বরফকুচি খামে দূর পাহাড়ের ডাক
শাহজিদের ঘুম হলো না। অনেক অনেক দিন পর নিজের ভেতর এক রকম বাঁধ-ছেঁড়া উত্তেজনা টের পাচ্ছিল সে। তার আমিময় মিত্রহীন চরাচরে এবার একজন ‘তুমি’র আবির্ভাব হবে! দুর্ঘটনার আগের জীবনটা অ্যাডভেঞ্চারে পরিপূর্ণ ছিল। দুর্ঘটনা-পরবর্তী পঙ্গুত্ব তার বেঁচে থাকার সমস্ত উত্তাপ রক্তচোষার মতো শুষে নিয়েছে। সে বুঝতে পারছিল এভাবে চলতে থাকলে পাহাড়ের সেই মরণস্বপ্নটা খুব দ্রুতই তাকে গিলে খাবে। একটা পরিবর্তন আবশ্যক হয়ে পড়েছিল। তুরিনকে নিয়ে এই যে অজানার উদ্দ্যেশ্যে পাড়ি জমানোর দুঃসাহসিক অভিযান…এটা নেহাত আবেগজনিত বা প্রেমঘটিত নয়। বরং অনেক বেশি বাস্তবিক এবং স্বার্থসম্মত।
সুটকেস আগেই গোছানো ছিল। এখন শুধু ব্যাকপ্যাকে ল্যাপটপ, পাসপোর্ট, সোশ্যালসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র গুছিয়ে নিল। দুর্দান্ত সুদর্শন রুপালি রঙের পিস্তলটা যত্নের সঙ্গে ভরে নিল প্যান্টের পকেটে। ক্রাচে ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এসব কাজ করতে কষ্ট যে হয় না, তা কিন্তু নয়। অল্প পরিশ্রমেই বেশ ধকল বয়ে যায় শরীরের ওপর দিয়ে। গলগল করে ঘাম ছোটে। তবুও নিত্যকার অপরিহার্য কাজগুলো নিজ হাতে করার মধ্যেই শাহজিদ একটু একটু করে নিজের কাছে জিতে যায়। এটুকু নিশ্চিত হতে পেরে স্বস্তির শ্বাস ফেলে যে অন্য কারো দয়ায় বা নির্ভরতায় তাকে বাঁচতে হবে না। যতদিন বাঁচবে, আত্মনির্ভরশীল হয়েই বাঁচবে। আগামী দিনগুলোতে তুরিন কি দৈনন্দিন কাজে তাকে সাহায্য করতে চাইবে? কেমন স্ত্রী হবে তুরিন? কেমন হবে ওদের দুজনার সংসার? বিয়ের পর একটা মেয়ের ওপর সম্পূর্ণ দখল, নির্ভরতা, শতভাগ বিশ্বস্ততা…এগুলো পুরুষ মানুষের সহজাত চাহিদা। মানসিকভাবে তুরিন এখনো যথেষ্ট অপরিপক্ব। পুরোদস্তুর স্ত্রীসুলভ আচরণ তার কাছ থেকে আশা করা বোকামি। অবশ্য শাহজিদ নিজেও খুব একটা সংস্কারপন্থি নয়। এমনকি তুরিন যদি বিয়ে না করে লিভ টুগেদার করতে চায় তাতেও কোন আপত্তি নেই।
কাল থেকে এই ঘরে আর থাকা হবে না। এখানে তার জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ নিঃসঙ্গ দিনগুলো কেটেছে। এই বদ্ধ ঘরে একলা বসে বসে সে তুরিনের কথা বহুদিন বিনা কারণে ভেবে গেছে নিরবচ্ছিন্নভাবে। কাল সেই তুরিনের সঙ্গেই নতুন একটা জীবন শুরু হবে। নতুন দিনের নরম সূর্যের অলৌকিক আঁচ টের পায় শাহজিদ। শিরদাঁড়ায় একটা মন কেমনের শিরশিরানি ওঠে। ভারী চঞ্চল হয়ে ওঠে হৃদয়। চনমনে ভাব আসে দেহে। জীবন তাকে আরেকবার গুটি চালার সুযোগ করে দিয়েছে। এইবারের দানে আর হারবে না সে।
ঘুম হলো না তুরিনেরও। কত কথা যে মনের ওপর দিয়ে এলো আর গেল! নচ্ছার সব উড়ু উড়ু ভাবনারা পলকা মেঘের মতো ভেসে ভেসে সমস্ত ইন্দ্রিয়কে টানটান উত্তেজনায় অনুক্ষণ জাগ্রত করে রাখল। নির্ঘুম চোখের তারায় শত শত স্বপ্নের জোনাকি নিঃশব্দে জ্বলল আর নিভল। অনেকদিন তো পাহাড়ে থাকা হলো…এবার সমুদ্রের কাছাকাছি কোথাও গেলে ভালো হয়। ইস্ট অথবা ওয়েস্ট কোস্টে। সাগরের ধারঘেঁষে একটা বাসা হবে ওদের। ভোরের শামুকগন্ধী লোনা বাতাস উত্তাল ঢেউয়ে চেপে উড়ে এসে জানালায় টোকা দিয়ে ঘুম ভাঙাবে। একেকটা দিন স্রোতে ভেসে আসা জংলি ফুলের মতো সুন্দর হবে!
ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে নিয়ে জানালার ধারে এসে দাঁড়াল তুরিন। একটু আগেই দেখা হলো…তবুও এই মুহূর্তে শাহজিদকে আর একটিবার দেখতে পাবার দুর্মর তৃষ্ণা তার শ্বাসবায়ুতে একটা উচ্ছন্ন কম্পন সৃষ্টি করছে। রাতের অন্ধকার ধীরে ধীরে উড়ে যাচ্ছে পৃথিবীর উল্টো পিঠে। কিন্তু এই শুভ্র শীতল বরফকুচির একটানা একঘেয়ে রাত্রিটি যেন ফুরোতেই চাইছে না। ভোর চারটার দিকে শাহজিদ ফোন করল।
— ‘ঘুমোচ্ছিলে?’
— ‘ঘুম তো এলো না!’
— ‘বলো কী? সারারাত জেগে ছিলে?’
— ‘হুম।’
শাহজিদ একটু সময় চুপ থেকে আস্তে করে বলে, ‘আমিও!’
— ‘ঘুম হয়নি?’
— ‘নাহ।’
— ‘কেন?’
— ‘ঘুমাতে দিলে কখন তুমি?’
তুরিন এই প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে কিছু বলে না। হাসতে থাকে।
— ‘আসছ তো?’ হঠাৎ কেমন গম্ভীর গলায় প্রশ্নটা করে শাহজিদ।
— ‘এখনো সন্দেহ আছে?’
— ‘মেয়েদের ওপর আমি শতভাগ বিশ্বাস করতে পারি না। সব মেয়েরাই বোধহয় একটু স্বার্থপর, একটু মিথ্যুক আর একটু একটু লোভী হয়।’
— ‘সবাই তোমার এক্স গার্লফ্রেন্ডের মতো না। এখন চটপট বলো কোথায় আসতে হবে।’
‘টেক্সট করে দিচ্ছি লোকেশন। আমার গাড়ি এসে গেছে। মিনিট দশেকের মধ্যেই বেরিয়ে পড়ব।’
— ‘ঠিক আছে। পাঁচটার সময় মিট করছি তোমার সঙ্গে।’
— ‘যাবে কীভাবে? নাকি একসঙ্গেই বেরিয়ে পড়ব?’
— ‘একসঙ্গে বেরোনোটা রিস্ক হয়ে যায়। কেউ দেখে ফেললে সমস্যা হয়ে যাবে। উবার কল করব।’
— ‘পাঁচটার আগেই এসো। সাড়ে পাঁচটার দিকে স্নো-ফল শুরু হবে। স্টর্ম ওয়ার্নিং আছে। তৈরি হয়ে নাও। দেরি করো না।’
দেরি করল না তুরিন। মনের মধ্যে ফড়িং উড়ছে তিড়িংবিড়িং করে। সেই সঙ্গে ভয় আর উত্তেজনাও কম নয়। সাজগোজ তেমন একটা করল না। কালো জিন্স, গোলাপি টপ পরে নিল। লেদারের একটা সাদা জ্যাকেট হাতে নিয়ে নিল। বেরোবার আগ মুহূর্তে হঠাৎ বাবা-মার জন্য মন কেমন করে উঠল ওর। বিকেলে যখন বাসায় ফিরবে না, আর কোনদিনই ফিরবে না, বাবা-মা কি কষ্ট পাবে খুব? কষ্ট পাবে কি দাদা-দাদু? একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। নাহ… বিয়ের পর একবার ফিরে আসবে শাহজিদকে নিয়ে। দেখা করে যাবে পরিবারের সবার সঙ্গে। তবে আপাতত কিছুদিন গা-ঢাকা দিয়েই থাকবে। বাবাকে আর মাকে এবার একটা মস্ত শিক্ষা দিয়ে ছাড়বে!
খুব সন্তর্পণে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো তুরিন। বাবা-মায়ের ঘরের দরজা আধখোলা। তুরিন জানে ও ঘরে এখন বাবা নেই। মা একা। কদিন ধরে বাবা নিশার ঘরেই রাত কাটায়। কথাটা মনে পড়তেই বুকটা একটু চিনচিন করে ওঠে ব্যথায়। নিশার ওপর রাগ হয়। মার জন্য মন পোড়ে। আর বাবার জন্য? বাবার জন্য বুকের মধ্যে বিশাল বড় গর্ত! কষ্ট…বড় কষ্ট হয় তুরিনের। কেউ বোঝে না এই কষ্টের গভীরতা!
.
হঠাৎ কী কারণে যেন ঘুম ছুটে গেল জাহিদের। মাথা ভার হয়ে আছে। মনটা বিষাদে ছাওয়া! জুবিন বেবিকটে ঘুমোচ্ছে। নিশার নরম কোমল ডান হাতটা লতার মতো জড়িয়ে আছে ওর শরীর। নিশা ঘুমোচ্ছে নিশ্চিন্তে। নিঃশ্বাসে মৃদু ফোসফাস। খোলা চুল থেকে সুন্দর ঘ্রাণ উড়ে এসে লাগছে নাকে। জাহিদ একটা গভীর শ্বাস ফেলল। এই একটুখানিই তার পৃথিবী হতে পারত। সুন্দর, ছোট্ট, ছিমিছাম একটা পরিবার। কিন্তু হাজার চাইলেও শুধু এই দুজনের মধ্যে সে নিজেকে আটকাতে পারবে না। তুরিনের অভিমান, রাগ এবং বিচ্ছেদ তাকে তুষের আগুনের মতো পুড়িয়ে যাবে অহোরাত্র। এই পাগল একরোখা জেদি মেয়েকে বশে আনার সাধ্য আছে কার?
নিশার হাতটা খুব ধীরে ধীরে নিজের গায়ের ওপর থেকে সরিয়ে রাখে জাহিদ। বিছানা থেকে নেমে ঘুমন্ত জুবিনকে দেখে একবার। কপালে চুমু খায়। ছোট্ট ঘরটার ভেতর খালি পায়ে পায়চারি করে। বুকের চাপ বাড়তে থাকে। অশান্তি লাগে। মেয়েটা কি খুব বেশি কষ্ট পেল? মানসিক দিক থেকে একেবারে ভেঙে পড়বে না তো? জাহিদ ঠিক করল আজ সকালেই তুরিনকে ডেকে কথা বলবে।
তুরিন আনমনে মায়ের ঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। পায়ে জুতো নেই এখন। কাঁধে ব্যাকপ্যাক। হাতে জ্যাকেট আর ছোট একটা ট্র্যাভেল ব্যাগ। যাওয়ার আগে মায়ের ঘুমন্ত চেহারাটা একবার দেখে নিতে চায় সে। বাইরে আলো ফোটেনি এখনো। হলওয়ে অন্ধকারে ছেয়ে আছে। একটু পরেই ফজরের ওয়াক্ত। দাদা-দাদু উঠে পড়বেন কিছুক্ষণের মাঝেই। তুরিনকে তার আগেই বেরিয়ে পড়তে হবে। মায়ের ঘরের দরজার সামনে পৌঁছে একটু চমকে ওঠে। মা কি জেগে আছে? এটা তো তার জেগে থাকার সময় নয়। ভোররাতের দিকে সে অঘোরে ঘুমোয়। ঘরের ভেতর থেকে পায়ের আওয়াজ ভেসে আসে। তুরিন কাঠের দরজার আড়ালে চট করে লুকিয়ে ফেলে নিজেকে । শ্বাসরোধ করে দেওয়ালের সঙ্গে শরীর ঠেকিয়ে দেয়। মায়ের কাছে কিছুতেই ধরা পড়তে চায় না। কিন্তু ভয় হচ্ছে ভীষণ! মা নিশ্চয়ই হলওয়ের বাতি জ্বালাবে। কারণ চারপাশ ঘুটঘুটে অন্ধকার। সাধারণ লোকে কখনো এমন বিকট অন্ধকারে চলাফেরা করে না। তারাই করে যাদের মনে বদ মতলব থাকে, চোরা কারবার থাকে। তুরিন রুদ্ধশ্বাসে আল্লাহর নাম নিচ্ছিল। ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এসেছে। এখুনি বুঝি বাতি জ্বলে উঠল! আল্লাহ বাঁচিয়ে দিলেন…বাতিটা জ্বলল না। আতঙ্কে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে ত্রস্ত তুরিন দেখল ফারার লম্বা, শীর্ণ, তন্বী দেহখানি ঘুটঘুটে অন্ধকারের ভেতর দিয়ে অতি সতর্কতার সঙ্গে সিঁড়ি অভিমুখে এগিয়ে যাচ্ছে। আকণ্ঠ উত্তেজনায় ডুবে থেকেও সে বুঝল মায়ের হাঁটার কায়দাটার মধ্যে একটা লুকোচুরির ভাব আছে। হঠাৎ প্রশ্নটা টুং করে টোকা দিল মাথায়। এই ভোররাতে মা কোথায় যাচ্ছে? অন্ধকারে চুপিচুপি?
তুরিন খুব বেশিকিছু ভাবতে পারল না। পা বাড়াল সামনে। নিঃশব্দে এগোতে লাগল ফারার পিছু পিছু। লিভিংরুমে কম পাওয়ারের একটা দুর্বল আলো জ্বলছে। সেই আলোর ক্ষীণ রেশ এসে পড়েছে সিঁড়িতে। কয়েক ধাপ নেমে ফারা একবার থমকে দাঁড়াল। ঘুরে তাকাল পেছনে। সিঁড়ির ডানপাশে একটা উঁচু বইয়ের তাকের পেছনে নিজেকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে ছিল তুরিন। ফারা ওকে দেখতে পেল না। সদর দরজার সামনে এসে একবার চারপাশে সতর্ক ভাবে চোখ বুলিয়ে নিল। তারপর খুব ধীরে ধীরে দরজাটা খুলল। তুরিন নেমে এলো নিচে। নিঃশ্বাস আটকে আছে গলার কাছে। ছাড়ার সাহস নেই।
চারিদিক বড্ড নীরব। মনে হয় যেন নিঃশ্বাসের ওই একটুখানি শব্দেই ঘুম ভেঙে যাবে গোটা পৃথিবীর। মা আসলে যাচ্ছে কোথায়? জগিং করতে? কিন্তু রাতের অন্ধকারে কীসের জগিং? পোশাকটাও তো পালটায়নি। গায়ে ঢলঢল করছে ঘরোয়া ম্যাক্সি। ওপরে একটা পাতলা চাদর।
তুরিন দরজাটা অল্প একটু ফাঁক করে উঁকি দিল। প্যাটিওতে কেউ নেই। মা কোথায় গেল? ভ্রু কুঁচকে গম্ভীরভাবে দরজার সামনে একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে তুরিন। কান খাড়া। উৎকর্ণ মন। স্নায়ু টানটান। কী করবে? এখন বেরোলেই তো মায়ের কাছে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এদিকে শাহজিদ আরো মিনিট দশেক আগে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। হঠাৎ একটা ফিসফিস শব্দ উঠল হাওয়ায়। ফারা কথা বলছে। খুব নিচু স্বরে।
— ‘কী ব্যাপার? সমস্যা কী তোমার?’
কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে ডানদিকের কটনউড গাছের আড়াল থেকে। ওদিকে ব্যাকইয়ার্ড যাওয়ার রাস্তা। মা কার সঙ্গে কথা বলছে? এই অসময়ে কে এলো মার কাছে?
— ‘তোমাকে নিষেধ করেছিলাম এ বাড়িতে আসতে। তবুও তুমি এলে কেন? আমার সর্বনাশ না করে ঘুমাতে পারছ না, তাই না?’
তুরিন দরজা ঠেলে এগোলো কয়েক পা। প্যাটিওর ডান পাশে, দেওয়ালের একদম শেষ মাথায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়াল চোরের মতো। গাছের আড়ালের মানুষগুলোকে দেখা যায় না। তুরিন দেখার চেষ্টাও করল না। কান খাড়া করল শুধু। একটা পুরুষ কণ্ঠ কথা বলছে এখন। খুব চেনা কণ্ঠটা।
— ‘তুমি ফোন রিসিভ করলেই তো আর কোন ঝামেলা হতো না। আমাকেও এত রাতে আসতে হতো না। কয়টা মিসডকল গেছে তোমার ফোনে?
কথাগুলো শুনতে শুনতে গায়ে কাঁটা দিল তুরিনের। কণ্ঠটা চিনেছে সে।
— ‘ফোন কেন দিচ্ছ বারবার? আমি তো বলেই দিয়েছি তোমার সঙ্গে আমি আর নেই।’
— ‘আমার সঙ্গে তুমি আর নেই? এত সোজা? তুমি বললে আর আমি মেনে নিলাম, তাই না?’
‘অনিমেষ শোন, অনেক হয়েছে। এবার প্লিজ আমাকে আমার মতো ছেড়ে দাও। আমার লাইফে ইন্টারফেয়ার করা বন্ধ কর। শুধু তোমার জন্য আজকে আমার সংসারটা ভেঙে ছারখার হয়ে গেল!’
— ‘কীসের সংসার? এই বাড়িতে তোমার কোন সংসার-টংসার নেই।’
— ‘উফ…অনেক হয়েছে! প্লিজ এখান থেকে যাও। আর কোনদিন এসো না। তোমার স্পর্ধা কতবড় ওই ল্যাংড়া ছেলেটাকে তুমি আমার বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে চাইছিলে? ছিঃ লজ্জা করে না তোমার?’
তুরিন কাঁপতে থাকে। গা শিউরে ওঠা ভয়ের চাবুক সপাং সপাং আঘাত হানে শরীরে। শিরদাঁড়া টনটন করে।
‘আমার মেয়েটাকে আমার কাছ থেকে জোরপূর্বক ছিনিয়ে নিতে, আমাকে বাবার অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে তোমার লজ্জা করে না ফারা?’
— ‘তুরিনের ওপর তোমার কোন রাইট নেই।’
— ‘একশ বার আছে। তুরিন আমার মেয়ে!’
— ‘শুধু জন্ম দিলেই বাবা হওয়া যায় না অনি! বাবা হওয়ার অন্যরকম যোগ্যতা লাগে। যেটা তোমার নেই, জাহিদের আছে! আজকে আমার আফসোস হয় তুরিন কেন সত্যিই জাহিদের মেয়ে হলো না? কেন আমি তোমার জন্য জাহিদের মতো একজন নিপাট ভালো মানুষকে ঠকিয়েছিলাম!’
প্রকাণ্ড এক বেগবান ঢেউ আচানক তেড়ে এসে তুরিনের সমস্ত অস্তিত্ব এবং চেতনায় সুতীব্র ঝাঁকুনি দিয়ে যায়। অনেক উঁচু থেকে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলে বুক যেমন খালি হয় ঠিক সেরকম একটা খালি খালি ভাব হাঙর মাছের বিশাল হাঁ করা মুখের মতো টপ করে গিলে খায় ওকে। কানে ঝিঁঝি ধরে যায়। আঙুল দিয়ে কয়েকবার কান পরিষ্কার করে তুরিন। কী শুনল? কী শুনল মাত্র? ভুল শুনেছে নিশ্চয়ই!
প্যান্টের পকেটে রাখা সেলফোন ভাইব্রেট হচ্ছিল। ভনভন শব্দটা রাতভোরের নিস্তব্ধতাকে কাঁপিয়ে দিল একদম। তুরিন স্খলিত হাতে পকেট থেকে ফোন বের করল। শাহজিদের ফোন। ফারা ভাইব্রেশনের শব্দ শুনতে পেয়ে চমকে উঠেছে, ‘কে ওখানে?’
দ্রুত পা চালিয়ে প্যাটিওর কাছাকাছি এল সে। সেলফোনের আলোয় তুরিনকে স্পষ্ট দেখতে পেল।
মুহূর্তের মধ্যে ওর মুখ থেকে সরে গেল রক্ত। কাগজের মতো সাদা খসখসে দুটি ঠোঁট নেড়ে অনেক কষ্টে বলল, ‘তুমি এখানে?’
তুরিনের সেলফোন অনবরত ভাইব্রেট হচ্ছে। বিকিরণ করছে আলো। সেই নীলচে আলোর রহস্যময় উপস্থিতিতে খোলা চুলের তুরিনকে তখন অভিশপ্ত প্রেতাত্মার মতো দেখাচ্ছিল। তার শ্বাস পড়ছে না। পড়ছে না চোখের পলক। হাতে ধরা ফোনটা রিসিভ করার কোন লক্ষণও তার মাঝে দেখা যাচ্ছে না। গা ছমছমে সর্বনাশা এক ভেদক দৃষ্টিতে সে ফারার দিকে চেয়ে আছে। ঠিকমতো লক্ষ করতেই ফারা বুঝল তুরিনের শরীর অসম্ভব কাঁপছে। এত বেশি কাঁপছে যে হাতের সেলফোনটা খুব বেশিক্ষণ কম্পনরত পাঁচ আঙুলের মধ্যে আটকে রইল না। পড়ে গেল মেঝেতে। ফারার মনে হলো এই তুরিনকে সে চেনে না। বাতাসে বারুদের গন্ধ ভাসছে। মনে হচ্ছে একটা ভয়ংকর বিস্ফোরণ ঘটতে যাচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যেই। হাত-পায়ের প্রতিটি সন্ধি আতঙ্কে খিল ধরে যাচ্ছে। নিজেকে সামলাবার জন্য প্যাটিওর থামের ওপর একটা হাত রাখল ফারা। কুঁজো হয়ে খানিকটা ছেড়ে দিল শরীরের ভর। মৃত্যুর দোরগোড়ায় পৌঁছে যাওয়া মুমূর্ষু রোগীর মতো হাঁফধরা গলায় বলল,
— ‘তুমি এখানে কী করছ তুরিন?’
গাছের আড়াল থেকে অনিমেষ বেরিয়ে আসে। সটান দাঁড়িয়ে পড়ে ফারার পাশে। তুরিন চেয়ে আছে মায়ের দিকে। চেয়ে আছে এক পৃথিবী বিভ্রম, অবিশ্বাস আর আতঙ্ক নিয়ে। চোখে টগবগ করছে রক্ত। হিড়হিড় করে দাঁতে লাগছে দাঁত। টালমাটাল পায়ে বাড়ির সদর দরজার দিকে এগিয়ে যায় সে। ফারা পেছন থেকে হাঁক ছাড়ে, ‘কোথায় যাচ্ছ? কী হয়েছে তোমার? দাঁড়াও!…দাঁড়াও বলছি!’
তুরিন ভেতরে ঢুকতেই ফারা অপ্রকৃতস্থের মতো অনিমেষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, ‘তুমি আমার সব শেষ করে দিলে। সব শেষ করে দিলে! এবার খুশি হও। খুশি তো এবার?’ ফারার মাতম দেখে মনে হয় এইমাত্র কোন নিকটাত্মীয় পরপারে পাড়ি জমিয়েছে। ডাঙ্গায় তোলা মাছের মতো ছটফট করতে থাকে সে। অনিমেষের বুকে এলোপাতারি আঘাত হানে। এমন বুকভাঙা কান্না কাঁদতে থাকে যে দেখে মনে হয় এখুনি কণ্ঠার রগ ছিঁড়ে যাবে, ফিট হয়ে নইলে চূড়ান্ত পাগল অবস্থায় মেন্টাল হাসপাতালে দাখিল হবে এই নারী। তুরিন তাড়া খাওয়া আসামির মতো ছুটে যাচ্ছিল বাড়ির ভেতর। পা চলতে চাইছে না। নিঃশ্বাস ফুরিয়ে আসছে। চোখের সামনে বাদুড়ের মতো ঝুলে আছে অভিশপ্ত অন্ধকার। চৈতন্যবোধ ক্রমেই ভেসে যাচ্ছে দুর্বার এক জলোচ্ছ্বাসে। বুকের পাঁজর চূর্ণবিচূর্ণ করে আত্মার অন্তঃস্থল থেকে শুধু একটি ডাক ঊর্ধমুখী হয়ে ছুটে আসতে চাইছে…বাবা! বাবা! বাবা!
জাহিদ হাঁটতে বেরোবে। দোতলার সিঁড়ির সামনে এসে থমকে গেল। তুরিন বিকৃতমস্তিষ্ক উন্মাদের মতো দৌড়ে আসছে। তার চোখ রক্তবর্ণ। ঠোঁট সাদা। মুখ দিয়ে অদ্ভুত গোঙানির মতো শব্দ হচ্ছে। মেয়ের এই দশা দেখে বুক কেঁপে উঠল জাহিদের। হায় আল্লাহ! কোন বিপদ হয়নি তো? এরকম করছে কেন মেয়েটা? তুরিন সিঁড়ির মুখে জাহিদকে দেখে কান্নাজড়িত অস্পষ্ট কণ্ঠে একবার ডাকল, ‘বাবা!’
ডাকতে ডাকতে অবিন্যস্ত পায়ে মাঝ সিঁড়িতে উঠে এলো সে। জাহিদ দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে নিচে নামতে যাচ্ছিল। ঠিক সেই সময় তুরিন আর্তস্বরে বলে উঠল, ‘বাবা…তুমি কি আমার বাবা না? ‘
অদ্ভুত প্রশ্নটা জাহিদের হৃৎপিণ্ড খামচে ধরল। বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেল সে। ঠিক সেই সময় হঠাৎ পিছলে গেল তুরিনের বেসামাল ডান পা। ভারসাম্যহীন শরীরটা মুহূর্তের মধ্যে কাটা গাছের মতো নেতিয়ে পড়ল… সিঁড়ির প্রতিটি ধাপে ধাক্কা খেয়ে…ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল নিচে। হতভম্ব, শঙ্কিত, কিংকর্তব্যবিমূঢ় জাহিদ মেয়েকে বাঁচানোর প্রাণপণ চেষ্টা করেও শেষ রক্ষা হলো না। তুরিনের নিথর দেহ লুটিয়ে পড়ল লিভিংরুমের মেঝেতে। পরনের গোলাপি জামা তখন গাঢ় লাল রক্তে মাখামাখি!
.
সেকেন্ডের কাঁটা গড়িয়ে যাচ্ছে, আঙুলের ফাঁক গলে গড়িয়ে পড়া ঝরনার জলধারার মতো। মেইনস্ট্রিটের একটা স্টারবাক্সের সামনে গাড়ি পার্ক করেছে শাহজিদ। তুরিনের আসার কথা পাঁচটায়। এখন পৌনে ছয়টা বাজে। বিগত চল্লিশ মিনিট ধরে ক্রমাগত ডায়াল করে গেছে ওর নাম্বারে। তুরিন রিসিভ করেনি। হয়তো শেষ মুহূর্তে আর সাহসে কুলিয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু কথা দিয়ে কথা না রাখা বড় ধরনের প্রতারণা। প্রতারকদের শাহজিদ ঘৃণা করে। হঠাৎ একটা অদ্ভুত কথা মনে হতেই আপনমনে বিদ্রুপাত্মক হাসি হাসল শাহজিদ। ফারার মেয়ে হয়ে তুরিন আর কতটাই বা বিশ্বস্ত এবং বিবেকবান হবে? রক্ত তো একদিন কথা বলবেই! এমন মায়ের মেয়েকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে হয়তো ভুল করেছিল সে। মস্ত ভুল!
গতকাল সবকিছু পেয়ে গিয়ে বুঝেছিল এতদিন তার জীবনে কতটা শূন্যতা ছিল। শূন্যস্থান পূরণ হলেই শূন্যতার অস্তিত্ব সবচেয়ে বেশি করে অনুভব করা যায়। আবার পূরণ হওয়া শূন্যতা কোন আগাম বার্তা ছাড়া হুট করে গায়েব হলে পূর্বের শূন্যতা আগের চাইতেও প্রবল শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসে। সঙ্গে থাকে পরাজয়ের গ্লানি আর অপমান।
গাড়ি নিয়ে মূল রাস্তায় উঠে আসে সে। একবার অন্তত তুরিনের মুখোমুখি দাঁড়াবে। বাইরে ভোর ফুটেছে মাত্র। সাদা তুলোর ফুলঝুরি হয়ে উড়ছে তুষার! গাড়ির জানালার কাচে জমছে কুয়াশা। সুবিশাল, শীতার্ত সাদা আকাশটা ক্রমেই টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙেচুরে এই স্বার্থপর পৃথিবীর পেটের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। মিশে যাচ্ছে শাহজিদের বুকের মধ্যে। ভয়ংকর হতাশায় মথিত হয়ে উঠছে নিঃশ্বাস। আগেও বহুবার হোঁচট খেয়েছে। কিন্তু এবারের হোঁচট বোধহয় ওর শিরদাঁড়া পিষে একেবারে গুঁড়ো করে দিয়ে গেল। মনে মনেও আর কোনদিন সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে কিনা কে জানে! শরীরের পঙ্গুত্ব থেকে মনকে বাঁচিয়ে রেখেছিল এতকাল…এবার বুঝি মনের পঙ্গুত্বও এসে গেল।
বাবার মৃত্যু দিনটার কথা মনে পড়ে অতর্কিতে। সেদিনও এমন ভর ভরন্ত তুষার ছিল। চারিদিকে নিষ্কলুষ শুভ্র তুহিনের ঘেরাটোপ। এতদিন বাদে আবারও ওর মনের মধ্যে দু কূল ছাপিয়ে নদীর ঢলের মতো নেমে এলো সেদিনের হাহাকার…সেদিনের রিক্ততা…সেদিনের বিষণ্নতা! দীর্ঘশ্বাসের চোরাকাঁটায় বিঁধে বিঁধে শ্বাসনালি রক্তাক্ত হয়ে উঠল। আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে একটা অভিশপ্ত কণ্ঠস্বর ক্রমাগত বলতে লাগল…তোমার কেউ নেই…কেউ নেই…তুমি বড্ড একা!
চলতে চলতে হঠাৎ সাদা তুষারের তুমুল তাণ্ডবের মধ্যে দূরের রকি মাউন্টেন চোখে পড়ে। রুপালি বরফের মুকুট পরা সর্বোচ্চ শিখরখানি আয়নার মতো চমকাচ্ছে। আকাশের কাছাকাছি তার অবস্থান…তবুও আকাশ থেকে যেন সে আরো উঁচু, আরো উদার…সীমাহীন তার হৃদয়ের বিস্তার! শাহজিদের মতো একা, বিষণ্ন, হতাশ মানুষদের জীবনের সব শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিজের বিশাল বুকে লুকোনোর জন্য ওত পেতে থাকে মায়াবিনী ওই কুহেলী পর্বত। রুপার পাতে মোড়া ঐন্দ্রজালিক পাহাড়চূড়ো সাদা বকুলের ঝিরিঝিরি বরফকুচি খামে করে পাঠায় চিঠি। সেই চিঠিতে দূরের হাতছানি! পুলকসর্বস্ব আচানক শিহরণ বয়ে যায় শাহজিদের মেরুদণ্ড দিয়ে। সুগভীর এক অলৌকিক সম্মোহনে গা ছমছম করে ওঠে। লুপ্ত হয়ে যায় বাস্তববোধ। মাথাচাড়া দেয় সেই গোপন দুর্ধর্ষ স্বপ্ন! প্যান্টের পকেটে রাখা পিস্তলটার ওপর অজান্তেই হাত চলে যায়। ঠিকঠাক আছে কি না দেখে নেয়। হাত বুলোয় যত্নের সঙ্গে। তারপর তার মনের দর্পনে উড়তে থাকে সাদা পায়রার মতো একঝাঁক খুশিয়াল বরফবিন্দু…একটা বিকট শব্দ…পর্বতের আনাচে কানাচে লুকিয়ে থাকা জীবজন্তুর সচকিত চিৎকার…ঝকঝকে ধবল বরফের ওপর ছিটকে পড়া টকটকে লাল রক্তের গা শিউরানো আলপনা…দেহ নামক খাঁচা থেকে একটা অতৃপ্ত আত্মার মুক্তি। আহ………..শান্তি!
সেলফোনটা ঝনঝন শব্দে বেজে ওঠে হঠাৎ। দিবাস্বপ্নে ভাঙন ধরে। শাহজিদ সচকিত হয়ে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকায়। নিশা ফোন করছে। ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে নিশার উত্তেজিত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, ‘কোথায় তুমি?’
— ‘আমি বাইরে। তোমার গলা এরকম শোনাচ্ছে কেন?’
নিশার কণ্ঠস্বর ভেঙে এলো, ‘একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। আমরা হাসপাতালে এসেছি।’
গা-কাঁটা দিয়ে উঠল শাহজিদের, ‘দুর্ঘটনা মানে? কী হয়েছে?’
— ‘তুরিন ইনজুরড। আমরা সবাই লংসপিক হসপিটালের ইমার্জেন্সিতে আছি এখন। চলে এসো তাড়াতাড়ি।’