পাঁচ – চাঁদ সামন্ত
সরসী তালুকদারকে আমি ‘বউদি’ বলেছি, বিনয়দা বলত বলে। অরুণ তালুকদারকে আমি ‘দাদা’ বলিনি, অরুণবাবু বলি। যে লোক নেটের গেঞ্জির ওপর চিকনের পাঞ্জাবি পরে, গায়ে সুগন্ধি মাখে, চুলে কেয়োকার্পিন তেল—দাশরথি রায়ের নাম জানে না, অথচ যাত্রা বিষয়ে বক্তৃতা দেয়, তেমন অশিক্ষিত লোককে আমি ‘দাদা’ বলি না।
বিনয়দাকে ‘দাদা’ বলি। প্রথমত, তাকে ভালবাসি (এঃ, বিনয়দা জেনে গেল), শ্রদ্ধা করি। ওর দুর্লভ গুণ হলো ও সবসময়েই সমসাময়িক থেকে যায়। আমি বয়সে বিনয়দার চেয়ে তের বছরের ছোট, আমার সবসময়ে মনে হয়েছে একজন সমসময়ের লোকের সঙ্গে কথা বলছি। অরু আমার চেয়ে পনের বছরের ছোট ওরও নিশ্চয় তেমনই মনে হয়। তার ওপরে যেটা আকর্ষণ করে, কোনো ভানভণিতা নেই। নির্ভেজাল সেই বাঙালি, যার রুচি, প্রবণতা, সৌজন্যবোধ, ভদ্রতা, মনের সততা পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে গঠিত। এবং বাণিজ্যিক মঞ্চ ও সিনেমার লাইনের লোক। সে মঞ্চ ও চিত্রজগতের খুঁটিনাটি সব খবর রাখে, সে সবে ওর ভালোবাসা প্রোথিত।
দেবী মুখার্জি আত্মহত্যা করলে আঠারো বছরের বিনয়দা কেঁদেছিল।
ছবি বিশ্বাসকে ও বলত রাজা—আর উত্তম—সুচিত্রার জুটির পর রোমান্টিক বাংলা ছবি মরে গেছে বলে ওর বিশ্বাস।
আধুনিক নয় ও? অনাধুনিকও নয়। এস ফোটোগ্রাফার ছিল। খুব সেনসিটিভ পোর্ট্রেট তুলতে পারত।
হেমন্ত মুখার্জির বাংলা গানের হিসেব ও মুখে মুখে দিতে পারে। মনটা ওর অত্যধিক নরম।
বিনয়দা কেন বিয়ে করে নি, তার একটুখানি আমি জানি। মেয়েটিকে ভালবাসত বছর ছয়েক ধরে—কিন্তু মেয়েটিকেই সে কথা বলে উঠতে পারেনি।
অবশ্যই মেয়েটির বিয়ে হয়ে যায়। আত্মীয়বৃত্তেই পড়ে, ফলে ক্বচিৎ কদাচ দেখাও হয়ে যায়। কিন্তু এ কথা মেয়েটি আজও জানে না।
আমার বহুদিনের বান্ধবী যখন আমাকে বিদায় জানিয়ে আমার এক দূরসম্পর্কের বকসওয়ালা কাকাকে বিয়ে করল, আমি কেঁদেছিলাম।
বিনয়দা আমাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে নিজের কাহিনী বলে।
আমার বান্ধবী এবং বিনয়দার সেই প্রেমাস্পদার নামটাও একই। বিনয়দা বলতে অনুমতি দিয়েছে বলে বললাম।
দত্তদাকেও আমি বিনয়দার সূত্রেই জেনেছি। দত্তদাকেও আমার ভারি পছন্দ। এমন খাঁটি মানুষ কমই দেখা যায়। দত্তদাও রুচি ইত্যাদিতে বিনয়দার স্কুলেরই লোক। দত্তদাও অনেক লোকের আপনজন হতে পারেন।
বউদির যে ব্যাপারটা আমাকে অভিভূত করত, তা হলো, অভিজ্ঞতা বা শিক্ষা দিয়ে নয় (বউদি কোনো ইংরিজি বই পড়েনি), হৃদয়ানুভূতি দিয়ে ও অনেকটা বুঝতে পারত।
পুরনো কেতার বাণিজ্যিক রঙ্গমঞ্চের অভিনেত্রী। কিন্তু আধুনিক যা কিছু, তা বুঝুক, না—বুঝুক—বুঝতে চেষ্টা করত।
আমি একান্তই পুঁথিগত বিদ্যা নিয়ে চলি। আমার সকল জ্ঞানই সেকেন্ড হ্যান্ড। অর্থাৎ অন্যের বইপত্রই আমার জ্ঞানের উৎস। অবশ্য এখন উৎসের সন্ধানও করি।
আমার নাম চন্দ্রনিভ সামন্ত। আমার বিচারক বাবা (স্কুলে শুনতাম ‘জজের ব্যাটা’) এবং সংস্কৃতে আদ্য—মধ্য—অন্ত পাশ মা, আমার অজানিত এবং ওঁদের জানিত কোনো গোপন ইচ্ছা পূরণ করেছিলেন সাতটি সন্তানের বিদকুটে সব নাম রেখে বিদ্যুৎনিভ (বব সামন্ত), সূর্যনিভ (সানি), বিশ্বনিভ (বেচারা আজও বিশে), চন্দ্রনিভ (চাঁদু বা চাঁদ), কুসুমবল্লভা (মানে কি?) এবং সমুদ্রপ্রভা (মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন)। এ হেন নামের বিরুদ্ধে যে—যার মতো বিদ্রোহ করেছি। বড়দা ও মেজদা যে জীবনবৃত্তে ঢুকেছে সেখানে বড় নাম চলে না। সেজদা চিরকাল স্কুলে গাল খেয়েছে, আ হা হা হা, বিশ্বনিভ! মানে বিশ্ব সদৃশ! নাম বদলাও, নাম বদলাও। বড়দি ভালমানুষ, জামাইবাবু ওকে এখানে ‘অয়ি বল্লভে’! বলেন। ছোড়দি এফিডেবিট করে সাগরী হয়েছে। চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়া!
আমার বাবার নাম কিন্তু লালগোপাল এবং মায়ের নাম কুমুদিনী। আমার নাম সংহিতা শুনে বউদি হাসতে হাসতে গড়িয়ে যেত। বলত, বাপ রে বাপ! নাম নিয়ে কি ভোগা না ভুগেছ!
—খুব। বিনয়দার মতো সৌভাগ্যবান নই। অরু তো আধুনিক সময়ের ছেলে।
আমি অনেক কথা বলব না।
বউদির ‘তাসের বিবি’ থেকে সব নাটকই দেখেছি আমি। অরুণবাবুর লেখা নাটকগুলো পড়েছি মাত্র। তাও কি ‘তাসের বিবি’ দেখতাম? বাবার ছবি রি—টাচ করাবার জন্যে কার কথায় যেন বিনয়দার স্টুডিওতে যাই।
বাবার গোঁপ ও স্যর আশুতোষ মার্কা জ্বলন্ত চোখ সেই জীর্ণ ফোটো থেকে উদ্ধার করা যায়নি। কিন্তু বিনয়দা আমার বন্ধু হয়ে গেলেন।
কোন বাড়ির ছেলে, কি পড়েছি, কি করি, বড়দের মতো জিগ্যেস করছিলেন, আমি উত্তর দিচ্ছিলাম। প্রেসিডেন্সি শুনে বললেন, আমিও প্রেসিডেন্সি হে। ১৯৪৯ সালের বি.এস.সি।
—আর আমি ১৯৬২—তে ইংরিজি অনার্স।
বিনয়দাই একদিন বললেন, চলো একজনের অসামান্য অভিনয় দেখিয়ে আনি।
বাণিজ্যিক মঞ্চকে তখন তাচ্ছিল্য করি। বলি, ওসব বস্তাপচা মালের দিন চলে গেছে। দেখা যায়, বসে?
—আমি তো দেখি।
দেখলাম। ‘তাসের বিবি’ দেখে সরসী তালুকদারের পায়ে মাথাটি রেখে এলাম, মনে মনে।
—এ রকম ট্যালেন্ট নিয়ে এই মঞ্চে?
—ভিড় দেখেছিলে? ভিড় হয়, মানুষ হাসে, কাঁদে আবার দেখে। ওঁর তো সব নাটকই হিট হয়। এটা অবাক কাণ্ড।
—নাট্যকারের বউ?
—হ্যাঁ। যদিও এ নাটক কিছুটা শোধরানো হয়েছে।
—নাট্যকার নারীবিদ্বেষী।
তখনো নারীমুক্তি আন্দোলন, ফেমিনিস্ট মুভমেন্ট, এসব শব্দ এমন প্রচলিত হয়। কিন্তু আমাকে লোকে ফেমিনিস্ট বলে, এবং আমি কারো দুঃখ—কষ্ট—যন্ত্রণা সহ্য করতে পারি না। মেয়েদের তো নয়ই। নাট্যকারের নারীবিদ্বেষ আমার ভালো লাগেনি।
বিনয়দা একটু চুপ করে থেকে বলেছিল, কি করবে বলো? পাবলিক পতিপরায়ণা সতী স্ত্রী, সন্তান—বাৎসল্যে প্রাণ দিতে প্রস্তুত মা, ইত্যাদি ইত্যাদি জীবনেও দেখতে চায়, মঞ্চ এবং পর্দাতেও।
—জীবনেও?
—আমার ধারণা, সাধারণত তাই চায়। ব্যতিক্রম থাকতেই পারে।
পরে বুঝেছি কথাটা সত্যি। সে সত্য অবশ্য বদলাচ্ছে, তবে ধীরে, অতি ধীরে।
বিনয়দা, দত্তদা—এদের সঙ্গেই অরুণ তালুকদারের বাড়িতে যাই, সরসী তালুকদারের সঙ্গে আলাপ করতে।
অরুণবাবু বলল, এদের তোয়াজ করো সরসী। এরা এ যুগের ছেলে…কালচার নিয়ে লেখে…উলটোপালটা লিখে দিলে তোমার ক্ষতি।
—তুমি কাগজে নাট্যসমালোচনা লেখো ভাই?
—না না, আমি লিখব নাট্যসমালোচনা?
বউদি অরুণবাবুকে বলল, তবে? বিনয় বাড়িতে কখনো কাগজের লোকজন ধরে আনেনি। অন্তত আমার জন্য নয়।
—আমার জন্যে এনেছিল, স্বীকার করি। তাতে লাভ হলো কি? এখন তো (কাঁধ ঝাঁকিয়ে অবজ্ঞার হাসি) আমি নাট্যকার হিসেবে…আউট হতে চলেছি।
বিনয়দা বলল, আপনাকে আউট করবে কে? একের পর এক মঞ্চসফল নাটক লিখে চলেছেন? কত লোক যে আপনাকে ঈর্ষা করে!
—হ্যাঁ (অহংকারী হাসি। লোকটাকে মুখ খুলে হা হা করে হাসতে দেখিনি কখনো। দেখছিলাম, ওর হাসি, কথা বলা, অসম্ভব চেষ্টিত)। ঈর্ষা তো করবেই। নাটক দিয়েছি, ট্রাজিডি কুইন দিয়েছি, ঈর্ষা হতেই পারে।
—ট্র্যাজিডি কুইন দিয়েছি! বুঝলাম না অরুণবাবু।
—আমার স্ফুলিঙ্গ, করুণা নিরুদ্দেশ, জননী।
—প্রত্যেকটা সুপারহিট নাটক।
—তাতে অভিনয় করেই তো ইনি তারকা হলেন। আমি চরিত্র দিয়েছি, ও অভিনয় করেছে।
বুঝলাম লোকটা অহং—উন্মাদ।
—অবশ্য চরিত্র না পেলে অভিনয় করতেন কি করে? এটা তো প্রথম কথা। পরের নাটক কি লিখছেন?
—এখন গোপন থাকুক।
বউদি এসে বলল, বাববাঃ! এত গোপন, এত গোপন যে লেখার ঘরে আমার ঢোকবার হুকুম নেই।
—স্টাডিতে বসে লেখেন?
—লেখার জন্য স্টাডিই তো চাই। বসার জন্যে বারান্দা, খাওয়ার জন্যে খাবার ঘর, শোবার জন্যে বেডরুম।
—কি সাজানো বাড়ি! যেন কোনো যুগের সেট ফেলেছে কোনো আর্ট ডিরেকটর।
বউদি ঝরঝর করে হেসে বললেন, সব যে সেকেলে ভাই! দাদামশায়ের আমলের। এর শ্বেতপাথরের টেবিলটা আবার তাঁর বাবার। তারপর…এর শখে স্টাডি সাজানো হয়েছে। আমার রিহার্সাল কিন্তু এ ঘরে—ও ঘরে।
আমি বোকার মতো বলেছিলাম, আপনার দাদামশাই কি অ্যান্টিক আসবাবের ব্যবসা করতেন?
অরুণবাবু চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, প্রজাশোষণ করতেন। জমিদার ছিলেন। ‘করুণা’ নাটকে দেখবেন জমিদারদের কেমন এক হাত নিয়েছি। দেব, বই দেব। পড়বেন। আপনি চন্দন মিত্রের নাম শুনেছেন?
—না তো।
—হয়তো শুনবেন।
আমি তো জানি না চন্দন মিত্র ‘তাসের বিবি’ রিভাইজ করেছে বলে বাড়িতে কি টেনশন চলেছে!
—অভিনেতা?
—নাট্যকার। অধীর কয়ালের মতে মহান নাট্যকার।
—থাক না ওসব ওসব কথা। চলো তোমরা। একটু চা খাবে চলো।
‘একটু চা’ মানে মটরশুঁটির ঘুগনি, আলু—পরটা, মাংসের চপ, কেক, চা।
—এত আয়োজন?
—ওর জন্যে করতেই হয়। তাও তো যে খেয়ালী! হয়তো বলে বসল এসব খাব না, নারকেলের সিঙাড়া খাব। তাই করতে হয় তখন! ও যে শিবঠাকুর! তুষ্ট না রাখলেই তাণ্ডব!
বউদির মুখে যেন ভেতর থেকে আলো জ্বেলে দিত কেউ অরুণবাবু প্রসঙ্গে কথা হলে।
আমি বিনয়দাকে বলেছিলাম, অভিনেত্রী বটে! গলার পাল্লা কি, ভয়েস কন্ট্রোল, ভয়েস থ্রো (স্বরনিয়ন্ত্রণ, স্বরনিক্ষেপ বলতে পারি না আমি। আমরা এক সংকর সময়ের প্রডাকট, কথায় কথায় ইংরিজির শরণ নিই) আশ্চর্য। ওরকম একটা মোটা দাগের চরিত্রকে কোথায় নিয়ে গেল? আর ওই যে চিৎকার, ‘আমার গলা ভেঙে যাচ্ছে কুমার। আমি কথা বলতে পারব না…গলা ভেঙে যাচ্ছে কুমার। আমি কথা বলতে পারব না…গলা ভেঙে যাচ্ছে…’
—যাকে বলে শ্যাটারিং, তাই না চাঁদু?
—হ্যাঁ, বিনয়দা।
—অরুণবাবুর নাটকগুলো পড়ো।
শেলী, বিনয়দা, দত্তদা যা বলেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি আমি বলব না। ওরা ওদের মতো বলেছে, আমি আমার মতো বলি। এ সময়টা এখানে আছি বলে এ কাজটা করে যেতে পারছি। তারপরেই তো বেরিয়ে যাব আমি আর জয়া। লম্বা, বহুত লম্বা সফর—রাজস্থান, হিমাচল, সৌরাষ্ট্র—লোকসংস্কৃতির নানা কর্মের সন্ধানে! কিন্তু বউদি সম্পর্কে আজ বলতে না পারি তো আর বলাই হবে না।
আমার অভিজ্ঞতাগুলো সাম—আপ করছি।
তবে বলা দরকার, অরুণবাবুর নাটকগুলো আমি পড়েছিলাম।
অসম্ভব মোটা দাগের নাটক। চড়া রঙের চরিত্র, আবেগের সাইক্লোন।
কি নাটকে, কি যাত্রাপালায়, সে এক জিনিসই লিখে যাচ্ছে। যে মেয়েটিই স্বাধীন ইচ্ছা বা সত্তা নিয়ে বিকশিত হবার স্পর্ধা করেছে, তাকে গভীর অনুশোচনায়, ভুল স্বীকার করতে করতে ফিরে আসতে হচ্ছে পুরুষের পায়ের নিচে।
পুরুষ চরিত্রগুলোও এমন যে তারা মা—স্ত্রী—বোন—মেয়ে—প্রেমিকা—বউদির বোন—বোনের ননদ—আশ্রয়দাত্রী প্রেমময়ী বেশ্যা—ইত্যাদি ইত্যাদি, কোনো মেয়ের প্রয়োজনীয়তাই স্বীকার করে না। তারা স্বয়ম্ভূ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ। মেয়েদের ত্যাগ, প্রেম, জীবনোৎসর্গ তারা নেয় অধিকার বলে।
প্রতিক্রিয়াশীল, সামন্ততান্ত্রিক, ভয়ংকর নীতিবাগীশ ও কট্টর।
‘করুণা’ নাটক থেকে শেষ যাত্রাপালা অবধি একই বিষয়বস্তু ঘুরে ঘুরে এসেছে। অবশ্য বিভিন্ন পটভূমিতে।
ভাষা—টাষা শাণিত হয়েছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু অরুণ তালুকদার যেমনটি ছিল, তেমনটি থেকেই জনগণ মনোরঞ্জন করে যাচ্ছে।
সাফল্যের মতো কিছুই সফল হতে পারে না। তা ছাড়া গান লেখে, পালার বিজ্ঞাপন লেখে, অরুণ তালুকদার একটি নাম।
আমি মনে করি লোকটা রক্তে রক্তে নারীবিদ্বেষী। উপেক্ষা দেখিয়েই বউদিকে আকর্ষণ করেছিল। কিন্তু বউদির ভালবাসার অপার ক্ষমতার জন্যে প্রস্তুত ছিল না।
আমার বন্ধু, যাত্রা—সাংবাদিক কুশলকে খিকখিক করে হেসে বলেছিল, যখন মঞ্চ ছেড়ে দিল, তখন থাকলেও থাকতে পারত। মা—মাসী—ধাই—দাসী, ক্রমে ক্রমে করতেই হতো। কিন্তু থাকল না তো? তাতেই মুছে গেল। শিল্পী হলে শিল্পের তাগিদেই করত। এখন তো…মুছে গেছে।
অরুণবাবুকে দোষ দেব কেন? বউদি এক অতি মানবীয় মাপের হৃদয় নিয়ে জন্মেছিল। অরুণ তালুকদারকে ভালবাসার জন্যই।
এ পর্যন্ত সবাই জানে।
যেটা জানে না, যেটা মর্মে বিঁধে আছে, সেটা হলো, বউদিকে কয়েক বছর ধরেই আমি নতুন নাটক পড়তে দিতাম, দেখাতেও নিয়ে যেতাম। খেলাচ্ছলেই বলতাম, পড়ুন তো, শুনি?
—একা একা কি পড়া যায়?
—পড়ুন না।
দেখলাম, গলার রেঞ্জ ভালোই আছে।
বললাম, আমার জানাশোনা ছেলেমেয়েরা সবাই ইয়ং। বাংলা ক্লাসিকাল নাটকে কোনো রসই পায় না। ওদের যদি একটু পড়ে শোনান—ধরুন মাইকেল, গিরিশ ঘোষ…দীনবন্ধু মিত্র…
—পুরুষ চরিত্রও তো আছে চাঁদু!
—কুশল চমৎকার আবৃত্তি করে। ও পড়বে।
বিনয়দা তো বিশ্বাসই করে না।
—রাজী হয়েছে?
—হয়েছেন, হয়েছেন…এটার অন্য দিকও আছে বিনয়দা। জনা, বা প্রমীলা, এসব চরিত্রের ক্রেডিবিলিটি আনতে গেলে…বউদিই পারবে। দেখবেন…
খুব, খুব জমে উঠেছিল কয়েকটা দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা।
বউদি অনেকদিন বাদে বাড়ি পরিষ্কার করে, আয়োজন করে বসে থাকত।
এখনকার সালোয়ার—কামিজ, বা জিনস ও কুর্তা—পরা মেয়েদের ও তরুণ ছেলেদের দেখে কি খুশি, কি খুশি।
ওরাও বউদির পাঠ শুনে খুব ইমপ্রেসড। টিটু বলল, এসব স্কুল অফ অ্যাকটিং চলে গেছে চাঁদুদা। এখন বিনোদিনী, বা তারাসুন্দরী, বা সরযূ দেবীর বিষয়ে শ্রদ্ধাসমীহের ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছে।
আর বউদি পরে বলল, কত, কত সহজ হয়ে গেছে সব, বলো? মেয়েদের পোশাকে কত স্বাধীনতা আর শোভনতা! ছেলেতে মেয়েতে কত সহজ বন্ধুত্ব। আমি জানতামই না। জানব বা কি করে? কাচের ঘরে সব বন্ধ করে বসে থাকলে কি রোদ—বাতাস আসে।
আমাদের এগারোটা সেশান হয়েছিল। বিনয়দা আর দত্তদা খুব খুশি।
অরু তো স্বল্পভাষী। ও বলল, কবে থেকে রগড়ে যাচ্ছি, হ্যাঁ বলেই না বউদি। কেমন, এখন ভালো লাগছে না?
—লাগছে।
—শুধু বই পড়ে, আর ছাতে হেঁটে, আর মাঝে মাঝে গঙ্গার ধারে বা গড়ের মাঠে বসে থাকলে কি সময় কাটে?
কলকাতা ছোট্ট গ্রাম। সাংস্কৃতিক জগতের বৃত্তটাও একটুখানি। কুশলের ও আমার উদ্যোগে, অলকাদির উৎসাহে, এ বাড়িতেই খাবার হলঘরে একটা ছোট্ট সেশন হয়।
অলকাদি বলল, যাক! সরসীদি নির্বাসন থেকে ফিরল! চলো! এবার বড় করে করব।
আর বউদি ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।
—আমি পেরেছি অলকা, আমি পারব?
—নিশ্চয় পারবে। এর পর মাঝে মাঝে, আমাদের অনুরোধে নাটকও করবে।
—পয়সা নেব না কিন্তু।
অরু বলল, তা নেবেন কেন? খাট—আলমারি—ফুলদানি বেচার জিনিস তো এখনো আছে। আমাকে চটাবেন না।
—আমার ওপর রাগতে রাগতে কতগুলো বছর কাটিয়ে দিলে অরু?
—আপনি ভালোই জানেন, রাগ কার ওপর?
—থাক থাক, অন্য কথা বলো।
ওই যে বললাম, কলকাতা একটা ছোট্ট গ্রাম। এই সেশনের পর, ক’দিনও যায়নি, বিনয়দার ফ্র্যান্টিক ফোন।
—অরু চলে এসেছে চাঁদু, তুমি এসো।
গেলাম।
অরু বলল, দত্তদাও আসবেন। তাছাড়া আপনারা দু’জন আছেন। দেখুন, আপনারা তিনজন দায়িত্ব দেন, আমি বউদির কাছে ছিলাম। আমি চলে যাচ্ছি, সেটা জানিয়ে গেলাম।
—কিন্তু কেন?
—ভোরে সেই কাপালিকাটা ফোন করেছিল। (অরু অরুণ তালুকদারকে ভণ্ড কাপালিক বলত)। ফোন করে বলেছে, এতকাল বাদে ধাষ্টামো করার মানে কি? কতকগুলো ডেঁও ছেলেমেয়ে জুটিয়ে সেশন হচ্ছে? তুমি ক্লাসিকাল নাটক পড়ছ, ওদের উচ্চারণ, হেন—তেন শেখাচ্ছে? যাক! যারা নাচাচ্ছে, তারা কি শেষরক্ষা করবে?
—গড!
—বউদি পড়ে যাচ্ছিল প্রায়, আমি ফোনটা কেড়ে নিয়ে বলেছি, তুমি একটা বাস্টার্ড! বদমাশ! ভণ্ড কাপালিক!
দত্তদা বলল, যাক! কেউ বলল তবে!
বিনয়দা বলল, বউদি কি…?
—না। আমিই বললাম, লোকটাকে যা মনে করি তাই বলেছি। আমি কেন, বহুজনই মনে করে। কিন্তু আপনি তাকে বিশাল ভালবাসেন—বহু বছর ধরে তার জন্যে আত্মহত্যা করেছেন। এখন আমাকে আপনি বদমাশটার ভালোত্ব এবং আপনার ওপর অপার ভালবাসা বিষয়ে বোঝাতে থাকবেন। তখন আমি লোকটাকে ঠাঙাতে যেতেও পারি। অতএব বউদি, আমি চললাম। কেন না আমি জানি, এর পর আর আপনি নাটক পড়তে সাহস করবেন না। দোকানে বেণুকে বলে যাব, ও আপনার বিল—টিল দিয়ে দেবে। ওঃ! একসঙ্গে এত কথা বলে ক্লান্ত লাগছে।
দত্তদা বলল, যাচ্ছ কোথায়?
—হাওড়া। তারপর রাঁচী—বরিহাতু। ‘সেভ দেম’—এর সঙ্গে কিছু কাজ করছি, ওখানেই ওদের সেন্টারে যাব।
বিনয়দা বলল, এখানে থাকো।
অরু বলল, আপনারা আমাকে চেনেনা। আমার হাতের থাপ্পড় খেয়ে কুচবিহারে কয়েকজনের মুখের ম্যাপ পালটে গেছে। এখানে থাকে আমি কাপালিকাটাকে ছাত থেকে ফেলে দেব। বউদি হয়তো দক্ষ—কন্যার মতো প্রাণত্যাগ করবে। দরকার কি?
—আর…আসবে না?
—এখন কিছু বলা যাচ্ছে না। আমি ভয়ও খেয়ে গেছি। গাছগাছড়ার ওষুধ নিয়ে কাজটায় লেগে পড়া বাকি—বিয়ে করতে হবে—নর্মাল জীবন চাই, আমাকে বাধা দিলে আমি লণ্ডভণ্ড কাণ্ড করব। চললাম।
বিনয়দা বলল, ব্যাক টু স্কোয়্যার ওয়ান।
আমি ভায়োলেন্ট নেই। রাগলে বাড়ি চলে আসি। দুঃখ হলে কাঁদি। রাতদিন লেখাপড়া, বই, আলোচনা, ইত্যাদি ইত্যাদি নিয়ে থাকি। অত্যন্ত সেকেনড অস্তিত্ব আমার।
অরুণ তালুকদার কি, তা বোঝাতে পারলাম বোধহয়।
বউদি আমার ব্যাখ্যাতীত।
হয়তো ওই ফোনটা না পেলে বউদি আত্মবিশ্বাস ফিরে পেত—জীবনে ফিরে আসত।
কিংবা আসত না।
ঠাকুরপুকুরে গেলাম—হেলান দিয়ে সূর্যাস্ত দেখছিল। বলল, কয়েকটা কবিতা পড়ব, ক্যাসেট করে রাখব ভাবছি।
—শুধু কবিতা?
—নাটকও।
অপচয়, অপচয়, কি অর্থহীন অপচয়! আমরা কেন অপচয় না—করতে শিখলাম না?