ফুলকিয়ার জন্য

ফুলকিয়ার জন্য

উঁচু টিলাটার মাথায় উঠতেই ডাকটা শুনতে পেল ধর্মু, ‘হেই রুখো, রুখো যা—ও—ও—ও—ও—’

গলার স্বরটা খুবই চেনা। ধর্মু থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল, তারপর ঘুরে দাঁড়াতেই ফুলকিয়াকে দেখতে পেল।

টিলাটার ঢালে তেমন গাছপালা নেই। কস্টিকরির কিছু ঝাড় আর বেঁটে বেঁটে ত্রিভঙ্গ চেহারার কয়েকটা সীসম গাছ এলোমেলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সে—সবের ফাঁক দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ুতে দৌড়ুতে উঠে আসছিল ফুলকিয়া।

এখন দুপুরও না, আবার বিকেলও না। সময়টা দুইয়ের মাঝামাঝি জায়গায় থমকে রয়েছে।

গরম কাল শেষ হয়ে আসছে। আর দশ—পনেরো দিনের মধ্যেই বর্ষা নেমে যাবে। এখানে—মধ্যপ্রদেশের এই বস্তার জেলার আকাশে এর মধ্যেই টুকরো টুকরো ছন্নছাড়া মেঘ হানা দিতে শুরু করেছে। বর্ষার আগে আগে এই সময়টায় রোদে তাত নেই, তার গায়ে ঝলসে—ওঠা ছুরির ধারও নেই। তখনকার রোদ বাসি হলুদের মতো ম্যাড়মেড়ে।

ধর্মু যে টিলাটার মাথায় দাঁড়িয়ে আছে তার পশ্চিম দিকে বিশাল একটা গাঁ চোখে পড়ে, তার নাম তিরুকোট। ফুলকিয়ারা তিরুকোটে থাকে। ধর্মু অবশ্য ওখানে থাকে না, তার গাঁ এখান থেকে চার মাইল উত্তরে বরবৌলি তালুকে।

টিলাটার পুব দিকে আধ মাইল হেঁটে গেলে বস্তার জেলার রিজার্ভ ফরেস্ট বা সংরক্ষিত বনের সীমানা শুরু হয়েছে। ছোট—বড় এবং মাঝারি নানা মাপের অগুনতি পাহাড়ের গায়ে বস্তারের এই রিজার্ভ ফরেস্ট। বনভূমির মাথায় ছেঁড়া ছেঁড়া রঙিন কাগজের টুকরোর মতো নানা রঙের হাজার হাজার পাখি উড়ছে।

আকাশের মেঘ, মরা রোদ বা ঝাঁক ঝাঁক পাখি কিংবা দূরের পাহাড় আর ফরেস্টের গাঢ় সবুজ রঙের ঘন জঙ্গল কোনও দিকেই লক্ষ নেই ধর্মুর। একদৃষ্টে, প্রায় পলকহীন ফুলকিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে সে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার বুকের ভেতর পাহাড়ী নদীর দুরন্ত ঢলের মতো কিছু একটা বয়ে যেতে লাগল।

ধর্মুর পুরো নাম ধর্মু সিং, জাতে তারা রাজপুত ক্ষত্রিয়। কয়েক পুরুষ ধরে ধর্মুরা মধ্যপ্রদেশে বস্তার জেলায় রয়েছে। অনেক কাল এখানে থাকতে থাকতে তাদের চাল—চলন আচার ব্যবহার এখানকার মতোই হয়ে গেছে।

ধর্মুর বয়স পঁচিশ—ছাব্বিশ। লম্বা প্রায় ছ—ফুট। সরু কোমর, চ্যাটালো বুক, শক্ত চওড়া কাঁধ। হাত দুটো জানু ছাপিয়ে নেমে গেছে। এক পলক তাকিয়েই টের পাওয়া যায় সে একজন দুর্দান্ত বলশালী জোয়ান।

ধর্মুর মুখ লম্বাটে। খাড়া নাকটা সটান তার কপাল থেকে নেমে এসেছে, তার দু—ধারে ঘন—পালক—ঘেরা চোখ। ঝাঁকড়া চুল অযত্নে অবহেলায় পেছন দিকে উল্টে দেওয়া। গালে চার পাঁচ দিনের চোখা দাড়ি। গায়ের রং পোড়া ব্রোঞ্জের মতো। রোদে পুড়ে জলে ভিজে তার চামড়া টান টান হয়ে গেছে। তবু সব মিলিয়ে সে দারুণ আকর্ষণীয়।

ধর্মুর পরনে এই মুহূর্তে ময়লা চাপা চুস্ত আর ঢোলা খাকি কুর্তা। পিঠের দিকে কুর্তার তলায় একটা দেশি বন্দুক বাঁধা রয়েছে। বন্দুকটার মতো বুকের দিকের কুর্তার তলায় টোটার মালাও বাঁধা।

ধর্মু একজন ‘পোচার’। তার কাজ হল বে—আইনিভাবে বস্তার জেলার সংরক্ষিত বনে ঢুকে লুকিয়ে—চুরিয়ে জন্তু—জানোয়ার মারা। তারপর সেই সব জন্তুর ছাল—দাঁত—নখ ভূপাল শহরে গিয়ে সাহেবদের কাছে বেচে আসা। বরবৌলি তালুকে তাদের অল্প কিছু জমিজমা আছে। কিন্তু বিরাট সংসার—বুড়ো মা—বাপ ছোটো ছোটো তিন—চারটে ভাই—বোন। অথচ রোজগার করার লোক বলতে ধর্মু ছাড়া আর কেউ নেই। এদিকে সামান্য দু’—চার বিঘে জমিতে যে গেঁহু ফলে তাতে সবার দু—মাসের খোরাকও হয় না। কাজেই চুরি করে রিজার্ভ ফরেস্টে ঢুকে জন্তু—জানোয়ার না মারতে পারলে উপোস অবধারিত। মাসে একটা চিতল হরিণ কি বাঘ মারতে পারলেই ধর্মুদের কোনওরকমে চলে যায়। কিন্তু কাজটা খুব সহজ নয়। অনেক সময় দিনের পর দিন হানা দিয়েও একটা চুহা বা খরগোশ পর্যন্ত পাওয়া যায় না। তা ছাড়া ফরেস্ট গার্ডদের হাতে যে কোনও সময় ধরা পড়ে যাবার ভয় আছে। এখন যে নতুন রেঞ্জার সাহেব এসেছে সে দারুণ কড়া অফসর (অফিসার)। গোটা সংরক্ষিত বনটা যেন তার বাপের সম্পত্তি। বাঘ—ভাল্লুক মারা তো দূরের কথা, গাছের একটা পাতা খসালে আর তা যদি তাঁর চোখে পড়ে গুলি মেরে মাথার চাঁদি উড়িয়ে দেবে।

যাই হোক আজও রিজার্ভ ফরেস্টে যাচ্ছিল ধর্মু। সাত দিনের মধ্যে অন্তত দু’টো বাঘ তাকে মারতেই হবে।

উপোস থেকে বাঁচবার জন্যে এবার জঙ্গলে হানা দিচ্ছে না ধর্মু। ঘরে যে গেঁহু আর মাইলো আছে তাতে একটা মাস চোখ বুজে চলে যাবে। তবু সে যে রিজার্ভ ফরেস্টে যাচ্ছে তাঁর একমাত্র কারণ ফুলকিয়া। কিন্তু কারণটার কথা পরে।

বরবৌলি তালুক থেকে রিজার্ভ ফরেস্টে যেতে হলে তিরুকোট গাঁয়ের পাশের এই টিলাটা পেরুতে হয়। ফরেস্টে যাবার এটাই একমাত্র রাস্তা। ফি মাসে কম করে আট—দশবার জঙ্গলে যায় ধর্মু। আর যখনই যায় ফুলকিয়া তাকে ঠিক ঠিক দেখে ফেলে। মেয়েটা যেন দিন—রাত হাজারটা চোখ মেলে তিরুকোট গাঁয়ে বসে থাকে। ধর্মুকে একবার দেখলেই হল, দৌড়ে কাছে চলে আসে।

ধর্মু তাকিয়েই ছিল, তাকিয়েই ছিল। ফুলকিয়াকে দেখতে দেখতে তার বুকে যেমন ঢল বয়ে যাচ্ছিল চোখ দুটো তেমনি খুশিতে ঝকমকিয়ে উঠছিল। সেই সঙ্গে দুঃখের পাতলা একটু ছায়াও মিশে আছে।

একটু পরেই টিলা বেয়ে ওপরে উঠে এল ফুলকিয়া। তার বয়স সতেরো—আঠারো। গায়ের রং পাকা গমের মতো। পাতলা কোমর, যমজ পাহাড়ের মতো তার বুক, কোমরের তলায় বিশাল উপত্যকা।

পানের মতো মুখ ফুলকিয়ার, সরু থুতনি। নাকটা মোটার ধার ঘেঁষে। ছোট্ট কপালের ওপর থেকে ঘন চুলের ঘের। চুলগুলো জারিওলা রঙিন ফিতে দিয়ে একবেণী করে বেঁধে পিঠের ওপর ফেলে রাখা হয়েছে। খঞ্জন পাখির চোখের মতো তার চোখ দুটো ছটফটে।

ফুলকিয়ার পরনে কাঁচ আর পুঁতি বসানো রং—চংয়ে ঘাঘরা আর ঢোলা কামিজ। হাতে রুপোর কাঙনা, গলায় রুপোর জবরজং হার আর কানে জালিকাটা প্রকাণ্ড ঝুমকো।

এতটা চড়াই বেয়ে ওপরে উঠে আসার জন্য ফুলকিয়া হাঁপিয়ে গিয়েছিল। জোরে জোরে এবার শ্বাস পড়ল তার। মুখটা লাল হয়ে উঠেছে, ঘাড়ে কপালে গলায় দানা দানা ঘাম ফুটে বেরিয়েছে।

একটু জিরিয়ে নিয়ে মধ্যপ্রদেশের দেহাতি হিন্দিতে ফুলকিয়া বলল, ‘কী ব্যওস্থা করলে? আর কতদিন তিরুকোটে পড়ে থাকব?’

ধর্মু হাসল। তারপর ফুলকিয়ার দিকে ঝুঁকে বলল, ‘আর বেশি দিন পড়ে থাকতে হবে না। সাত দিনের ভেতর দুটো বাঘ যেভাবে হোক মারবই মারব? ভূপালে সাহিবরা রয়েছে, তাঁদের কাছে বাঘের ছাল—নখটখ নিয়ে গেলে দু’ হাজার রূপেয়া মিলবে। ক্যাশ টু থাউজেণ্ড রূপিজ। তখন জরুর তোকে আমার কাছে নিয়ে যাব। ভূপালে সত্যিকারের সাদা চামড়ার সাহেবদের কাছে জন্তু—জানোয়ারের ছাল—টাল বেচতে গিয়ে দু—চারটে ইংরেজি বুলি শিখে ফেলেছে ধর্মু। এই নিয়ে তার বেশ গর্বও রয়েছে সেটা সে চেপে রাখে না।

ভারী গলায় ফুলকিয়া বলল, ‘দেখা হলেই তো তুমি আমাকে বাঘ—ভাল্লুক দেখাও। এই করে করে পাঁচ বরিষ (বছর) কাটিয়ে দিলে।’

‘এবার আর আমার কথার নড়চড় হবে না দেখে নিস।’

‘সব বারই তো ওই এক কথা বলছ। আমি বিশোয়াস (বিশ্বাস) করি না।’

‘এবারটা বিশোয়াস কর। শিউজী কসম—’

ফুলকিয়া ধর্মুর বিয়ে করা বউ। দশ বছর আগে তার বয়স যখন পনেরো—ষোলো আর ফুলকিয়ার সাত—আট তখন তাদের বিয়ে হয়। বিয়ের পর তিন রাত শ্বশুর বাড়িতে থেকে তিরুকোটে বাপের কাছে চলে গিয়েছিল ফুলকিয়া। ওদের সামাজিক রীতি অনুযায়ী বিবাহিতা মেয়ে যুবতি হবার পর আবার স্বামীর কাছে ফিরে যায়। যদ্দিন না সে যুবতি হচ্ছে তাকে বাপের ঘরে থাকতে হয়।

পাঁচ বছর আগে যুবতি হয়েছে ফুলকিয়া। তার বাপ সে খবরটা ধর্মুদের পাঠিয়েও দিয়েছে। এই খবর পাবার পর ধর্মুদের যা করা উচিত ছিল তা হল ফুলকিয়াকে বাড়ি নিয়ে আসা।

এই সময়টা যে যার সাধ্যমত শ্বশুর বাড়ির লোকদের নানা রকম উপহার —টুপহার আর প্রণামী দেয়। তারপর বউকে দামি শাড়ি এবং গয়নায় সাজিয়ে কেউ মখমলে—মোড়া ডুলিতে, কেউ হাতীর পিঠে চড়িয়ে বাজনা—টাজনা বাজিয়ে পতাকারি (আতস বাজি) ফাটাতে ফাটাতে নিজের বাড়ি নিয়ে যায়।

কিন্তু ধর্মুরা ফুলকিয়াকে নিয়ে যেতে পারেনি। তার কারণ ফুলকিয়া খুবই বড় ঘরের মেয়ে। তার বাপ তিরুকোট তালুকের মুখিয়া অর্থাৎ এক নম্বর মানুষ। লোকটার যেমন অঢেল পয়সা তেমনি প্রচণ্ড দাপট।

মাইলের পর মাইল জুড়ে তার ক্ষেতি—বাড়ি। আশ—পাশর বিশ পঞ্চাশটা তালুকের মধ্যে একমাত্র তারই পাকা তিনতলা হাবেলি রয়েছে। আর আছে দুশো তাগড়া মোষ, পঞ্চাশ—ষাটটা বয়েল গাড়ি, গোটা পনেরোটা গাদা বন্দুক। ধান আর গেঁহুর গোলা যে কত, গুনে শেষ করা যায় না। দশ—বিশজন বাদ দিলে তিরুকোট তালুকের সব মেয়ে—পুরুষই তার জমিতে পেটে—ভাতায় প্রায় সারা বছর খেটে খায়।

অবস্থার এত ফারাক তবু ফুলকিয়ার বাপ গুলিক সিং যে ধর্মুর সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিল তার একটা জোরালো হেতু আছে। গুলিক সিং ভয়ানক গোঁড়া রাজপুত ক্ষত্রিয়, নিজের জাত ছাড়া অন্য জাতে মেয়ের বিয়ে দেবে না। অথচ আশ—পাশর তিরিশ—চল্লিশটা তালুকের মধ্যে ধর্মুরা ছাড়া আর কোনও রাজপুত ক্ষত্রিয় নেই। অবশ্য রায়পুর শহর বা দ্রুগ কিংবা জগদলপুরের দিকে খোঁজ করলে নিশ্চয়ই স্বজাতের ভালো ছেলেটেলে পাওয়া যেত। কিন্তু গুলিক সিং মেয়েকে দারুণ ভালোবাসে, ফুলকিয়াকে বিয়ে দিয়ে সে বেশি দূরে পাঠাতে চায় না, কাছাকাছি রাখতে চায় যাতে ইচ্ছা করলেই দেখে আসতে পারে। তা ছাড়া আরও একটা ব্যাপার আছে, ধর্মুরা গরিব। তাই তার ইচ্ছা ছিল বিয়ের পর দামাদকে (জামাইকে) নিজের কাছে এনে ঘর—জামাই করে রাখবে। একান্তই যদি না হয় কিছু জমিজমা আর দশ—বিশটা বয়েল দিয়ে দাঁড় করিয়ে দেবে। কিন্তু তার এই শেষ হিসেব দুটো মেলেনি। গরিব হলেও ধর্মুর আত্মসম্মান জ্ঞানটা খুবই বেশি। ঘর জামাই হওয়ার চাইতে বুকে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করাটা তার পক্ষে অনেক সোজা কাজ। আর যদি দাঁড়াতেই হয় নিজের ক্ষমতায় দাঁড়াবে শ্বশুরের করুণার ওপর নির্ভর করে নয়।

ফুলকিয়া যুবতি হওয়ার পরও ধর্মু যে পাঁচটা বছর চুপচাপ আছে সেটা এই জন্য। মনে মনে তার জেদ, রীতিমতো জাঁকজমক করেই সে ফুলকিয়াকে নিজের ঘরে নিয়ে আসবে। গুলিক সিং যেন নাক কুঁচকে বলতে না পারে, এমন ঘরে মেয়ে দিয়েছি যে ভিখমাঙোয়া অর্থাৎ ভিখিরির মতো নিয়ে গেল।

জেদ থাকা এক কথা আর সেটা কাজে করে দেখানো আরেক কথা। ধর্মু পাঁচ বছরের মধ্যে এমন টাকা জমাতে পারেনি যাতে সবার চোখে তাক লাগিয়ে বউকে ঘরে নিয়ে আসতে পারে।

এদিকে ফুলকিয়া কিন্তু অস্থির হয়ে উঠেছে। বছর তিন চারেক আগে ধর্মু যখন পোচারের কাজ শুরু করল তখন থেকে প্রায়ই ফরেস্টে যাবার জন্য তিরুকোটে আসছে। প্রথম প্রথম তাকে দেখে কাছে ঘেঁষত না ফুলকিয়া। দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুখ টিপে হাসত। তারপর আস্তে আস্তে তার লজ্জা কাটল। ধর্মুকে দেখতে পেলেই এখন সে ছুটে আসে।

ফুলকিয়া বলল, ‘আগেও তো তুমি কতবার শিউজীর নামে কসম খেয়েছ।’

ধর্মু হকচকিয়ে গেল। কথাটা মিথ্যে বলেনি ফুলকিয়া। খুব ব্যস্তভাবে তার কাঁধে আঙুল রেখে ধর্মু বলল, ‘ঠিক আছে, এই তোকে ছুঁয়ে কসম খাচ্ছি, এবার নিয়ে যাব, নিয়ে যাব, নিয়ে যাব।’

ফুলকিয়া বলল ‘সচ?’

‘তোকে ছুঁয়ে ঝুট বলতে পারি?’

‘তোষামোদ হচ্ছে?’

‘বিলকুল না।’

ধর্মুর বুকের কাছে ঘন হয়ে এল ফুলকিয়া। একবার তার মুখের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে চোখ নামিয়ে নিল। তারপর মাথা নাড়তে নাড়তে আধফোটা গলায় বলল, ‘আমার আর ভালো লাগছে না।’

বুকের কাছে ফুলকিয়ার নিশ্বাস পড়ছে। শিরায় শিরায় রক্ত তোলপাড় করে ঢেউ উঠতে লাগল ধর্মুর। সে কী বলবে ভেবে পেল না।

ফুলকিয়া এবার বলল, ‘সব মেয়েই সাদির পর সসুঁরালে (শ্বশুরবাড়ি) গিয়ে থাকে। আমিই শুধু বাপের ঘরে পড়ে আছি।’ তার গলার স্বর ধীরে ধীরে বুজে এল।

ধর্মু ফুলকিয়ার কানের কাছে মুখ এনে গাঢ় গলায় বলল, ‘আর মোটে ক’টা দিন তো—’

‘না—’

‘কী না?’

‘না—’ জোরে জোরে প্রবল বেগে মাথা নাড়তে লাগল ফুলকিয়া।

আদরের সুরে ধর্মু জিজ্ঞেস করল, ‘কী হল তোর?’

‘আজই আমাকে নিয়ে চল।’

‘এভাবে নিয়ে যাওয়া যায় নাকি।’

আমি তোমার কোনও কথা শুনব না। খালি বাহানা বাহানা আর বাহানা। বলেই ধর্মুর বুকের ভেতর দূরন্ত স্রোতের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল ফুলকিয়া। তারপর অদ্ভুত এক আবেগে তার বুকে গাল আর ঠোঁট ঘষতে লাগল।

আগে আর কখনও এভাবে ধর্মুকে জড়িয়ে ধরেনি ফুলকিয়া। তার এরকম অস্থিরতা দেখা যায়নি।

ফুলকিয়ার নরম উষ্ণ ঠোঁট আর গাল বুকের অনেকখানি জায়গা জুড়ে ক্রমাগত আশ্চর্য এক আকুলতা নিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। পাহাড়চূড়ার মতো তার অটুট বুক পাঁজরের কাছে ধীরে ধীরে বিঁধে যাচ্ছে। ধর্মুর মনে হতে লাগল, তার শ্বাসপ্রশ্বাস এবার বন্ধ হয়ে যাবে। শরীরের সব শক্তি ক্রমশ ফুরিয়ে আসছিল, মাথার ভেতরটা প্রচণ্ড নেশার ঘোরে যেন ঝিম ঝিম করে চলেছে। নিজের অজান্তেই কখন যে ধর্মু দু’হাতে ফুলকিয়াকে জড়িয়ে ধরেছে সে নিজেই জানে না।

অনেকক্ষণ পর ধর্মু বলল, ‘এবার ছাড়—’

ফুলকিয়া ধর্মুকে ছাড়ল না। তার বুকের ভেতর গোটা শরীরটাকে গুঁজে রেখে গলার ভেতর আদুরে মেয়ে পায়রার মতো শব্দ করল, না—’

‘ছাড়—’

‘না।’

বিকেল হয়ে এল। এরপর জঙ্গলে ঢুকলে অন্ধেরাতে কিছু দেখতে পাব না। আর জানোয়ার মারতে না পারলে তোকে তোর বাপের ঘর থেকে নিজের কাছে নিয়ে আসতে দেরি হয়ে যাবে।

তবু আরও কিছুক্ষণ ফুলকিয়া ধর্মুর বুকের সঙ্গে মিশে রইল। তার পর আস্তে আস্তে মুখ তুলে বলল, ‘আমি আর একেলী থাকতে পারব না।’

ধর্মু বলল, ‘একেলী কেন? তোর বাপের ঘরে কত লোকজন—’

‘তুমি তো কাছে নেই। যত লোকজনই থাক, একেলী লাগে না?’

গভীর গলায় ধর্মু বলল, ‘হাঁ, লাগে। আর কটা দিন। স্রিফ ক’টা দিন। ‘প্রাণপণ শক্তিতে ফুলকিয়ার কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল ধর্মু। তারপর বলল, ‘যাই।’

দু’চোখে আশ্চর্য যাদু নিয়ে তাকিয়ে রইল ফুলকিয়া। সম্মোহিতের মতো তাকে দেখতে দেখতে ফিসফিসিয়ে আবার বলল ধর্মু। ‘যাই—’

‘আচ্ছা। লেকেন মনে রেখো সাত রোজ দেখব। তার ভেতর যদি আমাকে না নিয়ে যাও গলায় রশি দেব।’

ফুলকিয়ার গালে মুখ ঠেকিয়ে ধর্মু বলল, ‘সাতদিনের মধ্যে তোকে নিয়ে যাব। তুই ঘরে যা। আমি চলি।’ বলে আর দাঁড়াল না। টিলার মাথা থেকে পুবদিকের ঢাল বেয়ে নীচে নামতে লাগল। বিকেলের ছায়া ঘন হবার আগেই তাকে রিজার্ভ ফরেস্টে পৌঁছুতে হবে।

অনেক দূরে, বনের সীমানার কাছাকাছি গিয়ে ধর্মু, একবার পেছন ফিরল। দেখল, ফুলকিয়া তখনও স্বপ্নে দেখা কোনও ছবির মতো টিলার মাথায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর হৃৎপিণ্ড সমুদ্রে ঝড় ভেঙে পড়ার মতো দুলতে লাগল। মনে মনে ধর্মু প্রতিজ্ঞা করে ফেলল আজ বাঘ না মেরে ফরেস্ট থেকে বেরুচ্ছে না। ফুলকিয়াকে সে কথা দিয়েছে সাত দিনের ভেতর নিজের কাছে নিয়ে যাবে।

এক সময় ফুলকিয়ার দিক থেকে ঘাড় ফিরিয়ে আস্তে আস্তে ধর্মু বনভূমিতে ঢুকে গেল।

চারদিকে বিশাল বিশাল সব গাছ। অর্জুন কেন্দু গরান জারুল পিয়াশাল ইত্যাদি। জঙ্গলের মাথায় ছাতা ধরে আছে তারা। এই গাছগুলো যেন বনভূমির অলংকার। এ ছাড়া রয়েছে নানা রকমের সব লতা—সোনাঙ্ক, তেলাকুচু, চিহড়। প্রতিটা গাছকে তারা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। আর আছে প্রচুর ছোটো বড়ো ঝোপঝাড়।

জঙ্গলের মাথায় গাছের ডালপালা আর পাতা এত ঘন যে আকাশটা ভালো করে দেখা যায় না। তবে সে—সবের ফাঁক দিয়ে যে আলোটুকু চুঁইয়ে চুঁইয়ে এসেছে তাতে বনভূমির ভেতরটা বেশ স্পষ্টই।

কেউ কোথাও নেই। নির্জন অরণ্যে শুধু ছোটো ছোটো গাঁদাল পোকারা ঝাঁক বেঁধে উড়ে বেড়াচ্ছে। ঝোপঝাড়ের মধ্যে ঝিঁঝিঁরা একটানা ডেকে যাচ্ছিল। ঝিল্লিস্বর চারদিকের নির্জনতা যেন দশগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

জঙ্গলে ঢুকলেই ধর্মুর স্নায়ুগুলো দারুণ সজাগ হয়ে যায়। মনে হয় রক্তবাহী শিরাগুলো কষে—বাঁধা ছিলার মতো টানটান হয়ে গেছে। খুব সতর্কভাবে এ—ধারে ওধারে তাকাতে তাকাতে সে এগিয়ে যাচ্ছিল।

এই সতর্কতা অকারণে নয়। রিজার্ভ ফরেস্টে জন্তু—জানোয়ার মারা নিষিদ্ধ। মাঝে মাঝে ঢেঁড়া পিটিয়ে এই হোঁলিয়ারিটা চারদিকের লোকজনকে জানিয়ে দেওয়া হয়। তা ছাড়া নতুন রেঞ্জার সাহেব এবং তার শ’—খানেক ফরেসটি গার্ড সব সময় বন্দুক তাক করে জঙ্গলের ভেতর চরকির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। একবার তাদের চোখে পড়ে গেলে নিস্তার নেই। হয় ধরা দিতে হবে, আর পালাতে গেলে গুলি খাওয়া অবধারিত।

ঝোপঝাড় বা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে কোনো ফরেস্ট গার্ড বা রেঞ্জার সাহেব স্বয়ং তার ওপর নজর রাখছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। ঝোপঝাড় ঠেলে এগিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল ধর্মু। তারপর পিঠের সঙ্গে বাঁধা বন্দুকটা খুলে আকাশের দিকে উঁচিয়ে একটা ফাঁকা আওয়াজ করল।

এটা ধর্মুর অনেক দিনের কৌশল। জঙ্গলে ঢুকে খানিকটা যাবার পরই সে ফাঁকা আওয়াজ করে আবহাওয়াটা বুঝে নেয়। তাতে লাভ হয় এই ফরেস্ট গার্ড বা রেঞ্জার সাহেব কাছাকাছি থাকলে বন্দুকের আওয়াজ পেলেই চেঁচাতে চেঁচাতে ছুটে আসে। তাদের পায়ের শব্দ কানে গেলে পালানো সহজ হয়।

আজ কিন্তু কেউ দৌড়ে এল না। তার মানে আশপাশে কেউ নেই। অবশ্য বন্দুকের আওয়াজে গাছের মাথা থেকে হাজার হাজার পাখি ডানা ঝাপটিয়ে চেঁচামেচি করতে করতে উড়ে গিয়েছিল। ডালপালার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে তারা আকাশে চক্কর দিয়ে বেড়াচ্ছে। দু’—একটা বুনো শুয়োর হুড়মুড় করে দৌড়তে দৌড়তে দূরের একটা ঝোপের পেছনে অদৃশ্য হয়ে গেল। তারপর বনভূমি আবার চুপচাপ।

লক্ষণটা মোটামুটি ভালোই মনে হচ্ছে। ধর্মু, আর দাঁড়াল না। বেশ খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়েই গভীর জঙ্গলের দিকে এগিয়ে চলল।’

ধর্মু এখন যেখান দিয়ে যাচ্ছে সেখানে কোথাও সমতল জায়গা নেই। শুধু পাহাড় আর পাহাড়। চড়াই আর উতরাইতে রিজার্ভ ফরেস্টটা এখানে ছড়িয়ে আছে।

খানিকটা হাঁটবার পর দূরে ফাঁকা মতো একটু জায়গা চোখে পড়ল। সেখানে ঝরনার তিরতিরে স্রোত বয়ে গেছে। একটা প্রকাণ্ড চিতল হরিণ ঝরণায় মুখ ডুবিয়ে জল খেয়ে যাচ্ছিল। হরিণটার গায়ের রং খয়েরি। তার ওপর সাদা সাদা গোল ফুটকি, মাথায় ডালপালাওলা ঝাড়ালো শিং। লোমগুলো নরম সিল্কের মতো মসৃণ।

হরিণটাকে দেখতে দেখতে ধর্মুর চোখদুটো চকচকিয়ে উঠল। ওটার চামড়া আর শিং নিয়ে গেলে ভূপালের সাহেবরা ভালো দাম দেবে।

বন্দুকের কুঁদোটা কাঁধের কাছে আটকে নলের মাছিতে চোখ রেখে হরিণটাকে তাক করল ধর্মু। কিন্তু গুলিটা ছুঁড়বার আগেই অঘটন ঘটে গেল। কী ভেবে জল থেকে মুখ তুলে সাঁ করে ঘাড়টা ঘোরালো হরিণটা। দূরে ধর্মুকে দেখেই কানদুটো খাড়া করল। তারপর একটা লাফ দিয়ে বিদ্যুৎ চমকের মতো চোখের পলকে ঘন জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।

মেজাজটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল ধর্মুর। আজকের প্রথম শিকার, তাও কিনা ফসকে গেল। কিছুক্ষণ দারুণ বিরক্তভাবে দাঁড়িয়ে থেকে আবার আস্তে আস্তে হাঁটতে শুরু করল সে। সেই ফাঁকা জায়গা আর ঝরনাটা পেরিয়ে সে পুব—দক্ষিণে হেঁটেই চলেছে, হেঁটেই চলেছে। কিন্তু না হরিণ না ভাল্লুক না বাঘ—কিছুই আর চোখে পড়ছে না। জঙ্গলের যাবতীয় জন্তু—জানোয়ার যেন আজ ষড়যন্ত্র করেছে, কিছুতেই ধর্মুর বন্দুকের পাল্লার ভেতর আসবে না।

ধর্মু আগেও লক্ষ করেছে প্রথম শিকার ফসকানো মানেই দারুণ একটা অপয়া ব্যাপার। সেই দিনটা একেবারে বেফায়দা নষ্ট হয়ে যায়।

ধর্মু একবার ভাবল আজ আর কিছু হবে না। শুধু শুধু না ঘুরে ফিরে যাওয়াই ভালো। পরক্ষণেই সে ঠিক করে ফেলল না, ফিরবে না। দিনের আয়ু, এখনও অনেকখানিই রয়েছে। এই গরমকালে রোদও থাকবে বহুক্ষণ। সন্ধে পর্যন্ত না দেখে ফেরার কোনও মানে হয় না। লম্বা লম্বা পা ফেলে সে এগিয়ে যেতে লাগল।

এবার মাঝে মধ্যে দু’—চারটে খরগোস চোখে পড়ছে। সাদা ধবধবে, আশ্চর্য নরম আর তুলতুলে এই নিরীহ ছোট্ট প্রাণীগুলো কোনও ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে আচমকা ধর্মুকে দেখেই রীতিমতো অবাক হয়েই যেন থমকে যাচ্ছে। তারপর লম্বা লম্বা কানগুলো সটান খাড়া করে চকচকে কাচের গুলির মতো চোখে একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তুরতুর করে আবার অন্য একটা ঝোপে ঢুকে পড়ছে।

বাজারে খরগোশের চামড়ার দাম নেই। কাজেই সেগুলোর দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না ধর্মু।

একবার একটা শজারু সামনে এসে পড়েছিল। রায়পুরে নিয়ে গেলে শজারুর কাঁটার ভালো দাম পাওয়া যায়। তা ছাড়া এই জন্তুটার মাংসও খেতে খারাপ না। কিন্তু বন্দুক উচোঁবার আগেই কাঁটার ঝন ঝন শব্দ করে শজারুটা সামনের বড়ো একটা গর্তে ঢুকে গেল।

আজকের দিনটাই যা—তা। মেজাজ আরও খারাপ হয়ে গেল ধর্মুর। তবু সে আশা ছাড়ল না, গভীর জঙ্গলের দিকে এগুতে লাগল।

ধর্মু এই অরণ্যের যাবতীয় গাছপালা এবং লতা—টতা চেনে। তার চাইতেও বেশি করে চেনে প্রতিটি জন্তু জানোয়ার আর তাদের চালচলন আচার— আচরণকে। হরিণ, বাঘ বা ভাল্লুকের গলার স্বর সে অবিকল নকল করতে পারে।

জঙ্গলে হানা দিয়ে ধর্মু যখন কোনো জন্তু টন্তুর দেখা পায় না তখন দুটো হাত মুখের কাছে চোঙার মতো ধরে হরিণ বা বাঘের ডাক ডেকে যায়। আর সেই ডাকে জন্তুরা বেরিয়ে আসে।

আজও গভীর জঙ্গলের দিকে যেতে যেতে বার কয়েক বাঘের ডাক ডাকল ধর্মু, হরিণের ডাক ডাকল। কিন্তু ফল কিছুই হল না। না হরিণ, না বাঘ, না ভাল্লুক—একটা জানোয়ারও বেরিয়ে এল না।

অথচ যেভাবেই হোক অন্তত একটা বাঘ বা হরিণ তাকে আজ মারতেই হবে। কেননা তার শরীরে এখনও ফুলিকিয়ার শরীরের গাঢ় ছোঁয়া লেগে রয়েছে। ফুলকিয়ার ঠোঁট, গাল, মুখ, জোড়া পাহাড়ের মতো বুক—সব কিছু গলে গলে আশ্চর্য এক সুখ হয়ে তার সারা গায়ে এবং রক্তের ঢেউয়ে মিশে গেছে। ফুলকিয়ার মুখ যতবার তার মনে হচ্ছে ততবারই সে অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে, ততবারই তার গায়ে কাঁটা দিয়ে দিয়ে উঠছে।

হাঁটতে হাঁটতে অন্যমনস্কতার মধ্যে কখন যে গড়ানে উপত্যকার মতো একটা জায়গায় এসে পড়েছে, ধর্মুর খেয়াল নেই। ফুলকিয়ার কথা ভাবতে ভাবতে আবছাভাবে তার মনে হচ্ছিল জন্তু—জানোয়াররা যদি তার সঙ্গে ক্রমাগত বিশ্বাসঘাতকতা করে জঙ্গলে লুকিয়ে থাকে ফুলকিয়াকে নিজের কাছে নিয়ে আসবে কী করে?

আচমকা খুব কাছ থেকে একটা শব্দ হল—গর—র—র—র—

চমকে ধর্মু দেখল পনেরো কুড়ি হাত তফাতে একটা ঝাঁকড়া অর্জুন গাছের মোটা গুঁড়ির গা ঘেঁষে একটা প্রকাণ্ড বাঘিনী দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার চোখ দুটো এদিকেই ফেরানো।

পনেরো কুড়ি হাত দূরত্ব এমন কিছুই না। বাঘিনীটা ইচ্ছা করলে চোখের পাতা পড়তে না পড়তে এক লাফে ধর্মুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে।

তিন চার বছর এই রিজার্ভ ফরেস্টে ঢুকে জন্তু—জানোয়ার মারছে ধর্মু কিন্তু কখনও কোনও বাঘ বা বাঘিনীর এত কাছে এসে পড়েনি। তার বুকের ভেতর রক্ত যেন পলকে জমাট বেঁধে গেল। বন্দুক তুলে তাক করার কথাও সে মনে করতে পারল না। দৌড়ে যে নিরাপদ জায়গায় সরে যাবে, তাও তার খেয়াল রইল না। মনে হল পেরেক ঠুকে কেউ যেন পা দুটো মাটির সঙ্গে গেঁথে দিয়েছে।

বাঘিনীটা সমানে শব্দ করে যাচ্ছিল, গ—র—র—র—তার দুই কষ বেয়ে লালা গড়িয়ে পড়ছে।

সম্মোহিতের মতো বাঘিনীর দিকে তাকিয়েই রয়েছে ধর্মু। অস্পষ্টভাবে তার মনে হচ্ছিল যে কোনও মুহূর্তে বাঘিনীটা লাফিয়ে পড়ে তাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। মৃত্যুর কথা ভাবতে ভাবতে তার শরীর ক্রমশ অসাড় হয়ে যাচ্ছিল।

আশ্চর্য, বাঘিনীটা ঝাঁপিয়ে পড়ল না। তার গলার সেই গরগরানিটা আস্তে আস্তে গাঢ হতে লাগল। সেই অবস্থাতেই সে ঘুরে দাঁড়াল। আর তখনই ধর্মু দেখতে পেল ওধারের ঝঁপসি জঙ্গলের আড়াল থেকে বিরাট একটা বাঘ আস্তে আস্তে বেরিয়ে বাঘিনীটার কাছে চলে এল।

বাঘটা ধর্মুকে দেখতে পায়নি, তাকে কাছাকাছি পেয়ে বাঘিনীর সেই গরগরানি আরো বেড়ে গেল। থাবা দিয়ে বাঘটার গা আস্তে আস্তে আঁচড়াতে লাগল সে; তারপর মুখটা বাঘের মুখের কাছে এনে আদরের ভঙ্গিতে কামড়াতে লাগল।

এতক্ষণে বাঘটার গলা থেকেও গরগরানির আওয়াজ বেরুতে শুরু করেছে। তার কষ বেয়েও লালা ঝরছে। সে—ও বাঘিনীটাকে আঁচড়াতে আর কামড়াতে লাগল।

একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল ধর্মু। এতক্ষণে তার বিহ্বল ভয়ের ভাবটা অনেকখানি কেটে গেছে। মনে মনে বাঘ আর বাঘিনীটাকে মেপে ফেলল সে। কম করে জানোয়ার দুটো তেরো চোদ্দো ফুট লম্বা হবে। তাদের শরীর চকচকে সোনালি লোমে ঢাকা, মাথা দুটোও প্রকাণ্ড।

তিন চার বছর এই জঙ্গলে হানা দিচ্ছে ধর্মু কিন্তু এতবড় বাঘ আগে আর কখনও মারতে পারেনি। বন্দুকের পাল্লার মধ্যেই জানোয়ার দুটো রয়েছে। মাত্র দুটো কি তিনটে গুলি খরচ করলেই ফুলকিয়াকে তার বাপের ঘর থেকে নিয়ে আসার পয়সা উঠে আসবে। বন্দুক তুলে ধর্মু নিশানা ঠিক করতে যাবে, হঠাৎ বাঘটা তাকে দেখতে পেল। কয়েক পলক সে ধর্মুর দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর দ্রুত বাঘিনীটার দিকে ফিরল। ওদিকে বাঘিনীটা কোনও কামুক যুবতির মতো সামনের দুই থাবা দিয়ে বাঘটার গলা জড়িয়ে ধরেছে। বাঘটার গলা থেকে গাঢ় সুখের আওয়াজ বেরিয়ে আসতে লাগল, ‘গর—র—র—র—’

বাঘিনীটা ক্রমশ বাঘটাকে উত্তেজিত করে তুলছে। সে—ও দুই থাবায় তার বাঘিনীর গলা বেষ্টন করল।

ধর্মু আরেকবার বন্দুক তুলতে যাবে, সেই যময় বাঘ আর বাঘিনীর গা থেকে তার নাকে একটা বুনো গন্ধ এসে লাগল। এই গন্ধটা তার চেনা। বাঘিনী যখন বাঘকে ঘনিষ্ঠভাবে পাবার জন্য মেতে ওঠে তাদের দু’জনেরই গা থেকে এই আশ্চর্য গন্ধ বেরোয়।

এদিকে পশ্চিম আকাশের ঢালু গা বেয়ে সূর্যটা অনেকখানি নেমে গেছে। দিনটা দ্রুত ফুরিয়ে আসছিল। গাছ—পালার ফাঁক দিয়ে শেষ বেলার চিকরি—কাটা নরম সোনালি রোদ এসে পড়েছে বনভূমিতে। সেই রোদ গায়ে মেখে বাঘিনী বাঘটাকে আঁচড়াচ্ছে কামড়াচ্ছে গলার ভেতর আরামের শব্দ করে করে তার আদর জানাচ্ছে। বাঘিনী যেন তার সঙ্গীকে নিয়ে নির্জন উপত্যকায় পৃথিবীর এক আদিম খেলায় মেতে উঠেছে।

ওদের, বিশেষ করে বাঘিনীকে দেখতে দেখতে আচমকা ফুলকিয়ার মুখটা মনে পড়ে গেল ধর্মুর। কিছুক্ষণ আগে ফুলকিয়াও তো তাকে নিয়ে এই রকম এক খেলায় মেতে উঠেছিল। বন্দুকটা তাক করতে গিয়েও নামিয়ে নিল ধর্মু।

মৃত্যু যে পনেরো কুড়ি হাত তফাতে দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে লক্ষ্য নেই বাঘ আর বাঘিনীর। ধর্মুকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে নিজেদের নিয়েই তারা মেতে আছে।

কিছুক্ষণ বাদে আবার বন্দুক তুলল ধর্মু। কিন্তু বাঘিনীটাকে দেখতে দেখতে আবার ফুলকিয়ার মুখ মনে পড়ে গেল তার। হঠাৎ তপ্ত স্রোতের মতো কিছু একটা তার শরীর জুড়ে বয়ে যেতে লাগল। আস্তে আস্তে বন্দুক নামিয়ে নিল সে। তারপর যতবার বন্দুক তুলল ততবার ফুলকিয়ার মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠল আর ততবারই বন্দুক নামাতে হল। শেষ পর্যন্ত বাঘ আর বাঘিনীর দিকে তাক করে বন্দুকের ঘোড়াটা আর টেপাই হল না।

জীবনে এমন সুযোগ আর কখনও আসবে না। সে জন্য পরে হয়তো ধর্মুকে হাত কামড়াতে হবে। কী আর করা যাবে!

ফুলকিয়ার জন্য বাঘ আর বাঘিনীটাকে মারা দরকার কিন্তু ফুলকিয়ার জন্যই পৃথিবীর আদিম সুখে মত্ত জন্তু দুটোকে মারা সম্ভব নয়। বন্দুক নামিয়ে উপত্যকার ঢাল বেয়ে বেয়ে ফিরে নামতে লাগল ধর্মু।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *