ফাঁদ
হ্যালো ম্যাডাম, আমি ইউসুফ বলছি৷ এটা অন্য নম্বর৷ অরবিন্দ স্কুলের সামনে গিয়েছিলাম৷ ওই সৃজিতদের দোকানটা তো সেদিন থেকেই বন্ধ আছে৷ উনি হসপিটালে যে অ্যাড্রেস দিয়েছিলেন, সেটা ফেক৷ স্কুলের সামনেই ওদের দোকান আর সঙ্গে দুটো ঘরের বাড়ি৷ কিন্তু ছেলেটাও স্কুলে যাচ্ছে না৷ ওদের বাড়িতে তালা ঝুলছে৷ পাখি মনে হচ্ছে, পালিয়েছে ম্যাডাম৷ আর খোঁজ যা পেলাম, তাতে সৃজিতের বাবা চলে যাবার পরে ওরা খেতে পেত না৷ ওর মামাবাড়ির অবস্থাও খুব খারাপ৷ মেয়েকে নিয়ে গিয়ে রাখতেও পারেনি৷ সৃজিতের বাবার বাড়ির সামনের বারান্দায় এই দোকানটা খুলেছিল ওর মা৷ কোনোমতে চলছিল৷ মাস পাঁচেক রমরমা হয়েছে৷ ছেলে স্কুলে চলে গেলে দোকানে একটা ছেলেকে বসিয়ে মহিলা সেজেগুজে কোথায় যেন যেত৷ একটা সাদা ইনোভা এসে দাঁড়াত বাড়ির সামনে৷ সন্ধের আগেই নাকি বাড়িতে ফিরিয়ে দিয়ে যেতো ওই গাড়িটাই৷
লগ্নজিতা বলল, ‘সপ্তাহে কদিন যেত এরকম?’
ইউসুফ বলল, ‘পাড়ার লোকজন বলছে, কখনো সপ্তাহে একদিন, কখনো মাসে দু-দিন যেত৷ লোকজন জিজ্ঞাসা করলে বলত, ব্যবসার কাজে যাই৷ দোকানটাকে বাড়াতে হবে— এ কথা নাকি প্রায় বলত৷ একটা ফোন নম্বর পেয়েছিলাম, ম্যাডাম ওই মহিলার৷ সেটাও সুইচড অফ৷ আপনাকে পাঠাচ্ছি, দেখুন যদি ট্র্যাক করতে পারেন৷ ওহ, জয়ন্ত প্রামাণিকের ওই ফোনে তিনটি কল এসেছিল সেদিন৷ তার একটা উৎপলের, একটা সুমনের স্ত্রী-র, আরেকটা কোনো এক মল্লিকা দস্তিদার নামের মহিলার৷’
লগ্নজিতা উত্তেজিত হয়ে বলল, ওই মহিলার ফোন নম্বর দাও৷’
ইউসুফের সঙ্গে কথা শেষ করে থানায় ঢুকতেই দেখল, উকিল নিয়ে বসে আছেন জলধরবাবু৷
ওকে দেখেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বললেন, এটা রাম রাজত্ব নয়, মামা বাড়ি নাকি ? যাকে যখন পারছেন অ্যারেস্ট করে নিয়ে আসছেন? মগের মুলুক নাকি?
লগ্নজিতা দেখল, সুশোভন খাতায় কী সব নোট করছিল৷ সেদিকে তাকিয়েই ও বলল, ‘সুশোভন, তুমি যেন কার শিষ্য? মেসির তা-ই না? আর্জেন্টিনার জার্সি পরে ঘুরে বেড়াও সুযোগ পেলেই৷ তো মেসির অধ্যবসায়টা তো ধার করতে পারো একটু৷ দেখলে তো সোনার বুট নিয়ে ভদ্রলোক শান্তি পাচ্ছিলেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত কাপটা না ঘরে নিয়ে যেতে পারছিলেন ততক্ষণ লেগে ছিলেন৷ সক্রেটিসের গল্প জানো? উনিও মারাত্মক ঠান্ডা মাথার লোক ছিলেন৷ শোনা যায়, ওঁর স্ত্রী নাকি বড়োই কলহপ্রিয় ছিলেন৷ জ্যানথিপি যখন রেগে গিয়ে চিৎকার করতেন তখনও সক্রেটিস ঠান্ডা মাথায় বই পড়তেন৷ তো সুশোভন, তাঁর শিষ্যরা এত বদরাগী হলে কি চলে?
লগ্নজিতার চিবিয়ে চিবিয়ে বলা কথাতে আরও রেগে গেলেন জলধরবাবু৷ প্রায় চিৎকার করে বললেন, ‘রসিকতা হচ্ছে বুঝি? আমি জানতে চাই, আমার ভাইপোকে আমাদের না জানিয়ে কেন এভাবে আটকে রাখা হয়েছে?’
‘জয়ন্ত প্রামাণিককে যে লরিটা ধাক্কা দিয়েছিল, সেটা আপনার গুণধর ভাইপোর৷ ওইদিন সকালে জয়ন্ত প্রামাণিককে কল করেছিল আপনার ভাইপো৷ মার্ডার হওয়ার একদিন আগেই উৎপলের সঙ্গে ঝগড়াও হয়েছিল জয়ন্তর৷ এরপরেও যদি না তুলি তাহলে সাধারণ পাবলিক আমায় জুতোর মালা দিয়ে বরণ করে নেবে, মশাই৷ উৎপলকে বলুন, সব স্বীকার করে আমাদের হেল্প করলে বেলের ব্যবস্থা করব৷ না হলে এমন রিপোর্ট দিয়ে কোর্টে প্রোডিউস করব, যাতে নন-বেলেবল অফেন্স প্রমাণ হয়৷
জলধরবাবুর গলার তেজ একটু কমল৷ উকিলের সঙ্গে কিছু একটা পরামর্শ করে বললেন, ‘আমরা একবার উৎপলের সঙ্গে কথা বলতে চাই৷’
সুশোভন একজন কনস্টেবলকে ইশারা করতেই সে দুজনকে নিয়ে গেল উৎপলের কাছে৷ লগ্নজিতা বলল, ‘বুঝলে সুশোভন জলধরবাবু কিন্তু বেশ ছবিপ্রেমী৷ প্রায়ই ফোটো এগজিবিশনে যান৷ ‘বিশেষ করে সুবর্ণা গোস্বামীর ছবি দেখতে৷ ভাইপো আর জেঠু দুজনেই ঋতিকার জন্য ফাঁদ পেতেছে কি না জানতে হবে৷ নাকি জলধরবাবু না জেনেই হবু বেয়ানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করছেন, কে জানে! তবে শিক্ষক হবার কোনো যোগ্যতা ওঁর নেই৷’
সুশোভন বলল, আপনি ঢোকার আগে মেজোবাবুকে ঘুস খাওয়ানোর চেষ্টা করছিল৷ আমাদের নীলাভদা তো হাসতে হাসতে হাত বাড়াতেই যাচ্ছিল, তারপর বলল, অ্যারেস্ট কে করেছে? জলধরবাবু রাগত স্বরে বললেন, ওই যে আপনাদের অফিসার লগ্নজিতা ভট্টাচার্য৷ মেজোবাবু এমনভাবে তাকাল বিরাট কোহেলির হেলমেটে বল লাগলেও ওইভাবে তাকায় না৷ তারপর লাফিয়ে উঠে বলল, মজা পেয়েছেন অ্যাঁ? আইনকে টাকা দিয়ে কিনতে এসেছেন৷ যান, পাশের ঘর বসুন৷ ম্যাডাম এলে কথা বলবেন৷’
লগ্নজিতা হেসে বলল, ‘তোমাদের মেজোবাবুর বাঁ হাতের ইনকামটা এবারে বন্ধ করতে হবে, বুঝলে সুশোভন৷ না হলে ট্রান্সফার করে দেব এমন জায়গায়, যেখানে ঘুস হিসাবে লোকজন সাপের মাংস নিয়ে আসবে৷’
জলধরবাবু ভাইপোর সঙ্গে দেখা করে এসে বললেন, ‘ম্যাডাম ও যেটা সত্যি সেটা বলতে রাজি৷ তবে ম্যাডাম, জয়ন্তকে খুন ও করেনি৷’
লগ্নজিতা বলল, তাহলে তপনকে কে খুন করল আপনি? কেন তপন উৎপল আর জয়ন্তর হূদ্যতাটা জানত বলে সরিয়ে দিলেন?
জলধরবাবুর অল্পবয়েসি উকিলটা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, লগ্নজিতা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘আরে আপনি থামুন তো, স্যারের ছাত্র ছিলেন তাই কৃতজ্ঞতাবশে চলে এসেছেন তো বিনা পয়সায়? সব শুনে তারপর মতামত দেবেন৷ এমনিতেও ফি পাবেন না, লাফালাফি করলেও ফি জুটবে না, সুতরাং চুপ করে শুনুন৷ বলুন জলধরবাবু, আপনার সিকিউরিটি চড়া ডোজের ড্রাগস নিত আপনি জানতেন না? আপনার স্কুলের সামনের দোকানে মাদক বিক্রি হত, সেটাও জানতেন না৷ আপনার স্কুলের স্টুডেন্টরা মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছিল, সেটাও আপনার অজ্ঞাত ছিল, আপনি জানতেন কি? শুধু মিডডে মিলের হিসেব নিতেন? দেখুন, আপনার স্কুলের সিকিউরিটি খুন হয়েছে, আপনার স্কুলের স্টুডেন্ট ধরা পড়েছে, এরপরেও আপনি থানায় বসে গলাবাজি করেন কোন সাহসে?
জলধরবাবু বললেন, ‘কী মুশকিল, আমি একটা স্কুলের প্রধানশিক্ষক৷ স্কুলের স্টুডেন্টরা কী চকোলেট খাচ্ছে, সিকিউরিটি রাতে স্কুল বন্ধ হবার পরে কী করছে, সেগুলো খোঁজ নেওয়া কি আমার কাজ? আমার স্কুলের মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট দেখলেই বুঝবেন, পড়াশোনার দিকে আমি নজর দিই৷ তাছাড়া সব ছাত্রর হেলথের দিকেও আমার নজর থাকে, ম্যাডাম৷ তা-ই বলে কে কোন দোকান থেকে কোন চকোলেট খাবে সেটা দেখার দায় তো আমার নয়, ম্যাডাম৷
লগ্নজিতা বলল, ‘দেখুন, আপনার গুরু সক্রেটিস গ্রিসের গণতন্ত্রের বিরোধী ছিলেন, আর আপনি সত্যের বিরোধী৷ তখন থেকে বকে চলেছেন, অথচ একটাও সত্যি বললেন না৷ তপন মহান্তি থানা থেকে বেরোনোর পরেই তাকে মিডিয়ার সামনে বসিয়ে থানায় তাকে টর্চার করা হয়েছে এমন বিদঘুটে বুদ্ধিটা যে আপনারই দেওয়া, সেটা আমরা জানি৷ শুনুন জলধরবাবু, পারলে সত্যি বলুন, না হলে এখন আপনার ভাইপো আছে জেলে, পরে আপনিও ঢুকবেন৷ ওসব প্রধান শিক্ষক বলে সেন্টু দিতে আসবেন না৷ আমিও আমার প্রধানশিক্ষককে দেখেছি, যাঁর ধ্যানজ্ঞান ছিল ছাত্রছাত্রীরা৷ যাঁর স্যালারি অ্যাকাউন্ট ফাঁকা থাকলেও কোনো স্টুডেন্ট খালি পেটে আছে জানলে ধার করেও তাকে খাওয়াতেন৷ তাই ওইসব শিক্ষকের সঙ্গে নিজের তুলনা করে পদটার অসম্মান করবেন না৷ আপনার অ্যাকাউন্ট চেক করা হয়ে গেছে৷ স্যালারি তো মন্দ পান না৷ লাখখানেক টাকা স্যালারি পাওয়ার পরেও প্রতিমাসে আপনার অ্যাকাউন্টে আশি থেকে নব্বই হাজার ঢোকে কোথা থেকে? এই এক্সট্রা টাকার সোর্সটা কী, জলধরবাবু? আপনার সেভিংস, ফিক্স ডিপোজিট এসব আলাদা৷ কোনো সেভিংস অ্যাকাউন্ট থেকে এই আশি ঢোকে না৷ আপনি ব্যাঙ্কে গিয়ে ক্যাশ জমা দিয়ে আসেন৷ কোথায় পান এই ক্যাশ? তাহলে তো বলতে হয়, মিডডে মিল থেকে সরান?’
জলধরবাবু গর্জে উঠলেন, কেউ বলতে পারবে না আমি স্কুলের টাকা কোথাও সরাই৷
লগ্নজিতা বলল, ‘তাহলে ওই ক্যাশ প্রতিমাসে কোথায় পেতেন? ট্যাক্স দিতেন ওটার?’
সুশোভন বলল, ‘ম্যাডাম, আমাকে এখন একবার বেরোতে হবে৷ রুদ্রজ্যোতি স্যার ডেকেছেন৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘এগুলোর উত্তর খুঁজতে খুব তাড়াতাড়ি আপনার বাড়ি যাব৷ স্কুলে তো তালা ঝুলিয়েই দিলেন, এবারে বাড়িতেও তালা ঝুলবে৷’
জলধরবাবু কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, ‘বিশ্বাস করুন, আমি তপনকে খুন করিনি৷ জয়ন্তকেও আমি খুন করিনি৷ স্কুল বন্ধ হোক আমি চাইনি৷ কেউ চক্রান্ত করে ফাঁসাতে চাইছে আমায়৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘সঠিক প্রমাণগুলো জোগাড় করে আপনার বাড়িতে আসব৷ এখন আপনি এখানেই থাকবেন নাকি উকিল ছাত্রকে আরেকটু মিথ্যে বলার ট্রেনিং দেবেন, সেটা আপনি ঠিক করুন৷ চলো সুশোভন, আমিও যাই, রুদ্র স্যারের সঙ্গে একটু গল্প করে আসি৷’