প্রথম পর্ব— মনোসরণি
আজ কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে বেশ সাজসাজ ব্যাপার। বছর শেষের দিন। ক্যালকাটা মেডিক্যাল সোসাইটির বার্ষিক সভা অনুষ্ঠিত হবে আজ। ১৮৭৯ সালের ২৪ নভেম্বর স্থাপিত হওয়া এই সোসাইটির প্রথম সভাপতি ছিলেন ডি.বি.স্মিথ। দারুণ মানুষ। নেটিভদের মধ্যে চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ যাতে ছড়িয়ে পড়ে সেদিকে তাঁর নজর ছিল প্রথম থেকেই। মূলত তাঁর উদ্যোগেই শুরু হয় এই বার্ষিক সভা। ১৮৮০-তে শুরু হয়ে এবছর এই সভা বারো বছরে পড়ল। শুধু চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্ররাই না, বিজ্ঞানে উৎসাহী মানুষ মাত্রই এই সভায় যাবার জন্য মুখিয়ে থাকেন। যাঁরা অনুমতি পান না, তাঁরা চেষ্টা করেন সভার রিপোর্ট জোগাড় করার। এই বছরের সভায় একেবারে শেষের দিকে বসে আছেন আমাদের পরিচিত দুজন। বাঙালি ভদ্রলোকটি একটু উশখুশ করছেন। এ জাতীয় সভায় বসে থাকার চেয়ে অপরাধীর পিছু ধাওয়া করতেই তিনি অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ। পাশে ফ্রক কোট পরা নাক লম্বা সাহেবটি অনেকক্ষণ ধরে কী যেন পড়তে ব্যস্ত। সভা এখনও শুরু হয়নি। তাঁরা এসেছেন একটাই কারণে। আলোচনার বিষয়বস্তু। আজকের মূল আকর্ষণ ডাক্তার গোপালচন্দ্র দত্তের ভাষণ। মনোবিজ্ঞানের নতুন দিক নিয়ে আলোচনা করবেন তিনি। এই গোপালচন্দ্রকে কিছুক্ষণের জন্য দেখেছিল প্রিয়নাথ, সেই লাশকাটা ঘরে। কিন্তু তাঁর ভাষণ শুনতে আসার কী দরকার, তা প্রিয়নাথের মাথায় ঢোকেনি। টমসন সাহেব এদিকে তাকে নির্দেশ দিয়েছেন সাইগারসনের সঙ্গে সঙ্গে থাকার।
খানিক এদিক-ওদিক তাকিয়ে আর না পেরে প্রিয়নাথ জিজ্ঞাসা করল, “কী পড়ছেন সাহেব?”
সাহেব যেন শুনতেই পাননি।
আর-একবার জিজ্ঞাসা করতে গিয়েও চুপ করে গেল প্রিয়নাথ। একটা ছোট্ট পাতলা বই। মলাটে লেখা সাদার্ন লিটেরারি ম্যাগাজিন, রিচমন্ড ভার্জিনিয়া। বইটি বেশ প্রাচীন। পাতা হলুদ হয়ে এসেছে। সাহেব এর মধ্যে কী পেয়েছেন কে জানে, ডুবে আছেন পুরোপুরি। এদিকে মঞ্চসজ্জা চলছে। অনুষ্ঠান শুরু হতে খানিক সময় বাকি। বই থেকে মাথা উঠিয়ে সাইগারসন বললেন, “আপনি ব্যারন ভন কেম্পেলেনের নাম শুনেছেন?”
মাথা নাড়ল প্রিয়নাথ। শোনেনি।
“উলফগ্যাং ভন কেম্পেলেন ছিলেন হাঙ্গেরির ইঞ্জিনিয়ার। তবে পেশায় রানি মারি থেরেসার পরামর্শদাতা। একবার ১৭৬৯ সালে এক ফরাসি জাদুকর চুম্বকের নানা খেলা দেখিয়ে রানিকে চমকে দেয়। তখন ব্যারন বলেন যে তিনি হাতে সময় পেলে মাত্র ছয় মাসে এর থেকে অনেক ভালো খেলা বানাতে পারবেন। বানালেনও।”
“কী সেটা?”
“একটা পুতুল। অটোমেটিক। পুতুলটার মাথায় পাগড়ি, এক হাতে লাঠি, অন্য হাত দাবার বোর্ডে। পুতুলের নাম তুর্কি। কেউ চাল দিলে পুতুলটা ফিরতি চাল দেয়। চেনা চেনা লাগছে?”
“এ কী!! এ তো…”
“তৈমুর। তাই তো? অনেকটা তাই। আবার তা নয়ও। কেম্পেলেনের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলের বন্ধু যোহান মেলজেল এই পুতুলের কারুকাজ জেনে নেন। আর একটু অদলবদল করে আমেরিকায় মেলজেল’স চেজ প্লেয়ার নামে এর খেলা দেখাতে থাকেন। তখনকার দিনে সব জাদুকরের কাছে এই পুতুল একরকম বিস্ময়ই ছিল। অনেকেই চেষ্টা করেছেন, কিন্তু কেউ এর রহস্যভেদ করতে পারেননি। শেষে ১৮৩৬ সালের এপ্রিল মাসে এই ম্যাগাজিনে Mäelzels’s Chess Player নামের এক প্রবন্ধে এক ভদ্রলোক রীতিমতো গবেষণা করে এই পুতুলের রহস্য ফাঁস করেন। এই সেই লেখা…” বলে প্রিয়নাথের সামনে বইটা মেলে ধরলেন সাইগারসন।
“আরেহ! এডগার অ্যালান পো! ইনি তো…”
“হ্যাঁ, দ্যুপঁ নামে এক গোয়েন্দাকে নিয়ে কিছু গল্প লিখেছেন বটে। খুব একটা সুবিধার না। দুপ্যঁ একটাই কায়দা জানত, অনেকক্ষণ চুপ থেকে আচমকা একটা কথা বলে বন্ধুকে চমকে দেওয়া। কিছু যুক্তিবুদ্ধি ছিল বটে, কিন্তু পো যতটা দেখিয়েছেন, ততটাও না। বরং এই লেখাটা বেশ ভালো। পো একের পর এক ছবি দেখিয়ে প্রমাণ করেছেন যে এই যন্ত্র আদৌ স্বয়ংক্রিয় না, এর ভিতরে মানুষ থাকে। কীভাবে থাকে সেটাও ডায়াগ্রাম এঁকে বুঝিয়েছেন। এই দেখুন…”
“ঠিক এটাই তো সেদিন তারিণী আমাদের বলল!”
“ভুল বলছেন। তারিণী বলেনি। বলেছে ওর সেই জাদুকর বন্ধু। তবে একবারমাত্র মঞ্চে দেখে যে প্রায় সত্তর বছর ধরে চলে আসা ধাঁধার সমাধান করে দেয়, সে বড়ো সাধারণ জাদুকর নয়!”
“তৈমুরের প্ল্যানটা কার?”
“কার্টারের। আমি যে বইটা পাঠ করি, ওটা কার্টারই আমায় দিয়েছিল। লেখকের নাম নেই। তবে প্রথম পাতায় সই আছে E.A. Poe। আমার বিশ্বাস ছিল ওটাও পো-র লেখা। কিন্তু নিশ্চিত ছিলাম না। এই ম্যাগাজিনেও দেখুন, শুরুতেই পো-র সই। কোনও কারণে পো-র ব্যক্তিগত সংগ্রহ কার্টারের হাতে আসে। সেখান থেকেই ও তৈমুরের আইডিয়া পায়।”
“পো-র বই কার্টার পেল কীভাবে?”
“পো প্রায় কপর্দকশূন্য হয়ে মারা যান। তাঁর সব জিনিস আমেরিকার চোরাবাজারে জলের দরে বিক্রি হয়ে যায়। রবার্ট হুডিন সেই সময় আমেরিকায় ম্যাজিক দেখাচ্ছেন। উনিই এসব নিয়ে এসেছেন। আর ওঁর মৃত্যুর পরে এরা কার্টারের দখলে আসে।”
“কিন্তু এই ম্যাগাজিন আপনার কাছে!”
একটা চোরা হাসি ফুটে উঠল সাইগারসনের মুখে। “জানি না, বলা উচিত হবে কি না, গতকাল রাতে আমি কার্টারের ঘরে ঢুকেছিলাম। ঘরটা পুলিশ সিল করে দিয়েছে জানি। তবে তাতে আমার খুব একটা অসুবিধে হয়নি। ঘরে একটা সিন্দুকে এই ম্যাগাজিনটা পেলাম। আর এই ম্যাগাজিনের মধ্যেই ছিল আসল জিনিসটা।”
“আসল জিনিস? সেটা আবার কী?”
“দাঁড়ান দেখাই”, বলে সাইগারসন কোটের পকেটে হাত ঢোকাতে না ঢোকাতে চারিদিকে হাততালির আওয়াজ। মঞ্চ তৈরি। অনুষ্ঠান এখুনি শুরু হবে।
“পরে দেখাচ্ছি”, বলে সাইগারসন আবার সেটা পকেটেই গুঁজে রাখলেন।
মঞ্চে একে একে উঠে এলেন মার্টিন সাহেব, উইলসন সাহেব আর গোপালচন্দ্র। দুই সাহেবকে প্রিয়নাথ চিনত না। সাইগারসন চেনালেন। এই মার্টিন সাহেব নাকি সম্পর্কে টমসন সাহেবের ভগ্নীপতি। এতদিন টমসনের কাছে থেকেও প্রিয়নাথ জানত না।
শুরুতেই তাঁর বক্তব্য রাখলেন মার্টিন সাহেব। ক্যালকাটা মেডিক্যাল সোসাইটির স্থাপন, ইতিহাস, উদ্দেশ্য নিয়ে নানা কথা বলার পর নিজেই বললেন, “আজকাল আমি আর সোসাইটির কাজে মন দিতে পারি না। একদিকে মেডিক্যাল কলেজ, অন্যদিকে ভবানীপুর আর ডালান্ডা হাউসের দায়িত্ব সামলাতে হিমশিম খাচ্ছি। তবু আমি সোসাইটিকে ধন্যবাদ দেব, তাঁরা নিরন্তর তাঁদের গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। মেডিক্যাল কলেজের সার্জিক্যাল বিভাগের দায়িত্ব দারুণভাবে সামলাচ্ছেন ডাঃ উইলসন। তিনি এবং তাঁর ছাত্ররা চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিভিন্ন দিক নিয়ে যে গবেষণা চালাচ্ছেন, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে।” মার্টিন বেশি কিছু বললেন না। বোঝা গেল তিনি কোনও কারণে একটু অন্যমনস্ক। খুব সাদামাটা ভাবে গোপালচন্দ্রের পরিচয় দিলেন। এটাও বললেন, গোপাল সার্জিক্যালের ছাত্র হলেও মনোবিদ্যা নিয়ে ভালোই কাজ করছে। শেষে বললেন, “আমার অবর্তমানে এরাই চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আমি আর বেশিদিন এই পদে থাকছি না। আমার শরীর ভালো না, আমি আগামী মাসেই বিলেত ফিরে যাব। তবে আমার থাকা না-থাকাতে কিছু হবে না। বিজ্ঞান এবং সত্যের জয় হবেই।”
এরপরেই বলতে উঠল গোপালচন্দ্র। সে উঠতেই নেটিভ ছাত্রদের এক অংশ হাততালি দিয়ে উঠল। গোপাল তাহলে বেশ জনপ্রিয়, প্রিয়নাথ ভাবল। সামান্য ভদ্রতাসূচক ধন্যবাদ দিয়েই গোপাল নিজের গবেষণার বিষয়ে বলতে শুরু করল। তার বিষয় মনোরোগে সার্জারির ভূমিকা। সে শুরুই করল এই বলে, “মানুষ পাগল কেন হয়? লন্ডনের বিখ্যাত পাগলাগারদ বেডলামে রবার্ট হুক, রিচার্ড কিং সহ বিভিন্ন বিজ্ঞানী এই বিষয়ে একমত হয়েছেন যে মানব রক্তে হিউমর নামে একটি বস্তুর পরিমাণ বেড়ে গেলে রক্ত গরম হয়ে যায়। বিশেষ করে মস্তিষ্কের রক্ত। এই সমস্যা যেমন এদেশি নেটিভদের, তেমনি ইউরোপীয়দেরও। ইউরোপীয়দের ক্ষেত্রে ভয় বেশি, যেহেতু তাঁরা এই দেশের তাপমাত্রায় অভ্যস্ত নন। রক্ত গরম হয়ে গেলে মানুষ উত্তেজিত হয়ে যায়, রেগে যায় এবং এমন সব কাজ করে যা সুস্থ মানুষ করে না। এর কোনও ওষুধ নেই। উপায় একটাই। অস্ত্রোপচার। ইউরোপে বহু আগে থেকে ট্রেপ্যানিং নামে একটি অস্ত্রোপচার পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। এতে একটি ড্রিল দিয়ে রোগীর মাথায় প্রথমে একটি ছোটো ফুটো করে দেওয়া হয়, যাতে গরম রক্ত থেকে হিউমরের বাষ্প বেরিয়ে যেতে পারে। অনেক সময় এতেই কাজ হয়। না হলে ছিদ্রের মাপ বাড়াতে হবে। এই ছিদ্রটি করতে হবে ক্রেনিয়াম বরাবর। কিন্তু আমি আরও এক ধাপ এগিয়ে যেতে চাইছি। আমি চাই আগে রোগীর মস্তিষ্কের ঠিক কোথায় সমস্যাটা সেটা নির্ধারণ করা হোক। যদি নির্ধারিত জায়গাটি চিহ্নিত হয়, তবে সেই ফুটো দিয়ে মস্তিষ্কের সেই অংশটা কেটে ফেলে দিলেই রোগী সুস্থ হয়ে যাবে। মস্তিস্কের কর্টেক্স অংশ, যা আমাদের যুক্তিবুদ্ধি নির্ধারণ করে, সেই অংশই এই অস্ত্রোপচারের আদর্শ স্থান। শুনেছি বেডলামে কিছু কিছু চিকিৎসক এই ধরনের কাজ করছেন। ভারত তথা এশিয়ায় এ ধরনের কাজ আজ অবধি হয়নি। আমরা বেডলামের ধাঁচে ডালান্ডা হাউসে এই পরীক্ষা করতে শুরু করেছি। আপনাদের জানাই ইতিমধ্যে দুজন রোগীর ক্ষেত্রে সুফল পাওয়া গেছে।
আগে একটা সমস্যা ছিল। খুলি ফুটো করার ব্যথা অনেকে সহ্য করতে পারত না। অপারেশন টেবিলেই মারা যেত। আমরা সৌভাগ্যবান, ইদানীং ক্লোরোফর্ম নামে এক আশ্চর্য রাসায়নিক আবিষ্কার হয়েছে, যাতে রোগীকে অপারেশনের সময় অজ্ঞান রাখা যায়।”
প্রায় এক ঘণ্টা বক্তৃতা দিল গোপালচন্দ্র। এবার প্রশ্ন-উত্তরের পালা। উঠে দাঁড়াল এক নেটিভ ছাত্র। গোপালকে অভিনন্দন জানিয়ে সে বলল, “কিন্তু ডাক্তার দত্ত, একটা ব্যাপার বলুন, ইদানীং নাকি বেডলামে অন্য একটি ব্যবস্থাতেও রোগীর চিকিৎসা হচ্ছে। ১৬৬৭ সালে জঁ ব্যাপ্তিস্তে ডেনিস প্রথম এই পদ্ধতিতে পাগলদের চিকিৎসার কথা বলেন। এতে নাকি হিউমর দূর করার জন্য বারবার খুলি ফুটো বা অস্ত্রোপচারের দরকারই নেই। রোগীর দেহের রক্ত পুরো বার করে অন্য রক্ত পুরে দিলেই রোগী সুস্থ হয়ে যাবে। ডেনিস নিজে পনেরো বছরের একটা ছেলের রক্ত বদলে ভেড়ার রক্ত দিয়ে তাকে সারিয়ে তুলেছিলেন। তারপরেও নাকি অনেক রোগী সুস্থ হয়েছেন। আপনি আপনার বক্তব্যে তো এই নিয়ে একটা কথাও বললেন না…”
আগুনে যেন ঘি পড়ল। প্রিয়নাথ স্পষ্ট বুঝতে পারল গোপালচন্দ্র রাগে জ্বলে উঠেছে।
“আপনি জানেন ডাঃ কৈলাসনাথ গুপ্ত, যে, এই কথার জন্য আপনি গ্রেপ্তার অবধি হতে পারেন? ব্লাড ট্রান্সফিউশান বা রক্ত পরিবর্তন একটা অপবিজ্ঞান এবং প্রমাণিত অপবিজ্ঞান। আপনার কি মনে হয়, আমি ডেনিসের কথা জানিই না? কিন্তু আপনি কি জানেন, তারপরে ডেনিস একই পদ্ধতিতে আরও দুজনের চিকিৎসা করেন, যারা দুজনেই মারা যায়! রক্ত এমন একটা পদার্থ, যেটা যার যার নিজস্ব। একজনের রক্তের সঙ্গে অন্যজনের রক্ত মেশে না। মিশলেও তা কাকতালীয়। রক্ত সমীক্ষার এই পদ্ধতিতে মৃত্যুর হার এতটাই বেশি যে স্বয়ং ইংরেজ সরকার বাহাদুর একে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। আর আপনি এই বিজ্ঞানের সারস্বত মঞ্চে এইসব অপবিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করছেন? ধিক আপনাকে!”
মার্টিন সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। দেখেই বোঝা যাচ্ছে তাঁর শরীর খারাপ লাগছে। তিনি সকলের থেকে ক্ষমা চেয়ে মঞ্চ থেকে বিদায় নিলেন। সভাও আর বেশিক্ষণ চলল না। প্রিয়নাথ সাইগারসনের দিকে চেয়ে দেখল তাঁর চোখ জ্বলজ্বল করছে। চোয়াল দৃঢ়। মনে হল অনেকক্ষণ ধরে কিছু একটা খুঁজছিলেন, পেয়ে গেছেন।
যেন সামনের বাতাসকেই বলছেন, এমনভাবে সাইগারসন বলে উঠলেন, “পল কিথ ফিলমোরিস ল্যান্সডাউন কীভাবে মারা গেলেন আমি জানি।”
প্রিয়নাথের চোখ গোল গোল হয়ে গেছে, “কে মারল তাঁকে?”
—কে মারল বলিনি তো! বললাম কীভাবে মারা গেলেন।
—দুটো তো একই হল।
—তাই কী? না বোধহয়। তবে এই প্রশ্নের উত্তর দেবার সময় আসেনি এখনও। আর দু-একটা সূত্র হাতে আসা বাকি। কয়েকটা জট পরিষ্কার করতে হবে। তাহলেই তিনটে খুন একেবারে এক সরলরেখায় চলে আসবে…
—মানে কার্টার আর চিন-সু-লিনের মৃত্যুর সঙ্গে পলের মৃত্যুর যোগ আছে?
—অবশ্যই। কুয়াশাটা প্রায় কেটে গেছে, আর-একটু আলো।
—অনুষ্ঠান শুরুর আগে কী একটা দেখাবেন বলছিলেন?
—ও হ্যাঁ, এই দেখুন। কাল কার্টারের আলমারিতে পেলাম।
প্রিয়নাথ দেখল একটা ছবি। সাদা-কালো, কিন্তু তাতে তুলি দিয়ে রং করা। এই ধরনের ছবিকে এম্বেলিসড ফটোগ্রাফ বলে। ছবিতে এক মহিলা বসে আছেন। মলিন মুখ। ইউরোপীয় পোশাক, সোনালি চুল একঢাল। ছবির পিছনে একটা পেনসিল দিয়ে লেখা, ‘শার্লি জনসন, মাদার’। কার্টারের মা।
“এবার আর-একটা জিনিস দেখুন”, বলে হাতের ম্যাগাজিন থেকে একটা পুরোনো পেপার কাটিং বার করলেন সাইগারসন। প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগের পুরোনো একটা পেপার কাটিং। তাতে লেখা—
The Cradle
On the 20th ultimo, Miss Charlot Harley of Bradford Street gave birth of a beautiful boy. Mother and son doing well. Papers please copy.
“কী বুঝলেন?” সাইগারসন শুধালেন।
“একটা জিনিস অদ্ভুত লাগছে। মিস লেখা। মিসেস নয় কেন? আর পেপারে কেন?”
“ঠিক ধরেছেন। লন্ডনে সবার জন্মপত্র বাধ্যতামূলক, যদি অবশ্য তাঁদের বাবা-মা দুজনেই থেকে থাকেন। শুধু মা থাকলে জন্মপত্র হয় না। সেক্ষেত্রে জনসংখ্যার হিসেব রাখতে পত্রিকার এই কলামে জন্মের খবরটা ছাপিয়ে দেওয়া হয়।”
“তার মানে হ্যারি জনসন…?”
“অবৈধ সন্তান। ছবি দেখেই সেটা আমি বুঝেছি।”
“কীভাবে?”
“শার্লির চোখের রং দেখুন। গাঢ় নীল। বুড়ো জর্জ আমায় বলেছে হ্যারির বাবার চোখের রং ছিল নীল। হ্যারির চোখের রং…”
“বাদামি।”
“একদম তাই। দুজন নীল চোখের মানুষের সন্তান সচরাচর বাদামি চোখের হয় না।”
“কিন্তু বুড়ো জর্জের চোখের রং তো বাদামি…”
সাইগারসন খুব ধীরে ধীরে প্রিয়নাথের দিকে ফিরলেন। আর সোজা তাকিয়েই রইলেন। প্রিয়নাথ দেখতে পেল এতক্ষণে তাঁর ঠোঁটের কোনায় একটা হাসি তিরতির করে কাঁপছে।