২০
মিরকোর গানটা মাথায় ঘুরছে। সিঁড়ি দিয়ে ক্লান্ত পায়ে চারতলা উঠে আসতে থাকে বিপাশা—বিশাল বাড়ি—অন্তহীন ঘর—ছাত্রীরা রাত্রিবাস পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এত রাত্রেও প্রাণের অভাব নেই এ বাড়িতে।
নিজের ঘরে ঢুকে বিপাশা দেখল চারটে বেজে পঁচিশ। কয়েক মিনিটের মধ্যেই বেচকা চলে আসবে। সুটকেসটা গোছাতে হবে। সুটকেসে হাত না দিয়ে ঘরের সংলগ্ন ঝুলবারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো বিপাশা।
নীচে শেষরাত্রির বিজন বড় রাস্তা। কিছু—দূরে একটি ছায়ামূর্তি, হুডমাথায়, দীর্ঘ একটি মানুষ এই বিরাট আলোকিত, জনহীন রাজপথের একধার দিয়ে বৃষ্টির মধ্যে একা হেঁটে ফিরে যাচ্ছে। তার দুটি হাত বুকের কাছে জড়ো করা—কোনো মহার্ঘ সম্পদ অতি সাবধানে বুকে করে নিয়ে যাচ্ছে সে।
ঘরে ফিরে এসে কোটটা খুলে রেখে দেয়ালের রেডিওটার সুইচ অন করে দেয় বিপাশা। মৃদু ঝঙ্কারে ঘরের নিঃসঙ্গ স্তব্ধতা ভেঙে যায়। কোলের ওপরে দুহাত জোড়া করে কয়েক মিনিট বসে থাকে বিছানার ওপরে। সমস্ত ব্যাপারটাকে হৃদয়ঙ্গম করবার চেষ্টা করে। কিন্তু মনটা যে কেবলই ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। মন কিছুতেই বিশ্লেষণে যেতে রাজী নয়। ফাঁকা মনে, ফাঁকা চোখে, বিপাশা এবার বাইরে দৃষ্টিপাত করে। ভেতর থেকে চোখ তুলে নিয়ে।
যদিও ঘড়িতে রাত্রি শেষ হয়ে এসেছে, আকাশে তার পর্দাখোলা কাচের দরজার বাইরে, নীত্রার বৃষ্টি ভেজা কালো আকাশ গাছের সারির মাথার ওপরে কনুই ভর দিয়ে অনন্ত শয্যায় শুয়েছে।
কিন্তু বিপাশার শুলে চলবে না—বেরিয়ে পড়তে হবে। সুটকেস খুলে টুকিটাকি জিনিসপত্রগুলো ভরে নিতে নিতে ও ভাবে, বেচকা যদি না আসে, শুধু গাড়িটাই আসে, তাহলেই বেশি ভালো হয়। বেচকার মুখোমুখি হতে ইচ্ছে করছে না। আটদিনে বেচকা প্রায় বন্ধু হয়ে গেছে।
২১
দরজায় টোকা পড়ে।
—’এসো বেচকা।’
—’এ কি, এক্কেবারে তৈরি যে? শাড়িটাড়ি পরা—বিছানা—টিছানা তুলে ফেলেছো দেখছি। বাঃ খুব কাজের মেয়ে তো তুমি। আমার মা খুব খুশি হতেন তোমাকে দেখে।’
অব্যবহৃত শয্যা, টান টান, পরিচ্ছন্ন, সুসজ্জিত। এক নজর সেদিকে তাকিয়ে বিপাশা অন্য কথা তোলে।
—’আমিও খুশি হতাম তাঁকে দেখতে পেলে। তুমি আর দেখালে কই?’
এই কথায় লজ্জা পেয়ে বেচকা যথারীতি লাল টুকটুকে পাকা আপেলটি হয়ে যায়।
—’কী করব বলো, য়োহানেরই ব্যবস্থা সব। আমার খুবই ইচ্ছে ছিল তোমাকে বাড়িতে নিয়ে যাই—খামার বাড়ি দেখিয়ে আনি।’
বলতে বলতেই হাতের ব্যাগটি খুলে নিজের মুখচ্ছবি দুটি আপেল বের করলো বেচকা।—’বাবা পাঠিয়েছেন তোমার জন্যে—আমাদের গাছের ফল।’
—’বাঃ! ধন্যবাদ, অনেক ধন্যবাদ বেচকা। তোমার বাবা আমাকে স্নেহভরে আপেল খেতে দিয়েছেন? অথচ চেনেনই না তো আমাকে!’
বিপাশার মনটা হঠাৎ খুব খুশি খুশি লাগে। আপেল খেতে সে অবশ্যি খুব একটা ভালবাসে না। তবু খুশি খুশি? নাকি দুঃখী দুঃখী লাগছে? হঠাৎ বিপাশার বুকের মধ্যে কেমন মোচড় দিয়ে ওঠে।
—’যাই, মুখটা ধুয়ে আসি’—বলে ছুটে সে দরজার পাশে বেসিনটার কাছে চলে যায়। তারপর চোখে—মুখে দু’হাতে জলের ঝাপটা দিতে দিতে বেসিনে মুখ নামিয়ে অঝোরে কাঁদে। নিঃশব্দে! এ—ঘরে আড়াল নেই।
পর্দা নেই, দরজা নেই। কান্নার আশ্রয় নেই কোনো। বেচকা ঘরে!
বিপাশার চোখেমুখে জলের ঝাপ্টা দেওয়া আর থামেই না।
—সমীর রে, এ কোন অরণ্যে আমি একা! আমি যে কিছুই বুঝতে পারি না আজকাল। এ কি দুঃখ? য়োহানকে ছেড়ে যেতে হচ্ছে বলে? কিন্তু য়োহানকে তো আমি চিনিই না। তবে কি তোর জন্যেই, সমীর, তবে কি তোরই জন্য? বুকের ভেতরে মোচড় দিয়ে পাকে পাকে একটা ঝাপসা যন্ত্রণা উঠে আসছে—এ কিসের যন্ত্রণা, তুই বুঝিয়ে দে আমাকে।
য়োহান তো বলল শেষ নয়, বলল এটাই আরম্ভ। শেষ না শুরু, সুখ না দুঃখ সেটাই যে—মেয়ে বুঝতে পারে না সে—মেয়ের কী গতি হবে এই পৃথিবীতে?—কোথায় যেন একটা রেলের বাঁশি বাজছে, কোন ট্রেন গমগম করে যেন সেতু পার হয়ে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে, সমীর রে, বলে দে আমি কোন দিকে যাই?—
শাদা, ঠাণ্ডা, এ্যান্টিসেপটিক বেসিনে ঠাঁই ঠাঁই মাথা ঠুকতে ইচ্ছে করে মজ বিপাশা চৌধুরীর। কিন্তু বেচকা আছে ঘরে।
—ছোট্ট থেকে বাবা আমাদের সব ভুলভাল শিখিয়েছেন—দাদা—ছোড়দার সমস্ত হিসেব ভুল—সব ভুল সমীর—মা বেঁচে থাকলে হয়তো ঠিক ঠিক শেখাতেন কে জানে, বুকের ভেতরে এ কী কষ্ট—বুক জুড়ে মাইল মাইল ফাঁকা রাস্তা শূন্য পড়ে আছে—কোন দিকে আমি যাব রে সমীর—কোথায় যে আমার ঘর…
—’তোমার যে এবার ঠাণ্ডা লেগে যাবে। আর জল ঘেঁটো না বিপাশা।’ বেচকা ডাকে।—’এবার তৈরি হয়ে নাও। যা বৃষ্টি, যেতে অনেকটা সময় লেগে যাবে। আবার নতুন এক উপসর্গ দেখা দিচ্ছে শুনছি—খুব ঝড় আসছে।’
—’এই বৃষ্টির মধ্যেই?’—
—’হ্যাঁ, ঝোড়ো হাওয়া। মার্চ—এপ্রিলে এরকম প্রায়ই বয়।’
বিপাশা কোট চাপিয়ে সুটকেসটা হাতে তুলে নেয়। বেরুনোর আগে একবার ঘরের চারিদিকে চোখ বুলিয়ে দেখে—কিছু পড়ে রইলো না তো? কবি বিপাশা চৌধুরীর কিছু টুকরোটাকরা?
হাত বাড়িয়ে রেডিওটা অফ করে দেয় বেচকা।
বিপাশা আলোটা নিবিয়ে দেয়। মুহূর্তেই ঘরের অন্ধকার আর বাইরের অন্ধকার একাকার হয়ে যায়। দরজাটা টেনে দিয়ে, চাবিটা বেচকা হাতে নেয়, অন্য হাতে কেড়ে নেয় বিপাশার সুটকেস।
—’দাও আমাকে দাও, তুমি তো একটা ঘাসফড়িং। তুমি পারবে না।’
২২
বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে বাতাসও প্রবল হয়ে উঠেছে।
বেচকা একটার পর একটা আপেল খেয়ে যাচ্ছে, আর কোটের পকেটে বীচি ফেলছে। বিপাশার সেই একটা আপেলই শেষ হয়নি।
গাড়ি ছুটছে খুব জোরে।
—’কী গাড়ি এটা? মার্সিডিজ বেনজ মনে হচ্ছে?’
—’না, এটা মার্সিডিজ ঠিক নয়, তবে অবশ্য তারই রুশী সংস্করণ। খুব ভাল গাড়ি।’
—’সে তো টেরই পাচ্ছি—একটু আওয়াজ নেই, একটু ঝাঁকুনি নেই, খুবই আরামের।’
দু’পাশ দিয়ে শাঁ শাঁ করে ছুটে যাচ্ছে পতিত জমি, খোলা মাঠ, মাঝে মাঝে কলকারখানা—ছোট ছোট গ্রাম—মফঃস্বলী শহর—
বৃষ্টি তো বাড়ছেই, বাড়ছেই—বাতাসও বাড়ছে—রাস্তায় মোটেই গাছপালা নেই, তাই হাওয়ার গতিটা বোঝা যাচ্ছে না—কিন্তু ঝোড়ো বাতাসে জানলা—তোলা এয়ার টাইট গাড়িটা কেঁপে কেঁপে উঠছে, যেন উলটে যাবে—বৃষ্টি—বাদল আকাশ আঁধার করে আছে—সকাল হবার নাম নেই।
‘ভিজিবিলিটি এত লো, যে জোরে চালানো যাচ্ছে না—’, বেচকা বলে।
গাড়ি চালাচ্ছেন খাকী উর্দি পরা সরকারী সারথি।
—’তাছাড়া এত জোর বাতাসেও তো স্পীড দেওয়া যায় না—’ বিপাশা যোগ করে দেয়।
—’তোমার বাসের কিন্তু বেশি দেরি নেই, বিপাশা।’
—’আমরা তো ঠিক করা সময়েই বেরিয়েছি।’
—’হ্যাঁ, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে হাতে আরও সময় নিয়ে বেরুনো উচিত ছিল। এত ঝড়বৃষ্টি বেড়ে যাবে বুঝিনি।’
উদ্বিগ্ন হয়ে বেচকা কথা বলছে, বিপাশাও কথার পিঠে কথা চালান দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বিপাশা যেন বেচকার উদ্বেগটার ভাগ নিতে পারছে না ঠিকমতো। অথচ বেচকার উদ্বেগ তো বিপাশার জন্যেই। মনে মনে এই অসম্পৃক্ততার জন্য অপরাধী বোধ করে বিপাশা। কিন্তু কেন যেন ও কিছুতেই কিছু নিয়ে খুব একটা উত্তেজিত হয়ে উঠতে পারে না ইদানিং।
দেরি হয়, তো ভিয়েনার বাসটা পাবে না। বাস না পায়, তো লন্ডনের প্লেনটা পাবে না। এই তো? ঠিক আছে। পরের প্লেনের জন্য পরের বাস আছে। এটাই তো শেষ নয়। একমাত্র নয়। এত কি আছে উদ্বেগের? জীবনে কিছুতেই কোথাও সম্পৃক্ত হবার মতো গুরুত্ব নেই, বিপাশা ভাবে। প্লেন ধরা এমন কী একটা জীবনমরণ যজ্ঞ? বিপাশা, তোমার কি কোনো জীবনমরণ যজ্ঞ আছে?
বিপাশা ওই প্লেনটা ধরতে পারলে তুমি কোথায় যাবে? সেটা কি তোমার ঘর? তুমি কোথায় যাচ্ছ? কিসের প্লেন ধরছ তুমি এত তাড়াহুড়ো করে? এই বর্ষাচ্ছন্ন, মেঘমেদুর, ঝোড়ো হাওয়ার সকালে? তুমি কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছ? একে কি ফিরে—যাওয়া বলে? নীত্রা থেকে লন্ডন, শূন্য থেকে শূন্যে। এ অঙ্ক তোমার মিলবে কেমন করে? নিঃশব্দ বিপাশা নিজের সঙ্গে কথা বলে চলে—
বেচকা দুবার প্রশ্ন করে উত্তর না পেয়ে চুপ করে যায়।
বিপাশার মনের মধ্যে কোত্থেকে তেড়ে আসছে হাজার হাজার কথা, হাজার তীক্ষ্নমুখ প্রশ্নে ঠিক বাইরের ওই বৃষ্টির ছিটে যেমন ঝোড়োবাতাসের ঘোড়ায় চড়ে বর্শার ফলার মতো তীক্ষ্ন হয়ে উঠেছে—বিপাশা অসহায়।
বেচকার গলা তার কানে পৌঁছয় না।
কোথায় যাচ্ছি আমি? মুক্ত বিশ্বে?
বিপাশা, তুমি বাড়ি যাবে না? তুমি তো লন্ডনে বসে ইংরিজিতে কবিতা লিখতে চলেছ। ইংরিজিতে তোমাকে চিঠি লিখতুম বলে তুমি আমাকে খ্যাপাতে সমীর, মাতৃভাষাটা যে আমাদের শেখাই হয়নি স্কুলে, সমীর, শোনো, আমি আর ইংরাজিতে চিঠি লিখব না—আই প্রমিস, আই সোয়্যার—অসম্পূর্ণ স্বপ্নের যন্ত্রণায়, অকারণ উদ্বেগে ছিন্ন ভিন্ন য়োহানও আমার চেয়ে বেশি মুক্ত সমীর!—জেলের ভেতরেও তুমি নিশ্চয়ই যেমন অনিরুদ্ধ। এই অসম্পূর্ণ আদর্শের কৃষ্ণছায়ার আবহাওয়াতে য়োহান দিব্যি স্বাধীন, অনিরুদ্ধ—তোমাদের যে পায়ের তলায় মুক্ত মাটি রয়েছে, রয়েছে মাতৃভাষা, মাতৃভূমি, তোমাদের মাটিতে, পূর্ণ বসন্তের আশ্বাস—সমীর রে, এ কোন অরণ্যে আমি একা—আমি বাড়ি যেতে চাই, এবারে আমি বাড়ি ফিরে যাবো,—দেখিস সমীর আমি ঠিক তোকে খুঁজে বের করবো।
এই য়োহান কেমন তার নিজের বাড়িতেই আছে—যতই দুঃখ হোক, সে সুখী। কাত্রিনা কোথায় হারিয়ে গেল কে জানে? আমি কাত্রিনার মতো হারিয়ে যেতে চাই না সমীর, আমিও বাড়ি যেতে চাই—য়োহান তো কম্যুনিস্ট হয়েও কেমন বলল—পৃথিবীটা ছোট্ট, জীবন খুব বড়, তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবেই—এটা শেষ দেখা নয়। এই প্রথম দর্শন—অথচ আমি তো জানি চেকোস্লোভাকিয়ার এই অখ্যাত মফঃস্বল শহরে আর কখনো ফিরে আসার দরকার হবে না আমার—সেও তা নিশ্চয়ই জানে—তবু তো বলতে পারল—শোন সমীর, আমিও বলছি আমি ঠিক তার কাছে আসতে পারবো, আর আমি ভয়ের ভেতরে লুকিয়ে থাকবো না। আমি আমার বাড়ির রাস্তাটা এতদিনে চিনে গেলাম রে—এবার আমি বাড়ি ফিরে যাবো, তুই দেখিস—যতো বৃষ্টি, যতো ঝঞ্ঝা হোক, সবুজ ডালে আমরা ঠিক ফুল ফোটাতে পারবো—সমস্ত ঋতুই হবে বসন্তের দিন…
—’বিপাশা? বেচকো আস্তে আস্তে ওর হাত ধরে টানে।—’আমাদের নামতে হবে এবার। ব্রাটিস্লাভায় এসে গিয়েছি। ওই যে তোমার বাসস্টপ। আমরা মিনিট পাঁচেক লেট, কিন্তু বাস এখনও ছাড়েনি। চলো, দৌড়ে গেলে এখনও ধরতে পারবো।’
—’বাসটা আছে?’ হঠাৎ আর্তনাদ করে জেগে ওঠে বিপাশা।
—’আছে, আছে, অসম্ভব লাকি আমরা।’
—’চলো দৌড়োই—’ বিপাশার সুটকেস হাতে বেচকা বৃষ্টির মধ্যে দৌড়োতে শুরু করে—একহাতে শাড়ির কোঁচা তুলে বিপাশাও খুট খুট করে ছুট লাগায়।
অঝোর বৃষ্টিধারার পর্দার ফাঁক দিয়ে সামনের কর্মব্যস্ত পাঁচ মাথার মোড়টাকে দেখায় ঠিক যেন বৃষ্টি ভেজা চৌরঙ্গী—ধর্মতলার মোড়।
***