তুমি পাহাড়ের মতো ভালো
এভাবে কোনদিন কারো জন্য অপেক্ষা করেনি শাহজিদ। নিশ্ছিদ্র, নিরবচ্ছিন্ন, অটুট অপেক্ষার প্রভাব যে এমন ভয়ংকর পীড়াদায়ক হয়, এটাও তার জানা ছিল না আগে। গতকাল সকালের পর থেকে সে একনিষ্ঠভাবে তুরিনের জন্য অপেক্ষা করে যাচ্ছে। এই অপেক্ষা আবেগতাড়িত নয়, বরং অনেক বেশি যুক্তিসংগত। কারণ তুরিনের পাগলামোর কারণেই এই বাড়ি এখনো ছাড়া হয়নি। অথচ সেই নাটকের পর থেকে মেয়েটা পুরোদস্তুর গায়েব হয়ে গেছে। ফাজলামোর একটা সীমা থাকা উচিত। অপেক্ষা করতে করতে এক সময় মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে উঠল। ভাবল কিছু না বলেই বেরিয়ে যায়। তবেই উচিত শিক্ষা হবে মেয়েটার। কিন্তু কী মনে করে যেন যাওয়া হলো না, থেকে গেল। অস্থির শাহজিদ মনে মনে গুছিয়ে নিতে লাগল কথা। নাটকের স্ক্রিপ্টের মতো। বারবার দরজার দিকে তাকাল। কান পেতে রাখল সিঁড়িঘরে। স্নায়ু এত বেশি টানটান হয়ে রইল যে কোথাও হালকা একটু শব্দ হলেই মনে হচ্ছিল তুরিন এসেছে। কী বিরক্তিকর! কোন কাজে মন দিতে পারল না। রাতে ঘুমও হলো না ঠিকমতো। আধোঘুমের মধ্যে টের পেল ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও তুরিনের কথাই ভাবছে। রোমান্টিক কোন ভাবনা নয়, বরং দুশ্চিন্তামিশ্রিত বাস্তবিক খটোমটো ভাবনা। সকালে ঘুম ভাঙল নিদারুণ অশান্তি নিয়ে। মাথা ভার হয়ে আছে। অনিশ্চয়তায় দুলছে বুক। বারবার ট্র্যাভেল ব্যাগে রাখা রুপালি রঙের ছোট্ট সুন্দর পিস্তলটার দিকে মন চলে যাচ্ছে। জানালার ওপাশের দূরবর্তী লাল পাথুরে পাহাড়ের দিকে ছুটে যাচ্ছে লোভাতুর দৃষ্টি। পাহাড়চূড়ো ডাকছে ওকে হাতছানি দিয়ে। বিরহের যন্ত্রণা হচ্ছে ভেতরে। সেই দুর্ধর্ষ স্বপ্নটা বাস্তবায়নের তীব্র ইচ্ছা বারেবারে গুমড়ে উঠছে মনের পরতে পরতে। সকালে ব্রেকফাস্ট স্কিপ করল। অবসাদে ভার হয়ে আছে শরীর। অ্যাপেটাইট নেই।
সকাল আটটায় দরজায় ধাক্কা পড়ল। লক খোলা ছিল। আদেশ করল শাহজিদ, ‘কাম ইন! ‘
স্লাইডিং ডোরটা খুলেই তুরিন জরুরি গলায় বলল, ‘আমি ক্যাম্পাসে যাচ্ছি। তুমি আসবে আমার সঙ্গে? একটু কথা ছিল!’
শাহজিদ পিসির সামনে বসে ছিল হুইলচেয়ার নিয়ে। আর ঘণ্টাখানেক বাদে ওর অফিস শুরু হবে। হাতে এখনো সময় আছে। তুরিনের দিকে না তাকিয়েই ফোঁস করে একটা বিরক্তিমিশ্রিত শ্বাস ফেলে বলল, ‘এতক্ষণে আসার টাইম হলো তোমার?’
তুরিনের কণ্ঠে ঝাঁপতালে নেমে এলো আহ্লাদী সুর, ‘অ…তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করছিলে হানি? রাতে ঘুমোতে পারোনি তাই না? ডিড ইউ মিস মি?’
শাহজিদের মুখ গম্ভীর হয়ে ওঠে। হুইলচেয়ারটা ঘুরিয়ে নেয় তুরিনের দিকে। সাদা ওভারকোট ওর পরনে। সঙ্গে ব্ল্যাক জিন্স আর হাঁটু পর্যন্ত উঠে আসা লং-বুট। শাহজিদ কঠিনভাবে কিছু একটা বলতে গিয়েও চুপ করে যায় হঠাৎ। কেন যেন বিনিদ্র ক্লান্তিময় দীর্ঘ রজনীর পর তুরিনের খরগোশের মতো তুলতুলে মুখটা দেখামাত্র একটা আরামবোধ হলো। পাহাড়ের পাথুরে গায়ের শীতল ঘ্রাণের মতো পবিত্র প্রাণজুড়ানো ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ল বাতাসে। মনের অজান্তেই পুরু ভ্রুজোড়া কুঁচকে ফেলে শাহজিদ। ডান গালে ঠেকে যায় জিব। পাহাড়ের সঙ্গে তুরিনের সম্পর্ক কী? তুরিনকে দেখা মাত্রই কেন মনে হলো ও পাহাড়ের মতই সুন্দর?
চোখের সামনে তুড়ি বাজাল তুরিন, ‘হ্যালো গ্রাম্পি ইয়াং ম্যান! ওয়েক আপ!’
শাহজিদের গায়ে ঘরোয়া টি-শার্ট আর ট্রাউজার। হুইলচেয়ারের হাতলে ভর দিয়ে এক পায়ে উঠে দাঁড়াল সে। উবু হয়ে বিছনায় রাখা ক্রাচদুটো বগলদাবা করল। তুরিন এগিয়ে এসেছিল সাহায্যের উদ্দেশ্যে। শাহজিদ কারো সাহায্য নিতে নারাজ, ‘নোপ…আই ডোন্ট নিড ইয়োর হেল্প…আই ক্যান হ্যান্ডেল মাইসেলফ।’
একটা লেদারের জ্যাকেট পরে নিল ও। কালো রঙের। কান পর্যন্ত নেমে আসা ঈষৎ লালচে চুলগুলো অবিন্যস্ত হয়ে আছে। গালের আধ ইঞ্চি লম্বা দাড়িগুলোও বড্ড এলোমেলো। তুরিন বলল, ‘তুমি চুলটুল কাটো না কেন? বানর হতে চাও নাকি?’
শাহজিদ মুখ বাঁকাল গম্ভীরভাবে। কিছু বলল না। ব্যাকইয়ার্ডে বেরিয়ে এসেছিল ওরা। তুরিনের গাড়ি স্ট্রিট পার্কিং করা ছিল। সেই পর্যন্ত আসতে মিনিট চারেক সময় লেগে গেল। গাঢ় নীল আকাশের নিচে থইথই করছে বরফ ধোয়া এক ঝকঝকে সকাল! চারিদিকে চোখ ধাঁধানো আলো! রোদে শুধু তেজ আছে, উত্তাপের লেশমাত্র নেই। শাহজিদ উঠে বসল গাড়িতে। সাহায্য করল তুরিন। তারপর ড্রাইভিং সিটে এসে বসল। গাড়ি স্টার্ট দেবার আগে একবার তাকাল শাহজিদের দিকে। তাকাল শাহজিদও। চোখে চোখে ধাক্কা খেল ঠিকই, কিন্তু স্থির হলো না দৃষ্টি। অন্যদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে নিল দুজনেই। কোন কথা না বলে ইঞ্জিন স্টার্ট করল তুরিন। নেইবারহুডের পিচ্ছিল কর্দমাক্ত বরফ ঢাকা রাস্তায় গাড়িটা ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে চলতে লাগল। একটা সময় শাহজিদ বলল, ‘শোন তুরিন, আমি ভেবে দেখলাম…তুমি যেহেতু আমাকে বিয়ে করতে চাইছ…মানে বিয়ে করার জন্য এত ক্রেজি হয়ে গেছ…. তুরিন ফোঁস করে উঠল মাঝপথে, ‘হ্যাং অন! আমি ক্রেজি হয়ে গেছি মানে? তুমি বুঝি চাও না?’
শাহজিদ জানালার বাইরে চোখ রেখে বলে, ‘আমার চাওয়া না চাওয়ায় তো কিছু এসে যায় না। তুমি তো পাগল। সবার ওপর জোরজার করা তোমার অভ্যাস। আমি আমার কথা ভাবছি না, তোমার পাগলামোর কথাই ভাবছি।’
অপমানে কান ঝাঁঝাঁ করে ওঠে তুরিনের। কষ্টও হয় ভীষণ। ব্যথিত স্বরে বলে, ‘হোয়াই আর ইউ বিইং সো রুড টু মি?’
—‘আই অ্যাম নট বিয়িং রুড…জাস্ট ট্রাইং টু বি প্র্যাকটিক্যাল।’ একটু থেমে শাহজিদ আবার বলল, ‘যাই হোক…বিয়ের ব্যাপারে কথা বলছিলাম!’ শাহজিদ তুরিনের দিকে ঘুরে তাকায়। দৃঢ় দুটি চোখ রাখে ওর মুখের ওপর। গাড়িটা নেইবারহুডের রাস্তা ছেড়ে বড় রাস্তায় উঠে আসে। শাহজিদ জোরালো গলায় বলে, ‘আমি ঠিক করেছি তোমাকে বিয়ে করব!’
তুরিনের হৃৎপিণ্ড ধক করে উঠে আসে গলার কাছে। আড়চোখে তাকায় শাহজিদের দিকে। সাবধানে উচ্চারণ করে শব্দটা. ‘তাই?’
— ‘হ্যাঁ তাই…কিন্তু একটা শর্ত আছে!’
তুরিন থমকায়, ‘শর্ত?’
— ‘হ্যাঁ শর্ত। শর্তটা মেনে নিলেই আমাদের বিয়ে হবে…নইলে না।’
— ‘তুমি এমনভাবে কথা বলছ যেন বিয়ে করার গরজটা একা আমার! আমি কোন শর্ত-টর্ত মানব না।’
— ‘তাহলে বিয়েও হবে না!’
— মরে যাচ্ছি না বিয়ে করার জন্য!’
— ‘তাহলে আমাকে যেতে দিলে না কেন গতকাল?’ ক্ষেপে যায় শাহজিদ।
— ‘গলা টিপে মারব তোমাকে…এইজন্য যেতে দিইনি। বুঝলে?’
— ‘পাগল!’
‘তুমি পাগল!’ একটু থেমে নিয়ে তুরিন সাপের মতো ফণা তুলে হিসিহিসে গলায় বলে, ‘কী শর্ত তোমার, শুনি?’
সেলফোনটা বেজে উঠল হঠাৎ। তুরিন অস্থির হয়ে বলল, ‘দ্যাখো তো কে কল করছে? পকেট থেকে বের করো ফোনটা।’
শাহজিদ বিরক্তিমিশ্রিত ত্যাড়া দৃষ্টিতে চেয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড। খ্যাক দিয়ে উঠল তুরিন, ‘কী হলো? স্ট্যাচু হয়ে গেলে কেন?’
শাহজিদ না পারতে হাত বাড়িয়ে তুরিনের কোটের পকেট থেকে অ্যান্ড্রয়েড ফোনটা বের করে আনল। পানসে মুখে বলল, ‘তোমার মা।’
— ‘রিসিভ করো।’
— ‘আমার কোন কথা নেই উনার সঙ্গে।’
‘আমি কথা বলব। লাউড স্পিকার অন কর।’
শাহজিদ আদেশ পালন করল। অ্যানসার বাটন প্রেস করতেই ফারার বিক্ষুব্ধ কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,
— ‘কোথায় তুমি?’
— ‘ক্যাম্পাসে যাচ্ছি।’
— ‘ফিরবে কখন?’
— ‘জানি না।’
— ‘জানো না মানে?
— ‘জানি না মানে জানি না…ড্রাইভ করছি। এখন কথা বলতে পারব না।’
— ‘ক্যাম্পাসে যেতে হবে না। তুমি আমার অফিসে আসো। জরুরি কথা আছে।’
তুরিন বিরক্ত হয়, ‘কী এমন জরুরি কথা যা এখন না বললেই নয়?’
— ‘এখুনি কথাগুলো তোমাকে বলতে হবে তুরিন! প্ল্যান করতে হবে। নিশাকে আমি আর একটা দিনও সহ্য করতে পারব না।’
ফারার বলা শেষ কথাটা সংকুচিত করে তুলল তুরিনকে, শাহজিদের সামনে। শাহজিদ চট করে তাকাল একবার ওর মুখের দিকে।
তুরিন বিব্রত স্বরে ফারাকে বলল, ‘পরে কথা বলছি তোমার সঙ্গে। এখন রাখি।’
ফোনের লাইন কাটার সঙ্গে সঙ্গে শাহজিদ চমকানো গলায় বলল,
— ‘কী করলে?’
— ‘কী করলাম?’
— ‘ইউ জাস্ট র্যান আ রেডলাইট।’
— ‘আসলেই?’
শাহজিদ বিরক্ত হলো, ‘গাড়ি পার্ক করো কোথাও। এভাবে হবে না।’
— ‘কী হবে না?’
— ‘কথা বলা যাবে না।’
— ‘কেন?’
— ‘কারণ তুমি খুবই বাজে ড্রাইভার। নিয়ম-কানুন মানতে চাও না।’
তুরিনকে একটু নার্ভাস দেখাল। মেইনস্ট্রিটের ব্যস্ত রাস্তা থেকে বেরিয়ে পড়ল চট করে। উঠে এলো পাহাড়কাটা আঁকাবাঁকা পথে। একপাশে লাল পাহাড়ের পাথুরে উঁচু পাঁচিল। অন্যপাশে রাস্তা উত্রাই হয়ে নেমে গেছে নিচে। মিশেছে ছাইরঙের পাথরে ঘেরা সেইন্ট ড্রেইন ক্রিকের সঙ্গে। ক্রিকের ওপারের শৈলশিরায় দাঁড়িয়ে থাকা সারিবদ্ধ পাইন গাছের মাথায় সাদা বরফের প্রলেপ জমেছে। দেখলে মনে হয় যেন কোন-আইস্ক্রিম। বরফ জমে আছে ক্রিকের চারিধারে ছড়িয়ে থাকা ছোট বড় নানা আকৃতির পাথরের খাঁজে খাঁজে। তার ওপর দিয়ে ছলাৎ ছলাৎ বয়ে চলেছে কাচের মতো স্বচ্ছ জলের ঢেউ।
তুরিন নেমে এসে ব্যাকডালা থেকে শাহজিদের ক্রাচ বের করল। শাহজিদ গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলল, ‘সারা জীবন এসব করতে পারবে তুরিন? উচ্ছৃঙ্খল এক ডাকাতিয়া বাতাসে তুরিনের সিল্কি চুল উড়ছিল। হাত দিয়ে বেসামাল চুলের গোছা কোন রকমে সামলে নিয়ে সে বিস্মিত গলায় প্রশ্ন করল, ‘কীসের কথা বলছ?’
শাহজিদ ঠোঁটের কোণে দুর্বোধ্য একটা হাসি ঝুলিয়ে বলল, ‘এই যে এসব…উঠতে নামতে সাহায্য করা…ডোন্ট ইউ ফিল পিটি ফর মি?’
— ‘বাজে কথা বলো না।’
শাহজিদ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, ‘বাজে কথা বলছি না তুরিন! খুব বাস্তব কথা বলছি।’
— ‘আমার তো তোমাকে সাহায্য করতে খারাপ লাগে না!’
— ‘কিন্তু আমার যে অন্যের সাহায্য নিতে ভীষণ খারাপ লাগে!’
— ‘খারাপ লাগত না যদি তুমি আমাকে আপন ভাবতে পারতে। তোমার খুব আপন কেউ…ধরো তোমার বাবা-মা-ভাই বোন যদি থাকত…তাদের সাহায্য পেতে কি তোমার খারাপ লাগত?’
— ‘কেমন লাগত তা বলতে পারছি না! যে অভিজ্ঞতা কখনো হয়নি সে সম্পর্কে মতামত দিই কী করে, বলো?’
তুরিনের মনটা খারাপ হলো। যার সব আছে…সে কখনো কিচ্ছু না থাকার দুঃখটা ঠিকঠাক অনুভব করতে পারে না। বাবা-মা না থাকলে…আপনজন না থাকলে…পরিবার না থাকলে মানুষের কেমন লাগে কে জানে! তাকিয়ে দেখল শাহজিদের হালকা লাল মেশানো কালো চুলে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অবাধ্য বাতাস। চারিদিকে ঝলমল করছে সর্বগ্রাসী সূর্যের নিঃসীম সাদা আলো। চোখ খোলা রাখা যায় না ঠিকমতো। শাহজিদের চোখ আলোর দাপটে একটু ছোট হয়ে এসেছিল। কপালে সুস্পষ্ট কুঞ্চন। পার্কিং লটের পাশেই তিরতির করে বয়ে চলেছে সেইন্ট ভ্রেইন ক্রিকের নির্মল জল ধারা। এই ক্রিকটা তুরিনদের বাড়ির ব্যাকইয়ার্ড পর্যন্ত গড়িয়ে গেছে। ঢেউয়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে রোদ, চমকাচ্ছে হীরার মতো।
শাহজিদ ক্রিকের ধারে এসে দাঁড়ায়। ডান দিকের পাহাড় কাটা রাস্তা চড়াই হয়ে উঠে গেছে ওপরে। খরস্রোতা বাঁধটার কাছাকাছি যেতে হলে এই রাস্তা বেয়ে ওপরে উঠতে হবে। খানিক দূরে দুটি ছেলেমেয়ে হিল ট্র্যাকিং করছে। পাহাড়ের মাঝ বরাবর ঝুলছে ওদের শরীর। দড়ি বেয়ে বেয়ে ওপরে ওঠার চেষ্টা করছে। একটা সময় এখানে নিয়মিত আসা হতো। এই পাহাড়ের চূড়োয় উঠেছে শাহজিদ একাধিকবার। আজকে শুধু তৃষাতুর চোখে চড়াই হওয়া রাস্তাটার দিকে চেয়ে রইল। রিজার্ভার ড্যাম পর্যন্ত যাওয়াটাই হয়তো সম্ভব হবে না। তুরিনের অস্থির কণ্ঠস্বর ভেসে এলো পেছন থেকে, ‘চলো ওপরে যাই।’
— ‘নাহ।’
— ‘কেন?’
— ‘এমনিই…ইচ্ছা করছে না।’
— ‘তুমি ভয় পাচ্ছ?’
‘ভয় পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।’ দৃঢ় কণ্ঠে উচ্চারণ করে শাহজিদ কথাটা। যেন নিজেকেই নিজে অভয় দেওয়ার চেষ্টা করে।
— ‘তাহলে চলো। আমি আছি তো!’
শাহজিদ ঘাড় ঘুরিয়ে রাস্তাটা দেখল একবার। অনেক খাঁড়া! গলাটা কেমন শুকিয়ে যায়। শুকনো ঠোঁট জিব দিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে বিপন্ন গলায় বলে, ‘কতদূর যেতে চাও?’
— ‘ড্যাম পর্যন্ত যেতে চাই।’
— ‘লংমন্ট ড্যাম নাকি বাটনরক?’
— ‘লংমন্ট।’
—‘মিনিমাম ওয়ান মাইল।’
—‘তোমার সব মুখস্থ?’
— ‘হুম।’
— ‘বাটনরক কতদূর এখান থেকে?’
—‘ওয়ান পয়েন্ট নাইন মাইলস।’
— ‘তারপর?’
— ‘স্লিপি লায়ন ট্রেইল।
— ‘আমি যাইনি কখনো।’
শাহজিদের যেন হঠাৎ মনে পড়ল,
— ‘ক্লাসে যাবে না?’
—‘যাচ্ছি না।’
—‘পড়াশোনায় সিরিয়াস হলে না আর। এভাবে চলবে?’
—‘চলে যাচ্ছে একরকম।’
কথা বলতে বলতে হাঁটা শুরু করল তুরিন। শাহজিদ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বাঁ পা এগিয়ে দিল। ভয় হচ্ছে একটু একটু। পারবে তো ঢালু রাস্তাটা বেয়ে উঠতে? না পারলে…তুরিনের সামনে সত্যিই ভীষণ লজ্জা পাবে ও। পরাজয়ের গ্লানির উদ্রেক হবে মনে। কাপুরুষ মনে হবে নিজেকে। পথটা একেবারে খাঁড়া নয়। ঢালু হয়ে আস্তে আস্তে উঁচুতে উঠেছে। উঠবার সময় মধ্যাকর্ষণ শক্তির টান প্রবলভাবে অনুভূত হয় তবে পড়ে যাওয়ার ভয় লাগে না। কিন্তু দোপেয়ে প্রাণী আর একপেয়ে প্রাণীর মধ্যে তফাত আছে। ঢালু রাস্তায় মধ্যাকর্ষণ শক্তির বিপরীতে, উঁচুনিচু অমসৃণ পথে, ক্রাচ ঠেকিয়ে এগিয়ে যাওয়া খুব একটা সহজ হলো না শাহজিদের জন্য। শুরুতে মনে হচ্ছিল ক্রাচদুটোই হাত ফসকে পড়ে যাবে। তুরিন এগিয়ে এসে বলল, ‘টেক আ ডিপ ব্রেথ শাহজিদ! বড় করে শ্বাস নাও। ডোন্ট ফ্রিক আউট। ইউ আর ডুইং গ্রেট!’ শাহজিদ নিঃশ্বাস টেনে নিল বুক ভরে। সময় নিয়ে। তারপর ধীরে ধীরে এগোতে লাগল। বাতাস খুব তীব্র একটু ওপরে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে অক্সিজেনের অভাব বোধ হয়। হাঁসফাঁস লাগে। ক্রাচের ঘষায় ব্যথা অনুভূত হয় বগলে। গলা শুকিয়ে যায় কাঠকয়লার মতো। শাহজিদ কিছুটা পথ উঠে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। বড় বড় শ্বাস নেয়। তুরিন তাকায় না ওর দিকে। এমন ভাব করে যেন কোনদিকে লক্ষই করছে না। কারণ লক্ষ করলেই শাহজিদ আরো বেশি বিচলিত হবে। জীবনে কিছু বিশেষ সময় থাকে, যে সময়গুলো শুধু নিজের সঙ্গে বোঝাপড়ার। এই বোঝাপড়ার সময়টুকু একান্ত ব্যক্তিগত হওয়া বাঞ্ছনীয়। আরেকটু ওপরে উঠতেই পানির শব্দ স্পষ্ট হলো। চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল কৃত্রিম বাধের সুশীতল জলধারা। পাহাড়ের কোলে ঝরনার মতো ঝরঝর করে গড়িয়ে পড়ছে। শাহজিদ হাঁপ ধরা গলায় বলল, ‘পানির বোতল আছে?’
তুরিন জিব কাটল, ‘ওহো…সঙ্গে তো নেই। বাট গাড়িতে আছে। তুমি দাঁড়াও। আমি এখুনি নিয়ে আসছি।’
শাহজিদ আঁতকে ওঠা গলায় বলল, ‘না না! লাগবে না! এতটা পথ হেঁটে এসেছ। আবার ফিরে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না।’
—‘আরে পাঁচ মিনিট লাগবে। আমি যাব আর আসব। তুমি একটু অপেক্ষা কর।’
—‘প্লিজ যেও না!’
কে শোনে কার কথা? তুরিন স্প্রিংয়ের মতো লাফ-ঝাঁপ দিয়ে নামতে লাগল নিচে। নিরুপায় শাহজিদ বিস্মিত চোখে অদ্ভুত মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকে। ভেতরে একটা গ্লানির কাঁটা খচখচ করে। মনে হয় এত মনোযোগ বা যত্ন পাবার কোন যোগ্যতাই তার নেই। তুরিন নেহাত ছেলেমানুষ। দুদিন পর, ছেলেমানুষ মনটার ওপর যখন প্রাপ্তবয়স্ক মন ভর করবে তখন নির্দ্বিধায় পুরনো ডায়েরির অপ্রয়োজনীয় পাতার মতো শাহজিদকে ছিঁড়ে ফেলে দুমড়েমুচড়ে ট্র্যাশ করে দেবে মেয়েটা। নিজের করা ভুলের জন্য পস্তাবে আজীবন। একটা পাথরের ওপর সাবধানে বসল শাহজিদ। সিগারেট ধরাবার চেষ্টা করল। আগুন জ্বলল না ঠিকমতো। দুরন্ত বাতাসের অত্যাচারে বারবার নিভে যেতে লাগল। আকাশে মেঘের বিস্তার হয়েছে এখন। ড্যামের খরস্রোতা ঝরনার পানিতে, আর পাইন গাছের বরফমাখা আইসক্রিম মাথায় পিছলে বেড়াচ্ছে হীরক-কুচি রোদ্দুর। পাহাড়ের গা থেকে ভেসে আসছে শীতল একটা পবিত্র ঘ্রাণ। তুরিন ফিরে এলো পনেরো মিনিটের মাথায়। হাতে পানির বোতল। হাঁপাচ্ছে অনবরত। শাহজিদ চট করে উঠতে পারল না বসা থেকে। কিন্তু ওর ইচ্ছে হলো উঠে গিয়ে তুরিনের হাত থেকে বোতলটা নেয়। কাঁধে হাত রেখে যত্ন করে টেনে এনে বসায় নিজের পাশে। এই সব ইচ্ছেরা নিজের অপারগতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় বারবার। মনটা সংকুচিত হয়ে ওঠে। তুরিন কাছে এসে বোতলটা এগিয়ে দিল। শাহজিদ পানি পান করল ঢকঢক করে। শীতল বাতাস শরীরের চামড়ায় চাবুকের মতো আঘাত হানছিল। শুষ্ক ত্বকের আস্তর কেটে কেটে বসিয়ে দিচ্ছিল করাল দাঁত। শাহজিদের জ্যাকেটের বুক খোলা। ভেতর থেকে উঁকি দিয়ে আছে কালো টি-শার্ট। তুরিন সামনে এসে দাঁড়াল। একটু ঝুঁকে শাহজিদের জ্যাকেটের কলারটা ঠিক করল টেনেটুনে। তারপর চেইন লাগাতে লাগাতে বলল, ‘শীত করছে না তোমার?’
শাহজিদ উত্তর দিল না। দেখল তুরিনকে। চুলগুলো উঁচু করে বাঁধা। বাতাসের দাপাদাপিতে সিল্ক কাপড়ের মতো পিচ্ছিল চুল মুঠোবন্দি হয়ে থাকতে চাইছে না। ডান পাশের কান ছুঁয়ে দিয়ে গড়িয়ে পড়েছে ঘাড়ে। বাঁ দিকের গোছা এখনো রিবনে বন্দি। চুলের এই এলোমেলো ভঙ্গিটায় সাদা ওভারকোট পরিহিতা তুরিনকে কেমন অন্যরকম সুন্দর দেখায়। ফরসা মুখে আয়নার মতো চিকচিক করে রোদ। সূচালো ভ্রুজোড়ার নিচে ছোট ছোট দুটি চোখ অনেক দূরে দূরে বসানো। খর্বকায়, ক্ষীণ নাক আর ফিনফিনে পাতলা ঠোঁট ওর চেহারায় একটা ভোঁতা ভাবের উদ্রেক করতে গিয়েও দারুণভাবে হার মেনে গেছে শানিত এবং নিখুঁত চিবুক-রেখাটির কাছে। সূক্ষ্মাগ্র চিবুকখানি ওর ছোট চোখের তুলতুলে চেহারায় ধারাল অলংকার যুক্ত করেছে। একটু দূরে সরে এসে লাল রঙের পাহাড়ের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল ও। ব্যস্ত গলায় বলল, ‘কীসব শর্তের কথা বলছিলে তুমি তখন?’
শাহজিদের মনে পড়ল, ‘ও, হ্যাঁ… আসল কথাটাই বলতে ভুলে গেছি! শর্তটা হলো, বিয়ে করতে রাজি আছি, কিন্তু এখন নয়।’
—‘মানে কী?’
—‘মানে খুব সহজ। আমরা কিছুদিন একজন আরেকজনকে সময় দেব। বোঝার চেষ্টা করব। যদি আমাদের রিলেশনটা টেকে। তবেই বিয়ে করব।’ তুরিনের মুখে বিস্ময়ের ঢেউ ভাঙছিল ক্রমাগত। হতভম্ব গলায় বলল, কী আশ্চর্য! কেন?’
—‘কারণ এটাই আমার কাছে যুক্তিসংগত মনে হয়েছে। হুট করে বিয়ে করে ফেলাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।’
তুরিন ব্যথিত স্বরে বলল, ‘তুমি আমাকে বিশ্বাস করো না?’
শাহজিদ তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল তুরিনের দিকে। দুই গালের হাই-চিকবোনে থমথম করে উঠল অকাট গাম্ভীর্য। দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
—‘বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কথা আসছে না। আমি তো কোন সাধারণ মানুষ নই। হয়তো এখন তোমার মনে হচ্ছে আমার মতো ডিজেবল মানুষের সঙ্গে সারা জীবন কাটাতে পারবে। অল্প বয়সে মানুষের অনেক অসম্ভব কাজকেও সম্ভব বলে মনে হয়। কিন্তু বাস্তবতা হয়তো অন্য কথা বলবে। হয়তো কিছুদিন একসঙ্গে কাটাবার পর তুমি বুঝতে পারবে সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল।’
তুরিনের বুকে চিনচিনে ব্যথা হয়। চিংড়িমাছ তেলে ছাড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই যেমন সাদা আর লাল রেখায় গা ভরে যায়, ঠিক সেইরকমই লাল লাল দাগে আরক্ত হয়ে ওঠে ওর দুধে আলতা ফরসা মুখ। শক্ত গলায় বলে, ‘আমার সিচুয়েশনটা মনে হয় তুমি বুঝতে পারছ না। দাদাজান আমাকে আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই বিয়ে দিতে চান। তুমি বিয়ে না করলে অর্ণব বা অন্য কারো সঙ্গে আমার বিয়েটা হয়ে যাবে।’
ভ্রু কুঁচকে যায় শাহজিদের, ‘ব্যাপারটা খুবই উইয়ার্ড। এটা দু হাজার তেইশ সাল। উনিশশ তেপ্পান্ন সাল না। এই যুগে কেউ কাউকে জোর করে বিয়ে দিতে পারে না।’
তুরিন অসহায়ভাবে বলল, ‘দাদাজান আমার বাবাকেও জোর করে বিয়ে দিয়েছিল। আমি জানি সেম জিনিস আমার সঙ্গেও হবে।’
—‘স্ট্রেঞ্জ!’
—‘তুমি আমাকে ভালোবাসো না, তাই না শাহজিদ?’
—‘আমি কোনদিন কোন মানুষকে ভালোবাসিনি। মাকে কখনো কাছে পাইনি। বাবা কাছে থেকেও অনেক দূরের মানুষ ছিলেন। অ্যাঞ্জেলিনার সঙ্গে গুড আন্ডারস্ট্যান্ডিং ছিল। ভালোবাসা বোধহয় ছিল না।’
—‘এখনো তুমি বোঝাপড়াকে প্রাধান্য দিচ্ছ। মনের অনুভূতির কোন দাম নেই তোমার কাছে?’
‘তুরিন শোন, আমি খুব প্র্যাকটিক্যাল একটা মানুষ। পাহাড় ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোন বস্তু আমাকে ইমোশনাল করেনি কখনো। কিন্তু…’
হঠাৎ কথা থামিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে নিল শাহজিদ। দেখল তুরিনকে। চার চোখেতে একটা অদৃশ্য সেতুবন্ধন তৈরি হলো। শাহজিদের মনে হলো পাহাড়ের গায়ের শীতল ঘ্রাণের সঙ্গে তুরিনের কোথায় যেন একটা আশ্চর্য মিল আছে!
—‘থামলে কেন?’
শাহজিদ একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, ‘না কিছু না…’
একটু থেমে আবার বলল, ‘তাহলে প্ল্যান কী? তুমি আর তোমার মা নিশাকে বাড়ি থেকে তাড়াবার প্রিপারেশন নিচ্ছ নাকি?’
তুরিন বিব্রত বোধ করল। চোখ সরিয়ে নিল অন্যদিকে। শাহজিদ গম্ভীর গলায় বলল, –’জীবনটা যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, সেভাবেই তাকে গ্রহণ করার চেষ্টা করো। ষড়যন্ত্র করে, জোর খাটিয়ে পৃথিবীতে কিছু আদায় করা যায় না। তোমার ফ্রেন্ডদের দিকেই তাকিয়ে দ্যাখো। কজনের বাবা-মা একসঙ্গে সুখে আছে বলো তো?’
—‘ফ্রেন্ডদের দেখতে হবে কেন? তুমি আনিতাকেই দ্যাখো না। চাচা-চাচি আমার ফেভারিট কাপল। আই উইশ আমি ওদের মতো হতে পারতাম! আনিতা কত লাকি! কী সুন্দর নিট অ্যান্ড ক্লিন একটা ফ্যামিলি ওর!’
—‘আনিতার কথা বাদ দাও। তোমার বন্ধুদের বিষয়ে বলো। তোমার কাছের বন্ধু কজন?’
—‘পাঁচজন।’
—‘কজনের বাবা-মায়ের ডিভোর্স হয়েছে?’
তুরিন একটু চিন্তা করে বলল, ‘দুজনের বাবা-মায়ের সেপারেশন চলছে। আরেকজনের মা সিঙ্গেল। বিয়ে করেনি।’
—‘এদের মধ্যে এলজিবিটি কমিউনিটির সদস্য কজন?’
—একজন।
—‘জীবন কতটা বিচিত্র দেখেছ? মাত্র পাঁচজন বন্ধু তোমার। এদের কেউই পুরোপুরি স্বাভাবিক জীবন পায়নি। কিংবা বলতে পারো এটাই স্বাভাবিক। ব্যক্তিস্বাধীনতাটাই মুখ্য। তুমি ডিভোর্সি, গে, লেসবিয়ান যাইই হও না কেন পৃথিবীর এতে কিছু এসে যায় না। বরং সততার সঙ্গে সমস্ত সীমাবদ্ধতাকে গ্রহণ করে নেয়াটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।’ একটু বিরতি নিয়ে শাহজিদ আবার বলল, ‘নিশাকে ওর মতো ছেড়ে দাও। সেই বেচারি এসব ডিজার্ভ করে না। ভালো একটা মেয়ে! তোমরা অযথা ওর লাইফটা হেল বানিয়ে ছাড়ছ।’
তুরিনের কণ্ঠে হঠাৎ ঝাঁজাল একটা সুর এসে যুক্ত হয়, ‘নিশাকে তুমি খুব পছন্দ করো, তাই না?’
শাহজিদ থতমত খাওয়া গলায় বলল, ‘পছন্দ না করার কোন কারণ আছে কি?’
তুরিনের নাকের চামড়া ফুলে ওঠে ঢোলের মতো। চোখে ধকধক করে চাপা রোষের আগুন। কাষ্ঠ গলায় বলে, “তা কেন থাকবে? ওকে অপছন্দ করার তো কোন কারণ নেই। কিন্তু আমাকে অপছন্দ করার অজস্র কারণ আছে। শাহজিদ বিদ্রুপের হাসি হাসল, ‘তা ঠিক।’
—‘কী?’
—‘কী আবার? বললাম তোমার কথা ঠিক।’
—‘কোনটা ঠিক?’
—‘এই যে…তোমাকে অপছন্দ করার অজস্র কারণ আছে…কথাটা ঠিক।’ তুরিন বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। মাথার তার আরেকটু হলেই ছিঁড়ে যাবে খুব সম্ভবত। শাহজিদ সতর্ক গলায় বলল, ‘পাগলামো শুরু করবে নাকি এখন? পাহাড় থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিও না আবার! আমি অবশ্য পাহাড়েই মরতে চাই। তবে তোমার হাতে খুন হতে চাই না।’
তুরিন দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘আমাকে অপছন্দ করার কারণগুলো কী কী? শুনি তো!’
—‘প্রথম কারণ হলো, তুমি বোকা।’
—‘আর?’
তুরিনের তেলে ভাজা চিংড়িমাছের মতো সাদা লাল মুখটার দিকে চেয়ে দুরূহ একটা চাপা হাসি হেসে যাচ্ছিল শাহজিদ। হাসতে হাসতেই বলল, ‘তুমি পাগল।’
নিজের কোমরে আপনা-আপনিই হাত উঠে যায় তুরিনের। ঝগড়াটে গলায় বলে, ‘আর কী কী কারণ আছে শাহজিদ?’
—‘তুমি একটা খরগোশের বাচ্চা।’
—‘ফালতু কথা।’
শাহজিদ বসা থেকে উঠল ধীরে ধীরে। ক্রাচে ভর দিয়ে এগিয়ে এলো কয়েক পা। তুরিনের একটা হাত ধরল। হ্যাচকা টানে সরিয়ে নিল তুরিন নিজের হাত। বিষঢালা গলায় বলল, ‘কাছে আসবে না তুমি।’
—‘কেন?’
—‘নিষেধ করেছি তাই।’
শাহজিদ প্রতিবাদী হয়ে উঠল, ‘কিন্তু কেন? আজকে থেকে তুমি অফিসিয়ালি আমার গার্লফ্রেন্ড, তাই না?
তুরিন অপ্রতিভ হয়, ‘গার্লফ্রেন্ড না ছাই…তোমার মতলবটা আমি বুঝেছি। আসলেই তুমি একটা বাজে ছেলে। প্রেম করতে চাও। কিন্তু বিয়ে করতে চাও না। এসব হবে না।’
—‘আর ইউ রিজেক্টিং মি?’ কথাটা বলতে বলতেই আচমকা অন্য একটা কথা মনে পড়ে যায় শাহজিদের। সন্দিগ্ধ চোখে তাকায় তুরিনের দিকে। কঠিনভাবে বলে, ‘তুমি অর্ণবকে কিস করেছিলে কেন?’
তুরিনের মুখের রং পালটে যায় এই প্রশ্নে। চপল গলায় বলে, ‘তাতে তোমার কী?’
—‘আমার কিছুই না। কিন্তু যাকে তুমি বিয়ে করতে চাও না…তাকে কেন অযথা…তোমাকে আসলে আমি বুঝি না।’
— ‘তোমার হিংসে হয়েছে খুব, তাই না?’
— ‘প্রশ্নই আসে না।’
— ‘আমাকেও তো তুমি বিয়ে করতে চাও না। কিন্তু চুমু খেয়েছিলে।’
— ‘আমি তো বাজে ছেলে। তুমি নিজেই বলেছ একটু আগে।’
— ‘আমিও বাজে মেয়ে। আমাকে কেউ পছন্দ করে না, জানো তো? আমার নিজের বাবাও এখন আর আমাকে আগের মতো ভালোবাসে না। নিশার মতো ভালো নই তো আমি। আমাকে অপছন্দ করার অজস্র কারণ আছে। হয়তো অর্ণবও আমাকে অপছন্দ করে। জোর করে ওর গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে আমাকে।’ বাধভাঙা ঝর্ণার শব্দে তুরিনের কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বর অনেকটাই ক্ষীণ হয়ে আসে। ঠোঁট কাঁপতে থাকে হালকা। সেদিকে চেয়ে থেকে শাহজিদ নিজের হৃৎপিণ্ডে একটা অস্থির অট্টরব অনুভব করে। এক থোকা মন কেমনের বাতাস আটকে যায় শ্বাসনালিতে! রুদ্ধস্বরে বলে,
‘তুমি বাজে নও। তুমি ভালো। পাহাড়ের মতো ভালো!’
— ‘পাহাড়ের মতো?’
— ‘হুম।’
— ‘বাজে মেটাফোর!’
শাহজিদ হাসল, ‘আমি জানি…হয়তো বলা উচিত ছিল তুমি ফুল, পাখি কিংবা চাঁদের মতো…কিন্তু আমার কাছে পাহাড় সবচেয়ে ভালো…আর তোমাকে আমার পাহাড়ের মতোই ভালো লাগে!’
তুরিনের মুখটা সদ্য ঋতুমতী চতুর্দশী কিশোরীর মতো আরক্ত হয়ে ওঠে হঠাৎ। বুকের পাঁজরের খাঁচায় রঙিন পাখনার অচিন প্রজাপতির উড়াউড়ি টের পায় সে! সংকোচের ভারে নেমে আসে চোখের পাতা।