প্রথম স্পর্শ

প্রথম স্পর্শ

সাজানো গোছানো একটা নিখুঁত বাড়ি৷

গোটা বাড়িময় আভিজাত্যের চিহ্ন৷ পামেলার নিজের হাতে সাজানো সংসার৷ সৌমেনের স্বপ্নের বাড়িকে নিজের রুচিতে সাজিয়ে তুলেছে পামেলা৷

সৌমেন কলেজের প্রফেসর৷ নির্বিবাদী মানুষ৷ তবে একটা অদ্ভুত উদাসীনতা যেন সব সময় গ্রাস করে আছে ওকে৷ না, ওই বেরঙিন উদাসীনতার ঘেরা টোপের মধ্যে কখনো পামেলাও ঢুকতে পারেনি৷

ওটা যেন সৌমেনের একান্ত বিলাসিতার জায়গা৷ ওর মনখারাপ,না পাওয়াটাকে যেন একটু করে করে খরচ করে ও৷ কিছুতেই যেন ওই কষ্টের ভাগ দেবে না কাউকে৷

বিয়ের প্রথম প্রথম পামেলা জিজ্ঞেস করতো, কি হয়েছে সৌমেন? মনখারাপ৷

ঘাড় নেড়ে না বলা ছাড়া যেন আর কিছুই বলার নেই ওর৷

পামেলাও গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে৷

সম্পর্কটা ধীরে ধীরে কর্তব্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ৷ পামেলা স্বামীর জন্য পছন্দের খাবার বানায়, ঘর গোছায়৷ সৌমেনও কিনে দেয় পামেলার একমাত্র বিলাসিতা, পছন্দের বই৷

বই পড়াটা পামেলার মারাত্মক একটা নেশা৷

অবশ্য এই বই পাড়াতেই ওদের প্রথম আলাপ৷

ভগবান তথাগতর ওপর একটা রেয়ার বইয়ের একটাই কপি নিয়ে ওদের ঝগড়া লেগেছিলো৷ পামেলা বলেছিলো, বইটা আমি আগে দেখেছিলাম, দিয়ে অর্ডার করেছি৷ সৌমেনের বক্তব্য ছিলো, আমি আগে পেমেন্ট করেছি৷

অবশেষে বুক সেলারই এর বিধান দিয়েছিলেন৷ পনেরোদিন আপনি রাখুন, পনেরো দিন আপনি৷

আবার প্রিন্ট হলে আরেকজন কিনে নেবেন৷ শেষ পর্যন্ত ঝগড়া করে পামেলা বইটা প্রথম নিয়ে গিয়েছিলো নিজের বাড়িতে৷ অবশ্য কথা রেখেছিলো পামেলা৷ নিজেই ফোন করে সৌমেনকে ডেকেছিলো কফি হাউসে, দিয়ে শর্ত অনুযায়ী বই এসেছিলো সৌমেনের কাছে৷

প্রথম আলাপটা বেশ রোমান্টিক হলেও বিয়েটা বেশ কঠিন ছিলো৷ কারণ পামেলারা ছিল খ্রিষ্টান৷ সৌমেন খাঁটি ব্রাহ্মণ বাড়ির ছেলে৷

পামেলা প্রায়ই মজা করে বলতো, সপ্তপদীর কৃষ্ণেন্দু তার প্রিয় চরিত্র৷

যদিও প্রেম বলতে যেটা বলা হয় সেরকম সম্পর্ক ওদের কোনোদিনই ছিলো না৷ হয়তো প্রাপ্ত বয়স্কদের বন্ধুত্বে উচ্ছল আবেগটা একটু কম থাকে বলেই,কেউ কাউকে ভালোবাসি কথাটাও বলে উঠতে পারেনি আজও৷

পামেলা আর সৌমেনের গল্পগুলোও ছিল বইপত্র কেন্দ্রিক৷ তাই হূদয়ের আবেগে ভেসে যেতে পারেনি কোনোদিনই৷ তবুও কেমন একটা টান… ভালোলাগা ছিলো তো বটেই৷ পছন্দের কোনো বই পড়েই সৌমেন প্রথম ফোনটা করতো পামেলাকে৷

বিয়েটা হয়েছিলো পামেলার বাড়ির ইচ্ছেতেই৷ সৌমেনের মা প্রথমে মেনে নেননি, তারপর ছেলের মুখের দিকে তাকিয়েই বিয়েতে মত দিয়েছিলেন৷

বিয়ের পর বছর দেড়েক ভালোই কাটলো৷

কিছুদিন ধরেই একটা নতুন সমস্যা দেখা দিয়েছে পামেলার৷ বই পড়তে গেলেই চোখদুটো অসম্ভব লাল হয়ে যাচ্ছে, সাথে জল পড়ছে৷ সাথে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে চশমার পাওয়ার৷

ডক্টর বললেন, কর্নিয়া এফেকটেড৷ বেশি স্টেইন দেওয়া চলবে না চোখের ওপরে৷

তাও কমছে না পামেলার বই পড়া৷

সেদিন সন্ধ্যেতে হঠাৎ পামেলা বললো, জানো সৌমেন, কেন জানিনা আমার মনে হচ্ছে, আমি অন্ধ হয়ে যাবো৷ হয়তো আর বই পড়তেই পারবো না৷ তাই যতটা পারছি পড়ে নিচ্ছি৷

সৌমেন বলেছিল, জীবনে তো অনেক পড়লে, আর নাইবা এমন অত্যাচার করলে চোখদুটোর ওপরে?

অন্ধকার কিন্তু বড়ো কষ্টদায়ক পামেলা৷ ওই সাত আট ঘন্টার রাত্রির বিশ্রাম বলেই হয়তো অন্ধকার মোহময়৷ কিন্তু ভেবে দেখো তো, একদিন সকালে উঠে দেখলে, চারিদিক শুধুই অন্ধকার… তখন?

পামেলা অবসন্ন গলায় বলেছিল, কি হবে এই সাজানো সংসারের আড়ালের নিস্পৃহতা দেখে?

এখন মনে হয় জানো সৌমেন, শুধু বই পড়ার রুচির মিল হলেই মনের সব অংশের মিল হয় না৷ সংসার আরো বৃহত্তর জায়গা৷ বিয়েটা না হলেই বোধহয় ভালো হতো?

সৌমেন ব্যালকনির সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে তাকিয়ে বলেছিলো, আমি কি তোমাকে স্বাচ্ছন্দ্য দিইনি পামেলা?

দিয়েছো, দুটো শরীর এক হয়েছে, শুধু উষ্ণ হয়নি ভালোবাসার ছোঁয়ায়৷

পামেলা আর কথা না বাড়িয়ে একটু জোরেই চালিয়ে দিয়েছিলো টিভির অপ্রয়োজনীয় খবরের চ্যানেল৷

আবার শুরু হয়েছিলো একটা নতুন দিন৷

কয়েকদিন ধরে পামেলা আর একেবারেই বই পড়তে পারছে না৷ ডক্টরেরা রেস্ট লিখে দেওয়ার পরেও পড়ছিল৷ কিন্তু এখন পড়তে গেলেই চোখ দিয়ে জল পড়ছে৷

অনেক ভেবে সৌমেনই একটা উপায় বের করলো৷

কাগজে বিজ্ঞাপনটা দিয়েই দিলো৷ একজন পঁচিশ-ত্রিশের মেয়ে চাই৷ যে ইংরেজি বাংলায় পারদর্শী৷ বই পত্র পড়তে ভালোবাসে৷ পামেলার সমবয়সী হলে কথা বলতেও ভালো লাগবে বলেই এই বয়সটা নির্দিষ্ট করেছিল সৌমেন৷

দিনে তিনঘন্টা বিভিন্ন বই পড়ে শোনাতে হবে পামেলাকে৷

পামেলা শুনেই বলেছিল, কেন অকারণ খরচ করছো বলতো৷ এমনিতেই আমার চোখের ট্রিটমেন্টের জন্য কত টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে৷ শোনেনি সৌমেন৷ বই না পড়তে পারলে পামেলার যে ঠিক কতটা কষ্ট হবে সেটা ওর থেকে আর কে বেশি বুঝবে!

সৌমেন বললো, পামেলা বিকেলের দিকে ইন্টারভিউ রেখেছি৷ আমি তো থাকতে পারবো না, তুমিই পছন্দ করে নিও, তোমার পঠন সঙ্গীকে৷

দেখো দিনকাল কিন্তু খারাপ, সাবধানে বাছবে কিন্তু৷

পামেলার মুখটা হঠাৎ খুশিতে ভরে গেছে৷ হয়তো সৌমেনের ওর প্রতি মনোযোগই এই খুশির একমাত্র কারণ৷

বাড়ি ফেরার পরেই পামেলা বেশ উচ্ছসিত৷ জানো সৌমেন, মোট এগারো জন মতো এসেছিল৷ তার মধ্যে আমি একজনকে পছন্দ করেছি৷ নয়নিকা নাম মেয়েটির৷ মেয়েটি খুবই সাদামাঠা দেখতে, কিন্তু চোখ দুটো অপূর্ব৷ ইংরেজি উচচারণে একটি গ্রাম্য টান আছে ঠিকই কিন্তু ওর একটা জিনিসই আমার খুব ভালো লাগলো৷ বই পড়ার আগে নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে খুব যত্ন করে বইটা মুছে নিলো৷

অনেকদিন পরে পামেলাকে এইভাবে হাসতে দেখে খুব ভালো লাগলো সৌমেনের৷

বেশ, তোমার এই অয়নিকা আসবে কখন?

উফ সৌমেন, নাম ভুলে যাবার বাতিকটা তোমার এখনো যায়নি দেখছি৷ অয়নিকা নয় ওর নাম৷

পামেলার সাথে প্রথম পরিচয়ের দ্বিতীয় দিনেই সৌমেন ওকে পায়েল বলে ডেকেছিলো৷ সত্যি এই নাম ভুলে যাবার রোগটা বত্রিশে এসেও গেল না সৌমেনের৷

মেয়েটি নাকি কাল থেকেই আসবে৷ দুপুর তিনটে নাগাদ আসবে ৷ যাক ভালোই হয়েছে, লাইব্রেরি, টুকিটাকি কাজ করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সৌমেনের প্রায়ই সন্ধ্যে ছটা বেজে যায়৷ আজকাল অপরিচিত মানুষদের সম্মুখীন হতে বড়ো অস্বস্তি হয় সৌমেনের৷ কলেজ কলিগ, ছাত্র ছাত্রী, বইপত্র আর পামেলার বাইরে কারোর সাথেই ঠিক মতো যোগাযোগ রাখতে ইচ্ছে করে না সৌমেনের৷ পামেলা বলে, তুমি বড্ড ঘরকুনো হয়ে যাচ্ছো সৌমেন৷

রোজই পামেলার কাছে ওই অয়নিকা না নয়নিকার গল্প শোনে সৌমেন৷ পামেলার চোখের প্রব্লেমটাও একটু কমেছে৷ প্রেশার কম পড়ছে চোখে৷ দিন পনেরো হয়ে গেল মেয়েটি জয়েন করেছে, এর মধ্যেই পামেলার চোখটা অনেকটা ভালো৷

আজ ঘরে ঢুকেই চোখে পড়লো, ফ্লাওয়ার ভাসে একগুচ্ছ রজনীগন্ধা৷ পামেলার পছন্দ রক্ত গোলাপ আর টিউলিপ৷ তাই এ বাড়িতে ওই দুটো ফুলই দেখতে পায় সৌমেন৷ বাকিদের প্রবেশ ঘটেনি৷ তারা ব্রাত্য৷

সৌমেনের হাসি পেয়ে গেল৷ পুরোনো স্মৃতির গন্ধ এসে ঝাপটা দিলো নাকে৷ ক্লাস সেভেনের ক্লাসে দাঁড়িয়ে রোগা রোগা ছেলেটা বলেছিল, ম্যাম আমার পছন্দের ফুল গোলাপ নয়, রজনীগন্ধা৷ গোলাপের মধ্যে কেমন একটা অহংকারী মন লুকিয়ে আছে৷ রজনীগন্ধা যেন মধ্যবিত্ত৷

ম্যাডাম বলেছিলেন, সৌমেন তোমার প্রচুর জ্ঞান বেড়ে গেছে, এবার জীবনবিজ্ঞান বইটা খোল৷

বেশ কিছুক্ষণ ধরে রজনীগন্ধার সামনে দাঁড়িয়ে গন্ধটাকে ভিতরে মিশিয়ে নিলো সৌমেন৷

স্যার! আপনাকে বৌদি ডাকছেন৷

পিছন ঘুরেই চমকে গেছে সৌমেন৷

নয়ন!

তুমি?

আমার নাম নয়নিকা স্যার, আমিই বৌদির কাছে বইপত্র পড়ার জন্য আসছি৷

পাশের ঘরে চলে গেছে ও৷

এক ঝাড় রজনীগন্ধার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সৌমেন৷

সময় যেন থমকে গেছে৷

কিন্তু হঠাৎ করেই একটা গ্রাম্য হাওয়া মুহূর্তে উড়িয়ে নিয়ে গেল সৌমেনের আনা মনখারাপের কারণগুলোকে৷ যে মনখারাপের কারণটাই ছিল সৌমেনের নিজের কাছেই অচেনা৷ মনকে বারবার প্রশ্ন করেও যার সঠিক উত্তর পায়নি ও৷

পিছিয়ে চলে যাচ্ছে সেই পলাশপুর গ্রামের বড়ো মাসির বাড়িতে ৷

কলেজের গ্রীষ্মের ছুটিতে মা-কে নিয়ে মাসির বাড়ি গিয়েছিলো সৌমেন৷

মা অনেকদিন যায় নি, বড়ো মেসোমসাই খুব অসুস্থ ছিলো৷

অগত্যা সৌমেনের ওপরেই দায়িত্ব পড়েছিলো মা-কে নিয়ে পলাশপুর যাবার৷

মাসির বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে কালবৈশাখীর আগমন বার্তা শুনছিলো সৌমেন৷

হঠাৎই খেয়াল করেছিলো সামনের চুন খসা একতলাটার ছাদে দাঁড়িয়ে একটা মেয়ে পাগল হাওয়ায় নিজের ওড়নাটা ওড়াচ্ছে৷

সৌমেনের খুব মজা লেগেছিলো৷

বেশ জোরেই হেসেছিলো ও৷

মেয়েটি হাওয়ার শনশন আওয়াজকে উপেক্ষা করেই চেঁচিয়ে বলেছিলো, ওমা দীপিকা পিসির বোনপোটা পুরো পাগল৷ কথায় একটু গ্রাম্য টান৷

কিন্তু গলাটা বেশ মিষ্টি৷

সৌমেন হকচকিয়ে বলেছিলো, আমি পাগল নই… যে ওড়না ওড়াচ্ছে সে পাগল৷

পরেরদিন সকালে ঘুম ভেঙেই দেখেছিলো কালকের উড়িয়ে ওড়না দাঁড়িয়ে আছে, হাতে নারায়ণ সান্যালের ‘বিশ্বাসঘাতক’৷

এই নিন, দীপিকা পিসি বললো, তার বোনপো নাকি বই পড়তে ভালোবাসে?

গ্রামে এসে বই পাচ্ছে না বলে রাগ হচ্ছে তার!

গ্রামের লোকেরা বুঝি বই পড়ে না? তবে শুনুন, এটা কিন্তু গ্রামীন লাইব্রেরির বই, একটু যত্ন করে পড়বেন৷ কিনে পড়ার সামর্থ্য হয়তো আমাদের নেই৷

নিজের ওড়নার খুঁট দিয়ে মুছে বইটা সৌমেনের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলো৷

প্রায় সমবয়সী ওদের মধ্যে বন্ধুত্ব হতে সময় লাগেনি খুব৷ নয়ন তখন ক্লাস টুলেভের ছাত্রী৷ সৌমেন সেকেন্ড ইয়ারে৷

মাসি ওকে নয়ন বলেই ডেকেছিলো৷ তাই সৌমেনও ওই নামটাই জেনেছিলো৷

ওদের গ্রামটা ঘুরিয়ে সৌমেনকে দেখানোর দায়িত্ব পড়েছিলো নয়নের ওপরেই৷

উফ একটু আস্তে হাঁট চয়ন!

কোমরে হাত দিয়ে নয়ন বলেছিলো, খবরদার ভুল নামে ডাকলে সাড়া দেব না, কিন্তু৷

গরিবের না আছে টাকা, না আছে রূপ… ওই নাম টুকুই তো সম্বল, ওটাও ভুল বললে… নিজেকে চিনবো কি করে?

সৌমেন কনে দেখা আলোয়, শালুক ভরা পুকুরের সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিলো, তোমার নয়ন সমুদ্রে ডুব দিয়ে ডুবুরি হতে ইচ্ছে করছে৷

তোমার চোখ দুটো বড়ো সুন্দর৷

সন্ধ্যের অন্ধকারে দড়ির ব্রিজ পেরোনোর সময় সৌমেন প্রথম ধরেছিলো নয়নের হাত৷

কেঁপে উঠছিল অষ্টাদশী তরুণী পুরুষের প্রথম স্পর্শে তবুও হাত ধরেই পর করেছিল শহুরে ছেলেকে!

দিন পাঁচেক গোটা গ্রামের আনাচে কানাচে ঘুরেছিলো ওরা৷

নয়নের মা মারা গিয়েছিলো সেই ছোটোবেলায়৷ একটা ছোটো ভাই, নয়ন আর বাবার ছোট্ট সংসার ওদের৷

রং চটা ঘরগুলো যেন নয়নের হাতের ছোঁয়ায় পরিপাটি৷ বিছানার চাদরে নয়নের নিজের হাতের সেলাই৷

কাল ভোরেই চলে যাবে ওরা৷ তাই আজ সন্ধ্যেতে লাইব্রেরির দুটো বই নিয়ে ফেরত দিতে গিয়েছিলো নয়নের বাড়িতে৷

সংকুচিত হয়ে গিয়েছিলো নয়ন৷ বড়োলোকের ছেলেকে কোথায় বসাবে সেটাই যেন চিন্তা ছিলো ওর৷

সৌমেন বলেছিলো, বই পড়ার তো বেশ নেশা দেখছি৷

নয়ন হেসে বলেছিলো, হ্যাঁ পাড়ার পাঁচজনের কার্ডে এক সাথে বই তুলি আমি৷ লাইব্রেরির কাকু বলেছে, আর বই জোগান দিতে পারবে না ওরা৷

বাইরে কোথাও একটা হইচই হচ্ছিলো৷ নয়ন জানালা দিয়ে তাকিয়েই বলেছিলো, সৌমেন দা তুমি শিগগির পিছনের দরজা দিয়ে পালাও৷

গরিবের বড়ো লোভ৷ বাবা পাড়ার কিছু লোক নিয়ে আসছে৷ সৌমেন না বুঝে অবাক হয়ে তাকিয়েছিলো৷

কিছুই বুঝতে পারেনি৷

নয়ন বলেছিলো, বাবা নিজের মেয়েকে তোমার ঘাড়ে চাপাতে চাইছে৷ যেহেতু তুমি ক-দিন ঘুরেছ আমার সাথে তাই৷

সৌমেন অবাক হয়ে ভেবেছিলো, হয়তো পড়া শেষ করে নয়নকে বিয়ের কথা ভাবাও যেত, তাই বলে এভাবে?

নয়ন ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো পিছনের দরজার কাছে৷

চলে আসার আগে নয়ন বলেছিলো, সৌমেনদা যদি কখনো সত্যি প্রয়োজন হয় তাহলে যোগাযোগ করবো, সেদিন পাশে থেকো৷

কাল ভোরেই তোমরা পলাশপুর ছেড়ে চলে যেও৷

সৌমেন স্পষ্ট দেখেছিলো, নয়নের চোখে জল৷

তারপর তো মাসিরা কলকাতা চলে এসেছিলো, মেসোর ট্রিটমেন্টের জন্য৷ এখানেই ফ্ল্যাট কিনেছিলো৷

না, কোনো চিঠি দেয়নি নয়ন৷

তারপরে তো কলেজের চাকরিটা পাওয়ার পরেই পামেলার সাথে আলাপ৷

নয়নকে সম্পূর্ণ ভুলেছিলো সৌমেন৷ নামের সাথে সাথে মানুষটাও আস্তে আস্তে স্মৃতির পাতায় গুঁড়ো ধুলোয় চাপা পড়ে গিয়েছিলো৷

পামেলার সাথে বিয়ের ঠিক তিনদিন আগেই পুরোনো লেটার বক্সে একটা চিঠি পেয়েছিলো সৌমেন৷

ফোন, হোয়াটস আপের যুগে চিঠিটা বড়ো ব্যতিক্রমী৷ চিঠি খুলেই চমকে গিয়েছিল সৌমেন৷ পলাশপুরের নয়ন৷

সৌমেন দা,

জানি না আদৌ তোমার আমাকে মনে আছে কিনা! না থাকাই স্বাভাবিক৷ দীপিকা পিসিরাও বহুদিন পলাশপুর ছেড়েছে৷ ভাই কলকাতায় একটা সামান্য মাইনের চাকরি পেয়েছে, আমি আর ভাই সামনের সপ্তাহেই কলকাতা যাচ্ছি৷

বাবা, মাস দুয়েক হলো আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন৷ কলকাতায় কেউ চেনা জানা নেই, যদি কোনো ঘর ভাড়া দেখে দেওয়া সম্ভব হয়!…..

একদিন পলাশপুরে বৃষ্টিভেজা মাটিতে দাঁড়িয়ে সৌমেন বলেছিলো, নয়ন.. তুমি যদি কখনো কলকাতা যাও তবে আমিও তোমাকে সব দেখাবো! তুমি যে ভাবে তোমাদের গ্রাম দেখালে, ঠিক সেই ভাবে আমিও আমার শহর দেখাবো৷

এইচিঠিটা হাতে পেয়ে বড্ড অস্বস্তি হচ্ছিলো সৌমেনের৷ সামনেই বিয়ে, বিয়েতে অনেক কাজ৷ এই অবস্থায় নয়নকে দেবার মতো সময় ছিলো না সৌমেনের কাছে৷

চিঠিটা ভাঁজ করে সরিয়ে রেখেছিলো নিজের দৃষ্টিপথের আড়ালে৷

বিয়ের একমাসের মধ্যেই এই নতুন বাড়িতে শিফট করেছিলো সৌমেন আর পামেলা৷

মা, রয়ে গিয়েছিলো বড়দার কাছে৷ দু-মাস সৌমেনের কাছে দু-মাস দাদার কাছে থাকে মা৷

পামেলা বলেছিল, মা আপনি আমাদের কাছেই থাকুন৷ দাদার আপত্তি ছিলো,মায়েরও৷ যতই হোক ওটাই ওদের আদি বাড়ি কিনা৷

বাড়ি ছাড়ার সময় প্রয়োজনীয় জিনিসের ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছিলো নয়নের চিঠিটা৷

আজ হঠাৎ গড়িয়ার বাড়িতে পামেলার বই পড়ে দেবার পাত্রীকে চাক্ষুস দেখে চমকে উঠেছে সৌমেন৷

নয়ন যেন চিনেও না চেনার ভান করে এড়িয়ে গেছে৷

পামেলা ডাকছিলো সৌমেনকে, পুরোনো কথা ভাবতে ভাবতে ভুলেই গিয়েছিল ও৷

পামেলার ঘরে যাওয়ার মুখেই ড্রয়িংয়ের প্যাসেজে আবার দেখা হলো নয়নের সাথে৷

পামেলার বইয়ের আলমারিগুলো গোছাচ্ছে ও৷

নিজেই সামনে এগিয়ে এসে বললো, ভাই খুবই কম মাইনে পায়, আমিও মাস্টার্স করে চাকরি পায়নি৷ তাই এই এডটা দেখে না জেনেই এসেছিলাম৷ আমি জানতাম না এটা তোমাদের বাড়ি৷

আমি কালই চাকরিটা ছেড়ে দেবো৷

সৌমেন সামলে নিয়ে বলল, কিন্তু কেন? তোমার কি এখানে অসুবিধা হচ্ছে?

এতদিন হচ্ছিলো না, কিন্তু এবার হবে৷ মনে হবে তোমার উপকারে বেঁচে আছি৷

নয়নের গলায় অভিমান স্পষ্ট৷

সৌমেন বললো, তুমি এখানেই থাকো, পামেলার কাছে৷ আমিই না হয় তোমার সম্মুখীন হবো না কোনদিন৷

নয়ন বললো, বলা যায় না, আমি আমার বিশ্বাসঘাতক চোখ দুটোকে বিশ্বাস করি না৷ গরিবের লোভ বড়ো খারাপ জিনিস৷ পামেলা বৌদি আমাকে বড্ড বিশ্বাস করেছে, ভরসা করেছে৷ তাকে প্রবঞ্চনা করে ফেলি যদি৷

সারা রাত এপাশ ওপাশ করছিলো সৌমেন৷

হয়তো ওই ছিলো নয়নের জীবনের প্রথম অনুরাগের পরশ৷ অনেক ভরসা করেই হয়তো কলকাতা আসার আগে চিঠিটা লিখেছিলো নয়ন৷

ইস.. নিজের কাছেই নিজে ছোটো হয়ে যাচ্ছে সৌমেন৷

মনে পড়ে যাচ্ছে, সেই ব্রিজে ওর হাত ধরার মুহূর্তটা৷ নয়ন বলেছিলো, এই হাতটা এভাবেই ধরে রাখতে ইচ্ছে করছে৷ মনে হচ্ছে তোমার হাতের ছোঁয়া কখনো প্রবঞ্চনা করবে না৷

সারারাত না ঘুমিয়ে ব্রেকফার্স্ট টেবিলে বসতেই পামেলা বললো, ভালো লাগছে না সৌমেন৷ মনটা বড্ড খারাপ৷

দেখো না, নয়নিকার কি যে হলো, বললো… বৌদি আমি আর কাল থেকে আসতে পারবো না৷ এই দিন পনেরোর মাইনে দিতে গেলাম তাও নিলো না৷ মেয়েটা বড় ভালো ছিলো গো!

চলে গেছে নয়ন!

গরিবের আত্মসম্মান বড্ড বেশি পামেলা৷ আমি আজই আরেকটা এড দেব তোমার পাঠ সঙ্গী খুঁজে৷ তুমি নিশ্চিন্ত থাকো৷

শুধু একটা মানুষই ক্ষমা করলো না সৌমেনকে৷

নিরুপায় সৌমেন, সারাটা জীবন হয়তো এই অপরাধ বোধ ওকে ক্ষত বিক্ষত করবে৷

তবু যেন ওই পলাশপুরের নিম্নমধ্যবিত্ত মেয়েটা জিতে গেল সৌমেনের চোখে৷ একদিন যার সাথে ওরও পছন্দের ফুল রজনীগন্ধার মিল হয়ে গিয়েছিল৷

কালকের ফুলগুলো এখনো রয়েছে ফুলদানিতে৷ শুধু গন্ধটা আর টাটকা নেই…

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *