ফরজানার ঘুংরু
১৩ জানুয়ারি, সকাল ৮-১০
লখনৌ শহরের বাতাসে ইতিহাসের কোড়ক ভাসে। এই শহরে একবার প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিলে সংস্কৃতি তার দলিলদস্তাবেজ সমেত হুড়মুড়িয়ে ভেতরে সেঁধিয়ে যায়। ঐতিহ্য আর আভিজাত্যের বুদবুদ ভেসে বেড়ায়। যা শুনেছিলাম, ভুল নয়। লখনৌতে পা দেওয়া ইস্তক হৃদয় দিয়ে অনুভব করছি।
আমি সকিনা আখতার। ভোপালে বাড়ি। জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটিতে মুঘল মিউজিকাল পিরিয়ড নিয়ে রিসার্চ করছি। ভারতীয় সংস্কৃতির রন্ধ্রে বইছে ধ্রুপদ, ধাম্রা, ঠুংরি, গজল, তারানা, সাদরা। এই স্রোতের উৎসমুখ খুঁজে বের করা কঠিন। পাওয়া যেতে পারে এর বিস্তার, প্রভাব, গভীরতা। আমি তারই সুলুকসন্ধানে বেরিয়েছি। আমার রিসার্চের ফোকাস হল লখনৌয়ের বাইজিরা। আঠারো শতকের শেষ দিকে অওধের রাজধানী ফৈয়জাবাদ থেকে সরানো হয় লখনৌতে। এই শহরের তওয়ায়েফ সাম্রাজ্যের রমরমা শুরু তখন থেকেই। অওধের নবাবরা সঙ্গীতের তো বটেই শিল্পের ও শিল্পীর সমঝদার ছিলেন। কদর বুঝতেন। দিল্লির অনেক নামী গাইয়ে, বাজিয়ে, কবি, শিল্পীরা লখনৌতে আসতে শুরু করেন। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মোড় ঘোরা সময় ওটা। রিসার্চ পেপারে ওই ধারাটাকে তুলে ধরতেই আমার লখনৌ আসা।
একটু আগে আমার ফ্লাইট ল্যান্ড করেছে। ট্যাক্সি করে গেস্টহাউসে যাচ্ছি। শহরটার ওপর চোখ বোলাতে বোলাতে হিজিবিজি কিছু লিখে রাখছি ডায়েরিতে। এই পর্বে সাতদিন থাকব। বড্ড কম সময়। এর মধ্যে যতটা সম্ভব লখনৌকে শুষে নিতে চাই। বর্ণ, শব্দ, গন্ধের সমস্ত প্রকোষ্ঠগুলো খুলে রেখেছি। হৃদয়টাও মেলে ধরতে হবে। একমাত্র মনের অনুভূতিই সমস্ত বন্ধ দরজা কিংবা হারিয়ে যাওয়া দরজাগুলো খুলে দিতে পারে।
১৪ জানুয়ারি, রাত ৯-৩০
কাজে একবার নেমে পড়লে আর কোনও হুঁশ থাকে না আমার। কাল থেকে চব্বিশ ঘণ্টা কেটে গেছে। পুরো শহরটা দৌড়ে বেড়িয়েছি। বলা উচিত, লখনৌ আমাকে পুরোপুরি গিলে নিয়েছে। বাইজিদের নিয়ে এই শহরে এখনও বেঁচেবর্তে রয়েছে অঢেল সম্মান। বিশ্বাসে, গল্পে ভুরিভুরি চরিত্র। কোনটা নেব, কোনটায় গুরুত্ব দেব, বুঝে উঠতে পারছি না। মনে হচ্ছে একটা পুরো জন্ম কম পড়ে যাবে এই রিসার্চ করার জন্য।
চকবাজার, কাইজারবাগে একসময় নামকরা তাবড় বাইজিদের কোঠা ছিল। যদিও সারা শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল এরা। অভিজাত ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোকজন আসতেন গান শুনতে, নাচ দেখতে। নবাবজাদাদের বাইজি-প্রেমে পড়ার আকছাড় গল্প লোকগাথা হয়ে রয়েছে। সে সব জীবনের অনুষঙ্গ। থাকবেই। আসল হল সংস্কৃতির ধারাটা। সেই নির্নিমেষ মোহ, অমোঘ টান ঘূর্ণাবর্তের মতো লখনৌয়ের এই আধুনিক সমাজের অন্তরে প্রবলভাবে রয়েছে। শরদ, সেতার, তবলা বোলের সঙ্গে ঘুংরুর ঝঙ্কার, অসামান্য গলার উত্তাপ, সবই টের পাচ্ছি। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের মতো আমার মনের গভীরে বাজছে। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সঙ্গে কত্থকের অপূর্ব পেশকশ ভারতীয় সংস্কৃতির আশ্চর্য দিগদর্শন হয়ে রয়েছে। আফসোস হচ্ছে, কেন যে ওইসময় জন্মালাম না! চক্ষু-কর্ণ সার্থক করতে পারতাম। কাল সকালে আবার দৌড়ব সেইসব জায়গায়, যেখানে ইতিহাস এখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এই শহর আমার মধ্যে একটা তুমুল আলোড়ন তৈরি করেছে।
১৫ জানুয়ারি, দুপুর ২টো
কপাল! সবই কপাল। না হলে মুন্নিবাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়!
আশিয়ানার ঘুপচি ঘরটার খবর দিয়েছিলেন সাহিল হুসেন। লখনৌ ইউনিভার্সিটির ফিজিক্সের প্রফেসর। কিন্তু এই শহরের ইতিহাস ওঁর নখদর্পণে। জেএনইউ-এর একটা কানেকশন থেকে সাহিলসাহেবের নাম্বারটা পেয়েছিলাম। উনি আমার রিসার্চের বিষয়টা শুনে কয়েকটা লিড দিয়েছেন। যাঁর মধ্যে একটা মুন্নিবাই। তবে সাহিলসাহেব নিশ্চিত ছিলেন না, উনি আদৌ বেঁচে আছেন কিনা। বছর দশেক আগে নাকি একবার মুন্নিবাইয়ের সঙ্গে ওঁর দেখা হয়েছিল। তার পর আর খোঁজ রাখেননি। আমি কপাল ঠুঁকে বেরিয়েছিলাম। আশিয়ানার শাহি রোডের এক ঘিঞ্জি বস্তিতে বিস্তর খোঁড়াখুড়ির পর মুন্নিবাইয়ের দেখা পেলাম।
ভীষণ রোগা চেহারার কেউ পাঞ্জাবি পরলে যেমন লাগে, মুন্নিবাইকে তেমন দেখতে। ঢলঢলে হয়ে গেছে গায়ের চামড়া। যেন হ্যাঙ্গারে ঝুলছে পুরো শরীরটা! নব্বই পেরিয়ে যাওয়ার পর বেঁচে থাকাটা যে বিলাসিতা, মুন্নিবাইকে দেখে বুঝতে পেরেছি। একসময় মঞ্জিল ছিল সারা লখনৌয়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় কোঠা। মঞ্জিলের খ্যাতি দেশভর ছড়িয়ে দিয়েছিলেন নর্তকী-গায়িকা ফরজানাবাই। সেসময় তিন ধরনের বাইজি ছিল লখনৌতে। কাঞ্চনি, চুনাওয়ালি ও নগরন্ত। উঁচু দরের বাইজিদের কাঞ্চনি বলা হত। গান আর নাচ ছিল যাদের একমাত্র পেশা। যথেষ্ট শিক্ষিত হতেন ওঁরা। অনেকে তো কবিতা, গানও লিখতেন। ফরজানা ছিলেন তেমন বাইজি। যেমন সুন্দর নাচতেন, তেমনই মিঠে গলা। ওঁর ঠুংরি, গজল শুনতে নাকি লখনৌ তো বটেই, দিল্লির আমির-ওমরাওরাও নাকি হামলে পড়ত। ফরজানার মেয়ে বেগম আজিনও গায়িকা ছিলেন। তবে মায়ের মতো মাধুর্য্য মেয়ের গলায় ছিল না। তবে, নাচতেন ভালো। ফরজানা মারা যাওয়ার পর মেহ্ফিল বসত ঠিকই, কিন্তু সমঝদারদের ভিড় কমতে শুরু করেছিল। আজিনের খাস খিদমতগার ছিলেন মুন্নিবাই। পাঁচবছর বয়সে পা দিয়েছিলেন মঞ্জিলের কোঠায়। তিনি চোখের সামনে নিভে যেতে দেখেছিলেন মঞ্জিলের সমস্ত ঝলমলে প্রদীপ। তবু শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন আজিনের সঙ্গে।
মুন্নিবাই এখন স্মৃতিহারা এক বৃদ্ধা। অতীত আর বর্তমানের উল জড়িয়ে ফেলেছেন। সকাল থেকে ঘণ্টা তিনেক ছিলাম ওঁর কাছে। অনেক ভুল বকলেন। খড়ের গাদায় সূচ খোঁজার মতো আমি উল্টেপাল্টে দেখলাম সেসব। কাজে লাগার মতো তেমন কিছু দিতে পারলেন না। পুরোনো ক্যাসেটের মতো জড়িয়ে ফেলছেন সমস্ত ঘটনা। আমি নিরাশ হইনি। এমন তো হবেই। তার মধ্যেও নিজের অজান্তে যদি কিছু মণিমুক্তো ছড়িয়ে দেন। কুঁজোবুড়িরও বোধহয় আমাকে ভালোলেগে গেছিল। আমি দু’হাজার টাকার একটা নোট দিতে চেয়েছিলাম। নিলেন না।
ঘষা কাচের মতো কাঁপা গলায় শায়েরি করে মুন্নিবাই বললেন, ‘মেহমান হুঁ চন্দ দিনোঁ কা। জিন্দেগি সে ক্যায়া মাঙ্গনা। ছোড় জায়েঙ্গে সারে গম্, ইয়াদোঁ মে সামহাল্কে রখ্না।’
বস্তির একটাই ঘরে মুন্নিবাইয়ের কোনও রকমে টিকে থাকা। ঘরের অর্ধেকটা জুড়ে চৌকি পাতা। তেলচিটে দেওয়াল, নোংরা বিছানাই হল মুন্নিবাইয়ের সংসার। কবিতার ঢঙে বলা ওঁর ক’টা কথা শুনে আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল। বুড়ি একটা জলচৌকিতে মুখোমুখি বসেছিল। আমার ভিজে চোখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। শীর্ণ হাত বাড়িয়ে চৌকির তলা থেকে বেতের ঝাঁপি বের করে আনলেন। দেখলাম, মখমলি কাপড়ের পুটুলিটা। উনি সেটা হাতে দিয়ে বললেন, ‘কে জানে কালকের সকাল দেখতে পাব কিনা। তুমি এটা রাখো।’
এই প্রথম মুন্নিবাইয়ের ঘোলাটে চোখে স্বচ্ছতা দেখলাম। আমি ইতস্তত করছি দেখে মুন্নিবাই বললেন, ‘ওতে ফরজানার ঘুংরু আছে। যেটা পরে প্রথমবার মেহ্ফিলে নেচেছিলেন বিবিজান। মৃত্যুর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ওটাকে সামলে রেখেছিলেন ওঁর আজিন। মারা যাওয়ার সময় আমার বলেছিলেন, ওটা যেন যত্ন করে রাখি। আমি আর কতদিন। তুমি নিয়ে যাও। না হলে মরেও শান্তি পাব না।’
আমি থমকে গেছিলাম। এটা একটা বিরাট সম্পদ। ইতিহাসের নথি। অ্যান্টিক ভ্যালু কত হবে, কে জানে। এ আমার অবিশ্বাস্য প্রাপ্তি। ফরজানার মতো প্রসিদ্ধ, ইতিহাস বিখ্যাত বাইজির সম্পত্তির ওয়ারিস হতে যাচ্ছি আমি, বিশ্বাসই হচ্ছিল না। কালচে গোলাপী রংয়ের মখমলের পুটুলিটা খুলতেই আতরের গন্ধ ভেসে এল। সোনার জল করা রুপোর ঘুংরু। এখনও কী উজ্জ্বল! যেন এই সদ্য বানানো হয়েছে!
উত্তেজিত গলায় বললাম, ‘সত্যিই এটা রাখব?’
মুন্নিবাই দুলে দুলে হাসছে। ‘বিটিয়া তুমহারে লিয়ে তৌফা হ্যায়, ইস তওয়ায়েফ কা।’
অদ্ভুত আনন্দ হচ্ছিল আমার। ভাষায় ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। মুন্নিবাইয়ের হাতে চুমু খেলাম। ওঁর ঘরে থেকে বেরিয়ে আসার সময় বৃদ্ধা আমাকে আবার কাছে ডাকলেন। তোবড়া গালে হাসি এনে বললেন, ‘বিবিজান আপনি বেটি কো ভি কভি ইয়ে প্যাহেননে নেহি দিয়া। দিল সে লাগাকর রাখতে থে ইয়ে ঘুঙ্গরু। তুম ভি কভি প্যাহেননা নেহি!’
বহু পুরোনো জিনিস। একশো বছরেরও বেশি পুরোনো। সুতোর বাঁধনে মরচে ধরতে পারে। পরতে গেলে হয়তো ছিঁড়ে যাবে। তাই হয়তো সতর্ক করে দিলেন বৃদ্ধা।
১৬ জানুয়ারি, রাত দেড়টা
অদ্ভুত সব ভাবনা আমার মাথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। লোকে পাগল ভাবতে পারে। কিন্তু এটা সত্যিই। রাত অনেক হয়েছে, বুঝতে পারছি। কিন্তু না লিখে উপায় নেই। আজও দিনভর নানা জায়গায় ছুটে বেড়িয়েছি। খুব ক্লান্ত। সাড়ে ন’টা নাগাদ ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম। একটা বড় হলঘর। দক্ষিণমুখী জানলায় মসলিনের পাতলা পর্দা ঝুলছে। ঝিরিঝিরি হাওয়ায় দুলছে সেটা। ঘরের এককোণে তিনজন লোক বসে। শরদ, সেতার, তবলা বাজাচ্ছে। বাদ্যযন্ত্রের মিঠে আওয়াজ ভেসে বেড়াচ্ছে। ঘরের আর এক কোণে চারটে বাচ্চা মেয়ে ঘাগরা-চুড়িদার পরে নাচছে। তাদের সামনে এক মাঝবয়সী মহিলা। বাচ্চাদের কত্থক শেখাচ্ছেন তিনি। বাঁহাতের তালুর ওপর তাল ঠুকছেন ডানহাত দিয়ে।
পর্দা ঠেলে ঘরে ঢুকলেন এক সৌম্যদর্শন ভদ্রলোক। রাজপোশাক ঝলমল করছে তাঁর শরীরে। মহিলা উঠে দাঁড়িয়ে কুর্নিশ করলেন তাঁকে। ভদ্রলোক একপলক দেখলেন বাচ্চাদের। তারপর মহিলার দিকে গম্ভীর গলায় বললেন, ‘নসরিন, ফরজানা কাঁহা হ্যায়? উসে তৈয়ার নেহি কিয়া?’
নসরিন নামের মহিলা বললেন, ‘ওর শরীরটা খারাপ। আজ থাক না। অন্য আর একদিন আসবেন!’
রাজপোশাক পরা ভদ্রলোক হাসলেন। ‘তা বললে চলবে কেমন করে? তাওয়ায়েফদের এত মনমর্জি করলে চলে? যাও-যাও নিয়ে এসো ওকে। নবাবের মেহ্ফিলে নাচতে হবে। তৈরি করে দাও।’
ঘরের কোণে চারটে বাচ্চা মেয়েদের দিকে তাকালেন নাসরিন। তাঁর চোখ ছলছল করছে। নাসরিনের পা থমকে রয়েছে। রাজপোশাক পরা ভদ্রলোকের চোখে যেন আগুন জ্বলছে। মহিলা আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। মিনিট কয়েক পরে একটি বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে ঘরে এলেন। তার চেহারা আলুথালু। একরাশ খোলা চুল পড়ে রয়েছে পিঠে। কেঁদেকেঁদে চোখ লাল। মুখ ফুলে রয়েছে। কিন্তু মেয়েটা ভারি মিষ্টি দেখতে। ফুলের মতো।
মেয়েটিকে দেখেই ওই ভদ্রলোক নির্দেশ দিলেন, ‘আলি, ইসে লেকে চলো!’
পর্দা সরিয়ে ঘরে যে ঢুকল, তাকে দেখে মেয়েটি কেঁদে উঠল। লোকটার দুটো সবল হাত এগিয়ে আসছে তার দিকে। সে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরেছে নাসরিনকে। তিনি নিরুপায় দাঁড়িয়ে। দু’চোখে উপচে পড়া জলে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে নাসরিন কোনওরকমে বললেন, ‘বিটিয়া খুশ রহ্না।’
এই স্বপ্নটা কেন আমি দেখলাম? কিছুতেই বুঝতে পারছি না। স্বপ্নটা দেখার পরই ঘুম ভেঙে গেছে। একটা মেয়েকে কেউ তুলে নিয়ে যাচ্ছে। সে সময় মেয়েদের নিরাপত্তা, ইচ্ছা-অনিচ্ছা বলে কিছু ছিল না। ওই মেয়েটা কে? ফরজানা নাম বলছিল না? ও-ই কি সেই ফরজানা, যার ঘুংরু আমি নিয়ে এসেছি? অনেক সময় অতীতের কোনও ঘটনা, কোনও চরিত্র এতটা প্রভাব ফেলে যে, বাস্তবের চরিত্র অতীতে আটকে যায়। আমার ক্ষেত্রেও কি তাই হয়েছে?
১৭ জানুয়ারি, রাত আড়াইটে
আমি জানি না, কী ঘটছে আমার সঙ্গে। একই স্বপ্ন আজও দেখলাম। সেই একই ঘটনা। এক স্বপ্ন বারবার আসে, আমি জানতাম না। দিল্লি ফিরে সায়কিয়াট্রিস্ট দেখাতে হবে। সে না হয় দেখাব, কিন্তু আজকের ঘটনাটা আমাকে মুশকিলে ফেলছে। তোলপাড় করছে।
ঘুমটা ভাঙার পর ফরজানার ঘুংরুটা বের করেছি। ওটা ভিজে ভিজে। যেন কেউ জল ফেলেছে ওটায়! তা তো হওয়ার কথা নয়! ঘুংরুটা হাতে নেওয়ার পর থেকে মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কেন জানি না বারবার মনে হচ্ছে, এই ঘুংরুটাতে কারও চোখের জলের ছিটে লেগেছে। অবান্তর কথা লিখছি হয়তো। কিন্তু এটাই সত্যি। যা মনে হচ্ছে আমার, তাই তুলে ধরার চেষ্টা করছি। ওই কিশোরী ফরজানা, যাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল এক রাজপুরুষ, তার উপচে পড়া বিন্দু বিন্দু চোখের জল কি লেগেছিল এতে? মুন্নিবাই ঘুংরুটা পরতে বারণ করেছেন। বহুদিনের পুরোনো জিনিস। তবু এটা টানছে। একবার পরব। জাস্ট একবার। লোভ সামলাতে পারছি না।
১৭ জানুয়ারি, রাত সাড়ে তিনটে
ঘুংরুটা পুরোনো বলে নয়, আমি একশো শতাংশ নিশ্চিত, অতীতের সঙ্গে এটার কোনও একটা যোগাযোগ আছে। আমি লখনৌয়ের যে গেস্টহাউসে রয়েছি, তার সঙ্গে অতীতের কোনও যোগাযোগ নেই। থাকার কথাও নয়। এটা নতুন তৈরি হওয়া হোটেল। অথচ, ঘুংরুটা পরার পরই এই ঘরটা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিল। চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল সেই ঘরটা। যে ঘরের এক কোণে চারটে মেয়ে নাচছে। আর এককোণে তবলা, শরদ, সেতার বাজাচ্ছে তিনটে লোক। সেই ঘরটা, যেখানে নাচ শেখাচ্ছেন নাসরিন নামের এক মহিলা। সেই ঘরটা, যেখানে এসে দাঁড়িয়েছেন রাজপোশাক পরা এক ভদ্রলোক। আর আলুথালু চেহারার একটা মেয়ে। এ-ই তা হলে ফরজানা!
কারও স্বপ্ন কি সত্যি হয়? হয়-হয়! অন্যরা কী বলবে, জানি না। আমার অন্তত তাই হয়েছে। স্বপ্নটা সত্যি হল বলেই তো আলিকে দেখতে পেলাম। দরজাটার ঠিক পাশে দাঁড়িয়েছিলাম আমি। আমার চোখের সামনে দিয়ে ঘরে ঢুকল আলি। লম্বা-দোহারা চেহারা। একজোড়া নিষ্ঠুর চোখ, পেশিবহুল শক্ত, সবল একজোড়া হাত। আলিকে হিংস্র পশুর মতো দেখতে। নির্মম কঠিন মুখ। সে এগিয়ে আসছে ফরজানার দিকে। কিশোরী ফরজানা কাঁদছে। আহা দশ-এগারো বছর বয়স হবে মেয়েটার। কতটুকু আর পৃথিবী দেখেছে! সারা দুনিয়াতে রোজ কত মেয়ের সঙ্গে যে এমন হচ্ছে, কে জানে! ইচ্ছের বিরুদ্ধে একটা কিশোরীর ওপর পাশবিক অত্যাচার চালানো আমি মেনে নেব না! একটা মেয়ে হয়ে মেনে নিতে পারব না। কোনও ভাবেই পারব না। যাই হোক না কেন, ফরজানাকে যেতে দেব না। আমিও একটা মেয়ে। কোনও মেয়ের সম্মান নিয়ে কেউ খেললে ভেতরে আগুন জ্বলতে শুরু করে। আমার কষ্ট হয়। রাগ হয়। যেভাবেই হোক বাঁচাতে হবে মেয়েটাকে।
আলি ঘরে ঢুকতেই হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে আমি দৌড়তে শুরু করলাম ফরজানার দিকে। আমার পায়ে ঘুংরুটা বাঁধা ছিল। দৌড়ের সময় সারা ঘরে, আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল ছম-ছম-ছমছম-ছম শব্দ। ছুটে গিয়ে দু’হাত দিয়ে আড়াল করলাম ফরজানাকে। বেচারি এত ভয় পেয়ে গেছে যে, আমার পিছনে লুকিয়ে কাঁপতে থাকল। আলি প্রথমে একটু থমকে গিয়েছিল। তার পর একগাল হিংস্র হেসে এগিয়ে আসতে শুরু করল আমাদের দিকে। আমি পিছিয়ে যেতে লাগলাম। আলি সবল পুরুষ। তার সঙ্গে পেরে উঠলাম না। বিশাল দুটো হাত নিয়ে সে আমাকে ঘিরে ধরল। ওর সাঁড়াশির মতো আঙু্লগুলো গলায় বসে যাচ্ছিল। তখনই রাজপোশাক পরা লোকটা বলল, ‘আলি ঘুংরু উতাড় লো!’
ঘুংরু? কার? আমার পায়ে যেটা বাঁধা? ওটা এখন আমার। মুন্নিবাই আমাকে দিয়েছেন। যার-তার হাতে আমি কোনওভাবেই দেব না। কেউ কেড়ে নিতে পারবে না আমার কাছে থেকে।
গলা ছেড়ে আমার পা দুটো চেপে ধরল আলি। আমার গায়ে তত জোর নেই। কিন্তু এক অদ্ভুত শক্তি ভর করল আমার ওপর। দু’হাত দিয়ে এলোপাথারি ঘুষি মারতে লাগলাম আলিকে। আচমকা আক্রমণে ও থমকে গেছে। সেই সুযোগে নিজেকে ছাড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে টানা লম্বা বারান্দা ধরে ছুটতে শুরু করলাম। চারমহলা দোতলা বাড়ি। দোতলার বারান্দা ধরে দৌড়চ্ছি। নিশ্চয় নিচে নামার রাস্তা আছে। সিঁড়ি থাকবে নিশ্চয়। ফরজানা কোথায়? দেখলাম, আমার কিছুটা আগে দোতলার সিঁড়ির মুখ দাঁড়িয়ে হাতছানি দিচ্ছে। পিছনে ফিরে দেখলাম, আলি এখনও আসেনি। বেমক্কা আক্রমণে ঝটকা কাটিয়ে উঠতে ওর সময় লাগবে না। তার আগেই পালাতে হবে আমাদের দু’জনকে। দোতলার সিঁড়ির মুখে দাঁড়ানো ফরজানার দিকে প্রাণপণ দৌড়তে লাগলাম। আর তখনই পায়ে-পায়ে লেগে আছাড় খেলাম। মাথাটা সজোরে ঠুকে গেল মেঝেতে। আলিকে দেখতে পাচ্ছি না। এখনই এসে পড়বে হয়তো। তার আসার আগে মেঝেতে উঠে বসে দু’হাত দিয়ে ঘুংরু দুটো খুলতে শুরু করলাম। ঘুংরু পরে দৌড়নোর জন্য আওয়াজ হচ্ছে। এই ছমছম শব্দই আমার উপস্থিতি জানিয়ে দেবে ওকে। তা ছাড়া, জিনিস আমার। কাউকে দেব না। কেউ নিতে পারবে না আমার কাছ থেকে। ঘুংরু জোড়াটা খুলে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। ভয়ে-আতঙ্কে আমি কেঁদে ফেলেছি। ঘুংরু দুটো ভিজে যাচ্ছে। আশ্চর্য, ঘুংরুর জোড়া দুটো খুলতেই ওই বারান্দাটা, বাড়ি, পুরো দৃশ্যটা উবে গেল চোখের সামনে থেকে। নিজেকে গেস্টহাউসের ঘরেই আবিষ্কার করলাম!
বুঝতে পারছিলাম না, কী চলছে। আমি কি স্বপ্ন দেখছিলাম? তাই যদি হবে, আমার কপাল ফেটে গিয়ে রক্ত পড়ছে কেন? স্বপ্নে তো কেউ চোট পায় না!
আমি ভয় পেয়েছি প্রচণ্ড। ডায়েরি লিখতে লিখতে হাত কেঁপে যাচ্ছে। তবু লিখছি। না হলে এই রাতের ঘটনাটা ভুলে যেতে পারি। পরে আর আমার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রতিটা অনুষঙ্গ তুলে ধরা যাবে না। আমার সঙ্গে একটু আগে যা ঘটল, সবই কি সত্যি? নাকি আমার ভ্রম। আমি কি স্বপ্ন দেখতে দেখতে উত্তেজনার বশে খাট থেকে পড়ে মাথায় চোট পেয়েছি?
প্রশ্নের মিছিলে দাঁড়িয়ে আছি আমি। তবু ভয়টা আমাকে গিলে খেতে আসছে। এই ভয়টা কমানোর জন্যই লেখার মধ্যে ডুবে যেতে চাইছি। মন থেকে ধীরে ধীরে হয়তো স্বপ্নের ঘোরটা কেটে যাবে। কিছুটা স্বাভাবিক হতে পারব। এছাড়া আর উপায় কী? এখনও ভোর হতে বিস্তর বাকি। এই রাতে কাউকে ডাকলেও পাব না।
রুমের দরজায় টকটক আওয়াজ পেলাম। কেউ নক করছে নাকি? রাত সাড়ে তিনটে বাজছে। এত রাতে কে? আমি কি চেঁচাব? ইন্টারকম একটা দেখেছিলাম না বেডসাইড টেবলে। সেটা কোথায়? আমার মোবাইলটা ব্যাগে আছে। ব্যাগটা কোথায় রেখেছি? ঘরে আলো জ্বলছে। না-না, এ আমার মনে ভুল। কেউ নেই। কে আসবে এখন? আমি এখন লিখব। লিখে যাব। মনটা ঘোরাতে হবে। কিন্তু পারছি না। দরজায় আবার টকটক আওয়াজ।
স্পষ্ট শুনলাম, কেউ একজন বলছে, ‘দরওয়াজা খোলিয়ে, মোহ্তরমা। ঘুংরু লেনে কে লিয়ে আয়ে হ্যায়!’
১৮ জানুয়ারি, দুপুর ১টা, ব্লু হেভেন গেস্টহাউস
সরফরাজ খান দোতলার ১৮ নম্বর রুমে ঢুকলেন। দরজাটা ভাঙতে হয়েছে। কিন্তু ঘরে কেউ নেই! আশ্চর্য ব্যাপার। তা হলে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করল কে? হোটেলের ম্যানেজার বলেছে, দরজা নিজে নিজেই লক হয়ে যায় ঠিকই, কিন্তু ভেতর থেকে পার্মানেন্ট লক কাউকে করতে হয়। ঘরে পার্মানেন্ট লকই তো করা ছিল!
সরফরাজ চোখ বোলাচ্ছিলেন রুমে। ভাঁজহীন বিছানার চাদর, পায়ের দিকে পরিপাটি করে রাখা কম্বল। টি-টেবল, ড্রেসিং টেবল— সমস্ত গোছানো। গেস্টহাউসের রিসেপশনিস্ট বলছে, কাল রাতে সকিনা আখতার নামের মেয়েটা ফিরেছিল। তাকে কেউ বেরিয়ে যেতে দেখেনি। গেস্টহাউসের করিডর, প্যাসেজে সিসিটিভি লাগানো আছে। বেরোলে সিসিটিভি ফুটেজে পাওয়া যেত। কোথায় গেল তবে মেয়েটা? রুম বা বাথরুমের জানলায় গরাদ লাগানো। কারও পক্ষে ওই গরাদের ফাঁক দিয়ে গলে বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তা ছাড়া সাকিনার লাগেজও পড়ে রয়েছে। সকালে রুম সার্ভিসের লোক ঘর পরিষ্কার করার জন্য নক করেছিল। সাড়া পায়নি। ভেবেছিল ঘুমোচ্ছে, তাই ডিস্টার্ব করেনি। বেলা গড়ানোর পরও যখন কোনও সাড়া আসছিল না। তাই পুলিশকে খবর দেওয়া হয়। কনস্টেবল হিম্মত সিং বেডের তলা থেকে একটা ডায়েরি পেল। সেটা দিল সরফরাজকে। মেয়েটা ডায়েরি লিখত। কিছু ক্লু পাওয়া যেতে পারে।
১৮ জানুয়ারি, দুপুর ২টো
উত্তেজিত হয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন সরফরাজ। গলা তুলে বললেন, ‘হিম্মত সিং!’
সাহেবের ডাক পেয়ে হিম্মত দৌড়ে এল। ‘ইয়েস স্যর?’
‘ঘরটা খুঁজে দেখো তো, কোথাও একজোড়া ঘুংরু পাও কিনা!’