তুষারকন্যা
সে অনেক কাল আগের কথা। তুষারাবৃত এক রাজ্যে বাস করত রাজা আর রানি। রানির কোলে জন্ম নিয়েছিল অপূর্ব সুন্দরী কন্যা। রাজা তুষারের মতো ধবল কন্যার নাম রাখলেন তুষারকন্যা। এই রূপকথা তো জানা আছে। কিন্তু আমাদের গল্প এমন এক তুষারকন্যাকে নিয়ে যার জন্ম কোন তুষারাবৃত দেশে হয়নি। সে জন্মেছিল নাতিশীতোষ্ণ নদীমাতৃক বাংলাদেশের এক মফস্সল শহরে। তার পিতা রাজা-মহারাজা নয়। স্থানীয় সরকারি বিদ্যালয়ের অঙ্কের শিক্ষক। এই সাধারণ শিক্ষকের ঘরে জন্ম নিল ধবধবে ফরসা পরির মতো এক দেবশিশু। মেয়ের মুখ দেখামাত্র পিতা নাম রাখলেন, ‘তুষারকন্যা!’
জন্মের ঠিক চব্বিশটি বসন্ত পার হওয়ার পর, মার্কিন মুলুকের এক সদ্য ফোটা ভোরের হিমবর্ষী আকাশের নিচে, প্রাণহীন জীর্ণ ঘাসের ওপর লেপ্টে থাকা হীরের টুকরোর মতো তুষারবিন্দুর দিকে নির্নিমেষ নেত্রে চেয়ে থেকে, স্কুল মাস্টারের সেই তুষারকন্যা আপনমনে কী ভাবছিল কে জানে! তার পরনের বসনখানি পিঙ্গল। একটি সুতির ওড়না জড়ানো মাথায়। একটু আগে সে ফজরের নামাজ আদায় করেছে। হাতে এখনো ভাঁজ করা জায়নামাজ। জানালার পাল্লা বন্ধ। সারা ঘর হিটারের উত্তাপে উষ্ণ হয়ে আছে। বাইরে শীত মোড়ানো ভোরবেলা। বাড়ির অগ্র-পশ্চাতের রুক্ষ মাটি শুভ্র তুষারে ঢেকে গেছে। জানালার ধারঘেঁষেই সারিবাঁধা কয়েকটা ক্র্যাব অ্যাপল ট্রি। সেই গাছে এখন পাতা নেই, ফল নেই, আছে তুষারের সাদা ফুল। শ্বেত রঙের নিষ্কলুষ প্রকৃতির ওপর ধীরে ধীরে ভোরের নরম আলোর প্রলেপ পড়ছে। চারপাশ অদ্ভুত নিস্তব্ধ। পাখির কোলাহল নেই। বাতাসের চলাচল নেই। পিতা আদর করে তুষারকন্যা নামকরণ করলেও সেই নাম পরবর্তীতে টিকল না। স্কুলে ভর্তির সময় নাম পাল্টে রাখা হলো নিষাদ হায়াত। ডাক নাম নিশা। বাবা ছাড়া অন্য কেউ তুষারকন্যা বলে ডাকেনি কখনো। পদশব্দ কানে এসে লাগল। একটা চাপা কণ্ঠ ভেসে এলো দরজার ওপাশ থেকে, ‘বৌমা! উঠেছ ঘুম থেকে?’ নিশা তড়িঘড়ি করে সরে এলো জানালা থেকে। জুবিন বেবিকটে ঘুমোচ্ছে অঘোরে। কম্বল দিয়ে মোড়ানো ওর ছোট্ট শরীরটা। বছর দেড়েক বয়স হলো মেয়ের। নিশা খুব সাবধানে ছোট্ট জুবিনকে পুঁটলির মতো কোলে তুলে নিয়ে ঘরের দরজা খুলল। শাশুড়ি নাসিমা বেগম জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন দোরগোড়ায়। পুত্রবধূকে দেখা মাত্র হাত বাড়িয়ে নাতনিকে কোলে তুলে নিলেন। নিশা ব্যস্ত গলায় বলল, ‘দুপুরে কজন মানুষ খাবে মা?’
নাসিমা বেগম নাতনিকে বুকে জড়িয়ে ধরে ধীরস্থিরভাবে বললেন, ‘আমি তো ঠিক জানি না। জাহিদ বলেনি কিছু?’
একটা বুকচাপা শ্বাস পড়ল নিশার। জাহিদ, কাগজে-কলমে যে কি না তার স্বামী। সেই লোকের সঙ্গে সাংসারিক আলাপ করা নিশার জন্য এভারেস্ট জয় করার চাইতেও কঠিন! নিজের ঘরের চৌকাঠ থেকে ঠিক দশ কদম দূরের বদ্ধ দরজাটার দিকে একবার অপাঙ্গে তাকাল সে। দরজার ওপাশের ছিমছাম কক্ষে প্রায়ান্ধকারে শায়িত আছে তার স্বামী, প্রথম স্ত্রীর বাহুবেষ্টনীর মধ্যে। আজ মঙ্গলবার। দুজনেরই অফিস আছে। ঠিক সাতটায় টেবিলে নাশতা চাই ওদের। আটটার মধ্যে অফিসের উদ্দেশ্যে যাত্রা। স্বামী-স্ত্রী দুজনে একই ব্যাংকে কাজ করে। সমবয়সি এই জুটির প্রেমের বিয়েটা হয়েছিল প্রায় বাইশ বছর আগে। জাহিদের প্রথম স্ত্রী ফারা শিক্ষিতা, আধুনিক এবং অতিশয় বুদ্ধিমতী। চল্লিশে এসেও তার যৌবন ক্ষয়ে যায়নি। ছিপছিপে দেহখানায় সাদা শার্ট, কালো স্কার্ট জড়িয়ে হাই-হিল জুতোয় টুকটুক শব্দ তুলে সে যখন বাড়ি থেকে বেরোয়, নিশা তখন বিহ্বল চোখে চেয়ে থাকে শুধু। এই অসম্ভব ব্যক্তিত্বময়ী, স্মার্ট, সুন্দরী মহিলাটির সঙ্গে কথা বলতেও ভয় হয় তার। কথা অবশ্য খুব একটা বলার প্রয়োজনও পড়ে না। শুধু শ্বশুর-শাশুড়ি ছাড়া এই বাড়িতে নিশার আপনজন বলতে কেউ নেই। আরেকজন আছে। পাতালঘরে সে মানুষের বাস। ল্যাংড়া খোঁড়া মানুষ। নিশারই মতো সেই যুবকটিও উনপাঁজুরে অভাগা বলেই তার সঙ্গে কথা বলতে পেরে অল্পবিস্তর স্বস্তির উদ্রেক হয় মনে।
কালারফুল কলোরাডো
ডেনভার এয়ারপোর্ট থেকে বেরোনো মাত্র চোখ ধাঁধানো সাদায় অর্ণবের মাথা প্রায় ঘুরে গেল। গায়ে কামড় বসাল হিম জমানো শীত। আজ পহেলা এপ্রিল। অন্য রাজ্যগুলোতে এর মাঝেই বসন্ত এসে গেছে। কিন্তু কলোরাডো এখনো শীতনিদ্রায় আচ্ছন্ন। এ যেন বাস্তব পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন এক জগৎ। আকাশ নেমে গেছে অনেক নিচে। বাড়ির ছাদে উঠলেই বুঝি বরফের মতো শীতল নিথর আকাশটাকে ছোঁয়া যাবে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ছ হাজার ফিট উঁচু সমতল ভূমিতে দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল অর্ণবের। হাওয়া এত ঠাণ্ডা যে শিরদাঁড়া কাঁপছে ঠকঠক করে। বিমানবন্দরের প্রস্থান দ্বারের সম্মুখবর্তী রাস্তায় বেশ কিছু গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। বন্ধুবান্ধব বা স্বজনদের বরণ করে নিতে এসেছে অনেকেই। অর্ণবকে কেউ নিতে আসেনি। আসার কথাও না। গাড়ি ভাড়া করেছে অনলাইনে। রেন্ট-এ কারের অফিস থেকে সেই গাড়ি পিক করার কথা সকাল সাতটায়। সকালেও বেজায় ভিড়। কলোরাডো মার্কিন মুলুকের অন্যতম টুরিস্ট অ্যাট্রাকশন গুলোর একটি। একে বলা হয় যুক্তরাষ্ট্রের সুইজারল্যান্ড। সারা বছর তাই পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে। শীতকালে ভিড়টা আরো বেশি করে জমে ওঠে। দেশ-বিদেশের নানা লোক ছুটে আসে হরেকরকম উইন্টার অ্যাডভেঞ্চারে মেতে উঠতে। রাস্তা পার হয়ে ছাউনি দেয়া বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়িয়েছে অর্ণব। তার গায়ে একটা ছাই রঙের জ্যাকেট। মাথায় হুডি। পাঁচ মিনিটের মধ্যে শাটল আসার কথা। শাটলে করে যেতে হবে রেন্ট-এ কারের অফিসে। বিমানবন্দর এলাকার মধ্যেই বেশ কয়েকটা রেন্ট-এ কারের অফিস আছে। আছে পার্কিং লট। কিন্তু সেসব অফিস এবং পার্কিং লট এত দূরে যে পায়ে হেঁটে যাওয়া প্রচুর সময়ের ব্যাপার। তাই যাত্রীদের জন্য শাটলের ব্যবস্থা আছে। এখন স্নোফল হচ্ছে না। একটু একটু রোদ চড়েছে আকাশে। অর্ণব শুনেছে কলোরাডোতে বছরের তিনশ দিনই রোদ ওঠে লোকে বলে এটি যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে রৌদ্রকরোজ্জ্বল রাজ্য। এবারই প্রথম আসা। আসার পেছনের কারণটি বড় অদ্ভুত। শুধু অদ্ভুত না, অস্বস্তিকরও বটে। ভাবতে গেলেই মনটা শরমে একেবারে একটুখানি হয়ে যাচ্ছে। আমেরিকা এসেছিল দু বছর আগে এফ ওয়ান ভিসা নিয়ে। মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করার সুযোগ হয়েছিল। পরিবারের আর্থিক অবস্থা শোচনীয়। ভালো ছাত্র হওয়ায় জুটে গিয়েছিল ফুলফান্ড স্কলারশিপ। মাস্টার্স ভালোয় ভালোয় শেষ হয়েছে। সপ্তাহখানেক আগে তার ওপিটির দরখাস্ত মঞ্জুর হয়েছে। হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজছে। এর মধ্যেই হঠাৎ ভাগ্যতারকা মুখ তুলে চাইল। আকাশ থেকে ঝুপ করে নেমে এলো অবিশ্বাস্য এক প্রস্তাব। প্রস্তাবটা এলো পিতার নিকটতম বন্ধুর মারফতে। বন্ধুর দুঃসম্পর্কের এক মামাতো ভাইয়ের পরিবার প্রায় চল্লিশ বছর ধরে কলোরাডোর বাসিন্দা। একমাত্র কন্যা বিবাহযোগ্যা হয়ে উঠেছে। পরিবারটির আর্থিক টানাপোড়েন নেই। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে একাধিক স্থায়ী সম্পত্তি আছে। পাত্রীর বাবা একজন সচ্চরিত্র, শিক্ষিত, বাংলাদেশি মুসলিম পাত্রের সন্ধান করছেন। ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড জুতসই না হলেও আপত্তি নেই। অর্ণবের পরিবার ধনী নয়। বরং দরিদ্রই বলা চলে। বাবা বেকার। এক কালে ব্যবসা করত। এখন ব্যবসা-বাণিজ্য খুইয়ে এর-ওর কাছ থেকে টাকা ধার করে চলে। একমাত্র ছোটভাই ক্লাস টেনে পড়ে। মা মারা গেছে খুব ছোটবেলায়। পিতা সুযোগ পেলেই যার-তার সঙ্গে পুত্রের সাফল্যের গল্প শোনান। সেই সাফল্যগাথা শুনে পিতার বন্ধু খুশি হয়ে প্রস্তাবটা নিয়ে এলো। অর্ণব সুশিক্ষিত এবং বাংলাদেশি মুসলিম, চেহারাটাও চলনসই। সব কিছু একবারে খাপে খাপ। এই একটা বিয়ে তার পরিবারের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিতে পারে রাতারাতি। নিজের যোগ্যতায় ইউএস সিটিজেন হতে হলে বহুদিন ধৈর্য ধরতে হবে। টাকা-পয়াসার ব্যাপারও আছে। এক বছরের মধ্যে চাকরি না পেলে আমেরিকান সরকার ধাক্কা মেরে বের করে দেবে দেশ থেকে। এমতাবস্থায় আমেরিকান সিটিজেন পাত্রীর বিয়ের প্রস্তাবটা যেন তার জীবনে আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। বিয়েটা একবার হয়ে গেলেই কেল্লা ফতে। খুব দ্রুত বাবা আর ছোটভাইকেও নিয়ে আসবে নিজের কাছে। লজ্জা যে হচ্ছে না তা নয়। একদম কুঁকড়ে গেছে ভেতরটা। কখনো ভাবেনি শুধু সুনিশ্চিত ভবিষ্যৎ গড়ার উদ্দেশ্যে অজানা-অচেনা একটা মেয়ের গলায় বিয়ের মালা পরাতে হবে। কিন্তু জীবন তো ফুলশয্যা নয়। বেঁচে থাকার তাগিদে মানুষকে অনেক অপ্রিয় কাজ করতে হয়। অর্ণব জীবনে কখনো ভালোবাসার স্বপ্ন দেখেনি। শুধু একটু ভালো থাকার স্বপ্ন দেখেছে। ভালো থাকতে কে না চায়? এই চাওয়ায় কোন দোষ নেই!
তুষারকন্যা যখন সৎ মা
বাবা বলেছিল তার তুষারকন্যা রাজকন্যা হয়ে জন্মায়নি বটে, কিন্তু একদিন সে ঠিক ঠিক রাজকন্যা হয়ে উঠবে। স্বপ্নের রাজারকুমার সাত সমুদ্দুর তের নদী পেরিয়ে এসে তাকে নিয়ে যাবে দূরের কোন এক স্বর্গরাজ্যে। নিশা স্বর্গের মতো সুন্দর রাজ্যে এসেছে এ কথা সত্য। কিন্তু রাজকন্যা হয়ে নয়। বরং রাজকন্যার সত্মা হয়ে। আজ তার স্বামীর প্রথম স্ত্রীর প্রথম কন্যাকে দেখতে আসবে পাত্রপক্ষ। কন্যার বয়স একুশ। নিশা পাত্রপক্ষের আগমনের খবরটা পেয়েছে। কিন্তু কজন আসবে, কী ধরনের খাবার খাবে-এসব কিছুই তাকে বলা হয়নি। সে তড়িঘড়ি করে নাশতা তৈরি করছিল। ডিম ভাজি, হাতে বানানো রুটি আর কফি। এই বাড়িতে মেয়ের আধিক্য আছে। ভাশুরের ঘরেও দুটি মেয়ে। মূলত পুত্রের অভাব পূরণের উদ্দেশ্যেই এ সংসারে তার আগমন হয়েছিল। কিন্তু বিধাতার লিখন খণ্ডাবে কে? নিশার কোলজুড়ে জন্ম নিল এ পরিবারের চতুর্থ কন্যা, জুবিন।
মেয়েদের স্কুল-কলেজে যাওয়ার সময় হয়েছে। সবাই ডাইনিংয়ে উপস্থিত। নিশা দ্রুত খাবার-দাবার এগিয়ে দিচ্ছে টেবিলে। মেয়েরা রুটি-ডিম খায় না। সিরিয়াল আর ওটমিল খায়। জাহিদ এবং তার প্রথম স্ত্রী ফারা উপস্থিত হলো মিনিট পাঁচেকের মধ্যে। নিশা সাধারণত টেবিল সাজিয়েই নিরাপদ দূরত্বে সরে যায়। এরা কেউ তাকে পরিবারের সদস্য হিসেবে গণ্য করে না। সৎমেয়ে তুরিন চোখে চোখে তাকায় না। সামনে পড়লে এমনভাবে নাক কুঁচকে ফেলে যেন নিশা ডাস্টবিন থেকে উঠে এসেছে।
আজ জাহিদকে সরাসরিই প্রশ্ন করল নিশা, ‘দুপুরে কজন অতিথি আসছে?’
উত্তরটা এলো ফারার কাছ থেকে, ‘একজন আসবে। বাঙালি ছেলে। ভাত-মাছ খাবে। বারোটার আগেই রান্না কমপ্লিট করে ফেলবে।’ ফারা এমনভাবে কথাটা বলল যেন নিশা এ বাড়ির বাঁধা চাকর। বাড়ির সদস্যদের আদেশ পালন করাই যার একমাত্র কাজ। পাত্রপক্ষ সাধারণত দলবল নিয়ে আসে। একজন মাত্র লোক কখনো বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে আসতে পারে এটা ছিল ভাবনার অতীত। কপালে হালকা কুঞ্চন নিয়ে নিশা একটি ট্রেতে নাশতা গুছিয়ে নিতে লাগল। পাতালঘরের ছেলেটা ঘুম থেকে ওঠে খুব ভোরে। সকালের নাশতার পর বেচারার ওষুধ খেতে হয়। নিশা রোজ আটটার মধ্যে ওর ঘরে নাশতা নিয়ে যায়। আজকেও ব্যতিক্রম হলো না। খাবারের ট্রে হাতে নিয়ে বেজমেন্টের দরজার দিকে এগোচ্ছিল। হঠাৎ শুনতে পেল সৎমেয়ে তুরিন চড়া গলায় বলছে, ‘ওই ল্যাংড়া ছেলেটাকে প্রতি বেলা খাবার খাওয়ানোর দায়িত্ব কি আমাদের? সে আমাদের কে হয়? আর উনারই বা এত কীসের গরজ? যখন তখন বেজমেন্টে রওয়ানা দেয়!’ নিশার মনটা খারাপ হয়ে গেল। নিজের জন্য তার মন খারাপ হয় না একটুও। কিন্তু পছন্দের মানুষগুলোকে নিয়ে কটু মন্তব্য শুনলেই বুকে কাঁটার মতো কী যেন এসে বিঁধে।
শাহজিদ নিশার জন্যই অপেক্ষা করছিল। সিঁড়ির কাছ ঘেঁষে একটা হুইলচেয়ার। সেই হুইলচেয়ারে শিরদাঁড়া সোজা করে বসে আছে শাহজিদ।
—’গুডমর্নিং সানশাইন!’ এক গাল হাসি হেসে উজ্জ্বল গৌরবর্ণের যুবকটি নিশাকে অভিবাদন করল। এই একজন মাত্র মানুষ, যে কি না নিশাকে সত্যিকারের মানুষ মনে করে। যদিও নিশা জানে যে শাহজিদের উপযুক্ত সঙ্গীহওয়ার কোন যোগ্যতা তার নেই। এই বেদান্তবাগীশ পণ্ডিত যুবক হুইলচেয়ারে বসে একটা ল্যাপটপে মুখ গুঁজে অনলাইনে দিনরাত এত কাজ করে যে নিশা দুটি সবল পা নিয়ে ঘুরে বেরিয়েও সেসব কাজের সিকিভাগ সম্পন্ন করার কথা চিন্তা অবধি করতে পারে না।
খাবারের ট্রে পড়ার টেবিলের ওপর রাখল নিশা। চারপাশ বড্ড অগোছালো। ঘরটা আয়তনে খুব একটা ছোট নয়। সিঙ্গেল খাট, বিশাল আকারের ফ্রিজ, পড়ার টেবিল আর একটা ক্যাবিনেট অনায়াসে এঁটে গেছে। বামপাশের দেয়ালে সাদা পর্দায় ঢাকা একটি স্লাইডিং ডোর। দরজার ওপাশে ব্যাকইয়ার্ড। নিশার শ্বশুর মুর্তজা সাহেব আজ থেকে দু বছর আগে এই পঙ্গু ছেলেটিকে বেজমেন্টের ঘরটা বলতে গেলে দান করে দিয়েছিলেন। বাড়িতে কোন লিফট নেই। হুইলচেয়ার নিয়ে সিঁড়ি ভাঙা অসম্ভব ব্যাপার। তাই নিচতলার এই কামরা শাহজিদের জন্য সবদিক দিয়েই জুতসই। শাহজিদ এই পরিবারের কে হয়, প্রশ্নটার উত্তর খুব কমপ্লিকেটেড। সবাই এর উত্তর জানে, আবার কেউই যেন জানে না। এমনকি শাহজিদ নিজেও এসব নিয়ে কথা বলতে ভালোবাসে না। নিশা জানতে চেয়েছিল প্রথম সাক্ষাতে। শাহজিদ ওর হ্যাজেল কালার চোখের মণিতে অদ্ভুত এক তরঙ্গ তুলে খুব ছোট্ট করে বলেছিল, ‘ফ্যামিলি!’ নিশার মনে হয়েছে সেই প্রথম এবং শেষবারের মতো শাহজিদ তার সঙ্গে মিথ্যে বলেছিল। এতে অবশ্য কিছু মনে করেনি সে। হয়তো মিথ্যেটা বলা প্রয়োজন ছিল। জীবনে কিছু কিছু মিথ্যের গুরুত্ব ঠিক সত্যেরই মতো, সেই মিথ্যেগুলো না থাকলে সত্যর প্রকাশ সুন্দর হয় না।
হুইলচেয়ারের হাতলসংলগ্ন একটা বাটন প্রেস করতেই চেয়ারটা টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। হাতে বাটার নাইফ তুলে নিতে নিতে গলায় নরম সুর টেনে নিয়ে শাহজিদ বলল, ‘তুমি না থাকলে আমার কী হতো নিশা?
নিশা পিঠময় ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো মুড়িয়ে খোঁপা বাঁধছিল। কথাটা শুনে মুচকি হাসল। এই পরিবারের কেউ কোনদিন মুখ ফুটে তার প্রশংসা করেনি। শাহজিদ যে রূপ-গুণের প্রশংসা করে একেবারে আকাশে তুলে ফেলে তা নয়, তবে সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে জানে। এই ন্যূনতম কৃতজ্ঞতা বোধটুকু বাড়ির অন্য কোন সদস্যের নেই। এলোমেলো বিছানাটা ঠিক করতে করতে একটু আদিখ্যেতার গলায় নিশা বলল, ‘আমি না থাকলে কে তোমাকে ব্রেকফাস্ট করাত? কে তোমার খবর রাখত? এক আমি ছাড়া তোমার আর আছে কে?’
শাহজিদ মাখনমাখা ব্রেডটোস্টে কামড় দেয়। মুখে মচমচ শব্দ তুলে বলে, ‘সত্যি! তুমি আমার সেভিয়র। তোমার করুণায়ই বেঁচে আছি।’
—‘বাজে কথা বলো না। তোমাকে আমি করুণা করতে যাব কোন দুঃখে? তুমি তো করুণার পাত্ৰ নও।’
—‘নই?’
—‘না নও।’
—‘পঙ্গু, বিকলাঙ্গ ব্যক্তিকে সবাই করুণা করে নিশা! তুমি যে আমার খেয়াল রাখো। এই খেয়ালটুকু করুণা থেকেই আসে।’
—‘চুপ কর। তুমি পঙ্গু না হলেও আমি তোমার টেককেয়ার করতাম।’ বলল নিশা একটু কমজোর গলায়। কারণ কথাটা সত্য নয়। শাহজিদ বিকলাঙ্গ বলেই নিশার ওর জন্য দরদ হয়। তা ছাড়া ওর প্রতিও বাড়ির লোকদের দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটা নিশারই মতো। দুজনেই এখানে অপাঙ্ক্তেয়, অবহেলিত। নিশা যদি কন্যার স্থলে একজন পুত্র সন্তানের জন্ম দিতে পারত, তবে হয়তো বাড়ির মানুষগুলোর কাছে সে বড় দুই জায়ের চাইতেও বেশি মূল্যবান হয়ে উঠত। যদিও এসব সাংসারিক মেকি মূল্যের কোন ব্যক্তিগত মূল্য নেই তার কাছে। স্বার্থের বিনিময়ে সুখ বা সম্মানের লেনদেনটা বাইরের লোকের সঙ্গে মানায়। পরিবারের লোকের সঙ্গে নয়। নিশা জানে শুধু নিজের নাড়িছেঁড়া কন্যাটি ছাড়া এ পৃথিবীতে তার আপন বলতে কেউ নেই। আশপাশের মানুষেরা কেউ তাকে জানে না, বুঝে না, এমনকি চেনেও না। ওদের আর দোষ কী? মাঝেমধ্যে তো নিশা নিজেকেই নিজে চেনে না। তার ভেতরকার আমিটা, প্রিয় বাবার তুষারকন্যাটা হারিয়ে গেছে আজ থেকে চার বছর আগে। যেদিন একটা কাগজে সাইন করে, সম্পূর্ণ অপরিচিত এক ভদ্রলোকের নামমাত্র স্ত্রী হয়ে তাকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল। নিশা ক্রমেই অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল। শাহজিদের কথায় ঘোর ভাঙল,
—‘আমি সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ হলে তুমি আমার ঘরে আসার সাহসই করতে না। তোমার বর তোমাকে আমার কাছে আসতেই দিত না!’
নিশা বেড কাভার টানটান করে বিছিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘খুব দিত! আমার কাজে-কর্মে তার কিছুই এসে যায় না। তা ছাড়া আমিও ওর সেন্টিমেন্টকে কেয়ার করি না। আমার শ্বশুর-শাশুড়িও কিছু মনে করতেন না কারণ আমার ওপর তাঁদের ভরসা আছে।
—’তাই?’
—‘ঠিক তাই!’
শাহজিদ হাসল। হাসলে ওর অনেক দিনের না কামানো দাড়ি-গোঁফের জঙ্গলের আড়ালে থাকা ফরসা মুখখানায় আত্মবিশ্বাসের একটা প্রবল আলোড়ন খেলে যায়। এই আত্মবিশ্বাসটুকু অন্যান্য সাধারণ মানুষ থেকে ওকে আলাদা করে দেয়।
—‘তোমার নার্স আসার কথা না আজ? এখনো এলো না কেন?’ নিশার প্রশ্ন।
শাহজিদ ঠোঁট উল্টে বলল, ‘হু নোজ! পালিয়েছে মনে হয়!’
—‘হায় আল্লাহ। পালাবে কেন? অদ্ভুত কথাবার্তা!’
—‘পালালে দোষ কী? আমারও মাঝেমধ্যে খুব পালাতে ইচ্ছে করে জানো?’ একটু বিরতি নিয়ে কফির মগে চুমুক দিল শাহজিদ। ভ্রু জোড়ায় গম্ভীর ভাব ফুটিয়ে বলল, ‘ইনফ্যাক্ট আমার মনে হয় তোমারও পালিয়ে যাওয়া উচিত এই নরক থেকে।’
নিশা কয়েক পা হেঁটে এগিয়ে স্লাইডিং ডোরের পর্দা সরাতে সরাতে বলল, ‘জুবিন না থাকলে সত্যি কবেই পালিয়ে যেতাম! মেয়েটার জন্যই পারছি না।’
পর্দা সরাতেই সকালের মিঠা রোদ এসে ঝিলিক দিল নিশার অপাপবিদ্ধ সুন্দর মুখখানায়। ওর পরনে একটা হালকা হলুদ রঙের সালোয়ার-কামিজ 1 মাথার ওড়না ঘাড়ে নেমেছে। শাহজিদ একটু ফিচেল গলায় বলল, ‘লেটস মেক অ্যা প্ল্যান। তুমি আর আমি পালিয়ে যাই চলো।’
কথাটা নতুন কিছু নয়। আগেও বলেছে শাহজিদ। নিশা তাই এক বিন্দুও বিচলিত না হয়ে পাশ কাটানো গলায় বলল, ‘বাইরে সুন্দর রোদ উঠেছে। এক রাউন্ড হেঁটে আসি চলো।’
—‘ঠাণ্ডা তো খুব!’
নিশা প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না। ক্লজেট থেকে একটা লেদারের মোটা জ্যাকেট বের করে শাহজিদকে পরিয়ে দিল যত্ন করে। শাহজিদের ঘাড় পর্যন্ত গড়ানো ঈষৎ লালচে সিল্কি চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ছিল। কালো রঙের জ্যাকেট কোমরে এসে থেমেছে। জ্যাকেটের নিচে ট্রাউজার। ডান দিকের হাঁটুর পরেই শূন্যতা। পায়ের স্থান ফাঁকা এবং ঢলঢলে। বাঁ পা অক্ষত বটে কিন্তু দুটি আঙুল অনুপস্থিত। নিশা ওর আঙুলবিহীন পায়ের দিকে চেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, ‘একটু অপেক্ষা কর। আমি জ্যাকেট নিয়ে আসছি।’
শাহজিদ বিকলাঙ্গ বটে, কিন্তু বেকার নয়। পৃথিবীতে এরকম অনেক কাজ আছে যেগুলো করতে পায়ের প্রয়োজন হয় না, শুধু মগজ থাকলেই চলে। বছরখানেক হলো একটি সফটওয়্যার কোম্পানিতে চাকরি করছে। অফিসে যেতে হয় কদাচিৎ। বাড়ি থেকেই অনলাইনে কাজ করে। রোজ অফিস শুরুর আগে নিশা একবার ওকে নিয়ে হাঁটতে বেরোয়। হাঁটতে যাওয়ার জন্য কারো সাহায্য শাহজিদের প্রয়োজন হয় না। বাড়ির আশপাশের সমতল চত্বরে হুইলচেয়ার নিয়ে সে অনায়াসে ঘুরে বেড়াতে পারে। তবুও কেউ একজন সঙ্গে থাকলে ভালো লাগে। একটা সময় অগণিত মানুষের প্রিয় পাত্র ছিল। আসর জমানোর জন্য বাঙালি, ভারতীয়, আমেরিকান যেকোনো কমিউনিটির মিলনমেলায় ডাক পড়ত হরহামেশা। শীত কি গ্রীষ্ম, বছরের যেকোনো সময়ে বন্ধু-বান্ধব নিয়ে রকি মাউন্টেনের উঁচু-নিচু শৃঙ্গে আরোহণ করা ছিল তার অত্যন্ত প্রিয় শখগুলোর একটি। একটা মাত্র দুর্ঘটনা জীবন বদলে দিয়েছে। যে মানুষগুলো সুস্থ স্বাভাবিক টগবগে শাহজিদকে একসময় মুগ্ধ চোখে দেখত, অনুকরণ করত, মনে মনে ঈর্ষা করত, সেই মানুষগুলোর চোখে তার জন্য এখন শুধুই অনুকম্পার উপস্থিতি।
নিশা কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এলো। গোলাপি রঙের একটা মোটা উলের জ্যাকেট এখন তার পরনে। গলায় মাফলার। বাইরে ঝকঝকে দিন। আকাশে নিখাদ নীলের ছড়াছড়ি। রোদ উপচে পড়ছে রাস্তার ধারের জমে থাকা সাদা বরফপুঞ্জে। নীল আর সাদা রঙের অদ্ভুত সুন্দর কারুকাজে মুখর হয়ে আছে পৃথিবী। বাতাস থমকে আছে। বরফ জমা গাছের ডাল একরত্তি নড়ছে না। তবুও প্রাণের অনাবিল সঞ্চারণ চারধারে। এমন আলো ঝলমলে বিশুদ্ধ সুন্দর দিনে মন খারাপের কোন অবকাশ নেই। গত বিকেলে নিশা শোভেল দিয়ে বাড়ির অগ্র-পশ্চাতের বরফ অপসারণ করার চেষ্টা করেছে। লাভ হয়নি খুব একটা। শাহজিদের হুইলচেয়ার এগিয়ে যাচ্ছিল। নিশা ওর পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলল ‘আজকে খুব বেশিক্ষণ হাঁটব না, কেমন? দুপুরে গেস্ট আসবে।’
শাহজিদ ঘাড় বাঁকিয়ে নিশাকে একবার দেখার চেষ্টা করল, ‘কে আসবে?’ নিশার শীত করছিল। বেরোবার আগে পায়ে মোজা পরতে ভুলে গেছে। পায়ের গোড়ালিতে একটুখানি খালি জায়গা পেয়েই নচ্ছার শীতটা বিষদাঁত বসিয়ে দিচ্ছে একদম।
—‘তুরিনকে দেখতে আসবে পাত্রপক্ষ।’
বিস্ময়টা লুকোতে পারল না শাহজিদ, ‘বলছো কী?’
—’হুম ঠিকই বলছি।’
—‘সিরিয়াসলি? ওই উইয়ার্ড মেইড ইন চায়নাকে কে বিয়ে করবে?’ নিশা হাসল, ‘যে কেউ!
—‘সেই বেচারার দুর্ভাগ্যের কথা চিন্তা করে আফসোস হচ্ছে।’
কথা বলতে বলতে ওরা বাড়ির সামনের রাস্তায় উঠে এসেছিল। ব্যাকইয়ার্ডের সঙ্গে লাগোয়া একটা পার্ক আছে। কিন্তু বরফ জমে থাকায় সেই পার্কে এখন হুইলচেয়ার নিয়ে যাওয়া কষ্টকর। অগত্যা নেইবারহুডের রাস্তা দিয়েই হাঁটতে হবে। তুরিনের গাড়িটা স্ট্রিট পার্কিং করা। গাড়ির ছাদ থেকে সে বরফ পরিষ্কার করছে। পাশে আনিতা দাঁড়িয়ে আছে। ব্লু কালারের পলিস্টারের জ্যাকেট পরেছে ও। মাথায় হুডি। কাঁধে ল্যাপটপের ব্যাগ। দুবোনই কলোরাডো বোল্ডার ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করছে। বাড়ির কাছেই ওদের ক্যাম্পাস।
দৃশ্যটা প্রথমে শাহজিদের নজরেই পড়ল। বাঁকা একটা কাষ্ঠ হাসি হেসে বলল, ‘ওয়েল…স্পিক অব দ্য উইচ (witch) অ্যান্ড শি শ্যাল অ্যাপিয়ার!’
তুরিন ওদের লক্ষ করেছে। তার পরনে একটা হালকা বেগুনি রঙের লং কোট। কালো রেশমি চুলগুলো ছড়িয়ে আছে ঘাড়ে। তুরিনের নানাবাড়ি পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান। বংশগতভাবেই ওদের চেহারায় আদিবাসী ছাপ আছে। চোখদুটো ছোট, সরু আর কিঞ্চিৎ বাঁকানো। মুখের ছাঁচ লম্বাটে। কাঁচা হলুদের মসৃণ ত্বক। ছিপছিপে শরীরের গড়নটা ভারি নজরকাড়া। আনিতা তুরিনকে একটা খোঁচা দিল, ‘দ্যাখো দ্যাখো!’
তুরিন স্নো শাভল দিয়ে উইন্ডশিল্ডের বরফ ক্লিন করছিল। বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘দেখার কী আছে?’
—‘দ্যাখো তোমার স্টেপমাদার তার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ঘুরতে বেরিয়েছে।’ এবার আনিতার কণ্ঠে আলগা রসের সঞ্চার হলো।
তুরিন এই কথার পিঠে কিছু না বলে কড়া চোখে একবার তাকাল হুইলচেয়ারে বসা শাহজিদের দিকে। শাহজিদ ওকেই দেখছিল। চোখে চোখ পড়তেই তুরিনের মুখটা থমথমে গম্ভীর হয়ে উঠল। দৃষ্টি সরিয়ে নিল চকিতে। তাড়া দিয়ে আনিতাকে বলল, ‘চলো চলো।’
আনিতা হাত তুলে থামিয়ে দিল ওকে, ‘আরে থামো। পাগলটাকে একটু দেখি। অনেক সুন্দর কিন্তু! দেখলেই কেমন যেন প্রেম প্রেম ফিল হয়।’
তুরিন ঝলসে উঠল একদম— ‘বন্ধ করো তোমার ফালতু প্যাঁচাল। ভীষণ বাজে তুমি!’
তুরিনের ওই রুষ্ট, কোপিত মুখশ্রীর দিকে বক্র চোখে চেয়ে থেকে শাহজিদ বলছিল, ‘এরকম ডাইনির মতো দেখতে একটা মেয়েকে কে বিয়ে করবে? সারাক্ষণ মুখটাকে এমন বানিয়ে রাখে কেন? সমস্যা কী এর?
নিশা মুচকি হাসল, ‘সমস্যা হলাম আমরা। আমাদেরকে সে অত্যন্ত অপছন্দ করে। তাই আমাদের সামনে এলেই ওর মুখটা আপনাআপনি কঠিন হয়ে যায়।’
তুরিন সেলফোনটা ভুলে রেখে এসেছিল বাড়িতে। মনে পড়তেই বাড়ির দিকে ফিরতে হলো তার। চকচকে রোদ তখন শাহজিদের ঈষৎ লালচে চুল আর দাড়িতে সোনালি পরশ বুলাচ্ছিল। হ্যাজেল রঙের চোখজোড়ায় খেলছিল ক্ষুরধার বিদ্বেষের চাপা স্ফুলিঙ্গ। তুরিনের পায়ে হাই-হিল বুটজুতো। তার হাঁটায় একটা চমৎকার ছন্দময় ভঙ্গি আছে। জুতোর হিলে টুকটুক শব্দ হচ্ছে আর গতির দমকে রেশমি চুলগুলো এদিক-সেদিক উড়ছে। দেখতে লাগছে বেশ! একজন শ্বেতাঙ্গ তরুণ পোষা কুকুর নিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। তুরিনের চোখাচোখি হতেই হাসল সে। হাসল তুরিনও।
ওদিকে শাহজিদ পিঠ টান করে বসে আছে হুইলচেয়ারে। ওর পাশে নিশা। এদের দুজনকে একত্রে দেখলেই মনের মধ্যে একটা তেতো ভাব চিড়বিড়িয়ে ওঠে। নাহ তুরিন কোনদিন নিশাকে পিতার স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেনি। কিন্তু তার দাদা-দাদি তো করেছে। এমনকি এই মেয়ের গর্ভে জন্ম নিয়েছে তার পিতার দ্বিতীয় সন্তান। মফস্সলের গরিব এক পরিবার থেকে দাদাজান তুলে এনেছিল মেয়েটাকে। না খেতে পেয়ে মরে যাচ্ছিল এদের পরিবার। দাদাজান ছিল এদের ত্রাণকর্তা, রক্ষাকর্তা। মেয়েটির অন্তরে কি তিল পরিমাণ কৃতজ্ঞতা বোধ নেই? বাড়ির কেউ আপত্তি করে না বলেই দিনদুপুরে সবার সামনে প্রেম করে বেড়াবে? তুরিন শতভাগ নিশ্চিত এই শাহজিদ সুস্থ সবল মানুষ হলে কবেই তল্পিতল্পা গুটিয়ে পালিয়ে যেত দুজনে। এমনটা হলেই খুব ভালো হতো। শিক্ষা হতো দাদাজানের। মনের এলোমেলো কূট চিন্তার প্রভাব তুরিনের মুখের চামড়ায় প্রত্যক্ষভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছিল। কপালে কুঞ্চন, বোঁচা আদুরে নাকটায় অহংসর্বস্ব তাচ্ছিল্যের ঢেউ। নিশা রাস্তা পার হওয়ার জন্য উদ্যত হয়েছিল। শাহজিদ ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘দাঁড়াও, একটা মজা দেখাই।’ কথাটা পুরোপুরি শেষ করার আগেই সে হুইলচেয়ারের বাটন প্রেস করে সপাং করে ঘুরে গেল। তারপর তুরিনের মুখোমুখি ফুটপাত দিয়ে চলতে আরম্ভ করল। তুরিন খুব বেশি দূরে ছিল না। হঠাৎ আবিষ্কার করল হুইলচেয়ারের পাগলটা মুখে ব্রুম ব্রুম শব্দ করতে করতে তার দিকেই এগিয়ে আসছে ঝড়ের গতিতে। হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে উঠল ভয়ে। জমে গেল পা। শাহজিদ তখন একেবারে কাছাকাছি এসে গেছে। মনে হচ্ছে হুইলচেয়ারটা এখুনি তুলে দেবে তুরিনের গায়ে। কী আশ্চর্য! সমস্যা কী পাগলটার? জানে মেরে ফেলতে চায় নাকি? অতর্কিতে পা চালাতে গিয়ে হাই-হিল জুতো ভারসাম্য রাখতে পারল না। রাস্তার ওপরেই ধপাস করে পড়ে গেল তুরিন পা ফসকে। করুণ আর্তনাদ ছিটকে এলো গলা থেকে। নিশা আর আনিতা দৌড়ে ছুটে গেল।
আনিতা চেঁচিয়ে গলা ফাটাচ্ছে, ‘হোয়াট দ্য হেল ম্যান? হ্যাভ ইউ গন ম্যাড? ইউ স্টুপিড সাইকোপ্যাথ!’
শাহজিদ হুইলচেয়ারটা রাস্তার ধারঘেঁষে দাঁড় করিয়েছিল। ধীরস্থির গলায় বলল, ‘আমি তো জাস্ট একটু মজা করলাম। উনি এতটা ভয় পাবেন কে জানত!’ একটু থেমে তুরিনের যন্ত্রণা কাতর মুখখানার দিকে চেয়ে খুব ব্যথিত হওয়ার ভান করে বলল, ‘হিল পরার অভ্যাস নেই মনে হয়। আজকেই প্রথম পরেছেন?’ তুরিনের মনে হলো কথা নয়, বরং জুতো ছুড়ে দিয়েছে কেউ তার মুখ বরাবর। সাপের মতো ফোঁস করে উঠে বলল, ‘ফাজলামো করার জায়গা পান না? আমাকে মেরে ফেলতে চাইছিলেন? ওয়েইট…আমি আপনার নামে অ্যাটেম্পট টু মার্ডারের কেস করব।’
নিশা বেশ অপ্রস্তুত বোধ করছিল। রাগ হচ্ছিল শাহজিদের ওপর। এসব ছেলেমানুষীর কোন মানে হয়? মেয়েটার পা ভেঙে গিয়ে থাকলে কী হবে এখন? ভয়ে আত্মা শুকিয়ে আসছিল। বাধ্যগত ভৃত্যের মতো তুরিনের প্রায় মচকে যাওয়া পা-টা মালিশ করে যাচ্ছিল সে। তুরিন এই খেদমতটুকুকে গ্রাহ্য করছে না। কুটিল বক্র চোখে চেয়ে আছে শাহজিদের দিকে। শাহজিদের মুখে আত্মবিশ্বাসের হাসি। বিকলাঙ্গ একটা লোকের এত আত্মবিশ্বাস আর সাহস কোত্থেকে আসে তুরিন কিছুতেই ভেবে পায় না। রাগে তার নিঃশ্বাসের সঙ্গে কাঠকয়লা পোড়া আগুন বেরোচ্ছে যেন। আনিতা ওর হাত চেপে ধরে দাঁড় করাবার চেষ্টা করছে। শাহজিদ ডাকল,
—‘নিশা চলে এসো। উনি ঠিক হয়ে যাবেন। ডোন্ট ওরি।’
তুরিন আনিতার কাঁধে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে তখন। একটা খ্যাক দিয়ে নিশাকে বলল, ‘যান যান! আপনার বন্ধু ডাকছে। এখানে সংয়ের মতো দাঁড়িয়ে থেকে আর ঢং করতে হবে না।’
নিশা অপমানটা হজম করল। সব সময় যেমন করে আরকি। গটগটিয়ে হেঁটে এসে শাহজিদকে বলল, ‘কী দরকার ছিল এমন একটা কাণ্ড করার? কোন বিপদ হলে কী হতো?’
শাহজিদ মাছি তাড়াবার ভঙ্গিতে উড়িয়ে দেয় কথাটা, ‘ধুর! এত ভয় পেলে হয় নাকি? ডাইনিটাকে একটু শিক্ষা দিলাম।’
—‘তুমি আসলেই পাগল হয়ে গেছ। এতই যখন নিজে নিজে চলতে পার তো আমাকে দরকার কী? একাই যাও। আমি যাব না!’
শাহজিদ হাত বাড়িয়ে নিশার ডান কবজিটা ধরল। নরম স্বরে বলল, ‘একা তো যেতেই পারি। কিন্তু তুমি পাশে থাকলে ভালো লাগে।’
তুরিন তেরছা চোখে দেখল দৃশ্যটা। চাপা গর্জনের সঙ্গে স্বগতোক্তি করল, ‘খুব বেশি বাড় বেড়েছে দুজনের। আজকেই আমি দাদাজানের সঙ্গে কথা বলব!’
শুভদৃষ্টি
কলোরাডোর আকাশ মুগ্ধ করল অর্ণবকে। এমন বিস্তৃত, খোলামেলা অপরিসীম আকাশ সে এর আগে কখনো দেখেছে বলে মনে পড়ে না। শীতের বিষদাঁত সহ্য করেও রোদরশ্মি চাঁপা ফুলের মতো ফুটে আছে চারধারে। হাইওয়েতে উঠবার পর হঠাৎ হঠাৎ মনে হচ্ছিল সে বুঝি রাস্তায় চলছে না বরং আকাশে ভাসছে। পিচঢালা রুপালি রাস্তা বয়ে চলেছে পর্বতবেষ্টিত সুবিস্তৃত মালভূমির বুক চিরে। পথের দু ধারে যতদূর চোখ যায় শুধু সমতল মাঠ-ঘাট, খেতের খামার, কৃষকদের বাড়িঘর। কোথাও আবার মাইলের পর মাইল পরিত্যক্ত জমি। দূরের পাহাড় চুড়োয় পুঞ্জীভূত বরফ। সকালের ঝিকিমিকি রোদ্দুরে পাহাড়টাকে মনে হচ্ছে যেন মাথায় হীরের মুকুট পরিহিত কোন গর্বিত রাজা। এই সেই স্বপ্নের রকি মাউন্টেন! রকি মাউন্টেন দেখবার বড় সাধ ছিল অর্ণবের। আজ সেই বহুদিনের আরাধ্য স্বপ্ন এমনভাবেই পূরণ হলো যে রকি পর্বতমালা কিছুতেই আর তার পিছু ছাড়ছে না। একেক রাস্তায় একেকরকম মোহনিয়া রূপ ধরে হাজির হচ্ছে সম্মুখে। ঠিকানা মোতাবেক বোল্ডার কাউন্টির লায়ন্স এলাকায় এসে টের পেল ডেনভার থেকেও আরো উঁচুতে পৌঁছে গেছে। আকাশের খুব কাছে। নেইবারহুডের সরু রাস্তাটা ছিমছাম। দুধারে ছবির মতো সুন্দর বাড়ি। ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিয়ে আছে লাল পাথর আর সবুজ বৃক্ষের পাহাড়। এখন যদিও লাল সবুজ রং অতটা আলাদা করা যাচ্ছে না। সর্বত্রই তুষারপাতের শুভ্র সাদা জাল।
বেশ নার্ভাস লাগছিল। চুপচাপ লাজুক ধরনের ছেলে অর্ণব। মেয়েদের সঙ্গে তো একেবারেই সহজভাবে কথা বলতে পারে না। কী করে পারবে? নারীবিহীন সংসারেই যে বেড়ে ওঠা তার! যার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার কথা সেই মেয়েটি কেমন মানুষ কে জানে! ছবি দেখেছে। চাইনিজ ছাপ আছে চেহারায়। ওই মেয়েটি কি তার ছবি দেখে পছন্দ করেছে? নাকি বাবা-মা জোর করে বিয়ে দেবার পাঁয়তারা করছে? এমনই অগণিত প্রশ্ন এবং সম্ভাবনার দোলাচলে মন ডুবিয়ে গাড়ি থেকে নামল অর্ণব। হাতে স্যুটকেস আর কাঁধে ব্যাকপ্যাক ঝুলিয়ে প্যাটিওর সামনে এসে দাঁড়াতেই প্রশ্নটা ছুটে এলো পেছন থেকে, ‘হাই দেয়ার! হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?’
চকিতে ঘাড় ঘুরিয়ে অর্ণব দেখল দুজন তরুণী দাঁড়িয়ে আছে পাশাপাশি। এর মাঝে একজনকে সে চেনে। এই সেই ছবির মেয়েটা। মেয়েটি হাঁটছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। অপর মেয়েটি শক্ত করে তার হাত ধরে আছে। অর্ণব কয়েক সেকেন্ড হতভম্ভ চোখে মেয়ে দুটোর দিকে চেয়ে রইল। তারপর বাধোবাধো গলায় বলল, ‘আমি অর্ণব। মেরিল্যান্ড থেকে এসেছি। আজ আমার আসার কথা ছিল। মুর্তজা সাহেব কি বাড়িতে আছেন?’
একটু থমকাল তুরিন। এই চিড়িয়াই তাহলে দাদাজানের পছন্দের পাত্র। বায়োডাটা পাঠানো হয়েছিল তাকে কিন্তু খুলে দেখার সময় বা রুচি কোনটিই হয়নি। বিতৃষ্ণা ভরা চোখ মেলে তাকাল তুরিন সামনে দাঁড়ানো যুবকটির দিকে। ছিপছিপে দোহারা শরীরে ছাই রঙের জ্যাকেট। গায়ের রং কালোর দিকে। শীর্ণ মুখ। চোখদুটো টানাটানা। হরিণের মতো। পুরুষ মানুষের চোখ এমন টানাটানা হতে তুরিন এর আগে কখনো দেখেনি। অর্ণব তাকাল সামনে দাঁড়ানো বোঁচা নাকের সুন্দরী মেয়েটার দিকে। প্রথম সকালের প্রখর আলোর বন্যায় এভাবেই হবু স্ত্রীর সঙ্গে শুভদৃষ্টি সম্পন্ন হলো অর্ণবের। কিন্তু মেয়েটির মুখে কোন ভাবান্তর নেই। কেমন যেন খটমটো আর উগ্র তার চোখের চাউনি I অর্ণব বিব্রত হয়ে পড়ল।
—‘দাদাজান এখন বাড়িতে নেই। বিকেলে ফিরবেন।’ উত্তর দিল আনিতা। অর্ণব মাথা নিচু করে বেশ লজ্জিত গলায় বলল, ‘জি উনি আমাকে আজ আসতে বলেছিলেন।’
—‘ভেতরে গিয়ে বসেন।’ আদেশটা ছুড়ে দিয়েই পোর্চের সিঁড়িতে পা রাখল তুরিন। আগের চাইতে কিছুটা সহজভাবে হাঁটতে পারছে সে এখন। পেছন ফিরে তাকানোর তাগিদ অনুভব করল না। অর্ণবকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেই ঢুকে গেল বাড়ির ভেতর। আনিতা তাড়া দিয়ে উঠে বলল, ‘তাড়াতাড়ি সেলফোনটা নিয়ে বেরিয়ে এসো। দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
তুরিনের গলার স্বর ক্লান্ত, ‘আমি আর যাব না আজ।’
—‘কেন?’
—‘ওই পাগলটাকে দেখলেই আমার দিন খারাপ যায়। আজ দিনের শুরুতেই এমন ঝামেলা বেঁধে গেল। না জানি আরো কী না কী বিপদ হয়। ভাললাগছে না কিছুই। অসভ্যটাকে একটা উপযুক্ত শিক্ষা না দিলে শান্তি হবে না।’
আনিতা সরু চোখে বলল, ‘আসলেই? নাকি বিয়ের পাত্র দেখে মাথা ঘুরে গেছে?’
—‘ওই খ্যাতটাকে পছন্দ হবে আমার? গেঁয়ো ভূত একটা।’
—‘অ্যাগ্রি উইদ ইউ। ভীষণ কালো!’
‘গায়ের রং কোন বিষয় না। বিষয় হচ্ছে ছেলেটা আনকালচার্ড, গাইয়া। গিয়ে দ্যাখ ঠিক মতো ইংরেজিও বলতে পারে না। দাদাজান মনে হয় পণ করেছে বাংলাদেশের সমস্ত গরিব-দুঃখী-গেঁয়োদের এই বাড়িতে এনে ঠাই দেবে। অসহ্য!’
বিষাক্ত বাসর
ফিরে এসে দেখা গেল শাশুড়িমা কিচেন কাউন্টারের টুলের ওপর বসে আছেন জুবিনকে কোলে নিয়ে। জুবিন ওর ছোট্ট হাত-পা ছুড়ে কাঁদছে। নিশা পড়িমরি করে মেয়েকে কোলে তুলে নিল। মেয়ে এখনো বুকের দুধ ছাড়েনি। কান্নার ধরন দেখে মনে হচ্ছে খিদে পেয়েছে। রান্নাঘরে শাশুড়ি ছাড়া কেউ নেই। নিশা শাশুড়ির পাশের টুলে বসে মেয়েকে খাওয়ানোর উদ্যোগ নিল।
—‘এত দেরি করলে কেন বৌমা?’
প্রশ্ন শুনে ঈষৎ অপ্রতিভ হয় নিশা। অন্যদিন চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ মিনিট হাঁটে। আজ আধাঘণ্টার ভেতরেই ফেরত এসেছে। সুতরাং বিলম্বের অভিযোগটা একেবারেই অযৌক্তিক, তবুও মাথা উঁচু করে স্পষ্ট স্বরে প্রতিবাদ করতে পারল না। কখনো পারেনি। ওর স্বভাবে বিদ্রোহ ব্যাপারটা নেই বললেই চলে। দুর্বল গলায় বলল, ‘আধাঘণ্টার মতো হয়েছে মা।’
মিসেস মুর্তজা শক্ত হলেন, ‘তোমার কী অত দায় পড়েছে ল্যাংড়া ছেলেটাকে প্রতিদিন বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার? লোকে মন্দ কথা বলে।’
নিশা চুপ করে রইল। তাকে নিয়ে আলোচনা করার মতো লোকের সংখ্যা খুব একটা নেই সংসারে। নিশার অস্তিত্ব শুধু বাড়ির কজন লোক ছাড়া বাদবাকি পৃথিবীর কাছে অপ্রকাশ্য। খুব অদ্ভুত হলেও ব্যাপারটা সত্য। নিশাকে আত্মীয়- স্বজনের সামনে যেতে দেয়া হয় না। ইদের দিন বা অন্য যেকোনো উৎসবমুখর সময়ে নিশা ওপরতলার কামরায় বন্দি থাকে। জুবিনকে সকলে ফারার মেয়ে হিসেবেই চেনে। জাহিদের সুবিশাল বন্ধুমহলের কেউই তার দ্বিতীয় স্ত্রী সম্পর্কে অবগত নয়। এ দেশে একই সঙ্গে দুজন স্ত্রী থাকা অবৈধ। শ্বশুর মুর্তজা সাহেব চতুর কৌশলে ব্যাপারটা সামাল দিয়েছেন। কাগজে-কলমে নিশার বিয়ে হয়েছিল জাহিদের এক কাজিনের সঙ্গে। সেই লোকের কাগজের বউ হয়ে নিশা আমেরিকায় এলো। মুর্তজা সাহেব ডিভোর্স করালেন অতি সত্বর। তারপর নিজের ছোট ছেলের সঙ্গে নিশার বিয়ে দিলেন। এই বিয়ের কোন রেজিস্ট্রেশন হলো না। শুধু আল্লাহকে সাক্ষী রেখে পাত্র-পাত্রি কবুল বলল। নিশার ক্যান্সার আক্রান্ত দরিদ্র বাবা সমস্তটাই মুখ বুজে মেনে নিলেন। মুর্তজা সাহেবের বদান্যতায় তার চিকিৎসা হচ্ছে। ছোট ছেলে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। এই একটা বিয়ে নিশার পুরো পরিবারের ভাগ্য পাল্টে দিয়েছে।
নিশার নিরুত্তর বিষণ্ন বদনের দিকে চেয়ে মিসেস মুর্তজা বললেন, ‘অসহায় মানুষকে সাহায্য করবে ভালো কথা। দেখভাল করছ, যত্নআত্তি করছ, এই পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু রোজ রোজ বাইরে বেড়ানোর কী দরকার? বিষয়টা দৃষ্টিকটু।’
নিশা চুপ করে রইল। সারাদিনের মধ্যে সকাল বেলার ওই একটুখানি সময় প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেয় সে। একমাত্র শাহজিদের সঙ্গেই মন খুলে কথা বলা যায়। একেবারে আপন লোকের মতো। মিসেস মুর্তজা কেশে একটু গলা পরিষ্কার করলেন। গম্ভীরভাবে বললেন, ‘শুনো বৌমা, সময় নষ্ট না করে খুব তাড়াতাড়ি আরেকটা বাচ্চা নিয়ে নাও। তোমার শ্বশুরও এটাই চায়। মন বলছে এবার ছেলে হবে।’
নিশা হতভম্ভ হয়ে গেল কথাটা শুনে। মিসেস মুর্তজা বলে চললেন,
—‘তোমার শ্বশুরের পঁচাত্তরের ওপরে বয়স হয়েছে। কোন সময় পরপারের ডাক আসে বলা যায় না। বুড়া মানুষটার অনেক শখ মরার আগে নাতির মুখ দেখার। আমি জাহিদের সঙ্গেও কথা বলেছি…’
বুকচাপা এক হাহাকারে পিষে গেল পাঁজরের হাড়। এইতো মাত্র সেদিন জুবিন এলো ওর কোল আলো করে। দু বছরও কাটেনি। এখনই আবার…?
বিয়ের প্রথম রাত। প্রাসাদতুল্য বাড়ির চকচকে কামরায় নববধূ সেজে বসে আছে নিশা। শুনেছে বরের বয়স সাঁইত্রিশ। নিশার কোন পছন্দের মানুষ ছিল না। পিতার পছন্দকে নিজের পছন্দ হিসেবে মেনে নেওয়ার জন্য সদা প্রস্তুত ছিল মনে মনে। নিজেকে বুঝিয়েছে খুব করে। বয়স কোন ব্যাপার নয়। মানুষটা যদি ভালো হয়, সচ্চরিত্র হয়, নিশা তাকে সর্বস্ব দিয়ে ভালোবাসবে। তার আজন্ম লালিত মধ্যবিত্ত ধ্যান-ধারণা এই বিয়েকে পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ করার জন্য তৎপর হয়ে ছিল।
বুকের মধ্যে অবাধ্য এক দাপাদাপি নিয়ে বাসরঘরের ফুলশয্যায় অপেক্ষা করছে সে। একটা সময় আবছায়া ঘরের ভেতর পা রাখল লম্বা চওড়া সুঠাম দেহের এক পুরুষ। ফ্যাকাশে আলোর ল্যাম্পশেড জ্বলছিল। কম্পিত বুক নিয়ে নিশা দেখতে পেল লোকটার পা অসম্ভব টলছে। পরনে পাঞ্জাবি। টকটকে ফরসা গায়ের রং। চোখে পাতলা ফ্রেমের চশমা। টলমলে পা নিয়ে বিছানার ওপর ধপ করে বসে পড়ল। নিশার মুখ অবনত। শরীরে কম্পন। এই রাতটাকে ঘিরে সব মেয়েদের মনে আলাদা রকমের স্বপ্ন থাকে। নিশারও ছিল। পাড়ার লোকে বলত ওর মতো সুন্দরী লাখে একটা পাওয়া যায় না। যে পুরুষ ওকে পাবে…সে নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান। ফুল ফুটলে ভ্রমর তো আসেই। নিশার প্রেমে পড়া পুরুষের সংখ্যা কম ছিল না। একবার এক ছেলে আত্মহত্যা পর্যন্ত করতে চাইল। এত এত প্রেমপ্রার্থীদের মধ্যে নিশা কারুকেই মন দিল না। তার মনটা সে সযত্নে তুলে রেখেছিল, অনেক বসন্ত ধরে জমিয়ে রেখেছিল…বিয়ের পরে নিজের স্বামীর হাতে তুলে দেবে বলে।
লোকটা কিছু বলছে না। বসে বসে একটু ঢুলছে মনে হয়। রোগীর মতো ঢুলছে কেন কে জানে! দেখতে তো বেশ হৃষ্ট-পুষ্ট-বলিষ্ঠ! নিশা চোখের কিনার দিয়ে দেখল একবার। লোকটা চশমা খুলে হাতে নিল। রাখল বিছানার পাশের নাইটস্ট্যান্ডের ওপর। হঠাৎ শুয়ে পড়ল বিছানায়। গোঙানির মতো কেমন একটা অদ্ভুত শব্দ করল মুখ দিয়ে। নিশা শ্বাস রোধ করে অপেক্ষা করছে। কিছু তো বলবে তার সদ্য বিবাহিত বর! হ্যাঁ…বলল অবশেষে! ভাঙা-চড়া সাঙ্ঘাতিক এক আওয়াজ গলায় তুলে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘টেক অফ ইওর ক্লোদস।’
নিশা ইংরেজি অত ভালো বোঝে না। তার ওপর লোকটার উচ্চারণ দ্রুত, জড়ানো এবং অস্পষ্ট।
—‘জি?’
লোকটা একবারও তাকাল না ওর দিকে। ঘরের দেয়ালের দিকে চোখ ঠেকিয়ে কঠোরভাবে নির্দেশ দিল, ‘কাপড় খুলে এসো।’
শিউরে উঠল নিশা। অতিকায় এক ঐরাবতের পায়ের তলায় যেন থেঁতলে গেল মন!
—‘কী বলছেন?’
জাহিদ ঘুরে তাকাল। চোখ ফেলল নিশার মুখের ওপর, ‘এটা ছাড়া আর কী বলার আছে তোমাকে আমার? কী আশা করেছিলে তুমি?’
নিশা কাঁপছিল। প্রতিবাদের যথোচিত ভাষা মুখে আসছিল না।
—‘আমার সেলফিশ বাবা তোমাকে এখানে কেন ধরে নিয়ে এসেছে জানো তো? এনেছে সন্তান উৎপাদনের জন্য। তুমি নিশ্চয়ই সব জেনেশুনেই এসেছ। তাহলে এখন আপত্তি করছ কেন? তুমি কি ভেবেছিলে আমি তোমার সঙ্গে ভালোবাসার কথা বলব? প্রেমের কথা বলব?’ একটু থেমে বড় একটা শ্বাস টেনে নিল জাহিদ। চুপ করে রইল কয়েক সেকেন্ড। তারপর গলার স্বর নিচের মাত্রায় নামিয়ে এনে কিছুটা নরমভাবে বলল, ‘আমি আমার স্ত্রী, কন্যাকে ভালোবাসি।
—‘আপনাদের ডিভোর্স হয়নি?’
—‘না হয়নি।’
নিশা পায়ের তলায় মাটি খুঁজে পাচ্ছিল না। রাগে, দুঃখে, অপমানে কাঁপতে কাঁপতে কোন রকমে বলল,
—‘আমাকে বলা হয়েছিল আপনার প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে ডিভোর্স হয়েছে।’
—‘মিথ্যে বলা হয়েছে। যদি ডিভোর্স হয়েই থাকত তাহলে আমার চাচাতো ভাইয়ের নকল স্ত্রী সেজে তোমাকে দেশ ছাড়তে হতো না।’ অসহায় কান্নায় নিশার কণ্ঠরোধ হয়ে এলো। তীক্ষ্ণ ছুরির আঘাতে বিদীর্ণ হতে লাগল বক্ষ। জাহিদ তখন মদ খেয়ে পাঁড়মাতাল। চিৎকার করে বলল,
‘ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছ কেন? ডু ইওর জব! কাম অন! এসো আমার কাছে। এসে আমাকে উদ্ধার কর! গিভ মি অ্যা চাইল্ড। গিভ মি অ্যা ফাকিং চাইল্ড অ্যানড লিভ মি এলোন!’ নিশা কিছু বলতে পারল না…নড়তে পারল না…হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল শুধু। খানিক বাদে জাহিদ গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। জেগে রইল নিশা। নববধূর সাজ সেজে একলা। পাগলের মতো পায়চারি করতে লাগল ঘরের ভেতর। একটা সময় ঘুমন্ত জাহিদের শরীরে ধাক্কা দিয়ে কান্নায় ফেটে পড়ে বলল, ‘কেন আমার এই সর্বনাশ করলেন আপনি? পিতার আদেশের বিরোধিতা করেননি কেন? আপনি তো অবুঝ বালক নন। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ!’
জাহিদ ঘুম চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে নির্জীব গলায় বলল, ‘আমার বাবার বংশধর চাই। ছেলে উত্তরাধিকার।’
—‘এর মানে বাবার সিদ্ধান্তে আপনার সমৰ্থন আছে!’
—‘দ্যাখো, তুমি চলে যেতে চাইলে যেতে পারো। আর যদি থাকতে চাও…প্লিজ আমাকে একটু সময় দাও। আমার প্রথম স্ত্রীকে আমি কখনোই ছাড়ব না। সে আমার সন্তানের মা।’
—‘উনি কি এই বাড়িতেই আছে?’
—‘কে?’
—‘আপনার প্রথম স্ত্রী।’
—‘কোথায় যাবে সে আমাকে ফেলে?’
বিশ্রী একটা অনুভূতি চিড়বিড়িয়ে উঠল শরীরে। কেউ যদি এক শিশি বিষ জোগাড় করে দিত, তবে এই মুহূর্তে গলায় সবটুকু উগড়ে দিয়ে বীতশ্রদ্ধ জীবনটার ইতি টানত নিশা। বিষ পেল না বটে, কিন্তু গভীর বিষাদের এক বিষাক্ত ছোবল কোত্থেকে যেন তেড়ে এসে রক্তের প্রতিটি কণিকায় মরণ জ্বালার সঞ্চারণ করল। সদ্য স্বজনহারা মানুষের মতো ডুকরে কেঁদে উঠল সে। ঠিক করল কাল সকালেই সব ছেড়ে-ছুড়ে দেশে ফিরে যাবে। কিন্তু হলো না। শ্বশুর মুর্তজা সাহেব সুকৌশলী জাঁদরেল লোক। মানুষের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে কী করে নিজের আখের গোছাতে হয় তা খুব ভালো মতোই জানা আছে তার। নিশা থেকে গেল। এই থাকার বিনিময়ে বাংলাদেশে তার পরিবার একটি সুনিশ্চিত সচ্ছল জীবন অর্জন করল। এ এক বিশাল প্রাপ্তি। এই প্রাপ্তির জন্য নিজেকে জ্যান্ত কবর দিতেও দ্বিধা করবে না সে।
—‘কী হইল বৌমা? কিছু বলছো না যে?’
শাশুড়ির প্রশ্নে ঘোর ভাঙল নিশার। জুবিন ঘুমিয়ে পড়েছে। ওকে শাশুড়ির কোলে তুলে দিয়ে নির্জীব গলায় বলল, ‘জুবিনকে রাখেন মা।’
—‘তুমি আমার কথা বুঝছ? দ্বিতীয় সন্তান নেওয়ার এখনই সময়।’
নিশা উঠে পড়ল বসা থেকে।
—‘গুরুজনের কথার উত্তর না দেয়া বড় ধরনের বেয়াদবি।’
নিশা চুপচাপ প্যান্ট্রির দিকে এগিয়ে গেল। তার চোখে-মুখে পিত্তি-জ্বালানো রাগের ছাপ। ঠোঁট কাঁপছে। বুকে কান্নার ধোঁয়াশা।
ঘরের শত্রু বিভীষণ
দশটার দিকে তুরিন দৌড়ে এলো এক পাক। দৌড়ল শ্বেত শুভ্র তুষারঘেরা পাহাড়ের কোলঘেঁষা রাস্তায়…নীল ঝকঝকে আকাশের নিচে। ফিরে এসে নামল ব্যাক ইয়ার্ডের হট টাবে। জ্যাকেট, জুতো সব ছেড়ে শুধু সুইম স্যুট পরে বুদবুদ ওঠা উষ্ণ জলে নামতেই শরীর প্রসন্ন হয়ে উঠল। কানে হেডফোন গুঁজে মোবাইলে ছেড়ে দিল পছন্দের গান। খানিক দূরেই সেইন্ট ভেইন ক্রিক। ক্রিকের চারধারে আগাছা আর জঙ্গল। বরফে সাদা হয়ে আছে সব। জমে থাকা বরফ থেকে উড়ে আসছে হিম। হিম জড়ানো রৌদ্রকরোজ্জ্বল সাদা দিনের কাছে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সঁপে দিয়ে মনের ভেতরের মনে শান্তির তালাশ করছিল তুরিন। গায়ে গরম জলের ঢেউ এসে লাগছে, কানে অ্যাডিলের গান…কিন্তু মন মাছিটা উড়ে উড়ে শুধু একটা জায়গায় গিয়ে আটকা পড়ছে। নাহ…এভাবে ছেড়ে দেয়া যাবে না। সীমাহীন সাহস হয়ে গেছে ছেলেটার। কিন্তু কী করবে তুরিন? সরাসরি গালে একটা চড় বসাতে পারলে শান্তি হতো। এরপর যেদিনই ওর সঙ্গে পা মাড়িয়ে ঝগড়া করতে আসবে ওই অথর্ব, অসামাজিক, অভদ্রটা ঠিক এই কাজটাই করবে। ঠাস করে পাঁচ আঙুলের দাগ বসিয়ে দেবে গালে। অশান্ত মন নিয়ে খুব বেশিক্ষণ শান্ত হয়ে জলে ডুবে থাকা সম্ভব হলো না। উঠে পড়ল। সুইম স্যুটের ওপর নীল রঙের একটা বাথরোব গায়ে জড়িয়ে হাঁটা দিল বাড়ির দিকে। ড্রয়িংরুমে এখনো গেঁয়ো ছেলেটা বসে আছে চুপচাপ। তুরিনকে দেখেই ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়াল বসা থেকে। যেন তুরিন তার মুরব্বি। দাঁড়িয়ে সম্মান দেখাতে হবে। কী বিরক্তিকর!
—‘বসেন বসেন। দাঁড়ানোর কী আছে?’
অর্ণব বাথরোব পরা ভেজা চুলের তুরিনের দিকে একবার তাকিয়েই লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিল। আড়ষ্ট গলায় বলল, ‘না মানে…এমনি…!’
—‘এমনি এমনি অত সম্মান দেখানো আমার পছন্দ না। বুঝেছেন?’
অর্ণব মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে পারে না। তার ওপর এমন স্মার্ট, সুন্দরী আর ধারালো মেয়ে! বাপরে বাপ কথায় কী তেজ! কী জৌলুস তার দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে, চোখের চাউনিতে! দেখলে বোঝা যায় পৃথিবীর কাউকে তোয়াক্কা করে না। অর্ণব বড় একটা শ্বাস টেনে নিয়ে ক্ষয়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাসটা একটু খানি ফিরিয়ে আনল। নত মুখে বলল, ‘ভদ্র আচরণ করা কি অন্যায়?’
তুরিন অপলক নেত্রে সামনে দাঁড়ানো জড়সড়ো আড়ষ্ট যুবকটিকে একবার আপাদমস্তক দেখে নিল। স্বভাবসুলভ খটোমটো গলায় বলল, ‘আমাকে এসব ভদ্রতা দিয়ে ইম্প্রেস করার চেষ্টা করে লাভ নেই। আপনি কী মতলবে এখানে এসেছেন তা আমি জানি। ওসব হবে না আগেই বলে দিচ্ছি।’
—‘না হলে আর কী করা। আপনার যদি আমাকে পছন্দ না হয়…আমি ফিরে যাব।’
—‘ভাবলেন কী করে আপনাকে আমার পছন্দ হবে? চেহারাটা কখনো দেখেছেন আয়নায়?’
—‘জি দেখেছি।’ অর্ধনিমীলিত চোখ তুলে অর্নব বলল।
—‘কেমন দেখেছেন?’
—‘ভালোই! দেখতে আমি অতটা খারাপ নই।’
—‘বাহ! নিজের সম্বন্ধে খুব উচ্চ ধারণা আছে দেখছি আপনার। ফালতু যত্তসব।’
কথাগুলো বারুদের মতো অর্ণবের মুখ পানে ছুড়ে দিয়ে গটগট করে হেঁটে জায়গাটা থেকে সরে এলো তুরিন। কিছুদূর গিয়ে থামল একবার। পেছন ফিরে তাকিয়ে ধমকের সুরে বলল, ‘খেয়েছেন কিছু?’
অর্ণবের আসলেই খুব খিদে পেয়েছিল। ভারি বিনীত গলায় উত্তর দিল, ‘জি না।’
তুরিন কোন কথা না বলে কিচেনের দিকে এগিয়ে গেল। নিশা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবজি কাটছিল ছুরি দিয়ে। দাদিজান জুবিনকে কোলে নিয়ে বসে আছে। তুরিন দাদিজানকে বলল,’ গেস্ট এসেছে। সকাল থেকে কিছুই খায়নি। এটা কেমন কথা দাদিজান?’
নাসিমা বেগম উঠে দাঁড়ালেন, ‘এই নে। তোর বোনকে ধর। নাশতা রেডি আছে। আমি এক দৌড়ে গিয়ে দিয়ে আসি।’
তুরিন বিরক্ত হলো, ‘আমার সারা গা ভেজা। বাচ্চা কোলে নিব কীভাবে?’ নাসিমা বেগম নাতনির প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করলেন। একরকম জোর করে জুবিনকে গুঁজে দিলেন তুরিনের কোলে। তুরিন কেমন শক্ত হয়ে গেল। এই বাচ্চার শরীরের তার পিতার রক্ত বইছে। বয়সে উনিশ বছরের ছোট। ভাবা যায়? নাহ…ভাবা যায় না…ভাবতে চায়ও না…অসহ্য একটা অনুভূতি হয় এসব মনে পড়লে। কিন্তু হাসিটা…কী মিষ্টি করে হাসে ওই একরত্তি মানুষটা! চাইলেও এর সঙ্গে রাগ করে থাকা যায় না। নিশা আড়চোখে দেখছিল। তুরিনের কুঁকড়ে যাওয়া ফ্যাকাসে মুখটা। আস্তে করে বলল, ‘নামিয়ে দাও, হাঁটবে। কোলে নিতে হবে না।’ তুরিন তৎক্ষণাৎ আদেশ পালন করল। বোনকে নামিয়ে দিল মেঝেতে। ছোট্ট জুবিন টুকটুক করে কয়েক পা হেঁটেও ফেলল। সারা দিনের মধ্যে এই একটা মাত্র ভালো ঘটনা ঘটল। তুরিন সেলফোন বের করে ছোট বোনের গুটিগুটি পায়ে হেঁটে বেড়ানোর দৃশ্যটা ভিডিও করতে লাগল।
.
মা এলো বিকেলে। আসতেই তুরিন রেগেমেগে বলল, ‘ওই ফাজিল ছেলেটা আজকে কী করেছে জানো মা?’
ফারা গায়ের কোট খুলে ক্লজেটের হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখল। কালো রঙের একটা স্কার্ট আর সাদা শার্ট তার পরনে। হাই-হিল জুতো। চুলগুলো চুড়ো করে খোঁপা বাঁধা। দারুণ ঝাঁ চকচকে। দেখলে বোঝা যায় না তুরিনের বয়সি মেয়ের মা।
—’কী করেছে?’
তুরিন মনের সব ঝাল মিটিয়ে সকালবেলার ঘটনাটা মায়ের কাছে পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে বর্ণনা করল। শুনতে শুনতে ফারার প্রসাধন মাখা নিভাজ টানটান মুখের চামড়ায় আগুনের আঁচ এসে পড়ল। শ্বশুরের ওপর সে বহুদিন ধরেই অসন্তুষ্ট। ওই স্বৈরাচার, স্বার্থপর, বিষয়ী লোকটার সঙ্গে পাঁচ বছর ধরে একটা বাক্যও বিনিময় করেনি সে। বিকলাঙ্গ ছেলেটিকে বাড়িতে আশ্রয় দেয়াও ওই লোকের বহুবিধ স্বেচ্ছাচারী দুর্বিনীত কর্মকাণ্ডের একটি। কিছুক্ষণ কুঞ্চিত কপাল নিয়ে চেয়ে রইল ফারা। তারপর দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। সোজা নেমে এলো নিচে। তুরিন মাকে অনুসরণ করছিল। ফারা বেজমেন্টের দরজায় কয়েকবার ধাক্কা দিল। কোন সাড়া না পেয়ে দরজাটা এক টানে খুলে ফেলল। দরজার সামনে ছোট্ট একটা হলওয়ে। তারপর অন্ধকার সিঁড়ি। এ পর্যায়ে নিচ থেকে গলার আওয়াজ ভেসে এলো।
—‘কে?’
উত্তর না দিয়ে সিঁড়ি ভাঙতে লাগল ফারা। তুরিন সিঁড়িঘরসংলগ্ন হলওয়েতে দাঁড়াল। নামল না নিচে। আরাম লাগছে এখন। মনে হচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে গলায় বিঁধে থাকা কাঁটা নেমে গেছে। আচ্ছা শিক্ষা হবে এবার ওই শয়তানটার।
শাহজিদ একটা কনফারেন্স কলে ছিল। ফারার আকস্মিক উপস্থিতির দরুন ব্রেক নিতে হলো। ক্যামেরা আর হেডফোন মিউট করে হুইলচেয়ার ঘুরিয়ে নিল, ‘কী ব্যাপার?’
কোমরে হাত রেখে একটু বঙ্কিম ভঙ্গিতে দাঁড়াল ফারা, ‘তুমি নিজেকে ভাবো কী?’
শাহজিদ কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো হাত দিয়ে সরিয়ে কানের পেছনে আটকে দিল। নির্বিকার গলায় বলল, ‘আমি শাহজিদ আনাম। এটাই ভাবি।’
—‘তোমার সাহস কী করে হয় আমার মেয়েকে টিজ করার?’ অবাক হয় শাহজিদ, ‘টিজ করিনি তো!’
—‘তুমি আমার মেয়ের গায়ে হুইলচেয়ার তুলে দিচ্ছিলে। যদি কোন দুর্ঘটনা ঘটে যেত? তোমার এগেইন্সটে কেস করা উচিত।’
—‘ও আচ্ছা! এর মানে কমপ্লেইন গেছে আপনার কাছে।’ কথাটা বলে শাহজিদ আপন মনে কেমন যেন একটা ফিচেল এবং আমুদে হাসি হাসল। যেন কল্পনায় দেখতে পেল তুরিন কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কাছে তার বিরুদ্ধে নালিশ করছে।
—‘আমার মেয়ে আমার কাছে কমপ্লেইন করবে না তো কার কাছে করবে? নাকি পুলিশ স্টেশনে যাওয়া উচিত ছিল ওর?’
শাহজিদ শ্রাগ করল, ‘কিন্তু আমি তো কিছুই করিনি। হাওয়া খেতে বেরিয়েছিলাম হঠাৎ দেখি আপনার মেয়ে আমার সামনে! প্রায় পথ রোধ করে দাঁড়াল।’
তুরিন ওপরের সিঁড়িঘরে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল। এই পর্যায়ে সে রাগ জবজবে কণ্ঠে স্বগতোক্তি করল, ‘মিথ্যুক!’
ফারা গরম তেলে পেঁয়াজ ছাড়ার মতো তেঁতে উঠে বলল- ‘দ্যাখো ছেলে, আমার শ্বশুরের সঙ্গে তোমার কীসের কমিটমেন্ট তা আমি জানি না। তবে জেনে রাখো, সন্তানের ভালোর জন্য আমি সব করতে পারি। কাউকে ভয় পাই না। আর কখনো যদি আমার মেয়ের দিকে নজর দিয়েছ তো সরাসরি পুলিশ কমপ্লেইন করব।’
শাহজিদ ওর দাড়ি-গোঁফ ভরা মুখে দুষ্টু হাসির স্পষ্ট একটা রেখা ফুটিয়ে তুলল। ডান গালে জিব ঠেকিয়ে কী যেন ভাবল খানিকক্ষণ। তারপর খুব মজার কোন কৌতুক শুনেছে এমন ভঙ্গিতে বলল, ‘এই মাত্র কী বললেন আপনি? নজর দেব? আপনার মেয়ের দিকে? সিরিয়াসলি?’
সম্মুখে বসা বিকলাঙ্গ যুবকটির স্পর্ধা দেখে অবাক না হয়ে পারে না ফারা। বাবা-মা, ভাই-বোন কেউ নেই চোদ্দ গুষ্টিতে। শুনেছে আগে বেশ কিছু মেয়ে বন্ধু ছিল। ঠ্যাং হারিয়ে পঙ্গু হওয়ার পর মেয়েদের দল লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে। এখন আশ্রিত হয়ে পড়ে আছে এ বাড়িতে। এত সাহস, এত আত্মবিশ্বাস, এত অহংকার কোত্থেকে আসে এর মাঝে? অপ্রতিরোধ্য রাগের হলকায় কণ্ঠ প্রায় রোধ হয়ে এলো ফারার। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘ডোন্ট ট্রাই টু বি ওভারস্মার্ট।’
—‘আপনার মেয়ের দিকে নজর দেয়ার মতো নজরকাড়া সে নয়। আর আমার নজর তো এমনিতেও যত্রতত্র পড়ে না। সো এটা নিয়ে ভাবনার কিছু নেই। আপনি বরং আপনার মেয়েকে একটু ডিসেন্ট হতে বলুন। সে মানুষ হচ্ছে না।’
—‘আমার মেয়েকে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। তুমি আমার মেয়ের কাছ থেকে একশ হাত দূরে থাকবে। মনে থাকে যেন।’
শাহজিদ ওর আত্মবিশ্বাসময় ঝকঝকে হাসিটা একবার হেসেই হুইলচেয়ার ঘুরিয়ে নিল ঝড়ের বেগে। দায়সারা কণ্ঠে বলল, ‘ইওর টাইম ইজ আপ। প্লিজ লিভ!’
তুরিন সরে পড়েছিল জায়গাটা থেকে। ক্রোধের অন্ধকারে চোখের দৃষ্টি ঢাকা পড়েছে। অপমানে জ্বলছে শরীর। গটগটিয়ে হেঁটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো সে। শেষ কথাটা কানের কাছে বিরক্তিকর বাদ্যযন্ত্রের মতো একটানা বেজে চলেছে, ‘আপনার মেয়ের দিকে নজর দেয়ার মতো নজরকাড়া সে নয়। আর আমার নজর তো এমনিতেও যত্রতত্র পড়ে না।’ সত্যিই কি তাই? তুরিনকে একটুও নজরকাড়া মনে হয়নি কখনো ওই অসভ্য ছেলেটার? তবে নজরকাড়া কে? তুরিনের সত্মা? বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী? একমাত্র বোনের গর্ভধারিণী?
কেউ কেউ একা
সন্ধ্যের পর শাহজিদের আর কিছুই করার থাকে না। ভিডিও গেমস খেলে কিছু সময় কাটায়, তারপর হয়তো পছন্দের বই নিয়ে বসে। ইউটিউবে সাবস্ক্রাইব করা দেশ-বিদেশের নিউজ চ্যানেলগুলো দেখে। মুভি দেখা হয় কদাচিৎ। খুব ভালো রিভিউ পেলে তারপর। আগে…যখন সে সুস্থ স্বাভাবিক আস্ত একটা মানুষ ছিল…যখন বাবা বেঁচে ছিল…তখন ডেনভারে একটা টাউন হাউসে থাকত ওরা। বাবা, বাবার গার্লফ্রেন্ড আর শাহজিদ। পাঁচ বছর বয়সে মাকে হারিয়েছিল। তারপর থেকে বাবার জীবনে আজকে এক গার্লফ্রেন্ড তো কালকে আরেক। মদ খেয়ে টাল হয়ে রোজ নতুন নতুন মেয়ে নিয়ে ঘরে ফেরা। শাহজিদ সারাদিন ডে-কেয়ারে। রাতে একলা খাটে ঘুম…বাসে করে একলা একলা স্কুলে যাওয়া-আসা…এভাবেই কেটে গেল ছয় বছর। এক গ্রীষ্মের ছুটিতে বাংলাদেশ বেড়াতে গেল বাবার সঙ্গে। নানিজান ফিরতে দিলেন না আর। বাবাও বেশ খুশি। পুত্র বিরহ তাকে কাবু করল না। বরং স্বাধীন উচ্ছন্ন জীবনে আর কোন পিছুটান রইল না ভেবে আনন্দে আটখানা হলেন। ঢাকার একটা অভিজাত ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি হলো শাহজিদ। পড়ার খরচ বাবাই বহন করেন। পিতা হিসেবে ওইটুকু দায়িত্বই তিনি পালন করেন। নানির বাসায় নানি আর ছোটমামাকে নিয়ে শাহজিদের দিনগুলো নিশ্চিন্তে কাটছিল। বাবাকে তেমন একটা মনে পড়ে না। মায়ের স্মৃতিও ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে আসছে। বাবা মাঝেমধ্যে নানারকম বিদেশি খেলনা কিনে পাঠায়। ষোল বছরের জন্মদিনে একটা হেলিকপ্টার কিনে পাঠাল। ব্যাটারি দিলে ওটা ফরফর করে উড়ে বেড়ায়। এই ছিল বাবার কাছ থেকে পাওয়া শেষ উপহার। কয়মাস বাদে বাবার কোলন ক্যান্সার ধরা পড়ল। যেদিন শাহজিদ ফিরে এলো কলোরাডোতে, বাবাকে এক নজর দেখবে বলে, ঠিক সেদিনই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। না, শেষ দেখা হয়নি বাপ-ব্যাটার মধ্যে। মাসদুয়েক পর নানিজানও পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলেন। প্রকৃতি যেন শাহজিদকে একা করে দেবার নিষ্ফল এক পরিকল্পনা এঁটে বসেছিল। তবুও জীবনতরী যে বাইতেই হবে! শাহজিদ একলা হাতেই এবার শক্ত করে বৈঠা চেপে ধরল। পারিবারিক জীবনে একের পর এক ঝড় ঝাপটা, উত্থান-পতন, প্রিয়জনের বিচ্ছেদ…এর কোনটাই তাকে টলাতে পারেনি। তার নিরিবিলি, নির্মক্ষিক, একলা জীবনে ভাবাবেগের কমতি ছিল বটে, তবে উদ্যমের অভাব ছিল না। বাকপটু, বুদ্ধিমান এবং কর্মঠ শাহজিদ তাই খুব অল্প সময়ের মধ্যেই নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নিল। পড়াশোনার পাশাপাশি পার্টটাইম জব, সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, উইকেন্ডে পর্বত আরোহণ…এই নিয়ে তার জীবনচাকা ঘুরছিল নির্বিঘ্নে। সবাই তাঁকে পছন্দ করে, যার সঙ্গে মেশে তাকেই বশ করে ফেলে তার সম্মোহনী ব্যক্তিত্ব। বন্ধুদের আড্ডার মধ্যমণি সে। তাকে ছাড়া জমেই না। অ্যাঞ্জেলিনা নামের একটা রাশান মেয়ের সঙ্গে কিঞ্চিৎ ভাবের আদান-প্রদানও হয়ে গেল। রূপের প্রতি শাহজিদের তৃষ্ণা অতি ক্ষীণ। তার মন অন্য ধাতুতে গড়া। নারী দেহের সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে বাহ্যজ্ঞান হারানো তার চরিত্রগত বৈশিষ্ট নয়। তার মন আরো উঁচুদরের কোন মনোহারিতার জন্য উন্মুখ। শরীরী অবয়ব সেই মনোহারিতার জোগান দিতে পারে না। তবে অ্যাঞ্জেলিনাকে একটু একটু ভালো লাগছিল। রকি মাউন্টেনে একসঙ্গে হাইকিং করত ওরা। একবার ক্যাম্পিংয়ে গিয়েছিল দল বেঁধে। তাঁবুর ভেতর অ্যাঞ্জেলিনাকে চুমু খেয়েছিল শাহজিদ। ওটাই ছিল জীবনের প্রথম চুম্বন। সখ্যতা জমে উঠেছিল। এমনকি লিভ টুগেদারের সিদ্ধান্ত নিতেও পিছপা হয়নি দুজনে। পড়াশোনা শেষ। চাকরি খুঁজছে হন্যে হয়ে। শিগিরই একটা রেন্টেড অ্যাপার্টমেন্টে মুভ করবে ওরা। এমন সময়ে ঘটল দুর্ঘটনা। ওই একটা মুহূর্ত ফুডুত করে উল্টে দিল জীবনের পাতা। প্রথম কয়েক মাস আঞ্জেলিনা রোজ দেখতে আসত শাহজিদকে ফুলের তোড়া নিয়ে। আসত বন্ধুরাও। ধীরে ধীরে সবার আসা-যাওয়া কমতে লাগল। আগে যে যুবককে দেখলে, যার সঙ্গে কথা বললে লোকে অনুপ্রেরণা পেত, হারানো উদ্যম খুঁজে পেত, বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা ফিরে পেত, এখন সেই যুবকের চারিপাশে শুধু ঘোর বিষণ্ণতা। এই নির্বাক নিরানন্দ উদাস পরিস্থিতি আর কত সহ্য করা যায়? সপ্তাহখানেক কেটে যাওয়ার পর অ্যাঞ্জেলিনা লাপাত্তা হলো। হঠাৎ এক বিকেলে আবার এলো সে। এবার ফুলের তোড়া সঙ্গে নেই। আছে নতুন বয়ফ্রেন্ড। শাহজিদ হাসিমুখে অভিবাদন জানাল ওর নতুন সঙ্গীকে। অ্যাঞ্জেলিনার ওপর কোন রাগ নেই তার। অভিমান হয়তো আছে। কিন্তু যে অভিমানের দাম থাকে না, সেই অভিমানের আয়ুও দীর্ঘস্থায়ী হয় না।
আজ সন্ধ্যের পর অরহান পামুকের একটা বই নিয়ে বসেছিল। বইয়ের নাম ‘ A strangeness in my mind’। গ্রাম্য সহজ-সরল এক যুবকের আখ্যান। গল্প বলার ধরন নিঃসন্দেহে চমৎকার। কিন্তু অতটাও মন লাগছিল না। মনে হচ্ছে ইংরেজি অনুবাদটা আরেকটু উন্নত হলে ভালো হতো। হুইলচেয়ারের হাতলে দু হাত রেখে দুই আঙুলবিহীন বাঁ পাটায় ভর দিয়ে সামান্য সময়ের জন্য উঠে দাঁড়াল সে। দেয়ালে হেলান দিয়ে রাখা ক্রাচদুটো বগলদাবা করল অতি দ্রুত। খুব অল্প কাজ। তবুও হাঁফ ধরে যায়। আগে এসব করতে দ্বিগুণ কষ্ট হতো। এখন আগের মতো কষ্ট হয় না। অভ্যাসের দাসত্ব কষ্টের প্রকোপ অনেকখানি কমিয়ে এনেছে। ক্রাচে ভর দিয়ে কয়েক কদম হাঁটল। বাঁ পায়ে একটা চপ্পল গলিয়ে স্লাইডিং ডোরটা খুলল এক হাত দিয়ে। উঠোনে লাল ইটের মেঝেওয়ালা চারকোনা পোর্চ আছে। বাঁ দিকের দেয়ালঘেঁষে একটা চেয়ার রাখা। ধীরেধীরে চেয়ারটার দিকে এগিয়ে গেল সে। আকাশে গোলাপি রঙের আভা। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা শুকনো গাছের ডালে সাদা বরফের প্রলেপ। পাহাড়ের চূড়োয় জমা শ্বেত বরণ তুষারের ছায়া পড়েছে রাতের আকাশে। ব্যাকইয়ার্ড ফেলে কয়েক কদম হেঁটে গেলেই ছোট একটা জাকুজি পুল। তার ঠিক পরে পাইন আর অ্যাস্পেন গাছের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে সেইন্ট ভ্রেইন ক্রিক পর্যন্ত চলে গেছে উঁচু-নিচু মাটিযুক্ত এক সুঁড়িপথ। ব্যাকইয়ার্ডে বসলে ক্রিকের পানির শব্দ পাওয়া যায়। ক্রিকের ধারে বসে নেইবারহুডের ছেলেমেয়েরা আড্ডা দেয় প্রায়ই। গাঁজা খায়। গাঁজার গন্ধে ভরে থাকে বাতাস। কলোরাডোতে গাঁজা অবৈধ নয়। এই মাদকদ্রব্য সেবনে তাই কোন লুকোচুরির প্রয়োজন পড়ে না এখানে। শাহজিদ একটা সিগারেট ধরিয়েছিল। ঠিক মাথার ওপরেই দোতলার কাঠের ডেক। পোর্চের চতুর্দিকে অবস্থিত চারটি কাঠের খুঁটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে ডেকটা। ডেকের রেলিংয়ের বাঁ পাশ ঘেঁষে একটা সিঁড়ি নেমে এসেছে পোর্চ পার্শ্বস্থ লনের মাঝ বরাবর। ওপরে কখনো যায়নি শাহজিদ। যাওয়ার প্রয়োজন পড়েনি। নিশা মাঝেমধ্যে জুবিনকে কোলে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে। মুর্তজা সাহেবও আসেন কদাচিৎ, খোঁজখবর নিয়ে থাকেন। আজ কেউ আসবে কি না কে জানে!
তুরিন, আনিতা আর ওর ছোট বোন তানিশা প্রায়ই ডেকের ওপর দড়িলাফ খেলে। শাহজিদ পোর্চে বসে সিগারেট ধরালে নিকোটিনের ধোঁয়া উড়ে যায় ওপরে। তুরিন কাশতে থাকে। এই কাশিটা মেকি বলে মনে হয় শাহজিদের। মেকি কাশি কাশতে কাশতে তুরিন খিটখিটে গলায় শাহজিদকে নিয়ে নানা কটু কথা বলে। শাহজিদ নির্বিকারে সবটা শোনে। কখনো কিছু বলে না। মাসখানেক আগের ঘটনা। ব্যাকইয়ার্ডের পোর্চে বসে ছিল। তখনো সন্ধ্যে হয়নি পুরোদমে। আকাশে গোধূলির রং ঠিক মতো ধরতে না ধরতেই তুলোর ঝরনা ঝরতে লাগল। মাথার ওপর ডেকের ছাদ থাকায় তুলোর বৃষ্টি শাহজিদকে সরাসরি ভেজাতে পারল না। তবে চোখে-মুখে বরফ কণা এসে লাগছিল। সিগারেট তখন শেষের পথে। এমন সময় তুরিন তার বান্ধবীকে নিয়ে জাকুজি পুলে নাইতে এলো। কনকনে ঠাণ্ডা বরফঝরা দিনে ছেলেমেয়েরা উষ্ণ জলের চৌবাচ্চায় নামবে, আমোদ-ফূর্তি করবে-এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু কী কারণে যেন শাহজিদ মনে মনে বিরক্ত হলো খুব। অপরিচিতা মেয়েটি সৌজন্য হাসি হাসল। আর তুরিন সব সময়ের মতো গম্ভীর, ভ্রুকুটিবক্র মুখ। রাগী চাউনি। মেয়েটি তুরিনকে প্রশ্ন করল, ‘ও কে?’
তুরিন সাবলীল ইংরেজিতে জবাব দিল, ‘একজন অসহায় মানুষ। আমার গ্র্যান্ডপা দয়া করে আশ্রয় দিয়েছে।’ কথাটা কেন যেন এত বিশ্রীভাবে কানে লেগে গেল যে অনেকক্ষণ অবধি শাহজিদ তার মস্তিষ্কের ঘেরাটোপে শুধু একটি বাক্যই প্রতিধ্বনিত হতে শুনল। কে যেন অট্টহাসি হেসে ভর্ৎসনা করতে লাগল অনবরত, ‘একজন অসহায় মানুষ…হ্যালো…তুমি একজন অসহায় মানুষ…অন্য লোকের দয়ায় বেঁচে আছ…তুমি জানো?’
মুর্তজা সাহেব এই বাড়িতে শাহজিদকে আশ্রয় না দিলেও সে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে পারত। তবুও তুরিনের বলা কথাটায় অমন খোঁচা লাগল কেন? হয়তো মেয়েটা শাহজিদের ভেতরকার অসহায়ত্বকেই ইঙ্গিত করেছে। কোনকোন নির্জন সন্ধ্যায় শাহজিদের খুব একলা লাগে। মনে হয় পাশে কেউ এসে বসুক। দু-চারটা কথা বলুক, বিকলাঙ্গ হিসেবে নয়, করুণা থেকে নয়, একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করুক। এই চাওয়া যখন অপূর্ণ থেকে যায়, তখন সত্যিই কী নিদারুণ এক অসহায়ত্ব মাতম তুলে বুকটাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে একদম ছারখার করে দেয়! এই বিপুলা পৃথিবী নিষ্ঠুর এক অট্টহাসি হেসে কটাক্ষ করে বলতে থাকে, ‘তুমি একা! তুমি একা!’ তুরিন বোধহয় এই মানসিক অসহায়ত্বের কথাই ব্যক্ত করেছে তার বান্ধবীকে।
এক রত্তি বাতাস নেই। গাছপালাসহ গোটা আকাশ শীতের দাপটে জমে হিম হয়ে গেছে। হঠাৎ হঠাৎ থপ করে গাছের ডাল থেকে খসে পড়ছে বরফের গোলা। জলের কলতানের সঙ্গে মানুষের কণ্ঠস্বরও শোনা যায়। দু-একটা চাপা গলার স্বর। একটা কালো মোটা বুনো বিড়াল শাহজিদকে দেখে কোত্থেকে যেন ছুটে আসে অন্ধকার ফুঁড়ে। ওর পায়ের কাছে ঘুরঘুর করে। শাহজিদের মনে হয় তারই মতো বুনো বিড়ালটাও বুঝি একদম একা। আচমকা একটা আর্তচিৎকার আঘাত হানল কানের পর্দায়।
সতিনের সংসার
শাহজিদের ঘর থেকে ফিরে এসে ফারা তুরিনকে আর ত্রিসীমানায় খুঁজে পেল না। রাতে ডিনারের দাওয়াত আছে। তুরিনেরও যাওয়ার কথা। এদিকে শ্বশুরমশাইয়ের পছন্দের পাত্র এসে বসে আছে সকাল থেকে। ছেলেটার সঙ্গে এখন পর্যন্ত দেখা করার সুযোগ হয়নি। ঘড়ির কাঁটা সাতটার ঘর পেরিয়ে গেছে। জাহিদ ফেরেনি এখনো। দোতলার হলওয়ে ধরে অন্যমনস্কভাবে হাঁটছিল ফারা। সেলফোন হাতে নিয়ে জাহিদের নাম্বারে কল করতে যাবে, ঠিক সেই মুহূর্তে পাশের ঘর থেকে একটা পুরুষালি কণ্ঠ ভেসে এলো। থমকে গেল পা। এই ঘরে নিশা থাকে তার বাচ্চাকে নিয়ে। জাহিদ এখানে কী করছে? ঘরের দরজা হাট করে খোলা। ফারা গলা বাড়িয়ে ভেতরটা দেখল একবার। নিশা কর্নারের টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে কিছু একটা করছে। খুব সম্ভবত বাচ্চার খাবার রেডি করছে। জাহিদ বিছানার ওপর বসে আছে বাচ্চা কোলে নিয়ে। তার পরনে অফিসের শার্ট প্যান্ট, টাই। পায়ে বুট জুতো। বাচ্চাটা ছোট্ট হাত বাড়িয়ে জাহিদের পাতলা ফ্রেমের চশমা ধরার চেষ্টা করছে। হাতদুটো চশমা বরাবর এগিয়ে যেতেই জাহিদ মাথা পেছনে সরিয়ে নিচ্ছে। পুরো প্রক্রিয়াটাতে বাচ্চা খুব মজা পাচ্ছে। ফ্যাকফ্যাক করে হাসছে ফোকলা দাঁতে। হাসছে জাহিদও। দৃশ্যটা দেখে ফারার অন্তরের অন্দরমহলে অগ্নিলাভা জ্বলে উঠল ভস করে। যেদিন খবর পেয়েছিল নিশার গর্ভে পুত্রসন্তান নয়, এসেছে কন্যাসন্তান, সেই দিনটি ফারার জীবনের সবচেয়ে খুশির দিন ছিল। যেন একটা পাষাণভার নেমে গিয়েছিল বুক থেকে। কন্যাশিশুটির প্রতি শ্বশুরমশাইয়ের তেমন কোন স্নেহের প্রকাশ ছিল না প্রথমে। জাহিদ তো দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে বরাবরই উদাস। হাসপাতাল থেকে ফেরার পর প্রথম দুমাস সে সন্তানকে কোলে নেয়নি। ফিরেও তাকায়নি। এই আচরণে ফারা সুখী ছিল, নিশ্চিন্ত ছিল। বাচ্চা তার দাদি এবং মায়ের কাছেই লালিত পালিত হচ্ছিল। এক ছুটির সন্ধ্যায় ভাশুর শহিদ এবং তার স্ত্রী নীলিমাসহ ডেকের ওপর বসে আড্ডা দিচ্ছিল সবাই। শ্বশুর-শাশুড়ি বাড়িতে অনুপস্থিত। জাহিদ গাড়ির ওয়ার্কশপে গিয়েছিল। ফিরেছে মাত্র। একটা চেয়ারে বসে জুতোর ফিতা খুলছে। ঠিক সেই সময় নিশা উদয় হলো দৃশ্যপটে। কোলের বাচ্চা কাঁদছে খুব। শ্বশুর-শাশুড়ি ব্যতীত পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে নিশার সম্পর্ক স্বাভাবিক নয়। ওর সঙ্গে কেউ প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না। পারতপক্ষে নিশা পারিবারিক আড্ডায় এসে বাগড়া দেয় না। সেদিন ওর আকস্মিক উপস্থিতিতে সকলে চমকে গিয়েছিল। একটা লাল রঙের ঢোলা-ঢালা নাইটি তার পরনে। চোখে-মুখে ক্লান্তি। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ডান গালে কয়েকটা চুল ঘামে লেপ্টে আছে। তবুও তাকে অপূর্ব সুন্দর লাগছে! নিশাকে দেখার আগে ফারার ধারণা ছিল শ্বশুরমশাই বাংলাদেশের অজপাড়াগাঁ থেকে গাইয়া একটা মেয়ে তুলে এনেছে। কিন্তু সেই গাইয়া মেয়েটাকে নিজ চোখে দেখার পর…বলতে নেই ভেতরে একটা দারুণ রকমের ধাক্কা এসে লেগেছিল। তার এতদিনের অহংকার, সাহস, আত্মবিশ্বাস সমস্তটাই যেন উবে গিয়েছিল হাওয়ায়। ফারা নিজে সুন্দরী বটে কিন্তু এতটাও নয়। এই মেয়ের ধারেকাছে সে দাঁড়াতে পারবে না।
নিশা কারো দিকে না তাকিয়ে ক্রন্দনরত জুবিনকে জাহিদের দিকে এগিয়ে দিয়ে স্তিমিত কণ্ঠে বলল, ‘ওকে একটু রাখবেন কিছুক্ষণের জন্য? আমি বাথরুমে যাব। মা নেই বাড়িতে।’ জাহিদের চশমা পরা ভদ্র গোছের ফরসা, ধারালো মুখখানায় একটা অপ্রস্তুত ভাব খেলে গেল মুহূর্তের জন্য। সংকুচিতভাবে একবার তাকাল সে ফারার দিকে। ফারা চোখ সরিয়ে নিল। পরিস্থিতি সামাল দিতে নীলিমা বলল, ‘আমার কাছে দাও।’ জাহিদ চট করে উঠে পড়ল বসা থেকে। হাত বাড়িয়ে জুবিনকে কোলে তুলে নিয়ে বলল, ‘তুমি বসো ভাবি। আমি দেখছি।’ নিশা বাচ্চাকে বাপের কোলে তুলে দিয়ে প্রস্থান করল। সেই প্রথম জুবিনকে কোলে নিয়েছিল জাহিদ। ফারা দেখেছিল সেদিন ওর মুখটা। কী ঝলমলে! কী সুখী! পিতৃত্বের অহংকারে রমরম করছে ওই মুখ।
চুঁ শব্দটি না করে নিজের ঘরে ফিরে এল। শরীর কাঁপছে প্রতিবাদের জোয়ারে। বুকে আগুন। এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। এভাবে চলতে পারে না। জাহিদকে দুই স্ত্রীর মধ্যে যেকোনো একজনকে বেছে নিতে হবে। ফারা নিজেই খুব দ্রুত একটা সিদ্ধান্ত নেবে। তুরিনকে নিয়েই যত চিন্তা। মেয়েটার বিয়ের ব্যবস্থা করতে পারলে ভালো হয়। যা বদরাগী হয়েছে! ওর জন্য সহনশীল কোন সঙ্গী প্রয়োজন। যে ছেলেটি এসেছে আজ সকালে তার স্বভাবচরিত্র কেমন কে জানে! ফারা ঠিক করল এখুনি একবার ছেলেটির সঙ্গে দেখা করবে। দ্রুত পায়ে নিচে নেমে এলো সে।
বিনা মেঘে বজ্রপাত
সন্ধ্যা নেমে গেছে। লাল কুসুমের মতো সূর্যটা রকি মাউন্টেনের পেছনে এইমাত্র টুপ করে ডুবে গেল। সম্মুখের পাহাড়ের দিকে আনমনে চেয়ে থেকে সিগারেটে আগুন ধরিয়েছিল তুরিন। সে বসেছে ছাই রঙের একটা পাথরের ওপর। পাথরে বরফের আস্তর পড়েছিল। বসার আগে পরিষ্কার করতে হয়েছে। জল গড়ানোর শব্দ ছাড়া অন্য কোন শব্দ নেই ধারেকাছে। তুষার ঢাকা সাদা ভূতের মতো গাছগুলো এক বিন্দুও নড়ছে না। হাওয়ার অস্তিত্ব নেই ত্রিভুবনে। তুরিনের গায়ে মোটা কাপড়ের জ্যাকেট। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে স্থাণুবৎ হয়ে বসে আছে সে। হৃদয়জুড়ে একটা অহেতুক অকারণ হাহাকার বেজে চলেছে। শাহজিদের মুখ নিঃসৃত কথাগুলো কিছুতেই ভুলতে পারছে না। অপমান সহ্য করার ক্ষমতা নিয়ে সে জন্মায়নি। নিশা পারে, চুপচাপ মুখ বুজে সব কথা হজম করতে। কিন্তু তুরিনের মতো মেয়েরা অপমান সহ্য করা তো দূরে থাক তিল পরিমাণ অবহেলাও সইতে পারে না।
ক্রিকের ওপরে পারাপারের জন্য একটা ব্রিজ আছে। তুরিন দেখল ব্ৰিজ ধরে অন্ধকারে একটা ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসছে। ছায়ার অবয়ব দেখে চিনতে পারল। কার্লোস। এই পাড়ায়ই থাকে। হালকা-পাতলা বন্ধুত্ব আছে ওর সঙ্গে। হাই স্কুল পর্যন্ত একসঙ্গে পড়েছে। কার্লোস ব্রিজের মাঝ বরাবর এসে থমকে দাঁড়াল। সিগারেটের আগুনের ওঠানামা লক্ষ করল বোধহয়। চিৎকার করে ইংরেজিতে বলল, ‘কে ওখানে?’
তুরিন কোন উত্তর দিল না। চুপচাপ সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে লাগল। কার্লোস ব্রিজ থেকে নেমে পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো ক্রিকের ধারে। ওর হাতে ব্রান্ডির বোতল। হাঁটার ধরন অবিন্যস্ত। চলতে গিয়ে একবার বরফে পা পিছলে যাচ্ছিল। সামলে নিল।
—‘কী খবর?’ মাতাল গলায় প্রশ্নটা ছুড়ে দিয়ে তুরিনের পাশে বসল কার্লোস, পাথরের ওপর। ব্র্যান্ডির বোতল এক চুমুকে শেষ করে ছুড়ে ফেলে দিল ক্রিকের স্রোতে। ঝপাং করে একটা শব্দ হলো জলে। তুরিন নিঃস্পৃহভাবে ধোঁয়া ছাড়ল সিগারেটের। ধোঁয়াটা সরাসরি কার্লোসের মুখে গিয়ে পড়তেই সে কেশে উঠল খুকখুক শব্দে। তুষারঢাকা সাদা রাত্তিরের একটা নিজস্ব আলো আছে। সেই আলোতে কার্লোস তুরিনের মুখখানা একবার ভালো মতো দেখে নিয়ে অস্পষ্ট জড়ানো গলায় বলল, ‘কী হয়েছে তোমার?’
তুরিন একটু সময় কার্লোসের ফরসা ফোলা ফোলা মুখটার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকল, তারপর কেমন দ্বিধাজড়িত গলায় বলল, ‘আমাকে দেখে তোমার কী মনে হয়?’
—‘কী আবার মনে হবে?’
—‘না মানে…আমাকে কি তোমার কখনো অ্যাট্রাকটিভ মনে হয়নি? আমি কি যথেষ্ট সুন্দরী নই?’
প্রশ্ন শুনে কার্লোস একটু থমকাল। ঢোক গিলল একবার। তারপর আরেকটু ঘনিষ্ঠ হয়ে বসল। লুব্ধ গলায় বলল, ‘কে বলবে তুমি সুন্দর নও? কার এত স্পর্ধা?’
—‘বলেছে এক অহংকারী বাজে লোক!’
—‘আমি ওই লোকের মাথায় গুলি করে দেব। এসো আমার কাছে।’ কথাটা বলেই কার্লোস তুরিনকে দু হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরল। তুরিন এক ধাক্কায় সরিয়ে দিল ওকে। কার্লোসের মাতাল শরীর ভারসাম্য ধরে রাখতে পারল না। পড়ে গেল পানিতে। চিৎকার করে একটা গালি ছুড়ে দিয়ে বলল, ‘তোমার এত সাহস? তুমি আমাকে ফেলে দিলে?’
তুরিন বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। ঘটনা এদিকে গড়াবে ভাবতে পারেনি। বেশ নার্ভাস লাগছে এখন। কম্পিত গলায় বলল, ‘তুমি কী করতে যাচ্ছিলে? এসব কী ধরনের অসভ্যতা?’
এদিকে জল তেমন গভীর নয়। অনেকদূর অবধি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে পাথর। পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে ক্রিকের শীর্ণ স্রোত। কার্লোসের মাথায় বেশ লেগেছে। টনটন করছে ব্যথায়। তবে ব্যথার চাইতেও রাগের প্রাবল্য বেশি। হাঁটুজলে ডুবে আছে সে। তুরিন দাঁড়িয়ে আছে পাথরের ওপর। কার্লোস আচমকা হাত বাড়িয়ে তুরিনের একটা পা ধরে ফেলল। দিল হ্যাঁচকা টান। তুরিন মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল। পাথরে ঘষা খেয়ে, ছেঁচড়ে পড়ল জলে। কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে এলো আর্তচিৎকার। ভাগ্যিস মাথাটা বেঁচে গেল। কিন্তু কোমরে এত বেশি লাগল যে মনে হচ্ছিল শিরদাঁড়া গুঁড়িয়ে যাচ্ছে ব্যথায়। রাগে অন্ধ হয়ে কার্লসের গাল বরাবর একটা চড় বসিয়ে দিল তুরিন। কার্লোসের তখন মদের নেশা চড়াও হয়েছে। লুপ্ত হয়েছে নৈতিকতা বোধ। তুরিনকে সে মনে মনে বহুদিন ধরে কামনা করে আসছিল। তুরিন কখনো গ্রাহ্য করেনি। আজকের এই অপমান সেই কামনার স্ফুলিঙ্গকে প্রতিশোধের আগুনে রূপান্তরিত করে দিল। শরীরের সমস্ত শক্তি জড়ো করে সে তুরিনের গালে একটা চপেটাঘাত করে বসল। সাংঘাতিক চড়টা খাবার পর তুরিনের মনে হলো পৃথিবী ভোঁ-ভোঁ করে ঘুরছে। ঝাঁ-ঝাঁ করছে কান। যেন মাথাটা আরেকটু হলেই খসে পড়ে যাবে দেহ থেকে। রাগে অন্ধ হয়ে গলা টিপে ধরল কার্লোসের। কিন্তু শক্তিতে পারল না। কার্লোস তাকে এক ধাক্কায় দূরে সরিয়ে দিল, পরমুহূর্তেই পাঁচ আঙুল বসিয়ে দিল গলায়। হাঁটুতে শীতল জলের ধাক্কা এসে লাগছে। পায়ের তলায় স্যাঁতসেঁতে পিচ্ছিল মাটি। তুরিন ভারসাম্য টিকিয়ে রাখতে পারল না। পাথরের ওপর হেলে পড়ল। মনে হলো যন্ত্রণায় শরীরটা দুই টুকরা হয়ে যাচ্ছে। গলায় কার্লোসের আঙুলের দুঃসহ চাপ। চোখ বেরিয়ে আসতে চাইছে কোটর থেকে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে ক্রমেই। ছেলেটার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? তুরিনকে কি মেরে ফেলবে? মেরে লাশ ভাসিয়ে দেবে ক্রিকের পানিতে? অনেক চেষ্টা করেও নিজেকে এই শ্বাপদ থাবা থেকে মুক্তো করতে পারল না। এবার হাল ছেড়ে দিল। গলা দিয়ে শুধু গোঁ গোঁ শব্দ বেরোতে লাগল।
—‘কী হচ্ছে ওখানে?’
হঠাৎ আসা কণ্ঠস্বরটা থমকে দিল কার্লোসকে। টর্চের হলুদ আলো চোখ ধাঁধিয়ে দিল। কার্লোস তুরিনের গলা থেকে হাতের আঙুল আলগা করল। আগুন চোখে টর্চধারীর দিকে চেয়ে বলল, ‘কী চাই?’
টর্চের আলোটা তুরিনের মুখের ওপর পড়তেই শাহজিদ চমকে উঠল 1 তুরিন এখন ভয়ংকরভাবে কাশছে। কাশির দমকে যেন ফুসফুসটাই উগড়ে দেবে গলা দিয়ে। শাহজিদ অত্যন্ত কঠোর গলায় কার্লোসকে বলল, ‘কী হচ্ছিল? তুমি কী করছিলে? ওয়েইট…আমি এখুনি পুলিশ কল করছি।’ কথাটা বলতে বলতে পকেট থেকে সেলফোন বের করল। কার্লোস অনবরত আজেবাজে গালাগাল দিচ্ছিল। চকিতে লাফ দিয়ে ডাঙ্গায় উঠে এলো সে। এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে প্রবলভাবে একটা লাথি বসিয়ে দিল শাহজিদের পেটে।
কে তুমি সুন্দর কন্যা
অর্ণব এত বড় বাড়ি এর আগে কখনো দেখেনি। শনির আখড়ায় দুই-কামরার ভাড়াবাসায় থাকত। ইউএসএ আসার পর মেরিল্যান্ডে সাতজন ছাত্র মিলে ওয়ান বেডরুম অ্যাপার্টমেন্টে থেকেছে। ছারপোকার যন্ত্রণায় রাতে ঘুমোতে পারত না। সকাল বেলা বাথরুমে লাইন। কী দুর্বিষহ জীবন। কিন্তু এখানে, আজকের এই হিম জড়ানো শীতের দিনটায়, লাল রঙের দামি কার্পেট মোড়ানো ঝাঁ-চকচকে লিভিংরুমে বসে থেকে অর্ণবের মনে হচ্ছিল দুর্ভাগ্যের নাগপাশ এবার সত্যি কেটে গেছে। ভাগ্যের চাকাটা ঘুরে গেছে অবশেষে। কলোরাডোতে ঠাণ্ডা বেশি এটাই একমাত্র সমস্যা। বসন্ত কালেও ঝিরঝির বরফ পড়ে। তাজ্জব কাণ্ড।
.
লিভিংরুমে আপাতত কেউ নেই। ফায়ারপ্লেসের সামনে রাখা আরামদায়ক কাউচে গা এলিয়ে দিয়ে মহাআনন্দে পা নাচাচ্ছিল অর্ণব। মনে মনে সে বেশ কিছু পরিকল্পনা এঁটে ফেলেছে। ঠিক করেছে বিয়ের পর কটা দিন শ্বশুরবাড়িতেই থাকবে। তারপর ভালো একটা চাকরি পাবার পর বউ নিয়ে নতুন বাসায় মুভ করবে। তবে প্রথমেই শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে এই বিষয়ে কিছু বলবে না। ভাবটা এমন দেখাবে যে সে ঘরজামাই প্রথার ঘোর বিরোধী। যে করেই হোক আত্মসম্মানটা টিকিয়ে রাখতে হবে।
দুপুরের খাবারটাও হয়েছে জম্পেশ। অনেকদিন পর এত পদের খাবার খেয়ে পেট ভরার পাশাপাশি মনটাও ভরে গেছে কানায় কানায়। খাবার টেবিলে একজন বয়স্ক মহিলার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে। আপ্যায়ন করছিলেন। জানা গেল তিনি কন্যার দাদিজান। দাদিজানের ব্যবহার মাশাআল্লাহ অতি অমায়িক। অর্ণবকে তিনি এর মাঝেই বাড়ির জামাই বলে গণ্য করছেন সেটা কথার ধরন দেখেই বোঝা গেছে। সবই ঠিক আছে, শুধু পাত্রীকে নিয়েই যা একটু সমস্যা। এত বদরাগী তেজি মেয়ে অর্ণব এর আগে কখনো দেখেনি। এই মেয়ে খুব সহজে বিয়েতে রাজি হবে বলে মনে হয় না। একটু চোখ লেগে এসেছিল। হঠাৎ একটা শব্দ হলো। ছেদ পড়ল ঘুমের আবেশে। উঠে বসল ধড়মড় করে। অপ্রস্তুতভাবে কুঁচকে যাওয়া ফুলহাতা শার্টটা একটু ধাতস্ত করে নিল। একজন ভদ্রলোক ঢুকেছেন ভেতরে। পরনে কালো স্যুট। সাদা চুল, সোনালি চাপদাড়ি। বয়স বোঝা মুশকিল। অর্ণব সালাম দিল বিনীতভাবে। সহাস্যবদনে সালামের উত্তর দিয়ে ভদ্রলোক বললেন, ‘তুমি অর্ণব?’
—‘জি।’ অর্ণবের গলার স্বরে বিনয় ঝরে পড়ল।
ভদ্রলোক হেসে বললেন, ‘বেশ বেশ। কেমন আছ? আমি মুর্তজা।’
হবু দাদাশ্বশুরের উপস্থিতি অর্ণবকে মোমের মতো গলিয়ে দিল একদম। ফট করে পা ছুঁয়ে সালাম করে ফেলল। আসার আগে খুব লজ্জা লাগছিল, সংকোচ হচ্ছিল এই ভেবে যে সে যেচে পড়ে ঘরজামাই হতে চলে এসেছে সুদূর মেরিল্যান্ড থেকে। কিন্তু এদের ব্যবহার এত আন্তরিক! অর্ণবের এখন আর একটুও সংকোচ হচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেন এরা কত কালের চেনা! মুর্তজা সাহেব সদ্য পরিচিত যুবকটির ভদ্রতায় মুগ্ধ হলেন। ছেলেটা বেশ লম্বা। মায়াভরা মুখ। একটু রোগা, তবে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শরীর ফিরে যাবে। সবচেয়ে বড় কথা এই ছেলে মেধাবী। নাতনির জন্য একজন মেধাবী পাত্র খুঁজছিলেন তিনি। অর্ণবের কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘তুমি খেয়েছ?’ অর্ণব উত্তর দিতে যাচ্ছিল। হঠাৎ একজোড়া পদশব্দ মুখের কথা কেড়ে নিল। হাই- হিল জুতোয় টুকটুক আওয়াজ তুলে একজন নারী সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো নিচে। আঁটসাঁট সাদা শার্ট, কালো স্কার্ট। ছিপছিপে মেদহীন শরীর।
ফারার আগমনে মুর্তজা সাহেবের কপালে বিরক্তিমাখা কুঞ্চন সৃষ্টি হলো। ছোট ছেলের প্রথম স্ত্রীকে তিনি বিশেষ পছন্দ করেন না। বাধ্য হয়ে এই মেয়ের সঙ্গে ছেলের বিয়ে দিয়েছিলেন। ছেলের বয়স তখন নিতান্তই অল্প। মেয়েটি সমবয়সি। একসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত। পড়াকালীন সময়েই ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছিল বলে সামাজিক চাপে পড়ে বিয়েটা দিতে হয়েছিল। বিয়ের সময় তুরিন তার মায়ের পেটে। অর্ণব বেশ বিব্রত বোধ করছিল। মুর্তজা সাহেব হালকা কেশে নিয়ে বললেন, ‘এই হলো তুরিনের মা।’
চক্ষুদুটো এবার ছানাবড়া হওয়ার দশা। হাঁ হয়ে গেল অর্ণব। তুরিনের মা? মানে তার শাশুড়ি? এত ইয়াং! এত সুন্দর! কীভাবে সম্ভব? সালাম দিয়ে ব্যাক্কলের মতো চেয়ে থাকল শুধু। পা ছুঁয়ে কদমবুসি করা ঠিক হবে কি না এই নিয়ে একটু দোলাচলে পড়ে গেল।
‘বসো বসো। দাঁড়িয়ে কেন?’ বলতে বলতে ফারা নিজেই একটি সোফায় পায়ের ওপর পা তুলে বসে পড়ল। শ্বশুরের তোয়াক্কা করল না। মুর্তজা সাহেব ঘটনাটা আড়চোখে একবার লক্ষ করলেন। তারপর প্রস্থানোদ্যত হয়ে অর্ণবকে বললেন, ‘আমি একটু ফ্রেশ হয়ে নিই। তোমার সঙ্গে ডিনারের টেবিলে আলাপ হবে, কেমন?’ ফারা শ্বশুরের দিকে বাঁকাচোরা চোখে তাকাল একবার। বুড়ার কথা বলার ধরন দেখলে মনে হয় যেন মানুষ হিসেবে সে অতি উদারচেতা এবং উন্নতমনা, অথচ সেই হলো এ সংসারের সমস্ত অশান্তির নাটের গুরু। তুরিনের বিয়ের ব্যাপারেও অন্য কারো মতামতকে প্রাধান্য দেবে না,ফারা তা খুব ভালো মতো জানে। তবে নিজের মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে কোন রকম কম্প্রোমাইজ করবে না বলে মনঃস্থির করেছে। ছেলে পছন্দ না হলে সরাসরি নাকচ করে দেবে।
লিভিংরুমের পাশঘেঁষে দোতলা যাওয়ার ঘুরানো সিঁড়ি। অর্ণবরা যেখানে দাঁড়িয়েছে সেখান থেকে মুখ তুলে তাকালেই দোতলার লফট দেখা যায়। অর্ণব সোফায় বসতে বসতে লক্ষ করল সিঁড়ি বেয়ে দুজন মানুষ নিচে নামছে। একজন সুদর্শন ভদ্রলোক। তার কোলে একটি ছোট বাচ্চা। ভদ্রলোকের ঠিক পেছনে একটি মেয়ে। গোলাপি রঙের সালোওয়ার-কামিজ তার পরনে। চুলে একটা হৃষ্টপুষ্ট বিনুনি। চোখে-মুখে কী এক আশ্চর্য রূপের মাধুর্য ছড়ানো! মেয়েটি সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে মুর্তজা সাহেবকে একবার প্রশ্ন করল, ‘বাবা আপনাকে চা-কফি কিছু দেব?’
মুর্তজা সাহেব প্রসন্ন কণ্ঠে বললেন, ‘না মা। একটু আরলি ডিনার করব আজকে। খানা লাগাও টেবিলে।’
মেয়েটি নিঃসন্দেহে অন্যরকম। এবাড়ির বাকি সদস্যদের সঙ্গে এর কোথায় যেন একটা বিষদ পার্থক্য আছে। কিন্তু তার চোখে মুখে ভাবাবেগের চিহ্ন মাত্র নেই। কেমন যেন যান্ত্রিক। নিচে নেমেই রোবটের মতো রান্নাঘরের দিকে ছুটে গেল। অর্ণবের চোখে আচমকা কেমন যেন এক ঘোর লেগেছে। মেয়েটা এলো আর গেল…কিন্তু যাওয়ার আগে খসখস করে বুঝি একটা বইয়ের পাতা উল্টে দিয়ে গেল। অর্ণবের একটু আগের বৈষয়িক, সজাগ মনটা হঠাৎ কেমন আনমনা হয়ে উঠল।
সুদর্শন ভদ্রলোক কাছাকাছি এসে বললেন, ‘তোমার নাম অর্ণব?’ অর্ণব অন্যমনস্কভাবে উত্তর দিল, ‘জি।’
—‘আমি জাহিদ। তুরিনের বাবা।’
আরেকবার খাবি খাওয়ার দশা হলো অর্ণবের। এমন যুবক দেখতে একটা লোকের তুরিনের বয়সি মেয়ে আছে ভাবাই যায় না। ইনাকে বরং কোলের ন্যাদা বাচ্চাটার বাবা হিসেবেই মানায়। এই বাড়ির সবকিছুই কেমন যেন অদ্ভুত! সামনে দাঁড়ানো অল্পবয়সি দেখতে জুটিটিকে কিছুতেই শ্বশুর-শাশুড়ি হিসেবে মেনে নিতে ইচ্ছে করছিল না অর্ণবের। সে অতিশয় কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে সালাম দিল জাহিদকে।
Thank you so much for posting this book..so grateful