বরফকুচি খামে দূর পাহাড়ের ডাক – ২

একটা আর্তচিৎকার ছিটকে বেরিয়ে এসেছিল শাহজিদের মুখ থেকে। স্থানচ্যুত হয়ে পড়ল হাতের ক্রাচ। খসে পড়ল সেলফোন। মুহূর্তের মধ্যে তার পাঁচ ফিট দশ ইঞ্চির দিঘল শরীরটা নুড়ি পাথর আর ছোট-বড় আগাছাযুক্ত রুক্ষ মাটিতে চিত হয়ে পড়ে গেল কাটা গাছের মতো। মাথাটা ঠাশ করে লাগল কোথাও। পাথর-টাথর কিছু হবে হয়তো। যন্ত্রণায় চোখ বুজে ফেলল শাহজিদ। আর ঠিক সেই মুহূর্তে অনেক অনেক দিন বাদে ডান পায়ের জায়গাটায় একটা দুঃসহ শূন্যতা অনুভব করল। দুই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারলে একটা সামান্য লাথি আজকে তাকে এভাবে কাবু করতে পারত না! কার্লোস তখন হাতের আঙুল উঁচিয়ে গলায় বিষ ঢেলে বলছে, ‘পঙ্গু হয়ে তুমি আমার সঙ্গে লড়তে এলে। সাহস তো কম না! ক্রিপলড কোথাকার!’ তুরিনের কাশি থেমে গেছে। হতভম্ব চোখে একবার কার্লোসের রুদ্রমূর্তির দিকে আরেকবার আহত শাহজিদের দিকে তাকাল সে। মিনিট অতিক্রম হওয়ার আগেই আচমকা ফুঁসে উঠল আগ্নেয়গিরির মতো। যন্ত্রণাবিদ্ধ দুর্বল শরীরটাকে টেনেহিঁচড়ে ছেঁচড়ে তুলে আনল পানির ওপরে। ক্ষ্যাপা বাঘিনীর মতো কার্লোসের দিকে ছুটে গিয়ে জ্যাকেটের কলার খামচে ধরে চিৎকার করে বলল, ‘মারলে কেন ওকে? এত সাহস তোমার! ও ক্রিপলড? আর তুমি? তুমি তো মেন্টালি ক্রিপলড! 

কার্লোসের হিংস্রতা চরম পর্যায়ে পৌঁছুতে সময় লাগল না। এক ধাক্কায় তুরিনকে কয়েক পা পিছিয়ে দিল। তারপর জানোয়ারের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর গায়ের ওপর। টেনেহিঁচড়ে খুলে ফেলল মোটা জ্যাকেট। শাহজিদ ক্লেশ জর্জরিত মাথা সামান্য তুলতেই দৃশ্যটা দেখতে পেল। ছেলেটা তুরিনের গায়ের ওপর চেপে বসে হাতের পাঁচ আঙুল দিয়ে ওর মুখ ঢেকে রেখেছে। তুরিন চিৎকার করতে পারছে না। অস্ফুট একটা গোঙানির শব্দ বেরোচ্ছে ওর মুখ থেকে। অন্ধকারে কার্লোসকে মানুষ নয়, হিংস্র শ্বাপদ জন্তুর মতো দেখাচ্ছে। ক্রাচ দুটো কোথায় ছিটকে পড়েছে কে জানে। শরীর এমনভাবে সেঁটে গেছে মাটির সঙ্গে যে নড়াচড়া করা মুশকিল। মাথাটা লোহার মতো ভারী। ঠিক কয়েক গজ দূরেই ঘটনাটা ঘটছে। শাহজিদ যেন এক গহন অন্ধকার গুহা থেকে প্রাণপণে উঠে আসতে চাইছে। পারছে না। দাঁড়াবার চেষ্টা না করে এবার মাটির ওপর ঘষটাতে ঘষটাতে রুদ্ধশ্বাসে এগিয়ে যেতে লাগল সামনে। সরীসৃপের মতো। পথের আগাছা আর পাথরে কেটে ছিঁড়ে যাচ্ছিল শরীরের বিভিন্ন জায়গা। এক হাতে কার্লোসের জ্যাকেটের পেছনটা খামছে ধরল শাহজিদ। টান দিয়ে ওই হৃষ্টপুষ্ট স্থুল দেহটাকে তুরিনের গায়ের ওপর থেকে তুলে আনতে বেশ বেগ পেতে হলো। আকস্মিক আক্রমণে কার্লোস কিঞ্চিৎ দূরে ছিটকে পড়ল। শাহজিদ ওর দুই পা টেনে ধরে কাছাকাছি নিয়ে এলো। এলোপাতাড়ি ঘুষি মারল কয়েকটা। তুরিন উঠে দাঁড়িয়েছে তখন। অন্ধকারে হাতড়ে শাহজিদের বাঁশের ক্রাচ তুলে নিয়েছে। এমন ভঙ্গিতে হাতে নিয়েছে মনে হচ্ছে যেন এখুনি কারো মাথা ফাটাবে। শত্রুপক্ষের শক্তি দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা টের পেয়ে কার্লোস দু-তিনটা লাথি মেরে শাহজিদকে একটু দূরে ঠেলে দিয়েই পড়িমরি করে ছুটে পালাল। জঙ্গলের অন্ধকারে ওর বিশাল বপুটা অদৃশ্য হতে খুব বেশি সময় লাগল না। 

তুরিনের হাতে তখনো বাঁশের ক্রাচ। মারার জন্য উদ্যত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আলুথালু চুল আর ছেঁড়া-ফাঁড়া টি-শার্ট পরিহিতা তুরিনকে দেখে মনে হচ্ছে যেন কোনগহিন অরণ্যের আদিবাসী জংলি। শাহজিদ শরীর ছেড়ে দিয়েছিল কঠিন মাটির ওপর। মাথা টনটন করছে। শরীর ব্যথা। চোখ বুজল একবার। কয়েকটা শ্বাস নিল বড় বড়। তারপর নিশ্ছিদ্র অচেতনতার গভীর খাদ থেকে যেন তুলে আনল নিজের কণ্ঠশক্তি। চোখ বুজেই প্রশ্ন করল, ‘আপনি ঠিক আছেন? 

একটা উৎকট ঝড়ের পরে তুরিন তখন লণ্ডভণ্ড, বিধ্বস্ত। হাত-পা অস্বাভাবিক কাঁপছে। মেরুদণ্ডে শীতল স্রোত। পায়ের তলায় মাটি খুঁজে পাচ্ছে না। মনে হচ্ছে এখুনি পড়ে যাবে বেহুঁশ হয়ে। ভয়ের রেশ কাটেনি। গলা দিয়ে স্বর বেরোচ্ছে না। নড়ছে না পা। কয়েক সেকেন্ড থম ধরে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর কষ্টে…অনেক কষ্টে দু পায়ে ভর দিয়ে শাহজিদের লুটিয়ে থাকা শরীরটার দিকে এগিয়ে যেতে পারল। হাঁটু গেঁড়ে বসে একটু ঝুঁকে ফ্যাসফ্যাসে কাঁপা গলায় বলল, ‘আপনার কি বেশি লেগেছে? অ্যাম্বুলেন্স কল করব?’ 

—‘অ্যাম্বুলেন্স লাগবে না। পুলিশে রিপোর্ট করা দরকার।’ 

পুলিশের কথায় বিচলিত হয় তুরিন। পুলিশ রিপোর্ট মানেই বাবা-মা-দাদা দাদিসহ পুরো পরিবারের কানে ঘটনাটা তুলে দেয়া। সে নার্ভাসভাবে বলল, ‘রিপোর্ট করা যাবে পরে। আপনি উঠুন আগে।’ 

তুরিনের কাঁধে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল শাহজিদ, এক পায়ে। একটা ক্রাচ ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে অপর ক্রাচটা খুঁজতে লাগল তুরিন। ধারে-কাছে কোথাও নেই। জলে পড়ে গেছে কিংবা কোন পাথরের আনাচে-কানাচে লুকিয়ে আছে। 

—‘অন্ধকারে পাওয়া যাচ্ছে না। কাল দিনের আলোয় খুঁজতে হবে। আপনি একটা ক্রাচ দিয়ে হাঁটতে পারবেন?’ তুরিনের প্রশ্ন। 

—‘পারব আশা করি।’ কথাটা বলে শাহজিদ পা এগিয়ে দিয়েছিল। ওকে একটু টলতে দেখেই তুরিন ঝড়ের গতিতে এগিয়ে এসে ডান কনুইটা ধরে ফেলল। শুকনো গাছের ডাল, বরফ আর আগাছা মাড়িয়ে দুজনে আস্তে আস্তে চলতে লাগল বাড়ির দিকে। সারা পথে কেউ কোন কথা বলল না। একটা অস্বস্তিজনক বাকরুদ্ধতা ঘিরে থাকল দুজনকে। নিঃশ্বাস ফেলতেও যেন অস্বস্তি হচ্ছিল। ভাগ্যিস ব্যাকইয়ার্ডের আলো জ্বলছে না। কিন্তু ডেকের ওপর কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে ছায়ামূর্তিটা দেখেই মনে মনে শিউরে উঠল তুরিন। কে ওটা? দাদাজান নয়তো? 

স্লাইডিং ডোর খুলে ঘরে ঢুকল ওরা। শাহজিদকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে কানার মতো হাতড়ে হাতড়ে বাতির সুইচ খুঁজে পেল তুরিন। হঠাৎ পাওয়া আলোটা দুজনেরই চোখে ছুড়ির মতো বিঁধল। কয়েকটা সেকেন্ড কাটার পর আলো সয়ে এলো চোখে। শাহজিদ ধুলো আর মাটি লাগা জ্যাকেটটা গা থেকে খুলতে খুলতে চোখা চোখে তুরিনকে দেখছিল। মেয়েটার চুলের অবস্থা এলোমেলো। ঠোঁটের পাশে রক্তের দাগ। পরনের হলুদ টি-শার্ট ছিঁড়ে গেছে অনেকখানি। ফরসা গলায় কার্লোসের পাঁচ আঙুলের ছাপ। ছোট ছোট বঙ্কিম চোখে এখনো লেপ্টে আছে ভয়। 

—‘ক্লজেটটা খুলুন। ওপরের তাকে ফার্স্ট এইড বক্স আছে। নিয়ে আসুন প্লিজ।’ 

তুরিন খুব আড়ষ্টভাবে শাহজিদের দিকে তাকাল একবার। কালো টি-শার্ট পরা দাড়ি-গোঁফওয়ালা ছেলেটা ওর দিকেই তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে ছিল। দুই জোড়া দৃষ্টি একটি গন্তব্যে মিলিত হতেই কেমন যেন গা ছমছম করে উঠল। হঠাৎ মনে হলো এর সঙ্গে একলা ঘরে মুখোমুখি হওয়ার চাইতে কার্লোসের অত্যাচার সহ্য করাও ঢের সহজ ছিল। তুরিন বেসামাল গলায় বলল, ‘আপনার কোথায় লেগেছে?’ 

শাহজিদ দুই হাতের তালু প্রদর্শন করল। দুই হাতেই একাধিক কাঁটাছেঁড়া। ওর ভ্রু কুঞ্চিত। চোয়াল শক্ত। চোখে রাজ্যের বিরক্তি। হঠাৎ কী যেন মনে পড়তেই প্যান্টের পকেট হাতড়াতে হাতড়াতে বলল, 

—‘শিট…আমার মোবাইল কোথায়?’ 

তুরিন ক্লজেট থেকে ফার্স্টএইড বক্স নামাচ্ছিল। ধীর স্বরে বলল, ‘আমার কাছে আছে। আমি খুঁজে পেয়েছিলাম।’ 

হাঁফ ছাড়ল শাহজিদ, ‘থ্যাংক গড!’ 

শব্দদুটো উচ্চারণ করে তুরিনের মুখের ওপর একবার চোখ ফেলল। কিছুটা কুণ্ঠার সঙ্গে বলল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ।’ 

তুরিন পকেট থেকে শাহজিদের ফোনটা বের করে রাখল পড়ার টেবিলের ওপর। তারপর হাতে বাক্সটা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্তভাবে দাঁড়িয়ে রইল। 

—‘দাঁড়িয়েই থাকবেন?’ শাহজিদ ওর হ্যাজেল রঙের বিমোহন চোখজোড়ায় একটু ভর্ৎসনার ঢেউ তুলল। 

অন্যসময় হলে তুরিন রেগে যেত। কিন্তু আজকের পরিস্থিতি ব্যতিক্রম। অনেক বড় বিপদের হাত থেকে আল্লাহর রহমতে বেঁচে ফিরে আসতে পেরেছে। অতএব তার দম্ভ এখন স্তিমিত। ভেতর থেকে ভয়ের রেশ কাটেনি। মেজাজ-মর্জি অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনুকূলে রাখতে হচ্ছে। তার ওপর এমন বিব্রতকর পরিস্থিতি। হম্বিতম্বি দেখানোর সময় যে এটা না অন্তত এতটুকু বোঝার মতো কমনসেন্স তার আছে। সে ধীর পায়ে এগিয়ে এলো সামনে। বসল বিছানার ওপর। শাহজিদের একটা পা ঝুলছিল বিছানার বাইরে। অপর পায়ের জায়গাটা শূন্য। প্যান্টের কাপড় দুলছে একটু একটু। তুরিনের হাত কাঁপছিল। একটা অবাধ্য কান্নার ঢেউ ঝাঁপ মেরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। প্রাণপণে কান্না চাপাচ্ছে সে। শাহজিদ দেখছিল ওর শঙ্কিত চোখ, থরথর করে কাঁপতে থাকা ঠোঁট। তুলতুলে গাল। কী ইনোসেন্ট! কিন্তু ভেতরটা? ভেতরটা যে কী বীভৎস কুৎসিত তা শাহজিদের চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না! 

তুরিন অনভিজ্ঞ হাতে ফার্স্টএইড বক্সের জিনিসগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। শাহজিদ ভ্রু কুঁচকে তীক্ষ্ণ চোখে ওর কর্মকাণ্ড দেখে যাচ্ছে। কাঁপা হাতে তুরিন এক টুকরো তুলোতে এন্টিসেপটিক লাগাল। তারপর কী করবে খুঁজে না পেয়ে তুলোর দলা একপাশে রেখে ছোট একটা গজ তুলে নিল ক্লিনিংয়ের জন্য। শাহজিদের কপালে চোট লেগেছিল হালকা। তুরিন গজটা ওর কপালের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতেই শাহজিদ খপ করে হাতটা ধরে ফেলল। ধক করে উঠল তুরিনের বুক। শাহজিদ গম্ভীরভাবে ওর হাতের মুঠো থেকে গজটা তুলে নিল। তারপর একটিও বাক্য ব্যয় না করে নির্দ্বিধায় ওর ঠোঁটের বাঁ পাশ দিয়ে গড়িয়ে পরা জমাটবাঁধা রক্ত মুছে নিল। তুরিন ঘটনার আকস্মিকতায় দম নিতে ভুলে গিয়েছিল। এতক্ষণ ব্যথা-যন্ত্রণার অস্তিত্ব ছিল না। হঠাৎ আকাশছোঁয়া যন্ত্রণা যেন বিদ্যুতের মতো চিলিক দিয়ে ফিরে এলো শরীর আর মনের সমস্ত আনাচ কানাচে। আটকে রাখা কান্নাটা এবার বাধ ভাঙল। থমকে গেল শাহজিদের হাত। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে চোখ বন্ধ করে কান্না চাপানোর চেষ্টা করছে তুরিন। বদ্ধ চোখের দুয়ার উপচে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। রক্তাভ গালের চামড়ায় রুপোর মতো চিকচিক করছে জলবিন্দু। হঠাৎ একটা আশ্চর্যজনক অস্বস্তি শাহজিদকে ঘিরে ধরল। নিশা ছাড়া অন্য কোন মেয়ের সঙ্গে ইদানীংকালে মেলামেশা হয় না। কিন্তু নিশার উপস্থিতি কখনো তার জন্য অস্বস্তির উদ্রেক করে না। আজকের এই অদ্ভুত অস্বস্তির কারণ কী? সে হাত নামিয়ে নিয়ে একটু বিব্রতভাবে বলল, ‘আমার মনে হয় আপনার এখুনি পুলিশ কমপ্লেইন করা উচিত।’ 

কান্না চাপানোর চেষ্টা করল তুরিন, ‘না!’ 

—‘কেন নয়?’ শাহজিদ অবাক। 

—‘পুলিশ কমপ্লেইন করলে বাড়ির মানুষ জেনে যাবে।’ 

—‘জানলে সমস্যা কী? বাড়ির লোকে জানবে বলে একটা ক্রিমিনালের শাস্তি হবে না?’ 

—‘ওকে শাস্তি দিতে গিয়ে তো আমি ফেঁসে যাব। যখন জানতে চাইবে এত রাতে ক্রিকের ধারে কেন গিয়েছিলাম তখন কী জবাব দেব?’ 

—‘সঠিক জবাবটাই দেবেন। বাই দ্যা ওয়ে…কেন গিয়েছিলেন?’ প্রশ্নটা করে একটু থামল শাহজিদ। চোখা চোখে তাকাল তুরিনের দিকে, ‘ওই স্টুপিড বাস্টার্ডটা আপনার বয়ফ্রেন্ড নাকি?’ 

—‘মাথা খারাপ!’ 

—‘তাহলে?’ 

তুরিন দুর্বল চোখে তাকাল শাহজিদের দিকে। কী করে বলবে যে প্রশ্নকর্তার করা অপমান সইতে না পেরেই মনের দুঃখে একলা একলা বসে ছিল ক্রিকের ধারে। খুব মন খারাপের সময় তার স্মোক করতে মন চায়। আজকেও মন খুব বেশি খারাপ ছিল। অন্ধকারে একলা বসে স্মোক করছিল। অকস্মাৎ বজ্রপাতের মতো দৃশ্যপটে পতিত হলো কার্লোস। সব দোষ শাহজিদের। বলতে ইচ্ছে হলো অনেক কিছু। জমে থাকা অপমান, রাগ, প্রতিশোধপরায়ণতা… যা এতকাল বুকের মধ্যে মাথা কুটে কুটে মরছিল…সমস্তটা উগড়ে দিয়ে…উজাড় করে দিয়ে…এই সদম্ভে ডগমগ করা আশ্চর্য ছেলেটার কাছে নিজেকে সমর্পণ করার নির্লজ্জ বাসনা চেপে বসল মাথায়। কিন্তু একটা বাক্যও উচ্চারণ করতে পারল না। শুধু কান্না চাপা ঝাপসা দুটি চোখ মেলে চেয়ে রইল। আজকে…অনেকদিন বাদে একে সে এত কাছ থেকে দেখছে। লালচে দাড়ি গোঁফের পেছনে এখনো আগের সেই রক্ত ঝিম ধরা সুন্দর মুখটা রয়ে গেছে। পাল্টায়নি একটুও। শাহজিদ কী বলবে খুঁজে পাচ্ছিল না। মাথার ভেতর একটা ব্ল্যাংকনেস কাজ করছে। আকস্মিক…খুব আকস্মিকভাবে শাহজিদের চোখজোড়া চুম্বকের মতো তুরিনের ছেঁড়া টি-শার্টের ওপর নিবদ্ধ হলো। সে দেখল বিদীর্ণ হওয়া হলুদ টি-শার্টের ফোঁকর দিয়ে উঁকি দিচ্ছে সাদা লঞ্জারি, তার ঠিক মাঝবরাবর ধবল দুটি পায়রার মসৃণ ভাঁজ…আর ঠিক তখনই হঠাৎ দৃষ্টির বাণ গড়িয়ে পড়ল ছিপছিপে বঙ্কিম কোমরটায়…শাহজিদের অবাধ্য চোখ দেখল কমলা রঙের ফরসা কোমরে কালো কালি দিয়ে একটা উল্কি আঁকা। কী লেখা ওখানে? এক ঝলক দেখতেই বিদ্যুৎ চমক খেলে গেল বুকে। কিন্তু…মানে আসলেই? নাহ নিশ্চয়ই সে ভুল দেখছে। এমন জায়গায় যে ভালো মতো তাকানোও যায় না। একবার দেখার পর দ্বিতীয়বার দেখতে সংকোচ হচ্ছে। তুরিন নড়ে উঠেছে। বিব্রতভাবে কাপড় টেনে ঠিক করছে। চোখেমুখে হতবুদ্ধি ভাব। উল্কি আঁকা জায়গাটা আড়াল করতে চাইল সে। বাড়ির কেউ জানে না যে সে কোমরে ট্যাটু করেছে। জানলে তুলকালাম কাণ্ড করবে। দাদাজান তো মেরেই ফেলবে। ইশ…আরেকটু হলেই সর্বনাশ হয়ে যেত। সে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। পুরুষের দৃষ্টি তাকে সংকুচিত করে না কখনো, আজকে করল। লজ্জায় লাল-টাল হয়ে বেসামাল গলায় বলল, ‘কী ব্যাপার? কী দেখছেন?’ 

শাহজিদ চোখ সরিয়ে নিয়েছে। কান ঝাঁঝাঁ করছে। কোন শব্দ বেরোচ্ছে না মুখ দিয়ে। একটা হতভম্ব ভাব সমস্ত চেতনাকে নিঃসাড় করে দিচ্ছে। কী দেখল মাত্র? এটাও কি হতে পারে? অসম্ভব! 

প্রথম প্রেম 

শাহজিদ চোখের কিনার দিয়ে দেখল একবার। কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে তুরিন। ওর দিকে সরাসরি তাকানো যাচ্ছে না। কেন যাচ্ছে না সে কারণ স্পষ্ট নয়। এমন আড়ষ্টতা শাহজিদের চিরাচরিত স্বভাব চরিত্রের বিপরীত। ধাক্কাটা এখনো সামলে উঠতে পারেনি সে। মনে হচ্ছে একটা বিভ্রমের ভেতরে আছে। কিয়ৎক্ষণ আগে চর্মচক্ষুতে যা দেখল, তা কোনভাবেই বাস্তব হতে পারে না…আর হলেও…না…ভাবাই যায় না! 

—‘একটা কোট দেবেন? আমার জ্যাকেট ভুলে ফেলে এসেছি জঙ্গলে।

—‘নিশ্চয়ই।’ 

বিছানা থেকে নামতে গিয়ে স্মরণে এলো ক্রাচ বা হুইলচেয়ার ছাড়া এক পায়ে ক্লজেটের কাছে যাওয়ার সামর্থ্য তার নেই। দমে গেল মনে মনে। 

—‘ক্লজেটে আছে। একটু নিয়ে নেবেন কষ্ট করে?’

তুরিন আদেশ পালন করল। বাছাবাছি করল না। ক্লজেটের ডোর খুলে সামনের সারিতে ঝুলিয়ে রাখা একটা নেভি-ব্লু রঙের জ্যাকেট তুলে নিল হাতে। এই ঘরের সব কিছুই অনেক গোছানো। ব্যাচেলরদের ঘর সাধারণত এত পরিপাটি হয় না। এসবের দেখভাল কে করে? নিজেকে প্রশ্ন করে নিজের মনেই উত্তরটা পেয়ে যায়। কে আবার? সে…যে তার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী, তার মায়ের সতিন, আর তার সত্মা। মনে পড়তেই বিশেষভাবে সচেতন হয়ে ওঠে ভেতরটা। এখানে তো রোজ আসে ওই অসহ্য মেয়ে। যে মেয়ে তুরিনের ব্যক্তিগত পারিবারিক সুখ-শান্তি কেড়ে নিয়েছে, ছারখার করেছে বাবা-মায়ের দাম্পত্য জীবন, আর যে মেয়ের খুব কাছের বন্ধু(প্রেমিকও হতে পারে) সেই মানুষটা…যে মানুষটা তুরিনকে জীবনের সব থেকে ভয়ংকর কষ্টটা উপহার দিয়েছে। অদৃষ্টের কী সকরুণ প্রহসন! যাকে কোন দিন ক্ষমা করবে না বলে মনে মনে শপথ নিয়েছিল একদিন। আজ সকালেও যার সঙ্গে কোমর বেঁধে ঝগড়া করেছে, মনে মনে অভিসম্পাত করেছে, ঘৃণা করেছে প্রাণ ভরে। এই মুহূর্তে সেই বিশেষ বিদ্বিষ্ট ব্যক্তিটিরই সম্মুখে, করুণার পাত্র হয়ে মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। সাহায্য প্রার্থনা করতে হচ্ছে। ইশ! অপমানের দুষিত বায়ুতে তার শ্বাসনালি বিষাক্ত হয়ে উঠল হঠাৎ। এত অপমান নিয়ে মানুষ বেঁচে থাকে কী করে! তার উচিত পানিতে ডুবে মরা। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো তার এখন একটুও মরতে ইচ্ছে করছে না। অপমানের বিষ বায়ুটাও কোন এক আজব কারণে সহনীয় লাগছে। হাতে ধরা পলিস্টারের নরম জ্যাকেটটা থেকে একটা সুন্দর ঘ্রাণ উড়ে এসে লাগছে নাকে। উপবাসী মনের জানালার বদ্ধ কাচে সেই ঘ্রাণটা বিন্দু বিন্দু বাষ্পকণার মতো জমতে শুরু করেছে। যেন বৃষ্টি নামার আগে জমাট বাঁধছে মেঘ। তুরিন লাজুকভাবে জ্যাকেটটা গায়ে জড়িয়ে নিল। অনেক বড়। এই অবস্থায় যে কেউ তাকে দেখলে বুঝবে অন্যের কাছ থেকে ধার করা কাপড় গায়ে চড়িয়েছে সে। বুঝলেও বা কী করার আছে! ছেঁড়া টি-শার্ট আর আহত শরীর আড়াল করার এর চেয়ে উত্তম উপায় এখন আর নেই। 

শাহজিদ বিছানা ছেড়ে উঠতে গিয়েও শেষমেশ আর ওঠেনি। তার ওঠা তো আর সাধারণ মানুষের মতো সহজ নয়। কেন যেন মেয়েটির সামনে নিজের পঙ্গু জীবনের দুর্বিষহ বৃত্তান্ত জাহির করতে এখন ইচ্ছে করছে না। 

—‘আমি যাই।’ তুরিন বলল। ইয়া বড় লম্বা ঢলঢলে জ্যাকেটটা পরার পর ওকে পেটমোটা কিউট পেঙ্গুইনের মতো দেখাচ্ছিল। লালচে গাল, পাতলা ফিনফিনে গোলাপি ঠোঁট, পুতুপুতু ছোট চোখ…সব মিলিয়ে দারুণ মিষ্টি একটা প্যাকেজ। শাহজিদের ঠোঁটে আলতো একটা বঙ্কিম রেখা ফুটে উঠছিল ধীরেধীরে। কী যেন বলতে গিয়েও বলল না আবার। চোখে ঝিকিমিকি হাসির আভাস নিয়ে তাকিয়ে রইল শুধু। 

তুরিন ছুটে গেল সিঁড়ির দিকে। ভয় করছিল ওর। এই বাড়িটা কখনোই নিরিবিলি পাওয়া যায় না। একগাদা মানুষ গিজগিজ করে সর্বত্র। কী করে সবার নজর বাঁচিয়ে নিজের শোবার ঘর অবধি পৌঁছুবে সেই দুশ্চিন্তায় কাঁটা হয়ে আছে ভেতরটা। ভাগ্য ভালো ছিল শুধু দাদিজান আর আনিতা ছাড়া অন্য কারো মুখোমুখি হতে হলো না। আনিতা ওর পেছন পেছন আসছিল 

—‘কী ব্যাপার? এটা কার জ্যাকেট পরেছ তুমি?’ 

তুরিন উত্তর না দিয়ে ঝড়ের বেগে হাঁটছিল। নিজের ঘরে এসে আনিতার মুখের ওপর দরজাটা সটান বন্ধ করে দিল। বাতি জ্বালাল না। দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। হৃৎপিণ্ড খাঁচায় বন্দি পাখির মতো ডানা ঝাপটে যাচ্ছে। মাথাটা শূন্য। কতক্ষণ যে কাটল তা সঠিকভাবে ঠাওর করা গেল না। একটা সময় গায়ের জ্যাকেটটা খুলে নিয়ে দুমড়ে মুচড়ে বুকের ভেতর চেপে ধরল সে আদুরে বিড়াল ছানার মতো। পায়ে পায়ে হেঁটে বিছানার কাছে এগিয়ে এলো। শুয়ে পড়ল জ্যাকেটটা কোলবালিশের মতো জড়িয়ে ধরে। ঘরের ভেতর ঝুপসি অন্ধকার। জানালার কাচের বাইরে সাদা রাত। তুরিনের নরম শরীরটার নানা জায়গায় কাটাছেঁড়া। একটা ভয়ংকর দুর্ঘটনার মুখ থেকে অলৌকিকভাবে ফিরে এসেছে সে। কিন্তু সেই দুর্ঘটনার বিন্দু মাত্র আঁচড় এখন তার মনের মাঝে নেই। বুকে ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ ভাঙছে আবেগ। জ্যাকেটের স্পর্শ এক আশ্চর্য শিহরণ জাগাচ্ছে রক্তে। প্রথমবার দেখা হয়েছিল রকি মাউন্টেনে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে বারো হাজার ফিট উঁচুতে। তখন বসন্তকাল। কিন্তু পাহাড়ের ওপর ঋতুবৈচিত্র্য বলতে কিছুই নেই। ওখানে সারাবছর বরফকুচি শীতল হাওয়া। পাহাড়ের গায়ে সরু রুপালি সিমেন্টের সিঁড়ি। স্টাডি ট্যুরের ছেলেমেয়েরা সব হইহই করে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছে। বিরতিহীন সিঁড়িটার দিকে তাকালে মনে হয় যেন এতে চড়ে আকাশে পৌঁছে যাওয়া যাবে। মাঝসিঁড়িতে এসে থমকে গিয়েছে তুরিন। হঠাৎ করেই তার শ্বাসক্রিয়ায় জটিলতা দেখা দিয়েছে। কষ্ট হচ্ছে নিশ্বাস নিতে। বন্ধুদের দেখাদেখি একটানা উঠে আসা ভুল হয়েছে। থেমে থেমে ওঠা উচিত ছিল। চারিদিকে বালুর মতো চিকচিক করছে রোদ্দুর। তুরিনের পরনে একটা গোলাপি রঙের উইন্ডব্রেকার। সিল্কি চুলগুলো বাঁধা ছিল উঁচু করে। বাতাসের ধাক্কায় এইমাত্র খুলে গেছে। চোখেমুখে চুলের ঝাপটা এসে লাগছে। এত বাতাস! মনে হচ্ছে যেন বাতাসের সমুদ্রে ডুবে আছে। বন্ধুদের কেউ কেউ অনেক আগেই উঠে গেছে চূড়োয়। কেউ কেউ আবার পিছিয়ে পড়েছে। এখানে টেম্পারেচার মাইনাস থার্টিন। হাড়কাঁপানো শীত। তুরিনের মনে হচ্ছিল দম আটকে মরে যাবে। নাক দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানি। মুখ হাঁ করে নিঃশ্বাস নেবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হচ্ছে। কাউকে গলা ছেড়ে ডাকবে সেই শক্তিও নেই। সমগ্র বিশ্বরঙ্গভূমি ক্রমেই ঝাপসা হয়ে আসছে। প্রেতাত্মার দীর্ঘশ্বাসের মতো কাঁদছে বাতাস। রোদের তেজি করাঘাতে ঝলসে যাচ্ছে চোখ। হঠাৎ একটা কণ্ঠস্বর কানে এসে লাগে, ‘আর ইউ ওকে?’ তুরিন দেখল নেভি-ব্লু রঙের জ্যাকেট পরা একটা লম্বা ছেলে চোখে রোদচশমা নিয়ে ঝুঁকে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ছেলেটা ওর দিকে পানির বোতল এগিয়ে দিল, ‘ড্রিংক সাম ওয়াটার। ইউ উইল ফিল বেটার।’ তুরিন পানির বোতলটা হাত বাড়িয়ে তুলে নিল। ঢালল গলায় ঢকঢক করে। পানিটুকু পান করার পর যেন শ্বাসক্রিয়া আগের চাইতে একটু স্বাভাবিক হলো। ছেলেটা বলল, ‘মনে হচ্ছে তুমি চোখ খুলতে পারছ না। সানগ্লাস পরোনি কেন?’ কথাটা বলতে বলতে সে নিজের চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে তুরিনের চোখে পরিয়ে দিল। পোলারাইজড সানগ্লাসটা চোখের সামনে আসা মাত্র চারপাশ ভারি কোমল হয়ে উঠল। অনেক ক্ষণ বাদে তুরিন চোখ মেলে তাকাতে পারল। আজকে কোন আক্কেলে সানগ্লাসটা বাড়িতে রেখে এসেছিল কে জানে! এই সানলাইট অধিষ্ঠিত রাজ্যে দিনের বেলা খুব কম লোকেই সানগ্লাস ছাড়া বাড়ি থেকে বেরোয়। সামনে দাঁড়ানো ছেলেটির সম্পূর্ণ মূর্তি এতক্ষণে ভালো মতো দৃষ্টিগোচর হলো তার। সেদিন রোদচশমার কাচের ভেতর দিয়ে সে তার জীবনে দেখা সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষটিকে প্রথমবারের মতো দেখেছিল। ওই চোখের রং সোনালি, বাদামি নাকি সবুজ…তা ঠিকঠাক বোঝা গেল না। কেমন যেন অন্যরকম। পুরু ভ্রুযুগল, সরু এবং শানিত নাসিকা, মিলিটারি সোলজারদের মতো হাই চিকবোন, মেদহীন চোয়াল আর আত্মবিশ্বাসের ঝিলিক ওঠা ঝলমলে হাসি। তুরিন একটা দুর্মোচ্য সম্মোহনে ডুবে গেল যেন! 

—‘নিচে নামবে? নাকি ওপরে যাওয়ার সাহস আছে এখনো?’ ছেলেটা প্ৰশ্ন করল। তুরিনের কথা জড়িয়ে যাচ্ছে জিবে। সে কোন উত্তর দিতে পারল না। 

—‘নিঃশ্বাস নিতে পারছ এখন?’ 

তুরিন ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল। 

—‘গ্রেট। তাহলে এখন নিচে নেমে যাওয়া মানে হেরে যাওয়া। চল ওপরে।’ 

তুরিন একটা বড় দম নেওয়ার পর অস্ফুটে বলতে পারল, ‘চল!’ 

ছেলেটা পাশাপাশি হাঁটছিল। তুরিন বলল, ‘তোমার সানগ্লাস ছাড়া অসুবিধা হচ্ছে না?’ 

—‘না। আমার অভ্যাস আছে।’ আরো কয়েকটা সিঁড়ি ভাঙার পর বোঝা গেল পাহাড়ের চূড়োয় বৃষ্টি নেমেছে। এখানে আবহাওয়ার কোন ঠিক নেই। এই বৃষ্টি তো এই রোদ!বৃষ্টির ঠাণ্ডা ছাঁট এসে মুখে লাগছিল। তুরিন একটা একটা করে সিঁড়ি ভাঙছে। ছেলেটা একটু দ্বিধা নিয়ে বলল, ‘তুমি এখন ঠিক আছ? আমি কি এগিয়ে যেতে পারি?’ 

‘নিশ্চয়ই!’ তুরিন বলল ভদ্রতার গলায়। 

অনুমতি পাওয়া মাত্র ছেলেটা স্নিকারস পরা দুর্দান্ত পায়ে টগবগে ঘোড়ার মতো ছুটতে লাগল। তুরিন মুগ্ধতা নিয়ে চেয়েছিল। এক পাও এগোয়নি। ছেলেটি মাঝপথে থামল। ফিরে তাকাল পেছনে। মুহূর্ত না গড়াতেই ধুপধাপ নেমে এলো আবার নিচে। তুরিনের কাছে ফিরে এসে একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘এসো।’ যেন দেবদূত নেমে এসেছে স্বর্গ থেকে। তুরিন মোহাবিষ্ট হয়ে সেই আশ্চর্য সুন্দর দেখতে দেবদূতের সঙ্গে স্বর্গের সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে লাগল। মেঘ আর বৃষ্টিতে ওরা ভিজে যাচ্ছিল। চূড়োয় ওঠার পর বাতাসের তোড় এত বেড়ে গেল যে কথা বলা প্রায় অসম্ভব। চারধারে শুধু আকাশ আর আকাশ…রোদ আর রোদ…মেঘ আর মেঘ…বাতাসের হুংকার আর আস্ফালন! এর মাঝে একটি দৃশ্য সবার নজর কেড়ে ফেলেছে। একজোড়া শ্বেতাঙ্গ যুবক- যুবতী সবচেয়ে উঁচু শিলাখণ্ডটির ওপর আরোহণ করেছে। প্রথমে বোঝা যাচ্ছিল না ঘটনা কী ঘটতে যাচ্ছে। যুবকটি যখন যুবতীর সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়ল তখনই সকলের নজর চুম্বকের মতো আটকে গেল ওদের ওপর। তুরিনের আঠার বছরের কোমল হৃদয় বশীভূত হয়ে গিয়েছিল। এক প্রাণবন্ত স্বতশ্চাঞ্চল্য মুগ্ধতা চিকচিক করছে ওর মুখে। কেটে গেছে খানিক আগের ভয়-ভীতি, অসুস্থতা। সে পাশে দাঁড়ানো ছেলেটিকে আপ্লুত গলায় বলল, ‘কী কিউট না?’ 

ছেলেটির মুখে হাসি লেগেই থাকে। এই বুঝি তার একটা বড় গুণ। হাসতে হাসতেই বলল, ‘আমার কাছে এসব ইমোশনাল ড্রামা খুব ওভাররেটেড মনে হয়।’ 

—‘বলো কী? আমার তো ভীষণ ভালো লাগছে। ইশ আমাকে যদি কেউ এভাবে প্রপোজ করত! মাটি থেকে বারো হাজার ফিট উঁচুতে! পাহাড়ের ওপর! আকাশের বুকে!’ 

ছেলেটি তুরিনের ছেলেমানুষি কথা শুনে প্রাণ ভরে হাসল, তারপর সান্ত্বনার গলায় বলল, ‘চিন্তা কোর না। তোমার স্বপ্ন নিশ্চয়ই পূরণ হবে একদিন।’ একটু থেমে ছেলেটা প্রশ্ন করল, ‘বাই দ্য ওয়ে…তোমার নাম কী?’ 

—‘তুরিন মুর্তজা।’ 

ছেলেটির চোখে একটা বিস্ময় খেলে গেল মুহূর্তের মাঝে, ‘তুমি বাঙালি?’

—‘হ্যাঁ। কী করে বুঝলে?’ 

—‘নাম শুনে।আমিও বাঙালি। আমার নাম শাহজিদ আনাম। তুমি বাংলায় কথা বলতে পার?’ 

—‘কেন নয়? আপনি পারেন তো?’ উত্তরটা বাংলায়ই দিল তুরিন। 

—‘খুব পারি! মুর্তজা নামের একজনকে আমি চিনি। আমার বাবার পরিচিত ছিলেন। আপনি সামহাউ উনার সঙ্গে কানেক্টেড নন তো?’ 

—‘আমার দাদাজানের নাম বশির মুর্তজা। উনাকে সবাই মুর্তজা নামেই চেনে।’ 

এভাবেই শুরু। আর কী আশ্চর্য! সেদিন শাহজিদের পরনে নীল জ্যাকেটটাই ছিল। যে জ্যাকেটটা এই মুহূর্তে বুকে জড়িয়ে ধরে নিজের বিছানায় জবুথবু হয়ে শুয়ে আছে তুরিন। সেদিনের পর থেকে কী আবোলতাবোল কাণ্ড! সারাক্ষণ ওই একটা মুখ মনে পড়ে। হৃদয়ের ভেতরে, হৃদয়ের বাইরে, আকাশে বাতাসে, রাস্তা-ঘাটে সর্বত্র শুধু একটাই নাম। কলেজের বান্ধবীর সঙ্গে ট্যাটু পার্লারে গেল একদিন। ট্যাটু করানোর কোন উদ্দেশ্যই ছিল না তুরিনের। কিন্তু হঠাৎ কী এক মতিভ্রম ঘটে গেল! বান্ধবীর দেখাদেখি সে নিজেও একটা উল্কি আঁকিয়ে ফেলল শরীরে। প্রথম প্রেমের নেশায় বোকা মেয়েটার মগজে তখন শুধুই ধোঁয়াশা। আগপিছ কিছু চিন্তা না করেই নিজের সুন্দর মসৃণ কোমরের ডান পাশে ধারালো মেশিন দিয়ে একটা নাম খোদাই করাল সে। টানা হরফে গোটা গোটা অক্ষরে, ‘Shahzid’ 

এমন বোকামিও মানুষ করে? করে…কেউ কেউ করে! চোখের জলে ভিজে যাচ্ছিল বালিশ। ভিজে যাচ্ছিল বুকে চেপে ধরা জ্যাকেট। যে মানুষটার নাম খোদাই করেছিল মনের ভিতরে আর শরীরে…সেই মানুষটা তুরিনকে কখনো ভালোবাসেনি। সে ভালোবাসত অ্যাঞ্জেলিনা নামের এক রাশান মেয়েকে। তুরিন ওকে রোজ ফোন করত ছ্যাচড়ার মতো। শাহজিদ দারুণ কথা বলতে পারত। তার বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা অগণিত। কথোপকথনে তার কোন কার্পণ্য নেই। সবার সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলে ঝলমলে ব্যক্তিত্বের দুর্দান্ত এই যুবক। সবাই তাকে ভালোবাসে, সবাই তার বন্ধু হতে চায়। তুরিনও সেইসব গরপড়তা মুগ্ধ ভক্তদের দলেই মিশে গেল! 

দরজায় ধাক্কা পড়ছে। আনিতার কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। তুরিন নড়ল না। মটকা মেরে পড়ে রইল বিছানায়। 

কে তুমি সুন্দর কন্যা 

জুবিনকে নিয়ে একটু অস্বস্তিতে ভুগছিল জাহিদ। চল্লিশ বছর বয়সে নবজাতিকার বাবা হওয়া অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়, তবে পঁচিশ বছর বয়সি হবু জামাতাকে এই সংবাদ দেয়াটা বেশ বিব্রতকরই বলা চলে। তা ছাড়া সম্পর্ক হতে হলে নিশার কথাও পাত্রপক্ষকে জানাতে হবে। মুর্তজা সাহেব এর মাঝেই পাত্রের বাবার সঙ্গে এসব নিয়ে আলোচনা করেছেন কি না জানে না জাহিদ। জুবিন ঘুমিয়ে পড়েছে। ফারা ইন্টারভিউ বোর্ডের প্রশ্নকর্তার মতো একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছিল অর্ণবকে। অর্ণব মাথা নত করে অতি আদবের সঙ্গে সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। মাঝেমধ্যে ফারার প্রশ্ন ভদ্রতার চৌকাঠ ডিঙিয়ে যাচ্ছে। এই যেমন খানিক আগে সে জানতে চেয়েছে ‘তোমার বাবার বার্ষিক আয় কত?’ অর্ণব কাঁচুমাচু হয়ে বলেছে, ‘ঠিক জানি না ম্যাডাম!’ 

জাহিদ একটু পর পর ঘড়ি দেখছিল। বন্ধুর বাসায় ডিনারের দাওয়াত আছে। ধৈর্যের বিচ্যুতি ঘটল একটা সময়। ঈষৎ বিরক্তিমাখা গলায় স্ত্রীকে বলল, ‘তোমার প্রশ্নপর্ব শেষ হলে আমি একটু কথা বলতে পারি?’ 

ফারার সাংসারিক জ্ঞান জাহিদের চেয়ে উন্নত পর্যায়ের। পাছে সদ্য পরিচিত ছেলেটি তাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার সম্পর্কের তিক্ততা আঁচ করে ফেলে, সেই ভয়ে সে অত্যন্ত বিগলিত হাসি ঝুলিয়ে নিল ঠোঁটে, ‘নিশ্চয়ই!’ 

জাহিদ প্রসন্ন কণ্ঠে বলল, ‘শোন অর্ণব, তোমার বায়োডাটা আমি দেখেছি। অনেস্টলি স্পিকিং তোমার এডুকেশনাল ব্যাকগ্রাউন্ড আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমার বাবাও বেশ পছন্দ করেছেন তোমাকে। বাবার সিদ্ধান্তের ওপর সাধারণত আমরা কেউ কখনো কথা বলি না। তবে সত্যি বলতে কি আমার মেয়েটা এখনো ছেলেমানুষ। বিয়ের জন্য প্রস্তুত নয়। তোমাকে জানিয়ে রাখছি দুই পক্ষ সম্মত হলেও আমার মেয়ে কিন্তু যেকোনো মুহূর্তে বেঁকে বসতে পারে। তোমাকে একটু পেশেন্ট হতে হবে। কেমন?’ 

অর্ণবের খুব ভালো লাগল এই সোজাসাপটা কথা বলার ধরন। ঘাড় নেড়ে বাধ্য ছেলের মতো বলল, ‘জি নিশ্চয়ই। 

জুবিন এতক্ষণ ঠিকঠাক ছিল। হঠাৎ কী কারণে যেন তারস্বরে কেঁদে উঠল। কান্নার সর্বগ্রাসী দাপটে কানে তালা লাগার জোগাড়। নিশা রান্নাঘরে কাজ করছিল। মেয়ের আকস্মিক আর্তনাদ শুনে ছটফট করে উঠল। জাহিদ বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে, বাচ্চার পিঠে হাত বুলিয়ে, নড়েচড়ে, নানা ভঙ্গিমায় কান্না থামানোর চেষ্টা করছিল। সেই অবস্থায়ই অর্ণবকে বলল, ‘সম্পর্ক হোক বা না হোক…সেটা বড় কথা নয়। তুমি আমাদের গেস্ট। তোমার আপ্যায়নের সর্বোচ্চ চেষ্টা আমরা করব।’ 

হাতের কাজ ফেলে রেখে নিশা ছুটে এসেছে। চোখমুখ উদ্বিগ্ন। বাচ্চা কাঁদলে তার দুনিয়া অন্ধকার হয়ে যায়। বাস্তব জ্ঞান লোপ পায়। সে জাহিদের কোল থেকে ছোঁ মেরে ছিনিয়ে নিল জুবিনকে। জুবিনের পুতুল পুতুল মুখ চোখের পানি আর নাকের পানিতে মাখামাখি। গালদুটো টমেটোর মতো লাল। কী আদর লাগে দেখতে! নিশা মেয়েকে কোলে নিয়ে টসটস করে দুটো চুমু খেলো গালে। মুখে বলল, ‘কী হয়েছে বাবুটার? কাঁদছে কেন?’ 

অর্ণব অপরিচিতা মেয়েটির সহজ-সরল সুকুমার লালিত্য চোখ দিয়ে পান করছিল যেন। একটা অকাট্য মুগ্ধতার রেশ তার হৃৎপিণ্ডকে চেপে ধরেছে চারপাশ থেকে। জাহিদ অপ্রস্তুত বোধ করছিল। ফারার মুখে ক্রোধের স্ফুরণ খেলছে। হঠাৎ সংবিৎ ফিরল নিশার। অপরাধী চোখে একবার জাহিদের দিকে তাকাল সে। চোখ পড়ল সামনে বসা ছিপছিপে, লম্বা, শ্যামবরণ ছেলেটার দিকে। কয়েকটা থতমত খাওয়া অস্বস্তিজনক মুহূর্ত কাটল। তারপর কোন মতে সংকোচের আক্রমণ কাটিয়ে নিশা এক দৌড়ে জুবিনকে নিয়ে পালিয়ে এলো জায়গাটা থেকে। জাহিদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে অর্ণবকে বলল, ‘এসো তোমার ঘর দেখিয়ে দিই।’ 

ফারা এগিয়ে গেল সিঁড়ির দিকে। তাকে ডিনারপার্টিতে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে হবে। অর্ণবকে নিচতলার একটা গেস্টরুমে থাকতে দেয়া হলো। পায়ের তলায় নরম ঘাসের মতো কার্পেট, পরিপাটি বিছানা, চকচকে বাথটাব ওয়ালা আধুনিক সজ্জায় সজ্জিত বাথরুম…সমস্তটাই দারুণ ভালো লেগে গেল অর্ণবের। হবু শ্বশুর তাকে একলা ঘরে রেখে বিদায় নেবার পর বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল সে। চোখ বন্ধ করতেই শরৎ-মধ্যাহ্নের আলোর মতো স্নিগ্ধ একটা মুখ মানসপটের হিজিবিজি জলের ভেতর থেকে ছলাৎ করে ভেসে উঠল যেন। চমকে উঠল অর্ণব। ধড়ফড় করে উঠে বসল শোয়া থেকে। তীক্ষ্ণমুখ সুঁইয়ের মতো মস্তিষ্ক থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল একটি মাত্র প্রশ্ন, মেয়েটা কে? এই বাড়ির সঙ্গে তার কীসের সম্পর্ক? 

জুবিন কেন এত কাঁদছে কে জানে! শাশুড়িমা নিজের ঘরে এশার নামাজ আদায় করছেন। চুলায় রান্না। নিশা উদ্বেগ উত্তেজনায় একদম অস্থির হয়ে উঠল। জাহিদ অর্ণবকে ওর ঘরে ছেড়ে লিভিংরুমে ফিরে এসেছে। আনিতা কোত্থেকে যেন ঝড়ের বেগে ছুটে এলো, ‘চাচ্চু, তুরিনের কী হয়েছে জানো?’ 

—‘কী হয়েছে?’ 

আনিতা হড়বড় করে বলল, ‘জানি না তো! সেই কখন থেকে দরজা আটকে বসে আছে। ডাকলাম কত! কোন রেসপন্স করছে না!’ 

জাহিদের মুখে দুশ্চিন্তার কুয়াশা জমল, ‘কেন? হঠাৎ কী হলো?’

আনিতা ঠোঁট উল্টে বলে, ‘জানি না তো চাচ্চু! যাও তুমি গিয়ে খোঁজ নাও।’ 

জুবিনের কিন্নরকণ্ঠী কান্না তখনো আকাশ-বাতাস কাঁপাচ্ছে। জাহিদ তুরিনের ঘরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে গিয়ে থমকে গেল একবার। আনিতাকে বলল, ‘জুবিন কাঁদছে কেন একবার দ্যাখো তো মা!’ 

আনিতার সেলফোন বাজছিল। সে এমনিতেও নিশাকে সচেতনভাবে এড়িয়ে চলে। ফোনের বাহানায় চাচার উপরোধটাও এড়িয়ে যেতে পারল। 

—‘সরি চাচ্চু, ফোন এসেছে। ফোনটা রিসিভ করি প্লিজ?’ 

জাহিদ একটু দ্বিধা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। সম্ভবত নিশা এখন বাড়ির লোকের জন্য ডিনার রেডি করছে। একই সঙ্গে রান্নাঘরের কাজ করা আর বাচ্চা সামলানো নিশ্চয়ই সহজ ব্যাপার নয়। মা এই সময়টায় নামাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। বাড়িতে বাসিন্দার অভাব নেই কিন্তু কেউ কয়টা মুহূর্তের জন্য বাচ্চাটার দেখভাল করতে নারাজ। জাহিদ তুরিনের কাছে যাওয়ার আগে রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল একবার। নিশা এক হাতে কোলের বাচ্চা সামলে অন্য হাতে চুলোয় বসানো তরকারি নাড়ছে। চুলার উত্তাপ জুবিনকে আরো বেশি অস্থির করে তুলছে। জাহিদ একটু সংকুচিতভাবে পুরো দৃশ্যটা নিরীক্ষণ করছিল। নিশাকে সাহায্য করাটা তার জন্য সহজ কাজ নয়। এ কথা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার যে নিশা জগতের একটা পিঁপড়ার কাছ থেকেও সাহায্য গ্রহণ করতে রাজি আছে, কিন্তু জাহিদের করা কোন উপকার তার কাছে লাল মরিচের ঝাঁঝের চেয়েও বেশি অসহনীয়। ভাব দেখে মনে হয় যেন জুবিন তার একারই মেয়ে। জাহিদ ইতস্ততা দূরে ঠেলে কয়েক পা এগিয়ে গেল। জুবিনের দিকে দুহাত বাড়িয়ে বলল, ‘এসো আমার কাছে।’ 

জুবিন ঝাঁপ দিয়ে বাবার কোলে উঠল। কিন্তু কান্নাটা থামছিল না। নিশা চুলার আঁচ কমিয়ে দিয়ে বাচ্চার কাছে এগিয়ে এলো। 

—‘খিদে পায়নি তো ওর?’ জাহিদের প্রশ্ন। 

—‘একটু আগেই তো ফরমুলা দিলাম। থমথমে মুখে উত্তর দিল নিশা। জাহিদের দিকে না তাকিয়েই। জাহিদ লক্ষ করেছে নিশা কখনোই তার চোখে চোখে তাকায় না। হাসেও না। সব সময় চোখ-মুখ পাথরের মতো কঠিন 

—‘এত কাঁদছে কেন?’ জাহিদ উদ্বিগ্ন। 

নিশা মেয়ের গালে একটা হাত রেখে চিন্তাডুবি গলায় বলল, ‘র‍্যাশ উঠল নাকি? এত লাল কেন মুখ?’ 

বাবা-মাকে কাছাকাছি পেয়ে জুবিনের কান্নার তোড় একটু দমে এসেছিল। জাহিদ বলল, ‘ডাক্তারকে ফোন করা দরকার।’ হঠাৎ নিশার চোখ আটকে গেল রান্নাঘরের চৌকাঠে। ফারা দাঁড়িয়ে আছে কুটিলবক্র চোখ নিয়ে। তার পরনে একটা সবুজ রঙের সিল্ক শাড়ি। খোলা চুল। কড়া পারফিউমের গন্ধে ভুরভুর করছে বাতাস। ওদিকে চোখ পড়তেই নিশা একটু থমকাল। জাহিদের কোল থেকে প্রায় জোর করে জুবিনকে ছিনিয়ে নিয়ে স্পষ্ট গলায় বলল, ‘ডাক্তার লাগবে না। আপনার স্ত্রী অপেক্ষা করছে আপনার জন্য। প্লিজ আপনি যান!’ 

দেখেছিলাম আলোর নিচে; অপূর্ব সে আলো! 
স্বীকার করি, দুজনকেই মানিয়েছিল ভালো 

— জয় গোস্বামী 

তুরিনের মনটা যেন অস্থিরমতি স্পন্দমান এক প্রজাপতি! বিন্দুমাত্র স্থিতিশীলতা নেই। সারাদিনে অসংখ্যবার শাহজিদকে ফোন করে। শাহজিদ কখনোই বিরক্ত হয় না। ব্যস্ততার সময় বিনীতভাবে ক্ষমা চেয়ে নেয়। ফুরসতে ঠিক ঠিক কল ব্যাক করে। কখনো ভুলে যায় না। এত কথা হয়। তবুও আসল কথাটিই কেন যেন কেউ মুখে আনে না। অধৈর্য তুরিন ঠিক করল এবার সবটা খুলে বলবে। তখনো ড্রাইভিং লাইসেন্স হয়নি। এক বন্ধুর সঙ্গে ডেনভার গেল, শাহজিদের অ্যাপার্টমেন্টে। ওটা ছিল গ্রীষ্মের দীর্ঘতর দিনগুলোর একটা। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে আটটার ঘরে। সন্ধ্যা হয়নি তখনো। অ্যাপার্টমেন্টের নিচে আসতেই একটা ভোক্সওয়াগন গাড়ি থেকে নামতে দেখল শাহজিদকে। মনে মনে খুশি হলো তুরিন। অল্প-বিস্তর আগে পৌঁছুলে ওকে না পেয়ে ফিরে যেতে হতো। গাড়ি থেকে নামতে যাচ্ছিল,হঠাৎ করেই থমকে গেল, হারিয়ে গেল চলৎশক্তি। ভোক্সওয়াগন থেকে কোঁকড়া চুলের একটি মেয়ে নেমে এলো। দিনের শেষ সূর্যের আলোক রোশনাই তখন পৃথিবী ঝলসে দিচ্ছে। ঝলসানো সেই সোনালি আলোর নিচে, তুরিন দেখল মেয়েটি শাহজিদের গলা জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট রেখেছে। কী রকম উল্টেপাল্টে গেল দুনিয়াটা মুহূর্তের মধ্যে! শরবিদ্ধ হৃৎপিণ্ড থেকে ফিনকি দিয়ে যেন রক্ত ছুটল। তার আঠারো বছরের প্রজাপতির মতো সুন্দর, নরম হৃদয়টা কাচের টুকরোর মতো ভেঙেচুরে খানখান হয়ে গেল। ভেতরের কষ্টটা ক্রমেই দুর্দমনীয় এক ক্রোধে রূপান্তরিত হলো। সহজ-সরল হাসিখুশি মেয়েটি সব কিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করল। নিজের শরীরটাও যেন দিবা-রাত্রি তাকে উপহাস করে চলেছে। এমন মানুষের নাম সে চিরদিনের জন্য চামড়ায় খোদাই করেছে-যে কি না কখনোই তার আপন ছিল না। এই নির্বুদ্ধিতার পরিণাম ভুগতে হবে আজীবন! আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিল কয়েকবার। সফল হয়নি। ট্যাটু রিমুভ করার জন্য যে অর্থের প্রয়োজন সেটা জোগাড় করার সামর্থ্য নেই। শরীরে লেখা নাম হয়তো কোন উপায়ে অপসরণ করা যাবে। কিন্তু হৃদয়ে মুদ্রিত নামটা কী করে মুছে ফেলা যায় তুরিন তা জানে না! মরে যেতে পারলেই সবচেয়ে ভালো হতো! কিন্তু মরাটাও তো অত সহজ না। কিছুই পারে না সে, না পারে বাঁচার মতো করে বাঁচতে, না পারে মরতে! বাড়িতে থাকতেও ইচ্ছে করে না। বাবা-মায়ের যেকোনো মুহূর্তে বিচ্ছেদ হতে পারে। বিচ্ছেদের আগে তুরিনের বিয়েটা নাকি আবশ্যক। তুরিনকে বিয়ে দিয়েই মা এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। যে বাবা তার কাছে অতিমানবের চেয়ে কোন অংশে কম ছিল না, সেই বাবার চোখে চোখে তাকাতে আজকাল তার সংকোচ হয়। এমনকি ঘৃণাও হয় মাঝেমধ্যে! দাদাজানকে ভালোবাসত। কিন্তু যেদিন বাবার দ্বিতীয় বিয়ে হলো, সেদিন থেকে দাদাজানকে তার একজন খুনির চেয়েও জঘন্য অপরাধী বলে মনে হয়। বিয়ের দিন তুরিন খুব কেঁদেছিল। দাদাজান তার মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন, ‘কান্না কোর না দাদাভাই। আমি অকারণে কোন কাজ করি না। এই কাজের পেছনে একটি বিশেষ কারণ আছে। তোমাকে সবটা বলা যাচ্ছে না। একদিন হয়তো তুমি বুঝবে। 

চারটে দেয়াল মানেই নয় তো ঘর 
নিজের ঘরেও অনেক মানুষ পর : 

— অঞ্জন দত্ত 

—‘এভাবে কী দেখছ? হোয়াটস রং?’ গাড়ির সিটবেল্ট বাঁধতে বাঁধতে প্রশ্ন করল জাহিদ। ফারা ড্রাইভিং সিটে বসেছে। ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে কড়া চোখে তাকাল একবার জাহিদের দিকে। তীর্যক গলায় বলল, 

—‘আমার তো কোন সমস্যা নেই। কিন্তু তোমার মধ্যে কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে মনে হচ্ছে।’ 

—‘যা বলার সরাসরি বলো। ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা বলা আমি পছন্দ করি না!’ 

নেইবারহুডের ছিমছাম রাস্তাটা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল গাড়ি। ফারা তর্জনস্বরে বলল, ‘আজকাল অফিস থেকে ফিরে ডিরেক্ট তোমার ছোট বউয়ের ঘরে যাও দেখছি! সারাক্ষণ বাচ্চা কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াও। দুদিন পর তোমার বড় মেয়ের বিয়ে। এই সময়ে, এই বয়সে আঠারো মাসের একটা শিশুর বাবা সাজতে খুব আনন্দ হচ্ছে তাই না?’ 

জাহিদ একটা বড় শ্বাস ফেলল। চশমাটা চোখ থেকে সরিয়ে ক্লান্তভাবে মাথাটা হেলিয়ে দিল পেছনে। চোখ বুজে বলল, ‘বাবা সাজতে হবে কেন? আমিই তো ওর বাবা! এটা অস্বীকার করার তো কোন অবকাশ নেই! 

ঘেন্নায় ফারার মুখ বেঁকে যায়। কর্কশ হয়ে ওঠে কণ্ঠস্বর, ‘ভালোই উন্নতি হয়েছে তোমার। ওই গ্রাম্য মেয়েটা দেখছি এর মাঝেই বশ করে নিয়েছে তোমাকে। দুদিন পর নিশ্চয়ই ওকে স্ত্রী হিসেবে স্বীকার করতেও কোন আপত্তি থাকবে না। রুচির অধঃপতন দেখে অবাক না হয়ে পারছি না। 

জাহিদ দুর্বল গলায় বলল, ‘তোমাকে আগেও বলেছি। ওই মেয়েটির জন্য আমার মনে তিল পরিমাণ জায়গা নেই। আমার স্ত্রী শুধু একজন। সে তুমি।’ 

—‘আর ওই ডাইনিটা তোমার কী হয় শুনি? সারাক্ষণ তো ওর আগেপিছে ঘুরঘুর করতে থাকো।’ 

—‘কিছুই না!’ একটু থেমে জাহিদ আবার যোগ করল, ‘কিছু না বলাটা ভুল। সে আমার মেয়ের মা। আর এ কারণেই…এ কারণেই ফারা, আমি চাই তুমি যেন তাকে ন্যূনতম সম্মান দিয়ে কথা বল।’ 

রাগের চোটে ফারা গাড়ির গতি বৃদ্ধি করে। চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, ‘তোমার এত লাগছে কেন? ডাইনির প্রেমে পড়লে নাকি?’ 

—‘বাজে বকো না। বাচ্চা একটা মেয়ে! তুরিনের চেয়ে মাত্র কয়েক বছরের বড় হবে। 

—‘ও! বাচ্চা একটা মেয়ে!’ মুখ বাঁকিয়ে, চোখ ঘুরিয়ে, কপট স্বরে জাহিদকে নকল করল ফারা। তারপর রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘আমার তো বয়স হয়ে গেছে তাই না? এখন নিশ্চয়ই বাচ্চা মেয়েদেরকেই খুব ভালো লাগছে!’ 

—‘তোমার মাথাটা গেছে। পাগল হয়ে গেছ।’ 

ফারা বিষঢালা গলায় বলল, ‘বাচ্চা মেয়েটার সঙ্গে বিছানায় শুতে তো তোমার লজ্জা করল না। এখন যে খুব বড় বড় কথা বলা হচ্ছে!’ 

জাহিদ মহা বিরক্ত হলো, ‘রোজ রোজ একই ঘ্যানর ঘ্যানর ভালো লাগে না। আই প্টে উইদ হার ফর ওয়ান্স! ওই একদিনই। আর তখন আমার মনের মধ্যে নিশা ছিল না। তুমিই ছিলে!’ 

ফারা ভর্ৎসনার বিকট হাসিতে ফেটে পড়ে, ‘ফাইজলামির জায়গা পাও না! লাইফটাকে সিনামা পেয়েছ? বিশ্বাস করতে বলো আমাকে এসব ভুজুং ভাজুং?’ 

—‘বিশ্বাস করো, কারণ এটাই সত্য!’ 

ফারা সজোরে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ‘তুমি এবং তোমার বাবা, দুজনেই হিপোক্রেট। এতদিন কেন মুখ বুজে তোমাদের ওই জাহান্নামে পড়ে আছি জানো? শুধু আমার মেয়েটার জন্য। মেয়েটার একটা বিয়ে দিয়েই তোমাদের এই বিশ্রী দুর্গন্ধযুক্ত ব্যাক ডেটেড বাড়ি থেকে চিরতরে বিদায় নেব।’ 

—‘বিদায় নিয়ে যাবে কোথায়? কার কাছে যাবে? প্রেম-ট্রেম করছ নাকি?’ 

—‘করে থাকলেও সেটা নিতান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তোমার এখন আর কোন অধিকার নেই এসব জানতে চাইবার। আমি ওই শাকচুন্নির সঙ্গে এক ছাদের নিচে থাকব না এটাই মেইন কথা। ক্লিয়ার?’ 

জাহিদ চুপ করে গেল। গোপন করল একটা দীর্ঘশ্বাস। ছিঁড়ে যাওয়া নাটাইয়ের সুতা কী করে জোড়া লাগাতে হয় সে জানে না! বিক্ষুব্ধ এক অসহায়বোধে ক্রমেই তার সমস্ত হৃদয় মথিত হয়ে উঠল নিশা ডিশওয়াশারে এঁটো বাটি আর প্লেট তুলে রাখছিল। ভাশুরের বৌ নীলিমা তাকে সাহায্য করছে। নীলিমা স্বল্পভাষী, শান্তশিষ্ট রমণী। নিশার সঙ্গে নিজ উদ্যোগে কখনো কথা বলে না। নিজের মেয়েদেরকেও প্রথম থেকেই নির্দেশনা দিয়েছে নিশার সঙ্গে যেন নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখে। নীলিমার মতে নিশার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো না। যারা সামান্য অর্থের বিনিময়ে একজন দোজবর ব্যক্তির কাছে নির্দ্বিধায় মেয়ে গছিয়ে দেয় তারা কোন মতেই ভদ্র বা উচ্চসমাজভুক্ত লোক নয়। নিশা স্বল্পশিক্ষিতা গ্রাম্য মেয়ে। নিজের আত্মসম্মান বিকিয়ে দিয়ে এ বাড়িতে আশ্রিতা হয়ে পড়ে আছে। তার কাছ থেকে নতুন প্রজন্ম কী শিখবে? না, নীলিমা নিজ কন্যাদের দুর্ব্যবহার করার অনুমতি দেয়নি। বরং চোখাচোখি হলে সালাম বিনিময়ের শিক্ষা দেয়া হয়েছে। কিন্তু এর বাইরে একটি সৌজন্য কথাও বলা বারণ। জাহিদের সঙ্গে নিশার এই বিয়ে সামাজিকভাবে স্বীকৃত নয়। সভ্য সমাজে একজন পুরুষের দুজন স্ত্রী থাকতে পারে না। নীলিমা চায় তার কন্যারা যেন এই সম্পর্ককে সুস্পষ্টভাবে অগ্রাহ্য করার সাহস রাখে। এমন অসুস্থ সংস্কারের বিরুদ্ধে মেয়েদের সোচ্চার হতে হবে, প্রতিবাদী হতে হবে অতি অল্প বয়স থেকেই। 

নিশা চুপচাপ কাজ করে যাচ্ছিল। নীলিমার চোখে চোখ পড়লেই সে একটু মুচকি হেসে ভদ্রতা রক্ষা করছে। অনতিদূরে, কিচেন কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে ছুরি দিয়ে ফল কাটছে আনিতা। কাটতে কাটতে বলল, ‘দাদাজান বলেছে গেস্টের ঘরে ফল দিয়ে আসতে। কিন্তু আমার ওই ঘরে যেতে ইচ্ছে করছে না।’ 

নীলিমা মেয়ের কথার প্রত্যুত্তর করল না। করার প্রয়োজন নেই। কারণ বাড়ির যে কাজগুলো অন্য কেউ করে না, অন্য কারো করতে ইচ্ছে করে না, সেই কাজগুলো দিনশেষে নিশাই করে। এমনিতেও নীলিমা চায় না ব্যাচেলর ছেলের ঘরে রাত-বিরেতে অবিবাহিতা তরুণী মেয়ে ফলের বাটি নিয়ে যাক। 

আনিতা কাটা ফলের প্লেটটা এনে নিশার সামনে রাখল। বলল না কিছুই। আকার ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল, তার যা করার করেছে, বাকিটা নিশার দায়িত্ব। কাজ শেষে দোতলায় যাওয়ার আগে নিশা একবার অর্ণবের ঘরে ঢুঁ মারল। অর্ণব বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়েছিল। বড্ড ক্লান্ত। নতুন জায়গায় ঘুমও আসছিল না। এপাশ-ওপাশ করছিল। দরজার কড়া নড়তেই শোয়া থেকে উঠে বাতি জ্বালাল। তার পরনে সাদা-কালো চেকের লুঙ্গি। হাতাকাটা গেঞ্জি। এমন অবস্থায় দরজা খোলা ঠিক হবে না ভেবে গেঞ্জির ওপর একটি টি-শার্ট চড়িয়ে নিল চট করে। লুঙ্গি না পরলে রাতে ঘুমই হয় না। বিদেশবিভূঁইয়ে এসেও এই স্বভাবে পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়নি। ডাল-ভাত আর লুঙ্গি এই তিন জিনিস জীবনে কখনো ছাড়তে পারবে বলে মনে হয় না। দরজা খুলে দেখল সেই মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। অর্ণব হতভম্বভাবে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ। নিশা হাতে ধরা প্লেটটা এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এটা রাখুন। 

অর্ণব নড়ল না, কিছু বললও না, বিকারগ্রস্তের মতো চেয়ে রইল শুধু। নিশা ছেলেটির অসংগত, অসংলগ্ন আচরণে কিঞ্চিৎ বিস্মিত হলো। তার বয়স চোদ্দ নয়, চব্বিশ। তা ছাড়া মানুষের বয়স সময়ে নয়, বরং অভিজ্ঞতায় বাড়ে। সাংসারিক নানা অভিজ্ঞতা নিশার ভেতরের বালিকাসুলভ মনটাকে অনেক আগেই পিষে থেঁতলে একাকার করে দিয়েছে। পুরুষের দৃষ্টি এখন আর তাকে উতলা করে না। সে অর্ণবের হাভাতের মতো তাকিয়ে থাকা চোখের দিকে চেয়ে বলল, ‘কী হলো? দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? 

অর্ণব ঘোর ভাঙা শ্লথ হাত দুটো বাড়িয়ে দিল সামনে। আস্তে করে বলল, ‘আপনাকে ঠিক চিনলাম না।’ 

নিশা বুঝল জাহিদ তার হবু জামাতাকে দ্বিতীয় স্ত্রী সম্পর্কে কিছুই বলেনি। আগ বাড়িয়ে পরিচয় দেয়া ঠিক হবে কি না এই নিয়ে একটু দ্বিধায় ভুগল সে। কুটুমবাড়ির লোকদের চট করে ব্যক্তিগত বিষয় সম্পর্কে বলতে নেই। ভেবেচিন্তে বলা উচিত। পাশকাটানো গলায় বলল, ‘পরে কথা হবে। গুডনাইট।’ 

সব কাজ গুছিয়ে বেডরুমে ফিরল রাত দশটায়। জুবিন ঘুমিয়ে পড়েছিল দাদির কোলে। ওকে বেবিকটে শুইয়ে দিয়ে ভেবেছিল গোসল খানায় যাবে। তোয়ালেটা হাতে নিতে না নিতেই ভ্যাভ্যাঁ করে কেঁদে উঠল মেয়ে। বেজায় বিরক্ত হলো নিশা। এই দুষ্টু বাচ্চাটা নিতান্তই অকারণে কান্নাকাটি করে তার জীবন বিপর্যস্ত করে তোলে। কত দিন যে রাতে একটু শান্তি মতো ঘুমাতে পারে না! কবে এই বাচ্চা বড় হবে আর নিশাকে উদ্ধার করবে খোদা জানে। নিশা তোয়ালেটা বিছানায় ফেলে রেখে জুবিনের কাছে এলো, থমথমে গলায় বলল, ‘কী মহারানি? তোমার মা কি একটু গোসলও করতে পারবে না? কী চাও তুমি? 

জুবিন কান্না থামিয়ে বড় বড় চোখ মেলে মাকে দেখতে লাগল। যেন মায়ের কথাগুলো সে বুঝতে পারছে। কুই কুই শব্দ করে কী যেন বলারও চেষ্টা করছে। ওই অঙ্গভঙ্গি দেখে নিশার মনে সারাদিন বাদে একটা বিশুদ্ধ আনন্দের ধারা প্রবাহিত হলো। মশারি তুলে মেয়ের ছোট্ট পেটের মধ্যে সুড়সুড়ি দিতে দিতে সে বলতে লাগল, ‘কী বলতে চান আপনি? হ্যাঁ? গল্প করবেন? আসেন আমরা গল্প করি!’ 

জুবিন ফোকলা দাঁতে খিলখিল করে হাসতে লাগল। হাসতে লাগল নিশাও। একটা গাড়ি এসে থেমেছে বাড়ির সামনে। নিশা মেয়েকে বলল, ‘তোমার বাবা এসেছে!’ জুবিন যেন বুঝে ফেলল কথাটা। শোয়া থেকে উঠে বসল ঝুপ করে। নিশা মেয়েকে কোলে নিয়ে ঘরের বাতি নিভিয়ে জানালার ধারে এসে দাঁড়াল। ফারা গাড়ি পার্ক করছে। জাহিদ নেমে গেছে বোধহয় আগেই। খানিক বাদে ঘরের বাইরে থেকে পদশব্দ ভেসে এলো। করিডরের বাতিটা জ্বালাল কেউ একজন। ইদানীং ঘুমোতে যাওয়ার আগে জাহিদ একবার আসে এই ঘরে, মেয়েকে দেখতে। আজও হয়তো আসবে। তার আসা না আসায় যদিও নিশার কিছুই এসে-যায় না। তবুও নিজের অজান্তেই সে একটু উৎকর্ণ হয়ে থাকে। ওই লোকের যখন-তখন ঘরে প্রবেশ করাটা তার পছন্দ নয়। শাশুড়িমা ছেলের কাছে ঘরের একটা চাবি দিয়ে রেখেছেন। যেন ইচ্ছে হলেই জাহিদ জুবিনকে দেখতে আসতে পারে। নিশার এই ব্যাপারে প্রথম থেকেই সম্মতি ছিল না। লোকটা জুবিনের বাবা হতে পারে কিন্তু নিশার তো কেউ না! মন প্রতিবাদী হয়ে উঠলেও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেনি। কখনোই বলতে পারে না। বলতে না পারার এক অসাধারণ দক্ষতা নিয়ে জন্মেছিল সে। তাই তো এত লোকের মধ্যে থেকেও সারাক্ষণ নিজস্ব পৃথিবীটাতে শুধু নিজেকেই নিজে বেষ্টন করে বসে থাকে। অন্ধকারে আঁকড়ে ধরার মতো কাউকেই পায় না। পায়ের শব্দ দূরে সরে গেছে। লোকটা আজকে আর আসবে না। যাক বাঁচা গেল! 

নিশা জানালার পর্দা টেনে দিয়ে জুবিনকে ব্রেস্টফিড করানোর প্রস্তুতি নিল। ল্যাম্পশেডটা জ্বলছিল টিমটিম করে। হঠাৎ করেই নিচতলার গেস্টরুমের ছেলেটার কথা মনে পড়ল তার। এমন সহজ-সরল অকপট মুখশ্রী অনেকদিন দেখেনি। একদম সহজ-সরল ছেলেটা। শুনেছে ছাত্র হিসেবে খুব ব্রাইট। আমেরিকান সরকার নাকি ভালো ছাত্রদের ছাড়ে না, রেখে দেয়। এই ছেলের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। কিন্তু এত ভালো ছাত্র ঘরজামাই হতে চায় কেন? আত্মসম্মান বোধ নেই নাকি? দরজার নবটা আকস্মিক ঘুরে গেল। ভাবনায় ছেদ পড়ল নিশার। জুবিনকে বুকে নিয়ে বিছানায় আধশোয়া হয়ে ছিল। জাহিদ ঘরে ঢুকে দরজাটা ঠেলে দিল আগের জায়গায়। ওর পরনে একটা গাঢ় জলপাই রঙের পাতলা টি-শার্ট, কালো ট্রাউজার। লোকটার গায়ের রং উজ্জ্বল ফরসা। গাঢ় রঙের জামা গায়ে দিলেও বেশ মানিয়ে যায়। 

নিশাকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলার কোন অভিপ্রায় জাহিদের ছিল না। কিন্তু কোন এক আশ্চর্য কারণে নিশা তার উপস্থিতিতে সর্বদাই বিব্রত হয়। আজকেও হলো। জাহিদকে দেখামাত্র গায়ে ওড়না টেনে নিয়ে নিজেকে প্রায় প্যাকেট করে ফেলল। এমনই প্যাকেট করল যে জুবিনকেও আর দেখা যাচ্ছে না। এই আচরণে জাহিদ ভেতরে ভেতরে অস্বস্তি বোধ করে। নিশার দিকে সরাসরি তাকায় না, জানালায় চোখ রেখে বলে, ‘ঘুমিয়েছে?’ 

—‘খাচ্ছে।’ 

জাহিদ কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে মেয়েকে এক নজর দেখার চেষ্টা করল। পারল না। নিশা সুতির ওড়না দিয়ে নিজের সারাটা শরীর আড়াল করে রেখেছে। ওড়নার নিচে জুবিনের নড়াচড়া কিছুটা টের পাওয়া যাচ্ছে। জাহিদের উঁকিঝুঁকি নিশাকে ক্রমেই আরো বেশি কুণ্ঠিত করে তুলছে। সে পাথরের মতো মুখ বানিয়ে থমথমে গলায় বলল, ‘একটু অপেক্ষা করুন। এখুনি হয়ে যাবে।’ 

জাহিদ বসল বিছানার ওপর, নিশার পায়ের কাছে। 

খাওয়া শেষ হলে জুবিনকে জাহিদের কাছে হস্তান্তর করল নিশা। জুবিন তখনো ঘুমোয়নি। আজকাল তার রাতের বেলা বাবার কোলে ঘুমোনোর অভ্যাস হয়েছে। জাহিদ ওকে কোলে নিয়ে এদিক-সেদিক হাঁটাহাঁটি করে খানিকক্ষণ। বাচ্চা ঘুমিয়ে পড়লে বেবিকট কিংবা বিছানায় আস্তে করে শুইয়ে দিয়ে প্রস্থান করে। জুবিনের ছোট্ট বলের মতো গোলাকার মাথাটা জাহিদের বুকের ওপর রাখা এখন। জাহিদ হাঁটছে ধীরে ধীরে, ঘরের এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। চোরা চোখে দৃশ্যটা একবার দেখল নিশা। বলতে কী, জুবিন তার বাবার কাছে থাকলেই নিশা সবচেয়ে বেশি নিশ্চিন্ত বোধ করে। প্রথমদিকে একটু দুশ্চিন্তায় ছিল এই ভেবে যে মেয়েটা হয়তো বাবার ভালোবাসা পাবে না। কিন্তু দিন যত কেটেছে, নিশা বুঝেছে যে এই লোকটা পারিবারিক দায়দায়িত্ব বেশ ভালোভাবেই পালন করতে জানে। নিশাকে অবশ্য সে মানুষ হিসেবে গণ্য করে না। আজ পর্যন্ত কোন দিন নিশার সঙ্গে হেসে কথা বলেনি। এমনকি একটা বার জানতেও চায়নি সে কেমন আছে। কষ্ট লাগলেও কষ্টটাকে আমলে নিতে চায় না নিশা। জন্ম থেকেই তার মধ্যে মানুষকে ভক্তি করার একটা অনর্থক ব্যগ্রতা আছে। সহ্য করার আশ্চর্য ক্ষমতা আছে। সহজে কাউকে ঘৃণা করতে পারে না। এমনকি ফারা, তুরিন যে অহোরাত্র সাপের মতো ফোঁসফোঁস নিঃশ্বাস ফেলে ঘুরে বেড়ায় চারপাশে, সুযোগ পেলেই বিষাক্ত ফণা তোলে, এদেরও সে শতভাগ ঘৃণা করতে পারে না। মাঝেমধ্যে মনে হয় ঘৃণা করার সামর্থ্যই তার নেই। 

—‘আমি একটু গোসলে যেতে চাইছিলাম। যাব?’ নিচু স্বরে প্রশ্ন করল নিশা। যেন জুবিনের ঘুম না ভাঙে।

জাহিদ ছোট করে উত্তর দিল, ‘নিশ্চয়ই। যেতে পার।’ 

একটু তাড়াহুড়া করেই গোসল সারল। মনের মধ্যে খচখচ করছিল। কয়েক দিন আগে ঠিক আজকের মতোই জুবিনকে তার বাবার কাছে রেখে শাওয়ার নিতে গিয়েছিল। বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখে বাপ-বেটির কেউই ঘরে নেই। রাত তখন সাড়ে বারোটা। বাড়ির সব সদস্যই ঘুমে কাদা হয়ে আছে। জাহিদ এত রাতে কোথায় গেল মেয়েকে নিয়ে? কলিজাটা যেন কেউ টেনেহিঁচড়ে বুক থেকে ছিনিয়ে নিতে চাইছিল। হতবিহ্বল নিশা পাগলের মতো সমস্ত বাড়ি চষে ফেলল। লিভিংরুম, কিচেন, বারান্দা, কোন জায়গা বাদ রাখল না। মেয়েকে কোথাও না পেয়ে নিঃস্ব ভিখারিনীর মতো জাহিদের বেডরুমের দরজায় এসে দাঁড়াল। ব্যখ্যাতীত রাগে তার হাত-পা কাঁপছিল। এই রুমে সে আগে কখনো আসেনি। প্রয়োজন পড়েনি। রুচিও হয়নি। সেদিন আগ পিছ কিছু চিন্তা করার সামর্থ্য ছিল না। ক্ষ্যাপা পাগলের মতো দরজায় আঘাত করতে লাগল। মুহূর্তের মধ্যেই জাহিদ দরজা খুলল। নিশা বারুদের মতো ঝলসে উঠে বলল, ‘আমার মেয়ে কোথায়?’ 

জাহিদ নির্বাক চোখে চাইল ওর দিকে। চেয়েই রইল খানিকক্ষণ। তারপর কোন কথা বলেই সরে পড়ল দরজা থেকে। ফাঁকা দরজা দিয়ে নিশা দেখল জুবিন খাটের ওপর হামাগুড়ি দিচ্ছে। ফারা শুয়ে আছে জুবিনের ছোট্ট শরীরটার ডানপাশে। শোয়া অবস্থায়ই নিশার বারুদময় মুখটার দিকে একবার পাশ কাটানো দৃষ্টি দিল সে। হাসল বোধহয় একটু। তাচ্ছিল্যের হাসি। জাহিদ জুবিনকে কোলে নিয়ে দরজার কাছে আসতে না আসতেই নিশা ছোঁ মেরে ছিনিয়ে নিল মেয়েকে। রুদ্ধশ্বাসে বলল, ‘ওকে এই ঘরে আর কোন দিন আনবেন না। মনে থাকে যেন!’ 

জাহিদ প্রত্যুত্তরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল শুধু, সশব্দে। মুখ ফুটে কিছু বলেনি। মাথায় টাওয়েল পেঁচিয়ে কোন মতে একটা ম্যাক্সি পরে নিশা তড়িঘড়ি বেরিয়ে এলো বাথরুম থেকে। মনটা আশঙ্কায় কাঁটা হয়ে আছে। এই বুঝি লোকটা জুবিনকে নিয়ে পাশের ঘরে পালিয়ে গেল! বেরিয়ে দেখল জুবিন ঘুমাচ্ছে বিছানায়। জাহিদ শুয়ে আছে ওর পাশে চিত হয়ে। লম্বা পা জোড়া ঝুলছে খাটের বাইরে। নিশ্চিন্তের মৃদু শ্বাস পড়ল নিশার। ল্যাম্পশেডের কমলা আলোয় দেখল জুবিনের ছোট্ট লাল টুকটুক ঠোঁটে একটা মুচকি হাসির রেখা লেগে আছে। জাহিদের হাতে কাচের চশমা আলগা করে ধরা। চোখে ঘুম। 

নিশা কী করবে বুঝে পেল না। ঘুমন্ত পিতা-কন্যার দিকে কিছুক্ষণ একমনে চেয়ে রইল। মনে হলো জুবিনের মুখটা তার বাবারই মতো। ঠোঁটজোড়াও অবিকল মিলে যায়। সেলফোনটা হাতে নিয়ে আস্তে করে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। ভেজা তোয়ালে চুলে জড়িয়েই বাংলাদেশে ফোন করল। প্রায় আধাঘণ্টা ফোনালাপের পর যখন ঘরে ফিরল তখনো বাপ-বেটি ঘুমাচ্ছে অঘোরে। তার নিজেরও খুব ক্লান্ত লাগছে। লোকটার সঙ্গে একই বিছানায় শোবার কথা ভাবতে গিয়ে সংকোচ, বিরক্তি এমনকি অভক্তির মতো একটা বিশ্রী অনুভূতি চিড়বিড়িয়ে উঠছে মনে। তবুও ক্লান্ত শ্রান্ত মানুষটাকে ঘুম থেকে ডাকতে ইচ্ছে হলো না। জাহিদের হাতে ধরা চশমাটা আলগোছে নিজের হাতে তুলে নিল নিশা। রাখল খাটের পাশের নাইট স্ট্যান্ডের ওপর। বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ল গুটিশুটি হয়ে জুবিনের পাশে। মাঝে মাঝে জুবিনকে বেবিকটে না রেখে নিজের পাশে নিয়ে শোয় নিশা। তখন অন্যপাশে কোলবালিশ দিয়ে ব্যারিকেড দিতে হয়। আজকে ব্যারিকেড হয়ে তার বাবা শুয়ে আছে। বিষয়টা সুন্দর। ভাবতেই নিশার বদ্ধ ঠোঁটে সামান্য হাসি ঝিলিক দিয়ে উঠল ভোরের প্রথম সূর্যরশ্মি রকি মাউন্টেনের আকাশস্পর্শী শৈলশিখর অতিক্রম করে, কলোরাডোর বিস্তৃত বিরান মালভূমি পার হয়ে, হরেক পাখির কিচিরমিচির সঙ্গে নিয়ে, নিশার শোবার ঘরের জানালায় যখন ঠকঠক কড়া নাড়ল, ঘুমের রাজ্যের সঙ্গে জাহিদের চেতনার সংযোগটাও ঠিক সেই মুহূর্তেই ছিন্ন হলো। চোখ খুলে ঘোলা চোখে সে নিজেকে আবিষ্কার করল নিশার বিছানায়। ডান হাতটা জুবিনের মাথার ওপর রাখা। নিশার হাতের আঙুল ছুঁয়ে আছে ওর আঙুল। চশমাবিহীন আবছা চোখে নিশার শুভ্র সুন্দর মুখখানির দিকে কয়েক সেকেন্ড অপলক চেয়ে রইল। জুবিন ঘুমাচ্ছে। মা-মেয়ের চোখের পাপড়ির ঝালরে নিখাদ মিল! ফুলের পাপড়ির মতো বঙ্কিম। কৃষ্ণ কালো! জাহিদ ইচ্ছে করেই নড়ছিল না। পাছে ওদের ঘুম ভেঙে যায় সেই ভয়ে। কিন্তু লাভ কিছুই হলো না। খানিক বাদে আপনা আপনিই নিশার ঘুমে ছেদ পড়ল। চোখ খুলে জাহিদকে দেখামাত্র পিলে চমকে উঠল সে। জাহিদের আঙুল ছুঁয়ে থাকা ডান হাতটা চট করে টেনে নিল নিজের কাছে। দুর্মোচ্য সংকোচের অনর্থক অত্যাচারে বুকের ভেতরটা দুরদুর করে কাঁপতে লাগল। জাহিদ আবছা চোখে মেয়েটার অকারণ ছটফটানি দেখতে লাগল। একটা সময় না পারতে বলল, ‘আমার চশমাটা কোথায়?’ 

নিশা উঠে এলো বিছানা থেকে। চশমাটা এগিয়ে দিল জাহিদের দিকে জাহিদ চোখে চশমা পরে নিয়ে নিশার দিশাহারা বিপন্ন মুখটার দিকে পরিপূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকাল। 

—‘কী হয়েছে তোমার?’ 

—‘কী হবে?’ নিশা চোখ সরিয়ে নেয়। 

—‘দুঃস্বপ্ন দেখেছ?’ 

নিশা একটুক্ষণ চুপ করে থেকে তেরছা গলায় বলে, ‘দেখেছি বোধহয়। তবে ঘুমিয়ে নয়, ঘুম থেকে জাগার পর!’ 

জাহিদ হেসে ফেলল। নিশা আড় চোখে দেখল হাসিটা। হাসিটা হুল- বেঁধানো, জ্বালাময়…তবুও কেমন যেন টানটান সুশ্রী! নিশার হাঁসফাঁশ লাগতে থাকে। জুবিন এখনো ক্যাবলাকান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে কেন কে জানে! অন্যদিন তো ভোরের আলো ফোটার আগেই ট্যা ট্যা করে দুনিয়া মাথায় তোলে। আজকে সময় মতো উঠে গেলে তো ওকে নিয়ে ব্যস্ত হওয়া যেত। লোকটার সামনে অযথা ভাঁড়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হতো না। 

বেডরুমের দরজায় হঠাৎ যেন ডাকাত পড়ল। সেই শব্দে ছুটে গেল জুবিনের ঘুম। তারস্বরে কেঁদে উঠল সে। জাহিদ এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলল। ফারা দাঁড়িয়ে আছে। পরনে জগিং স্যুট। চোখে প্রলয়ের চাপা আভাস। জাহিদ অপ্রস্তুত হলো, ‘কিছু বলবে?’ 

—‘বলবে তো তুমি!এখানে কী করছ শুনি?’ রূঢ় শোনাল ফারার কণ্ঠস্বর। জাহিদ পেছন ফিরে একবার বিপর্যস্ত চোখে নিশাকে দেখল, 

—‘চলো ওদিকে গিয়ে কথা বলি।’ 

—‘ওদিকে যেতে হবে কেন? এখানে দাঁড়িয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতে কি তোমার লজ্জা হচ্ছে?’ 

জাহিদ জোর করে ফারাকে দরজার বাইরে নিয়ে এলো। নিশা জুবিনকে বুকে চেপে ধরে থম করে বসে রইল বিছানায়। ফারার কণ্ঠস্বর উচ্চাঙ্গে উঠছে ক্রমেই। ছাপিয়ে যাচ্ছে জুবিনের কান্নার শব্দকে। 

—‘এখন তুমি ওই ঘরে রাত কাটানো শুরু করেছ? আর কী কী দেখতে হবে আমার এই সংসারে জাহিদ? কবে এসব অরাজকতার দি এন্ড হবে শুনি?’ 

নিশার কানে কথাগুলো বোমার বিস্ফোরণের মতো শোনায়। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে অশ্রু রোধ করার চেষ্টা করে সে। ব্যর্থ হয়। চোখের কার্নিশ উপচে টপটপ করে গড়িয়ে পড়তে থাকে জল। 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *