প্রেত-প্রেয়সী – ২.১

(১)

‘শ্বাস নিন… জোরে… কাশুন… আর একবার শ্বাস নিন… ফাইন… এবার হার্টটা দেখা যাক… নিঃশ্বাস ধরে রাখুন, ছাড়বেন না… হুম! খুব ভালো দেখছি না… ঠিক আছে, জামা-কাপড় পরে নিন…’

ডাক্তারের তীক্ষ্ণদৃষ্টির সামনে থেকে চোরের মতো সরে গিয়ে শার্টটা গায়ে চাপালাম আমি।

‘বিয়ে করেছেন?’

‘না… এই তো ফিরলাম বোম্বে থেকে।’

‘কী করতেন সেখানে?’

‘অনেকরকম কাজ। কিছুদিন সেলসম্যান ছিলাম একটা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে। ভালো লাগল না সে কাজ… তাই…’

‘এবার কি কলকাতাতেই থাকবেন?’

‘ঠিক জানি না। আগে এখানেই প্র্যাকটিস করতাম। কিন্তু এখন যে কী করব, তা-ই জানি না।’

‘কীসের প্র্যাকটিস?’

‘আইনের।’

‘তাহলে থেকে যান। প্র্যাকটিস জমতে কতদিনই বা যাবে।’

‘একটা ফ্ল্যাট তো দরকার। আগের ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখলাম সেখানে একটা পাঞ্জাবি ফ্যামিলি রয়েছে। জানেন তো এখন বাসা পাওয়া কী মুশকিল।’

কান চুলকোতে চুলকোতে ডাক্তারবাবু শুধোলেন, ‘আপনি মদ খান?’

‘তা খাই। জীবনে অনেক চোট খেয়েছি তো।’

টেবিলে বসে পড়ে ফাউন্টেন পেনের ক্যাপ খুলতে খুলতে বললেন ডাক্তার, ‘আপনার স্বাস্থ্য মোটেই ভালো দেখছি না। প্রচুর বিশ্রাম দরকার আপনার। সমুদ্রতীরে মাসখানেক থাকতে পারলে খুবই ভালো হয়… আর আবোলতাবোল চিন্তা আর স্বপ্ন সম্বন্ধে যা বললেন— সে ব্যাপারে আমার করণীয় কিছু নেই। আমি লিখে দিচ্ছি— আপনি ডক্টর মল্লিকের সঙ্গে দেখা করুন— এ বিষয়ে উনি স্পেশালিস্ট।’

‘যা বললেন, তা কি সত্যই খুব সিরিয়াস।’ ভয়ে ভয়ে শুধোই।

‘ডক্টর মল্লিকের সঙ্গে দেখা করুন।’

খসখস করে প্যাডের ওপর কলম চালালেন ডাক্তার।

‘আপনার এখন দরকার ভালো খাওয়া, পুরো বিশ্রাম, আর উদ্ভট চিন্তা থেকে মাথাকে একদম রেহাই দেওয়া। চিঠিপত্র লেখাও বন্ধ রাখুন। পড়াশুনাও তা-ই।… আট টাকা… থ্যাংক ইউ।’

বিড়বিড় করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলাম। স্পেশালিস্ট! সাইকিয়াট্রিস্ট! সব রহস্য জেনে নিয়ে কস্তুরীর মৃত্যু সম্বন্ধেও কথা বলতে বাধ্য করবে আমাকে। পাগল আর কি! তার চাইতে বরং সারা জীবন এই দুঃস্বপ্ন নিয়েই থাকব। তবুও সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে মনের দরজা খুলতে যাব না। বোম্বাইতে এই ক-টা বছর উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপন করেছি। শরীর ভেঙেছে সেই কারণেই। এখন আর কোনও ভয় নেই।

কলকাতাকে যেন আর চেনাই যায় না। অনেক পালটেছে এই ক-বছরের মধ্যে। ম্যাডান স্ট্রিটের বারে ঢুকে একটা নিরালা টেবিলে বসে পড়লাম।

পর পর দু-পেগ ব্র্যান্ডি গলা দিয়ে নামিয়ে একটু ধাতস্থ মনে হল নিজেকে। আরও এক গেলাস রেখে গেছে সামনে। টলটলে হলুদ সুরা। মনের আঁধারে সুপ্ত প্রেতদের যে জাগিয়ে তুলতে অদ্বিতীয়। না, কস্তুরী মরেনি। প্ল্যাটফর্মে পা দেওয়ার পর থেকেই কস্তুরী সঙ্গ নিয়েছে আমার। অনেক মুখই মানুষ ভুলে যায়। পাথরে খোদাই মূর্তিও রোদে জলে ক্ষয়ে যায়। কিন্তু কস্তুরীর মুখ কোনওদিন ভোলা যাবে না। প্রাণচঞ্চল স্ফুর্তিতে উজ্জ্বল অপরূপ রূপসী তন্বী দেহকে আবার চোখের সামনে দেখতে পেলাম… ছলছল করে জল বয়ে চলেছে গঙ্গায়… ঝুঁকে পড়েছে কস্তুরী… টুকরো টুকরো হয়ে উড়ে গেল চিঠিটা…

এক ঢোকে নিঃশেষ করে দিলাম গেলাসটা।

‘ওয়েটার! আর একটা।’

মদ আমার ভালো লাগে না, কিন্তু মদ ছাড়া ইদানীং থাকাও যাচ্ছে না। কলকাতায় নেমেই মহেন্দ্রর খোঁজ নিয়েছিলাম। মহেন্দ্র মারা গেছে মোটর দুর্ঘটনায়। কস্তুরীর মৃত্যুর কিছু পরেই। দূর সম্পর্কের এক ভাই আস্তানা নিয়েছে তার প্রাসাদ তুল্য ভবনে। কিন্তু তবুও স্বস্তি পাচ্ছি কই? তুষের আগুনের মতো সেই জ্বলুনিটা…

কপাল ভালো। বাইরে পা দিয়েই ট্যাক্সিটা পাওয়া গেল। অনেক দূরে যাব। হ্যাঁ, শ্যামনগর। সেই টাওয়ার… সেই চত্বর… সেই ভাঙা নীলকুঠি… যেন চুম্বকের মতো টানছে আমাকে…

হলুদ রঙের ধূ-ধূ সরষের খেতের অপরূপ সুষমা, পথের দু-ধারে অজস্র হাড়মটমটি গাছের লাইলাক রঙের ফুলের বন্য সৌন্দর্যেও দৃষ্টি ছিল না আমার। পুরোনো সেই চত্বরটার সামনে এসে হঠাৎ বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। ওই তো বুরুজ। বুরুজের ওপর থেকে যে কুঁড়ে ঘরগুলো লক্ষ করেছিলাম, তারই একটার দিকে এগিয়ে গেলাম পায়ে পায়ে। স্নায়ুগুলো অস্থির হয়ে উঠেছে। নার্ভাসনেস।

মুদির দোকান। আধবুড়ো মুদি আমাকে দেখে একটু অবাকই হল।

‘কী দেব বলুন?’

আমতা আমতা করে বলি, ‘এসেছিলাম বুরুজটা দেখতে। তাই ভাবলাম আপনার সঙ্গে পাঁচ মিনিট গল্প করে যাই।’

গাঁয়ের মানুষ শহরের বাবুর মুখে আপনি সম্বোধন শুনে খুশিই হল। খাতির করে নড়বড়ে বেঞ্চিতে বসিয়ে তক্ষুনি এক ভাঁড় চায়ের অর্ডারও দিয়ে দিল। একথা-সেকথার পর শুধোলাম, ‘আচ্ছা, কয়েক বছর আগে কাগজে পড়েছিলাম কে যেন আত্মহত্যা করেছিল এখানে?’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, একটি মেয়ে বুরুজ থেকে লাফিয়ে পড়েছিল।’

‘মনে পড়েছে— কলকাতার একজন মস্ত ব্যবসাদারের বউ। তা-ই না?’

‘হ্যাঁ, নামটা মনে নেই। লাশটা বুড়ির চোখে পড়ার পর আমিই পুলিশে খবর দিয়েছিলাম। তার ঝক্কিও কম পোয়াতে হয়নি। তবে কেউ কেউ বলে মেয়েটাকে নাকি ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়েছে।’

‘ঠেলে দেওয়া হয়েছে?’ মাথা ঘুরে ওঠে আমার।

‘হ্যাঁ, একজন বুড়ো একটা গাড়ি যেতে দেখেছিল। গাড়িতে ছিল একজন মেয়েলোক, আর একজন ভদ্দরলোক।’

রুদ্ধ নিঃশ্বাসটা ত্যাগ করলাম। কস্তুরী আর আমাকেই যেতে দেখেছে বুড়ো, অর্থাৎ খুনি হিসাবে আমাকে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে দেওয়ার জন্যে একজন সাক্ষী অন্তত হাজির রয়েছে এ গ্রামে। অবশ্য সে বুড়ো এখন বেঁচে আছে কি না ভগবান জানেন। তবুও সাবধানের মার নেই। এ জায়গা ছেড়ে এবার সরে পড়াই ভালো।

আরও দু-চার কথার পর উঠে পড়লাম। মাথাটা ঝিমঝিম করছে উত্তেজনায়। ব্র্যান্ডির প্রতিক্রিয়াও হতে পারে।

ট্যাক্সি ফিরে এল কলকাতায়।

মনের সঙ্গে অনেক লড়াই করেও ডক্টর মল্লিকের কাছে না গিয়ে পারলাম না। সব কথাই খুলে বললাম— কিছু কিছু অবশ্য বাদ দিয়ে। মহেন্দ্রর নাম একেবারেই উল্লেখ করলাম না; পুলিশের সন্দেহের কথাও চেপে গেলাম। বলতে বলতে বার কয়েক ঝরঝর করে কেঁদেও ফেললাম।

শুনে সাইকিয়াট্রিস্ট বললেন, ‘তাহলে এখনও আপনি ভদ্রমহিলাকে দেখার আশা রাখছেন। আপনি বিশ্বাস করেন না যে, তিনি মৃত?’

‘বিশ্বাসের প্রশ্ন নয়, ডক্টর। এ যে আমি নিজের কানে শুনেছি, স্বচক্ষে দেখেছি।’

‘যা-ই দেখে থাকুন অথবা শুনে থাকুন না কেন, সারকথা এই— আপনি বিশ্বাস করেন কস্তুরী বেঁচে থাকতে পারে এই কারণে যে, মৃত্যুর পরেও তাঁকে একবার বেঁচে উঠতে দেখা গেছে।’

‘ঠিক ওইভাবে অবশ্য আমি বলতে—’

‘অন্য কিছুভাবেও বলেননি আপনি। পক্ষান্তরে, নিজের অজ্ঞাতসারে এমন সব কথা বলছেন, যাতে সমস্ত জিনিসটাই বেশ ঘুলিয়ে ওঠে। নিন, ওই কৌচটায় শুয়ে পড়ুন দিকি।’

বেশ কিছুক্ষণ ধরে রিফ্লেক্স পরীক্ষা করলেন ডক্টর। তারপর কপাল কুঁচকে বললেন, ‘আগে মদ খেতেন?’

‘খুব বেশি নয়; নেশা ছিল না— এখন নেশায় দাঁড়িয়েছে।’

‘আর কোনও মাদক দ্রব্য?’

‘না।’

‘সত্যি সত্যিই সেরে উঠতে চান কি না ভাবছি আমি।’

‘সেই জন্যেই তো এলাম আপনার কাছে।’

‘তা যদি চান তো মদ খাওয়া বন্ধ করতে হবে; মন থেকে এই মেয়েটিকে নির্বাসন দিতে হবে। মনকে এই কথাই বিশ্বাস করাতে হবে যে, সে মরে গেছে— একেবারেই মরেছে— আর বেঁচে উঠবে না। বুঝেছেন তো— স্থায়ী মৃত্যু… কিন্তু তার আগে আর একবার জিজ্ঞেস করে নিই, সত্যি সত্যিই সেরে উঠতে চান কি না বলুন।’

‘কী বলছেন ডক্টর? কী করে যে বিশ্বাস করাই আপনাকে…’

‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। তাহলে শুরু হল আপনার চিকিৎসা। পুরীতে আমার বন্ধুর বাড়ি আছে… সমুদ্রের ধারেই স্বর্গদ্বারে— চিঠি দিচ্ছি আপনাকে।’

ঢোক গিলে বলি, ‘তাহলে পাগলা গারদে থাকার দরকার নেই?’

হেসে উঠলেন ডক্টর।

‘না, না, সেরকম সিরিয়াস কিছু হয়নি। পুরীতে যেতে বলছি কেবল সেখানকাব জল-হাওয়ার জন্য। কাছে টাকা আছে তো?’

‘আছে।’

‘আগে থেকেই জানিয়ে রাখি, এ চিকিৎসা দু-দিনে শেষ হবে না।’

‘যত দিন লাগুক, আমি রাজি আছি।’

পা টনটন করছিল, তাই বসে পড়লাম সামনের চেয়ারে। ডাক্তারের কোনও কথায় আর কান ছিল না; একই কথাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার আবৃত্তি করে চলেছিলাম মনে মনে, আমি সেরে উঠতে চাই… সেরে উঠতে চাই…

চিকিৎসার শুরু থেকেই একটু একটু করে অনুশোচনা দানা বেঁধে উঠতে লাগল মনের মধ্যে। এ অনুশোচনা কস্তুরীকে ভালোবাসার… ভালো না বাসলে তো এভাবে কষ্ট পেতে হত না আমাকে। আবার নতুন করে শুরু হোক আমার জীবনযাপন, নতুন উদ্যম নিয়ে। অস্পষ্ট হয়ে যাক পুরোনো পৃষ্ঠাগুলো— তাহলেই আবার ভালোবাসতে পারব আর কাউকে… আর সবার মতোই সুখে ঘর বাঁধতে পারব। তখনও উপদেশবর্ষণ করে চলেছিলেন ডক্টর। সব কিছুতেই সায় দিয়ে চলেছিলাম, প্রতিশ্রুতি দিচ্ছিলাম সব নির্দেশেই। হ্যাঁ, আগামী কালই রওনা হব পুরীতে। মদ খাওয়াও বন্ধ করব। পুরো বিশ্রাম নেব। রাজি… রাজি… রাজি— সমস্ততে রাজি…

‘ট্যাক্সি ডেকে দেব? ডক্টরের অ্যাসিস্ট্যান্ট জিজ্ঞেস করলেন আমাকে।

‘না; একটু হাঁটলে মনটা ভালো থাকবে।’

প্রথমেই বুকিং অফিসে গিয়ে আগামী কালের টিকিট কাটলাম। তারপর ব্যাঙ্ক আর হোটেল। হাতে এখনও অনেকটা সময় রয়েছে। সিনেমায় ঢুকে পড়লাম— ছবি দেখার চাইতে সময় কাটানোই আমার মুখ্য উদ্দেশ্য। আরও উদ্দেশ্য আছে— ডক্টর মল্লিকের প্রশ্নগুলোকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম আমি। কোনওদিন ঘুণাক্ষরেও কি ভেবেছি, পাগল হতে হবে আমাকে? তাই দারুণ ভয় সাপের মতো পেঁচিয়ে ধরেছিল মনটাকে। স্নায়ুগুলোও তখন থেকে স্থির নেই। হাত-পা সবই যেন কাঁপছে। একটু ব্র্যান্ডি পেলে ভালো হত। পরক্ষণেই দাঁতে দাঁত পিষে গালি দিয়ে উঠলাম নিজের দুর্বলতাকে।

আলোকিত হয়ে উঠল রুপোলি পর্দা। প্রথমেই খবর— কটকের দৃশ্য: জনতার ভিড় ঠেলে মহাত্মা গান্ধী এগিয়ে চলেছেন মঞ্চের দিকে; চরকা আঁকা পতাকা, লাল পাগড়ি আর অজস্র উৎসুক মুখ। আরও কাছে এগিয়ে এল ক্যামেরা— জনতা জয়ধ্বনি করছে, কিন্তু শব্দ শোনা যাচ্ছে না; হাত নাড়ছে একজন মোটা লোক। ধীরে ধীরে ক্যামেরার লেন্সের দিকে ফিরে দাঁড়াল একজন স্ত্রীলোক… ফ্যাকাশে চোখ… কিন্তু দেহরেখা দেখে পটে আঁকা ছবির কথা মনে পড়ে যায়। এগিয়ে গেল ক্যামেরা… কিন্তু ওইটুকু সময়ের মধ্যেই চিনতে পেরেছিলাম… চেয়ার ছেড়ে অর্ধেক উঠে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে রইলাম পর্দার পানে।

পেছনের সারি থেকে চেঁচিয়ে উঠল একজন, ‘বসে পড়ুন, বসে পড়ুন!’

দু-হাতে তখন নিজের গাল খামচে ধরেছি আমি— অবরুদ্ধ আর্ত-চিৎকারে ফেটে পড়তে চাইছে বুকের খাঁচাটা। শূন্য দৃষ্টি মেলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম পর্দার জনতার পানে, গান্ধীজীর এগিয়ে চলা মূর্তির পানে। তারপরেই একটা হ্যাঁচকা টানে বসে পড়লাম সিটে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *