প্রথম পরিচ্ছেদ— বেডলামের গোপন অধিবেশন
১৫ আগস্ট, ১৮৮৫, লন্ডন
১।
গত চারদিন অবিশ্রান্ত ধারার বৃষ্টিতে গোটা লন্ডন শহর জুড়ে বিচ্ছিরি প্যাঁচপ্যাচে কাদা। সঙ্গে একটানা ঠান্ডা হাওয়ার দাপট। গতকালই লন্ডন টাইমসে খবর করেছিল, এ শহরে নাকি প্রতি আট মিনিটে মারা যাচ্ছে একজন মানুষ। কিন্তু কারও তাতে কিচ্ছু আসে যায় না। প্রতি পাঁচ মিনিটে জন্ম হচ্ছে একজন নবজাতকের। মহারানি ভিক্টোরিয়া সিংহাসনে বসার চল্লিশ বছর যেতে না যেতে শহরের জনসংখ্যা ১০ লক্ষ থেকে বেড়ে প্রায় ৪০ লক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছত্রাকের মতো চারিদিকে গজিয়ে উঠছে নিত্যনতুন বাসস্থান, কলকারখানা। শহর জুড়ে অজস্র রাস্তা আর গলিঘুঁজির গোলকধাঁধা। গোটা শহরটাই যেন বিরাট এক কনস্ট্রাকশন সাইট। শহরে নিকাশি ব্যবস্থা বলে কিছু নেই। গোটা টেমস নদী বদ্ধ ডোবার মতো ঘন মলে পরিপূর্ণ। মাঝে মাঝে নদী থেকে বয়ে আসে পূতিগন্ধযুক্ত হাওয়া। কলেরা, প্লেগ, গুটিবসন্ত এই শহরের অতি পরিচিত তিন সঙ্গী। তবে এসব কিছুই ভাবছিলেন না লুই। তিনি ভাবছিলেন গতকাল রাতে আসা বেনামি চিঠিটার কথা। তাঁর স্ত্রী অসুস্থ। অন্য ঘরে ঘুমান। লুই বাইরের ঘরে একটা বিছানায় ব্যবস্থা করে নিয়েছেন। কাল অনেক রাতে দরজায় মৃদু টোকা পড়ে। লুইয়ের রাতে ভালো ঘুম হয় না। তিনি উঠে দরজা খুলতেই চাকর জানায় একজন অচেনা লোক এসে এইমাত্র চিঠিটা দিয়ে গেল। বলেছে এখুনি মালিককে দিতে। জরুরি।
সাদা খামে ভরা মামুলি চিঠির মতো দেখতে হলেও গালায় যে মোহরটা আঁকা ছিল, সেটা দেখেই লুই বুঝলেন, এ কোনও সাধারণ চিঠি না। আগামী কাল, সকাল ঠিক এগারোটায় বেথলেহেমে প্রভু যিশুর চরণে নিজেকে সমর্পণ করতে বলা হয়েছে সেই চিঠিতে। সঙ্গে দুটো মরচে পড়া চাবি। চিঠিতে যদি বা কিছু সন্দেহ থেকে থাকত, দেখা করার সময়কাল আর এই চাবিতে তা দূর হল একেবারে। শমন এসেছে। এই ডাক অগ্রাহ্য করার সাধ্য নেই তাঁর।
পরদিন সকালে বৃষ্টিটা ধরল একটু। কিন্তু তাতে লাভের চেয়ে ক্ষতি হল বেশি। দম বন্ধ করা গাঢ় হলুদ কুয়াশা ঢেকে দিয়েছে গোটা লন্ডন শহরকে। কারখানা থেকে বেরোনো গন্ধকে ভরা এই কুয়াশায় বেশিক্ষণ শ্বাস নেওয়া যায় না, কাপড় চ্যাটচ্যাটে হয়ে যায়। অন্য কোনও দিন হলে লুই বাড়ির বাইরে পা দিতেন না। কিন্তু আজ উপায় নেই। আধখানা ডিম আর এক গেলাস ক্ল্যারেট পেটে ঢেলেই টুপি, ছাতা নিয়ে ধরাচূড়া পরে হাঁটা দিলেন বেড়লাম হাসপাতালের দিকে। অপ্রত্যাশিত, আকস্মিক কোনও ঘটনা ঘটেছে। তা না হলে গত দশ বছর তিনি এই সংঘের সঙ্গে যুক্ত। এমন জরুরি তলব আসেনি কোনও দিন।
কুয়াশার উপদ্রবে দিনের বেলাতেও রাস্তায় গ্যাসলাইট জ্বালানো। গোটা শহর এক অদ্ভুত রহস্যময় রূপ ধারণ করেছে। মানুষ চলছে অশরীরী প্রেতাত্মার মতো। খটখট শব্দ করে পাথুরে রাস্তায় এগিয়ে চলেছে ঘোড়ায় টানা বগি আর হ্যানসম ক্যাব। চাইলেই একটা ক্যাব নিয়ে নেওয়া যেত। কিন্তু সংঘের মাস্টারের কড়া নিষেধ। কোনও সাক্ষী রাখা যাবে না। আরও মিনিট পনেরো হেঁটে নদী পেরিয়ে লুই চলে এলেন সাউথওয়ার্কে। তাঁর অভীষ্ট স্থানে। প্রায় ছশো বছরের প্রাচীন এই বেডলাম হাসপাতালের আসল নাম বেথলেহেম হসপিটাল। প্রথমে সবরকম চিকিৎসাই চলত এখানে। মূলত শহরের দরিদ্র, অনাথরাই এদের রোগী। পরে রাজা অষ্টম হেনরির আদেশে এই হাসপাতালকে শুধুমাত্র উন্মাদ আর মানসিক রোগীদেরই চিকিৎসায় নিয়োজিত করা হল। লোকমুখে বেথলেহেম হল বেডলাম। মূল ফটকের পাশের চত্বরের দুপাশে দুটো বিরাট পুরুষ মূর্তি। একজনের নাম মনখারাপ, অন্যজনের নাম পাগলামো। লোকে ঠাট্টা করে এঁদের নাম রেখেছে “ব্রেইনলেস ব্রাদার্স।” তবে লুই মূল ফটকের দিকে গেলেনই না। তিনি মাথার টপহ্যাটটাকে একটু নামিয়ে দিয়ে মুখের কিছুটা ঢেকে পা চালালেন হাসপাতালের বাগানের দিকে। সেখান থেকে সোজা চলে যাওয়া যায় পিছনের ছোটো খিড়কি দরজায়। এই কুয়াশায় সুবিধেই হয়েছে একরকম। তা না হলে তাঁকে কেউ না কেউ চিনে ফেলতই। বিশেষ করে তাঁর লেখা শেষ বইটা বাচ্চাদের জন্য লেখা হলেও বড়োরাও পড়ে খুব সুখ্যাতি করেছেন। স্বল্পপরিচিত কবি থেকে তিনি একজন কেউকেটা হয়ে উঠেছেন রাতারাতি। খিড়কির সামনে এসে খানিক অপেক্ষা করলেন লুই। পিছনে তাকিয়ে দেখলেন। কেউ অনুসরণ করছে না তো? নাহ, কেউ নেই।
কালো খিড়কির দরজাটা দেওয়ালের সঙ্গে এমনভাবে মিশে আছে যে খেয়াল না করলে এর অস্তিত্ব বোঝা মুশকিল। লুই সাবধানে সিঁড়ির তিনটে ধাপ উঠে দরজায় খটখট করলেন। প্রথমে তিনবার। একটু থেমে আবার তিনবার। দরজার উপরে ছোটো একটা ঘুলঘুলি খুলে গেল। একটা হলুদ লণ্ঠনের আলো। ভিতরের লোকটি নিশ্চিত হতে চাইছে কে এসেছে। শুধু দরজা খোলার সংকেত জানলেই হবে না। এরপর ভিতর থেকে নির্দেশ এল “ক্ল্যাভিস।” পকেট হাতড়ে সেই চিঠির সঙ্গে পাওয়া চাবিটা ঘুলঘুলি দিয়ে ঢুকিয়ে দিলেন লুই। একটু বাদেই সামান্য আওয়াজ করে দরজা খুলে গেল। ছোটোখাটো চেহারার এক কিশোর লুইকে দেখে হাত বাড়িয়ে দিল করমর্দনের জন্য। লুই জানেন কোন পদ্ধতিতে হাত ধরতে হবে। এই গোপন করমর্দনের ভঙ্গি সংঘের সদস্য বাদে কেউ জানে না। কিন্তু লুই হাত ধরতেই ছেলেটি তাঁর হাতের তেলোতে চারটে আঙুল রেখে মাঝের দুটো আঙুল খুলে দিল। ফিসফিসিয়ে বলে উঠল, “মাহাবোন।” চমকে উঠলেন লুই। এই সংকেত, এই গোপন শব্দের অর্থ তিনি জানেন।
.
“লজের দরজা খোলা।” সংঘের গোপনতম কোনও সভায় আমন্ত্রণ পেলেই এই শব্দ উচ্চারিত হয়। কী হবে আজ?
লুইয়ের দুর্বল হৃৎপিণ্ড জোরে জোরে ধুকপুক করতে লাগল। মুখে সে ভাব দেখালেন না তিনি। সামনে ছেলেটা পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এই পথ গোলকধাঁধা। তাঁকে একা ছেড়ে দিলে কিছুতেই ফিরে আসতে পারবেন না। লুইয়ের নাকে আসছে রোগীদের মলমূত্রের কটু গন্ধ। কাকে যেন চাবুক মারা হচ্ছে। তার চিৎকারে কেঁপে কেঁপে উঠছে হাসপাতালের নিস্তব্ধতা। আরও একটু এগোতেই কানে এল দোতলার উন্মাদদের হাসির শব্দ, শিকলের ঝনঝন। আর দুই একটা মোড় ঘুরে সিঁড়ি চলে গেছে নিচের দিকে। এখানে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। আলো বলতে শুধু সেই হলুদ লণ্ঠনের মিটমিটে আভা। এখানে কোনও শব্দ নেই। যেন সবাই মরে গেছে। এতক্ষণ তাও লুইয়ের মনে হচ্ছিল তিনি ইহজগতে আছেন। এখন পাতালপুরীর এই নিস্তব্ধতায় তাঁর দম বন্ধ হয়ে এল। অবস্থা একটু স্বাভাবিক করতে গলা খাঁকরে তিনি সামনের ছেলেটিকে শুধালেন, “তোমার নাম কী বাছা? কী করা হয়?”
ছেলেটি স্বভাবে গম্ভীর। একটু থেমে পিছন ফিরে জানাল, “আমি মাস্টারের সেবা করি। আমার নাম রিচার্ড হ্যালিডে।”
.
২।
লুই ভেবেছিলেন ছেলেটা তাঁকে কোনও সভাঘরে নিয়ে যাবে। কিন্তু ভারী ওক কাঠের দরজার পিছনের নিভুনিভু গ্যাসলাইটের আলোয় যে অপার্থিব ঘরটা লুইয়ের চোখের সামনে খুলে গেল, সেটা দেখবেন বলে লুই আশা করেননি। ঘরের লম্বা করিডরের দুইপাশে কাঠের চেম্বার, তাতে লাইন ধরে নানা অদ্ভুত লেবেল মারা সব রাসায়নিকের বোতল, রিটট, টেস্টটিউবের সারি আর বকযন্ত্র শোভা পাচ্ছে। অন্যদিকের টেবিলের ঠিক মাঝখানে ধিকিধিকি জ্বলছে বুনসেন বার্নার। তাতে কিছু একটা ফুটে বগবগ শব্দ হচ্ছে। প্রথমে খানিক সময় লাগল বুঝে উঠতে। তারপর ঘরে উপস্থিত সবাইকে দেখতে পেলেন লুই। এ যে চাঁদের হাট বসেছে! সংঘের সব মাথারা বসে আছেন গোল টেবিল ঘিরে। মাঝে মাস্টার ম্যাসন এলি হেনকি (জুনিয়র) স্বয়ং। তাঁকে ঘিরে অভিনেতা হেনরি আরভিং, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের বাঘাবাঘা গোয়েন্দারা। এঁদের মধ্যে মেকলিজনের মতো কুখ্যাত অফিসার থেকে জর্জ ক্লার্ক, উইলিয়াম পামার, নাথানিয়েল ডুস্কভিচ কে নেই! লুই গুনে দেখলেন মোট সাতজন। উইলিয়াম পামার সর্বজনশ্রদ্ধেয় হলেও ইদানীং কোনও কারণে সরকারের রোষে পড়েছেন। কিন্তু এরা সবাই মিলে একসঙ্গে এখানে কী করছে! লুই এসব ভাবার আগেই পামার অনুচ্চ কন্ঠে বলে উঠলেন, “চিহ্ন।” লুই জানেন তাঁকে কী করতে হবে। তিনি একটা হাত বুকের ওপরে রেখে অন্য হাত দিয়ে নিজের গলা কাটার ভঙ্গি করলেন। মৃদু হেসে হেনকি হাত বাড়িয়ে বললেন, “গ্রিপ।” আবার করমর্দন। কিন্তু এই পদ্ধতি আরও গোপন। সংঘের একেবারে উপরের ডিগ্রির কেউ না হলে, এটা জানা অসম্ভব। লুই জানেন। হাত মিলিয়ে বুড়ো আঙুল দিয়ে মাস্টারের হাতের গিঁটে স্পর্শ করতে হয়। এর মানে সম্পূর্ণ বশ্যতা।
.
এবার আরভিং-এর পালা। লাইসেনিয়াম থিয়েটারের এই নামজাদা অভিনেতা লন্ডনের প্রথম ম্যাসনিক লজের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম। গম্ভীর গলায় তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “ওয়ার্ড।” লুই এর উত্তর জানেন। একটুও না ভেবে বললেন, “বোয়াজ।” আর মনে মনে ভাবতে লাগলেন এমন হাই ম্যাসন মিটে তাঁর মতো অভাজনের ডাক পড়ল কেন?
প্রথম কথা বললেন উইলিয়াম পামার। হেনকির দিকে তাকিয়ে বললেন, “তবে সভা শুরু করা যাক?”
হেনকি মাথা নেড়ে সায় দিয়ে ইশারায় পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রিচার্ড হ্যালিডেকে কী যেন ইঙ্গিত করলেন। হ্যালিডে চকিতে বাইরে বেরিয়ে পাশের ঘর থেকে ধরে আনল একেবারে ছোটোখাটো একটা মানুষকে। লোকটা নিজের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারছে না। চোখ ঘুমে ঢুলুঢুলু। কোনওক্রমে তাকে ধরে এনে চেয়ারে বসাতেই সে ধপ করে বসেই আবার ঢুলতে লাগল। হেনকি উঠে দাঁড়ালেন। গম্ভীর স্বরে বলা শুরু করলেন, “ব্রাদার্স, আপনারা হয়তো জানেন, আমাদের ম্যাসনিক লজের একেবারে শুরুর দিন থেকে সদস্যদের খোঁজ ছিল এমন এক সত্যের, যে সত্য মানুষের মনের গহিনতম রূপকে ধরতে পারে। আমাদের কাছে নিশ্চিত খবর আছে, শুধু আমরাই না, সুদূর এশিয়ার পীত চিনদেশীয়রাও বহু আগে থেকে এই খোঁজ চালাচ্ছেন। মানবমনের নেতিবাচক শক্তিকে তাঁরা ইন এবং ইতিবাচক শক্তিকে ইয়ান বলে চিহ্নিত করেন। তাঁদের সুপ্রাচীন বর্ণমালা ই-চিং-এ এই ইন ও ইয়ান মিলিয়ে মোট চৌষট্টিটি চিহ্ন বা হেক্সাগ্রাম আছে। কিন্তু যা আজ অবধি সবার অধরাই থেকে গেছে, তা হল এমন কিছু, যা এই শুভ আর অশুভ, ইন আর ইয়ান-কে আলাদা করতে পারে। ধূসরকে ভেঙে ফেলতে পারে সাদা কালোয়। আদিম যুগ থেকে চিনা গং-সি আর টং, জার্মানির ইলুমিনাটি, আমেরিকার স্কাল অ্যান্ড বোন, সবাই অতি সংগোপনে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছিল এই নিয়ে। নিজেদের মতো। কিন্তু কেউ সফলকাম হয়নি।”
এলি হেনকি বলে যাচ্ছিলেন, লুই বুঝবার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন, এসব ইতিহাস বলার জন্য এত গোপন মিটিং-এর কী দরকার? আর এই অর্ধঘুমন্ত মানুষটিই বা কে? যেন তাঁর মনের কথা বুঝতে পেরেই হেনকি বলে উঠলেন, “ইতিহাসের কথা বলে আর আপনাদের ধৈর্যের পরীক্ষা নেব না। যে কারণে আজকের এই জরুরি মিটিং, আমি এমন কিছু একটা আবিষ্কার করেছি, যা মানবমনের ইন আর ইয়ান-কে আলাদা করতে পারে।”
ঘোষণাটা এতই অস্বাভাবিক আর অকল্পনীয় যে কেউ এর জন্য তৈরি ছিল না। ঘরে গুনগুন শব্দ শুরু হল। সবাই অবাক। এ যে অবিশ্বাস্য! হেনকি কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। যেন সবাইকে সুযোগ দিলেন খবরটা হজম করার। তারপর চেয়ারে বসে ঢুলতে থাকা মানুষটির দিকে তর্জনী দিয়ে দেখিয়ে বললেন, “আপনারা অনেকেই হয়তো এই হতভাগ্য মানুষটিকে চেনেন না। কিন্তু নাম শুনেছেন। এই বেচারা মানুষটির নাম জেমস লংলি।”
নামটা উচ্চারণ করতেই ঘরের অনেকেই সচকিত হয়ে লোকটির দিকে তাকালেন। পামার আর মেকলিজন বাদে। খুব সম্ভব পুলিশে কাজ করার দরুন তাঁরা একে আগে থেকেই চেনেন। মেকলিজন একটা রুপোর খড়কে কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচাচ্ছিল। পামার নিরুত্তাপ। লুই সবিস্ময়ে দেখছিলেন লংলিকে। দুই মাস আগেই লন্ডনের সব পত্রিকার প্রথম পাতা জুড়ে দিনের পর দিন লংলির কীর্তিকাহিনি ছাপা হয়েছে। নেহাত ছাপোষা স্কুলমাস্টার লংলি মানসিক সমস্যার জন্য বেডলামে ভরতি ছিলেন। একদিন সবার নজর এড়িয়ে তিনি পালিয়ে যান। যাবার সময় এলি হেনকির কোটের পকেট থেকে কোল্ট প্যাটারসন রিভলভারটাও গোপনে হাতিয়ে নেন। বেডলাম থেকে বেরিয়ে তিনি প্রথমেই তাঁর স্কুলে গেলেন। কাউকে কিছু বুঝতে দেবার আগেই ক্লাসরুমে ঢুকে এক গুলিতে চার বছরের ছোট্ট মেয়ে মিয়া ইভান্সের মাথা উড়িয়ে দেন তিনি। বিচার চলে। বিচারে লংলির প্রাণদণ্ড হয়। কিন্তু ডাক্তার এলি হেনকি অনেক বলেকয়ে, মুচলেকা দিয়ে তাঁকে আবার বেডলামে নিয়ে আসেন চিকিৎসার জন্য। সে লোক এখানে কী করছে?
“আপনারা ভয় পাবেন না। জেমস লংলি এখন একটা গাছের চেয়েও শান্ত। আমার কথায় রোজ ওকে পনেরো গ্রেইন করে ক্লোরাল হাইড্রেট দেওয়া হচ্ছে। এতে হৃৎস্পন্দন কমে যায়। রোগী আপনাআপনি শান্ত হয়ে পড়ে। এবার আমি আপনাদের সামনেই ওকে কিছু প্রশ্ন করব। আপনারা শুধু শুনে যান। কিছু বলবেন না।”
লংলির একেবারে সামনে একটা চেয়ার নিয়ে বসে তিনি খুব শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার নাম কী বাছা?”
প্রথমে সে শুনতে পায়নি। পরে আবার একই কথা জিজ্ঞাসা করায় ইঁদুরের মতো চিঁচিঁ শব্দে উত্তর দিল, “জেমস লংলি।”
“ঠিকানা?”
“৩৯, চ্যারিংক্রশ, লন্ডন।”
“তুমি এলি প্যাটারসনকে খুন করেছ?”
এলির নাম শুনতেই লংলির দুই চোখ বেয়ে জল গড়াতে লাগল। পাশাপাশি মাথা নাড়ল সে।
“কখনোই না। মিয়া আমার সবচেয়ে প্রিয় ছাত্রী ছিল। সবচেয়ে মিষ্টি আর আদুরে। আমার অঙ্ক ক্লাসে শুধু আমার জন্যেই রোজ একটা না একটা উপহার নিয়ে আসত।”
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন এলি হেনকি।
“ব্রাদারস! এই হল জেমস লংলি। এবার অন্য একজনের সঙ্গে আপনাদের আলাপ করাই।”
এলি আবার ইশারা করতেই রিচার্ড কোথা থেকে এসে লংলির হাত পা চেয়ারের সঙ্গে শিকল দিয়ে বেঁধে দিল। ব্যথায় কুঁকড়ে উঠল লংলির মুখ। হেনকি এগিয়ে গেলেন কেমিক্যালের টেবিলের দিকে। সেখানে একটা কাঠের ছোটো স্ট্যান্ডে তিন-চারটে বোতল রাখা। পাশেই বেশ কয়েকটা টেস্টটিউব। তাদের একটা হাতে নিয়ে এলি হেনকি এবার সরাসরি তাকালেন লুইয়ের দিকে। হালকা একটা হাসি ফুটে উঠল তাঁর ঠোঁটের কোনায়। তাঁকে উদ্দেশ্য করেই বললেন, “দেখুন ব্রাদার, ভালো করে দেখুন এবার কী হতে চলেছে। আর কেউ না দেখলেও আপনি দেখুন। আপনার দেখা দরকার।”
“কিন্তু কেন? আমিই কেন?” অস্ফুট স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন লুই।
“কারণ, আমরা কেউই লেখক না। আপনি লেখক। জনপ্রিয় লেখক। শব্দের জাদু আপনার হাতে। আপনি চাইলেই সত্যিকে মিথ্যা বানাতে পারেন আর মিথ্যাকে সত্যি।”
“কিন্তু এক্ষেত্রে…”
“এক্ষেত্রে আপনি যা যা দেখবেন, তা যত অসম্ভবই মনে হোক না কেন, আপনি সেটা লিখবেন। লিখবেন কল্পকাহিনির ঢং-এ, অলীক রূপকথার মতো। যাতে সবাই একে বানানো গল্প বলে বিশ্বাস করে। বইয়ের প্রচারের ভার আমাদের ব্রাদাররা নেবেন। সে চিন্তা আপনাকে করতে হবে না। আপনি শুধু কাহিনিটা লিখে দেবেন। জানেন তো আমরা, ব্রাদাররা একটা কথায় বিশ্বাস করি। যেদিন ঈশ্বরের সৃষ্টি হয়েছিল সেদিন সৃষ্টি হয়েছিল শয়তানেরও। তবে শয়তানের শয়তানি কোথায় জানেন? শয়তান মানুষকে বিশ্বাস করিয়েছে সে অলীক, অবাস্তব। তার কোনও অস্তিত্ব নেই। আর এই বিশ্বাসের সুযোগেই সে ছোবল মারে। আমরাও সে পন্থাই নেব।”
এলি হেনকি তাঁর টেস্টটিউবে প্রথমে ঢেলে নিলেন রক্তের মতো লাল রঙের এক তরল। বার্গান্ডি রেড। দ্রুত হাতে তাতে মিশিয়ে দিলেন কয়েক ফোঁটা প্রবণ আর সাদা পাউডার। বার্নারে গরম করতেই মিশ্রণটা টগবগ করে ফুটতে লাগল। রং বদলে প্রথমে লাল থেকে বেগুনি, পরে অদ্ভুত সবুজ বর্ণ নিল। ঠান্ডা হতেই হেনকির নির্দেশে লংলির মুখ হাঁ করিয়ে সেই তরল ঢেলে দিল তাঁর সহকারী হ্যালিডে।
প্রথমে কিছু না বোঝা গেলেও খুব ধীরে ধীরে লংলির মধ্যে একটা পরিবর্তন খেয়াল করলেন লুই। সারা দেহ অল্প অল্প কাঁপছে। মাথা নড়ছে। কাঁপুনি বাড়তে শুরু করল। সঙ্গে মুখ দিয়ে অদ্ভুত পাশবিক ঘড়ঘড় আওয়াজ। তারপর গোটা দেহ জুড়ে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি। লুই ভয় পেলেন। মনে হল এই শিকলও দুর্বল হয়ে পড়বে। ভারী ওক কাঠের চেয়ার দুলতে লাগল সামনে পিছনে। মিনিটখানেক এমন চলল। তারপর সব শাস্ত। শুধু লংলির গলার অদ্ভুত আওয়াজ শোনা যাচ্ছে গোটা ঘর জুড়ে। হেনকি লংলির সামনে গিয়ে বসলেন। আবার আগের মতো জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি মিয়া ইভান্সকে খুন করেছ?” আবার মাথা নাড়ল লংলি। তবে এবারে উপরে নিচে।
“মুখে বলো”, একটু ধমকের সুরে বললেন ডাক্তার।
“হ্যাঁ” ঘড়ঘড়ে গলায় উত্তর এল।
“কেন?”
“এমনি….. কোনও কারণ নেই। মজা পেলাম। তাই। সুযোগ পেলে আরও মানুষ মারব। মানুষ মারতে মজা লাগে।”
“তোমার নাম কি জেমস লংলি?”
পাশাপাশি নাড়ল লংলি। না।
“তবে? তবে তোমার নাম কী?”
লুইকে চমকে দিয়ে চাপা গলায় লংলি বলে উঠল, “আমার নাম হিউড রাডি। ঠিকানা ৩৯, ক্রশ, লন্ডন।”