দুই – শেলী
আমাকে উনি শেলী বলতেন। আমার নাম সেলিমা। কাগজে নাকি সব লিখেছে দেখলাম। হোঃ! বাড়ি তো তাঁর এটাই ছিল, এ—ই ২। ৫। এ, মেহতাব রোড। আমারই ওনার কাছে আটত্রিশ বছর হয়ে গেল। আগে সব এখেনেই থাকত আমি যখন এসেছি। তা, তখন আমার দশ বছর হবে। বাবু থাকত, মা থাকত। পিপুল তখন ছোট ছেলে। এনাদের দুই লোকের কাজ বাইরে বাইরে, ছেলেকে কাছে রাখত না। দার্জিলিঙে পাঠিয়ে দিয়েছিল। মা বলত, বড় দুঃখের দিনে পিপুল এসেছিল, জানলি শেলী? তাই কষ্ট করেও ভাল জায়গায় পড়াচ্ছি, যাতে মানুষ হয়। তা মানুষ তো সে ভালই হয়েছে শুনতে পাই। আজ সেও তো আধবুড়ো বেটাছেলে। অনেক নামডাক, অনেক কামায়। কিন্তু আমি বলি মহাপাপী। অমন মা, তারে দেখল না, বাপ বলতে মুচ্ছো যায়। এসব শোনা কথা নয়, দেখা কথা।
মিছে বলব কেন? মা অনেক করেছে আমার। এত করা কেউ করে না।
শুনচি, এ বাড়ি বেচে দেবে বাবু। বাড়ি, যা শুনেচি, বাবুর নয়, মায়ের দিদমা মাকে দিইছিল। তিনি খুব খাণ্ডার মেয়েছেলে ছিল। উদোম খেতে পারত। আম, কাঁটাল, দুধ, ঘি খুব খেত। তিনির বংশেও এক মেয়ে। মায়ের মা। মায়ের দিদমাকে তাদের জমিদারিতে সবাই বলতে সিংহবাঘিনী। জমিদারি সামলেচে, কাছারির কাগজপত্তর দেখেচে—আর মায়ের বাবাকে ঘরজামাই রেখেছিল, ছেলে হয়ে থাকবে বলে।
মা বলত, বড়লোকের ঘরজামাই মানুষ হয় না। মায়ের বাবাও তেমন ধারাই ছিল শুনি। ভাতের পাতে গোটা ইলিশ ভাজা খাব, লুচির ফুলকো ছিঁড়ে কচি পাঁঠার ঝোল খাব। খেতে খেতে ঘুমোতে যেত, ঘুমিয়ে খাবার স্বপন দেখত উঠে আবার খেতে থাকত।
তিনি তো একঘরের এক ছেলে। যতদিন মায়ের দিদমা বেঁচে ছিল, ততদিন সাওস পায়নি। তিনি মরল তো তার জ্ঞাতগুষ্টি এসে চেপে বসল। তাদের খাইয়ে—মাখিয়েই সব জলে চলে গেল।
এই বাড়িটা, আর পাশের জমিটা মায়ের নামে ছিল, এটুকুই যা বেঁচেচে।
এটুকু না থাকলে মার চলত? পাশের জমি বেচেও তো টাকা বেহাত হয়ে যেত। নেহাৎ বিনয়বাবু ধমকেধামকে ব্যাঙ্কে রাখিয়ে দেয়, তাতেই মাকে হাত পেতে চাইতে হয়নি। কত বলেচে বিনয়বাবু, বেচে দিন সব—ফেলাট কিনে নিন। মা শোনে নে। কিন্তু কিচু জমি তো বন্দকী বোদ করি, জানি নি।
এসব কথাই কিরে দিয়ে বলতে পারি। মা যা বলেচে, আমি তাই বলচি। বলেচে বা বলচি কেন, স্বচোখ্যে তো দেখিচি এত বছর ধরে।
অবশ্যি এ কথা বললেই বাবু চেয়ারে কাত হয়ে চোখ উলটে খানিক মুচকে হেসে বলবে, অতই যদি জানবে তবে সেই কেন লিখুক না তার মায়ের কথা? আসল কথা তো বলা যায় না, ওই শেলী সরসীর কাছে তো মাঝে মাঝেই থাকেনি। চলে যায়নি যখন তখন?
বলতে পারে, বললে মিছে বলবো না কিন্তু কি করতাম? নিজের মা নেই না আছে জানিনে কোনোদিন। বাপ বলত, মায়ের নাম কল্যে কেটে ফেলে দেব। শেষমেশ বাপ জেলে, আমার গতি হতো এতিমখানা। মা বলল, ওর বাপ গ্যারেজে কাজ কত্ত না? সব কতা শুনেমেলে বলল, চ, আমার সঙ্গে চ।
তখন হতেই মায়ের কাচে। আমাকে নতুন জামা কিনে দিল। মাতার উকুন ছাড়াল। আমি রোজ ভাবতাম তাইড়ে দেবে, নয় বেচে দেবে। এমন তো বেচে মেয়েদের…বাপ বলত, জাঁললার ধারে যাবিনি, কে ধরে নে যেয়ে বেচে দেবে।
কেমন করে জানব, সেই মাকেও কেউ বেচে দিয়েচে কিনা?
আমার মা নাকি খুব ডবকা ছিল।
মা তখন হতেই তিনি আমার মা।
বাবু বলত, পুষ্যি বাড়াচ্ছ, ভাল করছ?
মা বলত, পিপুল নি কাছে, আমার খালি খালি লাগে নে? ও কাছে থাকুক।
—মেয়েছেলেদের ভার নেয় কেউ?
—কেউ না কেউ তো নেয়! যেমন আমি নিলাম।
তখনে মা উটচে ওপর পানে—পরের রমরমা তখনে হয়নি, হবো হবো কচ্চে। কিন্তুক মায়ের বাড়ি তো নিজের বাড়ি, থেটার কত্তে যায়। বাবু আর মা ট্যাসকি চেপে যায়। বাড়িতে বাসিনী মাসি আর তার ছেলে ভানু সব্যস্য কাজ করে। মাসির কাছে বসে খুব শোলোক শিকতাম। মাসি রাঁদত, বাড়ত, কালনির মা ঠিকে কাজ করত, ভানু আর সব দোকানপাট…ছুটোছুটি…কিন্তু বাবুর তরে সে খাটত বেশি।
বাবুর কি ম্যাজাক, কি ম্যাজাক—সব্যদা সব হাতে হাতে চাই… লেখায় ঘরে কেউ ঢুকবে না মা ছাড়া। থেটারের বই লিখত। পরে তো যাত্তারার পালা লিখে লিখে… থেটার করে…গান লিখে অত রমরমা হল।
মা যেন ঠাকুরসেবা কত্ত।
বাবুর ইচ্ছে হল তো ভরা বৈশেখে কমলালেবুর পায়েস আর ফুলকপির ডাঁললা খাবে।
মা ছুটল নিউ মার্কেটে!
কোথ্যেকে যোগাড় করে আনত বল তো?
সব—সব বিনয়বাবু।
কোথ্যেকে এসে জুটেছিল মায়ের কপালে, কে বলবে! বাবুর ওপর ভকতিভরে এসিছিল প্রথমে! ভদ্দরঘরের ছেলে…থিয়েটার সিনেমার কতা লিকত আর ফটো তুলত। মায়ের সকল ছবিই তো তেনার তোলা। সিদিনে তার বয়সও কম, শামবন্য ছেলে। কতা কম কয়— কেমন করে জানব অত পয়সা ওদেরে—কাজের নামডাক বাড়চে—
মায়ের জন্যে জীবন দিতে পাত্ত। বিনয়বাবুর গাড়িটা তো মায়ের দোরেই বাঁদা থাকত। তা মা নজ্জা নজ্জা হেসে বলত, বিনয়! ওর তো জানো—যা বলবে সেটি চাই। নে যাবে নিউ মার্কেটে?
—একনি চলুন না।
সেই কমলালেবু এল, পায়েস করল মা, রেঁদেবেড়ে বাবুকে খাইয়ে—দাইয়ে বলল, হ্যাঁ গো! জমিদারি তো আমাদের ছিল। তোমার এমন জমিদারি ম্যাজাক হল কোত্থেকে?
বাবুও তখনে, মিছে বলব না, বলত, কেন? তুমি আচ, আমি তো রাজা!
ওই মাজেসাজে। মা সব্যস্য খেটে মত্ত। বাবু মাজে মাজে খানিগ সাজানো কতা ছুঁড়ে দিত। তাতেই মা এমন কত্ত, যেন আসমান থেকে তারা পেয়েচে।
মা, লাগাবাঁদা থাকিনি তখনে।
মা কত বলত, মাস্টারনী রেখিচি, ভাল করে পড় শেলী। তোরে আমি খরচ করে বে দেব।
বাবু বলত, কেন? থেটারে নামাবে না?
—’মা’ বলেচে, ওরে থেটারে দেব?
আমাকে সাজ্যে—গুজ্যে, চুল বেঁদে নিজের কাপড় পইনে নে ঘুত্ত।
—কোথা যেত?
—থেটারে গেচি তো বটেই। রাধা বষ্টুমী হয়ে মা নলিনবাবুর জন্যি কেঁদে কেঁদে গান গাইতে গাইতে মরে গেল দেকে আমার কি কান্না। —থেটার সব দেকেচি…দাজ্যিলিং, পাটনা, ধানবাদ। যকনে যেতা থেটারে কত্তে গেচে আমারে নে যেত।
—ঠিক বলোচো, আমিই মার চুল বাঁদতাম, মার জামাকাপড় দেকে রাকতাম। লেকাপড়া যকনে করলামই না, চিঠিপত্তর কষ্টে—ছিষ্টে…মুকের বোলও পষ্কের হল না… মা বলত তোরে দোকান করে দোব। কনে সাজাবি…চুল বাঁদবি…
—সর্বত্তর গেচি। বাবু চলে গেল যকনে তকন তো মা কপাল চাপড়ে চাপড়ে…সে সময়ে বিনয়বাবুর বাসায় তো আমি দৌড়লাম! নহলে কি আর মাকে…আর এই হাসপাতাল থেকে হাসাপাতাল? সে এই শেলী। নুন খেইচি, গুণ গাইব, কিন্তু মা তো থাগল না। শেষকালটা …বিনয়বাবুও তকনে কোত…না মত্ত না। বিনয়বাবু, চাঁদুদাদা, দত্তবাবু, অরুবাবু সকল আপনজনদেরে ছাড়ল যেদিন থেকে…
—না, আমি লাগাবাঁদা থাকিনি গোড়ের দিকটায়। বয়স তখনে একুশই হবে, তা ইলোটিরি দোকান যার, সেই দিলীপের সঙ্গে পেনয় হয়ে গেল যে! সে কি পেরেম আমার, সে কি পীরিতি! ওরে নইলে চক্কে আঁদার দেখি!
মা কত বকেচে, বুজিয়েচে, ওর বয়স ছত্তিরিশ… বউ—সন্তান আচে…ও তোরে নে দুদিন খেলবে, তা বাদে ছেড়ে দেবে!
তকনে আমি সুচিত্রা—উত্তম দেখচি ওর সঙ্গে পাইলে পাইলে…মায়ের থেটার দেকচি…বাবু গান বাঁদচে, সব্যদা লোকের মুকে মুকে গান ‘যারে চাই তারে না পেলে সই, জীবন সঁপিব জলে…’ কি এট্টা গানের সিনিমার জন্যে বেঁদিচিল গানটা…
আমার তখন দশ অবস্তা!
মা যকনে বলল, ঘরে তালা দে রাকব শেলী! ভাল ছেলে দেকে বে দেব বলিচি না?
আমারও তখনে দুজ্যয় পেরেম! আহা! মুকখানা নয় যেমন তেমন, দেহে এট্টা জ্বালা নি? খুব মনে আচে, ‘করুণা’ নাটকের একশো নাইট… দেড় বচর বমরমিয়ে চলিছিল …মায়ের আলাদা সাজঘর…আলাদা ব্যবস্তা… থেটারে সীন ওটার একঘণ্টা আগে থেকে মা বসে থাকে নিশ্চুপ…পেত্যহ, পেত্যহ…কারো সঙ্গে কতা কয় নে…বাবুর সঙ্গেও না…স—ব জানি আমি। থেটার থেকে ফিরবে…গরম জলে নাইবে…আমি গা—হাত পাউডারে ডলে দোব, তবে ঘুমুবে।
স—ব জানি। স—ব ভুলে গেলাম। কোনো কিচু নয়, এ মাস মাইনের টাকাটা ডেক্রন শাড়ি কিনব বলে চেয়ে রেখিছিলাম…তাই নে, আর গায়ে যা ছিল কানফুল…গলার চেন…হাতের ঘড়ি…তাই নে বেইরে এলাম। সিধে শ্যালদা। বেলেঘাটায় এট্টা বস্তিতে তুলিছিলি বটে, কিন্তুক আমি জানি বে করবে। বে—র নাম করে নে বলে, তুই মোচনমান, আমি হিঁদু, বে হয়?
আমার তো মায়ের শিক্ষে। বলি, বে না করে বিচনায় তুলবি ভেবেছিলি? আর কোতা বা তোর ঘরদোর, কোতা কি?
বলে কি, কানফুলটা দে, বেচে টাকা নে এসে তোরে নে ধানবাদ যাব। সেতা বে—র কোনো ঝামেলা নি। আমার রাগ চড়ে গেল। দুজ্যয় পেরেম ছিল, দুজ্যয় রাগ উঠে গেল। খুব খানিক চেঁচালাম। ফলে?—
ভুস্যি নাশ যাকে বলে। বস্তি তো রেলধাওড়া। পরদিন কল হতে জল নিতে দেয় নি কেউ। বলে, মোচনমানের মেয়ে নে এসে সব্যনাশ করচে।
খুব শোরগোল। আমি তো ভয়ে বাঁচি না। মোচনমান বলতে পারো, সেলিমা নাম ছিল, বাপের নাম ছোলেমান।
কিন্তুক গভ্যধারিণী মা তো রামলাল ভুজাওয়ালার কেমন বোন ছিল বলে শুনিচি। দশ বছরেরটি এনে মা বলেছিল, এ তোর নবজন্ম হল শেলী। পুরনো সব ভুলে যা!
আমি অনেক সিনেমা থেটার দেকিচি। আমি জানতাম গরিব হলেও সুক হয়। মাকে দেকিচি, বাবুর জন্যে প্রাণ দিতে। ভাবতাম তেমন করেই সংসার করব। সে সব আশায় ছাই পড়ল। ওই যে ‘করুণা’ নাটকে বোরেগী গাইত, ‘আশা করো কেন মন, আশা শুধু ছলনা’—আমারও তাই হল।
বাবু গান বাঁদত, নীলকণ্ঠবাবু সুর দিত। সে সব সামাজিক পালার থেটার— কোথায় কি, সবেতে ছাই! নীলকণ্ঠবাবুও তো মরে গেচে কবে। একনে তার নাম করে নে কেউ! তবে বাবুর লেখা গানের ক্যাসেট বেরিয়েচে। মা পিপুলকে বলেছিল, তোমার বাবার উচিত, নীলকণ্ঠবাবুর বউ—মেয়েকে টাকা দেওয়া। সুরটা তো তার।
পিপুল বলল, তোমার অত দরদ তো তুমি দাও গে।
ক্যাসেট দুটোই মা খুব শুনত। বলত, ভাবতে পারি, কত গান আমিও গেয়েছি সে সময়ে?
সে—সময় আর এ—সময় কি। তোমার চে’ বয়সে কত বড় কতজনা বেঁচে আছে, মানুষ তাদের দেখছে, মনেও রেখেছে। তুমিই বাবুর কথায় নিজেরে সইরে নিলে। বিনয়বাবু তখনে কত বলল, নিজেরে সইরে নিলে মানুষ ভুলে যাবে।
তুমি তা মানলে না।
যা হোক, সে সব হাংনামায় পরে রেলপুলিশ আমাদের বেলেঘাটা থানায় নে গেল। থানাবাবু বলে, অমন একটা নামী লোকের বাড়ি ছেড়ে ভটার সঙ্গে ভাগলে? চুরিটুরি করিছিলে কিছু?
—ও ভটা কেন হবে বাবু?
—ওর নানা কীর্তি। নানা নাম।
আমারে কোতা পাটাত কে জানে, মা খবর পেয়ে বিনয়বাবুরে পাটাল। ছাই ফেলতে এট্টা কুলোই পেইছিল, ময্যাদা কত্তে পারল না। থেটারের লাইনে মা যেন এক…
তা বাবু তো ঢুকতে দেবে নে। কত গাল যে বাপছেলেতে করল মাকে! এ পাড়ায় থাকা যাবে নে, বাড়ির ইজ্জত বলতে থাকল না কিচু…!
মা বলল, দিলীপ তো দিব্যি সংসারে ফিরে যাচ্ছে। যত দোষ শেলীর হলো? বয়সের গরমে এট্টা কাজ করে ফেলেছে…
—তা বলে…তা বলে…
—ভালবাসলে মানুষ অন্ধই হয় অরুণ। রায়বাড়ির মেয়ে হয়ে থিয়েটারে নামলাম। তোমাকে বিয়ে করলাম…
—অন্ধ হয়ে করেছিল?
বাবু অমনি চিবিয়ে চিবিয়ে কতা বলত সব্যদা। সিনিমার ভিলেনরা একেকজন যেমন করে। ঠোঁট টিপে হেসে, মহাতাচ্ছিল্যভরে কতা কইত। মা তো গলাও তুলত না, জবাবও দিত না।
মা বলল, হয়তো জনমভোর অন্ধই থাকব। সে কথা নয়, শেলী আর পিপুল, বয়সে তেমন তফাৎ নেই। ও আমারে ‘মা’ বলেচে। আমার মায়ের বাড়ি থাকতে আমার মেয়ে যাবে কোতা?
এ কতা বললেই বাবু চুপ।
মা কিন্তুক টেনে এট্টা চড় মেরিছিল আমাকে। সেই যা চলে গিইছিলাম…
তা বাদে…অনেক কাল বাদে…মায়ের ওপর অযতা রাগ করেই চলে যাই কাজ নে। ওই যে সেদিনে এয়েছিল? মলিনী মিত্রের কাচে। বাবু ছ্যাঁচা দিয়েই যাচ্চে, আর বাবুদের ধরে রাকবার জন্যে মায়ের সে কি সাদাসাদি!
—না না না। চন্দ কেন, কারো লেকা নাটক করব না…
—শত বললেও সিনিমায় নামব না…
—তুমি কোতা যেয়ে থাকো, জানতেও যাব না…
স—ব দেকতে পাচ্চিলাম। চন্ননবাবু, যার খুব নাম গো! নার নাটক একন কত নাম হয়েচে, কত সিনিমার গপ্প লেকে, বোম্বাইতে নাকি বাড়ি করেচে। বউ ছেড়ে ওদেশী মেয়ে বে করেচে—তার নাটক কল্য মা ‘জীবন পিপাসা’!
আপনারা তো সকলই জানো। এই যে টেপ চালাচ্চে, সকল কতা লিকবে তো?
স—ব লিকো।
আমার মায়ের কতা বুকে নে জ্বলে মরচি বাবু!
সে সময়ে আমার মা একেবারে সুজ্য হয়ে জ্বলচে। থেটারে এমন ওটা কেউ ওটেনি!
যেকেনে মার লাশ নামাল, মালা দিল, সেই অপরূপা থেটারেই তো মা বাঁদা আকটিন করে গেচে।
তা অপরূপা হলেন মালিক মরে গেল। তিনির নাম শক্তিপদ কয়াল। তবে সবাই বলত কয়লাবাবু। তিনির চা বাগান, হেন তেন অনেক ছিল। মাত্তর জলের দামে কিনল ‘সান’ থিয়েটার। লাক লাক টাকা খর্চো করে ঢেলে সাজল।
বাড়তে বাড়তে মায়ের মাইনে তকনে অনে—ক। বোনাস রে, এ রে! সে রে!
বাবুতে মাতে যকনে ঢুকিছিল, বাবুর লেকা বই খুব নিত পাবলিক। বাবুর বই, মার অ্যাকটিনি। শেষে তো কয়লাবাবুর সঙ্গে মার কনটাকট হল, কৎ বচর যেন কত্তে হবে।
বাবুর ‘তাসের বিবি’ বইয়ের কালেই নতুন মালিক—কয়লাবাবুর ভাইপো—অধীরবাবু। সে বলল, আপনার বই অদলবদল কত্তে হবে।
এ বইটা লেকার পরে মাতে বাবুতে খুব তক্কো হইছিল। মা বারবার বলিছিল, বিনতা তপনের সঙ্গে পাইলে গেলে ওর চরিত্তিরের কোনো মানেই হয় না। এ তুমি বদলাও।
বাপ রে, বাবুর পজ্যলন্ত রাগ দেখিছি তকনে।
মাকে হাতে মারচে না, কিন্তু ঘরে পাইচারি কচ্চে আর চিবিয়ে চিবিয়ে কতা ছুঁড়ে দিচ্চে, যেন গুলি ছুঁড়চে।
—সুজাতা, মিস্টার বোস—তারা তোমার বচ, ভাল বোজে নাটক। বিনতা ওখেনে পাইলেই যাবে।
—তা বাদে ছ্যাঁচালাতি খেয়ে এসে সোয়ামির পায়ে পড়ে মরবে?
—তবে কি করবে?
—আর সোয়ামি পিয়ানো বাইজে অৎগুলো বচর কাইটে দেবে?
—তুমি নাটক লেকার কি বোজ? পারো তো শুদু কেঁদে হেসে লোক ভোলাতে।
—কিচুই না পাল্যে অরুণ! পাবলিক আমায় তাইড়ে দিত।
—পাবলিক বা কি বোজে! পাবলিক হলো পুতুল! যেমন খেলাবে, তেমনি খেলবে।
—আমি বারবার বলচি, তুমি নাটকের ধারা পালটাও।
—না! আমি আমিই থাকব।
সে টেকটেকানি তো টিকল না। কয়লাবাবুও ব্যবসা কত্ত, অধীরবাবু নতুন ছেলে, সেও ব্যবসা করে।
বাবুকে যকনে বাগ মানাতে পাল্য না, বলল, চন্নন মল্লিকরে দে আমি বই পালটে দেব।
বাবুর তো একটা অ্যাকটিনি জানা ছিল। এমন সব কতা হলেই সে বুকে হাত দে ‘মাতা ঘুচ্যে, শরীল কেমন কচ্যে’ বলে মুচ্ছো যেত। আর মা’র সেকি দাপাদাপি!
অধীরবাবু! এমন তুমি কত্তে পার না! তুমি অরুণ তালুকদারের সঙ্গে কতা কইচ মনে রেকো।
তা বাবদ ডাক্তার রে, নার্সিংহোম রে! এমন কবার করেচে।
কোন রোগ নি শরীরে। সব ভাল মত টেপ করে নাও বাবুরা। এ সগল কতা বিনয়বাবুরে শুইনে জেনে নিও সত্যি, না মিত্যে!
পরের দিকে তো বাবু বাড়ি বসে লিকতেও পাত্ত না! বিনয়বাবুর গাড়ি চেপে এগবার ডায়মনহারবার যেয়ে লিকল। আবার পুরীতে যেত যকন—তকন।
দেক! কোন কতা বলতে কোন কতা বলচি। তা ‘তাসের বিবি’ নাটক খুব, খুব চলিছিল। মায়ের জয়জয়কার যারে বলে। কাগজে কি নাম! আর সিনিমায় নামার জন্যে কি ঝোলাঝুলি মানুষের!
তাবড়, তাবড় মানুষরা এয়েচে। একনে কিচ্চু দেকতে পাচ্চ না। ঘরে ঢুকতে আগেই চোক পড়বে মায়ের ‘করুণা’ পাট্যের ছবি। ঘরের পর ঘর ছিল মায়ের ফটো দ্যালে, আর মায়ের দিদমার আমলের শ্বেতপাথরের টেবিল, বড় বড় ফুলের টব পেতলের! আবার মায়ের কত মেডেল, কত কি পেইছিল, স—ব সাজানো ছিল।
মা ওই চেয়ারটায় বসত।
ওই এট্টা জিনিসই আচে। আর সব?
বাবু বলে, কোনো ভাল জিনিসের কদর বুজত না। বেচে দিয়েচে। আট্যের কিচু বুজত না তো!
মা থাগতে বলেচো, তারে পিষে খেওচো দুজনায়।
বাপ আর ছেলে।
মরে যেতেও বলচো?
বাবুরা! আমি জানিনি আমি হিঁদু না মোচনমান। বাপ ছিল ছোলেমান। গভ্যধারিণী মা ছিল রামলাল ভুজাওলার বোন। বাপ আজ একেনে কাজ কত্ত, চুরি করে পালাত। আবার অন্যত্তর কাজে ঢুকত। ভাল মিস্তিরি ছিল। লেগেপড়ে কাজ করেচে যকনে, ভাল কাইমেচে। কিন্তুক লেগে তো সে থাগত না। তার কাচে কাজ শিকে শংকর দেক, মল্লিকবাজারে নিজের গ্যারেজ করেচে।
আমার কতা দেকানো কেন? বস্তির বাউড়িলি মাসির কাচেই তো থেকেচি। তারা দোকনো তো, আমিও দোকনো। বাপ অবিশ্যি দোকনো ছিল। গভ্যধারিণী মায়ের কতা মনে পড়ে নে তেমন।
তা দেক! হিঁদু না মোচনমান জানিনি। আমায় মা বলত, নতুন জম্মেছিস তুই। তুই হিঁদু, নয় মোচমান নয়, কেরেস্তান নয়, তুই মানুষ!
সেই আমি বলচি, সে ফেলাট কিনল বাবু।
ওই যে ‘অরুণোদয়’, সেতা কিচু দেকবে মায়ের জিনিস।
আর দেকবে ছেলের কাচে।
ছেলে তো বাপের ধারা পেয়েচে। মা কি খায়, কি পরে, কেমন থাকে, কিচু দেকত না। কি সব ঘরবাড়ি কেমন হবে, নকশা আঁকতে শিখিছিল। তা বাদে সেই কাজ করে। আবার ঘরদোর তৈরিও করায়। পেরথম বে’র বউ তো ঘরই করেনি। পরে যেটারে বে কল্য, সে বড়লোকের মেয়ে বটে। তবে মুক দেকলে মনে হবে টিভির ‘মহাভারত’—এর ভীম। হট্টাকট্টা বাজখেঁয়ে মেয়ে।
পিপুল বউ নে আসত, আর বউ একেকটা জিনিস দেকে মুচ্ছো যেত, কি মিষ্টি! দেক দেক, ঠিক যেন অ্যান্টিক।
অ্যান্টিক আবার কি বাবু? আর অতবড় দ্যালঘড়ি, চীনদেশ না কোৎকার ইয়া বড় বড় ছবি—আঁকা ফুলদানি, এসব মিষ্টি বা হয় কি করে?
মা ওটুকুতেই গলে যেত।
—নেবে? নেবে শ্রী? নাও না।
বাগাতেই আসত, বাগিয়ে চলে যেত! মা এগ জাতের মানুষ বটে। যে—সোয়ামি ছেড়ে গেচে, তার অসুক জানলে ছুটে যেয়ে সেবা করবে।
সে জনা ফেলাট কিনল—ছেলেই করিয়ে দিল— সঙ্গে সঙ্গে তার লেকার ঘরের টেবিল, চেয়ার, বইয়ের শেলপো, হেন, তেন, পাট্যে দিলে। বাবু চেয়েচে, আমি না বলতে পারি শেলী?
তা সে সময়ে ‘তাসের বিবি’ নে নানা কীত্তিকাণ্ড হল। অধীরবাবু বলল, ই কি ‘বিরাজ বৌ’ হচ্চে? তার স্বামী আর বিনতার সোয়ামিতে তপাৎ কি? বিরাজ অর বিনতা সবাই সোয়ামীর পায়ের কাচে মরবে, আর আমি পাপী! আমি পাপী বলবে? আমার কাচে এটা ব্যবসা। আমার লাব কিসে আমি দেকব না?
মাকেও মানতে হল।
বাবু খুব শাসাল, দাপাল, তোমারে আমি তৈরি করিচি। কে পুচত তোমাকে? যেমন মানায় তেমন বই লিকিচি?
—তাকনো যা লিকেচ, একনো তা লিকলে পাবলিক নেবে না অরুণ!
—আমার সঙ্গে দুব্যবহার করচে, তোমার ‘অপরূপা’ ছেড়ে দেয়া উচিত।
—কনটাকট করিচি, ছাড়তে পারব না।
আমি রাতে মায়েরে গা ডলতে ডলতে বললাম, মা! সগলেরি এদিন—সিদিন আচে। হটক্কারে কাজ কোর না।
বিনয়বাবু তো মারে বুজিয়ে বুজিয়ে বলল, এ লাইনে আপনার শত্তুর অনেক। এৎকাল রাজত্ব করচেন, পাবলিক টানচেন, শত্তুর অনেক। হটক্কারে করবেন না কিচু। ‘অপরূপা’র সঙ্গে দুব্যবহার কল্যে আপনি বিপদে পড়বেন।
—কেন?
—নিজের ভাল বোজেন না বলে।
শেষে বিনয়বাবুই অধীরবাবু, চন্ননবাবু, বাবু আর মাকে নে বসল। অধীরবাবু হটাৎ পয়সা দেকেনি। ‘অপরূপা’ না থাগলেও তারা জ্যাটার দরুণে বড় বড় বাড়ি পেয়েচে। সব্যত্তর আপিস ভাড়া আচে। সে হটচটকা লোক। কিন্তু বিনয়বাবুও কম যায় না। সেই সব রাজী করাল।
যে ‘তাসের বিবি’র জয়জয়কার হইছিল, তাকে চন্ননবাবু খানিক খানিক নতুন করে লিখিছিল।
নামটাই সব বাবু! আপনাদের দুনিয়াতে। সে বই হয়েও লেকা, যারে কেউ চেনে না। বেরুল বাবুর নামে। মা তকনো বলিছিল, এ বইয়ের টাকার অদ্যেক তো চন্ননের পাওনা হয়।
—না সরসী! তার নাম কোতাও নি।
—না থাগলেও তুমি মনে মনে তো জানো।
—এটাই তো ভুল করচ সরসী। নাম হল সব। নামের ওপরে কিচু নি। যদ্দিন নাম আচে, তদ্দিন তুমি আচ। আর এ তো তেমন, যারে বলে মডান থেটার নয়, যে আজ না হোক, কাল মানুষ কদর করবে, সম্মদ্দনা দেবে, বই লিকবে তাদেরে নে। এ হল পাবলিক থেটার।
—সে জন্যেই ওর নাম তুলে দিচ্চ?
—যা মনে করো। যা করবে বেঁচে থাগতে। সরযূ দেবী আচেন, লোকে নাম কচ্যে। আর সেকালের তাবড়, তাবড় লোকদের নাম কোতায়?
—তুমি অধম্য কচ্য অরুণ।
—দেক! আমার লেকা বই। তাতে অ্যাকটিনি করেই তুমি উটোচো অ্যাত দূর। আমাকে ধম্যঅধম্য শিকিও না।
মা বলল, খুব খারাপ কাজ হয়ে গেল।
আর ছেলে? সে তো ইংরিজি বিনে কতা কয় নে। মাকে কৎ উপদেশ না দিত! মা একজন অ্যাকটেস মাত্তরে, আর বাপ একজন জিনিস…কি বলচো বাবু? জিনিস নয়, জিনিয়াস? যে যা বলো, আমি তারে জিনিসই বলি। এমন আমি চিরকাল বলিচি। জিবের আড় ভাঙেনি ককনো। আর আমার যিনি সব্যস্য, সেই মা বলত, মুকের বুলি ছাড়বিনি শেলী! আমার কানে মিষ্টি লাগে। কেন! চন্ননবাবুর ত্যাখনকার বউ গো? সব আপিসে অ্যাকটিন কত্ত …আমার সঙ্গে কতা বলে বলে শিকিছিল ‘দরিয়ার ডাক’ নাটকে ফতেমার কতাবত্তা।
তা ছেলে সব্যদা বাপের দিকে। বাপের মতই নাক তুলে তুলে কতা কইত মায়ের সঙ্গে। মায়ের সঙ্গে মা নাকি জাস একজন অ্যাকটেস…অমন অত এয়েচে, কত আসবে, কত যাবে। কিন্তুক বাপ একজন জিনিস। থেটারের বই লেকা কম কতা নয়। বাপ লেকে বলেই মা অ্যাকটো কত্তে পারে।
বোজো কতা! মা যদি কিচু না হবে তো তারে টাকা দিচ্চে কেন মানুষ? কেন নামডাক তার? অ্যাকটো করা কি চাট্টিখানি কতা?
যা হোগ গে, মা অনেক দিয়েচে পিপুলদেরে…আর এগ সময়ে বেচেচে এও সত্যি। মা চলে গেচে, জানে না, বিনয়বাবু বলিছিল তোমারে দে বেচাবে। তুমি কিন্তুক জীবন থাগতে মারে বলো নি যে আমারে দেচো ওসব সামিগগিরি।
মা বুকে থাগলেও কিচু বলেনি। এ সব বিনয়বাবুর কাচে জেনে নেবেন। শুনিচি তিনি এ সব নে কোতা যেমন রাকবে!
বাবু! আমারে মায়ের কতা শুদোলে আমি অমন ধারাই হয়ে পড়ে। কত বচরের কত কতা!
কি বলচো? মারে ছেড়ে কেন মালিনী মিত্রের কাচে গেলাম?
তকনে ‘তাসের বিবি’ নে ফাটাফাটি হাউসফুল। সামাজিক বইয়ের মত কি আচে বলুন? যকনে বিনতা চিৎকার করে বলচে, ভেবোচো আমি তাসের বিবি? কাগজে পিন্টো করা ছবি? ছিঁড়বে, নয় ফেলে রাকবে, এট্টা নতুন কিনে নেবে? আমি মানুষ! আমার … দেহ আচে…মন আচে…
মানুষে কম হাততালি দিত? ওই যে মা পাবলিক পানে চেয়ে হঠাৎ ভীতু হেসে গলা নাম্যে বলত, নেই?
বেটাছেলে কেঁদে ফেলত।
যকনে ‘তাসের বিবি’ নে ফাটাফাটি চলচে দুজনে, মা এসে ওই ঘরে শুত। খাট আচে, বিচনা আচে, মানুষ নি!
তা খুব বুজি যে সে মানুষ রাতে ঘুমোয় নে। সকালা উটে আবার বাবু আর ছেলের মুকের মত বাঁদাবাড়ার যোগাড় দেকবে। সোমসার দেকবে— তাতে আমি দোষের মদ্যে বলিচি, তুমি তো দশবার খবর নাও। থেটারে গেলেও ফোন করো। কাদের জন্যে করচো বলতে পার?
—হঠাৎ এ কতা বললি?
—বাবু আর পিপুল তো আদ্যেক দিন খাবার ঠেলে দে বেইরে যায়।
—গেলে যায়, তোর কি?
—না, আমার আবার কি?
—ওই ‘তাসের বিবি’ নে বাবুর রাগ হয়েচে, জানলি? চিরকাল তো অভিমানী। নুন থে’ চুন খসলেই বাবুর অভিমান।
—খেটেট মরচো তো তুমি। মান—অভিমান তোমার থাগতে নেই। এই যে অধীরবাবু তোমার সম্মানে অৎবড় আয়োজনটা কল্যা, সেতা তোমারে যেতে দিল বাবু? কি, না অসুক!
—করিছিল তো অসুক!
—অসুক কল্যে পরদিন সকালা বেইরে যেয়ে কোতা দিন কাইটে আসত? এই যে সাদাসাদি কল্যে, এগবারটি যেয়ে চলে আসব, ‘হ্যাঁ’ বলো! বলিছিল?
মা চুপ।
—নিজের সব্যনাশ কোর না মা।
পরদিন বাবুকে মা কিচু বলে থাগবে। মা বেইরে গেল রিয়াসসালে, বাবু আর ছেলে আমারে যা মুক কল্য কি বলব! ড্যাং, ইস্টুপিড…বদমাশ মেয়েছেলে…লাই পেয়ে মাতায় উটেচে…লাত মেরে বের করে দেব…বাবু আবার চেকন চেকন হেসে বলচে, ও হল তোর মায়ের যুগ্যি মায়ের মত বন্দু! ওর সঙ্গে যত কতা। যা, বাক্স—বিচনা নে বেইরে যা!
আমি কি বললাম?
বললাম, যে এনেচে সে বের করে দিক, তবে যাব। তোমার ভরসায় তো আসিনি। লাত মারবে? মারো দেকি কেমন হেম্মত? চেঁচিয়ে নানাখানা করব বাবু। লোক জড়ো করে ফেলব। ছি ছি ছি! মা পায়ের পাপোশ হয়ে পড়ে আচে, তার এত হেনস্তা করচো, ধম্যে সইবে?
রান্নার মাসি এসে আমারে সইরে নে গেল। কিন্তুক ওপরঅলা নি গো বাবুরা! মা মল্য শ্যালকুকুরের মত! আর বাবুর দেক কত নাম।
তা মা এসতেই বাবু নানাখানা করে লাগল। আমি কিচু বলিনি। শুদু বলিচি, তুমি এনোচো, জান দে, তোমার সব্যস্য সামলাচ্ছি—এৎকাল থাগলে একটা কুকুরকেও ‘বেরো’ বলে না মানুষ। তোমার সোয়ামি আর ছেলে তো লাত মেরে বের করে দিচ্ছিল।
বাবু বলল, ও থাগলে আমি মারে বললাম, বাবুরে না দেকলে, ছেলেরে না দেখলে তুমি মরে যাবে মা! আমি চলেই যাই।
মা বলল, তাই যাস।
মা যকনে এ কতা বলল, বড় যন্তন্নায় বলিছিল। কিন্তু আমারও দুজ্যয় দুখ্যু হল বাবু। বাবু তো মতলবী। মায়েরে আগলে রাকি, তাতেই তাড়াতে চাইচে। তকনে তইলে ভাবিনি। পরদিনেই মালিনী মাসির হোতা চলে গেলাম।
সব আমার দুজ্যয় গো বাবু। মাকে দুজ্যয় ভালবাসতাম— রাগ উঠলেও দুজ্যয়—জলে যাচ্চি, না আগুনে, তো ভাবতাম না।
মালিনী মাসি তো হাতে চাঁদ পেল। বলল, বুজিচি তোমাদের মা—মেয়েতে কিচু হয়েচে। তবে তুই থাগলে তো আমি বত্তে যাই।
মালিনী মাসির মা, ভাই, ভাই—বউ, সব এগ জায়গায়। অনেক লোক, চাট্টে কুকুর, মটর গাড়ি—ওই যে ‘রঞ্জনা’ আর ‘নর্মদা’ সিনিমা হাউস যানার, সেই জেটমলবাবু ওনারে রেকিছিল। বাড়ির দোতলায় মাসি থাকত, এগতলায় এরা। মালিনী মাসির বুদ্দি ছিল। ব্যাঙ্কে টাকা, গায়ে গয়না, এই বাড়ি, মটর গাড়ি, সব করে নিইছিল। বলত, সময় থাগতে গুচিয়ে না নিলে বিন্দুবাসিনী হয়ে যাব শেলী!
বিন্দুবাসিনীর নাম খুব শুনিচি। এগকালে সে থেটারের মহারানী! চার ঘোড়ার গাড়ি গোলাপ ফুলে সাইজে তারে নে বেড়াত কোৎকার জমিদার। আবার শেষ জীবনে সেই লোগই নাকি বাবুঘাটে বসে ভিখ মাঙত।
তা সেতা ধরো ছ’মাসও থাগিনি।
বিনয়বাবু সেতা গেল। বলল, খুব অন্যায় করোচো শেলী। তুমি বিনা বউদির আপনজন নেই হোতা। তারে কিসের মুকে ফেলে এসোচো জান না?
—মা আমারে তো যেতে বলেনি।
—তিনি তোমার জন্যে শুষচে, আবার বলে, বিনয়। মালিনীর কৎ উপকার হচ্চে। ওরে নে আসাটা ধম্য হয়? তোমার তরে কেঁদে কেঁদে বউদি…তুমি চলো।
—আর হেতা?
—হেতা এরা লোক দেকে নেবে। আর…গেলেই জানবে… হোতা এট্টা বিপদ আসচে।
—কি বিপদ বাবু?
—গেলেই জানবে। বউদির জীবনটা…
—কি বলচো বাবু?
—আমার বলায় কতা নয়।
তদ্দিনে আমি অনেক বুজি। মালিনী মাসির হোতা না এলে সব বুজতাম না। মালিনী মাসি তো মা, ভাইকে অকর্তব্য করেনি। ভাইয়ের চাগরি করে দিল আর বলল, দেকে—শুনে নাও একটা ছোটমোট বাড়ি, যেমন সাত—আট হাজারে হয়। সেতা চলে যাও। আমারে ভাইঙে অনেকদিন খাচ্চ, এবারে নিজেদের মত থাকো গে। টাকা—পয়সা, এ বাড়ির ভাগ, কিচু পাচ্চ না তোমরা।
আমারে বলত, দিন থাকতে দিন গুচিয়ে নিতে হয়। তোর মা তো তা বুজবে না। সে থেটার কচ্যে ঠিকই। তবে বনেদী বংশের মেয়ে, শিক্কা অন্যরকম, সোয়ামিকে পুজো কত্তেই শিকেচে। ওনার বাপ জমিদারি ধ্বংস কল্য, ওনার মা চিরকাল সেই সোয়ামির পাদ্যোক খেয়েচে। আর! অরুণবাবুকে যা ভালবাসে, যেন সীতা—সতী—সাবিত্রীর মতো। ও এক আশ্চাজ্য মেয়েছেলে!
বলত, আমারও তো বে হবে এগদিন, সোমসার হবে। নয়তো থাগব কোতা? কারে নে?
ঠিক বলত। জেটমলবাবুর বড় বড় ছেলেমেয়ে, ভরাভর্তি সোমসার।
তেনার দু ছেলে দু মেয়ের এক সাতে বে হয়। খুব ধুমধাম, খুব পাট্টি হল হেতাহোতা। কিন্তুক মালিনী মাসি তা বাদেই বলল, একনে এট্টা থেটারের মেয়েছেলে নে থাকা তোমার সাজে না বাবু। সম্মান বলে এট্টা কতা আচে সমাজে। না, আমি আর বাবু করব না। বে করব।
এসব পরে হয়েচে, শুনিছিলাম মাত্তর।
মালিনী মাসি দেক, কারে বে করল! ওর যে লোক বাবুকে জুট্যে দিছিল, সেই নিখিলবাবুকে। নিখিলবাবুর বউ মরিছিল আগে, তার তিনটে মেয়েকে শুদ্দু নে এল। নিজের হয়নি বটে, কিন্তু তাদেরে পইড়ে শুইনে মানুষ করল, বে দিল। এখন সোয়ামি নেই, নাতি—নাতিনে ভরা সোমসার এখনো সিনিমায় মাসি, শাউড়ি, হেন—তেন পাট করে। যে বাড়ি দেখিছিলাম তা বেচে ফেলাট কিনেচে, গাড়ি রেকেচে— সে গাড়ি ভাড়াও খাটায়, নিজেও চাপে। ওই যে গো! মা যেতে শোঁসানে যেয়ে যে আমার হাত ধরে কাঁদছিল, সেই। বলল, সরসীদিদি তো বাঁচতে পারত না শেলী। অমন উচ্চণ্ড ভালবাসলে মানুষ খাক হয়ে যায়।
তা, বিনয়বাবুর কতা শুনে আমি চলে এলাম।
খাটে মা বসে আচে, যেন অশোক বনে সীতে। চুল এলো, মুক পাতর—পাতর।
আমি রান্নামাসিকে বলি, সব কোতা?
মাসি ফিসফিস করে বলল, ছেলে তো কি পড়তে দিল্লি গেচে। বাপ তার লেকার ঘরে।
মা আমারে দেকে মা শুদু বলল, থাগতে এলি, না দেকতে?
—থাগতে।
—ভাল। আর যসিনি যেন। জানিনি, হয়তো তুই আর আমিই থাগব। তাই মনে হচ্চে।
আমি কতা কইনি। কিচু বাদে বললাম, রিয়াসসাল আচে?
—আচে।
—যাবে তো তিনটেয়। একনে শোও খানিক।
—যাসনি শেলী।
—আর যাব না। কারো কতায় যাব না।
মাজে কত কি হয়েচে, সে কি আমি জানি? মালিনী মাসি জানলেও আমাকে বলেনি।
আপনারা বলচো বাবু থেটারের বই লিকলে যেমন, যাত্তারার পালা লিকতে তেমন।
সত্যিই তাই।
বাবুর যাত্তারার পালা লেকা থেকে দেক, কি হইরই কাণ্ড ঘটে গেল।
কত মানসম্মান, গরমেন বা কত খাতির করে। খুব হয়েচে সব।
আর সেদিনে?
‘তাসের বিবি’ চলচে, চলচে—বাবু কি বই লিকে বসল বলো তো?
‘গৃহত্যাগিনী।’
হ্যাঁগো হ্যাঁ, সেটাই পরে যাত্তা পালা হয়। যে পালায় নায়ক আর নায়িকা হইছিল বরুণকুমার আর শকুন্তলা। যে পালা নাকি পেরথোম সাম্যাজিক পালা!
মাকে মোটে পড়ে শোনায়নি বাবু। ‘তাসের বিবি’ যেমন চলতে থাকল, বাবুর ম্যাজাকও চড়বড়িয়ে উটতে থাগল। এট্টা কতা বলব, অভিনয় উনি মঞ্চে কমই করেচে, কিন্তুক ঘরে?
মাকে ছোবল মেরে চলেচে, মেরে চলেচে।
কিন্তুক বিনয়বাবু বা কেউ আসুক তো? মুকে মধু মেকে ডাককে সরসী। সরসী!
লোকদের বলবে, বলেন কেন! কতায় কতায় অভিমান! ধানবাদে ডেকেচে সম্মান করে—কত টাকা পাবে—আমি শরীলের জন্যে যেতে পাচ্চি না বলে সেও যাবে না!
সেই লোকই আমাদেরে চোক পাকিয়ে বলবে, মাইনে নে কাজ করো, ভুলে যেও না।
আবার যে ছোঁড়াটাকে মা রেখেছে বাবুকে ডলামলাই করবে বলে—তাকে কেমন নিশ্বাস টেনে টেনে বলবে, সিগারেট এনে দিবি বাবা? এ কাজটা করে দিবি? ও কাজটা করে দিবি? এ বাড়িতে তুই ছাড়া কারে বলব বল?
অ্যাকটিনি করেই চাইলে গেল।
তকনে ‘গৃহত্যাগিনী’ বই নিয়ে তো অধীরবাবুকে শোনাতে গেচে বাবু। অধীরবাবু, আর কে কে ছিল জানিনি।
অধীরবাবু নাকি বলেচে, অরুণবাবু! জ্যাটা আপনাকে খুব মান্য করেচে। আপনার লেকা পাবলিক জবর নিয়েচে, মানচি। কিন্তু আপনার এই বই…ম্যাডাম শুনেছিলেন?
মা তো শোনেনি। মা শত বললেও বাবু শোনায়নি। মা’র আবার মিথ্যে জবাব মুকে আসত না।
মা মাতা নেড়ে বলচে, ‘না’।
তকনে অধীরবাবু বলেচে, ‘তাসের বিবি’ নে যতষ্টো হয়েচে, আমি অশান্তি চাই না। কিন্তু এটা কোনো থেটারের বই হয়নি।
বাবু সব্যদা বলত, মানুষ পয়সায় বাঁচে না, মান নিয়ে বাঁচে।
তা মানীর তো মানে লেগে গেল।
তা বাদে খণ্ড পেলয় যারে বলে।
শেষে অধীরবাবু বলল, পেয়েচেন কি আপনি? সব্যদা দেকাবেন মেয়েরা হয় লাতি খাচ্চে, নয় পাপ কচ্যে, নয় সোমসার ভাঙচে, আর শেষেমেশে এসে বেটাছেলের কাচে হার মানচে। আজকাল এসব নেবে কেন এ যুগের পাবলিক? দূর্বা ব্যানার্জি প্রথম মেয়ে পাইলট, আরতি সাহা সাঁতরে চ্যানেল পেরুল—একনে সমাজ পালটাচ্চে, জানলেন? মেয়েদেরে অমনভাবে সদাসব্যদা দেকালে চলবে?
বাবু বলে, আলবাৎ চলবে।
অধীরবাবু বলল, যাত্তারা আলদা, থেটার আলদা। আপনি যাত্তারার পালা লিকেচেন।
—বটে! তবে নিয়ে চললাম বই… সরসী! উটে এসো। তুমি একেনে অ্যাকটো করবে না।
অধীরবাবু বলল, ওনার সঙ্গে রীতিমতো নতুন কনটাকট হয়েচে না? একনো অনেক বচর হেতা থাগতে হবে। আপনার সাতে কনটাকট নি, আপনি যেতে পারেন।
মা বলল, নতুন করে লিকলেই তো হয়।
অধীরবাবু বলল, দরকার হবে নে। যে লেকে লিকুক…অরুণ তালুকদার আর নয়। ই কি দুব্বাসা লোক রে বাবা! ইনভেস আমার…লস—পফিট আমার…
হেসো না বাবুরা। এমন ইংরিজি শুনে শুনে বুজতে পারি, বলতে পারি—লস—পফিট ডাং—আনকালচার—টাজিডি—ব্যাড ক্যারেকটার—মানি ইয়েস—কালচার নো—বিচ—হাউসফুল—এমন বুকনি ছোটবেলা থে শুনতে…
তা অধীরবাবুকে বাবু বলল, রইল আপনার ম্যাডাম!
বলে বেইরে গেল।
বলিনি বুজি? তদ্দিনে মারের গাড়ি হয়েচে। বিনয়বাবুই দেখেমেলে সেকেনে হ্যান ফিয়েট গাড়ি কিনে দেয়। শোভারাম চালাত। বাবু গাড়ি নিয়ে বেইরে গেল।
মা নাকি ছাইবন্ন মুক করে বসেছিল।
অধীরবাবু খুব মাপ চাইল।
মা বলল, আপনি অন্যায় কিছু বলেননি।
—আপনি এগবার শুনলেন না?
—না অধীরবাবু। নতুন নাটক পেয়েচেন?
—চন্ননবাবু দিয়েচে।
—আমরা কাল শুনব, তবে? বিনয়! আমায় পৌঁচে দেবে ভাই?
—চলুন বউদি।
মা এট্টু হেসে বলল, আজ ইংরিজি মাসের এক তারিক, তাই নয়?
—তাই তো!
—জানতাম, তাই হবে।
বেইরে এসে মা বলিছিল, কোন কতা শুদোবে না বিনয়। আমাকে এট্টু গঙ্গার ধারে নে চল। আমি এট্টু চুপ করে থাগতে চাই।
পরদিন সকালাই বিনয়বাবু এসে আমারে নে গেল।
চন্ননবাবুর সে নাটক ‘জীবন পিপাসা’। তা বাদে ‘কালরাত্রি’। তা বাদে ‘অশান্ত ঘুন্নি’! এট্টার পর এট্টা, এসব জানতে পারবেন চাঁদুবাবুদের কাচে।
ইদিকে বাবুও বলল, আমারে যাত্তারার লেখক বলেচে, যাত্তারার পালা লিকেই দেকাব। কিন্তুক এখেনে বসে লেকা হবে নে সরসী। আমাকে অন্য ব্যবস্তা কত্তে হবে।
শুদোচ্চ কি ব্যবস্তা কল্য বাবু?
বাবু কেন করবে? তিনি শুদু ওপরতলার মতো বলত, কত্তে হবে, দিতে হবে। এটা চাই, ওটা চাই।
আর সবারে গোলাম মনে কত্ত।
ব্যবস্তা মা—ই কল্য। বিনয়বাবুরে বলল, কাচে পিটে এট্যা ঘর বা দুটো ঘর ভাড়া নাও বিনয়, যাতে খাবার পাটানো যায়।
বাবু তো পাবার কপাল করে এইছিল। কংরেস এগজিবিশান রোডে দিব্যি দুখানা ঘরের ফেলাট…ভাড়া করা ফান্নিচার…ডলাই—মলাই করার ছোঁড়াটারে চাকর রেকে দিল। বলল, তুমি যা চাও, সব করে দিচ্চি অরুণ, শুদু তুমি…
ভেবো না সরসী…পত আমাদের এগ করিছিল, একনে পত দুভাগ হয়ে যাচ্চে… দেক কি হয়!
সে বটে যাত্তারা পালা লেকার র্যালা! এই টিপিন বাটিতে খাবার যাচ্চে… এই পাড়ি হোতা বাঁদা থাকচে…আর যে যাচ্চে, তারেই বাবু নিশ্বাস ফেলে মা যে কত নিমায়া, বাবুর ঋণ ভুলে গেচে…সব শোনাচ্চে।
মানুষ বিশ্বেসও কচ্যে। তোমাদের মুক দেকে খুব বুঝতে পাচ্চি, তোমরাও তাই বিশ্বাস করো। কত্তে পারো। বড় ঘরের মেয়ে… তার থেটার কত্ত…তার চরিত্তির কি ঠিক থাকে? তাই ভেবোচো।
ভাবো! মাকে তো আর কষ্ট দিতে পারবে না কেউ। সোয়ামির জন্যে এমন হা—পিত্যেশে জীবনটা জ্বাইলে দেওয়া…সতীসাবিত্তি এলেও পাত্ত না। আমার বুক একনো জ্বলচে গো বাবুরা…কার জন্যে সব ছাড়লে…জ্বলে জ্বলে মল্যে…সোয়ামি? ছেলে? কে দেকল?
তা বাদে…সব ওনারা বলবে…বাবুর যাত্তারা পালা তো লেগে গেল। মা তো আনন্দে বাঁচে নে। খুব ধুমোধামে বিবাহবাষ্যিকী কল্য। বাড়িতে খাওনদাওন, সবাই আসচে। পিপুল সে সময়েই মস্ত চাগরি পেল…তারও বে হল। ঝপ করে পেরেম…ধপ করে বে… সে মেয়ে না মেমসাহেব কে বলবে? ফসফস করে সিগারেট টানচে, হসহস করে ধোঁ ছাড়চে, বড়লোক বাপের পেল্লাদী মেয়ে… বাবু তো বলচে ‘হায় হায়’! মা বলচে, ওদের জীবন ওরা বুজুক না। আমি আর তুমি, আমাদের মত থাগি।
না, পিপুলের বে ভাঙা, আবার বে, সে পজ্যন্ত বাবু হেতা থাকেনি।
কি করে যে কি হল! মা বলল, দেক শেলী! আমার নামডাক বাড়চে, পয়সা আসচে, তাতেই তো ওনার যত গোঁসা হইছিল? একনে ওনার নামডাক হয়েচে, পয়সাও আসচে, একনে ওনার মাতা ঠিক হবে। আমার তো ঠিকুজি কইরেছিল মা… ওর এসবে বিশ্বাস নি…আমিও রাকিনি…তবে মা বলত, দুক্যের পরে সুক হবে…অনেক সুক…
অনে—ক সুকই হল।
পাঁচ বচরের কনটাকট শেষ হবো হবো। বাবুকে ঘিরে তকনে অনেক লোগ। যুদ্দ, বিলপব, সামাজিক, মদের নেশা সব্যনাশা, কি নিয়ে পালা লিকচে না? সে সব পালা নামাচ্চে বড় বড় কোম্পানি। থেটার কেন, সিনিমার লোগেরাও তাতে নামচে।
আর মা তো দশ মুকে লোককে বলে যাচ্চে। থেটার কৎজনা দেকে? যাত্তারা হল দেশের জিনিস…মাটির জিনিস…হাজার মানুষ দেকে…মানুষ শিক্কা পায়…যাত্তরার পালা লিকতে পারে কৎজনা? লিকতে যদি বা পারে, গান লিকতে পারে সেই সাতে?
মা খুশি তো আমরাও খুশি।
এমন কালেই চন্ননবাবুর ‘তাসের বিবি’ গল্প বোম্বাইয়ে ছবির জন্যে বিক্রি হল। চন্ননবাবুর সঙ্গেই হেতা এল ভদ্দরলোক। খুব কটমটে নামটা… সেই যে, গো কি জানি চৌধুরী…বাঙালি বটে…তিনি বলল, ম্যাডাম, বিনতার মা গোপার রোলে আর কাউকে ভাবতে পাচ্যি না।
মা তো হেসে বাঁচে না। বলে, শোনো বিনয়! বাংলা ছবিতেই নামলাম না, একন হিন্দী ছবি করব…
—বাংলা ছবিতে ডাক তো ‘নিরুদ্দেশ’ থেকেই পেয়েচেন বউদি…
—সে থাগ গে! জান তো সবই…
এ ভদ্দরলোক… হ্যাঁ হ্যাঁ, মনোজ চৌধুরী নাম বটে…হ্যাঁ। তিনিই। ফ্যামিলি সিনেমা কত্তেন, যেমন ছবি সবাই বসে দেকতে পারে…তিনি বলল। এ ছবি তো বাংলা আর হিন্দি এক সাতে হবে, করবেন?
মা বলল, এট্টু ভেবে দেকি।
ব্যস! অমনি যা কুলুখেত্তর বাঁদল সে কি বলি! সব আমি বলতেও পারচি না বাবু! বড্ড কষ্ট হচ্চে আমার। সব্যদিকে সব্যনাশ ধেয়ে এল। পিপুলের বউ তো ঘরই করত না, সে নামে যশে ছেড়ে গেল।
আর বাবুর সে কি পেলয় মুত্তি!
যাও! তুমিও যাও! কোন পরিচয়টা গব্যের মেয়েমানুষের? না, সে একজনের বউ, এক জনের মা! তুমি যে দেখচি শনি হয়ে ঢুকোচো, রাহু হয়ে বেরোচ্চ! থেটার আমি আনলাম! শেষে হলাম অমুকের সোয়ামি। থেটার ছেড়ে যাত্তারায় উঠচি বোঁ বোঁ করে…একনে তুমি সিনিমা করবে! তাও বাংলা আর হিন্দিতে! জানি না ভেবেচো? কতকগুলো লোকে খেলাচ্চে, আর তুমি খেলচো। যেতে পারো! থেটার—সিনিমা—কলকাতা—বোম্বে কত্তে পারো। কিন্তু আমি তোমায় তালাক দেবো। ওই হল বাবু, তালাক নয়, ডিভোস বলিছিল।
অবাক হচ্চ? বিশ্বাস হচ্চে নে?
কেন? বাড়িতে তো সেদিনে অনেক লোক ছিল।
বিনয়বাবু…চাঁদুবাবু…অরুবাবু…দত্তবাবু…এনাদের পুরনো বন্দুবান্দব যত।
জিগ্যেস করো…?
পিপুলও বলিছিল, বাবাকে তোমার জন্যে দুঃখ পেতেই দেকিচি মা! কৎটুকু কাচে পেইচি তোমাকে? বাবাই তো…
মা বলল, এ কতা আমাতে—বাবাতে হবে পিপুল!
কি টানাটানি না চলল। টানা একমাস!
চলতে, চলতে, চলতে, চলতে বাবু সত্যিই …বাড়ি ছেড়ে…চলে গেল!
আর মা মাটিতে আচড়ে পড়ে অজ্ঞান… বেহুঁশ …চোকের মণি নড়ে নে…
আমি হাহাকার কত্তে কত্তে দৌড়লাম বিনয়বাবুর বাড়ি।
ওনার কাচে দৌড়নো অব্যেস বাবু! দোরগোড়ে ডাক্তার…বাড়িতে টেলিফোন…
কি বলছ? বাড়ি আমার দে গেচে মা?
না, বাবু! তোমরা ভাবচো সম্পত্তির নোবে বাবুর কুচ্ছো গাইচি?
না, বাড়ি দেয়নি।
তবে জমি বেচার পরে বিনয়বাবুকে বলল, পরে তো ওরাই নেবে সব। এদেরকে কিচু দেবে না বিনয়। তুমি আমায় ‘না’ বোল না। আমি কত্যব্য করে যাই।
রান্নামাসির ছেলেরে, সেই বাসিনী মাসি গো…তার ছেলেরে মা কবে সরকারি চাগরি করে দিই ছিল। মাসি, ডাইভার, কারেও তো রাকতে পারেনি। মাসি ছেলের কাচেই চলে যায়। তারে ডাইকে এনে পাঁচ হাজার টাকা দিল। মাসি কাঁদচে তো মা বলচে, কেঁদো না তো! অমন কান্না আমি অনেক কেঁদিচি। এওচো…বাজার করো… রেঁদে—বেড়ে খাইয়ে যাও।
ডাইভারকে খোঁজ করে পায়নি। সে কোতা, কবে চাগরি নে গেচে, কে জানে!
আমার জন্যে, আমার নামে বিশ হাজার টাকা দে গেচে, ব্যাঙ্কে আচে।
টাকা দে কি করব?
বিনয়বাবুর মা শয্যেগত হয়ে আচে, সেতা যাবার কতাই আচে।
তবে জানি না কি করব! এ বাড়ির দায় মা দে গেচে, বাবু এলে চাবি তারে দে যাস শেলী।
খালি বাড়িতে ভয় করে কিনা?
না, বাবু, ভয় করে নে। বস্তি ভেঙে দিয়েচে না? যেতা বাপ থাগত! তারা ক’ঘর তো মা থাগতেই নিচে এসে উটিচিল। তাদেরও বলিচি, বাবু এলেই তোমাদের তাইড়ে দেবে।
ঠিক জেনো, বাবু আসবে ইংরিজি মাসের পয়লা তারিকে।
ইংরিজি মাসের পয়লা তারিকের কতা বারবার কেন বলচি?
বিনয়বাবু বলবে।