১
বিশাল কারুকার্য করা ভারী কাঠের দরজা ঠেলে নুড়ি বিছানো বাগানের রাস্তায় নেমে এল বিপাশা। ডাইনে মস্ত এক ফোয়ারা, যথারীতি নগ্ন পরীটরী সমেত, এবং যথারীতি শুকনো, নির্জলা। বিপাশার বেশ ভালো লাগলো। বাঃ! ঠিক দেশের মতন। পশ্চিম ইওরোপে ওর অভ্যেস হয়ে গেছে জল—ছলছল চালু ফোয়ারা দেখা। এই শুকনো ফোয়ারাটি বড্ডই মনে ধরল। শুকনো ফোয়ারা মানেই অভাব। বুদমেরিৎসে প্রাসাদের রাজকীয়তার কাল যে বিগত, তাতে আর কোনোদিকেই সন্দেহ নেই! ডাইনোসরের কঙ্কালের মতো কেবল পড়ে আছে বিপুল কাঠামোটা।
লাল কাঁকরের পথটা একটা নূপুরের মতো প্রাসাদের শাদা পাথুরে পায়ে জড়ানো—তা থেকে বাচ্চাদের আঁকা সূর্যের ছটার মতো নানান শাখা বেরিয়েছে, সবুজ বাগানকে টুকরো টুকরো কেকের মতো কেটে চলে গিয়েছে দিগ্বিদিকে। একটা গেছে বাঁ দিকের ওই দোতলা বাড়িতে—ওটা আউট হাউস বোধহয়। একটা গেছে ওই আপেলকুঞ্জে। যদিও আপেলমঞ্জরী এখনও ধরেনি, তবু অর্চার্ডটি বেশ দেখতে। ওখানে একটা ময়ূর চরে বেড়ায়। গোটাতিনেক টার্কী পাখির দলে। ময়ূরটা বাগানের ঘাসে কাল পেখম মেলেছিল। সেই দৃশ্য জানলা দিয়ে চোখে পড়ায় মিনিট দশেকের মতো কনফারেন্স ‘রিসেস’ হয়ে গিয়েছিল। সক্কলে জানলায় দাঁড়াতে চাইছিলেন। বিপাশা চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ময়ূরটাকে খুঁজলো। নেই। ময়ূরটাকে ওর খুব আপন লাগে, ওর নিজের লোক। দেশের লোক। টার্কী পাখির দলে, ময়ূরটাকে ঠিক যেন এই সাহেবদের মধ্যে বিপাশার মতো, আলাদা দেখায়।
আরেকটা লাল রাস্তা গেছে দক্ষিণ—পশ্চিমে সোজা বনটার মধ্যে ঢুকে। আজই এই লেখকদের সম্মেলন শেষ। আজ রাত্রেই তার চলে যাবার কথা একটা মফঃস্বল শহরে। সেখানে আরেকটা সভা আছে, বিভিন্ন স্কুলকলেজে গিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে পরিচয় করবেন বিদেশি নবীন লেখকরা।
এই চিঠিটা তার আগেই ডাকে দেওয়া দরকার। যে রাস্তাটা সোজা পুবদিকে গিয়ে বিশাল লোহার গেটটায় মিশেছে, বিপাশা সেটাই বেছে নেয়। ওক গাছের ফাঁক দিয়ে অল্প অল্প দেখা যাচ্ছে একটা চৌকিদারের ঘর। সেখানে বন্দুক হাতে একজন। আর গেটের দুদিকে দুজন দাঁড়িয়ে। সশস্ত্র প্রহরী। বিপাশা চিঠিটাকেই শক্ত করে ধরে পায়ে পায়ে এগিয়ে যায়—বাব্বাঃ, কী বিরাট তালা—গেট দুটো মোটা শিকলি জড়িয়ে বাঁধা। মস্ত গেট, প্রায় আড়াই মানুষ উঁচু! বিপাশা ছোট্টখাট্টো, পুরো একমানুষও নয় সে। এমনিতেই বেশি বড়সড় জিনিসপত্র দেখলে ওর বুকের মধ্যে একটা উদ্বেগ, একটা অস্বস্তি হতে থাকে।
চিঠিটা কিন্তু ডাকে দিতেই হবে। পাঁচ—ছ দিন ধরে চেকোস্লোভাকিয়াতে আছে—বাড়িতে চিঠি দেয়নি সে। তার আগেও দিন কয়েক খুব ব্যস্ত ছিল, আসবার আগে—ইংলন্ড থেকেও চিঠি দেয়া হয়নি। বাবা ভেবে ভেবে অস্থির হয়ে যাবেন। বাবার আবার ভাবনা করা স্বভাব। বিপাশাকে পোস্ট অফিসে যেতেই হবে আজ।
তালাবন্ধ গেটটার সামনে এসে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে পড়ে, এদিক ওদিক তাকায়। এই বিশাল ফটক, এত প্রকাণ্ড তালা, মোটা শেকল, বন্দুক ঘাড়ে প্রহরী—এসব দেখেশুনে ওর হঠাৎ একঝলক মনে হয় যেন জেলখানার ভেতরকার বাগানে বেড়াচ্ছে। যেন গেট খোলানোর চেষ্টাটা হবে অবৈধ। সমীরের অবশ্য বেড়ানোর সুযোগ নেই। সে থাকে একলা কুঠুরিতে, অন্যভাবে। গেটের বাইরে দীর্ঘ বাঁধানো সড়ক চলে গেছে।
পুবদিকে—বিপাশা তাকিয়ে দেখে—দুদিকে গাছের সারি—মেপলা গাছের দুপাশে ছড়ানো রয়েছে মাঠ—বিপাশার চোখ খুব ভাল নয়—সে দৃষ্টিটাকে তীক্ষ্ন করে তুলে দেখবার চেষ্টা করে—মাঠ? না ক্ষেত? বন্ধ গেটের ভেতর দিক থেকে অনাবাদী মাঠের আর বাড়ন্ত ক্ষেতের চেহারা যেন একই রকম দেখালো।
জনশূন্য, দীর্ঘ রাস্তার শেষ প্রান্তে, একটা গনগনে লাল যুদ্ধের ট্যাঙ্কের মতো সশস্ত্র সূর্য উদিত হচ্ছেন। কোনো অবস্থাতেই স্বাভাবিক হতে অসুবিধা হয় না বিপাশার, আর সামনে যখন অতবড় একজন চেনাশুনো আপনজন—সূর্য। পাঁচদিন পরে এই প্রথম দেখা। দেখেই ফুর্তি ফিরে এল, বিপাশা সহজ পায়ে এগিয়ে গিয়ে চৌকিদারদের হাসিমুখে অভিবাদন জানিয়ে ইংরিজিতে অনুরোধ করে—”দরজাটা একটু খুলে দিন দয়া করে।”
ভাষাটা ইংরেজি হলেও বিপাশা পুলিশকে সর্বদা মনে মনে আপনি—আজ্ঞে করে। পুলিশরা সমস্বরে বলে ওঠেন—”সুপ্রভাত।”—”গুটেনমরগেন।”
দরজা খোলার কোনো লক্ষণই কিন্তু দেখান না। বিপাশার জর্মনটা তত সুবিধের নয়। সে ফরাসীতে অনুরোধ করে—”দরজাটা মশাইরা একটু খুলে দেন যদি অনুগ্রহ করে।”
প্রহরীরা মোলায়েম হেসে বললেন—”হ্যাঁ, চমৎকার দিন।”
এবারে বিপাশা হেসে ফেলে। হাসলে তার ডান গালে একটা টোল পড়ে। প্রহরীরাও হাসেন। বিপাশা একটু সাহস পায়। এগিয়ে গিয়ে, তালাটা নেড়েচেড়ে খাস বাংলায় বলে—”কি মশাই, তালাটা খুলে দিন না একটু—” চিঠিটা তুলে ধরে, রাস্তা দেখিয়ে বলে—”ডাকঘরে যেতে হবে।”
এবার প্রহরীরা বোঝেন—মাথা নেড়েচেড়ে জর্মনে বললেন—”দুঃখিত মহাশয়া। হবে না। পারমিশান চাই।” তারপরেই হঠাৎ নিসর্গ—শোভায় গভীর মনোনিবেশ ঘটে যায় তাদের। বিপাশা বুঝল—গেট খুলবে না।
তার এখন যা বয়েস, তাতে কুক্কুরীও সুন্দরী হয়, আর বিপাশার মুখখানা তো রীতিমতো সুন্দর। কিন্তু এ তপস্বী—পুলিশের কাছে সুন্দর মুখেরও ঘোর পরাজয়।
২
বিপাশার মেজাজ খারাপ হল। দূর ছাই। ফিরেই যাবে তাহলে। পিছন ফিরেই চোখে ঝলমলিয়ে উঠল বিরাট একটা পাথুরে প্রাসাদ—ছেলেবেলায় বিদেশী ‘ফেয়ারি টেলস’ এর বইতে যেমন দেখেছে ঠিক যেন তাই। পিঠের কাছে শেকলবাঁধা বিশাল লোহার ফটক, সামনে বিপুল প্রাসাদ। বুদমেরিৎসে।—ব্রাটিস্লাভা থেকে পঁয়ত্রিশ মাইল দূরে এই উনিশশতকী প্রাসাদ। এখন হয়েছে স্লোভাক রাষ্ট্রের সরকারী লেখক নিবাস, ”রাইটার্স হোম”। এদেশের লেখক, অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবীরা যে যাই লিখুন, সে ইতিহাস, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা নাটক—নভেল যাই হোক না, এখানে এসে তিন মাস ফ্রী থাকা খাওয়া এবং শান্তি পাবেন। যানবাহন বলতে বাস, ট্রেন, ট্যাক্সি কিছুই নেই—কেবলমাত্র সরকার— বাহাদুরের দাক্ষিণ্যেই সম্ভব এখানে আসা, এবং এখান থেকে যাওয়া। বিপাশা ভাবল—”এই প্রাসাদ, এই বন্ধ তোরণ, এই সাজানো বাগান, এই ফোয়ারা, ময়ূর, প্রহরীর দল—আর বন্দিনী রাজকন্যা, এখানে সবই আছে, এখানে সবাই আছে, এখানে কেবল একজন রাজপুত্তুর চাই।”
ভেবে নিজেই হাসল। রাজপুত্তুর। দূর দূর। এখানে যাঁরা এসেছেন তাঁরা দেশবিদেশের নবীন লেখক। লিখিয়েরা বাস্তবজীবনে কক্ষনো সাহসী হয় না। ওই কলমের ডগাতেই যা দুঃসাহস।
কিন্তু প্রাসাদে কেন এত রকম সুরক্ষাকৌশল? কী হবে এ দিয়ে? সমাগত বিদেশীদের কারুর হাতেই তো টাকাকড়ি নেই তেমন। সব হিসেব বুঝিয়ে দিয়ে তবে ঢুকতে হয়েছে এই রাজ্যের সীমানায়। সরকারের দেওয়া জলপানি পকেটে নিয়ে। এখান থেকে কেউ কোথাও পালাতে পারবে না এক পায়ে—হেঁটে ছাড়া। তাছাড়া কেউ কি কাউকে কোনোদিন শিকলি পরিয়ে বাঁধতে পেরেছে? সমীর তো জেলে আছে। সমীর কি বাঁধা পড়েছে? মনে তো হয় না। যে পারে সে আপনি পারে, পারে শেকল ভাঙতে।
ভাবতে ভাবতে বিপাশা প্রাসাদের পিছনদিকে এসে উপস্থিত হয়। একটা চৌকো, বিশাল নীল মোজেইক করা চৌবাচ্চা। তাতে খুব নিচে অল্প জল রয়েছে। আর জলে ডজনখানেক লাল মাছ। বিপাশা ঝুঁকে পড়ে। —’হ্যাঁরে, এত ঠাণ্ডাতেও তোরা জমে মরিসনি? জল যতদিন না বরফ হচ্ছে, তোদের বুঝি ততদিন যমের ভয় করে না?’
—’এটা আসলে মাছেদের চৌবাচ্চা নয় মোটেই।’ চমকে ফিরে তাকায় বিপাশা। সে মনের সুখে বাংলায় কথা কইছিল মাছেদের সঙ্গে, কেউ বুঝি দেখে ফেলেছে।
য়োহান বলল দেড় মাথা উঁচু থেকে তার দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে—
—’এটা একটা সুইমিং পুল ছিল। প্রাসাদবাসীদের জন্যে। এখন আর ব্যবহার হয় না।’
—’কে বললে ব্যবহার হয় না? এই তো দিব্যি ব্যবহার হচ্ছে। সুইমিং পুলই তো রয়েছে এটা। এতগুলো লালমাছ তবে কী করছে এখানে, এই জলের মধ্যে?’
জলের তলায় মাছেরা শব্দ শুনতে পায় কি? মাছেদের পিলে থাকে কি? থাকলেও তা চমকায় কি? পিলে—চমকানো হাসি হেসে উঠে য়োহান বলল,—’বা, বেড়ে বলেছো তো? মাছেদের সুইমিং পুল। আশ্চর্য কথা! খুবই ডেকাডেন্ট ইম্যাজিনেশন বাপু তোমার। না বলেই পারছি না।’
শুনেই মাছেরা কুলকুলিয়ে ওদিকে সরে গেল। বিপাশাও চেষ্টা করলো খানিকটা সরতে। য়োহানের মুখ থেকে বিয়রের গন্ধ বেরুচ্ছে ভুরভুর করে। বিখ্যাত চেক বিয়র। পিলসনার। ঘাড়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে এমন ‘আহা—মরি’ করবার মতো আশ্চর্য কিছু কথা সে বলেছে বলে মনে হলো না বিপাশার।
য়োহান বলল—’ওহ! কী অপরূপ সকাল বেলা! এমন সূর্যস্নান সকাল বুদমেরিৎসে খুব বেশি দেখে না।’
এই রে—হয়ে গেছে! বিপাশা এবারে ঠিক জানে, য়োহান আর কী কী বলবে। বলবে—’তুমিই এই সূর্যের প্রসাদ বয়ে এনেছো, এ তোমারি কবোষ্ণ সুষমার নৈসর্গিক বিচ্ছুরণ। এ তোমার স্বদেশ থেকে বয়ে আনা উত্তপ্ত বন্ধুতার দীপ্তি’—এই লাইনগুলো গত পাঁচ বছরে শুনতে শুনতে মুখস্থ হয়ে গেছে বিপাশার। মনুষ্য—জীবনের ট্র্যাজিডি এটাই। তোমার স্বকৃত সুকর্মের জন্য জীবনে খুব কম সময়েই কেউ তোমাকে প্রাপ্য সম্মান দেবে। আর যে—কৃতিত্ব তোমার নয়, সেজন্য তোমাকে প্রায়ই ফাঁকা ঢনঢনে প্রশংসা—বাক্য শুনতে হবে। যা গ্রহণ করার সুযোগ নেই, না বুদ্ধিতে, না হৃদয়ে। ‘তুমিই এই সোনালি সকাল’…ইত্যাদি শোনা হয়ে যাবার পরে বিপাশা হাতের চিঠিটা দেখিয়ে বলে—’য়োহান, তোমাদের পোস্ট অফিসটা—?’
—’কেন? চিঠি পাঠাবে? আমাকে দাও।’ চিঠিটা নিয়ে নিজের ওভারকোটের পকেটে পোস্ট করে দেয় য়োহান। বিপাশা সুন্দরী, মাপসই, কিন্তু খুব ছোট্টখাট্টো। বাঙালী হিসেবেও রীতিমতো হ্রস্ব—আকার মেয়ে সে, ফরাসীতে যাদের আদর করে বলে, ‘পেতিত’। আর য়োহান খুব বড়োসড়ো মস্ত লম্বা, একটু কুঁজো। তার বুকপকেটটাও বিপাশার মাথার চেয়ে উঁচুতে।
মুখটি তুলে সেদিকে তাকিয়ে বিপাশা বলে—’স্ট্যাম্প মারা হয়নি।’
—’মেরে দেবো। হাওয়াই ডাকে যাবে তো? কোথায়—ইন্ডিয়া?’
—’হুঁ। কিন্তু য়োহান, তোমাদের ডাকঘরটা কোথায়?’
—’ওই তো। বেরিয়ে, ডানদিকে মাইল দেড়েক হবে, গ্রামটার মধ্যে।’
—’ওখানে তুমি যাবে কখন? শেষ মিটিং তো পনেরো মিনিটের মধ্যেই শুরু হচ্ছে।’
—’আমি যাবো না, সুইটহার্ট, আমি বেচকাকে দিয়ে দেব। বেচকা স্ট্যাম্প মেরে মেলব্যাগে ভরে দেবে। দুপুরবেলা লাঞ্চের পরেই চলে যাবে তোমার চিঠি।’
—’ধন্যবাদ, ধন্যবাদ! বাঁচা গেল।’ বিপাশা সত্যিই হাঁপ ছাড়ে একটা।
—’এত কাতরতা কেন? কাকে চিঠি? নিশ্চয়ই তোমার প্রেমিককে?
—’দূর, আমার আবার প্রেমিক কোথায়? বলতে বলতে বিপাশার মনে পড়ে যায় সমীরের মুখখানা—পাঁচ বছর আগেকার ফটোতে। সমীরকে কি এখনও বিপাশার প্রেমিক বলা যায়? অন্যমনস্ক সুরে বিপাশা ডাকে—’য়োহান?’ উদ্দেশ্য করা ঘোরানো।
কিন্তু তার জবাবে বিশাল য়োহান হঠাৎ নুয়ে পড়ল বিপাশার মুখের কাছে—’কী, মা—শেরি? বলো, বলো, তোমার কথা আমার কানে দেবদূতের গানের মতো শোনায়।’
যদিও পাঁচ—ছ’ বছর পশ্চিম দেশে রয়েছে, তবু এদেশে মুখের ওপরে এই ফ্লার্ট করাটা (নারীজাতির প্রতি এই ঐকান্তিক সম্মানজ্ঞাপন!) বিপাশার এখনও সহজে হজম হয় না। মুখখানা লাল হয়ে ওঠে। কী বলতে চেয়েছিল, ভুলে যায়। দূর ছাই।
এই য়োহানটা ভারী জ্বালায়। খুব নামডাক আছে এখানে, ব্রাটিস্লাভায় মস্ত অধ্যাপনা করে—মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে সাতটা সমালোচনার বই লিখে ফেলেছে—এই কনফারেন্সের সে—ই হর্তাকর্তা বিধাতা। অথচ হাবভাবে খাপছাড়া, একটা পাগলা দাশুর মতন লাগে মাঝে মাছে ওকে বিপাশার। এবং বিপাশার প্রতি তার অখণ্ড মনোযোগ। বিপাশার এই ‘ছোট্টখাট্টো’ হওয়াটাই ছ’ফুট চার ইঞ্চি য়োহানের কাজে দারুণ মজাদার মনে হয়। বিপাশার সেটা খুব একটা মজার লাগে না কিন্তু। বিপাশাকে এদের মেয়েদের পাশে একদম বেখাপ্পা লাগে। বেচকার পাশে ওকে কেমন পুতুল—পুতুল দেখায়। কেবল তার শাড়ি—ব্লাউজ আর কোমর পর্যন্ত লম্বা কালো বিনুনির জন্যেই নয়—তার দুধ বেশি দেওয়া চায়ের মতো রংয়ের জন্যেও নয়,—বিপাশার কালো চোখ দুটোর মধ্যে একটা সুদূর অন্য জগতের ভাব আছে। অনেক ভেবে একটা কথা বের করে বিপাশা।
—’বেচকা কি আমাদের সঙ্গে আজ যাবে, নীত্রায়?’
—’নিশ্চয়ই যাবে—তোমার দোভাষী তোমারই ছায়া। যাবে না মানে? আমারই অবশ্য বেচকার বদলে তোমার দোভাষী হতে খুব ইচ্ছে—কিন্তু আজ যে এখানে আমার একটা কাজ বাকী আছে। সেটা মিটিয়ে কালকেই চলে আসবো নীত্রা। ততক্ষণ বেচকাই তোমার সঙ্গ পাবে। লাকি গার্ল বেচকা।’ বলতে বলতে য়োহান ওর ভারী, গরম হাতটা দিয়ে বিপাশার কাঁধে একটা থাবড়া বসায়। তারপর মাথাটা নামিয়ে আনে কানের কাছে—’আমি একবার নীত্রায় গিয়ে পড়লে আর বেচকাকে কিন্তু ঘেঁষতে দেব না কাছে—।’
বিপাশা নিশ্বাস বন্ধ করে রাখে। এই সকালেই য়োহানের নিশ্বাস মধু—গন্ধে ভরা। য়োহানের পরনে ছেঁড়া—ছেঁড়া ব্লু—জীনস, গায়ে একটা খুব ভারী খাটো কালো ফার—কোট। তার ভেতরের দিকে ফার বসানো। পিঠের ওপর হুডটা উল্টে পড়ে আছে। দু’চোখের কোণে চামড়া কুঁচকে আছে, কথায় কথায় হাসে—চওড়া কপালে অনেকগুলো খাঁজ খাঁজ লাইন টানা—চওড়া চোয়াল, খাড়া নাক। মুখখানা এককেবারে গোল, আর হাসিটা বিপাশার ভীষণ চেনা—চেনা। কেন যে এমন চেনা—চেনা—যেন আগে কতই দেখেছে—তা ঠাহর করে উঠতে পারে না বিপাশা। য়োহানের বয়সের তুলনায় মাথার চুল পাতলা, কিন্তু খুব সোনালি—পিছনদিকে একটু টাকও পড়ছে, রোদে পোড়া তামাটে রংয়ের চামড়া, হাসি—ভরা চোখ দুটোর রং জলের মতো। য়োহান এই ক’দিন সবাইকে খুব যত্নআত্তি করেছে। দেশবিদেশের লেখকদের হ্যাপা সামলানো তো সোজা নয়। মেজাজী মানুষ প্রত্যেকে। তবে এই কনফারেন্সের বেড—টী ব্যাপারটি বড় বিশেষত্বপূর্ণ—তারই গুণে লেখকদের মেজাজ ঘুম ভেঙেই প্রফুল্ল হয়ে যায়।
এদেশের যত্নআত্তির তুলনা হয় না। বিপাশাই এটার নাম দিয়েছে বেড—টী। যদিও ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। ঘরে চা আসে না কারুর। মুখ—টুক ধুয়ে প্রত্যেককে খাবার—ঘরে যেতে হয় সাড়ে সাতটা নাগাদ। সেখানে বসলেই সামনে চলে আসে একপাত্র কালো কফি, আর একপাত্র কনিয়াক আর নুন মাখানো কাঠি—কাঠি রুটি এক চুপড়ি। ঘুম ভেঙে উঠেই এই যে বিশুদ্ধ কনিয়াক—সেবন, এইটেই সমাগত লেখকদের চিত্তশুদ্ধি ঘটাচ্ছে, বিপাশার সন্দেহ নেই।
‘ইংরিজি ভাষায় ভারতীয় লেখিকা কবি’ বিপাশা চৌধুরীর এখন যথেষ্ট প্রতিপত্তি ইংরিজিভাষী পাঠকমহলে, তবুও এই পাঁচবছরের প্রবাসের পরেও কিছু কিছু বাঙালপনা রয়ে গিয়েছে বিপাশার মধ্যে। রাত্রে পেট ভরে ডিনার খাবার পরে সুগন্ধি এক ফোঁটা কনিয়াক যদিও বা চলে, কিন্তু ভোরে উঠেই বাসিমুখে চতুর্দিকে এই আকণ্ঠ মধুপান—এই দৃশ্যটা পর্যন্ত সহ্য করতে কষ্ট হয় বিপাশার।
আর তেমনি মন—কেমন করে কলকাতার জন্যে। আহা বাবা, দাদা, ছোড়দারা এই ব্রেকফাস্ট পেলে কী আহ্লাদিতই হত! আহাহা, দেশের লেখকদের ‘প্রডাকশন’—লেভেলই কত উচ্চে উঠে যেত এমন আশ—মেটানো প্রাতরাশটি পেলে! তারা না এসে এল কিনা বিপাশা। একেই বলে অদৃষ্টের মার। কনিয়াকের গুণে সকাল থেকেই কনফারেন্সে প্রত্যেকের ঝলমলে মেজাজ। সূর্য উঠুক না উঠুক, সভা রৌদ্রকরোজ্জ্বল। অত্যন্ত মসৃণভাবেই কনফারেন্স হয়ে যাচ্ছে। বিপাশা লক্ষ্য করেছে, কবিরা ঔপন্যাসিকদের চেয়ে একটা বেশি ফাঁকিবাজ—পারলেই মিটিং—এ না এসে বনের দিকে হাঁটতে চলে যায়।
—’একটু হেঁটে আসবে নাকি?’ য়োহান বলে। ‘চল না, বনের দিকে?’ তালা—শেকলের দিকে কেউই বেড়াতে যায় না। ও প্রসঙ্গটাও কাউকেই তুলতে শোনেনি বিপাশা। সবাই যখন ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে বাইরে হেঁটে বেড়ায়, বেশিরভাগই বনের দিকে যায়। বিপাশাও কালকে ওদিকে গিয়েছিল। হান্সের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে।
লাল কাঁকরের রাস্তাটা শাদা প্রাসাদ ছেড়ে সবুজ লনের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে দুদিকে ক্রমশ বেড়ে ওঠা শুকনো ডালপালার ঝোপঝাড় পেরিয়ে আস্তে আস্তে ঘন কালো বনের অন্ধকারে ঢুকে পড়েছে। হাঁটতে হাঁটতে গল্প করতে করতে হান্স ঝোপগুলোর নীচে হঠাৎ মাটিতে একটা জায়গায় আঙুল দেখিয়ে, বিপাশার কনুই ধরে টেনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। সেখানে শুকনো পাতার স্তূপের ওপর ঢেউ খেলে যাচ্ছিল—ঢেউয়ের উৎস পাতার নিচে। কোনো প্রাণীর গুপ্ত চলাচলের ছায়াছবি ফুটে উঠছে পাতার কাঁপনে।
বিপাশা বলল—’সাপ!’
হান্স বলল—’ধ্যাৎ! এখনও শীত যায়নি, এখন সাপ কোথায়? বেজি টেজি হবে।’
যে প্রাণীই থাক, সে সোজাসুজি চলছিল না—সরীসৃপের মতোই ছিল তার গতি। হান্সের অন্য বাহু ওর কাঁধ অর্ধচন্দ্রাকারে ঘিরে ছিল প্রতিরক্ষাবাহিনীর সৈন্য সাজানোর ঢঙে। বনের ঠিক সামনে ওরা চুপ করে দাঁড়িয়েছিল—পথের মাঝখানে।
একটু পরে শুকনো পাতার কাঁপন আপনা থেকে থেমে গিয়েছিল। হান্স ওর কনুই ছেড়ে দিয়ে বলেছিল—’চল, যাই।’
আর তক্ষুনি ঘড়ির দিকে চোখ নামিয়েছিল বিপাশা। ঘড়িতে সময় হয়ে গেছে মিটিঙে ফেরার।
হান্স বলল—’দূর। ঘড়ি দেখতে হবে না। বনে তো যাওয়াই হল না।’ কিন্তু বিপাশা যায়নি। হান্সের দাড়ি—গোঁফের জঙ্গলের মধ্যে যে দুটি বাদামী চোখ ঝলমল করে তারা ওকে অনুনয় করেছিল—’চল, বনে চল’, আর বিপাশার শিরা—ধমনীর মধ্যে যে চোখটি জ্বলজ্বল করে, সে ওকে বারণ করেছিল, ‘যেও না, হান্সের সঙ্গে বনে যেতে নেই।’
বিপাশা পারেনি। হঠাৎ খুব চঞ্চল হয়ে উঠে বলেছিল—’এই যাঃ, একটা কাজ করতে হবে যে আমাকে মিটিঙে যাবার আগেই! দেখেছ—সব কেমন ভুলে গেছি’—বলে প্রায় দৌড়তে দৌড়তেই ফিরে গিয়েছিল সভা—বাড়ির নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে। হান্সের চোখের থেকে দূরে। কে জানে কী ছিল শুকনো পাতার নিচে। হান্স যাই দেখুক, বিপাশা তো দেখেছিল অদৃশ্য সরীসৃপের চলন।
য়োহান পিঠে আরেক থাবড়া বসিয়ে বলে—’চল চল সুন্দরী, বনটা ঘুরে দেখে আসবে। খুব সুন্দর বন এটা, দেখবার মতো।’
য়োহানের স্পষ্ট ফ্লার্টেশানের মধ্যে একটা নিশ্চিন্তি আছে। বনে নিয়ে গিয়ে কিছু সুযোগ নেবে না য়োহান—যে কুকুর বেশি চেঁচায় সে কামড়ায় না। বিপাশার মন সায় দেয়। মাছেদের ছেড়ে ওরা বনমুখো হাঁটে।
উল্টো দিক থেকে ভীষণ কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে। বিপাশা বলে—’কুকুর ডাকছে কোথায় এত? দেখছি না তো একটাও?’
য়োহান বলে—’আছে—আছে, দেখতে চাও? বল কুকুরটাই আগে দেখিয়ে আনি।’
একটু গিয়েই আউট হাউস। সেখানে বিপাশা দেখল একটা বন্ধ ঘরের ভিতর থেকে প্রবল গর্জন হচ্ছে, পাশবদ্ধ জানোয়ারের। দেখে মনে হয় ঘরটা ছিল আস্তাবল। ঘোড়া এখন নেই। ঘোড়াশালে কুকুর থাকে। আর তারই দোতলার বারান্দায় কিছু ময়লা জামাকাপড় ঝুলছে, কিছু ব্যবহৃত বাসনকোসন ছড়িয়ে আছে। মনে হয় কুকুরশালে এখন মানুষ থাকে।
—’কাদের কুকুর এগুলো? কারা থাকে এই দোতলার ঘরে?’ বিপাশা আকুল স্বরে প্রশ্ন করে।
য়োহানকে বিব্রত দেখায়—’আমিও ঠিক জানি না’—সে বলে, সম্ভবত এই প্রাসাদের কর্মচারীরা কেউ হবে—কুকুরও হয়তো তাঁদেরই।’
বিপাশা বোঝে য়োহান অস্বস্তি বোধ করছে। এমন সময়ে একটি বৃদ্ধ সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে দেখে য়োহান তাকে প্রশ্ন করে, লোকটিও দেশী ভাষায় উত্তর দেয়। য়োহান বিপাশাকে বলে—’ওরা এই প্রাসাদেরই কুকুর।’
বিপাশা উত্তরটা বুঝতে পারে না। প্রাসাদ আবার কুকুর পুষবে কি? প্রাসাদ তো নিজেই রাষ্ট্রের সম্পত্তি। কুকুরেরও নিশ্চয় তবে সেই একই প্রভু! পাশবদ্ধ জানোয়ারের গর্জন বড়ই ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে সদ্য—সূর্য—ওঠা ভোরবেলার প্রশান্তি। বনের দিকে গেলে হয় এবার। বিপাশা বনের রাস্তা ধরে। য়োহানেরও হঠাৎ কথা ফুরিয়ে গেছে। কান—ভর্তি কুকুরের চীৎকার নিয়ে ওরা ক্রমশ বনের মধ্যে প্রবেশ করে যায়।
বনের গোড়া থেকেই বিশাল বিরাট সব বৃক্ষ, জড়াজড়ি গলাগলি করে তারা অন্ধকার করে রেখেছে, শীতল করে রেখেছে বনের বদ্ধ বাতাস, বৃক্ষগুলির বাকলে কত বছরের প্রাচীন শৈবালের সবুজ স্তর, কিন্তু ডালে ডালে কচি পাতার উঁকিঝুঁকি, অচেনা সব ঝিরঝিরে লতা ঝুলছে ডালপালা থেকে, তাতে ছোট ছোট দু’একটি ফুলও ফুটতে শুরু করেছে, অলক্ষিতে পাখি—পাখালির ডাক অরণ্যের স্তব্ধ বাতাসকে দুলিয়ে দিচ্ছে বসন্তের বার্তা দিয়ে… অথচ সব চেয়ে আশ্চর্য, বিপাশা অবাক হয়ে দেখে, মাটি দেখাই যায় না, কেবল বরফ, শাদা বরফ জমে আছে বন—ভর্তি। তার ওপর দিয়ে সরু একটি পথ তৈরি হয়েছে পথচলতি লোকেদের জুতোর তলায়—কাদা—মাটি—বরফ—মাখা পথ।
কী আশ্চর্য, এত বরফ? এখন ক্যালেনডারে বসন্ত ঋতু, সূর্য কম উঠছেন বটে, শীতটাও প্রবল বটে, তবু বরফ তো পড়েনি, অন্তত এই ক’দিনে? বুদমেরিৎসে প্রাসাদের মাঠে, বাগানে, রাস্তায়, দালানে, বারান্দায়, ছাদে কোথাও বরফের চিহ্নমাত্র চোখে পড়েনি—সব বরফ জমিয়ে রাখার দায় কি একা এই অরণ্যের? বনের বাইরেই মাঠভর্তি সবুজ বাসন্তী রোদ, অথচ বনের মধ্যে দু’পা ঢুকে পড়লেই গভীর গহন শাদা—কালো শীতকালের রাজত্ব। ক্যালেনডার যাই বলুক, অরণ্যে এখন শীত।
বিপাশা নিচু হয়ে দস্তানাপরা মুঠোয় একদলা বরফ তুলে নেয়। য়োহান শিস দিয়ে একটা অচেনা সুর ভাঁজছে, আর কোত্থেকে একটা ডাল ভেঙে নিয়ে ছড়ি বানিয়ে ঝুলন্ত লতাপাতাগুলো ছিঁড়ছে।—’য়োহান!’ বিপাশা বলে—’লতাগুলো নষ্ট কোর না, কী সুন্দর!’
য়োহান হেসে ওঠে।—’নষ্ট? কালই আবার গজিয়ে যাবে। তুমি সত্যি বড্ড সেন্টিমেন্টাল। একটা জ্যান্ত, বাড়ন্ত জিনিস অত সহজে কেউ নষ্ট করতে পারে নাকি? এ কি শিল্প? এ হল নিসর্গ!’ হাতের ডালটা গুঁজে দেয় বরফের মধ্যে। একটা কালো সরু স্তম্ভের মতন সেটা দাঁড়িয়ে থাকে। মাথায় খানিকটা ছেঁড়া কচি সবুজ লতাপাতা নিয়ে।
য়োহান বলে—’এটা ধরা যাক একটা উঁচু পাহাড়ের চূড়ো, তোমাদের মহান হিমালয়েরই একটা নতুন চূড়ো—আজ আমরা দুজনে প্রথম জয় করেছি এটাকে—কেমন?’
বলে য়োহান নরম করে তাকায়, আলগা করে ওর হাতটা ধরে বলে—’এসো, আমরা বিজয় পতাকা পুঁতে রেখে যাই—এই লতাপাতাই বেশ আমাদের অভিযাত্রী দলের পতাকা,—কী বলো? ভালো হলো না?’ বলে হঠাৎ বিপাশার কাঁধে ভারী হাতটা রেখে আলতো একটানে কাছে টেনে নেয়।
এক মুহূর্তেই বিপাশার মনে পড়ে যায়, সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে, মিটিং ভেঙে যাবার পর সমীর সেই প্রথমবার—সঙ্গে সঙ্গে এত জোরে হেসে ওঠে য়োহান, তাতে বিপাশার বদ্ধ স্মৃতির সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধ অরণ্যের জমাট জরাও বেশ খানিকটা চমকে ওঠে, খানিকটা বিরক্ত হয়। বিপাশাও হাসে, নিঃশব্দে।—’সমীর, দেখে যাও এ কোন অরণ্যে আমি।’ তারপর বলে—’চলো য়োহান—শেষ মিটিঙে তুমি আমি দেরি করে ঢুকব কিন্তু।’
য়োহান বলে—’এইবার অভিযাত্রীদ্বয়ের পর্বতচূড়া হইতে অধঃপতন—’
তারপরে কয়েকটা মুহূর্ত আশ্চর্য একটা স্তব্ধতা এসে বনটা ভরে দেয়—য়োহান আর বিপাশার মধ্যে একটা ক্ষীরের মতো গাঢ় নিস্তব্ধতা ঢেউ তুলে যায়, কয়েকটা মুহূর্ত, বিপাশার মনে হয় এক্ষুনি একটা কিছু বলা দরকার, একটা কোনো শব্দ হওয়া খুব দরকার—তারপরেই হাঁটা শুরু হয় বাইরের দিকে।
সবুজ মাঠে বেরিয়ে এসে বিপাশা দেখল ময়ূরটা চরছে তার তিনজন টার্কী সহচরের সঙ্গে। আপেলকুঞ্জের সামনের মাঠটায় খেলা করছে নীলপালক দুলিয়ে—প্রবাসী—ময়ূর। একলা ময়ূর!
—’আচ্ছা, তোর শীত করে না? এই শীতে এই বরফে তুই আছিস কেমন করে?’ বিপাশা ময়ূরকে বলে—’তোর মন—কেমন করে না? হ্যাঁরে, তুই বুঝতে পারিস না, এরা সবাই টার্কী? এরা কেউ তোর নিজের জাত নয়—এখানে আর একটিও ময়ূর নেই—’
মনে মনে ময়ূরের সঙ্গে কথা বলছে, এমন সময়ে য়োহান তর্জনী তুলে দেখায়—’ওই দ্যাখো, বিপাশা, তোমার স্বজন, এ্যানাদার বিউটিফুল বার্ড ফ্রম ইনডিয়া!’
৩
—’এভিচকা! দ্যাখো, দ্যাখো, বিপাশা কেমন ভয়ংকর লঙ্কা চিবুচ্ছে!’ য়োহান চেঁচিয়ে ওঠে—’খবর্দার। খবর্দার! অত ঝাল খেও না বিপাশা, আপনি জানেন না আপনি কী খাইতেছেন, সর্বনাশ হবে তোমার, ইউ’ল টেস্ট ইট টোয়াইস, এখন একবার, এ্যান্ড টুমরো মরনিং ওয়ান্স মোর—’ বলে দুষ্টু ছেলের মতো হাসতে থাকে য়োহান।
—’য়ো—হা—ন!’ এভা এবং এলিজাবেথ একত্রে বেদম ধমকে ওঠে য়োহানকে—’কী অসভ্যতা হচ্ছে, মেয়েদের সামনে?’
—’য়োহানের আবার সভ্যতা—অসভ্যতা! য়োহান তো একটি বর্বর। ওর পোশাকটাই দ্যাখো না। কী নোংরা প্যান্ট!’
—’এই রেস্তরাঁয় তোমার পোশাকটাই সবচেয়ে খারাপ, য়োহান।’
—’কিন্তু বিপাশার পোশাকটি আমার সব কিছু ত্রুটি পরিপূরণ করে দিচ্ছে, তাই না বিপাশা?’ আলুথালু ব্লু জীনস পরা য়োহান কৃত্রিম ঘনিষ্ঠ দৃষ্টিতে তাকায় বিপাশার দিকে।
বিপাশা ভাবে তার পরনের সবুজ মাইসোর জর্জেটের সোনালি জরির ফুলগুলো এই জনবিরল দীর্ঘ ঘরের মোমজ্বলা আলো—আঁধারিতে বড় বেশি উজ্জ্বল। রেস্তরাঁটি এককালে নিশ্চয় যথেষ্ট ফ্যাশনেবল ছিল, দেয়ালে পালিশ করা কাঠের প্যানেলিং দেখে তাতে সন্দেহ থাকে না, সিলিং থেকে ঝুলছে ঝাড়লণ্ঠন। খড়খড়ে শাদা চাদর বিছোনো টেবিল ঘিরে ওরা ছ’জন। বিপাশা, য়োহান, এভা, এলিজাবেথ, দেনিশ আর গেয়র্গ। কাট গ্লাসের সরুগলা ফুলদানিতে মাত্র একটি ড্যাফোডিল ফুল। তার পাশেই একটা কারুকার্য করা ছোট্ট বেতের ঝুড়িতে নানারকমের শুকনো খটখটে রুটি রাখা। টেবিলের দু’প্রান্তে দু’টি রূপোর বাতিদানে দু’জোড়া মোমবাতি জ্বলছে। সকলের সামনেই দীর্ঘ বৃন্তের স্ফটিকপাত্র, কোনোটায় লাল রং টলটল করছে, কোনোটায় জলরঙের ভদকা। য়োহানই খবরদারির ভার নিয়েছে। আর দুটি সুন্দর কাটগ্লাসের বাটিতে গোল গোল লাল সবুজ খুদে টোমাটোর মতো দেখতে দু’মুঠো কাঁচালঙ্কা। একটি বাটিতে টাটকা, অন্যটিতে ভিনিগারে ভেজানো।
হঠাৎ কাঁচালঙ্কা দেখে বিপাশা আহ্লাদে শুকনো রুটি দিয়ে একখানা খেয়ে ফেলেছিল। তারই ফলে য়োহানের ওই বেদম বালখিল্য রসিকতা,—কলকাতাতে নিজের বাড়ির চার দেয়ালের মধ্যে দাদা—ছোড়দার মুখে ছাড়া এ ধরনের রসিকতা বিপাশা জীবনে কখনো শোনেনি। ইওরোপে তো নয়ই, দেশেও না। গত পাঁচ বছরের মধ্যে এ ধরনের রঙ্গরসের সঙ্গে তার পরিচয় ছিন্ন হয়ে গেছে।
এভা—এলিজাবেথ যত সহজে নিল, অতটা সহজ হতে পারল না বিপাশা। তবু মন কেমন করল। দাদা—ছোড়দার অসভ্যতার জন্য। দেশের জন্য। বাড়ির খাবার টেবিলটা ঘিরে তিন ভাইবোনের আড্ডা। কতদিন দেখা হয় না। আরো কত দিন? কিন্তু কোথায় ফিরবে বিপাশা? পার্টিকে ফেস করবে কেমন করে? অথবা পুলিশকে? সমীর এখনও জেলে। সমীরকেই বা ফেস করবে কী করে সে? সমীর তো সব উল্টো বুঝে আছে। শোন সমীর, তুই যা ভেবেছিস, তা নয়—।
‘এটা তো হাঙ্গেরিয়ান রেস্তরাঁ, তাই আজ আমাদের হাঙ্গেরিয়ান মেনু।’ দেনিশ বলে—’ওই দ্যাখো, গুলাশ এসে গেছে।’
বড় বড় গোমাংসের টুকরো, আলুর টুকরো, টোমাটো আর শুকনো লঙ্কা গোলা লাল টুকটুকে ঝোল এল বড় বড় বাটি ভর্তি।
—’গুলাশ হচ্ছে হাঙ্গারির—’ দেনিশ মুখ খুলতেই হঠাৎ অধৈর্য হয়ে তাকে থামিয়ে দেয় বিপাশা—’প্রধান এবং প্রায় একমাত্র খাদ্য। এই তো? আমরাও তা জানি। যেহেতু পশ্চিম ইওরোপেও সবাই খুব গুলাশ খায়। আসলে হাঙ্গেরিয়ান খাদ্যটা সকলেরই চেনা—যদিও তোমাদের দেশের স্বকীয় খাদ্য আমার জানা নেই কিছুই।’
—’সে কি? এই সাত আট দিনেও চেক—খাদ্যের বৈশিষ্ট্য জানলে না, অথবা স্লোভাক খাদ্যের?’
—’কী করে জানব? কেবলই তো ভিয়েনিজ, ফ্রেঞ্চ আর হাঙ্গেরিয়ানই খাওয়ালে তোমরা, আজ আমার শেষ মিলটাও হাঙ্গেরিয়ান হল। তোমাদের চেক বা স্লোভাক খাবারদাবার কি ভদ্রলোকের পাতে দেবার মতো নয়?’
—’সত্যিই তো! বেচকা, এভিচকা, তোমরা এ কী রকম যত্ন করলে বিপাশাকে!’
এলিজাবেথ এবং এভার বিব্রত মুখ দেখে বিপাশা হঠাৎ লজ্জিত হয়, ওদের আর দোষ কি। কলকাতাতে যখন কোনও অতিথি আসেন, তাঁদের কি আমরা পাইস হোটেলে নিয়ে সুক্তো, শাকের ঘণ্ট খাওয়াই? আমরা তাদের বিদেশী খানায়—হয় মোগলাই নয় চীনে খাদ্যে আপ্যায়িত করি। নয়তো বিপ্রদেশী খানায় অর্থাৎ মাদ্রাজী কিংবা পাঞ্জাবী হোটেলে। এদেরও সেই অবস্থা আর কি। মনে হওয়া মাত্রই বিপাশা বলে—’আমরাও বাঙালীরাও অবশ্য তোমাদেরই মতন। রোজ নিজেরা যা খাই, বাইরের কেউ এলে তাদের সেটা না খাইয়ে অন্য কিছু খাওয়াতে চেষ্টা করি। তার ফলে বিদেশী বন্ধুদের যে দিশি খানাটা খাওয়াই হল না, সেটা আর খেয়াল করি না।’
—’দূর দূর’—এভা আস্তে আস্তে বলে—’মোটেই দুঃখু কোর না বিপাশা, স্লোভাক খাদ্য মানে গরীবের খাদ্য আর চেক খাদ্য বলে কিছুই বিখ্যাত কিউলিনারি ডেলিকেসি জগতে নেই। প্রাহাতে গেলে তবু হয়ত কিছু লোক—দেখানো চেক খাদ্যের রেস্তরাঁ পেতে। এ তো অজ পাড়াগাঁ, এখানে ওসব থাকে না।’
য়োহান বলে—’ভাল খাওয়ানো নিয়ে তো কথা। হাঙ্গেরিয়ান, ভিয়েনিজ, ফ্রেঞ্চ—এরাই রাঁধতে জানে। আমরা ভাল কাটগ্লাস বানাতে পারি। ভাল বিয়র বানাতে পারি। এভিচকা আর কী কী জিনিস ভাল পারি আমরা? বলে দাও তো বিপাশাকে—’
—’আর ভাল প্রেম করতে পারি’—হঠাৎ গেওর্গ জর্মনে বলে ওঠে।
গেওর্গ এমনিতে কথা বলে না। কবিমানুষ, লাজুকও আছে। তাছাড়া ল্যাঙ্গুয়েজ স্কুলের ছাত্র নয়। দেনিশ, এভা, এলিজাবেথ ল্যাঙ্গুয়েজ স্কুলের গ্রাজুয়েট ছাত্র—ছাত্রী—য়োহান ওদের মাস্টারমশাই। গেওর্গ য়োহানের বন্ধু। চুপচাপ। দাড়িগোঁফ—কামানো, সাদা শার্ট, চওড়া কালো টাই, কালো সুট পরা নবীন কবি সে। দেখলে মনে হয় বিলিতি ব্যাঙ্কের অফিসার।
আশ্চর্য, এই ডিনার পার্টিতে কোনো স্বামী—স্ত্রী নেই? অথচ বিপাশা আর এলিজাবেথ ছাড়া প্রত্যেকেই বিবাহিত। এভিচকার দেহই বলে দিচ্ছে খবরটি। সগৌরবে। গ্রে সুটের নীচে ঘননীল ফর্ম্যাল শার্টের ওপর লাল টাই—দেনিশকে দেখলে মনে হয় বাচ্চা ছেলে, কিন্তু সে নিজেই দু’দুটি ছেলেমেয়ের বাবা।
য়োহানও বিবাহিত। তার দুটি ছেলে। বৃদ্ধা মাও সঙ্গেই থাকেন। গেওর্গের একদা বিয়ে হয়েছিল। এখন সে মুক্তপক্ষ। কিন্তু সে যতটা প্রেম করতে পারে বলে দাবী করল, বিপাশার মনে হল না, সে সত্যিই ততটা পারঙ্গম, যেহেতু য়োহানের প্রতিই গেওর্গের মনোযোগ বেশি।
অথচ এলিজাবেথের শরীরে যৌবন যেন চীৎকার করছে। তার পরনে মিনি মিনি—স্কার্ট, ঊরুসন্ধি পর্যন্ত পরিদৃশ্যমান। এলিজাবেথকে দেখলে মনে হয় যেন সশস্ত্রবাহিনীর ট্যাংক জোড়া কামান বাগিয়ে ধরে খোলাখুলি যুদ্ধে নেমেছে।
এমন কি বিপাশারই লজ্জা করে, চোখ তুললেই এলিজাবেথের স্বল্প জামার উপরে—নীচে উন্মুক্ত মাংসে চক্ষু এঁটে যায়, মৃতের দেহে যেমন কাক। মজা এই, মিনিস্কাট কিন্তু পশ্চিম ইওরোপে আর ফ্যাশনেবল নেই। এলিজাবেথের খুব বড়সড় শরীর এবং বুলেটের মতন স্বাস্থ্য ফুটে বেরুচ্ছে সমস্ত প্রত্যঙ্গ দিয়ে, চামড়ার তলা দিয়েও রক্তের দীপ্তি। তবু সে মুখে যথেষ্ট রং ব্যবহার করে। ওর দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং প্রবল যৌবন স্ক্যান্ডিনেভিয়ার প্রাচীন দেবীদের কথা মনে পড়িয়ে দেয়—একপিঠ খোলা সোনালি চুল, চোখের মণি নীল, চোখের পাতাও নীল, ঠোঁটে গালে রক্তের অতিরিক্ত রক্তিমা। এলিজাবেথ, বেচকা কৃষককন্যা। সব সময়ে একমুখ হেসেই আছে, ঠিক টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনের মতো।
এভা, দেনিশ এবং বেচকা কনফারেন্সের তিনজন সেক্রেটারি। এভা ইহুদী মেয়ে, ঘাড় পর্যন্ত নরম থাক থাক কালো চুল—পরনে হবু—মায়ের লজ্জা নিবারক ঝুলি জামা ‘স্মক’, কাগজের মতন নীরক্ত মুখে একজোড়া লাজুক উজ্জ্বল হাসি—হাসি কালো চোখ। এলিজাবেথের যেন ঠিক উল্টো এভা। কিন্তু কথা এভাই বলতে জানে। এভার চেহারাটা চোখে পড়ে না, মৃদু কণ্ঠটি ওর উপস্থিতি ঘোষণা করে। তবে বিপাশা লক্ষ্য না করে পারে না, এ দেশের মেয়েরা, বাঙালী মেয়েদের মতোই ছেলেদের সামনে এগিয়ে দিয়ে নিজেরা পশ্চাৎপটে সরে থাকতে পছন্দ করে।
আজকের বক্তৃতায় যা কিছু প্রশ্ন ছেলেরাই তুলছিল—মেয়েরা ছিল তুলনায় চুপচাপ, শ্রোতা।
এই যে সন্ধ্যায় বিপাশাকে সামাজিকভাবে ফেয়ারওয়েল পার্টি দিচ্ছে এরা, একজনও স্ত্রীকে সঙ্গে আনেনি। অথচ পশ্চিম ইওরোপে সাধারণত এসব সামাজিক পার্টিতে যুগলে আসাই কানুন। এভার স্বামী অবশ্য এখন শহরে নেই। দু’মাসের জন্য প্রাহাতে গেছেন। আর এলিজাবেথ স্বামী খুঁজছে—ওর উদ্ধত কৌমার্য যেন জগতের তাবৎ পৌরুষের প্রতি একটা উচ্চণ্ড চ্যালেঞ্জের মতো মুখিয়ে আছে। অথচ স্বভাবে সে মৃদু, রীতিমতো লাজুক, কথায় কথায় লাল হয়ে ওঠে।
একমাত্র য়োহান ছাড়া এরা কেউ ফ্লার্ট করে না। বিপাশা লক্ষ্য করল, ফ্লার্ট না করলেও দেনিশের মুগ্ধ দৃষ্টি তাকে আপন নারীত্ব বিষয়ে সচেতন করিয়ে দিচ্ছে।
গেয়র্গ—বিপাশার সন্দেহ হয়—সে নারীত্বে মোটে উৎসাহিতই নয়। য়োহানই গেয়র্গের আরাধ্য—তার দৃষ্টিতে রীতিমতো পুজোর ধূপধূনোর ধোঁয়া দেখতে পাচ্ছে বিপাশা। অবশ্য য়োহানের সে নিয়ে মাথাব্যথা আছে মনে হচ্ছে না। সে একসঙ্গে এভা, এলিজাবেথ, বিপাশা—তিনজনেরই মনোরঞ্জনে ব্যস্ত।
বিপাশা দেখলো এভা, এলিজাবেথ এতে খুশি—খুশি লজ্জা পাচ্ছে, য়োহানের সকৌতুক প্রণয়—খেলার মধ্যে একটা লাম্পট্যহীন সহজ পৌরুষ, বেশ একটা মিষ্টি—দুষ্টু—সরল ছেলেমানুষি সৌন্দর্য আছে।
য়োহানের ওই সর্বপ্লাবী ব্যক্তিত্বের জন্যই কিনা কে জানে গেয়র্গ এবং দেনিশ ছায়া—ছায়া অস্তিত্বে পর্যবসিত। অথচ আজই দেনিশ সারাদিন ঘুরেছে বিপাশাকে নিয়ে। সে এখন সংস্কৃত পড়ছে। একটা সংস্কৃত পকেট—গীতা চেয়েছে দেনিশ বিপাশার কাছে। বুকপকেট থেকে বের করে ওকে দেখিয়েছে একটা ছোট্ট ইংরিজি পকেট—গীতা,—দেনিশের মুখে ইংরিজি, ফরাসী, জর্মন, রুশ—প্রত্যেকটি ভাষাই নিখুঁত। এবং সংস্কৃতও।
বুদমেরিৎসে প্রাসাদের বাগানে য়োহানের হিসেবে ভুল হয়েছিল একটা। বেচকা নয়, নীত্রায় আসার পর থেকে দেনিশই বিপাশার দোভাষী হয়েছে। কিন্তু আজ বিকেলে ছাত্রসভায় বিপাশার বক্তৃতার সময়ে ঝড়ের মতো এসে উপস্থিত হল য়োহান—হলের ছাত্রছাত্রীদের প্রতিক্রিয়া থেকেই টের পেল বিপাশা।
য়োহান এখানে একজন কেউকেটা। তার আসার পর থেকেই দেনিশ দেয়ালের সঙ্গে মিশে গেছে। এই দু’দিনে কিন্তু অনেক গল্প করেছিল দু’জনে। দেনিশের বাচ্চাদের ছবি দেখতে চেয়েছিল বিপাশা। পশ্চিম ইওরোপ বা মার্কিন দেশের বাপ হলে তক্ষুনি পার্স খুলে দেখিয়ে দিত স্ত্রী—পুত্র—পরিবারের ছবি। দেনিশ পারেনি।—’ছবি? ছবি এখানে কোথায় পাবো। ছবিটবি তো সব বাড়িতে।’—উত্তরটা শুনে আরেকবার আরাম পেয়েছিল বিপাশা। যাক, স্ত্রী—পুত্রের ছবি এরা হৃদয়েই ভরে রাখে তাহলে, মানিব্যাগে রাখে না। ভারতবর্ষের মতোই।
পূর্ব ইওরোপের অনেক কিছুই বিপাশার কেবলই ”দেশের মতো” লাগছে—এই পাঁচ—ছ’ বছর পাশ্চাত্যবাসের পরে সে যেন হঠাৎ স্বদেশের কাছাকাছি এসে পড়েছে। অথচ মিলটা যে ঠিক কোনখানে তাও টের পাচ্ছে না। লোকগুলোও শাদা, ভাষাটাও পরদেশী, আর রাজনীতিটাও ভূষিমাল, সোশ্যালিস্ট ইমপিরিয়ালিজমের। তবে? দিশিয়ানাটা ঠিক কোনখানে? বিপাশা ধরতে পারছে না, অথচ যেন ছুঁতে পারছে। মিলটা কোনখানে? অনেকগুলো প্রশ্নই স্পষ্ট হয়নি।
এই সোশ্যাল—ইম্পিরিয়ালিজম ব্যাপারটাই বিপাশার কাছে কেমন যেন অস্পষ্ট। পার্টিও কিছু ভাল করে শেখায় নি যেন এই ব্যাপারে। বিপাশা অবাক হয়ে দেখেছে হাঙ্গারি—চেকোস্লাভাকিয়ার বেলায় পার্টির এক রকম মত,—আর তিব্বতের বেলায় আরেক। একটা ‘অকুপেশন’—কিন্তু অন্যটা ‘লিবরেশন’। কেন? কেননা এক জায়গায় সোসালিজম ছিলই—অন্যত্র ছিল না। তাই কি? পার্টি তার অনেক প্রশ্নেরই উত্তর দেয়নি, কেবল ইওরোপের কম্যুনিজম বিষয়ে বেশ কিছু বিষবাষ্প শ্বাসপ্রশ্বাসে ঢেলে দিয়েছে। অ্যালবেনিয়াকে কিন্তু পূর্ব ইওরোপের অংশ হিসাবে তখন ধরা হয়নি। যেহেতু সে দেশ পিকিংপন্থী।
বিপাশা এই পাঁচ বছরে মনে করেছে অনেক কিছুই, পার্টি ভুল শিখিয়েছিল, অনেক একদেশদর্শী, অসম্পূর্ণ ধারণার সৃষ্টি করে দিয়েছিল তার মনে। নিশ্চয়ই পূর্ব ইওরোপ সত্যি সত্যিই সেরকম নয়, তার থেকে অনেক ভাল।
বিপাশার এই প্রথম কোনো নন—ক্যাপিটালিস্ট দেশে আসা। নিশ্চয়ই যতটা তার ধারণা, অতটা খারাপ নয়! প্রকৃতপক্ষে রাজনীতিজ্ঞান খুব গভীর নয়, সমীরের কাছাকাছি থাকলে যতটা সব বুঝতে পারে সে, একলা একলা অতটা বুঝতে পারে না। গত পাঁচ—ছ’ বছর ধরে শিক্ষা দিয়েছে তাকে ইওরোপের একক জীবন—নিজে নিজে কিছুটা ভাবতে শিখেছে, দেখতে শিখেছে সমীরের চেয়ে আলাদা করে। তাতে আগের চেয়ে একটু ভালো করেই হয়তো নিজের দেশের সমস্যাটা দেখতে শিখেছে বিপাশা,—বুঝেছে পার্টির ভুল কোথায় ছিল। দেশে থাকলে এ—চোখ তার খুলত কি? কে জানে!
—’দেনিশ, চল, এবার অফিসেই যাওয়া যাক।’ ক্যারামেল কাস্টার্ডটা এগিয়ে দিয়ে য়োহান চেঁচায়।
বিপাশা দুঃখিত হয়ে ভাবে, হায়, এখানেও সেই ক্যারামেল কাস্টার্ড? তারপরে খেয়াল হয়—অফিস? অফিসে কেন?—’অফিসে যাওয়া যাক মানে? এত রাত্রে তোমরা অফিসে গিয়ে কাজ করবে?’
বিপাশার চমকে ওঠা দেখে হো হো করে হেসে ওঠে য়োহান। উত্তরটা দেনিশই দেয়—’হুঁ, কাজ করবো। ভীষণ কাজ। প্রচণ্ড জরুরী। তোমরাও যাবে কাজ করতে। এত খাওয়া—দাওয়া কি অমনি অমনি নাকি? পরিশ্রম করবে না এবার?’
বিপাশা ধাঁধায় পড়েছে দেখে এভা, এলিজাবেথ, এমনকি গেয়র্গও হাসে!
গেয়র্গ বলে—’য়োহান, আমি কিন্তু যাচ্ছি না। আমার সর্দি হয়েছে। আর রাত করতে চাই না। আজ আবার বৃষ্টি—বৃষ্টি আছে!’
য়োহান এক থাবড়া বসায় গেয়র্গের বদলে এভিচকার পিঠেই, যেহেতু সেটাই ওর হাতের কাছে, এবং ধমক লাগায় গেয়র্গকে।
—’গেয়র্গ, ভিজে কম্বলের মতো যাচ্ছেতাই হোয়ো না বাপু—একদম যা—তা হয়ে যাচ্ছো তুমি আজকাল, এটাকে কি বৃষ্টি বলে? ইলশেগুঁড়ি না হলে কি বসন্ত আসে? ভাল কড়া টোকাই মদ দেব—দেখো সব সর্দিফর্দি শুকিয়ে মাথার মধ্যে আগুন ধরে যাবে। সব্বাই যাবে এখন আমার অফিসে। স্কোয়াড, এ্যাটেনশন!’ বলেই সটান লাফিয়ে উঠে এ্যাটেনশনে দাঁড়ায় য়োহান।
রেস্তরাঁর অন্যান্য মানুষরা হাসিমুখে চেয়ে থাকে এই মোহন পাগলটির দিকে।
দেনিশ হেসে বিপাশাকে বলে—’য়োহানের অফিসে একটা আস্ত মদের আড়ৎ আছে—ওটাকে ওর পাবলিক রিলেশন্স অফিসই বলতে পারো! সেখানেই যাওয়া হচ্ছে।’
পথে বেরিয়ে এসে ওরা হাঁটতে থাকে। ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়ছে। পথে ট্রামবাস নেই। —’ট্যাক্সি নেবো একটা? তুমি হাঁটতে পারছো তো?’ দেনিশ প্রশ্ন করে।
—’এভিচকাকে প্রশ্নটা করো বরং।’ বিপাশা বলে—’ওরই হয় তো—’
—’মোটেই না—খুব হাঁটতে পারছি আমি। ডাক্তার আমাকে হাঁটতেই বলছে।’ এভা আপত্তি জানায়।
যে রাস্তায় ওরা ঢোকে, সে—রাস্তায় অন্ধকার। দুদিকে মস্ত মস্ত অট্টালিকা। ম্লান বিদ্যুৎস্তম্ভগুলি দীন আলোকসম্পাত করছে ভিজে ভিজে গোল গোল পাথর বসানো পুরোনো রাস্তার ওপরে। এইরকম নুড়ি বসানো রাস্তা ‘কবলড রোড’ বিপাশার খুব ভাল লাগে। রাস্তার দুধারে কেবলই বিশাল সব অন্ধকার বাড়ি। দু’একটা ঘরে বাতি জ্বলছে। সবই ইউনিভার্সিটির বাড়ি। এখন বন্ধ। তাই পাড়াটা এত অন্ধকার।
পথে লোকজন নেই। একটা প্রাসাদোপম বাড়ির বিশাল বন্ধ ফটকের সামনে তাদের ক্ষুদ্র শোভাযাত্রাটা থমকে দাঁড়ালো। দেয়ালে ‘মিউজিক স্কুল’ লেখা বড় বড় হরফে। ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে পকেট হাতড়ায় য়োহান। কোটেরই প্রায় দশটা পকেট—ভেতরে বাইরে আশেপাশে। নোটবই বেরুচ্ছে, পাইপ বেরুচ্ছে, লাইটার বেরুচ্ছে, দেশলাইও বেরুচ্ছে গাদা গাদা, রুমাল বেরুলো, গল্পের বইও বেরুলো, কলম, পেন্সিল এবং একাধিক চাবির গোছা। কোনোটা বাড়ির, কোনোটা তার ব্রাটিস্লাভার অফিসের, কোনোটা পার্টি অফিসের। য়োহান কম্যুনিস্ট পার্টির লোকাল চ্যাপ্টারের ফার্স্ট সেক্রেটারি। শেষপর্যন্ত প্যান্টের পকেট থেকে বেরুলো এই অফিসের চাবি!
৪
মিউজিক স্কুলের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো বিপাশারা ক’জন। দরজার কাছে গেয়র্গ আরেকবার চলে যাবার চেষ্টা করেছিল—দেনিশ বাধা দিল আর য়োহান ধমক দিল—গেয়র্গ থেকেই গেল দলে।
মস্ত সিঁড়ি। দেয়াল ভরা নানান বিজ্ঞাপন পোস্টারে পোস্টারে ছাওয়া। নানান সাংস্কৃতিক উৎসব হয় এখানে—পিয়ানোবাদন, ধ্রুপদী অপেরা এবং থিয়েটারের বিজ্ঞাপন ছাড়াও লোকনৃত্য—লোকগীতির বিজ্ঞাপন প্রচুর। দেয়াল দেখতে দেখতে সিঁড়ি দিয়ে উঠছে বিপাশা। শ্বেতপাথরের তৈরি সিঁড়ি উঠেছে দোতলা পর্যন্ত। মাথা ঘুরিয়ে ছাদের দিকে তাকালো বিপাশা। গম্বুজের ভেতর গম্বুজ; মস্ত মস্ত থাম মাথায় করে ধরে আছে ছাদের গম্বুজগুলো। ছ’জনের দল দোতলায় উঠে এলো। অন্ধকার দীর্ঘ নির্জন করিডর উত্তর—দক্ষিণে দু’দিকে দু’মুঠো গহন রহস্যের মধ্যে সেতু হয়ে জেগে উঠলো পায়ের নীচে। সামনে একটা বিরাট ব্ল্যাকবোর্ড, তাতে চকখড়ি দিয়ে নানান নির্দেশ লেখা, বিধাতার ললাটলিপির মতোই তা দুর্বোধ্য বিপাশার কাছে।
ওপরে এসে য়োহান চলল বাঁদিকে। দলসুদ্দু তাকে ফলো করে। অন্ধকার করিডরের গায়ে রাস্তার আলো এসে পড়েছে মাঝে মাঝে—মেঝেতে বিপুল থামের ছায়া সৃষ্টি করে।
হঠাৎ একটা আপত্তির স্বর ‘না’ ছিটকে উঠে এল অন্ধকার থেকে। একটি মেয়ের গলা।—’নি—য়ে!’ তারপর একটি পুরুষের অনুনয়ের কণ্ঠ—খাদে কিছু বললো। স্ত্রীকণ্ঠ আবার বলল—’নি—য়ে! নি—য়ে! নি—য়ে!’
ছ’জোড়ার মধ্যে তিনজোড়া পা এবারে থমকে গেল। বিপাশার সঙ্গে সঙ্গে থেমে পড়েছে এভা, এলিজাবেথ। সবাই চুপ। জুতোর শব্দ তুলে কেবল এগিয়ে যাচ্ছে য়োহান। গেয়র্গ, দেনিশের পায়ে কিছুটা অনিশ্চয়তার ছাপ।
হঠাৎ দেয়ালের আড়াল থেকে ছুটে এল একটি মেয়ে। দুই হাতে মুখ ঢেকে। চুল উড়ছে। স্কার্ফ উড়ছে। কোটের নিচেটা উড়ছে। করিডরে বেরিয়ে এসেই থেমে দাঁড়ালো, মুখ থেকে হাত সরিয়ে এদের দেখলো।
য়োহান বলল—’এই যে, য়ানা! কি ব্যাপার?’
য়ানা অন্ধকারে তর্জনী নির্দেশ করে কী যেন অভিযোগ জানায়।
সঙ্গে সঙ্গে হাসতে হাসতে এগিয়ে আসে একটি পুরুষ—তার হাতে কী যেন ঝিকিয়ে ওঠে—তারপরেই এক ঝলক আলো খেলে যায়—করিডরের পরবর্তী অন্ধকারকে আরো গাঢ় করে দিয়ে। মেয়েটি চেঁচিয়ে উঠে—’নিয়ে! কার্ল!’
হা—হা হাসিতে করিডর প্রতিধ্বনিত করে কার্ল বলে—’ধন্যবাদ, য়ানা।’ তার হাতে একটি ফ্ল্যাশবালব লাগানো বাচ্চাদের ক্যামেরা।
হায়, এই ব্যাপার! এভা ও বেচকা একসঙ্গে হেসে ওঠে খিলখিলিয়ে —’কার্ল, য়ানার ছবি তো কতই তুলতে পারবে, আজ বিপাশার একটা তোলো বরং’—এভা বলে।
কার্লও ক্যামেরা—হস্তে সুবোধ বালকের মতো অগ্রসর হয়—’নিশ্চয়, একশো বার—যদি উনি আপত্তি না করেন। বাবাঃ, য়ানার চীৎকার শুনলে লোকে তো ভাববে ওকে নির্জন বাড়িতে পেয়ে আমি বোধহয় বলাৎকার করছি।’
—’আমরা ঠিক তাই ভেবেছিলাম।’ এভা বলে।
বেচকা লজ্জা—লজ্জা হেসে ওঠে—’কী বোকাই আমরা!’
কার্ল খুবই সুদর্শন। এগিয়ে এসে নতশির অভিবাদন জানিয়ে বলে—’মে আই?’
য়োহান কোত্থেকে দৌড়ে এসে দাঁড়ায়—’আমরা এই ছ’জনেই থাকবো কিন্তু ছবিতে—য়ানা সুদ্দু’—বলে য়ানাকেও টেনে নেয়।
কার্ল গ্রুপ—ছবি তোলে। তারপরে বলে—’এবার এঁর একার একটা শাড়িপরা ছবি।’
বিপাশার খুব লজ্জা করতে থাকে। এই প্রাসাদের বদলে—মিউজিক স্কুলের বিপুল, বিস্তৃত, নির্জন, নিরালোক করিডরে—এত রাত্রে এই প্রেমিক যুগলের একান্ত সময়টুকু ধ্বংস করে দিয়ে নিজেদের ছবি তোলার পুরো ব্যাপারটাই তার বিশ্রী লাগল। কী যে হয় ছবি দিয়ে! ছবি কি মানুষটাকে ধরে রাখতে পারে? না মনকে?
থামের গায়ে হেলান দিয়ে বিপাশাকে দাঁড় করালো কার্ল—কোটটা খুলে নেবার ইচ্ছেও প্রকাশ করল—কিন্তু খোলা বারান্দায় কনকনে বাতাসে বিপাশা মোটেই রাজি হলো না শাড়ির বিজ্ঞাপন দিতে।
ছবি তোলার পরেই কার্ল ঠিকানা চাইল।
য়োহান এক ধমক লাগায়—’ঠিকানা আবার কি? আমাকে দেবে। আমিই পাঠিয়ে দেব। য়ানার ঠিকানাটাই মনে রাখো, ওতেই হবে।’
সবাই হেসে ওঠে।
বার বার বিদায় জানিয়ে কার্ল আর য়ানা পাশাপাশি হেঁটে করিডোরের অন্য প্রান্তের অন্ধকারে হারিয়ে গেল। পাশাপাশি—কিন্তু জড়াজড়ি করে নেয়।
কী করছে ওরা এই বন্ধ বাড়িতে? এত রাত্রে? বেচকা বলে—কার্ল মিউজিক স্কুলে পড়াচ্ছে—য়ানা ওখানে গ্রাজুয়েট ছাত্রী। বোধহয় কোনো রিহার্সাল চলছে বিশাল বাড়ির অন্যপ্রান্তে।
বিপাশা প্রথমে ভাবলো—ওরা তো হাতও ধরল না পরস্পরের? কেবল পাশাপাশি হেঁটে চলে গেল—যদিও স্পষ্টতই ওরা প্রণয়ী!
এ যেন ঠিক আমাদের দেশের মতো—পশ্চিম ইউরোপের প্রণয়ীদের চালচলন এর উল্টো! তার পরেই মনে হল—না, দেশের মতো নয়। দেশে হাত না ধরার কারণ রক্ষণশীলতা। আর এখানে কারণটা হল প্রগতি। যৌনতার নগ্ন প্রদর্শনী চোখে পড়ে না এখানে, তার কারণ দেশে এখন মুক্তির মুহূর্ত এসে পৌঁছয়নি, আর এরা সেই মুহূর্ত পেরিয়ে চলে গেছে। যত যাই হোক, কম্যুনিস্ট ডিসিপ্লিনটাই আসলে আলাদা। যতটা খারাপ কথা শিখেছিল তারা পার্টির কাছে এই পূর্ব ইওরোপের সমাজতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদ বিষয়ে—তার কতটা সত্য কে জানে? রিভিশানিজমের সঙ্গে তার জগৎটাও খুব স্পষ্ট না। কিন্তু এটাও সত্যি যে এখানে যুবক—যুবতীদের মধ্যে একটা সংযম আছে—একটা আদর্শ আছে সামনে —সেটা যেমনই হোক, পশ্চিম ইওরোপের পুঁজিবাদী ধনিক মানসিকতার চেয়ে তো ভাল।
দেশে কম্যুনিজম বলতে বিপাশা শিখেছিল মাওয়ের বাণী। কিন্তু এই পাঁচ বছর বিলেতে বসে বসে বাপের অন্নধ্বংস করছে সে। আর ইংরিজি ভাষাতে ভারতীয় লেখক হচ্ছে—যার ফলশ্রুতিতে এই কনফারেন্সে আসা।
বিলেতে বসে বসে অনেক বদল হয়েছে বিপাশার। এখন সে ইতালি কি ফ্রান্সের কম্যুনিস্ট পার্টিকে কিছুটা বুঝতে পারে। দেশে থাকতে এদের প্রতি ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। আর এই তার প্রথম লৌহ যবনিকার অন্তরে প্রবেশ। কিন্তু কি আশ্চর্য, এদের এখানে কিছুই যেন ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। একটা আলো—আঁধারি, একটা গোপনীয়তা (যা কিনা বহির্বিশ্বে সর্বজনবিদিত সাধারণ জ্ঞান)—সত্যিই কুয়াশার মতো বাতাস ভারী করে ঝুলে রয়েছে। মোটামুটি যে ইম্প্রেশনটা হয় সেটা কিন্তু নিঃসংশয় স্বস্তি দেয় না। সকলের সব কিছু থাকার যে অমূল্য তৃপ্তি, শ্রেণীহীন সমাজের বাসিন্দা হওয়ার যে পরিপূর্ণ নিশ্চিন্তি—তার বদলে কী একটা অদ্ভুত টেনশন প্রত্যেককে গেঁথে রেখেছে।
বিপাশা ভাবে—আমার বদলে যদি সমীর আসতো, পরিস্থিতিটা সে ঢের বেশি বুঝতে পারতো। আমি তো সত্যিই ভাল করে সবটা বুঝি না—আমার মনে প্রশ্নের পরে প্রশ্ন অমীমাংসিত রয়ে গেছে—তবে চেকোস্লোভাকিয়াতে আসতোই না সমীর এই যা।
এই হলো তাদের পার্টির একটা দোষ। এই মানসিক প্রতিবন্ধক গড়ে তোলা। মনটা খোলা রাখতে না দেওয়া। যেমন দেশকে বুর্জোয়া ইনফিলট্রেশন থেকে বাঁচাতে পূর্ব ইওরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো সীমানা নিয়ে বাড়াবাড়ি করে—তেমনি মনকে বুর্জোয়া ইনফিলট্রেশন থেকে বাঁচাতে পার্টিও কিন্তু কর্মীদের মনের সীমানাগুলো বড্ড ছোট করে দিয়েছে। কে জানে সেটাই ঠিক কিনা। গাছ বাড়বার সময়ে যেমন বেড়া দেওয়াটাই কর্তব্য।
বিপাশার আজকাল মনটা বড্ড বেশি খোলা হয়ে গিয়েছে—কোথাও যেন কোনো শেকড় খুঁজে পায় না। সবচেয়ে মনে হয়—’এও হয়, আবার ও—ও হয়’—এতটা উদারতা কি ভালো? এটাকে কি উদারতা বলে, না দুর্বলতা বলে? না বিশ্বাসের অভাব বলে? কমিটমেন্টের অভাবকে ‘উদারতা’ আখ্যা দেওয়ার মধ্যে নতুনত্ব আছে কী? সমীর কি তবে অনুদার? সমীর বুঝি তার অনুদারতার জন্যই পাঁচ বছর ধরে বিনা বিচারে জেলে রয়েছে? সমীর হলেও কক্ষনো তার হাত ধরত না এত লোকের সামনে।