৫
—’বিপাশা, কি ব্যাপার? তুমি যে রাত্রির দৃশ্য দেখতে দেখতে ধ্যানস্থ হয়ে গেলে? কীই—বা আছে দেখবার এখানে?’—এগিয়ে এসে দেনিশ ওর পাশে দাঁড়ায়, রেলিঙে দুটো অস্থিধবল হাত রাখে। বিপাশার খেয়াল হয়—বারান্দার রেলিঙে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে সে, মস্ত থামটার ছায়ায়—সামনে ম্লান বিদ্যুতের আলোয় একটা ঝাঁকড়া গাছের মাথা ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে ভিজছে। বাতাসে তার চুল উড়ে মুখময় হয়েছে।
—’ওদিক য়োহানের পার্টি অর্ধেক গড়িয়ে গেল—’
—’মোটেই না।’ এভিচকা বলে ওঠে—’য়োহান এতক্ষণে দরজার তালা খুলে আলো জ্বেলেছে মাত্র।’ ওরা এগিয়ে যায়।
য়োহানের বৈঠকখানা ঘরে চমৎকার হলুদ আর গাঢ়নীল সোফা কোচ, ভেলভেট মোড়া—পুরোনো ফ্যাশনের। বসলেই অনেকখানি দেবে যায় স্প্রিং। চারদিকে পুরোনো ধরনের মেহগনির আসবাবপত্র। ভারী গোল টেবিল, ভারী তাকে বই—ঘরের কোণে রাখা মোটা কাচের তৈরি টবে সবুজ লতাপাতা বেড়ে উঠছে। পায়ের নিচে দামী গালচে পাতা।
বিপাশা মাঝের খোলা দরজা দিয়ে দেখল পাশের ঘরেও আলো জ্বলছে—য়োহান সেই ঘরে। সেটা স্পষ্টতই অফিস ঘর। সেক্রেটারিয়েট টেবিল আর বইয়ের তাকগুলো দেখা যাচ্ছে—ওঘরে সব আখরোট—পালিশ মডার্ন আসবাবপত্র। য়োহান একটা ক্যাবিনেট খুলছে। একটু পরেই একরাশ চমৎকার কাটগ্লাসের গেলাসের ঠুংঠাং বাজনা বেজে উঠলো এ ঘরের টেবিলে। নামান মাপের নানা গড়নের বোতলও হাজির করলো য়োহান। এক মিনিট বিপাশা ভাবলো—এটা যে—কোনো বুর্জোয়া মদের পার্টির চেয়ে আলাদা কি? দূরছাই, এই বোকা—বোকা তুলনাগুলো কেন যে আসে!
ভারতবর্ষের হিন্দু—মুসলিম সমাজব্যবস্থার সঙ্গে তো পাশ্চাত্যের ক্রিশ্চান সামাজিক লৌকিকতার তুলনা চলবে না। তাছাড়া অতিথি—সৎকারের কানুন সর্বত্রই বিশেষ। বিপাশা নিজেকে খেয়াল করিয়ে দেয় অকারণ প্রেজুডিস থেকেই এসব ভাবছে সে। কেন, পিকিংয়ে যখন বিদেশী অতিথিরা যান, তখন কি বিপুল ব্যাংকোয়েট দেওয়া হয় না? এমন কি নিক্সনের বেলাতেও?
গেলাসগুলো ভরতে শুরু করেছে য়োহান এবং দেনিশ, গেয়র্গ চুপচাপ বইয়ের তাকের কাছে দাঁড়িয়ে এটার—ওটার পাতা ওলটাচ্ছে, বেচকা আর এভিচকা বাথরুমে গেছে, বিপাশাকেও ডেকেছিল, সে যায়নি। এভিচকাকে একটু ঘন ঘন বাথরুমে যেতে হয়। আর বেচকাকে ঘন ঘন ঠোঁটের রং পুনর্লেপ করতে হয়।
বিপাশা রং মাখে না। তারও ইচ্ছে বই উল্টে দেখা—কিন্তু বই তো সব চেক কিংবা স্লোভাক ভাষায় লেখা। উল্টে কী হবে? তা ছাড়া গেয়র্গের কাছে যেতেও ওর রুচি নেই। গেয়র্গের পুরো ব্যক্তিত্বের মধ্যেই একটা প্রচ্ছন্ন নারী—বিরাগ ভিতরে ভিতরে বিপাশাকে অপমান করছে। বিপাশা চুপ করে বসে দেনিশ আর য়োহানের মদ ঢালার কারুকর্ম দেখছে।
—’বরফ নেই?’
য়োহান বলে—’এত রাত্রে বরফ কোথায় পাব বল?’
—’কেন, এখানে কোনো আইস—মেশিন নেই? কিংবা রেফ্রিজারেটর?’
—রেফ্রিজারেটর? আইস—মেশিন?’ হা—হা অট্টহেসে উঠল য়োহান।
দেনিশ বলল—’তুমি কি ভেবেছ এটা নিউইয়র্ক? না শিকাগো?’
লজ্জিত হয়ে বিপাশা বলে—’তা কেন, কিন্তু—’
—’ওসব কিন্তু টিন্তু নেই।’ য়োহান বলে,—’ওসব ক্যাপিটালিস্ট কান্ট্রির লাকশারি মাদাম—এখানে যে মদগুলো আছে এই ঢের।’
কথাটার সুরে আদর্শবাদের টংকার শুনতে পেল না বিপাশা, বরং একটা ক্ষোভের নিশ্বাস কি?
৬
এমন সময়ে বিনা টোকাতে ধড়াস করে মস্ত কাঠের কারুকার্য করা দরজাটা খুলে যায়—ঘরে ঢুকে আসে একটি বৃষস্কন্ধ কিন্তু শালপ্রাংশু নয় এমন মূর্তি। এই শীতে তার পরনে শুধু একটা গরম পুলোভার—কোনো কোট নেই। দুই হাতে সে বুকের কাছে জড়ো করে আছে একটি লাল মাটির টব। হাতে দস্তানা নেই। টবে কয়েকটি ঋজু সবুজ পাতার মধ্যে চারটি টুকটুকে লাল টিউলিপের কুঁড়ি।
বিপাশা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। দু’হাতে তো টবটা ধরা, ও দরজার হাতল ঘোরাল কোন উপায়ে?
মূর্তিমান বসন্তের মতো ছেলেটি ঘরে ঢুকেই চেঁচিয়ে ওঠে—’য়ো—হা—ন!’
দরজার রহস্য পরিষ্কার হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। দরজা খুলে ধরেছিল বেচকা এবং এভা। তারাও ঘরে এসে যে যার আসন নেয়।
ছেলেটি ইতিমধ্যে স্থানীয় ভাষায় খুব হট্টগোল জুড়ে দিয়েছে। য়োহানকেও চুপ করিয়ে দিতে পারে এ—ছেলে।
এভা বলে—’মিরকো। মাডুনিচকি মিরকো। খুব নামকরা প্লেরাইট। এখানকার প্রফেশনাল থিয়েটারে ওর নাটক হয়। নানান ধরনের এক্সপেরিমেন্ট করে ও নাটকে, যেমন নাচগান ব্যবহার করে, পুরনো ফোকলোর ব্যবহার করে—’
—’মাডুনিচকি মিরকো।’
বিপাশা চমকে ওঠে। ছেলেটি হাঁটু মুড়ে বসে পড়েছে ওর পায়ের সামনে। দু’হাতে ফুলে ভরা টিউলিপের টব। বসন্তের ফুল টিউলিপ সাধারণত এপ্রিলেই ফোটে। গাছটি তাকেই নিবেদন করা হচ্ছে।
—’….’ অজানা ভাষায় অনেক কিছু বলে যায় মিরকো, চোখ দুটো ঝলমল করে ওঠে কৌতুকে।
‘মিরকো ইংরিজি জানে না, মিরকো বলছে—সে আজ তোমাকে স্প্রিং কুঈন আখ্যা দিচ্ছে, আমাদের মধ্যে তুমিই সবচেয়ে রূপসী—তুমি যদি দয়া করে এই টিউলিপ ফুল গ্রহণ করো, মিরকো কৃতকৃতার্থ হবে—’
বিপাশার মনে হল, যেন তার লজ্জা—পাওয়াটা ঘরসুদ্দু সকলেই বেশ উপভোগ করেছে। বার বার অন্য মেয়েদের সামনে তাকে এভাবে আলাদা করে বেছে নিয়ে রূপসী বলাটা তার মোটে ভাল লাগছিল না।
পশ্চিম ইউরোপে আদবকায়দা আরো সূক্ষ্ম, অনেক বেশি পরিশীলিত—অন্যদের কথা সবাই সর্বদা মনে রাখে।
এভার কিছুই মনে না হতে পারে—তার স্মক—জামার নিচে তার জয়ধ্বজা উড়ছে। কিন্তু বেচকা? সে পরমাসুন্দরী হলেও এখনও তার কোনও প্রণয়ী নেই।
বেচকা বিপাশাকে বলেছে, সে খুচরো প্রণয়ী চায় না,—পতি পরম—গুরু চায়। মনের মতো পাত্র পাচ্ছে না।
দোভাষীর কথা ফুরোবার আগেই বিপাশা মিরকোর হাত থেকে ফুলের টবটা নিয়ে নিয়েছিল। এবার টবটা কোথাও রাখতে হবে। একটা পছন্দসই জায়গা খুঁজতে বিপাশা উঠে দাঁড়ায়।
আর সঙ্গে সঙ্গেই মিরকোর সবিস্ময় শ্বাস টানার শব্দে ঘর সচকিত হয়। মিরকোর দু’হাত সামনে বাড়ানো, কোমর থেকে ঘাড় পর্যন্ত পিছনে হেলানো, মুখ ‘O’ হরফের মতো হাঁ—করা। এই নাটকীয় ভঙ্গিতেই সে কিছু রুদ্ধশ্বাস বাক্য বলে।
ঘরময় সকলের হাসির মধ্যে দেনিশ অনুবাদ করে দেয়—
—’হে বসন্ত—সম্রাজ্ঞী, তুমি উঠে না দাঁড়ালে আমি বুঝতেও পারতুম না তুমি কত বেশি সুন্দর, ঠিক যেন একটি বাসন্তী পরী, যেন একটি সবুজ ঘাস—ফড়িং।’
বলতে বলতেই বিপাশা উপলব্ধি করে, সে শূন্যে পা ছুঁড়ছে। মিরকোর শক্ত রুক্ষ দুটি হাত ফুলের টবের বদলে এখন বিপাশাকেই তুলে নিয়েছে, শূন্যে একপাক ঘরে যাচ্ছে বিপাশা—তার নিজের ইচ্ছে—অনিচ্ছের কোনো দামই নেই এখন।
মিরকো একটা গান গাইছে, খুব মোটা গলাতে—বিপাশা সুর—তালের ধরন থেকেই আন্দাজ করতে পারে—লোকসঙ্গীত হবে কোনো।
হঠাৎ একটা লাইনে ঘরসুদ্ধু সবাই গলা মেলায়।
বিপাশা গানের কথাগুলো কিছুই বোঝে না—দু’হাতে স্ফুটনোন্মুখ টিউলিপের টবটিকে বুকে আঁকড়ে শূন্যে ঝুলে থাকে সে—ঘন বাদামী চুলগুলো চোখের সামনে। হাতে ফুলের টবটা না থাকলে সে চুল টেনে ঠিক ছিঁড়ে দিত বিপাশা। কী দামাল ছেলে রে বাবা! নিজের হালকা পাতলা চেহারাটার ওপরই বিপাশার ভীষণ রাগ হতে থাকে—সঙ্গে সঙ্গে মনে হয়, কোথায় একটা ময়লা পর্দা ঝুলছিল, যেটা ছিঁড়েখুড়ে পরিষ্কার যৌবনের আলো এসে পড়লো ঘরটায়—তিন—চার পাক ঘোরার পরে…মিরকোর গানের কলি শেষ হল, বিপাশাকে নামিয়ে দিয়ে সে তার হাত থেকে ফুলের টবটি নিয়ে টেবিলে রেখে দিল এবং টবমুক্ত দুটি হাতের পাতাতেই দু’টি সশব্দ উষ্ণ চুম্বন রাখলো।
বিপাশার মাথায় ঘূর্ণি লেগেছে। এতটা নাটক তার ধাতে সয় না। সামনের সোফাটায় এলিয়ে পড়ে বিপাশা। মাথা ঘুরছে। সমীর, তুই যা রোগা, তুই কোনোদিনও পারতিস না এরকম দস্যির মতো ঘুরপাক খাওয়াতে আমাকে! পারতিস! সমীর, সমীর—
—’বাব্বাঃ! মিরকো, হচ্ছেটা কি? দেখছো একেই ওইরকম পাখির মতো চেহারা, অমন অত্যাচার করতে হয়?’—য়োহান ধমকে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে এক গ্লাস পানীয় এগিয়ে দেয়।
কী পানীয় জিজ্ঞেস না করেই বিপাশা গ্লাসটা নিতে যাচ্ছিল—কিন্তু তার আগেই মিরকো কেড়ে নেয় গ্লাস এবং তুলে ধরে বিপাশার ঠোঁটের কাছে—সঙ্গে সঙ্গে তার দুর্বোধ্য ভাষায় গদগদকণ্ঠে কোনো কবিতার লাইন আবৃত্তি করে। আবার ঘরসুদ্ধু হেসে ওঠে।
রাগ করেও রেগে উঠতে পারে না বিপাশা। এত বড় প্রকাণ্ড দেহটাতে মিরকোর হাসিমুখখানা বড় বেমানান। ওর ঘাড়টা যেন ঘাড় নয়, গর্দান। দেখলেই বৃষ কি মহিষের কথা মনে পড়ে। অথচ মুখটি ঢলঢল করছে কৈশোরের লাবণ্যে। বছর পঁচিশেকের বেশি কক্ষনো হবে না—বিপাশারই সমবয়সী হবে মিরকো।
ভাবতে না ভাবতে সে চুমুক দিয়ে ফেলেছে গ্লাসে আর গলায় ভেতরটা জ্বলে গেছে কড়া ভদকার আগুনে। মিরকো তাকে নতি জানিয়ে ‘বাও’ করে, সবিনয়ে গ্লাসটি হাত থেকে টেনে নিয়ে নিজে চুমুক দেয়।
এবারে বেচকা, এভা, দেনিশ সক্কলে মিলে ধমক দেয় মিরকোকে। —’ও বেচারীর ড্রিংকটা তুমি কেন খেয়ে নিচ্ছো? তোমার নিজের গ্লাস তো আছে!’
—’নিজেরটা খেলে যত নেশা হবে, এ গ্লাসটায় যে তার চেয়ে ঢের ঢের বেশি—এটা তো বন্ধুত্বের সাক্ষী—’ এক চোখ টিপে মিরকো দুষ্টু হেসে বলে শুদ্ধ ফরাসীতে।
—’বা রে, ফরাসী জানো তুমি? অথচ এতক্ষণ বলেছিলে না!’
বিপাশা আশ্চর্য হয়ে যায়।
—’আরো অনেক ভাষা জানে ও। হাঙ্গেরিয়ান তো আমরা সবাই জানি—এই শ্লোভাকিয়াতে প্রত্যেকেরই হয় মা, নয় দিদিমা, নয় বাবা কেউ না কেউ হাঙ্গারির লোক—তাছাড়া জর্মনটাও সবাই জানি—আর যারা সাহিত্য ভালোবাসে তারা ফরাসীটা শেখেই—’ দেনিশ বলছিল।
বিপাশার হঠাৎ কি মনে পড়ে যায়। দেনিশের কথার মাঝখানে সে বলে ওঠে—’আর রুশভাষা, সেটাও তো সব্বাই জানে। তাই না?’ এবার দেনিশ কেমনতর একটু হাসে।
মিরকো বলে—’রুস্কী? নিয়েৎ! নিয়েৎ!’ তারপর ফরাসীতে—’আমরা কেউ রুশভাষা জানি না। জানি কি? য়োহান? দেনিশ? এভিচকা? গেয়র্গ? জানি কি আমরা রুশভাষা?’
য়োহান হঠাৎ গম্ভীর গলায় কী যেন বলে চেক ভাষাতে মিরকোকে। অমনি দুজনে তর্ক বেধে যায়। জোরালো, সিরিয়াস তর্ক—গেয়র্গও তাতে মুখ খোলে। দেনিশ, এভা, এলিজাবেথ চুপ করে শোনে। এভা বিপাশাকে জানায়—’রাজনীতি নিয়ে তর্ক বেধেছে। মিরকো খোলাখুলি এমন সব কথা বলে, যা ঠিক বলাটা উচিত নয়। য়োহান ওকে সতর্ক করে দিচ্ছে। সেই নিয়েই তর্ক।’
দেনিশ বলে—’সত্যি, য়োহান ঠিকই বলছে। মিরকো বড্ড ছেলেমানুষি করে।’
এলিজাবেথ বলল—’মিরকো তো শিল্পী, ও ঠিক বাস্তব দিকটা টের পায় না, আপন মনে থাকে।’
—’আহাহা।’ এভা আপত্তি করে—’শিল্পী তো গেয়র্গও। তার তো দেখি বাস্তবজ্ঞান অতি টনটনে।’
দেনিশ বলে—’এটা ব্যক্তিগত চরিত্রের ব্যাপার, শিল্পী—অশিল্পীর ব্যাপার নয়। তাছাড়া শিল্পীদের খেয়ালিপনাটা সম্পূর্ণ বানিয়ে তোলা বুর্জোয়া ভণ্ডামি মাত্র। একটা সামাজিক লাইসেন্স নিয়ে নেওয়া আর কি, যা খুশি তাই করবার জন্য। একজন এঞ্জিনিয়র কি একজন কবির চেয়ে কম সৃজনশীল? নাকি সমাজের পক্ষে সে কিছু কম জরুরী? কৈ, তার বেলায় তো কেউ ‘আহা শিল্পীর খেয়াল, বলে সব ত্রুটি মার্জনা করে দেয় না?’
বিপাশার মনে হল সে সমীরের গলা শুনতে পাচ্ছে। ঠিক এই রকম তর্ক হল তাদের—কবি— শিল্পীরা সমাজে বেশি জরুরী, না ডাক্তার—এঞ্জিনিয়ররা? এক থালা ভাত বেশি জরুরী, না এক পাতা কবিতা? ভারতবর্ষের বর্তমান অর্থনৈতিক সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে উত্তরটা খুব স্পষ্ট ছিল তাদের কাছে। কিন্তু গত পাঁচ বছরে সব কিছু গোলমাল হয়ে গিয়েছে বিপাশার।
বাবা যখন জোরজুলুম করে বম্বেতে ধরে নিয়ে গেলেন, জবরদস্তি বিলেতে পাঠিয়ে দিলেন, সমীর তক্ষুনি জেলে গেছে। তারপর থেকেই সব কিছু গোলমাল হয়ে যাচ্ছে বিপাশার। সমীর, তুমি বুঝবে না, তুমি বিশ্বাস করবে না আমি পালিয়ে আসিনি। আমার সেদিন সত্যি কোনো দোষ ছিল না। আমার ক্ষমতা ছিল না। জোরালো বাপের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারিনি। ফলে, তারই ফলে, আজ—দেখে যাও সমীর আমার দেহ, আমার মন, কী রকম খেজুর গাছের কাণ্ডের মতো খুলে খুলে যাচ্ছে। কণ্টকিত, কণ্টকিত, সমীর! সমীর, তুমি কি জানো, বিপাশা এখন কে ও কী? সেই বিপাশা—তোমার বিপাশা? সে লন্ডনে বসে ইংরিজিতে কবিতা লেখে এখন—এর চেয়ে অবক্ষয়ী আর কী বা থাকতে পারে! সমীর, সমীর, তুমি আমাকে ঘেন্না করো—আমি জানি আমি জানি আমি জানি—
৭
—’রুশভাষাটা আসলে আমরা সকলেই জানি।’ এভা বলে—’ওটা আমাদের স্কুলেই শেখায়।’ বলে একটু হাসে।—’যেমন তোমরা সকলেই ইংরিজি জানো। তেমনি আর কি।’
একটা ধাক্কা খেয়ে আবার ঘরটার মধ্যে ফিরে আসে বিপাশা। আবার একটা গ্লাস এগিয়ে দিয়েছে দেনিশ। য়োহান এখনও তর্কে মত্ত। এভার মৃদু বাক্যগুলি খুব স্পষ্ট করে অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিল। মিরকোর—’রুস্কী? নিয়েৎ।’ স্পষ্ট হয়ে গেল। সমাজতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদ ব্যাপারটার ভাসা—ভাসা চেহারাটা হঠাৎ একটি মূর্তি পেল। ভাষা। তাই তো—সাম্রাজ্যবাদীর অন্যতম প্রধান অস্ত্রই তো তাই। ভাষার মাধ্যমে ভিন্ন সংস্কৃতি ভিন্ন চিন্তাধারা চাপিয়ে দেওয়া। মগজ ধোলাই হয়ে কিসে? ও, এবার বুঝছে বিপাশা তর্কটা কেন, তর্ক কিসের।
য়োহান এখানকার স্থানীয় চ্যাপ্টারের ফার্স্ট সেক্রেটারি—তার এ ব্যাপারে অফিসিয়াল দায়িত্ব আছে। এরকম দায়িত্বহীন উক্তিকে বাধা সে দিতেই পারে। তবে য়োহানই এস্টাব্লিশমেন্ট? অথচ ওর পোশাক—পরিচ্ছেদে তো তার চিহ্ন নেই? ঠিক বিপরীত চালেই চলে সে। বাকী সকলের গলায় টাই আছে। মিরকোরই পরনে যা টার্টল নেক পুলোভার—আর য়োহানের তো ভারী কোটটা খোলবার পরে সবুজ শার্টের খোলা কলার, এবং অনেকগুলো খোলা বোতামের ফাঁকে—বুকের সোনালি চুলগুলো কৌতূহলে ঘন হয়ে উঁকি দিচ্ছে বিপাশার দিকে। ব্লু জীনসের নিচেটা ছিন্নভিন্ন, উলিঝুলি কাদামাখা।
ঘরটি বেশ গরম—সেনট্রাল হীটিং আছে নিশ্চয়ই। পুরুষরা প্রত্যেকেই জ্যাকেট খুলে রেখে কেবল শার্ট পরে আছে। দেনিশ তো অনুমতি চাইল টাইটাও খুলে রাখার।
গেয়র্গ আপনমনে পান করে যাচ্ছে। প্রায় নিঃশব্দ এই লোকটিই এখানে বিপাশার জগতের লোক। দ্বিতীয় কবি। ভাবতেই বিশ্রী লাগে বিপাশার। এখানে এসে অবধি তার কাছে এই ইংরিজি ভাষাতে ভারতীয় কবি হওয়ায় ব্যাপারটির মৌলিক এ্যাবসারডিটি যেন খুব প্রকট হয়ে উঠেছে। ওর মনে হচ্ছে—এরা তাকে নিয়ে মনে মনে হাসছে।—”আহা ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদের শিকার—মাতৃভাষা না জেনে অত্যাচারীর ভাষায় নকল শিল্পসৃষ্টি করছে” কথাটা কেউ খুলে বলছে না বটে, কিন্তু প্রত্যেকেই মনে মনে ভাবছে। এই গেয়র্গও।
যদি আমি আজ বাংলায় কবিতা লিখতাম, গেয়র্গ, তাহলে তুমি আমাকে নিশ্চয় এত অবহেলা করতে না। মনে মনে বলল বিপাশা। আসলে তোমরা আমাকে এলেবেলে করে রেখেছ। আমি কোথায় আন্তর্জাতিক লেখক বলে বেশি সম্মান পাব—তোমরা আমার লেখা পড়তে পারছো, বুঝতে পারছো, সেটা কতখানি আনন্দের এবং সৌভাগ্যের কথা—তা নয়, তোমরা ভাবছো আমি সূর্য নই, চাঁদ। আমার নিজের জ্যোতি নেই, ধার—করা জ্যোতি নিয়ে আমি ভাষা—শিল্পী হচ্ছি। তোমরা আমাকে করুণা করছো, বুঝেছি। এইখানে আরেকবার আমার দেশের লোকের সঙ্গে তোমাদের মিল। আরেকবার পাশ্চাত্যের সঙ্গে তোমাদের ফারাক।
ইংরিজিতে লিখি বলেই না আমি আজ ‘লেখক’ হয়ে উঠেছি? আমি কি জানি না আমার চেয়ে ঢের ঢের ভাল কবিতা যারা বাংলায় লিখছে, পশ্চিমে কেউ তাদের নাম জানবে না কোনোদিন? অক্সফোর্ড বুক অব ভার্সে তারা থাকবে না। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ভারতীয় সাহিত্য’ কোর্সে কেউ তাদের মুখ দেখবে না, নাম শুনবে না। কিন্তু আমি থাকব। বিপাশা চৌধুরী, আমি, থাকব।
‘My Vindhya Nods’ লিখেছি বলে আমি থেকে যাব। ‘The Circe-Song’ লিখেছি বলে আমি থেকে যাব। কিন্তু সমীর, জগতের কেউ তোমাকে চিনবে না। কেউ জানবে না তুমি জেলে বসে বসে কী কবিতা লিখলে। কিছু লিখলে কিনা। গেয়র্গ অবশ্য তোমার সঙ্গে কথা বলতো। গেয়র্গকে দেখলেই আমার ঘেন্না করছে।
মিরকোর মুড—মেজাজ সব নষ্ট। সামনে তর্ক করে চলেছে য়োহান। বেচকা হঠাৎ উঠে গিয়ে দুজনের মাঝখানে দাঁড়ায়, কী যেন বলে। য়োহান সচকিত হয়ে ঘড়ি দ্যাখে, বলে, ‘সত্যি, ঠিকই বলেছো।’
মিরকোও হাঁপ ছাড়ে। বলে ওঠে—সুন্দর স্বচ্ছ ফরাসীতে—’আমার ফিয়াসেঁ অপেক্ষা করছে পাহাড়ের চুড়োয়, আমি তাকে আনতে যাব এবার, বার—টা বন্ধ হয়ে যাবার আগেই পৌঁছুতে চাই।’
—’তোমার ফিয়াসেঁ পাহাড়চূড়োয় বারে বসে কী করছে?’
—’আমার পথ চেয়ে কান্নাকাটি করছে। আবার কি করবে?’ মিরকো বলে।—’কিন্তু সে তোমার মতো এত সুন্দরী নয়, তোমাকে দেখলে তার খুবই হিংসে হবে।’
—’দূর!’ য়োহান বলে—’বিপাশাকে সে দেখবেই না তো—কাল ভোরেই ও চলে যাচ্ছে ভিয়েনা।’
—’তার আগে য়াংকার সঙ্গে দেখা হচ্ছে বিপাশার।’ স্থির গলায় মিরকো বলে।
—’আমি বিপাশাকে নিয়ে যাবো এখন পাহাড়ের চূড়োয়। তোমরাও আসতে পারো, একজন কেউ। আমার গাড়িকে তো চেনো। চারজন বসতে পারে খুব অতিরিক্ত ঠেসাঠেসি করলে।’
হাসতে হাসতে য়োহান বলে ওঠে—’বাঃ মিরকো, বাঃ। আমার অতিথিকে তুমি নিয়ে যাবার কে বলো তো? চলো, আমিও সঙ্গে যাব পাহারা দিতে। এটা লুম্পেনদের রাষ্ট্র নয় মশাই। দুটি নারী নিয়ে ফুর্তি করা এ দেশে চলে না। সে তুমি যতই বড় নাট্যকার হও।’
—’নাট্যকার? আমি?’ কৃত্রিম বিস্ময়ের চোখে তাকায় মিরকো।—’আমি তো মিস্ত্রি! আমি গাড়ির কারখানায় কাজ করি। বিপাশা, তুমি বুঝি আমাকে নাট্যকার ভাবছিলে সখি? অত্যন্ত দুঃখিত। এই ইন্টেলেকচুয়াল কম্যুনিস্টগুলো ভীষণ মিথ্যা কথা বলে। আমি একজন খেটে—খাওয়া লোক—খাঁটি শ্রমিক। এঁরা সব ইন্টেলেকচুয়াল—বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজকর্ম করেন—গেয়র্গ আবার মহাকবি। আমি বাপু কারখানার মজদুর—আসল প্রলেতারিয়েৎ। আসল চেকোস্লোভাকিয়া। অথবা বলতে পারো, আসল স্লোভাকিয়া। এই স্লোভাকিয়া সাদার্ন কান্ট্রিটা হচ্ছে গরীব কম্যুনিস্টদের দেশ—আর চেকদের রাজ্য, নর্দার্ন কান্ট্রি, যেখানে আলোকনগরী প্রাহা—সেইটে হচ্ছে বড়লোক কম্যুনিস্টদের অঞ্চল।’
—’মিরকো!’ আবার একটা বিরাট ধমক খায় মিরকো—ঘরসুদ্ধু সবার কাছে।—’বিপাশাকে তুমি এক্কেবারে গোলকধাঁধায় ফেলে দিচ্ছো। ও কী ভাবছে বল তো এদেশটার সম্পর্কে?’
—’যা ভাবা উচিত তাই যাতে ভাবে, সেটাই বলছি তো’—মিরকো মুচকি হেসে বিপাশার খোলা কোমরে হাত রাখে।—’চল গো সুন্দরী, তোমায় পাহাড়ের চূড়োয় নিয়ে যাই। পথে যদি চাও তো আমার কারখানাও দেখিয়ে দিতে পারি। এই দানব, এই হিংসুটে, এই বজ্জাত য়োহানটা যদিও আমাদের সঙ্গে সঙ্গে আসবেই। কী আর করব? উপায় নেই। এই সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে তো সমাজের জন্য ব্যক্তির সুখ—স্বাচ্ছন্দ্য বলি দেওয়াটা অবশ্যকর্তব্য! সয়ে নিতেই হবে আমাদের য়োহানের অবাঞ্ছিত উপস্থিতি।’
৮
ঘোরানো পাহাড়ী পথ বেয়ে মিরকো তার ছোট্টো, নতুন প্লাস্টিকের বডিওয়ালা শাদা গাড়িটি সাবধানে চালিয়ে বিপাশাকে পাহাড়চূড়োয় নিয়ে চলল। রাস্তায় বেশি গাড়িটাড়ি নেই। যা আছে তার অধিকাংশই শোনা গেল রুশদেশে তৈরি।
পাহাড়ে উঠে মিরকো বলে—’ওই দ্যাখো পদতলে পড়ে আছে স্লোভাকিয়া এ্যান্ড ইটস পীপল। এই যে ওপর থেকে নীচের দিকে তাকিয়ে দেখা, এটাই তো তোমাদের গলদওলা ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির শিক্ষা। তাই না? বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকেরা অবশ্য রাজনীতি—নিরপেক্ষ হয়ে সর্বত্রই এই নজরটা ধার করে নিয়ে ব্যবহার করে। তাই না, য়োহান?’
য়োহান উত্তর দেয় না। সে বোধহয় ঠিক করেছে আর ঝগড়া করবে না। ঝগড়া করতে করতেও তারা মদ্যপান খুব কম করেনি।
গাড়িতেই কোট রেখে যে নামবে, তার উপায় নেই। গাড়ি থেকে নামবামাত্র হাড়ের ভেতর কাঁপুনি ধরছে। এত ঠাণ্ডা। নিচে শত সহস্র রঙিন আলোর বিন্দু হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে স্লোভাকিয়া।
মিরকো বলল, ‘দাঁড়াও, য়াংকার খবর নিয়ে আসি। কখন তার ছুটি হবে কে জানে।’
বিপাশা আর য়োহান গাড়িতে উঠে বসে আবার। একটা বাগানের মধ্যে গাড়ি থেমে আছে। সামনেই একটা শাদা একতলা বাড়ি। হোটেল রেস্তরাঁ। ভেতর থেকে গানবাজনার ঝিনচাক ঝিনচাক শোনা যাচ্ছে। বেশ আধুনিক বাজনা। এবং বেশ অভিজাত দৃশ্যের হোটেল।
একটু পরেই মিরকো ফেরে। সঙ্গে একটি অদ্ভুত দেখতে মেয়ে। তার সব চুল রূপোলি। হঠাৎ দেখলে মনে হয় অশীতিপরা বৃদ্ধা। তারপরে চেনা যায়, এটা তার রংকরা কেশবিন্যাস প্লাটিনাম—ব্লনড যাকে বলে, তাই সেজেছে য়াংকা। হাতের নখগুলিও খুব দীর্ঘ এবং রূপোলি। ঠোঁটের রংও রূপোলি। পরনে খুব মিনি—মিনি গোলাপী স্কার্ট আর শাদা ব্লাউজ, কোমরে শাদা লেসের এপ্রন। মাথায় শাদা লেসের টুপি। পা দুটি দীর্ঘ, সুগঠিত, কৃত্রিম উপায়ে দীর্ঘপক্ষ্ম চোখ দুটি কোটরে ঢোকা, বুক অবশ্য তার ঠিক বিপরীত। য়াংকার বয়স ছাব্বিশ থেকে ছাপ্পান্ন পর্যন্ত যা খুশি হতে পারে।
য়াংকা ওকে দেখে খুব খুশি হল। শাদা দাঁত বের করে রোগা মুখে ভাঁজ ফেলে হাসল। তারপর ওদের কোটগুলি খুলে নিয়ে ওদের ভিতরের ঘরে বসাল।
বিপাশার তো ঘরে ঢুকেই চক্ষুস্থির। এই ক’দিনে ওর ধারণা হয়েছে চেকোস্লোভাকিয়ার জীবনযাত্রা খুব ম্লান, নিষ্প্রাণ, নিরালোক এবং নিরানন্দ। ও জিজ্ঞেস করে জেনেছে—দেনিশ দুটি শিশু ও স্ত্রী সমেত একটি দু’ঘরের হোস্টেলে থাকে। এভিচকা তাকে স্বামীসমেত ওমনিই একটা একলা ঘরে। কারুরই কিচেন নেই। কমন বাথরুম। সবাই বাইরে খেয়ে নেয়। এ আবার একটা জীবন নাকি? পথেঘাটে আলো কম, বার—রেস্তরাঁগুলো বাইরে থেকে দেখে চেনা যায় না। খোলা না বন্ধ উঁকি মেরে তবে বুঝে নিতে হয়। এই প্রথম বাইরে থেকে ঝিনচাক শোনা গেল। সঙ্গে সঙ্গে মানুষের গলাও। ঘরের মধ্যে এককোণে কঞ্চি পুঁতে আর পুঁতির ঝুরি ঝুরি মালা টাঙিয়ে একটি আলাদা ভাগ। সেখানেই নিয়ে বসালো ওদের য়াংকা।
মুক্ত অংশটিই দ্রষ্টব্য। সেখানে একদল অল্পবয়সী ছেলে—’স্টুডেন্টস’ বলল য়োহান—টেবিলের ওপরে চড়ে নাচছে এবং গীটার জাতীয় একটি তারযন্ত্র বাজিয়ে গান গাইছে। টেবিলে কিছু মেয়েও বসে আছে, দর্শক হয়েই, তারা ওই উদ্দাম নাচ—গানে অংশ নিচ্ছে না। যে ছেলেরা উদ্দামভাবে নাচ গান চালাচ্ছে তাদের কাছে গিয়ে বার বার কী যেন অনুরোধ করছে য়াংকার মতো গোলাপী স্কার্ট পরা অন্য একটি ওয়েট্রেস মেয়ে। তারা কান দিচ্ছে না।
এবার এগিয়ে গেল একটি পুরুষ ওয়েটার—প্রচণ্ড একটা ধমক শোনা গেল—গানের শব্দ ছাপিয়ে। কিন্তু গান থামল না। য়াংকা ইতিমধ্যে একটি কারাফে করে লাল মদ এনে সামনে রেখেছে তিনটি গ্লাস সমেত। নিজে কিছুই খেলো না য়াংকা। ‘না, ডিউটির সময়ে আমাদের খেতে নেই।’ য়োহানই অনুবাদ করে দেয়।
সে এতক্ষণে বিপাশার দোভাষী হয়েছে। গেয়র্গ, দেনিশ, এভিচকার কাছে বিদায় নিয়ে এসেছে বিপাশা। কেবল বেচকার কাছে নয়। কাল ভোর পাঁচটার সময়ে বেচকা আসবে বিপাশার হোস্টেলে—তাকে শহরে নিয়ে যাবে সঙ্গে করে। দেনিশ, এভিচকা তাকে দুই গালে দুটো করে চুমু খেয়ে বিদায় জানিয়েছে। গেয়র্গের হাতঝাঁকুনি ছিল শীতল, অস্থিসর্বস্ব। ভাল লাগেনি। থেকে থেকে দেনিশের কথা মনে পড়ছে, এবার কথাও। আর কোনোদিনও ওদের সম্ভবত দেখবে না বিপাশা। না—দেখাই স্বাভাবিক। অল্প অল্প মন—কেমন করছে কি? মিরকো য়াংকার সঙ্গে গল্প করছে—বিপাশারই গল্প—বিপাশা বুঝতে পারছে ওদের চাহনি থেকে। য়োহান বিপাশার চেয়ারের পিঠে হাত রেখে বসে আছে। মদের আর ঘামের একটা মিশ্র গন্ধ আসছে য়োহানের গা থেকে।
য়োহান বলল—’বার গন্ধ করার সময় হয়ে গিয়েছে, কিন্তু ছেলেরা মাতাল হয়ে আছে, বন্ধ করতে দিচ্ছে না। ওরা একটার পর একটা লোকসঙ্গীত গেয়ে যাচ্ছে। বেশ ভালোই গাইছে কিন্তু।’
য়াংকা একটানা বসতে পারছে না বলে য়াংকাকে খুব ব্যাকুল দেখায়। সে ঘুরে ঘুরে তার টেবিলগুলিতে অতিথিদের প্রতি মনোনিবেশ করছে আর মাঝে মাঝে এসে বসছে।
পাশের টেবিলে এক মাঝবয়সী মোটাসোটা দম্পতি বসে আছেন। ভদ্রমহিলার ফাঁপানো চুল কালো রং করা, ঠোঁট লাল রং করা, চোখের পাতা নীল রং করা, ফুলকো গাল গোলাপী রং করা, ইত্যাদি। পরনে ফর্ম্যাল কালো গাউন, উদ্বৃত্ত বুকে একটি তাজা গোলাপ। ভদ্রলোকও কালো সুটে, শাদা টাকে ফর্ম্যালি সজ্জিত।
ওদিকের এক টেবিলের ধারে একজন ঘাগু বেহালাবাদক ‘সেরানেড’ করছেন এক তরুণ দম্পতিকে। দুজনকেই খুব খুশি—খুশি দেখাচ্ছে।
ওখানে বাজানো শেষ হতেই পাশের টেবিলের ভদ্রলোক ডাকলেন বেহালাবাদককে। তিনি এসে, তাঁদের টেবিল ঘেঁষে একগাল হেসে, ছড় টানলেন মোক্ষম ধৈবতে—পঞ্চমে—ভদ্রমহিলার কান পর্যন্ত টোল পড়লো রোমাঞ্চ—উদ্বেল হাসিতে।
মিরকোকে ইঙ্গিত করে য়াংকা—বিপাশার জন্য ওকে ডাকবে নাকি? বিপাশা ভাষা না বুঝলেও বক্তব্য বুঝতে পেরে প্রবল আপত্তি করে। য়োহান ওকে বাঁচায়।
—’মিরকো, এক্ষুনি এইবার বন্ধ হয়ে যাবে। আর ঝামেলা বাড়িও না বাপু।’
এ যুক্তিটা য়াংকাও ফেলতে পারে না। ইতিমধ্যে ঐ টেবিলের নাচ এবং গান থেমেছে। পরম বিরক্তির গুঞ্জন সমেত সেই ছাত্ররা এখন বিল মেটাচ্ছে। মেয়েরা উঠে দাঁড়িয়েছে।
পাশের টেবিলের বেহালা খুব রোম্যান্টিক মীড় তুলে মোটা মহিলার কানের কাছে বাজছে। য়াংকা আরেকবার ঘুরে এল—এবারে উঠতে হবে সকলকেই। পশ্চিমী রেস্তরাঁর নিয়মেই, ঘরের আলোগুলি হঠাৎ মলিন হয়ে গেল—শেষে মাত্র একটিই জ্বলতে লাগল মিটমিট করে—চেয়ার টেবিলের ফাঁকে পথনির্দেশ দেবার উদ্দেশ্যে।
৯
বেরিয়ে এসে আবার গাড়িতে চড়ল সবাই। বিপাশা এবার পিছনে, য়োহানের কাছে, মিরকোর পাশে বসলো য়াংকা। গোলাপী স্কার্ট, শাদা এপ্রন, শাদা টুপি সব ছেড়ে, চুলটা ফিতে দিয়ে টেনে বেঁধে ছাপা ফুল—ফুল ড্রেসের ওপরে টুকটুকে লাল একটি ওভারকোট পরে এসেছে য়াংকা। আরেকটু ছেলেমানুষ দেখাচ্ছে। ত্রিশের এদিকেই আছে মনে হয়, তবু মিরকোর সঙ্গে মানায় না। মিরকোর স্বপ্নগুলি এ মেয়েটির চোখে ধরা দেবে না। এ মেয়ে স্বপ্ন দেখতে জানে না। অথচ ওই রেস্তরাঁয় বসে নোট—বইতে নাম ঠিকানা লিখে দিয়েছে মিরকো—সে য়াংকাকে বিয়ে করবে এই গ্রীষ্মে। বিপাশাকে নেমন্তন্ন জানাবে তখন।
য়াংকার মধ্যে একটা কাঠিন্য আছে। খেটে—খাওয়া মেয়ে বলে বোঝা যায়। য়াংকা আগে একটা কারখানায় কাজ করতো, ওর মা বাবা দুজনেই কারখানার শ্রমিক। আজকাল ও বার—মেইডের কাজ করে। য়াংকা নিজেও থাকে একটা চাকুরে মেয়েদের হস্টেলে।
উইক—এন্ডের ছুটি সে মিরকোর কাছে এসে কাটিয়ে যায়। শুনতে শুনতে বিপাশার অবাক লাগে।
একমাত্র চাষীর মেয়ে বেচকাই থাকে বাড়িতে, বাবার খামারবাড়িতে। সেইখানেই ফিরে গেল সে সোজা য়োহানের অফিস থেকে। রাত্রে তাকে বাড়িতে যেতেই হবে। মা বাবা জেগে বসে থাকবেন মেয়ের জন্য।
রীতিমতো পার্থক্য দেখতে পায় বিপাশা য়াংকা আর বেচকার মধ্যে। য়াংকা শহুরে মেয়ে, য়াংকা শ্রমিক। য়াংকার শক্তপোক্ত পোড়—খাওয়া মুখে কারখানার চিমনির ধুলো—ধোঁওয়া—মাখা পারিবারিক ইতিহাস লেখা আছে। আর বেচকার রূপলাবণ্যে, তার স্বাস্থ্যে, তার লাজুকতায় দিব্যি গ্রামগঞ্জের খোলা বাতাস, খামার বাড়ির তাজা সব্জীর গন্ধ। তফাতও নেই খুব একটা দুজনের বয়সে, পঁচিশের এদিক—ওদিক দু’এক বছরের ছোট—বড় হবে। শহরে এবং গ্রামে, শ্রমিকে এবং কৃষকে এখনও যথেষ্ট ফারাক। এই তথাকথিত তফাতটা এতদিনে একটা রোম্যান্টিক, থিওরেটিকল তফাত হয়ে যাওয়াই উচিত ছিল। এখনও যে এরকম বাস্তব একটা ফারাক সত্যিসত্যি বজায় আছে চাষী আর কারখানা শ্রমিকের দুটি স্টেরিওটাইপের মধ্যে, সেটা আশাই করতে পারেনি বিপাশা। অবশ্য ভারতবর্ষে আছে, এবং মার্কিন দেশেও। দুটি চরম অর্থনীতির পরিস্থিতিতে। এমন কি এখানেও? এই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও?
কিন্তু কী আশ্চর্য, এরা কেউই কি ‘বাসা’তে থাকে না? যাদের সঙ্গে পরিচয় হল, তারা কেউ ফ্যামিলি কোয়ার্টার্সের বাসিন্দা নয়। একটিও স্বামী—স্ত্রীকে একসঙ্গে চিনল না বিপাশা। একটিও শিশু দেখল না। কর্ম অক্ষম বৃদ্ধ দেখল না। রান্নাঘর কি শোবারঘর দেখল না। একে কি একটা দেশ—দেখা বলে? কেবলই কিছু বিশ্ববিদ্যালয়, জাদুঘর, প্রদর্শনী আর রেস্তরাঁ? এ কেমন সরকারী যত্ন?
—’দূর ছাই, তোমাদের দেশটা আমার দেখাই হোলো না।’ বলেই ফেললো বিপাশা।
—’সে কি কথা?’ শিউরে ওঠে য়োহান! ছোট্ট একটুখানি জায়গার মধ্যে এমনিতেই ভয়ানক ঘেঁষাঘেঁষি করে বসেছে দুজনে। য়োহানের হাঁটু দুটো দুখানি স্তম্ভের মতো তার প্রায় চিবুকের কাছাকাছি উঁচু হয়ে আছে। বিপাশা ছোট্টখাট্ট বলে তবু বাঁচোয়া। য়োহান একটি দীর্ঘ হাত বিপাশার পিঠের ওপরে ফেলে রেখেছে। ক্রমশ পিঠটায় বামনের পায়ের মতো সর্বব্যাপী গুরুভার হয়ে উঠছে য়োহানের উষ্ণ সতৃষ্ণ হাতটা।
—’সে কি কথা?’ য়োহানের সেই শিউরে ওঠাটা বিপাশার সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। নেহাৎ বাধ্যকরী শারীরিক নৈকট্যের কারণে।
—’আমার দেশটা তোমার দেখাই হয়নি?’ বলে য়োহান একটা ব্রাদারলি চাপ দেয় বিপাশার কাঁধে।—’কী সর্বনাশ! বলো, কী কী দেখতে চাও? এখনও ঘণ্টা—পাঁচেক সময় হাতে আছে।’
—’কালই তোমার যাবার কী দরকার? দু’দিন থেকে যাও না।’ মিরকো বলে।
ফরাসী য়াংকার আসে না, সে তক্ষুনি অনুবাদ দাবী করল। বিপাশা লক্ষ্য করেছে—য়োহান যখন ফরাসী বলে, বা ইংরিজি, য়াংকা তার মানে জানাতে চায় না! কিন্তু মিরকোর প্রতিটি শব্দের অর্থ তার জানা চাই। মিরকোও বেশ ধৈর্য ধরে আদর করে য়াংকাকে সব বুঝিয়ে দেয়। মিরকো বলে—’য়াংকাও বলছে বিপাশার কক্ষনো আজ যাওয়া উচিত নয়। এই তো উইক—এনডের শুরু।’
য়োহান কিন্তু খুব গম্ভীর—’কী হলো বলো তো বিপাশা? হঠাৎ কেন ও কথাটা বললে তুমি?’
বিপাশা এখন একটু বিব্রত বোধ করছে, তবু বলে—’আমি একটাও ফ্যামিলি দেখলাম না তোমাদের এখানে এসে। এ কেমন দেশ? তোমরা সবাই হস্টেলে থাকো কেন? হ্যাঁ, হতো যদি কমিউন, আমি বুঝতাম। এমন কি কিবুৎসও আমি বুঝি। কিন্তু এ তো তাও নয়। এ কেমন বাঁচা তোমাদের?’
হৈ—হৈ করে হেসে উঠে মিরকো জবাব দেয়—’একেবারে কাকতালীয় হয়ে গেছে ওঠা। যার যার ফ্যামিলিতেই তো থাকে সকলে। সামান্য সংখ্যক ছাত্র—টাত্রই কেবল বিবাহিত হয়েও হস্টেলে বাস করে—আর্থিক অসুবিধের কারণে। যেই আর্থিক স্বাচ্ছল্য পায়, যে—যার বাসায় উঠে যায়। এভা দেনিশ এখনও ছাত্র। আমি একটা উড়নচণ্ডে। কিন্তু গেয়র্গ তো বাসাতেই থাকে,—যদিও সে একক। সেখানে তোমাকে আমি পাঠাবো না বাপু। এলিজাবেথ থাকে শহরের বাইরে। তুমি আজ ওর সঙ্গে ওর বাড়িতে চলে গেলে পারতে, দিব্যি খামার—বাড়িটাড়ি দেখে আসতে।’
—’ও ডাকলে তো যাব? কৈ? ডাকলো না তো বেচকা?’
—’ডাকবে কী করে? য়োহানের ভয়ে কারুর কিছু নিজের ইচ্ছে প্রকাশ করবার যো আছে? নেহাৎ আমি একটা জন্তুবিশেষ, তাই তোমাকে ধরে এনেছি। য়োহান কি তাতে রাগ করেনি ভেবেছো?’
—’নিশ্চয়ই করেছি। গরিলাই বটে তুমি একটি।’ য়োহান গোঁ গোঁ করে।
মিরকো হঠাৎ বলে ওঠে—’এই তো তোমার সমাধান সামনেই। ওই দেখা যাচ্ছে য়োহানের একটা বাড়ি। য়োহানের তিনটে ফ্ল্যাট আছে—ব্রাটিস্লাভাতে একটা, এখানে একটা, আর ঐ যেটা দেখলে, অফিসে, ওই একটা। ওখানে ওর শোবারও বন্দোবস্ত আছে, বড় ডিভানটার মধ্যে বিছানাপত্তর সব রাখা আছে। কটা সংসার দেখবে তুমি? দ্যাখো গে যাও। ওর বউও আছে, বাচ্চাও আছে, মা—ও আছে—বিরাট সংসারী ব্যক্তি আমাদের অধ্যাপক মহাশয়। ওর বাড়িটা দেখলেই তোমার চেকোস্লোভাকিয়ার বড়লোকদের জীবনযাত্রা—প্রণালী সব জানা হয়ে যাবে।’
বলতে বলতেই মিরকোর গাড়ি ঢুকে পড়ে একটা আঙিনায়। সেখানে পাশাপাশি দুটো উঁচু উঁচু অট্টালিকা। কাচের টানা জানলার ফাঁক দিয়ে দীর্ঘ, আলোজ্বলা সিঁড়ি দেখা যাচ্ছে দশ—বারোতলা পর্যন্ত। এদিক—সেদিক কয়েকটি মাত্র জানলা চৌকো আলোয় জ্বলছে বিনিদ্র বাসিন্দার সাক্ষ্য হয়ে। আশ্চর্যের কথা, রাত এখনও একটা বাজেনি—ভয়ানক নিঝুমপুরী হয়ে গিয়েছে অঞ্চলটা।
—’কী? নামবে নাকি? দেখে আসবে অধ্যাপকদের বাসাবাড়ি কেমন হয়? তাদের জীবনযাত্রার মান কী রকম? এখান থেকে তোমার মেয়েদের হস্টেল দশ বারো মিনিটের পায়েহাঁটা পথ।’
বিপাশা য়োহানের দিকে তাকায়। চোখে প্রশ্ন। য়োহান গাড়ির জানালা দিয়ে অন্যমনে বাইরে বাড়িটার দিকে চেয়ে আছে।
মিরকো বলে—’য়োহান, তুমি বাড়ি—ঘরদোর ওকে দেখিয়ে দু’পা হেঁটে ওকে পৌঁছে দিতে পারবে না? নাকি আমরা সবাই ওপরে যাব? এত রাত্রে এতজন ঢুকলে অত্যাচার হবে না ঘুমন্ত মানুষগুলোর প্রতি?’
—’ঘুমন্ত মানুষগুলোর প্রতি অত্যাচার তো একজন লোক গেলেও হবে! বিপাশা বলল।
মিরকো বাধা দেয়—’মোটেই না। য়োহানের বউ ভারী ফ্যাশনেবল আর অহংকারী, হাঙ্গেরিয়ান কাউন্টেস কিনা সে! আমাদের মতো স্লোভাকদের মানুষই মনে করে না। কিন্তু তোমাকে দেখলেই স্বজাতি বলে চিনবে। তোমার সর্বাঙ্গে যা সোনাদানা!’—
সোনাদানা? বিপাশার এই প্রথম খেয়াল হোলো। তার হাতে একগাছি সোনার বালা, কানে সোনার পাশা, গলায় সোনার হার। বাঙালি মধ্যবিত্ত মেয়েদের যা সাধারণ সাজ। এবং শাড়ি ভর্তি সোনার জরির ফুল। আঙুলেও একটা সোনার আংটি আছে। সর্বাঙ্গেই সোনাদানা। সত্যিই তো। সমীর, তুই এসব খুলিয়েছিলি, আমি আবার পরে নিয়েছি। সমীর, আমি সব ফেলে দেওয়া জিনিস আবার তুলে নিয়েছি রে। স—ব।
হঠাৎ গাড়ির দরজা খুলে নেমে পড়ে য়োহান। বিপাশার দিকে ডানহাতটা বাড়িয়ে দেয়—’ঠিক আছে, চলে এসো, একটা দেড়টার মধ্যেই তোমাকে হস্টেলে পৌঁছে দিয়ে আসব। কাল আবার তোমার ভোরে বেরুনো।’
—’এই তো চাই।’ মিরকো সাবাস দেয়। য়াংকা যখন গলা জড়িয়ে চুমু খেয়ে বিদায় নিতে এল, সস্তা প্রসাধনের কড়া গন্ধ নাককে আক্রমণ করে বিপাশার।
মিরকো বলল—’য়াংকাই কেবল চুমু খাবে কেন? আমিও খাব।’ সঙ্গে সঙ্গেই সর্বাঙ্গে লৌহভীম—জাতীয় এক মিলিটারি আলিঙ্গন, এবং দু’গালে সশব্দ সপ্রাণ জোড়া—চুমু এসে পড়লো বিপাশার।
চলন্ত গাড়ির জানলা দিয়ে বৃষ্টির মধ্যে মুখ বাড়িয়ে মিরকো বলল—’চিঠি দিও কিন্তু! চিঠি দিও নিশ্চয় বিপাশা, মিরকোকে ভুলে যেও না যেন, ছোট্ট সবুজ ঘাসফড়িং আমাদের। আর টিউলিপটা সঙ্গে নিয়ে যাও। সারাটা বসন্তকাল ধরে মিরকোকে মনে পড়িয়ে দেবে ওরা। তোমাকে আমি ভুলব না ঘাসফড়িং, কোনোদিনও না—’