’ সায় দিল শাহজিদ। 

—‘ইস্ট-কোস্টে ভাই রাস্তায় নামলে মাঝেমধ্যে মনে হয় না বিদেশ। এত ভারতীয় চারিদিকে। এখানে তো সব সাদা। এরা মনে হয় বাদামি মানুষ দেখে অভ্যস্ত না। কেমনে কেমনে জানি চেয়ে থাকে। মনে হয় আমি মঙ্গলগ্রহ থেকে আসছি।’ 

অর্ণবের বলার ধরনে এবার তুরিনের ফিনফিনে পাতলা দুটি ঠোঁটেও হালকা হাসির রেশ যুক্ত হলো। এখন তার ভালো লাগছে। এত ভালো লাগছে যে মনে হচ্ছে আজকের দিনটা বাস্তব নয়, স্বপ্নলব্ধ কোন দিন। সামনে যে ছোট্ট এক টুকরো আয়না গাড়ির জানালার ধার ঘেঁষে ঝুলে আছে, সেই আয়নাটাকে এখন ম্যাজিক মিরর বলে ভ্রম হচ্ছে। ওদিকে চোখ মেলে চাইলেই জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মুখটা ভেসে উঠছে। রোদের ঝিকিমিকিতে উদ্ভাসিত সেই মুখ কী রকম যেন মাদক মাদক সুন্দর! দেখতে গিয়ে তুরিনের চোখের তারা ঝিমঝিম করে, সেই ঝিমঝিমানি শিরশির করে নেমে আসে নাকে, ঠোঁটে, বুকে, তারপর হৃৎপিণ্ডের স্পন্দনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় শরীরের প্রতিটি রক্ত কণিকায়। মাতাল মাতাল লাগে! 

—‘এখানকার বাঙালি কমিউনিটি একেবারেই ছোট। আগে তো বাঙালি ছিলই না বলতে গেলে। আমাদের ছোটবেলার কথা বলছি। এমনকি ডেনভারে একটা ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁ পর্যন্ত ছিল না।’ শাহজিদ বলল। 

আনিতা যোগ করল পেছন থেকে, ‘এ বছর বেশ কিছু স্টুডেন্ট এসেছে বাংলাদেশ থেকে। বোল্ডার সিইউ-তে।’ 

—‘আপনি কী পড়ছেন?’ অর্ণবের প্রশ্ন, আনিতার উদ্দেশে। 

—‘বিবিএ।’ 

—‘আমি বিজনেসের কিছুই বুঝি না। তবুও আউট অব কিওরিসিটি জানতে ইচ্ছে হচ্ছে। আপনার মেজর কী?’ 

আনিতা ড্রাইভিং সিটে বসা, ছাই রঙের ফতুয়া পরা, ছিপছিপে ছেলেটার দিকে ত্যাড়া চোখে তাকাল একবার। ব্যাটা অনেকটা রামছাগলের মতো দেখতে হলেও কথা কিন্তু ভালোই বলে! রামছাগলের কথা মনে হতেই আনিতা নিজের অজান্তে ফিক করে হেসে দিল। পরমুহূর্তে হাসিটা চট করে লুকিয়ে ফেলে বলল, ‘মার্কেটিং।’ 

নিশার বাইরে খুব একটা বেরোনো হয় না। জুবিনকে নিয়ে ডাক্তারখানায় যাওয়ার সময় একটা অন্যরকম ব্যস্ততা থাকে। এ দেশে গাড়িতে বাচ্চা কোলে নিয়ে বসা যায় না। গদির ওপর আলাদা কার-সিট রেখে তাতেই বাচ্চাকে বসাতে হয়। বেঁধে দিতে হয় বেল্ট দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে। জুবিন কার সিটে থাকতেই চায় না। কাঁদতে কাঁদতে পৃথিবী মাথায় তোলে। সঙ্গে সর্বদাই শ্বশুর- শাশুড়ি থাকেন। আজ শ্বশুর-শাশুড়ি নেই, জুবিনও নেই। নিশার যেন অফুরন্ত অবসর। বাইরের রোদ ধোয়া সতেজ প্রকৃতি সে মন ভরে পান করছিল। পাহাড়ি এলাকায় আবহাওয়ার কোন স্থিরতা নেই। একটু আগে তেজালো রোদ ছিল। এখন গাঢ় নীল পাতলা মেঘের আস্তর আকাশি রঙের মসৃণ আকাশটাকে অনেকখানি ঢেকে দিয়েছে। কয়েকটা দলছুট সাদা মেঘ নেমে এসেছে অনেক নিচে। যেন এখুনি টুপ করে ঝাঁপ দেবে গাছের মাথায়। চার লেনের সুবিশাল রাস্তাটার দুপাশে বিস্তৃত সমভূমি। রোদে জীর্ণ হওয়া সোনালি ঘাসের গায়ে একটু একটু সবুজের আঁচড় লেগেছে। দিগন্ত প্রসারিত সবুজ আভার সোনালি মাঠে স্রোতের মতো বয়ে চলেছে হাওয়া। কোথাও ছায়া, কোথাও রোদ্দুর…আর মাঠের শেষে…ওই দূরে…অনেক দূরে…রক্ষীবাহিনীর সামরিক সিপাহির মতো গর্বিত, দাপুটে ভঙ্গিতে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে রকি পর্বতমালা। পর্বতের চুড়োয় যেন অন্য একটা দুনিয়া। আকাশ থেকে আশ্চর্য আলো ঠিকরে পড়ছে সাদা বরফের মুকুট পরা পর্বতের মাথায়। বরফের মুকুট হীরের মতো ঝিকোচ্ছে। মেঘে মেঘে ছড়িয়ে পড়ছে হীরের টুকরোর রোশনাই। কত রং, কত বিভা! কত যে নিগুঢ় সৌন্দর্যের জাল ছড়ানো আলপনা! দেখলেও পুরোপুরি দেখা হয় না, বুঝলেও বোঝা যায় না, দুর্বোধ্য এক ভয়ংকর মুগ্ধতা বুকে চেপে ধরে প্রকৃতির সেই বিরাট মহাজ্যোতির্ময় লীলাখেলার দিকে নির্বাক চেয়ে থাকতে হয়। শিরা উপশিরার কুহরে কুহরে বাজতে থাকে অলৌকিক শঙ্খধ্বনি! নিশা বুঁদ হয়ে চেয়েছিল…ওইদিকে…আকাশ আর পাহাড় মিলেছে যেখানে। তার মনে পড়ছিল দেশের কথা, বাবার কথা, মায়ের কথা, মফস্সলের তিন কামরার বাসার কথা, গ্রামের বাড়ির টিনের চালের ঝমঝম বৃষ্টির শব্দের কথা, শীতকালের পিঠার কথা…! মনে পড়ছিল জুবিনের কথা…এমনকি…জুবিনের বাবার কথাও! 

—‘নিশা, পানি হবে তোমার কাছে?’ ঘাড় ঘুরিয়ে প্রশ্ন করেছিল শাহজিদ। নিশার ওপর চোখ পড়তেই ভারি চমৎকার হাসল সে, ‘বাহ! তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে তো!’ 

ওটা ছিল সাধারণ একটা স্তুতি বাক্য কিন্তু তুরিন শুনতে পেল কোথায় একটা কাচের শিশি ঝনঝন শব্দে ভেঙে গেল এই মাত্র। যন্ত্রণায় চিনচিন করে উঠল বুক। নিশা ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করতে করতে শান্ত গলায় ছোট করে উত্তর দিল শাহজিদকে, ‘থ্যাংক ইউ।’ 

শাহজিদ পানি খাওয়ার আগে চোখের সানগ্লাসটা খুলে নিয়েছিল। আয়নার ভেতর দিয়ে দেখল তুরিন বিষণ্ণ দৃষ্টি মেলে চেয়ে আছে দূর পাহাড়ের দিকে ওর চোখে কাচের মতো ভাসছে একটু একটু জল। ঠোঁট কাঁপছে হালকা। চুলের ঝাপটা এসে পড়ছে মুখে। ওই মুখখানা এখন রোদ ছায়ার লুকোচুরি খেলার মতো রহস্যময় সুন্দর! 

টেবল মেসা 

গাড়িটা উঁচুতে উঠছিল। আকাশটা যেন নিচে থেকে নিচে নেমে আসছে ক্রমশ। আরেকটু হলেই হাত বাড়িয়ে ছোঁয়া যাবে ভাসমান সাদা পালের মেঘ। গুগল ম্যাপ অর্ণবকে যে রাস্তার ওপর দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল তার নাম টেবল মেসা ড্রাইভ। বসতি ছেড়ে আঁকাবাঁকা রাস্তা পার হয়ে গাড়িটা ক্রমেই পাহাড়ের শিখরের দিকে ছুটছে। সোনালি আর সবুজ ঘাসের কার্পেট বিছানো চড়াই- উতরাই ভূমি রাস্তার দুধারে বহুদূর অবধি বিস্তৃত। শীতকালে তীব্র রোদে পুড়ে গিয়ে ঘাসগুলোর রং জ্বলে যায়। সোনালি পাটের মতো দেখায়। বসন্তের শুরুতে রুক্ষ ঘাসগুলোতে একটু একটু করে প্রাণের অস্তিত্ব ফিরে আসে। রাস্তার দুদিকে ঢেউয়ের মতো ছড়িয়ে থাকা উঁচু-নিচু মাঠের শেষে সারি বাঁধা পাইনগাছ। এই পাইনগাছগুলো খুব বেশি লম্বা নয়, আকারে মাঝারি। দূর থেকে দেখলে মনে হয় অগণিত প্রহরী পাহাড়ের ঢালে দলবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। যেন প্রাচীনকালের কোন যুদ্ধের ময়দান। চড়াই-উতরাইয়ের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে আঁকাবাঁকা একাধিক ট্রেইল। পর্যটকরা সেই ট্রেইল ধরে হেঁটে হেঁটে পুরো পাহাড় চষে বেড়াতে পারে। 

গন্তব্যস্থলে পৌঁছনোর পর দেখা গেল ভিড় নিছক কম নয়। পার্কিং লটে অনেক গাড়ি। দীর্ঘদিন পর আবহাওয়া ভালো। তার ওপর ছুটির দিন। ভিড় হওয়াটাই স্বাভাবিক। এত ভিড়ে পার্কিংয়ের জায়গা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হতো। কিন্তু শাহজিদ সঙ্গে থাকায় সেই ঝামেলা মিটে গেল। এ দেশে ডিজেবলদের জন্য আলাদা পার্কিং স্পট থাকে। সেসব জায়গা সুস্থ স্বাভাবিক লোকেরা ব্যবহার করলে দণ্ড হয়। আজকে হ্যান্ডিক্যাপড পার্কিংয়ে সোজা গাড়ি পার্ক করে ফেলল অর্ণব। সামনে ঝুলিয়ে দিল হ্যান্ডিক্যাপড স্টিকার। ভাগ্যিস শাহজিদ পকেটে করে নিয়ে এসেছিল ওটা। 

গাড়ি থেকে নামতেই বেগবান হাওয়ার দমক ধাক্কা দিল গায়ে। কানে এসে লাগল নানা জাতের পাখির ডাক। নিশা তড়িঘড়ি করে শাহজিদের ক্রাচ দুটো নামাল গাড়ির ট্রাঙ্ক থেকে। সে এখানে আগে কখনো আসেনি। এত আলো, এত আকাশ, এত হাওয়া, এত মেঘের আনাগোনা…একসঙ্গে আগে কখনো দেখেছে বলে মনে পড়ে না। তার মনটা অন্যরকম হয়ে গেছে এ জায়গায় এসে। বদ্ধ হৃদয়ের সবকটা দরজা-জানালা যেন খুলে গেছে। 

উঁচু-নিচু অসম মাটির ওপরের ঘাস আর আগাছা মাড়িয়ে কিছুদূর যেতেই পাহাড়ের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেল ওরা। চোখের সামনে একটা জীবন্ত লোকালয়ের ছবি ভেসে উঠল। ওপর থেকে দেখা যাচ্ছে ছোট ছোট বাড়ি, ছিমছাম রাস্তা-ঘাট, খেলনার মতো চলন্ত গাড়ি, পাহাড়ের ঢেউ ভাঙা নকশা কাটা ঢাল আর অগণিত সারি বাঁধা পাইনগাছ। পাহাড়টা একেবারে খাদের মতো নেমে যায়নি নিচে। বরং একটু একটু করে নেমেছে। সামনে তাকালে মনে হয় যেন সুবিস্তৃত কোন মালভূমি। যেন পৃথিবীর ছাদ। যেন এখানে, এই পাহাড়ের শেষ প্রান্তে দাঁড়ালে পুরো পৃথিবীটাকে এক লহমায় দেখে নেওয়া যাবে। 

নিশা ঘাসের ওপর একটা চাদর বিছিয়ে দিল। চাদরটা নিয়ে এসেছিল সঙ্গে করে। মাটি বেশ শক্ত। ঘাসগুলোও কেমন সুচালো আর ধারালো। তবুও শাহজিদকে নিয়ে বসার একটা জায়গা চাই। পাহাড়ের কিনারে বেশ কিছু পাথর ছড়ানো আছে। সেসব পাথরের ওপর অবশ্য চাইলেই বসা যায়। শাহজিদ সঙ্গে একটা বই নিয়ে এসেছিল। এক সময় এই জায়গা তার প্রিয় ছিল। পুরো পাহাড় চষে বেরিয়েছে বন্ধুদের সঙ্গে। কোথায় কোন ট্রেইল, কোথায় হরিণ আছে, কোথায় মাউন্টেন লায়ন বা গ্রিজলি বিয়ার, কোন শৈলখণ্ডের উচ্চতা কতখানি, কোন দিকে ক্যাম্পিং করলে বন্য জন্তুর আক্রমণের ঝুঁকি কম, সমস্ত খুঁটিনাটি এখনো তার মুখস্ত। আগে পাহাড়কে জয় করার অদম্য নেশা ছিল। এখন আর সেই নেশা নেই। পাহাড়কে সে আর কোন দিন জয় করতে পারবে না। পাহাড়ের কাছে…পাহাড়ের উচ্চতার কাছে…শাহজিদ হেরে গেছে চিরতরে! 

চাদরের ওপর পা ছড়িয়ে বসেছিল। কোলে বই। মনে হচ্ছে হেলান দেয়ার কিছু থাকলে ভালো হতো। শিরদাঁড়ায় একটু লাগছে। একটা মাত্র পায়ের যে কী দাম, তা টের পাওয়া গেল পা-টা চলে যাওয়ার পর। সাধারণ মানুষের মতো বসাটাও সম্ভব হচ্ছে না। এক পাশে ক্রাচ দুটো রাখা। অন্য পাশে নিশা। অর্ণব এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তুরিন এখন অবধি তার সঙ্গে একটি কথাও বলেনি। এই অহংকারী, উদ্ধত মেয়েটির সঙ্গে ভাব জমানোর কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছে না সে। ভাব করার খুব একটা তাগিদ যে অনুভব করছে তাও নয়। ওর বরং নিশাকেই ভালো লাগছে। নিশার আশেপাশে চুপ করে বসে থাকার মধ্যেও যেন একটা অন্যরকম ভালো লাগার ব্যাপার আছে। 

তুরিনদের দলটায় ছেলেমেয়ে মিলিয়ে ছয়জন সদস্য। নিশারা যেখানে বসেছে তার ঠিক ডান পাশে কয়েক গজ দূরেই জড়ো হয়েছে ওরা। ওদের পেছনে পাহাড় ঢালু হয়ে নেমে গেছে দূরের পাইনগাছ ঘেরা শহরের কাছে। আকাশে মেঘ আছে, আছে রোদ্দুরও। এ যেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক সুষম বণ্টন। শাহজিদ কোলের ওপর রাখা বইটার পাতা ওল্টাচ্ছিল অন্যমনস্কভাবে। তুরিনের বন্ধুরা ব্লুটুথ স্পিকার নিয়ে এসেছে। মিউজিক বাজিয়ে পাহাড়ের শান্ত সুনিবিড় পরিবেশ বিনষ্ট করছে। শাহজিদ মনে মনে বিরক্ত বোধ করছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই জায়গাটা যেন শ্যুটিং স্পটে রূপান্তরিত হলো। বোঝা গেল নাচ-গান কিছু একটা শ্যুট করা হবে। নিশার মজাই লাগছিল। মুখে একটা আমুদে হাসি নিয়ে ছেলেমেয়েদের কাজ-কারবার দেখছিল সে। 

আনিতা রিপড জিন্সের ওপর কালো একটা জ্যাকেট পরে ছিল এতক্ষণ। জ্যাকেট খুলে ফেলার পর তার গায়ে রইল স্লিভলেস লো কাট নীল রঙের ব্লাউজ। ওর চুলগুলো বেশ লম্বা, মজবুত এবং কালো। কোমর পর্যন্ত ছাপিয়ে আছে একদম। তুরিন দল থেকে একটু দূরে বিচ্ছিন্নভাবে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ আটকে গেছে চাদরের ওপরে বসে থাকা যুবক-যুবতীর ওপর। নিশা শাহজিদের এত কাছে বসেছে যে একটু নড়লেই পিঠের সঙ্গে পিঠ ঠেকে যাবে। দৃশ্যটা তুরিনের চোখে খেজুরকাঁটার মতো বিঁধছে। সে দৃষ্টি ফেরাতে পারছে না, তাকাতেও পারছে না। অস্থির লাগছে…এত অস্থির লাগছে যে মনে হচ্ছে পাহাড় থেকে লাফ দিয়ে পড়ে মরে গেলেই সবচেয়ে ভালো হয়! একদিন বলবে…একদিন নিশার চোখে চোখ রেখে দৃপ্ত কণ্ঠে শব্দগুলো উচ্চারণ করবে তুরিন, 

‘আমি তোমাকে ঘৃণা করি! খুব বেশি ঘৃণা করি!’ 

নাচ শুরু হয়ে গেছে। ছেলে মেয়েরা পর্যায়ক্রমে নেচে যাচ্ছিল। অর্থাৎ একজনের নাচ শেষ হলে অন্যজন শুরু করছিল। ছেলেদের পরনে টি-শার্ট আর হাফ প্যান্ট। মাথায় ক্যাপ। দুজন ক্যামেরাম্যান আছে। এদিকে অর্ণবও মোবাইলে ভিডিও করা শুরু করেছে। তার মুখে ফকফকে হাসি। এমন মজার ঘটনা যেন সে এর আগে কখনো দেখেনি। শাহজিদ চোখা চোখে দেখছিল। কুঞ্চিত ভ্রু। ঠোঁটে উপচেপড়া বিরক্তি। তুরিনের পালা এলো তিনজনের পর। পিংক কোটটা খুলে রেখেছে। এখন ওর গায়ে সাদা রঙের সিল্ক কাপড়ের স্লিভলেস ব্লাউজ। ব্লু জিন্স। ফরসা পেটের অনেকখানি অনাবৃত। ঝকঝকে সোনালি আলোর নিচে খোলা চুলে ও যখন ক্যামেরার সামনে এসে নাচ শুরু করল, ঠিক সেই সময় ওর দিকে তাকানো মাত্র শাহজিদ একটা হার্টবিট মিস করল। চাপা আগুনের নিবিড় আঁচ যেন ছড়িয়ে পড়ল চামড়ার তলায়। বিব্রত শাহজিদ কম্পিত বক্ষ নিয়ে দেখল, তুরিনের কণ্ঠার হাড়ের খাঁজে এক টুকরো বেহায়া রোদ লুকোচুরি খেলছে। ‘কলারবোন’ জিনিসটা এত কাব্যিক হতে পারে তা আজকে এই ক্ষণে তুরিনকে না দেখলে তার হয়তো কখনো জানা হতো না! 

ভিড়ের মাঝে একটা পুরুষকণ্ঠ বলল, ‘হার পশ্চার ইজ ভেরি গুড।’ আরেক জন বলল, ‘অ্যাবসোলিউটলি। আই জাস্ট লাভ টু ওয়াচ হার মুভ!’ 

মানুষ আজব প্রাণী। কথা গুলো শোনামাত্র, কেন কে জানে শাহজিদের মেজাজটা অতর্কিতে খিঁচড়ে গেল। বুকের নাড়িগুলো টনটন করে উঠল বিদ্রোহের হুংকারে। শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে উঁচু গলায় বলল, ‘টেরিবল পারফরমেন্স!’ কর্কশ শব্দ দুটো বাতাসে ডিগবাজি খেয়ে পারফরমারের কানে বিস্ফোরণ ঘটাতে সময় নিল না বেশি। তুরিন থমকে গেল। দুর্ধর্ষ চোখে তাকাল শাহজিদের দিকে। শাহজিদ আকাশে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে যেন পুরো বিশ্বের উদ্দেশে বলছে এমন ভঙ্গিতে বলল, ‘নেভার সিন সাচ বুলশিট বিফোর! হরিফিক! 

একটি ছেলে প্রতিবাদ করল, ‘হোয়াটস রং ম্যান? শি ইজ হট!’ 

—‘শাট ইওর মাউথ। বেল্ট আপ!’ ধমকে উঠল শাহজিদ। 

তুরিন স্তব্ধীভূত। তার মুখে রক্ত নেই। হাত-পা কাঁপছে এপিলেপ্সির রোগীর মতো। চোখে ভয়ংকর প্রলয়ের আভাস। কয়েক সেকেন্ড থম ধরে দাঁড়িয়ে থেকে একছুটে পালিয়ে গেল জায়গাটা ছেড়ে। শাহজিদ ভ্রুক্ষেপ করল না। নির্বিকারভাবে বইয়ের পাতা ওল্টাতে লাগল। 

—‘এটা কী করলে তুমি? কী সুন্দর নাচ হচ্ছিল। কেন এরকম করলে?’ তীর্যক গলায় বলল নিশা। 

শাহজিদ প্রত্যুত্তর করল না। নিশা বসা থেকে অস্থিরভাবে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ‘ইশ তুরিন নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পেয়েছে। এভাবে অপমান করে কেউ কাউকে? তুমি মানুষ না!’ 

কথাটা শেষ করে সে পাশে দাঁড়ানো অর্ণবকে বলল, ‘অর্ণব সাহেব, যন্ত্রের মতো দাঁড়িয়ে না থেকে, তুরিন কোথায় গেল একটু দেখুন। বেচারি মেয়েটা!’ 

একটি অন্যরকম দিন 

অপ্রকৃতস্থের মতো ছুটছিল তুরিন। কোথায়, কোনদিকে যাচ্ছে জানে না। এত তাণ্ডব সইতে পারছে না তার দুর্বল হৃদয়। দম আটকে আসছে। রক্তের শিরায়- উপশিরায় আসুরিক এক তেজের স্ফুরণ। এই মুহূর্তে মানুষ খুন করাও যেন অসম্ভব কিছু নয়। পার্কিং লটের কাছে এসে অর্ণবের গাড়িটা চিনতে পারছিল না। একটা অপরিচিত গাড়ির গায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াল। তারপর মুখের ওপর দুহাত চেপে দীনহীন রিক্ত নিঃস্বের মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক পাশের গাড়ি থেকে নামামাত্র দৃশ্যটা দেখল। সান্ত্বনার গলায় বলল, ‘টেক ইট ইজি হানি! থিংগস ওনট অলওয়েজ বি ব্যাড।’ কথাটা বলতে বলতে ভদ্রলোক একটু এগিয়ে এলো, নরম স্বরে বলল ‘ইউ ওকে?’ 

তুরিন এত জোরে চোখের পানি মুছতে লাগল যেন আরেকটু হলে চোখ সহ উপড়ে ফেলবে। ওপর-নিচে মাথা নেড়ে বলল, ‘আই অ্যাম অলরাইট। থ্যাংক ইউ।’ 

আনিতাকে দেখা গেল। তুরিনের মুখের ওপর বিস্মিত চোখজোড়া স্থাপন করে ভারি অবাক গলায় বলল, ‘এত কান্নাকাটির কী হলো?’ 

তুরিন ঝংকার দিয়ে উঠে বলল, ‘কী হলো তুমি দেখোনি? কীভাবে অপমান করল আমাকে?’ 

—‘কী এসে যায়? আমরা আবার শ্যুট করব তোমার অংশটা। কামঅন তুরিন! ওভার-রিঅ্যাক্ট কোর না!’ 

—‘আমি ওভার-রিঅ্যাক্ট করছি?’ 

—‘হ্যাঁ করছ।’ 

খানিক দূরে অর্ণব এসে দাঁড়িয়েছে। তার কাঁচুমাচু মুখে খেলছে দ্বিধার ঢেউ। কী করা উচিত বুঝতে পারছে না। বলতে কী, তুরিনকে মনে মনে একটু ভয়ই পায় সে। এমন আগুনের মতো রাগ মেয়েটার। বাবারে, চোখ দিয়ে যেন ঝলসে দেবে একদম। নিশা ওর পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। চাপা স্বরে বলল, ‘দাঁড়িয়ে আছেন কেন? যান গিয়ে কথা বলুন।’ 

অর্ণব চমকে উঠল, ‘জি? আমি?…মানে আমি?’ 

খুব বিরক্ত হলো নিশা, ‘হ্যাঁ আপনি!’ 

—‘ইয়ে…মনে হচ্ছে উনি খুব রেগে আছেন। এখন কথা বলাটা একেবারেই উচিত কাজ হবে না।’ 

এদিকে আনিতার কথা শুনে তুরিনের আরো বেশি রকমের কান্না পাচ্ছিল। ‘ওভার-রিঅ্যাক্ট’ বলতে ও কী বোঝাতে চাইছে? এত বড় অপমানের পর তুরিন চুপ করে বসে থাকবে? প্রতিবাদ করবে না? এমনকি প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করতে পারবে না? এত সোজা?…মানে একজন মানুষকে জনসম্মুখে নির্বিকারে লাঞ্ছিত করা এতই সোজা? তা ছাড়া নাচের দলের মধ্যে সবাই তুরিনের শুভাকাঙ্ক্ষী নয়। এই অবমাননার ঘটনায় কেউ কেউ খুশি হয়েছে। আড়ালে হাততালি দিয়ে উল্লাস জ্ঞাপন করছে। আনিতা তো ছোট বালিকা নয় যে এসব বোঝে না। তুরিন ব্যথিত স্বরে বলল, 

—‘তুমি আমার বোন হয়ে এরকম কথা বলতে পারছ? আমার মান-সম্মান ম্যাটার করে না তোমার কাছে?’ 

—‘সম্মান হানি হওয়ার মতো কিছু হয়েছে বলে তো আমার মনে হচ্ছে না। সবার তো সব সময় সবকিছু ভালো লাগতে হবে এমন কোন কথা নেই। মানে তোমার পারফরমেন্স কারো কাছে যদি খারাপ লাগে সে তো সেটা বলতেই পারে, তাই না? মানছি, এভাবে সবার সামনে বলাটা উচিত হয়নি। সে তো একটু পাগল আছে আমরা সবাই জানি। পাগলের কথা পাত্তা দিয়ে কী লাভ বলো?’ 

আনিতার বলা কথাগুলো শুনতে শুনতে যেন বিষম খেলো তুরিন। চোখে ঘনিয়ে এলো সন্দেহের মেঘ। কষ্টের একটা লৌহবেড়ি খামচে ধরল হৃৎপিণ্ড। ঝকঝকে দিনের আলোয় হঠাৎ এত কালের চেনা আনিতাকে কেমন অচেনা লাগতে লাগল তার। মনে হলো শাহজিদের করা অপমানটার কোথাও না কোথাও আনিতা বুঝি একটা গোপন আনন্দের স্বাদ খুঁজে পেয়েছে। ওর চোখের উজ্জ্বল তারার মাঝে চাপা বিজয়ের জেল্লা চিকচিক করছে। কী কাণ্ড! পৃথিবীর সব মানুষ কেন তুরিনকেই অপছন্দ করে? কেন তার হেরে যাওয়ার মাঝেই সুখ খুঁজে পায়? আশ্চর্য! নাহ…কষ্ট হচ্ছে না। বরং রাগ হচ্ছে। দুনিয়া কাঁপানো রাগ হচ্ছে। নিঃশ্বাস পড়ছে ঘনঘন। যুক্তিবোধ ক্রমেই ঝাপসা হয়ে আসছে। চোখের সামনে নেমে আসছে বিদঘুটে অন্ধকার! এরকম সময়ে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে পড়ার মতোই ঘটনা ঘটল একটা। নাচের দলের একজন মেয়ে সদস্য, স্টেলা ওর নাম, হঠাৎ আনিতার পাশে এসে দাঁড়িয়ে চঞ্চল কণ্ঠে বলল, ‘আমার মনে হয় ওই ছেলেটাকে আমি চিনতে পেরেছি। আমাদের স্কুলের সিনিয়ার ছিল।’ 

—‘কোন ছেলে?’ 

—‘হোয়াইট টি-শার্ট। অভিওসলি দ্য মোস্ট হ্যান্ডসাম ওয়ান।’ কথাটা বলে একটু ফিচেল হাসল মেয়েটি। তারপর আবার বলল, ‘স্কুলে ওর ওপর আমার ক্রাশ ছিল। ও কি তোমাদের পরিচিত? আমার সঙ্গে একটু আলাপ করিয়ে দাও না!’ 

তুরিন শ্বাপদ জন্তুর মতো বিভীষণ চোখে চেয়ে ছিল স্টেলার দিকে শুনছিল কথাগুলো। কর্কশ, নির্দয় পৃথিবীটাতে আর এক মুহূর্তও বাঁচতে ইচ্ছে করছে না তার। এমন কেউ কি নেই যে তাকে একটু বুঝবে? একটু বন্ধুর মতো আচরণ করবে? মনের কোনায় আশ্রয় দেবে? শরীরে কোন সাড় পাচ্ছিল না তুরিন। অদ্ভুত ভয়ংকর এক কষ্ট ভেতরের সমস্ত স্পন্দন থামিয়ে দিয়েছিল। ঝাপসা চোখে দেখল আনিতা স্টেলাকে নিয়ে হাঁটা দিয়েছে। একটু দূরে নিশা দাঁড়িয়ে আছে অর্ণবের পাশে। নিশাও নিশ্চয়ই মনে মনে তিরস্কারপূর্ণ হাসি হাসছে, আনিতার মতো, স্টেলার মতো…শুধু এরাই নয়, তুরিনের মনে হলো গোটা পৃথিবীটাই তাকে নিয়ে কৌতুকে মেতে উঠেছে। সমগ্র আকাশ-বাতাস কেঁপে কেঁপে উঠছে উপহাসের আমোদ রসে। তুরিন চোখ কান বুজে বুনো ষাঁড়ের মতো ছুটতে লাগল আনিতার পেছন পেছন। শাহজিদ তখনো চাদরের ওপর বসে ছিল। কোলে রাখা খোলা বই। তুরিন দেখল আনিতা স্টেলাকে সঙ্গে নিয়ে শাহজিদের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। শাহজিদ হেসে কী যেন বলল ওদের। হেসেই উত্তর দিল আনিতা। হনহন করে হেঁটে এগিয়ে এলো তুরিন। ওর চোখ লাল। গালে তেজের আগুন। যেন এক অপশক্তি ভর করেছে ওর ওপর। 

—‘কী ব্যাপার?’ ফুটন্ত গরম পানির মতো টগবগিয়ে ফুটতে ফুটতে প্রশ্নটা করল তুরিন আনিতাকে। 

আনিতা ভড়কে গেল, ‘মানে?’ 

—‘কেন এসেছ এখানে?’ 

—‘এরকম করছ কেন? পাগল হয়ে গেলে?’ 

শাহজিদ স্তব্ধ চোখে দেখছিল তুরিনকে। বুঝতে পেরেছিল যে মেয়েটা কষ্ট পেয়েছে। সত্যি বলতে বাচ্চা খরগোশটাকে কষ্ট দিয়ে একটুও স্বস্তি পাচ্ছিল না মনে মনে। নিজ উদ্যোগে ক্ষমা চাইতেও আত্মসম্মানে বাধছিল। তুরিন আগুন জ্বলা চোখে তাকাল একবার শাহজিদের দিকে। ঝড়ের বেগে এগিয়ে এলো। রাগে কাঁপতে কাঁপতে ওর কোলের ওপর রাখা বইটা তুলে নিয়ে সজোরে ছুড়ে মারল দূরে। সাঁইসাঁই বাতাস কেটে ভারি মোটা বইটা কোথায় গিয়ে যে ভূপতিত হলো সেই খবর আর কেউ জানল না। ঘটনার আকস্মিকতায় শাহজিদ থ বনে গেছে। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না একটা আস্ত জীবন্ত বই কোন মানুষ এমন ময়লা আবর্জনার মতো ছুড়ে ফেলতে পারে। ঠোঁট দুটো একটু ফাঁকা হয়ে গেছে। হ্যাজেল রঙের বিমোহন চোখে জন্মের বিস্ময়! তুরিন ঝগড়াটে ভঙ্গিতে কোমরে হাত রেখে গা শিউরে ওঠা শীতল কণ্ঠে বলল, ‘কেন এভাবে অপমান করলে আমাকে?’ 

শাহজিদ উত্তর দিতে পারল না। শুধু চেয়েই রইল। 

—‘কেন করলে?’ চিৎকারটা আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে দিল একদম। শাহজিদের ভেতরকার ঘুমটা ভাঙতে বাধ্য হলো সেই চিৎকারে। নড়েচড়ে বসে বলল, ‘কী বলছেন আবোলতাবোল?’ 

—‘কেন বললে আমার নাচ ভালো হয়নি? কোন সাহসে বললে? এখন সবার সামনে সরি বলো, ক্ষমা চাও।’ 

—‘হ্যাঁ?’ বেকুব বনে যাওয়া গলায় কোনমতে শব্দটা উচ্চারণ করল শাহজিদ। আশপাশে নাচের দলের সদস্যরা ভিড় করেছে। বাংলা বুঝতে পারছে না কিন্তু কিছু একটা গুরুতর ঘটনা যে ঘটছে তা টের পাচ্ছে সবাই। তুরিন দাঁতে দাঁত চিবিয়ে গমগমে গলায় বলল, ‘তুমি এখন সবার সামনে সরি বলবে। ক্ষমা চাইবে আমার কাছে।’ 

—‘তাই?’ শাহজিদের কণ্ঠ থেকে বিস্ময়ের ঘোর কাটছেই না। 

—হ্যাঁ তাই! 

কিছুক্ষণ তব্দা মেরে চেয়ে থেকে, যেন খুব মজার কোন কৌতুক শুনেছে এমন ভঙ্গিতে হাসল শাহজিদ। চোখ সরু করে তুরিনের রাগে লাল হওয়া মুখখানার দিকে চেয়ে ভারি কায়দা করে বলল, ‘আচ্ছা! ক্ষমা চাইতে হবে! আর কী কী করতে হবে ম্যাডাম?’ 

—‘যা কিছু তখন বলেছ সবটা ফিরিয়ে নেবে। সবার সামনে বলবে যে তুমি মিথ্যে বলেছ…আর সত্যিটা বলবে।’ 

—‘সত্যিটা কী?’ 

—‘সত্যিটা হলো আমি খুব ভালো নাচি, সবচেয়ে ভালো নাচি এবং আমি খুবই ভালো, আমি খুবই সুন্দর…আমি…মানে আমার প্রশংসা করবে!’ পাগলের মতো চোখ-কান বুজে কথাগুলো বলে যেতে লাগল তুরিন। শাহজিদ দেখল মেয়েটা ডাঙ্গায় তোলা মাছের মতো ছটফট করছে। যেন আরেকটু হলেই শ্বাসক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাবে। মেয়েটার আসলে বয়স বাড়েনি একটুও। মানসিক পরিপক্কতা আসেনি। এখনো বয়ঃসন্ধির বালিকার মতো নড়বড়ে আর নাজুক ওর ইমোশন। শাহজিদ আর এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করল না। গলাটাকে উচ্চগ্রামে নিয়ে উপস্থিত সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে তুরিনের দিকে চেয়ে বলল, ‘আই অ্যাম সরি ফর হোয়াট আই সেইড বিফোর। আই ডিডন’ট মিন ইট। ট্রুথ ইজ, ইওর ড্যান্স পারফরম্যান্স ওয়াজ ট্রিমেন্ডাস। মাই পুওর হার্ট কুডন’ট হ্যাণ্ডেল ইট। সো…আই ক্রুড আপ!’ 

দুনিয়াটা বড়ই আজব জায়গা। আজ এই প্রত্যুষে, তুরিনের ভাগ্যতারকার গতিবিধি দেখে মনে হচ্ছিল শাহজিদকে দিয়ে জোর করে ক্ষমা চাওয়ানোর পরে আপাতদৃষ্টিতে সবার সামনে সে নিজেই ক্লাউন হবে। সবাই বুঝবে চিৎকার- চ্যাঁচামেচি করে বদমেজাজি আত্মম্ভরী মেয়েটি শাহজিদকে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করেছে। কিন্তু শাহজিদের অকপট, আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠস্বর ঘটনার গতি পাল্টে দিল মুহূর্তের মধ্যে। ওর চোখের দিকে চাওয়া মাত্র সবাই বুঝে গেল, এই ছেলে একটা শব্দও মিথ্যে বলছে না। যা বলছে তার শত ভাগ সত্য! 

তুরিনের ঠোঁটজোড়া কাঁপছিল। চোখের কার্নিশে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল জলের আভাস। বুকে নিঃশ্বাসের উথাল-পাতাল। খোলা চুল উড়ছে দুর্ধর্ষ হাওয়ায়। এক টুকরো ঝকঝকে পলকা রোদ গলন্ত রুপা দিয়ে ধুয়ে দিচ্ছে ওর মুখ। কী সুন্দর! যেন সাদা রঙের একটা ডানাকাটা পরি। শাহজিদ ওর চোখের ওপর অনিমেষ দৃষ্টি রেখে কথা শুরু করল, ‘অ্যান্ড…’ 

আজব ব্যাপার! বলতে গিয়ে শাহজিদ নিজের হৃৎপিণ্ডের ধুকপুক নিজের কানে শুনতে পাচ্ছে। এতটা নার্ভাস অনেকদিন লাগেনি। সে কণ্ঠস্বরের কম্পন আত্মবিশ্বাস দিয়ে ঢাকা দেয়ার চেষ্টা করে খুব বোল্ডভাবে বলল, ‘অ্যান্ড আই হ্যাভ নেভার সিন এনিওয়ান, অ্যাজ বিউটিফুল অ্যাজ ইউ…ইউ আর ডিভাইনলি বিউটিফুল!’ 

ভেতর থেকে কেউ একজন জিব টেনে ধরতে চাইছিল। চিৎকার করে বলছিল, আরে থামো থামো! বলছো কী বোকার মতো? চুপ করো! ভেতরের ডাকটা ঠিকঠাক মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই শাহজিদ কথাগুলো বলে ফেলেছিল। বলার পর ওর সুন্দর চোখ দুটির তলায়, উঁচু চিকবোনের আনাচে- কানাচে লজ্জার একটা আরক্ত আভা এসে ভিড় করেছিল। 

এদিকে তুরিনের বুকে জ্বলতে থাকা দাউদাউ করা অগ্নিকুণ্ডতে ঠাণ্ডা পানির ছিটা পড়ছিল ধীরেধীরে। রাগ-অভিমানের জড়ত্ব কেটে গিয়ে মনের দেয়ালে দেয়ালে ছড়িয়ে পড়ছিল আবেগের আলতা রং। সংকোচ মিশ্রিত অদ্ভুত এক আলোড়নে তোলপাড় হয়ে, একটু অপ্রতিভ গলায় সে আনিতাকে বলল, ‘শুনলে তো? এবার যাও!’ 

আনিতার মুখটা অপমানে কালো হলো, ‘যাব মানে? কোথায় যাব?’ 

—‘তোমার বান্ধবীকে নিয়ে কেটে পড়।’ 

কথাটা বলতে বলতে তুরিন মাটিতে বিছানো চাদরের ওপর হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়ল। তার ধারণা, সে এখান থেকে সরে পড়লেই আনিতা আর স্টেলা শাহজিদকে ছেঁকে ধরবে। আজকে এসব হবে না। হতে দেয়া যাবে না। অনেক হয়েছে। আর কত! তুরিন এই এখানটায় বসে থেকে পাহারা দেবে। কেউ যেন মানুষটার ধারে-কাছে আসতে না পারে। 

নিশা আর অর্ণব অনতিদূরে দাঁড়িয়ে ছিল। নিশার ঠোঁটে একটা ফিচেল হাসি। চোখে রহস্য। অর্ণব ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে। ঘটনার আগামাথা কিছুই যেন বুঝতে পারছে না। নিশা বলল, ‘ইয়ে…অর্ণব সাহেব, চলুন আমরা অন্যদিকে যাই। একটু হাঁটাহাঁটি করি।’ 

আনিতা অপমানিত বোধ করলেও আচরণে তা প্রকাশ করল না। কপট হাসি দিয়ে চাপা দিল ক্ষোভ। সে তুরিনের মতো বোকা নয়। পরিস্থিতি কী করে হ্যান্ডেল করতে হয় জানা আছে তার। স্টেলাকে খুব স্বাভাবিকভাবে বলল, ‘তোমার কাছে পানির বোতল হবে? খুব তেষ্টা পেয়েছে!’ 

নিশার ব্যাগটা রাখা ছিল চাদরের ওপর। শাহজিদের ঠিক পাশে। হাঁটতে যাওয়ার আগে ব্যাগ নিতে আসতে হলো ওর। একটু ঝুঁকে শাহজিদের পাশ থেকে ব্যাগটা তুলে নিতে গেল। শাহজিদ অন্যদিকে চোখ দিয়ে ঝুম হয়ে বসেছিল। নিজেকে কেমন বোকা বোকা লাগছে। নিশা আস্তে করে বলল, ‘ভালো ছিল শাহজিদ! কিন্তু কাহিনি কী? প্রেমে পড়লে নাকি? 

শাহজিদ রাগতে গিয়েও হেসে ফেলল। লাল হয়ে উঠল কান। নিশা ব্যাগ নিয়ে কেটে পড়ার পর তুরিন উৎসুক হয়ে প্রশ্ন করল, ‘উনি কী বললেন?’ 

শাহজিদ ঘাড় নেড়ে উড়িয়ে দিল প্রশ্নটা, ‘কিছু না!’ প্রশ্নের যথোচিত জবাব না পেয়ে তুরিন কিছুক্ষণ উত্তেজিত চোখে চেয়ে রইল নিশার চলে যাওয়া পথের দিকে। খানিক বাদে নিশার অবয়ব অদৃশ্য হলো। তুরিন ক্ষিপ্তবৎ দুটি চোখ ফিরিয়ে আনল কয়েক হাত দূরে বসে থাকা শাহজিদের ওপর। চোখে চোখ পড়া মাত্র দুজনেই কেমন একটু থমকে গেল, বিভ্রান্তির মায়াজালে বন্দি হলো, তারপর সংকোচ মিশ্রিত অপ্রস্তুত হাসি হাসল। শাহজিদ এমন তব্দা খায়নি জীবনে কখনো। যেন পাগলামির এক অথৈ খাদ পার হয়ে এলো মাত্র। মাথাটা পুরাই ফাঁকা লাগছে। কী দরকার ছিল এতগুলো কথা বলার। শুধু সরি বলে চুপ করে গেলেই তো হতো। আর এই মেয়েটা কেন দুনিয়াদারি ফেলে তার পাশে বসে আছে এখন? কী কারণে? এর সমস্যা কী? চাপা রাগে ফুঁসছিল আনিতা। শাহজিদকে ওর ভালো লাগে, এ কথা হাজার বার বলেছে তুরিনকে। তুরিনই সেই ব্যক্তি যে কি না সব সময় ভেটো দিয়ে এসেছে। ‘খোঁড়া লোকের সঙ্গে প্রেম করবা? শেষ পর্যন্ত এই তোমার রুচি? কিছুতেই এই ভুল করো না, ব্লা ব্লা ব্লা।’ এমনই সব ঋণাত্মক ভাবনা আনিতার সহজ-সরল নিষ্পাপ মনটার ওপর একটা দ্বিধার বলয় সৃষ্টি করে এসেছে সর্বক্ষণ। বয়ফ্রেন্ড তার আছে নাম কা ওয়াস্তে। কিন্তু শাহজিদের দ্বিতীয় পিস এই দুনিয়ায় আর নেই তো! মনটা সব সময় মাছির মতো ভনভন করে নিচতলার ওই কামরায় গিয়েই আটকা পড়ে। সব সময়ই একটা সন্দেহ ছিল, হয়তো তুরিন মুখে যা বলছে মনে তার ঠিক উল্টো। কারণ শাহজিদের জন্য তুরিনের চোখে অন্যরকম একটা আভা দেখতে পায় আনিতা। আজকে মনে হলো বিষয়টা এক তরফা নয়। দুদিকেই রহস্য আছে। তুরিন কি কিছু লুকোচ্ছে তার কাছ থেকে? মেয়েটা আসলে এক নম্বরের স্বার্থপর! তার বিয়ে হওয়ার কথা অর্ণবের সঙ্গে। কিন্তু এখন ভাব জমাচ্ছে শাহজিদের সঙ্গে। দুমুখো সাপ একটা! 

অর্ণব আর নিশা হাঁটছিল ঢালু পথটার ওপর দিয়ে। ওদের পেছনে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে হাঁটছে আনিতা। নিশা অর্ণবকে নিয়ে একটু দুশ্চিন্তায় আছে। বেচারা শাহজিদ-তুরিনের নাটক সিনেমা দেখার পর না জানি কী ভাবছে! নিশা কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল, ‘অর্ণব সাহেব, ঢাকায় আপনাদের বাসা কোথায়?’ 

—‘শনির আখরায় থাকতাম আগে। এখন টিকাটুলিতে। আপনার পরিবার কোথায় থাকে?’ 

—‘জি আমার বাবা-মা ঢাকায় থাকেন না। কুমিল্লায় থাকেন।’

–-‘আপনি কি এখানে পড়ালেখা করছেন? 

নিশা একটু নিভল, ‘না, আমি পড়াশোনা করছি না।’ 

অর্ণবের মনটা নিশার ব্যাপারে আরো অনেক কিছু জানার জন্য আঁকুপাঁকু করছিল। প্রশ্নগুলো সাজিয়ে নিচ্ছিল মনে মনে। হঠাৎ সেলফোনটা বেজে উঠল। নম্বর অচেনা। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে একটা ভরাট কণ্ঠ বলল, ‘অর্ণব বলছো? আমি জাহিদ। তুরিনের বাবা।’ 

অর্ণব একটু ভড়কে গেল, ‘ও আচ্ছা! আসসালামু আলাইকুম আংকেল! কেমন আছেন?’ 

—‘আমি ভালো। তোমাদের কী খবর? 

ফোনটা আসায় অর্ণবের হাঁটা থেমে গিয়েছিল। থেমেছে নিশাও। উৎসুক চোখে চেয়ে আছে অর্ণবের দিকে। তার মন বলছে ফোন এসেছে বাড়ি থেকে। 

—‘আমরা ভালো আছি।’ 

—‘কোথায় এখন?’ 

—‘কাছাকাছিই। সাউথ বোল্ডারে। টেবল মেসা।’

—‘তুরিনের সঙ্গে কথা হয়েছে তোমার?’ 

অর্ণব দমল, ‘এখনো হয়নি…মানে হচ্ছে আরকি…’ 

—‘আমার মেয়েটা একটু বদরাগী আছে। বাট শি ইজ ভেরি গুড অ্যাট হার্ট।’ 

অর্ণব কী উত্তর দেবে ভেবে না পেয়ে হাসতে লাগল নিঃশব্দে। আনিতা হেঁটে হেঁটে ওদের কাছাকাছি এসেছে। হাতে ধরা সেলফোনের স্ক্রিনে ঠেসে রেখেছে চোখ। কপালজোড়া বিরক্তির কুঞ্চন। 

—‘আর সবার কী খবর?’ 

—‘জি…সবাই ভালো আছে।’ 

—‘সব ঠিকঠাক?’ 

—‘জি।’ 

—‘তুরিনের ফোনে রিচ হচ্ছিল না। সে কি তোমার সঙ্গে আছে?’ 

অর্ণব ইতস্ততভাবে বলল, 

—‘জি না। উনি একটু অন্যদিকে আছেন।’ 

—‘বাকিরা কোথায়?’ 

—‘আমার সঙ্গে মিস আনিতা আছেন, মিস নিশা আছেন।’ 

জাহিদ একটু চুপ করে রইল। 

—‘কে ফোন করেছে?’ নিশা পরের বাড়ির জানালায় বিনা অনুমতিতে উঁকি 

দেবার মতো একটা অপরাধবোধ গলায় নিয়ে প্রশ্নটা করল। 

—‘আংকেল।’ 

—‘আংকেল?’ 

—‘জাহিদ আংকেল।’ 

নিশা রুদ্ধশ্বাসে বলল, ‘জুবিন কেমন আছে? কী করছে?’ 

অর্ণব বলল, ‘মিস নিশা কিছু জানতে চাইছেন। উনাকে ফোন দেব?’

নিশা একটু অপ্রস্তুত হলো অর্ণবের কথায়। ফোন হস্তান্তর করার কী আছে? অর্ণব নিজে প্রশ্নটা করলেই তো পারে! 

—‘হ্যাঁ নিশ্চয়ই।’ জাহিদ বলল। কিঞ্চিৎ বিরতির পর। 

ফোন হাতে নিয়ে নিশা একটু দূরে সরে এলো। তার বুক কেন যে ধড়ফড় করছে জানে না। 

—‘হ্যালো।’ 

—‘হ্যালো নিশা।’ 

—‘জুবিন কেমন আছে?’ 

—‘জুবিন ভালো আছে। আমার সঙ্গেই আছে।’ 

নিশা চুপ করে গেল। কথা খুঁজে পেল না। জাহিদের সঙ্গে এই প্রথম ফোনে কথোপকথন হচ্ছে। এর আগে কোনদিন লোকটার কণ্ঠ টেলিফোনে শোনেনি সে। কেমন অচেনা লাগছে গলাটা! অনেক কষ্টে বলল, 

—‘জুবিন কান্না করছে না তো?’ 

—‘মাঝেমধ্যে কেঁদে উঠছে।’ 

—‘কাঁদছে কেন?’ 

—‘মাকে মিস করছে মনে হয়।’ 

খুশির একটা ঢেউ উঠল নিশার মনে। 

—‘জুবিনকে বলবেন, আমিও ওকে মিস করছি।’ 

অর্ণব আর আনিতা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে নিশার দিকেই তাকাচ্ছে আড়চোখে। অস্বস্তি লাগছে নিশার। ফোনের ওপার থেকে জুবিনের মিহি গলার লুতুপুতু আওয়াজ ভেসে আসছিল। ফোন রাখতে ইচ্ছে করছিল না। নিশা ইতস্ততভাবে বলল, 

—‘বাবা-মা কেমন আছেন?’ 

—‘ভালো।’ 

—কী করছেন?’ 

—‘মা রান্নাঘরে কাজ করছেন। বাবা টিভিতে নিউজ দেখছেন।’ 

—‘আপনার স্ত্রী?’ 

—‘বাইরে গেছে।’ 

—‘কখন ফিরবে?’ 

—‘ঘণ্টা দেড়েকের মাঝেই।’ 

—‘বেশ।’ 

জাহিদ কিয়ৎক্ষণ নীরব থেকে বলল, 

—‘জুবিনের মা কখন বাড়ি ফিরবে?’ 

একটা খোঁচা লাগল নিশার বুকে। ধীরস্বরে বলল, 

—‘তাতে জুবিনের বাবার কী? 

জাহিদ হাসল, ‘জুবিন জানতে চাইছে।’

—‘তাই নাকি?’ 

—‘হুম তাই!’ 

—‘বিকেলের আগেই ফিরে আসবে।’ 

—‘আচ্ছা।’ 

—‘জুবিন আর কিছু জানতে চায়?’ 

—‘ও জানতে চাইছে মায়ের দিন কেমন কাটছে?’ 

—‘মা জুবিনকে মিস করছে।’ 

—‘জুবিনও মাকে মিস করছে।’ 

কথাটা নিশার ভালো লাগল। এত বেশি ভালো লাগল যে ভালো লাগার আচমকা জোয়ারে কাঁপন ধরল কণ্ঠস্বরে। হালকাভাবে বলল, ‘রাখছি।’ 

অর্ণব ওর ছলছল চোখের দিকে সন্দেহের চোখে চেয়েছিল। নিশা ফোনটা ফিরিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমার শরীর ভালো লাগছে না। গাড়িতে গিয়ে একটু বসি?’ 

.

একটু আগে নিশার বলে যাওয়া কথাটা শাহজিদের মস্তিষ্কে বাড়ি খাচ্ছিল থেকে থেকে। জীবনটা তার জন্য একটা চ্যালেঞ্জ। একা বেঁচে থাকার, একা সংগ্রাম করার, একা একাই হেসে উড়িয়ে দেয়ার বা কেঁদে ভাসাবার দুর্গম চ্যালেঞ্জ। মানবীর প্রেমে পড়ার মতো শৌখিনতা এই প্রতিকূল জীবনে বড্ড বেমানান। প্রেম তো দূরের কথা, মেয়েমানুষের শরীর কামনা করার মধ্যেও একটা অশুচি বোধ কাজ করে ভেতরে। পরাজয়ের ঘ্রাণ পায়। তবে আজ একটু আগে বুঝি অদ্ভুত একটা পরাজয় খুব নিভৃতে ঘটে গেছে। এই পরাজয় বুকের ভেতর গ্লানি সৃষ্টি করছে না। বরং একটা নাম না জানা ভেজা ভেজা অনুভূতিতে ছেয়ে আছে সমস্ত সত্তা। তুরিন যখন গত তিন বছরের বাধা, সংকোচ, অবহেলা আর দূরত্ব ডিঙিয়ে ঝপ করে পাশে এসে বসল, ঠিক সেই মুহূর্তে পাহাড়ের কাছে হেরে যাওয়া বিধ্বংসী মনটার মাঝেও যেন একটা জয়ভেরির ডমরু বেজে উঠল। যে পাহাড়ের বিশালতা অষ্টপ্রহর কটাক্ষ করে আসছিল, তপ্ত শেলের মতো বিঁধছিল বুকে, সেই প্রকাণ্ড পাহাড়ের নির্মম পরিহাসও সহনশীল হয়ে উঠল। আশ্চর্য বটে! 

তুরিনের কপাল থেকে কুঞ্চন মুছে গেছে। সরে গেছে ঠোঁটের কোণের ঝাঁজালো ভাঁজ। কী রকম যেন নরম একটা আদুরে আবরণে ভরে গেছে ওর সারা শরীর। হতাশায়, অবহেলায় তার মনটা বদ্ধ পচা পুকুরে সাঁতরে বেড়ানো মাছের মতো হয়ে গিয়েছিল। আজকে যেন সেই মাছ পরিষ্কার টলটলে পানি পেল। মজা পুকুর থেকে ঝাঁপ দিল সমুদ্দুরে! শুধু কাছাকাছি চুপ করে বসে থাকাতেই যে এমন বিপুল মুক্তি মিলবে তা কে জানত! 

এখন রোদ কমে গেছে। বাতাস আগের চেয়ে ঠাণ্ডা। সামনের সুবিশাল নরম আকাশে এই মাত্র কোন শিল্পী যেন গাঢ় নীল রঙের কয়েকটা মেঘ এঁকে দিয়ে গেছে। 

তুরিনই কথা বলল প্রথম, 

—‘শেভ করেন না কেন?’ 

শাহজিদ গালের আধ ইঞ্চি লম্বা দাড়ি হাতড়ে উদাসভাবে বলল, ‘ইচ্ছে করে না।’ 

—‘ইচ্ছে না করলেও করবেন।’ 

শাহজিদের চোখে একটা দুষ্টু অথচ মিষ্টি হাসির প্রলেপ পড়েছে। ঠোঁটের কোণে ফিরে এসেছে আত্মবিশ্বাসের ঝিলিক। তুরিনের আরক্ত মুখের দিকে চেয়ে সে সকৌতুকে বলল, ‘এটা কি অনুরোধ? নাকি আদেশ?’ 

একটা নীল পাখনার ম্যাগপাই পাখি রুক্ষ সোনালি ঘাসের ওপর তিড়িং- বিড়িং করে লাফাচ্ছিল। ডাকছিল কাকে যেন আনচান গলায়। অস্থিরমতি পাখিটার ওপর অস্থির দুটি চোখ রেখে তুরিন কেটে কেটে বলল, ‘হবে কিছু একটা। শেভ করবেন, চুল কাটবেন। এরকম পাগলের মতো হয়ে থাকবেন না।’ 

শাহজিদের চোখে এখনো দুষ্টু হাসির ঝিকিমিকি। ডান দিকের গালে জিব ঠেকিয়ে, মুখ বাঁকিয়ে কী যেন ভাবল একটু। তারপর ঠোঁট উল্টে বলল, ‘নিশ্চয়ই! আপনার কথা তো শুনতেই হবে। নইলে কখন আবার বইয়ের মতো আমাকেও ছুড়ে ফেলে দেন পাহাড় থেকে…বলা যায় না!’ 

তুরিন কিছু বলল না। চোখে-মুখে লজ্জার আবির রং ছড়িয়ে চুপ করে রইল। 

—‘বাই দ্য ওয়ে, আমার পছন্দের বই ছিল। ফেলে দিলেন কেন?’

তুরিন চুপ। 

—‘মানুষের ওপর অত্যাচার তাও মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু বইয়ের ওপর এমন জুলুম মেনে নেওয়া যায় না। আপনার পানিশমেন্ট হওয়া উচিত।’ 

—‘পানিশমেন্ট তো হওয়া উচিত আপনার!’

—‘আমি কী করলাম?’ 

—’মিথ্যে বলেছিলেন কেন?’ 

—’কখন মিথ্যে বললাম? 

—‘ওই যে বললেন আমার নাকি টেরিবল পারফরমেন্স, ব্লা ব্লা… শাহজিদ রহস্য নিয়ে বলল, ‘সত্য-মিথ্যা যাচাই করা কঠিন ব্যাপার। তুরিন ঘুরে তাকাল, ‘আচ্ছা? তা এই মাত্র যে বললেন আমার চেয়ে সুন্দর মানুষ আর দেখেননি ওটা মিথ্যে ছিল?’ 

—‘আপনি বিশ্বাস করেছেন? সিরিয়াসলি? আপনার মতো মেইড ইন চায়না হবে পৃথিবীর সেরা সুন্দরী? অ্যাবসার্ড!’ হাসতে হাসতে বলছিল শাহজিদ কথাগুলো। দারুণ কিন্তু ওর বলার ভঙ্গিটা। তুরিন মুগ্ধ দুটি চোখ পেতে রইল খানিকক্ষণ ওই এলোমেলো চুল দাড়িওয়ালা সুন্দর মুখের ওপর। লঘু সব কথার ভিড়ে গুরুত্বপূর্ণ কথারা কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছিল ক্রমশ। শাহজিদের জানার ছিল গত তিনটি বছর তুরিন কেন তাকে অবহেলা করেছে? কেন বদলে গিয়েছিল হঠাৎ? তুরিনেরও জানার ছিল,… সেই সন্ধ্যায় শাহজিদের অ্যাপার্টমেন্টের নিচে যে দৃশ্যটি সে দেখেছিল সেই দৃশ্যটা কতভাগ সত্য? নিশার সঙ্গে শাহজিদের সম্পর্ক কী? নিশা এবং তুরিন, এই দুজনের মধ্যে কাউকে বেছে নিতে হলে শাহজিদ কাকে বেছে নেবে? মনের ভেতরের কূট চিন্তাসংলগ্ন সন্দেহের গ্যাজলা ওঠা কথাগুলো কেন যেন এই সুন্দর সময়টায় বলতে ইচ্ছে করছিল না একদম। 

সেই সময় হঠাৎ স্টেলাকে দেখা গেল আবার। হাসি হাসি মুখে এদিকেই এগিয়ে আসছে মেয়েটা। 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *