ফ্রেমের বাইরে

ফ্রেমের বাইরে

জানুয়ারি মাস৷ ঠান্ডাটাও এবছর জব্বর পড়েছে৷ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা অনুষ্ঠান ছিল৷ মন্ত্রী-সান্ত্রী, ভিআইপি-রা এসেছিলেন৷ সেখান থেকেই কাজ সেরে ফিরছিল প্রিয়ম আর সঞ্জীব৷ কলকাতার একটা বেশ নাম-ডাকওলা বাংলা চ্যানেলে কাজ করে দুজনে৷ প্রিয়ম রিপোর্টার আর সঞ্জীব ক্যামেরাম্যান৷ গাড়িতে উঠতে উঠতে সঞ্জীব ড্রাইভারকে বলল, কাচগুলো ভালো করে তুলে দে চাঁদু৷ আজ বড্ড ঠান্ডা৷

সঞ্জীবের কথা শুনে প্রিয়ম হেসে ফেলল, তোর আবার বড্ড শীত শীত বাতিক৷ কলকাতায় আবার শীত পড়ে কবে! এই তো দশ-পনেরোটা দিন একটু কনকনে ভাব৷ তাতেই একেবারে অস্থির হয়ে গেলি৷ এই জন্য বললাম, একটা চা খেয়ে তারপর গাড়িতে ওঠ….

না রে, আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে৷ মায়ের শরীরটা ভালো নেই৷ পাড়ার ডিসপেনসারিতে একবার দেখিয়ে আনব৷ একজন বয়স্ক ডাক্তার বসেন৷ ভালো লোক৷ মায়ের খুব ভরসা ওর ওপর৷

কিন্তু তোর তো অফিসে ফিরে ক্যামেরা জমা দিয়ে বেরোতে বেরোতে রাত আটটা বেজে যাবে৷

সেজন্যই তো এই অ্যাসাইনমেন্টটায় আসতে চাইছিলাম না৷ কিন্তু আর তো কেউ ছিল না৷ অসুবিধা হবে না৷ নাম লেখানো আছে৷ ডাক্তারবাবু দশটা অবধি চেম্বারে থাকে৷ মাকে বলেছি একদম তৈরি হয়ে থাকবে৷ আমি রাস্তা থেকে ফোন করে দেব৷ তক্ষুনি বেরিয়ে আসবে৷

গাড়ি চলতে শুরু করেছে৷ মাফলারটা ভালো করে গলায় জড়িয়ে নিয়ে প্রিয়ম বলল, তুই কলকাতার ঠান্ডাতেই এরকম করছিস আর আমি তো সামনের শনিবার মালদা যাচ্ছি৷

কেন রে?

তোকে বললাম না সেদিন, পৌষসংক্রান্তিতে আমাদের বাড়িতে কালীপুজো হয়৷ আত্মীয়স্বজন সবাই আসে৷ দারুণ হৈচৈ ব্যাপার৷

হ্যাঁ তোদের তো আবার জমিদারি ব্যাপার-স্যাপার৷ কী যেন একটা অদ্ভূত নাম তোদের গ্রামের?

কুলি৷ নামটা শুনতে বেশ মজার রে৷ তবে অনেক পুরোনো গ্রাম৷ আর ওসব জমিদারি এখন আর কিছুই নেই৷ অনেককাল গেছে৷ বাবা-কাকারা সবাই মোটামুটি ভালো চাকরি-বাকরি করছে, জমি-জায়গাও কিছু আছে৷ তাই পুজোটা ধুমধাম করেই হয়৷ তাছাড়া জ্যাঠামশাই তো গ্রামের বাড়িতেই থাকেন৷ উনিই যোগাড়যন্ত্র সব করে রাখেন৷

কাকু-কাকিমাও যাবেন তো তাহলে?

মা-বাবা তো কালই চলে গেছে৷ আমি শনিবার যাব….সঞ্জু শোন, তুই যাবি আমার সঙ্গে পৌষকালীর পুজোতে?

আমি! পাগল নাকি!

আরে শোন না পাগলা, আমি বলছি চল৷ ওখানে আমাদের মস্ত বাড়ি৷ থাকার কোনও অসুবিধাই নেই৷ আর তোর ছবি তোলার অনেক মেটিরিয়াল পাবি৷

কীরকম শুনি? এবার একটু কৌতূহলী হয় সঞ্জীব৷

প্রথমত মূর্তিটা খুব ইন্টারেস্টিং৷ তাছাড়া নানারকম বেশ অদ্ভূত অদ্ভূত রিচুয়াল আছে৷ যেগুলো ভিস্যুয়ালি খুব ভালো৷ তাছাড়া আমাদের গ্রামে একটা মস্ত ঝিল আছে৷ সেখানে এই সময় অনেক মাইগ্রেটারি বার্ডস আসে….

সেদিন রাতে অফিস থেকে বাড়ি ফেরার সময়ই সঞ্জীব মনে মনে ঠিক করে নেয় প্রিয়মের সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে কালীপুজো দেখতে যাবে৷ এমনিতেই অনেকদিন কোথাও বেরোন হয়নি৷ তাই মনটা উসখুস করছে৷ প্রিয়মকে মা-বাবা ভালো করেই চেনে৷ অনেকবার সঞ্জীবের সঙ্গে তাদের বাড়িতে গেছে৷ তাই প্রিয়মের সঙ্গে যাব বললে ঝামেলা পাকাবে না৷ প্রায় চার বছর হয়ে গেল এই চ্যানেলে কাজ করতে ঢুকেছে সঞ্জীব৷ প্রথম থেকেই প্রিয়মের সঙ্গে দিব্যি জমে তার৷ হাসিখুশি খোলামেলা ছেলে৷ তাছাড়া ইদানীং স্টিল ফটোগ্রাফির নেশাটা ক্রমশ জোরালভাবে পেয়ে বসেছে সঞ্জীবকে৷ ছবি তোলা, তারপর সেটাকে ফটোশপে ঠিকঠাক করা৷ দু-একটা কম্পিটিশনে পাঠিয়ে প্রাইজও পেয়েছে৷ ভালো ছবি, ভালো সাবজেক্টের জন্য সঞ্জীব তাই এখন যে কোনও জায়গায় যেতে রাজি৷

গৌড় এক্সপ্রেস ধরে প্রিয়ম আর সঞ্জীব ভোর ভোর পৌঁছে গেল মালদহ৷ স্টেশনের কাছেই বাসস্ট্যান্ড৷ সেখান থেকে বাস ধরতে হবে৷ মালদহ শহর থেকে কুলি গ্রামের দূরত্ব প্রায় সত্তর কিলোমিটার৷ বাসে ঘণ্টা তিনেক তো লাগবেই৷ দুজনে তাই স্টেশনেই হাত-মুখ ধুয়ে, চা-টোস্ট খেয়ে বাসে চেপে বসল৷ বেলা এগারোটা নাগাদ গ্রামের মুখে, বড় রাস্তার ওপর বাসটা নামিয়ে দিল তাদের৷ সেখান থেকে মিনিট দশেক হাঁটলেই বাড়ি৷ পৌঁছানো মাত্রই হৈহৈ করে ছুটে এল ভাই-বোনেরা৷ প্রিয়মের মা বেরিয়ে এসে আদর করে ভিতরে নিয়ে গেলেন সঞ্জীবকে৷ পরের দিনই পুজো৷ তাই আত্মীয়-স্বজন প্রায় সবাই এসে গেছে৷ বাড়ি একেবারে জমজমাট৷

দুপুরের রান্না শেষ হতে দেরী হবে৷ তাই ব্যাগ-পত্তর রেখে হাত-মুখ ধুতে না ধুতেই জলখাবার খেয়ে নেওয়ার ডাক পড়ল৷ বিশাল খাবার ঘর৷ মাঝখানে মস্ত একটা শ্বেতপাথরের টেবিল৷ সিংহের থাবার মতো তারা পায়া৷ চারপাশে অন্তত গোটা দশেক চেয়ার৷ বাকীদের খাওয়া হয়ে গেছে আগেই৷ তারা দুজনেই তাই বসল তখন৷ গরম গরম ফুলকো লুচি, ফুলকফি-আলু ভাজা আর বাড়িতে বানানো দরবেশ৷ প্রিয়মের মা খেতে দিচ্ছেন৷ কাকিমা, জেঠিমা, পিসিরাও আসা-যাওয়া করছেন৷ প্রিয়ম প্রায় সবার সঙ্গেই সঞ্জীবের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে৷ এই সময় হঠাৎ সঞ্জীবের চোখে পড়ল, খাবার ঘর থেকে যে দরজাটা সম্ভবত রান্নাঘরের দিকে গেছে, তার ঠিক উল্টোদিকের দরজায় এক ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে আছেন৷ বয়স খুব বেশি নয়৷ মাজা রঙ৷ লালপেড়ে হলুদ রঙের তাঁতের শাড়ি পরা৷ মাথায় হালকা ঘোমটা, কপালে বেশ বড় একটা সিঁদুরের টিপ৷ মহিলা কেমন যেন একটা অদ্ভূত বিষণ্ণ, মায়াময় চোখে একদৃষ্টে সঞ্জীবের দিকেই তাকিয়ে আছেন৷ একটু অস্বস্তিই লাগছিল সঞ্জীবের৷ প্রিয়ম অন্যদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেও, এনার সঙ্গে তখনও দেয়নি৷ কিন্তু সেকথা তো আর বলা যায় না৷ তাই চুপচাপ খাবারে মন দিল সঞ্জীব৷ একটু পরে অবশ্য চোখ তুলে আর মহিলাকে দেখতে পেল না৷

তবে ভদ্রমহিলা যে বাড়িরই কোনও ঘনিষ্ঠ আত্মীয় সেটা বুঝতে অসুবিধা হল না৷ কারণ দুপুরে খাওয়ার সময় আবার তাঁকে দেখতে পেল সঞ্জীব৷ বাড়িতে অনেক লোক বলে, ভিতরের টানা বারান্দায় সতরঞ্চি পেতে ছেলেপুলেদের খেতে দেওয়া হয়েছে৷ মা-কাকিমারাই পরিবেশন করছেন৷ সেই ভদ্রমহিলাও আছেন৷ যদিও পরিবেশনের কাজে খুব একটা হাত লাগাচ্ছেন না৷ সঞ্জীবের কেবলই মনে হচ্ছিল, তিনি যেন খুব মন দিয়ে শুধু তারই খাওয়া দেখছেন৷ ব্যাপারটা খুবই অস্বস্তিকর৷ অথচ কিছু করার নেই৷

দোতলার লম্বা টানা বারান্দার শেষপ্রান্তের একটা ঘরে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে প্রিয়ম আর সঞ্জীবের৷ বেশ বড় ঘর৷ দুপাশে দুটো সিঙ্গল খাট, টেবিল, জামাকাপড় রাখার আলনা, সবই আছে৷ রাতে ট্রেনে ভালো ঘুম হয়নি৷ তাই খাওয়া সেরে লেপ গায়ে দিয়ে শুতেই, ঘুমে চোখ জড়িয়ে এসেছিল সঞ্জীবের৷ কিন্তু বেশিক্ষণ ঘুমোনর কী জো আছে! একটু পরেই হাঁক-ডাক করে তাকে ঠেলে তুলল প্রিয়ম, শিগগির ওঠ৷ ক্যামেরা নিয়ে চল৷ এখন ঠাকুরকে গয়না পরানো হবে৷

ক্যামেরার ব্যাগ, লেন্স, স্ট্যান্ড সব গুছিয়ে নিয়ে নীচে নেমে সঞ্জীব দেখে ঠাকুর দালানে জোরালো আলো জ্বলছে৷ এক-পাশে অনেকগুলো গয়নার বাক্স রাখা৷ প্রিয়মের জেঠিমা লিস্ট মিলিয়ে সব গয়না গুছিয়ে রাখছেন৷ দুই কাকা প্রতিমাকে সেই অলঙ্কার পরাচ্ছেন৷

প্রিয়ম বলল, এইসব গয়নাই ঠাকুরের৷ কিছু তাদের পারিবারিক৷ তবে বেশিরভাগই মানতের গয়না৷ ঠাকুর খুব জাগ্রত বলে আশপাশের গ্রামের মানুষদের বিশ্বাস৷ তাই ঠাকুরের কাছে নানারকম মানত করে অনেকেই৷ মনস্কামনা পূরণ হলে সেই মানতি গয়না দিয়ে যায়৷ তবে সব গয়নাই সারা বছর ব্যাঙ্কের ভল্টে থাকে৷ পুজোর আগের দিন তুলে আনা হয়৷ আবার বিসর্জনের পরদিন দিয়ে আসা হয়৷ এই তিনদিন সেজন্য বাড়িতে বিশেষ পুলিশ পাহারারও ব্যবস্থা থাকে৷

জেঠিমা গয়না গুছিয়ে রাখছেন৷ বাড়ির অন্য মহিলারাও আশপাশে বসে পুজোর নানা যোগাড়যন্ত্র করছেন৷ গল্পগুজব, ঠাট্টা, ইয়ার্কিও চলছে পুরোদমে৷ সঞ্জীব খেয়াল করল, দলের মধ্যে সেই মহিলাও আছেন৷ তবে বোধহয় একটু চুপচাপ স্বভাবের৷ তাই কথাবার্তা তেমন বলছেন না৷

মন দিয়ে ছবি তুলছে সঞ্জীব৷ শুধু তো প্রতিমার ছবি নয়৷ এই যে মেয়েরা কাজ করছে, হাসছে, গল্প করছে, তাদের নানা মুড, মুখের ভঙ্গি এসবও তো ছবির বিষয়৷ এপাশ-ওপাশ ক্যামেরা ঘুরছে৷ হঠাৎ ফ্রেমের মধ্যে চলে এল সেই মহিলার মুখ৷ ভারী সুন্দর চোখ দুটো, মনে মনে ভাবল সঞ্জীব৷ তারপর আরও একটু ক্লোজ আপে ধরল মুখটা৷ সামনে অফ ফোকাসে জেঠিমা৷ শাড়ির লালপাড় মুখের চারপাশে একটা সুন্দর ফ্রেম তৈরি করেছে৷ ভালো হবে ছবিটা, ভাবতে ভাবতে শাটার টিপল সঞ্জীব৷ তারপর নানা অ্যাঙ্গেল থেকে মহিলার আরও কয়েকটা ছবি তুলল৷ কোনওটা একলা, কোনওটা অন্যদের সঙ্গে৷

মহিলামহলে তখন গল্প চলছে পুরোদমে৷ প্রিয়মের জেঠিমা একটা মুক্তো বসানো নথ-টানা হাতে নিয়ে পিসিকে বললেন, এবার এই নথটাই পরাই, কী বলিস?

পিসি একটু চুপ করে থেকে বলল, তাই পরাও৷ ঠাকুরের যে কী বিচার জানি না৷

তা যা বলেছিস৷ একটা ছেলের জন্য ছোট ঠাকুরপো আর বিমলা দুজনেই যেন পাগল হয়ে গেছিল৷ কত মানত, ঠাকুরের দোর ধরা৷ ছেলে হল৷ মানতের নথও এল৷ অথচ সেই নথ পরিয়ে ঠাকুর দেখা আর হল না….

জেঠিমার গলায় বিষণ্ণতার সুর৷ পারিবারিক কোনও কথা হচ্ছে বুঝে, সঞ্জীব সরে যায় সেখান থেকে৷

ঘড়ির কাঁটায় রাত মাত্র দশটা৷ অথচ মনে হচ্ছে যেন কত রাত হয়ে গেছে৷ সন্ধে হতে না হতেই তো চারিদিক নিঝুম৷ রাতের খাওয়াও শেষ৷ ঠান্ডা পড়েছে জাঁকিয়ে৷ হাত-পা যেন শিরশির করছে৷ সঞ্জীব তাই লেপের তলায় ঢুকে পড়ার উদ্যোগ করছিল৷ প্রিয়মের আসতে দেরী হবে৷ জ্যাঠামশাই খাওয়ার পর বাড়ির সব ছেলেদের নিয়ে বসেছেন৷ সবার দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হবে৷ কিন্তু শুতে ইচ্ছে করলেও ঘুম আসছিল না সঞ্জীবের৷ আসলে তার একটা বিচ্ছিরি অভ্যাস আছে৷ রাতে শোয়ার আগে এক গ্লাস গরম দুধ না খেলে কেমন যেন ঘুম আসতে চায় না৷ অভ্যাসটার জন্য অবশ্য মা দায়ী৷ ছোটবেলা থেকে রোজ রাতে দুধ খাইয়ে এমনটা করেছে৷ কিন্তু লোকের বাড়িতে এসে তো আর ধেড়ে ছেলে বলতে পারে না, দুধ না খেলে ঘুম আসে না৷ তাই মনে মনে মাকে দোষারোপ করতে করতেই বিছানায় ঢুকতে যাচ্ছিল সঞ্জীব, এমন সময় দরজায় খুটখুট শব্দ হল৷ তাড়াতাড়ি উঠে বসতেই, দরজা ঠেলে ঢুকলেন সেই মহিলা৷ সঞ্জীব অবাক হয়ে দেখল, তার হাতে একটা প্লেটের ওপর কাচের গ্লাসে এক গ্লাস দুধ৷

টেবিলের ওপর গ্লাসটা নামিয়ে বললেন, খেয়ে নাও৷ হালকা গরম আছে৷

বিনা প্রতিবাদে দুই চুমুকে দুধটা শেষ করল সঞ্জীব৷ তারপর আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কী করে জানলেন, আমি রাতে দুধ খাই….

আমি জানি৷ দুধ না খেলে ঘুম আসে না তোমার৷

বলে একটু হেসে গ্লাসটা তুলে নিয়ে চলে গেলেন মহিলা৷ নির্ঘাৎ প্রিয়ম বলেছে৷ মনে মনে ভাবল সঞ্জীব৷ কখনও নিশ্চয় কথাবার্তায় বলেছিল, ব্যাটা ঠিক মনে করে রেখেছে৷ তাছাড়া বাইরে কোথাও অ্যাসাইনমেন্টে গেলেও যে সঞ্জীব রাতে দুধ খায় সেটা খেয়াল করেছে৷ বন্ধুর প্রতি ভালোবাসায় মনটা ভরে গেল সঞ্জীবের৷ খুশি খুশি মেজাজে লেপের ভিতর ঢুকে ঘুমিয়েও পড়ল তক্ষুনি৷

পরের দিন পুজো৷ সারাদিন ধরে হইচই, হাঁকডাক৷ বাড়িভর্তি লোকজন৷ তার মাঝে সেই মহিলাকেও কয়েকবার চোখে পড়ল সঞ্জীবের৷ একবার ভাবল প্রিয়মকে ওনার পরিচয় জিজ্ঞাসা করে৷ কিন্তু প্রিয়মও নানা কাজে ব্যস্ত৷ তাই জিজ্ঞাসা করার আগে নানা গোলমালে সঞ্জীবের নিজের মাথা থেকেই ব্যাপারটা বেরিয়ে গেল৷

ছুটি মাত্র তিনদিনের৷ তাই বিসর্জনের রাতেই ফেরার ট্রেন ধরতে হবে৷ এদিকে এখনও পাখির ছবিই তোলা হয়নি৷ কালীপুজোর পরদিন ভোরে সঞ্জীব তাই বেরিয়ে পড়ল ক্যামেরা নিয়ে৷ প্রিয়ম তখনও ঘুমোচ্ছে৷ অনেক রাতে পুজো শেষ হয়েছে৷ বাড়ির লোকদের প্রায় কারুরই ঘুম ভাঙেনি তখনও৷ তবে বড় জ্যাঠামশাই উঠে পড়েছেন৷ তাঁর কাছেই ঝিলের দিকে যাওয়ার রাস্তাটা জেনে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সঞ্জীব৷

তখনও ভালো করে আলো ফোটেনি৷ রাস্তার ধারের ঘাসগুলো সব ভিজে চুপচুপে৷ মাঝেমধ্যে গাছের পাতা থেকেও টুপটাপ জল ঝরছে৷ জ্যাকেটের পকেটে হাতদুটো ঢোকাতে ঢোকাতে সঞ্জীব ভাবছিল, ইসস মাফলারটা সঙ্গে আনলেই হত৷ ঠান্ডা না লেগে যায়৷

মেঠোপথ৷ গাছের শুকনো পাতা জমে আছে৷ তাতেই শোনা গেল পায়ের শব্দ৷ সঞ্জীব পিছন ফিরে দেখে সেই মহিলা৷ হাতে তার চেককাটা উলেন মাফলার৷

এটা পরে নাও৷ ঠান্ডা লেগে যাবে৷

সঞ্জীবের হাতে মাফলারটা দিয়ে কেমন একটু অদ্ভূত চাপা স্বরে কথাগুলো বললেন মহিলা৷ তারপর একটু সময় সঞ্জীবের দিকে তাকিয়ে যেন মনের কথাটি পড়ে নিলেন, এই রাস্তাটা সোজা খানিকটা গিয়ে ভাগ হয়ে গেছে৷ বাঁদিকে ঝিলের রাস্তা৷ ডানদিকে একটু গেলেই চায়ের দোকান পাবে৷ ওটা ভোরবেলাতেই খুলে যায়৷

একটু পরে দোকানের বেঞ্চে বসে গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে সঞ্জীব ভাবল, ভদ্রমহিলা কিন্তু ভারী বুদ্ধিমান৷ তার যে এখন চা দরকার সেটা ঠিক বুঝেছেন৷ তাছাড়া কেয়ারিংও খুব৷ জ্যাঠামশাইয়ের কাছে নিশ্চয় শুনেছেন যে আমি ঝিলে যাচ্ছি৷ মাফলার নিইনি দেখে সেটা আবার দিতেও এসেছেন৷

প্রিয়ম মিথ্যে লোভ দেখায়নি৷ সঞ্জীব গিয়ে দেখল, ঝিলের জলে ডেরা বেঁধেছে নানা জাতের পরিযায়ী পাখির দল৷ সঞ্জীবের পাখি সম্বন্ধে জ্ঞান খুব বেশি নয়৷ কিন্তু তবু তার মনে হল, বেশ কিছু অচেনা পাখিও ঝাঁকের মধ্যে আছে৷ পাড়ের কাছেই একটা ঝোপের পাশে ক্যামেরা গুছিয়ে বসল সঞ্জীব৷ পাখিরা ইচ্ছেমত উড়ছে, বসছে, সাঁতার দিচ্ছে, গা ঝাড়ছে৷ ঝিলের পিছনে বড় বড় কয়েকটা বাবলা গাছের পিছন থেকে ধীরে ধীরে সূর্য উঠছে৷ সরে যাচ্ছে কুয়াশার চাদর৷ চমৎকার সব কম্পোজিশন৷ সূর্য বেশ খানিকটা মাথার ওপর উঠে যাওয়া পর্যন্ত মন দিয়ে ছবি তুলল সঞ্জীব৷ রোদ চড়া হতে পাখিরা খাবারের খোঁজে বেরিয়ে পড়লে সেও ক্যামেরা গুছিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দিল৷

রাতের ট্রেন৷ কিন্তু বাড়ি থেকে বেরোতে হয়েছে বিকেলেই৷ কারণ সন্ধের পর আর কুলি থেকে মালদহে আসার বাস পাওয়া যায় না৷ সন্ধের মুখে তাই স্টেশনে পৌঁছে ওয়েটিং রুমে ব্যাগ-পত্তর রেখে গুছিয়ে বসল দুজনে৷ রাতের খাবার সঙ্গেই আছে৷ প্রিয়ম দু-কাপ কফি নিয়ে এল৷ খুশি মনে কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে সঞ্জীব বলল, প্রিয়ম, ওই মহিলা তোর কে হয় বলতো? ওই যে বেশ সুন্দর দেখতে৷ বড় বড় চোখ৷

কার কথা বলছিস, ছোটপিসি?

দূর….ছোটপিসিকে তো আমি চিনি৷ রোগা মতন৷ উনি না৷ যিনি গয়না পরানোর সময় পাশে বসেছিলেন৷

সে তো বড় জেঠিমা৷

আরে বড় জেঠিমা গয়না গুছিয়ে রাখছিলেন৷ ওনার পাশে যিনি বসেছিলেন৷

কার কথা বলছিস? বুঝতে পারছি না তো৷

দাঁড়া দাঁড়া আমি তোকে দেখাচ্ছি…….

ব্যাগ খুলে ক্যামেরা বার করে সঞ্জীব৷ তারিখ দিয়ে মার্ক করা আছে৷ পুজোর আগের দিনের ছবিগুলো বার করতে থাকে৷ একটার পর একটা ছবি আসছে৷ ঠাকুরের মুখ, গয়না পরানো হচ্ছে, জেঠিমার হাতে ধরা মস্ত ফাঁদি নথ, কাকিমা সলতে পাকাচ্ছেন, কী একটা কথায় পিসি হেসে গড়িয়ে পড়ছেন৷ কিন্তু কোথাও সেই মহিলার কোনও ছবি নেই৷ এমনকী যেখানে ক্লোজাপে তাঁকে ধরেছিল সঞ্জীব, সেখানেও ফ্রেম জুড়ে শুধুই অফ ফোকাসে জেঠিমার মুখ৷

হতবাক হয়ে আঁতিপাঁতি করে খুঁজতে থাকে সঞ্জীব৷ পুজোর দিনের ছবিগুলোও ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে৷ নাঃ, কোথাও সেই মুখের একটু আভাস পর্যন্ত নেই৷ অবাক হয়ে গেছে প্রিয়মও, কার কথা বলছিস বল তো তুই? আর তো কেউ ছিল না৷ বাড়ির সব লোকই তো এখানে আছে৷

ছিল৷ আমি বলছি ছিল৷ আমার সঙ্গে কথা হয়েছে৷ সেদিন রাতে আমাকে দুধ এনে দিলেন৷ আজ সকালে মাফলার দিলেন৷ চায়ের দোকানের রাস্তা পর্যন্ত দেখিয়ে দিলেন৷ কিন্তু এতগুলো ছবি তুললাম……

কোনও কারণে হয়তো ফ্রেম থেকে বেরিয়ে গেছে, খেয়াল করিসনি……

বন্ধুকে খানিকটা সান্ত্বনা দিতেই বলে প্রিয়ম৷

ওরকম আমার হয় না প্রিয়৷ তুই তো জানিস৷ প্রেস কনফারেন্সে অত ধাক্কাধাক্কিতেও আমার ফ্রেম ঠিক থাকে৷

প্রিয়মও সেটা খুব ভালোমতোই জানে৷ তাই অপ্রস্তুত হয়ে চুপ করে থাকে৷ কারণ ব্যাপারটা যে কী হয়েছে, কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না৷ সঞ্জীবও কেমন যেন উদভ্রান্তের মতো ক্যামেরাটা কোলে নিয়ে বসে থাকে৷

ট্রেন লেট আছে৷ কিন্তু কতক্ষণ লেট জানতে স্টেশনমাস্টারের ঘরে গেছিল প্রিয়ম৷ ফিরে এসে দেখে বেঞ্চের ওপর শুয়ে আছে সঞ্জীব৷

কী হল রে, শুলি কেন?

প্রিয়মের গলা শুনে চোখ খুলে তাকায় সঞ্জীব৷ টকটকে লাল চোখে৷ গায়ে হাত দিয়ে দেখে জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে৷ বিড়বিড় করে কী বলে আবার চোখ বুজে ফেলে৷ বন্ধুর অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে যায় প্রিয়ম৷ তাড়াতাড়ি বলে, তুই শুয়ে থাক৷ আমি দেখি কোথায় ওষুধের দোকান আছে৷ প্যারাসিটামল কিনে আনি৷ এত জ্বর নিয়ে সারারাত ট্রেনে যাবি কী করে?

আমি যাব না৷ আমি তোদের বাড়ি যাব৷ আমাকে জানতে হবে ওই মহিলা কে? ওনার ছবি তুলতে হবে৷

স্পষ্ট গলায় বলে সঞ্জীব৷ তার কথা শুনে ঘাবড়ে যায় প্রিয়ম৷

কী পাগলামি করছিস সঞ্জু৷ আমাদের টিকিট কাটা আছে…..

টিকিট ফেরত দে৷ না হলে তুই চলে যা৷ আমি একাই কুলি ফেরত যাব৷ আমাকে যেতেই হবে৷ নাহলে আমার কনফিডেন্স নষ্ট হয়ে যাবে৷ আমি আর কোনওদিন ছবি তুলতে পারব না৷

সঞ্জীবকে বোঝানোর চেষ্টা করে কোনও লাভ হল না৷ বাধ্য হয়ে শেষপর্যন্ত টিকিট ফেরত দিয়ে এল প্রিয়ম৷ কিন্তু রাতে কুলি ফেরত যাওয়ার কোনও উপায় নেই৷ স্টেশনেই থাকবে৷ তবে পরদিন সকালে যে তারা যাচ্ছে সেটা মাকে ফোন করে জানিয়ে দিল৷ সঞ্জীবের সমস্যাটাও বলল৷ সঞ্জীব অসুস্থ হওয়ায় যে তারা ফিরতে পারছে না সেটা অফিসে জানিয়ে সঞ্জুর বাবাকেও ফোন করল একটা৷ তিনি তো সব শুনে রীতিমত উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, প্রিয়ম যেন সাবধানে বন্ধুকে নিয়ে যায়৷ পরদিন সকালের ট্রেনেই তিনি নিজেও মালদহ রওনা দেবেন৷

সকালের প্রথম বাসেই সঞ্জীবকে নিয়ে রওনা দিল প্রিয়ম৷ সঞ্জীবের জ্বর এখন একটু কম৷ কিন্তু তার চোখ-মুখের উদভ্রান্ত চেহারা মোটেই ভালো লাগছিল না প্রিয়মের৷ বাড়িতে তো খবর দেওয়াই ছিল৷ দুই দাদা বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষাও করছিল৷ তারাই সাইকেলে করে নিয়ে গেল ওদের দুজনকে৷ বসার ঘরে উদ্বিগ্ন মুখে বসে ছিলেন জ্যাঠামশাই৷ প্রিয়মের কাছে ভালো করে সব কথা শুনে তিনি তক্ষুনি বাড়ির সব মহিলাকে ডেকে পাঠালেন৷ আগের দিনই বিসর্জন হয়েছে৷ আত্মীয়-স্বজনরা সবাই তখনও রয়েছে৷ কিন্তু তাদের মধ্যে কেউই সঞ্জীবের দেখা সেই মহিলা নন৷ এবার সঞ্জীবের অবস্থা দেখে জ্যাঠামশাই নিজেও একটু ঘাবড়ে গেলেন৷ তবে তিনি ঠান্ডা মাথার মানুষ৷ তাই ভেবেচিন্তে বললেন, এক কাজ করা যাক, সঞ্জীব এখন ওষুধ খেয়ে একটু ঘুমোক৷ ততক্ষণে আমি গ্রামের সবার বাড়িতে খবর পাঠাই৷ পুজোর জন্য তো অনেকেই এসেছিল৷ হয়তো তাদের মধ্যেই কাউকে দেখেছে সঞ্জীব৷

মনে মনে অবশ্য তিনি ভাবছিলেন, বিকেলের মধ্যে যদি সঞ্জীবের বাবা এসে পড়েন, তাহলে তাঁরা একটু নিশ্চিন্ত হতে পারেন৷

দোতলার সেই কোণের ঘরটাতেই সঞ্জীবকে নিয়ে এসে শুইয়ে দিলেন প্রিয়মের মা৷ তিনটে দিন এঘরে থাকলেও রোজই তো ভোরবেলা বেরিয়ে গেছে আর রাতে ঘরে ঢুকেছে৷ তাই ঘরটাকে ভালো করে দেখাই হয়নি৷ আজ খোলা জানলা আর আলো ভাসাভাসি ঘরটা দেখে কেমন যেন আরাম হল সঞ্জীবের৷ কিন্তু শরীরও আর দিচ্ছে না৷ বিছানায় শুতেই চোখ জড়িয়ে এল ঘুমে৷ কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল জানে না৷ ঘুম ভাঙল বাবার গলার আওয়াজে৷ ছেলের কপালে হাত দিয়ে জ্বর কতটা বোঝার চেষ্টা করছিলেন সঞ্জীবের বাবা৷ প্রিয়মের বাবা আর জ্যাঠামশাইও ঘরে আছেন৷ একটু অপ্রস্তুত হয়েই উঠে বসল সঞ্জীব৷ আর বসেই স্তম্ভিত হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চেঁচিয়ে উঠল, ওই তো, ওই তো৷ আপনারা বলছিলেন উনি এই বাড়ির কেউ নন৷ ওই তো ওনার ছবি….

সঞ্জীবের চোখ দেওয়ালের দিকে৷ সেখানে ঝুলছে এক সদ্যবিবাহিত দম্পতির ছবি৷

কী বলছ তুমি পাগলের মতো! ওনাকে দেখেছো!

জ্যাঠামশাইয়ের গলা রীতিমত কাঁপছে৷

হ্যাঁ৷ ওনাকেই দেখেছি৷ উনিই আমাকে দুধ এনে দিয়েছিলেন৷ ওনারই ছবি আমি তুলেছিলাম৷ কোনও ভুল নেই…..

ততক্ষণে ঘরে এসে জড় হয়েছেন বাড়ির অন্যরাও৷ সঞ্জীবের কথা শুনে আতঙ্কে শিউরে উঠে মুখে আঁচল চাপা দিলেন প্রিয়মের মা৷

তুমি ওনাকে দেখতে পারো না৷ তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে৷ মাথা ঠান্ডা করো বাবা৷

জ্যাঠামশাইয়ের কথা শুনে এবার রীতিমত রেগে ওঠে সঞ্জীব, না ভুল আমার হচ্ছে না৷ আর আপনিই বা এত নিশ্চিত কী করে হচ্ছেন? উনি কি এবার আসেননি?

ঘরের মধ্যে কিছুক্ষণ একটা অদ্ভূত নৈঃশব্দ, যেন পিন পড়লেও শব্দ শোনা যাবে৷ তারপর জ্যাঠামশাই আস্তে আস্তে বললেন, সঞ্জীব, এনারা দুজন হলেন আমার সবথেকে ছোট ভাই আর তার বউ৷ বাইশ বছর আগে এক ট্রেন দুর্ঘটনায় দুজনেই মারা গেছেন৷ ঠিক এই কালীপুজোর সময়েই৷ খবর যখন এল, তখন ঠাকুরের প্রাণপ্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে৷ তাই পুজো বন্ধ করা যায়নি৷ কিন্তু সে যে কী ভয়ানক পুজো….৷ তাই বুঝতেই পারছ, ওনাকে তুমি দেখতে পারো না৷

সঞ্জীব স্তম্ভিত৷ ঘরের সবাই চুপ৷ হঠাৎ ভারী আশ্চর্যরকম শান্ত গলায় সঞ্জীবের বাবা বললেন, ওনারা যখন মারা যান তখন ওনাদের সঙ্গে আর কেউ ছিল?

প্রিয়মের বাবা উত্তর দিলেন, হ্যাঁ ছিল৷ ওদের তিনমাসের সন্তান৷ ছেলে হতেই বউমা বাপের বাড়ি গেছিলেন৷ কালীপুজোর সময় আমাদের বাড়ির বউরা কেউ বাইরে থাকে না৷ তাই ছোটু গেছিল ওকে আনতে৷ দুটো ট্রেনের মুখোমুখি ধাক্কা লেগেছিল৷ সব তালগোল পাকিয়ে যায়৷ কাউকেই আর চেনা যাচ্ছিল না৷ বাচ্চাটাকে তো আমরা কেউ চোখেই দেখলাম না৷

বাচ্চাটার কোনও ছবি আছে আপনাদের কাছে? কিছু শুনেছিলেন ওর সম্বন্ধে?

এবার এগিয়ে আসে প্রিয়মের ছোট পিসি, ছবি তো নেই৷ তবে ছেলে হওয়ার পর বউরানি আমাকে লিখেছিল, খুব নাকি ফর্সা হয়েছে আর বাঁ হাতের ভিতর দিকে নাকি একটা লাল পদ্মফুলের মতো জরুল আছে৷

ইলেকট্রিক শক লাগার মতো চমকে উঠে সঞ্জীব৷ তার জ্যাকেটের বাঁ-হাতটা গোটাতেই বেরিয়ে পড়ে লাল পদ্মফুলের মতো জরুল৷

সন্তানের টানেই বউমা এসেছিল৷ আমরা কেউ ওকে চিনতে পারিনি….কিন্তু মা ঠিক সন্তানকে চিনেছে৷

জ্যাঠামশাইয়ের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে৷

সেদিন ওই ট্রেনে আমি আর আমার স্ত্রীও ছিলাম৷ ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাই৷ একটা ঝোপের মধ্যে সঞ্জীব পড়েছিল৷ আমার স্ত্রীই ওকে প্রথমে দেখতে পেয়েছিলেন৷ কাদের ছেলে জানার জন্য অনেক চেষ্টা করেছিলাম৷ কিন্তু সন্ধান পাইনি৷ তখন আমরাও নিঃসন্তান৷ তাই ভাবলাম ঈশ্বরই নিশ্চয় ওকে আমাদের কাছে পাঠিয়েছেন৷ সঞ্জীব আমাদেরই ছেলে হয়ে গেল৷

ভাগ্যিস হয়ে গেল…..

সঞ্জীবের বাবার দু-হাত ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠেন জেঠিমা,

তাই তো শেষ পর্যন্ত ছোটুর বংশধরকে চোখে দেখতে পেলাম৷ ও আপনাদেরই ছেলে৷ আর এখন থেকে এটা আপনাদের সবার নিজের বাড়ি৷ আপনারা এখন আমাদের আত্মার আত্মীয়……

জেঠিমার কথা শুনতে শুনতে সঞ্জীবের মনে হল, ফ্রেমিং তো তারমানে ঠিকই ছিল৷ ছেলেকে দেখতে এল কিন্তু তাকে চিরকালের জন্য ফ্রেমে বন্দি সে করতে পারল না৷ হারিয়ে যাওয়া মা ক্যামেরায় ধরা দিল না৷

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *