প্রেত-প্রেয়সী – ১.৬

(৬)

দূর থেকেই ঝাপসা চোখে তাকালাম নিষ্প্রাণ দেহটির দিকে। বুরুজ থেকে বেরিয়ে এসেছি বটে, কিন্তু আর এক পা-ও এগোবার সামর্থ্য ছিল না। মনে পড়ল একদিন বিড়বিড় করে বলেছিল কস্তুরী, ‘মরতে আমার ভালো লাগে।’

ইসমাইলের সম্বন্ধে সবাই তা-ই বলেছিল। কস্তুরীর মতোই মাথা নীচের দিকে করে আছড়ে পড়েছিল সে। যন্ত্রণা ভোগ করার কোনও সময়ই পায়নি। সত্যিই কি তা-ই? ফুটপাতের পাথরে থেঁতলে গেছিল ইসমাইলের মাথা, ফিনকি দিয়ে রক্ত ছিটকে পড়েছিল চারপাশে…

আর ভাবতে পারলাম না। হাসপাতালে গিয়ে ইসমাইলের দেহাবশেষ দেখেছিলাম। কস্তুরীর চাইতেও কম উঁচু জায়গা থেকে পড়েছিল সে। কল্পনায় সেই ভয়ংকর সংঘর্ষ প্রতিটি স্নায়ু দিয়ে উপলব্ধি করলাম… প্রচণ্ড বিস্ফোরণের মতো আচমকা রেণু রেণু হয়ে গেছিল মনটা— অণুপরমাণুতে গুঁড়িয়ে যাওয়া মূল্যবান আয়নার মতোই। পোশাকের একটা প্রাণহীন দলা ছাড়া কস্তুরীরও আর কিছু অবশিষ্ট নেই!

জোর করে আরও কাছে এগিয়ে গেলাম। অসহ কষ্ট হলেও আমাকে দেখতে হবে এই দৃশ্য। এ ঘটনার জন্যে দায়ী আমি নিজেই— না দেখে পালানোর পথ কি আছে? অশ্রুপর্দার মধ্যে দিয়ে একটা ঝাপসা ছবি দেখলাম। দেখলাম, পাগলিনীর মতো চুলের রাশি ছড়িয়ে পড়েছে চোখে-মুখে-বুকে; ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে রুধিররঞ্জিত তিলোত্তমানিন্দিত মুখটি; যেন মোম দিয়ে গড়া একটি হাত ছড়িয়ে রয়েছে জমির ওপর— অনামিকায় চিকমিক করছে একটি আংটি। সামর্থ্যে কুলোলে ওই আংটিটি খুলে নিয়ে আসতাম, আমৃত্যু ধারণ করতাম নিজের আঙুলে। কিন্তু সে-শক্তি নেই আমার। তাই কুড়িয়ে নিলাম শুধু আয়নাটা।

একটু একটু করে পিছু হটে এলাম। নির্নিমেষ দৃষ্টি রইল নিষ্প্রাণ দেহপিণ্ডটির ওপর— এমনভাবে তাকিয়ে রইলাম যেন ও দেহের প্রাণপ্রদীপ নিভিয়ে দিয়েছি আমি স্বয়ং। আচম্বিতে ভয়ানক ভয় ঘিরে ধরল আমাকে— এ ভয় সামনের ওই বীভৎস তালগোল পাকানো দেহটিকে নিয়ে। কর্কশ শব্দে কা-কা করে ওপর দিয়ে উড়ে গেল কয়েকটা কাক।

পেছন ফিরেই দৌড়োলাম। হাতের শক্ত মুঠোয় ঘেমে উঠেছিল আয়নাটা। এক দৌড়ে চত্বর পেরিয়ে উঠে বসলাম গাড়িতে।

সব তো শেষ হয়ে গেছে। ইহলোক থেকে কস্তুরী বিদায় নিল কেন, কোনওদিনই কেউ তা জানতে পারবে না। জানতেও পারবে না যে আমিও হাজির ছিলাম, থেকেও দরজার বাধা পেরিয়ে পৌঁছোতে পারিনি বুরুজের চুড়োয়। উইন্ডস্ক্রিনের ওপর নিজের ছায়া দেখে মনে মনে এতটুকু হয়ে গেলাম আমি। নিদারুণ ধিক্কারে ভরে উঠল সমস্ত অন্তর। এর চাইতে মরে যাওয়াও ভালো। বেঁচে থাকাটাও এখন নরক বাসের সামিল।

উন্মাদের মতো অনেকক্ষণ ড্রাইভ করেছিলাম সেদিন। হঠাৎ সম্বিত ফিরে আসতে সচমকে দেখলাম সোদপুরের মধ্য দিয়ে ঝড়ের মতো উড়ে চলেছে গাড়ি। ফাঁড়িতে গেলে হয় না? লোকজন জড়ো করা উচিত নয় কি? না। আইনের চোখে কোনও অপরাধ করিনি। উলটে সবাই ভাববে কাপুরুষ… দুর্লভ সামন্ত কাপুরুষ! উঁচুতে ওঠার মতো পৌরুষ তার নেই।

সন্ধে ছ-টার সময়ে শ্যামবাজার পেরিয়ে কলকাতায় ঢুকলাম। মহেন্দ্রকে সব বলতে হবে। বলতেই হবে, পালিয়ে গেলে চলবে না।

একটা বারে ঢুকে চোখে মুখে জল ছিটিয়ে চুল আঁচড়ে নিলাম। তারপর কাউন্টারের সামনে গিয়ে তুললাম রিসিভার। মহেন্দ্র কৌশিক এখন অফিসে নেই— বাইরে গেছেন। আজ আর ফেরার সম্ভাবনা নেই। টেবিলে বসে এক গেলাস ব্র্যান্ডি ঢেলে দিলাম গলায়। ফুটন্ত পদ্মফুলের মতো মেয়েটিকে ইহজগতে আটকে রাখার জন্যে আরও বেশি মানোবলের দরকার ছিল আমার। তা যখন নেই, তখন…

আর এক গেলাস চাই। একবার তাকে জীবন দিয়েছিলাম। কিন্তু কই, সে জীবন তো ধরে রাখতে পারলাম না? আমার জন্যেই সে…

ব্র্যান্ডির দাম চুকিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এলাম। পাহাড়ে ওঠার মতো ক্লান্তি নেমেছে সারা অঙ্গে। স্টিয়ারিং হুইলে হাত দিয়েই মনটা কীরকম হয়ে গেল। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে এই হুইলেই হাত দিয়েছিল সে। প্রেততত্ত্ববিদদের মতো যদি রুমাল বা খাম বা যে কোনও জিনিস ছুঁয়েই অনেক কিছু জানা যেত! কস্তুরীর জীবনদীপ নিবে যাওয়ার ঠিক আগের যন্ত্রণাময় মনটিকে জানার জন্য সর্বস্ব দিতেও প্রস্তুত আমি। না, না, এ কী ভাবছি? কোনও যন্ত্রণাই পায়নি কস্তুরী। জীবনের প্রতি নির্লিপ্ততাই তার একমাত্র গোপন রহস্য। তাই তো এ জীবনকে পুরোনো খোলসের মতোই ছেড়ে গেল সে। মাথা নীচের দিকে করে হাত দুটো দু-দিকে ছড়িয়ে দিয়ে লাফিয়েছিল ও— আলিঙ্গন করতে উদ্যত হয়েছিল সেই ধরিত্রীকেই যে নির্মমভাবে ক্ষণপরেই প্রাণহীন করে দিয়েছিল তার দেহবল্লরীকে। মনে হয় যেন, ও পালায়নি… অন্য কোথাও গেছে… স্বগৃহে যাওয়ার মতোই…

এতটা ব্র্যান্ডি খাওয়া ঠিক হয়নি। একই চিন্তা বনবন করছে মাথার কোষে কোষে। এসে গেছে মহেন্দ্রর বাড়ি। ওই তো কালো গাড়িটা। ঠিক পেছনেই পার্ক করলাম। লাল মখমলের কার্পেট মোড়া সাদা মার্বেলের সিঁড়ি পেরিয়ে গটগট করে উঠে গেলাম ওপরে। তামার নেম প্লেটে ঝকমক করছে মহেন্দ্র কৌশিকের নাম। কলিংবেলের বোতাম টিপে দিয়ে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়ালাম আমি।

কস্তুরীর বাড়ি। বড় বড় কয়েকটা অয়েল পেন্টিং ঝুলছিল দেওয়ালে। অদ্ভুত ছবি। মানে বোঝা ভার। উঠে গিয়ে দাঁড়ালাম একটার নীচে। এককোণে নাম লেখা— কস্তুরী। ওগুলো কী? জানোয়ারের ছবি? কোন দেশের জন্তু এরা? আরেক জগতে কস্তুরীকে আহ্বান করে নিয়ে গেল কি এরাই? কোথায় দেখেছে কস্তুরী অত বড় কালো লেক? জলপদ্ম? দানবিক গাছের বুকে কালো কেউটের মতো লতার রাজত্ব? আর একটা ছবিতে একজন তরুণী মহিলার কণ্ঠে ঝুলছে একটা মণিহার। উমা দেবী। খোঁপাটা ঠিক কস্তুরীর মতো। মুখটা যেন আত্যন্তিক যন্ত্রণায় ঈষৎ বিকৃত— পলকহীন চোখে তাকিয়েছিলাম ছবিটার পানে— এমনি সময়ে খুলে গেল পেছনের দরজা।

‘এসেছ!’ মহেন্দ্রর গলা।

বোঁ করে ঘুরে দাঁড়ালাম।

‘এসেছেন উনি?’

‘কে?… সে তো তুমিই জানো?’

ধপ করে বসে পড়লাম একটা ইজিচেয়ারে। উদ্‌ভ্রান্ত মনকে মুখে ফুটিয়ে তোলার জন্যে কোনও অভিনয়ই করতে হল না।

‘আজ আমরা বেরোইনি… চারটা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলাম। তারপরেই গেলাম ঘোষপাড়া— যদি দেখা পাই। এই আশায়। চিতপুরের সেই হোটেলেই গেছিলাম… সেখানে থেকেই আসছি আমি… এখানেও যদি না থাকে…’

কাগজের মতো সাদা হয়ে গেল মহেন্দ্র। ঠেলে বেরিয়ে এল চোখ দুটো। হাঁ হয়ে গেল মুখটা।

‘না, না… দুর্লভ…’ তোতলাতে থাকে মহেন্দ্র, ‘তুমি মিথ্যা বলছ… তুমি… তুমি…’

গালে হাত বুলিয়ে নিয়ে বললাম, ‘বিশ্বাস করো। কোথাও খুঁজতে বাকি রাখিনি আমি।’

‘অসম্ভব… বুঝতে পারছ না…’

কার্পেটের ওপর সজোরে লাথি মেরে দুই হাত কচলাতে কচলাতে ধপ করে একটা সোফায় বসে পড়ল মহেন্দ্র।

খাবি খেতে খেতে বলল, ‘খুঁজে বার করতেই হবে… এক্ষুনি— যে ভাবেই হোক… বার করতেই হবে… আমি… আমি…’

‘স্ত্রীলোক যদি পালিয়ে যেতেই চায়, তখন তাকে বাধা না দেওয়াই ভালো।’

‘পালিয়ে যেতে চায়? পালিয়ে যেতে চায়? কস্তুরী যেন পালিয়ে যাওয়ার মেয়ে!… এতক্ষণে হয়তো সে…’

লাফিয়ে দাঁড়িয়ে উঠল মহেন্দ্র। ধাক্কা লেগে উলটে গেল কাশ্মীরি আতরদান বসানো একটা ছোট্ট টেবিল।

‘কী করি বলো তো, কী করা উচিত এখন? তুমি তো জানো এ অবস্থায় পড়লে কী করা দরকার? চুপ করে থেকো না, দোহাই তোমার, উত্তর দাও।’

‘সবাই হাসবে। দু-তিনদিন পরেও ফিরে না এলে অবশ্য আলাদা কথা।’

‘কিন্তু তুমি বললে হাসবে না। তুমি উকিল মানুষ… তা ছাড়া তুমি যদি বুঝিয়ে বলো সবাইকে যে আরও একবার আত্মহত্যা করতে চেষ্টা করেছিল কস্তুরী। সেবার গঙ্গা থেকে ওকে তুলে না আনলে কী যে হত… আজও হয়তো সেই চেষ্টাই করেছে ও… তুমি বললে বিশ্বাস করবে সবাই… নিশ্চয় করবে…’

‘কিস্যু করার দরকার নেই। এই তো ক-ঘণ্টা হল বাইরে গিয়েছেন উনি। রাত্রে খাবার আগেই আবার ফিরে আসবেন-খন, এ নিয়ে এত চিন্তার কী দরকার?’

‘যদি না আসে?’

‘না এলেও তার অন্তর্ধানের বৃত্তান্ত রিপোর্ট করাটা তো আমার ব্যাবসা নয়।’

‘অর্থাৎ তুমি সরে দাঁড়াচ্ছ?’

‘ঠিক তা নয়… একটু বুঝতে চেষ্টা করো… পুলিশে স্বামীই খবর দেবে— এইটাই কি স্বাভাবিক নয়?’

‘বেশ এখুনি দিচ্ছি।’

‘মিছে লোক হাসাবে। ক-ঘণ্টা হল তোমার স্ত্রী বাড়ি ফেরেননি। তোমার এই কেস শুনে আর সামান্য এই প্রমাণ নিয়ে তারা কোনও অ্যাকশনই নেবে না। যা বলবে তা-ই লিখে নিয়ে সাফ বলে দেবে, পাওয়া গেলেই খবর দেওয়া হবে। এর বেশি আর কিছুই করবে না।’

আলগোছে বুকের ওপর দু-হাত ভাঁজ করে রাখল মহেন্দ্র।

‘কিন্তু এইভাবে যদি নিষ্কর্মা হয়ে চুপচাপ বসে থাকতে হয় আমাকে, তাহলে নির্ঘাত পাগল হয়ে যাব।’

আবার পায়চারি শুরু করল মহেন্দ্র। তারপর জানলার সামনে পেতলের ঝকমকে টবে রাখা একগুচ্ছ গোলাপের পানে তাকিয়ে রইল বিষণ্ণ চোখে।

‘এবার তো আমাকে উঠতে হয়।’ বললাম আমি।

একটুও নড়ল না মহেন্দ্র। নির্নিমেষে চোখে তাকিয়ে রইল গোলাপগুচ্ছের পানে। সামান্য একটা কাঁপন চকিতে জেগে উঠেই মিলিয়ে গেল মুখের রেখায় রেখায়।

দরজার দিকে যেতে যেতে বললাম, ‘ফিরে এলে আমাকে ফোনে খবরটা দিও।’

আর নয়, এইবার যাওয়ার সময় হয়েছে। নিজের চোখের ওপর আস্থা রাখতে পারছিলাম না। নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলাম না মুখের মাংসপেশিগুলোকে। মুখ-বন্ধ আগ্নেয়গিরির মতোই নিষ্ঠুর সত্য ফুঁসে উঠে আসতে চাইছে ওপরে।

চৌকাঠে পা দিয়ে পেছন ফিরে তাকালাম। দুই করতলে মাথা গুঁজে পাথরের মতো দাঁড়িয়েছিল মহেন্দ্র। আঙুলের ওপর ভর দিয়ে হলঘরটা পেরিয়ে এলাম। সবচেয়ে কঠিন অংশটুকু ভালোভাবেই শেষ করা গেছে। যবনিকা পড়েছে মহেন্দ্রর কেসে। এবার ওর মানসিক যন্ত্রণা… কিন্তু আমার যাতনা কি তার চাইতেও বেশি নয়? অনেক বেশি! গাড়িতে বসে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিলাম। প্রথম থেকেই কস্তুরীর প্রকৃত স্বামীরূপে নিজেকে কল্পনা করে এসেছি— সুতরাং আমার মনোবেদনা তো বেশি হবেই। মহেন্দ্র তো এতদিন জবরদখল করেছিল কস্তুরীকে। কাজে কাজেই এ-হেন নীচ ব্যক্তির জন্যে নিজেকে কি কেউ উৎসর্গ করে? না, পুলিশে গিয়ে বলে যে, একদিন আমরা সহপাঠী ছিলাম, বন্ধুর তরুণী ভার্যার আত্মহত্যার সময়ে হাজির ছিলাম অকুস্থলে— কিন্তু তাকে নিবৃত্ত করার সাহস আমার ছিল না…! এখন কোথাও চলে গেলেই ভালো ছিল। বাঁকুড়ার সেই মক্কেলের কেসটি নিলে কলকাতা ছেড়ে কিছুদিন দূরে সরে যাওয়া যায়।

কীভাবে গাড়ি চালিয়ে গ্যারেজে গাড়ি তুলেছিলাম সেদিন, তা জানি না। হঠাৎ চমকে উঠে দেখি, পা টেনে টেনে হাঁটছি আমি। ব্ল্যাক আউটের রাস্তা। ঠুলিপরা ল্যাম্পপোস্ট; তারার আলোর মতো ফ্যাকাশে আলো। বেশি রাত হলেই রাস্তাগুলো আজকাল আরও জনহীন হয়ে যাচ্ছে। সকাল সকাল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দোকানগুলো। খাঁ-খাঁ করছে মোড়গুলো। মাঝে মাঝে দেখা যায় সামরিক যানের যাতায়াত। যুদ্ধের আতঙ্কে সত্যি সত্যিই মুষড়ে পড়েছে শহরের আত্মা। আর, সবাই যেন ষড়যন্ত্র করে বারবার আমার মনকে ঠেলে ঘুরিয়ে দিচ্ছে মৃত কস্তুরীর চিন্তায়। সামনেই একটা রেস্তোরাঁ দেখে ঢুকে পড়লাম।

‘ওমলেট আর টোস্ট।’

কিছু খাওয়া দরকার। দু-দিন আগেকার স্বাভাবিক জীবনে আমাকে ফিরে যেতেই হবে। খিদে না পেলেও খেতে হবে। পকেটে হাত দিতেই আয়নাটা আঙুলে ঠেকল। সঙ্গে সঙ্গে সাদা টেবিল ক্লথ আর চোখের মাঝে যেন ভেসে উঠল সেই মুখ… কস্তুরীর মুখ।

কলের পুতুলের মতো চামচ দিয়ে ওমলেটটা কেটে কেটে মুখে পুরতে লাগলাম। বৈরাগীর মতো নির্লিপ্ত হয়ে উঠেছি ইহসংসারের সবকিছুর প্রতি। এখন থেকে কপর্দকহীনের মতো জীবনযাপন করব— শোকসাগরে নিমজ্জিত থাকব প্রতিটি মুহূর্ত; প্রায়শ্চিত্ত করব আমৃত্যু— এ ছাড়া আর পথ নেই। ঘৃণার আগুনে তিল তিল করে পুড়িয়ে মারতে হবে নিজেকে— যতদিন না আত্মসম্মানের নতুন কোনও অধ্যায় উন্মোচিত হচ্ছে অন্ধকার জীবনে।

রাস্তায় বেরিয়ে এলাম। আরও অন্ধকার হয়ে এসেছে শহর। বড় বড় বাড়ির ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে লক্ষ লক্ষ তারার রোশনাই। মাঝে মাঝে সাঁ করে বেরিয়ে যাচ্ছে একটা মোটর, মিলিটারি সাঁজোয়া গাড়ি— হেড লাইটগুলোকেই ঠুলি পরিয়ে রেখেছে বোমার ভয়ে। মন স্থির করে উঠতে পারলাম না বাড়ি যাব কি না। ভয় টেলিফোন যন্ত্রটাকে— ঝনঝন করে বেজে উঠে নিয়ে আসবে সেই ভয়ংকর সংবাদ— লাশ পাওয়া গেছে! তা ছাড়া যে-দেহের অক্ষমতার জন্যে কস্তুরীর প্রাণবিয়োগ ঘটল, সে দেহকে ক্লান্তিদেহে আরও কিছুক্ষণ ডুবিয়ে রাখতে চাই। বাষ্পাচ্ছন্ন চোখে ক্ষিপ্তের মতো এলোমেলোভাবে এদিকে-ওদিকে করলাম কিছুক্ষণ। ভোর না হওয়া পর্যন্ত এই ভাবেই নির্যাতিত হোক অপটু দেহ। কস্তুরী! কস্তুরী! হতভাগিনী কস্তুরী!

অশ্রু এবার আর বাধা মানল না। উপচে উঠে গড়িয়ে পড়ল চোখের কোল বেয়ে। জলের ধারা মুছলাম না। কাঁদলে মনটা অনেকটা লঘু হয়ে যায়। বুকের অসহ্য অবর্ণনীয় টনটনে ব্যথাটা একটু যেন ফিকে হয়ে আসে। জমাট বাঁধা বেদনাটাই যেন গলে গলে অশ্রু হয়ে বেরিয়ে আসছে। আসুক। সামনে ও কীসের জল? গঙ্গা। ওই বেঞ্চিটায় একটু বসা যাক। বড় ঠান্ডা পড়েছে।

তাতে কী? মাথাটা ঝিমঝিম করছে। চোখ জুড়ে আসছে। ওই সেই গঙ্গা… যেখানে কস্তুরী… আয়না…

ভোরবেলা হি-হি করে কাঁপতে কাঁপতে উঠে বসলাম। ডান পায়ের শিরা টেনে ধরছে দারুণ ঠান্ডায়। রাস্তায় নেমে এসে এক ভাঁড় চা খেয়ে রওনা হলাম বাড়ির দিকে।

দরজা বন্ধ করতে না-করতেই বেজে উঠল টেলিফোনের ঘণ্টা। ‘হ্যালো! কে, দুর্লভ?’

‘হ্যাঁ।’

‘যা ভয় করেছিলাম, কস্তুরী আত্মহত্যা করেছে।’

কিছু না বলাই ভালো। প্রায় দমবন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি।

‘কালকেই খবর পেলাম। একটা বুরুজের নীচে ওর লাশ দেখতে পেয়েছে একজন বুড়ি।’

‘বুরুজ? কোথায়?’

‘শ্যামনগরের কাছে ভাঙা নীলকুঠির বুরুজ…’

‘ওখানে কী করতে গেছিলেন উনি?’

‘বুরুজের চুড়ো থেকে নীচের উঠোনে লাফিয়ে পড়েছিল কস্তুরী। ডেডবডি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’

‘কী শোচনীয় মৃত্যু! তুমি যাচ্ছ নাকি?’

‘এইমাত্র ফিরলাম আমি। খবর পেয়েই ছুটেছিলাম। তোমাকেও সঙ্গে নিতে চেয়েছিলাম— কিন্তু বাড়িতে ছিলে না তুমি। কিছু জরুরি কাজ ছিল বলে কলকাতায় এসেছি— এখুনি আবার ফিরে যাচ্ছি। পুলিশ তদন্ত শুরু করে দিয়েছে।

‘তা তো করবেই। যদিও এ মৃত্যু সুইসাইড ছাড়া আর কিছুই নয়।’

‘কয়েকটা গোলমেলে ব্যাপার দেখে মাথা গুলিয়ে গেছে পুলিশের। যেমন ধরো, সুইসাইডই যদি করতে হয়, এতদূরে আসার দরকারটা কী! কী যে ছাই বলি আমি, বুঝতে পারছি না। ওদেরকে এ-কথাটাও আমি জানাতে চাই না যে কস্তুরী…’

‘অতদূর ওরা এগবেই না।’

‘যাই হোক, আমার সঙ্গে তুমি থাকলে স্বস্তি পেতাম।’

‘যাওয়ার তো এখন প্রশ্নই ওঠে না, কেননা একটা জরুরি মোকদ্দমার ব্যাপারে বাঁকুড়া যেতে হচ্ছে আমাকে।’

‘অনেকদিন লাগবে নাকি?’

‘না, না, দিনদুয়েকের ব্যাপার। তা ছাড়া আমাকে তোমার দরকারই হবে না।’

‘আবার ফোন করব-খন।’ জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলল মহেন্দ্র— ঠিক যেন হাঁপাচ্ছে।

লাইন কেটে দিলাম। দেওয়ালের ধরে টলতে টলতে বিছানার ওপর গিয়ে শুয়ে পড়লাম চিত হয়ে। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে আমার।

একটু পরেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল ক্ষতবিক্ষত চেতনা।

সেই দিনই বাঁকুড়ার রওনা হয়েছিলাম। ছুটন্ত ট্রেনের তালে তালে মন ছুটে গেছিল শ্যামনগরের নীলকুঠির সেই প্রাঙ্গণে। উঁচু বুরুজের সামনে প্রশস্ত প্রাঙ্গণ— তার ওপরে পড়ে একটি রক্তাক্ত মাংসপিণ্ড… পুলিশ নিশ্চয় পোস্টমর্টেম করে আরও কদাকার ভয়াবহ করে তুলেছে সেই অপরূপ তন্বী দেহটিকে। কতদূর এগল তদন্ত? যুদ্ধের এই ডামাডোলের মধ্যে আসল রহস্যের সন্ধান কি পাওয়া যাবে?

বাঁকুড়ার হোটেলে আস্তানা নিয়েছিলাম। পরের দিন কাগজ খুলে খুঁজেছিলাম খবরটা। ভেতরের পৃষ্ঠায় এককোণায় বেরিয়েছিল মাত্র ক-টি লাইন। বড় বড় যুদ্ধের ছবি আর খবরের ভিড়ে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছিল লাইন ক-টি। পুলিশ তদন্ত চালাচ্ছে। তাদের সন্দেহ এ মৃত্যু আত্মহত্যা নয়। মহেন্দ্র নিশ্চয় নাজেহাল হচ্ছে পুলিশের জেরার সামনে। আর ক-টা দিন। তারপরেই ফিরে গিয়ে ভেবে দেখব। পুলিশের সামনে প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরে মহেন্দ্রকে নির্দোষ প্রতিপন্ন করব কি না, তা ভেবে দেখব কলকাতায় ফেরার পর।

কিন্তু সে সুযোগ আর এল না। দু-দিন পরেই জাপানিরা বোমা ফেলল কলকাতায়। কীরকম যেন হয়ে গেলাম। কলকাতায় ফিরে এসে সামান্য ক-টি সুটকেস নিয়ে ফ্ল্যাট ছেড়ে আবার পা বাড়ালাম কলকাতার বাইরে। ঘুণাক্ষরেও তখন জানতে পারিনি, প্রবাসেই অতিবাহিত হবে এতগুলি বছর। ঘটনার পাকেচক্রে এমন জড়িয়ে পড়লাম যে দীর্ঘ চারটি বছর হারিয়ে গেল কালের গর্ভে— কলকাতায় ফেরার কোনও সুযোগই পেলাম না।…

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *