পূর্বখণ্ড- সংশয়
মধ্যখণ্ড— সংযোগ
উত্তরখণ্ড— সংকাশ

প্রথম পরিচ্ছেদ— তৈমুরের অন্দরে অদ্ভুত রহস্য

প্রথম পরিচ্ছেদ— তৈমুরের অন্দরে অদ্ভুত রহস্য

খট করে একটা শব্দ হয়ে পাল্লাটা খুলে গেল। ভিতরে অন্ধকার। হাত ঢুকিয়ে বুঝলাম কিছু রাখা আছে। টেনে বার করে আনলাম। কাপড়ে প্যাঁচানো দড়ি বাঁধা একটা ছোট্ট প্যাকেট। দেখলেই বোঝা যায় একশো বছরেরও বেশি বয়স হয়েছে। কাপড় জ্যালজ্যালে হয়ে গেছে। দড়ি জায়গায় জায়গায় ছেঁড়া। কাপড় ছিঁড়তেই ভিতর থেকে বেরিয়ে এল একটা লাল খাম। মুখ আটকানো। আমার তর সইছিল না। হাত কাঁপছে। কোনওমতে খাম ছিঁড়তেই বেরিয়ে এল বাদামি রঙের একটা বই। আমি নেটে আগে দেখেছি। অবিকল সেটা। বিশ্বাস হচ্ছে না। হাত বোলালাম। আবার… আবার… সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল আরও বড়ো কাজ বাকি। তারিণীর ডায়রি? যা থেকে গণপতির ভূতের বাক্সের সন্ধান পাওয়া যাবে? ডিরেক্টরের খোপে হাত ঢোকালাম। কিছু ঠেকল না। এবার টর্চ মেরে দেখলাম। ভিতরটা খাঁ খাঁ করছে। একটা সুতোর টুকরো অবধি নেই।

বাইরের বৃষ্টিটা ধরে গেছে এতক্ষণে। মাথা ঠান্ডা করে ভাবতে বসলাম। যদি উর্ণার কথা আর গুগলে দেওয়া এই তথ্য সঠিক হয়, তবে এই মুহূর্তে আমি বেশ কয়েক কোটি টাকার মালিক। গোল্ডমাইন আমার হাতের মুঠোয়। কিন্তু কীভাবে সে মাইন থেকে টাকাটা পাব, জানি না। পেলে কী করব তাও বুঝতে পারছি না। প্রথমেই বোধহয় একটা ফ্ল্যাট কিনে উর্ণাকে বিয়ের প্রপোজ করব। ওর বাবা না করলেও শুনব না। কিংবা এই দুই কামরার অফিসের বদলে বড়ো একটা অফিস নেব। কোটিপতিরা কি অফিসে যায়? নো আইডিয়া। কেমন একটা ভোম্বল টাইপ লাগছে নিজেকে।

হাতের চটি বইটার উপরে বাদামি মলাটের চারিদিকে কলকা দেওয়া বর্ডার। ঠিক এমন বর্ডার আমি আগে কোথাও দেখেছি। কোথায় তা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। কিন্তু খুব চেনা। উপরে বড়ো বড়ো হরফে লেখা TAMERLANE, তারপরে ছোট্ট করে And আর তার তলায় OTHER POEMS। লেখকের নাম নেই। শুধু পাইকা হরফে মুদ্রিত “এ বোস্টোনিয়ান”, যেমনটা উর্ণা বলেছিল। মুদ্রক কেলভিন অ্যান্ড টমাসের নামের প্রকাশের সাল, ১৮২৭। টেমারলেনের ছাপা হওয়া পঞ্চাশ কপির একটা। “তৈমুরের কাব্যগাথা”, যার জন্য দেবাশিসদাকে খুন হতে হল, তা এই মুহূর্তে আমার হাতের মুঠোয়। উলটেপালটে দেখতে যাব, তার আগেই টেবিলে একটা গোঁ গোঁ শব্দ। ফোন বাজছে। ভাইব্রেটার মোডে। ফোন হাতে নিয়ে দেখলাম টেলিপ্যাথি… উর্ণা ফোন করছে।

—হ্যালো

—কী ব্যাপার? এতগুলো হোয়াটসঅ্যাপ করলাম, জবাব দিচ্ছ না কেন?  

—ক্লায়েন্ট এসেছিল। ব্যস্ত ছিলাম। তুমি এত ফিসফিস করে কথা বলছ কেন? কী হয়েছে?  

—অনেক কিছু। ফোনে বলা যাবে না। আমার ক্লাস এইমাত্র শেষ হল। দেখা করা যায়? আর্জেন্ট।

—ঠিক আছে। কিন্তু কোথায়?

—ওই চেনা জায়গা। অ্যালবার্ট হল। রিচার্ডসনের ঘর। শেষ গলিতে। রাখি। তাড়াহুড়ো করেই ফোন কেটে দিল উর্ণা। কী ব্যাপার কে জানে! ওর বাড়ির লোক, বিশেষ করে বাবা খুব স্ট্রিক্ট। আমার সঙ্গে প্রেম করছে জানলে আমাকে বাড়িছাড়া করবে। বাড়িতে আমরা অচেনা মানুষের মতো থাকি। বাইরেও লোকসমক্ষে ঘোরাঘুরি করি না। তাই দেখা করার জন্য অদ্ভুত সব জায়গা বেছেছে উর্ণা। তাদের একটা অ্যালবার্ট হলের রিচার্ডসনের ঘর। এই ব্যাপারটা আমি আগে জানতাম না। আমাকে উর্ণাই বলেছে। হিন্দু কলেজের ম্যানেজার রামকমল সেনের বাড়ির নাম ছিল অ্যালবার্ট হল। বেজায় রাজভক্ত এই ভদ্রলোক রানি ভিক্টোরিয়ার স্বামী অ্যালবার্ট, প্রিন্স কনসর্টের নামে নিজের বাড়ির নাম রাখেন। পরে এই বাড়িতেই তিনি স্থাপন করেন অ্যালবার্ট ইনস্টিটিউট। বাড়ির দোতলার এক ঘরে থাকতেন হিন্দু কলেজের বিখ্যাত ইংরেজির শিক্ষক, অধ্যক্ষ ক্যাপ্টেন ডি এল রিচার্ডসন। ‘সেই সময়’ বইতে সুনীল গাঙ্গুলিও নাকি তাঁর কথা লিখেছেন। পরে রামকমল সেনের নাতি কেশবচন্দ্র এই বাড়িতেই প্রতিষ্ঠা করেন ভারতসভা-র। চল্লিশের দশকে কলেজপাড়ার এই অ্যালবার্ট হল চলে গেল ভারতীয় কফি বোর্ডের হাতে। অ্যালবার্ট হল নাম মুছে গিয়ে জন্ম নিল নতুন নাম। কফি হাউস। কিন্তু উর্ণা আগের নামটাই পছন্দ করে। তাতে দুটো সুবিধে, একে তো নস্টালজিয়ার একটা ছোঁয়া থাকে, পাশে চেনা কেউ থাকলেও সহজে বুঝতে পারে না কোন জায়গার কথা হচ্ছে।

উর্ণার গলায় অদ্ভুত একটা চাপা টেনশান। কী হল কে জানে! হাতের বইটা উলটে দেখার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সময় নেই। কোনওমতে সেটাকে পিঠের ব্যাকপ্যাকে ফেলে অফিসে তালা লাগিয়ে বুলেট স্টার্ট দিলাম। মিনিট দশেক লাগল কফি হাউসের সামনে পৌঁছোতে। গিয়ে দেখি সামনে মঞ্চ-টঞ্চ বেঁধে বেজায় চেল্লামেল্লি করছে এক রাজনৈতিক দল। সামনে ভিড় জমে আছে। যেখানে রোজ বাইক রাখি সেখানে রাখতে গিয়ে দেখি গোপাল হাসি হাসি মুখে পান চিবোতে চিবোতে আসছে। গোপাল এই অস্থায়ী পার্কিংটা দ্যাখে। আমায় দেখে বললে, “আইজ এহানে না দাদা। দ্যাখসেন না মিটিং চলত্যাসে জ্যাম হইয়া যাইব।”  

—এই তো পঞ্চায়েত ভোট শেষ হল। আবার কীসের মিটিং?  

—আরে দাদা। আফনে বোঝেন না ক্যান? এডা তো সেমিফাইনাল। ফাইনাল হইব নেস্ট ইয়ার। লোকসভায়। হেইডারই প্রাকটিস চলতে আসে। এহন যতদিন না ইলেকশান হইব, এ চলব। আফনে অন্য জায়গায় গাড়ি রাহেন।

অনেক দূরে বাইক পার্ক করে আবার কফি হাউসে আসতে আরও মিনিট পনেরো লাগল। শ্যাওলাধরা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে দেখি উর্ণা আবার ফোন করছে। ফোন না ধরেই কফি হাউসকে ডান দিকে ফেলে সোজা ঢুকে গেলাম পাশেই চক্রবর্তী চ্যাটার্জির বইয়ের দোকানে। উর্ণার কেন জানি না ধারণা, এই ঘরেই রিচার্ডসন সাহেব থাকতেন। ব্যাগ পিঠেই ভিতরে ঢুকছিলাম। কাউন্টারের ভদ্রলোক মনে করিয়ে দিলেন ব্যাগটা রেখে ঢুকতে। এবার লম্বা লম্বা বইয়ের র্যাকের একেবারে শেষের গলিতে। গোপন কথা বলতে গেলে এমন অদ্ভুত জায়গাতেই দেখা করে।  

গিয়ে দেখি একটা ইংরাজি বই হাতে নিয়ে ওলটাচ্ছে। নাইট নামের কোনও এক লেখকের লেখা। আমাকে দেখে বই হাতেই বেশ তেরিয়া হয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোমার কী ব্যাপার বলো তো? কখন ফোন করেছি! এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আমার দোকানের আদ্ধেক বই মুখস্থ হয়ে গেল।”

—বাহ। জানলে তো আরও একটু পরে আসতাম। সব বই বিনে পয়সায় পড়া হয়ে যেত। কী বই পড়ছিলে?

—এই বইটা বেশ ইন্টারেস্টিং, ফ্রি ম্যাসনদের নিয়ে লেখা। কিনেই নেব ভাবছি। যাই হোক, শোনো। ফাজলামোর ব্যাপার না। একটা কেস হয়েছে তোমার জানা দরকার।

—কী কেস?  

—বাবা বোধহয় তোমার আমার রিলেশানটা জানতে পেরে গেছে।  

—কী করে বুঝলে?

—বাবা তো এমনিতে আমার সঙ্গে বিশেষ কথা বলে না জানোই। বললেও একেবারে ফর্মাল। সেই বাবা আজ সকালে ব্রেকফাস্টের সময় আমায় জিজ্ঞেস করছে, তুর্বসু কেমন ছেলে রে?

—তুমি কী বললে?

—আমি কী বলব? বলব যে বিচ্ছিরি ছেলে? ফোন করলে এক ঘণ্টা বইয়ের দোকানে দাঁড় করিয়ে রাখে? আমি বলেছি আমি জানি না। তখন বলল আমি তোমার সঙ্গে কথা বলি কি না। বললাম দুই-একবার কথা হয়েছে। তারপরেই অদ্ভুত একটা প্রশ্ন করল জানো। জিজ্ঞেস করল বাড়ির বাইরে কি আমরা কোথাও দেখা করি?

—কী আশ্চর্য! তুমি কী বললে!

—বললাম।

—কী?

—ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল আর গোলদিঘিতে দেখা করার কথা।

—মানে?

এবার হেসে ফেলল উর্ণা, “তুমি কি পাগল? ওসব কেউ বলে? বললে তুমি আর আমাদের বাড়ি টিকতে পারবে ভেবেছ? বললাম, জীবনে না। কিন্তু বাবা নানাভাবে জিজ্ঞেস করল। কী মুশকিল বলো দেখি।”

—হুম। তা আমায় এভাবে এখানে ডাকলে কেন?

—শোনো। আমার ধারণা আমার কোনও বন্ধুই বিভীষণগিরি করছে। আমাদের সাবধানে থাকতে হবে। বাইরেও কোথাও দেখা করা যাবে না। আমি চেষ্টা করছি কে এই শয়তানিটা করছে সেটা ধরার। ততদিন ভিক্টোরিয়া, গোলদিঘি সব বাদ।

—ফোন করা যাবে?

—হোয়া করবে। দরকার হলে আমি কল ব্যাক করব।

—তুমি বাবাকে খুব ভয় পাও, তাই না?

—ও বাবা! যমের মতো। ছোটো থেকে বাবা কোনও দিন আমার সঙ্গে বন্ধুর মতো মেশেনি। নিজের জগৎ নিয়ে থাকত। অফিস আর ওই এনজিও নিয়েই সারাদিন থাকে। আমার আর মায়ের সঙ্গে কটা কথাই বা বলে।  

—কীসের এনজিও?

—একটা এনজিও আছে বাবাদের। আমিও ভালো জানি না। নানারকম সামাজিক কাজকর্ম করে-টরে। ওটাই বাবার প্রাণ। আমি, মা, কেউ না। ছোটোবেলা একবার বাবার টুলবক্সের কম্পাস ভেঙে ফেলেছিলাম বলে বাবা আমায় প্রচণ্ড মেরেছিল। মা বাধা দিতে আসায় মাকেও…  

দেখলাম উর্ণার চোখের কালো আইলাইনারের কোনা জলে ভরে আসছে। গলা ভাঙা ভাঙা। প্রসঙ্গ বদলাবার জন্য লাম,

—শোনো না, একটা উপায় আছে। সবদিক ঠিক থাকবে। সাপ মরবে, লাঠিও ভাঙবে না।  

–“কী”, চোখের জল আঙুলের ডগা দিয়ে মুছে জিজ্ঞেস করল উর্ণা।  

—আমি বরং তোমার বাবার কাছে গিয়ে বলি আমি তোমায় বিয়ে করব।  

–“ইয়ার্কি মেরো না”, চোখে জল নিয়েই হেসে ফেলল উর্ণা, “তোমার সবটাতে ইয়ার্কি।”  

–একদম না। তুমি একবার বলো। আমি আজকেই গিয়ে বলছি তোমার বাবাকে।

—বাবাহ! বীরপুরুষ। বিয়ে করে রাখবে কোথায়? আমাদের বাড়িতে ঘরজামাই থাকা চলবে না বলে দিলাম।

—কে থাকবে ঘরজামাই! কাজীরহাটে ফ্ল্যাট কিনব ভাবছি।

—যা-তা বলছ কিন্তু এবার।  

—সিরিয়াসলি! পাঁচ কোটি টাকায় ভালো ফ্ল্যাট হবে না? —শোনো, হয় তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, নয়তো আমায় তুমি বোকা বানাচ্ছ। কেসটা

কী বলো দেখি?

—সেই পো-র বই। তৈমুরের কাব্যগাথা… তুমি বলেছিলে…. বারো কপি… পাঁচ কোটি…..গোল্ডমাইন …..

—হ্যাঁ, তাতে কী?

—তেরো নম্বরটা পাওয়া গেছে।

—বলো কী! সত্যি!! কোথায়? —কোথায় পাওয়া গেল পরে বলছি। কিন্তু এখন কোথায় আছে বলতে পারি।  

—কোথায়?

—মানে?

—ওই সামনের টেবিলে। আমার ব্যাকপ্যাকে।

—দেখবে তো চলো।

উর্ণা প্রায় লাফিয়ে বেরোতে যেতেই একপাশের ডাঁই করে রাখা বইতে ধাক্কা লাগাল। হুড়মুড় করে পড়ে গেল সবগুলো। কাউন্টারে বসা ভদ্রলোক বেশ ভ্রূকুটি করে তাকাতেই আমি “সরি সরি” বলে বই গুছাতে শুরু করলাম। উর্ণা ততক্ষণে কাউন্টারে চলে গেছে। হাতের বইটা সেই ভদ্রলোককে দিয়ে “এটার বিল করবেন” বলেই ব্যাকপ্যাক খুলে আমার বইটা বার করে ফেলেছে। অবাক চোখে তাকিয়ে আছে বইটার মলাটের দিকে। ওর চোখ বিস্ফারিত। মুখ হাঁ হয়ে আছে। যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না। খুব ধীরে ধীরে বইয়ের মলাট ওলটাল উর্ণা।  

আমি দূর থেকে দেখলাম ওর ভুরু কুঁচকে গেছে। আবার দুটো পাতা উলটে গেল খুব তাড়াতাড়ি। দ্রুত চলে গেল পিছনের মলাটে। তারপর হাতছানি দিয়ে আমায় ডাকল।  

আমি বইগুলো গুছিয়েই ওর কাছে উপস্থিত হলাম। উর্ণার চোখে ভ্রূকুটির সঙ্গে ঠোঁটের ডগায় অদ্ভুত তিরতিরে একটা হাসি। বইটা আমার হাতে দিয়ে বলল, “পো সাহেব বাংলায় নাটক লিখতেন সেটা তো জানা ছিল না!”

আমি কিছু না বুঝেই ওর হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলাম। কোথাও একটা বিষম ভুল হচ্ছে। সবটাই যেন খুব বাজে একটা মজা। প্র্যাকটিক্যাল জোক। যেখানে ইংরাজি কবিতা থাকার কথা, সেখানে একগাদা পাতলা বাদামি পাতা জুড়ে, জড়ানো ছাপার অক্ষরে একটা নাটক ছাপা রয়েছে। নাটক! আর গোটাটাই বাংলা ভাষায়। সে ভাষাও এমন ভাষা যা আমার একেবারেই অচেনা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *