ছয় – অরু
হ্যাঁ, চলে এসেছিলাম আমি বউদিকে ছেড়ে। চলে এসেছিলাম বলে বিনয়দা! আপনি বলেছিলেন, ছি ছি! বউদি একলা থাকবেন?
তুমি এ কি করলে অরু?
কি করতাম, কি করতাম আমি তখন? বউদিকে কার হাত থেকে বাঁচাতাম? বউদি বিশ্বাস করত, ম্যারেজেস আর মেড ইন হেভন।
আমার সঙ্গে তর্ক লেগে যেত।
—সব বিয়েই কি স্বর্গে হয় বউদি?
—বিয়ে করো অরু বুঝতে পারবে।
—আপনাকে দেখেই বুঝতে পারছি।
—তুমি বিয়ে তো করবে বাপু।
—অবশ্যই। বিনয়দাকে দেখে ভয় হয়ে গেছে।
—বিনয় তো ওইরকমই।
কি রকম তা আমি জানি না। আগে ভাবতাম বিনয়দা বউদিকে ভালবাসে। বউদি অবশ্যই ভালবাসে কাপালিকটাকে। সত্যি, লোকটাকে আমি ভণ্ড কাপালিক ছাড়া কিছুই মনে করতে পারি না। সেই পুরনো সিনেমার, বা ‘উল্লাসিনী গ্রন্থমালা’ সিরিজের ভণ্ড কাপালিকদের মতো, যারা মাঝে মাঝেই হঠাৎ আবির্ভূত হয়। আর মানুষের সুখশান্তিতে আগুন ছিটিয়ে দিয়ে হঠাৎ মিলিয়ে যায়। একটা দামড়া মদ্দ নেটের গেঞ্জি পরে। মোজার সঙ্গে নাগরা, দাড়ি কামিয়ে কি সব মাখে। চোখ সরু করে হাসে, কাপালিক ছাড়া আর কি?
চাঁদুদা বলে, বাবু কালচারের প্রতিনিধি।
আমার বিশ্বাস, ছোটবেলা ওর বাবা পেটাত যখন, তখন নিশ্চয় তার কারণ ছিল।
বউদি বলত, বাবার কাছে মার খেয়ে খেয়ে…
আমার ওকে পেটাবার খুব ইচ্ছে ছিল অনেকদিন ধরে। বউদির জন্যে পারি নি।
না, বউদি বোধহয় মরেই যেত এ কথা জানলে। বউদিকে ছেড়ে না এসে কি করতাম? লোকটা তো কবেই চলে গেছে আলাদা বাড়িতে। বছরের পর বছর দেখেছি, নিজের জন্মদিনে, নিজের বিবাহবার্ষিকীতে, ছেলের বিয়ের তারিখে, বউদি ফোন করে যাচ্ছে, যেন ক্ষমা চাইছে। আর ওদিক থেকে কিছু বাঁকা কথা, ব্যঙ্গের হাসি, কত সহ্য করা যায় বলুন?
এই যে ইয়ং ছেলেমেয়েরা (জিনিকে আমার বেশ লেগেছিল) আসছিল। বউদি একটা বাস্তব জগতে ফিরে আসছিল, নিজের আত্মবিশ্বাস ফিরে পাচ্ছিল। লোকটা তার ওপর রোলার চালিয়ে দিল তো?
বউদির কথা শুনেই বুঝতে পারছিলাম ও কি বলছে!
—কি বললে? আমি ধাষ্টামো করছি?
—কতকগুলো কি ছেলেমেয়ে? ডেঁও ছেলেমেয়ে মানে কি? ওরা তোমার বিরোধী শিবির? ছি ছি, ওরা ছাত্রছাত্রী।
—ক্লাসিকাল নাটক পড়ব, তাতে কি হল?
—আমি উচ্চারণ শেখাতে পারি না?
—কারা নাচাচ্ছে? আমার স্তাবকরা? দেখ! অনেকবার বলেছি তুমি বিনয়দের সম্পর্কে…
আমি সইতে পারিনি আর। বউদির হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে বলেছি, তুমি একটা বাস্টার্ড! বদমাশ! ভণ্ড কাপালিক! তোমাকে মেরে ভুট্টা করে দেব, বুঝেছ?
বউদি চেয়ারে বসে পড়েছিল। আমি বললাম, আমি জানি কি কি হবে। আপনি আমার মুখ দেখতে চাইবেন না, আমি বেরিয়ে যাব। আপনি তারপর শেলীকে দৌড় করাবেন। আমি ফিরে আসব। না, আর নয় বউদি।
বউদি কাঁদতে কাঁদতে বলল, সাত সকালে ওকে…
—জন্মে তো ফোন করে না, আপনি করেন। তা সাতসকালে ফোন করে ও কি কথামৃত শোনাচ্ছিল? সোজা কথা, আপনি একটু একটু করে ধাতস্থ হচ্ছিলেন, ও তা হতে দেবে না।
দত্তদা, আপনি বললেন, ভণ্ড কাপালিক! বেশ বলেছ! বলা দরকারই ছিল।
বিনয়দার তো যত ভাবনা বউদিকে নিয়ে। আপনি বললেন, বউদির সামনে বললে!
বলেছিলাম। আপনারা অনেক দেখেছেন, অনেক দেখেন নি। শীতের সময়ে পুরনো সোয়েটার খুলে, উল সাবানে ধুয়ে বুনতে দেখেন নি গায়ের জামা। বললাম, এমন নয় যে আপনি শাড়ি কিনতে পারেন না, অথবা একটা উলের সোয়েটার।
একটু হাসত। বলত, এক সময়ে টাকাকে টাকা মনে করিনি অরু! এমন অলক্ষ্মী কেন হলাম? আমার মা তো এ রকম ছিল না।
না, আপনারা দিনের পর দিন বউদির মুখে তাঁর মায়ের কথা শোনেন নি। এটা কি আশ্চর্য নয়, যে কুমারী জীবনের কথাই বলত, বিবাহিত জীবনের কথা আমার কাছে বলত না? হয়তো আশ্চর্য নয়। বউদি তো জানত যে আমি লোকটার নাম সহ্য করতে পারি না।
অবশ্য দূরে গিয়ে বুঝেঝি, যে অরুণ তালুকদার কোনো ক্রিমিনাল হয়তো নয়। বউদির মতো ভালবাসার তীব্রতা তার ছিল না।
অসুস্থতা এটা। উন্মত্ততা। প্রতিদিন পাচ্ছে না, একতরফা ভালবেসে যাচ্ছে। কি অর্থহীন আত্ম অপচয়!
আপনারা জানেন না, বাড়ি থেকে এটা সেটা বিক্রি করার ভয়ঙ্কর ইতিহাস! জানেন না শুধু ভ্রমণ নিয়ে কত কথা বলত!
বউদির কে এক আত্মীয়া ছিলেন। তিনি না কি তীর্থে তীর্থে ঘুরতেন।
বললাম, যান না, বেড়িয়ে আসুন না দেশ বিদেশ।
বলত, মনে মনে কম বেড়াই না কি? ম্যাপের বই দেখি, টাইমটেবিল দেখি, তা জান?
না, সেদিন ধৈর্য ছিল না আমার। একজন মহিলা, যার জন্যে আমরা চারজন ভেবে যাচ্ছি বছরের পর বছর,—শেলী নিজের কথা না ভেবে সেবা করে যাচ্ছে,—তাঁকে ভীষণ স্বার্থপর মনে হয়েছিল।
ভাগ্যে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলাম। বউদি ককিয়ে উঠল, শেলী! অরু যে সত্যিই চলে যাচ্ছে। দুমদাম করে ব্যাগে ভরছে সব!
শেলী বিরস গলায় বললে, তার পায়ে তো বেড়ি পরানো নেই মা! আমার পায়ে বেড়ি, সারাজীবন থাকব। অরুদাদা থাকবে কেন?
ভাগ্যে চলে এসেছিলাম। কিছু দিন ভেবে চলে গেলাম বাঁকুড়া। তারপর রাঁচি…তারপর সেরেংসিঘাটি…না গেলে এলিকে জানা হত না, জীবনটা ছিন্নভিন্ন হয়ে যেত, অর্থহীন, অপচয় হয়ে যেত নিশ্চয়।
অপচয়ই তো দেখেছি চিরকাল। দেখেছি, মনে মনে রাগে জ্বলে গেছি। কষ্ট হয় না, রাগ হয়, এতো আপনারা জানেন। কাকে বিশ্বাস করি ভাবালুতায় নয়, এটা বউদির কাছেও বাড়াবাড়ি মনে হত। কেন নিজের জামাকাপড় নিজে কাচি, ঘর পরিষ্কার করি, শখ শৌখিনতার ধার ধারি না, বউদি কষ্ট পেত।
আপনারাও কম নন। বউদিকে অনেক আগে যদি বাস্তবজগতে টেনে আনতেন অরুণ তালুকদারের সঙ্গে সঙ্গে আপনারাও ওকে ছেড়ে যেতেন, বউদি হয়তো অন্যরকম হতে শিখত।
অলকাদির মতো।
মালিনীদের মতো।
হয়তো ও বাড়ির ঘড়িগুলো চলত। ঘড়িগুলো তো ১৯৭৪ সালের সেই দিনটায় থেমে আছে, যেদিন অরুণ তালুকদার ও বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। সমস্ত বাড়িতে তার ফিরে আসার প্রতীক্ষা।
প্রতীক্ষা খুব নিঃশব্দ।
নৈঃশব্দ্য ভয়ংকর গুরুভার।
আপনারা বউদির জন্যে ভাবেন, এই তো! আপনারা তাঁর জীবনের খুঁটিনাটিতে জড়িয়ে আছেন, অথচ তাঁকে চেনেন নি।
বউদির কাছে আমরা নিঃশেষে প্রয়োজনীয় ছিলাম না। ও অরুণ তালুকদারের জন্যে বেঁচে থাকত। আমরা সবাই সরে গেলেও ও বেঁচে থাকত, যদি ওর স্বামী ওকে একবার…
এ সব পুরাণে—মহাকাব্যে পড়তে ভালো, প্রাত্যহিক জীবনে অমন বিশাল ত্যাগ, প্রচণ্ড স্বামী—আনুগত্য, স্বামীর জন্য আত্মত্যাগ এ সব খাটে না। ভারতবর্ষ সম্পর্কে সে সব প্রাচীন ভাবমূর্তি বিসর্জন দরকার। সেই সীতাসাবিত্রীর মডেল ছিল বউদি। আর, এখন আমি বিশ্বাস করি, ভয়ংকর সচেতন না হলে, বেজায় ঝামেলা না পাকালে এ সব মূর্তি ভাঙা যাবে না। হায়! এ তো সে যুগও নয়, যে ‘আদর্শ রমণী’ হিসেবে বউদিকে উপন্যাসের নায়িকা করে মেয়েদের শিক্ষা দেয়া যাবে।
পিপুলকে আপনারা একতরফা ‘অভিযুক্ত’ বলেই জানালেন দেখছি।
আমি দূরত্বে বিশ্বাস করি। কিছুটা তফাৎ থেকে না দেখলে কোনো কিছুই ঠিক চেহারায় ধরা দেয় না।
আমি তো দূরেই চলে যাই সেদিন। এখন ভালো করেই বুঝি, পিপুল যে মনে করে তার মা তার বিষয়ে কিছুটা নিরাসক্ত ছিল, তারও হয়তো কারণ আছে।
স্বামী—স্ত্রী ব্যস্ত থাকে বলে ছেলেকে ছোটবেলাই হস্টেলে দিল ছেলেরই ভালোর জন্যে, ঠিক আছে। কিন্তু বাবারাই ব্যস্ত থাকেন। মা—রা নয়। এ হেন ধারণা হয়তো পিপুলের ছিল। মা নয়, বাবাই ওকে সময় দিয়েছেন বেশি, এটা ঘটনা। অরুণাবাবুকে পিপুল নিশ্চয় খুব ভালবাসে। কিন্তু ও একদিন না কি বউদিকে বলেছিল। তোমাকে আমি পেলাম কোথায়? সবসময়েই তো বাবাকে ঘিরে তোমার জীবন ঘুরত। আমি বাইরে থেকে দেখতাম মা!
মহিলা খুবই দুর্ভাগিনী। একজনের জন্যে সকলকেই হারাল।
আপনারা বলবেন, না।
সেটা কি সত্যি? বিনয়দার জীবন খুব কি শূন্য হবে? উনিও তো বাইরে চলে যান মাঝে মাঝে। পাহাড়ে গিয়ে প্রশান্তি খোঁজেন। দত্তদার আছে গাছপালা,—এবং মা কালী। চাঁদুদা আর জয়া বউদি অন্য রকম কাজ করছেন। তাই, কার্যকারণ যাই হোক, সরসী তালুকদারকে নিয়ে বসে নেই কেউ। এটা সমালোচনা নয় তারিফ জানাচ্ছি। আপনারা যে যার মতো বাঁচার ছক করে নিয়েছেন।
আর আমি? আমি তো পাহাড়ে গেলে প্রশান্তি পাই না, পাহাড়ের সন্তানদের জীবনে বিষ ঢেলে যাচ্ছি। আমি দেখি পতিত বনভূমি। নিঃশেষিত জীব ও প্রাণী জগৎ, বাতাস ও জল দূষণ।
আমার দেখাটা সত্তর ভাগ সত্য। আপনাদেরটা ত্রিশ ভাগ। আলিপুরের বাগানে মহীরুহরা আমাকে শান্তি দেয় না। কলকাতা ও জেলা শহরে শহরে ব্যাপক বৃক্ষ হত্যা আমাকে ক্ষেপিয়ে তোলে।
এই ক্ষ্যাপাক্ষেপি থেকে নৈরাজ্যবাদী হয়ে যাওয়াতে আমি বিশ্বাস করি না। ‘যা হচ্ছে, সব বিধ্বংসী’ বলে নিরাপদ দূরত্বে বসে থাকাকে আমি ঘৃণা করি।
কাজ, কাজ, কাজের মতো কোনো কাজ খুঁজতে চলে যাই, যে কাজ করে আমার মনে হবে সামান্য হলেও ভালো কিছু করছি।
এলির সঙ্গে বিয়ে অবশ্য হতেই হতো। এলি নার্স, পুরো না হলেও আধা ট্রেনিং নিয়েছে। সেরেংসিঘাটিতে ওদের, হো আদিবাসীদের গ্রামে গ্রামে বড় বড় গাছে মাচা বেঁধে ওরা ধান রাখে হাতির ভয়ে। এলেনা জোংকো ওখানে মাদার ফিগার। সকালেই ব্যাগে ওষুধপত্তর গুছিয়ে সাইকেলে বেরিয়ে যেত। দিনে ১৪—১৬ ঘণ্টা সাইকেলে ঘুরত।
আমি ওষুধ বানাতাম। ও নিয়ে যেত। আমরা তো ওখানে স্থানীয় লোকজনের প্রয়োজন মতো গাছগাছড়ার ওষুধ বানাই। কুষ্ঠ আর যক্ষ্মা যে ওষুধ খেলে সেরে যায়। তা বোঝাই। খুব স্বাভাবিক, স্বীরছন্দ জীবন। ফটাফট ইংরেজি বলে এলি। ওর সম্মান খুব।
বউদি তো নিজেই ‘আনারকলি’ হয়ে কবর গাঁথছিল নিজেকে ঘিরে, শেলীও তার মধ্যেই তলিয়ে যাচ্ছিল। বউদিকে তো বাঁচানোই গেল না। ক্যানসারের সাতটা লক্ষণ ও জানত না। চোখে ঝাপসা দেখছে, চশমা পালটাল, পেট দমসম লাগছে, রাতে খেল না, এর বেশি বুঝত না।
ভাগ্যে সুলতানাদি ছিলেন!
কত বলেছেন, আমায় নার্সিংহোমে নয় অ্যাসিসট করলে? বউদি যাবে পরের সেবা করতে? ওর নিজের দুঃখ সবসময়েই কত বড় নয়?
ওই মহিলাই তো ঠাকুরপুকুরে…আর বউদিও মরে যাবে জেনে আত্মস্থ হয়েছিল,—ঠাকুরপুকুরে নেবার প্রস্তাবটা সুলতানাদির। বউদি রাজী হলো।
আর মরে যাবে জেনেই বলল, ‘বাড়ি যাব।’
শেলী হাত পা ছেড়ে বসে আছে। বউদি নেই, ওরই যেন যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে।
ওর কি হবে?
আমি খুব গদ্যময় মানুষ বিনয়দা, আপনারা বউদির কথাই ভাবছেন। আমি ভাবছি শেলীর কথা।
শুনতে অ্যাবসার্ড লাগবে। কিন্তু এবার আমি ওকে নিয়ে চলে যাব।
কি বললেন? কোথায় যাব?
আমি যেখানে থাকি, সেখানে।
ও সব জায়গা এখনো সম্পূর্ণ দূষিত নয়। নষ্ট হয়ে যায় নি সব কিছু। অন্তত দুঃখবঞ্চনা দেখতে হলে চেষ্টা করতে হয় না। তার মধ্যেই বাস করি বলতে পারেন। শেলীকে একটা অন্য মেরুতে নিয়ে যাওয়া দরকার। বউদি থাকলে বুঝত কি বলছি। কত রকম মানুষ ওখানে,—ড্রাইভার—বাসের হেলপার—মদের দোকানী—চাঅলা—ম্যাজিকঅলা,—হাটবারে তো মানুষের ভিড় ওখানে। হাটে যাওয়াটাই অন্যতম আকর্ষণ, কেনাবেচা না করলেও।
শেলী একদিন জুটে যাবে কারো সঙ্গে। ওরও একটা জীবন হবে। আমার যেমন হয়েছে।
ওর কথা ভেবেছেন?
বহু বছর ধরে ভণ্ড কাপালিকটার প্রতি বউদির প্রতিদান—অপ্রত্যাশী রাক্ষুসে অতিকায় প্রেমের তাজমহলের চৌকিদারনী করে রাখা হয়েছে ওকে—ভিনিশিয়ান কাচের আয়নায় মুখে দেখতে দেওয়া হয়েছে—পুরনো পোকায় কাটা শ্রফের কার্পেটে শুতে দেওয়া হয়েছে—সেট ভেঙে যাওয়া দামী এবং ফাটা ডিনার প্লেটে ভাত, শাকভাজা আর কাদাচিংড়ির চচ্চড়ি খেতে দেওয়া হয়েছে—ওর যাবজ্জীবনের মেয়াদ খতম। ওকে আমি নিয়ে যাব জ্যান্ত মানুষদের জগতে। ও বিনয়দা নয়, পাখির ছবি তুলবে না, দত্তদা নয়, ক্যাসুরিনা বা জ্যাকারান্দা গাছের নিঃশব্দ সংগীত শুনবে না—চাঁদুদা নয়, রিসার্চ করবে না। এ শহরে কাপালিক থাকে, নির্ঘাৎ টার্গেট করবে ওকে—ওকে আমি নিয়ে যাব।
আমি আর এলি একটা কাঁচা, রোদে শুকনো ইটের এক কামরা বাংলায় থাকি। বাংলার চারপাশে ফণীমনসার গাছ। আমি আর এলি দুজনে মিলে হাজার টাকা পাই। আমাদের একটা চৌকি, একটা টেবিল, দুটো চেয়ার করে দিয়েছে রয়্যাল কার্পেন্টার শংকটা জোংকো। চাপাকল থেকে জল যে পারি আনি, রান্না করার জন্য কাঁচা ইটের একটা উঁচু ধাপি আছে—একটা জনতা স্টোভ, একটা কড়াই, একটা খুন্তি, দুটো গেলাস একটা থালা, ব্যাস! যে যখন পারি কড়াইয়ে খিচুড়ি রাঁধি, এক থালাতেই খাই। ওষুধপালার গাছগাছড়ার বাগান আছে সংগঠনের, একটা ছোট দু’কামরার হাসপাতাল, একটা রোগী থাকার শেড। এলি নার্স, আমি ওষধি চাষ করতে ও ওষুধ বানাতে শিখছি—রুগীর ভিড় থাকে, চর্মরোগ, আন্ত্রিক, জ্বর ইত্যাদি সারে।
এ শহরে থাকব না আমি, বউদির শোক আপনাদের বিনয়দাকে কোথাও বন্দী করে ফেলছে। আপনারা এই শহর নামক কাপালিকটার শিকার হয়ে যাবেন বলে দিলাম। শেলীকে ছেড়ে দিন, শেলী আর এলি বেশ থাকবে—শেলী নার্মাল জীবন পাক একটা। না, আমি বলব না বেশি কিছু—বউদির চেহারা আমাকে তাড়া করছে। চলে আসার সময়ে আমার সব কথা শুনে ও বলেছিল, আমাকে ফেলে যেও না অরু—আর জিগ্যেস করবেন না।
নেকলেসটা বেচে এলির বাপকে কিছু জমি কিনে দিয়েছে এলি—কিছু রেখেছে—সপ্তাহে সপ্তাহে বউদির চিঠি পেতাম, জবাব দিতাম না—সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে মাথার মধ্যে।
ক্যাসেটে আপনারা বংশপরিচয়, নাম, হেন—তেন বলেছেন কেন? পুলিশ কি জেরা করেছিল? আমি অত বলতে পারব না, দত্তদা হয়তো কিছু জানে—ওর বোন আমার মামিমা হয়—কুচবিহারে আমার বাবা, মা, একপাল ভাই—বোন—সবাই আছে। বাবা আমাকে ছোটবেলা থেকে পিটিয়ে পিটিয়ে ঘ্যাঁচড়া করে দেয়। বাড়ি থেকে আমি অনেক দিনই পলাতক—ওসব জীবন ফালতু হয়ে গেছে অনেককাল—কিন্তু আমার জীবন—কাহিনী তো অবান্তর, না? আপনাদের যেমন বংশ বা বাড়ি, বা বাবা নিয়ে অনেক বলবার আছে, আমার তা নেই মানে ওগুলো আমার কাছে ফালতু।
বউদিকে আমার মা বোন বা অনুরূপ কিছু মনে হয়নি। আপনাদের কথাতেই যাই—কিন্তু তার আগেই বুঝেছিলাম, বউদি, শামুক বা কাঁকড়া বা কচ্ছপকে জ্যান্ত রেখে—খোলাটা তুলে দিয়ে জীবনযুদ্ধে ফেলে দিলে সে যেমন অসহায়, তেমন অসহায় একটা প্রাণী। তাকে মর্মান্তিক যন্ত্রণা দেওয়া খুব সোজা, সে নিজেকে বাঁচাতে অক্ষম। এখন অসহায় কোনো প্রাণীকে নির্যাতিত দেখলে আমি জ্বলে যাই। আমার ছোট ভাই কয়েকটা বেড়াল—ছানা থলিতে ভরে পুকুরে ডুবিয়ে মেরেছিল বলে আমি তার ডান হাত মুচড়ে এমনভাবে ভেঙে দিই যে সে নুলো হয়ে আছে। এরকম কাজ আমি অনেক করেছি, অনেক। শেলী বলুক না, ওকে না বউদিকে কি বলেছিল বলে আমি রকের মস্তানকে কি পেটান পেটাই।
বউদিকে ওরকম মনে হয় বলেই আমি থাকতে গেলাম। আমি কাছ থেকে যা দেখেছি—তা আপনারা দেখেননি। বিনয়দা জমিটা বেচে দেবার আগের অবস্থা জানেন? আমি তো বাড়িতে খেতাম না, খুব ক্বচিৎ কদাচ খেয়েছি। দেখি বাজারই হয় না, মাছই আসে না। তারপর বুঝি জিনিসপত্র বেচছে। একদিন বললাম, যদি বেচতে হয়, আমাকে জানাবেন। আমি লোক আনব, সঠিক দাম পাবেন। অ্যান্টিক ফার্নিচারের ভীষণ দাম, বোকার মতো বেচবেন না।
জিনিস বেচবে, গয়না ব্যাঙ্কে রেখে গোলড লোন নেবে না। ওগুলো পিপুলের বউ পাবে। আপনারা কিছু মনে করবেন না, বউদি নিজেও নিজের কম শত্রু ছিল না।
আর ওই কাপালিকটা! বছরের পর বছর বউদির ভীরু গলায়—চেষ্টা করে সপ্রতিভ হেসে সাতসকালে ফোন করা—আজকের দিনটা মনে আছে তো?
একবার বউদির জবাব থেকেই বুঝলাম, ও কি বলছে।
—কি বললে? আমার জন্মদিন আমার কাছেই স্মরণীয় হয়ে থাক?
—…
—ও! বিয়ের তারিখটা তোমার মনে থাকে না? হ্যাঁ…হ্যাঁ…জানি, পিপুলের জন্মদিন…আমি এস.টি.ডি তো রেখেছি সে জন্যেই…তবে আশীর্বাদ জানাব না তা কি হয়?…পিপুল…জাপান গেছে সস্ত্রীক?…ও! না, ও তো লেখে না…সময়ই পায় না হয়তো…
এগুলো আপনারা শোনেননি। আমি শুনেছি। কতবার বলতে ইচ্ছে হয়েছে, ওদের জীবন আছে, কাজ আছে, ব্যস্ততা আছে—আপনি তার বাইরে…আউটসাইডার…অন্ত্যেবাসী… আপনার কাছে পয়লা জানুয়ারির মর্মার্থ যা, ওদের কাছে তা নয়…
বলতে পারিনি…ওঁর যন্ত্রণা দেখে রাগ হতো ওঁর ওপরেই…বলতে পারিনি…
আমাকে দেখতে হয়েছে, পালাকারের জন্মদিনে উনি টাকা দিচ্ছেন, একটা সরু, গুঁফো প্রৌঢ় ফুল আর কার্ড নিয়ে যাচ্ছে…যদিও পয়লা জানুয়ারি একটা ফোনও ওদিক থেকে আসত না। সবই ওয়ান—ওয়ে ট্রাফিক। একবার বলেওছি, টেলিফোনে এত বিল ওঠে আপনার…
বলত, ওর গলা শুনব বলে একেক দিন কত বার ফোন করি যে? আর ফোন না থাকলে তো পিপুলের গলাও…
দিনের পর দিন…দিনের পর দিন…যেদিন ফোনে ‘বাস্টার্ড’ বলে বেরিয়ে এলাম, সেদিনই বুঝেছিলাম বউদি ভেঙে যাচ্ছে।
এটাই যদি শেষ কথা হতো! এটাই যদি হতো শেষ কথা…আমার এত রাগ হতো না…পড়ুন, এই চিঠিটা পড়ুন… আমি অন্য ব্লকে কাজ করতে গিয়ে দুমাস থেকেই যাই…অনেকদিন বাদে ফিরে এসে চিঠিটা পাই…কি লিখেছে দেখুন!
‘অরু! আমার বোধহয় কিছু হয়েছে। ডাক্তার মনে করে জটিল কিছু। আমার বিশ্বাস হয় না। বিনয়রা কেউ জানে না। তোমাকে চিঠি লিখছি। অরু! আমি তোমাদের কাছে যেতে চাই। সব লিখে রেখেছি খাতায়, তুমি যেমন লিখেছ…আগে যাব চক্রধরপুর…সেখানে থেকে চাঁইবাসা যাব বাসে…তারপর রাজাঙ্কা…তারপর সেরেংসিঘাটি…তোমার সেই সব গাছগাছড়ার ওষুধের কথা লিখেছ না? সে সব খেলে আর এলির কাছে থাকলেই আমি… ভালো…হয়ে…যাব…তোমাদের কাছেই থাকব…অন্যরকম…কাজ করব…লিখেছিল…লিখেছিল…লিখেছিল…ওঃ!
না, নিজেকে ধরে রাখতে হবে এখন…এই, এই যে দেখুন—ব্যা…গ! (অরু চেঁচায় ও কাঁদে)…জামা—কাপড়…সাবান…টুথব্রাশ…পেস্ট…গরম জামা…সাদা কাগজে স্টেপল করা ছোট্ট খাতার ওপর লেখা…অরু আর এলির ঠিকানা! অরু আর এলির ঠিকানা…অরু আর এলির…।
না, আর বলতে বলবেন না আমায়। ভীষণ রেগে যাচ্ছি আমি। ভীষণ…আমাকে আপনারা চেনেন না…আমি রাগলে নাপাম হয়ে ফেটে পড়ব এই এসেলওয়ার্লড শহরের ওপর…তেমন দুনিয়ার ওপর…ওয়াহ! কেয়া সীন হ্যায়! বলার জন্যে কাউকে রাখব না, কেননা চিঠিটা পেয়েই আমি দৌড়ে এসেছি আর ততদিনে বউদি কোমাটিক…বাড়িতে…
আর রাগতে দেবেন না আমায়…এ প্রচণ্ড সর্বনাশা রাগ ধরে রাখতে না পারলে আমি…
বউদির নাম করলেই সেই ভীষণ রাগে ফেটে যাব…।
ব্যাগটা আমার ঘরেই থাকবে, বিনয়দা।
—