১৮
— ‘নিশা!…নিশা!’
জুবিনকে কোলে নিয়ে নিশা সিঁড়ির দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে সবেমাত্র। মেয়েকে গোসল করাতে হবে, খাওয়াতে হবে তারপর ফুলবাবুটি সাজিয়ে দিতে হবে জন্মদিনের পার্টির জন্য। সিঁড়িতে পা রাখতে যাবে, ঠিক সেই সময় উঠোন থেকে ডাকটা ভেসে এলো। কেউ একজন ওর নাম ধরে ডাকছে উচ্চকণ্ঠে গলার স্বরটা চেনা। কিন্তু শাহজিদ এভাবে কখনো ডাকেনি তো আগে! আজ হঠাৎ কী হলো?
জাহিদ তখনো ফারার সামনেই দাঁড়ানো। ডাকটা কানে এসে লাগতেই ওর মুখের রং পাল্টে গেছে। দিনেদুপুরে ভূত দেখার মতো চমক লেগেছে চোখে। নিশাও কম বিস্মিত হয়নি। কয়েক সেকেন্ড নিশ্চল জীবাশ্মের মতো দাঁড়িয়ে থেকে কম্পিত বক্ষ নিয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যেতে লাগল সদর দরজার দিকে। হঠাৎ ডাক পড়ল পেছন থেকে, ‘দাঁড়াও।’
নিশা দাঁড়াল। জাহিদ হনহনিয়ে হেঁটে এসে জুবিনকে ছোঁ মেরে নিশার কোল থেকে তুলে নিল। শীতল স্বরে বলল, ‘এবার যাও।’
নিশার হাতে তখনো জাহিদের দেওয়া চিরকুট। সে জানে শাহজিদের এই আকস্মিক ডাক শুনে জাহিদ কী ভাবছে। এর আগে যতবার এই প্রসঙ্গ এসেছে, ঘেন্নায় মুখ বুজে এসেছে নিশার। এমন জঘন্য বিষয় নিয়ে আলাপ করতেই ইচ্ছে করেনি। মুখ ফুটে বলতে ইচ্ছে করেনি যে আপনি যা ভাবছেন তা সম্পূর্ণ ভুল। বলার রুচি হয়নি। কিন্তু আজকে এই মুহূর্তে জাহিদের ওই পাল্টে যাওয়া মুখভঙ্গি দেখে নিশার মনে হলো বিষয়টা নিয়ে স্পষ্টভাবে কথা বলা উচিত ছিল অনেক আগেই। কিন্তু আগের সঙ্গে তো আজকের পরিস্থিতির তুলনা চলে না। আজকে নিশার হাতে আছে তার ভালোবাসার স্বীকৃতি। এই স্বীকৃতিটুকু বুকে জন্ম দিয়েছে অগাধ সাহস এবং অপার নিরাপত্তাবোধের। জীবনে এই প্রথমবারের মতো ফারা এবং তুরিনের সামনে দাঁড়িয়ে সে হীনম্মন্যতায় ভুগছে না। নিজেকে আশ্রিত বলে মনে হচ্ছে না। এই ছোট্ট এক টুকরো কাগজখানি তার সংকীর্ণ, কমজোর মনের কর্দমাক্ত মাটিতে আত্মপ্রত্যয়ের শক্ত চারা বপন করে দিয়েছে। প্রত্যাবৃত্ত করেছে হারিয়ে যাওয়া আত্মসম্মান।
শাহজিদ নিশার নাম ধরে ডেকে যাচ্ছিল। নিশা বেরিয়ে এসে দেখল তুরিন আরো আগেই এসে দাঁড়িয়েছে পোর্চে। এখনো ঝিরঝির করে ঝরছে বরফ। শাহজিদের গায়ে কালো ওভারকোট, হাতে ক্রাচ। ওভারকোটের গায়ে ছিটা ছিটা বরফবিন্দু জমেছে। নিশা বেরিয়ে আসতেই শাহজিদ বলল, ‘জরুরি কিছু কথা আছে। একবার আসবে?’
নিশা ঘাড় ঘুরিয়ে তুরিনকে দেখল। সেই সময় তুরিনও তাকাল ওর দিকে। চোখে চোখ পড়তেই তুরিনের দৃষ্টি প্রখর হলো। মুখে চিলিক মারল ক্রোধের স্ফুলিঙ্গ। পারলে নিশাকে চোখের আগুনেই ঝলসে দেয়। ওর গায়ে গরম কাপড় নেই। শুধু পাতলা টি-শার্ট আর ট্রাউজার। শীতে একটু একটু কাঁপছে হাত-পা।
‘কী হয়েছে শাহজিদ? সব ঠিক আছে তো?’ নিশা ঘাবড়ে যাওয়া গলায় প্রশ্নটা করল।
— ‘একটু শুনে যাও।’
কথাটা বলে শাহজিদ ক্রাচে ভর দিয়ে ব্যাকইয়ার্ডের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। নিশা ত্বরিতপদে ভেতরে ছুটে গিয়ে কোট স্ট্যান্ড থেকে কোট নামিয়ে নিল। জাহিদ জুবিনকে কোলে নিয়ে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মুখ জুড়ে থমথম করছে অমাবস্যার অন্ধকার। নিশা ভেতরে ঢুকতেই তীব্র নেত্রে তাকাল একবার। ওই চোখের দৃষ্টি নিশাকে থমকে দিল। ভয়ের অস্তিত্ব মৃদু অথচ দ্রুত পদসঞ্চারে জমিয়ে দিয়ে গেল হাত-পা। তার মনে হলো কিছু বলা উচিত। কয়েক সেকেন্ড তটস্থভাবে দাঁড়িয়ে থেকে কয়েকটা জুতসই শব্দ গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টা করল। লাভ কিছুই হলো না। যথাসময়ে ফারা উপস্থিত হলো দৃশ্যপটে। ঠোঁটে উপচে পড়ছে বিদ্রুপের হাসি। মুখশ্রীতে খুশি খুশি ভাব। নিশা কোটটা গায়ে চড়িয়ে তড়িঘরি করে বেরিয়ে এলো। ফারার তামাশাপ্রিয় মন সুযোগ হাতছাড়া করল না। জাহিদের পাশে দাঁড়িয়ে চতুর গলায় বলল, ‘দেখলে তো! প্রেম একেবারে জমে গেছে। আ’ম স্পিচলেস। ছেলেটার সাহসের প্রশংসা করতেই হয়।’ কথাটা জাহিদের কানে রীতিমতো অশ্রাব্য বলে মনে হলো। হাত-পা রিরি করে উঠল ঘেন্নায়। সেই সঙ্গে একটা উৎকট, উগ্র রাগের তুফান উঠল ভেতরে। ছেলেটার সত্যিই অনেক বেশি সাহস হয়ে গেছে। দিনে দুপুরে বাড়ি শুদ্ধ লোকের সামনে অকপটে নিশার নাম ধরে ডাকার স্পর্ধা কোত্থেকে পায় সে? জাহিদের মনে হলো এর একটা বিহিত আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেহেতু ঘটনা গড়িয়ে গেছে এতদূর…এখন আর হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা চলবে না। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল এখুনি শাহজিদকে কয়েকটা কড়া কথা শুনিয়ে দেয় কিংবা কোন উচ্চবাচ্য না করে সরাসরি ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। কিন্তু তার ভদ্রতা জ্ঞান বা শিষ্টাচার বিধি বাল্যকাল থেকেই অতি জাগ্ৰত। চাইলেই কারো সঙ্গে চট করে দুর্ব্যবহার করতে পারে না। এই শিষ্টাচার বোধ দিনকে দিন তার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রতিকূলতা এবং দুর্বলতায় রূপান্তরিত হচ্ছে। মানুষের কথা তো অনেক ভাবল…বাবার কথা, মায়ের কথা, ফারার কথা, তুরিন জুবিনের কথা, নিশার কথা…এমনকি পঙ্গু শাহজিদের জন্যও সময়ে সময়ে তার মন উতলা হয়েছে। নির্ভেজাল করুণার উদ্রেক হয়েছে মনে। অথচ এই মানুষগুলো কোনদিন তার কথা ভাবেনি। বাবা-মা ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে নিজস্ব সিদ্ধান্ত। নিশাকে বিয়ে করতে চায় না, এটা জানার পর মা ঘুমের ওষুধ খেয়ে ইমার্জেন্সিতে ছিলেন দুইদিন দুই রাত। বাবার হার্টের অবস্থা ভালো না। সেভেন্টি পার্সেন্ট ব্লক আছে। বছর পাঁচেক আগে রিং পরানো হয়েছিল। উত্তেজনার বশে হার্ট অ্যাটাক হলে প্রাণে বাঁচার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এই সব সাতপাঁচ ভেবেই দ্বিতীয় বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিল সে। বাধ্য করা হয়েছিল।
.
নিশা বাইরে এসে দেখল তুরিন এখনো পোর্চে দাঁড়িয়ে। শাহজিদকে দেখা যাচ্ছে না। স্নো বুট ছাড়া সাধারণ স্যান্ডেল পরে এই বরফের ওপর হাঁটা খুব কঠিন ব্যাপার। নিশা সাবধানে সিঁড়ি ভেঙে উঠোনে নেমে এলো। ঠিক তখনই ফারার কণ্ঠস্বর ভেসে এলো পেছন থেকে। গর্জে উঠে তুরিনকে বলতে লাগল, ‘তুমি এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে করছ কী? ভেতরে যাও!’
শাহজিদের ঘরের দরজাটা খোলা। নিশা ভেতরে ঢুকে দেখল মেঝেতে একটা ট্রাভেল ব্যাগ পড়ে আছে। শাহজিদ মৃদু স্বরে বলল, ‘সরি… বিরক্ত করলাম তোমাকে।’
— ‘কী হয়েছে?’ রুদ্ধশ্বাসে প্রশ্ন করে নিশা।
— ‘চলে যাচ্ছি।’
— ‘মানে কী? কোথায় যাচ্ছ হুট করে?’
— ‘হুম…হুট করেই ডিসিশন নিলাম। মনে হলো যাওয়ার আগে তোমার সঙ্গে একবার দেখা না করলে অন্যায় হবে।’
— ‘কিন্তু যাচ্ছ কোথায়?
— ‘দেখি।’
নিশার বুক কেঁপে উঠল অজানা আশঙ্কায়, ‘দেখি মানে কী? আমি তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না। তুমি একলা মানুষ, কোথায় যাবে?’
শাহজিদ ডান গালে জিব ঠেকিয়ে ক্ষণিকের জন্য ভাবল কিছু একটা
সামান্য হেসে বলল, ‘একলা মানুষরা কোথাও যেতে পারবে না। এমন কোন নিয়ম আছে নাকি?’
নিশা বিপন্ন গলায় বলল, ‘আমার ভয় হচ্ছে শাহজিদ! তোমার কথাবার্তা কেমন যেন এলোমেলো।’
— ‘নিশা শোন, এ বাড়িতে মুর্তজা আংকেল আর তুমি ছাড়া আমার কোন বন্ধু নেই। কিন্তু আংকেলকে গুডবাই বলার মতো সাহস নেই আমার। আমি বেরিয়ে যাওয়ার পর তুমি আংকেলকে খবরটা দেবে।”
— ‘তোমাকে এভাবে বিদায় করে দিলে বাবা আমাকে ভীষণ বকবেন!’
— ‘প্লিজ নিশা, হেল্প মি! আই নিড ইয়োর হেল্প।’
নিশা কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, ‘কেন হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত নিলে শাহজিদ? আবার কবে আসবে?’
শাহজিদ উত্তরে একটু মুচকি হাসল। কিছু বলল না। নিশা কণ্ঠে আকুতি ফুটিয়ে বলল, ‘যেও না ভাই। আর কিছুদিন থাকো। তুমি চলে গেলে আমার খুব খারাপ লাগবে।
‘আমিও তোমাকে মিস করব নিশা। তুমি প্লিজ নিজের দিকে খেয়াল রেখো। জীবন নিয়ে অবহেলা করো না। খুব দ্রুত একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নাও।’ নিশা হঠাৎ অন্যরকম গলায় বলল,
— ‘তুরিনকে কিছু বলে যাবে না তুমি?’
এই প্রশ্নে শাহজিদের মুখখানা কিঞ্চিৎ আরক্ত হয়ে ওঠে। হাত নেড়ে মাছি তাড়াবার ভঙ্গি করে বলে, ‘ওই পাগলের কথা বাদ দাও।’
নিশা ডাগর দু খানা চোখ মেলে হন্যে হয়ে কী যেন খুঁজল শাহজিদের মুখে। তারপর এক ছুটে বেরিয়ে এলো বাইরে। শাহজিদ তব্দা খাওয়া চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল নিশার এই আকস্মিক প্রস্থান।
টিভিতে স্পোর্টস চলছে। জাহিদ বসে আছে কাউচে। হাতে টিভির রিমোট। কুঞ্চিত ভ্রসমেত গম্ভীর দুটি চোখ মেলে চেয়ে আছে টিভির দিকে। পাশেই ওর গা-ঘেঁষে বসেছে তুরিন। তার মুখখানাও বড্ড থমথমে। একমাত্র ফারাকেই বেশ প্রফুল্ল দেখাচ্ছে। চেয়ারে বসে পা নাচাতে নাচাতে একনাগাড়ে অনেক কথা বলে যাচ্ছে সে। সেই সময় হঠাৎ সদর দরজাটা দড়াম করে খুলল কেউ একজন। ছুটে এলো একটা শ্বাসরুদ্ধকর কণ্ঠের অকস্মাৎ আর্তনাদ, ‘তুরিন!’
নিশার মুখে তুরিনের নাম উচ্চারিত হতে কেউ কোনদিন শোনেনি এর আগে। সবাই দারুণ রকম চমকে উঠল। অপ্রস্তুত তুরিন বিস্ময়বিমূঢ় চোখে কয়েক নিমেষ চেয়ে রইল নিশার দিকে। মুখ দিয়ে কোন শব্দ বেরোলো না। নিশা হাঁপ ধরা গলায় বলল, ‘এদিকে এসো। তাড়াতাড়ি!’
ফারার চোখ দুটো কোটোর থেকে মার্বেলের মতো খুলে পড়তে চাইল যেন। বিস্ময় আর বিরক্তিতে দুমড়েমুচড়ে গেল নাকমুখ। নিশার দিকে ডাকিনীর মতো হিংস্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল, ‘তুরিনকে তোমার কী প্রয়োজন?’
তুরিন উঠে দাঁড়িয়েছে তখন। ওর মুখখানা দ্বিধা আর বিভ্রমের যুগল স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। বুক দুলছে অনিশ্চয়তায়। তার ষষ্ঠইন্দ্রিয় বলছে নিশার কাছে শাহজিদ সম্পর্কিত কোন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে। ফারা খপ করে মেয়ের একটা হাত চেপে ধরল, ‘তুমি বসো। কোথাও যেতে হবে না।’
তুরিন অসহায় চোখে একবার মায়ের দিকে, আরেকবার নিশার দিকে তাকাল। কাটল কয়েকটি বিভ্রান্ত মুহূর্ত। জাহিদ উঠে দাঁড়িয়ে ফারার কবজা থেকে তুরিনের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল, ‘লেট হার গো।’
বাবার অনুমতি পাওয়া মাত্র তুরিন ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে গেল নিশার দিকে কাছাকাছি এসে রুদ্ধশ্বাসে প্রশ্ন করল, ‘কী হয়েছে?’
নিশা তুরিনের হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে দরজার বাইরে নিয়ে এলো। গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলল, ‘শাহজিদ তো চলে যাচ্ছে। এ বিষয়ে কিছু জানো তুমি?’
তুরিনের মুখটা কাগজের মতো সাদা হয়ে গেল, ‘চলে যাচ্ছে মানে? কোথায় যাচ্ছে?’
— ‘জানি না। তুমি তাড়াতাড়ি যাও। কথা বল ওর সঙ্গে। এখুনি বেরিয়ে পড়বে।’
তুরিন ছুটল দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে। পায়ে জুতোটা পর্যন্ত পরতে ভুলে গেল। উঠোনে তিন ইঞ্চি পুরু বরফ জমে গেছে এর মাঝেই। পেলব তুলোর মতো নরম আর সাবানের ফেনার মতো ভেজা ভেজা ঈষৎ পিচ্ছিল সেই বরফের শুভ্র আস্তরে নিখুঁত পায়ের ছাপ ফেলে মেরু অঞ্চলের শ্বাপদ প্রাণীর মতো নির্ভয়ে ছুটে যাচ্ছিল তুরিন। পায়ের ক্ষত এখনো পুরোপুরি শুকোয়নি। সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই মেয়েটার। নিশা পেছন থেকে হাঁক ছাড়ল, ‘আস্তে যাও। পড়ে যাবা!’ সত্যিই ফ্রন্ট ইয়ার্ড থেকে ব্যাক ইয়ার্ডে নামার উত্রাই পার হওয়ার সময় তুরিনের পা ফসকে যাচ্ছিল। নিশা ওকে ধরে ফেলল।
পাগল ছাড়া দুনিয়া চলে না
গাছের ডালে ঘাপটি মেরে বসে আছে চাক চাক তুষারবিন্দু। হঠাৎ চোখে পড়লে মনে হয় স্নো-ড্রপ বা বকুলফুলের সমাহার। বরফকুচির ধূম্রজাল গুটিয়ে নিয়েছে প্রকৃতি। এতক্ষণ ওপরে তাকালে আকাশ দেখা যাচ্ছিল না, সাদা মশারিতে আটকে যাচ্ছিল চোখ। এখন আকাশ পরিষ্কার নীল। রোদ ঠিকরে পড়ছে ভূ- খণ্ডের জমাটবাঁধা বরফে। রুপোর মতো ঝিকোচ্ছে চারপাশ। একটা ঘণ্টা অবিরত ঝিরিঝিরি ঝরে পড়ার পর তুষারপাত থেমেছে অবশেষে। আবহাওয়া পূর্বাভাস বলছে রাত দশটা থেকে আবারও ঝরবে। হুইলচেয়ার নিয়ে ব্যাকইয়ার্ডে বেরিয়ে এসেছে শাহজিদ। মেইলবক্সের চাবি এবং ঘরের চাবি দরজার সামনের আউটডোর ম্যাটের ওপর সযত্নে নামিয়ে রাখল। সেই সঙ্গে রাখল মুর্তজা সাহেবের উদ্দেশ্যে লেখা কয়েক লাইনের ছোট্ট নোট 1
— ‘কোথায় যাচ্ছ?’
উদ্দীপিত কণ্ঠস্বর ভেসে আসতেই হালকা চমকালো শাহজিদ। প্রথমেই চোখ পড়ল তুরিনের নিরাবরণ পা-জোড়ার ওপর। কনকনে ঠান্ডা বরফের ঘষা লেগে রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। ঠকঠক করে শীতে কাঁপছে সর্বাঙ্গ। ওর পেছনে নিশা দাঁড়িয়ে আছে কোট গায়ে দিয়ে। শাহজিদ নিশার দিকে সীমাহীন বিরক্তির একটা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বিদ্রুপের সুরে বলল, ‘গ্রেট জব! দারুণ একটা কাজ করলে তুমি। ফ্যাসিনেটিং!’ নিশা লজ্জিত ভঙ্গিতে মুখ নিচু করল।
— ‘কোথায় যাচ্ছ?’ তারস্বরে আবারও প্রশ্নটা ছুঁড়েদিল তুরিন। শাহজিদ প্রত্যুত্তর করল না। হুইলচেয়ারের পাশে উঠোনে রাখা ব্যাগটা একটু ঝুঁকে, হাত বাড়িয়ে কোলের ওপর তুলে নিল। তুরিন পথ আটকে দাঁড়াল, ‘আমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছ না কেন?’
নিশা এগিয়ে এলো কয়েক পা, ‘শাহজিদ, ভেতরে গিয়ে কথা বলো। দ্যাখো তুরিন ঠান্ডায় কীরকম কাঁপছে।’
তুরিন হুইলচেয়ারের সামনে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। শীতের দাপটে কুঁকড়ে গেছে মুখের চামড়া। ফাটা ঠোঁটে লাল লাল আঁচর বসে গেছে। শাহজিদ যথাসাধ্য শান্ত গলায় বলল, ‘সরে দাঁড়াও। আই অ্যাম অ্যা বিট টাইড আপ নাও। আই শ্যুড গেট গোইং।’
তুরিন সরল না। কয়েক সেকেন্ড গভীর সংশয় নিয়ে শাহজিদের থমথমে মুখের দিকে চেয়ে থেকে অদ্ভুত শীতল গলায় বলল, ‘এর মানে…শেষ পর্যন্ত তুমি পালিয়ে যাচ্ছ শাহজিদ আনাম! ইউ আর রানিং অ্যাওয়ে ফ্রম মি।’ শিউরে উঠল শাহজিদ। চমকে তাকাল তুরিনের দিকে, ‘পালিয়ে যাচ্ছি মানে? পালাব কেন?’
— ‘অর্ণবের সঙ্গে আমার বিয়ে হবে এটা তুমি সহ্য করতে পারছ না। এ কারণেই পালিয়ে যাচ্ছ।’
থমকানো শাহজিদ বিস্ময়ের বেগ সামলে নিয়ে কোনরকমে বলল, ‘সিরিয়াসলি? তোমার তাই মনে হয়? তুমি কিংবা অর্ণব, তোমরা কেউই আমার কাছে ইম্পরট্যান্ট নও। এখন সরো এখান থেকে। যেতে দাও।’
তুরিন হঠাৎ অপ্রকৃতস্থ ভাবে চিৎকার করে উঠল, ‘তুমি যেতে পারবে না! আমার বিয়ে হওয়ার আগে তুমি এখান থেকে এক পা-ও নড়তে পারবে না শাহজিদ আনাম! আমি অর্ণবকে বিয়ে করব আর সেটা তুমি চোখ মেলে চেয়ে দেখবে!’
শাহজিদ কিন্তু মনে মনে বিষম রকম ধাক্কা খেয়ে গেছে তখন! বোকা, হিংসুটে অনুর্বর মস্তিষ্কের তুরিনের কাছে ধরা পড়ে যাওয়ার পর নিজেকে নিতান্তই শূন্যগর্ভ পরাজিত এক কাপুরুষ বলে মনে হচ্ছে তার। তুরিনের চোখে চোখে সরাসরি তাকাবার সাহস পাচ্ছে না। তবুও জোর করে মুখে একটা নির্বিকার হাসি টেনে এনে বলল, ‘তোমাকে নিয়ে মোটেও ভাবছি না তুরিন। আমি যাচ্ছি নিজের প্রয়োজনে।’
তুরিন রেগে গেলে কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। পাগলের মতো চিৎকার করতে থাকে, কাঁপতে থাকে, জিনিসপত্র ছুঁড়েমারতে থাকে। আজকেও ব্যতিক্রম হলো না। শাহজিদের ব্যাগটা দু হাত দিয়ে খামচে ধরে উঠোনে জমে থাকা তিন ইঞ্চি পুরু বরফের ওপর ধপ করে ফেলে দিল। দশ কেজি ওজনের ব্যাগের আঘাতে শ্বেতশুভ্র তুষারাবৃত মাটি চূর্ণবিচূর্ণ হলো। বরফ কণা ছিটকে পড়ল এদিক- সেদিক। তুরিন বক্ষ বিদীর্ণ করা উৎকট আর্তনাদে ফেটে পড়ে বলল, ‘তুমি যাবে না! খবরদার যাবে না!’
শাহজিদ থমকানো বিস্ফারিত দুটি চোখ তুরিনের আগুনগরম মুখের ওপর মেলে রেখে আতঙ্কগ্রস্ত গলায় নিশাকে বলল, ‘আই থিংক শি নিডস আ সাইকিয়াট্রিস্ট। তোমরা এই চিড়িয়াটাকে ধরে বেঁধে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও না কেন?’
এ কথা শুনে তুরিনের রাগ আরো তুঙ্গে উঠল। ডাঙ্গায় তোলা কইমাছের মতো ছটফট করতে করতে বলল, ‘তুমি বলতে চাইছ আমি পাগল…হ্যাঁ? ইউ থিংক আই অ্যাম ক্রেজি?’ শাহজিদ লাফঝাঁপ দেখতে দেখতে ঠান্ডা গলায় ঘোষণা দিল,
— ‘ইউ আর ক্রেজি, স্ক্যারি অ্যান্ড ক্রিপি!’
তুরিনের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। মধ্যাঙ্গুলি প্রদর্শন করে দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল, ‘ফাক ইউ!’
শাহজিদ অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে নিল। কী কথা বলবে এই পাগলের সঙ্গে?
তুরিনের কাঁপুনিটা নিশার লক্ষ্যগোচর হয়েছে অনেক আগেই। আরেকটু হলেই বুঝি মেয়ের দাঁত কপাটি লেগে যাবে। নিশা পদব্ৰজে এগিয়ে এসে ওর বাহুতে একটা হাত রাখল। মৃত মানুষের মতো ঠান্ডা হয়ে এসেছে শরীর। নিজের পরনের কোটটা খুলে নিয়ে তুরিনের গায়ে জড়িয়ে দিতে দিতে নিশা বলল, ‘তুমি ভেতরে যাও। ঠান্ডায় তোমার হাত-পা জমে গেছে।’
ততক্ষণে ওরা খেয়াল করল তুরিনের খর্বকায় চোখজোড়ার কার্নিশ উপচে ঝরঝর করে গড়িয়ে পড়ছে জল। নাকের পানি স্পর্শ করেছে ঠোঁটের দেওয়াল। দুই গাল হয়ে উঠেছে টমেটোর মতো লাল টকটকে। কাঁদতে কাঁদতে…কাঁপতে কাঁপতে…রাগে গজগজ করতে করতে সে নিশাকে বলল, ‘এই স্টুপিড ছেলেটা যেন কোথাও না যায়। ও চলে গেলে কিন্তু খারাপ হবে…খুব খারাপ হবে!’
নিশা প্রবোধ দেওয়ার স্বরে বলল, ‘ও কোথাও যাবে না। তুমি চিন্তা করো না।’
শাহজিদ তব্দা খাওয়া চোখে তুরিনের পাগলামো দেখে যাচ্ছিল। এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘আমাকে সত্যিই যেতে হবে!’
তুরিন শাহজিদকে কিছু বলল না। নিশার দিকে চেয়ে নাছোড় গলায় দাঁতে দাঁত কেটে কেটে বলল, ‘ওকে জানিয়ে দাও, আজকে এখান থেকে চলে গেলে আর কোনদিন আমার মুখ দেখতে পাবে না! ‘
সেই সময় হঠাৎ রঙ্গমঞ্চের পট সামান্য পরিবর্তিত হলো। ফ্রন্ট-ইয়ার্ড থেকে ব্যাক-ইয়ার্ডে আসার ঢালু পথটা ধরে ফারা আর জাহিদকে নেমে আসতে দেখল শাহজিদ। নিশার একটা হাত তখনো তুরিনের কাঁধের ওপর রাখা। তুরিন বিদ্রোহী ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থেকে রাগে গজরাচ্ছে…অবোধ বালিকার মতো কাঁদছে…অপ্রকৃতস্থ মানুষের মতো ফোঁসফোঁস শ্বাস ফেলছে! জাহিদ, ফারা দুজনের কেউই ঠিক এরকম একটা ঘটনার সাক্ষী হওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল না। ওরা পাথরের মূর্তির মতো থমকে গেছে। মুখে সাঁতার কাটছে নিশ্ছিদ্র বিস্ময়। কয়েকটা স্তব্ধ মুহূর্ত পার হওয়ার পর ফারা গলা ফাটানো চিৎকার করে বলল, ‘কী হচ্ছে এখানে?’
শাহজিদ তুরিনের দিকে তাকাল একপলক। তারপর সুস্পষ্ট গলায় ফারার প্রশ্নের উত্তর দিল, ‘আমি চলে যাচ্ছি।’
জাহিদ তীক্ষ্ণ চোখে নিশা আর তুরিনকে পর্যবেক্ষণ করছিল। ঘটনার মাথামুণ্ডু কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। তুরিনের পরনে কি ওটা নিশার কোট? হ্যা…দেখে তো সেরকমই মনে হচ্ছে। বাতাসে রহস্যের ঘ্রাণ পাচ্ছিল সে। তবে এ কথা সত্য…ভীষণ ভীষণ সত্য…যে এত সন্দেহ, এত অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও জীবনে প্রথমবারের মতো নিশা আর তুরিনকে কাছাকাছি, পাশাপাশি বন্ধুর মত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এক অনীর্বচনীয় স্বস্তিতে ওর মন-প্রাণ ভরে গেছে। মনে হচ্ছে যেন অনেক দিন পর একটা সত্যিকারের সুন্দর দৃশ্য দেখল। একদম মনের মতো দৃশ্য!
ফারার নাকের পাল্লা দুটি ফুলে ঢোল হয়েছে। লোহা ঝালাইয়ের মতো বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গ খেলছে মুখের সমস্ত গলি-ঘুঁজিতে। ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে এগিয়ে এলো সে। তুরিনের কনুই ধরে হ্যাঁচকা টানে নিশার কাছ থেকে বেশ অনেকখানি দূরে সরিয়ে আনল। ক্যাটক্যাট করে শাহজিদকে বলল, ‘হোয়াট আর ইউ ওয়েটিং ফর? চলে গেলে চলে যাও। প্লিজ লিভ! ‘
তুরিনের মাথার তার এখন ছেঁড়া। চৈতন্যের কোঠা পুরাদস্তুর ফাঁপা বলা চলে। দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘ও কোথাও যাবে না!’ ফারা দুনিয়া কাঁপানো চমক নিয়ে তাকাল মেয়ের দিকে। তাকিয়েই রইল কয়েক নিমেষ। তারপর কণ্ঠস্বর অনেকখানি চেপে নিয়ে বলল, ‘তুমি বড়দের মাঝখানে কথা বলো না হানি! আমি দেখছি।’ একটু বিরতি নিয়ে ফারা ব্যস্ত গলায় শাহজিদকে বলল, ‘চলে যাও…চলে যাও…অনেক দিন তো থাকলে…আর কত?’
তুরিন ক্ষুধার্ত বাঘিনীর মতো গর্জে উঠল, ‘মা! চুপ করো!’
জাহিদ দাঁড়িয়ে ছিল চুপচাপ। কালো জ্যাকেটের পকেটে হাতদুটি রাখা। কপালে কুঞ্চন। চোখে সন্দেহের অবাধ বিচরণ। সে ঠান্ডা প্রকৃতির মানুষ। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে রাগের বশে হঠকারী আচরণ করা তার স্বভাবে নেই। আজ পর্যন্ত তুরিনকে শুধু তার সঙ্গেই এমন চূড়ান্ত পাগলামো করতে দেখেছে। মেয়েটা যখনই নিশাকে নিয়ে অনিরাপত্তায় ভুগেছে। যখনই মনে হয়েছে নিশা তার কাছ থেকে বাবাকে ছিনিয়ে নেবে, তখনই বাহ্যজ্ঞানরহিত উন্মাদিনীর মতো আচরণ করেছে। কিন্তু আজকের ঘটনায় জাহিদ অনাহুত এক দর্শক মাত্র। তাহলে তুরিনের এই অসংযত, লাগামছাড়া আচরণের কারণ কী?
এদিকে মেয়ের ধমক খেয়েও ফারা দমল না। শাহজিদকে এখান থেকে এই মুহূর্তে বিদায় করতে না পারলে যেন শান্তিতে শ্বাসটুকুও ফেলতে পারছে না। অধৈর্য হয়ে বলল, ‘তুমি একাই যাবে? নিশাকে নিয়ে যাবে না?’ এই কথায় উপস্থিত সবার মুখে একটা অস্বস্তি চনমন করে উঠল। নিশা চমকে উঠে রুদ্ধশ্বাসে তাকাল ফারার দিকে। শাহজিদ অকপট বিস্ময়ে বলল, ‘নিশাকে কেন নিয়ে যাব?’
ফারা হাসল, ‘না নিলে তুমি বাঁচবে কী করে?
— ‘ফারা! হ্যাং অন। তুমি আর কথা বলো না। এখানেই থামো। আমি দেখছি ব্যাপারটা।’ শীতল কণ্ঠের আদেশটা শুনে ফারা আগুন চোখে তাকাল একবার জাহিদের দিকে। সে লক্ষ করেছে জাহিদ আজকাল তার সঙ্গে ঝগড়া করে না, তর্ক করে না, শুধুই হুকুম বা হুমকী দেয়। ফারার কোন মতামতকেই সে আর গ্রাহ্য করে না। এটা ভালো লক্ষণ নয়। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে ঝগড়া বা তর্ক বিতর্ক বন্ধ হয়ে গেলে বুঝতে হবে এই সম্পর্ক স্বাভাবিকতা হারিয়েছে। এই সম্পর্ক এখন মৃত্যুপথযাত্রী। জাহিদ কয়েক পা এগিয়ে এসে তুরিনের কাঁধ জড়িয়ে ধরল। মেয়েটা হিড়হিড় করে কাঁপছে। দাঁতের সঙ্গে দাঁত ঘষা খাচ্ছে। নাক চোখ পানিতে একাকার। মেয়ের গালের পানি মুছে দিতে দিতে জাহিদ শান্ত স্বরে প্রশ্ন করল, ‘কী হয়েছে? আমাকে একটু খুলে বলো ঘটনাটা।’
বাবার সান্নিধ্য তুরিনের চেতনায় একটা মৃদু ধাক্কা দিয়ে গেল। ক্রোধের আগুনে পুড়ে ছাই হওয়া মস্তিষ্কে বিবেকের অল্প একটু আলো প্রতিফলিত হলো যেন। পরমুহূর্তেই সংকোচ হলো তার…ভীষণ সংকোচ! বাবাকে এখন কী বলবে? সব কথা কি বলা যায়?’
কথা বলল নিশা। কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে ভারী স্পষ্টভাবে বলল, ‘শাহজিদ চলে যাচ্ছিল বাড়ি ছেড়ে। আমি ভাবলাম খবরটা তুরিনকে একবার দেওয়া প্রয়োজন। তাই ওকে ডেকে এনেছিলাম। তো…এসব নিয়েই ওদের মধ্যে বাগবিতণ্ডা হচ্ছিল।’
নিশার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে জাহিদ গম্ভীর গলায় বলল, ‘আই হ্যাভ নো আইডিয়া হোয়াট ইউ আর টকিং অ্যাবাউট। প্রথমত শাহজিদ কেন চলে যাচ্ছিল হুট করে? দ্বিতীয়ত শাহজিদের চলে যাওয়া বা না যাওয়ায় তুরিনের কী এসে যায়? ফিল মি ইন প্লিজ!’
নিশা শাহজিদের দিকে তাকাল অপ্রস্তুত ভাবে। শাহজিদ স্তম্ভিত এবং লজ্জিত। একটা অপ্রতিভ ভাব খেলছে ওর চোখে মুখে। ফারা বুঝতে পারছিল পরিস্থিতি মোটেও তার অনুকূলে নেই। মাথায় আগুনের গনগনে আঁচ টের পাচ্ছিল সে। আত্মবিশ্বাসে টান পড়ে গেছে রীতিমতোন। সাপের মতো ছোবোল দিয়ে উঠে নিশাকে বলল, ‘এটা তোমারই কাজ। তুমি আমার মেয়েকে এই পঙ্গু ছেলেটার সঙ্গে ভিড়িয়ে দিতে চাইছ। নিজেকে সেইফ সাইডে রাখার জন্য আমার মেয়েকে এই বিশ্রী ব্যাপারটাতে টেনে আনলে। কত বড় সাহস তোমার!’ তুরিন চেঁচিয়ে উঠল, ‘উফ মা! হোল্ড ইয়োর টাং! যেটা জানো না সেটা নিয়ে কথা বলতে এসো না।’
মেয়ের কথা শুনে ফারার চেহারা এমন ভাবে ভচকে গেল, দেখে মনে হলো যেন দশতলা উঁচু দালান থেকে এই মাত্র মুখ থুবড়ে পড়েছে। এটা কী হলো? তুরিন নিশার পক্ষ নিয়ে তাকে কথা শোনাচ্ছে? এমন দিনও ভাগ্যে ছিল! এটাও সম্ভব! ফারা এত বেশি হতভম্ব হয়ে গেল যে তার মুখ দিয়ে কোন শব্দ বেরোল না। শাহজিদ কথা বলল, ‘জাহিদ শুনুন…ঘটনা খুবই সিম্পল। আমি এখান থেকে চলে যাচ্ছি। মুর্তজা আংকেলকে কথাটা বলার সাহস পাচ্ছি না। আপনি একটু আমার হয়ে বলে দিয়েন। ব্যস এটুকুই।’
তুরিনের মাথার একটা তার আবারও টং করে ছিঁড়ে গেল। উচ্চ কণ্ঠে বলে উঠল, ‘ইউ নো হোয়াট? ইউ আর সাচ অ্যা কাওয়ার্ড! আমি আগেই জানতাম আমার বাবাকে তুমি ভয় পাও। এমনকি অর্ণবকেও ভয় পাও।’
দিনের আলো এখন আগের চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী। সূর্যরশ্মি সাদা বরফে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে চারিদিকে চোখধাঁধানো রোশনাই বিকিরণ করছে। গাছের ডালে আর বাড়ির দোচালা ছাদে জমে থাকা বরফ একটু একটু গলতে শুরু করেছে। টুপটাপ মাটিতে ঝরে পড়ছে বরফ গলা পানি। বাড়ির ছাদের চিমনি থেকে ভুরভুর করে বেরিয়ে আসছে দলাপাকানো ধোঁয়া। শাহজিদের ফরসা মুখে লাল রক্তের ছোপ পড়েছে। এতক্ষণে তুরিনের চোখে চোখ রাখল সে। ঠান্ডা স্বরে বলল, ‘আমি কাউকে ভয় পাই না।’
— ‘তাহলে চলে যাচ্ছ কেন?’
— ‘যেতে হচ্ছে!’
— ‘আজ এখান থেকে চলে গেলে আর কোনদিন আমার মুখ দেখতে পাবে না তুমি শাহজিদ!’
তুরিনের কণ্ঠস্বর কাঁপতে থাকে। একটা দীর্ঘশ্বাস হাহাকারের মতো বেরিয়ে আসে শাহজিদের বুক চিরে। পাহাড়ে একবার পৌঁছে যাওয়ার পর পৃথিবীর অন্য সব দুঃখ অবধারিতভাবে তার কাছে লঘু এবং অপাঙক্তেয় বলে মনে হবে। পাহাড় ছাড়া অন্য কেউই কখনো শাহজিদকে পরিপূর্ণভাবে পাবে না। পাহাড়ের দুর্দমনীয় আকর্ষণ তাকে কোন এক অলীক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখায়। তবুও তুরিনকে আর কোন দিন দেখতে পাবে না এই ভাবনা মনকে ব্যথিত করল, পীড়িত করল, দুর্মোচ্য এক গভীর হতাশায় আকণ্ঠভাবে নিমজ্জিত করল! স্তিমিত স্বরে বলল, ‘দেখতে না পেলে…কী আর করার আছে বলো?’
এ কথা শুনে বোকা, ছেলেমানুষ, পাগল তুরিনটা বাবা-মায়ের সামনেই হিতাহিতজ্ঞান শূন্য হয়ে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলে উঠল, ‘এর মানে তুমি কোনদিনই আমাকে ভালোবাসোনি!’
হঠাৎ মৃত মানুষ জ্যান্ত হয়ে উঠেছে— এরকম তথ্য পেলে মানুষের মুখে যেমন অবাধ আশ্চর্যের ঢেউ খেলা করে যায়, তুরিনের কথাটা শুনে ঠিক সেরকমই বাধভাঙা বিস্ময়ে প্লাবিত হলো জাহিদ। আশ্চর্য চোখে মেয়ের দিকে তাকাল সে। ফারা সেই সময় উড়ে আসল ঝড়ের মতো। চকিতে তুরিনের মুখটা শক্ত করে হাত দিয়ে চেপে ধরে প্রবল উত্তেজনায় ফেটে পড়ে বলল, ‘চুপ করো…স্টুপিড মেয়ে! চুপ করো তুমি! তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।’
জাহিদ ফারার হাতটা সরিয়ে দিল, ‘কী করছ তুমি? পাগল নাকি!’
মায়ের এই নির্মম, নিষ্ঠুর, উদ্ধত আচরণ তুরিনকে কাঁদিয়ে ছাড়ল। ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগল সে। মেয়ের প্রতি জাহিদের দুর্বলতা অন্য পর্যায়ের। মেয়ের কান্না দেখলে মাথা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এবার শাহজিদকে একটু কড়া ভাবে বলল, ‘এসব কী হচ্ছে? হোয়াট কাইন্ড অব রিলেশনশিপ ডু ইউ হ্যাভ উইদ মাই ডটার?’
ফোড়ন কাটল ফারা, ‘আরে আমার মেয়ের সঙ্গে ওর কী? ও তো প্ৰেম করছে নিশার সঙ্গে!’
কথাটা ফুটন্ত গরম পানির মতো ছিটকে পড়ল নিশার গায়ে। জাহিদও ভীষণ অপ্রতিভ হলো। আর শাহজিদের মুখটা ছিল দেখার মতো! নিশা আজকে চুপ করে রইল না। আজকের দিনটা আলাদা। ওইযে তুরিনের গায়ে যে লাল কোট, সেই কোটের পকেটে সযত্নে রাখা আছে ছোট্ট কাগজটা। যে কাগজে মানুষটা লিখেছে, সে নিশাকে ভালোবাসে। নিশা জানে না কথাটা কতটা সত্য। সত্য হোক বা মিথ্যা…এক লাইনের ছোট্ট স্বীকারোক্তিটা তাকে আজ দুর্নিবার সাহসের সন্ধান দিয়েছে। জীবনে এই প্রথমবারের মতো ফারার কথার প্রত্যুত্তর করল। মজবুত কণ্ঠে বলল, ‘একজন বিবাহিতা মেয়েকে নিয়ে আপনি এমন মন্তব্য করতে পারেন না!’
ফারার চোখ দুটো কপালে উঠে গেল একলাফে, ‘বিবাহিতা? কোন বিয়ের কথা বলছ তুমি? তোমার এই বিয়ের কোন স্ট্যাটাস আছে? তুমি এখানে আছ শুধু মাত্র একজন মিস্ট্রেস হিসেবে। বাংলায় যাকে বলে…কী জানি বলে? আশ্রিত? না না…হোয়াটেভার ইট ইজ তোমার এই ম্যারেজের সোশ্যাল বা লিগ্যাল কোন ভ্যালু নেই।’ ফারা মিস্ট্রেসের বাংলা অর্থটা স্মরণ করতে পারল না। কিন্তু নিশা বুঝে নিল এইমাত্র তাকে রক্ষিতা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। অপমানের তীব্র আঘাতে গুঁড়িয়ে গেল পাঁজরের হাড়। গলায় ধাক্কা দিল কান্নার একটা দমক। জাহিদ নিশার চোখের কোণে জলের ঝিকিমিকিটা প্রত্যক্ষ করল। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল নিমেষে। মুখের আনাচেকানাচে চিলিক কেটে গেল ক্রোধের বিদ্যুৎ। গা-শিউরানো কঠিন গলায় কেটে কেটে বলল, ‘ফারা! ডোন্ট গো বিয়ন্ড ইয়োর লিমিটস!’
— ‘কেন? আমি কি ভুল কিছু বলেছি?’ সাপের মতো ফণা তুলে প্রশ্ন করে ফারা।’
— ‘হ্যাঁ ভুল বলেছ। শি ইজ নট এনি মিস্ট্রেস, শি ইজ মাই ওয়াইফ। সৃষ্টিকর্তাকে সাক্ষী রেখে তাকে আমি স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছি। এবং সে আমার সন্তানের মা!’
ফারার চোখে-মুখে বীভৎস ভাঙচুর হলো, ‘কথাটা বলতে তোমার লজ্জা করল না?’
— ‘সত্য কথায় লজ্জার কিছু নেই।’
নিশা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল। ওর ডাগর ডাগর সুন্দর দুটি চোখ ডুবে গিয়েছিল অশ্রুর লোনা জলে। হঠাৎ করেই নিজেকে তার পরিপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে কোথাও কোন অভাব নেই…পায়ের তলায় শক্ত মাটি আছে…মাথার ওপর আছে নিরাপদ ছাদ…
‘সৃষ্টিকর্তাকে সাক্ষী রেখে আমি তাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছি।’ এভাবে এর আগে কোনদিন বলেনি লোকটা! সবচেয়ে বেশি ভালো লাগল ‘গ্রহণ করেছি!’ কথাটা শুনতে। নিশা এতকাল জানত… মানুষটা তাকে গ্রহণই করেনি কখনো। আজকে এই ছোট্ট দুটো শব্দ ওর কাছে দৈববাণীর মতো মনে হলো!
ফারাকে দেখে মনে হচ্ছিল এখুনি কেঁদে ফেলবে, ‘এরা সবাই আমাকে এভাবে অপমান করছে আর তুমি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছ?’ মেয়ের মুখের ওপর কথাটা ছুঁড়েদিয়েই ফারা গটগট করে এগিয়ে গেল ফ্রন্ট ইয়ার্ডের দিকে। তুরিনের বুকটা মায়ের কথা শুনে মুচড়ে উঠল কষ্টে। শাহজিদের দিকে একবার অসহায়ভাবে তাকিয়ে মায়ের পেছন পেছন ছুট দিল। শাহজিদ এতক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দেখছিল সব। এমন নাটক সে বাপের জন্মে দেখেনি কখনো! তুরিন আর ফারার প্রস্থানের পর হুইলচেয়ারের চাকাগুলো সামনে এগিয়ে দিল। জাহিদ বলল, ‘দাঁড়াও শাহজিদ…কথা আছে তোমার সঙ্গে।’
শাহজিদ একটা মোটাদাগের দীর্ঘশ্বাস আড়াল করে গম্ভীর ভাবে বলল, ‘জাহিদ, আমাকে একটু সময় দেবেন প্লিজ? আমি নিজেই আপনার সঙ্গে কথা বলব। তার আগে একটু সময় চাই।’
জাহিদ এই কথার প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না। তার ভেতরটা আশ্চর্য রকমের বোকা বনে গেছে। তুরিনের সঙ্গে যে শাহজিদের হৃদয়ঘটিত কোন টানাপোড়েন থাকতে পারে এ ব্যাপারটা কিছুতেই যেন বিশ্বাস করতে পারছে না তার বিস্ময়-বিহর্ষ মন। এতদিন নিশার নামের সঙ্গে শাহজিদকে জড়িয়ে কীসব আবোল তাবোল ভাবনা ভেবে এসেছে। লজ্জা হচ্ছে ভীষণ! এরপর নিশার চোখে চোখ মেলে তাকাবে কী করে?
১৯
তুষারের একটা আলাদা ঘ্রাণ আছে। গাছের শুকনো পাতা আর পাহাড়ের পাথুরে স্যাতস্যাতে গায়ের সঙ্গে মিলেমিশে তুষারগন্ধী হিমহিম বাতাসটা ক্রমেই কেমন বিষণ্ন, একা একা আর দুর্লভ হয়ে ধরা দেয় জাহিদের কাছে। এই সব তুষারভেজা ধবধবে সাদা কবুতরের মতো নিষ্কলুষ সুন্দর দিনে মনটা কেবলই এক নিপাট, নির্বিঘ্ন, আরামদায়ক অবকাশের জন্য ছটফট করে। কিন্তু অবকাশ তো কোথাও নেই। সংসারী মানুষের জন্য বোধহয় সংসারটাই দুনিয়ার সবচেয়ে বড় কারাগার। অন্য সব বাধা ছিন্নভিন্ন করা গেলেও সংসারটা আমৃত্যু কাঁটার মতো লেগে থাকে গলায়। অফিসের কাজ, ব্যবসার লাভ-লোকসান, পারিবারিক টানাপড়েন…এই সব পার্থিব জীবনমুখী আয়োজনের কোথাও নিজের জন্য একরত্তি আশ্রয় খুঁজে পায় না জাহিদ। ছুটির দিনগুলোতেও ক্লায়েন্টদের ফোন আসে। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, কার্ড অ্যাকটিভেশন, প্রফিট বা ইনভেস্টমেন্ট সম্পর্কিত নানা রকম প্রশ্ন থাকে। এদের মধ্যে কিছু ক্লায়েন্ট খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী। এদের ফোন অগ্রাহ্য করা যায় না। অফিসরুমে বসে ফোনে কথা বলতে বলতেই জাহিদ দেখছিল জানালার বাইরের সাদায় ধোয়া প্রকৃতি। হঠাৎ মনে হলো, মানুষ জীবনে প্রতিনিয়ত অসংখ্য ভ্রান্তিময় দৃশ্য অবলোকন করে থাকে। চোখের দেখা কোন ঘটনাকেই হুট করে বিশ্বাস করা উচিত নয়। চোখের চাইতে মনের বিশ্বাসযোগ্যতা অনেক বেশি। তাই জীবনের যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা চোখ দিয়ে নয়, বরং মন দিয়েই দেখা উচিত।
শাহজিদের সঙ্গে নিশার একটা অনৈতিক সম্পর্ক আছে…এই ভাবনাটা ভাবা যত সহজ, তার চাইতে অনেক বেশি কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে, কন্যার পাশে একজন বিকলাঙ্গ মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে মেনে নেয়া। অথচ এই বিকলাঙ্গ শাহজিদকে নিশার জন্য কখনোই অযোগ্য বলে মনে হয়নি। নিশা তার সন্তানের মা…সেই প্রেক্ষাপট থেকে দেখতে হলে শাহজিদ এতদিন ছিল তার প্রতিদ্বন্দ্বী। ছেলেটার প্রতি যে ঈর্ষা হয়নি এমন নয়। ঈর্ষার বশবর্তী হয়ে বেশ কবার বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবার পরিকল্পনাও এঁটেছিল মনে মনে। আবার নিজেকেই নিজে প্রবোধ দিয়েছে এই ভেবে যে, শাহজিদের মতো সুদর্শন, বিবেচক, বুদ্ধিমান যুবকই হয়তো নিশার স্বপ্নের পুরুষ। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হলো…রূপবান, গুণবান এই শাহজিদকেই নিজ কন্যার জন্য মোটেও যোগ্য পাত্র বলে মনে হচ্ছে না। বার বার একটা ভাবনা মাথায় আসতেই শিউরে উঠছে মন, ছেলেটার দেহের একটা সম্পূর্ণ অঙ্গ অনুপস্থিত। তুরিন ছোটমানুষ, নিজের দায়িত্ব নেবার সামর্থ্যটুকুই ওর নেই। আদৌ কোনদিন হবে কিনা তা নিয়েও সন্দেহ আছে। এই পঙ্গু ছেলের বোঝা এইটুকুন তুরিন সারা জীবনভর বইবে কী করে? এ কথা সত্য শাহজিদ আত্মনির্ভরশীল। মার্কিন সরকার ডিজেবলদের নানা রকম সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে। কিন্তু অর্থের নিরাপত্তাই তো সব নয়। সর্বক্ষণ হুইলচেয়ার বা ক্রাচ সঙ্গে নিয়ে চলা একজন মানুষ কখনোই আর দশটা মানুষের মতো স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে না। ছেলেটার যত্ন আত্তির জন্য নার্স আসে। ব্যায়াম করা, গোসল করা, কাপড় পরা এমন খুঁটিনাটি নানা কাজে অন্যের সহায়তা লাগে। যার সঙ্গে ওর বিয়ে হবে, অবশ্যম্ভাবীভাবেই এসব দায়িত্বের বোঝা অনেকাংশে বর্তাবে সেই মেয়ের ওপর। নিশার মধ্যে যে ম্যাচিওরিটি আছে, তুরিনের মধ্যে সেই ম্যাচিওরিটি কস্মিন কালেও কখনো আসবে বলে মনে হয় না। সবচেয়ে বড় কথা হলো জাহিদ এতদিন শাহজিদকে দেখে এসেছিল নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে। সেই ছেলেকেই কন্যার জামাতা হিসেবে কল্পনা করতে গিয়ে বারবার হোঁচট খেয়ে যাচ্ছে মন। হিসাবে গোলমাল লেগে যাচ্ছে। তবুও চেতনার অনেক গহিনে স্বস্তির একটা ঝিরিঝিরি বর্ষণ টের পাচ্ছে সে। নিশাকে নিয়ে ঘনিয়ে ওঠা সন্দেহটা যে নিতান্তই অমূলক ছিল এই সত্যের উন্মোচনটুকুই আজকের দিনটাকে জীবনের সবচেয়ে প্রশান্তিময় দিনগুলোর একটিতে রূপান্তর করেছে। মানুষের মগজ কতই না বিচিত্র এক যন্ত্র! কম্পিউটারের পর্দায় যেমন একই সঙ্গে একাধিক ট্যাব বা সফটওয়্যারের কাজ করা যায়, ঠিক তেমনিভাবেই ক্লায়েন্টের সঙ্গে ফোনে কথা বলতে বলতে জাহিদের বিক্ষিপ্ত মনটা মস্তিষ্কের একাধিক ট্যাবে অস্থিরভাবে বিচরণ করে যাচ্ছিল ক্রমাগত। তবে এই প্রক্রিয়া খুব বেশিক্ষণ কার্যকর হওয়ার নয়। খেই হারিয়ে যাচ্ছে। ফসকে যাচ্ছে তাল। আলোচনা সংক্ষিপ্ত করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফোনের লাইন কাটল জাহিদ। জানালার বাইরের সফেদ দুপুর রিমঝিম রিমঝিম সুর তুলে চেয়ে আছে ওর দিকে। এই তুষারঢাকা শুভ্রতা তাকে একটা নিশ্ছিদ্র ঝকঝকে অবকাশের প্রলোভন দেখায়। মন চায় সমস্ত কাজ, দুশ্চিন্তা আর টানাপোড়েন থেকে ছুটি নিয়ে শুধু নিজের…একদম নিজের মনের ভেতরের মনটাকে মনের মতো করে সময় দেয়। মাথার মগজের শিরা-উপশিরা থেকে টেনে টেনে ছিঁড়ে ফেলে দেয় দুশ্চিন্তার আগাছা। চনমনে, প্রফুল্ল একটা মন নিয়ে ওই সাদা ধবধবে পায়রার মতো ফুরফুরে দিনটার বুক চিরে চিরে চলে যায় দূরে কোথাও। কলোরাডো স্প্রিংস বা ব্রেক অ্যান্ড রিজের কোন হিল সাইড রিসোর্টে। তারপর এক মগ ধোঁয়া ওঠা ব্ল্যাক কফি…হাতে পছন্দের বই…জানালায় লটকে থাকা বরফের বকুলফুল… ফায়ারপ্লেসের কমলা আগুনের উষ্ণতা…ব্যস আর কী চাই?
আর…কী…চা…ই? বাক্যটা স্বগতোক্তির মতো কয়েকবার আওড়ে গেল জাহিদ সেই বিশেষ মানুষটিকে ছাড়া অবকাশ যাপন কি আদৌ সুখকর হবে? একা হলেই তো তাকে ভীষণভাবে মনে পড়ে! শুধু একা হলেই নয়। এক ঝাঁক মানুষের মাঝে…আকণ্ঠ কাজের মাঝে…দৈনন্দিন জীবনের নানা ব্যস্ততার মাঝে সেই মুখটা অসময়ে…অকারণে…অতর্কিতভাবে মস্তিষ্কে হানা দিয়ে যায়। গা শিরশিরে এক সূক্ষ্মতর ভালোলাগার ঝাপটায় বিবশ হয়ে আসে মন। পা পিছলে যাওয়া কয়েকটা এলোমেলো মুহূর্তের পরেই মনটাকে সামলে নিয়ে পুনরায় শক্ত মাটিতে দাঁড় করিয়ে দিতে বাধ্য হয় জাহিদ। যে মেয়েটির কোন ভূমিকাই থাকার কথা ছিল না তার জীবনে। যাকে প্রথম দেখার দিনই মনে মনে শপথ করেছিল, কোনদিন একে নিজের বলে গ্রহণ করবে না। আজকাল সেই বিনামূল্যের, বিনা-আকাঙ্ক্ষার, বিনা-চিন্তার অতি সাধারণ মেয়েটি, তার একান্ত আপন ভাবন ঘরে অহর্নিশ অবাধ উচ্ছৃঙ্খল বিচরণ করে…আর এই অনধিকার অনুপ্রবেশ জাহিদের খুঁতখুঁতে রুচিসম্পন্ন, বিবেচক মনটা কিছুতেই সর্বান্তঃকরণে গ্রহণ করতে পারে না। অন্তত এতদিন পারেনি!
শাহজিদ এ বাড়িতে এসেছিল নিশার আগমনের কয়েক মাস পরে। তখনো জুবিনের জন্ম হয়নি। অফিস থেকে সবেমাত্র বাড়ি ফিরছিল জাহিদ। সন্ধ্যার আবছায়া নেমে এসেছে নেইবারহুডের ঘরবাড়ি আর রাস্তাঘাটে। হঠাৎ চোখ পড়ল ওয়াক ওয়েতে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন যুবক-যুবতীর ওপর। রমজান মাসে বোল্ডারের মসজিদে শাহজিদকে কয়েকবার দেখেছিল জাহিদ। বাবা পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। বাংলাদেশি কমিউনিটির অনুষ্ঠানগুলো জাহিদ সজ্ঞানে এড়িয়ে চলে। ওরা সেকেন্ড জেনারেশন। জেনারেশনের বাংলাদেশি আমেরিকানদের বাঙালিয়ানা বলতে তেমন কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না। দেশি ভাই-ব্রাদারের সঙ্গে মসজিদেই একটু দেখা-সাক্ষাত হয়। কিন্তু শাহজিদের পা হারানোর ঘটনা সম্পর্কে সে অবগত ছিল না। হঠাৎ একটা শক্ত সমর্থ যুবক ছেলেকে হুইলচেয়ারের শরণাপন্ন হতে দেখে অবাক হলো। তার চাইতে বেশি অবাক হল নিশার মুখের ঝলমলে হাসি দেখে। কারণ এই দিনটির আগ পর্যন্ত নিশাকে সে একটা বারের জন্যও হাসতে দেখেনি। দৃশ্যটা কেন যেন মনে গেঁথে গিয়েছিল। বুঝতে পেরেছিল নিশাকে হাসাতে পারে এমন মানুষ এই বাড়িতে শুধু একজনই আছে। সেই মানুষের নাম শাহজিদ। অথচ আজকের ঘটনা সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী বিবৃতি দিয়েছে। তাহলে কি সেদিনের দৃশ্যটা ভুল ছিল? নাকি ভুল ছিল জাহিদের দেখার দৃষ্টিভঙ্গি? কিন্তু … হঠাৎ ভাবনাটা মাথায় বিষের মতো ছোবল দিয়ে ওঠে। তার মেয়েটা নিতান্তই অপরিপক্ব মস্তিষ্কের অধিকারিণী। ছেলেমানুষ রয়ে গেছে এখনো। শাহজিদের প্রতি তার দুর্বলতা আছে এ কথা জলের মতো পরিষ্কার, কিন্তু শাহজিদ? শাহজিদ কি তুরিনকে চায়? নাকি নিশাকে? বিষয়টা মনে হতেই একটা দমবন্ধ ভাব হলো জাহিদের ও বসা থেকে উঠে পড়ল। অফিসরুম থেকে বেরিয়ে দেখল মুর্তজা সাহেব ক্যাটারিং থেকে খাবার-দাবার নিয়ে এসেছেন। নীলিমা শ্বশুরকে সাহায্য করছে। ফোর্ট কলিন্সে মুর্তজা সাহেবের চাচাতো ভাই থাকেন। তিনি সপরিবারে উপস্থিত হয়েছেন এর মাঝেই। এই রাজ্যে বাঙালির সংখ্যা এখনো নগণ্য। সব মিলিয়ে এক শ পরিবার হবে হয়তো। অধিকাংশ বাঙালিরা অরোরাতে বাড়িঘর কিনে থিতু হয়েছে। কিছু বাঙালি ছাত্র-ছাত্রী সিইউ বোল্ডারের ক্যাম্পাস এলাকায় থাকে। তুরিন, আনিতার কিছু বাংলাদেশি ক্লাসমেট আছে। যারা স্কলারশিপ নিয়ে সদ্য দেশ ছেড়ে ইউএসএতে পাড়ি জমিয়েছে। অরোরা থেকে লায়ন্স প্রায় দেড় ঘন্টা ড্রাইভ। আজকের আবহাওয়া বৈরী। রাস্তা পিচ্ছিল। স্নো গ্লোয়িং সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। অল্প সময়ের মধ্যে সব রাস্তা পরিষ্কার করা সম্ভব হয় না। বরফ জমে থাকে। গাড়ির চাকা পিছলে যায়। একাধিক গাড়ি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। সড়ক দুর্ঘটনার ফলে কয়েকটা রুট অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। যানজট বাড়তে থাকে। অবশ্য কলোরাডোবাসীরা এই বৈরী আবহাওয়ার সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করতে বাধ্য হয়েছে। তাই আবহাওয়া যেমনই হোক না কেন। অতিথিরা আসবে।
মায়ের কান্নাটা তুরিনের সহ্য হচ্ছিল না। সে জানে তার মা একটু ঠোঁটকাটা এবং রাগী। তবুও মা তো মা-ই। মায়ের চোখের জল দেখতে কোন সন্তানের ভালো লাগে? তা ছাড়া তুরিনের মায়ের যে অনেক কষ্ট! ভালোবাসার মানুষকে অন্যের সঙ্গে ভাগ বাটোয়ারা করে নেয়ার মতো দুঃসহ যন্ত্রণা কি আর দ্বিতীয়টি আছে পৃথিবীতে? মাকে যে এই অসহ্য পীড়াদায়ক পরিস্থিতি দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করতে হচ্ছে অষ্টপ্রহর। তুরিন এখন বড় হয়েছে। মায়ের কষ্ট সে বোঝে।
ফারা বালিশে মুখ চেপে উপুড় হয়ে শুয়ে ছিল। ওর পিঠটা কান্নার দমকে ফুলে উঠছে। তুরিন মায়ের পিঠের ওপর হাত রেখে করুণ স্বরে বলছে, ‘কেঁদো না মা। বাবাকে আমি খুব করে বকে দেব। আর কোনদিন এসব কথা বলার সাহস পাবে না। দেখে নিও তুমি।’
ফারা উঠে বসল, ‘তুমি তো কিছুই বললে না তখন। হা করে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলে।’
তুরিন মায়ের চোখের জল মুছে দিল, ‘বাবা এত বোল্ড-ভাবে কথাগুলো বলছিল। আমি ইন্টারফেয়ার করতে পারিনি। ভয় পেয়েছি।’
ফারা তুরিনের কাঁধ চেপে ধরে একটা প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ‘তুমি ভয় পেলে হবে না। তুমি হচ্ছ তোমার বাবার প্রথম এবং একমাত্র দুর্বলতা। তোমার বাবা তোমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। জুবিনের চাইতেও বেশি ভালোবাসে। তুমিই পারবে তোমার মায়ের সংসারটা বাঁচাতে। বুঝলে?’
তুরিন ফ্যালফ্যাল করে মায়ের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না ঠিক কীভাবে কী করব। বাবা তো আমাকে কথা দিয়েছিল নিশাকে ডিভোর্স দেবে। তাহলে আজ আবার ওর সাপোর্টে কথা বলল কেন?’
— ‘তুমিও তো ওর সাপোর্টে কথা বলেছ। আমি ভুলে গিয়েছি মনে করেছ?’
তুরিন মুখ নামাল। এ কথা সত্য নিশা আজকে এক বিশাল বড় উপকার করেছে। শাহজিদ যদি কিছু না বলে চলে যেত তাহলে তুরিনের কী সর্বনাশটা হতো ভাবা যায়? এই আকাশস্পর্শী উপকারের জন্য নিশার কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে তুরিন। কিন্তু মাকে এই কথা বোঝাবে কী করে? মায়ের যে শাহজিদকে পছন্দ না এটা তুরিন খুব ভালো মতোই জানে। এখন মনে হচ্ছে কয়েকটা দিন মায়ের কথা মন দিয়ে শুনলে, সব আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করলে মায়ের মেজাজ-মর্জি হয়তো তার প্রতি প্রসন্ন থাকবে। সেই প্রসন্নতা বা কৃতজ্ঞতা থেকেই এক সময় শাহজিদের প্রতি গ্রহণযোগ্যতাও এসে যাবে। ফারা ঘন ঘন কয়েকবার নাক টানল। ন্যাপকিন দিয়ে মুখ মুছল। ধরা গলায় বলল, ‘শোন, তোমাকে আমি যা করতে বলব তাই করবে। তুমি তোমার বাবাকে ফিরিয়ে আনবে। এমন ভাবে ফিরিয়ে আনবে যেন নিশার কোন চিহ্ন আমাদের জীবনে না থাকে। প্রমিজ কর আমাকে।’
তুরিন মায়ের দিকে অসহায়ভাবে তাকাল। নিশার প্রতি একটা কৃতজ্ঞতাবোধ তার মনের মধ্যে টিকটিক করে নিজের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। কিন্তু এ কথা সত্য ওই নিশার জন্যই আজকে তার মায়ের জীবনের এই দুর্বিষহ অবস্থা হয়েছে। বাবাও দূরে সরে যাচ্ছে ওই নিশার জন্যই। ফারার একটা হাত ধরে তুরিন দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ‘তুমি চিন্তা করো না মা। আমি প্রমিজ করছি। নিশা আমাদের মধ্যে থাকবে না।
সেই সময় জাহিদ প্রবেশ করল ঘরে। মা-মেয়েকে একসঙ্গে দেখে হালকা একটু ভদ্রতার হাসি হাসল। ঠিক পরমুহূর্তেই দরজার চৌকাঠে একটি নারীমূর্তির ছায়া পড়ল। জাহিদ ঘুরে তাকিয়ে আবিষ্কার করল নিশাকে। নিশা তুরিনের দিকে চেয়ে মৃদু স্বরে বলল, ‘আমার কোটটা নিতে এসেছি।’
তুরিন উঠে এসে চেয়ারের পিঠে ঝুলিয়ে রাখা কোট তুলে দিল নিশার হাতে। নিশা জিনিসটা হাতে নিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে এলো। নিজের ঘরে এসে কোটের পকেটে হাত রাখতেই কেঁপে উঠল আত্মা! চিরকুটটা নেই! পাগলের মতো সব পকেট হাতড়াতে লাগল সে। কোথাও নেই সেই এক টুকরো কাগজ! নিশার মনে হলো কেউ তার কলিজাটা খুবলে নিয়েছে মাত্র। কী করবে এখন? কোথায় খুঁজবে ছোট্ট জিনিসটা? হায় খোদা! তার সঙ্গে কেন সব সময় এমন হয়? এতদিনের এত অপেক্ষার পরে তো লোকটা লিখেছিল একটা মাত্র দুর্লভ বাক্য! নিশার কাছে সেই একটি বাক্যের দাম নিজের জীবনের চাইতেও অনেক বেশি!
আজকে জুবিনের জন্মদিন উপলক্ষে বাড়িতে কত হই-হুল্লোড় হবে। নিশাকে কেউ ডাকবে না, ওর কথা কেউ ভাববেও না। দোতলার এই ছোট্ট ঘরে বন্দি হয়ে থাকবে সে। একথা ভাবতে একটু আগেও বিন্দুমাত্র খারাপ লাগছিল না। নিশা ভেবেছিল ওই ছোট্ট কাগজটা হাতে নিয়ে চুপচাপ বসে থেকে সব দুঃখ ভুলে যাবে। কিন্তু এখন কী হলো? কেন হলো? মানুষটা যদি কথা ঘুরিয়ে ফেলে? আর কোনদিন যদি মুখ ফুটে কিছু না বলে? দশ বছরের বালিকা প্রিয় পুতুল খানি হারিয়ে গেলে যেমন ঠোঁট ফুলিয়ে অপ্রতিরোধ্য কান্নায় ভেঙে পড়ে, ঠিক তেমনই এক অতি উচ্ছন্ন দুর্মর কান্নার আয়োজনভাৱে নিশার ঠোঁটজোড়া থরথর করে কাঁপতে লাগল। বিষাদগ্রস্ত, তমসাচ্ছন্ন মন নিয়েই জুবিনকে গোসল করাল, খাওয়াল, দুপুরে ঘুম পাড়িয়ে দিল। তার মেয়েটার আজ জন্মদিন। দু বছর হলো। কত আনন্দের দিন! অথচ এই আনন্দের এক রত্তি ভাগিদারও সে হতে পারছে না। গত বছরের জন্মদিনে জাহিদ কী একটা কাজে জাপান গিয়েছিল। ওর অনুপস্থিতিতেও মুর্তজা সাহেব ধুমধাম করে জন্মদিন পালন করেছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে ফারা নিশাকে জুবিনের ন্যানি হিসেবে উপস্থাপন করেছিল অতিথিদের সামনে। এরপর নিশা ঠিক করেছিল আর কখনো এই বাড়ির কোন পারিবারিক মিলনায়তনে সে যোগ দেবে না। ঈদ, পহেলা বৈশাখ, থ্যাংকস গিভিং….কোন সময়েই নিশা আর নিচে নামে না। ঘরবন্দি হয়ে থাকে।
.
বিকেলের পর থেকে অতিথিরা আসা শুরু করল। বাঙালিদের পাশাপাশি মুর্তজা সাহেবের মার্কিন বন্ধুরাও দাওয়াত পেয়েছে। সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ বাড়ির ড্রইংরুম আর লিভিংরুম অতিথি সমাগমে মুখর হয়ে উঠল। বাচ্চারা হই- হুল্লোড় করে মাথায় তুলতে লাগল সারা বাড়ি। গোলাপি আর বেগুনির মিশেলের প্রিন্সেস ড্রেসে ছোট্ট জুবিনটাকে ডল পুতুলের মতো সুন্দর দেখাচ্ছিল। মাথায় রুপালি রঙের টিয়ারা। পিঠে বেঁধে দেওয়া হয়েছে পরির ডানা। আদরের পুঁটলিটাকে নিয়ে সবার মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে গেল একদম। বিশাল বড় উপহারের বাক্স হাতে নিয়ে অনিমেষ উপস্থিত হলো যথাসময়ে। ওকে দেখামাত্র গাত্রদাহ হলো ফারার। এতবার নিষেধ করার পরেও এই বেহায়া লোকটাকে আসতেই হলো বার্থডে পার্টিতে। আজকাল জাহিদের মতো এই লোকটাও ফারার কোন অনুরোধ-উপরোধ গ্রাহ্য করছে না। ক্রমেই পরিস্থিতি হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। বেশ কিছুদিন হলো অনিমেষের প্রতি একটা বিরূপ মনোভাব মনের মধ্যে শিকড়ের মতো গজিয়ে উঠেছে সুশীল, সৌম্য জাহিদের পাশে গোঁয়ার একরোখা অনিমেষকে যেন কিছুতেই আর সহ্য করা যাচ্ছে না। ওই যে দ্যাখো কালো পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে জাহিদ দাঁড়িয়ে আছে লিভিংরুমের মাঝ বরাবর। বিশাল বড় ঝুলন্ত ঝাড়বাতিটার ঠিক নিচে। ওর চোখে পাতলা কাচের চশমা, মুখে মার্জিত হাসি…দেখলেই বোঝা যায় সম্ভ্রান্ত বংশের রক্ত বইছে শরীরে। ওর দিকে কেউ একবার তাকিয়েই সহজে চোখ ফিরিয়ে নিতে পারবে না। ফিরিয়ে নিলেও আরেকবার তাকাতে বাধ্য হবে। ফারার ভাবতে ভালো লাগে এই মানুষটা তার স্বামী। এর সঙ্গেই তার বিয়ে হয়েছিল, অনিমেষের সঙ্গে নয়। ভালোলাগার পাশাপাশি বুকের মধ্যে একটা আগুন টের পাচ্ছিল সে। এই আগুন আফসোসের, এই আগুন অনুশোচনার…কেন যে তার জীবনে অনিমেষ এসেছিল! ওই একটা মানুষের জন্য সবকিছু ছারখার হয়ে গেল। ধ্বংস হয়ে গেল। পুরনো প্রেম অনেকদিন বাদে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। শাশুড়ির কোল থেকে জুবিনকে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে জাহিদের পাশে এসে দাঁড়াল সে। মুখে ঝুলিয়ে রাখল চমৎকার একটা হাসি। বাদামি রঙের স্লিভলেস ব্লাউজের সঙ্গে সাদা সুতার কাজঅলা সিল্ক শাড়ি পরেছিল ফারা। খোলা চুলের একধারে গুঁজে দিয়েছিল স্নোড্রপ ফুল। উপস্থিত অতিথিরা সুন্দরী মায়ের কোলে পুতুলের মতো ফুটফুটে মেয়েকে দেখে মুগ্ধ হচ্ছিল, প্রশংসায় পঞ্চমুখ হচ্ছিল!
এদিকে হরেক লোকের হইচইপূর্ণ উচ্ছ্বসিত কোলাহলের মধ্যেও জাহিদ একা হয়ে যাচ্ছিল ক্ষণে ক্ষণে। চারিদিকের রঙিন দৃশ্যগুলো সাদাকালো টেলিভিশনের ঝিরঝির করা বিকল পর্দার মতো ধূসর হয়ে ধরা দিচ্ছিল তার চোখে। কিছুতেই আনন্দোৎসবে মন লাগাতে পারছিল না। তার মনটা বারবার ছুটে যাচ্ছিল দোতলার সর্ব দখিনের ছোট্ট ঘরটায়। যেখানে একটা মেয়ে বদ্ধ দরজার পেছনে একলা বসে আছে।
ফটোগ্রাফার একের পর এক ছবি তুলে যাচ্ছে। পরিবারের সকল সদস্য ফ্রেমবন্দি হচ্ছে। ফারার কোলে জুবিন, পাশে জাহিদ, জাহিদের গলা জড়িয়ে ধরে হাস্যোজ্জ্বল মুখে দাঁড়িয়ে আছে তুরিন। ফারা জুবিনকে কিছুতেই কোল ছাড়া করছে না। শাশুড়ি একাধিকবার হাত বাড়িয়েছেন নাতনিকে কোলে নেয়ার জন্য। ফারা দেয়নি। কেক কাটার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। নানা বয়সি বাচ্চারা কেকের টেবিল ঘিরে দাঁড়িয়েছে। জন্মদিনের অনুষ্ঠান ওদের জন্যই। কেক কাটা নিয়ে তাই ওদের উৎসাহটাই সবচেয়ে বেশি। জুবিনের এখনো অত কিছু বোঝার বয়স হয়নি। তবে এত এত লোক একসঙ্গে পেয়ে গিয়ে সে তব্দা খেয়ে গেছে। পুতুপুতু চোখ মেলে চারপাশটা দেখছে। কে জানে হয়তো ছোট্ট মানুষটা ভিড়ের মধ্যে মাকেই খুঁজছিল। মুখ ফুটে বলতে তো পারছে না। পূর্ণবয়স্ক মানুষেরাও অনেক সময় অবলা শিশুদের মতোই মনের কথা মুখে আনতে ব্যর্থ হয়। বয়সের পসার মানুষকে বাকস্বাধীনতা দেয় না বরং কেড়ে নিতে থাকে দিনকে দিন। জাহিদ টের পাচ্ছিল তার প্রতিটা নিঃশ্বাসে বিষাক্ত হূল ফুটছে। একটা বিপুল মাতঙ্গ যেন হৃৎপিণ্ডটাকে পায়ের তলায় ফেলে পিষ্ট করে যাচ্ছে ক্রমাগত। দম বন্ধ হয়ে আসছে। ভিড়ের মধ্যে থেকে পিছিয়ে এসেছিল কয়েক পা। সিঁড়ির কাছটায় আসতেই তুরিন হঠাৎ একটা হাত খামচে ধরল, ‘বাবা এসো। ছবি তুলব। এবার শুধু আমরা দুজন।’