প্রাচীনকালের আধুনিকা
কালিদাসের কালের সেই নিপুণিকা, চতুরিকা।—যাদের সঙ্গে মিলন হয়নি বলে অন্যমনা হয়েছেন কবি—তাদের বিচ্ছেদের দুঃখ কিছুটা ভুলিয়ে দিয়েছে তাঁর নিজেরই কালের ‘বিদুষী’ ‘বিনোদিনী’রা। কালিদাসের সময়-তারিখ মিলছে না—তাতে দুঃখ নেই কোনো, কিন্তু—
হায়রে গেল সঙ্গে তারি,
সেদিনের সেই পৌরনারী,
নিপুণিকা, চতুরিকা,
মালবিকার দল।
আদি সাহিত্যের যত কবি-সাহিত্যিক আছেন, তাঁরাও সবাই আকুল হয়েছেন এই বরাঙ্গনাদের নিয়ে। গাঁয়ের বধূর সরল, শান্ত মুখচ্ছবি নিয়ে ‘ভ্রুবিলাস শেখে নাই কারা সেই নারী’—এমনতর কবিত্ব হয়েছে অনেক; কিন্তু তাদের নিয়ে কখনো চিন্তাকুল দৃষ্টিতে বসে থাকতে হয়নি কবিদের। সহজ কথাটি, সহজ ভাবটি সহজেই সেখানে ধরা পড়েছে। অথচ যাদের দৃষ্টির বিভ্রম নিয়ে ঝড় উঠেছে কবিকুলে? যার গ্রীবাভঙ্গে কত শত নবকুমারের হৃদয়তন্ত্রী বেজে ওঠে, যে একবার কথা বললে, মনে হয় কেন বলল, কিংবা, না বললে মনে হয় কেন বলল না—তারাই হলেন নাগরিকা বা পৌরনারী।
নাগরিকার সংজ্ঞা করা যায় না। শব্দের অন্তরে যদিও নগর কথাটি আছে তবু তাকে যে নগর-বাসিনী বা পুর-বাসিনী হতেই হবে এমন কোনও মাথার দিব্য নেই। আমরা জানি ‘নাগর’ কথাটি এখন আর স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত নয়, কিন্তু সেকালে নাগর, নাগরক কিংবা নাগরিক বলতে যা বোঝাত, তাতে তার নগরবাসের ঠিকানাটি যথেষ্ট নয় মোটেই; বরঞ্চ একটি বৃত্তি, যে বৃত্তিতে মার্জিত রুচি, সৌন্দর্যবোধ, বাক-বৈদগ্ধী—এ সব কিছুই প্রতিবিম্বিত হত,—সেই বৃত্তিই ছিল নাগরিকত্বের সবচেয়ে বড় প্রমাণ। সেক্ষেত্রে নাগরিকা মানে শুধুমাত্র শহুরে মেয়ে নয়, সে হবে বুদ্ধিমতী, সুরসিকা, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘সফিসটিকেটেড’ এক অর্থে আধুনিকাও বটে।
দুঃখের বিষয়, বাৎসায়ন তাঁর কামসূত্রে সম্পূর্ণ চতুর্থ অধ্যায়টি কাটিয়ে দিয়েছেন নাগরিকদের ব্যবহার নিয়ে, কিন্তু নাগরিকারা সেখানে একেবারেই উপেক্ষিতা। তবে টীকাকার এটুকু স্বীকার করেছেন যে, নাগরিক মানে বিদগ্ধ-জন এবং বিদগ্ধ বলেই তার স্থানটি নির্দেশ করা হয়েছে সেইখানেই, যেখানে বিদগ্ধজনেরা বাস করেন বেশি,—’মহতি বা সজ্জনাশ্রয়ে’, অর্থাৎ সেই নগরেই, কিংবা রাজধানীতে অথবা কোনো বর্ধিষ্ণু জায়গায়।
শহরের মেয়ে অর্থাৎ নাগরিকার সঙ্গে গ্রামবাসিনীর যদি কোনো প্রতিযোগিতা হয় তাহলে কে জিতবেন, প্রাচীনকালের নিরিখে সেকথা বলা বড়ই শক্ত, কেননা কাব্যপ্রকাশের একটি শ্লোকে দেখি, এক গ্রামবাসিনী মহিলা অত্যন্ত পরুষ ভাষায় গালাগালি দিচ্ছেন নাগরিকাদের। ধরে নেওয়া যায়, কোনো নাগরিকার কঠিন পরিহাসের প্রত্যুক্তি হিসেবেই সরলা নায়িকার এই গর্বোক্তি। সে বলছে—গ্রামেই আমার জন্ম, থাকিও গ্রামে, নগরের কায়দা-কানুনও জানি না তত। তবে এটুকু ঠিক যে, নগরবাসিনী চতুরা নাগরিকদের সামনে বসিয়ে তাদের প্রিয় পুরুষটিকে বশ করার ক্ষমতা রাখি আমি—অতএব আমি যা আছি, তাই আছি,—ণ্যআরিআশং পইণো হরেমি জা হোমি সা হোমি।
এই প্রস্তাবনা থেকে এটুকু পরিষ্কার যে নাগরিকাদের গর্ব খর্ব করা অনেক সুমহিলা থাকতে পারেন গ্রামেও, কিন্তু এই যে বাচনভঙ্গি, এইটেই ঠিক নাগরিকার মত নয়। কিন্তু সহজ না হলেও বিদগ্ধ বাচনভঙ্গি যেহেতু আয়ত্ত করা যায়, শিখে নেওয়া যায় সেই ভাবটুকু, ভঙ্গিটুকু—যা ঠিক নাগরিকার মত—তাই নাগরিকার ঠিকানা নিয়ে আমরা তর্ক করব না, বরঞ্চ আমাদের উপজীব্য হবে সেই জিনিসই, যাতে করে বুঝতে পারি নাগরিক কারা?
বাস্তবিক পক্ষে পরবর্তী কালে নাগরিকা বলতে যে ধারণা গড়ে উঠেছে আমাদের মনে, একেবারে আদ্যিকালের সাহিত্যে সে রকমটি দেখতে পাই না। নাগরিকারা সেখানে রূপবতীই শুধু; তবে একথা এখনই স্বীকার করে রাখা ভালো যে, একটু ছলা-কলা, একটু পরচিত্তাকর্ষক, কিংবা আহ্বানমূলক ভাবভঙ্গি—যাতে করে পুরুষের মনে হবে—’আহা কি দেখিলাম’—সেটি কিন্তু আদ্যিকালের সাহিত্যেও ছিল। যেমন ধরি বেদের মধ্যে ঊষার কথা। নিসর্গ সংসারে এই ঊষা যেন মোহময়ী নাগরিকা। কবির কল্পনার মতোই সে সুন্দর—নর্তকীর মত সে তার রূপ প্রকাশ করে—দীপ্তিময়ী, অবগুন্ঠিতা। সূর্যকে সে রাঙিয়ে দেয় আপন ভালোবাসার রঙে—কেননা তার যাতায়াত অভিসারিকার মতো। অন্যদিকে অগ্নি—তাকেও সে অবহেলা করতে পারে না। ঋষিগৃহে, আশ্রম-কাননে অগ্নি সমিধ্যমান হলেই না ঊষা তার দীপ্তি প্রকাশ করতে পারে। মর্ত্যলোকে, অগ্নির সঙ্গেও তাই তার নান্দনিক সম্পর্ক—কিন্তু এতো পুরো সমর্পণ নয়, এ যেন অল্প অল্প রস-নিষেক করে গৌরবকারী, পুরুষটিকে চেতিয়ে রাখা, অবশেষে আকাশের সঙ্গী সূর্যের কাছেই ফিরে চলে যায় ঊষা। ম্যাকডোনেল সাহেব পর্যন্ত ঊষার এই ‘দোলাচল-চিত্তবৃত্তি’ লক্ষ করে ছিলেন, নাহলে এমন কথা বলবেন কেন—Agni is naturally often associated with Usas in this connection, sometimes not without a side-glance at the Sun. তাহলে কি নাগরিকার চরিত্র হল প্রিয়তম পুরুষটি থাকতেও অন্যদিকে অভিরাম গ্রীবাভঙ্গি? ঠিক তা নয়, তবে তাও খানিকটা। মনে আছে সেই কবির স্ত্রীর কথা, যে কবিকে প্রায় রাজবেশে সাজিয়ে দিয়ে সামনে একখানি আরশি রেখে বলেছিল—’পুরনারীদের পরাণ হানিয়া ফিরিয়া আসিবে আজি’।
নির্মল-হৃদয় এই নারীর অন্তরে নিশ্চয়ই কোনো ঈর্ষা ছিল পুরনারীদের ওপর। যেহেতু স্বভাবগতভাবেই নাগরিকদের কিছু হৃদয় বিদ্ধ করার ক্ষমতা থাকে, তাই তাদের অহংকারে আঘাত করতে পারলেই যেন সরলা বধূর আত্মতৃপ্তি হয়। শুধু কবির স্ত্রী কেন, পুরুষ কবিরা—কালিদাস থেকে বাণভট্ট সবাই তাঁদের উদাত্ত গম্ভীর নায়কটিকে অনেক সময় হাঁটিয়ে নিয়ে গেছেন রাজপথ দিয়ে, আর দলে দলে পুরবালাদের হাজির করেছেন গবাক্ষপথে তারা নিতম্বের মেখলা গলায় পরে, চোখের কাজল ঠোঁটে মেখে, একে অন্যের জন্য অপেক্ষা না করে লালায়িত চোখে চোখ রেখেছে, যাতে অভিমত পুরুষের চাহনিটি তার দিকেই পড়ে। কিন্তু তা হয়নি, নায়কে ‘হাথথি চলে বাজারমে’ এই ভঙ্গিতে অবহেলে, পুরনারীদের মনে অসংখ্য দাগা দিয়ে, উপস্থিত হয়েছে কোন এক বনজ্যোৎস্নার মতো শান্ত বালিকার কাছে। এসব লেখা খুব ভালো, খুব-ইচ্ছাপূরক কিন্তু কবির পক্ষে এটা আত্মবঞ্চনা নয়তো? ‘পুরস্কার’ কবিতায় কবির স্ত্রী এবং সংস্কৃতের পুরুষকবিরা বিলক্ষণ মনে মনে জানতেন, যে পুরনারীদের চোখে পড়েও যদি আবার ঘরে ফিরতে হয় তাহলে আয়োজনে প্রত্যয় তার ওপরেই যে হৃদয় বাঁধতে পারে আরও গভীরতরভাবে।
কালিদাসের যক্ষ যখন মেঘকে দূত করে পাঠিয়েছিল, তখন তাকে কিছু ঠিকানা দিয়েছিল আমোদ-প্রমোদের জন্যে। অর্থাৎ পরের কাজে শুষ্ক পথটি যেন নারীসঙ্গহীন অবস্থায় না যায় সেই ব্যবস্থা। জড় প্রকৃতিকে চেতনার রঙে সাজিয়ে নায়িকার কাজ চলেছে অনেক জায়গায়, কোথাও বা কালিদাস সশরীরেই উপস্থিত করেছেন কাউকে, কিন্তু একটি জায়গায় তিনি মেঘকে প্রায় জোর করে ধরে নিয়ে গেছেন, সেটি তাঁর নিজের বসতি উজ্জয়িনী। অলকাপুরীর সোজা রাস্তা বাতলে দিয়ে যক্ষ বলল—ভাই মেঘ, উত্তরদিকের পথিক তুমি, পথ যদিও বাঁকা হবে তবু উজ্জয়িনীর বিরাট বিরাট বাড়িগুলো না দেখে চলে যেয়ো না। তবে হ্যাঁ, এই পাষাণকায়া রাজধানীটি দেখানোর জন্যই তোমায় এই বাঁকাপথে নিয়ে এসেছি তা মনে কর না। আমার জন্য সুদূর অলকা যাবার পরিশ্রম স্বীকার করেছ তুমি, তোমাকে তাই দর্শনীয় বস্তু থেকে বঞ্চিত করব না। উজ্জয়িনীতে গেলে দেখতে পাবে, সেখানে আছে পৌরাঙ্গনারা। তাদের বিদ্যুৎ-চোখের চাহনি যদি একটু পরখ করে না যাও—তাহলে চোখ থাকতেও তুমি অন্ধ—”লোলাপাঙ্গৈ যদি ন রমসে লোচনৈ বঞ্চিতোহসি।” যদি বল, কাজল-চোখের চাহনি তো অনেক দেখেছি, এই তো যখন তোমার কথামতো মালক্ষেত্রের কাছাকাছি এসে পড়েছিলাম, তখন জনপদবধূরা আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়েছিল—তাহলে বলি, ওরা গাঁয়ের বধূ—ওরা জানে বৃষ্টি হলেই শস্য হবে, তাই তাকিয়েছিল তোমার দিকে, এ কেবল অন্য উদ্দেশ্যে ‘প্রীতিস্নিগ্ধ’, শীতলচোখের ছায়াপাত। কিন্তু উজ্জয়িনীতে যদি যাও, তাহলে দেখবে বিনা কারণেই পূর্ববালারা অপাঙ্গ সন্ধান করবে তোমার দিকে। তোমার মতো ভোগী মানুষ উজ্জয়িনীতে গেলে ভোগবাসনা চরিতার্থ হবে—ফলম অধিকলং কামুকত্বসা লবধবা।
মেঘদূতের এই এতটুকু বর্ণনা থেকে এটা মনে করা কিন্তু ঠিক হবে না যে, কটাক্ষই নাগরিকাদের একমাত্র সম্বল। আগেই বলেছিলাম নাগরিকার সংজ্ঞা করা যায় না, এখানে ওখানে নাগরিকাদের ওপর কবির পক্ষপাতদুষ্ট কথা থেকে, আলঙ্কারিকদের স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাস থেকে নাগরিকাদের চেহারা কিম্বা চরিত্রটি পুনর্গঠন করে নিতে হবে। অমরু কবি—যাঁর এক একটি শ্লোককে আলঙ্কারিকেরা বহু যত্ন করে উল্লেখ করেছেন—তাঁর মতে নাগরিকাদের আচার-ব্যবহার মোটেই সাধারণ মহিলাদের মতো নয়। প্রসঙ্গ এলে অন্য নারী যেখানে ক্রুদ্ধ হবেন সেখানে সামান্য ভ্রুকুটি দিয়েই কাজ সেরে নেবেন নাগরিকা, কথা কাটাকাটির প্রশ্ন এলে, তিনি থাকবেন প্রায় নিরুত্তর—’কোপো যত্র ভ্রুকুটি-রচনা বিগ্রহো যত্র মৌনম।’ বিদগ্ধা নাগরিকার অনুনয়বচন হল তাঁর স্মিত হাসিটি, আর প্রসন্নতা বোঝা যাবে তাঁর উদার আয়ত দৃষ্টি থেকে। একই কথা একটু অন্যরকমভাবে উপস্থাপন করেছেন মহাকবি হাল। তাঁর মতে—সুমহিলাদের রীতিই নাকি হাসি দিয়ে তিরস্কার করা, বেশি আদর করে ক্ষোভ জানানো আর চোখের জলে নিজেকে আরও বেশি আকর্ষণীয় করে তোলা।
এ তো গেল নাগরিকাদের স্বভাব, তবে সব নাগরিকাদেরই স্বভাব একরকম নয়—’সময় বুঝে মানুষ দেখে’ কেউ বা একটু ধীরা কেউ বা কিছু প্রগলভা। আমরা উজ্জয়িনীতে যে নাগরিকাদের দেখেছি তারা দ্বিতীয় দলের; আর অমরু, হাল যাঁদের কথা লিখেছেন তাঁরা প্রথম দলের—বিদগ্ধা নাগরিকা। বড়মাপের চরিত্র সৃষ্টি করার সময় কিন্তু মহাকবিরা বেছে নিয়েছেন বিদগ্ধা নাগরিকাকে। কেননা মহাকবিদের আপন অন্তরে যে বাছাই করা শব্দচিত্র আছে তা প্রকাশ করতে হলে বিদগ্ধা নাগরিকার মুখেই তা বসাতে হবে। নৈষধকার তো এতদূর বলেছেন যে, ”বাঁকা কথার বাঁধুনী—সে তো তোমার মুখেই মানায়, বুঝতেই পারি না তুমি ‘হ্যাঁ’ বলছ, নাকি ‘না’ বলছ, এখন বুঝি আলঙ্কারিকেরা যে কবিতার মধ্যে ব্যঞ্জনা খুঁজে বেড়ান, বিদগ্ধা মহিলার কথাই তো সেই ব্যঞ্জনাবৃত্তির আকর—বিদগ্ধনারী-বচনং তদ আকরঃ।” কাজেই বিদগ্ধা নাগরিকাকে কথা জানতে হবে এবং সেই শব্দমন্ত্রে তিনি সংসার জয় করবেন। শেষ প্রশ্নের কমলকে মনে আছে তো, বিদগ্ধা নাগরিকা প্রায় তাই। তবে যখন তখন রাস্তাঘাটে এঁদের পাওয়া যায় না। যাদের আমরা উজ্জয়িনীতে দেখেছি তারা সাধারণ শহুরে মেয়ে, চটুল পরিধান, মনোহর ভঙ্গি অল্প পরিচয়েও কিছু প্রশ্ন থাকে যেন! কি জানি কেন, নানা গ্রন্থে, মহাকবি কালিদাসের পক্ষপাত বারবারই তাদের ওপরে গিয়ে পড়েছে। এদের চটক যেহেতু বেশি, সাহসও বা—তাই বিদ্যুৎ ঝলকের মতো এরা কবিদের আকৃষ্ট করেছে বারবার। সেই মেঘদূতেই উজ্জয়িনীর তিমির রজনীতে ‘ক্বচিৎ বিদ্যুতালোকে’ এদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গেছেন কালিদাস। বলেছেন, রাজপথে রুদ্ধালোক রাত্রিতে, শঙ্কিত হৃদয়ে যে রমণীরা প্রিয়-মিলনের জন্য বর্ষাভিসার করতে বেরিয়েছে, তাদের পায়ের কাছে, নিকষে কনকরেখার মতো, একটুখানি বিদ্যুতের ঝিলিক দিয়ো তুমি। অতীতের মাঝে ডুব দিয়ে রবীন্দ্রনাথ এদেরই ডেকেছেন ‘সাহসিকা’ বলে—দেখিছ না ওগো সাহসিকা, ঝিকিমিকি বিদ্যুতের শিখা/মনে ভেবে দেখ তবে, এ ঝড়ে কি বাঁধা রবে/করবীর শেফালিমালিকা।
কালিদাসের বর্ণনা থেকে পাঠককুল সন্দেহ করবেন আমরা নাগরিকার চরিত্রের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছি অভিসারিকাকে। মনে রাখা দরকার, অভিসারিকা মাত্রেই নাগরিকা নয়, কিন্তু নাগরিকা হলেই মাঝেমধ্যে একটু আধটু অভিসারের ঝোঁক থাকবেই। তা যেমন কখনও একা একা, কখনও বা বহু সঙ্গে। আসলে নাগরিকা যে শহুরে মেয়ে, স্বভাবসিদ্ধভাবেই সে কিছু সাহসিনী হবে, হবে কিছু সপ্রতিভ। মাঝেমধ্যে তাদের প্রশ্রয় এমন মানুষদের ওপরেও পড়ে যে তাদের রুচি সম্বন্ধে সন্দেহ জাগে, কখনও বা ভয়ও। এই নিরিখেই বাণভট্ট স্থাঙ্গীশ্বর (থানেশ্বর) রাজধানীতে যে শহুরে মেয়েদের দেখতে চেয়েছিলেন, শ্লেষভরা ভাষায় তাদের বলেছেন—’মাতঙ্গ গামিন্যঃ শীলবত্যশ্চ’—তারা যেমন গজগামিনী তেমনি শীলবতী, চরিত্রবতী। মহারাজ পুষ্পভূতির রাজধানীর মেয়ে, কাজেই মাতঙ্গগামিনী শব্দের ওপরের অর্থ গজগামিনীই বটে; কিন্তু শ্লেষ ভাঙলে মানে দাঁড়াবে চণ্ডালগামিনী, কারণ মাতঙ্গ শব্দের অর্থ হল চণ্ডাল। এই শ্লেষের মধ্যেই বাণভট্ট তাদের নিশ্বাসে মদের গন্ধ পেয়েছেন, বুঝেছেন টাকা-পয়সার দিকে এদের একটু নজর বেশি কিংবা লক্ষ করেছেন তাদের উজ্জ্বল উচ্ছ্বল চেহারা, এমনকী তাদের ঊর্ধ্ববাসের সংকীর্ণতাও কবির নজর এড়ায়নি।
আমরা কালিদাস বাণভট্টের কথা বারবার বলছি তার কারণ এঁরা রাজধানীর কবি, শহুরে মেয়েদের এঁরা চেনেন ভালো করে। উৎসবমুখর দিনে সবার সঙ্গে সপ্রগলভ মেলামেশা, নাগরিক পুরুষদের সমানে সমানে চলা—এটি পাওয়া যাবে শহুরে মেয়ের চরিত্রেই। আমাদের কথা যে মিথ্যে নয় তার প্রমাণ দিয়েছেন একাধারে রাজা এবং কবি হর্ষবর্ধন শিলাদিত্য, তাঁর স্বরচিত ‘রত্নাবলী’ নাটিকায়। বসন্তোৎসব চলছে—বৎসরাজের রাজধানী কোশাম্বীতে। পুরজনের প্রমোদ দেখবার জন্য স্বয়ং রাজাও উঠে এসেছেন রাজপ্রাসাদের ছাদে। রাস্তায় দেখা যাচ্ছে পুরকামিনীদের। ঈষৎ মধুপানের রঙ ফুটে উঠেছে তাদের চেহারায়, পিচকারি আর আবির-গোলালে তারা বাতিব্যস্ত করে তুলেছে নাগরক পুরুষদের। মৃদুমন্দ মৃদঙ্গের তালে তালে নাচতে নাচতে সেই নাগরকদের কৌতূহল বাড়িয়ে দিচ্ছে আরও।
যদি বলেন, এরা যে গণিকা নয়, তার প্রমাণ? প্রমাণ হর্ষদেব পৃথকভাবে বারবিলাসিনীদের কথাও উল্লেখ করেছেন—ঐ একই রাজপথে, একই প্রমোদ উৎসবে, এবং তা ঠিক পুরকামিনীদের পরেই। কামসূত্রকার বাৎস্যায়ন তাঁর চতুর্থ অধ্যায়ে সুরুচিসম্পন্ন নাগরক পুরুষটির যে ছবি এঁকেছেন তাকে স্ত্রী-বেশে সাজিয়ে নিলেই তো ব্যাকরণগতভাবে শুদ্ধা নাগরিকার প্রতিচ্ছবি পাওয়া যেতে পারে। তা থেকে ছেঁটে দিতে হবে সেইটুকুই যা নাকি স্ত্রী-সুলভ নয়। বাৎস্যায়নের মতে একজন শহুরে পুরুষ সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত অনেক কিছু করেন। তার মধ্যে বেশবাস, ঠোঁট রাঙানো কাজল পরা, পোষা পাখির সঙ্গে কথা বলা কিংবা দুপুরবেলায় ‘বিউটি স্লিপ’—এসব তো মেয়েদের মতোই, কাজেই শহুরে মেয়েদের সঙ্গে এসব দিব্যি মিলে যায়। মুশকিলটা হয় সন্ধ্যাবেলায়। এই সময়ে মোহন সাজে সেজে নাগরক পুরুষ বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে আড্ডা দিতে বেরোন। আজকাল যাকে ‘পার্টি’ বলি, তার আসর বসত কখনও পানাগারে, কখনও সামাজিক উৎসবে, কখনও সেই সব মহিলাদের বাড়িতেই, যাদের বাৎস্যায়ন বলেছেন ‘গণিকা’, ড. দাশগুপ্ত বলেছেন ‘demi-monde’ আমরা বলি এরা নাগরিকা নয়তো! ‘গণিকা’ কথাটি শুনলেই মনের মধ্যে যে ভাবটি আসে প্রাচীনকালের নিরিখে তার কিছু সংশোধন দরকার। বিদ্যা, বুদ্ধি, কলা, রূপ, শীল, গুণ সব কিছুরই চরম ফলশ্রুতি হল গণিকা অন্তত বাৎস্যায়নের মতে তাই।
রাজারা নাকি এঁদের মাথায় করে রাখেন, জ্ঞানীগুণীরা এঁদের স্তুতিবাদে মুখর—পূজিতা চ সদা রাজ্ঞা গুণবদ্ভিশ্ব সংস্তুতা। সবার প্রার্থনীয়া, সবার লক্ষ্যের বিষয়—এত প্রশংসার মধ্যে বাৎস্যায়নের একটি কথাই মুশকিল করেছে—তা হল ‘অভিগম্যা চ’। বুঝতে পারি গণিকা কথাটির তাৎপর্য যেখানে শারীরিক বৃত্তিতে, বাৎস্যায়নকে তাই একথা লিখতেই হয়েছে, কিন্তু তাঁর গুণমান কখনওই সাধারণ বারবিলাসিনীর সঙ্গে মেলে না, মৃচ্ছকটিকের বসন্তসেনাই তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। তাঁর রুচি, লাজ-লজ্জা কোনোটাই তো গণিকার মতো নয়। অথচ বসন্তসেনার পরিচয় তিনি গণিকা। ধনীমানী অনেক ব্যক্তিরই তিনি প্রার্থনীয়া বটে, কিন্তু অভিগম্যা তো নন। নাট্যশাস্ত্রকার ভরত যে গণিকার সংজ্ঞা দিয়েছেন তাতে ‘অভিগম্যা’ কথাটি কোথাও নেই, বরঞ্চ গণিকার গুণবর্ণনায় ভরত যতদূর গেছেন যে তাকে নম্র, গুরুজনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল পর্যন্ত করে তোলা হয়েছে। আবার সাধারণ রমণীদের মধ্যে যে সব দোষ আছে তাও নাকি তার থাকবে না। আরও বড় কথা, বেঁকিয়ে কথা বলতে তার জুড়ি নেই, ভাষায় নেই কোনো জড়তা। ভেবে দেখুন তো সাধারণ অর্থে এঁকে গণিকার সঙ্গে কতটা মেলানো যায়? বিশেষ করে সুরুচিসম্পন্ন যে নাগরিক পুরুষটি কাব্য-সাহিত্য কিংবা রসালাপের জন্য (কামসূত্রে তাই আছে) যে মহিলার বাড়ি যাবেন, সে গণিকা হতে যাবে কেন, সে নাগরিকা। সুরুচিসম্পন্না এই মহিলা সপ্রতিভভাবে বহু পুরুষের সঙ্গে মিশতে পারেন বলেই তিনি গণিকা হয়ে যাননি তো? স্মরণ করা যেতে পারে ফ্রান্সের সালোঁগুলির (Salon) কথা। সুন্দরী, শিক্ষিতা, অভিজাত এবং সুরুচিশালিনী মহিলাদের বাড়ির আড্ডাকেই বলা যায় সালোঁ। এসব জায়গায় নিয়মিত আসতেন জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিরা—জন স্টুয়ার্ট মিল থেকে গুস্তাভ ফ্লবেয়ার। শেষোক্ত ব্যক্তির আড্ডাখানা ছিল মারী আঁতোনায়েতের সালোঁ, মাদাম রোভারীর উৎসর্গপত্রে মারী আঁতোনায়েতের সম্বন্ধে উচ্ছ্বাসটিও লক্ষণীয়। মারী আঁতোনায়েতকে কি তাহলে গণিকা বলব? অবশ্য বহু পুরুষের সঙ্গে মেলামেশা, বহুজনের মনোরঞ্জন করা—এই যদি গণিকার একমাত্র লক্ষণ হয় তবে সব নাগরিকাই গণিকা, সর্বকালে সর্বদেশে, মারী আঁতোনায়েত থেকে আরম্ভ করে সবাই। আসলে সেকালের নাগরিকা, মানে, শহুরে মেয়েরা অনেকটা রবীন্দ্রনাথের উর্বশী কবিতার মতো। না সাধারণ লজ্জাবতী নারী, না অভিসারিকা, না গণিকা—অথচ তারা একটু আলাদা। আজকালকার কথা বলছি না তবে, সেকালের শহুরে মেয়ে মাত্রই তার ধরন-ধারণ, ভাবভঙ্গি, বেশবাস, কথাবার্তা এবং রুচি—এসব কিছুই কালানুযায়ী নিশ্চয়ই, ততটাই আধুনিক এবং তাৎপর্যপূর্ণ ছিল যা শেষ পর্যন্ত, আপাত কুৎসিত একটি শব্দের জন্ম দিয়েছে—নাগরী। আমরা একটি করুণ কাহিনি দিয়ে নাগরিকা বৃত্তান্ত শেষ করব।
শ্রীকৃষ্ণ ব্রজের গ্রাম্য পরিবেশ ছেড়ে, চূড়া-বাঁশি আর পীতধড়া বিসর্জন দিয়ে শহরে গেছেন মথুরায়। যেখানে যৌবনমদে মত্তা নটীদের জ্বালায় প্রাচীরের তলায় পর্যন্ত নিশ্চিন্তে থাকা যায় না, সেখানে কৃষ্ণের মতো প্রেমিক পুরুষের অবস্থা কি হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। যা হোক মথুরায় কংস-ধ্বংস ইত্যাদি কর্তব্য সেরে বহুদিন কোনো সময়ই পাননি সরলা ব্রজবধূদের খবর করার। বিবেকের দংশনে শেষ পর্যন্ত উদ্ধবকে পাঠালেন দূত করে। উদ্ধব আস্তে-ব্যস্তে নন্দ-যশোদা প্রভৃতি গুরুজনদের সঙ্গে দেখা করে যখন ব্রজবালাদের সঙ্গে আলাপ করতে আরম্ভ করেছেন তখন দেখা গেল তাঁরা ভীষণ ক্রুদ্ধ। বললেন, আবার আমাদের কাছে কেন, কৃষ্ণের মা-বাবার কাছে যাও, অনেক খবর পাবে। পুরুষের সঙ্গে স্ত্রীলোকের বন্ধুত্ব! যেন মধুকরের সঙ্গে ফুলের। এরকম আরও কিছুক্ষণ চলার পর বোঝা গেল, আসলে তাঁদের রাগটা কাদের ওপর। চৈতন্যপন্থীরা মনে করেন এই কথাগুলি স্বয়ং রাধিকার, কাজেই তাঁর জবানিতেই বলি। রাধা বললেন—তোমার সখা যদিও গোপজাতি, তবুও আপাতত তিনি মধুপুরীর মানিনীদের মান প্রশমনে ব্যস্ত থাকুন, কারণ তিনি তো আর এখন ব্রজের রাখাল নয়, মধুপতি বটে। তাছাড়া কংস হত হয়েছেন, বড়ই ভালো খবর, কিন্তু এখন তিনি নিশ্চয় মথুরার পুর-ললনাদের স্নিগ্ধ সলজ্জ হাসিতে অভিবাদিত হচ্ছেন, আমাদের কথা তিনি মনে রাখবেন কেন? কৃষ্ণ নিজের রতিকলায় কুশল, তাতে মিলেছেন মথুরা-নারীদের সঙ্গে। অবশ্য কৃষ্ণের মোহিত হবার কারণও আছে যথেষ্ট—তাঁদের বক্রোক্তিমাখা বাচনভঙ্গি যেমন, তেমনি তাঁদের বিলাস-বিভ্রম, কটাক্ষ—কথং…নানুবধ্যেত তদবাকৈর্বিভ্রমৈ শ্চানুভাজিতঃ। হে উদ্ধব, কৃষ্ণ আমাদের সঙ্গে আর নাই বা মিশলেন, নাই বা ভালোবাসলেন আমাদের, কিন্তু মথুরার পুর-ললনাদের সভায় স্বচ্ছন্দ কথা-প্রসঙ্গে এই গ্রাম্য গোপবালাদের কখনও স্মরণ করেন কি?—গোষ্ঠী মধ্যে পুরস্ত্রীণাং গ্রাম্যাঃ স্বৈর-কথান্তরে।
শ্রীমদভাগবতের কবি সরল সাদাসিধে গোপবালাদের জবানবন্দিতে মথুরার নাগরিকদের চটকদার স্বভাব-চরিত্র দারুণ ফুটিয়ে তুলেছেন। পদকর্তা বিদ্যাপতি সখীর আবেশে রাধাকে বারবার সান্ত্বনা দিয়েছেন—’ধৈরজ ধনি, মিলব তুরিতহি কান’ কিংবা ‘সো ব্রজনন্দন—ঝটিতি মিলব তুঅ পাশ।’ কিন্তু রাধা—তিনি তো জানেন কৃষ্ণের কি হয়েছে—
হমারি নাগর তন্ময় বিভোর
কেহেন নাগরী মিলল রে।
নাগরী পাত্র নাগর সুখী তেল
হমারি হিয়া দয় সেল রে।।
রাধার মনের ব্যথা প্রাণে-প্রাণে জানতে পেরে বিদ্যাপতিও রাধাকে আর মিথ্যে স্তোক দেননি, ঈর্ষাবশত বলেই ফেলেছেন—
শুন বরনারী
পুর-রমণীগণ রাখল বারি।
চৈতন্য-সম্প্রদায়ের দার্শনিকেরা বারবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবার চেষ্টা করেছেন—কৃষ্ণ আর কখনও, অন্তত একবারের জন্যেও বৃন্দাবনে ফিরে এসেছিলেন কিনা, কিন্তু আমরা জানি মথুরার, আরও পরে দ্বারকার নাগরিকাদের মোহিনী মায়া এড়িয়ে কৃষ্ণের পক্ষে বৃন্দাবনের কুঞ্জভবনে আর ফেরা সম্ভব হয়নি।