প্রথম পর্ব- গাঢ়ধূম্রের কুণ্ডলী
ক্রিং ক্রিং ক্রিং… একটা অ্যালার্ম ঘড়ির ধাতব শব্দে ঘুম ভেঙে গেল প্ৰশান্ত মজুমদারের। খুব জোরে না, কিন্তু বেজেই চলেছে আওয়াজটা। প্রশান্ত জানেন তাঁকে এবার উঠে যেতে হবে। না হলে এই আওয়াজ থেকে মুক্তি নেই। আর প্রতিবার এই আওয়াজ তাঁকে ছোটোবেলায় ফিরিয়ে নিয়ে যায়। ডালহৌসি স্কোয়ারে আজ থেকে একশো বছর আগে জেমস মুরের ঘড়ির দোকান ছিল। সাহেবসুবোদের ঘড়ি কেনার একমাত্র জায়গা। একবার নেটিভ হিন্দুদের জন্য অদ্ভুত একটা অ্যালার্ম ঘড়ি বার করল তারা। নাম দিয়েছিল “বৃন্দাবন ক্লক”। ডায়ালে রাধাকৃষ্ণের মূর্তি খোদাই করা। মাত্র তিনশোখানা অমন ঘড়ি বাজারে আনার পর বৃন্দাবন ব্লক বন্ধ হয়ে যায়। প্রশান্ত মজুমদারের বৃন্দাবন ক্লক খুব সম্ভব সারা বিশ্বে এই ঘড়ির একমাত্র চালু প্রতিনিধি। তিনি এটাকে নিজের হাতে অয়েলিং করেন, কাচ মোছেন, পাতলা সাদা কাপড় ঘষে ঘষে পরিষ্কার করেন। এই ঘড়ি তাঁর ঠাকুর্দা নিশিকান্ত মজুমদারের। ছোটোবেলা থেকেই তাঁকে বোঝানো হয়েছিল এ ঘড়ি বড়ো সামান্য জিনিস না। সত্যি বলতে কি, পুরোনো জিনিসের উপরে তাঁর এই অদম্য আগ্রহের শুরু হয়েছিল এই ঘড়িটা থেকেই।
সাদার্ন অ্যাভিনিউর বিরাট চারতলা ‘মজুমদার ভবন’-এ সময় আজকাল বড্ড ধীর গতিতে চলে। বিরাট বাড়িতে প্রশান্তবাবু ছাড়া আর কেউ নেই। গোটা বাড়ি জুড়ে কেমন একটা অভিশাপের হাওয়া ঘুরে বেড়ায়। এ বাড়িও নিশিকান্তের তৈরি। নিশিকান্তকে কে যেন অভিশাপ দিয়েছিল দুই প্রজন্মের মধ্যে তাঁদের বংশ নির্বংশ হবে। বাবা খুব বলতেন। প্রৌঢ় প্রশান্ত মজুমদার জানেন অভিশাপ সত্যি হোক কি মিথ্যে, বংশ শেষ হবে তাঁর সঙ্গেই। প্রশান্ত বিয়ে করেননি। করার ইচ্ছেও জাগেনি কোনও দিন। বরং সারাজীবনের আয়ে বাড়িটাকে সাজিয়েছেন একেবারে মিউজিয়ামের মতো করে। অনেকেই জানে না, কলকাতার অ্যান্টিক কালেকটরেদের মধ্যে একেবারে প্রথম সারিতেই আছেন তিনি। কী নেই তাঁর কাছে? এইচ বোসের সিলিন্ডার রেকর্ড, ফুলমণি ও করুণার বিবরণের প্রথম সংস্করণ, আবোলতাবোলের সুকুমারের নিজের করা খসড়া খাতাখানা, গণপতির ম্যাজিকের পোস্টার, হীরালাল সেনের তোলা স্টিল ফটোগ্রাফ। তবু এখন, এই বয়সে এসে অদ্ভুত এক হতাশা জুড়ে থাকে তাঁকে। ঘুম থেকে জেগে উঠলেই সেই হতাশাটা যেন কামড়ে ধরে। দিন বাড়লে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়।
ব্যক্তিগত কাজে দিন দু-একের জন্য এলাহাবাদ গেছিলেন প্ৰশাস্ত। সেখানেও অফিস থেকে সামুইবাবুর ফোন এসেছিল। জরুরি তলব। কোথায় নাকি অ্যাকুইজিশানের প্রয়োজন। আগে এইসব কাজে বলার আগেই লাফিয়ে পড়তেন প্রশান্ত। কলকাতার পুরোনো ঘরবাড়ি তাঁকে টানে। এ টান অমোঘ। এ টান উপেক্ষা করা যায় না। বড়োবড়ো হল, পোর্টিকো, ডোরিক থাম, দরবার ঘর, জলসাঘর, গোমস্তাখানা, ঠাকুরদালান আর দেওয়ালে টাঙানো বিরাট সব সাহেবি তৈলচিত্র যেন এক লহমায় প্রশান্তকে টাইম মেশিনে চাপিয়ে নিয়ে চলে যায় উনিশ শতকে। পরম যত্নে এক-একটা জিনিস ধরে ধরে দেখেন তিনি। মিং আমলের পোর্সেলিনের ফুলদানি, ঝাড়লণ্ঠন, মার্বেলের মূর্তি, অ্যান্টিক আসবাব। এদের কিছু খোলা বাজারে বিক্রি হবে, কিছু দান করা হবে মিউজিয়ামে, আর সবচেয়ে সরেস বস্তুগুলো চলে যাবে অকশন হাউসে। আর এখানেই প্রশান্তের আগ্রহ সবচেয়ে বেশি। বহুদিন হল ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের স্টেনার এন্ড কোং কিংবা পার্ক স্ট্রিটের ভিক্টর ব্রাদার্স বন্ধ। সবেধন নীলমণি বলতে রাসেল স্ট্রিটে সেলিম ভাইদের রাসেল এক্সচেঞ্জ। প্রশান্ত মজুমদারের ব্যক্তিগত সংগ্রহের অনেকটাই এসেছে এই দোকান থেকে। এককালে পাগলের মতো সংগ্রহ করে যেতেন। ক্যাটালগ বানাতেন। এখন আর সেই বয়স নেই। উৎসাহেও ভাটা পড়েছে। তাই সামুইবাবুর ফোনে আর উত্তেজিত হন না তিনি।
নিজের পুরোনো প্রিমিয়ার পদ্মিনী গাড়িটা নিয়ে যখন অফিসের দিকে রওনা হলেন তখন নটা বেজে গেছে। আগের ডিরেক্টর মিসেস রত্না সেন আসা যাওয়ার সময়টা খুব মেনটেন করতেন। তিনি রিটায়ারের পর সামুইবাবু চার্জে আছেন। তিনি জানেন এই পদ কদিনের মাত্র। কিছুদিন পরেই নতুন অর্ডার বেরোবে, আর চিফ আর্কাইভিস্ট প্রশান্ত মজুমদার ডিরেক্টর হয়ে তাঁর মাথায় চেপে বসবেন। ফলে একটু যেন কাছাখোলা হয়েই অফিস চলছে। কেউ কোনও কিছুতে বিশেষ গা করে না।
পার্ক স্ট্রিট পেরোনোর সময় প্রশান্ত খেয়াল করলেন এখনও এক মাসের মতো বাকি, কিন্তু বড়দিনের বিজ্ঞাপন আর ফেস্টুন লাগানো শুরু হয়ে গেছে। গাড়ি ঘুরিয়ে শেক্সপিয়র সরণির বিরাট বাড়িটার পার্কিং-এ ঢুকলেন প্রশান্ত। আগে বাড়ির রং হলুদ ছিল। এক বছর হল সরকার বদলেছে। এখন রং নীল-সাদা। গাড়ি থেকে অ্যাটাচি কেসটা বার করে সোজা লিফটে চড়ে চলে গেলেন টপ ফ্লোরে। এখানেই সামুইবাবু বসেন।
অলক সামুই মানুষটা ছোটোখাটো। সর্বদা হাসিমুখ। প্রশান্তকে দেখেই একগাল হেসে বললেন, “আরে আসুন আসুন। দারুণ একটা খবর আছে। আপনার জন্যেই এতদিন চিঠিটা চেপে রেখে দিয়েছি। জানি আপনি এই ধরনের কাজে উৎসাহ পান। এই দেখুন…” বলে লম্বা বাদামি একটা খাম বাড়িয়ে দিলেন প্রশান্তর দিকে। খাম খুলতে মোটা কাগজে টাইপ করা একটা চিঠি বেরোল। আদ্যোপান্ত চিঠিটা মন দিয়ে পড়লেন প্রশান্ত। তারপর চিঠি থেকে মুখ তুলে বললেন, “এ তো অবিশ্বাস্য!”
“না হলে আর বলছি কী!”
“গোটাটাই স্টেট আর্কাইভে দেবে?”
“গোটাটা কি আর দেয়? দামি জিনিসগুলো সব বেচে দিয়েছে। সেই টাকাতেই বিদেশ যাচ্ছে। ঝড়তি পড়তি কিছু পড়ে আছে, সেগুলো দিতে চাইছে। তা আপনার চেয়ে যোগ্য আর কে-ই বা হতে পারে। দেখুন গিয়ে, যদি কিছু দরকারি জিনিস থাকে।”
“ওহহ। তাই বলুন। ইনভেনটরির লিস্ট পাঠিয়েছে? ‘
“তা পাঠিয়েছে একটা। কিন্তু সে থেকে কিছু বুঝে নেওয়া মুশকিল। না, না, আপনি নিজে তদারক করে অ্যাকোয়ার করুন।”
“এদের পরিবারেই সেই প্রাণকৃষ্ণ দত্ত ছিলেন না? যাঁর ‘কলকাতার ইতিবৃত্ত’ বিখ্যাত?”
“তাঁরাই। তবে এ অন্য গুষ্টি। গোপালচন্দ্র দত্ত। ইনি ডাক্তার ছিলেন। এই যে। এই কাগজটা দেখুন। এখানে একটা সংক্ষিপ্ত বংশতালিকা পাবেন।”
“সে ঠিক আছে, কিন্তু আমার আর এসব পোষায় না। অন্য কাউকে যদি……”
“কী বলছেন মশাই! এই কাজে আপনার চেয়ে উপযুক্ত আর কে আছে! আজ অবধি যে কটা বড়ো অ্যাকুইজিশান হয়েছে, সবেতেই আপনি ছিলেন। সে দ্বারকানাথের বেলগাছিয়া ভিলাই হোক কিংবা খেলাতচন্দ্র ঘোষের বাড়ি। আপনি না করলে কে করবে এই কাজ?”
“আসলে স্যার, সত্যি কথা বলি। তখন বয়স কম ছিল, উৎসাহ বেশি ছিল, সারাদিন দাঁড়িয়ে এসব করতাম। এখন সেই উৎসাহও নেই। শরীরও সায় দেয় না। সবচেয়ে বড়ো কথা, এরা সব বেচে আমাদের জন্য যা ফেলে রাখে তাতে দরকারি খুব বেশি কিছু থাকে না। তাও আপনি আমাকে মার্কা করে দিন। দেখি, যদি পারি নিজে যাব। নয়তো কাউকে পাঠাব। চিন্তা নেই, অযোগ্য কেউ হবে না।”
মার্কামারা চিঠিটা হাতে নিয়েই নিজের কামরার ঢুকলেন প্ৰশান্ত। এই কামরাটা অন্য সব কামরা থেকে আলাদা। পিছনে একটা দাগারোটাইপ ছবি ঝুলছে। টেবিলে ছোটো শ্বেতপাথরের পিরামিড। জানলায় ভারী পর্দা। নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে রুমটাকে সাজিয়েছেন তিনি। ঘরে ঢুকলেই আবছা একটা ধূপের গন্ধ পাওয়া যায়। চন্দনের গন্ধ। এই গন্ধটা তাঁর খুব প্রিয়। ঢাকা ধূপদানে নতুন ধূপকাঠি জ্বেলে টেবিলের ঘন্টাটা বাজালেন তিনি। কাঠের ধূপদানের ফাঁক দিয়ে মৃদু মৃদু ধোঁয়া উঠছে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পিয়ন এসে ঢুকল।
“ডাকছিলেন স্যার?”
“হ্যাঁ, অরুণ, আজকে দেবাশিস এসেছে?”
“কে? গুহবাবু? দেখলাম তো একটু আগেই। পাঠিয়ে দেব?”
“হ্যাঁ, বলো একটু জরুরি।”
মিনিট পাঁচেক পরেই দরজায় নক করে দেবাশিস এসে ঢুকল।
“আসছি।”
“হ্যাঁ এসো। দ্যাখ তো এই চিঠিটা…”
চিঠি পড়তে পড়তে দেবাশিসের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
“হাটখোলার দত্ত বাড়ির অ্যাকুইজিশান! এ তো দুরন্ত খবর!”
“শোন, ইনভেটরির যে লিস্ট পাঠিয়েছে, তাতে চোখ বোলালাম। এতে তেমন কিছু নেই। আর এইসব কাজ বড়ো ঝামেলার। সারাদিন নষ্ট। ইন ফ্যাক্ট একদিনে হবেও না। তুমিই তো একদিন বলছিলে ভালো অ্যাকুইজিশান পেলে তোমায় জানাতে। শুরু হিসেবে মন্দ হবে না।”
“কিন্তু এতে তো আপনাকে মার্কা করা।”
“সে আমি সামুইবাবুকে বলে ম্যানেজ করে দেব। তোমাকে উনি স্নেহ করেন। তোমার নাম বললে না করবেন না। যাবে তো বলো….’
ঠিক চারদিন পরে বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের এক খুপরি ঘরের দরজা খুলে প্ৰায় হাঁফাতে হাঁফাতে ঢুকল এক যুবক। পরিশ্রম না। উত্তেজনায় হাঁফাচ্ছে সে। ডিসেম্বরের শীতেও তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ঘরে একটা হলদে আলো জ্বলছে। একটা টেবিল আর গোটা তিন-চার চেয়ার ছাড়া গোটা ঘরে কোনও আসবাব নেই। টেবিলের ওদিকে গম্ভীর মুখে বসে চুরুট টানছিলেন এক ভদ্রলোক। মুখে স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ। যুবককে কিছু বলবার সুযোগ না দিয়ে তিনি প্রায় কড়কেই উঠলেন, “আচমকা আমাকে এখানে ডাকার মানে?”
“মাস্টার”, কোনওমতে বলল যুবক, “এ কথা অন্য কোথাও বলা যেত না।”
“কী এমন কথা?”
“যা আপনি এতদিন ধরে আমাদের সবাইকে বলে আসছেন। সংঘের কেউই আপনাকে বিশ্বাস করতে পারেনি। আমিও না। কিন্তু আজ আমি জানি, আপনি যা বলেছেন তা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। আমি ক্ষমা চাইছি।”
“কী বিষয়ে বলছ সেটাই তো বুঝতে পারছি না।”
“ভূত বিষয়ে।”
এবার একটু চমকে গেলেন টেবিলের অন্য দিকের মানুষটা।
“কী বলছ?”
“হ্যাঁ মাস্টার। আমি প্রমাণ পেয়েছি ভূত একেবারেই একটা মিথ না। ভূত জলজ্যান্ত ইতিহাস। সে ইতিহাস এতদিন লুকিয়ে রাখা হয়েছিল।”
“এ কী শোনাচ্ছ হে দেবাশিস! ভূত যে সত্যিই ছিল তার পাথুরে প্রমাণ পেয়েছ তুমি! এ যে অবিশ্বাস্য!”
“আরও কিছু বেশি পেয়েছি মাস্টার। ভূত শুধু ছিল না। ভূত আছে। আর ভূতকে আবার জাগানো সম্ভব।”