প্রবাসে দৈবের বশে – ১০

১০

—Jamais je ne t’oublirais’—মিরকোর গলার গানের একটা কলি সমেত ছোট্ট শাদা প্লাস্টিকের গাড়িটা বৃষ্টির মধ্যে রাস্তার আলোর সঙ্গে মিশে হারিয়ে গেল।

বুকে টিউলিপের টব—আঁকড়ানো বিপাশাকে একহাতে আগলে নিয়ে য়োহান দৌড়ে পোর্টিকোর নিচে এসে দাঁড়ালো। এই পোর্টিকো মানে সেই গাড়িবারান্দা নয়, একটুখানি দাঁড়াবার মতো ছাদ—ছাওয়া আশ্রয়মাত্র, ঠিক গেটে ঢোকবার মুখে। পকেট থেকে একগোছা চাবি বের করে প্রথমে বড় দরজা খুলল য়োহান, বাড়ির ভিতরে ঠেলে দিল বিপাশাকে। বিপাশা লিফটের সামনে এসে দাঁড়ায়। য়োহান অতি সাবধানে দরজা ভেজিয়ে বন্ধ করে এসে ফিসফিস করে বলল—’একদম কথা নয়। রাত অনেক হয়েছে তো।’

বোতাম টিপে টিপে হয়রান হয়ে গিয়ে য়োহান একটা দিব্যি দিয়ে বলল,—’ব্যাটারা কোল্যাপ্সিবল গেটটা নির্ঘাৎ খুলে রেখেছে কেউ। যত সব!’—

বিপাশার হাসি পেয়ে যায়। এও আবার এক দেশোয়ালি স্বভাব। পাশ্চাত্য দেশের মানুষজন প্রায় কখনোই এই ভুলটা করে না। পুঁজিবাদীরা পুঁজিবাদীদের সুবিধে না দেখলে কে দেখবে। অথচ এই সমাজতান্ত্রিক দেশে…এমনও ভুল হয়? বিপাশা কোনোদিনই ভালো বিপ্লবী তৈরি হতে পারেনি, সমীরের জন্যেই সে বিপ্লবী হয়েছিল, বিপ্লবের মাধ্যমে সমীরকে পায়নি। এইখানে একটা বিরাট তফাৎ থেকে যাচ্ছে প্রকৃত বিপ্লবী আর বিপাশার মধ্যে। বিপাশা আপ্রাণ ইচ্ছেয় বিপ্লবী হয়েও হতে পারল না—শেষ জিৎ হল তার বাবা—দাদারই। শেষ পর্যন্ত সে বাবার জোরজুলুমের কাছে নতিস্বীকার করে বিলেতে পালাতে বাধ্য হয়েছে—এবং পাঁচ বছর ধরে আর ফিরে যেতে সাহস করেনি।

একদিকে পার্টি অন্যদিকে পুলিশ, আর ওদিকে জেলের মধ্যে সমীর স্বয়ং—কাকে ফেস করবে বিপাশা? বিপাশা বুঝে গেছে, সে দুর্বল। মধ্যবিত্ত সমাজে, ভারতীয় স্ত্রীলোকের যা যা দুর্বলতা থাকে, যার বিরুদ্ধে তাদের বিদ্রোহ—সে সমস্তের কাছেই হার মেনেছে বিপাশা নিজে।

পার্ক স্ট্রীটে ওদের ফ্ল্যাট বাড়িতে লিফটটা কক্ষনো ব্যবহার করতো না সমীর—চারতলা হেঁটেই উঠতো। এসব আধুনিক দশ বারোতলা ফ্ল্যাট বাড়ি তো নয়, ওদের ফ্ল্যাটগুলো সাহেবি দিনের লাকশারি ফ্ল্যাট, পাঁচতলা, বড়জোর ছ’তলা। সমীর, কি করলে তুমি বিশ্বাস করবে জানি না, বাবা আমাকে জুলুম করে বম্বে নিয়ে গিয়েছিলেন—আমি ইচ্ছে করে তোমাকে ছেড়ে যাইনি, সমীর।

লিফট নামলো না।

—’তুমি দাঁড়াও, আমি ওপরে গিয়ে লিফট নিয়ে আসছি। ফুলটা আমাকে দাও—’ বলেই টিউলিপের টবটা কেড়ে নিয়ে য়োহান দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে যায়।

বিপাশাও পিছন পিছন উঠতে শুরু করে।

য়োহান পিছন ফিরে তাকায়। ইশারায় দেখায়—’কথা নয়। পা টিপে টিপে!’

বিপাশা বেশ মজা পায় এতে। এত বড় একজন অধ্যাপক, সাহিত্য—সমালোচক হিসেবে দেশে যিনি এখন শ্রেষ্ঠ নামগুলির অন্যতম, তিনি এত সন্তর্পণে চলেন প্রতিবেশীদের ডিস্টার্ব করবার আশঙ্কায়। কতটা অন্যের প্রতি সচেতন ভাবনা থাকলে এটা হয়। যেমন কেউ কেউ লিফটের দরজা বন্ধ করে না, তেমনি কেউ কেউ আবার য়োহানের মতোও তো হয়।

ক’পাক উঠলো সিঁড়ি বেয়ে, বিপাশা গোনে নি। তার সামনে ভারী কালো কোট, ময়লা ব্লু জীনসের প্যান্ট, বগলে একটা ব্রীফ কেস, দুই হাতে ফুলন্ত টিউলিপের টব জড়ানো—দু’তিন সিঁড়ি বাদ দিয়ে দিয়ে লাফাতে লাফাতে উঠছে য়োহান, কিন্তু টেনিস শু—তে শব্দ হচ্ছে না।

সেই দীর্ঘ মূর্তির পিছু পিছু ক্ষুদ্র বিপাশা উঠছে, তবে লাফিয়ে নয়। সরু স্টিলেটো হীলের উঁচু জুতো তার, খুট খুট শব্দ হবেই—তাই জুতো খুলে হাতে নিয়েছে সে, নাইলনের মোজা পরা পায়ে আস্তে আস্তে উঠছে।

ডানদিকের একটা ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়ালো য়োহান। দাঁড়িয়েই টবটা কাঁখে নিয়ে পিছন ফিরে ফের ঠোঁটে হাত ছোঁওয়ালো—’চুপ!’

জুতো খুলে বিপাশাকে হয়তো আরো ছোট্ট দেখাচ্ছে মনে হতে বিপাশার নিজের একটু লজ্জা করলো। কখন যে ঘরে ঢুকে পড়ে জুতো দুটো পায়ে গলাবে! এগিয়ে গিয়ে টিউলিপের টবটা নিয়ে নিল য়োহানের হাত থেকে বিপাশা।

পকেট থেকে চাবি বের করে আবার খুঁজছে য়োহান। একটা এই অফিসের একটা সেই অফিসের, শেষ পর্যন্ত ঠিক ঠিক চাবি বেরুলো, নিঃশব্দে দরজা খুলে ধরলো সে—বিপাশা ঢুকে গেল অন্ধকার একটা সরু গলির মতো দালানে।

সিঁড়ির বাঁ দিকেও এমনিই একটা দরজা ছিল—তার কাচের ভিতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে, ওদের দালানে আলো জ্বলছে। অথচ এটা আঁধার। ভিতরে এসে অনেকক্ষণ ধরে আস্তে আস্তে চেপে দরজাটা বন্ধ করে দেয় য়োহান। পুরু কাচের দরজা।

পেতলের গা—চাবি। এবার আরেক প্রস্থ চাবি অনুসন্ধান। ভেতরে আবার একটা দরজা আছে। এই অন্ধকার দালানের আবার দু মুখে দুটো দরজা।

একটি দরজা খোলবার চেষ্টা করছে য়োহান। ওর আনাড়িপনা দেখে অবাক লাগে বিপাশার। এই কি মানুষের নিজের বাড়িতে ঢোকার ধরনধারণ? এ যেন অন্য কারুর ফ্ল্যাটে চুরি করে ঢোকা হচ্ছে। কাচের দরজা দিয়ে সিঁড়ির আলো আসছে, তার মধ্যেই চাবিটি খুঁজছে য়োহান, চাবি খোঁজার সময়ে খুব সাবধানে চাবির থলেটা চেপে ধরে থাকছে যাতে ঝঙ্কার না ওঠে—মহামান্য প্রতিবেশীর মূল্যবান নিদ্রায় যেন ব্যাঘাত না হয়। সেই উদ্দেশে আরো একবার ঠোঁটে তর্জনী দিয়ে বিপাশার বাকস্ফূর্তি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

নিঃশব্দে ঠোঁট টিপে হেসে যাচ্ছে বিপাশা য়োহানের কাণ্ডকারখানা দেখে। বাব্বাঃ। এ যেন নিষিদ্ধ সম্পর্ক স্থাপনের জন্য চোরা—অভিসারে আসা হচ্ছে। —এক বিবাহিত ভদ্রলোক তাঁর স্বগৃহে এক বিদেশী অতিথিকে নিয়ে আসছেন, চেকোস্লোভাকিয়া দেশের ঘরসংসার কেমন হয় দেখাতে—এর মধ্যে এত লুকোচুরি—হাশ—হাশ—চুপিচুপি কিসের? ষড়যন্ত্রকারীর মতো ভাব করবার কী আছে?

য়োহানের সবই অদ্ভুত। যখন লোকজন থাকে, তখন তো প্রেমের ঠেলায় প্রাণান্ত। আর এখন? এই নির্জনে—সে নিজেই ভয়ের ঠেলায় নিষ্প্রাণ হয়ে পড়েছে। এত ভয়টা কিসের? না—হয় ঘুমই ভাঙবে একটু প্রতিবেশীর। তাই বা কেন ভাঙবে? এতগুলো কাচের দরজা ভেদ করে শব্দের পক্ষে ঘরে ঘরে যাওয়া খুবই দুঃসাধ্য অভিযান হবে।

বিপাশার কেমন যেন মনে হয়, এই সব ইওরোপীয় দেশে এখনও কিছুটা স্তালিনরাজের সময়কার ষড়যন্ত্রী আবহাওয়ার চাপ রয়ে গেছে—অকারণেই ভয় পায় এরা। সেই বন্ধ—জানলা, নিশ্বাসে—উষ্ণ ছোট্ট গাড়িটার ভিতরের বাধ্যকরী শারীরিক নৈকট্য ওদের মধ্যে যে একটা ঘনিষ্ঠ আমেজ গড়ে দিয়েছিল, তা য়োহানের এই ভয়—ভয় আচরণে কেমন যেন ছিন্ন হয়ে গেল। বিপাশার মনে কোথায় একটু বেসুর বাজতে থাকে। অন্ধকার করিডর ফুটে ওঠে। বিপাশাকে ভেতরে টেনে নিয়ে একহাতে আস্তে আস্তে দরজা বন্ধ করে দেয় য়োহান। শব্দ হয় না।

এ কেমন অন্ধকার?

একবুক নিশ্বাসের সঙ্গে একরাত্রি তরল অন্ধকার টেনে নেয় বিপাশা। অদৃশ্য নতুন রংয়ের তাজা তীব্র গন্ধ ফুসফুসে প্রবেশ করে।

কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কোনো শব্দও নেই।

আশা—উদ্বেগের মাঝামাঝি একটা নাম—না—জানা অনুভূতি আচ্ছন্ন করে ফেলে বিপাশার স্নায়ু।

১১

কী আশ্চর্য! য়োহান কোথায়? আলোটা কেন জ্বলছে না? সারা ফ্ল্যাটে একটিও আলো জ্বলে না কেন, বাড়ির কর্তা বাইরে যখন? ফুলের টব একহাতে জড়িয়ে বিপাশাই আন্দাজে হাত বাড়ায়। দরজার ঠিক পাশেই সাধারণত আলোর সুইচ থাকার কথা। হাতে ঠেকেও সুইচ। আঃ—হাতের ডগায় নিশ্চিন্দিপুর। সব স্পষ্ট হয়ে যাবে এইবার। বিপাশা কাঁপা হাতে সুইচ টেপে।

আলো জ্বলে না।

—’য়োহান!’ অন্ধকারে ওর খুব চাপা স্বরটাও চীৎকারের মতো শোনায়।

—’ইয়েস, ডারলিং।’ খুব কাছেই উত্তর আসে।

—’আলো? আলো কোথায়? আলো কি জ্বলবে না?’

তৃপ্তি মিত্রের অভিনীত রানী সুদর্শনার মতো মরীয়া সুরে কাতরে ওঠে বিপাশা।

—’নো, ডারলিং।’ বলতে বলতে একহাতে লাইটার জ্বালায় য়োহান। তখন দেখা যায় তার অন্য হাতে একটা চায়ের পিরিচে গলে—যাওয়া আধখানা খুব মোটা মোমবাতি।

মোমবাতিটা জ্বালিয়ে য়োহান হাসে। আগের চেয়ে অনেকটা আলগা হয়ে এসেছে তার মুখের কঠিন হয়ে ওঠা রেখাগুলি। হেসে য়োহান বাতিটা মেঝেতে নামিয়ে রেখে বিপাশার হাত থেকে টিউলিপের টবটা তুলে নিয়ে মেঝেয় রাখে। তারপরে বিপাশার ওভারকোটটি সবিনয়ে খুলে নিতে থাকে।

—’ইলেকট্রিক বিল দেওয়া হয়নি বলে লাইন কেটে দিয়েছে!’ বলে নিচু গলায় হেসে ওঠে য়োহান। বিপাশার কোটটা নিয়ে দরজা খুলে ওয়ার্ডরোবে ঝুলিয়ে রাখে। নিজের কোটটাও খোলে।

সবুজ শার্টের তলার দিকে কেবল দুটো বোতাম লাগানো। মোমের আলোয় সেই খোলা বুকের ভেতর থেকে উঁকি দেওয়া লালচে চুলগুলো কিরকম যেন জান্তব দেখায়। গা শিরশির করে ওঠে বিপাশার।

সেটা চেপে দিয়ে নিজেকেই ধমকে ওঠে বিপাশা :

—তুমি কি একটা জন্তু? অন্ধকার আর খোলা শরীর দেখেই জেগে উঠলো?

মুখে বলে : ‘সে কি? ইলেকট্রিক বিল দাওনি বলে সত্যি সত্যি লাইন কেটে দিয়েছে? কেন, ওয়ার্নিং দেয় না তোমাদের?’

—’দিয়েছিল। আমি এখানে ছিলাম না তো, তাই দেওয়া হয়নি।’

—’বারে বা, তোমার স্ত্রী তো আছেন? তিনিও এই অন্ধকারের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন? বাচ্চাকাচ্চা সমেত?’

উত্তর না দিয়ে একটু হেসে ওয়ার্ডরোবটা বন্ধ করে দিয়ে জুতোমোজা খুলে, এক জোড়া নরম পশমের জুতো পায়ে দেয় য়োহান। আরেক জোড়া ছোট লাল পশমের জুতো এগিয়ে দিয়ে বলে—’এগুলো পরে নাও, আরাম পাবে।’

বিপাশার ইচ্ছে করে না অপরের জুতোয় পা গলাতে। সে বলে—’না, আমার খালি পায়ে বেশ লাগে।’

—’বেশ লাগবে না—ঘরে তো হিটার জ্বলবে না।’

—’কিন্তু ঠাণ্ডা তো নয়। সারা বাড়ি সেন্ট্রালি হীটেড, হয়ত সেই গরম আসছে।’

—’না, সম্ভবতই আসছে না।’

—’তবে কেন শীত করছে না?’

—’সেটা তোমার যৌবনের গুণ। অথবা আমারও হ’তে পারে।’—বলে এমন করে তাকায় য়োহান, বিপাশার সমস্ত শরীর সত্যি শুধু সেই দৃষ্টিপাতেই গরম হয়ে ওঠে।

আবার নিজেকে ধমক দেয় বিপাশা। কী হচ্ছে বিপাশা? হলো কী, তোমার?

মুখে বলে,—ফিসফিস করেই—

—’তোমার চেয়ে তোমার বউয়ের গুণ হওয়াই বেশি স্বাভাবিক। এখন তো তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন?’

পিছন ফিরে আলোটা তুলে ধরে য়োহান।

—’চল ঘরে যাই।’ বিপাশার হাত একহাতের মুঠোয় ধরে লম্বা লম্বা পা ফেলে। য়োহানের হাত ধরে পিছু পিছু যেতে যেতে হঠাৎ বিপাশার ইচ্ছে করলো পদক্ষেপ গুনতে—মনটা কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগছে।

—পাঁচ, ছয়, সাত, আট—

—’এইটে আমাদের বসবার ঘর।’

য়োহানের হাতের আলোয় বিপাশা তাকিয়ে দেখলো মাঝারি মাপের ঘর সম্পূর্ণ ফাঁকা। এককোণে একটি ছোট টী—পয়ে একটা এঁটো গেলাস আর একটি দেওয়ালের বেশ খানিকটা জুড়ে একটা কিছু পশমী রোমশ জিনিস টাঙানো কোনো জন্তুর ছাল। অন্য একটা দেওয়াল জোড়া ব্রাউন পেপারের মতো ক্যানভাসের পর্দা ঢাকা একটা বিরাট জানলা। সমস্ত ঘরে আর কিছু নেই। মেঝেয় অবশ্য সতরঞ্চি জাতীয় সস্তা কার্পেট। এই ঘর? এই বসবার ঘর? লোকে বসে কোথায়? আসন কই? চেয়ার টেবিল? সোফা—কৌচ?

—’দ্যাখো, এই ওয়াল—হ্যাঙিঙ্টা ভালো না?’ সেই লোমশ ছালের দিকে আঙুল তুলে দেখায় য়োহান।—’আমার পছন্দ। যুগোস্লাভিয়া থেকে নিয়ে এসেছি।’

বিপাশার ভয়ানক আশ্চর্য লাগতে থাকে য়োহানের এই সহজ ভাবটা। এইটেই যেন স্বাভাবিক—এই আসবাবহীন শূন্য ঘরের দেওয়াল—সজ্জা। সেই বিখ্যাত ছবি ‘অলিম্পিয়া’ মনে পড়ে যায় যেখানে পায়ের হীলতোলা জুতো দুটি নগ্না নারীর শায়িত নগ্নতাকে করে তুলেছে প্রকটতর।

বিপাশা না বলে পারে না—’ওয়াল—হ্যাঙিঙ না করে ওটা মেঝের পাতলে লোকে বসতে পারতো।’

—’যাঃ সে কি, অত ভাল জিনিসে কেউ বসে? বসুক না যার যেখানে খুশি।’

—কোথায়?’

বিপাশা ইওরোপের এই জন্তুর ছাল—প্রীতিটাকে মানতে পারে না কিছুতেই। কেমন যেন একটা বর্বরতা আছে এর মধ্যে, গুহা—মানুষজাতীয় আদিম পাশবিক রুচির ছাপ। ঘরের মেঝেয়, খাটের ওপরে যত্রতত্র এই লোমশ জন্তুর ছাল পেতে রাখাটা পশ্চিমে সুরুচির লক্ষণ!—পূর্ব ইওরোপে আবার দেয়ালে টাঙানোটাই ফ্যাশন দেখা যাচ্ছে। মেয়েদের ঘাড়ে—গলায় শেয়ালের ল্যাজ কিংবা মিংকের ছাল চামড়া জড়ানো—আর গায়ে চিতাবাঘের চামড়ার কোট চড়ানো—সবই খুব অমার্জিত, শ্রীহীন লাগে বিপাশারা। কীরকম একটা কুরুচি আছে, একটা নিষ্ঠুরতা আছে, সভ্যতার পরিপন্থী কী—একটা ইঙ্গিত আছে ওই জানোয়ারের ছাল গায়ে দেওয়ার মধ্যে।

ভস্মমাখা, জটাজুটধারী পশুপতি ভোলানাথের কোমরে যেটা খুব মানায়, ম্যানিকিওর্ড নোখ আর রংকরা মুখের নারীদের অঙ্গে সেইটে কখনো মানানসই হতে পারে? পশুর চামড়া জয় করার মধ্যে যে—জোরের পরিচয় মেলে—সেটা অবক্ষয়ী সভ্যতার ভুক্তাবশেষ।

নয়া সোসালিস্ট স্টেটে আর এসব থাকা উচিত নয়। ভাবতে ভাবতে বিপাশা অন্য কথা বলে—’কই, তোমার স্ত্রীকে বলবে না যে আমি এসেছি? বাচ্চাদের ঘুম ভেঙে যাবে, নইলে ওদেরও দেখতাম।’

এই কাঁপা কাঁপা মোমবাতির আলোয় দেওয়ালের বড় বড় ছায়াতেই রিক্ত ঘর ভরে গেছে—এই নিঃস্ব, শূন্য—আসবাব ঘরের একমাত্র সজ্জা এই মৃত পশুর চামড়া।

সত্যি খুব বিশ্রী লাগে বিপাশার। মনে হয় এটা যেন একটা গুহা। ভূতের ভয়ে যেমন লোকে রামনাম বলে, তাড়াতাড়ি সে তেমনি শিশুদের প্রসঙ্গ তোলে—যা জগতের সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে পবিত্র বিষয়! যেন তা এই পশু—প্রসঙ্গের নিষ্ঠুরতা ঢেকে দেবে।

—’বাচ্চাদের, না হলে বুড়ো মানুষদের ভাল করে না দেখলে একটা দেশকে ঠিক চেনাই হয় না।’

উত্তর না দিয়ে য়োহান মোমবাতি নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

পিছু পিছু বিপাশাও।

অন্য একটি ঘরে ঢুকে আলোটা উঁচু করে ধরে সে। দেওয়ালে একটি লাল—নীল—হলুদ, খুব চড়ারঙের মস্ত পোস্টার। সৈনিকদের মার্চ করে চলা, মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে আছে—লেখাগুলি বোধগম্য হল না, কেবল চেকোস্লোভাকিয়াটুকু বুঝল বিপাশা। ছোট ঘর। একটা দেয়ালে। ঐ পোস্টার অন্য দেয়ালে দুটি সিংগল খাট—বাংক বেড। নিচে—ওপরে। একটি সিঁড়িও আছে। সৈনিকদের মতোই ব্যবস্থা। খাটে গদি আছে, চাদর নেই।

—’এটা আমার বাচ্চাদের ঘর।’

—’কোথায় তারা? খাট তো খালি!’

—’তারা এখানে নেই।’

—’উইক—এনডে বেড়াতে গেছে বুঝি?’ বিপাশা খাটের দিকে তাকায়, বেডকভার, বালিশ, চাদর, কম্বল—কিছুই নেই। নগ্ন গদি। মৃতদেহ তুলে নিয়ে যাবার পরে খাট যেমন দেখায়।

—’না। উইক—এনডে নয়। মামাবাড়িতে গেছে। হাঙ্গারিতে।’

—’সে কি? একা একাই?’

—’না। তাদের মায়ের সঙ্গে।’

—’মায়ের সঙ্গে মানে? তোমার স্ত্রী বাড়িতে নেই?’

—’আমার স্ত্রী চেকোস্লোভাকিয়াতে থাকতে ভালবাসে না, বিপাশা!’

—’হাঙ্গারি বুঝি চেকোস্লোভাকিয়ার চেয়ে ভাল জায়গা? এখন? ১৯৫৬ সালের পরেও?’

—’চুপ চুপ—বিপাশা, তুমি বড্ড এলোমেলো কথা কও। ওসব কথা এখানে তুলো না। কে কোথায় কি শুনতে পাবে—! আসল কথা হাঙ্গারিতে বুদাপেস্টটা আছে তো। সেটা তো একটা বড় শহর। আমার স্ত্রী সেই বড় শহরের মেয়ে। সেখানে ওর একটা সাংস্কৃতিক জীবন আছে। এই ছোট্ট শহর নীত্রাতে সে হাঁপ ফেলতে পারে না।’

—’ব্রাটিস্লাভাতে থাকো না কেন তোমরা?’

—’সেও এমন কিছু জায়গা নয়। হ্যাঁ, বড় শহর প্রাহা। কিন্তু আমার কাজ তো প্রাহাতে নয়।’

—’স্ত্রী নেই, আমাকে সেকথা তুমি বললে না কেন য়োহান? আসার আগে?’

—’বলবার কি সুযোগ দিল মিরকো?’

—’মিরকো তোমার স্ত্রীকে পছন্দ করে বলে মনে হলো না। কাউন্টেস বলে খোঁটা দিল।’

—’কথাটা খুব ভুল বলেনি মিরকো। ও তো পাগলা আছে, পটাপট সত্যি কথা বলে দেয়। সেটাই তো মুশকিল মিরকোকে নিয়ে।’

—’ওকে তুমি বললে না কেন, যে তোমার স্ত্রী হাঙ্গারিতে? তার অসুবিধেটা কী ছিল?’

—’বিপাশা, তুমি নিজেই ভেবে দ্যাখো তো, কেন বলিনি?’

—’আমি ভাবতে পারছি না।’

—’চল আগে অন্য ঘরগুলো দেখিয়ে আনি।’ য়োহান বেরিয়ে আসে। আবার বিপাশার হাত নিজের হাতে তুলে নেয়। কিন্তু এবারে যেন সব কিছু পাল্টে গেছে। বিপাশার হাতটা ভিজে ভিজে হয়ে ওঠে। ওর ইচ্ছে করে হাত ছাড়িয়ে নিতে। কিন্তু নেয় না। অন্য একটা টানে হাতটা যেন আপনা আপনি আটকে থাকে।

—’য়োহান।’

—’বলো, ডারলিং?’

—’তোমার মা—ও তো এখানেই থাকেন। তাই না?’

—’তা থাকেন। এটা মারই ঘর। যেখানে তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি।’

একটা দরজা খুলে দেয় য়োহান। এ ঘরে একটি খাট। খাটে লাল, ভারী ওজনের ক্যান্ডলস্ট্রিক— চাদর বিছোনো। বালিশটালিশ অবশ্য দেখা যায় না, চেকোস্লোভাকিয়ার খাটের ধারেই লুকোনো দেরাজ থাকে, তাতে ভরা থাকে বালিশ, কম্বল! খাট সর্বদাই ডিভানের মতো পরিপাটি। ফাঁকা শাদা দেয়ালে কোনো ছবি নেই। একটি টেবিল একটা চেয়ার আছে এঘরে। টেবিলে অনেক কাগজপত্র রাখা ট্রে—তে। এ—ঘরে যে জ্যান্ত মানুষ বাস করে, তা মনে হয়। কিন্তু এ—ঘরেও আপাতত কোনো বাসিন্দা নেই।

—’মা কোথায়?’

—’প্রাহা গেছেন। মাকে মাঝে মাঝে ঘোরাঘুরি করতে হয়। শিক্ষা বিভাগে কাজ করেন।’

—’কে—উ নেই বাড়িতে?’ বিপাশার গলায় একটা ভয়—ভয় ছায়া—ছায়া হু হু করা স্বর ফোটে,—যেন রাত্রির প্রান্তরের ওপর দিয়ে বাতাস বয়ে যায়।

—’তাতে কি তোমার ভয় করছে, বিপাশা?’ য়োহান হাতটি ঘিরে আনে বিপাশার কাঁধের ওপর দিয়ে।

বিপাশার শরীরে একটা চাপা কাঁপুনি স্রোতের মতো বয়ে যায়, পায়ের আঙুলের ডগায় পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।

বিপাশা বলে, ‘আমি তো একটা পূর্ণ সংসার দেখতে চেয়েছিলাম, এমনি একটা শূন্য বাসা, দেখতে চাইনি’।

—’আমি তো সেই জন্যেই তোমাকে ডেকে আনিনি বিপাশা। আমি তোমাকে ঠকাতে চাইনি। পরিস্থিতি শেষটা এমনই হোলো যে আমাদের সেটা থেকে বেরুনোর উপায় ছিল না।’

—’কেন? কেন ছিল না পথ? তুমি বললেই পারতে মিরকোকে—এখন তোমার স্ত্রীপুত্র, মা কেউই শহরে নেই। আমাকে ওরা নামিয়ে দিত হস্টেলেই সোজাসুজি। এখন আবার এই বৃষ্টির মধ্যে তোমাকে বেরুতে হবে মিছিমিছি।’

—’সেটা কিছুই নয়। তুমি যে দয়া করে এসেছো বিপাশা, আমার এই শূন্যবাড়ি যে কয়েক মুহূর্তের জন্যেও তোমার পায়ের ছোঁওয়ায় তোমার গায়ের সৌরভে ভরে উঠেছে, সেটা কি আমার কাছে একটা প্রাপ্তি নয়? বরং তুমি বলতে পারো, এই বৃষ্টির মধ্যে এই খালি বাড়িতে তোমাকে টেনে আনাটা আমার স্বার্থপরতা হয়েছে। তোমাকে বৃষ্টিতে হাঁটতে হবে। কাল অনেকদূর যাবে তুমি। হ্যাঁ, আমারই ওপরে বরং তুমি রাগ করতে পারো।’

—বলতে বলতে বিপাশার ছোট্ট হালকা শরীরটাকে নিজের মধ্যে নেয় একটুক্ষণের জন্যে য়োহান, ওই একহাতেই—অন্য হাতে সে মোমবাতির পিরিচটা ধরে আছে।

ওরা যে ঘরটায় এসে ঢুকল এবারে, সে ঘরের মেঝে ভর্তি সংসারের হরেকরকম জিনিসপত্র ছড়ানো—বড়বড় কার্ডবোর্ডের বাক্স, সব মাল বোঝাই—এখনো আনপ্যাকড হয়নি। কিছু কিছু খোলা এলোমেলো পড়ে আছে।

—’ওই দেখো, ওই যে আমার সংসার!’ কার্ডবোর্ডের বাক্স উপচে মাটিতে পড়ছে পোশাক, জুতো, বই, রান্নার বাসন—এক আশ্চর্য মানুষ বটে য়োহান।

—’এইটা আমাদের মাস্টার—বেডরুম। বুঝেছ? আমার এবং আমার কাউন্টেস—পত্নীর শয়নকক্ষ।’

ঘরটাতে কিছুই নেই। গুদোম ঘর। এক দেওয়াল ভর্তি টানা ক্যানভাসের পর্দা ঝুলছে। বোঝা গেল ওটা একটা বিশাল জানলা, পিকচার উইনডো। বসবার ঘরেও একটা দেয়ালভর্তি এই রকম চওড়া পর্দা ছিল।

—’কিন্তু এসবই তো সাময়িক বন্দোবস্ত। এই সব পর্দা তো থাকবে না? না?’

—’কেন থাকবে না?’ য়োহান অবাক হয়ে বলে।

ব্রাউন পেপারের মতো দেখতে ক্যানভাসের পর্দার দিকে আরো আরো অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে বিপাশা। ওর মনে পড়ে রেস্তরাঁয় দেখা দামী ভারী পর্দা, মনে পড়ে একটু আগেই দেখা য়োহানের অফিসে ভারী স্যাটিন ধরনের ট্যাপেস্ট্রী কাপড়ের পর্দা।

য়োহান বুঝতে পেরে বলে—’এগুলো থাকবে, আবার ভেতর দিকে ভালো পর্দাও লাগানো হবে। এসব মায়ের ডিপার্টমেন্ট। ওসব আমি দেখি না।’

—’মায়ের? তোমার স্ত্রী দেখেন না?’

—’স্ত্রী তো ব্রাটিস্লাভার ফ্ল্যাটটা সাজিয়েছে। সেটা দেখলে তোমার মাথা ঘুরে যাবে। ভীষণ লজ্জা করে আমার। আমার স্ত্রী কিছুতেই বোঝে না।—একদম বুর্জোয়া স্টাইলে—বুর্জোয়া কি, ফিউডাল স্টাইলেই বলব—সাজানো সেই ফ্ল্যাট। তার অনেক নিজস্ব সম্পত্তি নিয়ে এসে সেইখানে লাগিয়েছে সে। এটা আমার মায়েরই ফ্ল্যাট। মা তো কাউন্টেস নন, স্কুলটিচার। এটা প্রলেটারিয়েট ফ্ল্যাট।’

—’তোমার মায়ের একটা ফোটো দেখাবে?’

—’ফোটো? হঠাৎ?’

—’এমনিই।—তোমার স্ত্রীপুত্রদের ফোটো নেই?’

—’থাকবে না কেন। এ্যালবামে নিশ্চয় আছে। কিন্তু এ্যালবামটা এখন কোন বাক্সোতে আছে—’

বিপাশা সামনে তাকিয়ে দ্যাখে অন্তহীন বাক্সো। কিছু বন্ধ, কিছু আধাখোলা। যেন একটা ইস্টিশানের প্লাটফর্মে মালগাড়ি খালাস হচ্ছে। মুখটা ঘুরিয়ে উপর দিকে তুলে য়োহানের মুখের দিকে তাকায় সে।

য়োহান বলে—’দাঁড়াও! ওইখানে দু’একটা ফোটো থাকতেও পারে।’ বলে একটা ছোটো বক্সফাইল জাতীয় বাক্স ঘাঁটতে লেগে যায় এক হাঁটু মুড়ে মাটিতে বসে পড়ে।

বেরোয়ও।

একটি নয়, তিন—চারটি ছবি। রঙিন। একটি অহংকারী, বছর পঁয়ত্রিশের রূপসী, কোলের কাছে দুটি অত্যন্ত অহংকারী চেহারার শিশুপুত্র—ঠোঁট টিপে হাসছে তারা—মিলিটারি কায়দায় শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে। একটি শাদা চুল বৃদ্ধা, আরো কয়েকটি মানুষের সঙ্গে দাঁড়িয়ে হাসছেন।

য়োহান তর্জনী দেখালো—’আমার মা, তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে।’

বৃদ্ধাকে বেশ ভালো লাগলো বিপাশার। আরেকটি ছবি—ওই অহংকারী নারীটির সঙ্গে দুটি নারীপুরুষ—তিনজনেই খুব রিল্যাকসড, খুব হাসছে। পিছনে পটভূমিতে ওটা কি? আকাশে নোতরদাম গির্জের পদ্ম—জানলা না? বিপাশা বলে ওঠে—

—’একি, এটা ঠিক নোতরদামের মতো যে—চেকোস্লোভাকিয়াতে কোনো নকল আছে নাকি?’

—’ওটা নোতরদামই।’

—’বাঃ তোমার স্ত্রী বুঝি প্যারিসে গিয়েছিলেন?’

—’গিয়েছেন। এখন তিনি সেইখানেই। এ ছবি অবশ্য গতবছরের। ওর কোন ভগ্নিপতির সঙ্গে তোলা। প্যারিসেই থাকে।’

—’প্যারিসে? তবে যে বললে ওঁরা হাঙ্গারিতে গেছেন?’

—’বিপাশা, প্রশ্ন কোরো না, প্লীজ প্রশ্ন কোরো না। আমি তোমার কাছে সব সত্যি কথা বলছি। স—ব। তুমি কিন্তু বেচকাকে এসব খবর্দার বলবে না, কাল যখন দেখা হবে। এগুলো ভীষণ গোপন কথা। ভয়ংকর দামী গোপনীয়তা আমার।’

—’কেন, প্যারিসে যাওয়া বুঝি নিষিদ্ধ?’

—’ঠিক বুঝবে না তুমি। নিষিদ্ধ বলে কিছু নেই—অথচ নিষিদ্ধ অনেক কিছুই। আমার স্ত্রী তো প্যারিসে যায়নি। গেছে হাঙ্গারি। সেখান থেকে প্যারিসে পালিয়েছে।’

—’পালিয়েছে? তার মানে?’

—’সব বলব তোমাকে, সব বলব বিপাশা, আমার লক্ষ্মীমেয়ে, সোনামেয়ে, ছোট্ট মেয়ে মিরকো ঠিকই নাম দিয়েছে তোমার—সবুজ ঘাসফড়িং। এখন থাক, কেমন? একটু পরে হবে ওসব কথা।’

বিপাশা কেমন ভয় পেয়ে যায়। য়োহান ওকে হঠাৎ দুহাতে জড়িয়ে ধরেছে। মোমবাতিটা রেখে দিয়েছিল মেঝেতে ছবি খোঁজবার সময়েই। দুজনে মাটিতে আধোবসা হয়ে ছবি দেখছিল। য়োহান ওকে ছড়িয়ে ধরে আচমকা মেঝেয় শুইয়ে ফেলেছে। য়োহানের শার্ট খোলা। ওর শরীরের খুব কাছে য়োহানের লোমভরা বুকের চামড়ার গন্ধ।

বিপাশার সমস্ত দেহে হঠাৎ প্রস্তুতির সাড়া পড়ে যায়। কেউ কোথাও একটা জরুরি সিগন্যাল নামিয়ে দিয়েছে। এবার ট্রেন আসবে—মেল ট্রেন। দূরের গুমটিতে ঘণ্টি বাজছে, ঘণ্টি বাজছে, লাইনে কান পাতলেই শোনা যাবে ট্রেনের চাপা ঝমঝম শব্দ—

সমীর দেখে যাও। তোমার সম্পত্তির কী হাল!

সমীর বলত—”একটা বিষয়ে আমি বাবা পুঁজিবাদী। তোমার ব্যাপারে। তুমি আমার সম্পত্তি। আমার প্রাইভেট প্রপার্টি।”

ঘন হয়ে আদর করতে করতে সমীর বলত—”এই মেয়েটার জন্যে আমার আর পুরোপুরি কম্যুনিস্ট হওয়া হল না।”

সমীর, আমি তোর যোগ্য ছিলাম না রে। আমি একটা ফুরফুরে ফড়িং। একটা ঘাসফড়িং। মিরকো যেমন বলেছে। এই দ্যাখ আমার নেমকহারামী। এই দ্যাখ আমার নেমকহারাম শরীরে কেমন কাঁটা দিয়েছে—কেমন নেচে উঠেছে ধমনীর ভেতরে গরম গরম রক্ত—ঠিক যেমনটি হত তোর ছোঁওয়া পেলে। দ্যাখ রে সমীর—শরীরটা একটা বুনো জানোয়ার—পোষ মানে না—যখন যে—বনের তখন সেই বনেরই।

একটা মখমলের মতো মোহের নরম গদির মধ্যে ডুবে যেতে যেতে নিজেকে জোর করে টেনে তোলে বিপাশা। দুই হাতে জোরে ঠেলে দেয় য়োহানের বুক—য়োহানের ঠোঁট খুব বেশি কাছে চলে এসেছিল—এবারে সরে যাক, দূরে সরে যাক—

—’আমার তেষ্টা পেয়েছে, য়োহান। উঃ কি গরম এখানে।’

বিপাশাকে মুক্তি দিয়ে য়োহান উঠে পড়ে। ডান হাতটি বাড়িয়ে দেয়, বিপাশাকে তুলবে বলে। বিপাশা উঠে দাঁড়ায়।

১২

নিচু হয়ে মোমবাতিটা তুলে নিতে গেল বিপাশা—হঠাৎ আঁচলের ঝাপটাতেই বোধহয়, মোমবাতিটা নিবে গেল। আবার গভীর নিরালোকে সহসা নিক্ষিপ্ত হল সময়—বিপাশা—য়োহানকে বুকে নিয়ে।

বিপাশা ভয়ার্ত, চেঁচিয়ে ওঠে—’য়োহান?’

—’এই তো, ডারলিং।’ ফস করে লাইটারটা জ্বলে ওঠে।

—’দেখি, বাতিটা দাও।’

মোম নিয়ে এগিয়ে যায় য়োহান, আপন মনে বলে—’কি জানি কী পানীয় আছে ঘরে—কিছু আছে কিনা! এটা তো কোনো সংসার নয়!’

—’শুধু একটু জল পেলেই হবে। জল নেই?’ বিপাশা ভয়ে ভয়ে বলে।

—’জ—ল আছে। বাঃ, জল থাকবে না কেন? বাথরুম—রান্নাঘর নেই?’

—’কি জানি! ভাবলাম যদি কনেকশন কেটে দিয়ে থাকে? আমি কিছু বুঝতে পারছি না তোমাদের ব্যাপার—স্যাপার। সোস্যালিস্ট স্টেটের।’

—’দূর পাগলি। ইলেকট্রিক বিল না দিলে ক্যাপিটালিস্ট দেশেরও কনেকশন কেটে দেয়। তোমাদের দেয় না?’

—’দেবার কথা অবশ্য। দেয় কিনা আমি জানি না।’

—’তুমি জানবে কি করে। তুমি তো বড়লোকের মেয়ে।’

—’কেমন করে বুঝলে? শাড়ি দেখে? ও থেকে কিছুই বোঝা যায় না?’

—’এইটে আমাদের রান্নাঘর।’ লম্বাটে ঘরটা খুব ছোট নয়। এক দেয়ালের গায়ে একটি ছোট চৌকো টেবিলের দুদিকে দুটি চেয়ার পাতা। টেবিলে নুন মরিচের পাত্রের সঙ্গে একটি ছোট সরুগলা কাচের ফুলদানি—তাতে প্লাস্টিকের পুষ্প—পত্র। বিপাশার মনটা একটু ধাক্কা খায়। তারপরেই খেয়াল হয়—’এটা কোন সংসারই নয়।’ অন্য দেয়ালের গায়ে জোড়া—কলওলা সিংগল সিংক, মাঝারি ফ্রিজ, উনুন। কল খুলে হাত পেতে দেয় বিপাশা। ঠাণ্ডা জল। আঃ।

—’এই যে।’ য়োহান একটা গ্লাস এগিয়ে দিয়েছে। বিপাশাই জলপান করে তৃপ্তি পায়। অন্য কলটা খুলে হাত পাতে—একটু পরেই গরম হয়ে ওঠে জল।

—’তবে যে বললে বিদ্যুৎ কনেকশন নেই?’

—’এটা অন্য লাইন। বাথরুমেও গরম জল আছে। আমি তো স্নান করে নেব এখন। তুমি স্নান করবে?’

—’স্নান! স্নান কেন করব?’

—’না, এমনিই বলছিলাম। যদি চাও। বাথরুমটা ঠিক ওপাশটায়। এই ঘরেরই আধখানা।’ বলে আঙুল দেখায় য়োহান।

উৎসাহভরে সেদিকে যায় বিপাশা। একটি ছোট ল্যাভেটরি। তার দরজা বন্ধ করা যায়। আর একটি ছোট স্নানঘর—তাতে অদ্ভুত একটা বড় গোল গামলার মতো বেসিন জাতীয় দ্রব্য—ওটাই বাথটব বলে সন্দেহ হয় বিপাশার। তার গায়ে দুটো কল, আর একটা শাওয়ারের নল ঝুলছে। চারপাশে পর্দা টেনে দেওয়া যায়। প্লাস্টিকের ভারী পর্দা রয়েছে। আর রয়েছে বাথ—সোপ—মস্ত বড় শাদা একটা সাবান। বিরাট এক তোয়ালে। নিচে পাতা বাথ—ম্যাটও।

—’বাথরুম সন্দর্শন হল?’ য়োহান প্রশ্ন করে, ‘স্নান করে দেখবে নাকি?’

—’না না। অন্যের বাড়িতে স্নান করব কি?’

য়োহান হঠাৎ হেসে ওঠে—’বা রে? অন্যের বাড়িতে বাথরুমে যায় না লোকে? ল্যাভেটরি ব্যবহার করে না? তাতে দোষ নেই, আর স্নান করলেই দোষ?’ হেসেই চুপ করে যায় য়োহান। ‘ইশশ, বড্ড জোরে হাসা হয়ে গেল। তুমি যা জ্বালাও আমাকে! না হেসে পারি না।’

—’জোরে হেসেছ তো কী হয়েছে? পড়শীরাও নিশ্চয় হাসে? এতে দোষটা কোথায়? এই হাশ—হাশ চুপ—চুপ ব্যাপারটা একদম ভালো লাগছে না আমার।’

এ বাড়িতে ঢুকে অবধি এই বিপাশার চলেছে। স্টিলেটো হীল বলে জুতো খোলা দিয়ে যার শুরু। তারপর ফ্ল্যাটে ইস্তক বাচ্চারা ঘুমোচ্ছে ভেবে ফিসফাস করেছে বিপাশা। কিন্তু এখন যখন জানা কথা যে পুরো ফ্ল্যাটে আর জনমনিষ্যি নেই—তখন ফিসফাসের কী আছে? ‘পড়শী—পড়শী করে বাতিকগ্রস্ত হয়ে পড়বে তুমি য়োহান। পড়শী তো জগতে সর্বত্রই আছে।’

মোমবাতিটা একদম ক্ষয়ে প্লেটের সঙ্গে প্রায় মিশে এসেছে। য়োহান হাত লম্বা করে ফ্রিজের দেয়ালের উঁচু তাক থেকে একটা কী যেন পেড়ে আনে। মোমবাতি। এইটে থেকেই সেটা ধরিয়ে নেয়। পিরিচে আধার দীর্ঘায়িত দীপ্তি। ‘হাউ রোমান্টিক!’ বলে চোখ মেরে চাপা গলায় রগুড়ে হাসি হাসে য়োহান। টেবিলে আলোটা রাখে।—’আ ক্যানডল লাইট ইভনিং ফর টু। এবং গোলমালটি সেইখানেই। পড়শীরা যদি জানতে পারে তোমায় ফ্ল্যাটে এনেছিলাম, তবেই হয়ে যাবে।’

—’সে কি?’

—’আমাদের সোশ্যালিস্ট দেশের সেকশুয়াল মরালিটিটা একটু প্রুডিশ।’

—’মানে? সে তো পেটি—বুর্জোয়া মনোবৃত্তি। সোশ্যালিস্ট স্টেটের উপযোগী মনের তো তা হবার কথা নয়।’

—’কী যে হবার কথা, আর কী যে হবার কথা নয়, অতশত কিছুই কেউ জানে না ভাই—কী হয়, কী হয়ে থাকে, শুধু সেটাই স্থির জানি। এখানে নিন্দে রটে ঠিক খড়ের ঘরে আগুনের মতো। আর নিন্দের বেশ হানি করার শক্তিও আছে। আমি তো এই চ্যাপ্টারের জরুরি পার্টি—অফিস হোল্ড করি। আমাকে খুব সাবধানে খুব সন্তর্পণে থাকতে হয়।’

বলতে বলতে য়োহান কাসুন্দির মতো কী একটা শিশি খুলছিল। খোলা হাতে বড় চামচে মেপে সেই অর্ধতরল বস্তুটি গ্লাসে ঢালল, এবং কলের তলায় ধরে ঠাণ্ডা জল মেশাল তাতে। কথা শেষ হতে হতেই কাজটিও শেষ, গ্লাসটা বিপাশার সামনে এনে রাখে।

—’সরি, বরফ নেই। তবে জল ঠাণ্ডাই।’

—’কী এটা?’ হলদে রংয়ের শরবৎটা হাতে নিয়ে বিপাশা বলে।

—’কিছু না। একটু কমলার রস বানিয়েছিলাম। অরেঞ্জ কনসেনট্রেট থেকে। বাড়িতে না আছে ছাই একটাও মদ, না আছে একটাও সফট ড্রিংক। ফ্রিজটাও শূন্য।’

বিপাশার ‘অরেঞ্জ কনসেনট্রেট’ শুনেই পান করার ইচ্ছে ভাগলবা। এ যেন ওষুধ গেলা। তবু একটা চুমুক দেয়। না মন্দ না। তাজা করলাম রসের মতোই স্বাদু।

—’তুমি খাবে না?’

—’ওসব কমলার রস—ফস আমি কোনোদিন খাই না বাবা। আমি হলাম হার্ড—লাইনার। বুঝলে খুকি?’

—’বুঝলাম। তাহলে আমি একাই খাব?’

—’তোমারটা থেকেই মাঝে মাঝে আমাকে দিও বরং।’

বলতে বলতে টেবিল থেকে গ্লাসটা তুলে চুমুক লাগায় য়োহান।

বিপাশার ঘেন্না করে। এটাও তার অভ্যেস হয়নি। না, পশ্চিমের অনেক কিছুই ভেতরে নেয়নি এই ইন্দো—অ্যাংলিয়ান পোয়েট মজ বিপাশ রায়চৌধুরী।

সমীর, তুই আমাকে যতখানি মেম ভাবিস ততটা মেম আমি না রে। মেম ইস্কুলে পড়েছি বলে আমার বাংলাটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু সংস্কার ধ্বংস হয় না রে। এঁটো খেতে আমার ঘেন্না করে—হাফ মেমে তোমার বিপাশার এখনও ঘেন্না করে। অথচ তোমার সঙ্গে ভাগ করে কতদিন চা খেয়েছি, কত কফি, কত, কত, কত—? তখন তো কই ঘেন্না করেনি? সমীর—তখন তো আমার ঘেন্না করতো না? অথচ তুমি তো সরসুনার বাংলা ইস্কুল থেকে পাশ করা বাড়িতে কাচা ছিটের শার্ট আর ময়লা পাজামা পরা গরীব রোগা একটা ছেলে—যতই স্কলারশিপ থাকুক না তোমার, যতই প্রেসিডেন্সিতে সর্দার হয়ে ওঠো না তুমি—তুমি তো আসলে তা—ই তবুও তোমাকে তো ঘেন্না করিনি? অথচ য়োহানকে—

—’তুমি ওটা খাও, আমি চট করে স্নানটা সেরে আসি? বলতে বলতে গা থেকে শার্টটা টেনে খুলে ফ্যালে য়োহান।

কানের ওপর হঠাৎ একটা থাপ্পড় খাবার মতো ঝাঁ করে ওঠে বিপাশার মাথার ভেতরটা। ক্রুড সেক্স—অ্যাপীল কথাটা কেবল স্ত্রী—প্রসঙ্গেই শোনা যায়, আর পুরুষ—প্রসঙ্গে হলিউডের ছবিতে কিছুটা দেখা যায়—হঠাৎ ব্যাপারটার প্রকৃতি বিপাশার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ভিক্টর ম্যচিওর কি জন ওয়েন টাইপ নয়, কিন্তু পেশীবহুল টানটান মেদবর্জিত শরীরটায় য়োহান যেন বিদ্যুৎশক্তির মতো কিছু একটা জমিয়ে রেখেছে। ইচ্ছে করলেই বিচ্ছুরণ ঘটাতে পারে সে। কিংবা বিস্ফোরণও। য়োহানের অন্যমনস্ক এলোমেলো সাজপোশাকে এই ব্যাপারটা মোটেই বোঝা যায় না বাইরে থেকে।

বিপাশা মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে। সমীরের রোগা বুকটার কথা তার আর মনে পড়ে না। য়োহান লক্ষ্য করলে কী মনে করবে সেটাও তার খেয়াল হয় না।

য়োহান অবশ্য লক্ষ্য করে না। শিস দিতে দিতে বাথরুমের দিকে চলে যায়—যেতে যেতে বলে—’ওন্ট বি আ মিনিট ডারলিং—জাস্ট টু ক্লীন মাই সেলফ আপ—’

আশ্চর্য, আর সময় পেল না? এখনই? অতিথিকে একা বসিয়ে রেখে মাঝরাত্তিরে পরিচ্ছন্নতার সাধনা করতে হবে? আচ্ছা মানুষ বাবা য়োহান। বিপাশা ভাবে।

তবে একটা পার্থক্য, চোখে না পড়েই উপায় নেই—বাইরে, সভা—সমিতিতে, রেস্তরাঁয়, পার্টিতে সে এতক্ষণ যে য়োহানকে দেখেছে—এই অট্টালিকাটিতে ঢোকার পর থেকে সেই য়োহান আর নেই। সেই য়োহানের সর্বাঙ্গে জড়ানো ছিল একটা বেপরোয়া ব্যক্তিত্ব—সে হাহা করে হাসে—না—ভেবেচিন্তে বদরঙা রসিকতা করে বসে—বনস্থলীর বুকে জমাট বরফের ওপরে লতাপাতার পতাকা ওড়ায়—সে য়োহান ঘরে ঢুকলে ছাত্রছাত্রীদের চোখে মুখে ঠিকরে পড়ে সম্মান। যুবতীদের সঙ্গে খোলা মনে বিনা দ্বিধায় যা খুশি রঙ্গরসিকতা করে সেই য়োহান। বাড়িতে ঢোকার মুহূর্ত থেকেই সে যেন ভয়ে কাঁটা। আগে যাকে মনে হয়েছিল খোলাখুলি—তারই মধ্যে ঢাকাঢুকির অন্ত নেই।

কেন মিরকো জানে না যে তার বউ এখানে নেই, সন্তানরাও নেই? কেন মিরকোকে ও বলল না যে মা—ও নেই? সংসারটা এখনও গোছানোই হয়নি।

পরে বলবে বলেছে—আসুক স্নান করে। এলেই বলতে হবে। কমলার রসে চুমুক দিতে দিতে বিপাশা ভাবে। কে য়োহান? কোনটা আসল য়োহান কোনজন?

১৩

সরসুনাতে সমীরদের এক আত্মীয়ার বাড়িতে সমীর ওকে একদিন নিয়ে গিয়েছিল, ওদের ওখানেও বিদ্যুৎ ছিল না। লণ্ঠন জ্বলছিল। একটা মাদুর পেতে চৌকির ওপরে শুয়ে ছিলেন এক বৃদ্ধা। ফাটা চেরা গলায় কেবলই বলছিলেন, ‘কেডা? আমি কেডা?’

সমীরের মাসীমা তাঁকে আকুলকণ্ঠে বলেছিলেন—’কেন মা, আপনি তো ব্রজসুন্দরীমা, আপনি তো আপনার রাজাগোপাল আর ব্রজগোপালের মা—’

বৃদ্ধা বললেন—’রাজাগোপাল কেডা? ব্রজগোপালই বা কেডা?’

—’কী? আপনার রাজা—ব্রজকে চিনতে পারছেন না মা?’

মাসিমার কণ্ঠে একটা অস্থির ভয় চমকে উঠেছিল। হাঁটু আঁকড়ে বসেছিল তাঁর দুই নাতিনাতনী। তাদের মুকে টেনে নিয়ে প্রৌঢ়া মাসিমা বলেছিলেন—’রাজা—ব্রজ আপনার দুই ছেলে, যে, মা?’

—’কার ছেইলা? আমি জানি না’—বৃদ্ধার গলা আবার অন্ধকারকে দীর্ণ করেছিল।

—’কেডা? আমি কেডা?’

—’আপনি ব্রজসুন্দরী।’

—ব্রজসুন্দরিটা আবার কেডা? কাদের বউ?’

—’ভগবান শ্রীহরি। ভগবান শ্রীহরি। পরম শত্রুরও যেন এমন দশা না হয় ঠাকুর।’ হঠাৎ দুই হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে সমীরের মাসীমা কান্নাধরা গলায় বিড়বিড় করেছিলেন।

বিপাশার সমস্ত শরীর দিয়ে ঢেউ খেলে গিয়েছিল একটা বিজাতীয় ভয়।

সেদিনই বেহালায় একটা পুলিশের সংঘর্ষে গোটা তিনেক ছেলে খুন হয়েছে, বিপাশা এনেছিল কিছু রসদ,—ওই মাসীমা নির্ভীক ভাবে আশ্রয় দিয়ে সাহায্য করেছিলেন ছেলেদের, সমীর বাদল দেবুদের জন্যে ওঁর দরজা সব সময়েই খোলা ছিল।

চোখের সামনেই একমাত্র সন্তানটি খুন হয়ে গেছে, তারই বিধবা বউ আর দুটি শিশু নিয়ে মাসিমা একা একা যুদ্ধ করে চলেছেন।

সেই মাসিমার হৃদয়ে অদ্ভুত একটা ভয়ের পদক্ষেপ শুনেছিল সেদিন বিপাশা। বৃদ্ধার সেই আকুল—’আমি কেডা?’ শুনলে সত্যিই ভয়ে বুকের অন্তস্তল পর্যন্ত কেঁপে ওঠে—এই কি মানুষের শেষ পরিণতি?—আমি কেডা?

—তুমিমজ বিপাশা চৌধুরী, বয়স পঁচিশ, ইন্দো—এ্যাংলিয়ান পোয়েট। ব্যারিস্টার সুবর্ণ চৌধুরীর একমাত্র মেয়ে, আই পি এস অফিসার সুকান্ত চৌধুরী আর চাটার্ড এ্যাকাউন্ট্যান্ট সুজয় চৌধুরীর একমাত্র ছোট বোন—

সমীর চট্টোপাধ্যায়ের—রাজবন্দী সমীর চট্টোপাধ্যায়ের … কে? কে তুমি? তুমি কেডা? সমীরের তুমি কেডা?

১৪

বাথরুম থেকে শাওয়ারের শব্দ আসছে। দুটো ঘরের মধ্যে পার্টিশন দেওয়ালটার গাঁথনি ছাদ পর্যন্ত উঁচু নয়। ওপর দিকে বেশ খানিকটা শুধু কাচের। ওঘর থেকে গুনগুন গানের আওয়াজও শোনা যাচ্ছে।

—’য়োহা—ন!’ হঠাৎ ডেকে ওঠে বিপাশা। চাপা গলাতেই। এই বাড়িতে ঢুকে অবধি গলার স্বর আপনা আপনি চাপা হয়ে গেছে।

—’কা—মিং ডিয়ার।’ বুক ভরা আওয়াজে উত্তর আসে।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আবির্ভূত হয় য়োহান। কোমরে কেবল একটা তোয়ালে। সেই শাদা হলুদ কাজ করা মস্তবড় তোয়ালেটা। তলা দিয়ে পেশিবহুল দুটি দীর্ঘ পা বেরিয়ে আছে।

—’স্যরি ডারলিং। আমার বর্বরতা মাপ করো।’

য়োহানের গা থেকে শাদাটে স্বাস্থ্যকর একটা তাজা গন্ধ আসছে—বেশ স্যানিটারি—এ্যান্টিসেপটিক টাইপের নীরোগ নির্দোষ গন্ধ। ব্লিচিং পাউডার ঢালা মেঝের মতন।

বিপাশার মনে হয় এর আগের ঘাম—ঘাম—মদ—মদ জ্যান্ত ক্লান্ত গন্ধটাই বেশি মানাচ্ছিল য়োহানকে। বাইরের এলো—মেলো য়োহানের কিছু ছিটেফোঁটাও আর বাকী নেই ধোয়া—মোছা শ্বেতপাথরের য়োহানের মধ্যে।

—’উনুনটা যে জ্বলছে না—ইলেকট্রিক তো নেই, নইলে তোমাকে কফি বানিয়ে দিতাম।’

—’কেন, কলেই তো গরম জল আছে।’

—’দূর! সে কি কফি নাকি? সে তো নেসকেফ! নেসকেফ আমরা খাই না।’

—’নেসকেফ না, নেসকাফে—’

য়োহান হেসে ওঠে,—’জানি আমি ইচ্ছে করে ঐরকম বলি।’ বলে মিটিমিটি হাসতে হাসতে য়োহান সামনের চেয়ারে এসে বসে।

—’তুমি তোয়ালেটা বদলে পেন্টুলুন পরে এসো তো—’

—’বাপরে! তুমি সত্যি সত্যি আমার বুনোপনা সহ্য করবে না?’

—’না। আমার জংলীদের ভাল লাগে না।’

—’সত্যি? আমি তো ভাবতাম, মেয়েরা একটু আধটু জংলীপনা ভালই বাসে।’

—’আমি বাসি না।’

—’পেন্টুলুন পরে ভদ্রস্থ হও য়োহান—পাঁচ মিনিট সময় দিচ্ছি।’

—’এক কাজ করবে বলো, তাহলে এক্ষুণি পেন্টুলুন পরে আসবো।’ আহ্লাদে গলায় য়োহান বলে।

—’কী কাজ? আচ্ছা ঝামেলা তো?’

—’এই দীর্ঘ কাপড়টা তুমি কিভাবে গায়ে জড়িয়েছো সেই কায়দাটা আজ আমাকে দেখাতে হবে। পিওরলি সায়েন্টিফিক ইন্টারেস্ট! সেলাই না—করা পোশাক পরার ব্যাপারটা আমাকে চিরকাল মুগ্ধ করে। সেই গ্রীকদের যুগ থেকেই।’

—’তারই উদাহরণ বুঝি এই তোয়ালে—পরা? বোধহয় গ্রীক সভ্যতা? সেলাই—না—করা পোশাক!’

—’খানিকটা তাই, খানিকটা আলস্য, আর খানিকটা—’ মিটির মিটির হাসতে থাকে য়োহান।

—’কী।’

—’বদমাইশি, বলতে পারো।’ বলতে বলতে টেবিলের তলায় পা বাড়িয়ে, চটি খুলে বিপাশার পায়ে চাপ দেয় য়োহান।

বিপাশার শিউরে ওঠাটা হয়তো বুঝতেও পারে সে। তাই ফুঁ দিয়ে ক্যানডলটা নিবিয়ে দেয়। আর সঙ্গে সঙ্গে টেবিলে রাখা বিপাশার হাতটা নিজের থাবার মধ্যে তুলে নেয়।

—’সত্যি বলতে কি, ইলেকট্রিক সাপ্লাই বিভাগের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই। কী সুন্দর সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে আমাকে।’

য়োহানের কথার উত্তরে বিপাশা কিছুই ভেবে পায় না। য়োহানও কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকে এবারে। তারপরে বলে—

—’ওঠো, উঠবে? চল ও ঘরে যাই—।’

মন্ত্রমুগ্ধের মতো উঠে দাঁড়ায় বিপাশা।

য়োহান ওকে হাত ধরে কে জানে কোন ঘরে নিয়ে যায়। আরও অন্ধকারে। করিডরে যখন য়োহান জড়িয়ে ধরে, বিপাশার হাত পা যথেষ্ট আপত্তি করে অভ্যস্ত নিয়মে। কিন্তু বুক কি অতটাই আপত্তি করে? বিশ্বাসঘাতক শরীর সহযোগী হতে চায় না?

বিপাশা কিছু ভাবতে পারে না—একটা গরম ভিজে চাপ থেকে ঠোঁট দুটো খুলে নিতে নিতেই বুঝতে পারে, ওরা কোনো একটা ঘরে ঢুকেছে।

—’পর্দাটা তুলে দাও য়োহান, আলো আসুক।’

এই বাড়িতে ঢুকে অবধি আলোর জন্যে বিপাশার সমস্ত ইন্দ্রিয়ে মরুভূমির তেষ্টা—অথচ আলোর চেয়ে অন্ধকারই সাধারণত বেশি পছন্দ করে বিপাশা। কিন্তু এ বাড়ির অন্ধকারটা কেমন যেন জাল পাতছে। এস অন্ধকারের সঙ্গে য়োহানের জীবনের নানান অন্ধকার যেন মিশে যাচ্ছে।

বিপাশার সমস্ত শরীরে যেন জড়িয়ে যাচ্ছে এই অন্ধকার। জলের তলায় যেমন দাম। একবার লেকে সাঁতার কাটবার সময়ে দুই পায়ে দাম জড়িয়ে গিয়েছিল বিপাশার। এক মুহূর্তের জন্য সমস্ত চৈতন্য অন্ধকার নেমে এসেছিল। কিন্তু মাত্র এক মুহূর্তেই। তারপরেই দাম ছিঁড়ে পা মুক্ত করে নিতে পেরেছিল সে।

কিন্তু এ অন্ধকার যেন পা ছুঁড়ে হাত ছুঁড়ে একটুও ছেঁড়া যাচ্ছে না। নিচের গহনতর আঁধারে টেনে নিয়ে যাচ্ছে বিপাশাকে। সমস্ত শরীরে ঝুরি ঝুরি দামের মতো পেঁচিয়ে ধরছে অন্ধকার—দম বন্ধ হয়ে আসছে।

—’য়োহা—ন, পর্দাটা তুলে দাও, প্লীজ।’

য়োহান পর্দা তুলে দেয়।

সঙ্গে সঙ্গেই ঘরের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে বৃষ্টি ভেজা একটুকরো নির্জন মধ্য—রাত্রের পথ। একটা ল্যাম্পপোস্ট একটু দূর থেকে বিপাশাকে আলো দিচ্ছে। আলোকস্তম্ভটিকে বিপাশার হঠাৎ মনে হলো লাইটহাউস। যেন গভীর গহন পথহারা সমুদ্রের বুকে ভাসতে হঠাৎ দেখা গেছে আলোর ইশারা।

বৃষ্টিতে আলোটা কেমন আবছা জ্যোতির মতো উদ্ভাসিত করে রেখেছে রাত্রির নির্জন পথ। একটা আধাতৈরি বাড়ির সামনে সিমেন্ট মাখার বিপুল যন্ত্রটা দাঁড়িয়ে আছে প্রাগৈতিহাসিক দানবের মতো—অনেক ইঁট সাজানো একদিকে—ভাল দেখা যাচ্ছে না—কেমন ইঁট। পথটার কালো, ঘুমন্ত সাপের মতো চকচকে পিঠে হিলহিলে আলো পিছলে পড়ছে, বৃষ্টিতে।

মন্ত্রমুগ্ধ বিপাশা গিয়ে জানলায় দাঁড়ায়। যেন গভীর নিশ্বাস নিতে। জানলার পুরু কাচে ঘর একেবারে বন্ধছন্দ।

পর্দা তুলতে কেবল অদম্য আলোই এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ঘরে, আর সঙ্গে এনেছে অনিবার্য কিছু আলুথালু ছায়া। কিন্তু বৃষ্টি, কি টাটকা বাতাস, কি শীত—এরা কেউই ঘরে ঢোকার ছাড়পত্র পায়নি।

বিপাশা জানলার কাচে নিজের নাকটা চেপে ধরে—মিষ্টির দোকানের সামনে ভিখিরির বাচ্চার মতন।

ওখানে আলো—বাতাস, ওখানে পথ, ওখানে বৃষ্টি ভেজা রাত্রি, ওখানে জীবনের বয়ে যাওয়া স্রোত। একটিও মানুষ নেই পথে—আর আধো—তৈরি গৃহে তো থাকবেই না কেউ।

হঠাৎ দূর থেকে দুটি মানুষের ছায়া পথে আবির্ভূত হয়। বিপাশার সমস্ত মন নেচে ওঠে আকাশে মেঘের সমাগমে যেমন ময়ূরের পেখম। জেগে আছো? তোমরাও জেগে আছো?

হঠাৎ হাতে একটা আচমকা ঝাঁকুনি খেয়ে টাল সামলাতে পারে না বিপাশা—হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায় মেঝেতে য়োহানের শরীরের ওপরে। য়োহান তাকে একরকম লুফেই নেয়।

—’উঃ!’ ব্যথা চাপবার শব্দ বেরোয় বিপাশার মুখ থেকে।

য়োহান তখনও শক্ত করে ধরে আছে ওর ডান হাতটা। দুঃখ প্রকাশের ধার দিয়েও যায় না সে—বরং এক ধমক লাগায়।

—’খবর্দার উঠবে না এখন। স্টুপিড মেয়ে। জানলায় দাঁড়াতে আছে অমন করে, এই মাঝরাত্রে, লোকে কী ভাববে?’

বিপাশা স্তম্ভিত হয়ে থাকে।

লোক কোথায়? কে ভাববে? এই ঘন অন্ধকার ঘরের মধ্যে তাকে দেখাই বা যাবে কেমন করে? ওইটুকু পথের আলোয়? কতটুকুই বা সেই আলো? এ কেমনধারা ভয়ে সারাক্ষণ রেগে কুঁকড়ে আছে এই মানুষটি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *