ফিরে আসে – মনোজ সেন

ফিরে আসে

এক রোববারের নিষ্কর্মা বিকেলে খুব বৃষ্টি নেমেছিল। শ্রাবণের ধারা যাকে বলে। তখন ক্লাবের ঘরে বসে বেকার আমাদের উত্তেজিত হওয়ার বিষয়বস্তু ছিল কুসংস্কার কাকে বলে আর সেটা মেনে চলা ভালো না খারাপ। আমাদের মোটামুটি সকলেরই মত হল, বিজ্ঞান দিয়ে যার ব্যাখ্যা করা যায় না সেটাই কুসংস্কার আর সেটা সর্বাদা পরিত্যাজ্য।

আমাদের মধ্যে একমাত্র ইতিহাসের অধ্যাপক মুকুল গাঙ্গুলী, আমাদের সঙ্গে একমত হতে রাজি ছিল না। তার বক্তব্য ছিল যে, যেকোনো কুসংস্কার পত্রপাঠ জানলা দিয়ে বাইরে ছুড়ে ফেলবার আগে তার উদ্ভব কী করে বা কোথা থেকে হল, সেটা জেনে নেওয়া দরকার। অনেক সময়ই দেখা গেছে যে, কোনো কোনো কুসংস্কারের সৃষ্টি হয়েছে কোনো অদ্ভুত বা অবিশ্বাস্য সত্য ঘটনা থেকে; যেটা আমাদের বর্তমান বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। আর এটাও মনে রাখা দরকার যে আজ থেকে হাজার বছর আগে সেই সময়ের বিজ্ঞান দিয়ে যা ব্যাখ্যা করা যেত না, বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে তার অনেক কিছুই আজ সত্যি বলে মানা হচ্ছে। আসলে, মানা বা না মানা ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে, সব কুসংস্কারই যে অর্থহীন নির্বুদ্ধিতা সেটা ঠিক নয়।

এককালের বিপ্লবী, দেশ স্বাধীন হবার পরে আইনসভার বহুবারের সদস্য এবং আপাতত অবসর জীবনযাপনরত চিত্তপ্রসাদ রায় একটা বেতের চেয়ারে বসে আমাদের তর্ক শুনছিলেন। তার সমবয়সি দাবা খেলার প্রতিপক্ষরা কেউই সেদিন বৃষ্টির জন্য ক্লাবে আসতে পারেননি। তাই তখনকার মতো আমাদের আলোচনা শোনা ছাড়া তাঁর করবার আর কিছু ছিল না।

মুকুল হঠাৎ তাঁর দিকে ফিরে প্রশ্ন করল, ‘রায়মশাই, এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী?’

রায়মশাই বললেন, ‘এ ব্যাপারে আপনার সঙ্গে আমি মোটামুটি একমত। যেমন ধরুন, অশ্লেষা, মঘা, ত্র্যহস্পর্শ ইত্যাদি যোগে ভ্ৰমণ এককালে নিষিদ্ধ ছিল। এটাকে আমরা কুসংস্কার বলি। একটু যদি ভেবে দেখেন তো দেখবেন এই কুসংস্কারটা চালু করবার পেছনে একটা অতি মহৎ উদ্দেশ্য ছিল।’

মুকুলসহ আমরা সবাই স্তম্ভিত। সব সমস্বরে প্রশ্ন করলুম, ‘কী অতি মহৎ উদ্দেশ্য?’

‘অতি মহৎ উদ্দেশ্যটা হল, যাঁদের কোনো অত্যন্ত জরুরি কাজে কোথাও যাবার থাকে, তাঁরা যেন সেদিন একটু আরামসে ট্রেনে যেতে পারেন। যেমন ধরুন, আমি আর আমার দুই কাকা কোথাও যদি যেতেই হত, তখন পাঁজি দেখে যত অযাত্রার দিনে আমরা রওনা দিতুম। সেদিন ট্রেন থাকত ফাঁকা, দিব্যি হাত-পা ছড়িয়ে যাওয়া যেত। আজ অবশ্য সে সুখের দিন আর নেই।’

আমরা হাসতে হাসতে বললুম, ‘না, রায়মশাই, ঠাট্টা নয়। শনি-মঙ্গলে বেগুন খাবে না, পুব বা দক্ষিণ দিকে পা করে শোবে না, জন্মবারে চুল কাটবে না— এইসব সংস্কারগুলো কি অর্থহীন নির্বুদ্ধিতা নয়? এগুলোর পেছনে কি সত্যিই কোনো মহৎ উদ্দেশ্য ছিল বা আছে?’

‘আলু বেগুন বা চুলকাটা এগুলো তো অতি সামান্য ব্যাপার। এগুলো নিয়ে আলোচনা করা নিতান্তই সময় নষ্ট। এসবের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ কুসংস্কার আছে যা নিয়ে অনেক দিন থেকে অনেক আলোচনা, গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু আজও সেগুলো কুসংস্কার না কুসংস্কার নয়- সেই প্রশ্নের সমাধান হয়নি।’

আমাদের নিরঞ্জন প্রশ্ন করল, ‘যথা? একটা উদাহরণ দিন।’

‘উদাহরণ? আপনারা তো গল্প শুনতে ভালোবাসেন। তাহলে, আমি আমার জীবনের একটা ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা বলি। আপনারা যদি সেটা গাঁজাখুরি গল্প বলেন, স্বচ্ছন্দে বলতে পারে আমি কোনোরকম আপত্তি করব না।’

আমরা সবাই আবার সমস্বরে বললুম, ‘শুরু করে দিন, স্যার। আর দেরি করবেন না।’

সেদিন, রায়মশাই যে কাহিনিটি আমাদের শুনিয়েছিলেন সেটা এইরকম।

বর্ধমান জেলায়, বীরভূম জেলার সীমান্তের কাছাকাছি, পলাশপাড়া নামে একটা গ্রাম আছে। আজকে তার অবস্থা বেশ ভালো, যদিও বছর পঞ্চাশ আগেও এটা একটা নিতান্তই দরিদ্র চাষিদের বাসস্থান ছিল। এই গ্রামটিকে আগাপাস্তলা ঘিরে রেখেছে এক বিশাল আর গভীর জঙ্গল, যার স্থানীয় নাম পাঁচভরির জঙ্গল। এহেন বিচিত্র নামের কারণ কী তা স্থানীয়দের কেউ জানে না। আর জানবেই বা কী করে? যাদের ডাইনে আনতে বাঁয়ে কুলোয় না, তাদের দায় পড়েছে তাদের গ্রামের ইতিহাস বা ভূগোল নিয়ে মাথা ঘামাতে।

সেই দায় নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়েছিলেন বর্ধমান জেলার একজন প্রাক্তন জেলাশাসক শ্রীঅর্ধেন্দুবিকাশ সোম। সোমসাহেবের নানা বিষয়ে কৌতূহল তো ছিলই, আর ছিল প্রচুর পড়াশুনো। যেখানেই বদলি হয়ে যেতেন সেখানেই প্রশাসনিক কাজের ফাঁকে ফাঁকে সেই জেলার হারানো ইতিহাস, সেখানকার গাছ পালা, জন্তুজানোয়ার, উৎসব এবং সর্বোপরি সেখানকার বাসিন্দাদের জীবনযাপন সম্পর্কে যতটা সম্ভব তথ্য জোগাড় করতেন। সেসব নিয়ে অনেক বইও লিখেছেন ছদ্মনামে। সেই বইগুলি যথেষ্ট প্রশংসিতও হয়েছে।

বর্ধমান জেলায় আসবার পর এই জেলার ইতিহাসের ওপরে বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে সোমসাহেব পাঁচভরির জঙ্গলের খোঁজ পান। সেইসঙ্গে জানতে পারেন যে ওই জঙ্গলের ভেতরে একটা বিশাল প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ আছে, যার ইতিহাস লোকশ্রুতি অনুযায়ী অদ্ভুত আর করুণ। কিন্তু, তার আসল ইতিহাসটা যে কী, সেটা কোথাও বিস্তারিতভাবে লেখা নেই।

একটা কথা বোঝা গেছে যে পাঁচভরির জঙ্গলের ভেতরে যে প্রাসাদটা আছে, তার ইতিহাসের লেখকরা কেউ সেটা নিজের চোখে দেখেননি। পশালপাড়া গ্রামের কোনো কোনো বাসিন্দার বলা বিবরণ থেকে একটা মোটামুটি বিশ্বাসযোগ্য রচনা দাঁড় করানো হয়েছে। এই বাসিন্দারা প্রায় সকলেই বোলপুর, ভেদিয়া বা গুসকরায় ছোটো-বড়ো কাজের সন্ধানে আসে বা কাজ করে। তাদের বলা যত গল্প তার বেশিরভাগই স্পষ্টতই কাল্পনিক বা বংশানুক্রমে শুনে আসা লোকস্মৃতি।

যেমন, পলাশপাড়ার একজন মহিলা, যিনি ভেদিয়া স্কুলের ক্লাস ফোর স্টাফ, বলেন যে প্রাসাদটি না কি রাজা হরিশচন্দ্র বানিয়েছিলেন হাজার হাজার বছর আগে। হাজার হাজার বছরটা বাদ দেওয়া যেতে পারে। আর একজন, গুসকরায় একটি হোটেলের কর্মচারীর মতে, প্রাসাদটি হরিশচন্দ্র রায় নামক একজন জমিদার বানিয়েছিলেন সাতশো বছর আগে। হরিশচন্দ্র রায় কিন্তু স্থানীয় লোক ছিলেন না। তিনি যে কোথা থেকে এসেছিলেন আর তাঁর পরিবারই বা এখন কোথায় তা কেউ জানে না। হরিশচন্দ্র মিলে গেল, সাতশো বছরটাও খুব একটা অসম্ভব ব্যাপার কিছু নয়। অতএব, সাতশোটা কমিয়ে পাঁচশো করে প্রাসাদ তৈরির ইতিহাস দাঁড়াল, পাঁচশো বছর আগে হরিশচন্দ্র রায় নামক এক ব্যক্তি কোনো অজ্ঞাত জায়গা থেকে এসে পাঁচভরির জঙ্গলের ভেতরে একটা বিশাল প্রাসাদ বানিয়েছিলেন।

কেন? তার দুটো কারণ থাকতে পারে। প্রথম কারণ, হরিশচন্দ্র রায় বদ্ধ উন্মাদ ছিলেন। তা না হলে খামোখা একগাদা পয়সা খরচ করে ঘন জঙ্গলের ভেতরে এমন প্রকাণ্ড প্রাসাদ কেউ বানায়? অথবা, দ্বিতীয় কারণ, পাঁচশো বছর আগে এই জঙ্গলটা ছিলই না। একটা জনবসতি নিশ্চয়ই ছিল বা রায়পরিবার বাইরে থেকে রায়তদের নিয়ে এসে পলাশপাড়া গ্রামের পত্তন করেছিলেন। রায় পরিবার এখান থেকে চলে গেলে শূন্য প্রাসাদটা জঙ্গলে ঘিরে ফেলল। ফলে, কয়েকশো বছরে প্রাসাদটা স্থানীয় লোকেদের স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেল।

দ্বিতীয় কারণটা বিশ্বাসযোগ্যা হলো- সোমসাহেব কিন্তু পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। এই সহজ সরল থিওরিটা মেনে নিলে, প্রাসাদটা সম্পর্কে যে অদ্ভুত আর করুণ ইতিহাস পলাশপাড়া গ্রামের লোকেরা বলে থাকেন আর প্রাসাদ আর তার সংলগ্ন জায়গাটা অভিশপ্ত বলে তার ধারে-কাছেও যান না— এই সমস্ত ব্যাপারটাই গেঁও লোকের বাজে কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দিতে হয়। এটা অর্ধেন্দুবাবুর কিছুতেই মনঃপুত হল না। যে প্রশ্নটার কোনো উত্তর পাওয়া গেল না, তা হল, রায়পরিবার আর পালাশপাড়ার বাসিন্দারা কোথায় গেলেন এবং কেনই-বা গেলেন।

এর পরে তো আর ঘরে বসে থাকা যায় না। অতএব, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, পলাশপাড়ায় একটা টুরের ব্যবস্থা করে ফেললেন সোমসাহেব।

এই পর্যন্ত বলে, চিত্তপ্রসাদ রায় একটু থামলেন। বললেন, ‘এইখানে শ্রীঅর্ধেন্দু সোপ সম্পর্কে কিছু বলে রাখা ভালো।

‘১৯৪৭ সালে প্রায় কপর্দকশূন্য অবস্থায় সেই সময়কার পূর্ব পাকিস্তান থেকে শিয়ালদা স্টেশনে এসে পৌঁছেছিল সোন পরিবার। অর্ধেন্দুবাবুর বয়েস তখন তেরো। সোম পরিবার আশ্রয় পেয়েছিল স্কুল অফ ট্রপিকাল মেডিসিনের উলটোদিকে সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ থেকে বের হওয়া একটা গলির ভেতরে একটি অতি প্রাচীন দোতলা বাড়িতে।

‘একটা ছোটো প্রায়ান্ধকার ঘরে অর্ধেন্দুবাবু, তাঁর বাবা পূর্ণেন্দু মা রমা আর ছোটোবোন ভগবতী ওরফে পারুলের স্থান হয়েছিল। সেই সময়ে সেটাই আশাতীত প্রাপ্তি ছিল। বাড়ির মালিক ছিলেন অর্ধেন্দুবাবুর এক দূরসম্পর্কের জ্যাঠামশাই রাধানাথ সরকার, রেলের অবসরপ্রাপ্ত টিকিট-চেকার। রাধানাথবাবু একজন অত্যন্ত সজ্জন মানুষ, পূর্ণেন্দুবাবুর টেলিগ্রাম পেয়ে খুব খুশি হয়ে তাঁকে শিয়ালদায় নেমেই পত্রপাঠ তাঁর কাছে চলে আসতে বলেছিলেন। তিনি অকৃতদার ছিলেন, একা থাকতেন। পূর্ণেন্দুবাবুকে আশ্রয় দিয়ে তাঁর আনন্দিত হবারই কথা।

‘পূর্ব পাকিস্তানে মুন্সিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাইস্কুলের ছাত্র অর্ধেন্দুর পড়াশুনোর ফলাফলের বিবরণ শুনে রাধানাথ চমৎকৃত হয়েছিলেন। তিনি নিজে পরীক্ষা করে দেখলেন সেই বিবরণ সঠিক। তখন তিনি নাতিকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে হেয়ার স্কুলে ভরতি করে দেন । কোনো সার্টিফিকেট তো ছিল না। কাজেই রাধানাথের মুখের কথা অবিশ্বাস না করলেও স্কুল কর্তৃপক্ষ সকলের সন্তুষ্টির জন্য একটা পরীক্ষা নিয়েছিলেন। তার কি ফল হয়েছিল সেটা বলাই বাহুল্য।

‘সেই যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, প্রেসিডেন্সি কলেজ হয়ে তার শেষ হল প্রশাসনিক পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়ে। তখন অর্ধেন্দুর বয়েস ছিল বাইশ। এদিকে, পূর্ণেন্দুবাবু অনেক হাঁটাহাঁটির পর কলকাতা বন্দরে একটা কেরানির কাজ পেয়েছিলেন। পদোন্নতি হয়ে ১৯৬৩ সালে বড়োবাবু হয়ে যখন চাকরির মেয়াদ শেষ হবার বছর তিনেক আগেই অবসর মিলেন তখন তার বয়েস সাতান্ন।

‘শিয়ালদা স্টেশনে নামার দিন থেকে এই খোলো বছরে অবশ্যই আরও কিছু ঘটনা ঘটে গিয়েছে। অর্ধেন্দু প্রশাসনিক পরীক্ষা পাশ করবার পর থেকেই নানা জায়গা থেকে তার বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকে। পারুলও বছর তিনেক বাদে এম.এ ক্লাসে ভরতি হবার পর তার জন্যেও একটা-দুটো প্রস্তাব আসতে থাকে।

‘পূর্ণেন্দুবাবু কিন্তু এদের কোনোটা নিয়ে এগোতে পারেননি কারণ, তাঁর একতলার ছোটোঘরটায় এই সব প্রস্তাব নিয়ে কারোর সঙ্গে আলোচনা করতে তিনি সংকোচ বোধ করতেন। কাজেই, ১৯৫৯ সালে মির্জাপুর স্ট্রিটের ওপরে খুব বেশি পুরোনো নয় এইরকম একটি ছোটোখাটো বাড়ির দোতলার ওপরে বারোশো স্কোয়ার ফুটের একটা ফ্ল্যাট কেনেন। তখন অবশ্য অর্ধেন্দু অধুনা মহারাষ্ট্রের বিদর্ভ ডিভিশনের নাগপুরে পোস্টিং পেয়ে চলে গেছেন। এই বাড়ি কেনবার জন্যে তিনি তাঁর বাবাকে বেশ কিছু টাকা দিয়েছিলেন।

‘অর্ধেন্দু কিন্তু বিয়ে করলেন না। তার কারণ সম্ভবত, তাঁর কোনো কোনো বন্ধুর মুখে ১৯৪৭-এ তাঁদের পূর্ববঙ্গের কয়েকটা ভয়ংকর স্মৃতি তাঁর মনের মধ্যে যে ক্ষত তৈরি করেছিল, সেটার যন্ত্রণা থেকে তিনি কিছুতেই বেরিয়ে আসতে পারছিলেন না। মাঝে মাঝে সন্ধের দিকে মাথার ভেতরে খুব কষ্ট হত, তখন রাতের পর রাত ঘুমোতে পারতেন না। স্বপ্ন দেখতেন যেন তাঁর চারদিকে আগুন জ্বলছে আর একটি সশস্ত্র ক্ষিপ্ত জনতা তাঁকে মারতে ছুটে আসছে। একটা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পালাবার চেষ্টা করছেন কিন্তু জনতা প্রতি মুহূর্তে তাঁর আরও কাছে এগিয়ে আসছে। একটা তীব্র যন্ত্রণায় তাঁর ঘুম ভেঙে যেত। সেই সময়টা কোনো ঘুমের ওষুধই কোনো কাজ করত না। যখন এই স্বপ্নগুলো আসত, তার পরের বেশ কয়েকটা দিন তিনি কেমন যেন ঝিমিয়ে থাকতেন। এই সময়টা তাঁর ভেতরে ফনা তুলে ওঠা একটা প্রচণ্ড রাগ যেন কোনো নিরপরাধ মানুষের কোনো ক্ষতি না-করে ফেলে— এই চেষ্টায় তিনি নিজেকে ব্যাপৃত রাখতেন। কাজেই, কাউকে তাঁর ভেতরের জ্বালাটা কোনোদিন বুঝতে দেননি।

‘অর্ধেন্দুর এই ব্যাপারটা জানতেন একমাত্র তার মা, রমা। ছেলেকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু কোনো ফল হয়নি। তিনি ছেলেকে বলতেন যে তাঁর পরিবারের কারোর এই ধরনের অভিজ্ঞতার স্মৃতি থাকলেও, তা তাঁরা পেছনে ফেলে আবার নতুন করে যদি জীবন শুরু করতে পারেন, তবে সে পারছে না কেন? সেই আত্মীয় বা বন্ধুদের জীবনে যা ঘটেছে সেটা যে একটা দুঃস্বপ্ন মাত্র, এটা ভেবে নেওয়া কি এতই কঠিন? যার এত বুদ্ধি, এত পড়াশুনো, তার পক্ষে, কি হতে পারত তাই ভেবে নিজেকে কষ্ট দেওয়া কি কোনো কাজের কথা? সত্যিকথা বলতে কী, পূর্ণেন্দুবাবুর ক্ষেত্রে এরকম কোনো ঘটনা তো সত্যিই ঘটেনি। তাঁর মুসলমান সহকর্মীরা আর, ছাত্ররা তাঁর পরিবারের সবাইকে কোনোরকমে সসম্মানে বর্ডার পার করে দিয়েছিল। সেটাও মনে রাখা দরকার।

‘এসব কথায় কোনো লাভ হয়নি। অর্ধেন্দুর দ্বারা কিছুতেই এই দুঃস্বপ্নের নারকীয় জাল কেটে বেরিয়ে আসা সম্ভব হয়নি। ফলে তাঁর “আমার জন্যে একটি স্বাভাবিক মেয়ের জীবনটা নষ্ট হতে দেওয়া যায় না” বলে আর বিয়ে করাও হয়নি।

‘নাগপুরে রাতের পর রাত একা একা থাকতে থাকতে অর্ধেন্দুবাবুর এই যন্ত্রণাটা যেন আরও বেড়ে যেতে লাগল আর তার ফলে তাঁর কাজকর্মেও অসুবিধে হতে শুরু করল। তখন, একদিন উপায়ন্তর না-দেখে অর্ধেন্দুবাবু তাঁর বাড়ির কাছেই ড. সুশীল দামলে নামের একজন নামজাদা সাইকোলজিস্টের দ্বারস্থ হলেন।

‘ড. দামলে খুব মন দিয়ে অর্ধেন্দুবাবুর সব কথা শুনে বললেন যে, বারো-তেরো বছর বয়েসে যখন একজন মানুষ আবেগপ্রবণ কৈশোর আর বাস্তববাদী যৌবনের মাঝামাঝি এসে পৌঁছোয়, তখন যদি তার মনের ওপর কোনো প্রচণ্ড আঘাত আসে, তাহলে সেটা তার পক্ষে সহ্য করে একেবারে স্বাভাবিক হয়ে ওঠা খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। অর্ধেন্দুবাবু যে এইরকম একটা বয়েসে তাঁর অভ্যস্ত পরিবেশ থেকে চোরের মতো পালিয়ে এসেছিলেন আর প্রায় একই সময়ে তাঁর কোনো কোনো আত্মীয় বা বন্ধুর কাছে তাঁদের ভয়ংকর অভিজ্ঞতার বিবরণ শুনেছিলেন, এই দুটো ব্যাপার একসঙ্গে মিলেমিশে প্রতিফলিত হচ্ছে তাঁর স্বপ্নগুলোর মধ্যে। এইসব অভিজ্ঞতার জন্যেই তাঁর ঘুমের অভাব হচ্ছে আর মনের মধ্যে প্রচণ্ড রাগ জমে উঠছে। এই ঘটনাগুলো যে এখন নিতান্তই অতীত আর অদূর ভবিষ্যতে তাদের যে পুনরাবৃত্তি ঘটবে তার সম্ভাবনাও কম, সেটা জেনেও তিনি তাদের স্মৃতি থেকে সরিয়ে দিতে পারছেন না। আর যা ঘটেছে, তার তো কোনো প্রতিকার করবারও কোনো প্রশ্নই আজ আর ওকে না। কাজেই, উত্তেজিত না-হয়ে একটু কষ্ট করে এইসব কথা ভুলে যাওয়াই উচিত।

‘ড. দামলের উপদেশে আর তাঁর ওষুধে কিছুটা কাজ যে হল না তা নয়। রাত্রে ঘুম হতে শুরু করল, অল্পেই রেগে ওঠা প্রায় বন্ধ হল, কিন্তু পুরোটা হল না। তাঁকে খুন করবার জন্যে ছুটে আসা এক ক্ষিপ্ত হিংস্র জনতার ছবিটা আর তার সঙ্গে সম্পর্কিত তীব্র যন্ত্রণাটা তাঁর স্বপ্ন থেকে একেবারে চলে গেল না।

তবে, এর মধ্যে পারুলের বিয়ে হয়ে গেল আর সকলকে ছেড়ে চলে গেলেন পূর্ণেন্দু, রমা আর রাধানাথ। মির্জাপুর স্ট্রিটের বাড়িটায় পারুল আর তার বর এসে থাকতে শুরু করল। এখন অর্ধেন্দুবাবু প্রায় মুক্তবিহঙ্গ হয়ে তাঁর প্রশাসনিক কাজকর্ম আর লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করলেন। কিন্তু মনের ভেতরে একটা ক্ষত রয়েই গেল।’

চিত্তপ্রসাদবাবু এইখানে একটু থামলেন। সেই সুযোগে আমাদের হেমন্ত প্রশ্ন করল, ‘আপনি অর্ধেন্দুবাবু সম্পর্কে এত কিছু জানলেন কী করে?’

‘বলছি। এর কিছুদিন পরে অর্ধেন্দুবাবু বদলি হয়ে বর্ধমানে এলেন। তখন আমি বর্ধমানে আমাদের পার্টির সংগঠনের কাজে সাময়িকভাবে ওখানেই থাকি। যেখানে থাকতুম সেই বাড়িটা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের বাড়ি থেকে হাঁটা পথ। আমি তখন জানতুম না যে উনি আমার সম্পর্কে অনেক কিছু জানেন এবং আমার সঙ্গে আলাপ করতে উৎসুক।

‘সে যাই হোক, একদিন উনি আমাকে রাস্তা থেকে ধরে তাঁর বাড়িতে নিয়ে গেলেন। সেই হল আলাপের শুরু। কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের সাক্ষাৎগুলো ঘন ঘন হতে লাগল। স্বাভাবিকভাবেই, দু-জনেরই জীবনের নানা রোমাঞ্চকর ঘটনা আর দুর্ঘটনা নিয়ে আলোচনা হল। তখনই আমি, এই যে এতক্ষণ ধরে আপনাদের ওঁর জীবনের যতসব তিক্ততার কথা বললুম, সেই সব কাহিনি জানতে পারি।

‘এইসব গল্পগুলো শোনবার পরে আমার মনে অনেকগুলো প্রশ্ন উঠে আসে। তাদের মধ্যে যেটা প্রধান তা হল, যে অভিজ্ঞতা তিনি নিজে অনুভব করেননি, তার এমন সুস্পষ্ট আর বিস্তারিত স্বপ্ন দেখা কি তাঁর পক্ষে সম্ভব? ফ্রয়েডের তত্ত্ব দিয়ে এই ব্যাপারটা বোঝানো যায় কি? একমাত্র হতে পারে যে তিনি কোনো আত্মীয় বা বন্ধুর কাছে তার নিজের এরকম ভীতিজনক অভিজ্ঞতার একটা এতই পুঙ্খানুপুঙ্খ আর বিশদ বর্ণনা শুনেছিলেন যে সেটা তাঁর মনের ভেতরে একটা সিনেমার মতো গেঁথে রয়েছে আর সেটাই তাঁর স্বপ্নে ঘুরে ঘুরে আসছে। ফ্রয়েডের মত অনুযায়ী সেটা অসম্ভব। স্বপ্ন সবসময়েই যিনি দেখছেন তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার ফল। স্বপ্নগুলো কারোর নিজস্ব সাইকি বা মানসিক গঠনের ফলে স্বপ্নে একট উলটো পালটা হয়ে যেতে পারে। কিন্তু ধার করা অভিজ্ঞতা বা স্মৃতি হতে পারে না। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, স্মৃতির পটে জীবনের ছবি কে আঁকিয়া যায় জানি না- কথাটা ভুল বলেননি।

‘একদিন আমি সোমসাহেবকে এই প্রশ্নটা করি। তিনি সোজা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন যে, এই স্বপ্নগুলো কেন আসছে বা কোথাথেকে আসছে সেটা তাঁর বুদ্ধির অগম্য কিন্তু, সেগুলো এতটাই স্পষ্ট যে মারমুখি জনতার সামনে যে লোকেদের তিনি দেখে থাকেন, তাদের মুখগুলো পর্যন্ত তাঁর স্মৃতিতে গাঁথা হয়ে আছে। আমি স্তম্ভিত হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলুম যে সেই মুখগুলোর একটাও কি তিনি কোনোদিন বাস্তবে বা কোনো ছবিতে বা অন্য কোনো ভাবে দেখেছেন কি না। উত্তর পেয়েছিলুম একটা জোরালো, না কোনোদিন না।

‘তাহলে প্রশ্ন ওঠে, সেই মুখগুলো অর্ধেন্দুবাবুর স্মৃতিতে আসে কী করে?’

মুকুল বলল, ‘এর একটা উত্তর হল, অর্ধেন্দুবাবুর পড়া কোনো বই বা লেখায় হয়তো এইরকম কিছু মুখের বিস্তারিত বর্ণনা তাঁর স্মৃতি বা কল্পনায় প্রায় বাস্তবের মতো ছাপ রেখে গিয়েছিল।’

চিত্তপ্রসাদবাবু মাথা নেড়ে বললেন, ‘বললুম যে, ধার করা স্মৃতি কারোর স্বপ্ন সৃষ্টি করে না। এর যা আসল উত্তর সেটা কিন্তু বিংশ শতকের শুরুতেও কেউ চিন্তা করতে পারত না। আজ কিন্তু সেটা বিজ্ঞানের ভিত্তির ওপরে দাঁড়িয়ে গেছে। আমাদের স্মৃতি বা স্বপ্নগুলোর ব্যাখ্যা আর ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের ওপরে নির্ভর করে না।’

‘তবে কীসের ওপরে নির্ভর করে?’

‘বলব। তবে, তার আগে গল্পটা শেষ করে নি।’

আমরা বললুম, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেই ভালো। ব্যাখ্যা-ট্যাখ্যাগুলো পরে শোনা যাবে।’

চিত্তপ্রসাদ বললেন, ‘এই গল্পের শেষটা জানবার আগে পলাশপাড়ার বাড়িটার ইতিহাসটা বোধ হয় একটু জেনে নেওয়া দরকার। এই ইতিহাস আমি অনেকদিন ধরে এবং অনেক পরে জেনেছি। যারা শহরে কাজ করতে যায় তারা অল্পবয়সি। তাদের পলাশপাড়ার বাড়ির খোঁজখবর জানবার কোনো আগ্রহ বা ইচ্ছে কোনোটাই থাকবার কথা নয় । আর ওই অঞ্চল নিয়ে যেসব অলৌকিক বা ভূতুড়ে লোকশ্রুতি আছে সেসবের কোনো ব্যাখ্যা খোঁজার কোনো প্রয়োজন নেই বলেই তারা মনে করে। আপনাদের মতোই, লোকশ্রুতিগুলো কুসংস্কার বলে তারা প্রত্যাখ্যান করে।

‘আমি পলাশপুরের ইতিহাস খুঁজতে শুরু করি অন্য পথে। সেই খোঁজার ইতিহাস বলতে গেলে অনেক সময়ও লাগবে আর তার দরকারও নেই। শুধু এটুকু বললেই হবে যে আমার সময় লেগেছিল প্রায় নিরবচ্ছিন্ন তিন বছর। ষে ইতিহাসটা পেয়েছিলুম, সেটা মোটামুটি এইরকম—

‘এই পলাশপুরের জমিদারি কিনেছিলেন, হরিশ্চন্দ্র রায় নয়, হর্ষবর্ধন সিং। তিনি বিহারের রাজমহলের লোক। বেশ নামজাদা ব্যবসায়ী, পাটনা থেকে কাটোয়া পর্যন্ত তাঁর ব্যাবসা বিস্তৃত ছিল। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি বর্গিদের অত্যাচারে তিতিবিরক্ত হয়ে পাঁচভরি হিরে দিয়ে বর্ধমানের পশ্চিম সীমান্তে একটা জমি কিনে সেখানে একটা বড়োসড়ো বাড়ি বানিয়ে সপরিবারে উঠে আসেন আর নবাবি ফরমান এনে পলাশপাড়া গ্রামের পত্তন করেন। জায়গাটা খুবই নিরিবিলি আর ঘন জঙ্গলে ঘেরা বলে মোটামুটি লোকচক্ষুর আড়ালে ছিল। বর্গিদের আক্রমণের সম্ভাবনা এখানে ছিল না বললেই হয়। কজেই হর্ষবর্ধন এখানেই থেকে গেলেন আর ১৭৫১ সাল নাগাদ বর্গিরা বাংলা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর বৃদ্ধরয়াসেই প্রবল উৎসাহে আবার ব্যবসা শুরু করে দিলেন। রাজমহলের সঙ্গে আর তার যোগাযোগ ছিল কি না সেটা জানতে পারিনি।

‘১৭৫৬ সালে আশিবছর বয়েসে হর্ষবর্ধন দেহত্যাগ করেন। তবে, তার মধ্যেই তাঁর ব্যাবসা আবার পাটনা, কাটোয়া, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ হয়ে সুবা বাংলায় আরও অনেক জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিল। জগৎ শেঠদের সঙ্গেও তাঁর ব্যবসায়িক যোগাযোগ ছিল, তার প্রমাণ আছে। ফলে, তাঁর সম্পত্তি, বাড়ি আর জমিদারির এলাকা বেড়েই যাচ্ছিল। কিন্তু, তিনি খুব সাধারণভাবে থাকতেন, কোনো বড়োলোকের চালিয়াতি তাঁর ছিল না। প্রজাদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভালো ছিল। এইজন্যে, তাঁর দিকে কারোর কুদৃষ্টি পড়েনি।

‘এর প্রায় এক-শো বছর বাদে হর্ষবর্ধনের নাতির নাতি, বা ওইরকম এক বংশধর, হর্ষবর্ধনের, যাকে বলে, স্থলাভিষিক্ত হলেন। এরমধ্যে ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধ হয়ে গেছে। মুর্শিদাবাদে বিজয়ী ইংরেজ কোম্পানি বিশাল হাজার দুয়ারী বানিয়ে, সেখানে তাদের শাসনকেন্দ্র বসিয়ে আর দিল্লির সম্রাটের প্রতিভূ হিসেবে কর আদায়ের নামে স্রেফ লুঠ করতে শুরু করে বাংলাকে শ্মশান বানিয়ে ছেড়েছে। পলাশীর যুদ্ধের এক-শো বছর বাদে ১৮৫৭ সালে সিপাহিবিদ্রোহের পর বানিয়া ইংরেজ কোম্পানির মানদণ্ড রাজদণ্ডে পরিণত হয়েছে।

‘এই সময়ে, ১৭৭০ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ছাড়া, হর্ষবর্ধনের বংশধরদের আর বিশেষ কোনো ঝঞ্ঝাটে পড়তে হয়নি। হর্ষবর্ধনের ছেলে, তার নামটা মনে করতে পারছি না, দুর্ভিক্ষের খুব ভালোভাবে মোকাবিলা করেছিল। লঙ্গরখানা খুলেছিলেন, দূরদূরান্তর থেকে সেখানে ক্ষুধিত মানুষেরা আসত। কেউ ফিরে যেত না। কলকাতা থেকে ইংরেজ সরকার এক রিপোর্টে তাঁর এই পদক্ষেপের খুব প্রশংসা করেছিল।

এরপর, ১৮০০ সালের মাঝামাঝি দুর্ভাগা বাংলায় এল নীল রাক্ষস। নীলের ব্যবসায়ী একদল নৃশংস ইংরেজ যে নারকীয় উন্নাসে বংলার চাষিদের ওপর অত্যাচার শুরু করল, তার বর্ণনা শুনলে পলাশীর যুদ্ধের পরে ইংরেজ কোম্পানির কর আদায়ের প্রধান দেবী সিংহও বোধ হয় মূর্ছা যেতেন।

‘কথায় বলে, বেশি অত্যাচার করলে বেড়ালও ঘুরে দাঁড়ায়। নদীয়া জেলার চাষিরা প্রথম ঘুরে দাঁড়ালেন। সেই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ল অন্যান্য জেলায়। অপ্রত্যাশিতভাবে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সমস্ত অত্যাচারিত চাষিরা, এমনকী জমিদাররাও, এককাট্টা হয়ে এই বিদ্রোহে সামলি হলেন। হরিশচন্দ্র মুখার্জি কলকাতায় তাঁর হিন্দু পেট্রিয়ট কাগজে বিদ্রোহ দমনে ইংরেজপুংগবদের কীর্তিকলাপের বিস্তারিত বিবরণ ছাপতে শুরু করলেন। তাঁর সেই লেখা যখন ইংল্যান্ডে এবং ইউরোপে পৌঁছোল, তখন কিছু বিবেকবান ইংরেজ হইচই শুরু করে দিলেন।

‘নীল বিদ্রোহের সময় পাঁচভরির জমিদার ছিলেন রাজা উমেশচন্দ্র সিং। তাঁকে রাজা উপাধি কে দিয়েছিলেন তা আমি জানতে পারিনি। আমার তো মনে হয় তিনি নিজেই নিজেকে রাজা বানিয়েছিলেন। তিনি কিন্তু একেবারেই তাঁর পূর্বপুরুষদের মতো ছিলেন না। অত্যন্ত অহংকারী, নিষ্ঠুর এবং হিংস্র প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। প্রজাদের কাউকে মানুষ বলে গণ্য করতেন না। সামান্য অপরাধেও কদর্য উল্লাসে তাদের চাবুক দিয়ে পেটাতেন। তাঁর চরিত্রটিও ছিল তাঁরই উপযুক্ত। অত্যন্ত কুৎসিত। তিনি যখন ঘোড়ায় চড়ে জমিদারি দেখতে বের হতেন, গ্রামে কোনো বয়েসের কোনো মেয়েই থাকত না। জঙ্গলে পালিয়ে গিয়ে গা ঢাকা দিয়ে থাকত।

‘নীলকর সাহেবরা যখন পাঁচভরির কাছেই কুঠি বানাল, উমেশচন্দ্র পত্রপাঠ ভেট নিয়ে তাদের অভ্যর্থনা করতে চলে গেলেন। রতনে রতন চেনে। নীলকরেরা উমেশচন্দ্রর সানন্দ অনুমতিতে তাঁর প্রজাদের ওপর বাধনছেঁড়া উৎপীড়ন শুরু করে দিল। উমেশচন্দ্র যে শুধু সেই অত্যাচার সোল্লাসে উপভোগ করলেন তাই নয়, ইংরেজ জানোয়ারগুলোর আনন্দ বর্ধনের জন্য নিজের পাইক দিয়ে প্রজাদের বাড়ি থেকে মেয়েদের তুলে এনে নীলকুঠিতে পাঠিয়ে দিতে লাগলেন। তারা কেউ আর ফিরে আসেনি। পাঁচভরির আকাশ হাহাকারে ভরে উঠল।

‘উমেশচন্দ্র জানতেন না যে হিন্দু পেট্রিয়ট কাগজের খবরগুলো সমস্ত ইউরোপের মানুষ আর ইংল্যান্ডের কিছু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে কতটা নাড়া দিয়েছিল। ঘরে-বাইরে ইংরেজদের বাংলার নীলচাষিদের ওপরে, তারা শান্তিপ্রিয়ই হোক বা বিদ্রোহীই হোক, সভ্যতার সমস্ত সীমা ছাড়ানো জঘন্য আর নক্কারজনক অত্যাচারের বিরুদ্ধে যে তীব্র সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছিল তার ধাক্কা সামলানো আর তাদের সরকারের পক্ষে সম্ভব হল না। তার ওপরে ইংরেজদের বোঝার ওপর শাকের আঁটি ছিল সিপাহিবিদ্রোহ। নীলের চাষ বন্ধ হয়ে গেল। বোম্বেটে ইংরেজ নীলচাষিরা দেশে ফিরে গেল।

‘এইবার এল প্রত্যাঘাতের রাত। সেই রাত্রে যে কী হয়েছিল তা জানাবার মতো কাউকেই আর পরে পাওয়া যায়নি। মাসছয়েক বা তারও পরে, আশেপাশের শহরগুলো থেকে পলাশপাড়ার কাজের লোকেরা কাজে আসছে না বলে, কেউ কেউ খোঁজ নিতে এসে যা দেখলেন, তাতে তো তাঁরা স্তম্ভিত। সমস্ত পলাশপুর গ্রামটা, মায় বিশাল রাজবাড়ি তখন জনহীন, কোথাও একটা কুকুর পর্যন্ত নেই। থাকবেই বা কী করে? খাবার মতো তো কিছু থাকতে হবে। যাঁরা এসেছিলেন, তাঁরা ব্যাপার দেখে পত্রপাঠ প্রত্যাবর্তন করেছিলেন।

‘দু-একজন সাহস করে কয়েকটা গ্রামের বাড়ির ভেতরে ঢুকেছিলেন। সেখানে দেখা গিয়েছিল রান্নাঘরে ধুলিধূসরিত হাঁড়িকুড়ি, আর অন্যান্য ঘরে সেইরকম আসবাবপত্র নিজ নিজ স্থানেই রয়েছে। মনে হয়েছিল যেন বাসিন্দারা হঠাৎ, যেকোনো কারণেই হোক, একসঙ্গে গৃহত্যাগ করেছে।

‘যাঁরা রাজবাড়িতে ঢুকেছিলেন, তাঁদের অভিজ্ঞতা ছিল অনেক খারাপ। সারা বাড়িটা অবশ্যই ছিল জনপ্রাণীহীন। দরজা-জানলায় কোনো পাল্লা ছিল না। তেমনি, কোনো ঘরে কোনো আসবাবও ছিল না। একতলার ঘরগুলোয় আর বারান্দার মেঝেয় ছিল বড়ো বড়ো ফাটল, তার ভেতর থেকে বুনো ঘাস গজিয়ে উঠেছে। মোটা মোটা থামগুলো পেঁচিয়ে কাঁটালতা বেশ কিছুটা উঠে গেছে। ফলে, প্লাস্টারে ফাটল ধরতে শুরু করেছে। কোনো কোনো থামে কালো পোড়া দাগ নীচ থেকে ওপর পর্যন্ত উঠে গেছে। দোতলার কোনো কোনো ঘরের মেঝের টালি ভেঙে নীচে একতলায় পড়ে গেছে। আর সমস্ত বাড়ির ভেতরে জমাট বেঁধে আছে একটা আবছা অথচ অসহ্য দুর্গন্ধ।

‘ঘটনাটা ঘটেছিল ১৮৬০ সালের শেষদিকে। তখনও গ্রামাঞ্চলের শান্তি রক্ষা করত লাঠিহাতে চৌকিদার। কোথাও দাঙ্গহাঙ্গামা হলে চৌকিদার সদরে খবর পাঠাত। তখন বাংলার পুলিশ ডিপার্টমেন্ট সবে তৈরি হচ্ছে। বড়ো গণ্ডগোল কিছু হলে সদর থেকে ফোর্স আসত— একজন ইংরেজ ইনস্পেকটর, তার কাছে আগ্নেয়াস্ত্র থাকত, গুটিকয়েক তরোয়ালধারী কনস্টেবল আর কয়েক জন লাঠিধারী চৌকিদার।

‘পলাশপাড়ার চৌকিদার-টৌকিদার কিছুই ছিল না। জমিদারের পাইকরা পুলিশের কাজ করত। তারাও তো ভাগলবা। কাজেই সদরে লোকমুখে খবর পৌঁছোতে মাস গড়িয়ে গেল। তখন ফোর্স এল বটে, কিন্তু এদিক-ওদিক ঘুরে-ফিরে চলে গেল। তারপর প্রায় দেড়-শো বছরে দেশের লোক সেই পলাশপাড়ার কথা ভুলে যেতে বসেছিল। কিন্তু সেটা যে হয়নি তার কারণ ইতিমধ্যে, কিছু ভবঘুরে পলাশপাড়ায় গিয়ে বাসা বেঁধেছিল। পরে তাদের সঙ্গে যোগ দিল কিছু পূর্ববঙ্গ থেকে আসা উদ্বাস্তু। আস্তে আস্তে পলাশ পাড়া আবারও জনবসতি হয়ে উঠল। কিন্তু, যেকোনো কারণেই হোক, ওখানকার রাজবাড়িটা কেউ সাহস করে দখল করতে এগিয়ে এল না। তার কারণ সম্ভবত, হানাবাড়ি বলে রাজবাড়িটার একটা বদনাম ততদিনে বেশ ছড়িয়ে পড়েছিল।’

এই পর্যন্ত বলে চিত্তপ্রসাদ একটু থেমে বললেন, ‘আপনারা হয়তো ভাবছেন যে আমি কুসংস্কারের কথা বলতে গিয়ে এত ইতিহাসের কচকচানির অবতারণা করে অকারণে আপনাদের সময় নষ্ট করছি। তা কিন্তু নয়। কারণ আছে। সেটাই এবার বলব।’

নিরঞ্জন বলল, ‘না, সেটা আমরা কেউ ভাবছি বলে আমার মনে হয় না। তবে, লাহোর জেলে ইংরেজরা আপনার ওপরে অকথ্য অত্যাচার কেন করেছিল, সেটা বেশ পরিষ্কার বুঝতে পারছি।’

চিত্তপ্রসাদ হাত নেড়ে বললেন, ‘ওসব কথা থাক। এবারে অর্ধেন্দুবাবু আর এই গল্পের শেষ অঙ্কে ফিরে যাই।’

বলতে বলতে চিত্তপ্রসাদবাবুর মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেল। কিছুক্ষণ জানলা দিয়ে বাইরে বৃষ্টির প্রলয় নাচন দেখে হঠাৎই সংবৃৎ ফিরে পেয়ে তাঁর গল্পের শেষ অঙ্কের বিবরণ শুরু করলেন।

***

‘প্রথমদিন পলাশপাড়ার টুর শেষ করে ফিরে আসবার পর অর্ধেন্দুবাবু কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। কথা বলতে বলতে হঠাৎ চুপ করে কী যেন ভাবেন। আমি ওঁকে জিজ্ঞাসা করলুম যে ব্যাপারটা কী। কোনো উত্তর পাইনি।

‘কিছুদিন বাদে অর্ধেন্দুবাবু দ্বিতীয়বার পলাশপুরে গেলেন। এবার ফিরে আসবার পর দু-তিন দিন বাদে আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে তাঁর অবস্থা দেখে তাজ্জব হয়ে গেলুম। দেখি, ভদ্রলোক বুকের ওপর মাথা ঝুঁকিয়ে কেমন আচ্ছন্নের মতো তাঁর বসবার ঘরে একটা সোফার ওপরে বসে আছেন। আমি যে ঘরে ঢুকলুম, একটা চেয়ার টেনে সামনে বসলুম, সেটা যেন টেরই পেলেন না।

‘ব্যাপারটা আমার মোটেই ভালো লাগল না। আমি উদ্‌বিশ্ব হয়ে বললুম, “আপনার কী হয়েছে, বলুন তো? পলাশ পাড়ায় গিয়ে কিছু দেখেছেন? বা, কেউ কিছু বলেছে আপনাকে?”

‘অর্ধেন্দুবাবু হঠাৎ মুখ তুলে উদ্ভ্রান্তের মতো দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “না, চিত্তবাবু, সে রকম কিছু নয়। কিন্তু, কী জানেন, পলাশপাড়ায় গিয়ে আমার খালি মনে হতে লাগল, এ জায়গাটা আমি চিনি, খুব ভালো করে চিনি। গতবারেও তাই, এবারেও তাই। আর সঙ্গে সঙ্গে আমার বুকের ভেতরে একটা তীব্র ভয়মিশ্রিত রাগ আগুনের মতো জ্বলে উঠল। এমন কেন হল, চিত্তবাবু?”

‘আমি বললুম, ও, এই ব্যাপার? এতে এত উত্তেজিত হওয়ার তো কোনো কারণ নেই। আমারও তো মাঝে মাঝে কোনো নতুন জায়গায় গিয়ে এই ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে। যেমন প্রথমবার দেরাদুনে একটা জায়গায় গিয়ে যেন মনে হল এখানে আমি আগে এসেছি। হয়তো, আমার পূর্বজন্মের…

‘সোমসাহেব আমাকে বাধা দিয়ে বললেন, “দেখুন চিত্তবাবু, আমি ওসব পূর্বজন্ম-ফুর্বজন্মের মতো কুসংস্কারে বিশ্বাস করি না। কোনো বৈজ্ঞানিক যুক্তি যদি থাকে তো বলুন।”

আমি তখনও নাইজেল ক্যালডারের দি মাইন্ড অফ ম্যান বা দি ব্রেন বইদুটোর কোনোটাই পড়িনি। কাজেই আমি এর কোনো যুতসই জবাব সেদিন দিতে পারিনি। চুপ করে গিয়েছিলুম। বিদায় নেবার সময় শুধু বলেছিলুম, “এবার যখন যাবেন, অবশ্যই আমাকে সঙ্গে নেবেন।”

‘সোমসাহেব নিঃশব্দে মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়েছিলেন।

***

‘দু-তিন দিন পরেই সন্ধেবেলা ডাক এল। পরের দিন ভোরবেলা পলাশপাড়ায় সোম সাহেবের ট্যুর। আমাকেও যেতে হবে।

‘প্রথমে ভেবেছিলুম না বলে দেব। এত কম সময়ের মধ্যে যেতে বললেই তো আর যাওয়া যায় না। আমারও তো কাজকর্ম আছে। কিন্তু, পলাশপাড়ার রহস্যটা আমাকে বড্ড বেশি পেয়ে বসেছিল। তার সমাধানের এত বড়ো সুযোগ আর হয়তো পাওয়া যাবে না। অতএব যাওয়াই স্থির করলুম।

‘বর্ধমান থেকে পলাশপাড়া জিপে প্রায় পাঁচ-ঘণ্টার রাস্তা। সমস্ত পথটাই অর্ধেন্দুবাবু প্রায় কোনো কথাই বললেন না। স্থির হয়ে ভুরু কুঁচকে অত্যন্ত চিন্তিতমুখে সামনে তাকিয়ে বসে রইলেন। তাঁর মনের মধ্যে তখন কী হচ্ছিল, সেটা বোঝবার চেষ্টা করবার সাহস হয়নি। জানি না, বোধ হয় চেষ্টা করলেই ভালো হত।

‘আমরা পলাশ পাড়ায় পৌঁছোতেই অর্ধেন্দুবাবু জিপের ড্রাইভারকে বললেন গাড়ি গ্রামের দিকে না-নিয়ে রাজবাড়ির দেউড়ির সামনে পার্ক করতে। তাই করা হল। গাড়ি থামলে সোমসাহেব আমাকে বললেন, “আপনারা একটু বসুন, আমি চট করে ভেতরটা দেখে আসি।”

‘বললুম, না স্যার, আমরাও আপনার সঙ্গে যাব।

‘হঠাৎ রেগে গেলেন ভদ্রলোক। ধমকে উঠে উঁচু গলায় বললেন, “কেন? আমি কি কচি খোকা? একা একা একটা পোড়োবাড়ির ভেতরে যেতে পারব না? ভূতে ধরবে আর ঘাড় মটাকাবে, সেই ভয়ে?”

‘আমি শান্তভাবেই বললুম, “না, স্যার। আমি ভূতের ভয়ের কথা ভাবছি না। এতদিন ধরে বাড়িটা স্রেফ অব্যবহারে পড়ে আছে, তার ভেতরে বাইরে জঙ্গল গজিয়ে গেছে। ওখানে হিংস্র জন্তুজানোয়ারের থেকেও বিপজ্জনক কোনো অসামাজিক দলও ওখানে ডেরা বেঁধে থাকতে পারে। তারা যে আপনাকে দেখলে মোটেও খুশি হবে না, সেটা বলাই বাহুল্য। কাজেই আমরা আপনার সঙ্গে যাবোই। কি বলো। ঘিরিধারী?”

‘ড্রাইভার গিরিধারী কিছুদিন আর্মিতে কাজ করেছিল। সে প্রবলবেগে মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ স্যার, আমরা আপনাকে আর্মস ছাড়া ওই বাড়িতে কিছুতেই যেতে দিতে পারি না। আমরা সঙ্গে যাবোই। আমি এই লোহার রডটা নিচ্ছি আর রায়বাবুকে…”

‘আমি বাধা দিয়ে ফিসফিস করে বললুম, “আমার কথা ভেবো না, গিরিধারী। আমার সঙ্গে চেম্বার আছে।”

***

‘আমাদের কথা শুনে সোমসাহেব শান্ত হলেন বলে মনে তো হলই না, বরং আরও রেগে গেলেন বলে মনে হল। কিন্তু কিছু বলবার মতো না-পেয়ে, জিপ থেকে নেমে গজগজ করতে করতে দেউড়ি পার হয়ে রাজবাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। আমরা দুই বীরপুরুষ ওঁকে আর না ঘাঁটিয়ে গুটি গুটি ওঁকে অনুসরণ করলুম।

‘রাজবাড়ির কাছাকাছি এসে আমাকে নীরবতা ভঙ্গ করতেই হল। বললুম, ওই দেখুন, স্যার। বাঁ-দিক থেকে পাঁচনম্বর দরজাটায় একটা পায়ে চলা পথ উঠোন থেকে বেরিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে গেছে। তার মানে, ওই ঘরে কোনো একটা কিছুর যাতায়ত আছে।

‘সোমসাহেব হাঁটতে হাঁটতে বললেন, “ওটা কিছু নয়। কোনো কুকুর-টুকুরের পায়ের ছাপ হবে। দরজার পেছনে ওটা কাছারি ঘর। ওখানে প্রজাদের বিচার হত। ওখানে কেউ সাধ করে ঢুকবে না।”

‘বলে, খিক খিক করে হাসলেন। একটা অতি কদর্য হাসি। শুনে আমার বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল। আমার অভিজ্ঞতায় আমি কখনো ভদ্র শান্ত কায়দাদুরস্ত সোমসাহেবকে এমন জঘন্য কুৎসিত হাসি হাসতে শুনিনি। সেইসঙ্গে আমার মনে হল, আমি বোধ হয় এবার ওই রাজবাড়ির রহস্য সংক্রান্ত সব প্রশ্নের উত্তর পেতে চলেছি।’

হঠাৎ আমাদের চাদু, মানে চন্দ্রকুমার, অত্যন্ত উত্তেজিত গলায় বলে উঠল, ‘উউ, বুঝতে পেরেছি। জরাসন্ধ!!’

রায়মশাই শান্ত গলায় বললেন, ‘আপনি বোধ হয় জাতিস্মর বলতে চাইছেন…’

এবার, আমরা সমস্বরে বললুম, ‘চাঁদু, তুই চুপ কর। জরাসন্ধ বা জাতিস্মর যাই হোক, আগে গল্পটা শেষ হোক, তারপরে তোর কি মনে হচ্ছে বা না হচ্ছে সেসব বলিস।’

মৃদু হেসে রায়মশাই বললেন, ‘আপনারাও বোধ হয় এতক্ষণে ভেবে নিয়েছেন যে আমি একটা জাতিস্মরের গল্প ফেঁদে বসেছি। সে যাই হোক, আমি আগে গল্পটা শেষ করি, তারপরে এ সম্বন্ধে আলোচনা করব।

‘আমি আরও চিন্তিত হয়ে পড়লুম যখন দেখলুম সোমসাহেব বেশ খোশমেজাজে দু-হাত ঘষতে ঘষতে কাছারি ঘরে ঢুকলেন। আমাকে বললেন, “ওই দেখুন, ছাদের কড়ি-বরগায় লোহার হুক বসানো আছে। আমি লাগিয়েছিলুম ওগুলো। ওই হুকগুলোর সঙ্গে দড়ি বেঁধে বেয়াড়া অবাধ্য প্রজাদের উলঙ্গ করে পায়ে জড়িয়ে উলটো করে ঝুলিয়ে দেওয়া হত। তার পরে শপাশপ চাবুক। অনেকে নাকমুখে রক্ত উঠে ওখানেই টেসে যেত। যেগুলো বাঁচত তাদের আর সারাজীবন ট্যা-ফোঁ করতে হত না। অসভ্য ত্যাদোড় মেয়েছেলে থাকলে তাদেরও সেই শাস্তিই দেওয়া হত। সে কী মজা! ওই কোনায় আরাম কেদারায় বসে আমি আর আমার স্ত্রী, মহারানি তরঙ্গিনী, মহানন্দে দেখতুম। কী দিনকাল ছিল তখন। কেন যে হতভাগা নীলকর সায়েবগুলো দেশে চলে গেল। নীলকুঠি বন্ধ হয়ে গেল। সেখানকার তেলেঙ্গী সেপাইরাও পাত্তাড়ি গোটাল।

“তখন আমার গোরু-গাধার চেয়েও অধম প্রজারা সাপের পাঁচ পা দেখল। হঠাৎ একদিন রাত্রে আশেপাশের গ্রাম থেকে লোকজন নিয়ে শুয়োরের বাচ্চাগুলো দল বেঁধে আমার এখানে ঢুকে পড়ল। আমার অপদার্থ পেয়াদাগুলো ভয়ের চোটে ওই বদমাশগুলোর সঙ্গে ভিড়ে গেল। আমি ঘুম থেকে উঠে বন্দুকের গুলি চালালুম বটে কিন্তু শোবার আগে একটু বিলিতির নেশা করা ওব্যেস ছিল তো, তাই ক-টা লাশ পড়েছিল, বুঝতে পারিনি। কজেই, আমার গুলি চালানোয় কোনো লাভ হল না।

“ওরা প্রথমেই আমার দুটো ছেলের মাথায় কুড়ুল মারল। তারপর তরঙ্গিনী আর আমাকে টানতে টানতে নীচে এনে এই ঘরে ঢুকিয়ে দিল।”

‘বলতে বলতে দেখি সোমসাহেবের মুখটা একটা খোঁচা খাওয়া হিংস্র মাংসাশী শ্বাপদের মতো ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। বললেন, “ওরা আমার চোখের সামনে ওদের মহারানির পায়ে দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে দিয়ে তাঁকে পিটিয়ে মেরে ফেলল। আমি ওদের বললুম, তোদের চমর শাস্তি দেব আমি। তোদের জন্যে তখন শেয়াল কুকুরেও কাঁদবে না। শুনে, ওরা আমাকে টানতে টানতে ঘর থেকে বের করে বারান্দার একটা থামে বেঁধে সারা গায়ে খড় জড়িয়ে আগুন লাগিয়ে দিল।

“ওরা ভেবেছিল আমার হাত থেকে নিস্তার পাবে। ওরা জানে না আমার কথার কোনো নড়চড় হয় না। দেখুন, আমি আবার ফিরে এসেছি। এখনই ওদের একটাকে খুন করব, তার পরে পলাশপাড়া গ্রামে আগুন লাগিয়ে সব ছারখার করে দেব।”

‘বলেই অর্ধেন্দুবাবু গিরিধারীর দিকে ঘুরে পকেটে হাত ঢোকালেন। জানি না কেন, আমার মুখ দিয়ে একটা চিৎকার বেরিয়ে এল, গিরিধারী, সাবধান!

‘হাতটা যখন অর্ধেন্দুবাবুর পকেট থেকে বের হল, আমি আতঙ্কিত হয়ে দেখলুম সেই হাতে একটা পিস্তল। আমি আমার পিস্তলটা বের করতে যাচ্ছিলুম, কিন্তু অর্ধেন্দুবাবু তাঁর পিস্তলটা ওঠানোর আগেই গিরিধারীর লোহার রড প্রচণ্ড বেগে তাঁর ডান হাতের ওপরে এসে পড়ল। পিস্তলটা ছিটকে ঘরের একদিকে চলে গেল আর অর্ধেন্দুবাবু একটা ভয়ংকর জান্তব আর্তনাদ কার মেঝের ওপর অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন।

‘গিরিধারী বলল, “আমি আপনাদের কথাবার্তা সব শুনেছি। আপনি চুপ করে শুনছিলেন কী করে? আমার তো এই রাক্ষসটাকে পিটিয়ে মেরে ফেলবার ইচ্ছে হচ্ছিল। আপনি ছিলেন তাই শয়তানটা প্রাণে বেঁচে গেল।”

‘এরকম বিপদে সবসময়েই আমার মাথা খুব ঠান্ডা থাকে। আমি কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বললুম, “পাগলামি করো না, গিরিধারী। যা বলছি তার প্রত্যেকটি কথা মন দিয়ে শোনোতুমি গাড়িতে বসেছিলে। আমার চিৎকার শুনে ভেতরে এসে পাথর-বাঁধানো উঠোনের ওপর স্যারকে হাত-পা ছড়িয়ে উবুড় হয়ে পড়ে থাকতে দেখে তাঁকে উঠিয়ে জিপে তুলে হাসপাতালে নিয়ে গেছ। ব্যস, আর কিচ্ছু তুমি দেখওনি, শোনোওনি। সবাইকে ঠিক এই কথা বলবে। তাঁর যেন কোনোরকম নড়চড় না হয়।”

চিত্তপ্রসাদ চুপ করলেন। চাঁদু হাঁসফাস করে বলল, “তখন, আপনারা কী করলেন?’

‘আমরা আর কী করব? বর্ধমান মেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার বলে একটা হাসপাতাল আছে ফেরার পথে। ফেরার পথে অর্ধেন্দুবাবুকে সেখানে ভরতি করে দিলুম। ওঁর পরিচয় পেয়ে তো হাসপাতালের লোকেরা কেঁপেঝেপে একাকার। আমিও ওদের কাছে নেহাত অপরিচিত ছিলুম না। কাজেই আমাকে খাতির করেই বসানো হয়েছিল।

‘অর্ধেন্দুবাবুর অফিসের লোকজন আর পুলিশ চলে এল পাঁচ মিনিটের মধ্যে। পুলিশ আমার আর গিরিধারীর কাছে সমস্ত ঘটনার বিবরণ নিল। গিরিধারী আমি যা বলতে বলেছিলুম, তাই বলল। আমি বললুম, আমরা দু-জন যখন দোতলার ঘরগুলো দেখছিলুম তখন একটা ঘরের ভেতরে ঢুকতেই একটা গোখরো সাপ অর্ধেন্দুবাবুর পায়ের সামনে ফণা তুলে দাঁড়ায়। তাই দেখে ভয়ে দিশেহারা হয়ে অর্ধেন্দুবাবু পেছন ফিরে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে বারান্দায় বেরিয়ে আসেন। তাঁর বোধ হয় খেয়াল ছিল না যে বারান্দায় কোনো রেলিং-এর চিহ্ন মাত্র ছিল না। সেসব কবেই অদৃশ্য হয়েছে। কাজেই, টাল সামলাতে না-পেরে উনি দোতলার বারান্দা থেকে নীচে পাথরে বাঁধানো উঠোনে পড়ে যান। দোতলার বারান্দা থেকে পড়ে গেলে তাঁর মতো স্বাস্থ্যবান লোকের জ্ঞান হারানো উচিত নয়। তবে, মনে হয়, পড়বার পর তাঁর শরীরের কোথাও একটা সজোরে আঘাত পেয়েছিলেন নিশ্চয়ই। সেই কারণে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। পুলিশ আমাদের বয়ান মেনে নিয়েছিল।’

মুকুল জিজ্ঞাসা করল, ‘অর্ধেন্দুবাবু এখন কোথায়?’

‘গত বছর মারা গেছেন। বর্ধমান হাসপাতালে তাঁর জ্ঞান যখন ফেরে তিনি তখন বদ্ধ উন্মাদ। রাঁচির মানসিক রোগের হাসপাতালে ভরতি করা হয়েছিল। সেখানেই মারা যান।’

***

চাঁদু বলল, ‘তবে? আমি অন্যায়টা কি বলেছি? জাতিস্মর বলতে গিয়ে জরাসন্ধ বলে ফেলেছি। ওটা স্লিপ অফ দা টাঙ।’

রায়মশাই বললেন, ‘সে ঠিক আছে। তবে, সোমসাহেব জাতিস্মর ছিলেন না। আমরা জাতিস্মর বলতে বুঝি একই লোক মৃত্যুর পর অন্য দেহে পূর্বজন্মের স্মৃতি নিয়ে আবার জন্ম নিয়েছে। এর কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ছিল না বলে সবাই ভাবত ব্যপারটা একেবারে অবাস্তব কুসংস্কার। গীতায় যতই লেখা থাক বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায় ইত্যাদি, তার তো কোনো প্রমাণ ছিল না। তাই, যত নাস্তিক আর আগনাস্তিকরা এই থিওরিতে বিশ্বাসই করতেন না। তাঁদের পছন্দ ছিল বৈশেষিক দর্শনের থিওরিপ্রমাণ না থাকলে, কোনো কিছুই বিশ্বাসযোগ্য বলে ধরা যাবে না। এমনকী ঈশ্বরের অস্তিত্বও নয়।

‘তবে, বর্তমান বৈজ্ঞানিক গবেষণায় জানা গিয়েছে যে, জাতিস্মর ব্যাপারটা একটা অবাস্তব কুসংস্কার নয়। নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষায় প্রমাণ হয়েছে যে, আমাদের প্রত্যেকের প্রতিটি অভিজ্ঞতা আমাদের জিনে একটা সাংকেতিক চিহ্নে লেখা হয়ে যায়। আমরা সেই জিন আমাদের পরের প্রজন্মকে দিয়ে যাই। সেখানে আবার লেখা হতে থাকে। সেইভাবে দেখতে গেলে আমরা সকলেই আমাদের পূর্বপুরুষের সমস্ত স্মৃতি বহন করে চলেছি। সেই অর্থে আমরা সকলেই জাতিস্মর। একটা প্রচণ্ড মানসিক আলোড়নে সেই স্মৃতিভারের তলা থেকে কোনো কোনো অভিজ্ঞতা ওপরে উঠে আসতে পারে।’

মুকুল বলল, ‘তার মানে কি এই যে সরাসরি আমার কোনো গুহাবাসী পূর্বপুরুষ যিনি টাইরানোসরাস রেক্সের তাড়া খেয়ে পাহাড়ের ওপর থেকে গড়িয়ে পড়ে গিয়েছিলেন বা দশাননজয়ী রামচন্দ্রের প্রপিতামহের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন, তার স্মৃতি কোনো বিশেষ পরিস্থিতি বা পরিবেশে আমার নিজস্ব বলে মনে পড়ে যেতে পারে?’

‘হ্যাঁ, পারে বা আপনার স্বপ্নে উঠে আসতে পারে। ফ্রয়েড সাহেব অনেক অনুসন্ধানের পর একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে আমরা যেসব স্বপ্ন দেখি সেগুলো অবধারিতভাবে আমাদের নিজস্ব কোনো অভিজ্ঞতার অবিকৃত বা সামান্য বিকৃত রূপ। সেই বিকৃতিগুলো কেন আসে এখানে সেকথা আলোচনা করার অবশ্য কোনো দরকার নেই।’

আমরা কলরব করে বললুম, ‘না, না। ঢের হয়েছে। আর দরকার নেই। যা শুনলুম তাতেই মাথার মধ্যে ভেরেন্ডম লেগে গেছে। আজ এই পর্যন্তই থাক। বৃষ্টিটাও থেমেছে। কোনোরকমে বাড়ি যেতে পারলেই বাঁচি।’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *