প্রথম অধ্যায় – লড়ায়ের আগে
মক্কায় ইসলাম ও পৌত্তলিকতার মধ্যে সংঘাতের শুরু।
অপবাদমূলক প্রচারণা।
বিশৃঙ্খলা ও নির্যাতন।
কুরাইশদের আবু তালিবকে গৃহযুদ্ধের হুমকি।
হুমকির প্রতি আবু তালিবের তাচ্ছিল্য।
বনি হাশিম ও বনি আল-মুত্তালিবের প্রতি সামাজিক বর্জন ও অর্থনৈতিক অবরোধ। সামাজিক বর্জন ও অর্থনৈতিক অবরোধ নীতির ব্যর্থতা।
.
বদরের যুদ্ধের বিস্তারিত বর্ণনায় যাওয়ার আগে এর পূর্বেকার ঘটনাবলী এবং গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতিসমূহ সম্পর্কে আমাদের একটা নজর দেওয়া আবশ্যক, কারণ এসব ঘটনা এই যুদ্ধের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত।
মহানবী (সঃ) মক্কায় অবস্থানকালে সুদীর্ঘ তের বছর মক্কার লোকদের মধ্যে ইসলাম প্রচারের জন্য কঠোর পরিশ্রম করেন। মহান আল্লাহ্ তায়ালার আদেশে তিনি এই ধর্মবিশ্বাস প্রচারকে জীবনের মহান ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন!
মহানবীর মক্কী জীবনের সংগ্রাম ছিল সম্পূর্ণ অস্ত্রবিহীন ও শান্তিপূর্ণ। তাঁর প্রতিপক্ষরা ইসলামের বাণীর বিরোধিতা এবং এর অগ্রযাত্রাকে প্রতিহত করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়। এজন্য তারা নির্যাতন, ভীতি-প্রদর্শন এবং সামাজিকভাবে বর্জনের নীতি গ্রহণ করে তবে তারা অস্ত্রগ্রহণে অনিচ্ছুক ছিল।
শুরুতে কুরাইশ বংশের লোকেরাই ইসলামের বিরোধিতা করে। তারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি এবং মানুষকে মহানবীর কথা শুনতে বিরত রাখার জন্য নানা ধরণের বিরূপ প্রচারণার আশ্রয় নেয় এবং মহানবীর বাণীকে সবার সামনে বিকৃতভাবে উপস্থাপিত করে।
মক্কায় তারা মহানবীর (সঃ) বিরুদ্ধে কুৎসা রটনার জন্য ইতর শ্রেণীর লোক, গাল্পিক এবং কবিদের ভাড়া করতো। এটি ছিল একটি নিষ্ঠুর স্নায়ুযুদ্ধ। এর সঙ্গে জড়িত ছিল অনেক দুঃখ-কষ্ট ও নির্যাতন। যারা মহানবীর কথায় সাড়া দিতেন তাদেরকে ভয় দেখিয়ে তাঁর কাছ থেকে দূরে সরানোর জন্য সব রকম প্রচেষ্টা চালানো হতো। প্রথম দিকে, কুরাইশদের তাৎক্ষণিক লক্ষ্য সাধারণ মানুষের কাছ থেকে মহানবী ও তাঁর বাণীকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা এবং এতে তারা কিছুটা সফল হয়েছিল। এই প্রায় সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কে ইবনে হিশামের বক্তব্য হচ্ছে : “কুরাইশদের কাছ থেকে মহানবীর পাওয়া নিষ্ঠুরতম আচরণ হচ্ছে এই যে একদিন বাইরে গিয়ে তিনি যে সব লোকের (মুক্ত ও ক্রীতদাস) সাক্ষাত পান তাদের সবাই তাকে বিদ্রূপ ও প্রত্যাখ্যান করে। এ অবস্থায় চরম দুঃখ-ভারাক্রান্ত মনে তিনি বাড়ী ফিরে আসেন এবং ঐদিনের তিক্ত অভিজ্ঞতার লজ্জায় কাপড় মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েন। তখন মহান আল্লাহ্তায়ালা তাঁর কাছে এই ওহী পাঠান : “হে বস্ত্ৰবৃত! তুমি উঠ এবং সতর্ক করে দাও।”
মহানবীর বিরুদ্ধে প্রচারণা
মহানবীর মহান উদ্দেশ্যের সাফল্যে বিচলিত হয়ে কুরাইশরা সারা দেশে বহু দল ও প্রতিনিধি প্রেরণ করতো। তাদের কাজ ছিল নবীর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করা, অন্য গোত্রের মানুষদের বিভ্রান্ত করা এবং তাদেরকে ইসলাম গ্রহণে বিরত রাখা। এদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দলগুলোর কাজ ছিল হজ্ব মওসুমে একত্রে সংগঠিত হয়ে হজ্ব-যাত্রীদের বিভ্রান্ত করা এবং মহানবীর (সঃ) বক্তব্য ও প্রচার সম্পর্কে তাদের মনে সন্দেহ সৃষ্টি করা। কিন্তু প্রাথমিক এই সাফল্য কুরাইশরা ধরে রাখতে পারেনি। আল্লাহর বাণী প্রচারে বাধা সৃষ্টিতে তারা ব্যর্থ হয়। তাদের উপহাসের বাণ, অবজ্ঞাপূর্ণ উপহাস এবং মিথ্যা অপবাদমূলক প্রচারণা ব্যর্থ হয় এবং শত প্রতিকূলতার মাঝেও মহানবী (সঃ) বরাবরই স্থির ও অবিচল ছিলেন।
নতুন ধর্মমতের প্রতি কুরাইশদের বিরোধিতায় এর নিজের উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। কুরাইশদের ধারণা ছিল তাদের বিরোধিতার ফলে নতুন ধর্মের প্রচারণা বিঘ্নিত হবে এবং নতুন ধর্ম মক্কী-নগরীর অভ্যন্তরেই মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবে। কিন্তু কার্যতঃ তাদের বিরোধিতার ফলেই ইসলামের গতিশীল আবেদন কুরাইশদের বাইরেও একটা বৃহত্তর গোষ্ঠী গড়ে তুলেছিল। বিভিন্ন তীর্থযাত্রীর দল আরবের বিভিন্ন গোষ্ঠী থেকে মক্কায় আসলে মহানবী তাদের কাছে যান এবং এই সব বহু-ঈশ্বরবাদী লোকদের কাছে তিনি তাঁর বাণী পৌঁছে দেন এবং তাদেরকে ইসলামের পতাকাতলে আসার আহব্বান জানান।
মক্কী সংসদ অধিবেশন
আরবদের আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে কুরাইশদের শ্রেষ্ঠত্ব নতুন ধর্মমতের কাছে হুমকির সম্মুখীন হয়। তখন মক্কার বয়োজ্যেষ্ঠ নেতারা নতুন ধর্মমতের ক্ৰমবৰ্দ্ধমান প্রভাব প্রতিহত করার পদ্ধতি নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনার জন্য “দার-উন-নাদওয়া” নামে পরিচিত সংসদে সমবেত হয়। তারা মুহাম্মদ (সঃ) এবং তাঁর বাণীকে তাদের ধর্ম ও দেবতাদের জন্য একটা সমূহ বিপদ হিসেবে গণ্য করে।
সংসদ সকল সম্ভাব্য দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করে। বিভিন্ন নেতার কাছ থেকে বিভিন্ন রকম সমাধান ও পরামর্শ আসে। পার্লামেন্টের প্রথম বক্তা আল-ওয়ালিদ বিন আল-মুগিরা আল-মাখঝুমির বক্তব্য ছিল এরকম :
“হে কুরাইশ বংশের লোকসকল, আবারো তীর্থের সময় এসে পড়েছে এবং শীঘ্রই আরবের বিভিন্ন এলাকা থেকে জনগণের প্রতিনিধিবৃন্দ আপনাদের নগরীতে ভীড় জমাতে শুরু করবে। আপনারা জানেন, তারা ইতিমধ্যেই মুহাম্মদের কথা জেনে গেছে। অতএব, আপনাদের বক্তব্যের মধ্যে যাতে কোন বিরোধিতা না থাকে সেজন্য তার সম্পর্কে আপনাদের একটি অভিন্ন মত থাকা উচিত।”
সেখানে উপস্থিত সবাই জবাব দিল, “হে আবদ্ শামসের পিতা! তার সম্পর্কে আপনার অভিমত আমাদেরকে বলুন। আমরা সবাই তার সম্পর্কে একই মত পোষণ করব এবং প্রকাশ করব।” সে বললো, “তথাপি আপনারা কথা বলুন; আমি আপনাদের বক্তব্য শুনব।” এরপর অনেকেই বক্তব্য রাখলো এবং বিভিন্ন জন বিভিন্ন পরামর্শ দিল। একজন বক্তা বললো, “আমরা বলবো যে সে একটা গণৎকার।” তখন আল-ওয়ালিদ আপত্তি তুলে বললো, “কিন্তু সে গণৎকার নয়। আমরা অনেক গণৎকার দেখেছি। কিন্তু গণৎকারের কথার সঙ্গে তার বক্তব্যের কোন মিল নেই।” তারা বললো, “তাহলে আমরা বলবো যে সে একটা উম্মাদ।” সে বললো, “না, সে উম্মাদ নয়। আমরা উম্মাদদের দেখেছি এবং জানি উন্মাদনা কি। তার মধ্যে পাপাচ্ছন্নতা জাতীয় উন্মাদনার কোন লক্ষণ নেই।” তারা বললো, “আমরা বলবো যে সে একজন কবি।” সে বললো, “সে কোন কবি নয়। আমরা বিভিন্ন ঢংয়ের কবিতা দেখেছি—দ্বিমাত্রিক চরণের কবিতা, এর স্বরভঙ্গি, স্বতঃস্ফূর্ততা, কৃত্রিমতা এবং বিশুদ্ধতা; না এটি কোন কবিতা নয়।” লোকজন বললো, “তাহলে তাকে জাদুকর বলা হোক।” কিন্তু আল-ওয়ালিদ বললো, “সে জাদুকরও নয়। আমরা অনেক জাদুরক এবং তাদের জাদু দেখেছি। সে যা করে তাকে কোনক্রমেই জাদুকরের কাজ বলা যাবে না। সে কখনো গিট বাঁধে না।” এতে তারা তাকে জিজ্ঞেস করলো, “হে আবদ্ শামসের পিতা, তাহলে আমরা তার সম্বন্ধে কি বলবো?” এ প্রশ্নের জবাবে সে তার দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করে বললো, “প্রকৃতপক্ষেই তার কথা খুব মিষ্টি এবং তালগাছের মতই শক্তিশালী, সুমিষ্ট এবং ফলপ্রসূ। সুতরাং এ সম্বন্ধে তোমরা খারাপ কিছু যাই বল না কেন সবাই তা বুঝে ফেরবে।” তবে সে বললো, “সত্যের কাছাকাছি কথা হবে এই যে, তার কথার মধ্যে এমন জাদু আছে যা একজন মানুষকে তার পিতা, ভাই, স্ত্রী এবং পরিবারের কাছ থেকে আলাদা করে দেয়।” সম্মেলনের সবাই একমত হয়ে আল-ওয়ালিদ বিন আলমুগিরা আল-মুখঝুমির এই প্রস্তাব গ্রহণ করলো।
মিথ্যা কলঙ্ক রটনাকারী দলসমূহ
উপরোক্ত পরামর্শ বাস্তবায়নের জন্য কুরাইশরা বিশেষ দল গঠন করে তাদেরকে বলে দিল যে তারা মক্কায় আগত তীর্থযাত্রীদের কাছে যাবে এবং তাদেরকে মুহাম্মদের কথা শুনার অশুভ পরিনীতি সম্পর্কে হুশিয়ার করে দেবে। তারা তাদেরকে বলবে যে মুহাম্মদ হচ্ছে একন বিপজ্জনক জাদুকর যে ছেলেদেরকে তাদের বাবার কাছ থেকে এবং স্বামীদেরকে তাদের স্ত্রীর কাছ থেকে আলাদা করে দেয়।
ইবনু ইসহাক লিখেছেন : এই দলগুলি যাদেরই সাক্ষাত পেত তাদের মধ্যেই মহানবীর বিরুদ্ধে এই ধরণের অপবাদমূলক প্রচারণা চালাত। এর ফলে আরব তীর্থযাত্রীরা যখন তীর্থ শেষে বাড়ী ফিরতো তখন তারা মহানবীর নাম ও বাণীও বয়ে নিয়ে যেত। এভাবে সারা আরবদেশ মহানবী ও তাঁর উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে পারে।
কিন্তু এ সব অপবাদমূলক প্রচারণা বা ঠান্ডা লড়াই (বর্তমান বিশ্বের এ রকমই বলা হয়) কুরাইশদের কোন কাজে আসেনি। এতে মহানবী (সঃ) নিরুৎসাহিত হননি। তাঁর বিরুদ্ধে কুরাইশরা যে সব ষড়যন্ত্র করেছিল, প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল এবং মিথ্যা অভিযোগ এনেছিল তার ফলে তিনি তাঁর বাণী প্রচার থেকে বিরত থাকেন নি, যদিও প্রতিপক্ষদের প্রত্যাশা ছিল যে সবার কাছে পরিত্যক্ত হয়ে তিনি তাঁর উদ্দেশ্য পরিত্যাগ করবেন। বরঞ্চ তিনি শত প্রতিকূলতা ও নির্যাতন উপেক্ষা করে তাঁর জীবনের এই সংকটময় সময়ে তাঁর প্রভুর কথা প্রচারের কাজ অত্যন্ত ধৈর্য্য সহকারে অবিচলভাবে চালিয়ে গিয়েছিলেন। এতে করে তাঁর প্রতিপক্ষ কুরাইশদের উদ্বেগ এবং বিস্ময় যেমন বাড়ে, তেমনি বাড়ে তাঁর খ্যাতি এবং অনুসারীদের সংখ্যা।
গৃহযুদ্ধের হুমকি
মক্কার নেতৃবৃন্দ যখন দেখতে পেল তাদের প্রচারণায় কোন ফল হচ্ছে না, বরং তা মুহাম্মদের (সঃ) সিদ্ধান্ত কেই ইস্পাতের মত দৃঢ় করে দিচ্ছে তখন তারা তাদের বিশ্বাস ও ধর্মের মূলে আঘাতকারী ইসলামের প্রচার রোধকল্পে দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলো।
তারা ভয় দেখালো মহানবী যদি তাদের লোকদের মূর্তিপূজা বাদ দেওয়ার কথা বলে তাদের দেবদেবীকে অপমান করা থেকে বিরত না হন তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে তারা যুদ্ধ ঘোষণা করবে।
যেহেতু আবু তালিব (মহানবীর চাচা এবং তাঁর দাদা আবদাল মুত্তালিবের মৃত্যুর পর তাঁর অভিভাবক) ছিলেন বৈরি আরব গোষ্ঠীসমূহের বিরুদ্ধে মুহাম্মদের (সঃ) প্রধান সমর্থক, সেজন্য কুরাইশরা তাঁর কাছেই একজন প্রতিনিধির মাধ্যমে তাঁর ভাতিজার বিরুদ্ধে তাদের জোরালো প্রতিবাদ পাঠায়। তারা জানায় যে মহানবী (সঃ) তাদের দেবতাদের অপমান করেছেন এবং প্রতিমাদের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করেছেন। মক্কী সংসদ প্রতিনিধি দলের সদস্যদের পরামর্শ দেয় যে তারা এই মর্মে হাশেমী পরিবারের প্রধান আবু তালিবকে হুশিয়ার করে দেবে যে তাঁর ভাতিজা যদি পৌত্তলিকতা এবং প্রতিমা-পূজার বিপরীতে তাঁর বিদ্রোহী বাণী প্রচারে ক্ষান্ত না হন তাহলে তারা তাঁদের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধ ঘোষণা করবে। তারা বলে দেয় যে তিনি (অর্থাৎ আবু তালিব) যত দিন মহানবীকে আশ্রয় দেবেন এবং তাদের চিরাচরিত ধর্মের বিপরীতে তাঁর প্রচারণার প্রতি চোখ বন্ধ করে সমর্থন জানাবেন ততদিন তারাও তাদের লড়াই অব্যাহত রাখবে।
আবু তালিবের সঙ্গে কুরাইশ প্রতিনিধিদলের সাক্ষাৎ
সংসদীয় প্রতিনিধিদল হাশেমী পরিবারের প্রধানের সঙ্গে তাদের পারিবারিক সভাস্থলে দেখা করলো এবং আবদ মানাফের পরিবারের বয়োজৈষ্ঠ ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে প্রতিনিধিদলের নেতা বললো : “হে আবু তালিব! আপনি সত্যি সত্যি আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠ এবং সম্মানের পাত্র। আমরা ইতিপূর্বেই আপনাকে আপনার ভাতিজাকে এসব কাজ থেকে বিরত রাখতে বলেছিলাম কিন্তু আপনি তা করেননি। ঈশ্বরের নামে বলছি, আমরা আর অলস হয়ে বসে থেকে আমাদের পূর্বপুরুষদের আমাদের আদর্শের এবং দেব-দেবীর অবমাননা সহ্য করতে পারি না। হয় আপনি আপনার ভাতিজার প্রতি প্রতিরক্ষা প্রত্যাহার করুন নয়তো আমরা আপনাদের দু’জনের সঙ্গেই লড়াইয়ে অবতীর্ণ হব এবং এক পক্ষ নিশ্চিহ্ন না হওয়া পর্যন্ত সে লড়াই চলতে থাকবে।”
এই কঠোর হুঁশিয়ার বাণী বৃদ্ধ আবু তালিবের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করলো। তিনি মহানবীকে (সঃ) ডেকে কুরাইশদের প্রতিনিধিদলের কথা এবং তাদের অভিযোগের কথাগুলো জানালেন। তিনি মহানবীকে (সঃ) বললেন, “তুমি আমার প্রতি দয়াপরবশ হও। তুমি আমার উপর এমন বোঝা চাপিও না যা বহন করার মত শক্তি আমার নেই
এতেই মহানবী বুঝতে পারলেন যে তাঁর চাচার আর তাঁকে সাহায্য করার মানসিকতা নেই এবং তিনি দায়িত্ব এড়াতে চান। মহানবী অবশ্য এই সংকটময় অবস্থায়ও দূর্বল হলেন না, বরং দ্ব্যর্থহীন ও দ্বিধাহীন ভাষায় ঘোষণা করলেন যে তিনি এমন কোন চুক্তিতে রাজী হবেন না যা তাঁর প্রতি আল্লাহ্ কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব পালনে তাঁকে প্রতিহত করতে চায়। এমন কি তাঁর চাচা আবু তালিব যদি সমর্থন প্রত্যাহার করেন এবং সাহায্য করতে অস্বীকৃতি জানান তবু তিনি তাঁর কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হবেন না।
তিনি অবিচলিত কণ্ঠে তাঁর চাচাকে বললেন, “হে চাচা! আমি আল্লাহ্ নামে শপথ করে বলছি, এই সব লোক যদি আমার ডান হাতে সূর্য্য এবং বাম হাতে চন্দ্র এনে দিয়েও বলে যে আমাকে আমার উদ্দেশ্য পরিত্যাগ করতে হবে, আমি তা পরিত্যাগ করবো না” এবং এই বলে সেখান থেকে তিনি চলে গেলেন।
আবু তালিবের কুরাইশদের দাবী প্রত্যাখান :
মহানবীর কথাগুলো আবু তালিবের অন্তরকে স্পর্শ করলো এবং সাময়িকভাবে তিনি কুরাইশ প্রতিনিদি দলের হুঁশিয়ারীর কথা ভুলে গেলেন। তাঁর বিবেক জাগ্রত হলো এবং তিনি আর কুরাইশদের শক্তি কিংবা হুঁশিয়ারীকে ভয় পেলেন না। তিনি প্রস্থানোদ্দ্যত মহানবীকে ডেকে বললেন, “হে আমার ভ্রাতুষ্পুত্র! তুমি তোমার ইচ্ছেমত এগিয়ে যাও। আমি তোমাকে কখনোই তোমার শত্রুদের হাতে সমর্পন করবো না।”
আবু তালিব অবশ্য ভালভাবেই জানতেন তাঁর ভাতিজার প্রতি তাঁর সমর্থন এবং কুরাইশদের ‘কাছে তাঁর আত্মসমর্পনের অস্বীকৃতির ফলে কুরাইশদের প্রতিক্রিয়া কিরকম হবে। এজন্য তিনি বনি হাশিম এবং বনি আল-মুত্তালিবের নেতাদের ডেকে মহানবীর প্রতি তাঁর সমর্থনের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতির গুরুত্ব তাদেরকে অবহিত করলেন। তিনি মুহাম্মদকে রক্ষার কাজে তাদেরকে তাঁর পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধ জানালেন। এক মাত্র মুহাম্মদের আরেক চাচা আবু লাহাব (তাঁর ঘোরতর শত্রু) ছাড়া সেখানে উপস্থিত সবাই (মুসলমান এবং বহু-ঈশ্বরবাদী সবাই) তাঁর আবেদনে অনুকূল সাড়া দেন।
মহানবীর প্রতি আবু তালিবের সমর্থনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা পৌত্তলিকতা ও ইসলামের মধ্যেকার সংঘর্ষের ক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা এনে দেয়। কুরাইশরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের প্রচারণা জোরদার করে এবং তাদের মনোবল ভেঙ্গে দেয়ার জন্য দমন মূলক নীতি গ্রহণ করে। তারা মহানবীর ঘোরতর শত্রুতে পরিণত হয়। তবে যুদ্ধ ও শান্তি উভয় ক্ষেত্রে বনি হাশিম এবং বনি আল-মুত্তালিবের শক্তিশালী ভূমিকার কারণে কুরাইশরা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারেনি।
মহানবীর পক্ষ অবলম্বন করার জন্য বনি হাশিম এবং বনি আল-মুত্তালিব গোত্রের বিরুদ্ধে কুরাইশরা এক বার একটা রক্তাক্ত যুদ্ধ ঘোষণার চিন্তা করেছিল। কিন্তু তাদের মধ্যে বিজ্ঞ ব্যক্তিরা গৃহ যুদ্ধের ভয়াবহ পরিণাম জানতো। প্রকৃতপক্ষে, এই ভীতিই মহানবী (সঃ) কে হত্যা করার পথে তাদের প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায়।
এজন্যই ঐ সময় তারা মহানবীর সমর্থকদের সাথে সশস্ত্র সংঘর্ষ পরিহার করে। পরিবর্তে, তারা মুসলমানদের সামাজিকভাবে বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের এ ব্যবস্থা রক্তাক্ত সংগ্রামের ঘোষণার চেয়ে কম নিষ্ঠুর নয়। তারা দু’টি গোত্রকেই আর্থ-সামাজিকভাবে বর্জন করে।
কুরাইশরা মহানবীর সঙ্গে সৌহার্দ্য পুনঃ প্রতিষ্ঠা চায়
এই বর্জনের আগে কুরাইশরা আরেকবার মহানবীর কাছে এসে তাদের মধ্যেকার পারস্পরিক বৈরিতা দূর করতে চায়।
কথিত আছে, একদিন মক্কী সংসদে কথা বলতে গিয়ে বনি আব্দ মানাফের নেতা উতবাহ্ বিন রাবিয়াহ্ মহানবীর বাণীর ক্রমবর্ধমান বিপদে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন, কারণ মহানবীর বাণীর প্রতি কুরাইশ যুবকদের আকর্ষণ দিন দিনই বৃদ্ধি পাচ্ছিল।
উতবাহ্ ছিলেন একজন বিখ্যাত ও অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ। তার কথায় মক্কী সংসদে একটা গুরুগম্ভীর আলোচনা শুরু হয় এবং তারা মুহাম্মদের (সঃ) সঙ্গে যোগাযোগ করে একটা মীমাংসার চেষ্টার জন্য উতবাকে প্রতিনিধি হিসেবে পাঠানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। মুহাম্মদ (সঃ) তাঁর প্রচারণা বন্ধ করে চুপ করে বসে থাকবেন এই শর্তে তাঁকে যে কোন পদ বা যে কোন পরিমান অর্থ প্রদানের প্রস্তাব দেয়ার ক্ষমতা এই প্রতিনিধির হাতে অর্পন করা হয়। কুরাইশদের নেতা গোপনে মহানবীর সঙ্গে আলাপকালে বললেন, “হে আমার ভ্রাতুষ্পুত্র! তুমি ভাল করেই জান জ্ঞাতি হিসেবে তুমি আমাদেরই রক্ত-মাংস। কিন্তু তুমি তোমার আত্মীয়-স্বজনদের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস নিয়ে এসেছ, যা তাদের শক্তিকে দূর্বল করে দিয়েছে, তাদের আদর্শকে উপহাস করেছে, তাদের পূর্বপুরুষদের অবিশ্বাস করে তাদের দেব-দেবী ও ধর্মকে অবজ্ঞা করেছে। সুতরাং আমার কথা শোন। আমি তোমাকে এমন কিছু দিতে চাচ্ছি যা তোমার পছন্দ হতে পারে।’ আল্লাহর দূত জবাব দিলেনঃ “হে আবুল ওয়ালিদ, আপনি বলুন, আমি শুনছি।” এ কথা শুনে তিনি বললেন, “ভাতিজা, তোমার যদি ধন-সম্পত্তি লাভের কোন বাসনা থাকে তাহলে আমরা তোমাকে এমন সম্পদ দিতে পারি যা পেলে তুমিই আমাদের মধ্যে সবচেয়ে সম্পদশালী হবে; তুমি যদি সন্মান চাও, তাহলে তোমাকেই আমরা আমাদের নেতা বানাতে পারি এবং আমাদের সামাজিক জীবনে তোমার রায়কেই চূড়ান্ত বলে মেনে নেব; তুমি যদি নেতৃত্ব চাও, তাহলে তোমাকেই আমরা আমাদের রাজা বানাতে পারি এবং তোমার উপর যদি কোন অশুভ প্রেতাত্মা ভর করে থাকে যাকে তুমি ফেলতে পারছ না তাহলে আমরা তোমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারি; তুমি সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তোমার চিকিৎসার যাবতীয় খরচ আমরাই বহন করবো, কারণ মাঝে মাঝে এমন ঘটে যে প্রেতাত্মা মানুষের উপর এমন প্রভাব বিস্তার করে যে কেবলমাত্র যথাযথ চিকিৎসার মাধ্যমেই মানুষ সুস্থ হতে পারে।”
মীমাংসার উদ্যোগে ব্যৰ্থতা
উতবাহ বিন রাবিয়া কথা শেষ হলে আল্লাহর দূত বললেন, “আবুল ওয়ালিদ, আপনার কথা বলা কি শেষ হয়েছে?
তিনি বললেন, “হ্যাঁ, শেষ হয়েছে।”
তখন নবীজি বললেন, “আমার কথা শুনুন।
তিনি বললেন, “হ্যাঁ, শুনছি।”
নবীজি বললেন :
“পরম করুণাময় আল্লাহর নামে হা মিম। পরম দাতা ও দয়ালুর প্রত্যাদেশ। জ্ঞানবানদের জন্য আরবী ভাষায় পবিত্র গ্রন্থ কুরআন যার প্রতিটি আয়াত বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সুসংবাদ এবং সতর্কবাণী। কিন্তু তাদের মধ্যে অধিকাংশই শ্রবণ না করে মুখ ফিরিয়ে নেয়।”[১] এভাবে নবীজি কুরআনের সূরা থেকে আবৃত্তি করতে লাগলেন এবং উতবাহ চুপচাপ তাঁর কথা শুনলেন। এরপর মহানবী আবৃত্তি থামিয়ে আল্লাহর প্রশংসায় অবনত হয়ে পড়লেন। তারপর বললেন, “আবুল ওয়ালিদ, আপনার প্রস্তাবের জবাবে আমার যা বলার ছিল তা আপনি শুনলেন। এটাই হচ্ছে আপনাকে যারা পাঠিয়েছে সেই কুরাইশদের প্রতি এবং আপনার প্রতি আমার জবাব।”
[১. ফুসিলাত, ১-৩]
মহানবীর কথা শুনে উতবাহ্ এতই অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন যে তাঁর আবৃত্তির পর তিনি সম্পূর্ণ নির্বাক হয়ে পড়লেন। তিনি একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারলেন না। হঠাৎ করেই তার মনে একটা পরিবর্তন আসলো এবং একজন পরিবর্তিত মানুষ হিসেবেই তিনি কুরাইশদের কাছে ফিরে গেলেন।
উতবাহ ফিরে গেলে মক্কার নেতারা তার অভিব্যক্তির পরিবর্তন লক্ষ্য করলেন। একজন মন্তব্য করলেনঃ “যে আবুল ওয়ালিদ আপনাদের কাছে ফিরে এসেছেন তার মুখাবয়ব এবং যে আবুল ওয়ালিদ আপনাদের কাছ থেকে গিয়েছিলেন তার মুখাবয়ব সম্পূর্ণ আলাদা।” উতবাহ বিন রাবিয়াহ্ ছিলেন কুরাইশ নেতৃবৃন্দের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তাকে গণ্য করা হোত একজন সরল, গভীর অন্তর্দৃষ্টি-সম্পন্ন, বিচক্ষণ ব্যক্তি হিসেবে। সুতরাং তিনি যখন দরবারে তার আসন গ্রহণ করলেন, তখন কুরাইশরা মহানবীর সঙ্গে তার আলাপের ফলাফল সম্পর্কে জানতে চাইলো। তারা জিজ্ঞেস করলো, “হে আবুল ওয়ালিদ, আপনি কি ফেলে এসেছেন?” তিনি জবাব দিলেন, “আমি এমন একটা বিস্ময়কর বক্তব্য ফেলে এসেছি যা আমার জীবনে ইতিপূর্বে কখনো শুনিনি। ঈশ্বরের দোহাই, এটি কাব্যও নয়, দৈবজ্ঞগিরি ও নয়।” তিনি আরো বললেন হে কুরাইশ বংশের লোকসকল, তোমরা আমার উপদেশ শোন এবং এই লোকটিকে তার মত চলতে দাও। আমি ঈশ্বরের নামে শপথ করে বলছি, তার কথার মধ্যে বড় কিছু ঘটনার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আরবদের শক্তি যদি তার চেয়ে বেশী হতো তাহলে তোমরা এর মধ্যে সরাসরি জড়িত না হয়েও এর ফলাফলে সন্তুষ্ট হতে পার; পক্ষান্তরে সেও যদি আরব জাতিকে দমন করতে পারতো তাহলে তোমাদের দুশ্চিন্তার কিছু নেই, কারণ তার শাসন হবে তোমাদেরই শাসন এবং তার সম্মানও হবে তোমাদেরই সম্মান এবং তোমরাই হবে সমগ্র মানবজাতির মধ্যে সবচেয়ে ভাগ্যবান জাতি।”
একথা শুনে তারা বলে উঠলো, “হে আবুল ওয়ালিদ, নিশ্চয়ই সে আপনার উপর তার জাদুর প্রভাব ফেলেছে।” এভাবে তারা উতবাহ বিন রাবিয়ার পরামর্শ গ্রহণ না করে তাকে বরং এই বলে অভিযুক্ত করলো যে তিনি মহানবী মুহাম্মদের (সঃ) জাদুকরী ভাষা ও মন্ত্রের কাছে আত্মসমৰ্পণ করেছেন। এই অভিযোগের জবাবে উতবাহ্ (তার বক্তব্যের সত্যতায় আত্মবিশ্বাসী হয়ে) বললেন, “এটি হচ্ছে আমার মত। তোমরা যেমনটা ভাল মনে কর করতে পার।”
আর্থ- সামাজিক বর্জন নীতি
উতবাহ্ বিন রাবিয়ার মাধ্যমে কুরাইশরা যখন উচ্চ পদ-মর্যাদা এবং ধন সম্পত্তির লোভ দেখিয়ে মহানবীকে তাঁর প্রচারণা থেকে বিরত করতে পারলো না কিংবা তাঁকে পরিত্যাগ করার জন্য আবু তালিব, বনি হাশিম এবং বনি আল-মুত্তালিবকে রাজী করাতে ব্যর্থ হলো তখন তারা আর্থ- সামাজিকভাবে বনি হাশিম ও বনি আল-মুত্তালিবকে বর্জন করার নীতি গ্রহণ করলো। এ দু’টি বংশের উপর তারা অত্যন্ত নিষ্ঠুর একটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দিল।
নতুন ধর্মবিশ্বাসের ক্রমবর্ধমান হুমকি এবং মক্কার ভিতরে সমস্ত গোত্রের মধ্যে এর নতুন নতুন বিজয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ সম্পর্কে চূড়ান্ত আলোচনার জন্য কুরাইশরা তাদের দরবার হলে মিলিত হলো। তাদের জন্য বিশেষ মনোঃপীড়ার কারণ ছিল ওমর বিন আল-খাত্তাব এবং হামযা বিন আবদাল মুত্তালিবের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ, কারণ এরা দু’জন ছিলেন কুরাইশদের শীর্ষস্থানীয় নেতা। এদের ইসলাম গ্রহণ নিঃসন্দেহে মুসলমানদের শক্তি অনেক বাড়িয়ে দেয়।
দরবারে বর্জন নীতির সিদ্ধান্ত
মক্কী সংসদ এই মর্মে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো যে বনি হাশিম এবং আল-মুত্তালিব গোত্র দু’টির উপর একটা আর্থ-সামাজিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে। এই গোত্র দু’টির সবাই (মুসলমান ও অমুসলমান) অবশ্য এই নীতির বিরোধিতা করে এবং কখনই তারা আল্লাহর নবী মুহাম্মদ (সঃ) কে পরিত্যাগ করার কথা চিন্তা করে না। বরঞ্চ তারা নবীজিকে সমর্থন করার ফলে সৃষ্ট যাবতীয় দুঃখ-কষ্টকে সাহসিকতার সঙ্গে মোকাবিলার সিদ্ধান্ত গ্ৰহণ করে।
ইবনে ইসহাকের ভাষ্য অনুসারে, কুরাইশরা যখন দেখলো যে মহানবীর সাথীরা আবিসিনিয়ায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন এবং সেখানকার শাসনকর্তা নিগাস মুসলমানদেরকে কুরাইশদের কাছে সমর্পণ করতে অস্বীকার করেছেন, এবং ওমর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ ক’রে হামযা বিন আবদাল মুত্তালিবের সঙ্গে মহানবীর অনুসারীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন, এবং ইসলামের অগ্রগতি মক্কার বাইরের গোত্রসমূহের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে তখন তারা একত্রে মিলিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেয় যে বনি হাশিম এবং বনি আল-মুত্তালিব গোত্রের সঙ্গে তাদের বিয়ে-সাদি নিষিদ্ধ এবং তারা তাদের সঙ্গে কোন রকম ব্যবসা-বাণিজ্যও করবে না। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে এই মর্মে একটা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যে উক্ত গোত্র দু’টির বিরুদ্ধে শাস্তি বলবৎ করার বিষয়ে তারা পরস্পরকে সমর্থন করবে।
কুরাইশরা যখন আর্থ-সামাজিকভাবে বনি হাশিম এবং বনি আল-মুত্তালিব গোত্রের লোকদের বর্জন করে তখন তারা আবু তালিবের নেতৃত্বে শেয়াব আবি তালিব নামক উপত্যকায় গিয়ে আশ্রয় নেন। শুধুমাত্র আবু লাহাব (আবদাল উযা বিন আবদাল মুত্তালিব) নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে কুরাইশদের পক্ষে যোগ দেয়।
বর্জনের পরে
এভাবে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘাত বিস্তার লাভ করে, কারণ কুরাইশদের সংগ্রাম এখন আর শুধু মুহাম্মদের (সঃ) বিরুদ্ধে সীমাবদ্ধ থাকে না বরং এর মধ্যে জড়িয়ে পড়ে কুরাইশদের দু’টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গোত্র।
মুসলমানদের বিরুদ্ধে এবং তাদের সহযোগী বনি হাশিম এবং বনি আল-মুত্তালিব গোত্রের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলো। কুরাইশরা মুসলমানদের উপর বিরামহীনভাবে নির্যাতন চালাতে লাগলো। যে শেয়াব আবি তালিব উপত্যাকায় মুসলমানরা আশ্রয় নিয়েছিল সেখানে যাতে কোন সহৃদয় মক্কাবাসী খাদ্যসামগ্রী পাঠাতে না পারে সেজন্য পাহাড়ের উভয় পাশে পাহারার ব্যবস্থা করা হলো। আবু জেহেল নিজে অবরুদ্ধ মুসলমানদের উপর কড়া নজর রাখলো। একদিন পাহারার সময় তার সঙ্গে হাকিম বিন হিযাম বিন খালিদ বিন আসাদের দেখা হলো। আবু জেহেল দেখলেন তার সঙ্গে দু’জন ক্রীতদাস মহানবীর স্ত্রী খাদিজার[১] (খালিদের কন্যা এবং হাকিম বিন হিযাম বিন খালিদের ফুফু) জন্য কিছু বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি তক্ষুণি তাকে থামালেন এবং খাদ্যগুলি কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করলেন।
[১.খাদিজা বিনতে খালিদ বিন আসাদ বিন আবদাল উজ্জা আল কুরাইশিয়া ছিলেন মহানবীর প্রথমা স্ত্রী। বিয়ের সময় তাঁর বয়স ছিল মহানবীর চেয়ে পনেরো বছর বেশী। তাঁর পিতা ফুজারের যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন। তাঁর প্রথম স্বামী ছিলেন আবি হালা বিন যারারা আল তামিমি। তিনি ছিলেন একজন ধনাঢ্য মহিলা এবং বড় ব্যবসায়ী যিনি সিরিয়ার সঙ্গে বানিজ্যে অংশদারিত্বের ভিত্তিতে পরিশ্রমী কর্মী নিয়োগ করতেন। এভাবে সিরিয়াতে তাঁর মালামাল বিক্রির জন্য মহানবীর সঙ্গে তাঁর নবুয়তের আগেই একটি চুক্তি সম্পাদন করেন। মুহাম্মদ (সঃ) ব্যবসায় উপলক্ষ্যে অন্যান্য যাত্রীদের সঙ্গে সিরিয়ার বসরা বাজারে যেতেন এবং প্রচুর মুনাফা নিয়ে খাদিজার কাছে ফিরে আসতেন। তখন মুহাম্মদের (সঃ) বয়স ছিল ২৫। এ সময় বিবি খাদিজা তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন তিনি তাতে সম্মত হন। খাদিজা তখন বিষয়টি তাঁর চাচাকে (আমার বিন আসাদ বিন আব্দাল উজ্জা) জানালে তিনি খুব খুশী হন। এভাবে নবীজির নবুয়তপ্রাপ্তির পূর্বেই তাঁদের বিয়ে হয় এবং তাঁদের ঘরে দুই পুত্র আল-কাসিম (যাঁর নামানুসারে নবীজির ডাক নাম আবুল কাসিম) এবং আব্দুল্লাহ (সুন্দর ও বিশুদ্ধ), এবং চার কন্যা যয়নব, রুকাইয়া, উম্মে কুলসুম ও ফাতিমার (সবার উপর শান্তি বর্ষিত হোক) জন্ম হয়। মুহাম্মদের (সঃ) নবুয়ত প্রাপ্তির পর খাদিজাই সর্ব প্রথম নতুন ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত আদর্শ একজন স্ত্রী। মক্কার রাস্তাঘাটে যখন মহানবীকে নির্দয়ভাবে অত্যাচার ও নির্যাতন করা হতো তখন খাদিজার আচরণ এবং সহানুভূতিশীল হৃদয়ই ছিল নবীজির জন্য সবচেয়ে বড় সান্ত্বনা। খাদিজা হিযরতের তিন বছর পূর্বে ৬৪ বছর বয়সে মক্কায় মৃত্যুবরণ করেন।]
তিন বছর চলে অবরোধ
বনি হাশিম এবং বনি আল-মুত্তালিব গোত্রের উপর কুরাইশদের অবরোধ পুরো তিন বছর চলেছিল এবং এই সময় মুসলমানদের দুঃখ-কষ্টের শেষ ছিল না। তাদেরকে অন্য লোকের সঙ্গে মিশতে দেয়া হত না। তাদেরকে সামাজিকভাবে পুরোপুরি বর্জন করা হয়েছিল।
কুরাইশদের উদ্দেশ্য ছিল উক্ত গোত্র দু’টি মুহাম্মদ (সঃ) কে পরিত্যাগ করবে এবং তাঁর বিদ্রোহী বাণী মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবে।
কিন্তু তাদের এই নিষ্ঠুরতা নবীজিকে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস থেকে একচুলও নড়াতে পারেনি। বরং তাদের প্রত্যাশাকে ধুলিস্মাৎ করে দিয়ে মুসলমানরা আরো ঘনিষ্ঠভাবে নবীজির পাশে দাঁড়ায়। এমন কি তাঁর পরিবারের অমুসলিম সদস্যরাও তাঁকে দৃঢ়ভাবে রক্ষা করে।
মহানবী (সঃ) তাঁর অনুসারী এবং সাহায্যকারীদের উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা এবং সামাজিক বর্জন ইসলামের অব্যাহত বিস্তৃতি ও অগ্রগতিকে মোটেই রোধ করতে পারেনি। বরং ইসলামের অনুসারীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়তেই থাকে এবং মক্কার বাইরের গোত্রগুলির মধ্যেও এর বিস্তৃতি ছড়িয়ে পড়ে। ইসলামের বাণী সমগ্র আরব ভূমিতে বিস্তার লাভ করে। ইসলাম সম্পর্কে এবং আল্লাহ্ প্রেরিত মহাপুরুষ সম্পর্কে আরো কিছু জানার জন্য বহু লোক মক্কায় চলে আসে এবং ইসলামের বাণীতে মুগ্ধ হয়ে অধিকাংশ মানুষই তাৎক্ষণিকভাবে ধর্মান্তরিত হয়ে যায়।
নিষ্ঠুর নিষেধাজ্ঞার অবসান
কুরাইশদের অমানুষিক অত্যাচার ও নির্যাতনের মুখে মহানবী (সঃ) তাঁর অনুসারীবৃন্দ এবং তাঁর অবিশ্বাসী আত্মীয়-স্বজন-সবাই অটল ও অবিচল ছিলেন। পৌত্তলিক মক্কাবাসীদের মধ্যে কিছু কিছু সহৃদয় ও সাহসী ছিল যারা অবরুদ্ধ মুসলমানদের কাছে পাহাড়ের উপত্যকায় খাবার পাঠাত।
মক্কী নেতৃবৃন্দের নির্যাতন, নিষ্ঠুরতা এবং হৃদয়হীনতা যখন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায় তখন মক্কার কিছু সংখ্যক বিবেকবান ব্যক্তি এর বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। তারা গোপনে বৈঠক করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে তাদেরই লোকদের একটা অংশের প্রতি এহেন নির্যাতন করা ঘোরতর অন্যায়। তারা চুক্তিবদ্ধ হয় যে, যে কোন উপায়েই হোক ঐসব নির্যাতিত লোকদের উপর থেকে নিষ্ঠুর আর্থ-সামাজিক অবরোধ তুলে দেয়া হবে। এই উদ্দেশ্যে তারা কাবাঘরে রক্ষিত অবরোধের চুক্তিনামা দখল করে তা ছিড়ে ফেলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
পাঁচজন মহৎ ব্যক্তি
যে সব মহৎ-হৃদয় ব্যক্তি অবরোধ তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং অবশেষে তাদের মহৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সফল হন তারা ছিলেন :
১. হিশাম বিন আমর বিন রাবিয়াহ আল-আমরী;[১]
২. যুবাইর বিন আবি উমাইয়া বিনআল মাগিরা আল-মাখজুমী;[২]
৩. আল-মুতিম বিন আদি বিন নওফল বিন আব্দ মানাফ;[৩]
৪. আল-বখতারি বিন হিসাম;[৪]
৫.যামা বিন আল-আসওয়াদ বিন আল-মুত্তালিব আল-আসাদী।[৫]
[১. এই মহান ব্যক্তি পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করে একজন খাঁটি মুসলমানের জীবন যাপন করেন। হুনাইনের যুদ্ধে লুণ্ঠিত মাল থেকে মহানবী তাকে ১৫টি উট দান করেন।
২. ইনি ছিলেন মহানবীর স্ত্রী উম্মে সালমার ভাই যিনি মক্কা বিজয়ের পর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।
৩. ইবনে হাজরের আল-ইসাবায় বর্ণিত রিপোর্ট অনুসারে এই ব্যক্তি ইসলামের প্রতি বিশ্বাস না এনেই মৃত্যু বরণ করেন।
৪. এই ব্যক্তি বদরের যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন, যদিও অবরোধ অবসানের ক্ষেত্রে তার মূল্যবান ভূমিকার কথা স্মরণ করে মহানবী তাকে হত্যা না করার জন্য মুসলমান সৈন্যদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি যখন লড়াই ছাড়া অন্য সব বিকল্প গ্রহণে অস্বীকার করেন তখন আল-মাজার বিন জিয়াদ আল-বলভি তাকে তরবারির আঘাতে হত্যা করেন।
৫. এই বহু-ঈশ্বরবাদী ব্যক্তি বদরের যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন। ইনি তার পিতার অত্যন্ত প্রিয় পুত্ৰ ছিলেন।]
এই পাঁচ জন মহৎ ব্যক্তি মক্কার উচ্চাঞ্চলের আল-হাজুনে রাতে গোপন বৈঠকে মিলিত হয়ে মুসলমানদের উপর নির্যাতন বন্ধের সিদ্ধান্ত নেন। এ ব্যাপারে তারা একটা বিস্তারিত কর্মসূচীও গ্রহণ করেন। পরিকল্পনা অনুসারে সিদ্ধান্ত হয়। যে, যুহাইর বিন আবি উমাইয়া কাবায় কুরাইশদের দরবারে যোগ দেবেন এবং বনি হাশিম এবং বনি আল-মুত্তালেবের উপর আরোপিত আর্থ-সামাজিক অবরোধ সম্পর্কে অসন্তোষ প্রকাশ করবেন এবং কুরাইশদেরকে এই অবরোধ বাতিলের দাবী জানাবেন। তারা এটাও সিদ্ধান্ত নেন যে মক্কী নেতৃবৃন্দের মধ্যে কেউ যদি তার বিরোধিতা করেন তাহলে অবরোধ পরিকল্পনা বাতিলের দাবীতে বাকী চারজন তার সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হবেন।
রাতের একটি সিদ্ধান্ত
পরদিন ভোরে পাঁচজনের সবাই কাবার সভাস্থলে চলে গেলেন। যুহাইর বিন আবি উমাইয়া সাত বার পবিত্র কাবাঘর প্রদক্ষিণ করে কুরাইশদের সভার দিকে ফিরে ঘোষণা করলেনঃ “হে মক্কাবাসী, আমি খাবার খাচ্ছি এবং কাপড় পরছি কিন্ত বনু হাশিমের লোকেরা উপবাস করছে; তারা কোনকিছু কিনতেও পারছেনা, বেচতেও পারছে না। যতক্ষণ বর্জনের এই নিষ্ঠুর দলিল ছিঁড়ে ফেলতে না পারি ততক্ষণ আমি অলস হয়ে বসে থাকবো না।”[১]
[১. সিরাত ইবনে হিশাম, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৭৬]
একথা শুনে আবু জেহেল ক্ষিপ্ত হয়ে যুহাইর বিন আবি উমাইয়াকে চীৎকার করে বললেন, “আপনি একটা মিথ্যাবাদী। আপনি অবশ্যই এই দলিল ছিঁড়বেন না।” তখন পূর্বের সিদ্ধান্ত মোতাবেক যা’মা বিন আল-আসওয়াদ আবু জেহেলকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “ আপনি নিশ্চয়ই আরো বড় মিথ্যাবাদী। দলিলের কথাগুলি যখন লেখা হয় তখন আমরা তাতে সম্মতি দেইনি” যা’মাকে সমর্থন করে আবুল বখতরী বিন হিশাম বললেন, “যা’মা ঠিকই বলেছেন। আপনারা যা লিখেছিলেন তাতে আমাদের কখনোই সম্মতি ছিল না।” এরপর আল-মুতাম বিন আদি তার সাথীদের সমর্থন করে বললেন, “আপনাদের দু’জনের কথাই ঠিক। যে অন্যরকম কিছু বলে সেই অবশ্যই মিথ্যাবাদী। দলিলে যা কিছু লেখা আছে আমরা ঈশ্বরের সামনে তা থেকে নিজেদেরকে মুক্ত ঘোষণা করছি। আমরা এই চুক্তির সঙ্গে জড়িত নই।”
চুক্তিনামা বিনষ্ট : বর্জন নীতি ব্যর্থ
এতক্ষণে আবু জেহেল বুঝতে পারলেন যে সমস্ত ব্যাপারটি ছিল পূর্ব-পরিকল্পিত। তিনি বিখ্যাত মন্তব্য করলেন, “এটি একটি ষড়যন্ত্র যা করা হয়েছিল রাতের অন্ধকারে।” তিনি আরো বুঝতে পারলেন যে বর্জনের চুক্তিমানা বাতিল করা থেকে এই পাঁচজন নেতাকে বিরত করা অত্যন্ত কঠিন এবং তা করতে গেলে আরো বেশী জটিলতার সৃষ্টি হবে এবং গোটা ব্যাপারটি তখন গৃহযুদ্ধের মোড় নিতে পারে। একথা ভেবে তিনি সেখান থেকে উঠে গিয়ে চুপ করে থাকলেন। তখন আল-মুতাম বিন আদি চুক্তিনামাটি নিয়ে ছিঁড়ে ফেলার জন্য এগিয়ে আসলেন এবং অমানবিক বর্জন-নীতির অবসান ঘটাতে চাইলেন। কিন্ত তিনি দেখলেন যে শুধুমাত্র সূচনার “তোমার নামে, হে ঈশ্বর” শব্দগুলি ছাড়া চুক্তিনামাটির সম্পূর্ণটাই সাদা পিঁপড়ায় খেয়ে ফেলেছে। এই চুক্তিনামা বিনষ্ট করে কাবাঘর থেকে সরিয়ে ফেলে বনু হাশিম পরিবারের উপর কুরাইশদের আরোপিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা এবং সামাজিক বর্জনের অবসান ঘটানো হলো।
এভাবেই বনি হাশিম এবং আল-মুত্তালিব গোত্রের মুসলমানরা এবং তাদের অ-বিশ্বাসী সমর্থকবৃন্দ তাদের কঠোর পরীক্ষায় বিজয়ী হয়ে বেরিয়ে আসে। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হলে সবাই তারা মক্কায় ফিরে আসে। আবার তারা স্বাধীনভাবে ব্যবসায়িক লেনদেন শুরু করে। ইসলাম নতুন শক্তি সঞ্চয় করে এবং এর প্রভাব চারিদিকে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আর এভাবেই সত্যের পথ থেকে মুসলমানদেরকে সরানোর লক্ষ্যে তাদের উপর কুরাইশদের আরোপিত দমন ও ভীতি প্রদর্শনের নীতি সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়।