বনচর—শবর-ব্যাধ
মা বলেছিলেন—’ধনকে নিয়ে বনকে যাব’, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ‘সেথায়’ কী খাবেন এই দুশ্চিন্তায় তাঁর আর বনে যাওয়া হল না, তিনি ঘরে বসে পুত্রের মুখচন্দ্র দর্শন করেই যুগপৎ বনবাস এবং খাওয়ার কষ্ট থেকে মুক্ত হতে চাইলেন। আবার মার্কণ্ডেয়-চণ্ডী দেখুন—সুরথ রাজা পুত্র-পরিবারের লাথি-ঝাঁটা খেয়ে মনের দুঃখে একা একাই ঘোড়ায় চেপে চলে গেলেন বনে—একাকী হয়মারুহ্য জগাম গহনং বনম। শোকে তাপে ন্যুব্জ মানুষকে বনে পাঠানোর জন্য শাস্ত্রকারের সুভাষিত কিংবা উস্কানিরও অভাব ছিল না। পুরাণ-মুনি তাঁর বরাভয়ের মুদ্রাটি উঁচিয়ে বললেন—মা ভৈঃ, ভয় কি! গোরু দুইতে যতটুকুন সময় লাগে, ততটুকু সময়ও আমি গেরস্থর ঘরে কাটাইনি, আর তুমি থাকবে কোথায় সেই চিন্তায় মরছ! কেন, ভূমি কি তার বকুল-বিছানো শয্যা বিছিয়ে রাখেনি কোথাও, হাতের মতো একটা স্বতঃসিদ্ধ বালিশ থাকতে আবার শোয়ার চিন্তা কী? অঞ্জলিবদ্ধ একখানি পাত্র থাকতে বাসনকোসনেরই বা কি দরকার! লজ্জানিবারণের মতো জীর্ণ বস্ত্রখণ্ড রাস্তাতেই পাওয়া যাবে কত শত। মুনি বললেন—খাওয়া-দাওয়ার কথাও যেন ভেব না, কেননা গাছ এখনও ফলের ভিক্ষা দিতে ভোলে না, নদীগুলোও যায়নি শুকিয়ে—কিং দিশন্তি ভিক্ষাং নৈবাঙঘ্রিপাঃ পরভূতঃ সরিতো’প্যশুষ্যন—আর বসবাসের উপযোগী পর্বত-গুহা কি কারও জন্যে রুদ্ধ?
এই যে উন্মুক্ত বনরাজ্যে সবাইকে আমন্ত্রণ জানালেন ঋষি, তার উদ্দেশ্য কিন্তু বেশিটাই ক্লিন্ন সংসার-পাশ থেকে মুক্ত করা বাসনা। কবি ঝগড়া করে বলবেন—সে আবার কি কথা! বনবাসে আবার দুঃখ কিসের? বর্ষা-শীতের শত্রু ছাড়া বনবাসে সবটাই তো আনন্দ। সবুজ গাছের ছায়ে রাত্রি জেগে সাধ্যসাধন, বানপ্রস্থ বুঝি যৌবনেতেই ভালো মানায়, তবে হ্যাঁ, ভালোরকম তপস্বী হবার জন্যে একটি জব্বর তপস্বিনীও দরকার। সহৃদয় পাঠককুল, ঋষির কথা কিংবা কবির রসিকতায় একটুও বিভ্রান্ত হবেন না। কেননা যাদের কথা বললাম এবং কেউই আসল অর্থে বনবাসী নয়। কেউ অতি-কৌতুকে, কেউ-বা অতি-দুখে, কেউ-বা অতি-সুখে বনে যেতে চান। কারণে-অকারণে বনে যাওয়া এক জিনিস, আর বনে থাকা আরেক জিনিস। আমরা জানি ‘বনে থাকে বাঘ, গাছে থাকে পাখি,’ ঠিক এইরকম সহজভাবে যে মানুষ বনে থাকে, সেই তো বনবাসী—আরণ্যক।
যে শুধু অরণ্যে বাস করে তাকেই যে আরণ্যক বলব—এ কথাটা এমনি করে প্রথমে বলেছিলেন পাণিনি। সত্যি কথা বলতে কি ভারতবর্ষের যে সভ্যতা আর্যরা বয়ে এনেছিলেন, সে তো অরণ্যেরই সভ্যতা। বন থেকে বনান্তরে ঘুরে বেড়ানোই ছিল তাঁদের অভ্যাস। ভারতবর্ষে যাঁরা ছিলেন প্রাচীন, যাঁরা পাষাণকায়া রাজধানী তৈরি করেছিলেন সিন্ধু নদের অববাহিকায়, তাঁদের পুরী-নগরী ভেঙে দিয়ে যে পুরন্দরেরা ভারতবর্ষ জুড়ে বসলেন তাঁদের স্বপ্নে ছিল বনরাজ্যের মায়া, অন্তরে ছিল জ্যোৎস্নাভিসারের মাধুরী। কিন্তু হলে হবে কি, পরাভূতের শিল্প আয়ত্ত করতে সময় লাগে না। ইঁটকাঠের মোহ এমনই যে নগর তৈরি করতে আর্যদের সময় লাগল না। অরণ্যের কৃষ্টি থেকে যাঁদের গ্রন্থের নাম হয়েছিল আরণ্যক, বৃহদারণ্যক, তাঁরা যেন দৈনন্দিন সমিৎ আহরণের থেকে অশ্বমেধ বেশি ভালোবেসে ফেললেন। দিনান্তের সূর্য অরণ্যের দীপাগ্নিতে যতটকু তেজ মিশিয়ে রেখে গেল তাতে জ্বলে রইলেন শুধু ঋষিরা। ঋষিদের আমরা তাই অবশ্যই বনবাসী বলব, যাঁরা তাঁদের বংশবাহিত অরণ্য সংস্কার ভুলতে পারেননি। তাঁদের তপঃপ্রভাবে বাঘ আর কৃষ্ণসার মৃগ একই ভূমিতে বিচরণ করত কি না, সেটা বিশ্বাসের পরিসর। অপি চ বনবাসী হলেও ঋষিরা নগরবাসী ক্ষত্রিয়পুরুষের পরাক্রম এবং অস্ত্রচ্ছায়ায় বাস করতেন। বনে থাকাটা তাঁদের পক্ষে যতখানি কষ্টকর ছিল তার চেয়েও অনেক বেশি ছিল সুখের, আনন্দের। নিস্তব্ধ আশ্রম, হোম, যজ্ঞ, তপস্যা, অধ্যয়ন-অধ্যাপনা—এসবও কম বন্ধন নয়, এই বন্ধনেই ঋষিদের মুক্তি। মাঝে মাঝে বন্য শ্বাপদ কিংবা যক্ষ-রাক্ষসের উৎপাত ঘটত—তার জন্যে ক্ষত্রিয় রাজপুরুষের অস্ত্র ছিল সদা জাগ্রত।
রামের ওপর যখন বনবাসের অভিশাপ নেমে এলে তখন তিনি সীতাকে বললেন—আমি বনে যাচ্ছি, যাচ্ছি। তুমি আবার নাচছ কেন—স্থিরীভব মনস্বিনি। প্রথমে রাম বলেছিলেন—আমি বনে যাচ্ছি এবং বন হল মুনিদের জায়গা—মুনিগণ-নিষেবিতম। কিন্তু সীতার বায়না শুনে রামচন্দ্র মুনি-কল্পনার বিলাস ছেড়ে বললেন—বনের অবস্থা জান তুমি, বনবাস মানেই বিপদ—বহুদোষং হি কান্তারং বনমিত্যভিধীয়তে। সিংহের সিংহনাদ, কুমিরে ভর্তি নদী আর বন্য-কুক্কুটের শব্দ—এই হল বন। তাছাড়া শ্রমে কাতর হয়ে ঘুমাতে হবে আপনা থেকে ঝরা গাছের পাতার বিছানায় শুয়ে। খাওয়ার মধ্যে দিন-রাত্তির শুধু ফল আর ফল, আর মাঝে মাঝে উপবাস। বনবাসীরা যা পায়, সেই ‘যথালব্ধ’ ফল-মূলেই তাদের খাওয়া সারতে হয়—যথাহারৈর্বনচরৈঃ সীতে দুঃখমতো বনম—বনে থাকা বড়ই কষ্টের। পদে পদে সাপের ভয়, কাঁটা, পোকা, বিছে, ডাঁশ, মশা কি নেই। বনে কষ্টের শেষ নেই—বহুদোষকরং বনম। খুব ভেবেচিন্তেই বলছি সীতা,বনে যাওয়ায় তোমার কোনো মঙ্গল নেই।
সীতা শুনলেন না, তিনি বায়না ধরেই রইলেন। তোমার সঙ্গে থাকতে পেলে বনই আমার কাছে স্বর্গ, তোমার সঙ্গে বনে, বনান্তরে ঘুরে বেড়াব। থাক না বাঘ, থাক না সিংহ, তুমি আছ না। কত নদী, কত পাহাড়, কত ফুল—সব তোমার সঙ্গে সঙ্গে দেখব—ত্বয়া বীরেন সঙ্গতা। তোমার সঙ্গে মজা করব আর মধু-গন্ধে ভরা বনে বনে ঘুরে বেড়াব—সহরংস্যে ত্বয়া বীর বনেষু মধুগন্ধিষু। পুরুষের পক্ষে অতি মনোহরা এইসব উক্তি বেশিক্ষণ সহ্য করা সম্ভব নয়। বাল্মীকির ‘মধুগন্ধি বনের’ মাদকতা এত বেশি যে ভবভূতির মতো সার্থক কবি পর্যন্ত এই শব্দদুটি অক্ষুণ্ণ রেখে সীতার বনবাসে সমর্থন যুগিয়েছেন—ত্বয়া সহ নিবৎস্যামি বনেষু মধুগন্ধিষু।
সত্যি কথা বলতে কি, ‘বনবাসী’ শব্দটির মধ্যেই কেমন একটা মাদকতা আছে—আর আছে স্বেচ্ছা, স্বেচ্ছাচার, স্বৈরাচার—যা সর্বত্র প্রযোজ্য। নদী বইছে স্বেচ্ছায়। ‘মর্মর-পত্র-মোক্ষা’ বনস্থলী পাতা ঝরাচ্ছে স্বেচ্ছায়, পশু-পাখিরা স্বেচ্ছাচারী, কাজেই বনে যে থাকবে সেও এক স্বেচ্ছাচারের আনন্দে থাকবে। রামও তাই ছিলেন—বারবার তিনি বলেছেন, বনে এসে ইস্তক অযোধ্যার রাজসুখও তাঁর কাছে লঘু হয়ে গেছে। বন্যপ্রাণী শিকার করে, একবার এই নদীর কূলে বসে, আর একবার ওই পাহাড়ের কোলে তার দিন ভালোই কেটেছিল। কিন্তু তবু তিনি বনবাসী নন, অন্তত প্রকৃত অর্থে বনবাসী নন। তবু আমি রামের কথাগুলি উল্লেখ করলাম এইজন্যে যে, বনে থাকার যে কষ্ট, সে কষ্টগুলি বনে আছে, যে সুখ, সে সুখও বনেই আছে। যারা বনবাসী, তারা এই দুঃখ-সুখ তাদের জীবনে সহজ করেই নিয়েছে। রাম যখন বনে যান, তখন দুঃখজর্জর দশরথ সুমন্ত্রকে ডেকে বলেছিলেন—তুমি ব্যাধদের ডেকে আন যারা বনের রাস্তাঘাটের সব জানে, তারা রামের সঙ্গে সঙ্গে যাবে—অনুগচ্ছন্ত কাকুৎস্থং ব্যাধাশ্চারণ্যকোবিদাঃ। দশরথ যে বনের পথে মুনিঋষিদের ডাকেননি কিংবা অন্য কাউকে ডাকেননি, তার থেকে বোঝা যায় বনবাসী জনগোষ্ঠী বলতে সাধু-সন্ন্যাসী বোঝায় না। বরঞ্চ বোঝায় সেই অবহেলিত অন্ত্যজ জনসাধারণকে যাদের বাঘ-সিংহ, সাপ-কুমিরের সঙ্গে লড়াই করেই বাঁচতে হত। যজ্ঞধূমে আকুলিত দৃষ্টি, সমিৎ-কুশ আহরণে ব্যস্ত উপনিষৎ-নিমগ্ন ঋষিদের চেয়ে ক্রূরকর্মা প্রাণি-ঘাতক ব্যাধই বনের আসল পরিচয়।
ব্যাধ নাকি ‘আরণ্য-কোবিদ’—বনের খুঁটিনাটি সব সে জানে। ব্যাধের জীবন, জীবন-ধারণ এসব নিয়ে আমাদের দুঃখ যত আছে তার চেয়ে বেশি আছে কবিত্ব। এমনকী ব্যাধের থেকে ব্যাধের বউদের ওপর কবিদের চোখ আরও বেশি। ব্যাধকে তো শুধু নিষ্ঠুর, ক্রূর আর বন্য বলেই জানি। কিন্তু ব্যাধের মতো মানুষের বনবাসী জীবনেও মায়া আছে, মমতা আছে, গর্ব আছে, আর আছে ব্যাধ-বধূদের বন্য-সৌন্দর্য। অপনাগর বলে এক কবি লিখেছেন—বনের ঘাস আর বন-বহা জল আপনা-আপনি খেয়েই যে মৃগ আর মৃগীর জীবন চলে, তাদের আমরণ প্রেমও খেয়াল করার মতো। কবির চোখে দেখেছি এ প্রেম বন্য ব্যাধের মধ্যেও সংক্রমিত—সহবাসের পরিচয় বুঝি! সাতবাহন হালের গাথায় দেখা যাবে সতৃষ্ণ হরিণী যখন আকূতিভরে তাকিয়েছিল মৃগের দিকে তখন ক্রূরকর্মা ব্যাধের হাত থেকেও ধনুকটি খসে পড়েছে, তার যে আপন প্রিয়ার কথা মনে পড়েছিল। ব্যাধের কাছে হরিণী এতই সাধারণ লক্ষ যে হরিণীর নিরীহতা তাদের মনেও একধরনের নিশ্চেষ্টতা নিয়ে আসে। হালের কবিতার অন্য এক ব্যাধ তো প্রায় রুখেই উঠেছিল। চামড়ার ব্যাপারী এক পথিক যখন চিত্রল হরিণের চামড়া বেচা এক ব্যাধ-যুবকের ঠিকানা খুঁজতে এসেছিল, তখন রুখে উঠে সেই ব্যাধ বলল—অন্য ব্যাধের পো-দের জিজ্ঞেস করুন গিয়ে—অন্যেষু পথিকং পৃচ্ছ ব্যাধক-পুত্রেষু, আমাদের জোয়ানেরা হরিণ দেখে ধনুক তোলে না।
ব্যাধেরা জোয়ান, ব্যাধেরা সরল কিন্তু ততোধিক সরল বুঝি ব্যাধ-বধূরা আর এইখানেই কবি-দৃষ্টির কত তফাত। উদ্ভট কবি একটি শ্লোক সংগ্রহ করেছিলেন তাতে দেখি এক ভিল-রমণী গজমুক্তা কুড়িয়ে পেয়েছিল। একটি সিংহ হাতির মাথায় নখের আঘাত করেছিল এবং তাতেই সে মারা পড়ায় সেই গজমুক্তার গায়ে ঈষৎ রক্ত লেগে ছিল। বনের মধ্যে হঠাৎ এমন একটি অদ্ভুত জিনিস দেখে ভিল রমণীর মনে হল টোপা কুল বুঝি—কান্তারে বদরীভ্রমাদ দ্রুতমগাদ ভিল্লস্য পত্নী মুদা। কিন্তু হাতে নিয়ে সে যখন দেখল জিনিসটা কীরকম সাদা-সাদা লালচে, আবার শক্তও বটে, তখন ‘দূর ছাই’ বলে সে গজমুক্তা ছুড়ে ফেলে দিল। এই কবি বড় দুঃখ করে বলেছেন—অস্থানে অপাত্রে পড়লে ভালো জিনিসের এমন দুর্গতি হয়।
আমাদের এ দুঃখ নেই কেননা আমরা জানি ব্যাধ-বধূরা ওইরকমই। সাতবাহন হালও আমাকেই সমর্থন করবেন। তিনি বলবেন, শুধুমাত্র গুণ দেখেই মানুষ ভোলে না, ভাবের রসিক সুজন মানুষও আছে। ব্যাধ-পুলিন্দেরা যে মুক্তো ফেলে দিয়ে গুঞ্জাবীচি তুলে নেয় সে শুধু সেই ভাবের রসিক বলে—হ্রিয়তে যঃ যেন ভাবিতঃ তেন—যারা গুঞ্জাফুলের মালা গেঁথে পরে, পরায় গলায়। হাল-কবির আমলে যে ‘ট্র্যাডিশন’ ছিল, তা চলে এসেছে সেই চর্যাগীতির যুগ পর্যন্ত—মোরঙ্গিপিচ্ছপরহিণ সবরী গীবতগুঞ্জরীমালী। ময়ূরের পাখা চুলে গুঁজে, গুঞ্জার মালা গলায় দুলিয়ে যে শবর-বধূটি কবির কল্পনাতে স্থান পেয়েছে তার মধ্যে শহরের আভিজাত্য নেই, আড়ম্বরও নেই। কিন্তু ব্যাধের পরিবারে ময়ূরের পাখা আর গুঞ্জাবীচিরই কদর বেশি, মুক্তো কিংবা গজমুক্তার নয়। পোট্টিস বলে এক প্রাকৃত ভাষার কবির লেখায় সে কথা স্পষ্ট হয়ে গেছে। তিনি লিখেছেন—গজমুক্তা-দোলানো সতীনদের মধ্যে ময়ূরের পালক-গোঁজা ব্যাধ-বধূটিই সবচেয়ে উদ্ধত গর্বভরে চলাফেরা করে—শিখি-পিচ্ছাবতংসা বধূঃ ব্যাধস্য গর্বশীলা ভবতি। এ গর্ব তার স্বামীর গর্ব, ময়ূরের পালক চুলে গোঁজা বধূটিই সবচেয়ে সোহাগী। তবে স্বামী-সোহাগিনী ব্যাধবধূ সম্বন্ধে সবচেয়ে নির্মম শ্লোকটি লিখেছেন গন্ধরাজ নামে আরেক প্রাকৃত ভাষার কবি, যাঁর কবিতা-মুক্তাটি সংগ্রহ করে হাল আবারও আমাদের কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন। গন্ধরাজ লিখেছেন—বাপের বাড়ি থেকে ফিরে এল এক ব্যাধবধূ। সে এসে দেখল তারই বাড়ির করঞ্জ-গাছের ডালে মদগন্ধী এক বন্য হস্তী খুব করে মাথা ঘষে গেছে এবং তার চিহ্নও হয়ে গেছে গাছের শাখায় শাখায়। বধূ বুঝল—তার স্বামী আর বন থেকে ফেরেনি, সে মারা গেছে—জ্ঞাতং ব্যাধ-স্ত্রিয়া পতি-মরণম। কেননা ব্যাধবধূর ধারণা আছে, যে তার স্বামী বেঁচে থাকতে এমন কোনো বুনো হাতির সাহস হবে না যে, তারই বাড়ির গাছে এসে মাথা ঘষে যাবে। মাথা ঘষার আগেই সে মারা পড়বে।
হাল অথবা তাঁর পূর্বতন কবিদের লেখায় ব্যাধ-জীবনের দুঃখ, গর্ব, প্রেম ব্যাধবধূর যৌবনের ওপর অন্যের লালসাও ধরা পড়ে। কেননা হাল লিখেছেন, জোয়ানী ব্যাধবধূর বুক দুটি যতই যৌবনোদ্ধত হতে থাকে ততই ক্ষীণ হতে থাকে আর পাঁচটি জিনিস—এক ব্যাধবধূর মধ্যদেশ, দ্বিতীয় তার স্বয়ং মরদটি, তৃতীয় তার আত্মীয়স্বজন, চতুর্থ গাঁয়ের জোয়ান ছেলেগুলি আর তার সতীনেরা।
কবির ধৃষ্ট রসিকতা রেখে এবারে একটু গম্ভীর তত্ত্বকথায় আসি না কেন! জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রবাদপুরুষ বরাহমিহির পঞ্চম শতাব্দীর শেষের দিকে বৃহৎসংহিতা বলে একখানি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। তাতে দেখি ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় বনটি ছিল দণ্ডকারণ্য। সেই দণ্ডকারণ্য, যেখানে রামচন্দ্র বনবাসে ছিলেন, সেই দণ্ডকারণ্য, যেখানে অগস্ত্য ঋষির আশ্রম ছিল। পৌরাণিক কায়দায় বলতে গেলে দণ্ডকারণ্যের অবস্থিতি ছিল বিন্ধ্য পর্বত থেকে শৈবল পর্বত পর্যন্ত এবং এই অরণ্য বিস্তার লাভ করেছিল গোদাবরী তীরবর্তী জনস্থান পর্যন্ত। কিন্তু পারজিটার বলবেন বুন্দেলখণ্ড থেকে কৃষ্ণা নদী পর্যন্ত সমস্তটাই ছিল দণ্ডকারণ্যের পরিসর। ভারতের মধ্যদেশ ছিল ধর্মারণ্য, মহাভারতের মতে এখানে কণ্বমুনির আশ্রম ছিল আর পণ্ডিতেরা বলবেন ধর্মারণ্য হল এখনকার গারওয়াল আর কুমায়ুন অঞ্চল। দক্ষিণদেশে সবচেয়ে বড় বনটি হল মহাটবী বা মহাকান্তার যা যুদ্ধজয়ের সুবাদে মহারাজ সমুদ্রগুপ্তের শাসনভুক্ত হয়েছিল। আর ছিল নৈমিষারণ্য, যে পুণ্যভূমি আর্যসমাজের চিরকালের মনপসন্দ জায়গা; কত পুরাণ-কাহিনি এই অরণ্যেই কীর্তিত এবং শ্রুত। পুষ্করারণ্য কিংবা বসুবনের কথা না হয় বাদই দিলাম, কিন্তু বৃন্দাবনের কথা তো বলতেই হবে, নইলে ময়ূরপাখার উত্তরাধিকার, রাখালিয়া বাঁশির ধুন—সবই হবে বৃথা। তবু কিন্তু যাযাবর আভীরদের কথা আমরা বলব না, কেননা, ব্যাধ-শবরদের মতো একই ধরনের অন্ত্যজ হওয়া সত্ত্বেও, এমনকী অন্যমতে এই আভীরেরা বিদেশি অন্ত্যজ হওয়া সত্ত্বেও, বড় তাড়াতাড়ি জাতে উঠেছিলেন এবং তার কারণ বোধ হয় কৃষ্ণ ঠাকুর। বনবাসীদের লিস্টি থেকে আমরা তাই আভীরদের নাম ইচ্ছে করেই কেটে দিলাম।
পুরাণে কিংবা রামায়ণ-মহাভারতে আমরা যেসব বনবাসীদের কথা পাই তাদের ভাব-সাব, চেহারাপত্তর সবই একটু রাংতা-মোড়া ভদ্র-ভদ্র। পুরাণকারদের পরিশীলিত লেখনীতে অথবা অন্ত্যজ বনবাসীদের প্রকৃত অবস্থাটি সঠিকভাবে না জানার আলস্যেই হয়তো বা ব্যাধ-শবরদের আসল চেহারাটি পুরাণে ইতিহাসে সেরকম ফুটে ওঠেনি। রাম-লক্ষ্মণ বনে গিয়েছিলেন, পঞ্চ পাণ্ডবও বনে গিয়েছিলেন, কিন্তু সেখানে তাঁরা যত মুনিঋষিদের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন, বনবাসী নিষাদ কিরাত শবরদের সন্ধান তত পাননি। যাও-বা পেয়েছেন, তাদের ব্যবহার-আচার খানিকটা কৃত্রিম। রামায়ণে রামের বন্ধু নিষাদরাজ গুহকে দেখি। তিনি বনে থাকেন বটে কিন্তু বাল্মীকি তাঁর বর্ণনা সেরকম করে দেননি। তিনি রামের ‘আত্মসম’ বন্ধু, তাঁর ব্যবহারও প্রায় আর্যজনোচিত। তাঁর কথাবার্তা যেমন পরিশীলিত, তেমনি ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিখ্যাত স্থপতি—স্থপতিশ্চেতি বিশ্রুত। অবশ্য রাজা বলেও তাঁর আচারে ব্যবহারে আর্যনীতির ছোঁয়াচ লেগে থাকতে পারে। বরঞ্চ রামকে ফিরিয়ে আনতে যাবার সময় ভরত যখন শৃঙ্গবেরপুরে নিষাদরাজ্যে পৌঁছলেন তখনকার রামায়ণী বর্ণনায় নিষাদরাজ গুহকে খানিকটা পাওয়া যায়। নিষাদ রাজা অত্যন্ত বিশ্বস্ত। রামকে সে প্রভুও ভাবে, বন্ধুও ভাবে—ভর্তা চৈব সখা চৈব রামো দাশরথির্মম। ভরতকে দেখেই তার সহজ শঙ্কা হল কৈকেয়ীপুত্র রামের কোনো অনিষ্ট সাধন করবে না তো? ভরতের আসল উদ্দেশ্য কী—সেটা যতক্ষণ বোঝা না যাচ্ছে, ততক্ষণ তিনি তাঁর অনুগামীদের তৈরি থাকতে বললেন। ঠিক এই সময়টিতে আমরা নিষাদরাজার অনুগামীদের একটু পরিচয় পাই। তাদের একদল হল বলবান, মাংস আর ফলমূলভোজী দাস জাতীয়। নদীতে যুদ্ধ করতে তাঁরা অত্যন্ত দক্ষ—বলযুক্তা নদীরক্ষা মাংসমূলফলাশনাঃ। আর অন্য দলটি হল কৈবর্ত—তারা নদীবক্ষে একসঙ্গে পাঁচশো নৌকার বাইচ দিতে পারে। নিষাদরাজের আতিথেয়তাও একটু অন্যরকম। ভরতকে স্বাগত করার জন্য তিনি যেমন নিজে মৎস্য-মাংস এবং মধুর উপহার বাড়িয়ে দিলেন, তেমনি ভরতের সৈন্যবাহিনীর জন্যও তিনি উপযুক্ত ব্যবস্থা রেখেছেন। ভরতকে তিনি বললেন নিষাদেরা স্বয়ং আপনার সেনাবাহিনীর জন্য ফলমূল, শুকনো মাংস এবং আর্দ্রমাংসও সংগ্রহ করে এনেছে—অস্তি মূলফলঞ্চৈতন্নিষাদৈঃ স্বয়মর্জিতম। আর্দ্রং শুষ্কং তথা মাংসং বন্যঞ্চোচ্চাবচং তথা।
এই এতটুকুই যা নিষাদরাজা কিংবা তাঁর অনুচরবর্গের পরিচয়—এছাড়া কিছুই পাওয়া যায় না। নিষাদরাজার আপনজন হিসেবে যে দাস-জাতি এবং কৈবর্তদের কথা পাওয়া গেল তাদের কথা অবশ্য একটু বলতেই হবে। আর্যরা এসে ভারতবর্ষের যে বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে পরাভূত করে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছিল, তাদের নামই হয়ে গেছিল দাস অথবা দস্যু—ত্রিবর্ণের সেবা করাই ছিল তাদের প্রধান কাজ। পরে এই দাসেরাই একাত্ম হয়ে গেছে শূদ্রবর্ণ এবং অন্ত্যজ গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে। ঋগ্বেদে এমন একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়, যে আর্যসমাজের প্রধান যুদ্ধবীর ইন্দ্র দাসবর্ণকে একেবারে নিকৃষ্ট এবং গূঢ় স্থানে মানে গুহায় নির্বাসিত করেন—যো দাসবর্ণমধরং গুহাকঃ। বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন, ”ইহারা যে পরিশেষে আর্যের নিকট পরাজিত হইয়াছিল তাহাও নিশ্চিত। পরাজিত হইয়াই উহারা যে যেখানে বন্য ও পার্বত্য প্রদেশ পাইয়াছিল, সে সেইখানেই আশ্রয় গ্রহণ করিয়া আত্মরক্ষা করিয়াছিল। সেই সকল কুদেশ অধিকারে আর্যদেরও তাদৃশ ইচ্ছুক হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না; সুতরাং সেখানে আত্মরক্ষা সাধ্য হইল।” বেদের গুহাক=গুহক=রামায়ণের গুহ—এই শব্দগুলির আশ্চর্য মিল এই প্রসঙ্গে পুনঃস্মরণ করা ভালো। আবার গুহের অনুগামী কৈবর্ত যারা তারাও দাসবর্ণ থেকে আলাদা কিছু নয়। অন্তত রামায়ণে নিষাদরাজের অনুগামীদের মধ্যে দাস আর কৈবর্তদের মধ্যে যে বিভেদরেখা টানা হয়েছে, তার যে কোনো অর্থ নেই, তা বোঝা যাবে মহাভারতে শান্তনুর শ্বশুর দাসরাজের জাতি এবং বৃত্তিতে। শব্দটা মহাভারতে আছে ‘দাশ’ এবং নীলকণ্ঠ তার মানে করেছেন ‘দাশানাং ধীবরাণাম’। আমি বলি কি ধীবর কিংবা কৈবর্তকে দাস বললে কোনোই আপত্তি টিকবে না, যদিও দাস শব্দটির অর্থ অনেক প্রসারিত এবং দাস মাত্রেই ধীবর কিংবা কৈবর্ত নয়। কিন্তু বনবাসী গুহ নিষাদরাজা। অথচ তার অনুগামী দাস এবং কৈবর্ত এটাই-বা কেমন।
আসলে আমরা নিষাদ বলতে যে সাধারণভাবে ব্যাধ বুঝি, সেই ব্যাধ-জীবনের ছিটেফোঁটা গন্ধও কিন্তু বাল্মীকির নিষাদরাজের গায়ে লেগে নেই। বরঞ্চ তাঁর অনুগামীদের নিরিখে আমি তাঁকে ধীবর বলেই মানি। স্বয়ং মনু মহারাজ আমার সাক্ষী। মনু বলেছেন, ”নিষাদ পিতার ঔরসে এবং আয়োগব (শূদ্রপুরুষ এবং বৈশ্য নারীর মিলনে জাত আয়োগব) মাতার গর্ভে যে সংকর সন্তানের জন্ম হয়, তার নাম মার্গব। এদেরকে দাস বলা হয় এবং আর্যাবর্তের লোকেরা এই দাসেদেরই ধীবর বলে ডাকেন। এরা নৌকর্মের দ্বারা জীবিকানির্বাহ করে।” তাহলে দাস আর কৈবর্তদের মধ্যে যে বিভেদরেখা টেনেছিলেন নিষাদরাজ গুহ, তারা আসলে একই জাতের। উল্লিখিত মনু শ্লোকের টীকায় মেধাতিথি বলেছেন নিষাদ বলতে ওখানে আক্ষরিক অর্থে শূদ্রার গর্ভে ব্রাহ্মণের ঔরসজাত সন্তানকে বোঝাবে না, যেমনটি আমরাও সত্যি গুহের বেলায় বুঝিনি। নিষাদ বলতে বুঝতে হবে কোনো অধম সংকর জাতিকে। বাল্মীকির নিষাদরাজ নিষাদদেরও রাজা নন, মনুর আক্ষরিক অর্থেও নিষাদ নন, আবার বুঝি ব্যাধও নন। তিনি বোধ হয় কৈবর্ত কিংবা ধীবরই, কেননা তাঁরও কাজ ছিল নৌকর্ম। রাম, লক্ষ্মণ, সীতা, ভরত—সবাইকেই তিনি নৌকো করে নদী পার করিয়েছিলেন। আবার মহাভারতের ‘দাশ’ রাজা—তিনিও ছিলেন পারের কাণ্ডারী। বাল্মীকি ক্রৌঞ্চঘাতক ব্যাধটিকে ‘মা নিষাদ’ বলে অভিশাপ দিয়েছিলেন এবং সে তো সত্যিই ব্যাধ। ব্যাধ আর কৈবর্তও তাহলে এক নয়। অনেক ক্ষেত্রে অবশ্য কৈবর্ত-ধীবরেরাও রাজ্যের প্রত্যন্তবাসী ছিলেন। শান্তনু যে দাশরাজার কন্যা সত্যবতীর দেখা পেয়েছিলেন, সেও কিন্তু যমুনার তীরঘেঁষা এক বনেই—স কদাচিদ বনং যাতো যমুনামভিতো নদীম।
একথা অবশ্য স্বীকার করতেই হবে যে বনবাসী হলেও নিষাদ, ব্যাধ, দাস এবং কৈবর্ত এক জাতি নয়। প্রাচীন বর্ণব্যবস্থায় দাস অথবা শূদ্রই হল নিকৃষ্ট বর্ণ এবং অন্ত্যজ বর্ণগুলির মধ্যে যত পার্থক্যই থাকুক না কেন, বেদে এবং ব্রাহ্মণগ্রন্থগুলিতে তারা সবাই দাস বলেই পরিচিত। কিন্তু বর্ণ-ব্যবস্থার প্রথম স্তরে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র ছাড়াও আরও কোনো বর্ণের ছায়াপাত ঘটেছে কিনা সেটাই অবশ্যই দেখা দরকার এবং সেইখানেই আমরা বনবাসী নিষাদদের সন্ধান পাব। ঋগ্বেদে ‘পঞ্চজন’ বলে একটি শব্দ পাওয়া যায়। নিরুক্তবার যাস্ক, যিনি পাণিনিপূর্ব বৈয়াকরণ বলে বিখ্যাত, তিনি বলেছেন—পঞ্চজন বলতে যেমন গন্ধর্ব, পিতৃগণ, দেবতা, অসুর এবং রাক্ষসদের বোঝায়, তেমনি অন্যমতে (যাস্ক এইখানে তাঁরও পূর্ববর্তী উপমন্যুর মত উদ্ধার করেছেন) পঞ্চজন বলতে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এবং নিষাদদের বোঝায়—চত্বারো বর্ণা নিষাদঃ পঞ্চম ইত্যৌপমন্যবঃ। সুপ্রাচীন বৈদিক গ্রন্থ বৃহদদেবতার লেখক শৌনকও তাঁর পূর্ববর্তী শাকটায়নের মত উল্লেখ করে নিষাদকে পঞ্চম বর্ণ বলে স্বীকার করেছেন।
নিষাদের প্রসঙ্গে যাস্ক নিজেই প্রশ্ন তুলেছেন—এদের কেন আমরা নিষাদ বলে ডাকি? উত্তরে যাস্ক যে সমাধান দিয়েছেন তার ব্যাখ্যা করে নিরুক্তের টীকাকার দুর্গসিংহ বলেছেন—এরা বসে বসেই প্রাণিহত্যা করতে পারে—নিষদ্য হন্তি—প্রাণিবধই এদের জীবিকা—প্রাণিবধজীবিনঃ। শত শত পশুহত্যার পাপ নিয়েই যেহেতু এদের জীবন, ব্রাহ্মণ্য ধারায় তাই বিশ্বাস করা হয় পাপ যেন এদের মধ্যে বাসা বেঁধেই রয়েছে—নিষণ্ণম অস্মিন পাপকম—তাই এরা নিষাদ। দুর্গসিংহ অবশ্য প্রাচীন ধারণা উল্লেখ করে বলেছেন যে নিষাদেরা আগেকার দিনে রথ তৈরি করত—রথকার ইত্যেকে।
পশুহত্যার জন্য এরা পাপী কি না সে প্রশ্ন স্বতন্ত্র। প্রাণিহত্যা তাদের নেশা, না প্রাণিহত্যার পেশা নিতে তারা বাধ্য হয়েছে তার উত্তর দেবার দায় আর্থসামাজিক ঐতিহাসিকের। আমরা মহাভারত-বিখ্যাত ধর্মব্যাধের মতে বলতে পারি কিংবা অভিজ্ঞান-শকুন্তলের ধীবরের মতে বলতে পারি যে, যার যেটা পিতৃপুরুষাগত পেশা, তাতে পশুহত্যার পাপ মোটেই নেই। বাঘ যদি মানুষ খায় তবে তার কি পশুহত্যার পাপ হয়? অথবা এই কৈফিয়তের প্রয়োজন নেই, আপাতত এইটুকুই বলা যাচ্ছে যে, নিষাদেরা দাস, কৈবর্ত কিংবা শূদ্র বর্ণ ভুক্ত নন, তারা বিলক্ষণ এক বনবাসী জনগোষ্ঠী। নিষাদদের কথা যজুর্বেদের রুদ্রাধ্যায়ে পাওয়া যাবে এবং সেখানে তারা ব্রাত্য, ছুতোর, রথকার, কুমোর, কামার, পুঞ্জিষ্ঠ (মানে পাখিমারা ব্যাধ), কুকুর খেকো শ্বাদ এবং মৃগয়ু, মানে পশুমারা ব্যাধেদের সঙ্গে সমান আসনে বসেছে।
মজা হল আমি তো এদের বনবাসী-বনবাসী বলে যাচ্ছি কিন্তু বাস্তবিক অবস্থায় এদের সবাইকে থাকতে হত ব্রাহ্মণ্য স্পর্শের বাইরে, ঘর বাঁধতে হত ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য—এই ত্রিবর্ণ-রঞ্জিত বসতির বাইরে, গ্রামের প্রান্তসীমায় অরণ্যের আরম্ভস্থলে—কোন ক্রমেই যেন ভদ্রলোকের আসা-যাওয়ার পথে তাদের ছায়াপাত না ঘটে। মহাকালের অভিসন্ধিতে অনেকেই বামুনপাড়ার কাছাকাছি ঢুকে পড়েছিল, কিন্তু পারল না সেই নিষাদ শবর ডোম চণ্ডালেরা—ছোটবেলা থেকেই যাদের নিজের ছায়াকে ঘৃণা করতে শিখতে হয়। চর্যাকবিকে তাই গান বাঁধতে হয়েছে—নগর বাহিরি রে ডোম্বি তোহরি কুড়িয়া।
মনু বলেছিলেন—শূদ্রা নারীর গর্ভে ব্রাহ্মণ পুরুষের যে সন্তান জন্মে তাকে নিষাদ বলে। কিন্তু আমরা জানি তাকে নিষাদ বলে না, বললে মহাভারতের কবি ব্যাসদেবও নিষাদ নামে পরিচিত হতেন। বনবাসী নিষাদ শবরের জন্মরহস্য আরও গভীরে।
মহাভারতের শান্তিপর্বে শরশায়িত ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে রাজার জন্মকর্ম বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন, সেই সূত্রে নিষাদদের জন্মকথাও এল। ভীষ্ম বললেন, পুরাকালে সুনীথার পুত্র বেণ নামে এক রাজা ছিলেন। প্রজাপালনের ক্ষেত্রে তিনি শুধু বিধর্মী ছিলেন না, স্বেচ্ছাচার আর ক্রোধই তাকে সমস্ত কাজে পরিচালিত করত। শেষ পর্যন্ত অত্যাচারিত ব্রহ্মবাদী ঋষিরা মন্ত্রপূত কুশের আঘাতে বেণকে মেরে ফেললেন। ঋষিরা মন্ত্রোচ্চারণ করতে করতে মৃত বেণের দক্ষিণ ঊরুদেশ মন্থন করতে আরম্ভ করলেন। সেই ঊরু থেকে জন্ম নিল বিকৃত, বেঁটে এক কৃষ্ণকেশী পুরুষ, পোড়া লোহার মতো তার চেহারা, রক্তলাল চোখ—ততো’স্য বিকৃতো জজ্ঞে হ্রস্বাঙ্গঃ পুরুষো ভুবি। দগ্ধস্থূনাপ্রতীকাশো রক্তাক্ষঃ কৃষ্ণমূর্ধজঃ। জন্মাবার সঙ্গে সঙ্গে ঋষিরা তাকে বললেন—বসে থাক এখানে, যার সংস্কৃত হল ‘নিষীদ’। এই বসে থাকা মানুষটি থেকেই নাকি ক্রূরচরিত্র নিষাদের জন্ম, যাদের বাসভূমি হল পাহাড়ি এলাকা আর বন—তস্মান, নিষাদাঃ সম্ভূতা ক্রূরাঃ শৈলবনাশ্রয়াঃ। মহাভারতের মতে, শুধু নিষাদ নয়, বিন্ধ্যগিরির এদিকে-ওদিকে আরও যেসব ম্লেচ্ছ জাতি ছিল তাদেরও জন্ম হয়েছে এই হীন পুরুষটি থেকেই।
মহাভারতে যে বিবরণ পেলাম, সেটি সমর্থন করেছে বিষ্ণুপুরাণ, ভাগবতপুরাণ এবং পদ্মপুরাণ। বিষ্ণুপুরাণের মতে, যে অতিহ্রস্ব খর্বট পুরুষটি নিষাদপুরুষের জন্ম দিয়েছিল, সে বেণ রাজার সমস্ত পাপ নিয়েই জন্মেছিল, বেণের পাপ সে নিজেই গায়ে মেখে নিল—বেণকল্মষনাশনাঃ পুরাণকারেরা এর থেকে ভালো কী বলবেন! ব্রাহ্মণ্যভাবপুষ্ট ঋষিদের মুখে বিতাড়িত মানুষের কথা খানিকটা এইরকমেই শোনায়। অবশ্য অপেক্ষাকৃত পরবর্তী কালের ভাগবতপুরাণে নিষাদদের সম্বন্ধে যে বর্ণনা আছে, আধুনিক নৃ-তাত্ত্বিকের কাছে তা অতি প্রয়োজনীয় সংবাদ। ভাগবত বলেছে, নিষাদেরা সব পাহাড়ি জায়গা আর বনেই থাকে—গিরিকাননগোচরাঃ। তাদের চেহারা হল বেঁটে আর গায়ের রং কাকের মতো কালো—কালকৃষ্ণো’তি হ্রস্বাঙ্গঃ। পা-গুলোও একটু ছোট গোছের আর মুখের হনু-দুটি বড়। নাক খাঁদা, চোখ লাল, আর চুলের রং তামাটে—হ্রস্বপাৎ নিম্ননাসাগ্রো রক্তাক্ষস্তাম্রমূর্ধজঃ।
ভাগবতের নিষাদ-ধারণার সঙ্গে পদ্মপুরাণের ধারণা একেবারে মিলে যাবে। তবে পদ্মপুরাণের বিশেষত্ব অন্য জায়গায়। মহাভারত কিংবা বিষ্ণুপুরাণে আমরা জেনেছি যে, নিষাদ থেকেই অন্যান্য ম্লেচ্ছ জাতিগুলির উৎপত্তি হয়েছে কিন্তু তাদের নাম পাইনি। পদ্মপুরাণ ঘোষণা করেছে যে, নিষাদদের বংশজরা পর্বত আর বনেই থাকে—পর্বতেষু বনেষ্বেব তস্য বংশঃ প্রতিষ্ঠিতঃ। তারা হল—নিষাদ, কিরাত, ভিল্ল (ভিল), নাহলক, ভ্রমর, পুলিন্দ এবং অন্যান্য ম্লেচ্ছ জাতিগুলি, যারা সবাই পাপাচারী—পাপাচারাশ্চ তে সর্বে। নিষাদাশ্চ কিরাতাশ্চ ভিল্লা নাহলকাস্তথা। ভ্রমরাশ্চ পুলিন্দাশ্চ যে চান্যে ম্লেচ্ছজাতয়ঃ।।
এই যে শেষ কথাটি—আরও যত ম্লেচ্ছ জাতি—যে চান্যে ম্লেচ্ছজাতয়ঃ—এই কথাটিই মহাভারত বলেছিল এইভাবে—ম্লেচ্ছাঃ শতসহস্রশঃ—শত-সহস্র ম্লেচ্ছ জাতির জন্ম হয়েছে এই নিষাদ থেকে। বেশ বোঝা যায়, দিন যত গেছে, আর্যরা আপন কৃষ্টির বাইরে স্বধর্মবিরুদ্ধ যত জাতিই দেখেছেন, তাদেরই বলেছেন ম্লেচ্ছ। এখন নিষাদ, কিরাত, ভিলদের ম্লেচ্ছ বলেছেন, সময় এসেছে যখন হূন, অন্ধক, পুলিন্দ, পুক্কশ, খস, যবন সবাইকেই ম্লেচ্ছ বলেছেন। সেই শতপথ ব্রাহ্মণের আমল থেকে কালে কালে ম্লেচ্ছ শব্দের যে কত শত অর্থ-নিরুক্তি, কত পরিবর্তন ঘটেছে তা অন্যত্র আলোচনা করার ইচ্ছে রইল। আপাতত এইটুকুতেই আমরা সন্তুষ্ট যে, বনবাসী বলতে আমরা যে বনমালা পরিহিত নারীপুরুষের স্বপ্ন দেখি, আদতে তা নয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিষাদ-কিরাতদেরও এক ধরনের কৃষ্টি গড়ে উঠল, যদিও সে কৃষ্টি ব্রাহ্মণ্য-বহির্ভূত কৃষ্টি। ব্রাহ্মণ সমাজের প্রতিভূদের সেই বনবাসী কৃষ্টির সঙ্গে রাগ করেই চলতে হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা এই নিষাদ-কিরাতেরা সবসময়ই সমসাময়িক শূদ্রবর্ণের মতো আর্যদের দাসত্ব করে চলেনি, যে কথাটা রমাপ্রসাদ চন্দ্র মশাই ভারি সুন্দর করে বলেছেন : The Nisadas were too numerous to be annikilated and too powerful to be enslaved or expelled enmasse। এই কারণেই রামায়ণের নিষাদরাজ গুহ, তিনি যেমন নিষাদই হোন অথবা ধীবর তো বটেই, কিন্তু তাঁর সঙ্গেও রামচন্দ্রকে বন্ধুত্ব করে চলতে হয়েছে। মহাভারতের শান্তনু রাজাকে দাশরাজার বাড়িতে তার মেয়েকে পাবার জন্য সপুত্র ধর্না দিতে হয়েছে এবং তার শর্তও মেনে নিতে হয়েছে। চন্দ্রমশাই পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণের উক্তি উদ্ধার করে দেখিয়েছেন—অতি প্রাচীনকালে বিশ্বজিৎ যজ্ঞের অভিলাষী ব্যক্তিকে কীভাবে নিষাদদের বস্তিতে অন্তত তিনদিন থাকতে হত; দেখিয়েছেন, রাজা-রাজড়াদের যুদ্ধবাহিনীতেও এই নিষাদেরা কীরকম ডাক পেত।
বনবাসী হলে কী হয় তাদের প্রতাপ কম ছিল না। দ্বাদশ শতকের স্মৃতিকার ভবদেব ভট্ট কৈবর্তদের অন্ত্যজ পর্যায়ে গণনা করেছেন, তাদের নাম পড়েছেন মেদ, ভিল, চামারদের সঙ্গে একই নিশ্বাসে। কিন্তু বাঙালি কৈবর্তরাজ দিব্য বা দিব্বোক পাল রাজ দ্বিতীয় মহীপালের ভবলীলা সাঙ্গ করে দিয়েছিলেন। সমস্ত সামন্তচক্রের সঙ্গে তিনি পালরাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন এবং এই ভয়ংকর প্রমাদ ব্রাহ্মণ্যপ্রসাদভোজী সন্ধ্যাকর নন্দীর মনে ছিল। তিনি দিব্যকে বর্ণনা করেছেন, ‘ভবস্য আপদম’ বলে, তাতে দিব্যের গলা দিয়ে রক্ত ওঠেনি, তিনি বেশ কিছুদিন দিব্যি রাজাগিরি করেছেন।
এ আপদ আগেও ছিল। মহাভারতের প্রবাদপুরুষ একলব্যের কথা মনে আছে তো? তিনি ছিলেন নিষাদরাজা হিরণ্যধনুর ছেলে। শুধুমাত্র নিষাদদের ছেলে বলেই দ্রোণাচার্য তাঁকে অস্ত্রশিক্ষায় বঞ্চিত করেন—ন স তং প্রতিজগ্রাহ নৈষাদিরিতি চিন্তয়ন। শুধু তাই নয় অর্জুনের ওপর অতি-সোহাগে তিনি তাঁর ডানহাতের শরাকর্ষী আঙুলটিও কেটে নেন গুরুদক্ষিণা হিসেবে, যদিও সোজাসুজি তাঁর ওপর গুরুগিরি কোনোদিনই করেননি দ্রোণাচার্য। একলব্য অবশ্যই বনবাসী রাজার ছেলে, বনেই তিনি মানুষ, অস্ত্রশিক্ষাও তাঁর বনের মধ্যেই। পাণ্ডবরাও তাঁর খোঁজ পেয়েছিলেন বনেই—মৃগয়া করতে গিয়ে। মহাভারতকার দু-জায়গায় তাঁর চেহারার বর্ণনা দিয়েছেন এবং দু-জায়গাতেই দেখা যায়, বন্য সরলতা তাঁর সর্বাঙ্গে, ধুলোবালিমাখা গা, গায়ের রং-ও কালো। পরনে একটি কালো হরিণের চামড়া, মাথার চুলে জটা পাকিয়ে গেছে, সব মিলিয়ে বিকৃত-দর্শন—স কৃষ্ণমলদিগ্ধাঙ্গং কৃষ্ণাজিনজটাধরম। এই কালো মানুষটি কোনোদিন অর্জুনকে ক্ষমা করেননি। চিরকালই তিনি ছিলেন অর্জুনের বিরোধী শিবিরে। জরাসন্ধ, শিশুপাল, পৌণ্ড্র বাসুদেব—এঁরাই ছিলেন তাঁর চিরকালের আত্মপক্ষ। নিষাদ একলব্যকে স্বয়ং কৃষ্ণ পর্যন্ত কী রকম ভয় পেতেন, তার পরিচয় পাওয়া যাবে মহাভারতের দ্রোণপর্বে। কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন—কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধের আগেই যদি জরাসন্ধ, শিশুপাল এবং নিষাদপুত্র একলব্যকে না মেরে ফেলা যেত, তাহলে তারা এতদিনে ভয়ংকর হয়ে উঠত এবং তারা সবাই এখন কৌরবপক্ষে যোগ দিত—তে’স্মাসু নিত্যবিদ্বিষ্টা সংশ্রয়েষশ্চ কৌরবান।
কৃষ্ণ বললেন—তুমি জান না অর্জুন! তোমার ভালোর জন্যই দ্রোণকে আচার্য করে, সেই ছলেই তাঁকে দিয়ে একলব্যের আঙুল কাটিয়ে নেওয়া হয়েছে—তদহিতার্থঞ্চ নৈষাদিরঙ্গুষ্ঠেন বিয়োজিতঃ। দ্রোণেনচার্যকং কৃত্বা ছদ্মনা সত্যবিক্রমঃ। কৃষ্ণ আরও বললেন—একলব্য বনবাসী নিষাদ বটে, তবে সে অতি মানীপুরুষ। ধনুক হাতে থাকে সে স্বয়ং রামচন্দ্রের মতো—অতিমানী বনচরো বভৌ রাম ইবাপরঃ। একলব্যের যদি আঙুল থাকত—একলব্যং হি সাঙ্গুষ্ঠং—তাহলে তাঁকে যুদ্ধে এঁটে উঠবে এমন বীর দেবতা, দানব কি রাক্ষসদের মধ্যেও কেউ নেই। মহাভারতের মধ্যে একলব্যকে হত্যা করার সমস্ত ‘ক্রেডিট’ কৃষ্ণ নিজের হাতে নিয়েছেন বটে, তবে হরিবংশের মতে তিনি বলরামের দ্বারা বিজিত হয়েছিলেন মাত্র, মরেননি। নিষাদরাজ একলব্য বাংলাদেশের রাজা পৌণ্ড্রক বাসুদেবের সহায় হয়ে কৃষ্ণের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়েছিলেন এবং এইটাই স্বাভাবিক। কারণ, পৌণ্ড্রক বাসুদেব—বঙ্গ, পুণ্ড্রবর্ধন এবং কিরাতদেশের রাজা বলে পরিচিত ছিলেন—বঙ্গপুণ্ড্র-কিরাতেষু রাজা বলসমন্বিতঃ। বঙ্গ, পুণ্ড্র কিরাত—এরা সবাই তৎকালীন দিনে আর্যদের কাছে ছিলেন অত্যন্ত ঘৃণিত। কাজেই নিষাদরাজ একলব্য যে তাঁর জাতভাই কিরাতের সঙ্গে কৃষ্ণের বিপক্ষে যোগ দেবেন তাতে আর আশ্চর্য কি! হরিবংশের বয়ান মতো একলব্যের সঙ্গে যুদ্ধে বলরাম শত-সহস্র নিষাদকে হত্যা করেন এবং বিজিত একলব্য শেষপর্যন্ত সমুদ্রে সাঁতার কেটে একটি দ্বীপে পালিয়ে যান।
বেশ বোঝা যাচ্ছে, বনবাসী মানেই সবাই বনমালা বিভূষিত ‘কবলবেত্র-বিষাণবেণুঃ’ রাখালিয়া নন। রাজা-রাজড়ারা যে এদের যথেষ্ট ভয় পেতেন, তার প্রমাণ দেবেন স্বয়ং কৌটিল্য। যেসব রাজারা আত্মগরিমাবশত এই বনবাসীদের ভয় পান না, তাঁদের ভয় পেতে উপদেশ দিয়েছেন কৌটিল্য। রাজার আপন নিযুক্ত বনপাল অথবা আটবিক রাজা—এই দুই ব্যাপারেই রাজাদের যথাসম্ভব সাবধান থাকতে বলেছেন কৌটিল্য। বন যেহেতু অনেক ক্ষেত্রেই দুটি নগররাজ্যের মধ্যদেশেই বেশি দেখা যায়, তাই আটবিক রাজার সঙ্গে শত্রুতা এবং মিত্রতা—দুই-ই ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে হ্যাঁ, আটবিক শব্দটি থেকে নিকষ বনবাসী শবর-নিষাদদের পরিচয় কৌটিল্যে মেলে না।
মহাভারত বলেছে—সেই যেখানে সরস্বতী নদী ভুঁয়ে লুকিয়ে পড়েছে, সেই নদীবিনাশের ক্ষেত্রটিই ছিল নিষাদরাষ্ট্রের দ্বার। এইরকম নিষাদরাষ্ট্র বা নিষাদভূমির উল্লেখ মহাভারতে আরও আছে, যদিও আদতে এগুলি বনরাজ্য ছাড়া কিছুই নয়। পালি ভাষায় এগুলির উল্লেখ আছে আলবক (আলবী=অটবী, আলবক=আটবিক)। বলে। সব জায়গায় যে এইরকম বনরাজ্য ছিল তাও নয়। বরাহমিহির ‘নিষাদ-সংঘের’ উল্লেখ করেছেন। প্রাণিঘাতক নিষাদেরা সংঘ, যে নিষাদের বনে বনে দল বাঁধত নিজস্ব কারণে।
বারবার নিষাদ বলেই সব বনবাসীদের উল্লেখ করছি, কারণ, আজকে যাদের কোল, ভিল, মুণ্ডা বলি, তাদের অনেকেরই পূর্বপুরুষ এই নিষাদেরা, শবরেরা। একেক জায়গায় এরা একেক নামে পরিচিত এবং এই পরিচিতিও বেশ প্রাচীন। এদের সামাজিক মর্যাদা কি ছিল তা সহজেই অনুমেয়, তবে দেড়শো খ্রিস্টাব্দেই মহারাজ রুদ্রদামনের জুনাগড় লিপিতে নিষাদেরা যে রুদ্রদামনের শাসনভুক্ত ছিলেন সে খবরটি পাওয়া যায়। তেমনি আছে শবর, যারা বরাহমিহিরের বৃহৎসংহিতায় পুলিন্দদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে। ব্যাধ এবং চোরদের নামও বরাহমিহির একই পঙক্তিতে উল্লেখ করেছেন—শবর ব্যাধ-চোরসংঘঃ। তবে কি শবর, ব্যাধ এবং চোরেরা একসঙ্গে দল বাঁধত, নাকি শবর-ব্যাধেরাই অনেক ক্ষেত্রে চোর হত। আমার ধারণা—চোরেদের পক্ষেও নিরাপদে লোকালয়ে থাকা সম্ভব হত না বলেই, তারা জোট পাকাত শবর-ব্যাধেদের সঙ্গে, তাদের সঙ্গেই ফিরত বন থেকে বনান্তরে। তাতে চুরিরও সুবিধে, থাকারও সুবিধে। মৎস্যপুরাণ আর বায়ুপুরাণ বলেছে শবর, আভীর, পুলিন্দদের মতো বনবাসীদের আস্তানা ছিল দক্ষিণাপথে, বিন্ধ্যপাদমূলে। কথাটা খুব মিথ্যে নয় এবং পরবর্তী কিছু সাহিত্যেও শবর-শবরীদের দেখা মিলবে ওইখানেই দণ্ডকবনে।
দণ্ডকারণ্য পাঠককে চেনাতে হবে না। চেনাতে হবে না তারই মধ্যবর্তী পম্পা সরোবর, জানকীর গা-ধোয়া পুণ্যতোয়া পম্পা। রামায়ণ কিংবা পুরাণগুলিতে দণ্ডকবনের অধিবাসীদের যে বর্ণনা আছে সে তো মুনিঋষি আর রাক্ষসদের ধূসর জগৎ। আছেন এক শবরী যাঁর ভক্তিনম্র তপস্যা আর প্রতীক্ষা তাঁকে শবরী জন্মের কলঙ্ক এবং রোমাঞ্চ—দুই থেকেই মুক্ত করেছে। আমরা কিন্তু এর চেয়েও উজ্জীব এক কাহিনি শোনাতে চাই বাণভট্টের জবানীতে। যাঁদের ধারণা ভারতবর্ষের তাবৎ রাজসভার কবিরা রাজার দেওয়া কানন-ঘেরা বাড়িতে বসে রাজান্তঃপুরের কলকাহিনি লিখেছেন, তাঁরা যেন একটু বিদ্যাসামর্থ্য সংগ্রহ করে বাণভট্ট পড়েন। বাণভট্ট দুটি গ্রন্থ লিখেছেন হর্ষচরিত আর কাদম্বরী। দুটি গ্রন্থেই শবর-শবরীদের অপ্রত্যাশিত বর্ণনা আছে। এই শুধু বর্ণনা নয়, কবির অপরোক্ষ অনুভূতি এখানে মেশানো আছে হৃদয়াবেগের সঙ্গে সঙ্গে। হর্ষচরিতের বর্ণনাটি ছোট বলেই আমরা সোজাসুজি কাদম্বরীর কথামুখে পৌঁছাব। এখানে বাণভট্ট যেমন প্রথমেই মহারাজ শূদ্রকের কল্পকাহিনি বলতে আরম্ভ করেছেন অন্যদিকে কথামুখের পরেই রাজসভায় হাজির করেছেন দক্ষিণাপথের এক শবর-কন্যাকে, সে চণ্ডালিনীর ঝি। রাজার দরজায় দাঁড়িয়ে সে রাজাকে খবর পাঠাচ্ছে। তার সঙ্গে এসেছে এক বৃদ্ধ চণ্ডাল। তার চুল পাকা, চোখ লাল। কিন্তু তার দেহসন্ধি অতিরিক্ত ব্যায়ামে, পরিশ্রমে এখনও শিথিল হয়ে যায়নি। চণ্ডালিকার সঙ্গে এসেছে আরও একটি চণ্ডাল বালক এবং তার হাতে ধরা আছে একটি খাঁচা। সেই খাঁচায় আছে এক অলৌকিক শুকপাখি—সে মানুষের মতো কথা বলতে পারে।
প্রতিহারীর নির্দেশে তিনজনে রাজসভায় ঢুকল এবং মহারাজের চোখ পড়ল চণ্ডাল-কন্যার দিকে। সে শ্যামা মেয়ে, নীল কাপড়-পরা নীলমণির পুতুল যেন। কৃষ্ণকায় ঊর্ধ্বদেহে লাল রঙের ওড়না, যেন পাহাড়ি মাটিতে সন্ধ্যাসূর্যের আলো পড়েছে। কানে হাতির দাঁতের দুল, কপালে গোরচনা, যেন শিবের অনুগামিনী কিরাতবেশিনী ভবানী। সে পায়ে আলতা পরেছে। মহিষাসুরের রক্তে রাঙা দুর্গার পায়ের মতো দেখাচ্ছে তার পা-দুটি। বাণভট্ট বহুরকম করে কেবলই দুঃখ করেছেন যে, মেয়েটির জন্ম হয়েছে দূষণীয় চণ্ডালবংশে। দুঃখ আরও এইজন্যে যে, এই সুন্দরী চণ্ডালিকার মধ্যদেশখানি প্রায় মুষ্টিতেই ধরা যেত, দুঃখ এইজন্যে যে, রমণী পরম রূপবতী এবং যুবতী—অচিরোপরূঢ়ক্ষণযৌবনা; দুঃখ এইজন্যে যে চণ্ডালবংশে জন্ম বলে অসুরলক্ষ্মীর মতো তার স্পর্শ এবং সম্ভোগসুখে সবাই বঞ্চিত—কিমর্থমপগতস্পর্শ-সম্ভোগ সুখে কৃতং কুলে জন্ম।
রমণী শহরের ছলাকলা জানে না। সে প্রথমে ঢুকেই হাতের বেতখানি দিয়ে সভার মাঝখানে যেই সপাৎ করে শব্দ করল, অমনি সভাসদদের চোখ রাজার সিংহাসন থেকে নেমে এসে চণ্ডাল-কন্যার দিকে পড়ল। এই একইরকম বিসদৃশ ব্যবহার সে আবার করল, যখন প্রগলভ বনিতার মতো সে রাজাকে প্রণাম করল। বিনা ভণিতায় অলৌকিক শুকপাখির গুণবর্ণনা করে রাজাকে পাখিটি উপহার দিয়ে বিনা আড়ম্বরেই সে চলে গেল।
এবারে শুকপাখির পালা। অলৌকিক পাখির মুখে তার পাখি-জন্মের ইতিহাস শুনতে চাইলেন শূদ্রক। এই বৃত্তান্তের প্রথম পর্বে আবার কিন্তু সেই শবরদের কথাই এসেছে, কেননা এ পাখির জন্ম হয়েছিল দণ্ডকারণ্যে। জন্মস্থান সম্বন্ধে পাখির বড় গৌরববোধ আছে। তার গর্বের কারণ এই যে, লঙ্কা-যুদ্ধের অন্যতম নায়ক সুগ্রীব বালীর দ্বারা নির্বাসিত হয়ে এই বনেই ফল কুড়োতে আসতেন। দণ্ডকারণ্যে অগস্ত্যমুনির আশ্রমের কাছেই পম্পা সরোবর। সেখানে সকালবেলায় যেমন মুনিদের কমণ্ডলু ভরবার গ্লুব-গ্লুব শব্দ শোনা যায়, তেমনি অন্যসময় ভিল-রমণীদের, স্নানকৌতুকে তাদের কঠিন পয়োধরে আন্দোলিত হয় পম্পা সরোবরের জল। এই পম্পার তীরেই এক বিশাল শাল্মলী গাছে এই শুকপাখির জন্ম। এইবার বনবাসী পাখির চোখে বনবাসী মানুষের কথা।
বনের মধ্যে মৃগয়ার কোলাহল শোনা যাচ্ছে। না, না, এটি কোনো বিলাসী-ব্যসনী রাজার মৃগয়া করা নয়, এ মৃগয়ায় মারা পড়বে শক্তিমত্ত বনবাসীর হাতে দুর্বল নিরীহ বনবাসীরা। সময়টা সকালবেলা। সিংহ, হাতি, ময়ূরের সম্মিলিত চিৎকারে বনস্থল কেঁপে উঠল। একজন বলল—এইখানে পদ্মবনের ডাঁটাগুলো ভাঙা-ভাঙা, নিশ্চয়ই কোথাও হাতি আছে। ওখানে কচুর মোথাগুলো মাটি থেকে উপড়ানো—নিশ্চয়ই শুয়োর। ওখানে হরিণ, সেখানে ময়ূর—এইরকম নানা সন্দেহ-বিনিশ্চয়ের উতোর-চাপান শোনা গেল। তারপরেই—এই যে হরিণ যাচ্ছে, ধাওয়া কর। ওই গাছটায় ওঠ, ওই দিকে তাকা, ধনুক নিয়ে আয়, সাবধান! শিকারি কুকুরগুলোকে ছেড়ে দে—তরুশিখরম আরুহ্যতাম, আলোক্যতাং দিক, আকর্ণ্যতাং শব্দঃ, গৃহ্যতাং ধনুঃ, অবহিতৈঃ স্থীয়তাম, বিমুচ্যতাং, শ্বনঃ—এইরকম নির্দেশ, আদেশ এবং চিৎকারে শবরসেনারা পশুপাখির গন্ধে গন্ধে বনে ঢুকে পড়ল। এরা সবাই ব্যাধ, মৃগয়াটা এদের কাছে ব্যসন নয়, খেলা নয়, বরঞ্চ তাড়না, পেটের দায়। একদল ব্যাধ তাই পশুপাখির পেছনে ধাওয়া করল, আরেক দল তির দিয়ে তাদের বিঁধতে লাগল। এদের সঙ্গে আছে ভয়ংকর হিংস্র সব শিকারি কুকুর। হরিণ-টরিণের মতো সাধারণ প্রাণীকে এই কুকুরগুলিই কাবু করে দেয়—মৃগবধূ-বৈধব্য-দীক্ষা-দান-দক্ষঃ। আর ব্যাধগুলো! তাদের দেখলেই ভয় করে।
খাঁচায় বন্দি শুকপাখি—সে কিন্তু শহুরে সভ্যতার প্রতীক। সে রাজাকে বনের গল্প শোনাচ্ছে; কাজেই তার চোখে ব্যাধদের কীরকম দেখাচ্ছে সেটা লক্ষণীয়। নিরীহ শুকের দৃষ্টিতে কাজলকালো ব্যাধেদের গায়ের রং, একসঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকলে মনে হয় তমালচ্ছায়া নেমেছে বনে। নিষ্ঠুরতায় যেন যমের ভায়রা-ভাই, কাউকে খাতির করে না, দানবীয় ক্রূরতা। এই শবরসৈন্যদের মধ্যে যে পুরুষটি নায়ক, তার নাম মাতঙ্গ। আর শরীরটা লোহার মতো—অতিকর্কশাত্বাদ, আয়সমিব। তার তিরধনুকের টিপ ঠিক একলব্যের মতো (পাঠক! বাণভট্টের শৈলী লক্ষ করবেন)। মহাভারতকার একলব্যের উপমা দিয়েছিলেন রামচন্দ্রের সঙ্গে কিন্তু বাণভট্টে শবরের উপমা নিষাদরাজ। গায়ের রং নিকষ কালো, ঝাঁকড়া চুলগুলি কাঁধ পর্যন্ত নেমে এসেছে। মাতঙ্গের কপালটা বড়, (নায়ক বলেই) তার নাক উঁচু এবং ভয়ংকর। সাপের মাথার মণি দিয়ে দুল বানিয়ে সে পরেছে বাঁ কানে। চোখ-দুটি যেন হরিণের রক্ত দিয়ে ধোয়া, লাল—শোণিতার্ত্রয়েব দৃষ্ট্যা। ধারালো অস্ত্র নিয়ে সবসময় নাড়াচাড়া করায় মাতঙ্গের হাতের আঙুলগুলি সব ক্ষতবিক্ষত। পেটা শরীর, পরিধানে একটি লাল কাপড়। রাগ দেখিয়ে ভ্রূকুটি করার কারণ না থাকলেও সে ভ্রূকুটি করে, কারণ সে জাতেই নিষ্ঠুর। কুকুরগুলি তার চিরকালের সঙ্গী, আর সঙ্গী একটি ছুরি। ধনুক একখানা আছে বটে, তবে তার শোভাই সার—ময়ূরের পালক-লাগানো ধনুক এবং সেইজন্যেই বুঝি সে ময়ূরের জন্ম-শত্রু—ভীষ্মমিব শিখণ্ডিশত্রুম। হবেই বা না কেন, ময়ূরের পালক সে যে মাথাতেও গোঁজে—অচলরাজকন্যকাকেশপাশমিব নীলকণ্ঠচন্দ্রকাভরণম। হরিণ মারতেও সে খুব পছন্দ করে, আর যুবক বয়স তো, তাই কস্তুরী মন কেবলই বনের মধ্যে কস্তুরী খুঁজে বেড়ায়। এই বিলাসিতাটুকুর মধ্যেও বন্য বরাহের দাঁতে ক্ষতবিক্ষত মাতঙ্গের বক্ষোদেশখানি, বন্য মোষের রক্তে রাঙা তার শরীরখানি, তার নায়কোচিত বীরত্বের জানান দেয়। সে তো সুদর্শন নয় কখনোই, বরঞ্চ দুর্ধর্ষ—অনভিভবনীয় আকৃতি। কিন্তু তার সবচেয়ে বড় পরিচয়, অন্তত বাণভট্টের মতে বোধ হয় তাই, সে রাজসেবা কাকে বলে জানে না। হ্যাঁ, সে কোনোদিন কোনো রাজার সামনে যায়নি তা নয়, কিন্তু সামনে গেলেও তার মুখ দিয়ে কোনোদিন চাটুকথা বেরোয় না—ক্ষিতিভৃৎপাদানুবর্তিনমপি রাজসেবানভিজ্ঞম।
উপমাবিলাসী এক কবির কথার প্রতিবাদ এখানেই করতেই হবে, কেননা তিনি খল-পুরুষের সঙ্গে ব্যাধের উপমা দিয়েছেন। কবি বলেছেন কবিত্ব-শৈলীর প্রশংসা করলে খল ব্যক্তি যে নীরবে থাকে, তা গুণমুগ্ধ হয়ে নয়। সে চিন্তা করে—কী করে ওই রচনায় দোষারোপ করা যাবে। পাখি ডাকলে ব্যাধ যে নিঃশব্দে থাকে; তা মুগ্ধ হয়ে নয়। তার উদ্দেশ্য—পাখিটিকে সাতনলা বা আঠাকাঠি দিয়ে ধরা—সন্ধাতুমেব কিল সপ্তনলীং কিরাতাঃ। এ কথা মানি না। ব্যাধ নির্মম, নিষ্ঠুর, ক্রূর—এই সব বিশেষণই স্বীকার করি, কিন্তু ব্যাধ খল—এ কথা স্বীকার করি না। পাখি ধরার সময় সে যে নিশ্চুপে থাকে, সে তার বৃত্তিকৌশল, পশু মারার সময় সেই একই ব্যাধ তাহলে শব্দ করে কেন? খলের উপমা পৃথিবীতে খলই, একান্ত না কুলালে, সাপ। থাক এই কবির কথা। মৃগয়ার শেষে বাণভট্টের কিরাতসৈন্যরা যুবক মাতঙ্গকে ঘিরে ঘিরে চলেছে। নিষাদ সুর যেমন গানের সঙ্গে সঙ্গে চলে, তেমনি তারাও চলছে। তাদের মধ্যে কেউ চমরী-গোরুর লেজগাছি, কেউবা হাতির দাঁত, কেউবা পাতা দিয়ে তৈরি করা নিশ্ছিদ্র পাত্রে মধু সংগ্রহ করে নিয়ে চলেছে। কেউ নিয়ে চলেছে মাংস-ভার, কেউ সিংহের চামড়া, নিদেনপক্ষে কেউবা ময়ূরের পালক—সাজবার সময় কাজে লাগবে, এমনকি কাকের পালক পর্যন্ত। একমাত্র কিরাত-নায়ক মাতঙ্গ ছাড়া আর সবার পরনের কাপড়-চোপড় কিন্তু বড়ই মলিন—জলচ্ছায়া মলিনাম্বরৈঃ।
এইরকমই তো হবার কথা। সাধারণ শবর যারা, তাদের আচার-ব্যবহার, ভাব-ভঙ্গী তো আর তাদের মুখিয়াদের মতো হবে না। বাণভট্ট লিখেছেন—এদের জীবনে অজ্ঞানের ভাগই বেশি, চরিত্রও ভদ্রলোকের মতো নয়। কালীর কাছে নরমাংস নিবেদন করাই তাদের ধর্ম, মদ আর মাংসই তাদের খাবার। ব্যায়াম হল পশুহিংসা। শেয়ালের ডাকই তাদের শাস্ত্রবাণী, আর প্যাঁচার ডাকই হল সৎ-অসৎ বিচারের মাপকাঠি—শাস্ত্রং শিবারুতং, উপদেষ্টারঃ সদসতাং কৌশিকাঃ। পাখির ডাক শুনে মৃগয়ার শুভাশুভ নিরূপণ করাটাই অতাদের কাছে শ্রেষ্ঠ জ্ঞানের পরিচয়। পরিচিতিদের মধ্যে আছে কেবল কতকগুলি শিকারি কুকুর আর রাজত্ব হল মনুষ্যহীন বনে—পরিচিতাঃ শ্বানঃ, রাজ্যং শূন্যাটবীষু। উৎসব বলতে এই অশিক্ষিত শবরেরা বোঝে শুধু দশ জনে মিলে মদ খাওয়া। শরাঘাতে হরিণ মারা পড়লে যে উৎসাহ-মুখর শব্দটুকু তাদের গলা দিয়ে বেরোয়, সেই তাদের গান। জোর করে ধরে নিয়ে আসা পরের বউগুলিই তাদের গৃহিণী। (পাঠক! বনবাসীদের এই পরকীয়া রসের সূত্র ধরেই আহিরিণী যুবতীকুলের সঙ্গে কৃষ্ণঠাকুরকে সম্পর্কিত করেছেন অনেক পণ্ডিত। নৈতিক শিথিলতা নাকি বনবাসী আভীরদের এক বৈশিষ্ট্য, যার প্রকোপ থেকে আভীর কৃষ্ণই বাদ পড়েননি।) বাণভট্ট লক্ষ করেছেন যে, শত শত মৃগয়া করেই নিষাদ-শবরদের জীবিকানির্বাহ হয় না, এরা শহরের দিকে গেলে চুরিও করে—চৌর্যেন জীবনম (তুলনীয় বরাহমিহির—শবর-ব্যাধ-চোর-সংঘঃ)। সাপের মাথার মণিই এদের শ্রেষ্ঠ অলংকার। সবশেষে বাণভট্টের সিদ্ধান্ত—এরা যে বনে থাকে, সেই বনের সমস্তটাই শেষ করে দিয়ে যায়—যস্মিন্নেব কাননে নিবসন্তি, তদেব উৎখাতমূলম অশেষতঃ কুর্বন্তি।
বাণভট্টের মতো এমন করে আর শবর-কিরাতের কথা কে বলতে পেরেছে! বনে বনে দল বেঁধেই যাদের জীবন, বনের ফল-মূলমৃগ-পশু যাদের ভক্ষ্য—তারা যে বনে থাকবে, সেটিরই যে সর্বনাশ হবে, তাতে আর আশ্চর্য কী? সুগ্রীবের দাদা বালী যখন রামচন্দ্রের মৃত্যুবাণ খেলেন তখন তিনি আর্যপুত্র রামচন্দ্রকে প্রশ্ন করেছিলেন—আমরা বনবাসী, বনের ফল খাই, বনের মধু পান করি। অরণ্য-সম্পদের দিকে তো তোমাদের নজর থাকার কথা নয়! তোমরা শহুরে মানুষ, তোমাদের মাথা ঘামানোর জিনিস হল—ভূমির্হিরণ্যং রূপ্যঞ্চ—বাসযোগ্য ভূমি আর সোনাচাঁদি, টাকাপয়সা। আমার মতো বনভূমির রাজাকে মেরে তোমার লাভ কি হল? প্রত্যুত্তরে রাম যা বলেছিলেন, সে যুক্তি জোলো। মহাকাল, যে শিক্ষা দিয়েছে তাতে বুঝি বনবাসী অভদ্র শবর-কিরাতেরা বনভূমির যা ক্ষতি করেছে, তার থেকে অনেক বেশি সর্বনাশ করেছে শহরের ভদ্রলোকেরা। শবর-কিরাত-ব্যাধের জাতেরা বনের পাকা ফল খেয়ে, শালপাতা কুড়িয়ে মায়ের অবাধ্য ছেলের মতো যদি বনভূমিকে অত্যাচার করে থাকে, তাহলে ভদ্রলোক, শিক্ষিত, রাজবেশী আর্য পুরুষের হাতে সুন্দরী অরণ্যভূমি হয়েছে ধর্ষিতা। অপমানে ভূ-পাতিতা।