চার – অলক দত্ত
আমার কথা আমাকে বলতে দে—দেখছি বিনয় সব বলে রেখেছে। যা বলেনি, তাই বলি।
বাবা আমার নাম অলক রাখেননি। নাম রেখেছিলেন গোবিন্দচন্দ্র। গোবিন্দচন্দ্র। গোবিন্দ, গোপাল, কানাই, মুরলীধর, যত সব সেকেলে নাম। তা, পাখা গজাতেই আমি এপিডেবিট করে করে নাম করলাম ‘অলক’। এই নামটাই কেন? তখন রবীন্দ্রনাথের গানের রেকর্ড ‘অলকে কুসুম না দিও’ শুনেছি। শুনেছিলাম বিশ্বকবি সকলকে সুন্দর নাম দেন। বন্ধুরা বলেছিল, লিখে দেখ না একবার।
না, আমার সাহসে কুলোয়নি। আমি নিজেই বুদ্ধি খাটিয়ে নাম পালটে নিই। বউয়ের নামও কেতকী রাখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু শান্তিলতা যদি কেতকী হতে না চায়, তবে আমি কি করব?
‘দত্ত অ্যানড সানস’—এর কথা বলেছে বিনয় ভায়া—এও আমার নিজের তৈরি। নইলে বাবার মশলার কারবারে ঢুকতে হতো। আমার সে পোষাত না।
যারা লেখে—টেখে, তাদেরকে খুব শ্রদ্ধা করতাম। যে জন্যে অরুণবাবুর নামে মূর্ছা যেতাম। বিনয় ভায়া তাঁকে নারীবিদ্বেষী হেন তেন বলেছে। আমি অত বলি না। পাবলিক যা খায়, তাই তো খাওয়াতে হবে। তখনকার পাবলিক মদ্দামার্কা মেয়েছেলে দেখালে সে নাটক নিত না।
সরসী তালুকদারকে আমি ‘দিদি’ বলেছিলাম। শরৎচন্দ্রর পড়লে দেখা যাবে, ছোট বোনটি আদরের হলে বড় দাদা হরদম তাকে ‘দিদি’ বলে। তিনি আমার দিদি ওই অর্থে।
শেলী আর বিনয় যা হয়েছে, তাতে তো সবই বলা হয়েছে। নতুন করে আমি কি বলব? দিদিকে খুব কাছে পেয়েছি, অনেক বছর দেখেছি। আমাদের সকলের সঙ্গেই তার ভালবাসার সম্পর্ক কিন্তু সে ভালবাসায় কোনো ‘ইয়ে’ ছিল না। আমি বলি, দিদির দিক থেকে এ একটা বিরাট হেম্মতের কাজ। চারটে বেটাছেলের সঙ্গে এমন ওঠাবসা, খাওয়া—দাওয়া, গল্পগুজব,—অথচ তার নামে কেউ কোনোদিন একটা কথা বলতে পারেনি।
কথা কি বলেনি? বলেছে, অনেকে বলেছে। দিদি কাদার পুতুল ছিল। আমি তা মনে করি না। অরুণবাবু তো দিদির কাছে ঠাকুরদেবতা ছিল। দিদির আমার দুটি ঠাকুর। একটি স্বামী, আরেকটি ছেলে। পাথরের দেবতা হলেও সে ঠাকুর সাড়া দিত। মানুষ ঠাকুররা দিদিকে বোঝেনি, সাড়াও দেয়নি।
—তোমার তো তোমার লেফটেনাণ্টদের ওপর বেশি নির্ভর।
এমন কথা দিদি অনেক শুনেছে।
অরুণবাবুর মেজাজ অনুযায়ী আমাদের একেক রকম নাম হতো। কখনো লেফটেনাণ্ট, কখনো সোলজার, কখনো স্তাবক, কখনো পরামর্শদাদা, কখনো উজির—নাজির, কখনো আবার কুপরামর্শদাতা। বলতে পারে, সৃজনশীল লোক তো। নব নব নাম আবিষ্কার করতেই পারে।
তখন আমার দিদির হেম্মত দেখেছি। হেসেই বলত, অবিশ্বাস করার মতো কোনো কাজ ওরা কোনোদিন করেনি। বিশ্বাসের মর্যাদাও ভাঙেনি। আমার কাছে আসে, আমাকে ভালবাসে বলে। আমিও ওদের ভালবাসি।
দিদির হেম্মতটাকে আমি তো সেলাম করি। দিদি কতকগুলো লক্ষ্মণের গণ্ডী মেনে চলত। তার অরুণবাবুর ওপর যে ভালবাসা, তা নিয়ে মন্তব্য করতে দিত না। সে একটা লক্ষ্মণের গণ্ডী বটে।
আমরা তার মর্যাদা রেখেছি। সে লোক ফিরবে না। হেন রে, তেন রে, অনেক কথা বলেছি অনেক বছর ধরে—কিন্তু এ কথাটা কখনো বলিনি ‘সে—আপনাকে—ভালবাসে না’।
বলার এক্তিয়ার আমাদের ছিল না। স্বামী—স্ত্রী সম্পর্ক, অন্য কেউ বলাটা মানায় কি? আর দিদিও তো এমন মেয়েছেলে নয় যে বলে বেড়াবে, ওগো! সে আমায় ভালবাসে না।
অনেক মেয়ে বলে। এককালে ধীরা আমায় বলেনি? বলেছে, স্বামী আমায় ভালবাসে না। ঘর কত্তে ইচ্ছে হয় না।
আমি বলেছি, দেখ! সিনেমায় যেমন দেখ, তেমন প্রেম রোজকার জীবনে ঘটে না। ঘটলে কাজকারবার চৌপাট হয়ে যেত। তোমার স্বামী ভদ্দরলোক। ছোট দোকান চালায়, শান্ত মানুষ। আমি তো বলি সে মহান। তোমার বিষয়ে আমার মনে ‘ইয়ে’ আজ জেনেও মেনে নিয়েছে। গেলে বেজার হয় না। এ যথেষ্ট পাওনা ধীরা। উলটো—পালটা বকলে আমি মানব না। তুমি যদি আমার বাড়ি প্রত্যহ ‘কেমন আছ’ বলতে যেতে, আমার বউ তোমাকে ঝাঁটা মেরে বের করত।
ব্যস, ধীরা চুপ। আর বলেনি।
ভালবাসা নিয়ে হাঁইমাত্তোম আমার দুচোখের বিষ। দীপিকা আর রঞ্জন সিনেমায় নামল, বিয়ে করল। তা বাদে দীপিকা কেন ময়ূখবাবুর সঙ্গে ঘুরছে বলে রঞ্জন দীপিকার ওপর গুলিই চালিয়ে দিল?
লাভটা কি হলো? মেয়েটা অকালে মরল, আর তুই আউট হয়ে গেলি।
এর পালটাটাও দেখেছি। আমার পাশের বাড়ির ভদ্রলোকের ছেলে বিয়ে করল নিজের পছন্দে। বউয়ের বিরাট সন্দেহ বাতিক। ছেলে অতিষ্ঠ হয়েই গিয়েছিল। বউয়ের বান্ধবীর বাড়ি গিয়ে বসে থাকত। বেটার বউ তা নিয়ে এমন তাণ্ডব করল যে লজ্জায় ঘেন্নায় ছেলেটা আত্মঘাতী হলো।
দিদি আমার এসব খুব জানত। আমাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব, বা দিদি যেটা ন্যায্য মনে করে, যেমন শেলীকে রাখা—এসব বিষয়ে অরুণবাবুর কোনো কথা মানত না। সেও এক লক্ষ্মণের গণ্ডী।
অরুণবাবু দিদিকে তুচ্ছ—তাচ্ছিল্য কম করেনি, শেষ অবধি করেছে।
দিদি করেনি। বড় বংশের মেয়ে, কালচার ওর ভেতরে ছিল।
অনেকবার মুখে এসেছে, বলতে পারিনি, আজ বলছি।
অরুণ তালুকদার নিজেকে ছাড়া কাউকে ভালবাসেনি, সে ক্ষমতাই ওর নেই। দিদির মর্যাদা করবে ও? সকল মানুষ যে কুকুর বেড়াল মনে করে?
দিদির সর্বনাশ তো সে নানাভাবে করে গেল। দিদির বিষয়—বুদ্ধি ছিলই না, তাতে অরুণবাবু যখন হঠাৎ খবর দিল যে সোনারপুরে রেললাইনের পুবে, অনেকটা পথ গিয়ে এক বিঘা ধানী জমি আশী হাজার টাকায় পাওয়া যাবে—সে যে আগ্রহ করে বলেছে, তাতেই দিদি আহ্লাদে যেন আটখানা।
আমি বললাম, নাচছেন তো খুব—আপনার বাড়ি আছে, জমি আছে, আর জমি দিয়ে করবেন কি?
—কেন? সম্পত্তি একটা, ভবিষ্যৎ আছে না? কোনোদিন একটা ছোট্ট বাড়ি করতে পারি…বাগান থাকবে…
—খবরটা আনল কে?
—পিপুলের…বাবা…
—তিনি বিষয়—সম্পত্তি বোঝেন না। আপনি বোঝেন না, চলুন দেখে আসি।
—আপনি যাবেন সেখানে?
—যাব? আমার শালাকে নিয়ে যাব। ও উকিলও বটে, জমিজমার মধ্যস্থতাও করে, কমিশন পায়। ওকে দিয়েই সার্চ করিয়ে দেব।
—মানে…ও খবরটা দিল তো! আবার…
—তবু যাব। সর্বদা আপনার অন্যায় কথাতেও ‘হ্যাঁ’ বলি, জমিজমার ব্যাপারে পারলাম না। আপনার নিজের কোনো উকিল আছে?
—সে দিদমা আর মা থাকতে…ভবতারণবাবু ছিলেন। আমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। দিদিমার উইল আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে বলেন, তোমার কোনো কাজে আমাকে ডেকো না। শুনেছি, দিদিমা ওঁকে দিয়েই বিষয়—সম্পত্তি বেচান, তারপর উনি মস্ত বাড়ি করেন লেকটাউনে।
—স্বাভাবিক। তাহলে কাল যাচ্ছি।
জমির ব্যাপারটা অবশ্য সাচ্চাই ছিল। যাঁর জমি, তিনি ওটা বেচে দুই মেয়ের বিয়ে দেবেন। দিদি আশী হাজারে ওটা কিনে নেয়।
দিদিই বলেছে, আমি মধ্যস্থতা করেছিলাম বলে অরুণবাবু যথেষ্ট গালাগালি করেছে দিদিকে। পিপুল একটু একটু করে জমি উন্নয়ন ও বাড়ি তৈরিতে আগ্রহী হচ্ছে। দিল্লি থেকে আসা—যাওয়া করছে। হয়তো চাকরি ছেড়েই দেবে। এ কাজই করবে কলকাতায়। দিদি দত্তবাবুকে মাঝে রাখার ফলে বাপ ও ছেলে খুবই মনক্ষুণ্ণ।
আমি বললাম, বাঃ বেশ তো শুভাকাঙ্ক্ষী উনি? ওঁকে বা পিপুলকে যদি জমি কিনতে হয়, সার্চ করাবে না? দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা খুব খতরনাক জায়গা, ওখানে জমির মামলা খুব হয়।
দিদি তো চুপসে গেল। আর বাড়ি বা বাগানের কথা বলে না। আগে ক’দিন তো মুখে খই ফুটছিল।
—যেমন বাংলো বাড়ি…চারপাশে শুধু ফুলের গাছ কামিনী, জবা, শিউলি…
অরু বলল ক’শো করে বউদি? কত গাছ লাগালে এক বিঘা জায়গা ঢেকে যাবে?
—সে তখন দেখব। শেয়ালদা থেকে গাছ কিনব…আর একটা ছাতিমগাছের বেদী বানাব…
—আপনার ছাতিমতলা?
—আমরা সবাই বসে বেশ গল্প করব…
—আমি যাচ্ছি না। কেন্নো, কেঁচো, পিঁপড়ে, সাপ…
—পাখি আসবে অনেক! আঃ অরু! একটু স্বপ্ন দেখতে দাও না।
—দেব না, টাকা দিন।
—কেন?
—টেলিফোনের বিল দেব, সে তো চেক দেবেন। ইলেকট্রিক বিল…সাবান…
—বাড়ির নাম দেব ‘করুণা’।
—আমি চললাম।
তা, সেই যে জমি…তা তখন অরুণদার কে ভক্ত বলল যে সে বাগানবাড়ি করবে—অরুণদা বউদিকে বলল, বেচে দাও। অবশ্য একে না বেচতেও পারো। পরামর্শদাতারা যা বলবে, তা করতেও পারো।
বউদি আমাদের জানাইল না। বলল, তুমি লোক পাঠাও, আমি বেচব।
এ লোক আবার এক দালাল জোটাল। তখন রাস্তাঘাট হচ্ছে—ওখানে পাগলের মতো জমি কিনছে মানুষ—দিদি আমার জমি কিনল চার হাজার টাকা কাঠা, বেচল সাড়ে ছ’হাজার করে কাঠা—কম করে দশ হাজার করে কাঠা বেচতে পারত।
দিদি নিজেকে বাঁচাতে জানত না। এই যে অভিনয় ছেড়ে দিল দিদি, যখন ছাড়ল তখন তো নায়িকা হতে পারে না। কিন্তু একটু বয়স্কা মেয়েছেলের ভূমিকাতেই মাতিয়ে দিত। ছাড়ল তো ছাড়লই, আর অভিনয় করল না।
সবই ফানুস, ফেটে যায় শুধু। যার জন্যে এত ত্যাগ, সে তো এল না। স্বচক্ষে দেখেছি, সে যে আসবে না সেটা মেনে নিতে কি কষ্টটা পাচ্ছে!
অরু এসে না থাকলে, একটা সময় ঠিকমতো স্নানাহারও করত না মনে হয়।
শেষ সময়টা, বোধ করি মরবে বলেই অমনধারা করল আমাদের সঙ্গে।
দিদির জন্মদিনটা আমরাই করতাম। ওই চীনে খাবার আনলাম, ফুল আনলাম, গল্পগুজব হলো। ভুলেও বলতাম না এটা ওদের বিবাহবার্ষিকীও বটে, আবার বিনয়ের ক্যাসেটে শুনছি, পিপুলের জন্মও ওই তারিখেই। কি তালগোলের দুনিয়া বাবা! মাকে তো কম চড়ালাম না ফুল, দিদির কল্যাণ চেয়ে। প্রতি শনি—মঙ্গলে পাঁচ সিকের ফুল চড়বেই। সবই ফানুস! মা কিস্যু করল না দিদির জন্যে। শেষ সময়ে অযথা কষ্ট দিল, অযথা…
তা সে জন্মদিনের আগেই আমরা জানি। ‘অগ্নিযুগের অগ্নিশিখা’—রাজনীতি + বিপ্লব + প্রেম ও আত্মত্যাগ ইত্যাদি ইত্যাদি যাত্রাপালার রচয়িতা অরুণ তালুকদারকে সংবর্ধনা দিচ্ছে একটা ক্লাব ধুমধাম করে, ‘অপরূপা’ রঙ্গমঞ্চে।
দিদির নামে এক পেল্লায় কার্ড এসে হাজির। টেবিলে সে কার্ড রাখা, তা ছাড়া আমরা যা যা ভালবাসি সেইসব পকোড়া, পট্যাটো চিপস, চা সাজানো।
তখনো ঘরে ঢোকেনি দিদি, কার্ডও দেখে নি।
আমরা ভাবছি, কার্ড কে পাঠাল! দিদি ঢুকল, কার্ডটা খুলল ভুরু কুঁচকে, তারপর বসে পড়ল।
—ও…আমাকে…ওর…সংবর্ধনায়…ডেকেছে বিনয়!
আমরা নিশ্চুপ।
—নিজের সংবর্ধনায় নিজে ডাকল কেন?
দিদির চোখ জলে ঝাপসা, দিদি বসে পড়ল চেয়ারে।
বিনয় বলল, শান্ত হন বউদি। বসুন। নিজে ডেকেছে…?
—হ্যাঁ…দেখ…
বিনয় বলল, বউদি! এ তো অরুণ তলাপাত্র! ক্লাবের সেক্রেটারি।
দিদি চোখ মুছে ভালো করে দেখল। তারপর বলল, তালুকদার নয়! তলাপাত্র! আমার চোখে তো কিছু হয়নি?
চাঁদু একটু হেসে, অবস্থা সহজ করার জন্যে বলল, তা আপনি শুধু ‘অরুণ তালুকদার’ নাম জপে যাবেন…তাই তলাপাত্রকে দেখেছেন তালুকদার? এটা অটো—সাজেশান বউদি, রেখে দিন!
দিদি যেন জ্বলে উঠল। বলল, সবসময়ে তার নাম জপ করি? তাই ভুল দেখছি? এ কথা তুমি বলতে পারলে চাঁদু? তোমরা…তোমাদের আমি সবচেয়ে আপনজন ভাবি…কিসের জন্মদিন? কার জন্মদিন? তোমরা আমাকে নিয়ে হাসো?
তারপরেই বলল, যাও যাও, যাও তোমরা! কাউকে চাইনা আমি…আমি একটা করুণার পাত্র হয়ে গেছি…যাও! যা—ও!
বলেই বসে পড়ল মাটিতে, কাঁদতে শুরু করল।
শেলী দৌড়ে এল। বিনয় বলল, আমরা যাচ্ছি শেলী, তুমি বউদিকে শান্ত করো। উনি…অসুস্থ…হয়ে পড়বেন।
অরুও বেরিয়ে এসেছিল। ও ভুরু কুঁচকে হাঁটতে লাগল।
খানিকক্ষণ বাদে বলল, এত রিঅ্যাকশন এই তো প্রথম, তাই না?
চাঁদু হ্যাঁ…আমি অপরাধী হয়ে গেলাম।
বিনয় বলল, ননসেনস। সেও তো অমানুষ, জন্মদিনে একটা ফোন করতেও…
আমি বললাম, প্রতিবার তো করে, দিদি বলে যে আমাদের?
অরু বলল, করে না। কয়েক বছরই তো দেখেছি। বউদি ভোরে নিজে ফোন করেন আর প্রখ্যাত অরুণ তালুকদার দু—এক কথায় সেরে দেন।
আমি বললাম, তাহলে দিদি আজও নিশ্চয় ফোন করেছিল।
—করেছিলেন, কেউ ধরেনি।
বিনয় বলল, ছি ছি! নিষ্ঠুরতার একটা… না, শেষ নেই।
অরু বলল, আমি ডাক্তার না হয়েও ডাক্তারের মতো বলছি—এটা কিন্তু ভালো নয়। এ ভাবে হিস্টিরিক হয়ে পড়া।
বিনয় বলল, বহুদিন একটা কবজায় একটা দরজা ঝুলছে। দরজাটার অবলম্বন ওই কবজাটায়। কবজাটায় মরচে পড়বে, খসে পড়গে, এ থেকেই বুঝে নাও।
অরু বলল, আপনারা যান, আমি ফিরে যাই। অবশ্য মনে হচ্ছে, সবাই ফিরে গেলে ভালোই হতো, নাকি, হতো না?
আমি বললাম, কাঁদতে দাও দিদিকে…কেঁদে হালকা হোক…দিদি তো! কাল থেকেই ফোন করবে।
চাঁদু বলল, সে—ই তো করে। অনুশোচনা করে, কাকুতি—মিনতি করে…বউদি ভেঙে যাচ্ছে ভেতরে ভেতরে।
বিনয় মৃদু গলায় বলল, বাঁচতে যে চায় না, তাকে বাঁচাবে কি করে?
এর পরেও গেছি আমরা, কিন্তু কোথায় যেন কি ঘটে গেল…দিদি যেন এতদিনে হাল ছেড়ে দিল, অরু চলে গেল…তেমন তাপ—উত্তাপ দেখলাম না…অরু বিয়ে করল…চাঁইবাসা গেল…অনেক আশীর্বাদ করল, দুম করে একটা নেকলেসই কিনে আনল বউয়ের জন্যে।
অরু বলল, কোনো মানে হয়? ও তো পরবেই না…টাকাটা দিলে বউদি…
দিদি বলল, টাকার লাভ তো তোমাদের নেই। রোজগারও করছ। এটুকু করতে দাও আমাকে। ‘বউদি’ বলো, ছেলেরই মতো তো!
দিদির শেষ সময়টার কথাই ভাবতে পারি না।
ঠাকুরপুকুরে, আমরা জানি ওরা যায়—আমরা তত যাই না।
শুনি, সব খরচ ওরা করছে।
অলকা আর মালিনী একদিন এল। বলল, যাবেন তো ওখানে। সরসীদি আপনাকে খুঁজছিল। খুব দরকার।
আমি আর বিনয় গেলাম।
টাকা তোলার কথা তো বিনয় বলেছে।
যখন বুঝল আর থাকবে না, তখন বলল, বাড়ি যাব।
—সেখানে কে আছে, দিদি?
—সব আছে। স—ব।
সুলতানাদিদির নার্সিংহোমে খবর দিয়ে দিদির শোবার ঘরটাই কেবিন করে ফেলা হয়। নার্স, আয়া, ডাক্তার গুহ, সব ব্যবস্থা হলো। বুধবার বাড়িতে আনার পর পিপুল এল। বলল, আমাকে জানানো উচিত ছিল না?
—ফোনে তোমায় পাইনি। আর…দিদি বাড়ি আসতে চেয়েছিল।
—আর কষ্ট করবেন না আপনারা…আমি থাকব।
আমরা চলে এলাম।
আর বলতে ভালো লাগছে না। তিন দিন জ্ঞান ছিল না, অজ্ঞান অবস্থাতেই চলে যায়, এটাই যা স্বস্তি।
ক্যানসারের যন্ত্রণায় মানুষ উঃ করে না, ঠোঁট কামড়ে নীরবে কাঁদে?
আগে থেকেই গাছের কাছে গিয়ে বসছিলাম। এখন আরোই বসব।
হ্যাঁ, আমার বিশ্বাস আছে। দিদির নামে কালীঘাটে একদিন…
কিছুতে হিসেব মেলাতে পারি না, চেষ্টাও করি না এখন।
দিদি একটা গাছের নিচে বসতে চেয়েছিল, সেটা কি খুব বেশি চাওয়া?