প্রবাসে দৈবের বশে – ১৫

১৫

সমীরদের পালিয়ে বেড়ানোর দিনগুলো মনে পড়ে হঠাৎ শরীরটা কেঁপে গেল। না এর চেয়েও ঢের বেশি ভয়ের চেহারা তার দেখা আছে। যে—ভয়ে মানুষ রেগে উঠে মানুষকে খুনও করে ফেলে। প্রচণ্ড রাগের মধ্যেই পুরুষমানুষের ভয়ের চরম প্রকাশ হয়।

বিপাশা জেনে গেছে। যে টিউটোরিয়াল হোমটায় ওরা রাত কাটাতো, সেইখানে, ঠিক এমনি করে সমীর ওকে টেনে নিয়েছিল একদিন—সময়টা ছিল সন্ধে সন্ধে—সমীরের খুব জ্বর হয়েছিল—সেদিন রবিবার। টিউটোরিয়াল হোম বন্ধ। বিপাশাকে ওখানে আসতে নিষেধ করেছিল সমীর, তবুও ছুটে গিয়েছিল বিপাশা—সমীরের জন্য কিছু কোসাভিল নিয়ে।

দরজা খুলেই ঠিক এমনি করে ভিতরে টেনে নিয়েছিল ওকে সমীর, আর সঙ্গে সঙ্গেই গালে একটা বিরাট থাপ্পড়। কান মাথা ভোঁ করে উঠেছিল—অপমানে, অভিমানে, বিস্ময়ে বিপাশা স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল।

ঠিক এমনই। কাঁদতে পারেনি। সমীর দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিল—’স্টুপিড, ইডিয়ট, ন্যাকা কোথাকার। বারণ করলে কথা শোনে না। ওরা ঠিকই বলে—তুই—ই আমাদের ঝোলাবি বিপাশা—তুই আর তোর শুয়োরের বাচ্চা দাদাটা।’

একটু দূরেই নাকি পুলিশ ছিল। সমীর বলেছিল বিপাশা যেন আর কোনোদিনও না আসে—যেন আর কখনো দেখা না করে সমীরের সঙ্গে। দাদা নাকি বিপাশার পিছনে স্পাই লাগিয়েছে।

সমীর চাপা গর্জন করে উঠেছিল—’খবর্দার। খবর্দার, আমার নির্দেশ না পাওয়া অবধি আর কোথাও যেন তোমায় আসতে না দেখি, সব শেলটারগুলো এভাবে এক্সপোজ করে দিবি তুই এই ন্যাকামি করতে করতে।—ভাবতেও দুঃখু হয়। এদেশে মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে রেভোলিউশন করবার সময় এখনও বোধহয় আসেনি। ছি, ছি, তোর একটা মিনিমাম সিরিয়াসনেস নেই? এতবার নিষেধ করলাম! জীবনমরণের প্রশ্নটা পর্যন্ত বুঝিস না?—এত বাজে, এত হালকা তুই?’

বিপাশা শেষ পর্যন্ত ভেঙে পড়েছিল।

কিন্তু সমীর আদর করে কান্না থামায়নি। গোঁজ হয়ে বসে সিগারেট খেয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ তারপর বলেছিল—’আমারি ভুল। বড়লোক, যত পেটি বুর্জোয়ার বাচ্চা, তোদের মাথায় রেভোলিউশন ঢুকবে কেন। সুবর্ণ রায়চৌধুরীটা একটা চোর মন্ত্রী—বিড়লার হয়ে কেশ লড়ে, যার একটা ছেলে খুনে পুলিশ—অন্য ছেলেটা জালিয়াৎ—সি. এ., তার মেয়েটাই বা কী হবে? কত আলাদা হবে? কত আলাদা হবে! আমারি ভুল।’

শুনে চড়াৎ করে মাথার মধ্যে কী যেন হয়ে গিয়েছিল বিপাশার। কী বিষম, কী বিপুল সেই রাগ! অন্তরীক্ষে কোন গ্রহসংস্থান হয়েছিল কে জানে, বিপাশা বললঃ ‘বেশ তাই হবে। তোমরা আমাকে যা ভাবছো ঠিক তাই হবো আমি। দেব ঝুলিয়ে সবকটাকে। এক্ষুনি। আজই গিয়ে বলে দিচ্ছি দাদাকে। আমাকে তুই যা বলছিস, আমি ঠিক তাই হবো।’

তখন আর কেউ ছিল না টিউটোরিয়াল হোমে। বিপাশার শরীর ছুঁয়ে মান ভঞ্জন করেছিল সমীর। শেষপর্যন্ত সেই জ্বরতপ্ত উদ্বেগে টান টান শরীরে মিশিয়ে দিয়েছিল বিপাশা নিজেকে।

ভয়ে কান্নায় ভালোবাসায় ক্লান্ত সমীর হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিল একটু। শুয়েছিল চোখে হাত রেখে।

বিপাশা উঠে পা টিপে বেরিয়ে গিয়েছিল, বাদলকে দরজা খুলে দিয়ে।

সেই শেষ।

সেদিনই ঘটলো সেই অসীম সর্বনাশ। ঈশ্বর জানেন বিপাশা বলেনি। বিপাশা বোকা হতে পারে, বিপাশা প্রেম চেয়েছিল বিপ্লবের চেয়ে বেশি করে। তাই বলে বিপাশা ট্রেটর নয়।

সমীর, বিশ্বাস করো, আমি কিছুই জানতাম না। সেই রাত্রেই পুলিশ গিয়েছিল টিউটোরিয়াল হোমে—ধরা পড়ল বাদল আর দেবু। সমীর তখন ওখানে ছিল না।

তারপর কী দ্রুতই ঘটে গেল ঘটনাগুলো সব। নির্বাকযুগের কমিক ছবির মতো—দাদা ছুটে এসে বাবাকে খবর দিল ওর বস সোমশংকর দত্তরায়ের কাছে, সমীরের কিটব্যাগ জমা দিয়ে গেছেন প্রফেসর অনুপম রায়। তাতে বোমা পাইপগান মাও—পুস্তিকার সঙ্গে সঙ্গে সমীরের নোটবইটাও আছে। আছে বিপাশার প্রেমপত্রও।

সেই রাত্রেই বাবা উড়ে গেলেন বিপাশাকে নিয়ে বোম্বাই। সেখান থেকেই পাসপোর্ট হলো। দশদিনের মধ্যে লন্ডন। বোম্বাইতে বসে খবর গেল, সমীর ধরা পড়েছে।

—’বিপাশা?’ কে যেন অনেকদূর থেকে ডাকে।

—’উঁঃ?’ বিপাশা সাড়া দেয়।

—’আয়্যাম স্যরি। অমন করে বলা আমার উচিত হয়নি। তুমি কিছু মনে কোর না, প্লীজ, অমন চুপ করে থেকো না বিপাশা, কিছু বলো। বকো আমাকে।’

—’কিছুই মনে করিনি।’ বলতে বলতে উঠে বসতে গিয়ে পারে না বিপাশা।

য়োহান চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। তার বুকে, দুহাতের বেড়িতে বিপাশা বন্দী।

এতক্ষণ কী হয়েছিলো বিপাশার? বুদ্ধিভ্রংশ? ও যে একটি পুরুষের বুকের ওপর পড়ে আছে—সেটাও খেয়াল ছিল না?

সমীর রে, সমীর—দেখে যা—পেটি বুর্জোয়ার বাচ্চাটার হালটা দেখে যা—জোর করে হাতটা ছাড়াতে চেষ্টা করে বিরক্ত গলায় বিপাশা বলে—’ছেড়ে দাও, প্লীজ ছেড়ে দাও, য়োহান, ভাল্লাগছে না বলছি। একটুও—’

য়োহান ছাড়বার কোনও লক্ষণ দেখায় না।

খুব অস্বস্তি হচ্ছে সত্যিই—’এইবারে কিন্তু চেঁচাব য়োহান’—ঠাণ্ডা গলায় বিপাশা বলে কেটে কেটে।

ওর হিসেবে ভুল হয়নি। বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো য়োহান ওকে ছেড়ে দেয়।

বিপাশা উঠে বসে। কাপড় গুছিয়ে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে বুকের কাছে পা গুটিয়ে।

য়োহানও উঠে বসে।

—’ওরা সিকিউরিটির লোক। ওরা সব দিকে নজর রাখে। ওরা জানে আমার স্ত্রী এখানে নেই। এই বাড়িতে সবাই জানে স্ত্রী হাঙ্গারিতে গিয়েছে। যদি জানলাতে তোমাকে দেখতে পেতো?’

—’তো কী হতো? লোকের বাড়িতে লোকে আসে না? তোমাদের দেশে বাড়িতে মেয়েরা আসে না কারুর স্ত্রী না থাকলে?’

—’আমি যে একটা দায়িত্বশীল পদে প্রতিষ্ঠিত বিপাশা—এই চ্যাপ্টারে পার্টির প্রধান সেক্রেটারি আমি। আমার আচার—আচরণ সবাই লক্ষ্য করে। আমার কোনো প্রিভেসি নেই বিপাশা—আমার কোনো প্রাইভেট লাইফ নেই—ইট মাস্ট বি অ্যান ওপন বুক,—দেখছোই তো নীত্রা একটা ছোট্ট মফঃস্বল শহর। ছোট্ট সমাজ আমাদের, প্রায় গ্রাম্য নীচতা এখানকার লোকজনদের মনে, মিরকোর মতো সবাই নয়। এখানকার সামাজিক আদবকায়দা খুব গোঁড়া, খুব আঁটোসাঁটো—বিপাশা। ছোট জায়গা, হলেই যা হয়।’

—’একদিন বাড়িতে একজন মেয়ে এলেই—’

—’না না—’ ঠোঁটে জিবে চুকচুক করে একটা অধৈর্যের শব্দ করে ওঠে য়োহান—’অত সোজা নয়—এ তোমার পশ্চিম ইওরোপের পারমসিভ সোসাইটি নয়। এটা একটা সোশ্যালিস্ট স্টেট, এখানে মর‍্যালিটির দিকটা খুব বড়। ১৯৬৮—র পর থেকে তো আরোই বেড়েছে—বুর্জোয়া ইনফিলট্রেশন আটকানোর নামে, কাউন্টার রেভেল্যুশনের নামে এখানে যা কড়াক্কড়ি শুরু হয়েছে ছাত্রাবস্থায় আমরা তা দেখিনি। বিপাশা, তুমি ঠিক বুঝবে না। তোমরা ইংরিজিতে কবিতা লেখা ভারতীয়রা এসব বুঝবে না।’

আবার মাথার মধ্যে চড়াৎ করে ওঠে বিপাশার। রাগ হয়। বিপুল রাগ। ভয়ে, অসহায়তায় পুরুষমানুষ কেবল এটাই পারে। হাতের মধ্যে যে আছে, যে দুর্বল, তাকে অপমান করতে।—রাগটাকে পোষ মানিয়ে নাও বিপাশা—বিপাশা নিজেকে বলে। সর্বনাশা রাগ আর নয়। চুপ করে থাকো। একেবারে চুপ। অন্য কথা বলো বিপাশা।

—’তোমার মা কি জানেন, তোমার স্ত্রী হাঙ্গারিতে নেই?’

—’না। মাকে বলিনি।’

—’কেন বলনি মাকে?’

—’মার বয়স হয়েছে, মা মনেপ্রাণে কম্যুনিস্ট, মা এখনও অনেক স্বপ্ন দ্যাখেন। মা এত পরিশ্রম করেন, নাতিদের জন্যে একটা আইডিয়াল সোশ্যালিস্ট স্টেট গড়ে দিয়ে যেতে চান বলে।’

—’তার সঙ্গে এর কী যোগ।’

আলতো ভাবে হাত তুলে নেয় বিপাশার হাত—তারপর য়োহান জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে বলে—’ওরা যে আর ফিরবে না, বিপাশা।’

—’মানে?’

—’মানে?’ য়োহান দাঁত দিয়ে নিজের ঠোঁটটা কামড়ে ধরে।

একটা যুদ্ধবিগ্রহ চলেছে তার ভিতর দিকে—বিপাশা টের পায়। করতলে—ধরা য়োহানের হাত দুটিকে এবার সে নিজেও গ্রহণ করে, একটু চাপ দেয়—যেন সাহস দিচ্ছে। একজন আহত সৈনিককে যেমন আরেকজন সৈনিক।

য়োহান মুখ খোলে—’আমার স্ত্রী আমাকে পরিত্যাগ করেছে, বিপাশা। আমাকে ঠিক বলব না, আমার স্বদেশ, আমার পার্টি—তার দুচক্ষের বিষ; যে আমার পার্টিকে ঘেন্না করে, যে আমার চেকোস্লোভাকিয়াকে ঘেন্না করে, একলা আমাকে আলাদা করে ভালোবাসা তার পক্ষে কি সম্ভব? আমি তো ভাবতেই পারি না—!

‘বলো, আমি কী করে মিরকোকে বলবো, কাত্রিনা চলে গিয়েছে? কী করে বলবো আমি—মিরকো, দেখে যাও, আমার স্বদেশকে আমার স্বপ্নকে লাথি মেরে আমার স্ত্রী চলে গিয়েছে?’

‘আমি হেরে গিয়েছি, বিপাশা। মানুষ হিসেবে এটা আমার সবচেয়ে বড় হার। নিজের বৌকেই যে কনভিন্স করাতে পারেনি, সে কী করে দেশের জনগণের মধ্যে আশ্বাস সঞ্চার করবে বলতে পারো। আমার সারাজীবনের কাজের সার্থকতা কোথায় বলতে পারো বিপাশা?’

বিপাশা কী বলবে বুঝতে পারে না। কথা খুঁজে না পেয়ে কেবল য়োহানের হাতদুটোকে জড়ো করে নিজের কোলের মধ্যে টেনে নেয়।

—’আমার ছেলেরা আর ফিরবে না। কাত্রিনা লিখেছে—”ওদের আমি মুক্ত জীবনে নিয়ে এসেছি!” হাঃ—বোকা মেয়েটা, জীবনে এতো ঘা খেয়েও চিনল না মুক্তি কোথায়। মুক্তি কি প্যারিসে? ক্যাপিটালিজমে কখনো মুক্তি থাকতে পারে?

‘কাত্রিনা জানে না আমার ছেলেদের কতবড় একটা ক্ষতির মধ্যে নিয়ে ফেললে,—কত বড় একটা বন্ধন, একটা দাসত্বের বোঝা ওদের জীবনে চাপিয়ে দিলো। এটা কি মুক্তি? তুমি বলো, বিপাশা? আমি, আমার মা সারাজীবন যে—বিষের বিরুদ্ধে খেটে মরলাম, আমার ছেলেদের মধ্যে ঠিক সেই বিষই সঞ্চারিত করে দিল কাত্রিনা।

‘আমার মার পঁয়ষট্টি বছর বয়স—আমি তাঁকে একথা বলতে পারিনি বিপাশা। তিনি নাতিদের জন্যে জোড়া—খাট কিনলেন,—দেয়ালে কত যত্ন করে রঙিন পোস্টার সাঁটলেন—ঘর সাজাচ্ছেন নাতিদের জন্যে। আমি প্রাণে ধরে মাকে বলতে পারছি না—তোমার নাতিরা ও—খাটে কোনোদিনই শুতে আসবে না মা—আর কোনোদিনই হয়তো তুমি ওদের দেখবে না।’

বিপাশার মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগে—’কেন প্যারিসে গিয়ে দেখে আসা যাবে না?’

—’হয়তো যাবে, হয়তো যাবে না—কিছুই নিশ্চিত বলা যায় না।’

—’আমার মনে হয় বাচ্চারা নিজেরাই ফিরে আসবে য়োহান—বড় হলেই ফিরে আসবে নিজের দেশে—’

—’বলা যায় না বিপাশা, কিছুই বলা যায় না। ক্যাপিটালিজমের বিষ বড় ভয়ংকর বিষ, সমস্ত প্রতিরোধ শক্তি নষ্ট করে দেয়—ভেতরে ভেতরে কুরে কুরে খেয়ে নেয় নৈতিকতার শেকড়—মাটিটা পর্যন্ত পচিয়ে দেয়। আরাম বড় সংক্রামক বিষ, বড় ভয়ংকর—কাত্রিনাকে দেখেই আমি, মজ্জায় মজ্জায় টের পেয়েছি সব—’

১৬

যেন স্বপ্নের মধ্যে অন্যমনে কথা বলে যাচ্ছে য়োহান—বিপাশার দিকে তার চোখ নেই, কিন্তু বিপাশা অনুভব করে য়োহানের হাত দুটো আরেকটু আশ্রয় খুঁজছে বিপাশার কাছে। হাঁটু দুখানি বুকের কছে গুটিয়ে বসে আছে বিপাশা, বুকের কাছে, হাঁটুর ওপরে য়োহানের মস্ত হাতদুটো ধরে আছে নিজের ছোট ছোট মুঠোতে—য়োহানের হাত তাতে যথেষ্ট শান্তি পাচ্ছে না—সে আরেকটু নিরাপত্তা খুঁজছে, আরো একটু উষ্ণতা…হে ঈশ্বর, বিপাশার এখন কী করা উচিত—?

অস্থির উদ্বেগে বিপাশা বলে ওঠে :—’কটা বাজলো, য়োহান? আমাকে এবারে উঠতেই হবে।’

—’এখনই নয়। বিপাশা, আরেকটু থাকো লক্ষ্মীটি। আমি বড্ড একা এখানে, আমার কথা বলবার মানুষ নেই। আজ বলে নয়, বড় হয়ে যাবার পর থেকে আর কোনোদিনই ছিল না—কাত্রিনা আমার কথা শুনতে চায়নি কোনোদিনই, আমার মাকেও আর আমি সবকথা বলতে পারি না। আমি যুবক, আমি পুরুষ, আমি তাঁকে সব আঘাত থেকে আড়াল করে চলতে চাই, কিন্তু আপনাকে আড়াল করবে কে? বলো? বলো?’

বিপাশার কি জিব কেউ কেড়ে নিয়েছে? সে কথা বলছে না কেন? সেকি বুঝতে পারছে না য়োহান কী চাইছে? পাঁচটা বছর সে একা কাটিয়েছে লন্ডন শহরে লেখক—শিল্পীদের আলগানীতির পারমিসিভ পাড়ায়।

সমীরের বিপাশা হয়তো কিছুই বুঝতে পারত না। কিন্তু এ বিপাশা তো সে নয়। ‘আমি আর পারছি না। বিপাশা, আমাকে তুমি দয়া করো। আমার সমস্ত শরীর সমস্ত হৃদয় সমস্ত জীবন পিপাসিত, তুমি আমাকে দয়া করো। বিপাশা, বিশ্বাস করো এতে কোনো পাপ নেই। এটা তুমি দীনজনে দাক্ষিণ্য করার পর‍্যায়ে ফেলে দাও না কেন? তোমার কত আছে—তুমি মহৎ হবে না কেন? আমার মতো শুষ্ক দু’চারজন তৃষ্ণার্তকে জল দিলে তোমার তো কোনো ক্ষতি হবে না?’

বিপাশার দুই হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে ফেলেছে য়োহান। কখন শক্ত দুটো বাহু দিয়ে পুতুলের মতো ঘিরে ধরেছে বিপাশার উপবিষ্ট ছোট্ট শরীর।

বিপাশার কানে যেন কিছুই ঢুকছে না। কেবল নাকে তাজা তীব্র নতুন রংয়ের চড়া গন্ধ যেন একটা নেশা ধরিয়ে দিচ্ছে। বিপাশা স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো য়োহানের মাথায় একটা হাত রাখে। সেই হাতটা হঠাৎ মুঠোর মধ্যে টেনে নিয়ে অস্থির চুমুতে চুমুতে ভরে দ্যায় য়োহান।

—’আমার সোনা, আমার মণি, আমার ছোট্ট ঘাসফড়িং—আমার সাগরপারের স্বপ্ন’—

বিপাশা প্রস্তরমূর্তির মতো স্থাণু। শিশুর মতো বুকের মধ্যে মুখটা জোর করে গুঁজে দিয়ে য়োহান জ্বরগ্রস্ত রোগীর মতো অস্থির গলায় বলে চলে—’তুমি কী সুন্দর বিপাশা, তুমি কি স্বপ্ন? বলো, আমি কি স্বপন দেখছি?’

এই সমর্পিত মুহূর্তকে কীভাবে সম্মানিত করবে ভেবে পায় না বিপাশা—তার দুটি হাত শুধু য়োহানের আকুল মাথাটাকে বুকের মধ্যে আরো টেনে নেয়—ভয় পাওয়া শিশুকে যেমন আশ্রয় দেন জননী। কিছু ভাবার অবসর নেই—এমন মুহূর্তে মানুষের শরীর নিজেই নিজের গতিবিধি স্থির করে নেয়—সিদ্ধান্ত যা নেবার তা নিয়ে ফ্যালে।

এইসব প্রাথমিক প্রাকৃতিক প্রতিক্রিয়াগুলো জান্তব এবং সেই কারণেই নির্ভুল হয়ে থাকে—এইসব নিশ্চিত মুহূর্তে বুদ্ধির ছুটি মিলে যায়—সভ্যতার আদবকায়দা, অতীত ভবিষ্যতের হিসেব—নিকেশ ভালমন্দের নকল নিয়মাবলি মিলিয়ে নেবার সময় থাকে না মানুষের—সময় থাকে না পাঁচিল তোলার, ফলে, যা সৎ, যা অভ্রান্ত যা অনিবার্য, প্রকৃতি তাই ঘটিয়ে দেয়—যেমন কাপাসফল পাকলেই আপনি ফেটে যাওয়া অবধারিত। যেমন হঠাৎ কেউ সামনে ছুরি তুললে হাত আপনা হতেই উঠে আসে সে ছুরি আটকাতে, কিংবা যেমন হাঁটুতে একটা বিন্দুতে হাতুড়ি মারলে আপনিই ঠুক করে এগিয়ে যায় পায়ের হাড় সামনের দিকে—তেমনিই অনিবার্যতায় চোখ দুটি বুজে ফেলে বিপাশা।

সমীর তুমি সেদিন এমনিভাবে—তুমি আমাকে সেদিন এমনিভাবেই—আমরা তখন ছোট ছিলাম, না সমীর? কিছুই জানতাম না তেমন—তুমি খুব সাবধানী ছেলে,—কিন্তু তবু সেদিন ঠিক এমনিভাবেই না সমীর? সেই সেদিন তোমার গা জ্বরে যেন আগুনে পুড়ে যাচ্ছিল—যখন ঠিক আমরা, না সমীর? অথচ দ্যাখো এখন তুমি প্রেসিডেন্সি জেলে না পুরুলিয়া জেলে তাও আমি জানি না—আরেকটু, কাছে এসো সমীর, আরেকটু আদর করো আমাকে, আর রাগ কোরো না আমার ওপরে, সত্যি, শোনো, আমার কোনো দোষ ছিল না—আমি দাদাকে বলে দিইনি সমীর—তুমি যে কিটব্যাগ প্রফেসর রায়ের কাছে জমা রেখেছিলে সেকথা তো আমি জানতামই না, আশ্চর্য,—ওঁর মতো মানুষও এত নিচে নামতে পারেন—ভয় যে বড় সাংঘাতিক—কেউটে সাপের বিষ সমীর—ভয় মানুষকে দিয়ে করাতে পারে না এমন কাজ নেই, ভয়ই পারে প্রফেসর রায়কে দিয়েও অমন কাজ করাতে, ভয়, যে ভয় তোমার মুখ দিয়েও বিপাশাকে অমন কথা বলিয়েছিল, যে ভয়ে আমি আজও লন্ডনে পড়ে আছি, যে ভয় আমাকে দিয়ে—যে ভয় য়োহানকে দিয়ে—

য়োহান আমাকে ছেড়ে দাও, আমি বাড়ি যাব য়োহান, আমাকে বাড়ি যেতেই হবে,—আমাকে ছেড়ে দাও—আমার ভয় করছে—আমার খুব, খুব ভয় করছে—ওঃ য়োহান—

কী গহন, কী সবুজ, কী ঘনঘোর অন্ধকার এই অরণ্য, গভীর, দীর্ঘ শ্যাওলাধরা বৃক্ষগুলি মাথায় মাথায় ঠেকে গিয়েছে, তোরণের পরে তোরণ, তোরণের পরে তোরণ গড়ে চলেছে, যেন নমস্কারের যুগ্মকর, যেন গথিক চার্চের আর্চের গড়ন, গাছে গাছে কচি সবুজ পাতা ধরছে, লতায় লতায় ফুলের কুঁড়ি জাগছে, আড়ালে আড়ালে পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে—অথচ কী আশ্চর্য, বনের মেঝেয় কতো বরফ, কতো বরফ, ah the snows of yester-year!–যত পা ফেলা যায় ততই পা ডুবে যায় আরো গভীরে,—এই অরণ্যে কি রোদ বাতাস আসবে না কোনোদিনও? এমন সময়ে চোখের সামনেই বরফ ফাটিয়ে হঠাৎই, যেন জাদুমন্ত্রে, একটি দর্পিত নীল ক্রোকাসফুল ফুটে উঠল বসন্তের জয়ধ্বনি দিয়ে। কে যেন বলল রোদ—বাতাসের গলায়—

—’আমরা এই শিখরটা দুজনে জয় করলাম—এই ক্রোকাসফুল আমাদের জয়পাতাকা।’

১৭

চোখ মেলেই বিপাশা দেখল সামনে বিস্তৃত জানলার কাচ ভর্তি বৃষ্টির জলবিন্দু—দেয়াল জুড়ে বসন্তের গুটির মতো তারই ছায়া ছিটিয়ে পড়ছে—জলেরও এমন ছায়া হয়? বিপাশা এই প্রথম খেয়াল করল। কী আশ্চর্য এই পৃথিবী।

—’বিপাশা?’

—’বল।’

—’আমি জানি না তুমি আমাকে কী ভাবলে—শুধু বলতে চাই তুমি আজ আমাকে যা দিয়ে গেলে—তা আমার একচল্লিশ বছরের জীবনের মহার্ঘতম ঐশ্বর্য।’

—’তুমি যে পুঁজিবাদীর মতো কথা বলছো।’

—’হ্যাঁ, স্মৃতির ব্যাপারে আমি পুঁজিবাদী।’

সমীরও বলেছিলো—’তোমার বিষয়ে কিন্তু নেহাৎই পেটি বুর্জোয়ার মনোবৃত্তি আমার,—তুমি আমার প্রাইভেট প্রপার্টি।’

অলসভাবে শুয়ে থাকে বিপাশা। নিরুত্তর। বিপাশার কথা বলতে হচ্ছে করছে না। হাত উল্টে ঘড়িটা একবার দেখেই ঝট করে উঠে বসলো সে।

তার বসার ধরনটা দেখে য়োহানও উঠে পড়ে। লাইটার জ্বালিয়ে ঘড়ি দেখে।

—’একটু আসছি।’ বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। গিয়ে আবার ফিরে আসে। ‘চল, তুমিও যাবে?’

বিপাশা উঠে দাঁড়ায়। ঝেড়েঝুড়ে কাপড়টা গুছিয়ে পরে।’

য়োহান তাড়াতাড়ি বলে ওঠে—’দাঁড়াও, দাঁড়াও, আমি যে দেখতে চাই কেমন করে জড়াও তোমরা অতখানি কাপড়—’

বিপাশা কান দেয় না।—’একটু জল খাব।’

—’নিশ্চয়ই—চলো দিচ্ছি।’—তারপর পিঠে হাত রেখে প্রথম প্রশ্ন করে য়োহান,’ভালো লেগেছে?’

প্রতীক্ষায় দু’একটি মুহূর্ত কাঁপতে থাকে, রগের ওপরকার শিরার মতো দপদপ করে অন্ধকার।

বিপাশা এলোমেলো কোনো একদিকে ঘাড়টা হেলিয়ে দেয়। পুরুষের এই অনাবশ্যক প্রশ্নের চিরদিন উত্তর কেবল একটিই। বিপাশার চোখের মধ্যে বৃষ্টিবিন্দুর ছায়াগুলি অস্পষ্ট হতে হতে পরস্পর মিশে গিয়ে বিশাল আবছা এক কালো মেঘের আকৃতি দেয়। হাতের উল্টো পিঠে ঝাপসা চোখটা মুছে নিল বিপাশা। জলবিন্দুগুলি আবার আলাদা আলাদা হয়ে বসন্তের গুটির মতো ছড়িয়ে পড়ে দেয়ালে।

নিজের মনে বিপাশা একটু হাসে। বৃষ্টির বিন্দুগুলো জোড়া দিয়ে দিয়ে যদি একটা গোটা মেঘ পাওয়া যেতো!

শার্টটা কোমরে গুঁজতে গুঁজতে য়োহান বলে—’আমার একটা অনুরোধ রাখবে, বিপাশা?’

—’সর্বনাশ! আমার একটা অনুরোধ?’

বিপাশার কথায় য়োহান হেসে ফ্যালে।

—’সত্যি! কী যে দুষ্ট মেয়ে তুমি! তোমার জন্যে আমার খুব মন কেমন করবে কিন্তু। কাল এমন সময়ে তুমি কোথায়! কত দূরে। এতক্ষণে আমাকে হয়তো ভুলেই গেছ তুমি।’

বিপাশা উত্তর দেয় না। শুধু বলে—’কই, কী অনুরোধ, বলে ফ্যালো চটপট। সম্ভব হলে রাখবো।’

—’দুটো চিঠি দেবো, লন্ডন থেকে স্ট্যাম্প মেরে ডাকে দিয়ে দেবে একটু? প্লীজ?’

মাথার মধ্যে পোঁ করে একটা ডেনজার সিগন্যাল বেজে ওঠে বিপাশার। মুখ কঠিন হয়ে যায়।

—’কিসের চিঠি? আমি বিষয়বস্তু না জেনে চিঠি—টিঠি ডাকে দিতে পারব না।—এ—দেশের অতিথি আমি, এ দেশের কোনো ক্ষতি করতে রাজী নই, জ্ঞানে বা অজ্ঞানে।’

হঠাৎ বিপাশার গলার কঠিন স্বর, রূঢ় সুর শুনে হকচকিয়ে গেলেও, পরমুহূর্তেই ওকে জড়িয়ে ধরে শূন্যে তুলে ধরে বিপুল শব্দ করে একটা চুমু খায় য়োহান।

—’Sagesse d’un poete, je t’envie; বিপাশা তুমি একটি প্রথম শ্রেণীর কমিউনিস্ট হতে পারতে—যা নীতিবোধ আর নিষ্ঠা তোমার। আমার কাত্রিনা যদি এমনি হোতো!’

এবার অবাক হবার পালা বিপাশার। কিন্তু ওর কানের মধ্যে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে একটি অমোঘ বাক্য—’তুমি একটি প্রথম শ্রেণীর কমিউনিস্ট হতে পারতে’…ট্রেনের চাকায় যেমন কথার শেকল ঘুরতে থাকে ছন্দে ছন্দে—তেমনি বাক্যটি ঘুরতে লাগলো বিপাশার চৈতন্যকে আগুন করে—বিপাশা, তুমি একটি প্রথম শ্রেণীর…ও সমীর, শোনো, শুনেছ, এরা কী বলছে? বলছে, বিপাশা তুমি একটি…

—’চিঠি দুটো কিছুই নয়, একটা প্রফেশনল নেহাৎ এ্যাকাডেমিক, অন্যটা আমার স্ত্রীকে লেখা।—দাঁড়াও দেখাচ্ছি।’

ব্রীফকেসটা এনে রান্নাঘরের টেবিলের ওপরে রাখে। দুটি খাম বের করে য়োহান। একটার ওপরে আধখানা ঠিকানা লেখা—এক প্রফেসরের নাম, রাস্তার নাম, নম্বর—শহর আর দেশের নাম নেই। খাম খুলে বের করে একটা রি—প্রিন্ট, আর একটি ফর্ম্যাল চিঠি।

—’এটা ডাকে দিচ্ছ না কেন? এতে কী অসুবিধা?’

—’তুমি লন্ডনে গিয়ে এতে লিখবে সিউল, সাউথ কোরিয়া। বুঝলে? আমাদের এখান থেকে সিউলে চিঠি যায় না—নিষিদ্ধ অঞ্চল। এই প্রফেসর আমার বিষয় নিয়েই কাজ করেন, ওঁকে আমি পড়াতে চাই আমার এই লেখাটা—এটা তো ইংরিজিতে অনূদিত হয়েছে, তাই।’

—’কী আশ্চর্য। আর অন্যটা?’

—’এই যে। এইখানে একটা ঠিকানা লেখা আছে, কে পাচ্ছে লেখা নেই। তুমি বসিয়ে দিও। আমার পদবী তো জানই—আর কাত্রিনাটা তার আগে।—চিঠিটা ফ্রেঞ্চে লেখা, তুমিও পড়তে পারো।’

—’সে কি? নিজের বৌকে তুমি নিজের ভাষায় চিঠি লেখো না?’

—’নিজের ভাষা আছে নাকি আমাদের? ও তো হাঙ্গেরিয়ান আর আমি স্লোভাক—অবশ্য দুজনেই দুজনের ভাষা খুব ভালই জানি। তবু চিঠিপত্রের ভাষাটা আমাদের ফরাসি—এর জন্যে কাত্রিনাই দায়ী। কাত্রিনা আর তার ফিউডাল ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড। ওরা ছোট থেকে শিখেছে চিঠিপত্র জর্মনে কিংবা ফরাসিতে লিখতে হয়। যেহেতু জর্মনটাই চালু বেশি—ফরাসিটা তাই আরো একটু নাকউঁচু ব্যাপার হোলো—কাত্রিনা তো সর্বদাই বেশি উঁচু নাকের দিকে।’

—’তাহলে আমার ইংরিজি কবিতা লেখায় কী দোষ? সেটাকে কেন ঔপনিবেশিক দাসত্বসুলভ মনোবৃত্তি বলবে তোমরা?’

—’এটাও তাই। আমি কি বলছি এটা তা নয়? অন্য কিছু? বিপাশা—সোশ্যালিজম এখনও পাকা হয় নি আমাদের মধ্যে, এখনও বহু দ্বন্দ্ব, বহু বিচ্যুতি, বহু ত্রুটি কনট্রাডিকশনের সীমা নেই—আর সেই কনট্রাডিকশন জগতের কাছ থেকে লুকোনোর জন্যে আমাদের সাবধানতারও সীমা নেই। কিন্তু এখন যতই ত্রুটি থাকুক, যতই ভুলভ্রান্তি অপূর্ণতা থাকুক, এই তোমাকে আমি বলে দিচ্ছি বিপাশা—একদিন এদেশে সত্যিকার সোশ্যালিজম আসবেই—আসবেই। না এসেই পারে না। এত দিনের এত মানুষের সাধনা মিথ্যে হতে পারে না। এই লুকোচুরি, এই অনর্থক ষড়যন্ত্রের আবহাওয়া সেই যে স্টালিনের যুগ থেকেই সৃষ্টি হয়েছে—এখনও ঘোচেনি। কিন্তু এটা চিরস্থায়ী হতে পারে না। এ নিশ্চয় বদলাবে। দেখো, এমন দিন আসবে যখন নীত্রা থেকেই সিউলে চিঠি যাবে—যখন কারুর ধনী বৌ প্যারিসে পালালে তার স্বামী লোকলজ্জা করবার কিছু থাকবে না’—

বলতে বলতে খুব সহজভাবে হাসে য়োহান।

অবাক হয়ে বিপাশা ভাবে, মাত্র একটু আগেই এই রাত্রেই এই বিষয়টি কতদূর ভারাক্রান্ত রেখেছিল এই মানুষটিকে। এইটুকু সময়ের মধ্যে, মাত্র এইটুকু পাওয়া মানুষকে এতটা বদলে দিতে পারে? এতটা?

হঠাৎ বিপাশাকে আকাশে একবার ছুঁড়ে দিয়ে লুফে নেয় য়োহান—

—’ঘাসফড়িং, তুমি ঠিক একটা খুদে পুতুল, তোমার কোনো ওজন নেই।—আহা, আমার পড়শীরা যদি তোমার সঙ্গে আমাকে দেখতে পেতো। আজ আমার পরম সৌভাগ্যটা জগতে কেউই জানতে পারবে না, এই যা দুঃখু।’

চিঠি দুখানা ব্যাগের মধ্যে পুরে নিয়ে বিপাশা বাতিটা হাতে তুলে নেয়। ‘আর এক মিনিটও নয়। দ্যাখো য়োহান, তিনটে পঁয়ত্রিশ বেজে গেছে। আমার কাছে বেচকা গাড়ি নিয়ে আসবে ঠিক পাঁচটার সময়ে।’

—’ওঃ হো! শোনো, বেচকাকে যেন বোলো না এতক্ষণ এখানে ছিলে! যদি জিজ্ঞেস করে ক’টায় ফিরলে,—করবেই জিজ্ঞেস কনে হয়, বেচকা তো আর এভিচকা কি য়াঙ্কা নয়, ও চাষীর মেয়ে, অতশত বুঝবে না—ওকে বোলো, একটার সময়ে ফিরেছো। নইলে কিন্তু কাল এক্কেবারে—’

—’জানি, জানি, বুঝেছি।’ বলতে বলতে কোট রাখার কাবার্ডের দিকে এগিয়ে যায় বিপাশা। কাবার্ডের পাশেই, মাটির জুতোর পাশে চোখে পড়ে একটি ফুলের টব। তাতে তিনটি টুকটুকে লাল টিউলিপ ফুল। মিরকোর টিউলিপ। এ—বাড়ির অন্ধকারটা তার এখন খুব চেনা হয়ে গেছে।

এই নতুন রংয়ের গন্ধটাও তার বুকের ভেতর পর্যন্ত ঢুকে গিয়েছে। মনে হচ্ছে এই বাড়িটা তার কতকালের বাসা। দু’হাত বাড়িয়ে টিউলিপের টবটা বুকে তুলে নেয় বিপাশা।

১৮

ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে পথে বেরিয়ে এল দুজনে। রাস্তাঘাট শূন্য। একটিও গাড়ি নেই। —’দেখি যদি একটা ট্যাক্সি পাই। তুমি তো ভিজে যাচ্ছ। আমার না হয় হুড আছে’—কোটের হুডটা নিজের মাথায় তুলে দিয়ে য়োহান বলে।

—’আমারও হুড আছে—কোটে নাই বা থাকল—’ ঘোমটা দিতে দিতে বিপাশা বলে।

রাস্তায় ইঁটের পাঁজা, অর্ধসমাপ্ত বাড়ি, পার্ক করা গাড়ির সারি আর ল্যাম্পপোস্টেরা সবাই বিপাশা আর য়োহানকে দেখে খুশি হয়। রাস্তার একধারে উঁচু বহুদ্রষ্টা বৃদ্ধ বৃক্ষের সারি মাথায় অন্ধকার নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ভিজছে। হালকা পায়ে হেঁটে যেতে যেতে য়োহান এ—ঢিলে ও—ঢিলে লাথি মারে ফুটবল খেলোয়াড়ের ভঙ্গিতে। একহাতে সে কাঁখে ধরে আছে টিউলিপের টবটা, আর এক হাতে আগলে আছে বিপাশার কোমর।

—’এখন ভয় করছে না? কেউ যদি দ্যাখে?’ বিপাশা বিস্মিত হয়ে বলে।

—’উঁহুঁ’, করছে না। এখন সিকিউরিটি গার্ডদের আসার টাইম নয়।’

ফুটপাত দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ একটা মত্ত সঙ্গীতের শব্দ কানে আসে—কোরাস গান। রাস্তাটা এখানে মোড় ঘুরছে। ওপাশ থেকে একটা দল এগিয়ে আসছে মনে হয়। দু’একটি টুপিপরা মানুষকে এদিকে আসতে দেখেই য়োহান সহসা ফুলের টবটা বিপাশার হাতে গছিয়ে দেয়। দিয়েই কিছুমাত্র ভাববার সময় না দিয়ে বিনা ভূমিকায় বিপাশাকে বুকে জাপটে ধরে ঠোঁটের ওপর ঠোঁট চাপিয়ে দেয় সে। বিপাশার দম আটকে আসে। হঠাৎ খুব ভয় করতে থাকে—এ তো চুম্বন নয়, এ যেন অন্য কিছু! কী এ?’

গানের শব্দ এখনও পাশ দিয়ে যাচ্ছে। কে যেন শিস দিল। কিছু মন্তব্য করল কেউ। অন্যরা হাসল।

বন্দী নিষ্পিষ্ট বিপাশা নিজেকে ছাড়িয়ে দম নিতে চাইল কিন্তু দুহাতে ফুলের টব থাকায় সেটা সোজা হল না।

টের পেয়ে আরো জোরে, আঁকড়ে ধরলো তাকে য়োহান। যতক্ষণ না গানের শব্দ মিলিয়ে গেল—তাদের যুগলবন্দী মূর্তি ফুটপাতে একটা আবছা, থ্যাবড়া ছায়া ফেলে স্থাণু হয়ে রইল। তারই একদিকে দোল খেতে লাগলো কয়েকটি টিউলিপের জ্যান্ত ছায়া, বৃষ্টি ভেজা পথের ওপরে।

বিপাশার ঠোঁটের ওপরে বৃষ্টির জল। জল বিপাশার চোখেও।

বিপাশাকে মুক্তি দিয়ে য়োহান বলল—’স্যরি, বিপাশা, ওরা সব মাতাল, শ্রমিকের দল, ফিরছে। আমারই চ্যাপ্টারের লোক মনে হল। অমন না করলে আমাকে দেখে ওরা চিনতে পারতো। এইভাবে মুখটাকে লুকিয়ে ফেলা গেল, দেহের গড়নটাও বদলে গেল—বুঝলে না? তা ছাড়া ওরা তো মাতাল ছিল, হঠাৎ তোমাকে অন্যরকম পোশাক—টোশাকে দেখে কী করত কে জানে। মাতালের তো আর কম্যুনিস্ট—ক্যাপিটালিস্ট নেই। এইভাবে তুমিও সুরক্ষিত রইলে। ভালো বুদ্ধি করিনি?’

এই আজব ব্যাখ্যা শ্রবণে হতভম্ব হয়ে যাওয়া বিপাশা অবাক প্রশ্ন করে, ‘সোশ্যালিস্ট স্টেটেও মাতাল আছে?’ হেসে ফেলে য়োহান।

—’আমার বলা উচিত অবশ্য নেই! কিন্তু তুমি কী বলো?’

১৯

মেয়েদের হস্টেলের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে য়োহান ওকে দুই গালে দুটি বিদায় চুম্বন দেয়—কেননা গেটের খুপরি কামরায় পুষ্টকায়া দরওয়াননী চেড়ীর মতো উপদেষ্টা।

তারপরে গলা নামিয়ে বলে, ‘আবার দেখা হবে, বিপাশা—দেখা হবেই আমাদের—পৃথিবী খুব ছোট্ট জায়গা, জীবন অনেক বড়ো—এই তো সবে শুরু! এটা কখনো আমাদের শেষ দেখা নয় বিপাশা, আমি তোমাকে নিশ্চিত বললাম, দেখে নিও,—এই আমাদের প্রথম দর্শন!’

বিপাশা চুপ করে থাকে। তারপর যন্ত্রবৎ ডান হাত নেড়ে বিদায় জানায়। বাঁহাতে বুকে জড়ানো আছে ফুলের টব। স্থূলা দরওয়াননী কিছু বললেন।

য়োহান উত্তর দেয়। বিপাশা বোঝে না।

য়োহান বলে—’যাও বিপাশা, ওপরে চলে যাও! এখানে দাঁড়ানোটা ইনি পছন্দ করছেন না। আবার দেখা হবে—তবে, Partir, c’est un peu de mourir, প্রতিটি বিদায় মানেই একটুখানি মৃত্যু—বিপাশা, ছোট্ট সবুজ ঘাসফড়িং আমার—’

য়োহানকে গেটের সামনে বিদায় দিয়ে ফিরে আসতে আসতে হঠাৎ ছুটে গেটের দিকে ফিরে গেল বিপাশা।

—’য়োহান!’

যেতে যেতে অবাক হয়ে থমকে দাঁড়ায় য়োহান। তার পরে ফিরে আসে।

—’ইয়েস, মাই ডারলিং?’

—’এটা রাখো তোমার কাছে, য়োহান এটা তোমার বাড়িতে নিয়ে যাও, এটা তোমাকে ঘাস—ফড়িঙের উপহার।’

বিপাশার প্রসারিত দুই হাতে মিরকোর দেওয়া ফুটন্ত, জীবন্ত রক্তলাল টিউলিপের চারা। সারা বসন্তকাল ধরে প্রস্ফুটিত হবার আশ্বাস আছে তাদের মাটিতে।

বিনা কথায় দু’হাত বাড়িয়ে ফুলগাছ গ্রহণ করে য়োহান। কয়েকটি মুহূর্ত পূর্ণদলে বিকশিত হয়, নৈঃশব্দ্যে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *