ফুলডোরে বাঁধ ঝুলনা
সরস্বতী পুজোর দিন ফুলওয়ালি মাসির পসরায় এখন এখন শুধু গুটিকতক গাঁদাফুল, কিছু বেলপাতা আর দুব্বোঘাস পড়ে আছে। খরিদ্দার রাগ করছেন—কী মাসি! সেই সেসব কোথায়—পলাশ ফুল, আমের মুকুল, যবের শিষ—এসব কোথায়? মাসি বলল—সব শেষ হয়ে গেছে। খরিদ্দার বলল—সে কি! তা হলে কী হবে? এবার তার রাগ গিয়ে পড়ল পুরুতের ওপর—আর এই বামুনগুলো! কী যে সব ফর্দ দেয়! আগে সরস্বতী পুজো হবে। বিদ্যার দেবী বলে কথা—তাঁর করকমলের মধ্যেই যেখানে লেখনী-পুস্তকের উদ্যত সৌন্দর্য, সেখানে আবার এই পলাশ ফুল, আমার মুকুলের দরকারটা কী পড়ে? ফুলের দোকানের সামনে আমার মতো একটি চেনা মুখ দেখে ভদ্রলোক ভরসা পেয়ে বললেন—এই তো বাঁচা গেছে। আপনি তো মশায় ‘সংস্কৃত-টংস্কৃত’ পড়েছেন—তা বলতে পারেন—এসবের মানে কী। সরস্বতী পুজোর মধ্যে আবার পলাশ ফুল, আম্রমুকুল—এসব ফর্দের মানে কী? এগুলো বাদ দিলে কি কোনো অসুবিধে হবে? পুজোয় কোনো খুঁত থেকে যাবে না তো?
আমি বললুম—না পেলে আর কী করবেন? কলকাতা শহর, এখানে তো আর গাছে উঠে পলাশ ফুল, আমের মুকুল পেড়ে আনা যাবে না। অভাবে মনে মনেই দেবেন ঠাকুরকে—তিনি হৃদয় দেখেন, ফুল-বেলপাতা গুনে দেখেন না। ভদ্রলোক বললেন—তাহলে বামুনের এসব ফর্দ কেন? নিছক বামনাই ফলানোর জন্য…। আমি বললুম—না মশাই! বামুন যে কেন অমন ফর্দ দিয়েছে, তা হয়তো সে নিজেও জানে না। কিন্তু আমাদের দেশে একটা পুজো মানেই শুধু মৃন্ময়ী প্রতিমার মাধ্যমে মানুষের অন্তরাত্মাকে আহ্বান করা নয়, এই আবাহনের সঙ্গে জুড়ে আছে প্রকৃতির আবাহন। সরস্বতী পুজোর সঙ্গে জুড়ে আছে বসন্তের আগমনধ্বনি। শীত শেষ হয়ে গেছে, হাওয়ার গতি উলটো হয়ে উত্তুরে হাওয়া দখিনা বাতাসে যেই পরিণত হয়, তখনই আসে সরস্বতী পুজো। পলাশ ফুলের কুঁড়ি, আমের বোল, যেহেতু নতুন বসন্তের বার্তা বয়ে আনে, তাই শরৎকালীন দুর্গাপূজার বৃহদন্তরে থাকা সরস্বতী পুজোয় আমরা বসন্তের আবাহন করি পলাশের কুঁড়ি আর আমের মুকুল দিয়ে। শীতের আবরণ ভঙ্গ করে বসন্ত তখন জাগ্রত হয়ে ওঠে।
আমি যে দোলপূর্ণিমার কথা ছেড়ে বসন্তের কথা বলতে আরম্ভ করেছি, তার কারণ—বহু পুরাতনকালে ‘দোলযাত্রা’ বলে কিছু ছিল না, এমনকি দোলযাত্রার প্রখ্যাত নায়ক-নায়িকা যে-দুজন, সেই কৃষ্ণ-রাধার আমলেও আনুষ্ঠানিক ভাবে ‘দোলযাত্রা’ বলে কিছু পাওয়া যাবে না। তবে হ্যাঁ, মহান আনন্দ-উৎসবের সঙ্গে নাচন-কোদন, দোলা-ঝোলার যোগ আছে যেহেতু, তেমনই বসন্তোৎসবের সঙ্গেও দোলায় ওঠার একটা যোগ আছে। যাঁরা ভাবেন—কোনো এক মধুর বসন্ত রজনীতে দোলমঞ্চ তৈরি করে রাধাকৃষ্ণকে দোলানো হয়েছিল এবং তখন থেকেই দোলযাত্রা শুরু হল—তাঁরা নিঃসন্দেহে ভ্রান্ত। সত্যি বলতে কি, দোলায় ওঠা বসন্তোৎসবের একটি সুখকর অঙ্গমাত্র। সেকালের দিনের রাজা-রাজড়াদের উদ্যানবাটিকার মধ্যেই দোলনা থাকত অথবা বসন্তোৎসব উপলক্ষে লাগানো হত এবং বসন্তোৎসবের আনন্দ জাগ্রত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমোদ-প্রমোদের নতুন কৌতূহল প্রয়োগ করার তীব্র ইচ্ছাটুকু বড়মানুষদের প্রবৃত্ত করত দোলায় আরোহণে।
বসন্তোৎসবের সময় বাসন্তী পূর্ণিমার রাত্রে দোলায় আরোহণ করার ব্যাপারে কৃষ্ণ-রাধাই যে প্রথম এবং শেষ যুগল নন, তার প্রমাণ দেখুন কালিদাসের মালবিকাগ্নিমিত্র নাটকে। সেখানে দেখবেন বসন্তোৎসব আরম্ভ হয়েছে ধুমধাম করে। নাটকের নায়ক রাজা অগ্নিমিত্র বসন্তোৎসব ঘোষণা করেছেন রাজ্যে। নাটকের অন্যতম পাত্রী অগ্নিমিত্রের দ্বিতীয় স্ত্রী ইরাবতী সখী নিপুণিকার মাধ্যমে অগ্নিমিত্রের কাছে সংবাদ পাঠিয়েছেন—’আর্যপুত্রের সঙ্গে দোলায় আরোহণ করতে চাই।’ বসন্তের হাওয়ার কচি কচি পাতাগুলি আন্দোলিত হয়ে রাজাকেও যেন তাড়া দিচ্ছিল—রাজকর্ম ছেড়ে প্রমোদবনে ছুটে যাবার জন্য। রাজার পাটরানি ধারিণী পূর্বাহ্ণেই পৌঁছে গেছে সেখানে। কিন্তু উদ্যানবাটিকার সুসজ্জিত দোলায় দোল খেতে গিয়ে বিদূষকের চপলতায় পায়ে আঘাত পেলেন ধারিণী। তিনি তাঁর পদাঘাতে অশোককুঞ্জের ফুল ফোটাতে যেতে পারলেন না। সেই কাজের জন্য তিনি পাঠিয়ে দিলেন নবীনা যুবতী মালবিকাকে। এইখানে বিপদ ঘটে গেল রাজার দ্বিতীয় মহিষী ইরাবতীর। তিনি আর্যপুত্রের সঙ্গে দোলায় আরোহণ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সে সাধ তাঁর মিটল না। নবীনা যুবতী মালবিকার জালে বাঁধা পড়লেন অগ্নিমিত্র। বিদূষক মন্তব্য করলেন—মাতাল যদি মুখ বদলানোর মতো মাছের ডিম পায়, রাজাও তেমনি ইরাবতীর বাসন্তিক আহ্বান অবহেলা করে তাকিয়ে রইলেন মালবিকার দিকে। উদ্যানবাটিকার দোলনাটি খালিই পড়ে রইল।
দোলনা থাক খালি পড়ে। কিন্তু বসন্তোৎসবের অনুষঙ্গে দোলনা একটা ছিল এবং তাতেই জোর দিয়ে বলতে পারি যে, বসন্তের দিনে অথবা রাত্রে কৃষ্ণ যতবার গোপরমণীদের সঙ্গে মিলিত হয়েছেন, তার মধ্যে কয়েকবার নিশ্চয়ই তিনি গোপীশ্রেষ্ঠা শ্রীমতীর সঙ্গে দোলায়ও চড়ে থাকবেন। কিন্তু দোলায় আরোহণের চেয়েও বড় কথা হল নায়ক কৃষ্ণের বসন্ত-বিহার—যার মধ্যে দোলারোহণের অনুষঙ্গ যেমন আছে, তেমনই আছে গানের অনুষঙ্গ, মদ্যপানের অনুষঙ্গ, উদ্দাম নৃত্যের অনুষঙ্গ এবং একেবারে শেষে ধর্মের অনুষঙ্গ। সত্যি কথা বলতে কি, ধর্মের অনুষঙ্গটাই এখানে সবচেয়ে দুর্বল এবং তা প্রমাণ হয়ে যায় স্মৃতিশাস্ত্রকারদের শিথিল অভিসন্ধি থেকে। ফাল্গুনী পূর্ণিমার দিনে শ্রীগোবিন্দের দোলযাত্রা উৎসব পালন করতে হবে—এটা স্মৃতিশাস্ত্রের একটা সামান্য বিধিমাত্র। একই সঙ্গে বিধান দেওয়া হচ্ছে পূর্ণিমা তিথি থেকে পঞ্চমী পর্যন্ত ছয়টি তিথিতেই দোলযাত্রা উৎসব পালন করা যায়। বঙ্গদেশে যাঁরা পঞ্চম দোল, অষ্টম দোল ইত্যাদি দেখেছেন, তাঁরা বুঝবেন যে, নির্দিষ্ট একটি তিথি-নির্দেশের শিথিলতা এবং অন্তত ছ-দিনের যে-কোনো একটি দিনে এই উৎসবের পালনীয়তা থেকে প্রমাণ হয়—পুরাকালে বসন্তোৎসবের মধ্যে যে দীর্ঘায়িত উৎসবের পরিকল্পনা হত, তারই ছায়া পড়েছে দোলযাত্রাবিধির মধ্যেও। ঠিক এই নিরিখে দেখলে পরে কৃষ্ণকে অথবা রাধাকে শুধুমাত্র একটি দোলার মধ্যে আবদ্ধ রাখা যাবে না, তাঁদের নামিয়ে আনতে হবে প্রকৃতির রাজ্যে, বসন্তের হাওয়ায়, জ্যোৎস্না রাতে….মাতাল সমীরণে।
একথা মনে রাখতে হবে, আমি দোল পূর্ণিমার ক্ষেত্রে স্মার্তবিধিটুকুর মর্যাদা হয়তো সামান্য খর্ব করেছি, কিন্তু দোল পূর্ণিমার নায়কের মর্যাদা খর্ব করিনি। তিনি এমনই এক পুরুষোত্তম, যাঁকে ভারতবর্ষের সমস্ত মিলন-মাধুর্যের মধ্যে যেমন পাওয়া যায়, তেমনই পাওয়া যায় ঋতুর সঙ্গেও জাগরণে, সুরের সমারোহে। কৃষ্ণ এখানে ঋতুর সঙ্গেও যেমন জড়িত, তেমনই সুরের সঙ্গেও। ভগবদগীতায় অর্জুনকে আপন বিভূতি দেখানোর সময় কৃষ্ণ বলেছিলেন—জান তো অর্জুন! সমস্ত ঋতুর মধ্যে যেখানে আমি প্রতিষ্ঠিত, সেটা হল বসন্ত ঋতু—ঋতুনাং কুসুমাকরঃ। আবার রাগ বসন্তের দিকে তাকিয়ে দেখুন, বসন্তরাগের যে রূপ, কৃষ্ণের রূপও তাই। গীতরসিক ব্যক্তিরা বসন্তরাগের যে রূপ কল্পনা করেছেন—তাতে কৃষ্ণের মতোই তার গায়ের রঙ—ইন্দীবরশ্যাম অথবা ভ্রমরকৃষ্ণ। তার মাথায় একটি শিখিপুচ্ছও আছে।
সেই যে সরস্বতী পুজোর কথা বলেছিলাম—যদি সব দিকে খেয়াল করেন তবে দেখবেন, ওই সরস্বতী পুজোর দিন থেকেই দোল পূর্ণিমার বসন্তমুখর গানগুলি শুরু হয়ে যায়। বৃন্দাবনের সমস্ত রাধা-গোবিন্দের মন্দিরেই শ্রীপঞ্চমীর দিন থেকেই জয়দেবের লেখা গান আরম্ভ হয়ে যায় বসন্তরাগে—বিহরিত হরিহিহ সরস-বসন্তে। ললিত-লবঙ্গ-লতা-পরিশীলন-কোমল-মলয়-সমীরে। আসলে দোলনা নয়, দোলযাত্রা নয়, আসল নায়ক হলেন কৃষ্ণ যাঁর লীলায় উদ্দীপন ঘটে বসন্তকে কেন্দ্র করে এবং এই কেন্দ্রিকতার দিক দিয়ে দেখতে গেলে স্বয়ং বসন্তও কম বড় নায়ক নয়। কুমারসম্ভবের কবি তাঁর অসামান্য সুন্দরী নায়িকা পার্বতীকে শিবের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার সময় স্বয়ং ভালোবাসার দেবতাকে কাজে লাগিয়েছিলেন। কিন্তু সেই দেবতাও এই প্রথম মিলন ঘটানোর জন্য তাঁর বসন্ত-সখাকে নিয়ে এসেছিলেন সঙ্গে করে। বসন্ত ছাড়া নাকি প্রেমিক-প্রেমিকার মিলন ঘটানোই সম্ভব নয়। যে বসন্ত শিবের মতো বৈরাগী মানুষকেও মুহূর্তের জন্য পাগল করে তুলেছিল, সেই বসন্তে কৃষ্ণের মতো প্রেমিকের অথবা রাধার মতো আত্মনিবেদিতার কী অবস্থা হতে পারে, তা গীতগোবিন্দের কবি একটি বাক্যেই বলে দিয়েছেন—বসন্তের হাওয়া—সে হওয়ার মধ্যেই এমনই এক জোশ আছে, এমনই এক প্রাণশক্তি আছে—যা প্রেমিক-প্রেমিকার হৃদয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়—ইহ হি দহতি চেতঃ…..প্রাণবদ গন্ধবাহ।
আমি শুধু আশ্চর্য হই ভাগবত পুরাণের কবির কথা ভেবে। কৃষ্ণের শৈশব থেকে আরম্ভ করে যৌবনসন্ধি পর্যন্ত বৈচিত্র্যময় যে জীবন, তার বর্ণনা ভাগবত পুরাণের কবির মতো কেউ করতে পারেননি। বিশেষত এই পুরাণের দশম স্কন্ধে গোপরমণীদের সঙ্গে যে রাসনৃত্যের বর্ণনা আছে, সেই পঞ্চাধ্যায়ের অনুপম কবিত্ব সংস্কৃত সাহিত্যের আর কোথাও আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু কী দুর্ভাগ্য দেখুন, এই অনুপম রাসনৃত্যের ঘটনা কিন্তু ঋতুরাজ বসন্তের পরিসরে ঘটেনি। ঘটেছে শরৎকালে। বসন্তকে যিনি ঋতুশ্রেষ্ঠ মনে করে তার সঙ্গে একাত্ম হয়েছেন গীতায়, সেই কৃষ্ণের সবচাইতে ‘রোমান্টিক’ ঘটনাটি পৌরাণিকের অভিসন্ধিতে শরৎকালে গিয়ে পড়ল—সর্বাঃ শরৎকাব্যকথারসাশ্রয়াঃ। দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কী বলব একে।
অথচ এ-বাবদে কৃষ্ণজ্যেষ্ঠ বলরামের ভাগ্যটা দেখুন। তিনি কৃষ্ণের মতো বিলাসীও নন, তত রোমান্টিক মানুষও নন এবং সেইজন্য সবাই ভাবেন—কৃষ্ণ একাই বুঝি গোপী সঙ্গে নটন রঙ্গে রাসবিহার করতে পারেন, বলরাম পারেন না। কিন্তু জেনে রাখুন বলরামেরও একটা রাস আছে পুরাণে। এবং তিনি কিন্তু শরৎকালের ওপর এত করুণাশীল নন। তিনি সহজ-সরল সিধে মানুষ। তিনি জানেন—বসন্তঋতু শ্রেষ্ঠ, অতএব সময় বুঝেই যেতে হবে বৃন্দাবনে। কৃষ্ণ তখন মথুরায় কংস-ধ্বংস করে মগধরাজ জরাসন্ধের আক্রমণ থেকে বাঁচবার জন্য দ্বারকা-নগরীতে পাকাপাকিভাবে বসবাস করছেন, রুক্মিণী-সত্যভামার সঙ্গে বিয়ে-থাও তখন হয়ে গেছে। নতুন আলোয় নতুন সিন্ধুপারে নতুনভাবে কাটছে তাঁর জীবন। কিন্তু বলরাম—সাদা-সিধে মানুষ—হাজার দ্বারকাবাস করেও তাঁর মনে পড়ে বৃন্দাবনের কথা। পুরনো দিনের স্মৃতিভার বেশিদিন সইতে না পেরে বলরাম অতএব চলে এলেন বৃন্দাবনে। তখন বসন্তকাল চলছে।
অনেকদিন পর বলরামের সঙ্গে গোপবৃদ্ধদের দেখা হল। কুশল-বিনিময়, প্রণাম আশীর্বাদ শেষ হবার পর বলরামের সঙ্গে দেখা হল সখা-বন্ধুদের সঙ্গে। সেখানেও হাসি-ঠাট্টা, হাত-ধরাধরি করে অন্তর বিনিময় হল। এবারে সরলা গোপ-রমণীদের পালা। এঁদের মুখোমুখি হতে বলরামের ভয়ও ছিল, অস্বস্তিও ছিল। তাও সঙ্গত কারণেই—কৃষ্ণ যে সেই তাদের ফেরবার আসা দিয়ে বৃন্দাবন ছেড়ে মথুরা-দ্বারকায় পালালেন, তদবধি আর ফেরেননি। অতএব বলরামের সঙ্গে দেখা হতেই গোপ-সুন্দরীরা তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন—কেমন আছেন তিনি? তাঁর খবরটা কী? শহুরে মেয়েদের ভালোবাসার মুগ্ধ হয়ে বেশ সুখেই আছেন নিশ্চয়—ক্বচিদাস্তে সুখং কৃষ্ণং পুরস্ত্রীজনবল্লভঃ? এখানে মা-বাপ-ভাই-বন্ধু কারও কথা কি তার মনে পড়ে না?
বলরাম কোনোরকমে এসব অপ্রিয় প্রসঙ্গের উত্তর দিলেন। কোনোরকমে শান্ত করলেন রোদনোন্মুখ ব্রজরমণীদের। বলরাম নিজে কাঠখোট্টা গোছের মানুষ—সময় বুঝে পুরাতন বনস্থলীতে একটু আনন্দ করতে এসেছেন, এর মধ্যে কোনো মাথুর-বিরহ তাঁর বাসন্তিক স্ফূর্তি নষ্ট করুক, এ তিনি চাননি। কারণ তাঁর মনে আছে—শরৎকালের জ্যোৎস্না-ধোওয়া রাত্রিগুলোতে কৃষ্ণ এখানে রাসনৃত্যে মাতিয়ে রেখেছিলেন গোপরমণীদের। এসব ব্যাপারে কৃষ্ণের সঙ্গে পারবেন না জেনে তিনি তখন নিঃসঙ্গভাবে কাল কাটিয়েছেন। কিন্তু এবার আর তিনি ভুল করলেন না। তিনি এসেওছেন সময় বুঝে এবং থাকবেনও বসন্তের দুটি মাস—দ্বৌ মাসৌ তত্ত চাবাসীন মধু-মাধবমেব চ। মধু মানে চৈত্র, মাধব মানে বৈশাখ—এই দুই মাসকেই তখন বসন্তকাল বলা হত। মধু-মাধব থেকে কী করে ফাল্গুন-চৈত্রে সরে এল বসন্তকাল—সে আরেক ইতিহাস। সে-কথা অন্য সময়ে হবে। মোদ্দা কথা, বলরাম বসন্তের দুই মাস বৃন্দাবনে থেকে গেলেন।
বৃন্দাবনের পরিবেশটা খ্রিস্টীয় দ্বিতীয়-তৃতীয় শতাব্দীতেও—যখন হরিবংশ রচনা হচ্ছে অথবা ভাসের নাটক লেখা হচ্ছে—তখনও পর্যন্ত বৃন্দাবন ব্রাহ্মণ্যসংস্কারে তত অধ্যুষিত নয়। বেদপাঠ এবং হবির্ধূমে আমোদিত নয় বৃন্দাবনের সামাজিক পরিবেশ। এখানে ভোরের বেলায় গোপরমণীদের দধিমন্থধ্বনির তালে তালে দিন আরম্ভ হয়—আর ব্রাহ্মণ্য সংস্কার শুদ্ধিতে দিগ্ধ নয় বলেই রাতের বেলায় যদি জ্যোৎস্না ধুয়ে যায় বনাঞ্চল তখন ভাসের নাটকে বুড়ো গয়লা ভাঙা গলায় বৃন্দাবনের সুন্দরীদের ডেকে বলেন—ও বনমালা! ও চন্দ্ররেখা! তাড়াতাড়ি এসো। নাচ হবে। বাদ্যিবাজনা নিয়ে এসো সব। দামোদর কৃষ্ণ আসছেন নাচতে। ভাসের নাটকে দেখবেন বলরামের উৎসাহও এখানে কিছু কম নেই। ছোটভাই কৃষ্ণও এসেছেন নাচতে, অতএব বলরাম সেখানে পূর্বাগত। ঘোষসুন্দরীরা নাচতে আরম্ভ করলেই বলরাম হেঁকে বলেন—ওরে বাজা। বাজা। বাদ্যি বাজা।
বোঝায় যায়, এমন নাচ বৃন্দাবনে স্বভাবসিদ্ধ। কাজেই রসিক লেখক কৃষ্ণের অনুপস্থিতিতে ভাগবতের পৌরাণিক প্রেমিক মনের ছোঁয়া লাগিয়ে দিলেন বলরামের হৃদয়ে। ফলে বসন্তপূর্ণিমার রাত্রে পূর্ণচন্দ্রের জ্যোৎস্না যখন যমুনার তীরঘেঁষা গাছের আড়ালগুলিতে অস্পষ্ট আলোর আভাস ফেলছিল, শাপলা ফুলের বন্য গন্ধ যখন আমোদিত করছিল বৃন্দাবনের আরণ্য পরিবেশ ঠিক তখনই কৃষ্ণজ্যেষ্ঠ বলরাম রাসনৃত্য আরম্ভ করলেন ব্রজরমণীদের সঙ্গে—বলরামের বসন্তরাস—যমুনোপবনে রেমে সেবিতে স্ত্রীগণৈঃসহ।
বলরাম যেহেতু কৃষ্ণের মতো সহজ প্রেমিক নন, তাই বৃন্দাবনের বন্য বারুণী মদ্য পান করে পূর্বাহ্ণেই নিজেকে সামান্য চেতিয়ে নিয়েছেন তিনি। বৃন্দাবনের রমণীরাও এ বাবদে কিছু কম যান না। এঁরা নিশ্চয়ই কৃষ্ণপক্ষের রাধা কিংবা ললিতা-বিশাখার গোষ্ঠী নন এবং সেইজন্যেই যাঁর সঙ্গে যা, তেমনই ব্যবহার করেছেন তাঁরা। বলরামের সঙ্গে তাঁরাও দেখছি—সময় বুঝে মানুষ দেখে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন বারুণীর সুধাপানে—ললনাভিঃ সমং পপৌ। কৃষ্ণের মতো বলরামের মাত্রাজ্ঞান নেই। অতএব মদপাটলিত চক্ষু দুটি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বসন্তের উন্মাদনায় এমনই রাসনৃত্য আরম্ভ করলেন বলরাম যে, তাঁর কানের একটি কুণ্ডলই কোথায় খসে পড়ে গেল। অবশ্য তাতে কী, গলায় আজানুলম্বিত বৈজয়ন্তী মালা দুলিয়ে কানের একটি কুণ্ডল নিয়েই বসন্তনৃত্য করে গেলেন রলরাম।
বারুণীর মাত্রা কিছু বেশি ছিল এবং বসন্তোৎসবে তা অস্বাভাবিকও নয়। তাছাড়া এই মদ্যপানের ব্যাপারে বলরামের অভ্যাস এবং মনোযোগ দুটোই প্রবল ছিল। মধুমাস এবং বারুণী মধু—এ দুটোই এমন উতলা করে তুলল স্খলিত স্বরে আদেশ দিলেন—যমুনে! তুমি এদিকে এসো, আমরা সবাই স্নান করবো—স আজুহাব যমুনাং জলক্রীড়ার্থমীশ্বরঃ। নির্দিষ্টগতি নদীর স্বভাবে যমুনা প্রাথমিকভাবে সে আদেশ পালন করেননি বলে নানা গণ্ডগোল বেধে উঠেছিল এবং সেই গণ্ডগোলকেও আমরা বসন্তোৎসব বা হোলির অঙ্গ বলে মনে করি। এখনকার দিনেও হোলির উৎসবে এমন খুনখারাপি হয় যাতে উৎসব বিপন্ন হয়ে ওঠে মাঝে মাঝে। হোলির সুবিধে নিয়ে কখন যে কে পাঠান কেসর খাঁ-কে হোলি খেলার আমন্ত্রণ জানিয়ে বসে, তা বলা যায় না।
আসলে বসন্তোৎসবের মধ্যে একটা উদ্দাম ব্যাপার আছে, এখনকার দোলের অঙ্গ হোলির সঙ্গে যার কোনো তফাত নেই। এখনকার সময়ে দোলের দিন যেমন আবির-পিচকিরির রঙে রাস্তায় তিষ্ঠতে পারা যায় না বলেই সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়, তখনকার দিনে তেমনই রাজ্যের রাজারা নিজেরাই সমস্ত রাজকর্মে ছুটি দিয়ে বসন্তের রঙে মাতোয়ারা হতেন, শামিল হতেন জনগণের সঙ্গে—আবিরেগোলাপে। আপনারা তো হর্ষবর্ধন শিলাদিত্যের নাম শুনেছেন। তিনি বড় কবি ছিলেন এবং অন্তত তিন তিনখানা নাটক লিখেছিলেন বলে পণ্ডিতেরা মনে করেন। বৌদ্ধসংঘের দানব্রতে যিনি পরিধানের বস্ত্রখানি পর্যন্ত বিলিয়ে দিয়েছিলেন বলে শোনা যায়, সেই হর্ষদেব তাঁর রত্নাবলী নাটকের নায়ক রাজা উদয়নের ওপর নিজের প্রতিরূপ আরোপিত করে তাঁর রাজ্যের হোলিরঞ্জের নমুনা দিয়েছেন একটু।
সারা রাজ্যজুড়ে বসন্তের হাওয়ার সঙ্গে ছুটির হাওয়া বইছে। নিঃশত্রুক রাজ্যে মন্ত্রীর ওপর রাজকর্মের ভার দিয়ে রাজা উদয়ন নিজেও গা ভাসিয়েছেন বসন্তের হাওয়ায়। রঙের নেশায় রাজধানীর রমণীরা মদ্যপান করে পিচকিরি হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন চতুষ্পথে। বেশ-বাস আর রঙ-ঢঙে তাঁর নেশা জাগাচ্ছেন নাগরিক শহুরে পুরুষদের। মাদলের উদ্দাম তালে-তালে চর্চরী-ধ্বনির সঙ্গে নেচে চলেছে উদ্দাম যুবক-যুবতীরা। আবির আর ধারাযন্ত্রের তালে কর্দমাক্ত হয়ে উঠেছে কৌশাম্বী-নগরীর রাজপথ এবং গৃহপ্রাঙ্গণগুলি। আজকের কালেও দোল পূর্ণিমার দিনে যেটুকু রঙ এখনও অবশিষ্ট আছে, পিচকারির রঙ জল যেটুকু এখনও জনতার দেহ রঙিন করে রাস্তায় উছলে পড়ে, তাতে এই কলকাতা শহরের অনেক অলিগলি কর্দমাক্ত হয়ে ওঠে কৌশাম্বীর মতোই।
উপরিউক্ত পরিচ্ছেদে, আর কিছু খেয়াল না করুণ ‘চর্চরী-ধ্বনি’ নামক শব্দটি মাতায় রাখবেন কিন্তু। চর্চরী শব্দটার নামে এমনিতে উৎসবের কলরোল, অথবা হর্ষধ্বনি। তাই যদি এর মানে, তবে অন্য হাজারো উৎসবের আনন্দেও এই চর্চরী শব্দের প্রয়োগ হতে পারত। কিন্তু আশ্চর্য হল, বসন্তোৎসবের প্রসঙ্গেই ‘চর্চরী-ধ্বনি’র কথা বলেছেন রাজা হর্ষদেব, অন্য কোনও সামাজিক উৎসবে ‘চর্চরী’র প্রসঙ্গই আসে না। তাহলে ‘চর্চরী’ ব্যাপারটা বসন্তোৎসবের সঙ্গেই প্রথমত যুক্ত। এতে বোঝা যায় এই বিশেষ শব্দের আভিধানিক পরম্পরায়। শব্দের হৃদয় বিদীর্ণ করলে দেখা যাবে—ওই ‘চর্চরী’ শব্দটি থেকে চাঁচর কথাটি এসেছে। চাঁচরের সঙ্গে এখন বিভিন্ন প্রাদেশিক ‘মিথ’ যুক্ত হয়ে গেছে । কেউ বলেন—কৃষ্ণ নাকি মেটাসুর অথবা মেট্টাসুরকে বধ করেছিলেন, তারই স্মৃতিতে দোল পূর্ণিমার পূর্বদিনে খড় বা পিটুলি দিয়ে মেটাসুর তৈরি করে সেটাকে পোড়ানো হয়। এখনও পুরীর মন্দিরের পাশে দোলমঞ্চের কাছে চাঁচরের দিন একটি জীবন্ত ভেড়ার গায়ে প্রথাগতভাবে আগুন ছুঁইয়ে দেওয়া হয়। কোনও পণ্ডিতজন আবার এই প্রথার মধ্যে আদিম জনজাতির কৃষি সম্পর্কিত আচারের নিশানা পেয়েছেন। তবে সব কিছুর ওপরে আছে পুরাতন বর্ষের বিদায় এবং নতুন বৎসরের সূচনা। আগে বসন্তকালেই বর্ষবরণ হত, হয়তো সেই কারণেই পুরনো লতা-পাতা খড় পুড়িয়ে চাঁচরের ব্যবস্থা। কিন্তু এ কথাটা কেউ বলেন না যে, পুরাতন কালে ‘চর্চরী’ ধ্বনির মধ্যে বসন্তের প্রারম্ভিক যে হর্ষমুখরতা আর কলরোল ছিল, সেইটাই আসল চাঁচর। আসলে যে অর্থে বসন্তোৎসবের সঙ্গে দোলারোহণের যোগ, যে অর্থে বসন্তোৎসবের সঙ্গে আবিরগোলাপের যোগ অথবা যে অর্থে বসন্তের সঙ্গে মদিরা বা রমণীর যোগ, সেই অর্থেই হরষগীত ‘চর্চরী’ ধ্বনির যোগ অর্থাৎ এটিও বসন্তোৎসবের অঙ্গ।
আমরা সরল মানুষ। দোলপূর্ণিমা বলতে আমরা জানি মঠে, মন্দিরে, বাড়িতে দোলমঞ্চে দোলারূঢ় রাধাগোবিন্দের শ্রী অঙ্গে আবির-কুসুম ছড়িয়ে তিনবার মন্ত্র পড়ব—জয় গোপীমুখাম্ভোজ-মধুপান-মধুব্রত। মৃদঙ্গধীর দোলের কীর্তনের মধ্যে দিয়ে স্মরণ করব—কীভাবে বিনোদিনী রাই সখীদের সঙ্গে ‘রঙ’ মুটকি মাখে, হেত পিচকারি হাতে আপন কুঞ্জ থেকে বেরোবেন তাঁর শ্যামরায়ের সঙ্গে খেলতে। ওদিকে শ্যামরায় আসবেন সখাদের সঙ্গে উদ্দাম কলরোলে চারিদিক মুখর করে। হোলিখেলা আরম্ভ হবে ব্রজবধূদের লজ্জা ভঙ্গ করে। উতলা উত্তরীয় কখন উড়ে যাবে আকাশে স্বেচ্ছায় বা পরেচ্ছায়। দোলের দিন চিরন্তন এই প্রেমিক-প্রেমিকা যেভাবে কেন্দ্রবিন্দুতে এসে পড়েছেন, তার পিছনে কবিদের অভিসন্ধি আছে। আছে রসিক ভক্তের আকূতি। কিন্তু আগে দোল পূর্ণিমার গড়ন ঠিক এমন ছিল না। দোল পূর্ণিমা ছিল অনেকটাই লৌকিক আবেশে ঘেরা, সাধারণ থেকে অসাধারণ—সব রকম প্রেমিক-প্রেমিকার লজ্জাহীনভাবে মিলিত হবার দিন।
প্রেম যেহেতু বসন্তেরই সমবয়সী তাই বসন্তোৎসবের আরেকটা নামই ছিল মদনমহোৎসব। বসন্ত পূর্ণিমার দিনে শত শত ফুল ফোটা উদ্যানে অনঙ্গদেবতার প্রতিকৃতি তৈরি করে বসন্তের ফুলে সেজে প্রেমিক রমণীরা বসন্তেরই ফুল উৎসর্গ করতেন ভগবান অনঙ্গের উদ্দেশ্যে। রাজশেখরের মতো পণ্ডিত রমণীদের বড় বেশি প্রগলভা করে তুলেছে। কিন্তু রাজশেখর তো পরের যুগের মানুষ—খ্রিস্টীয় দ্বিতীয়-তৃতীয় শতাব্দীতে সাক্ষী মানুষ গাহাসত্তসঈর প্রাকৃত কবিতার। সাতবাহন হাল গ্রামের খবর দিয়ে বলেছেন—বাসন্তিকা তরুণীদের ‘সাধুগন্ধিত’ বদনগুলি বড় উজ্জ্বল। বসন্তের সময়ে আমের বনে মধুকর-নায়কদের গুঞ্জনধ্বনি যেমন বেড়ে যায়, তেমনই এই সময়ে গ্রামের মেয়েরাও রসিক পুরুষদের হৃদয় হরণ করে। আর উতলা বসন্তবাতাসে সেই গ্রাম্য রমণীদেরও বেশ-বাস বড় স্বল্প—বাসন্তী রঙ ছোপানো কঞ্চুলিকামাত্র। সাতবাহন হাল সেই কোন যুগে বসন্তাবিষ্ট নাগরক পুরুষদের দোলারূঢ় গোবিন্দের বিশ্লেষণ হয়ে গেছে খোদ গোবিন্দের প্রণামমন্ত্রের মধ্যে—জয় গোপীমুখাম্ভোজ-মধুপান-মধুব্রত—গোপীদের মুখকমলের মধুপানে ঠিক যিনি মধুকরের মতো।
রমণীর মুখাম্ভোজ মধু অবশ্যই সবার ভাগ্যে জুটত না এবং যাদের তা জুটত না, তাদের কাছে উৎসবের দিন পেয়ে মধুই কাম্য হয়ে উঠত। মধু মানে বসন্তও বটে, মদও বটে। কৃষ্ণজ্যেষ্ঠ বলরাম তাঁর বসন্তরাসে, যেমন অতিরিক্ত বারুণী মদ্য পান করে স্খলিত হয়ে পড়েছিলেন, তেমনই সাতবাহন হালের জবানিতে আমরা গ্রাম্যরমণীদের মুখে ‘মধুগন্ধ’ পেয়েছি। কাজেই বেশ বোঝা যায় সেকালের বসন্তোৎসবে রঙ-পিচকারি আর চর্চরীধ্বনির সঙ্গে মধুমদ্যের ব্যবস্থাটাও ছিল আগাগোড়া। এ-কালের বড় ঘরের রমণীরা ‘অলক নেড়ে দুলিয়ে বেণী’ মধুপান করতে পারেন, আর সেকালের রমণীরা সেটা পারতেন না—বললেই হল? যাঁরা সেকালের রমণীদের সবসময়ই নিয়মে বাঁধা বিধবা মনে করেন, তাঁরা কৃষ্ণাগ্রজ বলরামের সঙ্গিনীদের মনে রেখেছেন তো? তাঁরাও বলরামের সঙ্গে বারুণী মদ্য পান করেছিলেন একটু আধটু—ললনাভিঃ সমং পপৌ।
বাসন্তী পূর্ণিমার সঙ্গে মদ্যপানের সম্পর্ক অতি গভীর। আজকের হোলির দিনে বহু মানুষকে—যাঁরা অন্তত দোল পূর্ণিমার ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সঙ্গে তেমন জড়িত নন—তাঁদেরও মদ্যপান করে হুল্লোড় করতে দেখি। বিহার এবং উত্তরপ্রদেশের সান্ধ্য জনতার দিকে তাকালে কৃষ্ণাগ্রজ বলরামকেও শিশু মনে হবে। বসন্তের দিনে এই মদ্যপানের রঙিন আবেশটুকু স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষেই বর্তমান ছিল কালিদাসের কালেও। কালিদাসের মালবিকাগ্নিমিত্র নাটকে রাজার দ্বিতীয় মহিষী ইরাবতীর কথা আপনাদের বলেছি। বিদিশার নিশায় নয়, বিদিশার দিবাভাগেই যে বসন্তোৎসব চলছিল, তাতে প্রগলভা ইরাবতী পরিচারিকাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন—হ্যাঁরে নিপুণিকে। বেশি মদ খেলে মেয়েদের নাকি বেশি সুন্দর দেখায়। কথাটা কি সত্যি। নিপুণিকা স্বামীর মন বুঝে জবাব দিল—এতকাল কথাটা প্রবাদ ছিল বটে, কিন্তু তোমায় যেমন সুন্দর দেখাচ্ছে—তাতে এই প্রবাদটা সত্যি বলেই মনে হচ্ছে।
বসন্তের সরসতায় ইরাবতীর মধুপানের মাত্রাটা হয়তো বেশি হয়ে গিয়েছিল ফলে এই সময়ে স্বামী অগ্নিমিত্রকে দেখতে ভারী ইচ্ছে করছিল তাঁর। কিন্তু মদের প্রভাবে মদালসা ইরাবতীর পা চলছিল না। ইরাবতীর মদের নেশা অবশ্য কেটে গেল মালবিকাকে দেখেই—যিনি বসন্তদিনের ঘটনাচক্রে রাজা অগ্নিমিত্রের তৃতীয়া সহচরী হবেন। সে কথা থাক, কিন্তু মদিরা, মধুমাস এবং মধুরা যুবতী—এই সবকিছুর সঙ্গে একটি মুগ্ধ পুরুষ যোগ করলেই বসন্তোৎসবে সম্পূর্ণতা আসে। এগুলির একটি না থাকলেই অসম্পূর্ণতা।
শুধু এদেশে নয়, সব দেশেই। ওদেশে বিশেষ বসন্তদিনে ভেনাসের উদ্দেশে গোটা বাগান উৎসর্গ করা হত, যেমন আমাদের বসন্তোৎসবে বাগানে অধিকার থাকে ভালোবাসার দেবতা মদনদেবের। পরবর্তীকালে মদনদেব গদিচ্যুত হয়ে গেছেন এবং বসন্তের দোলপূর্ণিমার দিনে শত শত কুঞ্জবনের অধিকার পেয়েছেন স্বয়ং মদনমোহন কৃষ্ণ—কবিরাজ গোস্বামীর ভাষায়—চঢ়ি গোপীর মনোরথে, মনমথেরই মনমথে, নাম ধরে মদনমোহন—পীতাম্বরধরঃ স্রগ্বী সাক্ষান্মন্মথ মন্মথঃ। ওদেশে সুরাপানের উৎসবকে ওঁরা ‘ভিনালিয়া’ বলেন, সেই উৎসবের সঙ্গে ভেনাসের যোগ হল কী করে—তা নাকি অনেক পণ্ডিত ভেবে পান না। আমরা বলি—আমাদের দেশে যেমন করে মধুপান বা মধুমাসের সঙ্গে ভালোবাসার দেবতার অনঙ্গের যোগ হয়েছিল, সেইভাবে ‘ভিনালিয়া’র সঙ্গে ভেনাসের যোগ হয়েছে। ভাষাতত্ত্বের দিক থেকেও যদি দেখা যায় তাহলে ল্যাটিন ‘ভেনাস’ যে ধাতু থেকে এসেছে, ‘ভাইন’ বা ‘ভিনালিয়া’ও সেই ধাতু থেকেই এসেছে; আবার ল্যাটিনের ভগিনী ভাষা সংস্কৃতে ওই একই ধাতুর রূপান্তর ঘটেছে ‘বনিতা’ শব্দের মধ্যে।
তাহলে বনিতা, ভাইন এবং ভেনাসের গর্ভগৃহ যদি একই হয়, তাহলে অবশ্যই বলতে হবে—এই তিন নিয়েই বসন্ত-বিহার। বিশেষত পরবর্তীকালে যিনি বসন্তের অধিষ্ঠাতৃ দেবতা হয়েছেন, সেই কৃষ্ণের উপরিউক্ত কোনো অঙ্গেই অরুচি ছিল বলে মনে হয় না। সেকালের যাদব কৃষ্ণ ক্ষত্রিয় বলেই পরিচিত ছিলেন এবং ক্ষত্রিয় বলেই মদিরায় তাঁর অরুচি থাকবার কথা নয়। আর কৃষ্ণের যুগে সমস্ত বনিতাকুলই তাঁকে ছাড়া নিরালম্বা বোধ করতেন এবং কৃষ্ণও কোনো সরসা রমণীকে সাতঙ্কে অবহেলা করেননি। ভেনাস-এর কথা আর কী বলব, ভেনাস তো তিনি নিজেই। তবে হ্যাঁ, একথা মানতেই হবে, মাত্রাজ্ঞান ব্যাপারটা কৃষ্ণের মধ্যে খুব বেশি মাত্রায় ছিল। মহাভারতের একবারমাত্র আপন মদবিহ্বলতায় তিনি বন্ধুপত্নী তথা নিজের বান্ধবীকল্পা দ্রৌপদীর কোলে পা রেখে বসেছিলেন, নইলে অন্য কোথাও কৃষ্ণকে দাদা বলরামের মতো মদবিহ্বল অবস্থায় দেখা যায় না। অন্যদিকে এমন কেউ বলতে পারবে না যে, ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো রমণীকে তিনি জোর করে অধিকার করেছেন। কাজেই বসন্তের সমস্ত বাড়াবাড়ির মধ্যেও কৃষ্ণকে এমন মধুর পরিমার্জনের মধ্যে আমরা দেখতে পাই, যাতে বাসন্তিক দোলযাত্রা এখন শুধু কৃষ্ণকেই স্মরণে আনে, অন্য কাউকে নয়।
দোলারূঢ় কৃষ্ণের চরিত্র বলার আগে অনারূঢ় অবস্থায় তাঁর চরিত্রটি বলে নেওয়া দরকার। এমন যাঁকে আমরা স্বয়ং ভগবান বলে জানি বা বিশ্বাস করি সেই ভগবত্তার বুদ্ধিটা কৃষ্ণের নিজের যদি থাকত তাহলে আর নরলীলা হত না। নরলীলা যে কৃষ্ণের বৃন্দাবনে তাঁর কোনো ঐশ্বর্য নেই, বড়মানুষের গুমোর নেই, তিনি সবার বড় কাছের মানুষ। গোবর্ধন ধারণ অথবা কংসের পাঠানো দু-চারজন গুপ্তচর ব্রজের মানুষ কৃষ্ণের সঙ্গে সবে একটু সসম্ভ্রমে কথা বলতে আরম্ভ করেছিলেন, কৃষ্ণ সঙ্গে সঙ্গে এই সসম্ভ্রমভাব ঘুচিয়ে দিয়ে বলেছিলেন—আমাকে আপনারা কোনও ভীমবিক্রম পুরুষ ভেবে দূরে সরিয়ে রাখবেন না। আমি আপনাদেরই একজন, আপনারদের মতোই—স্বজাতীয়োস্মি বান্ধবঃ।
ভগবান বলে চিহ্নিত মানুষটির এই সহজ ভাবটাই বৃন্দাবনের বৈশিষ্ট্য। এখানে কেউ কৃষ্ণকে ভগবান বলে সম্মান করে না। তাঁর মা, বাবা, ভাই, বন্ধু এমনকী মেয়েগুলা পর্যন্ত তাকে তথাকথিত সম্মানের চোখে দেখে না। ঠিক এইরকম মধুর ভালোবাসার পরিমণ্ডলে ভগবান বলে চিহ্নিত এই মানুষটির পরম দুর্গতি সৃষ্টি হয় মাঝে মাঝেই। সেই প্রথম দিন থেকে পরম-পুরুষের এই দুর্ভোগ চলেছে কবিদের হাতে। সাতবাহন হালের কথাই ধরুন। তিনি কৃষ্ণচরিত্রের মূল ব্যঞ্জনা প্রকাশ করতে গিয়ে অসাধারণ একটি শ্লোক লিখেছিলেন। তাঁর শ্লোক অনুযায়ী জননী যশোমতী একদিন গোপ রমণীদের সামনে প্রায়-যুবক কৃষ্ণ সম্বন্ধে বলেছিলেন—অজ্জবি বালো দামোঅরেত্তি। যশোমতীর মুখে কৃষ্ণের এই বালকত্বের ভাষ্য শুনে সামনে দাঁড়ানো ব্রজরমণীরা সবাই কৃষ্ণের দিকে তাকিয়ে তেরচা করে অবিশ্বাসের হাসি হেসেছিল।
সাতবাহন হালের উদ্ধৃত এই প্রাকৃত শ্লোকের ব্যঞ্জনাটি অসাধারণ। ব্যঞ্জনাটি পরিষ্কার করে নিলে বেশ বোঝা যায়—সেদিন কৃষ্ণের প্রিয়া বান্ধবীরা কাছাকাছি সব দাঁড়িয়েছিলেন। দুপুরবেলাই গোষ্ঠে যাবার ছলে এই সব রমণীদের সঙ্গে তাঁর আন্তরিক মিলন ঘটেছে। কিন্তু তা যেন কিছুই হয়নি এমন ভাব করেই সন্ধ্যাবেলায় ব্রজরমণীরা আবার এসেছেন। যশোমতীর বাড়িতে কৃষ্ণকে দেখার ছলে। এখন তাঁদেরই সামনে যখন প্রগাঢ় বাৎসল্যরসে জননী যশোমতী এমন বলেন যে, কৃষ্ণ তাঁর ভারী ছেলেমানুষ, তখন কৃষ্ণের লীলা সরসতার প্রত্যক্ষ প্রমাণভূত ব্রজরমণীরা তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসবেনই তো। সাতবাহন হালের এই শ্লোক পরবর্তীকালে চৈতন্য-পার্ষদ রূপ গোস্বামী অন্যভাবে হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন। তাঁর বিদগ্ধমাধব নাটকে কৃষ্ণ গোরু চরিয়ে গোষ্ঠ থেকে ফিরেছেন এবং বৈকালের আসল মুহূর্তে কৃষ্ণ যখন জননী যশোমতীর কোলে মাথা রেখে আধশোয়া অবস্থায় নিশ্চিন্ত হয়েছেন—তখন কৃষ্ণের পালক পিতা স্নেহময় নন্দঘোষ প্রশ্ন তুললেন—ব্রজভূমিতে একটি যুবতী কন্যা দেখে তার সঙ্গে কৃষ্ণের বিয়ে দিলে হয়। কথাটা শুনে যশোমতী বললেন—এখনও যে কৃষ্ণ আমার দুগ্ধমুখ বালক, এখনই তার বিয়ে দেবে কী? যশোমতীর বক্তব্যে কৃষ্ণের সখা মধুমঙ্গল আর থাকতে না পেরে চাপা গলায় বললেন—সত্যি তোমার ছেলেটি দুগ্ধমুখ বটে—সচ্চং দুগ্ধমুহো—সেই দুগ্ধের লোভেই বোধ হয় শত শত ব্রজাঙ্গনারা এই বালকের মুখদুগ্ধ পান করে।
মহামতি রূপ গোস্বামী লীলাসমাহিত হয়ে যে কথা লিখেছেন, তা রসিক ভাবুকের ভাবনার পরিসর। কিন্তু সাধারণ্যে কৃষ্ণচরিত্র যে-রূপ প্রতিভাত, তাতে অসমাহিত ব্যক্তিরা প্রাকৃত দৃষ্টিতে অন্যার্থ করবেনই করবেন। ওই যে বলেছিলেন—ভাগবত পুরাণ—যা নাকি কৃষ্ণজীবনের প্রধানতম অবলম্বন, সেখানে বসন্তকালে কৃষ্ণের রাসলীলা নেই, আছে বলরামের। কিন্তু সে-কথা কি অন্য কবিরা মানতে পেরেছেন? গীতগোবিন্দের কবি তো তাঁর কাব্য আরম্ভ হতে-না-হতেই কালবিলম্ব না করে বসন্তের সুরে গান আরম্ভ করেছেন। বসন্তের এই উদ্দীপনের মধ্যে রাধাকে সঙ্গে সঙ্গে পাননি বটে কৃষ্ণ, কিন্তু নৃত্যপরা যেসব যুবতীরা রাধার অনুপস্থিতিতে আগে আগে কৃষ্ণের কাছে ছুটতেন, বসন্তের প্ররোচনায় কৃষ্ণ তাঁদের অবহেলা করেননি। তাঁদের সঙ্গ যে-ব্যবহার তিনি করেছেন, তা গীতগোবিন্দের ছন্দে এইরকম—শ্লিষ্যতি কামপি চুম্বতি কামপি কামনি রময়তি রামাম।
ঈশ্বরের অবতারতত্ত্বে যাঁরা বিশ্বাস করেন, তাঁরা ভগবান বিষ্ণুর মনুষ্য অবতারগুলির মধ্যে রসাহ্লাদ পূরণের কতকগুলি পরম্পরার কথা বলেন। যেমন তাঁরা বলেন—বিধিসম্মত প্রেমের মধ্যে নৈতিকতার বাঁধন থাকে বলে, সে প্রেম যতই গাঢ় হোক, তার মধ্যে গুরুজনের বাধা এবং সমাজের কার্যমানতা থাকে না বলে সে প্রেমের আপ্লুতি কিছু কম থাকে। তাই তাঁদের মতে রামচন্দ্রের একপত্নীব্রত যতই সামাজিকভাবে মান্য হোক, সে প্রেমের মধ্যে সীমাবদ্ধতাও কিছু আছে। কিন্তু কৃষ্ণের অবতারে প্রেম একেবারে উদ্দাম, এখানে বৈধতা অতিক্রান্ত হওয়ায় প্রেম অনেক বেশি আবেগঘন এবং মধুর। সত্যি কথা বলতে কি, আমরা এই অবতারতত্ত্বের প্রসঙ্গ এনেছি বসন্ত পূর্ণিমার দিকে খেয়াল রেখেই। আমাদের ধারণা ত্রেতা যুগের অবতার বনবাসী রামচন্দ্র সীতার বিরহে বসন্তকালটা এমন কষ্টে কাটিয়েছিলেন যে পরযুগের দ্বাপর অবতারে তা সম্পূর্ণ পুষিয়ে নিয়েছেন।
বাল্মীকিতে দেখবেন—রাবণ যখন সীতাকে হরণ করে নিয়ে গেছেন, তার কিছুকালের মধ্যেই বনবাসী রামচন্দ্রের বনসতিতে বসন্ত এসেছে পুত্র-পুষ্পের শোভায় আলোকিত হয়ে। নীতিনিষ্ঠ রামচন্দ্রের মনও এতে চঞ্চল হয়ে উঠেছে। বাল্মীকি মন্তব্য করেছেন—এই না ভালোবাসার সময়—কালঃ প্রচুরমন্মথঃ। মনে ভালোবাসা আছে, অথচ ভালোবাসার নীতিসম্মত পাত্রীটি নেই। রামচন্দ্রের মতো নরচন্দ্রমাও তাই এই বসন্তের মোহে সীতার প্রতি আসঙ্গলিপ্সায় এমন সব বাক্য ব্যবহার করেছেন যে, তাঁর ওই বসন্তবিলাপ ছোটভাই লক্ষ্মণকে শুনতে হয়েছে মাথা নিচু করে, কোনো প্রত্যুত্তর না দিয়ে। রাম অবতারে যে সাধ অপূর্ণ ছিল কৃষ্ণ অবতারে সেই সাধ পূরণ হয়েছে। জয়দেব থেকে আরম্ভ করে কৃষ্ণদাস কবিরাজ, বিদ্যাপতি থেকে গোবিন্দদাস সকলে মিলে কৃষ্ণের জন্য যে বসন্তের উপহার সাজিয়েছেন, তার সারমর্ম একটাই—শ্লিষ্যতি কামপি চুম্বতি কামপি।
এরই মধ্যে এক অঙ্গ মাত্র দোলযাত্রা, এবং তার উপাঙ্গ হল হোলি খেলা। রাধাকৃষ্ণ দোলায় আরোহণ করবেন—সখা-সখীরা রাগানুগা ভক্তিতে শ্যাম-অঙ্গে ফাগু চড়াবেন—এ তো রীতিমতো ভদ্রসভা ভক্তিমূলক ব্যাপার। কিন্তু দোললীলাকে কেন্দ্র করে রাধাকৃষ্ণের যে ফাগুখেলা বা রঙ খেলা হত, তাকে পদাবলীকারেরা এমন সব পদেই বেঁধেছেন যে প্রাকৃত জনকে—অন্তত রাধাকৃষ্ণের দার্শনিক তত্ত্ব সম্বন্ধে যাঁদের বুদ্ধি শুদ্ধ হয়নি তাঁদের রীতিমতো দ্বন্দ্বে ফেলে দেবে। ব্যক্তিগতভাবে আমি বৈষ্ণব বাড়ির জাতক হওয়ার সুবাদে বহু বহু বৈষ্ণব গৃহে তথা নিজের বাড়িতেও দোল উৎসব দেখেছি। তাতে হোলির যেসব গান হত, তাতে অদ্ভুত একটা পদ্ধতি লক্ষ করেছি। দেখেছি মহাজনপদগুলির প্রথমে গৌরচন্দ্রিকার পর পরই বসন্তকালীন বৃন্দাবন শোভার বর্ণনা হত—মধুবনে শ্যামচাঁদ সরাধিকে দুলছেন আর ফাগুর রঙে ”রাঙা ময়ূর নাচে কাছে রাঙা কোকিল গায়। রাঙা ফুলে ভ্রমর রাঙা মধু খায়”—ইত্যাদি বাসন্তিক বর্ণনা।
এর পরেই দেখতাম—হোলিখেলার তোড়জোড় আরম্ভ হয়ে যাচ্ছে। গানের মধ্যে লক্ষণীয় ছিল দুটি পৃথক দলের যুদ্ধং দেহি মনোভাব। কৃষ্ণ আসছেন সখাদের সঙ্গে আবির গোলালের বিপুল ভার নিয়ে। এই খবর সঙ্গে সঙ্গে চলে যাচ্ছে রাধার কাছে বাঁশির সুরে। গান আরম্ভ হবে—সাজল রে শ্যামমনমোহিনী রাধে। রঙ-পিচকারি হাতে রঙ্গিনী সঙ্গিনী সাথে—রাধারও হোলির ধুম কেমন—সে বর্ণনা চলবে গানে গানে। শ্যামচাঁদের সঙ্গে রাধার প্রথম দেখাটি বড়ই ভক্তিমুখর। নীপশাখে ফুলডোরে বাঁধা ঝুলনায় তাঁরা খানিকক্ষণ দুলতে থাকেন। সখীরা যুগলকিশোরকে ফাগু দেয়—সে বেশ কথা। কিন্তু এরপরেই নটঘট আরম্ভ হবে। দুষ্টা ব্রজবধূরা চোখ-মুখের সন্ধান বুঝে শ্যামচাঁদের দিকে ফাগু ছুড়বেন এবং মুহূর্তে শ্যামের এমন হাল হবে যে, কিছুই তিনি চোখে দেখতে পাবেন না। শেষ পর্যন্ত রাধার দোহাই দিয়ে তিনি ছাড়া পাবেন।
কৃষ্ণের এই বিপাকগ্রস্ত অবস্থায় দ্বিগুণ উদ্যমে আবারও হোলিখেলা আরম্ভ হবে শ্যামসখাদের প্ররোচনায়। দলপতির লজ্জা সামাল দিতে কৃষ্ণপক্ষীয়রা দ্বিগুণ উদ্যমে এগিয়ে আসে। কিন্তু অনুরাগের জগতে যেহেতু রাধারই জয়জয়কার অতএব রাধাই সেখানে চালিকার ভূমিকায় থাকেন। মহাজন-পদগীতে তিনি যেসব শর্ত রাখেন, তার মর্মকথা এই যে—তোমার সখাদের মুরোদ বোঝা গেছে। তোমাকে ধার দিচ্ছে বিশাখা-সখীকে সযূথে, রঙ না থাকলে রঙও দিচ্ছি, দেখি কেমন রঙ খেলতে পার তুমি। বলা বাহুল্য—এ খেলাতেও পদাবলীকারের রাধাপক্ষপাতে শ্যামাচাঁদ হেরে যাবেন এবং লীলাসমাহিত পদকর্তা বৃষভানু রাজনন্দিনীকে সদলে জিতিয়ে দেবেন। শ্যামাচাঁদের সখারা ততক্ষণে পালিয়ে গেছেন। কৃষ্ণের ওপর শেষ আক্ষেপ নেমে আসবে এবার ব্যক্তিগত নাচের প্রতিযোগিতায়। এখানে পুরুষ কেউ না থাকায় শর্তগুলিও সাংঘাতিক ব্যক্তিগত। রাধার বক্তব্য—শ্যাম হেরে গেল তাঁর সমস্ত গর্বের প্রতীক চূড়া-বাঁশি কেড়ে নেওয়া হবে। কৃষ্ণ ততোধিক আত্মবিশ্বাসে জবাব দেন—হারিলে তোমার নিব বেশর-কাঁচুলি। অর্থাৎ তাঁর নাকের নথ এবং উত্তমাঙ্গের আবরণ খোয়া যাবে।
উদ্ভট্ট তালে রাধাপক্ষের সখীরা খোলের বোল দেবেন। বস্তুত কীর্তনীয়াদের খুলিরা এই সময়ে শ্রীখোলের যত কসরত আছে, সব দেখান। শ্যামাচাঁদ উদ্ভট্ট তালে বাঁশি বাজান এবং রাধার নাচ আরম্ভ হয়। আমাদের কালে—এই কীর্তনেরই—চাঁদবদনী নাচত দেখি—লৌকিক প্রতিরূপ গেয়ে প্রয়াত নির্মলেন্দু চৌধুরী বহু আসর মাত করে দিতেন। যাই হোক, এই নাচেরও অবধারিত ফল—কৃষ্ণের উদ্ভট তাল সামাল দিয়েও শ্রীরাধিকা নাচের প্রতিযোগিতায় সফলভাবে জয়ী হবেন। পদকর্তা হইহই করে ভণিতা করলেন—
সবাই বলে রাই-এর জয় নাগর হারিলে।
দুঃখিনী কহিছে গোপীমণ্ডলী হাসালে।
দোল এবং হোলির এই লীলাকীর্তনের মধ্যে অসাধারণ এক উন্মাদনা আছে যা স্বাদু স্বাদু পদে পদে। এই উন্মাদনা ভক্ত-সজ্জনকে অতিক্রম করে প্রাকৃত জনের মধ্যেও অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে এবং অতিপ্রাকৃত রস রসাভাসেও পরিণত হয়েছে। তার প্রমাণ পাওয়া যাবে প্রখ্যাত পণ্ডিত গ্রাউজ সাহেবের মথুরা বিষয়ক কড়চায়। ১৮৭৭ সালে বৃন্দাবনে দোলপূর্ণিমার দিনে উৎসব দেখতে গিয়ে তিনি দেখেছিলেন : আবিরে গোলালে ছেয়ে গেছে বৃন্দাবনের আকাশ। বৃন্দাবনী রীতি অনুসারে এই দিন কৃষ্ণ তাঁর সঙ্গী-সখাদের নিয়ে হোলি খেলতে আসবেন রাধার গাঁয়ে। সে গাঁয়ের নাম বর্ষাণা। কৃষ্ণ এলেই যে হোলি খেলা হবে, তার নাম ‘বর্ষাণকি হোরি’। প্রত্যুত্তরে রাধাও তাঁর রঙ্গিনী-সঙ্গিনীদের নিয়ে কৃষ্ণের গাঁয়ে যাবেন। যে হোলি খেলা হবে, তার নাম ‘নন্দগাঁওকি হোরি’।
গ্রাউজ দেখলেন—সেই রাধাও নেই, সেই শ্যামও নেই, কিন্তু আজও আছে বৃন্দাবনের মানবের মনে। দোলের পুরাতন স্মৃতি মনে রেখে সেই হোলির দিনে শত শত মানুষ রাখাল-রাজা কৃষ্ণ এবং তাঁর সখাদের প্রতিরূপ ধারণ করে চলে আসে রাধার গ্রাম বর্ষাণায়। বর্ষাণার মেয়েদের সঙ্গে ইচ্ছে করে তারা একটা কৃত্রিম কলহের সৃষ্টি করে। রাখালিয়া কৃষ্ণের স্মরণে ব্রজবাসীরা এখনও হাতে নিয়ে আসে সরু সরু গরু চরাবার লাঠি। রাধার গাঁয়ের মেয়েরাও কিছু কম যায় না। রাধারানীর সম্মান রক্ষায় তারাও একাধিক লাঠি হাতে প্রতিস্পর্ধা দেখায়। মৃদুমন্দ যষ্টির আঘাতে ক্ষেপে ওঠে রাখালিয়া কৃষ্ণের দল। তাদের মাথায় এখনও ময়ূরপুচ্ছ শোভা পায়। রমণীর রমণীয় আঘাতে কৃত্রিম ক্ষিপ্ত নন্দগাঁয়ের লোকেরা তখন এমন সব গান ধরে—গ্রাউজ সাহেব লিখেছেন—তা অনুবাদের যোগ্য নয়। এমনই অশ্লীল। কৃষ্ণের সঙ্গে রাধার অন্তরঙ্গ সম্বন্ধ মাথায় রেখে নন্দগাঁয়ের কৃষ্ণপন্থীরা সবাই বর্ষাণার লোকদের ‘শালা’ বলে সম্বোধন করে। আবির খেলাও চলতে থাকে ওই অন্তরঙ্গতার মাধ্যমেই।
বৃন্দাবন নন্দগ্রাম কি বর্ষাণায় যা হয়, বাংলার গ্রামেগঞ্জে একইরকমের না হলেও অন্য সুরে অন্য গানে ওই একই হোলি খেলা হত এবং সে হোলি খেলা সব সময় যে মাত্রা রেখে চলত তা মোটেই নয়। গাঁয়েগঞ্জে আবিরের ভাঁড়ার শেষ হয়ে গেলে ধুলো ছোড়া হত, ছোড়া হত কাদা, তার সঙ্গে যে-সব গান হত, তার মধ্যে রাধাকৃষ্ণের ভক্তিরসের আস্বাদ লুপ্ত হয়ে গ্রাম্য রসাভাস এসে যেত মাঝেমাঝেই এবং সত্যি, সেসব গানও অনুবাদের যোগ্য নয়। তবে হ্যাঁ, আবির-গোলালের বদলে ধুলো ছোড়া—সে চলে আসছে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয়-তৃতীয় শতাব্দী থেকে। কেননা সাতবাহন হালই প্রাকৃত ভাষায় লিখেছেন—ফাগু খেলতে গিয়ে রঙিন পুরুষেরা কাদা ছুড়ত মেয়েদের দিকে। তাতে অন্য মেয়েরাই রাগত অভিমানিনী কর্দমাক্ত রমণীকে বলত—ধুয়ে ফেলছ কেন? নির্দোষ মনেই পুরুষেরা একটু কাদা ছুড়েছে তাতে কী এমন হল।
মেয়েদের রঙ মাখানোর জন্য সব পুরুষের এই নির্দোষভাব থাকে কি না, হোলির দিনে তা তখনও চিন্তনীয় বিষয় বটে। হয়তো সে দোষ আগেও ছিল, এখনও আছে। বসন্তের দোল পূর্ণিমায় বৃন্দাবনের লারলিজির মন্দির থেকে যে গৃহবধূরা হোলি খেলতে বেরোতেন, তাঁদেরও খুব ভদ্র পর্যায়ে থাকতে দিতেন না নন্দগাঁয়ের পুরুষেরা। কিন্তু হোলির দিন বলে সেই সদোষ পুরুষ-ভাব উপেক্ষা করেই গ্রাউজ সাহেব হোলিরঙ্গের মূল সুরটুকু মনে রেখে দিয়েছেন—যার প্রমাণ গ্রাম্য গীতখানি :
ঘর ঘরসে বনিতা বন আই অপনি অপনি জোরী।
ইততে নিকসে কুঁয়োর কনহাইয়া ইত বৃষভানু কিশোরী।।