তিন – বিনয় গুহ
হ্যাঁ, আমার কাছেই ছুটে এসেছিল শেলী। শুনলাম, শেলীর ক্যাসেট শুনলাম। চমৎকার গুছিয়ে বলেছে। আমি তোমাদের পাঠিয়েছিলাম, তা বুঝতে দাওনি বলে ধন্যবাদ। তোমরা খানিকটা অরুণদা’র সপক্ষে কথা বলে ভাল করেছ। তাতেই ও এমন মনে করে বলেছে।
আমি গেলে?
আমি, বা আমরা, অর্থাৎ বউদির সঙ্গে ভালয়—মন্দয় যারা থেকে গিছলাম, আমি… চাদু…দত্তবাবু…অরু পরে এলেও অরু…বিশেষ করে আমি গেলে শেলী এত কাঁদত… এত কাঁদত যে কোনো কথাই ক্যাসেট করা যেত না। কাজটা এখনি করে ফেলব ঠিক করেছি আমরা। চাঁদু, অর্থাৎ চন্দ্রনিভ…না, এ নামটা ব্যবহার করে না ও। ও সকলের কাছেই চাঁদু সামন্ত। চাঁদু তো আজ এখানে, কাল পুনা, পরশু ব্যাঙ্গালোর ঘুরে বেড়ায়। ও হপ্তাখানেক আছে!
শোক টাটকা টাটকা থাকতে যা বলা যাবে ক’মাস বা ক’বছর গেলে দেখা যাবে মন তত, উদ্বেল নেই। বেশ একটা নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি গজিয়ে উঠছে… বউদির ছবি এক শেড ফিকে হয়ে যাবে।
মনে রেখো, সম্পূর্ণ সত্য, চাইলেও আমরা বলতে পারি না। মানুষী ব্যর্থতা। আমরা বলি, আবার এমন শোকার্ত সময়েও নিজের বিষয়ে কিছু কিছু ঢাকি।
শেলী সবই বলেছে।
একটু গোপন করে গেছে।
বউদিদের ড্রাইভার শোভারামের সঙ্গে ওর বিয়ে হতে হতে হয়নি বলে কিছুদিন ও মানসিক বিষাদের শিকার হয়ে যায়।
বউদি ওকে বছর খানেক রেখেছিল ডক্টর সেনরায়ের নার্সিংহোমে।
আর, বউদির অবস্থা দেখে অরুণদাকে ও মারতে গিয়েছিল।
বউদি একসময় অরুণদা’র সঙ্গে লড়াই করে শেলীকে কাছে রেখেছে।
পরে শেলীও, বাঘিনী যেভাবে সদ্যোজাত শাবককে হিংস্রভাবে রক্ষা করে—সেইভাবে বউদিকে রক্ষা করেছে।
বউদি অন্যকে বাঁচাতে জানত, নিজেকে বাঁচাতে জানত না। সে জন্যেই মরে গেল।
অত বড় পেশাদার মঞ্চের অভিনেত্রী—নায়িকা থেকে চরিত্রাভিনেত্রী হয়ে কিভাবে বড় হচ্ছিল আরো—তার অভিনয় ছেড়ে সরে আসা মানে দেহ জীবিত থাকলেও মরে যাওয়া, তাই নয়?
রাগ হয়েছে, প্রচণ্ড রাগ হয়েছে, বহু বছর রেগেই থেকেছি। বউদিকেই বলেছি, জীবনকে শিল্পের চেয়ে বড় করে ফেললেন? শিল্প তো জীবনের চেয়ে বড়। শিল্পের জন্যে কঠিনও হতে হয়। অলকাদিকে ছেড়ে জীমূতবাবু চলে গেল, সেও বিয়ের কত বাদে। অলকাদি আর বিয়েও করেনি। কিন্তু গান তো সে ছাড়েনি? অভিনয় জগতে দেখেননি? তপনবাবুকে ছেড়ে কালীদি চলে গেলেন। তপনবাবু কি অভিনয় ছাড়লেন? ঠিক চালিয়ে গেলেন।
বউদি চুপ করে থাকত, ঠোঁটে একটু হাসি মেখে। কথাও বলত না।
কত, কত ভাবে চেষ্টা করেছি।
এমন কি অরুণদা’র কথাও বলেছি।
বলেছি, যার জন্যে এমন একখানা ত্যাগ করলেন, সে তো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।
বউদি ঈষৎ হেসে বলল, সে তো আমার মতো ভালবাসেনি।
—একতরফা ভালবাসা আপনাদের?
—কি জানি বিনয়! না…ভালবাসত, খুব ভালবাসত…এখনো নিশ্চয় বাসে। নইলে…
—নইলে মাঝে সাঝে আপনাকে স্মরণ করে কেন? তাই তো?
—দেখা না…অসুখ হলেই আমাকে পথ্য রেঁধে পাঠাতে হবে …ওর কেউ এলেই এখানে পাঠাবে…
—আচ্ছা, তারা ওখানেই বা যায় না কেন?
—আহা! তারা তো পর নয় আমার! আমারই দেওর, ননদ, তাদের ছেলেপিলে…
—নাঃ, আপনি একেবারে…
—যাচ্ছেতাই, তাই না?
কি বলতাম? কি বলার ছিল? ‘তাসের বিবি’ ছবিও হয়েছিল। বিনতার মা গোপার ভূমিকায় শুভশ্রী করল বাংলায়, হিন্দীতে মঞ্জরী আচেকার। মঞ্জরী জাতীয় পুরস্কারও পেল। বউদি পেতেই পারত। ছবি দেখে বেরিয়ে এসে বউদি বলল, আমি অমন পারতাম না। অত লাউড অথচ কত সুন্দর অ্যাকটিং!
—থাক, অ্যাকটিঙের নাম করবেন না।
এত বছরের এত কথা কেমন করে বলি? পেশাদারী মঞ্চজগতের এবং একজন যাত্রা—জগতেরও—বিখ্যাত স্বামীর একদা বিখ্যাত স্ত্রীর সঙ্গে আমি, বিনয় গুহ, একদিনের প্রখ্যাত আলোকচিত্র শিল্পী কেমন করে যে জড়িয়ে পড়েছিলাম!
পরের কথা আগে না বলে আগের কথা আগে বললে বলতে সুবিধে হবে।
শেলী বারবার ‘পয়লা তারিখ’ বলেছে।
এ থেকে কোনো জ্যোতিষশাস্ত্রী হিসেব—নিকেশ করতে পারে কিনা জানি না।
আমার ওসবে বিশ্বাস নেই।
আমার বাবা প্রাণকৃষ্ণ গুহ, যিনি শেয়ার কেনাবেচা করে অগাধ পয়সা করেছিলেন, তিনি বাড়িতে জ্যোতিষী ঢুকতে দিতেন না। মাকে বলেছিলেন, বিশাল জ্যোতিষী আমার কোষ্ঠীপত্র করেছিল—আমার উনিশ বছরে মরে যাওয়ার কথা! উনিশ বছর তিনবার পার করেও তো বেঁচে আছি।
উনিশ বছর চারবার পার করে আশি বছর বয়সে মারা গেলেন। মা বিরাশিতে মাঝে মাঝে বাতের জন্যে বিছানা নিচ্ছেন বটে, তবে মরবেন ঝট করে, তা মনে হয় না।
আমার বাবার খুব মুক্তমনা ছিলেন। আমি বড় ছেলে, আমাকে অবাধ স্বাধীনতা দিলেন। প্রেসিডেন্সি থেকে বি এস—সি পড়েও কিছু করলাম না। ফোটো তুলতে থাকলাম। ক্রমে থিয়েটার সিনেমা জগতেই ঢুকে গেলাম, কিছু বলেননি। বিয়ে করলাম না, তো মাকে বললেন, আমার জাঠতুতো বড়দাও ব্যাচেলর, এখনো বেঁচে আছেন।
মাকে সুখ দিয়েছে অন্য ভাইরা। সবাই কৃতী, ভালই রোজগার করে। তাদের ছেলেমেয়েও আছে। বাবার কল্যাণে চার ভাই চারটে বাড়িও পেয়েছি। মা মনে করেন, তাঁর দুর্বোধ্য জ্যেষ্ঠ পুত্রের কাছে থাকা তাঁর কর্তব্য, আমার কাছে থাকেন। আসলে মা ডাণ্ডা ঘোরাতে এখনো ভালবাসেন। যা স্নেহময়, শুভময় বা কল্যাণময়ের বাড়িতে সম্ভব নয়। বিয়ে করিনি, সংসার আছে। দিদি জামাইবাবু মারা যাবার পর ভাগ্নে—ভাগ্নীরা এখানে। বাবার কোন জ্ঞাতি খুড়তুতো ভাই, আমাদের পটল কাকা চিরকালই এ সংসারে। তিনি নেই, তাঁর ছেলে আছে। সেই ভাই আর বউমা, ওদের ছেলেমেয়ে, মা মনের সুখে ডাণ্ডা ঘোরান। স্টুডিও একতলায়। ‘মন্তাজ’ স্টুডিওর বয়স অনেক।
আমি একতলাতেই থাকি। একতলাটা আমার। ভেতরে এক টুকরো মাটিতে দুটো কামিনী, একটা জবা, একটা শিউলি গাছ আছে। একটা কাচঢাকা বারান্দা। বউদি এখানে বসে থাকতে ভালবাসতেন। বউদি সম্পর্কে ‘ভালবাসতেন’ বলছি, এটাও খুব বিস্ময়কর। শ্মশানে যাইনি। শুনলাম, যা করবার সব পিপুল করেছে। কাগজে দেখলাম, অরুণদা এসেছিলেন।
বউদি সম্পর্কে একটা স্ক্র্যাপবুক অনেকদিন ধরে তৈরি করে যাচ্ছি। তাতে যে কত কি আছে! একটা নয়, বারোটা মোটা মোটা অ্যালবাম। সব ছবি বউদিকে দিওনি। যদি কোনোদিন কেউ একটা অনেস্ট জীবনী লেখে তাকে দেব।
কিংবা চাঁদু যেমন বলে, একটা ছোট্ট মিউজিয়াম করে রেখে দেব আমরা।
এসব অবশ্য এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, পরে হয়তো মনে হবে না।
কিছু ছবি কাউকে দেখাব না।
বউদি গড়ের মাঠে ফুচকা খাচ্ছে।
বউদি আমাদের লক্ষ্মীপুরের বাগানে পুকুরের ঘাটের রানায় পা ছড়িয়ে বসে পেয়ারা খাচ্ছে।
পুরনো দিনের অ্যাকট্রেস মোহিনীবালার টিবি হলে বউদি কয়লাবাবুকে রাজী করিয়ে একটা চ্যারিটি শো করে ‘শাজাহান’।
বউদি জাহানআরার ভূমিকায়।
বউদি চিবুকে হাত রেখে গান শুনছে।
খবরটা জেনে আমাদের বাড়িতেই কতজন দুঃখ করল।
হরদম আসত তো!
আমার মা—ই ভাল বলল। বলল, তুই যাদের ছবি তুলিস, তারা বড্ড মরে যায়। সরসীর অত ছবি বা তুললি কেন? আমার ছবি আগে যা তুলেছিস, তুলেছিস। এখন যেন তুলিস না আর।
পটল কাকার ছেলে বাদলের বউ বলল, জ্যেঠিমা! বড়দা যাদের ছবি তোলেন না, তারাও তো মরে। আবার কত জন তো বেঁচেও আছে।
আমি নিচে এসে ঘর বন্ধ করে বসে থাকলাম।
আবার আগে পরে গুলিয়ে ফেলছি।
জ্যোতিষীদের কাছে একটা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছি। তারা হিসেব—নিকেশ করে সরসী তালুকদারের মতো একটি একান্ত প্রেমনিমজ্জিত নারীর জীবনের অঙ্ক মেলাতে পারবে?
গিনেস ওয়ার্লড বুকে যাবার মতে খবর।
সরসী রায়ের জন্ম : ১/১/১৯২৮,
প্রথম মঞ্চাবতরণ : ১/১/১৯৪৬,
বিয়ে : ১/১/১৯৭৪,
পিপুলের জন্ম : ১/১/১৯৪৮,
মঞ্চত্যাগ : ১/১/১৯৪৭,
মৃত্যু : ১/১/১৯৯৪।
বলেছিলাম, অমন একটা গোঁড়া পরিবারের মেয়ে হয়ে স্টেজে নামলেন কি করে?
—জেদ করে।
—আর, পৌষ মাসে নাকি বিয়ে হয় না?
—রেজেস্ট্রি বিয়ে, বিনয়।
—ফাংশানই হয়নি?
—বাড়ি থেকে পালিয়েছিলাম না! মা তো দিদমার ভয়ে মুখই খুলতে পারেনি। দিদমা মরল, মা তখন সেধে নিয়ে এল।
জন্মেছিল যে, সে সরসী রায়। দিদিমার সম্পত্তি। খাণ্ডারনী মেয়েমানুষ ছিলেন। গরিব ঘরের ছেলেকে ঘরজামাই রাখলে সে রানী রাসমণির মথুর জামাইয়ের মতো যোগ্য হবে এমন বিশ্বাসে মথুরামোহন রায়ের সঙ্গে বিয়ে দেন মেয়ের।
এ মথুর, সে মথুর নয়। তার পিছন পিছন তার আপন ও বৈমাত্র ভাইবোন এসে বাড়িতে চেপে বসল। বউদির বাবার বিশ্বাস ছিল, যতই ওড়াবে টাকা, তত যাবে বেড়ে। শেষে গরমকালে কমলালেবু, শীতকালে পাকা আম, বর্ষাকালে গোটা ইলিশ ভাজা, এভাবে খেতে খেতেই তিনি মারা যান।
দিদমা জামায়ের জ্ঞাতগুষ্টিকে তাড়ালেন। উকিলকে বললেন, এরও একটা মেয়ে। বিয়ে হয়ে চলে যাবে—জমিদারি তো যাবে যাবে শুনি। তুমি নয় বেচেই দাও। মেয়েকে যেমন শিকিয়েচি, তেমন করেচে। আমি সোয়ামিকে দাপের ভয়ে বশ রেখিচি, আবার পাদ্যোকও খেয়েচি। এখনো তাঁর খড়ম পুজো করি মেয়েটা তো আমার রাশ পায়নি। স্বামী ডাণ্ডা ঘোরাত মেয়ে পাদ্যোক খেত। নাতনি ইস্কুলে যাচ্ছে বটে, কিন্তু কি সব্যনাশ করবে কে জানে। বিষয় হলো বিষ। সব বেচে দাও। বাড়িটা আর পাশের জমিটা থাকুক। সব বেচেবুচে একবার তীর্থ ঘুরে আসি।
বউদির কাছে শুনেছি, দিদিমা তাঁকে দিয়ে মেয়েলী ব্রত করাতেন ‘সাজ’ বা যোগাড় দিতে বউদি খুব শিখেছিল। বউদির মা কার্পেটের ফোঁড়ে ‘পতি পরম গুরু’ সেলাই করে বাঁধিয়ে রেখেছিলেন।
এসবের মধ্যে বড় হয়েছিল বলে কি…?
শেলী আমার কাছে দৌড়ে এসে আছড়ে পড়েছে—স্টুডিওতে খুব তোড়জোড়, বম্বের এক চিত্রতারকার ছবি তুলব। হ্যাঁ, আমিই তো চিত্রজগতের নামকরা স্টিল ক্যামেরাম্যান। আমাদের কালে মঞ্চ ও চিত্রজগতের সঙ্গে যারা যুক্ত থাকত, তারা সাধারণত মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের, ট্রাডিশান থেকে নিঃসৃত মানুষ। একেবারে পেশাদারী একেবারে। তার মধ্যেই অধিকাংশ মানুষই গৃহস্থ মনোভাবের। তারকারা, অথবা অতি বিখ্যাত কেউ, তাঁরা ব্যক্তি—জীবনে যাই হোন, স্টেজে বা স্টুডিওতে, প্রকাশ্যে বা নেপথ্যে, একটা ‘নর্ম’ বা সৌজন্য রেখে চলতেন।
আমরা বাংলা মঞ্চ ও সিনেমার স্বর্ণযুগ দেখেছি। ‘বাংলা’ ও বাঙালি’ নাম নিয়ে খুব গর্ব। অনীতা গুহ বা স্মৃতিরেখা বিশ্বাস বা মালা সিংহ, এঁরা বোম্বাই গেলে জল্পনা বসে যেত ‘রায় কেবিন’—এ।
সবচেয়ে চিন্তিত হতো ‘অপরূপার’ মেকাপম্যান হরিবাবু।
‘অগো যদি সুইমিং কস্টুম পরায়, বাংলার তো বদনাম অইব।”
রক্ষণশীল ছিল মূল্যবোধ।
এখনকার মতো ছিল না সময়। সব ‘সেক্সি সেক্সি’ বা ‘ল্লাভ ল্লাভ’ বা ‘আব আয়েগা মজা’ হয়ে যায়নি। কেন, এক বিখ্যাত অভিনেত্রী, নায়িকার রোল প্রত্যাখান করে দিলেন, যখন তিনি বিখ্যাত নন, যখন স্বামী—স্ত্রীর ঘোর আর্থিক সংকট—কেন? না, কাপালিক যখন তাঁকে অপহরণ করে পাঁজাকোলা করে নিয়ে দৌড়াচ্ছে তখন তাঁর কাপড় হাঁটু অবধি উঠে যাবে।
বললেন, হাঁটু দেখাব? তারপর বলবেন কাঁধের আঁচল ফেলে দিন?
এসব কথা বকছি কেন? একটা বিগত সময়কে বোঝাবার চেষ্টা করছি। সময়ের মধ্যে বাঙালির রক্ষণশীল মূলবোধ ছিল। মঞ্চ পর্দার সামনেটা এবং পেছনটা এই একই মূল্যবোধে আচ্ছন্ন ছিল।
ব্যতিক্রম কি আমরা মেনে নিতাম না? নিতাম, বোবা হয়ে যেতাম গল্প শুনে। জ্যোতিপ্রকাশ আর শীলা হালদারের গল্প। শীলা হালদারের মৃত্যুর খবর পেয়ে স্টুডিওতে জ্যোতিপ্রকাশ বিষপানে আত্মহত্যা করেন। আমরা এ কাহিনী শুনেছি, প্রেমকে জানিয়েছি সেলাম।
বউদির ব্যাখ্যা খুঁজছি, আর খুঁজছি, আর খুঁজছি!
বউদির এই প্রচণ্ড ভালবাসা, যার প্রতিরোধ করার ক্ষমতাই ছিল না ওর—প্রতিদান ব্যতিরেকেই যা শেষ দিন অবধি বেঁচেছিল—তার ব্যাখ্যা খুঁজছি।
সেই কি ওর পারিবারিক পটভূমি থেকে জাত?
তা তো নয়! সেটা তো ছিল বিনা প্রশ্নে, মুখ বুজে যান্ত্রিক আনুগত্যের শিক্ষা।
সেটা কিছু ছিল, তার বাইরেও ছিল বউদির ভালবাসার শক্তি, যে শক্তি ওর সহনক্ষমতার চেয়ে জোরালো।
সে কি নিহিত ওর সময়ের বা আমাদের সময়ের মূল্যবোধে?
না, তার চেয়েও বেশি আদিম ও অচেনা প্রচণ্ড শক্তিমান কোনো জুরাসিক যুগে—তাই হবে তাই হবে।
শেলী এসে আছড়ে পড়ল।
আমি ফিলিপকে বললাম (ফিলিপ রাজেন বোস, আমার সহকারী), তুই ম্যানেজ করে নিস। বউদি অজ্ঞান হয়ে গেছে।
গিয়ে কি দেখলাম!
চিত হয়ে পড়ে আছে। পড়ার সময়ে পেলমেটে ঝোলানো পর্দা আঁকড়ে ধরেছিল, পেলমেট ভেঙে সব পর্দা জড়িয়ে, মড়িয়ে পড়েছে।
সবচেয়ে কাছে সুলতানা আন্টির নার্সিংহোম। ওখানেই নিয়ে গেলাম। মাথা ফেটেছিল, সর্বাঙ্গ কেটেকুটে গেছে, আঘাত কতটা জানি না।
তারপর তখনকার অভিজাত নার্সিংহোম এলগিন নার্সিংহোম। হাসপাতালে তো নেব না। শহর জেনে যাবে। হাসপাতাল অ্যাকসিডেন্ট কেস থানাকে জানায়—খবরের কাগজে থানা বা হাসপাতাল কে জানায় জানি না।
টাকা কি লাগবে, খরচা কি হবে, কিছুই ভাবিনি।
বউদির জ্ঞান ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল। শেলী তো নড়বে না কিছুতে। শেষে অরু, অরিন্দম সোম—সবে যাকে এনে দিয়েছে দত্তদা, অরু বলল, আমি থাকব। তুমি যাও বিনয়দা, খেয়ে দেয়ে এসো।
দত্তদার কোনো আত্মীয়ের ছেলে অরু—জীবিকার খোঁজে কলকাতা এসেছিল বলে শুনেছি—শ্যামবর্ণ মিতভাষী ছেলে কপালে ও গালে কয়েকটা ক্ষতচিহ্ন সেলাই করা—দত্তদা বলল, নিমতেল নিমোলা আর দাদের মলম ডারমোলা বিক্রির চাকরি করে দিয়েছি। খুব সবরকম কাজের ছেলে। তোমার ওখানে রাতটা শুয়ে থাকবে, অসুবিধে আছে? খাবে হোটেলে।
এ সময়ে অরু খুব সার্ভিস দিল। হাসপাতালে থাকা ও রোগীর শুশ্রূষায় ও এত দক্ষ তা এখন দেখলাম।
ও বলল, জখম তেমন জোর নয়—তবে মনে কোনো আঘাত পেয়েছেন।
শেলীকে বাড়ি পৌঁছলাম। বললাম, সব দেখেশুনে রাখো। মায়ের দায়িত্ব আমাদের।
তারপর সে একদিন গেছে বটে।
দৌড়লাম অরুণদার বাড়ি। অরুণদা সব শুনেটুনে চুপ করে থাকল। বলল, সরসী তালুকদারের স্বামী হয়ে থাকাটা পোষাল না বিনয়।
—বউদি সিরিয়াস অরুণদা।
—হ্যাঁ…অজ্ঞান হয়ে যেতে দেখিনি…তবে ভীষণ ইমোশনাল তো!
—আপনার মতো কে জানবে অরুণদা? আপনিই পারেন বউদিকে বাঁচাতে।
—কি করব, বলতে পারো? আমার অবস্থা বুঝতে পারো তোমরা…তুমি?
—আপনি তো নিজের হিম্মতেই বিখ্যাত।
অরুণদা একটা দামী কথা বলল। সেদিন কথাটা দামী মনে হয়নি। অরুণদাকেও নিষ্ঠুর মনে হয়েছিল। এখন বুঝি, মিথ্যে বলেনি।
অরুণদা বলল, বাড়িটা সরসীর।
—সে তো বরাবরই ছিল।
—তখন অন্যরকম, এখন অবস্থা অন্যরকম।
অরুণদার কথা বলা, তাকানো, হাঁটা—চলা, মাঝে মাঝে হাতের আঙুল ছড়িয়ে সেদিকে চেয়ে থাকা—সবকিছু আশ্চর্য মাপা মাপা। ঠিক যে এফেক্টটা ও তৈরি করতে চায়, তা করতে পারে। অভিনয় ও বলতে গেলে করেনি। আমি মনে করি বাংলার পুরনো ট্রাডিশনের পেশাদারী রঙ্গমঞ্চে ওর অভিনয় না—করাটা একটা বিশাল ক্ষতি।
আমি বললাম, অন্যরকম কিসে? বউদি আপনার জন্যে প্রাণ দিতে পারে।
—বিনয়! বিনয়! প্রত্যহ চলার জন্যে ওরকম অসম্ভব উচ্চমাত্রার, যাত্রামার্কা প্রেম, প্রাণদান, আত্মত্যাগ ইত্যাদি ইত্যাদির দরকার হয় না। হাঁপ ধরে যায়, মনে হয় কি জানো? এই যে কাচের কাগজচাপাটা দেখছ? দেখ! একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। উল্টে দিলাম, সোজা করলাম, ছেলেটাকে ঘিরে বরফ পড়ছে। সুজাতা আর মিস্টার বোস, বিলেত থেকে এনে দিলেন এটা। ওদের ‘লেখক’ নামের ওপর অন্ধভক্তি।
—আপনি কি পাগল? এসব বলছেন কেন? বউদি ওদিকে…
—এ ছেলেটা কাচের ভেতর থেকে বেরোতে পারব না। সরসীর টু ম্যাচ প্রেম, টু মাচ অনুরাগ, আমার নিজেকে বন্দী বন্দী লাগে। আমাকে অরুণ তালুকদার হতে হবে। যাত্রা যে কি ভয়ানক শক্তিশালী গণমাধ্যম, তোমরা বুঝছ না। আমাকে সেখানে মুকুটহীন রাজা হতে হবে। ওখানে…সরসীকেন্দ্রিক আবহাওয়াতে…আমি নিশ্বাস নিতে পারি না।
—বউদির অভিনয়প্রতিভা আছে, ও কি করবে? সব ছেড়ে দেবে?
—সে ও বুঝবে।
এখন অরুণদা হঠাৎ নিজের মুখ দেখাল। বলল, এই সরসী কে? এ তো আমার তৈরি। আমি চরিত্র সৃষ্টি করেছি, ও অ্যাকটিং করেছে। সৃষ্টি, স্রষ্টাকে উপেক্ষা করে চলবে…না!
—আপনার সব কথা মানলাম। সব করবেন আপনি। শুধু এ সময়টা…
—চলো…যাচ্ছি
—আমার বলা সাজে না…
—সে কি হে? তোমরা, বিশেষ তুমি তো ও—বাড়িতে…সরসী মানেই তার চার সেপাই। তুমি অবশ্য ক্যাপটেন।
—আমাকে আপনি এ কথা বললেন? আপনার জন্যে আমি…
—হ্যাঁ, অনেক করেছ, করে যাচ্ছ। ঠিক আছে, আমি যাব।
—নয় এখানেই আনুন বউদিকে। নয় দুজনে বাইরে যান কোথাও। আপনাকে দেখলেই বউদি…
—বেশ, কালই যাব। কথায় বলে, ভালবাসা এবং যুদ্ধে, সবকিছু করা চলে। ভালবাসায় তো আমি ক্লান্ত। এটা হয়তো যুদ্ধ। যুদ্ধে আমি জিততেই ভালবাসি।
ভালবাসায় অরুণদা ক্লান্ত!
‘জি’ টিভি—র সরব ঘোষণা শুনতে পাচ্ছি।
‘গর্মিসে ম্যয় থক গিয়া হুঁ’।
থক—পক—বকবক—অর্থহীন প্রলাপ দ্বারা মস্তিষ্ককোষকে সুকৌশলী আক্রমণ। তখন এসব ভাবা যেত না। রেডিওতে ‘বিবিধ ভারতী’তে শুধু শোনা যেত, ‘লাইফবয় যেখানে, স্বাস্থ্যও সেখানে!’
বিবিধ ভারতী ছিল, না রেডিও সিলোন? যাই থাক, সেটা শোনা কুরুচি বলে গণ্য হতো। আমার মামা বলতেন, বড়টাই যদি এসব শোনে, পরেরগুলো উচ্ছন্নে যাবে।
কখন বাড়ি ফিরলাম, কখন ঘুমোলাম…পরদিন অরুণদাকে নিয়ে গেলাম। বউদির পাশে গিয়ে বসল অরুণদা, আমরা বেরিয়ে এলাম।
অরুণদা বলল, এখানে এনে ভাল করেছে। হাসপাতালে গেলেই কাগজে বেরোত। কেচ্ছা! কেচ্ছা! যাত্রার লোকজন রক্ষণশীল তো!
—কাল তো ছেড়ে দেবে।
—বাড়িতে নিয়ে এসো, আমি নয় থাকব। কাল আবার…যাব একবার।
অরুণদা চলে গেলে দত্তদা বলল, যাবেন…থাকবেন না…জানি না দিদি এমন অবুঝ হছেন কেন! অরুণদা আর কোনোদিনই ওখানে থাকবেন না।
দত্তদার নাম অলক দত্ত। দত্তদা নামেই পরিচিত সর্বত্র। দত্তদার নানা গুণ। মঞ্চে সেট—সেটিং তৈরি করত। সিনেমাতেও সে কাজ করেছে। আসল কারবার ছিল পোশাক তৈরি করা। যাত্রা থিয়েটারে ও সিনেমায়, ‘দত্ত অ্যানড সানস’ কোম্পানিই সায়েবি মোগলাই, পাঠানী, রাজপুত, নানা ঢঙের পোশাক সাপ্লাই দিত। এক পার্শী ভদ্রলোক ওকে দোকানটা করে দেয়। দত্তদার বিয়ে হয়েছিল দশ বছর ছেলেপিলে হয়নি। আমরা বলতাম, অ দত্তদা! অ্যানড সানসের কি হবে?
—হয়ে যাবে, হয়ে যাবে, ভরসা রাখো।
শেষ অবধি শালার ছেলেরাই অ্যানড সানস হয়ে বসল। দত্তদা খুব ফুলবাবু ছিল। কোঁচানো ধুতি, গিলে করা পাঞ্জাবি, চীনে পাড়ার জুতো, বর্ষাকালে র্যালি ব্রাদার্সের ছাতা—ইয়ার্ডলি ল্যাভেন্ডার সুগন্ধি রুমাল। প্রচুর সিগারেট খেত, খাওয়াত, দরাজ দিল, দরাজ হাত।
বউদিকে কি চোখে দেখেছিল কে জানে! অরুণদার বয়েসী হবে, প্রথম দিনই বলেছিল, আপনি আমার দিদি হলেন।
—ওমা! ছোট বোন বলুন।
—তা কি করে বলব? আপনার নাম কি মানসী? আমার বড়দি সরসী, মেজদি অতসী, আমার পরের বোন মানসী। টেকিনকালি আপনি দিদি।
দত্তদা আরো বলল, অরুণদা দিদির সঙ্গে থাকবেন না। তাছাড়া ওর নাটক সর্বসমক্ষে বাতিল করার শোধ ও দিদির উপর তুলবে।
—কিন্তু কেন? বউদি তো বাতিল করেনি।
—ওই যে অধীরবাবু বলেছিল, ম্যাডাম! আপনি এ নাটক শুনেছেন? দিদি তো ‘হ্যাঁ’ বলেনি, স্বামীকে ব্যাকও করেনি।
—শোনায়নি দত্তদা, বিশ্বাস করুন! বউদি কতবার সেধেছে তখন!
—এই তো হয় রে ভাই। তুমি আমি কি করব?
সেদিন থেকেই দিদির নামে ফুল চড়াচ্ছি মায়ের পায়ে। মা নিচ্ছেই না।
তখন প্রথা ছিল, এখনো আছে কিনা জানি না, থাকাই সম্ভব। কালীবাড়ি গিয়ে পুজো দেওয়াতে, ফুল চড়ানোতে মঞ্চ ও পর্দার লোকদের অগাধ বিশ্বাস ছিল। শুনতাম, নতুন নতুন পরিচালকরা এসব মানেন না। কিন্তু যারা তাঁদের ছবিতে টাকা ঢালত, তারা মানত বলেই জানি। অসুবিধে তো নেই কিছু। আপনি মহৎ চিত্র করছেন, করুন। আমার কাছে এটা এই লাইনের রীতি। ‘তুফান’ ছবি সুপারহিট করতে কাপাডিয়াবাবু কালীঘাটের ঠনঠনের আর দক্ষিণেশ্বরের তিন কালীকে তিনটে মুকুট দিয়েছিলেন।
দত্তদা, যার অলক দত্ত নাম কেউ জানে না, তার আজও গভীর বিশ্বাস কালীতে। বউদির খবর জেনে থেকে বলছে, যা হোক করে মায়ের হোথা যেয়ে দিদির নামে কাঙালি খাইয়ে দেব।
আমি আর দত্তদা ভেতরে গেলাম। বউদি বলল, তোমাদের বড্ডই কষ্ট দিচ্ছি, তাই না বিনয়?
—নিজেকে কি করেছেন বউদি? মাথা ফেটে, সব কেটেকুটে …নাঃ। আপনাকে নিয়ে পারা যাবে না।
—কাল তো…বাড়ি যাব।
দত্তদা বলল, যাবেন দিদি। অরুণদাও আসবেন। আপনি যুক্তি দিয়ে বুঝুন,…
—জানি, জানি…ও বলেছে…ওর ভীষণ কাজ আছে। তাই আসবে একবার, আবার চলে যাবে।
—এই তো, দিদি সব বুঝেছে। এখন ঘুমোন দেখি। যত ঘুমোবেন, তত তাড়াতাড়ি সেরে উঠবেন।
—অরুণকে কিন্তু নিয়ে যাব সঙ্গে।
—কোথায় বউদি?
—আমার কাছে রেখে দেব। ও বেশ…আমার গার্জেন হয়ে থাকবে…
অরু বলল, বড় বড় সিদ্ধান্তগুলো পরে হবে। আজ ঘুমোন। আপনি কি, বউদি? এটা কি স্টেজ? পতন ও মূর্ছা গেলেই হলো?
—হাসিও না, হাসিও না অরু…হাসলে সেলাই ছিঁড়ে যাবে।
—কেন? ‘মৃদু হাস’ও তো স্টেজে করতে হয়।
বেরিয়ে এসে দত্তদা বলল, নিমোলা আর ডারমোলা নয়, অরুলা হচ্ছে আসল ওষুধ। সত্যি অরু! তুমি ওখানে থাকলে আমরা একটু নিশ্চিন্ত থাকব।
আমরা তিনজন আমার বাড়িই এলাম। তারপরই চাঁদুর ফোন। বলল, আমি আসছি, কথা আছে। বউদির ব্যাপারে দরকারি কথা।
দত্তদা বলল, কাল দিদির বাড়িতেই এসো বিকেলে। না এলে হবে না।
দত্তদা নিঃসন্তান ছিল, দত্তদা অরুকে এনেছিল। নিজের বাড়িতে ওকে রাখেনি, ভাগ্যে রাখেনি।
আমরা চা খেলাম। কাটলেট আনালাম দোকান থেকে। অরু বলল, এ ভদ্রলোক তো ফিরবে বলে মনে হয় না। বউদি যে কি করবে… কাল বলেই যাচ্ছে বিড়বিড় করে, আমাকে ফেলে ফেলে যেও না অরুণ…আমাকে নিয়ে যাও…
দত্তদা উঠে পড়ল। বলল, একজনের ডায়াবেটিস থাকে জানো? যা সারে না? কন্ট্রোলে না রাখলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। আমি চললাম। কাল দেখা হবে।
ঝড়—জল—দুর্যোগ—ট্রামবাস বন্ধ, যাই হোক না কেন, দত্তদা প্রত্যহ কালীঘাটেও যেত, আবার আনোয়ার শা’ রোডে ধীরাদির বাড়িতেও একবার যেত। ধীরাদি ছিল সিনেমায় দু—একবার মুখ—দেখানো মহিলা। দত্তদার ছিল নীরব, প্রত্যাশাহীন, দীর্ঘস্থায়ী প্রেম। ধীরাদির স্বামী সরোজবাবু রাধা ফিলম স্টুডিওর কাছে চা—নিমকির দোকান চালাত। ওদের ছেলেমেয়েও ছিল। দত্তদা বলত, যাই প্রত্যহের কর্তব্যটা করে আসি।
চাঁদু বলত, এ কেমন ব্যাপার দত্তদা?
—এ কি সিনেমা বা থিয়েটার রে ভাই! আমিও মজনু নই, সেও লায়লা নয়। ওই যাই, সরোজবাবু, ধীরা, ছেলেমেয়ে, ‘কেমন আছ’ জিগেস করি। এক কাপ চা খাই। আবার টুকটুক করে ট্রামে চেপে চলে আসি। এরকম অনেক কাল চলছে, অনেক কাল চলবে। তোমাদের বউদি সব জানে। তোমরা পারবে এরকম?
—না…তা পারব না…
—তবে? ভালবাসা হবে যাকে বলে গঠনমূলক, অর্থাৎ ভাঙবে না কিছু। আমার শিক্ষা সে রকমই। এ সরোজবাবুও জানে। কিছু মনে করে না।
—ছেলেমেয়েকে ভর্তিও করিয়েছেন।
—বাপ—মা’র ‘ক’ অক্ষর গোমাংস। ছেলে বাপের দোকানে চা করবে, এর বেশি আশা করেনি। এখন বুঝছে।
সেই ছেলে ড্রাফটসম্যানশিপ পাস করে কাজ করছে। সেই বাড়ি এখন পাকা হয়েছে। সেই মেয়ে নার্সও হয়েছে, বিয়েও করেছে। সরোজবাবু মরে গেছে বলে দত্তদা ধীরাদির বাড়ি যায় না।
পরদিন বউদি বাড়ি এল। তারপরই বলে, শেলী, বাড়ি পরিষ্কার করা। বাবু নোংরা দেখতে পারে না। আমার বিছানায় ভাল চাদর পেতে দে। চুলে হাত দিসনি বাপু। সে আমি আলগা করে এলো খোঁপা বেঁধে নেব। ইস! মুখের চেহারা যে কি হয়েছে।
এটা বরাবর দেখেছি যে বউদির মধ্যে ভারি শোভন নারীত্ববোধ ছিল। অলকাদির কথা উঠলেই বলত, কি করে পারে বাবা? যেমন তেমন চুল জড়িয়ে, যা পরে আছে তাই পরেই বেরিয়ে গেল? আমি মরে গেলেও পারব না।
তার রমরমার দিনে তো বটেই, বিস্মৃতির দিনেও দেখেছি যে আর কেউ নয়, আমি বা আমরা গেছি—নিমেষে কাপড় বদলে চুলটি আঁচড়ে মুখ মুছে তবে আসবে। রাস্তায় সাবান ও পেস্ট কিনতে যাবে—চুল বেঁধে, পাউডার মেখে, টিপ পরে যাবে।
বলত, জানো বিনয়! প্রভাদেবীর মতো বড় অভিনেত্রী বলতেন, মেয়েরা! সাম্য হয়ে বোস। সরসী কেমন করে বসেছে দেখছ না? পা মুড়ে, আঁচলে ঢেকে, মেয়েদের যেমন বসতে হয়।
তা, সেদিন বউদির অপেক্ষা আর ফুরোয় না। অরুণদা এল সন্ধ্যায়, সেও ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে। আমি বেরিয়ে গেলাম। অরুণদাও পাঁচ মিনিট বাদে বেরিয়ে গেল।
পরে যখন ঢুকলাম, বউদি বলল, এখন থেকে এরকম আসা—যাওয়া নিয়েই খুশি থাকতে হবে বিনয়। আর…পিপুল এলে বলতে হবে যে আমি বাথরুমে পা পিছলে পড়ে গেছলাম, আর…আর…এই তো!
আমি কি বলতাম?
—আমি কি করলে ও ফিরবে বলতে পার? একবার বলুক, আমি সব করব। উনিশ বছর বয়সে বিয়ে, আজ আমার ছেচল্লিশ চলছে, আমি তো ওকে ছাড়া কিছু জানি না বিনয়!
—আপনি জোর করে…মানে মানে জোর করে বেশ সুস্থ হয়ে উঠুন তো। অরুণদা কেরিয়ার করছেন, যা খুব প্রশংসনীয়…
—অধীরবাবুর মুখের মতো জবাব, বলো? ‘যাত্রার পালা লেখেন’ বলেছিল, তা যাত্রার পালা লিখেই দেখিয়ে দিচ্ছে।
—সেটা ভাল করছেন?
—নিশ্চয়।
—আপনিও নিজের কেরিয়ার করুন।
—হ্যাঁ বিনয়…ঠিক বলেছ…
—’জীবন পিপাসা’ বা ‘কালরাত্রি’ বা ‘অশান্ত ঘূর্ণী’, সব বইয়েই নায়িকা দুজন। একজন মাঝবয়সী, একজন তরুণী। আপনি…বলতে গেলে…চরিত্রাভিনয়, মানে ক্যারেকটার অ্যাকটিঙের দিকেই যাচ্ছেন। যেটা খুবই ভাল। ক্যারেকটার অ্যাকটিং দীর্ঘদিন করা যায়।
—সেই তো! ঠিক বলেছ।
অরু ঢুকে বলল, তাহলে সেই কথাই রইল। এখন যবনিকা পতন। বউদি বিশ্রাম করুন। বিনয়দা বাড়ি যান। আমি আজ রাতটা তো থাকি।
—কেন, সবসময়ে থাকবে না?
—দেখাই যাক না। এই মুহূর্তেই সব সিদ্ধান্ত নিতে হবে নাকি? আপনি জীবনটা স্টেজ করে ফেলবেন না। স্টেজে দু—আড়াই ঘণ্টায় পঞ্চাশ বছর কাটানো যায়। জীবনকে সময় দিতে হয়।
বেরিয়ে এসে অরু বলল, বাড়ি চলুন।
যেতে যেতে বলল, বউদি যেমন, স্বামী বা ছেলে তেমন নয়। স্বামী তো কাপ্তেন বললেই হয়। এসেছিল ট্যাক্সিতে এসে মুটকি বসেছিল। কি বাতাস খাচ্ছিল আঁচল নেড়ে!
—খুব ফর্সা? বব চুল?
—হ্যাঁ।
—সুজাতা বসু। স্বামী—স্ত্রী, বাড়ির সবাই অরুণদার ভক্ত।
—অরুণবাবু ট্যাক্সিতে উঠতে উঠতে বলল, সেই এক নাকে—কাঁদুনি…ডিসগাসটিং।
—এখনি এসো না তবে।
—বউদি তো বোঝে না…বউদির ওপরও রাগ হচ্ছে আমার।
আমি ভীষণ স্বস্তি পেলাম। যাক, আমার একার নয়, অরুরও রাগ হচ্ছে। বউদির ওপর রাগ হলে সে লোক থেকে যাবে।
তারাই থেকে গেল।
যাদের রাগ হতো না—করুণা, ঈর্ষা, ডিসগাসট হতো, তারা থাকল না।
বউদির কথা কি বললে শেষ হবে?
সে সময়কার ঘটনা—পিপুল আপিসের কাজে এসে হোটেলের বদলে মা—র কাছে উঠল।
আমি বললাম বউদি! পিপুল এসেছে, এখন ক’দিন আমরা নয় না এলাম।
বউদির হাসি ছিল খুব সরল, খুব স্বতোৎসারিত, আবার একটু ভীরু।
ওর হাসি দেখলে, অমন মানুষের ওপর রাগ করে যে, সে লোক অমানুষ।
বউদি বলল, কেন বিনয়? তোমরা কেন আসবে না? পিপুল তো তোমাদের চিরকাল দেখছে। জানে, তোমরা ওর বাবাকে কত মান্য করো! ও তো..ছেলেমানুষ নেই আর…ছাব্বিশ বছর বয়স…এ বয়সেই বড় চাকুরে…কত দুঃখও তো পেল বলো? পেল না? বউ চলে গেল…
পিপুলের প্রথম বিবাহ, বউ চলে যাওয়া, ডিভোর্স ও দ্বিতীয় বিবাহ সবই জেটগতিতে ঘটে। আমি বললাম, আপনি ওর সঙ্গে একান্ত যতটুকু পারেন, থাকুন না!
—ঠিক বলেছ—নইলে…ও যা অবুঝ…রেগেমেগে ওর বাবার কাছেই চলে যাবে হয়তো…কিন্তু আমার ব্যান্ডেজ ড্রেসিং…?
—সব তো সুলতানাদির লোক করে দিয়ে যায়। ও থাকার সময়ে শেলীদের একটু হাসিখুশি থাকতে বলবেন।
—নিশ্চয় বলব, নিশ্চয়।
—বাথরুমে পড়ে গিয়েছিলেন, মনে রাখবেন।
—মনে রেখেছি, রেখেছি, রেখেছি।
—চললাম বউদি।
—কিন্তু…কোনো দরকার হলে?
—হবে না। হলে ফোন করবেন।
পিপুল এসেছিল। কলকাতায় চার দিন ছিল। রোজই বউদির কাছে এসেছে, খেয়েছে রাতে। এক রাত কাছেও ছিল।
এখন আগের কথা কিছু বলা যাক।
বউদি যখন সরসী রায়, বিধবা দিদিমা ও বিধবা মায়ের আদরে মানুষ হচ্ছে, স্কুলেই আবৃত্তি, নাটক, গান এসবে খুব কৃতিত্ব দেখায়।
ওদের জমিতেই বারোয়ারি দুর্গোৎসব হতো। আর, কয়েকখানা বাড়ি বাদ দিয়ে পাড়ার নাটকের ক্লাব। পরিচালক অরুণ তালুকদার।
অরুণদার মোহিনীমায়া ছিল, আজও আছে। ওর সংস্পর্শে যে আসত, সেই ভয়ভক্তি করত।
বউদিদের বাড়িতে দুর্গোৎসবের পর ফাংশান হয়। অরুণদা ওর লেখা ‘দশমী’ নাটক করায়। বউদি তখন নাটক—পাগল। খুব জেদাজেদি করে পাড়ার ক্লাবের নাটকে যোগ দেয়। দিদিমার বাধানিষেধ খাটেনি। ওর মাও বলেছিলেন, সবাই চেনাশোনা—বাড়ির মাঠেই থিয়েটার হবে—ইস্কুলেও খুব সুখ্যাতি পেয়েছে, করুক না।
—শেষে নাটক! মেয়েকে খুব আহ্লাদ দিয়েছ মা!
—ওর বাবার থিয়েটার দেখার নেশা ছিল না? আর আমার কালে আপনি স্কুলের পড়া শেষ করতে দেননি। পনের না হতে বিয়ে দিলেন। সরসীকে আমি কলেজেও পড়াব।
—তোমার মেয়ে, তুমি বুঝবে। আমি তো বুঝি, বয়স হলেই বিয়ে দাও।
—আর ঘরজামাই রাখো? না মা, এখন সবাই পড়ে, সবাই কলেজে যায়, দিনকাল কবেই বদলে গেছে। ও পড়াশোনায় ভাল, দেখতে ভাল, নাচ—গান—নাটকে ভাল। শক্তসমর্থ হয়ে মানুষ হোক। নইলে আমার দশা হবে। তিনি ঘরজামাই ছিলেন, ঘরে ক’দিন পেয়েছি তাঁকে? ইয়ারবকসি নিয়ে মাছ ধরতে যাচ্ছি, পিকনিক করতে যাচ্ছি, থিয়েটারে যাচ্ছি…আমার জীবন তো কাটল আঁশ—হেঁশেলে।
সেই ‘দশমী’ নাটকেরই পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত রূপ ‘অপরূপা’য় নতুন নাট্যকার অরুণ তালুকদারের লেখা ‘স্ফুলিঙ্গ’ যাতে বউদি প্রথম নামে এবং মঞ্চজগতের তখনকার ভাষায় ‘ক্যান্টার’ করে দেয়।
‘দশমী’—র রিহার্সাল থেকেই প্রেম। ‘দশমী’ এতই সফল হয় যে ক্লাবের টাকা তোলার জন্য তা টিকিট বেচে হল ভাড়া নিয়ে করা হয়। ‘দশমী’—কে ‘স্ফুলিঙ্গে’ রূপান্তরিত করল অরুণদা। ‘স্ফুলিঙ্গ’, ‘সূর্য’ রঙ্গমঞ্চে একদিন চারিটি শো হল। সরসী রায়ের সুখ্যাতি ও ছবি বেরোল কাগজে। টাকা পয়সা আসতেই নাটকের ক্লাবে ভাঙন ধরল।
আর বউদি প্রথম ডিভিসনে বাংলার লেটার নিয়ে ম্যাট্রিক পাস করল—আশুতোষ কলেজে ভর্তি হল…এর কিছুদিন বাদেই ঘোষণা করল অরুণদাকে বিয়ে করবে।
বাড়িতে ঝড় উঠল বলা যায়। দিদিমা তীর্থযাত্রা বন্ধ করলেন। জাতে অমিল নেই, এরা এবং ওরা উভয় পক্ষই ব্রাহ্মণ। কিন্তু যার চালচুলো নেই—মেসে থাকে—ছুটছাট নাটক লেখে ও করে—তার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেওয়া যায় না।
দিদিমা ঘটক ডাকলেন। বললেন, এই ফালগুনেই নাতনির বে দেব। এ ছোঁড়া তো নাতনিকে দেখে মজেনি, সম্পত্তি দেখে মজেছে। আমিও দেখে নেব।
বউদি বাড়ি ছেড়ে পালাল।
১৯৪৭ সালের পয়লা জানুয়ারি, তিন আইনে বিয়ে হয়ে গেল। ম্যাট্রিকের সার্টিফিকেট বলে দিচ্ছে, মেয়ের উনিশ বছর পূর্ণ হচ্ছে বিয়ের দিন। দিদিমা থানা—পুলিশ করতে পারেননি।
ওরা কসবায় ওদের এজমালি বাড়িতে উঠেছিল। ঠিক এক বছরের মাথায় পিপুলের জন্ম হয়। পিপুলের বছর খানেক না হতে কয়লাবাবু ‘স্ফুলিঙ্গ’ রিহার্সালে ফেলল। ১৯৪৯ থেকেই বউদি পেশাদারী রঙ্গমঞ্চের অভিনেত্রী।
এর মধ্যে দিদিমা মারা গেলেন। মেয়েকে বললেন, আগে তোমার, তোমার পরে তোমার মেয়ের। ও ছোঁড়ার নামও রেখো না কোথাও। তারপর তোমার মেয়ে যা করবে। ভবিষ্যৎ তো দেখা যায় না!
বউদির মা কিছুকাল বেঁচে ছিলেন। বউদি মাকে ‘স্ফুলিঙ্গ’ নাটক দেখিয়েছিল। মা দেখুন, জামাই কি রকম লেখে, আর স্বামীসেবা, ঘরসংসার সব করেও তাঁর মেয়ে কি অসামান্য অভিনয় করে!
মায়ের চোখ দিয়ে জল গড়িয়েছিল।
—এমন নিষ্ঠুর বই লিখল অরুণ? কি দোষ করেছিল রাধা যে একটা ভুলের জন্যে ওকে সন্তান, সংসার সব ছেড়ে চলে যেতে হল? শেষে বাইজি হল, ছি ছি ছি! আর স্বামীর পায়ের কাছে পড়ে মরতে হল?
অরুণদা বলেছিল, এখানেই নাটকের সার্থকতা। আপনি যেমন কাঁদছেন, দর্শকও তেমনি কাঁদছে। নাটকটা নিয়েছে লোকে।
—আমি তো আমার মেয়েকে দেখছিলাম। বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। তা বাবা! তোমার হাতেই তো কলম, অভাগীকে একটু সুখ দিলে না?
—নাটক, নাটকই মা!
—যাকগে, দুঃখ যেন ওখানেই থাকে, তোমরা সুখে বেঁচে—বর্তে থাকো।
বউদি পরে বলত, ওর বাড়ির এ—সে আসে বলে রাগ করে বিনয়! আমার মা—ই যাওয়া—আসার সেতু বেঁধেছিল।
পৌষ মাসে রেজিস্ট্রি বিয়ে মায়ের বুকে তো বিঁধে থেকেছিল। অনেক স্বস্ত্যয়ন পুজো এসব করান তিনি।
মেয়ের শ্বশুরবাড়ি বলে একটু বস্তু আছে, তা জানার পর সেখানে আমের সময়ে আম, পুজোর সময়ে কাপড়চোপড়ও পাঠান।
অরুণদা নাকি মাকে শুনিয়ে মেয়েকে বলেছিল, তোমার মাকে ওসব লৌকিকতা করতে নিষেধ কোর।
—কেন বলো তো?
—ওরা লোক ভালো নয়। ভালো নয়, কালচার নেই, থাকলে আমি বাড়ি ছেড়ে আসি?
তা, বউদি এটাও বলে, আমার সঙ্গে কখনো জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট খোলেনি। বলত, তোমার টাকা তোমারই থাক। আমার প্রয়োজন খুব কম।
প্রয়োজনের তো ব্যাপার ছিল না। বউদির মা জানতেন, বেটাছেলেকে তুষ্ট রাখতে হয়। অরুণদার ঠাটবাট, সেবাযত্ন, মাঝরাতে চাইলে বাঘের দুধ জাতীয় ব্যাপারে কোনো ত্রুটি হয়নি।
বউদির মা বছর খানেক বাদে মারা যান। বউদি বলে, একে একগাদা উপোস করত, তার ওপর বিধবার আচার বিচার মানত… তারপর, বাবা থাকতেই চার ধাম তীর্থ করে আসে। টাইফয়েড যখন হল, দেহে যুঝবার মতো শক্তি ছিল না।
—খুব ধার্মিক ছিলেন বুঝি?
—ধর্ম—টর্ম করত খুব। সেও শূন্যতা ভরাতে। আমার দিদিমার মেয়ে, আমার বাবার স্ত্রী, দুটো হওয়া সহজ ছিল না। বাবার জঘন্য মেজাজ ছিল, জানো?
বউদি যদি বাবার মেজাজও পেত!
—আপনি কার মতো হয়েছেন?
হ্যাঁ, বউদি নিজের মতোই ছিল। পেশাদার অভিনেত্রী, অভিনয়ে ঠিক আছে। কিন্তু জীবন যাপনের ব্যাপারে একেবারে সশস্ত্র ছিল না। তাকে আঘাত করা, তার আত্মবিশ্বাস ভেঙে দেওয়া অতি সহজ ছিল সেই লোকের পক্ষে, যাকে বউদি অসহায়ভাবে ভালবাসত। যে জন্য ইদানীং বলত, এখনো ওকে এত ভালবাসি কেন বিনয়? কেন?
আমি মঞ্চ ও পর্দার পুরনো ট্রাডিশনের লোক, এখনও তাই রয়ে গেছি। আমার সময়কার বাংলা ছবি দেখার সুযোগ পেলে হামলে পড়ি। কি সিনেমা, কি থিয়েটার—আমি গল্প খুঁজি। এখনো বাণিজ্যিক মঞ্চে ও পর্দায় সেই আত্মত্যাগিনী স্ত্রী বা মা, পরিবারকে একান্নে রাখার জন্যে আত্মোৎসর্গকারী বড় দাদা ও মাতৃসমা বড় বউদি, স্বামীর জন্য অক্লেশে কর্মজীবন ত্যাগকারিণী রান্নাঘর—নির্বাচনকারী স্ত্রী, এদেরকেই নানাভাবে দেখা যায় শুনেছি।
দেখি না, সিনথেটিক লাগে।
এখনকার নায়ক—নায়িকাদের সিনথেটিক লাগে।
নিশ্চয় আমি ভীষণভাবেই ব্যাকডেটেড হয়ে গেছি। এখন আর বদলাই কেমন করে নিজেকে?
বউদি সম্পর্কে এত বিগলিত আমি কেন, এ কথা অরুণদা ভেবে পায় না। শুনেছি বলে, আমার কাছেই এসেছিল, আমারই অনুগত ছিল, তারপর…জানি না…সরসীর খবর তো রাখি না, শুনতে পাই।
বউদি বলত একসময়ে, বিনয়, তুমি বিয়ে করোনি কেন গো?
—হয়ে ওঠেনি বউদি, বিশ্বাস করুন।
—বিয়ে করলে সে মেয়েটা বড় সুখী হতো গো! তুমি এত ভাল, এমন সবদিকে নজর, এমন দয়ামায়া তোমার।
—তা কে জানে? আমার তো ধারণা মেয়েরা নিষ্ঠুর পুরুষদেরই ভালবাসে।
—দূর! সবাই কি আমার মতো গাধা?
আর পিপুল যখন একদিন, বছর ছয়েক আগে হঠাৎ বলল, বিনয়কাকা! ম্যান টু ম্যান প্রশ্ন করছি, তুমি বিয়ে করনি কেন?
—প্রশ্নটা কত বছরের, পিপুল?
—অনেক বছরের।
—ম্যান টু ম্যান। এর চেয়ে ফ্রাংক হতে পারতে। অনেক বছর আগেই। আমার কথা বলতে পারি, আমাদের বাড়িতেই একটা ট্রাডিশন—বড় ছেলে বিয়ে করে না। আমার জ্যাঠামশাই বিয়ে করেননি (ঘটনা), আমার পিতামহের বড়দাদা বিয়ে করেননি (এটা বানালাম)। আমরা বিয়ে করি না, বিয়ে দিই। আমার মতো চরিত্র তুমি পুরনো বাংলা ছবিতে, পুরনো বাংলা নভেলে অনেক পাবে।
—রিয়ালি…আমি খুব…যাকে বলে অভিভূত…যে আমার মা—র এত ভাল ভাল বন্ধু আছে।
—সে তো ছোটবেলা থেকেই দেখছ যে আমরা তোমার বাবা ও মার অনুগত সৈনিক।
—যাঃ, বাবার নয়!
—তাহলে তুমি ভুলে গেছ। তোমার বাবার…এখন আমাদের দরকার নেই…তিনি শক্তিমান…তোমার মা দুর্বল…তাঁর অসুখ—বিসুখ…বাড়ির সমস্যা…বউদিকে তোমার কাছে কেন নিয়ে যাও না পিপুল?
পিপুল কতকগুলো বানানো কথা এতকাল শুনছে যে সেগুলো বিশ্বাসও করে অনেককাল। তা ছাড়া যেদিনের কথা বলছি, পিপুল সামান্য মদ খেয়েছিল। ও মদ্যাসক্ত, মদ্যপ কিছুই নয়। হেলথ ক্লাব এবং ‘ইয়োগা’ এবং ‘নো সিগারেট’ এবং ওর পিতার অমোঘতায় এবং ওর স্ত্রীর অতিমানবীত্বে বা সুপার উওম্যানশিপে বিশ্বাসী—চল্লিশ বছর বয়স্ক, দু ছেলের বা এক স্থবির বৃদ্ধ চিরন্তন বাঙালি—যেমন বাঙালিরা একদা সতীদাহের বিধান দিত।
পিপুল, অতএব, খুব আন্তরিক ভাবেই বলল, মা আসবেই না।
—বলে দেখেছ?
—বাবা বলেছে, বাবাকেই বলেছে, যাব না।
—তুমি সরাসরি বলো না কেন?
—নট দ্যাট ক্লোজ টু হার। তুমি জান না, কি অবহেলিত ছোটবেলা আমার! মা যদি স্টেজ অ্যাকট্রেস হয়, সন্তানকে দেখবে কখন? দেখত তো বাবা।
বুঝলাম, কথা বলা বৃথা। কোনো কোনো রাস্তা বা সেতু বা বাড়ি কনডেমড হয়ে যায়। তাকে মেরামতের চেষ্টা করা বৃথা ও বিপজ্জনক।
বললাম, এটা তো মানবে যে সে দীর্ঘকাল সব ছেড়ে বসে আছে?
—হ্যাঁ…তা তো বটেই!
—একা থাকে, তোমরা দেখাশোনা করলে…
—মা কেন যে বাবার সঙ্গে থাকল না, জানি না…
বুঝলাম। এখন কথা বলা একেবারে বৃথা।
—এখন তো কলকাতাতেই বেশি থাকো।
—বউ দিল্লিতে। ওর তো নিজের ফার্ম। ছেলেরা ঋষিভ্যালিতে। আমি তো বাবার ঠিক উলটো দিকের ফ্ল্যাটটা…ইন ফ্যাকট, কলকাতাকে…সুন্দর করার জন্যে একটি বিশাল প্রজেকট…জানি না কি হবে! খুব দৌড়চ্ছি।
—নিশ্চয় হবে পিপুল।
এর পরে পরেই আমি তেড়েফুঁড়ে লেগে যাই বউদির পিছনে। বাড়ির সংলগ্ন জমি জোর করে বিক্রি করাই। বলি, ভাঁড়ে মা ভবানী হয়ে থাকবেন কেন? টাকা ব্যাঙ্কে রাখুন লগ্নী করে। বাড়ি রং—মেরামত করিয়ে নিন। চলে যান না ভালো নার্সিংহোমে, সব দেখিয়ে শুনিয়ে নিন। দেরী করবেন না।
—ওকে…একবার জানাব না?
—দেখুন, আপনি সচ্ছল ঘরে জন্মেছিলেন, কিন্তু বিষয়বুদ্ধি আপনার নেই। অরুদা, গরিবের ছেলে। সে এসব ব্যাপারে আপনার স্বার্থ দেখে ভালো পরামর্শ দিতে পারবে না। আপনার মায়ের রেখে যাওয়া টাকা নিয়ে তার পরামর্শে যা করলেন…আশি হাজারে এক বিঘা ধান জমি কিনলেন…যখন তার দাম চার লাখ, তার কথাতেই এক লাখ ত্রিশ হাজারে বেচলেন…দালাল খেল খানিক…এবার আর সে কাজ করবেন না। সে আপনার স্বার্থ দেখবে?
—সে এ সব বোঝে না বিনয়?
—বউদি! আমি সামান্য মাপের মানুষ। আপনাকে বুঝতে আমি একান্ত অক্ষম। হয় আমার কথামতো কাজ করবেন, নয় আমি আর আসব না। আমি ভীষণ ক্লান্ত বউদি। শুভময়ের জামাই টিকিট পাঠিয়েছে, আমি হিমাচলপ্রদেশে ওর আপেল বাগানে দুমাস থেকে আসব। এখন আপনি বুঝুন।
—আমাকে নিয়ে যাবে বিনয়?
—আমি? আপনাকে? অরু নিয়ে যেতে চাইল চাঁইবাসা, অলকাদি বলল, বাঙ্গালোর, চলো, আমি বললাম, আমরা সপরিবারে যাচ্ছি হাজারীবাগ—চলুন! কোথায় গেলেন, কবে? না, বউদি, আপনাকে নিয়ে যাব না। তা ছাড়া…অরুণদা কখন অসুস্থ হবেন, কখন পিপুল জানাবে…আপনি ঝোল—সুকতো রেঁধে দৌড়বেন—নো।
জমি বেচে চার লাখ টাকায়—আমি তো সব ব্যবস্থা করে রওনা হলাম। হঠাৎ বোধহয় মনে হলো কিছু—শুনলাম যাকে যা দেবার দিয়ে—থুয়ে, কিছু খরচ করেছে।
অরুণ বউকে নেকলেস কিনে দিয়েছে। অরু বলল, এটা ইডিয়টিক। ও নেকলেস পরবে না। টাকাটা দিলে কাজ হতো!
দেখলাম, ফিরে এসে দেখলাম, দোতলাটা রং করিয়েছে, বাথরুম নতুন করে নিয়েছে, আর, আর অবিশ্বাস্য, একটা ভালো ইনভার্টার কিনেছে।
সোনারপুরের জমি বেচে টি. ভি. কিনেছিল।
এখন কিনেছে ইনভার্টার।
—বাকি টাকা কি করলেন?
—ও তো ছোঁবেই না…ফোনই করেছিলাম। বলল, বাড়িও বেচে দাও না? বেশ ইউরোপ বেড়িয়ে এসো।
—প্রত্যাশিত। কি করেছেন টাকাটা।
—বাপ রে বাপ, পিপুলকে নমিনি করে ফিকসে রেখেছি। সুদে আমার চলে যাবে। খুব বেড়িয়েছ, তাই না?
—খুব শান্তি পেয়েছি। ওখানে সেটল করতেও পারি।
—অরু চলে গেছে… তুমি চলে যাবে…
—অরু এক বছরের জন্য গেছে, আবার আসবে। আমিও যাব বললেই যাচ্ছি না…
—যেতে হলে যাবে বিনয়…কতকাল আর…
—জানি না। দেখে যাই। এ কি! শেলী চা আনছে কেন? যে মেয়েটাকে রেখে গেলাম?
—কোনো দরকার নেই বিনয়…মিছেমিছে…
—নিজের জন্যে খরচ করবেন বা কেন? সবকিছুই তো আপনতম জনার্থে। চললাম।
‘চললাম’ বলেছি, পারিনি। অনেক কথা বলে যাচ্ছি, আসল কথাগুলো স্ক্র্যাপবই দেখে বলে যাই।
বউদি সেই মাথা ফাটার পর সেরে উঠলেও, অরুণদা এ—বাড়িতে ফেরেনি। বউদির সে সময়ে আশ্চর্য এবং দৃষ্টান্তমূলক আত্মত্যাগ—অভিনয় করাই বন্ধ করে দিল।
আমি এত রেগে যাই যে মাস ছয়েক যাইনি। দত্তদা, চাঁদু, অরু যেত।
দত্তদা একদিন বলল, চোরের ওপর রাগ করে মাটিতে ভাত কত দিন খাবে ব্রাদার। দিদি কেন অভিনয় করবে না, তার যুক্তি খাড়া করে ফেলেছে।
—আমাকে বলবেন না দয়া করে।
—শোনাই না, যেতে তো বলছি না।
—একটা লোক, এখন ত্রিশ বছরও বাঁচতে পারে…
—পারে। মানুষের লংজিভিটি বাড়ছে। আগে কলেরা, বসন্ত, সর্পাঘাত, ম্যালেরিয়া,বছরে ক—হাজার যেত! এসব তো কমে গেছে। ঘাটের মড়াগুলো অ্যান্টিবায়োটিকের জোরে ফিরে আসছে।
—একটা লোক বহু বছর ধরে আত্মহত্যা করবে, তা শুনতে চাই না।
—সে মনে করে, সে বসে গেলে অরুণদা বুঝবে যে দিদি যশাকাঙ্ক্ষী নয়। এখন রে রে করে সে ওপরে উঠতে পারে। আর এটা যেই বুঝবে, সেই ফিরে আসবে।
—সে আশা জলে গেল।
—হতেও তো পারে।
—আপনি বিশ্বাস করেন?
—না। অরুণ হালদার স্বার্থসর্বস্ব ছোট মাপের মানুষ। দিদি কেন, মেয়েছেলে জাতের ওপরেই ওর বিদ্বেষ।
—বউদি বিশাল ভুল করল।
—হয়তো শুধরে নেবে।
—কবে? আর হবে না দত্তদা, আপনি যান।
ভীষণ, ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়ি আমি। অসম্ভব ভয় পেয়ে যাই। কারো সঙ্গে কথা বলা দরকার, কিন্তু বলব কাকে? অবশেষে চাঁদু, দত্তদা আর অরুকেও ডাকলাম।
ওদের বুঝিয়ে বললাম আমি কেন এত ভয় পাচ্ছি। বউদিকে, বউদির হাত থেকে আর বাঁচানো যাবে না, সেটাও বললাম।
আমার যুক্তিগুলো এরকম ছিল : অরুণদা একেবারে সামন্তপুরুষ, সব মেয়েদের সম্পর্কেই। নারীবিদ্বেষ ওর ভেতরের ব্যাপার। নাটকের পর নাটকে ও মেয়েদের চিরঋণ, পদদলিত ভূমিকাই বহাল রেখেছে।
এবং সে বউদিকে তিলে তিলে শেষ করতে চায়, যা সে পারবে। নতুন নাটক নিয়ে চড় খাওয়া ও ভুলবে না। অধীরবাবু বা চন্দনবাবু নয়, বউদির ওপর শোধ তুলবে।
একই সঙ্গে এটাও সত্যি, যা ও নিজেই বলেছে যে এত বিরাট আত্মোৎসর্গ, এই যুক্তি—বুদ্ধি অতীত বিশাল প্রেম, এই নিরন্তর প্রেমাঞ্জলি গ্রহণ করা ওর সাধ্যাতীত। ওর হাঁফ লাগে। নিজেকে বন্দী—বন্দী লাগে। কাচের কাগজচাপার দৃষ্টান্ত বলেছিলাম।
বউদি কেরিয়ার ছেড়ে দিলে, জীবিত থেকেই মরে গেলে ওর কিছু এসে যাবে না। ও স্বরাষ্ট্রে সম্রাট। দম্ভস্ফীত অহংকারে নিজেই নিজেকে মুকুট পরিয়ে কোনো এক সিংহাসনে বসে আছে। ও ধূর্ত, কুশলী, ওর মন রুগণ। ও জানে, দিন বদলাবে, স্তাবক জুটবে, যশ, অর্থ, খ্যাতি ও পেয়ে যাবে। কেননা জনগণ চোখের সামনে যা দেখে, কানে যা শোনে, তাই বিশ্বাস করে।
আর অরুণদা নিজের স্বপক্ষে বউদির বিপক্ষে অনেক কাল ধরে জনমত তৈরি করছে। প্রথম শিষ্য পিপুল। আরো অনেকেই মনে করে বউদি ডাঁটিয়াল—সে অভিনয় করায় স্বার্থে স্বামী ও সন্তানকে অবহেলা করে—শেলীকে রেখে সে অরুণদাকে অপমান করেছে—অরুণদা ‘সরসী তালুকদারের স্বামী’ হয়ে থাকতে পারছে না।
এখন বউদির এই আশ্চর্য আত্মবলিদান, এর পর অরুণদা এত বড় ত্যাগের ভার বইতে চাইবে না। সব কাজকর্ম ছেড়ে নিরন্তর ঘরের বউয়ের ভূমিকায় সরসী তালুকদার থাকুক—কিন্তু অরুণদা সেখানে থাকবে না। কখনোই না। এ কাজ সে নিশ্চিন্তে করতে পারে, কেননা সে জানে, বউদি তার জন্যে বাঁচে, তার জন্যে বহু বছর ধরে মরবে! অতএব, বউদির হাত থেকে বউদিকে বাঁচাতে হলে তাকে কাজের জগতেই ফেরাতে হবে। অভিনয়ের লাইন এমনই যে, এখনি যে মানুষ চরিত্রাভিনেত্রী, সে ছেড়ে দিলে শূন্যস্থান যে ভাবেই হোক পূর্ণ হয়েই যাবে।
পাবলিক ভুলে যাবে।
মানুষ এখন সমান্তরাল ছবি ও নাটক দেখছে। আরো দেখবে। সময়ের গতি এখন জেট—সেট।
পেশাদার থিয়েটারকেও এসব ভাবতে হবে। অন্যরকম রুচি আমদানী করতে হবে।
বউদি যে ধারার অভিনয় করেছে, তা ধীরে ধীরে পালটাবে।
সময়ের সংকট বা সন্ধিকাল এটা।
এখন সব ছেড়ে চলে যাবে কেন? যার জন্য যাবে, তাকে তো পাবে না।
চাঁদু অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়ে। এমন করা মূর্খতা। বউদি বুঝুক!
অরু বলল, এমন নির্বোধের মতো নিজেকে অপচয় করবে ওই লোকটার জন্য?
দত্তদা বলল, ভালবাসে।
অরু বলল, সেনসলেস। বউদি তো অন্য যুগের মেয়ে, অন্য সময়ের। এ কি বিনোদিনীর যুগ, না উমাশশীর? বিয়ে করে মঞ্চ বা পর্দা ছেড়ে চলে গেলাম?
আমি নীরব।
—বয়স কত ওর?
—ছেচল্লিশ।
—দেখলে কে বলবে! এমন নয় যে সুন্দরী থাকার জন্যে প্রচুর খাটছেন।
না, আমি সুন্দরী বলব না বউদিকে—সুন্দরের চেয়ে অনেক বেশি! অসম্ভব মোবাইল মুখ, চোখ, গ্রীবা। খুব সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম স্তরে বদলে বদলে যায়। রং তো ফর্সাও নয়। চেহারায়, গড়নে, হাসিতে এমন একটা অসহায় নিষ্পাপ ভাব আছে, যা ব্যাখ্যাতীত।
চাঁদু বলল, চালাবে বা কি করে?
আমি বললাম, ত্যাগ কোর না বললে ও মানবে। ত্যাগ ও করবেই। অরুণদা যেহেতু জানে আমৃত্যু সরসী তার পথ চেয়ে থাকবে, সে হেতু ফিরবে না।
দত্তদা বলল, ফিরবে বা কেন? যারা তাকে প্যালা দিচ্ছে, তার মধ্যে অনেক মেয়েছেলে।
অরু ঈষৎ হেসে বলল, মেয়েরা সাধারণত মেয়েদের ওপর খুব সদয় কোনোকালেই নয়।
সময়টা ১৯৭৪। কত কি ঘটে গেছে, কত কি! নকশাল আন্দোলন, এমার্জেনসি আসে আসে—সিনেমায় সত্যজিৎ, ঋত্বিক, মৃণাল, তপন সিংহ, রাজেন তরফদার, কত নতুন নতুন নাম তখন, বহুকাল, দু দশক আগে প্রতিষ্ঠিত।
আমরা তার বাইরে থেকেছি।
একটি রমণীকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছি, যার বিষয়ে আমরা কেউ প্রেমাসক্ত নই, কিন্তু সে আমাদের জীবনে অমোঘ হয়ে থেকে যাচ্ছে দীর্ঘকাল। কি করতে পারতাম?
আজ বউদির মৃত্যুর পর ভাবছি। এটাও বুঝতে পারি, আমিই চির অনুগত থেকে গেছি বেশি করে।
দত্তদার নিজস্ব জীবন আছে। শালার ছেলেদের তো দত্তকই নেন। তাদের বউ, ছেলে, মেয়ে, ভরাভর্তি সংসার। ধীরাদিকে ‘কেমন আছ’ বলতে যান না, কিন্তু আজকাল নাকি চলে যান আলিপুর হর্টিকালচার বাগানে। পোশাকের কারবার বহুদিন নেই। ‘দত্ত অ্যান্ড সানস’ এখন ইস্পাতের আসবাব বিক্রি করে। দত্তদা বলেন, আমাদের জমানা চলে গেছে রে ভাই। এখনকার মানুষজনের সঙ্গে কথা বলেও সুখ নেই। কত কি এল—গেল, দেখলাম। গাছপালার মধ্যে বসে বেশ শান্তি পাই।
চাঁদু সামন্তও মহাব্যস্ত লোক। অন্তরটা তেমনি নরম, তেমনি সাচ্চাই আছে। কিন্তু বাবু—সংস্কৃতির বিষাক্ত প্রভাব ও লোক—সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে গবেষণা করে, বই লিখে ও বেজায় ব্যস্ত মানুষ হয়ে গেছে। জয়া থাডানি নামে একটি কলকাতা—নিবাসী সিন্ধী মেয়েকে বিয়ে করেছে গত বছর। দুজনেই রিসার্চ করে, লেকচার দেয়। বউদি জয়াকে একটা বেজায় দামী জামদানী ঢাকাই দিয়েছিল।
ওটা ‘জননী’র শততম রজনীতে পাওয়া।
ওই শাড়ি পরে বউদি সংবর্ধনা নিচ্ছে চন্দ্রাবতী দেবীর হাত থেকে, ছবিটা আমার আছে।
—অরু বউদির চরম দুঃসময়ে বউদির কাছে বছর আষ্টেক থেকে আমাকে চিরঋণী করেছে।
অরু একটি মস্ত স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানে কাজে ঢুকেছে। বিহারের আদিবাসী ক্রিশ্চান মেয়ে এলসাকে বিয়ে করেছে। চাঁইবাসায় এক বছর থাকছে। তারপর বাঁকুড়া গিয়ে সেন্টার খুলবে। গাছগাছড়া থেকে ওষুধ বানাবে।
১৯৭৪ সালে ফিরে যাই।
বউদি, যা ভেবেছিলাম, তাই, মঞ্চ কেন, অভিনয়ই ছেড়ে দিল।
অধীরবাবুকে বলল, কন্ট্রাক্ট আর রিনিউ করব না। ছাব্বিশ বছর না সাতাশ বছর অভিনয় করলাম, আর পারছি না।
—ম্যাডাম! স্টেজ আপনার জীবন!
—না, অধীরবাবু, আর না।
অধীরবাবু একটা ফেয়ারওয়েল দিল। ফেয়ারওয়েল নিতে গিয়ে বউদি কেঁদেও ফেলল।
আমরা একসঙ্গেই ফিরলাম।
বউদি বলল, সবাই চুপ কেন? কিছু বলুন?
অরু বলল, এত তাড়া কিসের? এখন বছর তিরিশ…মানে যতদিন বাঁচবেন… ধীরে ধীরে বলা যাবে। চাই কি, একটা আত্মজীবনীও লিখতে পারেন।
—দাঁড়াও, আসল লোককে জানাই…
বউদি ফোন করছে, আমরা বেরিয়ে এলাম।
কয়েকদিন না যেতেই আমাকে ফোন। গেলাম।
দেখলাম ভয়ানক নার্ভাস। বলল, বিনয়, বিনয়! এ কি বলছে জানো?
—বলছে আর ফিরবে না।
—সে এখানে এসে থাকবে না। আমাকেও নিয়ে যাবে না, এখন কি হবে?
—এই রকমই হবে।
—কিন্তু, সে কেন আসবে না?
—সেই জানে।
—আমি কি করব?
—আপনি জানবেন।
—তুমি কিছু বলবে না?
—আমরা সবাই মনে করি, কেরিয়ার ছেড়ে আপনি শেষ, অসংশোধনযোগ্য ভুল করলেন। অরুণদার আপনাকে দরকার নেই। পাবলিক আপনাকে ভুলে যাবে।
—যাঃ, তা কখনো হয়?
—অরুণদা তার মতো কাজ করছে, আপনি আপনার মতো কাজ করতেন না হয়? নাকি সেটা অসম্ভব?
—সে তো আমাকে ছাড়তে বলেনি বিনয়। আমিই বললাম সব ছেড়ে দেব। সে হেসে বলল, সময় কাটবে। কি করে? বললাম…কেন, তুমি আমি একসঙ্গে কাজ করব? যাত্রাতেও তো অভিনেত্রী থাকে… এমন করে হাসল জানো? এমন করে…হাসল আমার ভয় করছে বিনয়…
—আমি চলি বউদি।
—অধীরবাবুকেও যা তা বললাম… সব তো ওর জন্যে…ওতো এই চাইছিল, আমি মুছে যাই…সরে যাই…পিপুলেরও অনেক নালিশ…
—আমি চলি।
—সবাই ছেড়ে যাবে আমাকে? সবাই?
আমার বুক ছিঁড়ে গেল। সেখানে একটা স্থায়ী ক্ষত থেকে গেছে। বউদির কথা ভাবতে বসলেই রক্তক্ষরণ হয়।
না, আমি শরীরে সুস্থ।
কোনো রোগ নেই আমার, কোনো বদভ্যাস নেই।
১৯৭৪ সাল থেকে মাঝে মাঝেই আমি বেরিয়ে গেছি কলকাতা থেকে। আন্দামান থেকে সৌরাষ্ট্র, হিমাচল থেকে কন্যাকুমারিকা, অনেক, অনেক ঘুরেছি। পাখির ছবি তোলা আমার নবতম নেশা। দত্তদার গাছপালা, আমার পাখি। কিন্তু পাখির ছবি নিয়ে ক্যালেন্ডার করেছিল এক বড়সড় কোম্পানি। কিছু ছবি নিয়ে পিকচার পোস্টকার্ড করে দিয়েছি এস. টি. বা আন্তর্জাতিক ‘সেভ দেম’—এর জন্যে। নাম ও টাকা দুটি পাচ্ছি।
আমি বউদিকে বলেছিলাম, ছেড়ে যাচ্ছি কোথায়? আমরা আছি, আমরা থাকব।
বউদি সে সময়ে অত্যন্ত দিশাহারা হয়ে যায়, অত্যন্ত এলোমেলো। অরুণদাকে ফোন করে করে… শেষে একদিন বলল, আমি তো আর পারি না আমাকে নিয়ে।
—বাইরে ঘুরে আসুন না কোথাও?
—মনে হয়, মনে হয় বিনয়…যাই না কেন জান? হঠাৎ যদি হাজির হয়? তখন আমি না থাকলে যে কি রেগে যাবে…
বউদির মুখে, তেমন সম্ভাবনাতেই যেন আলো জ্বলে উঠল।
আমি বললাম, অরু এখানে থাকতে পারে?
—সে তো তখনি বলেছিলাম।
—পিপুল বা অরুণদা…
বউদি নিশ্বাস ফেলল। বলল, থাকবে তো আমার বাড়ি। এতগুলো ঘর…আমায় যেন খেতে আসে। এত জিনিস…এত আসবাব…সব ঝাড়ামোছা, পরিষ্কার রাখা…আমি আর পারি না।
—অরুর সম্পর্কে একটাই কথা—সুব্যবহার না করুন, দুর্ব্যবহার করবেন না।
—আমি কি দুর্ব্যবহার করি?
—আপনার কথা হচ্ছে না।
বউদি নিশ্বাস ফেলে সোজা হয়ে বসল। বলল, কেউ দুর্ব্যবহার করবে না।
—আপনার ভার আপনাকেই নিতে হবে, মনে রাখবেন। তাহলে ভালো থাকবেন।
—তোমরাও নিশ্চিন্ত হবে।
—সে তো আপনার হাতে।
—ভাল থাকব, বিনয়…
.
বউদি চলে গেল।
আর বলতে পারি না।
আন্ত্রিক ক্যানসার হয় যার, সে কেন বোঝেনি। এত ওজন কমে যাচ্ছে—হজমে এত কষ্ট, যা খায় সবেতে জ্বালা—এটা স্বাভাবিক নয়?
কার্যকারণ এমনই যে সে সময়ে আমি ছিলামই না। অরু তো চলেই গিয়েছিল—শেলীই দাপাদাপি করছিল।
দত্তদা বললেন, ডাক্তার নিয়োগীর কাজ নয়, ভর্তি হন কোথাও।
সুলতানাদির কাছে আমরা এজন্য ঋণী যে তিনি ঠাকুরপুকুরে ভর্তি করেন।
সেখানে ছিল তিন মাস। আমি যখন দেখতে যাই, একটু ভালোই মনে হলো। ক্যানসারের প্রথমাবস্থা, চিকিৎসায় রেসপনড করেছিল।
আমাকে বলল, ও এসেছে ক’বার…পিপুল…এসেছে…সব খরচপত্র ওরা করছে, জানো? আমি অবশ্য চেক লিখে দিলাম দত্তবাবুর কাছে। কত খরচ হবে কে জানে! মালিনী বলছে সরকার নাকি খরচ দেয়। আমি বলেছি, ‘না’।
অরুণদারা কি দিয়েছিলেন জানি না। কিন্তু আমার জেদে বউদি একটা ফিকস ডিপোজিট ভাঙালেন। তারপর…তারপর…বাঁচবেন না জেনেই বাড়ি ফেরার জন্যে ভীষণ জেদ ধরেন।
সুলতানাদির নার্সিংহোম থেকে ব্যবস্থা করে বউদির ঘরকে কেবিন করে ফেলা হয়। পিপুল বলল, আপনাদের থাকার দরকার দেখি না।
বাড়িতে বুধবার…মারা যায় শনিবার…নার্সরা ছিল…আয়া…শেলী…অরুণদা আর পিপুল ও—বাড়িতে থাকেনি, যাচ্ছিল—আসছিল…মৃত্যুর সময়ে কে কে ছিল বলতে পারি না।
সবচেয়ে অবাক কথা, বউদির আলমারিতে একটা পাসপোর্ট পাওয়া যায়। ঠিক রিনিউ করিয়ে গেছে।
যে শহর ছেড়েই বেরোয়নি এক অলীক প্রত্যাশায়, তার কাছে পাসপোর্ট!
বউদি কোথায় যেতে চেয়েছিল?