প্রিয়নাথের কথা

প্রিয়নাথের কথা

। এক।

সুতানুটি আর কলকাতার আশেপাশে বসত আর কারখানা স্থাপনের পর ইংরেজ বণিকরাই জমিদারের ক্ষমতা দখল করল। ফলে আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বও তাদের উপরেই চাপে। ১৭০৪ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ফোর্ট উইলিয়ামে এক সভায় আলোচনার পর কোম্পানি একজন হেড পিয়ন, পঁয়তাল্লিশজন পিয়ন, দুজন বর্শাধারী আর কুড়িজন গোয়ালাকে বেতনভুক পাহারাদার হিসেবে নিযুক্ত করে। এঁরাই ছিলেন কলকাতার প্রথম পুলিশ বাহিনী। ধীরে ধীরে কলকাতার ব্যাপ্তি বাড়তে থাকে। গড়ে ওঠে একের পর এক থানা। ১৮০০ সালে ওয়েলেসলি কমিটি কলকাতাকে চল্লিশটা থানায় বিভক্ত করেন। তাদের পনেরোটা ছিল সাহেব মহল্লায়, বাকিগুলো নেটিভদের ব্ল্যাক টাউনে। স্যামুয়েল ডেভিসকে সুপারিন্টেন্ডেন্ট জেনারেল অফ পুলিশ পদে নিযুক্ত করা হয়। বরকন্দাজরা ছিল বাউন্ডারি গার্ড। নজর রাখত আশেপাশের কোনও ডাকাত কলকাতায় না ঢুকে পড়ে। চৌকিদাররা রাতপাহারা দিত, দাঙ্গা বাধলেই ছুটে যেত টাউন গার্ড। প্রথম দিকে শিক্ষিত বাঙালি যুবকরা পুলিশে যেতে আগ্রহ দেখাত না ঠিকই, কিন্তু ১৮৬৮ থেকে বাঙালিরাও ইনস্পেক্টর পদে যোগ দিতে থাকেন। টাউন কলকাতায় জনবসতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে অপরাধ। পাপ। এদিকে পুলিশরা প্রায় সবাই দুর্নীতিতে ভরা, অপরাধীর বন্ধু আর নিরীহের যম। মানুষ পারতপক্ষে পুলিশের দ্বারস্থ হয় না। পুলিশের নানা গোপন রিপোর্টে একের পর এক তাঁদের অপদার্থতার কথা। এসব দেখে বিরক্ত হয়ে উঠলেন এক সাহেব। নাম স্টুয়ার্ট স্যান্ডার্স হগ। ১৮৬৬-র মাঝামাঝি বর্ধমানের ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট থেকে বদলি করে তাঁকে নিয়ে আসা হল পুলিশ কমিশনার আর কলকাতা কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান বানিয়ে। চেয়ারে বসে হগ সাহেব প্রথমেই রিপোর্ট দিলেন, “ইউরোপীয় অফিসাররা মদ্যপ, অপদার্থ আর তাঁদের আচরণ সন্তোষজনক না। স্বয়ং পুলিশ সুপার ফেরিস অকর্মণ্য।” এখানেই থামলেন না হগ। ঠিক করলেন নিজের হাতে খোলনলচে বদলে দেবেন গোটা সিস্টেমের। চেয়ারম্যান হিসেবে তৈরি করলেন ঝাঁ চকচকে একটা বাজার। লর্ড কার্জন তার নাম রাখলেন ‘হগ মার্কেট’। এর মধ্যে এমন একটা ঘটনা ঘটে গেল যে, হগ সাহেব আর চুপ করে বসে থাকতে পারলেন না।

১৮৬৮ সালের পয়লা এপ্রিল রাত দুটোয় এক বিট কনস্টেবল আমহার্স্ট স্ট্রিট দিয়ে যেতে যেতে পেভমেন্টের ওপরে এক তালগোল পাকানো দেহ দেখতে পান। এক স্ত্রীলোকের দেহ। কোমরের তলায় বাঁ হাত আর মুষ্টিবদ্ধ ডান হাত ডান কানের কাছে। ধারালো কোনও অস্ত্র দিয়ে কণ্ঠনালি সরাসরি কাটা, গোটা দেহ যেন রক্তে ডুবে আছে। স্ত্রীলোকটি যুবতি, সুন্দরী এবং খ্রিস্টান। কলকাতার পত্রিকাগুলো সোচ্চার হয়ে উঠল, অবিলম্বে অপরাধীকে শাস্তি দিতে হবে। এদিকে এতদিন গয়ংগচ্ছ করে কাটানো কলকাতা পুলিশ বুঝতেই পারছিল না কী করবে। এবার সত্যি সত্যি চটে গেলেন হগ। নিজের হাতে বাছাই করা কিছু দক্ষ অফিসারদের নিয়ে একটা টিম তৈরি করলেন। তাঁরা কিছুদিনের মধ্যেই জানতে পারলেন মৃতার পরিচয়। রোজ ব্রাউন, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, দেহপসারিণী। রিচার্ড রিড নামের এক অফিসার প্রায় একা হাতে অপরাধীকে ধরলেন। হগের মুখরক্ষা হল। কিন্তু তিনি বুঝে গেলেন এইভাবে চলবে না। ১৮৬৮ সালের ২৮ নভেম্বর, পুলিশ কমিশনার হিসেবে তিনি এক অর্ডার জারি করলেন। কলকাতা পুলিশের ইতিহাসে সেই ১৪৯ নম্বর অর্ডারটা ঐতিহাসিক, কারণ এই এক অর্ডারেই একেবারে বাছাই করা সৎ পুলিশ অফিসারদের নিয়ে গঠিত হল কলকাতা পুলিশের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট। তার ঠিক দশ বছর বাদে এই বিভাগে যোগদান করল প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়, আর সে এখন জানে হগ সাহেবের সাধের ডিপার্টমেন্টের সম্মান আবার ধুলোয় মিশল বলে। বড়োলাট কোনওক্রমে পত্রিকাদের ঠেকিয়ে রেখেছেন, শোনা গেছে ঘুষ দিয়ে। কিন্তু লোকের মুখকে থামাবে কে? প্রথম খুনটার কথা বেশি লোক জানতে না পারলেও দিন দশেক আগে করিন্থিয়ান থিয়েটারে পরপর দুই ম্যাজিশিয়ানের মৃত্যু তো সবার চোখের সামনে হয়েছে! বড়োলাট নিজে উপস্থিত ছিলেন। প্রিয়নাথ ছিল। এমনটা যে হতে পারে তা সে ভাবতেও পারেনি। নিজের অফিসে বসে আবার সেই অভিশপ্ত রাতের কথা চিন্তা করছিল প্রিয়নাথ। ঘটনাগুলোকে সাজাচ্ছিল একের পর এক। সেদিন সন্ধেবেলা আচমকা টমসন সাহেব তাকে বলেন ম্যাজিক শো-তে যাবার জন্য। বড়োলাট নাকি যাবেন ঠিক করেছেন। বড়োলাট বসেছিলেন একেবারে সামনের রো-তে। প্রিয়নাথের দায়িত্ব ছিল তাঁর দেখভাল করা। তাই ম্যাজিকের দিকে নজর না দিয়ে তাঁকেই দেখছিল প্রিয়নাথ। খুব অস্থির ছিলেন বড়োলাট। বারবার ঘড়ি দেখছিলেন। ঘাম মুছছিলেন ডিসেম্বরের এই শীতেও। যেন আঁচ করছিলেন কিছু একটা হবে। কার্টার যখন তৈমুরকে দেখাল, তখন অনেকের মতো প্রিয়নাথও চমকে গেছিল। তারপরই দেখল পকেট থেকে বড়োলাট কাগজের একটা টুকরো বার করে নিজের হাতের তেলোতে লুকিয়ে ফেললেন খুব তাড়াতাড়ি। সে কাগজে কী ছিল প্রিয়নাথ জানে না। একটু বাদে কার্টার বড়োলাটকে মঞ্চে ডাকলেন। কাগজের ব্যাপারটা প্রিয়নাথের মাথায় ছিল না। বড়োলাট নেমে এলেন। নিজের জায়গায় বসলেন। বারবার ঘড়ি দেখতে লাগলেন। তিনি কি কিছুর জন্যে অপেক্ষা করছিলেন? যদি করেন, তো কীসের জন্যে?

প্রিয়নাথ দলের সহযোগীদের থেকে নেওয়া জবানবন্দির কাগজগুলো টেনে নিল। প্রায় সবই একরকম। এরা মূলত ব্রিটিশ। লন্ডনের আশেপাশেই থাকে। গরিব। টাকার জন্য কার্টারের দলে যোগ দিয়েছে। ভারতে আসার মাস দুই আগে কার্টারের এক সহযোগী এদের ট্রেনিং দিয়ে পাঠিয়েছে। সবাই নতুন। পরিচয় হয়েছে জাহাজে। পুরোনোদের মধ্যে একজনই ছিল। বুড়ো জর্জ হগ। সে প্রায় ছোটোবেলা থেকে কার্টারকে মানুষ করেছে। কার্টার তাকে ছাড়া এক পা-ও চলতেন না। কার্টারের এমন মৃত্যু বুড়ো মেনে নিতে পারছিল না। কেঁদেই যাচ্ছিল ক্রমাগত। প্রিয়নাথ তার জবানবন্দিটাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দ্যাখে—

—আপনার নাম?

—জর্জ। জর্জ হগ।

—লন্ডনেই থাকেন?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। বেকার স্ট্রিটের পাশে। এক বস্তিতে।

—কার্টারকে কতদিন চেনেন?

—ওর নাম কার্টার না। জনসন। হ্যারি জনসন। ওর বাপ লিন্ডসে ছিল নামকরা চোর, খুনে। ওর মা, শার্লি কাজ করত ওয়ার্ক হাউসে। থাকত আমার বস্তিতেই। হ্যারি আমার কাছেই সারাদিন কাটাত। বাপটা তো সুযোগ পেলেই ওকে মেরে হাতের সুখ করত। তাই বাপের কাছে যেত না। মাকে কিন্তু খুব ভালোবাসত ছোকরা। মা বাড়িতে এলেই পায়ে পায়ে ঘুরত।

—তারপর?

—তারপর আর কী? ওর বাবা মরে গেল। মানে কেউ একটা মেরে ফেলে রেখেছিল আমাদের বস্তিতে। সে এক বীভৎস ব্যাপার। গলার নিচ থেকে পেট অবধি চেরা। নাড়িভুঁড়ি সব বেরিয়ে রয়েছে। গায়ে অজস্র আঘাতের চিহ্ন। চেনা যাচ্ছে না। অণ্ডকোশ কাটা। খুব রাগ না থাকলে কেউ এমন করে না। কোনও মহিলাঘটিত ব্যাপার হবে… বোঝেনই তো সব… মা-টা পাগল হয়ে গেল সেই দেখে। ছেলে মা-কে বেডলাম মানসিক হাসপাতালে ভরতি করে পালিয়ে গেল।

—পালিয়ে গেল? কোথায়?

—অনেক পরে যখন ফিরে এল তখন দেখা করতে এসেছিল। আমি চিনতেই পারিনি। নাম বদলেছে। পোশাক বদলেছে। পালিয়ে নাকি কোন এক ফরাসি জাদুকরের চ্যালা হয়ে ছিল কিছুদিন। তিনি নাকি ওঁকে ম্যাজিকের নানা বিদ্যা শিখিয়েছেন। তিনি মারা যেতেই ও নাম বদলে নিজেই ম্যাজিক দেখানো শুরু করেছে। আমাকে বলল, “জর্জ কাকা, আপনি তো একলা মানুষ, আমার দলে চলে আসুন।” আমিও হাত পা ঝাড়া… চলে গেলাম ওর দলে। তখন কি জানতাম, আমার চোখের সামনে ওকে এভাবে মরতে দেখতে হবে…

—কোন ম্যাজিশিয়ানের কাছে গেছিল, কিছু বলেছে?

—হ্যাঁ, রবার্ট হুডিন। সেইজন্যেই তো রবার্ট কার্টার নাম নিয়েছিল। ম্যাজিশিয়ান হবার পরে আর আগের কারও সঙ্গে সম্পর্ক রাখেনি ও, আমি ছাড়া। অবশ্য, শার্লিকে দেখতে যেত নিয়মিত।

—কার্টার, মানে হ্যারির মা এখনও বেঁচে আছেন?

—হ্যাঁ। বেডলামেই ওঁর চিকিৎসা চলছে।

—হ্যারির আর কোনও আত্মীয়স্বজন?

—ছোটো একটা ভাই আছে। একেবারেই বখাটে। যতসব উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলেপিলের সঙ্গে মেশে। হ্যারির থেকে মাঝে মাঝে টাকা চাইতে যেত। শুরুর দিকে দিত। শেষে আমি মানা করায় আর দিত না।

—সে ভাইয়ের নাম কী?

—উইগিন্স। উইগিন্স জনসন।

—আচ্ছা, এবার চিন-সু-লিনের কথায় আসি। মানে রিচার্ড হ্যালিডে। একে চিনতেন আপনি?

—না। হ্যারি চিনত। একেবারে শেষ মুহূর্তে ওকে দলে আনা হয়। খুব উদ্ধত। হ্যারির মুখে মুখে কথা বলত। আমরা কেউ সাহস করতাম না। ও বলত।

—আর হ্যারি? হ্যারি প্রতিবাদ করত না?

—একদম না। মাথা নিচু করে শুনত। আমি কয়েকবার বলেছিলাম, কেন কিছু বলে না? অদ্ভুত জবাব দিয়েছিল।

—কী জবাব?

—বলেছিল ‘পাপের প্রায়শ্চিত্ত’।

—কী পাপ?

—জানি না।

—হ্যালিডে কেমন ম্যাজিক দেখাত?

—নেহাত মামুলি। কোনও সঙ্গী নিত না। শো-এর পর সোজা চলে যেত।

—কোথায়?

—জানি না, তবে শুনেছি বেশ্যাপাড়ায় নিয়মিত যাতায়াত ছিল। সে তো বোধহয় আরও একজনের ছিল।

—সে কে?

—সাইগারসন। একেও শেষ মুহূর্তে ঢোকানো হয়। হ্যারি একে একদম পছন্দ করত না। ওর দাদা নাকি ব্রিটিশ সরকারের বড়ো হোমরাচোমরা। সত্যি মিথ্যে জানা নেই অবশ্য। তাই কবিতা বলতে একে ডাকা হয়েছে। এই ছোকরা চুপচাপ থাকে। কথা বলে না। বিশেষ মেশেও না কারও সঙ্গে। মাঝে মাঝে কোথায় হাওয়া হয়ে যায়। মাঝে মাঝে দলের সঙ্গেই থাকে। নিজের ঘরে একলা বসে বেহালা বাজায়।

—আপনার সঙ্গে আলাপ হয়েছে?

—একবারই। আর আমার সেটা মনে আছে, কারণ ও আমাকে একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করেছিল।

—কী সেটা?

—হ্যারির বাবার চোখের মণির রং কী ছিল?

—কী রং?

—নীল, ঘন নীল।

—শেষ প্রশ্ন। এই গোটা ঘটনায় সবার হিসেব পাওয়া যাচ্ছে। একজনের বাদে। রাখহরি। সে যেন হাওয়াতে মিলিয়ে গেছে। আপনি তার পরিচয় জানেন?

—নাহহ। সেই ভয়ংকর রাতে আমিও তাকে প্রথমবার দেখি। সেই শেষবার।

একের পর এক প্রশ্ন জাগছে প্রিয়নাথের মনে। রাখহরি তবে কে? কোথা থেকে এল? গেলই বা কোথায়? আর সাইগারসন? মেডিক্যাল কলেজের লাশকাটা ঘরে কী করছিলেন তিনি? উইংসের পাশে উঁকি মারছিলেন কেন বারবার? কার্টারকে ধরে ধরে নিয়ে যাবার আগে হেনরি সাহেবের কানে কী বলেছিলেন? কার্টারকে ঘর অবধি পৌঁছে দিয়েছিলেন সাইগারসন। এমনটাই বলেছিলেন তিনি। নিয়ে যাবার সময়ই নাকি কার্টারের জ্ঞান ফিরে আসে। কার্টার নিজে পায়ে হেঁটে গ্রিনরুমে ঢুকে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেন। কিন্তু সবাই যখন গুলির শব্দ পেয়ে সেই ঘরে যায়, তখন দরজা আধখোলা। দরজা বন্ধ করার পর আবার দরজা খুলে আত্মহত্যা কেন করতে যাবেন কার্টার? নাকি হ্যারি? একজনের কাছেই সে উত্তর থাকতে পারে। যে শেষবার কার্টারকে জীবিত দেখেছে। সাইগারসন। প্রিয়নাথ বুঝল, তাকে অন্তত একবার সাইগারসনের সঙ্গে কথা বলতে হবে। অনেকগুলো রাস্তা তার কাছে গিয়েই গিঁট পাকিয়ে আছে।

। দুই।

অষ্টাদশ শতকে কলকাতা শহরে আসা সাহেব মেমসাহেবরা তাঁদের সঙ্গে লন্ডনের হাওয়াও বয়ে নিয়ে এসেছিলেন। তাঁরা কলকাতাতেই আমোদপ্রমোদের জন্য বেশ কিছু পাঞ্চহাউস আর ট্যাভার্ন খুলে বসেন। ইংরেজরা নিজের দেশের মডেলে এইসব আড্ডাখানাগুলো গড়ে তুলেছিলেন। বাংলার মানুষের সমাজজীবনের থেকে এরা একেবারেই বিচ্ছিন্ন ছিল। ট্যাঙ্কস্কোয়ার (ডালহৌসি), লালবাজার আর কসাইতলা (বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট) ছিল তখনকার কলকাতার প্রাণকেন্দ্র। এই অঞ্চলেই আদিযুগের কলকাতার ট্যাভার্ন আর পাঞ্চহাউসগুলো গড়ে উঠেছিল। এদের মধ্যে সেরা ছিল ১৭৮০ সালে লালবাজারের হারমোনিক ট্যাভার্ন। বড়ো বড়ো হোটেলের চেয়েও এই আড্ডাখানার মর্যাদা বেশি ছিল। নিয়মিত বসত চা-কফির মজলিশ। এর আমন্ত্রণের টিকিট পাবার জন্য হাপিত্যেশ করে থাকতেন বড়ো বড়ো ইংরেজ আমলারা। মিসেস ওয়ারেন হেস্টিংস স্বয়ং ছিলেন এর অন্যতম পেট্রন। ১৭৮৫-তে হেস্টিংস বিদায় নিয়ে লন্ডন চলে গেলে হারমোনিকের ভাগ্যও বদলাতে থাকে। প্রথমে কোন এক সুবি সাহেব সেখানে স্কুল খুলে বসেন। সেই স্কুল চলল না বিশেষ। শেষে উনিশ শতকের শুরুতেই ইংরেজ সরকার এই বাড়ির এক অংশে স্থাপন করলেন প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট। ঠিক তার পরে পরেই কলকাতা পুলিশ বিভাগ চালু হতেই এই বাড়ি আর ঠিক পাশে জন পামারের বাড়ি নিয়ে লালবাজারে পুলিশের হেডকোয়ার্টার চালু হল। পামারের বাড়ির একতলার কোণে ছিল গোয়েন্দা বিভাগ, আর সেখানেই প্রিয়নাথের অফিস। অফিস থেকে কয়েক পা হেঁটে গেটের বাইরে দাঁড়াতেই দেখতে পেল একটা খালি পালকি দাঁড়িয়ে। তাতে চেপে প্রিয়নাথ বেহারাদের নির্দেশ দিল, “উইলসন সাহেবের হোটেলে চলো।” ডেভিড উইলসন শহরের সাহেবদের কাছে ডেইন্টি ডেভি নামে পরিচিত ছিলেন। ১৮৩৫ সালে কলকাতায় এসে সাহেব ‘অকল্যান্ড হোটেল অ্যান্ড হল অফ নেশনস’ নামে এক হোটেল খুলে বসেন। ব্যবসা ভালোই চলছিল। তখনকার সেরা হোটেল স্পেন্সেস-এর পরেই লোকে এর নাম করত। ১৮৬৫ নাগাদ উইলসন সাহেব কোনও এক অজানা কারণে হোটেলের নাম বদলে রাখলেন ‘গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল’। কাগজে অবশ্য এ নিয়ে সমালোচনাও হয়েছিল, কিন্তু সাহেব নাম বদলাননি। গাড়োয়ান আর পালকিবেহারারা অবশ্য এখনও উইলসন সাহেবের হোটেলই বলে। এই হোটেলেই কার্টারের গোটা দল আছে। তাদের চলে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু পরপর এই দুই খুনের পর পুলিশ কমিশনার কিছুদিনের জন্য তাদের যাওয়া আটকে দিয়েছেন।

প্রিয়নাথ চলেছে সাইগারসনের সঙ্গে দেখা করতে। এর আগে একবার সে টমসন সাহেবকে বলেছিল সাইগারসনকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। সাহেব অনুমতি দেননি। ওটা নাকি তিনি নিজেই করেছেন। প্রিয়নাথ বুঝতে পারছে কোনও এক অজ্ঞাত কারণে সাহেব সাইগারসনকে আড়াল করছেন। তাই কাউকে না জানিয়েই সে সাইগারসনের সঙ্গে দেখা করবে ঠিক করল। গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের দোতলায় কার্টারের দলকে রাখা হয়েছে। কার্টারের আলাদা ঘর। দরজায় বোর্ড ঝুলছে এখনও, “রবার্ট কার্টার, গ্রেটেস্ট ম্যাজিশিয়ান অফ দ্য ওয়ার্ল্ড।” মানুষটা নেই, বোর্ড রয়ে গেছে। প্রিয়নাথ অজান্তেই কাষ্ঠ হাসি হাসে। আর ঠিক তখনই তার কানে আসে মৃদু একটা বেহালার আওয়াজ। প্রিয়নাথ গানবাজনা বিশেষ বোঝে না, কিন্তু যে বাজাচ্ছে, সে যে দারুণ বাজায় তা বুঝতে সংগীতজ্ঞ হতে হয় না। সাইগারসন ঘরেই আছে। বুড়ো জর্জ বলেছিল ঘরে থাকলে সে একা একা বেহালা বাজায়। লবি দিয়ে হেঁটে বাজনার উৎসের কাছে এসে আবার চমকাল প্রিয়নাথ। সাইগারসনের জন্য আলাদা ঘর! এমন তো হবার কথা না। সাধারণত দলের প্রধান ম্যাজিশিয়ান বা ম্যানেজার আলাদা ঘর পান। বাকিরা একসঙ্গে ডরমেটরিতে থাকেন। কিন্তু এটা কী? সামান্য আবৃত্তি (যেটা সে অর্থে ম্যাজিকের সঙ্গে খুব একটা দরকারিও না) করে একটা আলাদা ঘর? জর্জ বলেছিল এর দাদা নাকি বড়ো হোমরাচোমরা, সেইজন্যেই কি অকর্মণ্য ভাই এসব সুযোগ পাচ্ছে? কে জানে! কিন্তু এর বাজনার হাত যে খাসা তা মানতেই হবে। দরজায় নক করতেই ভিতরের বাজনা থেমে গেল। আবার নক করতে যেতেই প্রিয়নাথ বুঝতে পারল দরজা ভেজানো। ভিতর থেকে আওয়াজ এল, “কাম ইন।”

ভিতরে ঢুকে প্রিয়নাথের মনে হল ঘরে আগুন লেগেছে। ঘন ধোঁয়ায় সারা ঘর ভর্তি। জানলা বন্ধ। একটু ধাতস্থ হতেই বুঝল এ ধোঁয়া কড়া পাইপের ধোঁয়া। প্রিয়নাথ নিজে ধূমপান করে, তবু এই ধোঁয়ায় তার কাশি শুরু হল। সাইগারসনের মুখে কালচে তেলতেলে একটা ক্লে পাইপ আর তা থেকে ভসভসিয়ে ধোঁয়া উঠছে। সাইগারসনের কপালে ভাঁজ, যেন গভীরভাবে কিছু চিন্তা করছিলেন। প্রিয়নাথকে দেখে এগিয়ে এসে ঘরে বসতে বললেন। ক্ষমা চাইলেন ঘরের এই অবস্থার জন্য। খুলে দিলেন জানলা। কিছুটা ধাতস্থ হয়ে কোচে বসার পর প্রথম প্রশ্ন সাইগারসনই করলেন, “বলুন অফিসার, পালকিতে চড়ে আসতে আপনার কোনও অসুবিধা হয়নি তো?”

চমকে উঠল প্রিয়নাথ। ঠিক যেমনটা আগের দিন চমকেছিল। এ তো কার্টারের চেয়েও বড়ো ম্যাজিশিয়ান! কীভাবে জানল সে পালকিতে এসেছে? প্রিয়নাথের মুখের হতভম্ব ভাব বুঝতে পারলেন সাইগারসন। এগিয়ে দিলেন সেদিনের স্টেটসম্যান পত্রিকার একটা খবর। গত পরশু এক ছ্যাকড়া গাড়ির ঘোড়া পাগল হয়ে এক পথচারীকে চাপা দেয়। ইদানীংকালে এরকম ঘটনা তিনখানা ঘটল। পথচারীরা গাড়োয়ানকে উত্তমমধ্যম দিয়েছে। ফলে গাড়োয়ানরা তিনদিন ধর্মঘট ডেকেছে। কিন্তু এর সঙ্গে…

উত্তরটা সাইগারসনই দিলেন। “গাড়োয়ানরা ঘোড়ার গাড়ি বন্ধ রেখেছে। আপনার আসার উপায় হয় পায়ে হেঁটে, নয় পালকি। পায়ে হেঁটে আপনি আসেননি। কারণ কাল রাতে অল্প বৃষ্টি হয়েছে। রাস্তায় কাদা। কিন্তু আপনার বুটজুতো একেবারে চকচক করছে। অতএব…” প্রিয়নাথ বেশ অবাক হল। বিলাতের স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিনে ইদানীং শার্লক হোমস নামে এক গোয়েন্দার গল্প বার হচ্ছে। আর্থার কোনান ডয়েল নামে এক ডাক্তারের লেখা। টমসন সাহেব সেই ডাক্তারকে চেনেন। উনিই প্রিয়নাথকে সেসব গল্প পড়িয়েছেন। সে গোয়েন্দাও অনেকটা এমন। কিন্তু সে তো গল্পের গোয়েন্দা, এ তো খাঁটি রক্তমাংসের মানুষ।

একটু আমতা আমতা করেই জিজ্ঞেস করল প্রিয়নাথ, “আচ্ছা, আর-একটা কথা। সেদিন লাশকাটা ঘরে আপনি কীভাবে জানলেন যে আমি পুলিশে কাজ করি? আমি তো সাদা পোশাকে ছিলাম। আর এই কেসের দায়িত্ব আমি পেয়েছি সেটাই বা জানলেন কীভাবে?”

“আপনি কি সেটা জানতে এত কষ্ট করে পালকি চেপে এলেন? তা তো মনে হয় না।”

“আজ্ঞে তা না। অন্য জিজ্ঞাসাও আছে। তবে যেভাবে আপনি পালকির কথা বললেন, তাতে মনে হল আর কি।”

“আমি নিজে মার্টিন সাহেব আর গোপালচন্দ্রকে বলেছিলাম লাশকাটা ঘরে যেন কাউকে না নিয়ে আসে। তারপরেও আপনি এলেন। মানে পদাধিকার বলে আপনি এসেছেন। কী সেই অধিকার যাতে নির্বিঘ্নে আপনি লাশকাটা ঘরে ঢুকতে পারেন? এক, আপনি কোনও ডাক্তার, অথবা তদন্তকারী অফিসারদের কেউ। আপনি যদি ডাক্তার হতেন তবে গোপাল আপনার পরিচয়ে মিস্টার প্রিয়নাথ না বলে ডাক্তার প্রিয়নাথ বলত। মানে আপনি তদন্তকারী অফিসার। আর এই কেসের কথা খুব কম মানুষকেই জানানো হয়েছে। আপনি জানেন। মানে এই কেসের ভার আপনাকেই দেওয়া হয়েছে। কেমন কিনা?”

“বাহ… আপনি বলার পর জলের মতো সোজা লাগছে। এবার একটাই প্রশ্ন, যার জন্য আমার এখানে আসা…”

“বলুন।” নিভে যাওয়া পাইপ আবার ধরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন সাইগারসন।

“আপনি কে? এই কেসের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কী?”

খুব ধীরে ধীরে মুখ থেকে পাইপ সরালেন সাইগারসন। কপালের ভাঁজ আরও গভীর হল। খাড়া নাক প্রায় চিবুক ছুঁয়েছে। চোখ মেঝের কার্পেটের দিকে। খানিক বাদে মুখ তুলে সোজা প্রিয়নাথের দিকে তাকিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করলেন সাইগারসন, “আপনার কী মনে হয়?”

একটু ইতস্তত করল প্রিয়নাথ। ঠিক এই পরিস্থিতি হবে ভাবেনি। তবু একটু ভেবে বলল, “দেখুন, আপনি কে তা আমি বলতে পারব না। কিন্তু যতটা জেনেছি কিছুতেই হিসেব মেলাতে পারছি না। আপনি ম্যাজিকের দলের সামান্য কবিতাপাঠক নন, কিন্তু আবৃত্তি ভালো করেন, মনে হয় কোনও এক সময় ভালো থিয়েটার করতেন। দারুণ বেহালা বাজান সেটা তো শুনতেই পেলাম। রসায়নে প্রগাঢ় জ্ঞান, নইলে সেদিন ক্লোরোফর্ম নিয়ে এত কিছু বলতে পারতেন না। উঁচু মহলে হাত আছে। আপনার দাদা একজন কেউকেটা। কিন্তু আপনি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের কেউ নন, তাহলে এমন লুকিয়ে থাকতেন না। আবার অপরাধীও নন, তাহলে টমসন সাহেব আপনাকে আগলে রাখতেন না…” বলতে বলতেই প্রিয়নাথের মাথায় যেন গোটা ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল, “আপনি কোনও প্রাইভেট ডিটেকটিভ নন তো?”

একটু থমকে গিয়ে হো হো করে হেসে উঠলেন সাইগারসন। “এলিমেন্টারি, ডিয়ার অফিসার। আমি এই ভয়টাই করছিলাম, ঠিক কখন কে আমায় ধরে ফ্যালে। এ দেশেও স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সঙ্গে পাল্লা দেবার মতো মাথা আছে তাহলে”, বলেই হাত বাড়িয়ে দিলেন সাইগারসন, “আমি সাইগারসন মোহেলস। প্রাইভেট না। কনসাল্টিং ডিটেকটিভ।”

“সেটা কী?”

“যখনই সরকারি পুলিশ কোনও আতান্তরে পড়ে, তখনই আমায় ডাকে। আমি সামান্য ফি-এর বদলে তাদের পরামর্শ দিয়ে থাকি। অপরাধী ধরা পড়ে। তারা সব ক্রেডিট নেয়, আর আমি আমার ফি পকেটে পুরি। এ ব্যাপারে বিশ্বে আমিই একা এবং অদ্বিতীয়।”

লোকটা বেশ অন্যরকম, কিন্তু অহংকারী। উদ্ধত। ভাবছিল প্রিয়নাথ। তারপরেই মনে পড়ল অনেক প্রশ্ন করা বাকি।

“আমার কিছু প্রশ্ন আছে।”

“নির্দ্বিধায় বলুন। কথা দিচ্ছি মিথ্যে বলব না।”

“আপনি এই কার্টারের দলের সঙ্গে এসেছেন কী করতে?”

“মি. টমসন আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন।”

“কিন্তু কেন?”

“একটা কেসের ব্যাপারে।”

“কোন কেস?”

“আপনি জানেন হয়তো। ডালান্ডা হাউস থেকে পাগলরা ক্রমাগত ভ্যানিশ হয়ে যাচ্ছে। হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে একের পর এক।”

“কিন্তু যারা পালিয়েছে তারা সবাই তো নেটিভ, আর ছোটোলোক। এদের খুঁজতে বিলেত থেকে আপনাকে এ দেশে আসতে হল কেন? আর তাও পরিচয় ভাঁড়িয়ে?”

“প্রথম প্রশ্নের উত্তর আগে দিই। যারা পালিয়েছে কিংবা হারিয়েছে তারা নেটিভ, আপনার ভাষায় ছোটোলোক, কিন্তু একটা ব্যাপার জানেন কী, এদের একটা মিল আছে। এরা সবাই পুরুষ, আর শুধু পাগলামো না, এদের প্রত্যেকের অপরাধের ইতিহাসও আছে। এদের একজন লালু মণ্ডল, সোনাগাজির তিনজন বেশ্যাকে গলা টিপে মেরেছিল। বাকিদেরও খুন বা ধর্ষণের ইতিহাস আছে। এই ধরনের পাগলরা ছাড়া পাচ্ছে কীভাবে? আর ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে কোথায়? সবাই ভয় পাচ্ছে এরা ছাড়া পেয়ে আরও অপরাধ করবে, কিন্তু আমার ভাবনা অন্য।”

“সেটা কী?”

“আমি কেস রিপোর্ট দেখেছি। এই পাগলদের যা অবস্থা, বাইরে বেরিয়ে শান্ত হয়ে থাকা তাদের পক্ষে অসম্ভব। আমি নিশ্চিত ছিলাম কিছুদিনের মধ্যেই অন্য কোনও অপরাধ করতে গিয়ে এরা ধরা পড়বেই। কিন্তু আশ্চর্য! একজনও ধরা পড়েনি। সবাই যেন কর্পূরের মতো বাতাসে মিলিয়ে গেছে।”

“এর কারণ?”

“সব সম্ভাবনাগুলোকে বাদ দিলে যেটা পড়ে থাকে, যতই অসম্ভব মনে হোক না কেন, সেটাই সত্যি।”

“আর সেটা কী?”

মাথাটা ঝুঁকিয়ে একেবারে প্রিয়নাথের মুখের সামনে এনে সাইগারসন বললেন, “আমার স্থির বিশ্বাস এই পাগলদের একজনও বেঁচে নেই।”

প্রায় লাফিয়ে উঠল প্রিয়নাথ, “মানে!”

“কেউ বা কারা খুব সন্তর্পণে এদের খুন করছে।”

“কিন্তু কেন?”

“ঠিক এই জায়গাতেই আমিও আটকে আছি। তিন-চারটে ছেঁড়া ছেঁড়া সুতো দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু তারা আবার কুয়াশায় মিলিয়ে যাচ্ছে।”

“আর আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন? আপনি নিজের পরিচয়ে না এসে পরিচয় গোপন করলেন কেন?”

“এই উত্তরটা ঠিক এখন দিতে পারছি না। ধরে নিন আমারও কদিন গা ঢাকা দেবার প্রয়োজন হয়েছে। লন্ডন আমার জন্য খুব গরম হয়ে উঠেছিল। থাকা যাচ্ছিল না। আর তাই দাদার কাছে টমসন যখন সাহায্য চান, আমিও সুযোগ পেয়ে চলে আসি।”

“আপনি কার্টারকে চিনতেন?”

“কার্টার না, ওঁর নাম হ্যারি। হ্যারি জনসন।”

“জানি। জর্জ বলেছে।”

“হ্যারিকে আমি চিনতাম না। কিন্তু ওর ভাই উইগিন্স আর তার দলবল আমার বিশেষ পরিচিত।”

“মানে ওই লোফাররা?”

“কে বলেছে আপনাকে ওরা লোফার? জর্জ?”

“হ্যাঁ।”

“বুড়ো আসলে উইগিন্সকে দুচোখে দেখতে পারে না। উইগিন্সের মা পাগল। বেডলামে ভরতি। ইদানীং হ্যারি কিছু পয়সাকড়ি দিচ্ছে, আগে তো উইগিন্সই চালাত।”

“কীভাবে?”

“উইগিন্সের দলবলের একটা সুবিধে আছে। ওদের কেউ সন্দেহ করে না। ওরা যেখানে সেখানে চলে যায়, আমার জন্য খবর নিয়ে আসে, আমি ওদের পয়সা দিই।”

“আর অন্য ম্যাজিশিয়ান? রিচার্ড হ্যালিডে?”

“ডিয়ার অফিসার, তাহলে আপনাকে আর-একটা খবর দেওয়া যাক। রিচার্ড হ্যালিডে শখের ম্যাজিশিয়ান। তার আসল পেশা অন্য।”

“সেটা কী?”

“সে ছিল বেডলাম হাসপাতালের ডাক্তার।”

“বলেন কী! এই বেডলামেই তো…”

“হ্যাঁ, হ্যারি আর উইগিন্সের মা শার্লি ভরতি।”

“তবে সে কেন নাম পরিচয় ভাঁড়িয়ে এ দেশে এসেছে?”

“আমি সেটা জানার বহু চেষ্টা করেছি। জানতে পারিনি। এই সফরের আগে হ্যারি তার গোটা দলকে নতুন করে সাজায়। এক বুড়ো জর্জ ছাড়া। সে আর-এক সেয়ানা। কথাই বলে না।”

“তাও তো আপনার একটা প্রশ্নের জবাব দিয়েছে।”

“হ্যারির বাবার চোখের রং তো? হ্যাঁ। হয়তো প্রশ্নের গুরুত্বটা বোঝেনি।”

“আপনি এটা জিজ্ঞাসা করলেন কেন?”

“একটা খটকা। বলার মতো কিছু হয়নি এখনও।”

“ও হ্যাঁ, সেদিন কার্টার মঞ্চে অজ্ঞান হয়ে যাবার পরে আপনিই তো তাঁকে গ্রিনরুমে নিয়ে যান?”

“অজ্ঞান হয়নি, মাথা ঘুরে গেছিল একটু। নিয়ে যেতে যেতে ঠিক হয়ে যায়। নিজে হেঁটেই ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়।”

“ভিতর থেকে?”

“হ্যাঁ, আমি আওয়াজ পেয়েছি।”

“তাহলে আমরা যখন গেলাম, তখন দরজা খোলা পেলাম কেন?”

“কার্টার, মানে হ্যারি নিজেই দরজা খুলে দিয়েছিল।”

“কাকে?”

“যে তাকে খুন করল, তাকে।”

“মানে? কার্টার আত্মহত্যা করেননি?”

“কার্টারের ডান হাতে বন্দুক ছিল, আর ও ছিল বাঁহাতি। ফ্লিন্টলক বন্দুকের ট্রিগারে যে পরিমাণ চাপ দিতে হয় তা কমজোরি হাতে দেওয়া সম্ভব না। এটা খুন। আপনি নিশ্চিত থাকুন।”

“কে খুন করেছে আপনি জানেন?”

“বোধহয় জানি। আমার ধারণা রাখহরি হতে পারে। কিন্তু কার্টারের ভ্যানিশিং অ্যাক্টের মতো রাখহরিও সেদিন থেকে ভ্যানিশ।”

“একটা কথা। আমি বড়োলাটের দেখাশোনা করছিলাম। উনি একটা কাগজের ফালি হাতে নিয়ে মঞ্চে ওঠেন। পরে আমি অনেক খুঁজেও সে কাগজ দেখতে পাইনি…”

সাইগারসনের চোখ চকচক করে উঠল। “দারুণ চোখ তো আপনার! বড়োলাট সে কাগজ মঞ্চে কার্টারের সঙ্গে হাত মেলানোর সময় তাকে দেন। কার্টার এক ঝলক দেখেই পকেটে রেখে দিয়েছিল। কার্টার মাথা ঘুরে পড়ে গেলে আমি ওকে ধরে নেবার অছিলায় ওর পকেট থেকে আলগোছে কাগজটা নিয়ে নিয়েছিলাম।”

“কী ছিল সেই কাগজে?”

“নিজেই দেখে নিন”, বলে সাইগারসন উঠে গিয়ে একটা টার্কিশ চটির তলা থেকে এক টুকরো কাগজ প্রিয়নাথের সামনে এনে দিলেন। কাগজে তিনটে সোজা দাগ। একটার ওপর একটা। এমন চিহ্ন আগে সে দেখেছে। সেই মৃতের বুকে অনেকটা এমন চিহ্ন ছিল।

“আবার ই-চিং?”

“আপনি ই-চিং-এর মানে জানেন?”

“প্রথম হত্যার খবর দিয়েছিল যে যুবক, তার থেকে নামটা শুনেছিলাম। বিস্তারিত জানি না। আপনি জানাতে পারেন?”

“জানাব, আগে বলুন আপনার হাতে একটু ফাঁকা সময় আছে?”

“আছে। কেন?”

“ডালান্ডা হাউসে যেতে হবে। ধরাচূড়া পরে না, সাদা পোশাকে যাবেন। কাউকে কিছু বলার দরকার নেই। একটা মতলব ফেঁদেছি…”

। তিন।

প্রিয়নাথরা ডালান্ডা পৌঁছোতে থাকুন, বরং এই সুযোগে উনিশ শতকে কলকাতার উন্মাদালয়গুলোর অবস্থা নিয়ে দু-এক কথা বলা যাক। বিলেতের মতো এ দেশেও সেই সময় পাগলদের ভয়ংকর কিছু মনে করা হত। মানুষ নয়, দানব। “গভীর রাতে যেসব নাম না জানা শয়তানি আত্মারা নেমে আসে পৃথিবীতে, তারাই তাদের কিছু অংশ ছেড়ে যায় এদের মধ্যে”, লিখেছিলেন এক সাহেব ডাক্তার। নেটিভ থেকে সাহেব, সবাই কোনওরকমে এদের থেকে পরিত্রাণ পেতে চাইতেন। ভাঙা আস্তাবল, জেল বা পরিত্যক্ত ব্যারাকের চারদিকে তিনগুণ উঁচু পাঁচিল দিয়ে এদের ঘিরে রাখা হত। একবার পরিবারের কাউকে এর ভিতরে ঢোকাতে পারলেই নিশ্চিন্ত। তারপর তাঁর কথা ভুলে যেতেন সবাই। এই পাগলাগারদগুলোর দায়িত্বে থাকতেন কোনও এক সিভিল সার্ভেন্ট, যাঁর এই পাগলদের নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা ছিল না। ফলে গোটা দায়িত্বই এসে পড়ত কিপারের ওপর। এই কিপাররা কেউই শিক্ষিত ছিলেন না। এমনকি অনেক সময় তো কুখ্যাত অপরাধীদের সাজা হিসেবে পাগলাগারদের কিপারের দায়িত্ব দিয়ে দেওয়া হত। তাঁদের একটাই মন্ত্র ছিল, “ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করো।” ইউরোপীয়দের জন্য আগে কেন্ডারডাইনের একটা ছোটো মানসিক হাসপাতাল ছিল হোয়াইট টাউনে। মেডিক্যাল বোর্ড ১৭৮৭-র মে মাসে বির্জিতালাও আর জেনারেল হাসপাতালের মাঝে আরও একটা বড়ো উন্মাদাগার স্থাপনের কথা ভাবে। তখন সার্জন উইলিয়াম ডিক নিজের খরচায় এই ভবনটি নির্মাণ করেন। শুধু শর্ত হয়, কোম্পানি তাঁকে ভাড়া বাবদ মাসান্তে চারশো টাকা এবং পরে মহিলাদের আলাদা ভবন হলে তার জন্য দুশো টাকা দেবে। ১৮২১-এ ডিক মারা গেলেন। কোম্পানি ঠিক করল এই হাসপাতাল বন্ধ করে দেবে। আর ঠিক তখনই ডিকের হাসপাতালের হেড কিপার মি. বিয়ার্ডসমোর জেনারেল হাসপাতালের ঠিক পিছনে আর-একটা মানসিক হাসপাতালের প্রস্তাব দেন। ১৮৫৩-তে বিয়ার্ডসমোর মারা যান। ১৮৫৫-তে স্বয়ং ব্রিটিশ সরকার এই হাসপাতালটি অধিগ্রহণ করেন। তখন থেকেই এই হাসপাতালের ভাগ্য বদলাতে থাকে। সবাই এর নাম দেয় ভবানীপুরের পাগলাগারদ। সেখানে ওষুধ বলতে ছিল শুধু মরফিন বা আফিম, তাও নেটিভ পাগলাগারদে বাড়ন্ত। রসা পাগলায় নেটিভদের জন্য হাসপাতালের অবস্থা রোগীর ভারে দিনে দিনে সঙ্গিন হয়ে উঠলে ধলন্দর প্রান্তরে “ডালান্ডা হাউস” গড়ে ওঠে। দেড়শো জন রোগীর জন্য তৈরি হাসপাতালে শুরুতেই তিনশো জনের বেশি রোগীকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। আর-একটা সমস্যা ছিল। অপরাধী আর নিরপরাধ, দুই ধরনের পাগলকেই ঠাঁই দেওয়া হত এখানে। ইংরেজ সরকারকে এই নিয়ে বেশ কয়েকবার জানানো হয়, কিন্তু সরকার গা করেননি। গোটা ভারতে তখন ছটা পাগলাগারদ, কিন্তু সবচেয়ে ভয়াবহ ডালান্ডা। এর ভিতরে কী হয় কেউ জানে না। বিশাল উঁচু গোল এই বিল্ডিংয়ের পাশ দিয়ে মানুষ যায় আর তাকিয়ে তাকিয়ে দ্যাখে। ভাবে ভিতরে কেমন সব প্রাণীরা আছে? বাবা-মায়েরা বাচ্চাদের ভয় দেখায়। মাঝে মাঝে ভিতর থেকে ভেসে আসে তীব্র আর্তনাদ, আর্ত চিৎকার। পথচারীরা শিউরে উঠে তাড়াতাড়ি পেরিয়ে যায় ডালান্ডা হাউসকে।

সাইগারসন আর প্রিয়নাথের পালকি দুটো ডালান্ডা হাউসের বিশাল সদর দরজা অবধি এল না। ওরা ভয় পায়। একটু পায়ে হেঁটে বিরাট লোহার পাত দেওয়া সদর দরজার সামনে যখন এল প্রিয়নাথ, তখন সামনে বেশ জটলা। তিন-চারজন মিলে একটা ঘোড়ায় টানা ময়লা ফেলার গাড়ি থেকে একজন বেশ শক্তপোক্ত লোককে টেনে ভিতরে ঢোকানোর চেষ্টা করছে। মাথার একদিকে চাপ চাপ রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে। নাক ফেটে চুঁইয়ে পড়ছে রক্ত। গলায় মোটা লোহার বেড়ি। খালি গা। একটা লেংটি মতো পরা। শিকল দিয়ে বাঁধা হাত-পা। লোকটা প্রাণপণে চিৎকার করছে, ভিতরে যাবে না। এক গাঁট্টাগোঁট্টা সাহেব কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আর তারই নির্দেশে একজন লোক একটা মোটা কাঠের রুল দিয়ে দমাদ্দম পেটাচ্ছে পাগলটাকে। এই সাহেবই সম্ভবত ডালান্ডার কিপার। পাগল লোকটা মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে যাচ্ছে, আবার ওকে টেনে তুলে মারছে। অর্থহীন প্রলাপের মতো চিৎকারে ভরে উঠছে আকাশ বাতাস। প্রিয়নাথ শুধু সেই জড়ানো শব্দাবলির মধ্যে বারবার “ও বুক রে… ও বুক…” বুঝতে পারল। খুব ইচ্ছে করছিল একবার দৌড়ে গিয়ে হাতের লাঠিটা কেড়ে কিপারটাকেই দু ঘা লাগাবে। কিন্তু হাতে একটা চাপ অনুভব করল। সাইগারসন এমন কিছু একটা অনুমান করেই তার হাত টেনে ধরেছেন। একটু এগিয়ে গেলেন সাইগারসন। সোজা কিপারের কাছে গিয়ে নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, “এক্সকিউজ মি স্যার, আপনিই তো ডালান্ডার কিপার?”

একটু চমকে উঠল লোকটা। তখনও তার মুখে একটা পৈশাচিক আনন্দের রেশ খেলে যাচ্ছে। পাগলটাকে প্রায় ঢোকানো হয়ে গেছে গেটের ভিতরে। সাইগারসনের প্রশ্নে ভুরু কুঁচকে গেল, “হ্যাঁ, কিন্তু আপনি কে?”

গলা নামালেন সাইগারসন, “একটু দরকারি কথা আছে। সময় হবে?”

“যা বলার এখানেই বলুন”, কিপার তাঁকে ঝেড়ে ফেলতে পারলে বাঁচে।

“আমার সঙ্গের এই ভদ্রলোক”, বলে প্রিয়নাথকে দেখালেন সাইগারসন, “বর্ধমান রাজপরিবারের ছেলে। এঁর দাদা বদ্ধ উন্মাদ। বাড়িতে রাখা যাচ্ছে না। এদিকে সরকারি নিয়মকানুন মেনে চলতে গেলে জানাজানি হয়ে যাবে, সেটাও এঁরা চান না। তাই যদি একটু কথা বলা যেত…”

বেশ সন্দেহের চোখে প্রিয়নাথের দিকে তাকাল কিপার। প্রিয়নাথ একটু হাসবার চেষ্টা করল। এই নাটকটা যে হতে যাচ্ছে, সেটা আগেই সাইগারসন বলেছিলেন। বুঝিয়েছিলেন সেই চৈনিক সংকেতের অর্থও, যদিও তাতে খুব বেশি ইতরবিশেষ হয়নি প্রিয়নাথের ক্ষেত্রে। সে যে তিমিরে, সেই তিমিরেই পড়ে আছে। বর্ধমান রাজবাড়ির ছেলের অভিনয়টা তাকে এখন চালিয়ে যেতে হবে।

“আপনি কে?” সাইগারসনকে প্রশ্ন করল কিপার।

“আমি ওঁর বন্ধু। ওঁকে ইংরাজি শেখাই। আমার নাম বেসিল এসকট।” বলেই হাত বাড়ালেন সাইগারসন।

লোকটা গোয়েন্দা না হয়ে অভিনেতা হলেও নাম করত, মনে মনে ভাবল প্রিয়নাথ।

বাড়ানো হাত ধরল না কিপার। ভুরু কুঁচকেই বলল, “ডাঃ মার্টিনের সঙ্গে কথা বলতে হবে।”

একগাল হাসল সাইগারসন। “তাহলে আর আপনার কাছে আসা কেন? কুমার বাহাদুর পাঁচকান করতে চাইছেন না। দেখুন না, আপনি যদি… খরচাপাতি নিয়ে ভাববেন না।”

শেষ কথায় মন্ত্রের মতো কাজ হল। কিপার আবার দুজনকে আগাপাশতলা দেখে নিয়ে বলল, “ভিতরে আসুন।”

বিশাল লোহার গেট পেরিয়ে একটা বড়ো উঠোনে এসে পড়ল ওরা। একধারে জমি খুঁড়ে কিছু চাষের চেষ্টা চলছে। মাটি কোপাচ্ছে তিনজন পুরুষ। ঘাস বাছছে দুই মহিলা।

“এখানে চাষবাসও হয়?” জিজ্ঞেস করলেন প্রিয়নাথ।

“বলেন কী? পিছনে অনেকটা জায়গা জুড়ে কফির চাষ। দেখতে যাবেন? লন্ডনের কফির দালালরা রীতিমতো এই কফির প্রশংসা করেন। আমি তো আখ আর সাপান কাঠেরও চাষ করাচ্ছি। মার্টিন সাহেব বিশেষ সময় পান না এখানে আসার… আমাকেই সব দেখতে হয়।”

দেখতে দেখতে যাচ্ছিল প্রিয়নাথরা। যারা অপেক্ষাকৃত সুস্থ, তাদের ছেড়ে রাখা হয়েছে। অবশ্য এর মধ্যে নেটিভ কর্মচারীও থাকতে পারে। সবাই একেবারে চুপচাপ কাজ করছে। কেউ কারও সঙ্গে কথা বলছে না। কারও দিকে তাকাচ্ছে না। প্রিয়নাথের কেমন ভয় ভয় করছিল। আগে কোনও দিন পাগলাগারদে আসতে হয়নি তাকে। মোরাম বিছানো পথ বেয়ে অফিস ঘরের দিকে এগিয়ে গেল তিনজন। চারিদিকে অদ্ভুত একটা গন্ধ। দুর্গন্ধ। তার মধ্যে এই ঝকঝকে অফিসঘরটা একটু বেমানানই ঠেকছে। অফিসটা মার্টিন সাহেবের। পাশের ছোটো ঘরটায় কিপার বসে। দরজার সামনের প্লেট থেকে প্রিয়নাথ বুঝল এর নাম জ্যাসন স্মিথ। আজ কী হবে গোটাটাই স্মিথ সাহেবের মর্জি।

চেয়ারে বসে আর্দালিকে তিনজনের জন্য চা আনতে বলে অবশেষে একটু স্বাভাবিক হল স্মিথ। ঠোঁটের কোনায় একটু হাসিও দেখা গেল। বলল, “ডালান্ডা নিয়ে অনেকে অনেকরকম কথা বলে মশাই। পত্রপত্রিকাতেও দুর্নাম করে। কিন্তু এখানে তাদের কাউকে এনে রাখুন দেখি এক সপ্তাহ! বাপ বাপ বলে বাড়ি পালাবে।”

“এঁর ভাই কিন্তু সাধারণ লোক নন। একটু স্পেশাল ব্যবস্থা লাগবে… হবে তো?”

“সব হবে। পয়সা দিলেই হবে। কিন্তু তা বলে রাজপ্রাসাদের মতো হবে না, বলে দিলাম। একটু মানিয়ে গুছিয়ে নেবেন। আর খুব আদরযত্ন চাইলে সেটা কি আর আপনারা নিজেরা করতেন না? তাহলে কি আর এখানে দিতেন?” হাসি হাসি মুখে প্রিয়নাথের দিকে তাকিয়ে শেষ কথাগুলো বলল ডালান্ডা হাউসের কিপার।

প্রিয়নাথ কিছু বলল না। সে খুব বেশি ইংরাজি জানে না, এই ভাবটা রেখে গেলেই ভালো। বরং সাইগারসনের কানের কাছে মুখ নিয়ে সে ফিসফিসিয়ে বলল, “আমাদের ঘুরে দেখতে দেবে না?”

সাইগারসন সেটাই বললেন। কিপার খানিক চিন্তিত মুখে বলল, “ঘুরে দেখার কী আছে? সবাই যেমন সুবিধা পায়, এঁর ভাইও তেমনই পাবেন।”

“তবু দেখুন, কুমার সাহেব একবার দেখতে চাইছেন, আসলে টাকা লাগাচ্ছেন, কিন্তু ভাইয়ের দেখভাল ঠিকঠাক হবে কি না, সুরক্ষা ব্যবস্থা কেমন, এসব না জানলে…” সাইগারসন বললেন।

“নিশ্চিন্ত থাকুন, আমাদের এখানে কোনও কিছু নিয়ে একটুও চিন্তা নেই।”

প্রিয়নাথ আবার মুখ নিয়ে গেল সাইগারসনের কানের কাছে। সাইগারসন যেন একটু অস্বস্তিতেই পড়লেন। তারপর বললেন, “আজ্ঞে কিছুদিন আগে ফ্রেন্ডস অফ ইন্ডিয়া একটা খবর ছেপেছিল আপনাদের নিয়ে। তাতে বলেছিল গত ছয় মাস ধরে নাকি আপনাদের এখান থেকে রোগী পালাচ্ছে…”

“কুত্তার বাচ্চা”, বলে উঠল কিপার।

দুজনেই চমকে গেলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষমা চেয়ে কিপার বলল, “আপনাদের বলিনি। ওই ব্যাটা রিপোর্টারকে বললাম। নাম যদি জানতে পারতাম… কী করে যে খবর পেল কে জানে!”

“মানে খবরটা সত্যি?”

এবার গলাটা একটু খাদে নামিয়ে কিপার বলল, “লালু মণ্ডলটা সত্যি। বাকিগুলো ভুল। বানিয়ে লেখা।”

“কী করে পালাল লালু মণ্ডল?”

“সে আমি কী করে বলব মশাই? জানলে কি ধরে আনতাম না? মহা বজ্জাত। যখন ঢুকেছিল, তখন মাথায় তিনটে খুনের মামলা। সামনে এলেই কামড়ে দেয়। এখানে আমরা চিকিৎসা করে অনেক শান্ত করে দিয়েছিলাম। মার্টিন সাহেব নিজে দায়িত্ব নিয়েছিলেন। অনেকটা শান্তও হয়ে গেছিল। আর শিকলে বেঁধে রাখতে হত না। কে বুঝবে যে সেয়ানা পাগল? কোন সুযোগে দেওয়াল টপকে পালিয়েছে।”

“এত উঁচু দেওয়াল টপকে পালাল? সম্ভব?”

“আপনি লালুকে দেখেননি। ওর পক্ষে কিচ্ছু অসম্ভব না। এখন দেখুন আমাদের ঝকমারি। পুলিশ মাঝে মাঝেই খোঁজ নিয়ে যায়। পুলিশ নিজেও খুঁজছে। আমি পড়ে গেছি ঝামেলায়। মাঝে মাঝেই আমায় এসে পুলিশ জেরা করে। ওদের কে এক টমসন আছে, সে তো আদাজল খেয়ে লেগেছে লালুকে খুঁজতে।”

তাহলে খবর সত্যিই। টমসন হালে পানি না পেয়েই সাইগারসনকে ডেকেছেন, ভাবল প্রিয়নাথ।

“তবে নিতান্ত যদি দেখতে চান, চলুন দেখিয়ে আনি”, বলে উঠে দাঁড়াল স্মিথ। ফলে প্রিয়নাথদেরও উঠে দাঁড়াতেই হল। স্মিথ ওদের নিয়ে চলল গোল বিল্ডিংয়ের একদিকে। যেতে যেতেই বিড়বিড় করছিল স্মিথ, “লোকজন নেই, মেথর আসছে না, যাতায়াতের টাঙ্গা বন্ধ, চালাবার জন্য টাকা নেই, চলবে কী করে? এই দেখুন এটা হিন্দুদের রান্নাঘর, আর ওপাশেরটা মুসলমানদের। সুতরাং আপনার ভাইয়ের জাত যাবার ভয় নেই…”

“আর ইউরোপীয়?” এই প্রথম কথা বলল প্রিয়নাথ।

“আপনি জানেন না? এখানে শুধু নেটিভদের চিকিৎসা হয়। ইউরোপিয়ানরা সব ভবানীপুরে। ওখানে রাজকীয় ব্যবস্থা।”

নিচু ছাদ, একের পর এক ঘর। অনেকটা সৈন্যদের ব্যারাকের মতো। ভিতরে এক এক ঘরে চারজন করে রোগীর ব্যবস্থা। দেওয়ালে নখ দিয়ে আঁচড় কেটে কেটে অদ্ভুত সব ছবি এঁকেছে এরাই। সে ছবির মানে কোনও সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। ঘরগুলোতে আলো কম। রাতে একেবারে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার হয়ে যায় বলাই বাহুল্য। একজন রোগীকে অদ্ভুত একটা পোশাক পরিয়ে বিছানায় বসিয়ে রাখা হয়েছে। এমন পোশাক প্রিয়নাথ আগে কোনও দিন দেখেনি।

“কী এটা?” প্রিয়নাথই বলল।

“এটাকে বলে স্ট্রেট জ্যাকেট। শক্ত ক্যানভাসের জ্যাকেট, এতে রোগীর হাত বেঁধে পিছমোড়া করে দেওয়া হয়। রোগী আর নড়তে চড়তে পারে না।”

প্রিয়নাথের মুখে একটা ভয়ের ছাপ ফুটে উঠেছিল বোধহয়। সেটা দেখেই স্মিথ বলল, “চিন্তা নেই। একেবারে বদ্ধ পাগল ছাড়া এমন করা হয় না। আর সবসময় তো না… যখন বাড়াবাড়ি করে তখন। এই ছেলেটাও বড়ো বাড়ির ছেলে। রাজপরিবারের। শুধু এর ছোটোভাই চায় না বড়োভাই সম্পত্তি পাক। অনেকটা আপনার মতন, কী বলেন?” বলেই প্রিয়নাথের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল স্মিথ।

প্রিয়নাথ গম্ভীর হয়েই রইল। ঠিক এমন সময় প্রায় দৌড়ে ঘরে ঢুকল এক নেটিভ বুড়ো। চোখেমুখে উত্তেজনা। স্মিথকে কী যেন বলতে গিয়ে প্রিয়নাথদের দেখেই থমকে গেল। স্মিথ কিছু আঁচ করেই বলল, “কী হয়েছে? কিছু গোলমাল?”

প্রায় বিড়বিড় করে ভাঙা ইংরাজিতে বুড়ো বললে, “মার্টিন সাহেব কাম স্যার। ভেরি অ্যাংগ্রি স্যার। ইউ প্লিজ কাম স্যার।”

প্রায় লাফিয়ে উঠল স্মিথ। “ডাঃ মার্টিন? এসময়? কী হল আবার? এদিকে আপনারা এখানে, আপনাদের দেখলে আমাকে নিশ্চিত জেলে পুরবে। এই লখন, এঁদের নিয়ে ডি ব্লকে চলে যাও তো। ডাঃ মার্টিন ভিজিটে এলেও ওদিকটায় যাবেন না”, বলে ওদের দিকে ফিরে বললেন, “মার্টিন যতক্ষণ আছে, আপনারা একটু গা ঢাকা দিয়ে থাকুন, বোঝেনই তো… লখন, এঁদের নিয়ে যাও।”

এতক্ষণ প্রিয়নাথ দেখেনি, প্রায় ছায়ার মতো দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে কুচকুচে কালো এক যুবক। খালি গা। দেহে যেন মাংসপেশির ঢেউ উঠেছে। প্রিয়নাথ বুঝল এ যুবক অসীম শক্তি ধরে। এই তবে লখন! কিন্তু কোথায় যেতে হবে ওদের? অদ্ভুত এক শঙ্কা নিয়ে লখনের পিছু পিছু পা বাড়াল ওরা দুজন। আর ঠিক তখনই প্রিয়নাথ খেয়াল করল লখনের ডান হাতের কড়ে আঙুলটা নেই।

। চার।

লখন ওদের নিয়ে চলল অদ্ভুত এক গোলকধাঁধার মতো পথ দিয়ে। যত এগোতে লাগল মূত্র আর পুরীষের তীব্র গন্ধ নাকে এসে লাগল প্রিয়নাথদের। দুজনেই রুমাল দিয়ে নাক ঢাকল। তার মানে এদিকে সাধারণদের বাস। লম্বা বারান্দায় যেতে যেতে আচমকা এক প্রায় উলঙ্গ পুরুষকে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে দেখল তারা। লখনের মুখে একচিলতে হাসি। সে লোকটার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “কি হে কাঙালিচরণ, আজ আবার গড়াগড়ি দিচ্চ? ঝুড়ি থেকে পড়ে গেলে বুঝি?” কাঙালিচরণও নিতান্ত অসহায়ের মতো বললে, “কী করব ভাই, গড়িয়ে পড়েছি। কেউ উঠিয়ে না দিলে উঠতে পারছি না।” লখন তার দুই হাত ধরে টেনে ওঠাতে ওঠাতে বললে, “আজ তুমি কী হয়েছ?”

—আজ আবার কী হব? আমি তো আলু ছিলাম, আলুই থাকব। তাই তো গড়াগড়ি দিচ্চি।

—এই যে সেদিন বললে তুমি পটল!

—না, না, সে তো আমায় কেষ্টা ভুল বুঝিয়েছিল। আমি আসলে আলু। পটল হল ও নিজে।

কাঙালিকে ঘরে ঢুকিয়ে দিতে গেলে আর-এক মুশকিল। সে কিছুতেই ঢুকবে না। বারবার বলছে সে রোদে বসবে, সে তো সবজি, রোদ না পেলে বাঁচবে কীভাবে? অগত্যা লখন তাকে উঠিয়ে একপাশে বসিয়ে দিয়ে গেল। “রাতে আবার ঘরে নিয়ে যেয়ো ভাই, ঠান্ডা লাগলে শুকিয়ে যাব”, বললে কাঙালি। তাকে আশ্বস্ত করে পাশের ঘরের দিকে যেতেই তীব্র কণ্ঠের একটা চিৎকার শুনতে পেল তারা। লখন “এই রে আবার খেপেছে” বলে দ্রুত পা বাড়াল। পিছু পিছু প্রিয়নাথরাও সেই ঘরে ঢুকতেই বুঝতে পারল স্পেশাল আর জেনারেল ওয়ার্ডে তফাত ঠিক কোথায়। একটু আগে দেখে আসা সেই কোন রাজবাড়ির ছেলের ঘরটা এর তুলনায় রাজপ্রাসাদ মনে হচ্ছে। নিশ্চিতভাবেই এটা সেই কুখ্যাত ডি ব্লক। গোটা ঘরটা স্যাঁতসেঁতে, মেঝেতে জল জমে আছে, ছাদ বেয়ে কালো কালো ছত্রাক বাসা বেঁধেছে। দেওয়ালে নোনা ধরে পলেস্তারা খসে আসার জোগাড়। একটা খাট অবধি নেই। বস্তা আর জাজিম পেতে তাতেই রোগীদের শুইয়ে রাখা হয়েছে। এই ঘরে দুজনকে দেখতে পেল ওরা। একজন দরজার দিকে পিছন ফিরে শুয়ে আছে। মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা। আর-একজন, যার গলার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিল ওরা, সে জাজিমে বসে দুর্বোধ্য জড়ানো গলায় কী যেন বলছে, লখন তার কাছে যেতেই সে জড়ানো গলাতেই বলল, “আজকে আমায় নিয়ে যাবে বলেছিলে? নিয়ে গেলে না তো?” লখন বললে, “যাব যাব, তাড়া কীসের? সময় হলেই নিয়ে যাব।”

—আমি সকাল থেকে তৈরি হয়ে বসে আছি, তোমরা কেউ আসছই না। কখন নেবে আমায়? নিয়ে চলো এক্ষুনি…

—এক্ষুনি তো নিয়ে যাওয়া যাবে না, সব জোগাড়যন্ত্র করে তবে নিয়ে যেতে হবে। মার্টিন সাহেব নিজে এসেছেন তদারক করতে…

রোগীর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। “সাহেব এসেছেন? তাহলে আজ হবে বলছ?”

—নিশ্চিতভাবে। সন্ধ্যা হোক।

—তাহলে আমাকে একটু বাইরে নিয়ে চলো। শেষবারের মতো একবার চারদিক দেখে নিই।

লখনের প্রিয়নাথদের ফেলে যাবার ইচ্ছে ছিল না। সে ইতস্তত করে প্রিয়নাথদের মুখের দিকে চাইল। প্রিয়নাথ একটু হাসার চেষ্টা করল। “তুমি এঁকে নিয়ে একটু ঘুরেই আস। আমরা এখানেই আছি। ইনি কি আজ ছাড়া পাবেন?”

হো হো করে হেসে উঠল লখন। “আপনি তাহলে কিছুই বোঝেননি স্যার। এর ধারণা এ হল ফাঁসির আসামি। একে ফাঁসিতে ঝোলানো হবে। রোজ খুব সকালে ঘুম থেকে উঠেই অপেক্ষায় থাকে, কখন একে ফাঁসি দেওয়া হবে। জনে জনে জিজ্ঞাসা করে। এভাবে চলবে সন্ধ্যা অবধি। তারপর ঘুমিয়ে পড়বে।”

“কেউ এঁকে সত্যিটা বলে না?”

“বলে। আমিই বলতাম। বিশ্বাস করে না জানেন। মরার এক অদ্ভুত নেশা পেয়ে বসেছে ওকে। ভাবে মরলেই সব কষ্ট দূর হবে। লোকে বাঁচার স্বপ্ন দেখে ভালো থাকে, আর এ মরার স্বপ্ন দেখে। আগে শুধরে দিতাম। এখন আর দিই না। এই তো অবস্থা। থাক না এর মধ্যেই একটু ভালো যদি থাকতে পারে…”

লখনকে যত দেখছিল, অবাক হয়ে যাচ্ছিল প্রিয়নাথ। এ বড়ো সাধারণ ছেলে না। কথায় শিক্ষার ছাপ। বেশ বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। এ ছেলে এখানে কী করছে? ভাবল জিজ্ঞাসা করবে, কিন্তু তার আগেই “আপনারা একটু অপেক্ষা করুন এখানে, আমি এঁকে বাইরে থেকে ঘুরিয়ে আনি। কোথাও বেরোবেন না। মার্টিন সাহেব দেখলে অনর্থ হবে”, বলে লখন সেই পাগলকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। সাইগারসন এতক্ষণ চুপ ছিলেন। খুব সম্ভব বোঝার চেষ্টা করছিলেন কী কথাবার্তা চলছে। এবার সুযোগ পেয়ে প্রিয়নাথ তাঁকে গোটাটা খুলে বললে।

“আপনারা এখানে এসেছেন কেন? এই নরকে? চলে যান… এখুনি চলে যান… নইলে বড্ড বিপদ…” গম্ভীর গলায় এই কথাগুলো শুনে দুজনেই একসঙ্গে তাকাল ঘরের একেবারে কোনার দেওয়ালের দিকে। পিছন ফিরে শুয়ে থাকা রোগী এবার তাদের দিকে ফিরেছে। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দুজনের দিকে। চোখের পলক পড়ছে না।

এমনটা যে হতে পারে দুজনের কেউই ভাবেনি। সাইগারসন প্রথম সংবিৎ ফিরে পেলেন। প্রিয়নাথকে জিজ্ঞেস করলেন, “কী বলছে?” প্রিয়নাথ ইংরাজিতে বলতেই সাইগারসন নির্দেশ দিলেন, “পাগলের কথাকে হালকা ভাবে নেবেন না। কেন এমন বলছে সেটাও জানতে চান।”

—আপনি এ কথা বলছেন কেন? —প্রিয়নাথ জিজ্ঞাসা করল।

—তা বলব না? এ বড়ো পাপের জায়গা। বড়ো পাপ এখানে… বড়ো পাপ… বড়ো পাপ… বড়ো পাপ… এখানে পাপ ঢুকেছে। অশুভ আত্মার ভর হয়েছে। সেই আত্মারা এসে আমাদের রক্ত চুষে খায়। ছিবড়ে বানিয়ে দেয়।

—কী বলছেন আপনি? কোন আত্মা?

—আপনারা জানেন না? এই ধলন্দরের মাঠে এককালে ঠগিরা কত মানুষের দেহ পুঁতে দিয়েছে। গভীর রাতে সেসব আত্মারা জেগে ওঠে। তখন তারা খুঁজতে বেরোয়…

—কাদের?

—পাপীদের। সেই মানুষের পাপ খেয়ে ওরা বেঁচে ওঠে। তারপর একসময় মানুষটাকেই খেয়ে নেয়। গোটা। শব্দ ওঠে… চপ চপ চপ… আমি সে শব্দ পেয়েছি…

—কাকে খেয়েছে ওঁরা?

—কেন, লালু মণ্ডলকে? এই ঘরেই থাকত। ওই যে, ওইদিকে। প্রথম যখন আনল, শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে হত। সারারাত ছটফট করত। তারপর মাটির নিচের আত্মারা ওকে ধরল। ধীরে ধীরে চারিয়ে বসল ওর মাথায়, ওর শরীরে। কেমন একটা শান্ত হয়ে যেতে থাকল লালু। চুপচাপ। কথা বলত না। গালাগাল দিত না। চেহারাও কেমন একটা ফ্যাকাশেপানা হয়ে গেছিল। ভ্যাবলার মতো দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে বসে থাকত। বসে বসেই বাহ্যি পেচ্ছাপ করত। এরকমই চলত। শুধু মাঝে মাঝে আত্মারা ভর করত ওর দেহে। তখন সারা শরীরে খিঁচুনি। মাথা ঠুকত দেওয়ালে। ওকে সেসময় শিকল বেঁধে, জ্যাকেট পরিয়ে রাখত। নিয়ে যেত ঝাড়াতে।

—কোথায়?

—তা আমি কী জানি? এদের ওঝা আছে, ঝেড়ে দেয়। তবে ভূতেরাও ছাড়ে না। শোধ নেয়…

—কীভাবে জানলেন?

—লালু দেখাত। আঁচড়ের দাগ। আত্মারা দেহ ছেড়ে দেবার আগে দাগ রেখে যায়। হাতে, বুকে… ঝাড়ানোর পর কিছুদিন একেবারে চুপচাপ থাকত লালু। তারপর একদিন রাতে আত্মারা এসে ওকে নিয়ে গেল।

—আপনি দেখেছিলেন?

—না। আমার রাতে ঘুম হয় না। সেদিন রাতে হয়েছিল। হতেই হবে। ওরা যখন আসে কাউকে জানায় না। আমার খুব আবছা মনে আছে। তিন-চারজন সাদা পোশাক পরা আত্মা এসেছিল। লালুকে নিয়ে গেল। তারপর চপ চপ চপ করে চিবিয়ে খেল… পরদিন ওদের বললাম… ওরা বলল লালু নাকি পালিয়েছে… আমি ভুল দেখেছি… স্বপ্ন দেখেছি…

—তা আপনি এখানে কেন?

—আমার পিছনে শল্ল ছেড়ে দিয়েছিল।

—সেটা কী?

—শল্ল জানেন না? মরা চণ্ডালের নাভি থেকে তৈরি হয়। অপদেবতা। শল্ল ভয়ানক খারাপ জিনিস। আপনার ভিটেমাটি উচ্ছেদ করবে। আমার এক জ্ঞাতি তারাপীঠের শ্মশান থেকে এই শল্ল জোগাড় করে গোপনে আমার ভিটাতে পুঁতে দিয়েছিল। যার বাড়িতে শল্ল ঢোকে, সেই বাড়ি নির্বংশ করে ছাড়ে। বউটা মরল, মেয়েটা মরল। লোকে আমায় এই নরকে ছেড়ে গেল। আমার মাথার মধ্যে এখনও শল্ল চলে বেড়ায়। আমি টের পাই…

—বউ আর মেয়ে মারা গেল কীভাবে?

—সে তো শল্লই মারল। আমার মাথায় বাসা বেঁধেছিল। আমার সঙ্গে কথা বলত। সে কথা আর কেউ শুনতে পেত না। আর সে কথা না মেনেও আপনার উপায় নেই। সারাদিন কানের কাছে ফিসফিস ফিসফিস… মনে হয় মাথাটা ফেটে যাবে… একরাতে শল্ল আমায় বলল, বউ আর বাচ্চাটাকে রেখেছিস কেন? শেষ করে দে… আমি অনেক বোঝালাম। হাতে পায়ে ধরলাম। শুনল না। কুড়োল দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে মেরে দিল। পুলিশ এল। আমি বললাম শল্ল মেরেছে। আমি মারিনি। বিশ্বাস করল না। এই নরকে নিয়ে এল।

—এখানে কেমন আছেন?

—ভালোই। এরা আমার কথা শুনেছে। বোঝে আমার মাথায় শল্ল বাসা বেঁধেছে, তাই দেখুন…

বলে ধীরে ধীরে মাথায় বাঁধা নোংরা ফেট্টিটা খোলা শুরু করল। খোলা হতেই প্রিয়নাথ আর সাইগারসন দুজনেই হাঁ হয়ে দেখল, লোকটার কপালের ঠিক ওপরে একটু ডানদিকে চুল অনেকটা জায়গা জুড়ে কামানো, আর সেখানে হাঁ করে রয়েছে গভীর কালো একটা গর্ত।

“এখান দিয়েই শল্লকে বার করে, বুঝলেন তো”, মাথার ফুটোর দিকে তর্জনী দেখিয়ে হাসি হাসি মুখে বলল লোকটা…

। পাঁচ।

লালু মণ্ডল যে পালায়নি সেটা প্রিয়নাথেরও এবার মাথায় ঢুকেছে। তার চেয়েও বড়ো যে সমস্যা, ডালান্ডা হাউসে কিছু একটা চলছে। সেটা কী, ধরেও ধরা যাচ্ছে না। সাইগারসন সাহেব এ দেশে নতুন, ফলে ঘাঁতঘোঁত খুব বেশি জানা সম্ভব না। সেদিন একটু পরেই লখন ঘরে ঢুকে তাদের প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেল, যেন তারা গোপন কিছু জেনে ফেলেছে। হাবেভাবে মনে হয় লখন কিছু জানে। বলবে না। পুলিশের পদাধিকারের জন্য অনেকে আবার প্রিয়নাথকেও চেনে। সবাই ডালান্ডা হাউসের কিপার না যে তাদের বর্ধমানের ছোটো কুমারের গল্প বলে বোকা বানানো যাবে। তবে একটা কিছু হয়েছে। সেদিন মার্টিন সাহেব আসার আগে কিপার বেশ ফুর্তিতেই ছিল, কিন্তু সাহেব চলে যাবার পর কিপার স্মিথের মুখ দেখেই বোঝা গেল ভয়ানক কোনও দুঃসংবাদ নিয়ে সাহেব এসেছেন বা কোনও কারণে তাকে চরম ধমক খেতে হয়েছে। প্রিয়নাথদের প্রায় পত্রপাঠ “পরে দেখব, এখন কিছু হবে না” বলে বিদায় করে দিল।

ফেরার পথে সেই পাগলের সব কথা সাইগারসনকে বলল প্রিয়নাথ। সাইগারসন বললেন, “এখন একটাই উপায়। এমন একজন বিশ্বস্ত দেশীয় লোক দরকার যে পুলিশের লোক না, তাকে কেউ সন্দেহ করবে না, কিন্তু সে আমাদের হয়ে কাজ করে দেবে। লন্ডন হলে চিন্তা ছিল না। আমার পরিচিত এমন বেশ কিছু লোক আছে… কিন্তু এ দেশে আপনিই ভালো বলতে পারবেন।”

মাথা নিচু করে খানিক ভাবল প্রিয়নাথ। শীতসন্ধ্যার কুয়াশা নেমে এসেছে চারিদিকে। ঠান্ডা বাড়ছে। অন্ধকারে ইতিউতি গ্যাসবাতির আলো। প্রিয়নাথের মনে পড়ছে সেই দিনের কথা, যেদিন এই সমস্ত কিছুর শুরু হয়েছিল। কে জানত একটা সামান্য এত্তেলা থেকে এইরকম এক অদ্ভুত রহস্যে জড়িয়ে পড়বে, যার কোথাও কোনও কূল কিনারা দেখা যাচ্ছে না!

দুজনেই হেঁটে চলেছে, কারও মুখে কোনও কথা নেই। সাইগারসনের মুখের ক্লে পাইপ থেকে ধোঁয়া উঠছে অবিরত। একটা প্ল্যান মাথায় আসছে, তবে মন সায় দিচ্ছে না। কিন্তু উপায়ও তো নেই। অনেক ভেবে শেষে প্রিয়নাথ বললে, “ক্রিক রোডে জন ড্রিসকল নামে এক প্রাইভেট ডিটেকটিভ আছেন। তবে বুড়ো হয়ে গেছেন। এখন আর কাজ করেন না। তাঁর এক চ্যালা, নাম তারিণীচরণ রায়, কিছুদিন হল ক্লাইভ স্ট্রিটে রে প্রাইভেট আই নামে ডিটেকটিভ এজেন্সি খুলে বসেছে। ছোকরা চালাক চতুর, যদিও তেমন পসার নেই। তাকে তেমন কেউ চেনেও না। আপনি বলেন তো কথা বলে দেখতে পারি…”

“খুব ভালো প্রস্তাব। তবে কালই যাওয়া যাক।” উত্তেজনায় দুই হাতের তেলো ঘষতে লাগলেন সাইগারসন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *