বরফকুচি খামে দূর পাহাড়ের ডাক – ২০.৩

মাঝপথে লাইন কেটে দিও না 

ওয়াশিং মেশিন থেকে একগাদা ভেজা কাপড় বের করে ড্রায়ারের খোপের ভেতর ছুঁড়েদিচ্ছিল নিশা। বাঁ কোমরে জুবিন ঝুলে আছে গাছে ঝোলা বাঁদরের মতো। মনের মাধুরী মিশিয়ে নিজের ভাষায় বলে যাচ্ছে হরেক রকম কথা। সেই সময় মিসেস মুর্তজার আগমন ঘটল লন্ড্রিরুমে। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে নিশার দিকে সেলফোন বাড়িয়ে দিয়ে ব্যতিব্যস্ত স্বরে বললেন, ‘বৌমা, জাহিদ ফোন করেছে। কথা বলবে তোমার সঙ্গে।’ 

নিশা অপ্রস্তুত হলো। লজ্জিত ভঙ্গিতে শাশুড়ির হাত থেকে ফোনটা তুলে নিল। মিসেস মুর্তজা দাঁড়ালেন না। বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। জুবিন মায়ের কাছ থেকে ফোনটা কেড়ে নেবার জন্য হ্যাচোড়প্যাচোড় করতে লাগল। এইটুকুন বয়সেই প্রযুক্তির প্রতি তার দারুণ ভালোবাসা। নিশা মোবাইলটা ওর হাত থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে কানে ঠেকিয়ে নিল। ভাঙা ভাঙা, ফ্যাসফ্যাসে গলায় উচ্চারণ করল শব্দটা, ‘হ্যালো!’ 

— ‘হ্যালো নিশা!’ 

— ‘জি বলুন।’ 

— ‘কী করছ?’ জীবনে প্রথমবারের মতো এমন সাধারণ ঘরোয়া একটা প্রশ্ন শুনতে পেল নিশা, নিজের সাড়ে তিন বছরের পুরোনো স্বামীর কাছ থেকে। ছোট্ট সহজ প্রশ্নটার মধ্যে মন ভালো করার টনিক ছিল নিশ্চয়ই। তাই তো নিশার ঠোঁটের পাঁচিল টপকে একটা তৃপ্তির হাসি উঁকি দিল, কাপড় ধুচ্ছিলাম। আপনি কী করছেন?’ 

— ‘ডেনভার এসেছি, হোটেলে। মিটিং ছিল। সন্ধ্যায় একটু বের হব তোমাকে নিয়ে। রেডি থেকো, কেমন?’ 

— ‘কোথায় যাবেন? 

— ‘কোথায় যাওয়া যায় বলো তো?’ 

নিশা চুপ করে থাকে। উত্তর খুঁজে পায় না। জাহিদ বলল, 

— ‘জুবিনের বার্থডে সেলিব্রেট করব। তার আগে একটু শপিং করলে কেমন হয়?’ 

নিশা এবারেও কিছু বলল না। কেন যেন ভীষণ লজ্জা করতে লাগল ওর। লজ্জায় লাল হয়ে উঠল কানের লতি। 

— ‘জুবিন কোথায়?’ 

— ‘এই তো এখানেই আছে। কথা বলবেন?’ লাউডস্পিকার অন করল নিশা। 

— ‘হ্যালো জুবিন সোনা! কেমন আছ তুমি?’ 

জুবিন বলল, ‘আ তা তা তা মাম্মাম মাম।’ 

এই বিজাতীয় ভাষার কথা শুনে হাসতে লাগল নিশা। হাসল জাহিদও। হাসতে হাসতেই বলল, 

— ‘আমার প্রিন্সেস কি লাঞ্চ করেছে?’ 

— ‘তা তা তা।’ 

— ‘আজ বিকেলে আমরা বেড়াতে যাব। তুমি রেডি হয়ে থেকো।’ 

— ‘মাম্মাম্মাম।’ 

— ‘বিকেলে তোমার মাকে শাড়ি পরতে বলবে।’ 

নিশা মেয়ের দিকে চেয়ে বলল, ‘জুবিনসোনা, বাবাকে জিজ্ঞাসা করো, মা কী রঙের শাড়ি পরবে?’ 

জুবিন বলল, ‘ইইইই!’ 

জাহিদ বলল, ‘সাদা!’ 

নিশা বলল, ‘মায়ের সাদা শাড়ি নেই। সাদাকালো আছে। বাবাকে জিজ্ঞাসা করো সাদাকালো চলবে কি না?’ 

— ‘না…সাদাকালো নয়। মাকে বলো নীল পরতে।’ 

— ‘ঠিক আছে জুবিন, বাবাকে বলে দিও মা নীল শাড়ি পরবে।’ 

‘বাবা তোমাকে মিস করছে!’ জুবিন কী বুঝল কে জানে, ভারি আবেগঘন গলায় বলল, 

— ‘আইতাইতাই!’ 

— ‘বাবা কিন্তু জুবিন সোনার মাকেও খুব মিস করছে! 

— 

— ‘বাবাকে বলো জুবিন…মা-ও তোমাকে মিস করছে।’ 

কথাটা এক নিঃশ্বাসে বলেই নিশা ফোনের লাইন কাটতে যাচ্ছিল। তার আগে ডাকটা ভেসে এলো অপর প্রান্ত থেকে। 

— ‘নিশা!’ 

— ‘জি বলুন।’ 

— ‘তুমি সত্যি আমাকে মিস করছ?’ নিশা থমকালো। 

— ‘আমার কথা শুনতে পেয়েছ?’ 

— ‘জি।’ অনেক কষ্টে ভেতর থেকে ঠেলেঠুলে শব্দটা বের করল নিশা। 

— ‘উত্তর দিচ্ছ না যে?’ 

— ‘হ্যাঁ.. মনে হয়!’ 

— ‘মনে হয়?’ 

— ‘মনে হয় মানে…’ বাক্যটা শেষ করতে পারল না। বুকের কাঁপাকাঁপি মুখের কথা কেড়ে নিল। জাহিদ কিছুটা বঙ্কিম স্বরে বলল, ‘এখন তোমার কথা নেই। গতরাতে কিন্তু অনেককিছু বলেছিলে।’ 

নিশা ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করে, ‘অনেক কিছু?’ – ‘হ্যাঁ।’ 

— ‘কী বলেছিলাম?’ 

— ‘তোমার মনে নেই?’ 

— ‘সবটা মনে পড়ছে না।’ 

— ‘মনে না পড়লেও চলবে। আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।’ 

— ‘কী প্রশ্ন?’ 

— ‘মিস করছ আমাকে?’ 

— ‘হুম।’ 

— ‘কী?’ 

— ‘বললাম তো!’ 

— ‘শুনতে পাইনি!’ 

— ‘মিস করছি।’ 

— ‘কাকে?’ 

— ‘ধুরছাই!’ 

— ‘কী হলো?’ 

— ‘মাথামুণ্ডু।’ 

— ‘এটা কীভাবে হয়?’ 

— ‘এভাবেই।’ 

— ‘হাসছ কেন?’ 

— ‘ফোন রাখছি।’ 

—‘রেখো না নিশা। সঙ্গে থাকো!’ 

— ‘কতক্ষণ?’ 

—‘আজীবন।’ 

— ‘আছি তো!’ 

— ‘মাঝপথে লাইন কেটে দিও না।’ 

— ‘আচ্ছা।’ 

— ‘কথা দিচ্ছ?’ 

— ‘কথা দিলাম!’ 

.

মুর্তজা সাহেব লিভিংরুমের কাউচে বসে ছিলেন। হাতে খবরের কাগজ। অর্ণব সামনে এসে দাঁড়াতেই তিনি কাগজটা কোলের ওপর নামিয়ে রাখলেন। গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘বসো।’ 

অর্ণবের কাঁধে ব্যাগ। পায়ে জুতো। পরনের জামাকাপড়ে ফিটফাট ভাব। মুখে লজ্জিত ভঙ্গি। মুর্তজা সাহেবের আদেশ নিঃশব্দে পালন করল সে। সশ্রদ্ধ ভঙ্গিতে বসে পড়ল উল্টো দিকের সোফায়। 

— ‘কোথায় যাচ্ছ?’ 

— অর্ণব নতমুখে বলল, একটা ইন্টারভিউ আছে। ক্যালিফোর্নিয়ায়। 

— ‘ইন্টারভিউ অনলাইনে দেওয়া যায় না?’  

— ‘অনলাইনেরটা হয়ে গেছে। নেক্সট ইন্টারভিউ ইন পার্সন হবে। 

— ‘ফিরবে কবে?’ 

অর্ণবের মুখটা আরো এক ধাপ নিচে নেমে গেল। চিবুক মিশে গেল গলার সঙ্গে।

— ‘ঠিক বলতে পারছি না।’ 

— ‘তুরিনের সঙ্গে তোমার কথাবার্তা হয়েছে ঠিকমতো?’ 

অর্ণব আড়ষ্টভাবে বলল, ‘জি না। উনি আসলে খুব ব্যস্ত থাকেন। 

মুর্তজা সাহেব তীক্ষ্ণ চোখে পরখ করলেন অর্ণবকে। গোবেচারার মতো মাথা হেঁট করে বসে আছে। সাধারণত দেশ থেকে আসা মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা চতুর গোছের হয়, স্ট্রিট স্মার্ট হয়। নানা কৌশল অবলম্বন করে এরা বিদেশের মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে চায়। এই ছেলে নিঃসন্দেহে ভালো ছাত্র, কিন্তু বুদ্ধিমান নয়। ঘটে বুদ্ধি থাকলে এমন সুযোগ হাতছাড়া করত না। তুরিনকে বিয়ে করে অতি দ্রুত নিজের চালচুলোহীন জীবনের মোড় পাল্টে নিত। রাতারাতি বনে যেতে পারত মার্কিন রাজ্যের স্থায়ী বাসিন্দা। মুর্তজা সাহেব সারা জীবন যা কামিয়েছেন তাতে অর্ণবের মতো শ খানেক গোবেচারা গোছের মানুষ অনায়াসে ঘাড়ে বসে খেতে পারবে। কিন্তু গাধা ছেলেটা এই দুষ্প্রাপ্য শুভ-যোগ পায়ে ঠেলে দিচ্ছে, বেছে নিচ্ছে সংগ্রামের জীবন। মুর্তজা সাহেব কেশে একটু গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বললেন, ‘চাকরির চেষ্টা তো বিয়ের পরেও করতে পারতে। বিয়েটা হোক। কিছুদিন ঘুরেফিরে লাইফ এনজয় করো। তারপর নাহয়…’ 

সেই মুহূর্তে নিশার আগমন ঘটল ঘরে। হাতে চায়ের কাপ। মুর্তজা সাহেবের দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিল সে। তারপর খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে অর্ণবের দিকে ফিরে তাকাল। আন্তরিক গলায় প্রশ্ন করল, ‘আপনাকে চা দেব?’ 

অর্ণবের হৃৎস্পন্দন থেমে এলো হঠাৎ। চোখে ভর করল বোকা বোকা দৃষ্টি। মুর্তজা সাহেব সূক্ষ্মদর্শী অভিজ্ঞ ব্যক্তি। অর্ণবের সহজ সরল মুগ্ধ অভিব্যক্তিটা তার নজর এড়াল না। তিনি কৌশলী গলায় প্রশ্ন তুললেন, ‘বৌমার সঙ্গে তোমার পরিচয় হয়েছে?’ 

‘বৌমা’ শব্দটা অর্ণবের কানে লাগল খট করে। চোখের বোকা দৃষ্টিতে বিদ্যুতের মতো চমক খেলে গেল। 

— ‘ওর নাম নিশা। আমার ছোট ছেলের বৌ।’ 

অজান্তেই অর্ণবের ভ্রুজোড়া কুঁচকে উঠল। ছোট ছেলে বলতে…! 

সদর দরজাটা ঝট করে খুলে গেল সেই মুহূর্তে। খোলা দরজা দিয়ে ধেয়ে আসা এক থোকা, হঠাৎ পাওয়া, জমকালো সূর্যের আলোর মধ্যে তুরিনকে দেখতে পেল ওরা। এই ঝটিকা আগমন সবাইকেই সেকেন্ডের জন্য থমকে দিল। তুরিন উত্তেজিত ভাবে প্রশ্ন করল, ‘বাবা ফিরেছে?’ 

উত্তরটা মুর্তজা সাহেব দিলেন, ‘এখনো ফেরেনি। কেন? সব ঠিক আছে তো?’ 

তুরিন কোন উত্তর না দিয়ে রুক্ষ চোখে একবার তাকাল নিশার দিকে। তাকিয়েই রইল কিয়ৎক্ষণ। তারপর কঠিন গলায় বলল, ‘বাবার সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে।’ 

নিশা সরে এলো জায়গাটা থেকে। হালকা বুক কাঁপল। কী জরুরি কথা বলবে তুরিন তার বাবার সঙ্গে? এই জরুরি কথায় নিশা কোনভাবে জড়িত নেই তো? কে জানে! 

মুর্তজা সাহেব অর্ণবকে যেতে দিলেন ঠিকই। তবে পইপই করে বলে দিলেন ইন্টারভিউ শেষ করেই যেন ফিরে আসে কলোরাডোতে। থেকে যায় আরো কটা দিন। 

ঘড়িতে তখন বিকেল সাড়ে পাঁচটা। নিশা নিজের ঘরে এসে মেয়েকে গোসল করাল। জামাকাপড় পরিয়ে ফিটফাট ফুলবাবুটি সাজিয়ে দিল। তারপর ওকে শাশুড়ির কাছে গচ্ছিত রেখে নিজে সাজতে বসল। কণ্ঠে লেগে রইল গুনগুন গানের সুর। কোন জমকালো সাজ নয়। শাড়ি পরা, চোখে হালকা কাজল দেওয়া, চুলে চিরুনি বুলিয়ে নেয়া…এসব টুকটাক সাজসজ্জাতেই যেন মিশে আছে সীমাহীন আনন্দ! 

সূর্য তখন মধ্য আকাশ অতিক্রম করে পশ্চিমের দিকে হেলে পড়ছে। নেমে আসছে চোখ বরাবর। তীব্র সূর্যরশ্মি ধারাল সুচের মতো বিঁধছে পৃথিবীর শুষ্ক মাটিতে। এই চোখ-ঝলসানো আলোর অত্যাচার বেশিক্ষণ সহ্য করা যায় না। শাহজিদ দরজায় ঝুলানো পর্দা টেনে দিচ্ছিল। হঠাৎ কাচের দরজার ওপাশে, ঝাঁঝাঁ রোদের মধ্যে একটা লম্বা চওড়া ছায়ামূর্তি দৃশ্যমান হয়ে উঠল। শাহজিদ আগে কোথায় যেন দেখেছিল একে! কিন্তু ঠিক মনে করতে পারছে না। 

দরজাটা অল্প করে খুলতেই শক্তপোক্ত চোয়াড়ে চেহারার লোকটা মুখ বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘তুমি নিশ্চয়ই শাহজিদ। আমি অনিমেষ। একটু কথা আছে তোমার সঙ্গে। ভেতরে আসতে পারি?’ 

শাহজিদ দ্বিধাগ্রস্ত নিশ্চল চোখে চেয়ে রইল। মস্তিষ্কের অলিগলি হাতড়ে মনে করার চেষ্টা করল মানুষটাকে আগে ঠিক কোথায় দেখেছিল? চেনা চেনা লাগছে কেন? 

নেইবারহুডের রাস্তার ধারে অনিমেষের গাড়িটা পার্ক করা ছিল। চোখ পড়া মাত্র ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠল ফারা। কী মতলবে এ বাড়িতে এসেছে লোকটা? বারংবার নিষেধ সত্ত্বেও? ভয়ের বিষাক্ত কাঁটা ছড়িয়ে পড়তে লাগল রক্তের শিরায় শিরায়। গলা শুকিয়ে এলো। অনিমেষ কি সর্বনাশটা করেই ছাড়বে? এর সম্পর্কে আরো আগেই সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। একটা ব্যবস্থা নেয়া উচিত ছিল। বিলম্ব হয়ে গেছে। ঢের বিলম্ব! 

কম্পিত বক্ষ নিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকল সে। ড্রইংরুমে শুধু তুরিন বসে আছে। অন্য কেউ নেই। অনিমেষকে দেখা যাচ্ছে না। ফারা মেয়ের দিকে বিভ্রান্ত একজোড়া চোখ স্থাপন করে ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করল, ‘কেউ এসেছে?’ 

তুরিন মোবাইলে গেম খেলছিল। মায়ের প্রশ্ন শুনে একটা ভ্রু উঁচিয়ে বলল, ‘কেউ আসার কথা?’ ফারা বুকের কাঁপাকাপি সামলে নিল কোন রকমে, ‘এমনিই জানতে চাইলাম।’ 

একটু থেমে আবার বলল, ‘তোমার বাবা ফেরেনি এখনো?’ 

— ‘না।’ 

— ‘মনে আছে তো কী বলতে হবে?’ 

— ‘হুম। মনে আছে।’ 

.

অপেক্ষার পালা যেন শেষই হচ্ছে না। মন সর্বক্ষণ উৎকর্ণ হয়ে আছে। ঠায় দাঁড়িয়ে আছে নিশা জানালার পাশে। এর মাঝে অনিমেষ এলো, ফারা এলো…কিন্তু জাহিদ এখনো লাপাত্তা। অনিমেষ অবশ্য সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করেনি। ফ্রন্টইয়ার্ডের উতরাই পেরিয়ে ব্যাকইয়ার্ডে নেমে গেছে। সূর্য এখন শেষ আকাশে নেমে এসেছে। বড্ড কড়া! খালি চোখে ঘরের বাইরে চোখ ফেলা যায় না। দৃষ্টি ঝলসে যায় রোদের তেজে। একটু পরেই প্রখর সূর্যটা টুপ করে হেলে পড়বে রকি মাউন্টেনের সুউচ্চ চূড়ার পেছনে। আলোর দাপট কমে আসবে। আকাশ ভরে যাবে গোধূলীর অপার্থিব রঙে। 

নিশার চোখে সানগ্লাস। রোদচশমার ভেতর থেকে জানালার ওপারের পৃথিবীকে নরম দেখাচ্ছে। উঠোনজুড়ে ছড়িয়ে আছে সাদা আর ম্যাজেন্টা ক্র্যাব অ্যাপল ব্লসম। একজোড়া দস্যি কাঠবিড়ালি ফুলের গালিচার ওপর পূর্ণ উদ্যমে লড়ে যাচ্ছিল। পাশের বাড়ির মোটা হোঁৎকা কালো বেড়ালটা চোখে নীল আলো জ্বালিয়ে কটমটিয়ে এগিয়ে আসতেই কাঠবিড়ালি দুটো লেজ তুলে পালিয়ে গেল ভয়ে। রোজ এই সময় জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে, দুর্ভেদ্যরহস্যপূর্ণ আশ্চর্য প্রকৃতির ভেতর লুকিয়ে থাকা খুঁটিনাটি গল্পগুলো পড়ার চেষ্টা করে নিশা। সময় কেটে যায় দিব্যি! এই দাঁড়িয়ে থাকার পেছনের উদ্দেশ্য শুধু প্রকৃতির গল্প পড়া নয়, বরং প্রিয় মানুষটিকে এক নজর দেখার জন্যই এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগে। বিকেল শেষের পিচ রঙের রোদ্দুর মাথায় নিয়ে একটি মেয়ে জানালায় দাঁড়িয়ে আছে। উতলা বাতাস তার এলোচুল নিয়ে খেলছে। মেয়েটির চোখে ভর করেছে দোজাহানের সমস্ত মায়া। এক সমুদ্র ভালোবাসা বুকে নিয়ে সে প্রিয়জনের পথ চেয়ে আছে। পৃথিবীতে এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য বোধহয় আর হয় না। তবে এই সুন্দর দৃশ্যটা চর্মচক্ষু দিয়ে অবলোকন করার সৌভাগ্য জাহিদের কখনো হয়ে ওঠেনি। কারণ ওর গাড়ি ড্রাইভওয়েতে উঠে আসা মাত্রই নিশা নিজেকে আড়াল করে ফেলে পর্দার আড়ালে। তারপর চোরা চোখে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে। জাহিদ গাড়ি থেকে নেমে একবার দোচালা বাড়ির দিকে মুখ উঁচিয়ে তাকায়। চোখে রোদচশমা থাকে, ঠিক কোন ঘরের জানালায় গিয়ে তার দৃষ্টি আশ্রয় নেয় তা বোঝা যায় না। 

.

আজও ব্যতিক্রম হলো না। গাড়ি থেকে নামামাত্রই ঘাড় উঁচু করে অপরাহ্নের শেষ সূর্যরশ্মিতে ঝলসে যাওয়া বাড়িটার দিকে তাকাল জাহিদ। চোখে পড়ল একটি মায়াবী দৃশ্য। নিশা জানালায় দাঁড়িয়ে আছে। পরনে নীল শাড়ি। মায়ের কোলে ঝুলতে থাকা জুবিন বাবাকে দূর থেকে দেখেই চিনে ফেলল। আশ্চর্য ব্যাপার হলো জীবনে এই প্রথমবারের মতো সে গলা ফাটানো চিৎকারে ফেটে পড়ে বাবা বলে ডেকে উঠল। খোলা বাতাসের অদৃশ্য রথে চেপে সেই ডাকটা ফুড়ুৎ করে এসে ধাক্কা খেলো জাহিদের কান বরাবর। কী আনন্দ যে লাগল! এই আনন্দের কোন তুলনা হয় না। দোতলার জানালায় দাঁড়িয়ে থাকা নিশাকে দেখে, নিশার কোলে জুবিনকে দেখে…জুবিনের আধো বোলের ওই বাবা ডাক শুনতে পেয়ে জাহিদের মনে হলো….বেঁচে থাকাটা আসলে ভারি সুন্দর… সুন্দরের চাইতেও… হাজার গুণ বেশি সুন্দর। 

হ্যাঁ সুন্দরই তো। কেমন কবিতার মতো…পছন্দের গানের মতো… বছরের প্রথম কালবৈশাখী পাগল করা মাতাল হাওয়ার মতো সুন্দর! ওই সুন্দরের উত্তাপ আলপিনের মতো ফুটছিল নিশার সর্বাঙ্গে। বুকের মধ্যে একটা শ্বেতশুভ্র সুখীয়াল কবুতর ডানা ঝাপটে যাচ্ছিল অনবরত। কেমন দমবদ্ধ একটা ভাব হচ্ছিল। জাহিদ নিশ্চয়ই এখুনি দোতলায় উঠে আসবে। লজ্জা লাগছে নিশার। লজ্জার প্রবল তাণ্ডবে কানের ডগা হয়ে উঠেছে টকটকে লাল। অপেক্ষার প্রহরের শেষ ঘণ্টা এখুনি বেজে উঠবে। নিশা রুদ্ধশ্বাসে চেয়ে রইল ঘরের দরজার দিকে। 

‘বাবা!’ 

বাড়ির ভেতরে পা রাখামাত্র ডাকটা কানে এসে লাগল। জাহিদ মুখ তুলে দেখল তুরিন দাঁড়িয়ে আছে লিভিংরুমের মাঝ বরাবর। উঁচু সিলিং থেকে ঝুলতে থাকা ঝাড়লণ্ঠনের ঠিক নিচে। আজ জাহিদের মন ভালো। ঘুম ভাঙার পর থেকেই অপ্রতিরোধ্য এক ভালো লাগার আনন্দ রঞ্জিত মাধুর্যরশ্মি দিনটাকে চারিদিক থেকে যেন মৌমাছির মতো ছেঁকে ধরে রেখেছে। মেয়েকে দেখে খুশি হলো সে। একগাল হাসি হেসে বলল, ‘আমার প্রিন্সেস কেমন আছে?’ 

তুরিন থমথমে গলায় বলল, ‘ভালো না।’ 

জাহিদ এতক্ষণে তুরিনকে সূক্ষ্মভাবে লক্ষ করল। সাজসজ্জা পরিপাটি। মুখে পরিমিত প্রসাধন। কোথাও কোন অস্বাভাবিকতার ছাপ নেই। তবে খেয়াল করলে বোঝা যায় খর্বকায় চোখের তারায় সাংঘাতিক এক অস্থিরতা বিরাজমান। জাহিদের বুক সামান্য কাঁপল, ‘কী হয়েছে?’ 

— ‘তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে। সময় হবে?’ 

জাহিদ হাতের কবজিতে বাঁধা অ্যাপলওয়াচটা দেখল একবার। ভ্রুজোড়া ক্ষীণ কুঞ্চিত হলো। সাড়ে ছয়টা বেজে গেছে। নিশা নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছে তার জন্য। জাহিদ মৃদু গাম্ভীর্যের সঙ্গে মেয়েকে বলল, ‘খুব আর্জেন্ট কিছু বলার আছে কি? রাতে ফিরে এসে কথা বলি?’ 

তুরিনের নাকটা ফুলে ঢোল হয়ে উঠল মুহূর্তের মাঝে। কণ্ঠে ঝনঝন করে বেজে উঠল প্রতিবাদী অভিমান, ‘ইউ নেভার হ্যাভ টাইম ফর মি, বাবা! মাত্র তো অফিস থেকে ফিরলে। এখুনি কী এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজ পড়ে গেল?’ 

জাহিদ বিপন্ন বোধ করল। অপরাধবোধ হালকাভাবে ডঙ্কা বাজিয়ে গেল বিবেকের কাঠগড়ায়। সত্যিই মেয়েটাকে আজকাল একদম সময় দেওয়া হচ্ছে না। 

— ‘আমার প্রিন্সেসের জন্য আমার সময় থাকবে না, ইজ দ্যাট ইভেন পসিবল?’ কথাটা বলতে বলতে জাহিদ এগিয়ে এলো কয়েক পা। দাঁড়াল তুরিনের মুখোমুখি। কিচেন কাউন্টারের টুলে বসে ছুরি দিয়ে ফল কাটছিল ফারা। মাঝে কোন দেওয়াল নেই। কিচেন থেকে লিভিংরুমের সবটাই দেখা যায়। শোনাও যায়। উত্তর দিকের জানালার কাচের ভেতর দিয়ে সামনের উঠোনটা পরিষ্কার ভাবে দৃশ্যমান। হঠাৎ ব্যাকইয়ার্ডের ঢাল বেয়ে অনিমেষকে উঠে আসতে দেখল ফারা। অনিমেষ কোনদিকে তাকাল না। উঠোন পেরিয়ে সোজা হনহন করে এগিয়ে গেল রাস্তায়। দৃশ্যটা দেখামাত্র একটা জটিল অঙ্ক যেন চোখের পলকে সমাধান হয়ে গেল। এর মানে অনিমেষ এতক্ষণ শাহজিদের ঘরে ছিল। কিন্তু শাহজিদের সঙ্গে অনিমেষের কীসের সম্পর্ক? ওরা আবার কবে থেকে বন্ধু হলো? কী এমন গোপন কথা থাকতে পারে ওদের দুজনের? ভাবতে গিয়ে ফারার বুক ধড়ফড় করতে লাগল। দুর্মোচ্য দুশ্চিন্তা বিষাক্ত হুল ফুটাতে থাকল মস্তিষ্কের শার্সিতে। 

এদিকে জাহিদ তখন তুরিনের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। তুরিন বাবার চোখে চোখ রেখে একরোখা ভঙ্গিতে বলছে, ‘আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ 

— ‘কী সিদ্ধান্ত?’ 

— ‘নিশাকে তোমার ডিভোর্স দেওয়ার কথা ছিল। তুমি প্রমিজ করেছিলে আমাকে। ভুলে গেছ?’ 

জাহিদের মুখে ঝপ করে অমাবস্যার অন্ধকার নেমে আসে। মনের মধ্যে ভাসতে থাকা উদভ্রান্ত আনন্দের জোয়ারে ভাটা পড়ে যায় নিমেষে! 

— ‘কথা বল বাবা!’ 

— ‘হঠাৎ এই প্রসঙ্গ তুললে কেন?’ 

তুরিনের কণ্ঠস্বর উচ্চাঙ্গে উঠে গেল, ‘বলছি কারণ আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ 

— ‘কী সিদ্ধান্ত?’ 

— ‘তোমাকে যেকোন একজনকে বেছে নিতে হবে! হয় আমি…নাহয় নিশা…নিশাকে ডিভোর্স না দিলে আমি তোমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে বাধ্য হব। তোমার লাইফ থেকে অনেক দূরে সরে যাব।’ 

জাহিদ থ বনে গেল মেয়ের কথা শুনে। বিস্ময়ের বুলেট ক্ষিপ্ৰ গতিতে তেড়ে এসে সবলে বিদ্ধ হলো বুকের পাটাতনে। টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া ক্ষত-বিক্ষত হৃদয় নিয়ে সে বড় আদরের… যত্নের…শখের… প্রিয় কন্যার দিকে চেয়ে রইল ব্যথিত চোখে। মেয়েটা কি অনেক বড় হয়ে গেছে? অনেক বড়? এত বড় যে বাবার সামনে দাঁড়িয়ে এমন মর্মান্তিক বেপরোয়া কথা বলতে একবারও বুক কাঁপল না? 

— ‘আমার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে পারবে তুমি?’ 

তুরিন চোখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নিয়ে বলল, ‘পারব…নিশাকে তুমি আমাদের জীবন থেকে না সরালে…আমিই সরে যাব বাবা! সত্যি বলছি! এখন তুমিই বলো…নিশাকে চাও? নাকি আমাকে?’ 

জাহিদ নিশ্চল দুটি জখম ভরা চোখের তারা কন্যার মুখের ওপর স্থিরভাবে নিবদ্ধ করে রাখল কিয়ৎক্ষণ। তারপর বাষ্পরূদ্ধ গলায় বলল, ‘আমার দুজনকেই চাই!’ 

রোষের আগুন ঝিলিক দিয়ে ওঠে তুরিনের চোখে। গরম তেলে পেঁয়াজ ছাড়ার মতো ছ্যাত করে উঠে বলে, ‘এটার মানে কী?’ 

নিশা নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়েছে লিভিংয়ের দরজার কাছে। জাহিদ নিশার দিকে তাকাল একবার। তারপর চোখ ফিরিয়ে আনল তুরিনের মুখের ওপর। বড় একটা শ্বাস টেনে নিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ‘তুমি তো এখন আর ছোট নও তুরিন। বড় হয়ে গেছ। এতটাই বড়…যে বাবাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা মুখ ফুটে বলতে তোমার ভয় করছে না। এ দেশে অবশ্য তোমার বয়সি ছেলেমেয়েরা বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকে না। কিন্তু আমি চাই না তুমি আমাকে ছেড়ে দূরে কোথাও যাও। আমাদের পরিবারটা এখনো বেশ রক্ষণশীল। এ কথা তো তোমার অজানা নয়। তা ছাড়া তোমাকে ছাড়া বেঁচে থাকার কথা আমি ভাবতেই পারি না! ঠিক তেমনি…নিশাকে ছেড়ে দেওয়াও আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। ডিভোর্সের কথা বলছ…যদি ডিভোর্স দিতেই হয় তবে নিশাকে নয়, বরং…’ 

তুরিনের সমস্ত অন্তঃকরণ আচমকা ভীষণভাবে বিদ্রোহী হয়ে উঠল এতকাল সে জানত বাবা তাকে জীবনের সবকিছুর চাইতে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। বাবার কাছে সমস্ত দুনিয়া একদিকে আর তুরিন অন্যদিকে। ছোটবেলা থেকে মাত্রাতিরিক্ত এক পিতৃস্নেহের অহংকার বুকে নিয়ে বেড়ে উঠেছে সে। বাবা তার একান্ত ব্যক্তিগত এবং নিজস্ব ঐশ্বর্য। এই ঐশ্বর্যে কেউ কোনদিন ভাগ বসাতে আসেনি। এমনকি নিজের জন্মদাত্রী মায়েরও সেই স্পর্ধা হয়নি। আজকে বাবার কাছে নিশা আর তুরিন এক হয়ে গেল? 

— ‘কী বলতে চাইছ তুমি? নিশাকে ডিভোর্স দেবে না…তো কাকে ডিভোর্স দেবে?’ তুরিনের কণ্ঠস্বর অসম্ভব কাঁপতে লাগল। জাহিদ স্থির ভাবে বলল, ‘তুমি শান্ত হও! ঠান্ডা মাথায় কথা বলো।’ শান্ত হওয়ার কোন লক্ষণ তো দেখা গেলই না বরং বাঘিনীর মতো গর্জে উঠে বাবার ওপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল তুরিন। শার্টের কলার খামচে ধরে দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলতে লাগল, “আমার মাকে ডিভোর্স দেবে তুমি? আমার মাকে?’ 

এই আকস্মিক আক্রমণে জাহিদ বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেছে। তুরিনের মধ্যে আদব-কায়দার অভাব ছিল বরাবর। কিন্তু এতটা সীমা লঙ্ঘন এর আগে কখনো করেনি সে। ফারা কিচেন কাউন্টার থেকে নীরব চোখে সবটাই দেখছিল। মেয়ের কৃতিত্বে সে শুধু সন্তুষ্টই নয়, বরং মুগ্ধ! 

নিশা ঠিক করেছিল বাবা-মেয়ের মধ্যে কখনোই আগ বাড়িয়ে কথা বলবে না। কিন্তু চোখের সামনে প্রিয় মানুষটার এহেন হেনস্থা তার সহ্য হলো না। আগ পিছ কিছু চিন্তা না করেই বুনো হরিণীর মতো ক্ষিপ্র পায়ে এগিয়ে গেল সে। 

তুরিনের হাতটা জাহিদের শার্টের কলার থেকে এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে ধমকের সুরে বলল, ‘কী করছ তুমি? বাবার সঙ্গে কেউ এমন আচরণ করে? 

তুরিনের চোখে বীভৎস এক ঘৃণার তরঙ্গ ফুঁসে উঠল। পাশবিক, বর্বর রাগের উৎকট অত্যাচারে অন্ধ হয়ে এলো চোখের দৃষ্টি। হঠাৎ ডান হাতটা ঝড়ের বেগে শূন্যে তুলে নিয়ে একটা অতর্কিত অভাবনীয়…অনভিপ্রেত আঘাত করে বসল সে নিশার গাল বরাবর। চপেটাঘাতের নির্মম শব্দটা যেন বিস্ফোরণের মতো ফেটে পড়ল সারা ঘরময়। মুহূর্তের জন্য থমকে গেল সবার হৃদস্পন্দন। 

ফারা উঠে দাঁড়িয়েছে বসা থেকে। হাত ফসকে ফল কাটার ছুরি পড়ে গেছে মেঝেতে। দারুণ ব্যাপার তো! আনন্দ আর উত্তেজনায় শ্বাস আটকে আসার উপক্রম হলো তার। 

অপমানে নিশার মুখ রক্তাভ হয়ে উঠেছে। চোখে টসটস করছে জল। জাহিদ থমকে গেছে সহস্র বছরের হিমায়িত জীবাশ্মের মতো। তার মুখখানা মৃত মানুষের মতো সাদা। কোন এক প্রলয়ংকরী ঝড় যেন এইমাত্র তার সমস্ত জীবনটাকে শিকড়শুদ্ধ উৎপাটিত করে দিয়ে গেছে। কয়েকটা স্থবির সেকেন্ড কেটে যাওয়ার পর জাহিদ জীবনে প্রথমবারের মতো এমন একটা কাজ করল, যা করার কথা কস্মিনকালেও ভাবেনি কখনো! যে মেয়ের গায়ে কোনদিন একটা টোকাও দেয়নি, সেই অতি স্নেহের, সাধের, পুতুলের মতো আদরের মেয়েটার গালে ক্ষিপ্রগতিতে এক করাঘাত বসিয়ে দিয়ে গগনবিদারী চিৎকারে ফেটে পড়ে বলল, ‘কী করলে তুমি? এত বড় সাহস হয় কী করে তোমার? অভদ্রতার সীমা থাকা উচিত!’ 

আঘাতের ধাক্কায় তুরিনের হালকা পাতলা শরীর কয়েক কদম পিছিয়ে গেছে। ঘাড়টা কাত হয়ে আছে হালকা। চোখের অচলিষ্ণু দৃষ্টি থেকে ফেটে পড়ছে আকাশস্পর্শী বিস্ময়। থরথর করে কাঁপছে দুটি ফ্যাকাসে পাতলা ঠোঁট ফারা ত্বরিত পদে এগিয়ে এলো কাছে। মর্মান্তিক হাহাকারে তার বক্ষ বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। একজন মানুষ কতটা পাষাণ হলে বাচ্চা একটা মেয়েকে এভাবে আঘাত করতে পারে! সে জাহিদের দিকে চেয়ে তীব্র বিদ্বেষ নিয়ে বলল, ‘তুমি কি মানুষ? নিজের সন্তানের গায়ে হাত তুললে?’ 

জাহিদ বজ্রকণ্ঠে বলল, ‘তুমি চুপ কর। আজকের এই পরিস্থিতির জন্য একমাত্র তুমিই দায়ী!’ 

— ‘আমি দায়ী?’ 

— ‘হ্যাঁ তুমি।’ 

তুরিনের বোধ বুদ্ধি তখন শূন্যের কোঠায়। রাগ, দুঃখ আর অপমানের চূড়ান্ত আস্ফালনে তার হৃৎপিণ্ড বিকল প্রায়। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। শরীরের ইঞ্চি ইঞ্চি চামড়ায় ক্রমাগত বিঁধে যাচ্ছে যন্ত্রণার সুচ। ফারা নিশার মুখের ওপর জ্বলন্ত চোখ বিদ্ধ করে অত্যন্ত কর্কশভাবে বলল, ‘এবার খুশি হয়েছ? আমার সংসারটা ভেঙে দিয়ে শান্তি হয়েছে তোমার?’ 

নিশা এ কথার পিঠে কড়া কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে গেল আবার। জাহিদের ক্রোধ জর্জরিত, অবিচলিত…অথচ তীব্র শোচনীয় অটল মূর্তি তার মুখের কথা কেড়ে নিল। বিপদের সময় সবাই একযোগে মাথা গরম করলে চলে না। বরং ঠান্ডা মাথায় প্রিয়জনের পাশে দাঁড়ানোই বুদ্ধিমানের কাজ। 

জীবনটাকে সেই মুহূর্তে দুঃসহ এক পাষাণভার মনে হচ্ছিল জাহিদের। সংসারের এমন বীভৎস, নারকীয় অশান্তির মধ্যে বেঁচে থাকার চাইতে বিষ পান করে মরে যাওয়াও বুঝি ঢের সহজ কাজ! মস্তিষ্কে একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটছে। আজকে এর একটা বিহিত করেই ছাড়বে সে। এভাবে আর চলতে পারে না। তুরিনের পাশ থেকে ফারাকে এক ঝটকায় দূরে সরিয়ে দিয়ে ক্ষিপ কণ্ঠে বলল, ‘তুরিন শোন, আজ তোমার সঙ্গে একটা সিক্রেট শেয়ার করব। এতদিন তোমাকে বলিনি কারণ ব্যাপারটা জানতে পারলে তুমি ভয়ংকর কষ্ট পাবে।’ 

তুরিন স্পন্দিতবক্ষ নিয়ে…বিস্ফারিত চক্ষে চেয়ে ছিল। তার মনে হচ্ছিল এই বাবাকে সে চেনে না। এমন পাগল পাগল অপ্রকৃতস্থ, অসংলগ্ন আচরণ বাবা এর আগে কোনদিন করেনি কারো সঙ্গে। তুরিনের ডান হাতের পাঁচ আঙুল তখনো নিজের গালের সঙ্গে লেপটে আছে। ওই গালে এখনো আঘাতের রেশ রয়ে গেছে। এই রেশ রয়ে যাবে আজীবন। আজকের ঘটনা ওর জীবন পাল্টে দিয়েছে। এতদিন কিচ্ছু না থাকলেও একান্ত নিজের একজন বাবা ছিল! আশ্রয় ছিল! আজ থেকে সেই বাবা পর হয়ে গেছে। হয়ে গেছে নিশার মতো গেঁয়ো, অশিক্ষিত মেয়ের আজ্ঞাবহ ভৃত্য। এই বাবাকে তার একটা ফোঁটাও ভালোবাসতে ইচ্ছে হচ্ছে না আর। ঘৃণা হচ্ছে…বীভৎস ঘৃণায় কাদার মতো থকথক করছে মনের চরাচর। ফারা তুরিনের সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়াল, ‘কী সিক্রেট শেয়ার করবে তুমি আমার মেয়ের সঙ্গে? তোমার মাথা মনে হয় গেছে একেবারেই।’ কথাটা বলতে বলতে সে তুরিনের হাত টেনে ধরে অনেকখানি দূরে সরে এলো। গলার স্বর এক ডিগ্রি নিচে নামিয়ে মেয়েকে বলল, ‘তুমি ঘরে যাও।’ 

— ‘ও কোথাও যাবে না! আমার কথা শেষ হয়নি এখনো।’ স্পর্ধিত কণ্ঠে কথাগুলো বলতে বলতে জাহিদ মেয়ের দিকে এগিয়ে এসে খপ করে ধরল একটা হাত। উত্তেজিত, ভীত, এবং যন্ত্রণাবিদ্ধ করুণ চোখে তুরিন একবার মায়ের দিকে এবং বাবার দিকে তাকাল। ফারার গালের চামড়া ভীষণ সাদা দেখাচ্ছে। কোটর থেকে আরেকটু হলেই বেরিয়ে পড়বে চোখের ডিম। হাত- পায়ের কাঁপনটা ধরা পড়ছে স্পষ্টভাবে। নিশা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করছিল ওকে। এত ভয় পাবার মতো হঠাৎ কী ঘটনা ঘটল? এই মহিলা অযথা এত ভয় পাচ্ছে কেন? 

— ‘তোমার মাকে প্রশ্ন কর অনিমেষের সঙ্গে তার কী সম্পর্ক?’ 

তুরিন প্রশ্নটা শুনল ঠিকই…কিন্তু বাক্যগুলো যেন তার মস্তিষ্কে কোন অর্থের অনুরণন ঘটাতে সক্ষম হলো না। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল শুধু। ফারা অস্থিরভাবে বলল, ‘বাজে কথা বলো না জাহিদ! অনিমেষ আমাদের বন্ধু! ওর সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের সম্পর্ক। ঠিক যেমন তোমার। এটা তো সবাই জানে! 

জাহিদ ফারার কথায় ভ্রূক্ষেপ না করে তুরিনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার মা মিথ্যে বলছে। অনিমেষের সঙ্গে তার…’ জাহিদ বড় একটা শ্বাস ফেলে চোখ নামিয়ে নিল নিচে। জমাট, গম্ভীর অথচ সুস্পষ্ট গলায় বলল, ‘সত্যটা হলো অনিমেষের সঙ্গে ওর অ্যাফেয়ার চলছে অনেকদিন ধরে। জানি কথাটা শুনতে তোমার খারাপ লাগছে…হয়তো বিশ্বাস হচ্ছে না…কিন্তু তুরিন…লক্ষ্মী মা আমার…ইউ নিড টু বি স্ট্রং…সত্যকে গ্রহণ করার মতো যথেষ্ট শক্তি ধারণ করতে হবে বুকে।’ 

কথাগুলো বলতে বলতে জাহিদ মেয়েকে নিজের কাছে টেনে আনার চেষ্টা করল। তুরিন এক ঝটকায় বাবার হাতটা দূরে সরিয়ে দিল। অবিশ্বাস ভরা অপ্রকৃতস্থ চোখে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ বাবার দিকে। তারপর মায়ের দিকে ঘুরে চাপা গলায় বলল, ‘এসবের মানে কী?’ 

ফারাকে দেখে মনে হচ্ছিল মাঝ সমুদ্রের উত্তাল ঝড়ে তাকে একলা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। অস্বাভাবিক ভীতির আক্রমণে কণ্ঠস্বর রোধ হয়ে এসেছে তার। হাঁটু কাঁপছে ঠকঠক করে। জাহিদ এভাবে কথাটা সরাসরি তুরিনকে বলে বসবে এটা ছিল ধারণার বাইরে। সে ভেবেছিল অন্তত মেয়ের জন্য হলেও লোকটা মুখ বুজে সবকিছু সহ্য করবে…মানিয়ে নেবে…সংসার ভাঙবে না। 

নিশা এই চমকের জন্য প্রস্তুত ছিল না। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট, বিস্ফারিত বদনে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। জাহিদ তুরিনের হাতটা আরো একবার ধরল শক্ত করে, অনেকটা ফিসফিস করে বলল, ‘আই ওয়ান্ট ইউ টু বি ব্রেভ নাউ…ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড? ইউ হ্যাভ টু ফেস দ্য ট্রুথ, ইভেন ইফ ইট হার্টস আ লট… ফারা হঠাৎ গগনবিদারী চিৎকার করে উঠে বলল, ‘মিথ্যা কথা বলছে তোমার বাবা। সব মিথ্যা…নিশাকে যেন ডিভোর্স দিতে না হয় সেইজন্য এসব মিথ্যা নাটক সাজাচ্ছে! নিশা আর তোমার বাবা মিলে দুজনে প্ল্যান করে আমাকে ফাঁসাতে চাইছে।’ 

তুরিন পাংশুবর্ণ, বিকারগ্রস্ত চোখে বাবা-মায়ের দিকে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ। তারপর প্রাণহীন, মৃত গলায় কেটে কেটে বলল, ‘আই হেইট ইউ বোথ…নোংরা…ভীষণ নোংরা তোমরা…ঘেন্না হয় আমার!’ 

কথাটা বলেই ঘূর্ণির মতো উল্টো দিকে ঘুরে একটা দৌড় দিল তুরিন। সিঁড়ির গোড়ায় আনিতা দাঁড়িয়ে ছিল। তুরিনকে আসতে দেখে চট করে অন্যদিকে সরে গেল। 

ফারার চোখের কার্নিশ তখন চুপচুপ করছে জলে। জাহিদের দিকে কটাক্ষ করে বলল, ‘কাজটা তুমি ঠিক করলে না!’ কথাটা ছুঁড়েদিয়েই তুরিনের পেছন পেছন দৌড়ে গেল সে। জাহিদ অসহায় ভাবে একবার তাকাল নিশার দিকে। ঝড়ের ঝাপটা আর অগ্রাহ্য করা গেল না। মুষড়ে পড়া কাটা গাছের মতো ঝপ করে বসে পড়ল সোফার ওপরে। বিষাদ জড়ানো কণ্ঠে বলল, ‘সরি নিশা…সব কিছুর জন্য আমি অনেক অনেক সরি… তুরিনের হয়ে আমিই তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। ক্ষমা করে দিও প্লিজ। আমার মেয়েটা এখনো ছেলেমানুষ … ম্যাচিওরিটি জিনিসটা ওর মধ্যে একেবারেই গ্রো করেনি…’ 

নিশা ধীর পায়ে হেঁটে এসে জাহিদের পাশে বসল। ‘আমাকে নিয়ে ভাববেন না। আমি ঠিক আছি।’ 

জাহিদ পলক তুলে চাইল নিশার দিকে। এতকিছুর পরেও কী করে এতটা ধীর, শান্ত এবং স্নিগ্ধ থাকে মেয়েটা? জাহিদের অসহায়, ব্যথিত চোখের চাউনি দেখে কেমন মায়া হলো নিশার। ওর হাতের ওপরে একটা হাত রাখল সে। মৃদুস্বরে বলল, ‘আপনি ভেঙে পড়বেন না একদম! আমি জানি আপনি আপনার বড় মেয়েকে অনেক ভালোবাসেন। ওকে কেউ আপনার কাছ থেকে দূরে সরাতে পারবে না। আল্লাহ ভরসা।’ 

জাহিদ একটা ঘন শ্বাস ফেলে বলল, ‘মেয়েকে ধরে রাখতে গিয়ে যদি তোমাকে ছেড়ে দিতে হয়…সেটা আমি সহ্য করতে পারব না নিশা! আবার তুরিন আমাকে ঘৃণা করছে.. এমন কোন পরিস্থিতি আসার আগে যেন আমার মৃত্যু হয়!’ 

— ‘এসব বাজে কথা বলবেন না। তুরিন আপনাকে অসম্ভব ভালোবাসে। রাগের মাথায় আমরা অনেক কিছুই বলে ফেলি যেসব কথার আসলে কোন অর্থ হয় না।’ 

এরপর ওরা কেউ আর কোন কথা বলল না। চুপচাপ বসে রইল একে অপরের হাতে হাত রেখে। এক সময় নিশা নিজের মাথাটা জাহিদের কাঁধের ওপর হেলিয়ে দিল আস্তে করে। চোখ বন্ধ করল। হারিয়ে যাওয়া শান্তির মেঘেরা হৃদয়াকাশে ফিরে এলো পায়ে পায়ে। নিঃশ্বাস ভরে গেল কুসুমগন্ধি স্বস্তির পেঁজাতুলো স্পর্শে। মনে হলো বেঁচে থাকাটা অতটাও খারাপ নয়! 

.

তুরিনের ঘরের দরজা বন্ধ। টানা পাঁচ মিনিট দরজায় ধাক্কা দিয়ে গেল ফারা। মেয়ের কোন সাড়াশব্দ নেই। হঠাৎ মনে পড়ল আজ বিকেলে অনিমেষ এসেছিল শাহজিদের ঘরে। লোকটা আবার কোন জট পাকিয়ে গেছে কে জানে! কথাটা মনে হতেই দ্রুত পায়ে নিচে নেমে এলো ফারা। শাহজিদের সঙ্গে এই মুহূর্তে কথা বলাটা তুরিনের রাগ ভাঙানোর চাইতে আরো অনেক বেশি জরুরি। 

পায়ের শব্দ শুনে ঘুরে তাকাল শাহজিদ। সিঁড়িঘরটা অন্ধকার হয়ে আছে। ঘন অন্ধকারের প্রলেপ ভেদ করে ক্রমশ একটা ছিপছিপে দেহ ল্যাম্পশেডের পিঙ্গল আলোয় দৃশ্যমান হয়ে উঠল। বাইরে ঝিম ধরা সন্ধ্যা। ব্যাকইয়ার্ডে কয়েকটা বাদুড় উড়ছে ছন্নছাড়াভাবে। কলোরাডোতে পোকার উপদ্রব নেই। জোনাকিও জ্বলে না। বাদুড়গুলোই সন্ধ্যার পর থেকে উড়াউড়ি করে এলাকাবাসীকে ত্যক্ত-বিরক্ত করে ফেলে। শাহজিদ ব্যাকইয়ার্ডের দরজার সামনে হুইলচেয়ার নিয়ে বসে ছিল। আড়চোখে ফারাকে দেখতে পেয়ে চেয়ারটা ঘুরিয়ে নিল। 

— ‘কেউ এসেছিল?’ 

ভূমিকাবিহীন অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নটা শাহজিদের কপালে অনভিপ্রেত ভাঁজ ফেলল। ভ্রু উঁচিয়ে বলল, ‘কারো আসার কথা ছিল নাকি?’ 

ফারা তীব্র চোখে তাকাল শাহজিদের দিকে। সে খুব ভালো মতোই জানে খোঁড়া, ল্যাংড়া যাই হোক না কেন এই ছেলে আদতে সহজ বস্তু নয়। চূড়ান্ত চালাক! দুনিয়ায় এত লোক থাকতে অনিমেষ এই ধূর্ত এবং অভদ্র ছেলেটার কাছে কেন গোপন অভিসারে এলো, এটাই তার মাথায় ঢুকছে না। ফারার ফ্যাকাসে মুখখানার দিকে অটল, স্থবির চোখে চেয়ে ছিল শাহজিদ। একটা ইট রঙের টপ আর ব্লু জিন্স ওর পরনে। হাই হিল জুতো। খোলা চুলের নিচের দিকটা কোঁকড়ানো। বেশ ফ্যাশন্যাবল দেখাচ্ছে। চোখের দিকে তুরিনের সঙ্গে বেশ মিল! কিন্তু তুরিনের মতো স্নিগ্ধ নয়। মুখের ছাঁচ যেমনই হোক না কেন রূপের বিশুদ্ধতা আসলে নির্ভর করে মনের স্বচ্ছতার ওপরে। এই চিরন্তন সত্যটা যেন নতুন রূপে আরো একবার অনুভব করল শাহজিদ। ফারার বাইরের চটক যতই আকর্ষণীয় হোক না কেন, ভেতরকার কুৎসিত কদর্যতা ওর সমস্ত অস্তিত্বকে কলুষিত করে তুলেছে। ফারা একটা বড় শ্বাস টেনে নিয়ে সরাসরি বলল, ‘অনিমেষ এসেছিল এখানে? 

— ‘সেই কৈফিয়ত আমার আপনাকে দিতে হবে?’ 

ফারা দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল, ‘কী কথা হয়েছে ওর সঙ্গে তোমার?’

শাহজিদ হাসল…গা শিউরে ওঠা, ঠান্ডা কনকনে হাসি। ভয়ের একটা শিরশিরে কাঁপন লাগল ফারার হৃৎপিণ্ডে। অধৈর্য হয়ে বলল, ‘আমার প্রশ্নের উত্তর দাও!’ 

— ‘এত ভয় পাচ্ছেন কেন? ভয়ের কিছু নেই…আমি আপনার সিক্রেট আপাতত কাউকে বলছি না।’ 

এ কথা শোনামাত্র ফারার মুখটা নীল হয়ে উঠল যন্ত্রণায়। চোখে ঝাপটা দিল অনিশ্চয়তার ঢেউ। ঠোঁট প্রেতাত্মার মতো সাদা। ইচ্ছে হলো অনিমেষের গলায় পাঁচ আঙুল চেপে ধরে খুন করে। কেন লোকটা তার এত বড় সর্বনাশ করল! এতগুলো বছর ধরে তিলতিল করে নিজের মেয়ের জন্য সাজানো- গোছানো পরিপাটি একটা সংসার গড়ে তোলার নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াস চালিয়ে গেছে ফারা। কত যুদ্ধ, কত সংগ্ৰাম, কত জ্বলন্ত মিথ্যের আশ্রয় নিতে হয়েছে এই সংসারটা ধরে রাখার জন্য। আজ অনিমেষ তার এত বছরের সংগ্রামকে এক লহমায় গুঁড়িয়ে দিয়ে গেল। 

— ‘তুমি এখনো এ বাড়িতে পড়ে আছ কেন? তোমার না চলে যাওয়ার কথা ছিল?’ 

শাহজিদ ঠোঁটে ঠান্ডা হাসিটা ধরে রেখেই ঠান্ডা গলায় বলল, ‘আমি তো চলে যেতেই চেয়েছিলাম। আপনার মেয়ে যেতে দিল না। ভুলে গেছেন?’ 

ফারার মাথাটা পাগল পাগল লাগছিল। মনে হচ্ছে যেন একটা সাইক্লোন ঘুরছে চারপাশে। এখুনি তার সমস্ত অস্তিত্বসহ উপড়ে নিয়ে ছুঁড়েফেলবে দূরে। আতঙ্কে শুকিয়ে গেছে গলা। শুকনো ঠোঁট জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে সে কোন রকমে বলল, ‘তুমি এখুনি বের হও। এখানে থেকে কাজ নেই আর।’ 

— ‘কাজ আছে।’ শাহজিদ বলল, গলায় অশনির কাঁপন তুলে। 

— ‘কী কাজ?’ নিঃশ্বাস থেমে গেছে ফারার। 

শাহজিদ ফারার চোখে চেয়ে স্পষ্ট গলায় বলল, ‘আপনার মেয়ে আমাকে ভালোবাসে, জানেন তো, তাই না?’ 

ফারার মনে হলো কথা নয়, যেন গাল বরাবর কেউ জুতো পেটা করল এইমাত্র! তীব্র রোষে গজগজ করে উঠে বলল, ‘তুরিন একটা বেকুব মেয়ে। ওর তোমার প্রতি কোন ফিলিংস নেই। তুমি চোখের সামনে থেকে বিদেয় হলেই দিব্যি ভুলে যাবে। তোমার মতো অথর্ব একটা ছেলের কথা ওর মনেই থাকবে না।’ 

শাহজিদ ডান গালে জিব ঠেকিয়ে কিছু একটা চিন্তা করল গভীরভাবে তারপর হালকা হেসে বলল, ‘তুরিনের ফিলিংস আছে কি নেই সেটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। 

— ‘মানে? কী বলতে চাইছ তুমি?’ 

— ‘তুরিনকে একটা কঠিন সত্যের সম্মুখীন হতে হবে খুব শিগগিরই। আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু লিভ হার এলোন অ্যাট দিস টাইম। পাশে থাকতে চাই।’ 

ফারার বুকের সমস্ত রক্তপ্রবাহ স্তব্ধ হয়ে এলো হঠাৎ। ফুলে উঠল কপালের নীল শিরা। সাদা…ভীষণ সাদা আর ফ্যাকাসে দেখাতে লাগল তাকে। শরীরের কম্পনটা এতই ব্যক্ত হয়ে ফুটে উঠল যে শাহজিদের মনে হলো সামনে দাঁড়ানো মানুষটা মৃগী রোগে আক্রান্ত। 

— ‘কী বলছ এসব? কীসের সত্য?’ অপ্রস্তুত, অপ্রতিভ এবং ভীত ফারা একটু হাসার চেষ্টা করে। গলার স্বর স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বলে, ‘ফাজলামোর একটা সীমা থাকা উচিত।’  

শাহজিদ কিছু বলে না। মুখে সেই দুর্বোধ্য ঠান্ডা হাসি ঝুলিয়ে রেখে অকপটে চেয়ে থাকে ফারার উদ্ভ্রান্ত, ফ্যাকাসে মুখখানার দিকে। উত্তেজনায় ফারার ঘাম হতে থাকে। ফরসা কপাল ভরে যায় চূর্ণ কাচের মতো ঘাম বিন্দুতে। ভীষণ ধুকপুক করতে থাকে বুকটা। মনে হয় এখুনি বুঝি হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া-প্রক্রিয়া থমকে যাবে। রুদ্ধশ্বাসে বলে, ‘আমার মেয়ের জীবনে কোন গোপন সত্য নেই। আমার বিরুদ্ধে অযথা ষড়যন্ত্র কোরো না। এর ফল ভালো হবে না বলে দিচ্ছি।’ কথাগুলো বলতে গিয়ে গলার স্বর প্রায় বুজে আসে তার। দুর্ভাবনার বিশ্রী একটা দম-আটকানো স্রোত বয়ে যায় মনের ওপর দিয়ে। অনিমেষ কেন এসেছিল শাহজিদের কাছে? নিজের জীবনের কদর্য গোপন সত্য অচেনা এক অথর্ব গোঁয়ার যুবকের সামনে মেলে ধরার পেছনে কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে? অনিমেষ…অনিমেষ …অনিমেষ…! এই মুহূর্তে অনিমেষকে সামনে পেলে হিংস্র নেকড়ের মতো ওর শরীরের সমস্ত মাংস আর হাড়গোড় ছিন্নভিন্ন করে তুলত! ফারা অপ্রকৃতস্থ ভঙ্গিতে কয়েক পা এগিয়ে আসে, ‘তুমি বেরিয়ে যাও এখুনি।’ 

শাহজিদ হাসে, ‘ভয় পাচ্ছেন?’ 

প্রচণ্ড রাগ হয় ফারার। রাগের বিভীষণ ঝাপটায় অন্ধ হয়ে আসে চোখ। চিৎকার করে বলে, ‘ভয় তো তোমার পাওয়া উচিত…তোমার কোন ধারণাই নেই এর পরিণতি কী কঠিন হতে পারে!’ 

— ‘কী করবেন শুনি? খুন করবেন? 

— ‘প্রয়োজনে তাই-ই করব!’ শাহজিদ হেসে ওঠে শব্দ করে। সেই অট্টহাসির দিকে চেয়ে থেকে শিউরে ওঠে ফারার সর্বাঙ্গ। গলায় নিঃশ্বাস আটকে যায়। কম্পিত বক্ষ নিয়ে সে অবলোকন করে, এলোমেলো চুলের সবল মুখের যুবকটির মধ্যে ভয়ের চিহ্নমাত্র নেই। হ্যাজেল রঙের চোখজোড়া থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে আত্মবিশ্বাস এবং সাহস। মুখের উঁচু হাড়ে ঝিলিক দিচ্ছে অহংকার। আশ্চর্য! জীবনের কাছে হেরে যাওয়া ব্যর্থ, পঙ্গু, অসহায় এক মানুষের মধ্যে এত অহংকার আসে কোত্থেকে? ফারা জানত, অর্থ এবং প্রাচুর্যই মানুষের অহংকারের মূল উৎস। এই ছেলের ধনাঢ্যতা নেই, এমনকি শারীরিক সুস্থতাও নেই। দু পায়ে ভর দিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার সামর্থ্য নেই। এর অহংকারের উৎস কী? ফারা শরীর জোড়া ভীতির সঞ্চার নিয়ে কয়েক পা পিছিয়ে আসে। দ্রুত এগিয়ে যায় সিঁড়ির দিকে। তার মনে হয় হাতে খুব বেশি একটা সময় নেই। টিকটিক করে এগিয়ে যাচ্ছে কালঘড়ি। যত দ্রুত সম্ভব এই বেপরোয়া যুবকটির হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে হবে। পেছন থেকে শাহজিদের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, 

— ‘আমার নতুন করে কিছু হারাবার নেই। আমি জানি পৃথিবীতে মৃত্যুই একমাত্র ধ্রুব সত্য। আর সত্য আমার চোখে সবসময়ই সুন্দর। তাই মরার কথা শুনলে আমার ভয় করে না।’ 

কথাগুলো বলতে বলতে শাহজিদ একটু অন্যমনস্ক হয়। নিজের অজান্তেই জিব ঠেকে যায় ডান গালে। কপালে মৃদু কুঞ্চন পড়ে। টের পায় মাত্র বলা কথাটার মধ্যে কিছু একটা গড়মিল আছে। পার্থিব টানাপোড়েন থেকেই তো দুশ্চিন্তার উদ্রেক হয়, দুশ্চিন্তার ডানায় ভর দিয়ে একে একে আসে অনিশ্চয়তা, শঙ্কা এবং ত্রাস। শাহজিদের নিজেকে নিয়ে কোন দুর্ভাবনা বা দুশ্চিন্তা নেই। তার চিন্তা হচ্ছে তুরিনকে নিয়ে। মানুষ জন্মগতভাবে যেসব দুর্বলতা নিয়ে জন্মায় তার মধ্যে বিশেষ হলো বাৎসল্য, মায়া মমতা এবং ভালোবাসা। শাহজিদের আপন বলতে কেউ নেই বলে বাৎসল্যের দুর্বলতা থেকে সে চিরমুক্ত। তুরিন তার রক্তের সম্পর্কের কেউ নয়। কিন্তু মেয়েটির জীবনের আসন্ন ঝড়কে কেন্দ্র করে শাহজিদের মনে যে আতঙ্কের সঞ্চার হয়েছে তা নিছক মানবিকতা নয়। অন্যরকম কিছু। অথচ প্রেমে হাবুডুবু খাবার মতো আকর্ষণীয় কোন মেয়ে তুরিন নয়। রূপের চটক আছে। কিন্তু শুধু রূপের মোহে আটকে যাবে এমন ঠুনকো ব্যক্তিত্ব শাহজিদের ছিল না কখনো। শাহজিদ হয়তো সেভাবে আটকায়নি এখনো। তবুও হৃদয়ের কোন এক জংধরা তার বোকাসোকা, ধারহীন, মাথামোটা, পাগল তুরিনের মনের তারের সঙ্গে দৈবক্রমে গিঁট খেয়ে গেছে। এটা কেন হয়েছে জানে না শাহজিদ…হয়তো তার কেউ নেই বলে…হয়তো তার আশাহীন, বান্ধবহীন, স্বপ্নহীন ধু-ধু মরুভূমির মতো বৈরাগ্যময় অন্ধকার জীবনে তুরিন…একমাত্র তুরিনই প্রভাতের আলো জ্বালানোর নিরলস চেষ্টা করেছে। তার যদি একটা স্বাভাবিক জীবন থাকত। যে জীবনে বাবা-মা থাকে, মনের মতো বন্ধু থাকে, ঝকঝকে প্রাণবন্ত তরুণীদের সান্নিধ্য থাকে, বেঁচে থাকার বাসনা থাকে…সেই জীবনটা কাছে পেলে হয়তো তুরিনের মতো নির্বোধ, ছিটিয়াল একটা মেয়েকে নিয়ে চিন্তারই অবকাশ থাকত না। নিজেকে বড়ই দুর্বোধ্য মনে হয় শাহজিদের। মাথাটা গোলমেলে লাগে। ভাবনার নৌকাটা যেন ফেনিল সমুদ্রের বিশাল পেটমোটা এক ঢেউয়ের ওপর দিশাহারা হয়ে দুলতে থাকে। ফারা কখন নিষ্ক্রান্ত হয়েছে খেয়াল করেনি শাহজিদ। ঝিম ধরে বসে ছিল। বসেই রইল একটানা। এক সময় দুচোখে তুলোর মতো ঝরঝর করে নেমে এলো ঘুমের নেশা। ঘাড়টা একটু কাত হয়ে হেলে পড়তেই ছুটে গেল নেশাটা। ঘোরসর্বস্ব, অস্পষ্ট মস্তিষ্ক নিয়ে টের পেল তার সর্বাঙ্গে বিন্দু বিন্দু জলের মতো লেগে আছে ঝাপসা কিছু পার্থিব দুর্বলতা। ভেতর থেকে এক অদৃশ্য সত্তা হুংকার ছাড়ে, ‘ঝেড়ে ফেল এই দুর্বলতার নোংরা জল। তোমার জন্য অপেক্ষা করছে বরফকুচি ছড়ানো সাদা রঙের এক বিশুদ্ধ মৃত্যু! সেই মৃত্যুকে স্বেচ্ছায় আলিঙ্গন কর। জিতে যাও জীবনযুদ্ধে। তুরিনের মতো একটা বিশিষ্টতাহীন, সাধারণ মেয়ের জন্য তুমি হেরে যাবে? মৃত্যুর অমোঘ পরিণতিকে ভয় পাবে? তুরিন কি তোমার যোগ্য? না আছে বুদ্ধি, না আছে ব্যক্তিত্ব…। 

হঠাৎ মনে পড়ে প্রথম দেখার দিনটির কথা। শাহজিদের তখন আস্ত দুটো পা ছিল। টগবগে যৌবন ছিল। সুন্দরী, মেধাবী, আকর্ষণীয় গার্লফ্রেন্ড ছিল তবুও সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে থেকে বারো হাজার ফিট ওপরে…রকিমাউন্টেনের চূড়োয়…সূর্যের ঝলসানো আলোর নিচে…বোকা বোকা, নরমসরম, খরগোশের মতো আদুরে তুরিনকে দেখে তার মনে হয়েছিল জীবনে এমন পবিত্র বস্তু সে আগে কখনো দেখেনি। ঘুমঘোরের নেশারু দুটি চোখের সামনে তুরিনের তুলতুলে মুখখানা অনেকক্ষণ অবধি স্থির হয়ে থাকে। হঠাৎ মনে হয় এই মেয়েটার খারাপ কিছু হয়ে গেলে সে বাঁচবে না। আশ্চর্য…এর মাঝেই মনের মধ্যে বাসা বঁধেছে মৃত্যুভয়? সর্বনাশ! 

.

তুরিনের চড় খাবার পর যতটা অপমানিত বোধ করার কথা ছিল, যতটা ভেঙে পড়ার কথা ছিল ততটা কিন্তু ভাঙল না নিশা। বরং মনের কোনায় কোনায় একটা চোরা আনন্দের ঢেউ কলকল করে বয়ে যাওয়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছিল সে। সেই শব্দ যখনই কানে এসে লাগছে লজ্জায় সংকুচিত হয়ে উঠছে। নিজেকে বড়ই ছোট মনে হচ্ছে। তার জন্যেই এই সংসারে ভাঙন ধরেছে। সারা বাড়িতে জ্বলছে অশান্তির আগুন। কিন্তু শুনতে খারাপ লাগলেও একথা সত্য যে এই আগুন নিশাকে এক রত্তিও পোড়াচ্ছে না। লোকটা যে আজ ফারার সামনে, তুরিনের সামনে নিশার পক্ষ নিয়ে কথা বলেছে, তুরিনের গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা বোধ করেনি এই একটুখানি ঘটনা নিশাকে দিয়েছে অপার আশ্রয়ের সন্ধান। আজ আর কোন দুঃখ নেই। এতটুকুই চেয়েছিল সে স্রষ্টার কাছে। ভালোবাসার মানুষটার বুকে নিজের জন্যে একটুখানি উর্বর জমি। আজ সেই জমিনটুকুর হদিস পেয়ে জীবনটাকে নির্মল, ভর-ভরন্ত, অলৌকিক বিকেলের মতো সুন্দর মনে হচ্ছিল তার। জুবিন কার্পেটে থপথপ করে কোমল কমজোর পা ফেলে হেঁটে বেড়াচ্ছিল। হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল…আবার উঠে দাঁড়াচ্ছিল। নিশা মেয়েকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুলে চিরুনি চালাচ্ছে আলতোভাবে। 

ঠিক সেই সময় শব্দটা কানে ভেসে এলো। 

চমকে ওঠা হৃৎপিণ্ড নিয়ে নিশা বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। হলওয়েতে ফারা দাঁড়িয়ে আছে। তুরিনের বেডরুমের দরজায় আঘাত করছে উপর্যুপুরি। নিশার পায়ের শব্দ পেয়ে চট করে ঘুরে তাকাল। বুকের পাঁজরে একটা কাঁপন টের পেল নিশা। ফারার চোখ দুটো টকটকে লাল, চুল এলোমেলো। চোখের চাউনি অতৃপ্ত প্রেতাত্মার মতো উৎকট। ঘটনা ঘটল খুব দ্রুত। ফারা হাওয়ার চাইতেও ক্ষিপ্র গতিতে ছুটে এসে নিশার গলায় হাতের দশটা আঙুল চেপে ধরল। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল, ‘আমার মেয়ে যদি আজকে সুইসাইড করে…তোমাকে আমি মেরে ফেলব। খুন করে ফেলব…!’ 

আক্রমণের ধাক্কায় নিশা কয়েক পা পিছিয়ে গেছে। দেওয়ালে ঠেকে গেছে মাথা। ফারার হাতের দশটা আঙুল ওর কণ্ঠনালিতে ক্রমেই চেপে বসছে সাঁড়াশির মতো। চোখ বেরিয়ে আসছে কোটর থেকে। 

.

তুরিনের বেডরুমের দরজাটা হুট করে খুলে গেল। 

— ‘মা!’ 

মেয়ের ডাকে সংবিৎ ফিরল যেন ফারার। নিশার গলার ওপর থেকে ধীরে ধীরে সরে এলো দুটি হাত। 

ঘাড় ঘুরিয়ে নিতেই তুরিনের চোখে চোখ পড়ল…আর ঠিক তখনই… যে কান্নাটা অনেকক্ষণ অবধি বুকের চার দেওয়ালে মাথা ঠুকে ঠুকে বেরোবার কোন পথ পাচ্ছিল না…সেই অসহায় কান্নাটা হঠাৎ দু চোখের অর্গল খুলে বেরিয়ে এলো ঝরঝরিয়ে। স্খলিত পদব্রজে মেয়ের দিকে এগিয়ে এলো সে। জাপটে ধরল দু হাত বাড়িয়ে। কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘তুমি ঠিক আছ? দরজা খুলছিলে না কেন? ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমি।’ এদিকে নিশা সাক্ষাৎ যমের কবল থেকে মুক্তি পেয়ে উপর্যুপরি কেশে যাচ্ছিল। তার চোখ দুটি টকটকে লাল। জিব বের করে বড় বড় শ্বাস নেবার চেষ্টা করছে। সেই সময় জাহিদের আবির্ভাব হলো দৃশ্যপটে। নিশার প্রায় মরতে মরতে বেঁচে যাওয়া মুমূর্ষু, পাণ্ডুবর্ণ মুখখানার দিকে পলক পড়তেই ভীষণ চমকে উঠল সে। সেই চমকের পাল্লায় ঢেউ লাগল অনতিদূরে দাঁড়িয়ে থাকা মা-মেয়ের কান্নাকাটির অবেগঘন দৃশ্যটি দৃষ্টিগোচর হওয়ার পর। স্তম্ভিত কণ্ঠে বলল, ‘কী হচ্ছে এখানে? 

ফারার মাথাটা তুরিনের বুকের সঙ্গে লেপটে আছে। মাকে লম্বায় ছাড়িয়ে গেছে তুরিন। এই মুহূর্তে তাকে বেশ পরিণত বয়স্ক এক যুবতী বলে মনে হচ্ছে। খর্বকায় দুটি চোখ কিঞ্চিৎ রক্তাভ। ধবধবে ফরসা গালে নীল শিরা জেগে আছে দ্বীপের মতো। নাকের ভাঁজে চিকচিক করছে ভয়শূন্য এক দুর্বিনীত স্পর্ধা। ফারার চোখের জলে ভিজে গেছে তার টি-শার্টের গলা। কেমন নিঃস্পৃহ, শীতল দৃষ্টিতে একবার জাহিদের দিকে তাকাল তুরিন। মেয়ের চোখে এমন বিতৃষ্ণা এর আগে কোনদিন দেখেনি জাহিদ। তার বুক কেঁপে উঠল দুয়ে আশঙ্কায়। তুরিন মায়ের মাথাটা তুলে ধরল শক্ত হাতে। হলওয়েতে জ্বলতে থাকা ফকফকে এলইডি বাল্বের সাদা আলোর নিচে, ফারার ক্রন্দনরত দলিত পেষিত এলোমেলো মুখের দিকে চেয়ে স্পষ্ট গলায় বলল, ‘কাঁদছ কেন বোকার মতো? কেঁদে লাভ নেই। যাও রেডি হয়ে নাও। আমরা আজকেই এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাব।’

ফারা কাঁদতে ভুলে গেল সেই মুহূর্তে। ফ্যালফ্যাল করে কয়েক সেকেন্ড মেয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে আশ্চর্য গলায় বলল, ‘কী বলছ এসব?’ 

— ‘যা শুনতে পেয়েছ ঠিক তাইই বলেছি। এখানে আমি আর একটা দিনও থাকতে চাই না।’তুরিন কথাটা বলতে বলতে জাহিদ আর নিশার দিকে তীর্যক চোখে তাকিয়েছিল একবার। তারপর আগের চাইতেও ধারাল গলায় কেটে কেটে বলেছে, ‘আমার মায়ের অপমান আমি আর সহ্য করতে পারব না। তোমাকে স্ট্রং হতে হবে মা! যে লোক তোমার ভালোবাসার বিন্দুমাত্র দাম দেয়নি…সেই লোকের সংসারে তোমার আর থাকার প্রয়োজন নেই।’ 

ফারা কান্নার ঢোক গিলল, ‘পাগলের মতো কথা বলো না তুরিন! 

‘আমি পাগলের মতো কথা বলছি? নাকি তুমি বছরের পর বছর শেমলেসের মতো কাজ করে যাচ্ছ? যে লোক তোমার সঙ্গে বিট্রে করেছে, ঠকিয়েছে…অন্য মেয়ের সঙ্গে শুয়েছে…এমনকি সেই মেয়েকে স্ত্রী হিসেবে স্বীকৃতিও দিয়েছে…সেই প্রতারক, ক্যারেক্টারলেস, বাজে লোকটার বাড়িতে নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে হ্যাংলার মতো পড়ে থাকতে তোমার লজ্জা করে না?’ 

একটা উদ্ভ্রান্ত ব্যথা জাহিদের বুকের পাঁজর ভেদ করে ধারাল ছুরির মতো একদম রুহের মধ্যিখানে গিয়ে বিদ্ধ হলো। তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠল সে। নিজের কলিজার টুকরা মেয়ের মুখ থেকে নিজেরই সম্বন্ধে এমন বিদ্বেষপূর্ণ বিরূপ মন্তব্য শোনার আগে তার মৃত্যু কেন হলো না? যন্ত্রণায় ওর মুখটা নীল হয়ে গিয়েছিল। সেই মুখের দিকে তাকানো মাত্র নিশার বুক মোচড় দিয়ে উঠল। আর কেউ না জানলেও সে তো জানে মানুষটা তুরিনকে জীবনের চাইতেও বেশি ভালোবাসে। 

ফারা চোখের জল মুছে নিয়ে সচেতন দৃষ্টিতে একবার চারপাশটা দেখে নিল। গলার স্বর এক ধাপ নিচে নামিয়ে বলল, ‘এসব নিয়ে পরে কথা হবে। এখন ভেতরে চলো।’ 

তীব্র রোষে হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে তুরিন, ‘এতকিছুর পরেও তুমি কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছ না? তুমি কি মানুষ?’ মেয়ের নির্বুদ্ধিতা আর বোকামো দেখে ফারার মাথা ঘুরে যাচ্ছে। এতক্ষণ মেয়েটার জন্য তার দুশ্চিন্তা হচ্ছিল, কষ্ট হচ্ছিল, মায়া হচ্ছিল। কিন্তু এখন মেয়ের এই অযৌক্তিক, ভিত্তিহীন কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে মাথায় একটা জোরেশোরে গাট্টা বসিয়ে দেয়। এত করে পাখি পড়ার মতো শেখানো হলো বেকুবটাকে, বুঝিয়ে দেওয়া হলো কীভাবে ছলে-বলে-কৌশলে নিজের বাবাকে আয়ত্তে আনতে হবে। প্রয়োজনে সুইসাইড করার অভিনয়ের ব্যাপারেও প্ল্যান করা আছে। সঙের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আজেবাজে কথা না বলে বিষ খাওয়ার ভান ধরে বিছানায় পড়ে থাকলেও তো কাজের কাজ হতো। মেয়ের মরণ দশা দেখে জাহিদ আজকেই বাধ্য হয়ে নিশাকে ডিভোর্স দিয়ে দিত। রাগে ফারার সারা শরীর চিড়বিড়িয়ে ওঠে। বিগত বছরগুলো অহোরাত্র সর্বপ্রকার হীনতা এবং লাঞ্ছনা সহ্য করে দাঁত কামড়ে এখানে পড়ে আছে শুধু তুরিনকে একটা সভ্য, মার্জিত পরিবারের অংশ করে তুলে করার জন্য। অনিমেষের মতো ভবঘুরে, উচ্ছন্ন লোকের বাচ্চা পেটে আসার পরেই ফারা বুঝতে পেরেছিল এই লোক স্ত্রী-সন্তানের যোগ্য মর্যাদা কোন দিন দিতে জানবে না। অনিমেষের একরোখা ধাত। এমন পুরুষের সঙ্গে প্রেম হয়…সংসার না। এত সংগ্রাম, এত ত্যাগ আর এত অপেক্ষার পর নিশার মতো সস্তা, আনসিভিলাইজড, গ্রাম্যমেয়ের কাছে ফারা হেরে যাবে? তুরিনের মাথাটা কি পুরোপুরিই গেছে? 

— ‘নির্লজ্জ আমি নই। নির্লজ্জ তাকে বলে যে বাইরে থেকে উড়ে এসে অন্যের সংসার ভাঙে। আমি আমার সংসার ছেড়ে কোথাও যাব না।’ 

তিরস্কারের এক নিদারুণ গাঢ় ছায়া পড়ল তুরিনের চোখে। মাকে সে এতকাল আত্মমর্যাদাসম্পন্ন আধুনিক নারী বলেই জানত। ছোটবেলা থেকে মায়ের প্রতি তিলেতিলে গড়ে ওঠা সম্মান, মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি সমস্তটাই যেন এক লহমায় ধূলিসাৎ হয়ে পড়ল। বিতৃষ্ণায় কুঁকড়ে গেল মুখ। নিজের গর্ভধারিণী মাকে তার এই মুহূর্তে ঘৃণিত ভিখারিনি মনে হলো। অনিমেষের ব্যাপারে জাহিদের বলা কথাটা মনে পড়ে গেল হঠাৎ। সত্যিই কি অনিমেষের সঙ্গে মায়ের কোন অনৈতিক সম্পর্ক আছে? থেকে থাকলে এই সংসার ছেড়ে চলে যেতে এত আপত্তি কেন? অনতিদূরে দাঁড়িয়ে আছে জাহিদ আর নিশা। পাশাপাশি, কাছাকাছি। ওদের দিকে একবার বিষদৃষ্টি নিক্ষেপ করে ঝড়ের বেগে বেডরুমে ঢুকে গেল তুরিন। দড়াম শব্দে দরজা আটকে দিল সবার মুখের ওপর। 

.

জুবিন অনেকটা সময় একলা আছে ঘরের ভেতর। মেয়ের কথা ভুলেই গিয়েছিল নিশা। মনে পড়তেই তড়িঘড়ি করে ছুটে এলো। দেখা গেল কার্পেটে হামাগুড়ি দিচ্ছে জুবিন। তার পরনের ঘেরওয়ালা সুন্দর জামাখানি কুঁচকে বুচকে যাচ্ছে। আজকে বাবা-মার সঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার কথা ছিল জুবিনরানির। তা আর হলো না। মেয়েকে কত যত্ন করে সাজিয়েছিল নিশা। সেজেছিল নিজেও। কেন যে তার ভাগ্যে সুখ সয় না কে জানে! এত মন্দ ভাগ্যও মানুষের হয়? 

জুবিন মেঝে থেকে কিছু একটা তুলে নিয়ে মুখে দিচ্ছিল। এই এক বাজে অভ্যাস মেয়ের। যা পায় তাই মুখে দেয়। নিশা ওর হাত থেকে জিনিসটা ছিনিয়ে নিল। বকাও দিল হালকা। মেয়েকে কোলে নিয়ে ঘর থেকে বেরোলো। বেরোনো মাত্র একটা শোচনীয় দৃশ্য বিদ্যুৎচমকের মতো ঝলসে উঠল চোখের সামনে। সে দেখল জাহিদ তুরিনের ঘরের সামনে এখনো অবিচল স্থিরচিত্রটি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চশমার কাচ কুয়াশার মতো ঝাপসা। আর সেই কাচের ফাঁক গলে অশ্রুর একটা ধারা নিঃশব্দে নেমে এসেছে নাকের কাছে। নিশার উপস্থিতি টের পেয়ে চমকে ওঠে জাহিদ। ভারি লজ্জিত বোধ করে। মুখ নিচু করে চুপিসারে জায়গাটা থেকে সরে পড়ে। ত্বরিত পায়ে এগিয়ে যায় সিঁড়ির দিকে। নিশাও এগোয় ওর পিছুপিছু। জাহিদ পেছনে ফিরে তাকায় না। যেন নিশা আর জুবিনের কাছ থেকে প্রাণপণে ছুটে পালাতে চায়। সিঁড়ি ভেঙে লিভিংরুমে পা রাখতেই পরিবারের অন্য সদস্যদের মুখোমুখি হতে হলো জাহিদকে। মিসেস মুর্তজা, নীলিমা আর আনিতা বসে আছে সোফায়। জাহিদ কারো দিকে তাকাল না। ছদ্মবেশী অপরাধীর মতো মুখ লুকিয়ে ঝড়ের চেয়েও ক্ষিপ্র গতিতে বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে। নিশা জুবিনকে শাশুড়ির কোলে তুলে দিয়ে জাহিদের পিছু নিল। 

পোর্চে এসে দাঁড়াতেই মোশন সেন্সর লাইটটা আপনাআপনি জ্বলে উঠল 1 সেই আলোতে জাহিদের লম্বা চওড়া শরীরটাকে মন্থরভাবে লনের ঘাস মাড়িয়ে এগিয়ে যেতে দেখল সে। বড়ই ক্লান্ত আর বিষণ্ন দেখাচ্ছিল জাহিদকে। 

— ‘কোথায় যাচ্ছেন?’ 

জাহিদ দাঁড়াল। মানুষের ছায়া কিঞ্চিৎ দূরে সরে যেতেই পোর্চের মোশন লাইট নিভে গেছে নিঃশব্দে। হিমেল অন্ধকারে ডুবে গেছে চারপাশ। গাছের পাতায় জমে থাকা বিন্দু বিন্দু বরফকুচির ক্ষীণ সাদাটে আলোয় শাড়ি পরা নিশার দিকে একবার তাকাল জাহিদ। কথা বলতে গিয়ে গলাটা একটু কেঁপে গেল ওর, ‘আমার মনটা খারাপ…একা থাকতে চাই।’ 

নিশা গাঢ় ভাঙা ভাঙা স্বরে বলল— ‘আমার মনটাও খারাপ। কিন্তু আমি একা থাকতে চাইছি না। আপনার সঙ্গে থাকতে চাইছি। আপনার সঙ্গে একটু থাকতে দেবেন?’ 

জাহিদ কিছুক্ষণ নির্বাক চোখে চেয়ে থাকে নিশার দিকে। তারপর কোন কথা না বলে হাঁটতে থাকে। হাঁটে নিশাও। একটু পিছে পিছে…একটু ভয়ে ভয়ে। এবারের তুষারপাতে গাছের সব ফুল ঝরে গেছে। সারা রাস্তা ভরে গেছে ঝরা ফুলের পাপড়িতে। ফুলের গন্ধে ভেসে গেছে চারপাশ। রাস্তার এক ধারে পাহাড়। সেই পাহাড়ের পাথুরে গায়ে হীরের মতো জ্বলজ্বল করছে শুভ্র রঙের বরফকুচি। ওরা ফুটপাতের ওপর দিয়ে হাঁটছে। একটা বাদামি চামড়ার খরগোশ ক্র্যাব অ্যাপল গাছের গুঁড়ির পাশে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল। মানুষের পায়ের শব্দ পেয়ে ভয়ে দৌড় দিল অন্যদিকে। সেই গাছের সামনে এসেই হঠাৎ থমকে দাঁড়াল জাহিদ। নিশার দিকে ঘুরে তাকিয়ে অসহায় ভাবে বলল, ‘কী করব এখন? কী হবে?’ 

প্রশ্নটা নিশার চেতনার পাল্লায় একটা জোর ধাক্কা দিয়ে গেল। এতক্ষণ তার কষ্ট হচ্ছিল। এই মানুষটার জন্য মায়া হচ্ছিল। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার অত্যাচারে মরে যাচ্ছিল সে ভেতরে ভেতরে। কিন্তু এই মাত্র ছুটে আসা প্রশ্নটা যেন আবেগ-অনুভূতির সমস্ত পাল্লা বন্ধ করে দিয়ে বাস্তবতার স্বেদগন্ধে ভরা বীভৎস এক ঘরের দরজা খুলে দিয়ে গেল। 

— ‘এত চিন্তা করবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে দেখবেন।’ খুবই সাধারণ, মূল্যহীন, ঠুনকো একটা কথা বলল নিশা। এই কথার কোন অর্থ হয় না। তবুও বলল…কিছু একটা বলার প্রয়োজন ছিল বলেই। 

— ‘আমার মেয়ে আজ আমার সম্পর্কে কী ধরনের কথা বলল শুনেছ? আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। ও কি কথাগুলো সত্যিই বলেছিল? নাকি আমি ভুল শুনেছি? 

জাহিদের গলা কাঁপছে প্রবল উত্তেজনায়। নিশা আস্তে করে ওর একটা হাত ধরল। মৃদু গলায় বলল, ‘তুরিন ছোট মানুষ। রাগের মাথায় বলে ফেলেছে। অত ভেবেচিন্তে কিছু বলেনি। ওর কথায় কষ্ট পেয়েন না। বরং তুরিনের সঙ্গে সরাসরি কথা বলুন। আমি জানি আপনি ওকে অসম্ভব ভালোবাসেন। নিজের মেয়েকে ভালোবাসবেন…এটাই তো স্বাভাবিক। প্রয়োজনে আমিই আপনাদের মাঝখান থেকে সরে যাব। আমার জন্য আপনাদের সবার জীবনে এমন অশান্তি নেমে আসুক…এটা আমি চাই না।’ 

— ‘তুমি সরে যাবে মানে? কোথায় যাবে?’ 

নিশা মুখ নিচু করে, ‘কোথায় যাব জানি না…কিন্তু প্রয়োজনে যেতে হবে।’ একটু থেমে কেমন অন্য গলায় বলে, ‘একটা প্রশ্ন করতে পারি?’ 

— ‘কী প্রশ্ন?’ 

— ‘আপনি তুরিনকে যতটা ভালোবাসেন…জুবিনকেও কি ঠিক ততটাই ভালোবাসেন?’ 

— ‘কী অদ্ভুত প্রশ্ন করছ নিশা! জুবিনও তো আমারই মেয়ে। ওকে ভালোবাসব না কেন?’ 

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে নিশার বুক চিরে, ‘যাক…নিশ্চিন্ত হলাম। আমার জুবিন যেন বাবার আদর-যত্ন-ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত না হয়। এদিকটা একটু খেয়াল রাখবেন।’ 

কথাটা জাহিদকে তেমন একটা স্পর্শ করল না। সে চোখ থেকে চশমা খুলে নিয়ে দু চোখের পাতায় হাতের পাঁচ আঙুল রাখে, দুদিকে মাথা নেড়ে অস্থিরভাবে বলে, ‘আমার মেয়ে আমাকে ক্যারেক্টারলেস ভাবছে, প্রতারক ভাবছে। এটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না নিশা… আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে!’ 

নিশা ঠিক সেই মুহূর্তে জীবনে প্রথমবারের মতো কাজটা করল। পায়ের পাতায় ভর দিয়ে মাথা উঁচু করে সামনে দাঁড়ানো মানুষটার ঠোঁটে একটা চুমু খেল। শুধু ভালোবাসা প্রকাশের জন্য নয় বরং জাহিদের সমস্ত কষ্ট, দুশ্চিন্তা আর যন্ত্রণা নিজের মধ্যে আকণ্ঠ শুষে নেবার জন্য। অপ্রত্যাশিত ঘটনাটা জাহিদের হৃৎপিণ্ড নাড়িয়ে দিল। মস্তিষ্কের যে রক্তকণাগুলো এতক্ষণ হিমঘরের ঘুমের মতো নিশ্চল হয়ে ছিল সেই সব রক্তকণারা আচানক ছুটোছুটি শুরু করে দিল। বুকে জমে থাকা যন্ত্রণা আর মরচে পড়া বিষণ্নতার বিষগুলো নিশার নরম, উষ্ণ, মদির ঠোঁটের মধ্যে মিশে গিয়ে কী এক আশ্চর্য জাদুবলে অমৃত হয়ে উঠল নেইবারহুডের রাস্তা দিয়ে জোরে গান বাজিয়ে একটা গাড়ি হুশ করে ছুটে গেল হঠাৎ। হেডলাইটের আলোয় চমকে উঠল ওরা। চোখে চোখ পড়ল দুজনের। লজ্জার ধক এসে লাগল নিশার চোখে মুখে। কয়েক পা পিছিয়ে এসে ভীত হরিণীর মতো একটা ছুট দিল সে বাড়ির দিকে। 

.

তুরিন কার্পেটের ওপর হাঁটু গেঁড়ে বসে ছিল। হাতে একটি পুরনো দিনের অ্যালবাম। ছোট বড় নানা আকারের ছবিতে ঠাসা অ্যালবামটা। প্রথম পৃষ্ঠায় সদ্য জন্মানো তুরিন বাবার কোলে। বাবার চেহারাটা ভীষণ বাচ্চা বাচ্চা ছিল। বসা চোয়াল। শীর্ণকায় লম্বাটে ঘাড়। কিন্তু মুখের হাসিটির কোন তুলনা নেই। ঝলমলে সুখী সুখী হাসি। বাবার কোলে পুঁটলির মতো গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে তুরিন। চোখ বন্ধ। শুধু যে বন্ধ তাই ই নয়, তুরিনের মনে হলো জন্মের সময় বুঝি তার চোখ আদৌ ছিল না। গোলাপি কপালের নিচে একটুখানি পাতলা ভ্রু আর দুটো গর্ত। চোখ ফুটেছে বলে মনে হচ্ছে না। প্রথম জন্মদিনে লাল প্রিন্সেস ড্রেস পরা তুরিন বাবা-মায়ের সঙ্গে। হাসছে না। কেমন একটু থমথমে ভাব লেগে আছে ওর ছোট্ট মুখখানায়। পাশের ছবিটায় সে আরেকটু বড় হয়েছে। বছর সাতেক বয়স। বাবার কাছে সাইকেল চালানো শিখছে। টপ করে রুপালি রঙের একটি জলবিন্দু গড়িয়ে পড়ল ছবিটার ওপর। বুকের ভেতর হুহু করা এক শূন্য আকাশ টের পেল তুরিন। সেই আকাশ তমসাচ্ছন্ন নিদারুণ সব ঘন মেঘে ছেয়ে আছে। মেঘের কারণে ঠিকমতো শ্বাস নেয়া যায় না। দমবন্ধ লাগে। অ্যালবামটা মাটিতে ফেলে রেখে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। কাঁদতে লাগল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। আজকের পর থেকে তার আর কোন বাবা নেই। যে বাবাকে ভালোবেসেছিল এক জীবনে সবচেয়ে বেশি! সেই বাবাই তার মনের ভেতরে গভীর এক অতল ছিদ্র তৈরি করে দিয়েছে। এই ছিদ্রিত হৃদয় আর কোনদিন সারবে না। কেন এমন হলো তার সঙ্গে? জীবনে কোন কিছুই কেন ঠিকঠাক পেল না তুরিন? লেখাপড়ায় বিশেষ কৃতিত্ব নেই। গুণের ভাণ্ডার শূন্য। মনের মতো বন্ধু নেই। প্রেমিক নেই। যে যুবকটিকে ভুল করে ভালোবেসেছিল সেই যুবক আরো আগেই মন দিয়েছিল অন্য এক যুবতীকে। তবুও তাকে ভোলা গেল না। এক কঠিন দুর্ঘটনা সেই মানুষটির জীবন থেকে সুস্থতা কেড়ে নিল। যতবার শাহজিদকে ওই দুই চাকার হুইলচেয়ারে দেখে, ক্রাচ নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে দেখে, যন্ত্রণার কী ভীষণ উত্তপ্ত অগ্নিলাভা তাকে আপাদমস্তক দগ্ধ করে তা প্রকাশ করার যোগ্য ভাষা বা শব্দ তুরিনের ছোট্ট মগজভাণ্ডারে মজুদ নেই। কাউকে কখনো বলতে পারেনি তুরিন। তার কষ্টটা কেউ বুঝল না! আঁজলাভর্তি কষ্ট আর না বলা কথা বুকে নিয়ে এই স্বার্থপর পৃথিবীতে সুখে থাকার মিথ্যে অভিনয় করে গেল অনবরত। সে জানে শাহজিদ তাকে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসেনি কখনো। তার মতো মেয়েকে ভালোবাসা যায় না। তাই তো নিজের জন্মদাতা পিতার কাছেও আজ সে তুচ্ছ, অকিঞ্চিৎকর হয়ে উঠেছে। বাবার সঙ্গে আজকের পর থেকে তার অনতিক্রমণীয় দূরত্ব! 

দরজায় ধাক্কা পড়ছে। তুরিন বিছানার সঙ্গে লেপটে আছে অনেকক্ষণ ধরে। ফোমের বালিশ ভিজে গেছে চোখের লোনা জলে। হতাশা বড়ই ভয়ংকর জিনিস। একবার কারো মনের মধ্যে বাসা বাঁধলে ছোঁয়াচে রোগের মতো ছড়িয়ে যায় শরীরের প্রতিটি কোষে কোষে। রক্তের কণায় কণায় খুঁচিয়ে তোলে বিষণ্ণ স্তব্ধতা। তুরিন নিজেই জানে না কষ্টের পাশাপাশি আজ তার শরীর আর মনে ঢুকে গেছে হতাশার বিষ। হৃদযন্ত্রে প্যালপিটিশন হচ্ছে। হাত-পা অবশ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে এই বেঁচে থাকার কোন মানে হয় না…মনে হচ্ছে একটা নড়বড়ে সুতোর মতো ব্রিজের ওপর একলা দাঁড়িয়ে আছে সে। পায়ের তলায় অন্তহীন শূন্যতা! যখন-তখন পা পিছলে অতল খাদে পড়ে যাবে। তাকে বাঁচাবার কেউ নেই। কোথাও কেউ নেই! 

দরজায় উপর্যুপরি আঘাত পড়ছিল। বিরক্তিতে চিড়বিড় করে ওঠে তুরিনের মন। যে জীবনে ভালোবাসা নেই, নির্ভরতা নেই, স্বাধীনতা নেই…সেই জীবন দিয়ে কী করবে মানুষ! এমন জীবন যাপন করার চাইতে বিনাশ করা অনেক সহজ এবং যৌক্তিক। কে দরজা ধাক্কাচ্ছে? মা… বাবা…দাদা-দাদু কিংবা আনিতা…। যেই হোক না কেন ভীষণ রকমের অপমান করে তাড়িয়ে দেবে তুরিন। আজ সে কাউকে ছাড়বে না! রাগে গজগজ করতে করতে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। চোখের জল, নাকের জল মুছতে ভুলে গেল। ভুলে গেল অগোছালো চুলের গোছা ঠিক করতে। ক্ষ্যাপা ডাকিনীর মতো উম্মত্ত রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে দরজাটা একটানে খুলে ফেলল সে। চৌকাঠের ওপাশে যে মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে তাকে ভুলেও আশা করেনি। এই মানুষ এর আগে কোনদিন তার ঘরে আসার স্পর্ধা পায়নি। আজকের এই অযাচিত স্পর্ধা তুরিনকে এক বিহর্ষ বিস্ময়ে স্তম্ভিত করে দিল। একটু আগের ফেটে পড়া রাগটা বুঝি হঠাৎ করেই থমকে গেছে। তুরিন অবিষ্কার করল রাগের বদলে একটা অন্যরকম বিশ্রী অনুভূতিতে তার গোটা অন্তর তিতা তিতা হয়ে যাচ্ছে। গা-ঘিনঘিনে একটা সংকীর্ণ মনোভাব সরীসৃপের মতো কিলবিল করে শরীর বেয়ে উঠে আসছে মাথায়। এই মেয়ের কাছে হেরে গেছে সে। আর হেরে গেছে বলেই, আজকে তার একে যতটা ঘৃণা হচ্ছে তার চাইতে আরো অনেক বেশি ঘৃণা হচ্ছে নিজেকে! 

— ‘একটু আসতে পারি?’ নিশা মৃদু স্বরে প্রশ্ন করল। তার পরনে এখনো নীল শাড়ি। মুখে হালকা প্রসাধন। চুলে একটা মস্ত খোঁপা। কপালের ডান পাশে কয়েকটা চূর্ণ চুল এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। ওর চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপ আছে, তবে ভয়ের চিহ্নমাত্র নেই। তুরিন ভেবেছিল আগন্তুক যেই হোক না কেন ভয়ংকর রকমের অপমান করে তাড়িয়ে দেবে। নিশাকে তার জুতাপেটা করে এখান থেকে বিদায় করা উচিত। কিন্তু কোন এক বিচিত্র কারণে সামান্যতম প্রতিক্রিয়াও সে এই মুহূর্তে ব্যক্ত করতে পারছে না। জীবনের চরম শত্রুর মুখোমুখি হলে কি মানুষ এমন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়? পাথর হয়ে যায়? তুরিন চিৎকার করে বলতে চাইল, তোমার সাহস হয় কী করে আমার ঘরে আসার? তোমার কারণে আজ আমার এই দশা। তোমার কারণে আজকে আমার বাবা নেই, পরিবার নেই, আমার মায়ের জীবনে সুখ নেই। তুমি আমাদের সুখের সংসার ভেঙেচুরে খানখান করে দিয়েছ! 

নিশা তুরিনের ফোলা ফোলা, লাল লাল, পাগল পাগল উদ্ভ্রান্ত চেহারাটা একদৃষ্টিতে অবলোকন করছিল। বেচারির দুরবস্থা দেখে মন খারাপ লাগছে। হঠাৎ একটা কাণ্ড হলো। আকস্মিক শক্তিশালী তোপের মতো হাওয়ায় ছুটে এলো এক কর্কশ কণ্ঠস্বর। চমকে উঠে নিশা আবিষ্কার করল ওর খুব কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে ফারা। প্রাণপণে চেঁচিয়ে বলছে, ‘তুমি আমার মেয়ের ঘরে কী করছ? কেন এসেছ এখানে? এতবড় সাহস তোমার!’ ফারার মারমার কাটকাট কথার বাণে বিদ্ধ হয়ে প্রথমে একটু ঘাবড়ে গেল নিশা। অতর্কিতে তাকাল একবার তুরিনের দিকে। তুরিনের চোখের চাউনিতে ওর মায়ের বলা কথাগুলোই ধ্বনিত হচ্ছে নিরুচ্চারে। নিশা বুঝল শত্রুপক্ষের দল এখন ভারী। তার উচিত হবে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যাওয়া। মা-মেয়ে একজোট হয়ে তাকে যাচ্ছেতাই অপমান করে ছাড়বে। কয়েকটা থমথমে সেকেন্ডে নিশার মস্তিষ্কের শিরা-উপশিরাগুলোতে হরেকরকম বিক্ষিপ্ত চিন্তার স্রোত বয়ে গেল। দুর্বল হয়ে এলো মনোবল। যুক্তি-তর্কের ঝড় উঠল মনের ভেতর। অদৃশ্য কেউ একজন কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলল, ভয় পেও না! এ সংসারে ওদের যতটুকু অধিকার আছে, ঠিক ততটা অধিকার তোমারও আছে। তোমার ভয় কীসের? 

নিশা বড় একটা শ্বাস টেনে নিল। চোখ অন্যদিকে সরিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, ‘তুরিনের সঙ্গে আমার একটু কথা আছে।’ 

ফারাকে দেখে মনে হলো এখুনি ওর মধ্যে একটা বিস্ফোরণ ঘটে যাবে। 

— ‘তুরিনের সঙ্গে…আমার মেয়ের সঙ্গে তোমার কী কথা শুনি?’ 

— ‘সেটা তুরিনকেই বলা যাবে। আপনাকে নয়।’

— ‘ফাজলামো করার আর জায়গা পাও না? যা বলার আমার সামনেই বলো!’ নিশা তুরিনের দিকে একবার তাকাল। তুরিনের মুখে এখন সুস্পষ্ট দ্বিধা। একটু বিস্ময়ও খেলছে। কিছুক্ষণ সামনে দাঁড়ানো দুই নারীর দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকার পর সে কোন রকমে বলল, ‘মা তুমি যাও। আমি দেখছি।’ কথাটা শোনা মাত্র অপমানের ঝাপটায় ফারার মুখখানা কালো হয়ে উঠল 

— ‘তোমার কোন কথা বলতে হবে না এর সঙ্গে। যা বলার আমিই বলছি।’ নিশার মনে সাহস ফিরে এসেছে। এক পা ঘরের ভেতরে এগিয়ে দিয়ে সে বিদ্রুপের গলায় তুরিনকে বলল, ‘তোমার মাকে বলো তুমি এখন বড় হয়েছ। কার সঙ্গে কথা বলবে আর কার সঙ্গে বলবে না, সেই সিদ্ধান্ত তুমি নিজেই নিতে পার।’ 

ফারার চোখ থেকে অবিশ্বাস ঝরে পড়ছিল। তুরিন মুখের ওপর দরজা বন্ধ করল। মায়ের ওপর আজ তার আকাশ-কাঁপানো রাগ। নইলে এমনটা করা কখনই সম্ভব হতো না। 

নিশা এই ঘরে জীবনে প্রথমবারের মতো এলো। ছোট পরিসরের একটা চারকোনা ঘর। ল্যাম্পশেডের হলুদ আলোয় ভেসে আছে। এলোমেলো বিছানার ওপরে একটা গোলাপি টেডি বিয়ার রাখা। কোনার দিকে এক চিলতে ক্লজেট। দক্ষিণের দেওয়ালের একটা ছবিতে জাহিদ ফারার সঙ্গে ফ্রেমবন্দি হয়ে আছে তুরিন। হাইস্কুলে গ্র্যাজুয়েশনের দিন তোলা। তুরিনের পরনে গ্র্যাজুয়েশন গাউন, মাথায় ক্যাপ। ঘরের আসবাবের মধ্যে ড্রেসিং টেবিলটা সর্ব প্রথম দৃষ্টিগোচর হয়। আয়নার সাদা কাঠের ফ্রেমে ছোট ছোট বাতি জ্বলছে। টেবিলে নামকরা ব্র্যান্ডের প্রসাধনী সামগ্রী। একপাশে একটা সেলফি রিং লাইট ট্রাইপড। বিছানার চাদর কুঁচকে আছে। মেঝেতে উল্টেপাল্টে পড়ে আছে একটা পুরনো অ্যালবাম। জানালা বন্ধ বলে ঘরে একটা ভ্যাপসা ভাব আছে। নিশা খুব সহজ গলায় বলল, ‘দমবন্ধ লাগছে। জানালাটা খুলে দিই?’ 

তুরিন কুটিল এবং ঝাঁজাল দৃষ্টির তীর মারল নিশার দিকে। ভাবভঙ্গির হিংস্রতা দেখে মনে হলো এখুনি মুখ দিয়ে ড্রাগনের মতো আগুনের গোলা বেরোবে। নিশা একবার শান্তভাবে ওর দিকে তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিল। একটুও বিচলিত হলো না। হবে কেন? দুদিন আগের নিশা আর এই নিশার মধ্যে যে ঢের তফাত! এই দুদিনেই ওর মনোবল বেড়ে গেছে অনেকখানি। পিঠে গজিয়ে গেছে সাহসের এক অদৃশ্য ডানা। সে একজন প্রাপ্তবয়স্কা নারী, একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের বৌ, একজন স্ত্রী, একজন মা…ছেলেমানুষ তুরিনকে তার ভয় পেলে চলবে কী করে? জানালার কাচটা সরিয়ে দিল নিশা। নেটের পাল্লাটাও সরাল। তারপর বাইরে মাথা বের করে উঁকি দিল একবার। তুরিনের দিকে আড়চোখে চেয়ে বলল, ‘এদিকে এসো। ওই দ্যাখো তোমার জন্য একজন অপেক্ষা করছে। কী নাকি জরুরি কথা আছে। অনেকক্ষণ ধরে ট্রাই করেছে তোমার ফোনে। ফোন লাগছিল না। তাই আমাকে দিয়ে খবর পাঠাল।’ 

তুরিনের কপালে ভাঁজ পড়ল। দ্বিধা, দ্বন্দ্ব এবং সংশয়ের প্রাবল্যে কেমন বোকা বোকা হয়ে উঠল মুখটা। কোন কথা না বলে এগিয়ে এলো জানালার ধারে। এই জানালা দিয়ে বাড়ির সামনের অংশটুকু স্পষ্ট দেখা যায়। প্যাটিওর ধারে ক্র্যাব অ্যাপল গাছের নিচে লম্বাটে ছায়ামূর্তিটাকে দেখতে পেল তুরিন। অবয়ব দেখেই বুঝতে পারল, ওটা শাহজিদ। বুকটা ধক করে উঠল। মুখের কাঠিন্য আর কুটিলতা সরে গেল মুহূর্তের জন্যে। তার বদলে ফুটে উঠল কিশোরীর অপাপবিদ্ধ চোখের উৎসুক চাউনি। শিউলি ফুলের মতো সহজ সারল্য…একটু লজ্জা…একটু জড়তা আর একটু একটু চাপা সুখের অযাচিত দাপাদাপিতে তুরিনের কান্না ফোলা এলোমেলো মুখটা হঠাৎ বড় সুন্দর হয়ে উঠল। কী বলবে, কী করবে বুঝে উঠতে পারল না। ফোনে চার্জ নেই অনেকক্ষণ হলো। শাহজিদ নিশ্চয়ই ফোন করে পায়নি। কিন্তু কী এমন জরুরি কথা থাকতে পারে যে নিশার মারফতে ডাক পাঠাতে হলো? তুরিন একটু ইতস্তত করে বলল, ‘কেন ডাকছে?’ 

নিশা ঠোঁট উল্টায়, ‘আমি কী জানি!’ 

তুরিন হঠাৎ করেই একটু নার্ভাস হয়ে পড়েছে। নিশাকে এতকাল সে মানুষ হিসেবেই গণ্য করেনি। খুবই বাধোবাধো, গেঁয়ো গেঁয়ো, শ্যাবি একটা ভাব লেগে থাকত সব সময় নিশার মধ্যে। ওই নরমসরম ব্যক্তিত্বে কখনো বিশেষ কিছু চোখে পড়েনি তুরিনের। কিন্তু আজকের নিশা যেন কেমন অন্যরকম। তুরিন লক্ষ করল নিশার চেরিফুলের মতো গোলাপি মুখশ্রীতে আলাদা একটা ধার ফুটে উঠেছে। শুধু ধারই নয়, বরং অনেকখানি আত্মবিশ্বাস যেন কোত্থেকে এসে যুক্ত হয়েছে ওর আচার আচারণে। বুকটা ভীষণ ধড়ফড় করছিল। সে ভেবেছিল ঘরের দরজা বন্ধ করে নিশাকে মনের আশ মিটিয়ে অপমান করবে। তারপর ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবে। সেই দৃশ্য মনে মনে কল্পনা করে একটা পৈশাচিক গোপন আনন্দও পাচ্ছিল। কিন্তু নিশা যে অন্য কোন কথা নয়, বরং শাহজিদের বার্তা নিয়ে এই ঘরে এসেছে তা কে জানত! কেমন যেন আবোলতাবোল লাগছিল তুরিনের মাথাটা। জোর কমে যাচ্ছে। যে মুহূর্তে শাহজিদকে গাছের নিচে অন্ধকারে নিজের জন্য অপেক্ষারত অবস্থায় দেখল, পৃথিবীটা যেন ঠিক সেই মুহূর্তেই পাল্টে গেল। কিন্তু এমন শাকচুন্নির মতো চেহারা নিয়ে ওর সামনে যাওয়া যাবে না। একটু ফিটফাট হতে হবে। চুলে চিরুনি লাগাতে হবে। নিশার সামনে এই কাজগুলো করতে লজ্জা লাগছে। নিশাই সমস্যার সমাধান করে দিল। অবিন্যস্ত বিছানার চাদরটা ঝেড়ে ঝুড়ে ঠিক করতে করতে খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘তোমার চুল এলোমেলো হয়ে আছে। আঁচড়ে নাও। মুখটাও ধুয়ে নাও একটু। ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে।’ 

তুরিন সব সময় নিজের কাজ নিজেই করে। এই দেশে একটা বয়সের পর কেউ কারো কাজ করে দেয় না। নিজের মাকে কখনো আজ অবধি তার বিছানা করতে দেখেনি তুরিন। নিশাকে অবলীলায় এই কাজটা করতে দেখে ভারী অবাক লাগল তার। তেরছা গলায় বলল, ‘তোমার আর কিছু বলার আছে? বলার না থাকলে কেটে পড়।’ 

নিশা চোখ তুলে তাকাল। একটা তীব্রতা ছিল সেই চোখের চাউনিতে তুরিন থতমত খেয়ে গেল ওই দৃষ্টির সামনে। মনে মনে ভাবল কী ভীষণ সাহস বেড়েছে এই মেয়ের! এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন তুরিন তার অধীনে চাকরিরত কোন কর্মচারী। দুদিন আগেও চোখ তুলে তাকাবার সাহস পেত না। নিশা ঠান্ডা গলায় বলল, ‘ভদ্রতার শিক্ষাটা তোমাকে দেওয়া হয়নি কখনো, তাই না?’ 

— ‘কী?’ 

নিশা বিছানার ওপর বসে ছোট একটা শ্বাস ফেলল, ‘কিছু না…। তোমার সঙ্গে কথা আছে। মিনিটপাঁচেক সময় হবে?’ 

— ‘সময় নেই। শাহজিদ অপেক্ষা করছে।’ ক্যাটক্যাট করে বলে ওঠে তুরিন। বাথরুমের বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে মুখে গরম পানির ছিটা দেয়। নিশার সাহস ওকে বিস্মিত এবং বিভ্রান্ত করে তুলছে। একটা ঘোর লেগে গেছে মাথায়। রাগও যে হচ্ছে না তা নয়। কত্ত বড় সাহস…তার বিছানায় পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছে। ভাব দেখে মনে হচ্ছে মহারানি ভিক্টোরিয়া এসেছে। একটা কড়া কথা এখন শোনাতেই হবে। তুরিন মনে মনে খুব কঠিন একটা বাক্য সাজিয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো। মুখ খুলতে যাবে ঠিক সেই সময় নিশা ওর চোখে চোখ রেখে স্পষ্ট গলায় বলল, ‘শাহজিদকে তুমি খুব ভালোবাসো, তাই না? 

থমকে গেল তুরিন। মার মার-কাট কাট উদ্ধত ভঙ্গিটায় হঠাৎ যেন কেউ ঝপ করে একগাদা জল ঢেলে দিল। চোখ থেকে সমস্ত তেজ শুকনো পাতার মতো ঝরে পড়ল। কান্না কান্না একটা ভাব আটকে গেল কণ্ঠার কাছে। কেউ কোনদিন এই প্রশ্নটা করেনি তাকে। ভালোবাসার কথা এ বাড়ির লোকেরা তেমন একটা বলে না। মনের কথা বলা যায় এমন মনের মতো কোন বন্ধুও তুরিনের কখনো ছিল না। এক আনিতা ছিল আবাল্য সখী। কিন্তু আনিতার চোখে ছোটবেলা থেকেই নিজের জন্য ঈর্ষার একটা বিদ্যুৎ দেখতে পেয়েছে সে। কেউ না জানলেও আনিতা জানত তুরিন শাহজিদকে চায়। কিন্তু আনিতা এই চাওয়াটুকুকে কখনো স্বীকৃতি দেয়নি। উল্টো নানা রকম হিংসুটে আচরণ করে তুরিনকে প্রতিনিয়ত দগ্ধ করেছে। আনিতার কথা তোলা থাক…নিজের মা-ই কখনো তুরিনকে বুঝল না। কই নিশার মতো মা তো কখনো তার চোখে চেয়ে প্রশ্ন করেনি, ‘শাহজিদকে তুমি ভালোবাসো, তাই না?’ 

মাকে তার অনুভূতিহীন জড় পদার্থ বলে মনে হয় মাঝেমধ্যে। বেশ কয়েকবার শাহজিদের কথা বলতে গিয়ে থমকে গেছে তুরিন, পিছিয়ে গেছে। মনে হয়েছে মা বুঝবে না। পেশায় ব্যাংকার হওয়াতেই বোধহয় টাকা-পয়সার হিসেব-নিকেশটাই মা সবচাইতে ভালো বোঝে। জীবনে প্রথমবারের মতো অত্যন্ত ব্যক্তিগত এবং মূল্যবান প্রশ্নটা কারো মুখ থেকে শুনতে পেয়ে তুরিন হতভম্ভ হয়ে গিয়েছিল। তার ঠোঁট ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। চোখের কার্নিশে টলটল করছে জল। নিশা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ‘মনের কথা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খুলে বলা ভালো। দেরি করলে অযথা সময় নষ্ট। নিজের জীবনে ঠেকে শিখেছি বলেই তোমাকে উপদেশটা দিতে পারলাম। এখন আর তোমাকে আটকে রাখছি না। নিচে যাও। ফিরে এসে একবার দেখা করো আমার সঙ্গে। আমি অপেক্ষা করব। জরুরি কথা আছে।’ 

তুরিন টালমাটাল পায়ে ঘরের দরজা খুলল। দরজার ওপাশে ফারা চোরের মতো ওত পেতে দাঁড়িয়ে ছিল। হুট করে পাল্লা খুলে যাওয়ায় বেজায় অপ্রস্তুত হলো। তুরিন মাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল। তার মাথাটা কুয়াশায় ভরে আছে। বুকে বড্ড দাপাদাপি! বাইরে ঝুপসি অন্ধকার। গাছের নিচে একটি লম্বা ছায়ামূর্তি স্থির হয়ে আছে। হাওয়া নেই খুব একটা। পাতায় পাতায় স্বপ্নের মতো জ্বলছে সাদা বরফকুচির দল। চারিদিক নিশ্চুপ, নিঝুম, নিবিড় রাতের শীতল চাদরে আবৃত। তুরিনের স্নায়ু ভীষণ টানটান। নিজের পায়ের শব্দে নিজেই চমকে উঠছে বারবার। 

— ‘কেমন আছ?’ শাহজিদ বলল। 

— ‘এই তো!’ 

কেউ কারো মুখ দেখতে পাচ্ছে না। শুধু অবয়বটাই ঠাওর করা যাচ্ছে। 

— ‘ডেকেছ কেন?’ বুকের অসহ্য ধড়ফড়ানিটা কথা বলতে দিচ্ছিল না। তবুও কোন রকমে প্রশ্নটা করল তুরিন। 

— ‘কথা ছিল।’ অন্যরকম শোনায় শাহজিদের গলা। 

— ‘বলে ফ্যালো।’ 

শাহজিদ একটু সময় চুপ করে থাকে। কী যেন ভাবে আনমনে। তুরিন ওই মুখ না দেখেও অনুমান করতে পারে এই মুহূর্তে ওর জিব ঠেকে গেছে ডান গালে। কুঞ্চন পড়েছে দুই ভ্রুর মধ্যিখানে। একটু কেশে গলা পরিষ্কার করল শাহজিদ। তারপর রুদ্ধ নিশ্বাসে বলল, ‘তুমি আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলে তাই না? অফারটা কি এখনো ওপেন আছে?’ 

বিস্ময়ে মূক হয়ে গেল তুরিন। কোন শব্দ বেরলো না গলা দিয়ে। স্থবির হয়ে চেয়ে রইল শুধু। শাহজিদ তার জন্য এতক্ষণ একটানা দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করেছে। নিজ গরজে ডেকে এনেছে। রুক্ষ একটা দিনের শেষে এই ঘটনা তার জন্য নিঃসন্দেহে ভালো লাগার এক টোটাল প্যাকেজ। এ কথা সত্য যে, সে শাহজিদকে সর্বান্তঃকরণে নিজের করে পেতে চায়। কিন্তু একটুখানি মেয়েলি আত্মসম্মান ঝড়ের কবলে পড়া মোমবাতির নিভু নিভু দুর্লভ আগুনেরই মতো এখনো লেগে আছে তার ব্যক্তিত্বের আনাচেকানাচে। তাই কথাটা শুনে ষোলাআনা খুশি হতে পারল না। বরং অপমানের ঝাঁঝ লাগল অন্তরে। 

— ‘আমি তোমাকে কখনো কোন অফার দিইনি। তুমিই বলেছিলে আমাকে বিয়ে করতে চাও। কী মিথ্যুক তুমি! 

শাহজিদ তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে, ‘আমি বলেছি শর্ত মেনে নিলে বিয়ে করতে রাজি আছি।’ 

তুরিনের মনটা আজ বিক্ষিপ্ত। রসিকতাবোধ কাজ করছে না। বড় অস্থির আর আবেগকম্পিত হয়ে আছে ভেতরটা। সে খুব ক্লান্ত গলায় বলল, ‘আমি তোমাকে বুঝি না শাহজিদ। তবে এটুকু বুঝি তুমি আমাকে ঠিক ভালোবাসো না। হয়তো করুণা কর।’ 

তুরিন এতটা গম্ভীর কথা এর আগে কখনো বলেছে কি না মনে পড়ে না শাহজিদের। সে বেশ অবাক হলো। স্তিমিত স্বরে বলল, ‘ভালোবাসা খুব জটিল একটা জিনিস। আমার মনে হয় আমি আমার মা-বাবাকেও কখনো সত্যিকার অর্থে ভালোবাসিনি।’ 

একটু থেমে শাহজিদ আবার বলে, ‘লং স্টোরি শর্ট, পাহাড় ছাড়া অন্য কিছুই কখনো ভালোবাসিনি আমি।’ 

— ‘ফালতু কথা।’ 

— ‘কোন কথাটা ফালতু লাগল তোমার?’ 

—‘পাহাড়কে আবার ভালোবাসার কী আছে? বুলশিট যত্তসব।’ 

শাহজিদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘এখন এসব নিয়ে তর্ক করে যাবে? নাকি জরুরি কথাটা শুনবে?’ 

— ‘কী কথা?’ 

— ‘তুমি আমার সঙ্গে পালিয়ে যাবে?’ 

এত সুন্দর এবং স্নিগ্ধ ছিল প্রশ্ন করার ধরনটা…যে তুরিন রীতিমতো সম্মোহিত হয়ে পড়ল। ভয়মিশ্রিত এক গভীর আনন্দের উচ্ছন্ন স্রোত তাকে কয়েক মুহূর্তের জন্য বরফমানবীতে রূপান্তরিত করে দিল। বরফ গলতে সময় লাগল। বাধো বাধো গলায় বলল, 

— ‘অদ্ভুত কথা বলছ কেন?’ 

— ‘অদ্ভুত কেন?’ 

তুরিনের ঠোঁটে একটা চোরা হাসি ঝুলে আছে এই মুহূর্তে। চারপাশে একবার সতর্ক চোখ বুলিয়ে নিয়ে গলাটা খাদে নামাল সে। প্রায় ফিসফিস করে বলল, ‘পালাতে হবে কেন? লাইফটা কি সিনেমা নাকি?’ 

— ‘ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন। এই বিখ্যাত উক্তিটা তো জানা আছে তাই না?’ 

— ‘কিন্তু পালাতে হবে কেন?’ 

শাহজিদ জানে না এই প্রশ্নের উত্তর ঠিক কীভাবে দেওয়া উচিত। বলতে কী, আজ সারাটা দিন অনেক ভেবেছে সে। অনিমেষের আকস্মিক আগমন, তুরিনের সম্পর্কে দেওয়া অবিশ্বাস্য সব তথ্য এবং সব শেষে অনিমেষের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় শাহজিদকে অংশগ্রহণের অনুরোধ…এসব ভীতিপ্রদ খবরের ছিটেফোঁটাও তুরিনের কান অবধি পৌঁছুক, এটা শাহজিদ চায় না। বরং অনেক বিশ্লেষণের পর তার মনে হয়েছে, তুরিনকে কখনো কিছু না জানানোই শ্রেয় হবে। মেয়েটা এই কণ্টকিত সত্য সহ্য করতে পারবে না। মানুষের জীবন খুবই ছোট। একটা সত্য না জেনে তুরিনের ছোট্ট জীবনটা কেটে গেলে পৃথিবীর কোন ক্ষতি হবে না। অনিমেষ বলেছিল খুব শিগগিরই সে সবাইকে সত্য জানাবে। এবং সেই সময়টায় শাহজিদকে শক্ত করে ধরতে হবে তুরিনের হাত। শাহজিদ সম্মতি বা অসম্মতি কোনটাই জানায়নি। সময় নিয়েছে। সময় নিয়ে সমীকরণটা সমাধানের নিরলস চেষ্টা করেছে। তার বিচার-বুদ্ধি বরাবরই প্রখর। দুইয়ে দুইয়ে চার মিলাতে গিয়ে সে আবিষ্কার করেছে অনিমেষ লোকটা মোটেই নির্লোভ, উদাসীন বা ব্যক্তিত্বশালী নয়। হলে এই জ্বলজ্যান্ত বাস্তব ঘটনা এতকাল চাপা থাকত না। সন্তানের প্রতি যথার্থ ভালোবাসা থাকলে পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুর জালিম পিতাটিও পিতৃত্বের দাবি থেকে সরে দাঁড়াবে না। এতগুলো বছর পর আচানক তুরিনকে নিজ কন্যা হিসেবে ফিরে পাবার অদম্য বাসনার পেছনে নিশ্চয়ই কোন গোপন দুরভিসন্ধি রয়েছে। তার চেয়ে বরং তুরিন কিছুদিন এই বাড়ি থেকে দূরে থাক। ফারা চতুর কম নয়। সে অবিলম্বেই অনিমেষকে দমানোর কোন পন্থা আবিষ্কার করে ফেলবে। পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তটাও চট করে নেয়নি শাহজিদ। শুধু যে তুরিনের কথাই ভেবেছে তাও কিন্তু নয়। নিজের মনটাকেও বারবার উল্টেপাল্টে দেখেছে। খুঁটিয়ে দেখেছে মনের অতলে গোপন অনুভূতির পলি জমেছে কি না। 

— ‘তুরিন শোন, আমার সামনে এখন দুটো অপশন আছে। তুমি অথবা পাহাড়।’ 

— ‘আজগুবি কথা বলো না। পাহাড় কখনো কোন অপশন হয় নাকি?’ 

— ‘আমার জন্য পাহাড় একটা অপশন। একটা স্বপ্ন!’ 

— ‘স্বপ্নটা কীরকম শুনে দেখি তো!’ 

শাহজিদ বিস্তারিত কিছু বলল না। সংক্ষেপে বলল, ‘স্বপ্ন দেখি পাহাড়ে যাব। পাহাড়েই মরব।’

তুরিন দিশেহারা হয়ে বলল, ‘তুমি মানুষটা খুব অদ্ভুত। মরার কথা বলছ কেন হঠাৎ?’

— ‘কেন বলছি সেই কথা আরেকদিন হবে। এখন আমার প্ল্যানটা শোন। কাল সকালে আমি এই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাব। গাড়ি রেন্ট করেছি। তোমার জন্য অপেক্ষা করব। তুমি আসবে তো?’ 

শাহজিদ যে এরকম একটা প্রস্তাব দিয়ে বসবে তা ভুলেও ভাবতে পারেনি তুরিন। সে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। বুকের মধ্যে তীব্র চিনচিনে আনন্দ এবং একই সঙ্গে ভয়ের ডুগডুগি বেজে চলেছে। শাহজিদ তার জন্য অপেক্ষা করবে আর সে যাবে না…এটা কি কখনো সম্ভব? 

— ‘তারপর কী হবে?’ তুরিনের গলা এবার কাঁপছে। 

— ‘আমরা দূরে কোথাও চলে যাব।’ আশ্চর্য এই যে…শাহজিদের কণ্ঠেও এখন স্পষ্টতর কম্পন। নিজেকে যতটা আবেগবর্জিত, নির্লিপ্ত মনে করেছিল আদতে হয়তো ততটাও রসকষহীন সে নয়। এই মুহূর্তে নিজের নিঃশ্বাসের পরিবর্তনটা খুব সূক্ষ্মভাবে টের পেল। তুরিনকে নিয়ে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাবে, শুরু করবে নতুন জীবন, হয়তো তারা একে অপরকে অসম্ভব ভালোবাসবে, ঘর বাঁধবে…এই সব সাধারণ সস্তা রোমান্টিক চিন্তা তার শুষ্ক, নিরাবেগ, পাথুরে হৃদয়ে হঠাৎ একটা অস্পষ্ট ভালোলাগার গোপন ইঙ্গিত দিয়ে গেল। 

— ‘কোথায় যাব?’ খুব আস্তে আস্তে প্রশ্নটা করল তুরিন। 

— ‘কোথায় যেতে চাও তুমি?’ 

তুরিন রুদ্ধস্বরে বলল, ‘তুমি যেখানে নিয়ে যাবে সেখানেই যাব শাহজিদ। জাহান্নামে যেতেও রাজি আছি।’ 

— ‘তাহলে মন দিয়ে শোন। আজকে রাতের মধ্যেই তৈরি হয়ে নেবে। সব প্রয়োজনীয় কাগজপত্র গুছিয়ে নেবে। পাসপোর্ট নিতে ভুলবে না। আইডি আর সোশ্যাল সিকিউরিটি কার্ডও নিয়ে নেবে। টাকা-পয়সা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। লোকেশন সেন্ড করে দেব। একই সঙ্গে বের হওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আমি বেরনোর আধাঘণ্টা পর তুমি বেরোবে। আর তোমার পড়াশোনার তো সমস্যা হওয়ার কথা না। অনলাইন ক্লাস করতে পারবে, তাই না?’ 

— ‘পারব।’ 

— ‘এ কথাই থাকল তবে। কাল ভোরে দেখা হচ্ছে।’ 

‘দেখা হচ্ছে!’ দৃঢ়চিত্তে মন্ত্র পড়ার মতো বিড়বিড় করল তুরিন। 

বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে খুব বেশিক্ষণ কথা বলাটা নিরাপদ নয় বলে দ্রুত প্রস্থান করল সে। শরীরের সব রক্তকণা কলকল করে যেন অনেক কথা বলছে। মনের মধ্যে সুখপাখির ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ। ভীষণ ভালো লাগছিল তুরিনের। যেন দীর্ঘদিনের মরণব্যাধি থেকে আরোগ্য লাভ হলো। এই অশান্তিময় অভিশপ্ত সংসার থেকে সে কাল সকালেই বিদায় নেবে। একা নয়, সঙ্গে থাকবে ভালোবাসার মানুষটি। এর চেয়ে আনন্দের ঘটনা আর কী হতে পারে জীবনে? 

লিভিং রুমে জাহিদ বসে ছিল। টিভির সামনে। তুরিন ভেতরে ঢুকতেই চোখাচোখি হলো। চোখ সরিয়ে নিল তুরিন। জাহিদ একবার ভাবল মেয়েকে ডেকে কথা বলবে। কিন্তু পরমুহূর্তেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করল। মেয়ে এখন বড় হয়েছে। অযৌক্তিক অভিমানকে আর প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। 

এত কিছুর পরেও বাবার দিকে তাকালে তুরিনের মায়া হয়। এ বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার সময় বাবার জন্যই সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগবে। অথচ এই মানুষটার কাছ থেকেই জীবনের সবচেয়ে বড় কষ্টটা পেল। বুকের মধ্যে অতল গতটা টের পায় তুরিন। ওই গর্ত বাবা খুঁড়ে দিয়েছে। আর কখনো সারবে না! খুব ভালো হবে তুরিন দূরে কোথাও চলে গেলে। বাবার একটা মস্ত শিক্ষা হবে! 

লফটের রেলিঙের ধারে নিশা দাঁড়িয়েছিল। কোলে জুবিন। তুরিন সিঁড়ির মুখ বরাবর উঠে আসতেই নিশা খুব সহজ গলায় প্রশ্ন করল, ‘কী খবর?’ 

তুরিন এই প্রশ্নের উত্তরে কিছু বলল না। একটু সময় থমকে দাঁড়িয়ে থেকে কী যেন চিন্তা করল। তারপর হালকাভাবে বলল, ‘তোমার কী যেন বলার ছিল?’ তুরিন এতটা হালকা স্বরে নিশার সঙ্গে এর আগে কখনোই কথা বলেনি। নিশা লক্ষ করল তুরিনের মধ্যে একটু আগের হতাশ ভাবটা এখন আর নেই। বরং ওর খর্বকায় চোখের তারায় আনন্দমিশ্রিত একটা দ্যুতি ঝিলিক দিচ্ছে। 

— ‘হ্যাঁ কথা ছিল। তুমি একবার আসবে আমার ঘরে?’ 

তুরিন কঠিন হতে গিয়েও পারল না। সিক্ত হয়ে আছে তার অভ্যন্তর। চেতনা বড্ড পিচ্ছিল। দৃঢ়তার সঙ্গে কিছু ভাবা যাচ্ছে না। তা ছাড়া নিশা কী বলল না বলল তাতে আর কী’ই বা এসে যায়? তুরিন তো চলেই যাচ্ছে। শাহজিদের সঙ্গে! আজকের পর থেকে এ বাড়ির সঙ্গে তার আর কোন সম্পর্ক থাকবে না। বাবা থাকুক তার নিশা আর জুবিনকে নিয়ে, মা থাকুক সো কলড সংসার, বয়ফ্রেন্ড আর স্ট্যাটাস নিয়ে, দাদা-দাদু থাকুক তাদের পারিবারিক মানসম্মান নিয়ে…তুরিন আর নেই এসবের মধ্যে! একটা বড় শ্বাস ফেলে খুব স্বাভাবিক গলায় তুরিন বলল, ‘চলো।’ 

নিশার ঘরে তুরিনের কখনো স্বেচ্ছায় আসা হয়নি। এদিকে তাকালেও গা ঘিনঘিন করত। এই বিছানায় তার বাবা… তুরিন আর ভাবতে পারল না। ভেতরে পা রাখা মাত্র গা-ঘিনঘিনে ব্যাপারটা পুনরায় ফিরে এসেছে তার মধ্যে। আড়ষ্ট হয়ে গেছে মন। নাকে তাচ্ছিল্যের একটা আলগা ভাঁজ পড়েছে। নিশার ঘরে শুধু একটা খাট, ড্রেসিং টেবিল, আর জুবিনের বেবিকট ছাড়া অন্য কোন আসবাব নেই। জুবিনের পুতুল পুতুল দুটি চোখে ঘুমের রেশ লেগে আছে। তুরিনকে দেখার পর থেকেই নানা রকম অঙ্গভঙ্গি এবং সাড়াশব্দ করে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে সে। তুরিন যে টের পাচ্ছে না তা নয়। ইচ্ছাকৃতভাবেই সে জুবিনের দিকে তাকাচ্ছে না। মুখটা জোর করে শক্ত বানিয়ে রেখেছে। নিশা ঘরের দরজা আটকে দিয়ে বলল, ‘বসো।’ 

— ‘বসব না। যা বলার তাড়াতাড়ি বল। আমার কাজ আছে।’ 

— ‘জুবিন মনে হয় তোমার কোলে যেতে চাইছে। তুমি ওকে একটু নেবে?’ তুরিন জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে নিঃস্পৃহ ভাবে বলল, ‘নাহ।’ 

নিশা একটু কপট ব্যথিত গলায় জুবিনকে বলল, ‘আপু তোমাকে নিতে চায় না জুবিনসোনা! তুমি বরং মায়ের কোলেই থাকো।’ 

নিশার রংঢং আর সহ্য হচ্ছে না তুরিনের। মেয়েটার মতলব কী আসলে? সে অত্যন্ত কঠিন গলায় বলল, ‘আমি যাচ্ছি। সময় নেই আমার।’ 

— ‘দাঁড়াও দাঁড়াও…এত অস্থির হচ্ছ কেন?’ কথাটা বলতে বলতে নিশা জুবিনকে মেঝেতে নামিয়ে দিল। মুক্ত হতেই জুবিন তাত তাত করে থপথপিয়ে হেঁটে এলো তুরিনের কাছে। তুরিন তাকাল না। নড়লও না। জানালার বাইরে দূরের দৃষ্টি দিয়ে রাখল। 

নিশা বিছানায় বসে খোলা চুলগুলো মুড়িয়ে খোঁপা বাঁধল একটা। স্তিমিত অথচ গভীর গলায় বলল, ‘আমি জানি তুমি আমাকে ঘৃণা কর। ঘৃণা করাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তুরিন, এই জীবনটা আমি নিজের ইচ্ছায় বেছে নিইনি। আমার সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছিল। বিয়ের আগে আমি জানতাম না যে তোমার বাবার অন্য একজন স্ত্রী আছে।’ 

তুরিনের মুখ থেকে কাঠিন্যের ছায়াটা সরে গিয়ে একটু অন্যমনস্কতার ছাপ ফুটে উঠল। কিন্তু এই অন্যমনস্কতা সাময়িক। পরমুহূর্তেই সে আবার গম্ভীর হয়ে গেল। নিশা যে জানত না তার বাবার আরেকজন স্ত্রী আছে এই তথ্য নতুন। কিন্তু তুরিনের মনে হলো এগুলো সব ফালতু কথা। এসব কথার কোন মূল্য নেই। কারণ আগে জানত না ভালো কথা, যখন জানল তখন চলে যায়নি কেন? কে বেঁধে রেখেছিল তাকে? নিশা চোখ নিচের দিকে নামিয়ে খুব ধীরে ধীরে বলল, ‘আমার বাবা ছোটবেলায় আদর করে আমার নাম রেখেছিলেন তুষারকন্যা। বাবা বলত একদিন কোন দূর দেশের রাজারকুমার এসে আমাকে নিয়ে যাবে। আমি খুব ছোটবেলা থেকেই সেই রাজার কুমারের স্বপ্ন দেখতাম। আমাদের অভাবের সংসার ছিল। তোমার মা আমার নামে যা বলে আমি আদতে আসলে তাইই। গরিব…গেঁয়ো…পড়ালেখায়ও খুব আহামরি কিছু ছিলাম না। তবে একেবারে অশিক্ষিতও নই। দেশে থাকলে এতদিনে আমার গ্র্যাজুয়েশন হয়ে যেত। পড়াশোনা করার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু তোমাদের বাড়ি থেকে যখন প্রস্তাবটা এলো, বাবা এক মুহূর্তও দেরি না করে মত দিয়ে দিলেন। আমাদের বাড়িতে ছোটরা বড়দের মুখের ওপর কথা বলে না। ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও আমাকে বিয়েতে রাজি হতে হলো। আমার মৌনতাকে বাবা-মা সম্মতি বলে ধরে নিলেন। এদিকে বিয়েতে আমার মন কিছুতেই সায় দিচ্ছিল না। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার কী জানো? তোমার বাবার ছবিটা দেখমাত্রই আমার খুব পছন্দ হয়ে গেল। মনে হলো এই বুঝি আমার স্বপ্নের রাজার কুমার। বলতে কোন দ্বিধা নেই আজ। তুমি তো যথেষ্ট বড় হয়েছে।’ 

তুরিন বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘এসব কথা আমাকে বলছ কেন? তোমার পার্সোনাল বিষয়ে আমার কোন ইন্টারেস্ট নেই।’ 

জুবিন অনেকক্ষণ ধরে তুরিনের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। ক্রমাগত ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে বেচারি। এবার ভ্যা করে কান্না করে দিল। তুরিন নিরাসক্ত চোখে তাকাল ওর দিকে। নিরাসক্তভাবেই কোলে তুলে নিল। মুখে বলল, ‘আচ্ছা যন্ত্রণা তো!’ 

— ‘গল্পের আসল টুইস্ট কিন্তু এখনো আসেনি। গল্পের টুইস্ট কোন জায়গায় শুনবে? আমি ছোটবেলা থেকে নিজেকে তুষারকন্যা ভাবতাম। কিন্তু বিয়ের পর জানলাম কোন প্রিন্স চার্মিংয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়নি। পুরো বিয়েটাই একটা প্রতারণা। এই লোকের বৌ আছে এমনকি প্রাপ্তবয়স্কা এক কন্যাও আছে। যেদিন দেখলাম…ধবধবে ফরসা, সুন্দর পুতুলের মতো তোমাকে…সেদিন জানলাম আমি তুষারকন্যা নই…বরং তুষারকন্যার সত্মা!’ 

গল্পের টুইস্টটা যেরকমই হোক না কেন, তুরিনের মধ্যে হালকাপাতলা নাড়া দিয়ে গেছে। একটু অপ্রস্তুত দেখাচ্ছে তাকে। এই অপ্রস্তুত অবস্থা সে নিশার সামনে প্রকাশ করতে চাইছে না। মুখে জোরপূর্বক একটা নিঃস্পৃহ ভাব ফুটিয়ে তুলতে চাইছে। 

নিশা কথা বলতে বলতে হঠাৎ একটু হাসল, ‘তোমাকে তুষারকন্যা বলার একটা কারণ আছে। শাহজিদ এই বাড়িতে প্রথম এলো হ্যালোয়িনের আগের দিন। তোমার মনে আছে?’ 

শাহজিদের প্রসঙ্গ উঠতেই তুরিন আরো বেশি বিব্রত হয়ে পড়ে। চাপা স্বরে বলে, ‘হুম।’ 

জুবিন তুরিনের চুল নিয়ে খেলছে। তুরিন আপত্তি করছে না। নিজের চুলগুলো জুবিনের ছোট্ট হাতের মুঠোয় সমর্পণ করে কাচের জানালায় ঠেস দিয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। 

— ‘সেবার হ্যালোয়িনে তুমি স্নো হোয়াইট সেজেছিলে। আমার সেদিনই শাহজিদের সঙ্গে প্রথম দেখা। পা হারানো পঙ্গু ছেলেটাকে দেখে আমার খুব মায়া হয়েছিল। উঠোনে দাঁড়িয়ে টুকটাক কথা বলছিলাম। শাহজিদ তখনো আমার পরিচয় জানে না। হঠাৎ তুমি আর আনিতা নেমে এলে। তোমার পরনে তুষারকন্যার জামা। মনে হলো তুমি যেন রূপকথার বইয়ের পাতা থেকে উঠে এসেছ। আর ঠিক সেই মুহূর্তে শাহজিদ যেভাবে তোমার দিকে তাকাল… সেই দৃষ্টি দেখা মাত্র বুঝলাম ও তোমাকে পছন্দ করে। আমি এও বুঝলাম এই তোমাদের প্রথম সাক্ষাৎ নয়। সে যাকগে। তুমি চলে যাওয়ার পর অনেকটা সময় ধরে শাহজিদ কেমন থম মেরে ছিল। সে বেচারার অবস্থা খারাপ। আমি একটু রসিকতা করলাম, স্নো হোয়াইটের প্রেমে পড়ে গেলে নাকি? শাহজিদ মুখ বাঁকিয়ে বলল, স্নো হোয়াইট না ছাই। ও হচ্ছে ইভিল কুইন। আমি হাসলাম কথাটা শুনে। হাসতে হাসতে বললাম। ইভিলকুইন ও নয়, বরং আমি ইভিলকুইন। আমি ওর সত্মা।’ 

জুবিন ঘুমিয়ে পড়েছে। তুরিনের কেমন এলোমেলো লাগছিল সব! বুকে একটা ভয়ের শিরশিরানি। প্রতিরোধের দেওয়াল ভেঙে যাচ্ছে ক্রমশ। নিশা আর শাহজিদকে নিয়ে একটা সময় কত বিরূপ ভাবনা ভেবেছে সে। সেসব কথা মনে করে কেমন একটু অনুশোচনা হচ্ছে আজ। 

সবচেয়ে বাজে ব্যাপার হলো নিশার ওপর সে এই মুহূর্তে কিছুতেই রাগ করতে পারছে না। মনের লাগাম শক্ত করে ধরার চেষ্টা করছে। নিজেকে বোঝাতে চাইছে…এখান থেকে উঠে পড় তুরিন। তোমার মা জানতে পারলে কতটা কষ্ট পাবে জানো তো? মায়ের কথা স্মরণে আসতেই মনের লাগাম ধরাটা তুরিনের জন্য সহজ হয়ে যায়। কর্কশ স্বরে বলে, ‘আমাকে এসব কথা বলার মানে কী? কে স্নো হোয়াইট, কে ইভিল কুইন এসব সিলি ইডিয়টিক বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানোর টাইম নেই আমার। তোমার যদি এতই অপছন্দ হয় আমাদের ফ্যামিলি তবে সব ছেড়ে চলে যাওনি কেন? যখন জানতে পারলে আমার বাবার আরেকজন স্ত্রী আছে, সন্তান আছে…তখন চলে যাওনি কেন?’ 

— ‘যেতে পারিনি।’ 

— ‘কেন?’ 

নিশা দীর্ঘশ্বাস ফেলল 

— ‘ভালোবেসে ফেলেছিলাম!’ 

তুরিন থমকে গেল। অস্বস্তি দানা বাঁধল মুখে। কী যেন একটা বলতে গিয়েও বলল না আর। চুপ করে গেল। নিশা কেমন সম্মোহনের গলায় বলল, ‘জীবনের প্রথম প্রেম পায়ে ঠেলে দেওয়া খুব সহজ কাজ নয়। আমিও পারিনি। প্রিন্স চার্মিং আমার জীবনে আসেনি বটে…কিন্তু ভালোবাসা এসেছিল।’ 

তুরিন বিদ্রুপের হাসি হাসে, ‘প্রিন্স চার্মিং দিয়ে আর কী করবে তুমি… কিং চার্মিংই তো তোমার দখলে।’ 

কথাটা বলতে বলতে জুবিনকে বেবিকটে শুইয়ে দিল তুরিন। নিশা জিবের ডগায় আলতো একটা শব্দ করে বলল, ‘কথাটা মন্দ বলোনি। কিং চার্মিং!’ 

তুরিন আর কোন কথা না বলে দরজার দিকে পা বাড়াল। নিশা পেছন থেকে বলল, ‘তোমার বাবা খুব কষ্ট পাচ্ছে তুরিন!’ 

তুরিন থামল। ঘুরে তাকিয়ে দেখল নিশাকে। চোখে প্রশ্নের ঝিলিক। কিন্তু মুখে কোন শব্দ নেই। 

— ‘পারলে একবার কথা বলে নিও। তোমাকে ভীষণ ভালোবাসে! প্রথম সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের টান অন্যরকম।’ 

— ‘অত টান থাকলে বাবা তোমাকে না, আমাকেই বেছে নিত।’ কেমন ছেলেমানুষি জেদ চেপে বসে তুরিনের কণ্ঠে। 

— ‘ভালোবাসার মানুষকে ছেড়ে দেওয়া কি অত সহজ তুরিন? তুমি কি চাইলেই পারবে? শাহজিদকে ছেড়ে দিতে?’ 

তুরিন সর্পিণীর মতো বিষাক্ত চোখে নিশার দিকে চেয়ে কেটে কেটে বলল,

— ‘তোমার ধারণা আমার বাবা তোমাকে খুব ভালোবাসে?’ 

— ‘ধারণা নয়। এটাই সত্য।’ 

— ‘বেশ তো। যে বাবা আমার মাকে ছেড়ে অন্য মেয়েকে ভালোবাসতে পারে…সেই বাবার প্রতি আমার আর কোন ফিলিংস নেই আজ থেকে।’ 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *