প্রেত উল্কি
এক
আমার কলেজের বন্ধু সাগ্নিকের ডাকে বিধনি গিয়েছিলাম। বেড়ানো ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। অথচ সেখানে গিয়ে এক হাড় হিম করা অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলাম।
পশ্চিমবঙ্গ আর ঝাড়খণ্ডের সীমান্তে শান্ত শহর বিধনি। সাগ্নিক ওখানকার থানার ও সি। তিনবছর ধরেই আমাকে ফোনে ডাক পাঠাচ্ছে, ”আমি ট্র্যান্সফার হয়ে যাওয়ার আগে একবার এখান থেকে ঘুরে যা পার্থ। হলফ করে বলতে পারি, এমন সুন্দর জায়গা কমই দেখেছিস।”
অতএব এবার ক্রিসমাসের ছুটিতে চলেই গেলাম বিধনি। ছোট্ট স্টেশনটা নামতেই চোখ জুড়িয়ে গেল। লাল মোরামে ঢাকা প্লাটফর্মের ওপর বিশাল বিশাল কয়েকটা মহুয়া আর শালের গাছ। যতদূর চোখ যায়, শীতের রোদে ঝলমল করছে সবুজে ছাওয়া ছোটনাগপুরের মালভূমি। দিগন্তে মেঘের মতন দাঁড়িয়ে রয়েছে দলমা পাহাড়। সেই পাহাড়ের দিক থেকেই একটা হিমঠান্ডা হাওয়া এসে শরীরের সমস্ত জড়তা ঝরিয়ে দিয়ে চলে গেল।
আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে সাগ্নিক নিজেই জিপ নিয়ে চলে এসেছিল। জিপে উঠে ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম, ”থ্যাঙ্ক ইউ ভাই। তুই না ডাকলে এরকম স্বর্গের মতন জায়গাটা অদেখাই থেকে যেত।”
সাগ্নিককে যতটা খুশি দেখব ভেবেছিলাম, ততটা খুশি দেখাল না। মুখে যেন একটা দুশ্চিন্তার কালো ছাপ। জিপটা মেন রোডে তুলে বলল, ”স্বর্গে ভূত ঢুকেছে।”
”মানে?” আমি অবাক হয়ে বললাম।
সাগ্নিক বলল, ”ঝাড়খণ্ডের টেররিস্টরা এখানে লুকিয়ে চুরিয়ে ঢুকে পড়ছে। গা ঢাকা দিয়ে বসে থাকছে, অথচ তাদের ধরতে পারছি না। আমি পৌঁছনোর আগেই ব্যাটারা কেমন করে যেন খবর পেয়ে পিঠটান দিচ্ছে। যাগগে, ওসব কথা থাক। তুই এসেছিস, এখন কদিন শুধু তোকে নিয়ে বেড়াব।”
বিধনি থানার পেছনেই সাগ্নিকের ছবির মতন সুন্দর কোয়ার্টার। লাল টালিতে ছাওয়া একতলা বাংলোবাড়ি। চারিদিকে ফুলের বাগান। ওর হেল্পিং—হ্যান্ড মধুদার মতন এত ভালো মানুষ দেখাই যায় না। আমি পৌঁছনো মাত্র আমাকে যে কীভাবে যত্ন করবেন তাই নিয়েই অস্থির হয়ে উঠলেন। যাই হোক, চানটান সেরে, মধুদার বানানো গরম গরম ফ্রায়েড রাইস আর চিকেন রেজালা দিয়ে লাঞ্চ সেরে বারান্দায় বেরিয়ে এসে দেখলাম, সাগ্নিক গম্ভীর মুখে একটা বেতের চেয়ারে বসে রয়েছে। পাজামা পাঞ্জাবি ছেড়ে আবার ইউনিফর্ম, টুপি সব পরে নিয়েছে, এমনকী জুতোটাও।
অবাক হয়ে বললাম, ”তুই কি আবার বেরোবি না কি?”
ও আমাকে পাশের বেতের চেয়ারটায় বসতে বলল। তারপর খুব দুঃখিত সুরে বলল, ”পার্থ, আমার এত খারাপ লাগছে তোকে কেমন করে বোঝাব। কিছুক্ষণ আগেই একটা মার্ডারের খবর এল। একবার গিয়ে ইনভেস্টিগেট না করলেই নয়। জায়গাটা এখান থেকে একটু দূরও আছে। অবশ্য একজন হাবিলদারকে অলরেডি ওখানে পাঠিয়ে দিয়েছে, ডেডবডি পাহারা দেওয়ার জন্যে। কাজেই আমি একটু দেরি করে বেরোলেও অসুবিধে নেই। কিন্তু তুই একা একা কী করবি?”
আমি বললাম, ”এর জন্যে এত সঙ্কুচিত হচ্ছিস কেন? পুলিশের চাকরিতে এরকম তো হতেই পারে। একটা কাজ করি না। যদি অসুবিধে না থাকে, তাহলে আমিও তোর সঙ্গে ঘুরে আসি? একটু বেড়ানোও হবে, আর বলা যায় না, কলকাতায় আমার কাগজে পাঠানোর মতন একটা রোমহর্ষক খবরও পেয়ে যেতে পারি।”
সাগ্নিক খুব খুশি হয়ে আমার হাতটা জড়িয়ে ধরে বলল, ”তুই সত্যি যাবি পার্থ? তাহলে তো খুব ভালো হয়। চল, আর দেরি করব না। যেতে যেতে তোকে কেসটা বলব।”
দুই
জিপ ড্রাইভ করতে করতে খুনের ঘটনাটা সম্বন্ধে সাগ্নিক আমাকে যা জানাল তা হল এই—
বিধনি থেকে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার পশ্চিমে একটা জঙ্গলে ঢাকা ছোট গ্রাম আছে, নাম সিরহুল। গ্রামের বাইরে নদী। নদীর নামও সিরহুল। নদীর ওপারে অনেকখানি কাশে ঢাকা প্রান্তর। সেই প্রান্তর গিয়ে মিশেছে ঝাড়খণ্ডের জঙ্গলে। কাশবনের মধ্যে একটু পরিষ্কার জায়গায় একটা মাত্র কুঁড়েঘর। ওটাই ছিল শিবসাধুর আস্তানা।
শিবসাধুর বয়স ষাট পঁয়ষট্টি হবে। সাধুদের মতনই জটা দাড়ি রক্তবস্ত্র সবই ছিল তার। সিরহুল আর তার আশপাশের গ্রামের লোকেরা জানত, শিবসাধুর নানারকম অলৌকিক ক্ষমতা আছে। ঝাঁড়ফুক, মারনউচাটন এসবে সে না কি সিদ্ধহস্ত। মুখে কেউ স্বীকার না করলেও, গ্রামের অনেকেই রাতের অন্ধকারে শিবসাধুর সঙ্গে দেখা করত। টাকাপয়সা দিয়ে শত্রুকে বাণ মারাত। নিজেদের ভাগ্যগণনাও করিয়ে আসত। সকলেই একটা কথা স্বীকার করত, শিবসাধু লোকটা ঈশ্বরের উপাসক ছিল না, ছিল শয়তানের সাধক।
মারণউচাটন ছাড়া শিবসাধুর আরেকটা গুণ ছিল— সে খুব ভালো উল্কি আঁকতে পারত। শুধু কালো বা নীল উল্কি নয়, নানারকম গাছের রসটস দিয়ে রঙিন উল্কি আঁকতেও সে ছিল ওস্তাদ। আদিবাসীদের উল্কিপ্রীতির কথা কে না জানে? তারা প্রায়ই শিবসাধুর কাছে গিয়ে পয়সা দিয়ে উল্কি আঁকিয়ে আনত।
সেই শিবসাধুই খুন হয়েছে। আজ সকালে গ্রামের কয়েকটা মেয়ে উল্কি আঁকাতে গিয়ে দেখে তার ঘরের দরজা খোলা, আর ঘরের মেঝেয় রক্তস্রোতের মধ্যে উপুড় হয়ে পড়ে আছে শিবসাধু।
আমি বললাম, ”এরকম একজন মানুষকে কে খুন করল? কেনই বা করল? সাধুসন্ন্যাসীদের গায়ে হাত দেওয়ার সাহস তো সাধারণ গ্রামবাসীদের থাকে না। তার ওপরে যার অলৌকিক ক্ষমতার ওপরে তাদের এত বিশ্বাস ছিল।”
সাগ্নিক বলল, ”ঠিকই বলেছিস। সাধারণ গ্রামবাসীরা শিবসাধুকে খুন করেনি। করেছে টেররিস্টরা।”
”টেররিস্টরা!” আমি অবাক হয়ে সাগ্নিকের মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। ”টেররিস্টদের সঙ্গে নির্জন নদীর চরে বসবাসকারী এক সন্ন্যাসীর কী সম্পর্ক?”
সাগ্নিক বলল, ”খবর পেয়েছি, রিসেন্টলি এরকম একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। জানিস নিশ্চয়, সন্ত্রাসবাদীদের মধ্যে ছোট ছোট অনেক দল উপদল রয়েছে। এক একটা দলের এক একরকম চিহ্ন বা লোগো। ওরা বুকে বা পিঠে সেই চিহ্ন উল্কি দিয়ে আঁকিয়ে নেয়, যাতে নিজের দলের সদস্যকে চিনতে অসুবিধে না হয়। সেরকমই একটা নতুন গজিয়ে ওঠা দলের সদস্যরা শিবসাধুর কাছে উল্কি আঁকতে আসত।”
আমি বললাম, ”কিন্তু তাতে তো শিবসাধুর সঙ্গে ওদের বন্ধুত্বই গড়ে উঠার কথা। তাকে মারবে কেন?”
সাগ্নিক বলল, ”সঠিক কারণটা এখনই বলতে পারব না। কিন্তু ধর যদি শিবসাধু ওদের কারুর পরিচয় জেনে ফেলে আর তারপর ব্ল্যাকমেলিং শুরু করে। তখন খুন করা ছাড়া উপায় কী?”
আমি বললাম, ”কিন্তু সাগ্নিক, শিবসাধু যদি ওদের কারুর পরিচয় জেনেই থাকত, তাতেই বা ক্ষতি কী ছিল? টেররিস্টরা তো থাকে জঙ্গলে। পরিচয় জানলে তো তাকে ধরতে পুলিশের বাড়তি কোনো সুবিধে হত না।”
”উঁহু, এটা তোর একেবারে ভুল ধারণা।”, বলল সাগ্নিক। ”ওরা অপারেশনের সময় ছাড়া অন্য সময় গ্রামবাসীদের মধ্যেই মিশে থাকে। এমনকী শুনলে অবাক হবি, বিভিন্ন সরকারি অফিসে, এমনকী পুলিশের মধ্যেও ওদের স্পাই মিশে রয়েছে। আমার দৃঢ় ধারণা, শিবসাধু সেরকমই কাউকে চিনতে পেরে গিয়েছিল। এমন কাউকে, যে খুব গুরুত্বপূর্ণ পজিশনে গা ঢাকা দিয়ে রয়েছে, খুব সাংঘাতিক সব ইনফর্মেশন নিয়মিত টেররিস্টদের হাতে পৌঁছিয়ে দিচ্ছে। শিবসাধু নিশ্চয় ওদের কাছে সেই পরিচয় লুকিয়ে রাখার জন্যে প্রচুর পয়সা চেয়েছিল। ওরা পয়সার বদলে শিবসাধুর মাথায় বুলেট পুরে দিয়েছে।”
তিন
কথা বলতে বলতে আমরা একটা ছোট গ্রাম পেরোলাম। বুঝলাম এটাই সেই সিরহুল গ্রাম। তারপর একটা নদী। শীতকাল বলে নদীতে জল কম ছিল। আমাদের জিপ দিব্যি নুড়ি পাথরের ওপর দিয়ে হেলতে দুলতে ওপারে পৌঁছল। তারপরেই দেখতে পেলাম শিবসাধুর ডেরা।
সাগ্নিক যেমন বলেছিল, কাশের জঙ্গলের মধ্যে একটা পরিষ্কার নিকোনো উঠোন। তার মাঝখানে ছোট একটা ঘর। আমাদের জিপ ঘরটার সামনে গিয়ে দাঁড়ানো মাত্র খাঁকি পোশাক পরা এক হাবিলদার দৌড়ে এসে স্যালুট করে দাঁড়ালেন। বুঝলাম এঁনাকেই সাগ্নিক লাশ পাহারা দেওয়ার জন্য পাঠিয়ে দিয়েছিল। সাগ্নিক বলল, ”জীবনবাবু। দরজাটা তালা দিয়ে রেখেছেন তো?”
”হ্যাঁ, স্যার।”
”ঠিক আছে। একটু খুলে দিন। আমরা ভেতরটা দেখব।”
ঘরটায় ঢোকা মাত্র আমার সারা শরীরে কেমন যেন একটা অস্বস্তি ছড়িয়ে গেল। সেটা শুধু মেঝের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে থাকা প্রাণহীন দেহটার জন্যে নয়। দেয়ালে টাঙানো হাড়, মড়ার মাথার খুলি, সাপের খোলস, নানারকমের ডমরু আর মাদলের মতন বাদ্যযন্ত্র— সেগুলোও অস্বস্তিটার জন্যে দায়ী।
সাগ্নিক উবু হয়ে বসে শিবসাধুর মাথার পেছন দিকটা দেখল। ওইখান থেকেই রক্ত গড়িয়ে এসে মেঝেতে পড়েছিল। সাধুর একটা হাত একটু তুলবার চেষ্টা করেই সাগ্নিক আবার নামিয়ে দিল। বলল, ”রাইগার মর্টিস সেট করে গেছে। মানে কাল রাত্তিরে খুন হয়েছে।”
তারপর মাথার পেছনের ইনজুরিটা ভালো করে দেখে বলল, ”একটাই গুলি খরচা হয়েছে। পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে তার বেশি লাগবেই বা কেন? কিন্তু…”
কথাটা শেষ না করেই সাগ্নিক কেমন যেন হতচকিত ভাব নিয়ে ঘরটার মধ্যে এদিক ওদিক ঘুরতে লাগল।
আমি বললাম, ”কী হল?”
”বুলেটের খোলটা তো এই ঘরেই পড়ে থাকবার কথা। সেটা কোথায় গেল?”
বুলেটের খোল পাওয়া গেল না। পাওয়া গেল না আরও অনেক কিছুই। কোনো পায়ের ছাপ নেই, ফিঙ্গার প্রিন্ট নেই। কারা যেন খুন হওয়ার পর যত্ন করে সে সব মুছে ফেলেছে।
ভুরু কুঁচকে গেল সাগ্নিকের। বলল, ”এটা কেমন হল! তার মানে কি সকালে যে মেয়েগুলো মৃতদেহ আবিষ্কার করেছিল তাদের মধ্যেই টেররিস্টদের লোক লুকিয়ে ছিল? ভালো করে দেখতে হবে তো ব্যাপারটা।”
শিবসাধুর হাতের কাছে কটা জিনিস পড়ে ছিল। সেগুলো ঘাঁটতে ঘাঁটতে সাগ্নিক বলল, ”এই দ্যাখ পার্থ। ট্যাটু করার, মানে উল্কি আঁকার সাজসরঞ্জাম। ছুঁচ, রং, তুলো আরও কীসব যেন। তার মানে শিবসাধু যখন ট্যাটু আঁকার প্রস্তুতি নিতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল, তখনই তাকে খুন করা হয়েছে। আরে, এটা কী?”
ট্যাটুর ব্যাগ থেকে একটা ট্রেসিং—পেপারের মতন কাগজ হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল সাগ্নিক। টর্চের আলোয় কাগজটাকে মেলে ধরে বলল, ”পার্থ, দ্যাখ এটা ইন্টারেস্টিং জিনিস। ট্রেসিং—পেপারের ওপর কাঁকড়াবিছের নকশা। এই ট্রেসিং—পেপার থেকে চামড়ার ওপর ছাপ তুলে ট্যাটু আঁকা হয়। তার মানে কি নতুন টেরস্টিদলের লোগো হচ্ছে কাঁকড়াবিছে? কে? কে ওখানে?”
দরজার কাছ থেকে একটা ছায়া সরে যেতে গিয়েও সাগ্নিকের চিৎকারে আবার এগিয়ে এল। ছায়ার পেছনে মানুষটাকেও দেখা গেল। অন্য কেউ নয়, হাবিলদার জীবনবাবু।
”উঁকি মারছিলেন কেন? কিছু বলার থাকলে ভেতরে আসবেন তো।”
”না স্যার। মানে আবহাওয়াটা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। আমাদের এবার রওনা হলে ভালো হত। ওই নদীতে যদি হড়পা বান আসে, তাহলে আমরা জিপ নিয়ে পেরোতে পারব না।”
জীবনবাবুর কথাটা সত্যি। হঠাৎই অসময়ের বৃষ্টি নেমেছে। সন্ধের আবছা আলোয় নদীর দিকে চেয়ে মনে হল, জল ইতিমধ্যেই অনেকটা বেড়ে গেছে। সাগ্নিক বলল, ”তাহলে একটা কাজ করুন। ঘরটা আর তালা দেওয়ার দরকার নেই। আপনি দরজায় গার্ড দিন। আমি আর এই সাহেব সিরহুল থেকে কয়েকজন লোক নিয়ে আসছি। তারা আপনার সঙ্গে ধরাধরি করে বডিটা জিপের পেছনে তুলে দেবে।”
জীবনবাবুকে পাহারায় রেখে আমরা জিপ নিয়ে নদী পেরোলাম। যখন প্রায় সিরহুল গ্রামের কাছাকাছি পৌঁছিয়ে গেছি, তখনই হঠাৎ শিবসাধুর ডেরার দিক থেকে মানুষের গলার তীক্ষ্ন আর্তনাদ ভেসে এল। ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষে জিপটাকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে সাগ্নিক আমাকে জিজ্ঞেস করল, ”তুই কিছু শুনলি পার্থ?”
আমি বললাম, ”হ্যাঁ। কে যেন চিৎকার করে উঠল।”
”তাহলে ঠিকই শুনেছি। জীবনবাবুকে কেউ অ্যাটাক করল না কি?”— বালি কাদার ওপরেই জিপটাকে ইউ—টার্ন করিয়ে সাগ্নিক শিবসাধুর আস্তানার দিকে ফিরে চলল। রাস্তা পেছল, স্পিড তোলা যাচ্ছিল না। শিবসাধুর আস্তানা অবধি ফিরে যেতে আমাদের অনেকটাই সময় লাগল।
ততক্ষণে পুরোপুরি অন্ধকার নেমে গেছে। বৃষ্টির জোরও বেড়েছে। জিপ থেকে নেমে আমরা দুজনে দুটো চার সেলের টর্চ জ্বালিয়ে শিবসাধুর ঘরের দিকে পা চালালাম। সামনে সাগ্নিক। আমি পেছনে। সাগ্নিকের হাতে টর্চ ছাড়াও একটা রিভলবার। কিছুক্ষণবাদে শিবসাধুর ঘরের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আমরা একসঙ্গেই ঘরের মেঝের দিকে টর্চের আলো ফেললাম।
চার
সেখানে এখন শিবসাধুর মৃতদেহ পড়ে নেই। তার বদলে অন্য একটা মৃতদেহ পড়ে আছে। মৃত মানুষটার চোখদুটো আতঙ্কে বিস্ফারিত, খাঁকি উর্দিটাও ছিঁড়ে ফালা ফালা হয়ে গেছে। তবু চিনতে অসুবিধে হচ্ছে না। হাবিলদার জীবনবাবু।
আমরা আরও দু’পা এগিয়ে গেলাম। জীবনবাবুর বুকের ওপর একটা পুরনো উল্কি— কাঁকড়াবিছের। তার নিচে আরও একটা নাম, একটা গ্রামের। সুঁচের টাটকা ফোঁড়গুলো থেকে এখনও রক্ত গড়াচ্ছে।
সাগ্নিক সেইদিক থেকে চোখ না সরিয়েই ফিসফিস করে বলল, ”তার মানে জীবনবাবু একজন বিশ্বাসঘাতক! টেররিস্ট। আমাদের মধ্যে মিশেছিলেন। এর আগে যখন শিবসাধুর কাছে কাঁকড়াবিছের উল্কি আঁকাতে এসেছিলেন তখন শিবসাধু ওঁনাকে চিনে ফেলেছিল। ওঁনার জন্যেই শিবসাধুকে খুন হতে হয়েছে।
”বুঝলি পার্থ, এখন মনে পড়ছে, আজ সকালে লাশ পাহারা দেওয়ার ডিউটি—টা জীবনবাবু একরকম জোর করেই আমার কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছিলেন। উদ্দেশ্যটা বুঝতে পারছিস তো? সমস্ত এভিডেন্স লোপাট করা।
”তবু ট্রেসিং—পেপারটা ওঁনার নজর এড়িয়ে গিয়েছিল। এখন ওঁটাকে সরাবার জন্যে ঘরে ঢুকেছিলেন। আর ঘরে ঢুকতেই …”
আমি বললাম, ”ঘরে ঢোকার পর কে ওঁনাকে মারল সাগ্নিক? ওঁনার বুকের ওপর নতুন করে উল্কিতে লেখা ওই নামধামগুলোই বা কাদের?”
”বুঝতে পারছিস না? নামগুলো ওঁনার দলের বাকি টেররিস্টদের। শুধু নাম নয়, এই মুহূর্তে ওরা যেখানে লুকিয়ে আছে, সেই গ্রামের নামও উল্কি দিয়ে লিখে রেখে গেছে। আমার কাজ শুধু ওদের ধরা।”
”কিন্তু কে? কে লিখে রেখে গেছে? কে খুন করল জীবনবাবুকে? শিবসাধুর লাশটাই বা কোথায় গেল?”
আমার কথার উত্তর না দিয়ে সাগ্নিক বাইরে বেরিয়ে এল। পেছন পেছন আমি। সাগ্নিক ওর টর্চের আলোটা উঠোনের ওপর ফেলল। দেখলাম কাদার ওপর দিয়ে দুটো টাটকা পায়ের ছাপ ঘরের পেছনদিকে চলে গেছে। আমরা ছাপগুলোকে অনুসরণ করে সেদিকে গেলাম। জ্বলন্ত টর্চটাকে তুলে ধরে কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘোরাতেই চোখে পড়ল সেই অভাবনীয় দৃশ্য— অনেক দূরে একটা মানুষের মূর্তি টলতে টলতে কাশবন ভেঙে জঙ্গলের দিকে এগিয়ে চলেছে।
এতদূর থেকেও বোঝা যাচ্ছিল তার মুখ জটা দাড়িতে ঢাকা। বৃষ্টির জলে গায়ের সঙ্গে লেপটে আছে গাঢ় রঙের ধুতি আর চাদর।
মাথার পেছনের বুলেটের ক্ষতটা অবশ্য এতদূর থেকে দেখা সম্ভব নয়।
টর্চটা নিভিয়ে দিয়ে সাগ্নিক বলল, যে মৃতদেহ উঠে দাঁড়ায়, খুন করে, উল্কি এঁকে চলে যায়, তাকে কি আর লাশ বলা যায় পার্থ? না, লাশ নয়। শিবসাধু এখন পিশাচ।”