প্রেত-প্রেয়সী – ২.৫

(৫)

সুলতা যখন ফিরে এল, আমি তখন চিত হয়ে শুয়ে খাটের ওপর।

‘বড্ড দেরি হয়ে গেল। রাগ করোনি তো?’

‘না, রাগ করব কেন।’

‘শরীর কীরকম? মাথার যন্ত্রণা কমেছে?’ পাশে বসে মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বললে সুলতা।

উত্তপ্ত মাথাটা যেন জুড়িয়ে গেল শীতল করস্পর্শে।

বললাম, ‘কই আর কমলো। অ্যাসপিরিন খেয়েও কিছু হচ্ছে না।’

অ্যাসপিরিন খেয়ে আকাশপাতাল ভাবলে কি মাথা সারে? একটু ঘুমোবার চেষ্টা করো। আমি বরং একটু ঘুরে আসি।

সচকিত হয়ে শুধোলাম, ‘কোথায়?’

‘স্নো-টা ফুরিয়েছে। আরও দু-একটা জিনিস কেনা দরকার। যাব আর আসব।’

চুপ করে রইলাম। কী জবাব দেব? এইমাত্র যা দেখে এলাম, যা শুনে এলাম, তারপরেও কি সুলতাকে চোখের আড়াল করা উচিত?’

চুলের মধ্যে আঙুল চালাতে চালাতে সুলতা বললে, ‘কিছু বলছ না কেন? যেতে দিতে মন সরছে না বুঝি?’

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, ‘সুলতা, আমাদের পরস্পরের কাছে কে যে বন্দি, আর কে মুক্ত, তা তুমি ভালো করেই জানো। কাজেই তুমি যেতে চাইলে আটকে রাখার ক্ষমতা তো আমার নেই।’

কথাটার অর্থ অনেক। কিন্তু যেন কিছু না বুঝেই সরল চোখে বললে সুলতা, ‘ও-কথা বলছ কেন?’

‘বড় ভয়, সুলতা, বড় ভয়। যদি বুঝতে…’

উঠে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসল সুলতা। বললে, ‘তোমার এই অসুখ শুধু ভয় থেকেই। ভয়টাকে জয় করতে পার না?’

চুপ করে রইলাম। কিছুক্ষণ নিঃশব্দে কেটে গেল। শুধু চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ আর চিরুনি। কাঁটা রাখার আওয়াজ থেকে বুঝলাম প্রসাধন নিয়ে তন্ময় হয়ে রয়েছে সুলতা। বড় নিঃসহায় মনে হল নিজেকে। দুর্গা হোটেলে উমা দেবীর আবির্ভাবের পর থেকেই যেন একটা দুর্ভেদ্য অদৃশ্য প্রাচীর উঠে গেছে আমাদের মধ্যে। আরও অবোধ্য হয়ে উঠেছে সুলতা।

টুল সরানোর শব্দ শুনলাম। তারপরেই পায়ের আওয়াজ এগিয়ে এল। পরক্ষণেই ভূত দেখার মত চমকে উঠলাম আমি।

সামনেই দাঁড়িয়ে কস্তুরী। কাঁধের ওপর বিচিত্র ফ্যাশনের খোঁপা। হালকা লিপস্টিকে উজ্জ্বল ধারালো অধরোষ্ঠ। সারা মুখে ঝকমক করছে এক দুর্বোধ্য হাসি— মোনালিসার হাসি।

বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল আমার। বিস্ফারিত দৃষ্টি মেলে দেখছিলাম সেই নারীমূর্তিকে, দীর্ঘ চার বছর যার স্মৃতি নিয়ে উন্মাদ হতে বসেছি আমি।

‘ভালো লাগছে তোমার?’ অদ্ভুত সুরে শুধোল সুলতা।

প্রত্যুত্তরে গলা দিয়ে খানিকটা ঘড় ঘড় শব্দ বেরোল— কথা ফুটল না।

‘আমাকে এইভাবে সাজাতে তোমার ভালো লাগে— তাই এই খোঁপাই বাঁধলাম। ঠিক হয়নি?’

‘হয়েছে।’ অবরুদ্ধ কণ্ঠে বলি আমি।

‘তাহলে আমি যাচ্ছি।’

ধড়মড়িয়ে উঠে বসি আমি, ‘তুমি… তুমি… ফিরে আসবে তো?’

বিলোল কটাক্ষ হেনে জবাব দিল সুলতা, ‘ছেলেমানুষি কোরো না। ফিরে আসব না তো যাব কোন চুলোয়?’

বন্ধ হয়ে গেল দরজা।

শূন্য ঘরে অভিভূতের মতো বসে রইলাম আমি। সমস্ত মাথাটা লোহার মতো ভারী মনে হচ্ছে। যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে প্রতিটি স্নায়ু— এমনি যন্ত্রণা। কিন্তু এ কী করলাম আমি? এইমাত্র যে রূপসী বিদায় নিয়ে গেল বিচিত্র হেসে— তাকে তো এর আগেও একবার হারিয়েছি নিষ্ঠুর মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে… এ বিদায়ও কি শেষে…? না… আমি যেতে দেব না… যেতে দেব না… কিছুতেই চোখের আড়ালে যেতে দেব না।

মাথার যন্ত্রণা ভুলে গিয়ে বিদ্যুৎবেগে উঠে পড়লাম শয্যা ছেড়ে। তরতরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে রাস্তায় পড়ে দেখেছিলাম ধীর পদক্ষেপে কস্তুরীকে এগিয়ে যেতে।

অলস চরণে অনেকক্ষণ হেঁটেছিল কস্তুরী। একটা মনিহারী দোকানে ও ঢুকেছিল। তারপর আবার শুরু হয়েছিল পথপরিক্রমা। শহরের এদিকে কোনওদিন আসার সুযোগ হয়নি আমার। রাশি রাশি ড্রামের পাহাড়। বাঁশ আর শাল কাঠের আড়ত। মাঝে মাঝে মোষের খাটাল। কোথাও থামল না কস্তুরী। সব কিছু পেরিয়ে এসে দাঁড়াল একটা মস্ত পুকুরের সামনে।

ক্ষিপ্তের মতো পেছন পেছন আসছিলাম আমি। ধাক্কা খেয়ে পথচারিরা সবিস্ময়ে তাকিয়েছে, গালি দিয়েছে, সশব্দে ব্রেক কষে বাপান্ত করেছে মোটর ড্রাইভার— কিন্তু কিছুতেই ভ্রূক্ষেপ করিনি আমি। মাথার যন্ত্রণায়, উদ্বেগে আতঙ্কে মুহ্যমানের মতো ছুটে চলেছিলাম। কোথায় চলেছিলাম, সে খেয়াল ছিল না। পুকুরের সামনে এলে সম্বিত ফিরে পেলাম।

এ যেন সিনেমা দৃশ্যের মতো অতীতের পুনরাবৃত্তি। এমনি করেই তো কস্তুরীর পিছু নিয়ে কখনও তাকে দেখেছি দুধসাগরের তীরে দাঁড়িয়ে থাকতে, কখনও গঙ্গার পাড়ে পায়চারি করতে। দৃশ্য হুবহু এক হলেও উদ্দেশ্য পালটেছে। চার বছর আগে কস্তুরীকে হারানোর ভয়ে তাকে চোখে চোখে রাখার ব্যবস্থা করেছিল মহেন্দ্র কৌশিক। আর চার বছর পরে সে ভয় আমাকেই প্রায় উন্মাদের পর্যায়ে এনে ফেলেছে। আজকের পিছু নেওয়া শুধু আমার জন্যেই— মহেন্দ্রর জন্যে নয়। একই নাটকের বিচিত্র পুনরাবৃত্তি… কিন্তু ও কী?

পুকুর পাড়ে ঘাস জমির ওপর ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে ফেলল কস্তুরী। তারপর একটা কাগজ আর একটা ফাউন্টেন পেন বার করে ঝুঁকে পড়ল কাগজের ওপর। মিনিট পাঁচেক পরে কলম মুড়ে ভাঁজ করে একটা খামের মধ্যে রেখে উঠে দাঁড়াল ও।

গঙ্গার তীরেও এমনিভাবে চিঠি লিখে এসে দাঁড়িয়েছিল কস্তুরী। টুকরো টুকরো কাগজ ছড়িয়ে পড়েছিল ভাগীরথীর জলে… তারপর…

আর ভাবতে পারলাম না। কীরকম যেন হয়ে গেলাম। মরিয়ার মতো ছুটে যেতেই দারুণ চমকে ঘুরে দাঁড়াল সুলতা। চিঠিটা ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পারলাম না। হাত ফসকে গিয়ে হাওয়ার টানে খামটা গিয়ে পড়ল পুকুরের জলে।

হাঁপাতে হাঁপাতে ঘুরে দাঁড়ালাম আমি। চোয়ালের হাড় শক্ত করে শুধোলাম, ‘কী লিখেছিলে চিঠিতে?’

দৃপ্ত ভঙ্গিতে মুখ টিপে দাঁড়িয়ে রইল সুলতা, কোনও জবাব দিল না।

‘আমাকে বিদায় সম্ভাষণ জানাচ্ছিলে তা-ই না?’

‘হ্যাঁ!’

‘কিন্তু কেন? কেন?’

‘আর সহ্য করতে পারছি না আমি। আর বেশিদিন এভাবে থাকলে পাগল হতে হবে আমাকে।’

‘চিঠিটা পোস্ট করবার পর কী করবার মতলব এঁটেছিলে? দু-হাতে ওর কাঁধ ধরে ঝাঁকানি দিয়ে শুধোই আমি।

‘চলে যেতাম… কালকেই যেতাম…’

‘আর আমি?’

জবাব দিল না সুলতা।

আচমকা উত্তেজনার পরেই অবসাদ আসে। আমারও শরীর-মন যেন ভেঙে পড়তে চাইল। ক্লান্ত স্বরে বললাম, ‘চলো, ফেরা যাক।’

কাদা প্যাচপেচে সঙ্কীর্ণ রাস্তা ধরে চললাম আমরা। শক্ত মুঠিতে সুলতার কবজি চেপে ধরেছিলাম আমি— প্রণয়ীর মতো নয়— পুলিশম্যানের মতো। একটা সূক্ষ্ম তৃপ্তি অনুভব করছিলাম মনে মনে। কস্তুরীকে আমি আবার ফিরিয়ে এনেছি মৃত্যুর উপত্যকা থেকে।

‘তুমিই কস্তুরী। তা-ই নয়?’

‘না।’

‘এ পশ্নের জবাব পাওয়ার অধিকার আমার এসেছে। আমি বলছি, তুমিই কস্তুরী, তুমিই জনা।’

‘না।’

‘তবে তুমি কে?’

‘সুলতা মিত্র।’

‘মিথ্যে কথা।’

‘না, মিথ্যে না।’

বাঁশ আর শাল কাঠের আড়তের ফাঁক দিয়ে নীল আকাশের ফালি দেখা যাচ্ছে। ইচ্ছে হল, গলা টিপে ধরি কস্তুরীর… শ্বাসরোধ করে দিয়ে শেষ করে দিই সব কিছুর।

‘তুমিই কস্তুরী। প্রমাণ— দুর্গা হোটেলে গিয়ে খাতায় নাম লিখিয়েছিলে— উমা দেবী।’

‘লিখিয়েছিলাম শুধু তোমার চোখে ধুলো দেওয়ার জন্যে।’

‘চোখে ধুলো দেওয়ার জন্যে? অর্থাৎ যাতে আর তোমাকে কোনওদিন খুঁজে না পাই?’

‘হ্যাঁ… তা-ই। তোমার যখন দৃঢ় বিশ্বাস যে আমিই উমা দেবী, তখন আমি উধাও হলে ওই নামেই খোঁজ নিতে তুমি। তাহলেই খুঁজে পেতে উমা দেবীর নাম… উধাও হয়ে যেতো সুলতা মিত্র… সুলতা মিত্রকে ভুলে গিয়ে যাতে কস্তুরী কৌশিকের স্মৃতি নিয়ে তুমি থাকতে পারো— সেই ব্যবস্থাই করছিলাম আমি।’

‘কস্তুরীর মতো চুল বেঁধেছ কেন?’

‘একই কারণে। শ্লেট থেকে সুলতাকে মুছে ফেলতে চাই। কস্তুরী ছাড়া আর কারও নাম থাকবে না সেখানে।’

‘কিন্তু আমি তোমাকেই রাখতে চাই।’

নিশ্চুপ রইল সুলতা।

‘পালাচ্ছিলে কেন? আমার সঙ্গ কি এতই যন্ত্রণাদায়ক?’

‘সত্যিই তা-ই।’

‘আজেবাজে প্রশ্ন করি বলে?’

‘হ্যাঁ… তা ছাড়া… আরও কারণ আছে।’

‘যদি কথা দিই যে এ নিয়ে আর কোনও প্রশ্ন করব না?’

‘হায়রে! কথা দিয়েও কি রেখেছ কোনওদিন?’

‘শোনো… স্বীকার করো তুমিই কস্তুরী, জীবনে আর এ প্রসঙ্গ নিয়ে কোনও কথা বলব না আমি… নতুন করে অন্য কোথাও গিয়ে ঘর বাঁধব, সুখী হব দু-জনেই।’

‘আমি কস্তুরী নই।’

আবার। আবার সেই অসহ্য একগুঁয়েমি!

‘চুলের ডগা থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত তুমি কস্তুরী… কোনওখানে কোনও তফাত নেই।’

‘হতে পারে। কিন্তু দোহাই তোমার, আমাকে রেহাই দাও… আমার নিজেরও অনেক দুশ্চিন্তা আছে।’

‘কীসের দুশ্চিন্তা?’

‘সব দুশ্চিন্তা কি সবাইকে বলে হালকা হওয়া যায়?’

কাঁদছে সুলতা। শুধু গলাই ধরেনি, চোখও ভিজেছে। রুমাল বার করে সযত্নে চোখ মুছে দিলাম ওর।

হোটেলে যখন পৌঁছোলাম, তখন সন্ধে হয়েছে। আলো-ঝলমল পোর্টিকো পেরিয়ে ডাইনিং রুমে ওমলেটের অর্ডার দিয়ে বসে পড়লাম কোণের টেবিলে।।

সুলত বসল না। বলল, ‘আমার ক্ষিদে নেই… মাথা ধরেছে… প্লিজ।’

টেনে বসালাম পাশের চেয়ারে। মড়ার মতো ফ্যাকাশে মুখ… কস্তুরীর মুখ… মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল অসম্ভব… পরক্ষণেই ভাবলাম ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছি না তো!

আধখানা ওমলেটও শেষ করতে পারল না কস্তুরী। লক্ষ করলাম, খেতে খেতে বেশ কয়েকবার স্বপ্নালু হয়ে উঠেছে ওর দুই চোখ— চার বছর আগে স্বপ্নবিভোর এ দৃষ্টি কতবার কতদিন দেখেছি আমি। পর পর তিনটে হুইস্কি শেষ করে ফেললাম আমি। তখন মুখ নিচু করে আত্মবিভোর হয়ে রইল কস্তুরী।

চতুর্থ পেগটা ঠোঁটের কাছে তুলে বললাম, ‘দেখতে পাচ্ছি, শেষ হতে চলেছে তোমার অন্তর্দ্বন্দ্ব… কস্তুরী, এবার কথা বলো।’

জ্যা-মুক্ত ধনুকের মতো তক্ষুনি উঠে দাঁড়াল কস্তুরী।

‘আসছি আমি,’ বলে চুমুক দিলাম গেলাসে। এক নিঃশ্বাসে সবটা শেষ করে দিয়ে সিঁড়ির গোড়াতেই ধরে ফেললাম ওকে। সিঁড়ির ধাপে পা দিয়ে বাঁ হাত দিয়ে কোমর জড়িয়ে ধরে, ঘাড় কাত করে ফিসফিস করে বললাম কানের কাছে, ‘স্বীকার করো কস্তুরী, স্বীকার করো।’

রেলিংয়ের ওপরে বসানো ব্রোঞ্জের কিউপিড মূর্তিটার ওপর মাথা রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সুলতা। বলল, ‘হ্যাঁ, আমিই কস্তুরী!’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *