প্রথম অধ্যায়
পুস্তকের প্রথম খণ্ডে বর্ণিত হয়েছে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষাংশ পর্যন্ত পুলিশী সংগঠনের ইতিবৃত্ত। এই খণ্ডে বর্ণিত হবে বিংশ শতাব্দীর সুরু থেকে পুলিশী ব্যবস্থার কাহিনী। কিন্তু—এ-দুয়ের মধ্যবর্তীকালে শহর-সমূহে পুলিশী ব্যবস্থা অক্ষুণ্ণ থাকলেও গ্রামাঞ্চলগুলি কিছুকাল ব্রিটিশ পুলিশের প্রভাব-মুক্ত ছিল।
ক্লাইভ বাংলার জমিদার শাসকদের সেনাবাহিনীর অবলুপ্তি ঘটান। লর্ড হেস্টিংস সাহেব তাঁদের বিচার-ব্যবস্থা বিলুপ্ত করেন। কর্ণওয়ালিশ অতঃপর রদ করলেন বাংলার জাতীয় পুলিশ। কিন্তু তার জায়গায় জমিনদারী পুলিশের মতো গ্রাম-ভিত্তিক কোন পুলিশী ব্যবস্থা থাকে নি। ফলে বহুকাল গ্রামাঞ্চলে ব্রিটিশ পুলিশের কোন প্রভাব ছিল না। সুসংগঠিত জমিনদারী পুলিশের মতো গ্রাম রক্ষার কোন ব্যবস্থা করা হয় নি। অন্য দিকে সূর্যাস্ত-আইনের দৌলতে প্রাচীন জমিদার বংশগুলি মৃতপ্রায় হয়েছে। তদস্থলে শহরাগত ব্যবসায়ী জমিনদাররা গ্রাম সম্পর্কে নিস্পৃহ। এতে মধ্যবর্তীকালে গ্রামাঞ্চলে বর্ধিষ্ণু পরিবারগুলির নেতৃত্বে একপ্রকার রক্ষণব্যবস্থা গড়ে ওঠে। সেই সঙ্গে শিক্ষা, পূর্তকার্য প্রভৃতি জনহিতকর কাজ গ্রামের লোক নিজেরা করেছে।
এই পরিচ্ছেদের বর্ণনীয় বিষয় মধ্যবর্তীকালে গ্রামের পুলিশ-বিহীন অবস্থার নিখুঁত ঘটনাবলী। রাষ্ট্রিয় ব্যবস্থার অদল-বদলে গ্রামীণ সমাজে কিছু বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়। এর অন্যতম কারণ শহরমুখী হয়ে শিক্ষিত ধনীদের দলে দলে গ্রাম পরিত্যাগ। জনগণের ক্ষমতার অতিরিক্ত ক্ষমতা পুলিশের নেই। একমাত্র অসাধু পুলিশ-কর্মীরাই অতিরিক্ত ক্ষমতা দাবী করে। জনগণের করণীয় কার্যই পুলিশ সম্পন্ন করে থাকে। জনসাধারণের কর্মব্যস্ততা ও সময়াভাবের জন্য একটি বেতনভুক গোষ্ঠীকে উর্দিভূষিত করে পুলিশী দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এর জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষাদিও তাদের দেওয়া হয়ে থাকে। [অবশ্য মানব-মনে ‘বিবেক’ই প্রথম পুলিশের কাজ করে।] গৃহতল্লাসী প্রভৃতি কয়েকটি দ্বায়িত্ব ছাড়া পুলিশের সকল ক্ষমতাই জনগণের আছে। কোন অপরাধ সম্মুখে ঘটলে রক্ষীদের মতো জনগণও অপরাধীকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম। আদালতের করণীয় কার্য স্বহস্তে গ্রহণ করলে জনগণের মতো পুলিশকেও দণ্ড পেতে হয়। ধৃত অপরাধীকে তৎক্ষণাৎ থানায় পাঠাতে হয়। কিন্তু, পুলিশ প্রয়োজনবোধে অপরাধীকে ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত নিজেদের হেফাজতে রাখতে পারে।
পুলিশ স্বীয় দায়িত্ব পালনে অবহেলা করলে জনগণ প্রাইভেট পুলিশ সৃষ্টি করতে বাধ্য হয়। কারণ, পৃথিবীতে ভ্যাকুয়াম বা শূন্যস্থান বলে কিছু নেই। পুলিশ নিষ্ক্রিয় হ’লে এরূপ-ঘটনা বারে বারে ঘটেছে। যথার্থ শিক্ষার অভাবে এ-সব ক্ষেত্রে জনগণের বহু ভুলভ্রান্তি হয়ে থাকে এবং কখনো কখনো এতে সমাজ-বিরোধীদের অনুপ্রবেশ হয়েছে।
বাঙালীর জাতীয় পুলিশের বিলুপ্তি ঘটালেও ব্রিটিশ রাজশক্তি গ্রামাঞ্চলে অনুরূপ দক্ষ পুলিশ তৈরী করতে পারে নি। জমিনদারী থানাগুলির এলাকা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিল। চৌকিদার, দফাদার, ঘাটীয়াল এবং থানার নায়ক নায়েব ও পাইকদের দ্বারা গ্রামগুলি পরিবেষ্টিত থাকতো। ফলে ওদের অভাবে গ্রামের মানুষ স্বীয় সমাজ-ব্যবস্থা ও মানসিকতার আমূল পরিবর্তন ঘটায়। তাতে গ্রামবাসীরা নিরাপত্তার ব্যাপারে রাষ্ট্রিয় পুলিশের সহায়তার কিছুমাত্র প্রয়োজন অনুভব করে নি। উহার প্রমাণ স্বরূপ আমার শৈশব-স্মৃতি থেকে একটি ঘটনার উল্লেখ করছি। “মাতুলালয় থেকে পিতৃগৃহে ফিরছি। তিরিশ মাইল পথ গরুর গাড়িতে করে যেতে হবে। গাড়িতে বসে আছি মার কোল ঘেঁষে। দিদিমা গরুর গাড়ির পিছন পিছন হাঁটছেন। গ্রামের সীমান্তে এসে থম্কে দাঁড়ালেন তিনি। চলমান গাড়ির ফোকরে দিদিমার মুখাবয়ব ক্রমশঃ ক্ষুদ্র হতে ক্ষুদ্রতর হতে থাকে। তারপর এক সময় পথের বাঁকে অদৃশ্য হলেন তিনি। আমি ‘দিদিমা-গো’ বলে মার কোলে মুখ লুকোলাম। উঁচু-নিচু কর্দমাক্ত মেটে রাস্তায় তখন গরুর গাড়ি ওঠানামা করছে। গাড়োয়ান এজাহার আলি সন্ধ্যার আগে আমাদের বাড়ি পৌঁছবে। পথে চোর-ডাকাত আর ঠেঙাড়ের ভয়। গাড়ির সামনে দেনালী ও মমতাজ মিঞা। আর দুপাশে লম্বা লাল লাঠি হাতে মহীন্দ্র বাগ্দী ও ফকির দুলে। ভাবতে বেশ অবাক্ লাগে বাড়ির লোকেদের মুশ্লিম প্রজাদের প্রতি কি অগাধ বিশ্বাস ছিল। সালঙ্কারা বধূদের রক্ষার ভার সেই কালে ওদের ওপরই নিশ্চিতে দেওয়া যেত।
[বিঃ দ্রঃ—সামাজিক প্রথানুসারে তৎকালে বধূরা প্রতিবৎসর কিছু কালের জন্য পিত্রালয়ে বাস করতেন। মাঝে মাঝে স্বামী-স্ত্রীর পৃথকভাবে থাকার বৈজ্ঞানিক প্রয়োজনীয়তা সমাজ-কর্তৃক স্বীকৃত ছিল। তাই আমাকেও কিছুকাল মার সঙ্গে মাতুলালয়ে থাকতে হতো। ঐ সময় পিতৃগৃহে বাঙালী বধূরা তাঁদের পুরো স্বাধীনতা ফিরে পেতেন।]
বেলা দ্বিপ্রহরে দুইটি বলবান বলদ গাড়ি নিয়ে মাঠের পথে চলেছে। হঠাৎ একদল ঝাঁকড়াচুলো লোক পথ আগ্লে বলে উঠলো—‘কেডা যায় রে!’ মা সভয়ে অস্ফুট কণ্ঠে তখন আমাকে বললেন, ‘খোকা, ওরা বোধহয় ডাকাত।’ মার গায়ে মূল্যবান জহরত ও স্বর্ণালঙ্কার। গাড়োয়ান এজাহার আলি গাড়ির বিচুলির গদির তলা থেকে একটা ধারালো কাতান বের করল। দেনালী মিঞা তখন ওদের সকলের নেতা। সে গাড়ির ছই’এর ভেতর মুখ বাড়িয়ে সে মাকে বললে,: ‘মা, এখানে আমরা চার ভাই। দেনালী, মমতাজ, মহীন্দ্র ও ফকির। তোমার এই চার বেটা জান কবুল করবে। তবে আগে জিজ্ঞেস করি, ওরা কোন্ দলের। এজাহার আলি রইল আমাদের পাহারায়।’ অন্য পক্ষ ওদিকে হুঙ্কার দিয়ে উঠল। দুই পক্ষ তখন পরস্পরের মুখোমুখি। জাত জমিদারের রক্ত আমার ধমনীতে। আমি যুদ্ধ দেখবার জন্য উদ্গ্রীব হলাম। ওদের মধ্যে কি কথা হ’ল শুনতে পেলাম না। একটু পরে সামনে ঝাঁকড়াচুলো কপালে সিঁদুর লোকটা এগিয়ে এসে নত হয়ে মাকে বললো, ‘মা, ভয় নেই, আমরা তোমাদেরই প্রজা।’ সে মার পায়ে একটা রৌপ্যমুদ্রা রেখে প্রণাম করল। ডাকাতগুলোর ওপর খুব রাগ হচ্ছিল আমার। মাঝখান থেকে আমার যুদ্ধটা দেখা হ’ল না।
[আশ্চর্য,—সেই মেটে পথ এখন বাস-চলা পিচের রাস্তা। দুধারে ইলেকট্রিক পোস্ট। মাঝে মাঝে টিউব ওয়েল। কৃষকদের পর্ণকুটিরের বদলে সর্বত্র টিনের ছাউনি।] রাত আটটায় আমরা পিতৃগৃহে পৌঁছলাম। কালী পুজোর অমা রাত্রি। সব মহল আলো ঝল্মল্। ঘরে ঘরে ঝাড়লণ্ঠন। দেয়ালে দেয়ালে দেয়াল-গিরি বাতি। সুউচ্চ ঠাকুর দালানে সুবিশাল মৃন্ময়ী নীলবর্ণের কালীমূর্তি। ওদিকে আমি মাতৃক্রোড়চ্যুত হয়ে ক্রোড় থেকে ক্রোড়ান্তরে ঝাঁপিয়ে পড়ছি। ততক্ষণে সেই নতুন পরিবেশে আমি দিদিমার কথা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছি।
[বিঃ দ্রঃ—জমিনদারী পুলিশের আমলে ঐ সব সংযোগ রক্ষাকারী রাজপথগুলি ঘাটিয়ালি পুলিশের রক্ষণাধীনে ছিল। ১ম খণ্ড দ্রঃ। তারা ঘাঁটিতে ঘাঁটিতে থেকে ঐ সমস্ত পথে টহল দিত। লর্ড কর্ণওয়ালিস জমিনদারী পুলিশ রাষ্ট্রায়ত্ত করে ঘাটিয়ালি পুলিশ ও থানাদারী পুলিশ বাতিল করেন। কিন্তু ব্রিটিশ থানাদারী বা অন্য পুলিশ দিয়ে ওগুলির কোন রক্ষণ ব্যবস্থা করা হয় নি।]
সমস্ত ঘটনা অবগত হয়ে অশীতিপর পিতামহী দেনালী মিঞাকে ডাকলেন ও কাছে বসালেন। তাদের মুড়ি-গুড় ও মিঠাই খেতে দিয়ে হুকুম দিলেন, ওদের প্রত্যেককে যেন গোলা থেকে চার মন করে ধান দেওয়া হয়। তারপর উনি ওদের একজনকে ডেকে বললেন, ‘বটে, ওটা গোপীনাথের দল! গোপীনাথকে কাল ডেকে আনবি। ওকে আমি নিজে ধম্কে দেব।’
আশ্চর্যের বিষয়, এতো বড়ো একটা ঘটনা জিলা হাকিম বা পুলিশকে কেউ জানাবার প্রয়োজনে মনে করলো না। অন্তঃপুরচারিণী পিতামহী বাড়িতে বসেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন।
[তৎকালীন গভর্ণমেন্ট পুলিশের মতো প্রাইভেট পুলিশদেরও পুরস্কার ও তিরস্কারের ব্যবস্থা ছিল। আশ্চর্যের ব্যাপার, পিতামহীর মতো অতি বৃদ্ধাও এই কার্যে সুদক্ষা ছিলেন। গভর্ণমেন্ট ও প্রাইভেট পুলিশের কার্যধারা প্রায় একই প্রকারের ছিল। তার ওপর প্রাইভেট পুলিশের এলাকা সম্পর্কিত কোন বাছবিচার না থাকায় পরস্পরের মধ্যে সহযোগিতা ছিল। জনগণের যে-কোনও অংশ প্রয়োজনে প্রাইভেট পুলিশের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে।
আন্তঃজিলা ও আন্তঃপ্রদেশ সড়কগুলি পূর্বে বিভিন্ন জামিনদারী পুলিশ পরস্পরের সহযোগিতায় রক্ষা করতো। জমিনদারী পুলিশ বাতিল হওয়ার পর ঐগুলি রক্ষার ভার কারও ওপর ন্যস্ত হয় নি। ফলে তীর্থযাত্রী ও বণিকদের পক্ষে ঐ পথ বিপদসংকুল হয়ে ওঠে। ঐ সময় তীর্থযাত্রীরা যাত্রার পূর্বে উইল করে পথে বেরুতেন। শুনেছি, পিতামহী একবার তীর্থে বেরুলে বাড়িতে কান্নাকাটি পড়ে যায়। উনি তাঁর যাবতীয় অলংকার বধূদের মধ্যে ভাগ করে দেন। ভবিষ্যৎ শরিকী বিবাদ এড়াতে পুত্রদের মধ্যে বিষয়-সম্পত্তি ভাগ করে দেওয়া হোল। সেকালে তীর্থে গেলে লোকে প্রায়ই জীবিতাবস্থায় ফিরে আসত না। কিন্তু পিতামহী সুস্থ শরীরেই গ্রামে ফিরে এসেছিলেন। তাঁর দুজন বলিষ্ঠ লাঠিয়াল প্রজা তাঁর নিরাপত্তার জন্য তাঁর সাথে নিযুক্ত ছিল। যারা রক্ষা করে তাদেরই রক্ষী তথা পুলিশ বলা হতো। কিছুক্ষণ একটা কক্ষে একটা পালঙ্কে ঘুমিয়েছিলাম আমি। হঠাৎ বাজনার তীব্র শব্দে ঘুম ভাঙল। অন্যদের সঙ্গে ছুটে গেলাম ঠাকুর দালানে। একটু পরেই বলিদান হবে প্রশস্ত প্রাঙ্গণে। বিশাল যূপকাষ্ঠের চতুস্পার্শ্বে মশালের উজ্জ্বল আলো। চতুর্দিকে অপেক্ষমাণ ভগবত বিশ্বাস জনতা। একটা মহিষ-শিশুকে টানতে টানতে সেখানে আনা হোল। কিছুতে বাগ মানানো যাচ্ছে না পশুটাকে। দুবার দড়ি ছিঁড়ে পালাল—দুবারই তাকে ধরে আনা হোল। শেষ পর্যন্ত বাঁশ দিয়ে ওর ধড় চেপে গলাটা রাখা হোল যূপকাষ্ঠে। আমি মশালের আলোয় স্পষ্টই দেখতে পেলাম নির্বাক ঐ মহিষ-শিশুর চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। আমার খুব রাগ হচ্ছিল। মা-কালী খাঁড়া নিয়ে ওদেরকে তাড়া করছেন না কেন! ঠাকুর দালানের উঁচু রোয়াকে দাঁড়িয়ে সবাই তারস্বরে মা-মা ডাকছে। সেই প্রার্থনার উদ্দেশ্য যাতে বলিদানে কোন বাধা না পড়ে। হঠাৎ জল্লাদের খাঁড়া জল্ জল্ করে ওপরে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে আমিও মেঝেতে পড়ে জ্ঞান হারালাম।
তখন আর মাতৃপূজার দিকে কারও মন রইল না। আমি বাড়ির জ্যেষ্ঠ পৌত্র। সকলেই ব্যস্ত হয়ে পড়ল আমাকে নিয়ে। ঠাকুমার হুকুমে পর বৎসর থেকে মহিষবলি বন্ধ। এরপর থেকে ঠাকুমা অন্দরমহলে ঠাকুর ঘরে নিরামিষাশী দেবতা নারায়ণের সেবাতে মন দিলেন।
[কিন্তু—ঐ কালী পূজার বলি বন্ধ কারও পছন্দ নয়। পারিবারিক পূজায় গ্রামের আবাল-বৃদ্ধবনিতা ও বাইরের গ্রামের বহু ব্যক্তিও সংশ্লিষ্ট ছিলেন। কিন্তু গণবিক্ষোভ দমনে ব্রিটিশ পুলিশ ডাকা হয় নি। ঠাকুমা নিজেই ওদের ধম্কে ও বুঝিয়ে সংযত করলেন।]
শহরে হলে এইরূপ অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রীয় পুলিশের পাহারা থাকতো। কিন্তু গ্রামে প্রত্যেকেই প্রত্যেকের পুলিশ হওয়াতে তার কোন প্রয়োজন ছিল না। তখনো গ্রামে সমঝোতাবোধ, আনুগত্য ও লোকবলের অভাব মনে হয় নি। আমাদের বিপুলায়তন গৃহের চারপাশে দৌহিত্র সন্তান ও পুরোহিত বংশের বসবাস। গ্রামের সীমানা বরাবর অসংখ্য কৃষক ও লড়াকু প্রজাদের বসতি। সমগ্র গ্রামটাই যেন একটা দুর্ভেদ্য দুর্গ। এক ডাকে যৌথ পরিবারগুলি থেকে এবং প্রজাদের মধ্য থেকে বহুলোক বয়োবৃদ্ধদের আদেশ পালনে তৎপর হয়। সেখানে রাষ্ট্রীয় পুলিশের উপস্থিতি নিতান্তই নিষ্প্রয়োজন।
[লোকবলের জন্য তৎকালে প্রথা ছিল, জমিজমা সহ বাস গৃহ প্রদান করে কন্যা জামাতা নিকটে রাখা। গ্রামে আমাদের বহু প্রতিবেশী বংশ ঐভাবে প্রতিষ্ঠিত। ভগিনীপতি জনসঙ্ঘ নেতা হরিপদ ভারতী ঐ প্রথা পুনঃপ্রবর্তনের জন্য বলেন। কিন্তু আর্থিক সংগতির অভাবের সঙ্গে সেদিনকার মানসিকতা ও প্রয়োজনীয়তা আজ আর নেই।]
ঘোষাল বাড়িতে নৈকষ্য-কুলীন ব্রাহ্মণকন্যা চাই। পঞ্চমবর্ষীয়া কন্যা পিতামহীকে এক উভয় পক্ষীয় আত্মীয়ের মাধ্যমে ভুলিয়ে এনে পিতামহের সঙ্গে বিবাহ দেওয়া হোল। কন্যা পক্ষ দক্ষ লাঠিয়ালদের ভয়ে পিছিয়ে গেলেন। ইহা ছিল শক্তিধর্মীয় পাত্রের সহিত বৈষ্ণব ধর্মীয় বধূর আন্তর্ধর্মীয় বিবাহ। কিন্তু এজন্য পাদ্রিদের মাধ্যমে ইংরাজ হাকিমের নিকট ওঁরা দরবার করে নি। শেষ পর্যন্ত উভয়পক্ষ ব্যাপারটা মিটমাট করে নিলেন। কিন্তু ঠাকুমা এজন্য কখনো অপমান বোধ করেন নি। সেই ঠাকুমা এখন এ-বাড়ির মতো সমগ্র গ্রামের মহা কর্ত্রী। আমাকে সঙ্গে নিয়ে উনি প্রজাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খবরাখবর নিতেন। একদিন শুনলাম, ঠাকুমা এক কৃষক বধূকে বলছেন,—‘হ্যাঁ রে বৌ, তোর সোয়ামী তোকে মারে? তা, তুই আমাকে তো বলিস্ নি।’ প্রত্যুত্তরে কৃষক বধূ সলজ্জভাবে বলেছিল,—‘তা, মারুক্ মা। না মারলে ও আমাকে ভালবাসে কিনা তা আমি বুঝবো কেমন করে!’ পারস্পরিক বিবাদে পুলিশ কিম্বা আদালতের শরণাপন্ন হওয়া তখনো অকল্পনীয়।
সমস্ত কাজকর্ম সমাধা করে ঠাকুমা সন্ধ্যেবেলা অন্দরমহলের উঁচু রোয়াকে আমাকে কোলে নিয়ে বসতেন। উঁচু দালানের লম্বা মাটির নলের ওপর দুটো ধব্ধবে সাদা পাখি। ও দুটো ঠাকুমার অতি আদরের লক্ষ্মী পেঁচা। এ-ছাড়া ঠাকুমার আরো দুটি প্রিয় প্রাণী ছিল। সে-দুটি বাস্তু সাপ। ওরা পুরুষানুক্রমে এখানে আছে। এ-বাড়ির কোন ক্ষতি করে না ওরা। জ্যোৎস্না রাতে কখনো কখনো ওদের দেখা যায়। কদাচিৎ বাড়ির উঠোনে ওদের শঙ্খ লাগে। ঊর্ধ্বফণী হয়ে ওরা পরস্পরকে আলিঙ্গন করে। সিঁদুরমাখানো চেলি ওদের দিকে ছোঁড়া হয়। ওগুলোর মধ্যে কিছুক্ষণ ক্রিড়া করে ওরা চলে গেলে ঐ চেলি পবিত্র দ্রব্যরূপে গৃহীত হতো।
পুরুষানুক্রমে মানুষের সঙ্গে একত্রে বাস করলে জন্তুরা হিউম্যান ইনস্টিংক্ট প্রাপ্ত হয়। তারা বোঝে যে এ-বাড়ির কেউ তাদের কিছু ক্ষতি করবে না। সর্পজীব আসলে ভীতু প্রাণী। ভয় পায় বলেই আত্মরক্ষার্থে ওরা ছোবল দেয়। এখানে তাদের কাউকে ভয় নেই। বৌদ্ধ মঠে পাখি মারা নিষেধ। তাই পাখিরা সেখানে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়ায়। এজন্যে মৃত্যুভয়ে ভীত বানররা পুরীর মন্দিরে আশ্রয় নেয়। এ’কারণে বন্য শূকররা পাকিস্থানে ও নীল গাই ভারতে বাসা নেয়।
ঠাকুমার একটা নিজস্ব পুরানো কাঠের সিন্দুক ছিল। তার ভেতরে সংগৃহীত ছিল কয়েক শতাব্দীর ঐতিহাসিক সামগ্রী। কবে পরিবারের কোন্ এক বধূ মৃত পতির চিতায় আত্মবিসর্জন করে সতী হন। তাঁর রক্তাভ পদচিহ্ন একটা পুরাতন তুলট কাগজের উপর আমি দেখেছি। শুভ কাজে যাত্রাকালে ওটা কপালে ঠেকানো হ’ত। ঐ সিন্দুকে ঠাকুমার প্রচুর মোহর ছিল। ঠাকুমা ওগুলো হাতছাড়া করতেন না কিছুতে। এ-বিষয়ে অনুযোগ করলে তিনি বলতেন,—‘পরে যদি তোরা আমাকে না দেখিস?’ ঠাকুমার ঐ কাঠের সিন্দুক থেকে প্রহরে প্রহরে কট্ কট্ করে শব্দ উঠতো। বাড়িতে অনেক ঘড়ি থাকা সত্ত্বেও ঠাকুমার ওর ওপরেই বিশ্বাস ছিল বেশী। পরে বুঝেছিলাম, তাপমাত্রার উত্থান-পতনে ঐ কাঠের সঙ্কোচন প্রসারণ হওয়াতে ঐরূপ শব্দ হোত।
[ঠাকুরমাতা তাঁর শ্বশ্রুমাতা ত্রিলোকীসুন্দরীর মুখে শোনা বাড়িতে ডাকাত পড়ার একটা পুরনো কাহিনীর বর্ণনা করেছিলেন। ঐ কাহিনী থেকে পুরানো দিনের জমিদারদের আত্মরক্ষা-ব্যবস্থা সম্বন্ধে কিছুটা অবহিত হওয়া যায়। একবার সংবাদ পাওয়া গেল, রাত দুটোয় ডাকাতরা ডাকাতি করতে আসবে। সেই কালে সূর্য ঘড়ি ছাড়া অন্য ঘড়ি সৃষ্ট হয় নি। ঠিক রাত দুটোর সময় ঐ সিন্দুকটা থেকে কট্ কট্ আওয়াজ উঠেছিল। ডাকাতরা জেনেছিল, এ-বাড়িতে অঢেল মোহর আছে। ইংরাজ রাজত্ব এদেশেতে বহুকাল স্থাপিত হয়েছে। আমাদের পুলিশ ও বিচার-ক্ষমতা ওরা কেড়ে নিলেও কিছু বরখাস্ত পাইক-বরকন্দাজ তখনো আমাদের অনুগত ছিল। এজন্য এখনো এ-বাড়ির দাপট কিছুমাত্র কমে নি। আমরা তখন চব্বিশ পরগণার ক্ষুদ্র জমিদার। ক্ষুদ্রদের দায়িত্ব কম হওয়াতে ক্ষমতা বেশী হয়।
একদিন একটা রক্ত বস্ত্র ও রুদ্রাক্ষের মালা পরিহিত ঝাঁকড়াচুলো লোক কর্তামশাই এর কাছে নত হয়ে ভূর্জপত্রে লেখা একটি পত্র দিল। ওদের চাহিদা সামান্য। বাংসরিক সিধা—‘বিশমন ধান, দুশো একান্নটি কড়ি এবং দুখানি আকবরী মোহর। প্রতি বছর কালী পুজোর রাতে তারা এসে তা নিয়ে যাবে। দূত অবধ্য হওয়াতে লোকটা ভর্ৎসিত হয়ে ডেরায় ফিরল।
কালী পূজার অমানিশা। রাত্রি দ্বিপ্রহর। নিশিপূজা সবে শেষ হয়েছে। হঠাৎ দেখা গেল অসংখ্য মশালের আলো। হারে-রে-রে শব্দ! তখন নিজস্ব পাইক-বরকন্দাজের দল আমাদের নেই। বহু পূর্বেই তারা বিদায় নিয়েছে। দ্বারিদের প্রধান অনুগত ডাকাত রঘু তখন দূর দেশে স্বকার্যে গেছে। অবশ্য বাড়ির তরুণরা তরবারি হস্তে যুদ্ধের জন্যে প্রাঙ্গণে প্রস্তুত। ওদিকে ঘোড় সওয়ার সদরে খবর দিতে গিয়েছে। বাড়ির চাপা সিঁড়িগুলির লোহার কপাট বন্ধ করে দেওয়া হোল। কুলনারীরা আত্মরক্ষার জন্য চোরা কুঠরিতে ঢুকলেন। বাধা দিল দেউড়ীর দ্বারবান’রা। ডাকাতরা ঢেঁকিকলের সাহায্যে দেউড়ীর দরজা ভাঙলো। কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের পর ওরা বাঁকা সিঁড়ির পথে উপরে উঠতে লাগল। বস্তা বস্তা সরষে ছিল সিঁড়ির চাতালের ওপর। বাড়ির গিন্নিরা সেগুলো সিঁড়ির ওপর ছড়িয়ে ছিলেন। ডাকাতরা অন্ধকারে পা পিছলে নিচে পড়তে লাগল।
বাড়ির চিলের ছাদের ওপর একটা মিনার ছিল। অন্তঃপুরিকারা ওখান থেকে দূরের গঙ্গা দেখত। কর্তামশাই ওখানে দাঁড়িয়ে শিঙে ফুঁকে দূরের প্রজাদের জানিয়ে দিলেন ডাকাত পড়ার খবর। হৈ-হৈ করে ছুটে এল বাগ্দী পাড়ার দুশো ঘর প্রজা স্ত্রী-পুরুষে বল্লম, লাঠি, আঁশবঁটি ও রাম দা হাতে। গৌরে বেদে ডাকাতের সেই প্রথম পরাজয়। স্ত্রী-পুরুষের সমবেত সাহসিকতা পূর্ণ প্রচেষ্টায় উহা সম্ভব হয়েছিল।
কিছু ডাকাতকে ওঁরা পিটিয়ে মাটির তলায় গুম করলেন। বাকি গুলোকে বশ্যতা স্বীকার করার পর পূর্বপুরুষদের খনন করা দীঘির বাকি কাজ সমাধার জন্য বেগার দেওয়া হোল। অপরাধীদের মেয়াদ না দিয়ে পুষ্করিণী ও বাঁধ তৈরীর কাজে নিয়োগ করা পুরানো প্রথা। অবাধ্যদের গুম্ করার জন্য ভূগর্ভে বহু কক্ষ আমি নিজেদের বাড়িতেও দেখেছি। তৎকালে ইংরাজ-নিযুক্ত উৎপীড়ক দারোগাদেরও গ্রামে গুম্ করা হয়েছে।
চার শ’ বছর পূর্বে তৈরী মাদরাল দীঘির মতো বড়ো দীঘি যুক্ত বাংলার প্রেসিডেন্সী ডিভিসানে আর একটিও নেই। এর চারদিকের পাড়গুলো দেড় তলার মতো উঁচু। প্রশস্ত বকচরের মধ্যবর্তী একশ বিঘার উপর জলাশয়। ওপারের মানুষকে এপার থেকে ছোট দেখায়।
আজ হতে চার শ’ বছর আগে কুলগুরু জমিদার শিষ্যকে জলকষ্ট নিবারণের জন্যে একটা সায়র তৈরীর নির্দেশ দিয়েছিলেন। প্রমাদ গুণে জমিদার রাজা তাঁকে বললেন, ঠাকুরমশাই, আপনি এক নিশ্বাসে যতদূর দৌড়বেন ঠিক তত দূর পর্যন্তই খোঁড়া হবে। ঐ বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ প্রাণপণে ভূমির শেষ প্রান্ত পর্যন্ত দৌড়ে জ্ঞানহারা হয়ে আর চোখ খুললেন না।
[এই বিশাল দীঘির পাড় ক’টি মাত্র আমার অধিকারে আছে। প্রশস্ত বক্চর পূর্বে জনগণের গোচারণ-ভূমি ছিল। গ্রামের লোক এ-থেকে যদৃচ্ছাক্রমে মৎস আহরণ করেছে। বালকেরা ওখানে সাঁতার কাটে ও নৌকো বাইতে শেখে।]
পাড়ের মধ্যস্থলে একশ দশ ফুট উচ্চ আমাদের প্রস্তর-নির্মিত মন্দির আছে। এই সর্বজনীন মন্দিরের বিগ্রহ সর্বশ্রেণীর ব্যক্তিকে স্পর্শ করতে দেওয়া হয়। পৃথক কোন পুরোহিতের ব্যবস্থা সেখানে নেই। বাঙলাদেশে বৃহদায়তন বহু মন্দির আছে। কিন্তু কারুকার্যখচিত এতো উঁচু মন্দির কোথাও নেই। মন্দির-সংলগ্ন আবাসিক উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের আমি প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ভট্টপল্লীর একটি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়েরও আমি প্রতিষ্ঠাতা। উপরন্তু এখনকার একমাত্র গ্রামীণ পার্কটিও আমার তৈরী। কৃষি বিদ্যালয়ের জন্যেও সেখানে প্রচুর জমি আমি আলাদা করেছি। ওখানকার দুটি প্রাইমারী বিদ্যালয়ও আমার প্রতিষ্ঠিত। এই নূতন অট্টালিকা ও পৈত্রিক বাড়ি-জমিজমা এই কাজে দান করেছি।
[বিঃ দ্রঃ—এখানকার আবাসিক উচ্চ বিদ্যালয়ে দুরন্ত বালকদের ভর্তি করা হয়। এদের জন্য আমার ‘ডাইভারসন্যাল’ চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। এদের বিপথগামী হওয়ার সকল সম্ভাবনাই এখানে বন্ধ করা হয়। অধিকন্তু অকৃতকার্য হওয়া ছাত্রদের এখানে প্রথমে ভর্তি করা হয়। কিন্তু আজও শেষ পরীক্ষাতে একজন ছাত্রও অকৃতকার্য হয় নি। এরা পালা করে নিজেদের পুলিশী কার্য নিজেরাই করে। এখানে আত্মজীবনী লেখা আমার উদ্দেশ্য নয়। জীবনী মৃত্যুর অন্ততঃ পঞ্চাশ বছর পরে লেখা সম্ভব। জীবনে এমন অনেক ঘটনা ঘটে যা প্রকাশ করা যায় না। তাই নিজেদের বিষয়ে কিছু না লেখাই আমি সমীচিন মনে করেছি।]
আমাদের পারিবারিক জীবনে এতোদিনে অধঃপতন সুরু হয়েছে। অবশিষ্ট জমিদারীগুলি একে একে বিক্রয় হয়ে গিয়েছে। কয়েকজন শরিকী তরুণের স্থির বিশ্বাস, তাদের অধিকারভুক্ত অংশে গুপ্তধন পোতা আছে। রাত্রে মাটি খুঁড়ে তারা দুই জালা গুপ্তধন পেল। কিন্তু সেগুলো মূল্যহীন অচল কড়িতে ভর্তি। এখন গোপনে তাড়াতাড়ি ঐ গর্ত বুজিয়ে ফেলতে হবে। তাদের অধিকারভুক্ত এলাকায় রক্ষিত ছিল বহু সংস্কৃত ও পার্শী গ্রন্থ। ওর মধ্যে ছিল পূর্বপুরুষ রাধকান্ত ঘোষাল প্রণীত চার’শ বছরের পুরানো কয়েকটি পাঁচালি কাব্য। সেগুলি তারা তাড়াতাড়ি ঐ গর্তে ফেলে মাটি চাপা দিল। মাটি চাপা পড়লেও ঐ ঘটনাটি চাপা থাকে নি।
নৈহাটী থেকে ছুটে এলেন সেই দিনের তরুণ কুটুম্ব হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। উনি কয়েকটা নক্সাকাটা কাঠের মলাট মাত্র উদ্ধার করতে সক্ষম হন। স্থানত্যাগ কালে উনি বাটীর তরুণদের বলে গেলেন: বাবাজীবনরা! তোমাদের ঊর্ধ্বতন সপ্ত পুরুষ পণ্ডিত ছিলেন। কিন্তু অধস্তন সপ্ত পুরুষের শিক্ষাদীক্ষা সম্বন্ধে আমার সন্দেহ রইল। এলেন প্রমথনাথ তর্কভূষণপঞ্চানন তর্করত্ন ও কুলগুরু কমলকৃষ্ণস্মৃতিতীর্থ। ওঁরা সব শুনলেন, দেখলেন, বুঝলেন ও আশীর্বাদ করে চলে গেলেন।
সেই মহাপণ্ডিত ব্রাহ্মণদের বাক্য আংশিক সত্য হয়েছিল। আমরা দুই ভাই ও এক বোন ডক্টরেট। অন্য ভগিনীরা ও এক ভ্রাতা এম, এ, বি-এল। কিন্তু যারা গ্রামে রইল, তারা স্কুলের গণ্ডি পেরুল না। এরা কেউ কেউ ‘ন’-এর তলায় ফুটকি দিলে কি হয় তাও বলতে পারে না।
আমাদের ঠাকুমার আমাদের জন্য একটি অমূল্য উপদেশ ছিল: তাঁর মতে যাচা কন্যা ও সাজা পান ফেরত দিতে নেই। তাঁর এই দুর্বলতার সুযোগে কেউ কেউ তাদের অনূঢ়া কন্যাকে বাড়িতে রেখে চলে গেছে। এই বাড়িতে কন্যা ঢুকলে বেরুতে নেই। অগত্যা বাড়ির কোন উপযুক্ত পুত্রের সঙ্গে তার বিবাহ হত। ফলে পূর্বের মতো দীর্ঘদেহী হলেও আমাদের কারও কারও গাত্রবর্ণ পূর্বের মতো গৌরবর্ণ নয়। ঠাকুমার আর একটি অপূর্ব উপদেশ ছিল: সবাই মিলে নিজ নিজ গ্রাম গড়লে দেশ আপনিই গড়ে উঠবে। জনৈক বালক আম গাছে উঠে আম পাড়ছে শুনে ঠাকুমা বলেছিলেন, ‘খবরদার ওদিকে কেউ যাবি না।’ সে ভয়ে গাছ থেকে পড়ে যাবে। ঠাকুমা কাউকে অপরাধী বলে অপরাধিনী হতে চাইতেন না।
এক শ’ বছর বয়সে ঠাকুমা একদিন বললেন যে তাঁর আর বাঁচার ইচ্ছে নেই। তার অন্তিম সময় সমাগত। তাড়াতাড়ি তাঁকে গঙ্গার ঘাটে নিয়ে যেতে হবে। সেখানে তিনি তে-রাত্তির বাস করবেন। উনি বাচ্চাদের তখন তাড়াতাড়ি খাইয়ে দিতে হুকুম দিলেন। সবাইকে সাবধান করে দিলেন ও বললেন যে বাসনগুলো না তুললে চুরি যাবে। আমরা তাঁর শেষ সময়ে সঙ্গে ছিলাম। গভীর রাতে অন্তর্জলির জন্যে তাঁর পায়ের বুড়ো আঙুল গঙ্গার জলে ডুবোনো হলো। উনি হরিবোল বলে আঙুল ঘুরিয়ে দেহত্যাগ করলেন। তাঁর প্রিয় পৌত্রদের প্রতি তিনি একবার ফিরেও তাকালেন না।
[হোমিওপ্যাথী চিকিৎসকরা বলেন, ওটা ঠিক ইচ্ছামৃত্যু নয়। ওটা একপ্রকার মৃত্যু-ভয়। হোমিওপ্যাথী ঔষধ প্রয়োগে উনি কিছুদিন বাঁচতেন। আমার মতে দিবসের শেষে নিদ্রাকাঙ্ক্ষা আসার মতো জীবনের শেষে মানুষ মৃত্যুকে আকাঙ্ক্ষা করে।]
কিন্তু—ঐ অবোধ মহিষ-শিশুর কান্না ব্যর্থ হয় নি। সেই বিরাট ঠাকুরদালানের অধিকাংশই আজ বিধ্বস্ত। তার স্তম্ভগুলির পোড়ামাটির অলংকরণে মুগ্ধ হয়ে তা লোকে সংগ্রহ করে। সেখানে আজ আর কোন মাতৃপূজার আয়োজন নেই। কুলনারীরা প্রতিমার কানে কানে বলে না: ‘মা সামনের বছর আবার এসো।’ শরিকী মামলায় সিন্দুকগুলি রৌপ্য মুদ্রার বদলে মামলার নথিতে ভর্তি। ঠাকুমা চেষ্টা করেও এ-সমস্তের অবসান ঘটাতে পারেন নি। একে একে ভেঙে পড়ল রাজা রামশঙ্কর নির্মিত সাতটি মহল। জমিদারী বিলুপ্ত হওয়াতে বৃহৎ অট্টালিকার মেরামত সম্ভব নয়। শরিকরা ঐ বাড়িরই ইঁট ও কড়ি তুলে দূরে দূরে পৃথক গৃহ নির্মাণ করেছেন। শিক্ষিত স্বচ্ছল যাঁরা তাঁদের সবাই য়ুরোপ ও ভারতের বিভিন্ন স্থানেতে বাস করে। ইঁটের ভগ্নস্তূপের ভেতর শিশুদের [রাম ছাগল টানা] গাড়ি চাকা, ভাঙা পাল্কীর কাঠ, বর্মার ফলক, তরবারী ও খাঁড়ার লৌহখণ্ড, হাতীদের লৌহ ডাঙস, ঘোড়ার সরঞ্জামের টুকরো এখনো পাওয়া যায়। উৎসাহী গুপ্তধন-সন্ধানীরা ভূগর্ভের কক্ষ ভেঙে খুঁজে পায় নরকঙ্কাল ও করোটি। পল্লীর লোকেরা সেখান থেকে ইঁট তুলে উনুন বানায় ও রাস্তা তৈরী করে। তবুও ইঁটের পাহাড় একটুও কমে না। বাটীর কিছু দ্বিতল ও ত্রিতল এখনো সগর্বে মাথা উঁচু করে আছে। ঠাকুমার লক্ষ্মী পেঁচারা এখন আর নেই। তবে তাঁর বাস্তু-সাপগুলির যথেষ্ট বংশ বৃদ্ধি হয়েছে। ওদের ভয়ে সম্প্রতি ঐ ভগ্নস্তূপের ক্ষতিসাধন করতে কেউ সাহসী হয় না। দারোয়ান আর পাইকদের অবর্তমানে ওরাই এখন ঐ প্রাচীন ভগ্ন প্রাসাদের রক্ষক।
পিতামহের মাতৃদেবী ত্রিলোকীসুন্দরী দেবী কর্তৃক তিনশো বছর পূর্বে প্রতিষ্ঠিত অশ্বত্থ বৃক্ষটি ঐ ভগ্নস্তূপের অদূরে দাঁড়িয়ে এখনো নীরব বিস্ময়ে বিধ্বস্ত প্রাসাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ওরই তলায় কয়েক পুরুষ গ্রাম্য বালকেরা কপাটি, ডাংগুলি খেলেছে। কিন্তু তারা ঐ বিরাট বৃক্ষের প্রতিষ্ঠাত্রীর নাম জানে না।
[সমগ্র বাংলার বর্ধিষ্ণু পরিবারগুলির পতনের একই ইতিহাস। এখানে একটিমাত্র উদাহরণ দেওয়া হোল। অথচ এ-গুলিই একসময় গ্রামীণ সমাজ-ব্যবস্থার স্টিল ফ্রেম বা লৌহ-কাঠামো ছিল। স্বাভাবিক নিয়মে নদীর এক কূল ভাঙলে অন্য কূল গড়ে। এখানে ভাঙার ব্যাপার থাকলেও গড়ার ব্যাপার নেই। এদের অভাবে গ্রামীণ সমাজ কিছুকাল অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে ছিল।]
পূর্বপুরুষদের রাধাবল্লভজীউর বিগ্রহ পান দৌহিত্র বংশের বঙ্কিমবাবুরা এবং নারায়ণ ঠাকুরের বিগ্রহ পান আমাদের পৌত্র বংশ। রাধাবল্লভজীউর ভাগ্য ভালো। উনি এখনো বঙ্কিম ভবনে সাড়ম্বরে পূজিত। কিন্তু আমাদের বাস্তুচ্যুত নারায়ণ ঠাকুর এখন পুরোহিত গৃহে। বাল্যে বয়স্কদের দেখেছি অনন্যশরণ হয়ে নারায়ণ মন্দিরে মাথা ঠুকতে। বিগ্রহের রূপোর সিংহাসন ও সোনার ছত্র। রূপোর ঝারিতে স্নানের ব্যবস্থা। মখমলের গদিতে শয়ন। মূল্যবান তাম্র ও রৌপ্যের বাসন-কোসন। সকাল-সন্ধ্যায় ভোগ ও বৈকালিক জলপানের ব্যবস্থা। নিত্যপূজা ও বহুজনে প্রসাদ বিতরণ তখনও অব্যাহত। এখন মন্দিরসহ দেবোত্তর সম্পত্তিও বিক্রিত। কিন্তু এজন্যে দেবতা কারও বিরুদ্ধে আদালতে মামলা রুজু করেন নি। এখন তিনি পরাশ্রয়ী, পরভোজী, গৃহচ্যুত দেবতা। হিসেবমত চার’শ বছরের প্রাচীন বিগ্রহ। সেদিন গ্রামে গেলে পুরোহিত পুত্র অনুযোগ করে বললেন ‘দুখানি বাতাসা-ভোগের জন্যে মাসে পাঁচটা টাকাও তো দেবেন।’… গাড়ির পেট্রোল কেনার পর দু’টাকা বেঁচে ছিল। অধোবদনে টাকা দুটো তার হাতে তুলে দিয়ে কলিকাতার নতুন তৈরী বাড়িতে ফিরলাম। জনৈক ব্যক্তি পাশ থেকে সব শুনে কিছু টিপ্পনি করলেন। ‘দুশো বছর আগে হলে এজন্য ঐখানেই তার গর্দান যেত।’
বাড়ির একজন ঝি-মা আমাদের ভূত-পেত্নীর গল্প শোনাত। ভূত-পেত্নীদের পায়ের চেটো পেছন দিকে থাকে। ছেলেদের পেত্নী, মেয়েদের ভূত এবং ব্রাহ্মণ-বিধবাদের ব্রহ্মদৈত্যি ভর করে। এ ছাড়া গন্নাখাঁদা, গো-ভূত ও মামদো ভূতও আছে। তাঁর মতে মানুষের রূপ ধরেই ওদের আনাগোনা।
ঠাকুমা এ-সব বিষয় জেনে একদিন তাকে ধম্কে দিলেন। ঠাকুমার মতে ওরা জীবন্ত দুষ্ট লোক ও তস্কর। চৌর্যকার্যের সুবিধের জন্য শুরা রাত্রে মানুষকে ভয় দেখায়। তিনি বলতেন, ‘আলেয়া জলাভূমিতে গ্যাসের আলো।’ আবার চাষীবধূরা মাঝে মাঝে পিত্রালয়ে পালায়। মাথায় মালসাতে আগুন জ্বেলে তারা ধুনো দেয়। ফলে তা থেকে দপ্ দপ্ করে আগুন জ্বলে। তা দেখে অনুসন্ধানকারীরা ভয় পেয়ে মাঠে নামে না। ভূত-টুত সব—ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর গল্পের মতো বাজে গালগল্প। জীবনে যারা খুব আপনার জন্য মরণান্তে তাদেরই কেউ চায় না। তাই তাদের নামে প্রিয়জনেরা ভয় পায়। মানুষ ও গরু মরে ভূত হলেও পিঁপড়া, বেজী বা সাপ ম’রে হয় না। কিন্তু আমি ভূতে পাওয়া লোককেও দেখেছি।
[পরে বুঝেছিলাম, ভূতে পাওয়া এক প্রকার যৌনজ হিষ্টিরিয়া রোগ। অবদমিত যৌনাকাঙ্ক্ষা থেকে এর উৎপত্তি। তাই পুরুষকে পেত্নীতে ও নারীকে ভূতে পায়। তাই রোজাদের মন্ত্রে অশ্লীল শব্দ থাকে। রোগীরা ওগুলো শুনে একটু একটু করে ভালো হয়। ভূত তাড়ানোর সময় কুমারী কন্যাদের কানে আঙুল দিয়ে ভূতে-পাওরা ব্যক্তির সামনে বসানো হ’ত।]
তৎকালে পুস্তক পাঠ, বাক্যালাপ প্রভৃতি কৃত্রিম উপায়ে যৌন স্পৃহা উপশমের সুযোগ ছিল না। তাই বলপূর্বক যৌন অবদমনের ফলে মানুষের স্নায়ুতন্ত্রের ওপর প্রবল চাপ পড়ত। বৌদি, ঠাকুমা ও শ্যালিকাদের ঠাট্টার সম্পর্ক যৌনাকাঙ্ক্ষা প্রশমনের সহায়ক হয়। [য়ুরোপে যুগ্ম নৃত্যের মাধ্যমে এ-উদ্দেশ্য সফল হয়] নতুবা সে-যুগে ভূত-পেত্নীর সংখ্যা আরও বেড়ে যেত। তবে বেশীর ভাগ ভূতের গল্প অলীক কাহিনী মনে হয়। নিম্নে এক বৃদ্ধের মুখে শোনা এ-ধরনের একটি কাহিনী উদ্ধৃত করা গেল।
“বহু বছর পরে পশ্চিম দেশ থেকে পিসিমার সঙ্গে দেশের বাড়িতে ফিরে দেখলাম ভেতর-বাড়ির প্রাঙ্গণে আতা গাছের জঙ্গল। বাইরের দিকের একটা ঘর পরিষ্কার করে আমরা দুজনে থাকি। ইতিমধ্যে একটা স্কুলেও ভর্তি হয়েছি। একদিন পিসিমার আর্তনাদে উঠোনে গিয়ে দেখি আতা পাড়ার আঁকশি হাতে পিসিমা অজ্ঞান হয়ে গেছেন। পিসিমাকে তুলে নিয়ে এসে ঝি-এর জিম্মায় রেখে ফিরে এসে দেখি, ডালের ওপর বসে আছে একটা ফর্সা টুকটুকে মেয়ে। তাকে মৃদু হাসতে দেখে আমি বললাম, ‘আরে, তুই পুঁটি না! তুই ত মরে গেছিস্ শুনলাম।’ মৃতা পুঁটির সঙ্গে আমার বাল্যপ্রণয় ছিল। পুঁটি আমাকে তিনতলায় নিয়ে গিয়ে একটা ভাঙা সিন্দুকের ওপর বসাতো। আর সে নিজেও সেখানে বসে আমাকে আদর করত। স্কুল থেকে ফিরে খাবার হাতে ওপরে গিয়ে সেগুলো আমরা ভাগাভাগি করে খেতাম। একদিন পুঁটি বললে, এবার তার সময় হয়েছে। তার ইহলোকে দিন ফুরিয়েছে। আমার কাঁধে নোখ দিয়ে চিরে একটা ওষুধ ঢুকিয়ে দিয়ে বললে যে ওটা থাকলে ভূতে কোন ক্ষতি করতে পারবে না। এই কটী কথা বলে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে হাওয়াতে মিলিয়ে গেল।”
অশরীরীদের মতো অলীক দেবতাদের কিছু উৎপাতও গ্রামে ছিল। হিষ্টিরিয়া রোগীরা অশ্লীল গালিগালাজ করলে তাদের বলা হ’ত ‘ভূতে পাওয়া’ [Possessed]। আর দেব-দেবীর জবানিতে উচ্চাঙ্গের বাক্য প্রয়োগ করলে বলা হ’ত ‘ভর হওয়া’ [inspired]। কিছু পুণ্যস্থানের উৎপত্তির মূলে আছে এইরূপ প্রবঞ্চনা। উপরোক্ত ভূতের কাহিনিটি একটি প্যাথোলোজিক্যাল মিথ্যা ভাষণের দৃষ্টান্ত। ঐরূপ মিথ্যা বলে ওরা একপ্রকার পুলক শিহরণ অনুভব করে। জনৈক সাধক গহন বনে ও শ্মশানে গভীর রাত্রিতে কালীপুজো করত। একটি গ্রাম্য বালক পূর্বেই বৃক্ষারূঢ় হয়ে ছিল। সাধক চক্ষু মুদ্রিত করার পর সে প্রসাদী ফলমূল ও মিষ্টাদি তুলে নিয়ে উধাও হ’ল। চক্ষু উন্মীলিত করে সাধকটি কেঁদে ফেলেছিল। তার বক্তব্য, মা সবকিছু খেয়ে নিয়েছেন। এক কণাও প্রসাদ রাখেন নি। আর একজন প্রবঞ্চক মাটির তলায় শুকনো ছোলা রেখে তার ওপর শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করে। তার ঘোষণানুযায়ী গ্রামের লোকেরা মাটির ওপর জল ঢালতে থাকে এবং ব্যোম্ ব্যোম্ ধ্বনি তোলে। যথারীতি ছোলা ভিজে ফুলে ওঠে এবং শিবলিঙ্গও উপরে প্রকটিত হয়।
গ্রামে নারীর বিরুদ্ধে অপরাধমূলক কাজ অসম্ভব ছিল। সেই কালে গ্রামীণ নারীরা আত্মরক্ষায় সক্ষম। ভূমিহরণকে লোকে মাতৃহরণ মনে করতে।। নারী নির্যাতনের অপরাধ ক্ষমাহীন বলে গণ্য হত। থানা-কোর্ট গ্রাহ্য না করে অপরাধীকে পিটিয়ে মেরে তার মৃতদেহ মাটির নিচে পুঁতে ফেলা হ’ত। গৃহস্থরা ঐ ধরনের সন্তানদের মুখ দর্শন করাও পাপ মনে করতেন। এই শ্রেণীর কেউ কেউ দেশ ত্যাগ করে ফেরার হয়ে এক জাতীয় সন্ন্যাসীর সৃষ্টি করেছে। জনগণই এক্ষেত্রে একই সঙ্গে তদন্ত-বিচার ও দণ্ডবিধানের দায়িত্ব পালন করতো। ব্রিটিশের শাসন-ব্যবস্থা বহুকাল গ্রামীণ মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে নি। কোনও অপরাধপ্রবণা চরিত্রহীনা নারী গ্রামে স্থান পেত না। তবে গোপন ব্যভিচারের নজির সেখানে ছিল। নিম্নের কাহিনী থেকে বক্তব্য-বিষয়টি পরিস্ফুট হবে। অশীতিপর এক বৃদ্ধের কাছে বাল্যকালে আমি এই ঘটনাটি শুনেছিলাম। তাঁর ভাষায়: ‘দাদা ও বৌদি খোলাছাদে ঘুমুচ্ছিলেন। আমি কষায় বস্ত্র পরিধান করে মোটা পৈতে গলায় খড়ম পায়ে খট্ খট্ করে এগুলাম। তারপর বেল গাছ বেয়ে পাশের বাড়ির পাঁচিলের ওপারে গেলাম। যেতে যেতে শুনলাম, বৌদি দাদাকে বলছে—‘ওগো, দেখছো!’ দাদা তখন বৌদিকে ধমক্ দিয়ে বললেন, ‘চুপ কর। ওঁকে আমি রোজ দেখি। উনি আমাদের ছোড়-দাদু। খবরদার, কেউ যেন না এ-সব জানতে পারে।’ [এতে গ্রামে নিন্দে হবে] ওদিকে আমি নির্বিঘ্নে গোয়াল ঘরে টুকলাম। ও-বাড়ির মেজবাবুর চাকরীর ক্ষেত্র লক্ষ্ণৌ। তিন বছর অন্তর তিনি একবার বাড়ি আসেন। ও বাড়ির শাশুড়ী ঠাকরুণ তাঁদের বাঁকা সিঁড়িতে ঝুম্-ঝুম্ ঘুঙুরের শব্দ শুনলেন। তিনি ভক্তিভরে কপালে হাত ঠেকিয়ে বললেন: ‘হে মা লক্ষ্মী, তুমি এমনি করে এ-বাড়িতে অচলা থেকো।’ আমরা প্রতিদিন যথারীতি ওদের গোয়াল ঘরে মিলিত হতাম। পরের দিন ওদের বাড়িতে পান চাইতে এসে সেখানে এলাহী ব্যাপার দেখলাম। ওঁদের বাঁকা সিঁড়িতে শাশুড়ী ঠাকরুণ লক্ষ্মীর পায়ের একটি ঘুঙুর কুড়িয়ে পেয়েছেন। ওটাকে নারায়ণের সিংহাসনে রেখে পুজো সুরু হয়ে গিয়েছে।’
বধূরা জল নিতে এসে পুকুর পাড়ে পরিত্যক্ত হাঁড়ির তলায় প্রেমপত্র রাখতো। জীউর মৃত্যুর পর ঐ সমস্ত ফেলে দেওয়া ওষুধের হাঁড়ি-কুঁড়ি ছুঁলে লোকে স্নান করত। তাই ওগুলোর তলাই ছিল সর্বাপেক্ষা নিরাপদ স্থান। এদিকে প্রেমাস্পদরা যথা সময়ে এসে পত্রগুলি হস্তগত করত। তবে গ্রামেতে এ ধরনের সাহসিকতার নজির সংখ্যাতে নগণ্য ছিল।
[সে-কালের ভূত-পেত্নীরা বিলুপ্ত হয় নি। সেকালে যাদের রাতের অন্ধকারে বেলগাছ কিম্বা শ্যাওড়া গাছে দেখা যেত, এখন তাদের দেখা যায় প্রকাশ্যে রেস্তরাঁ বা লেকের ধারে। এ-সব ভূত-পেত্নী চিরদিনই রক্ষীদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। অধুনা এদের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। সীমিত ক্ষেত্রে অন্য প্রকার অপরাধও গ্রামে দেখা যেত। জনৈক অশীতিপর বৃদ্ধের নিম্নোক্ত বিবৃতি থেকে তার কিছুটা আভাস পাওয়া যাবে।]
‘আমার পিতামহ ৪০টি বিবাহ করলেও আমার পিতার মাত্র ১২টি বিবাহ। পিতার পত্নীদের মাত্র দুজনে তাঁর স্বগৃহে স্থান পায়। আমি মা-র সঙ্গে মাতুলালয়ে থাকায় জ্ঞান হওয়ার পর পিতাকে কখনও দেখি নি। একদিন গ্রামান্তরে যেতে যেতে তাঁর মনে পড়ল, ঐ গ্রামে তাঁর এক স্ত্রী থাকে। আমাকে সম্মুখে পেয়ে তিনি নাম জিজ্ঞেস করলেন। তারপর আমার বয়স জেনে খাতা খুলে পরিচিতি মিলিয়ে বললেন,—‘বাবা, আমি তোমার পিতা।’ ঐ অদ্ভুত চেহারার লোকটির এবম্বিধ উক্তিতে ক্রুদ্ধ হয়ে আমি তাকে প্রহার করলাম। পরে মা ছুটে আসায় আমি প্রহার বন্ধ করে গৃহত্যাগ করি। এখনো পর্যন্ত আমি অবিবাহিত আছি। মহাকুলীন ব্রাহ্মণ-সন্তান হওয়া আমার কাছে অত্যন্ত লজ্জার ব্যাপার।’
অন্যায় হতে অপরাধ এবং অপরাধ হতে পাপের সৃষ্টি হয়। অন্যায় ও অপরাধ পাপের প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপ। তাই অপরাধ দূরীকরণে গ্রামীণ সমাজ অন্যায়কারী এবং পাপীকে প্রথমে দমন করতো। সমাজে অপরাধ নগণ্য থাকলে পুলিশেরও প্রয়োজন হয় না। সামাজিক বিধান কেউ সামান্য লঙ্ঘন করলে তাকে কঠোর শাস্তি পেতে হত। দুর্দান্ত জমিদারদেরও সমাজ ভয় না করে বিচারপূর্বক দণ্ডবিধান করত। তিন প্রকার দণ্ড ব্যবস্থা ছিল—সামাজিক, কায়িক ও আর্থিক। তৎকালে সমাজে শাস্তিবিধান অত্যন্ত কঠোর ভাবেই হ’ত। দুরন্ত জমিদারদেরকেও সমাজ নির্ভয়ে দণ্ডদান করেছে। গ্রামীণ সমাজ কোন অন্যায় বা অপরাধের লেশমাত্র কাউকে জিইয়ে রাখতে দেয় নি।
বাড়ির এক চতুর্দশী বিধবা বীণা দেবী থান পরেন না। তার ওপর হাতে দু-গাছি পাতলা চুড়ি পরেন। একাদশীতে উপোস করেন না। মাছ বাদ দিয়ে মাছের ঝোল খান। তাঁকে খোলা ছাদে বেড়াতে দেখা যায়। গ্রামের তরুণদের সঙ্গে তাঁর কথাবার্তা চলে। [জনপ্রবাদ—তাঁর ওরূপ আচরণেতে পিতামহীর অনুমতি ও সমর্থন ছিল।] গ্রামের মাতব্বররা বীণাদেবীকে শাসন করবার সুযোগ খুঁজছিলেন। একটি সামাজিক নিমন্ত্রণ উপলক্ষে সে সুযোগ এল। তাঁরা সঠিক খবর সংগ্রহ করলেন যে বীণা দেবী হেঁসেলে ঢুকেছেন। তাঁদের দাবী—ওঁকে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। [তৎকালে ধনী রমণীদের স্বহস্তে রান্না করার রেওয়াজ ছিল] মনীষী বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন নিমন্ত্রিতদের একজন। উনি পিতামহকে বললেন, ‘বীণার রান্নাই সবাইকে খেতে হবে। তা না হলে উনি নিমন্ত্রণ রক্ষা না করে চলে যাবেন।’ সেদিন কৃষক প্রজারাই কেবল আহার্য বস্তু গ্রহণ করে ছিল। ক্ষোভে শোকে বীণাদেবী শুকিয়ে যেতে থাকেন এবং একদিন তাঁর মৃত্যু ঘটে। “বঙ্কিমবাবুর গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পরের বছর বাড়ির এক তরুণ গ্র্যাজুয়েট হন। এক বাগ্দী প্রজার বাড়িতে ওঁর যাতায়াত ছিল। বাগ্দী কন্যা ক্ষ্যান্তমণির হাতের রান্না খেতেও তাঁর আপত্তি নেই। তবে তিনি ছিলেন উদার-হৃদয় জমিদার পুত্র। বহু প্রজার খাজনা তিনি মুকুব করে দিতেন এবং তাদের আর্থিক সাহায্যও করতেন। তাঁর আচরণে শীঘ্রই সামাজিক প্রতিক্রিয়া সুরু হ’ল। তিনি গৃহত্যাগী হয়ে অন্যত্র বাসা নিলেন। তাঁর সঙ্গে রইল কৃষক-কন্যা ক্ষ্যান্তমণি। ডেপুটী ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরী পেয়েও তিনি নিলেন না। ধীরে ধীরে সুরাসক্ত হলেন। অবশেষে একদিন ক্ষ্যান্তমণির হাতে এক ঢোঁক জল খেয়ে তিনি চোখ বুজলেন। এবাড়ি থেকে খবর পেয়ে সবাই ওখানে যেতেই ক্ষ্যান্তমণি বেরিয়ে যায়। সেদিন থেকে তাকে আর কোথাও দেখা যায় নি।”
কিন্তু অন্য একটি দোষে আমরা কিছুকাল এক ঘরে হলাম। অপরাধ—পিতামহীকে এক মিশনারী মেম কিছুদিন পড়িয়েছে। কোনও বিদেশীর সংস্পর্শ গ্রামীণ সমাজ সহ্য করত না। আমাদের ক্ষমতা লোপ ও পড়ন্ত দশার ওরা সুযোগ নিয়েছিল। তবে গ্রামের ধোপা নাপিত ও প্রজার দল আমাদের সঙ্গে রইল। সেদিন যাঁরা আমাদের এক ঘরে করেছিল তাঁরা জীবিত থাকলে তাঁদের উত্তর পুরুষদের আচার-আচরণ দেখে স্তম্ভিত হয়ে যেতেন। আমাদের বাড়ির কয়েক ভ্রাতার য়ুরোপীয় বধূ। কিন্তু তাদের আমরা বাড়িতে স্থান দিই নি। অন্যদিকে ওদের বংশধরদের মধ্যে অসবর্ণ বিবাহ শুরু হয়ে গিয়েছে।
জমিদার শাসক ও পণ্ডিত কুলের অভাবে যে কুফল দেখা দিয়েছে তা হ’ল—সমাজের চতুর্দিকে নানা কুসংস্কার ও নৈতিক অধঃপতন। পাঠশালা, সংস্কৃত টোল ও চতুষ্পাঠীগুলির ভগ্নদশা! গ্রামে ইংরাজী শিক্ষার তেমন সুযোগ ছিল না। ব্রিটিশ শাসকদের এই অব্যবস্থার ফলে গ্রামগুলি কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। সেগুলির দশা ঠিক হালহীন নৌকো বা চালকহীন শকটের মতো হয়ে যায়। এ-অবস্থা বহুদিন পর্যন্ত বাংলার কিছু গ্রামকে আচ্ছন্ন করে রাখে।
পণ্ডিতদের অনেকের আচরণের মধ্যে নানা অসংগতি, স্বার্থপরতা ও অন্যায় আস্ফালন লক্ষিত হত। কেউ কেউ ক্রুদ্ধ হলে উল্টো তুলসী দেবার ভয় দেখিয়ে বলতেন: ‘অর্বাচীন, মূর্খ, স্ব-পল্লীতে প্রাপ্তহলে গাত্রচর্ম স্খলিত করবো।’ আবার সামনে কেউ খেজুর রসের ভাঁড় দিলে ওঁরা বলতেন: ‘বাবা জীবন, তান্ত্রিকমতে আহ্নিক সেরে নিই।’ তারপর নামাবলীর তলায় খানিক আঙুল ঘুরিয়ে রসভাণ্ডে চুমুক দিতে তাঁদের বাধা নেই। পংক্তিভোজনে দৈবাৎ কোন অব্রাহ্মণ বসলে ওঁরা সত্বর দধি ও মিষ্টান্ন মুখে পুরে দিয়ে বলেছেন: ‘নাঃ, খাবো না। আমার জাতঃপাত হবে,’ ইত্যাদি। কোনও শিষ্য গুরুগৃহে এসে হঠাৎ বৃহৎ মৎস্য রান্না হতে দেখলে, নিরামিষাশী-মন্য স্বপাক-ভোজী গুরুদেব বলে উঠেছেন—‘এসো, বাবা জীবন এসো, এখানে মৎস্য-যজ্ঞের আয়োজন হয়েছে। এ-যজ্ঞ দ্বাদশ বৎসর অন্তর মদ্গৃহে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। তা বাবা জীবন! অত্র গৃহে প্ৰসাদ গ্রহণ করবে।’ মেথর অস্পৃশ্য হলেও এঁদের অনেকের কাছে তন্বী মেথরানী অস্পৃশ নয়। দুই বাগ্মী পণ্ডিতে ঘুসো-ঘুসি হলে জনৈক ব্যক্তি অভিমত দিলেন: ‘দন্ত ভগ্নে চ পপাতঃ।’ অন্যজনে তীব্র প্রতিবাদ করে বললেন: ‘উঁহু, মিথ্যা বাক্য। দন্ত ভগ্নে চ তিষ্ঠায়মান।’ যাত্রা প্রভৃতিতে নটীদের গানে মুগ্ধ হয়ে তাঁরা পুনরায় গানটি গীত হওয়ার জন্যে ‘পুনারোপী গাহিতম্’ বলেছেন। কেউ কথ্য ভাষা প্রয়োগের পক্ষপাতী ছিলেন না। বিদ্যা জাহির করে তাঁরা বলেছেন: ‘গবাক্ষপথে হস্ত প্রসারিত করে বৃষ্টি পতিত হচ্ছে কিনা দেখ।’ কোনও মঠের সন্ন্যাসীর নিকট অন্য সন্ন্যাসীর সংবাদ জানতে চাইলে মুখ থেকে চাদর না তুলে তিনি বলেছেন ‘ওঁর সঙ্গে আমার বাক্যালাপ নেই।’ ব্রাহ্মণদের একত্রে দেখলে ‘ব্রাহ্মনেভ্য নমো’ বলা সেই কালে একটি সভ্য সম্মত রীতি ছিল।
[পূর্বে নিমন্ত্রণ বাটিতে গৃহকর্তা অভ্যাগতদের বলতেন: ব্রাহ্মণরা এদিকে ও অন্যেরা ওদিকে বসুন। এ যুগে ওঁরাই ঐ ক্ষেত্রে বলে থাকেন: ভদ্রলোকেরা এদিকে এবং ব্রাহ্মণরা ওই রোয়াকে বসুন।]
ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা সমাজের পথপ্রদর্শক না হয়ে স্বস্থান হতে বিচ্যুত হয়ে ধীরে ধীরে চাকুরিজীবী হয়েছেন। সন্ন্যাসী ও জ্ঞানী গুণীরা তাঁদের স্থলাভিষিক্ত না হলে জনগণ আরও অধঃপতিত হ’ত। তবে গ্রামের অধিকাশ মহিলা নিরক্ষর হলেও অশিক্ষিতা ছিলেন না। যাত্রা গান, পুতুল নাচ, কথকতা ও রামায়ণ-মহাভারত পাঠ শ্রবণে তাঁরা নানা শিক্ষা লাভ করতেন। আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হিসেবে ওঁদের গুরুত্বকে খুব অস্বীকার করা চলে না। গুরুমশাইদের সাপ্তাহিক ‘সিধা’ পাঠিয়ে ওঁরাই পাঠশালাগুলোকে রক্ষা করে এসেছেন। কারণ, জমিদার গৃহ থেকে তাদের অর্থদান বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
বৃত্তিভিত্তিক সমাজ ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। স্ব-বৃত্তিতে অধিষ্ঠিত থাকা কারও পছন্দ নয়। কেবল কৃষক সমাজ গ্রামের মেরুদণ্ড হয়ে রইল। এক কৃষককে ডন বৈঠক সেরে তাল গাছে ধাক্কা মেরে বলতে শুনেছি, ‘মা, একটু ছাই দাও তো, এটাকে উপড়ে আবার পুঁতি।’ ম্যালেরিয়ার প্রচণ্ড প্রভাব সত্ত্বেও এদের বুকের ছাতি ও বাহুর পেশী ঈর্ষার বস্তু ছিল। এক মধ্যবিত্ত তরুণকে নারকেল গাছের মাথায় বসে ইতিহাস মুখস্থ করতে দেখেছি।
তৎকালে তরজা গায়ক দল জাতীয় সমালোচকের ভূমিকা গ্রহণ করতো। এই শ্রেণীর তরজা গায়করা গ্রামে গ্রামে তরজা গান পরিবেশন করে বেড়াত। কিন্তু তার আগে তারা গ্রামের বহু আভ্যন্তরীণ সংবাদ সংগ্রহ করত। অতঃপর গানের মাধ্যমে প্রতিটি দোষ-গুণ জনসমক্ষে প্রকাশ করত।—কোন্ পরিবারের কে কাকে প্রবঞ্চনা করেছে, কার পুত্র কেন বিপথগামী হবে, কার কোথায় সংশোধন যোগ্য ত্রুটি আছে ইত্যাদি প্রকাশ করে তরজা গায়করা এক প্রকার সংশোধনী পুলিশের কাজ করত।
সে-সময় মাদরাল থেকে কাঁকিনাড়া একটি মাত্র রাজপথ। পূর্বপুরুষরা এ পথ তৈরী করে স্টেশনগামী অন্নদা ব্যানার্জী রোডে যুক্ত করেন। [এঁর প্রথমা, পিতামহের ভগিনী।] কিন্তু নৈহাটী থেকে মাদরাল গ্রামে কোন রাস্তা না থাকায় তরজা গায়করা গাইল—‘গ্রাম মাদরাল, রাস্তা নাইকো খালি—আল খেতে দিল ডালে চাল।’ বয়োপ্রাপ্ত হয়ে নৈহাটী থেকে মাদরাল পর্যন্ত দু’মাইল রাস্তা আমিই তৈরী করি। আমার নিজস্ব ধানক্ষেতগুলি এতে দুভাগ হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু এর জন্যে আমি কোন সুনামের অধিকারী হলাম না। বর্ষীয়ানদের অভিমত—ঐ পথ দিয়ে গুণ্ডারা এসে লুটপাট করে আর সেই সঙ্গে বাড়তি উৎপাত রূপে আসে গাড়ি বোঝাই পুলিশ। প্রথম রাজপথটি পূর্বপুরুষদের চেষ্টায় এবং দ্বিতীয়টি আমার চেষ্টায় তৈরী হল। গ্রামের লোক সুখ পেলেও তাদের শান্তি হ’ল বিঘ্নিত। কল্যাণ রোড সমাপ্ত হলে মোটর ডাকাতির সম্ভাবনা দেখা দেয়, জঙ্গল সাফ করে আমার তৈরী পার্ক গুণ্ডাদের আসার সুযোগ করে দেয়—উপরন্তু গ্রামের লোকেদের স্বাভাবিক শৌচাগার নাকি এতে নষ্ট হ’ল। একজনের সুখ অন্যজনের দুঃখের কারণ হয়।
আজও মনে পড়ে সেদিনের সেই বৌ-কথা কও আর দোয়েল পাখির গান। গত মহাযুদ্ধের সময় আমাদের শরিকরা বাগানের গাছ, আর বাঁশ ঝাড় বিক্রি করে দেন। এর জন্যে অনুযোগ করলে তাঁরা বলেন—‘এত বড়ো দুর্ভিক্ষ গেল, তোমরা কি আমাদের দেখেছো?’ ফাগুনে আর আগুন জ্বলে না বাঁশে; তবু শুকনো পাতার মর্মর ধ্বনি আজো কানে বাজে। আজো মন ছুটে যায় গো-হাড়গিলেদের পেছন পেছন। শুনতে ইচ্ছে করে সেদিনের সেই পাঠশালার পড়ুয়াদের ছুটির আগের—‘দুই কড়া আধা গণ্ডা’ ডাক। শহরবাসী পুত্রটি পারিবারিক ঐতিহ্যকে স্বীকার করতে নারাজ। তার মনে ভয়, বন্ধুরা তাকে এতে বুর্জোয়া বলে উপহাস করবে।
[এ-জীবনে বারংবার দেখেছি, মানব-মনের পরিবর্তন কিভাবে ঘটে। প্রথম জীবনে বিপত্নীক হওয়ায় শ্বশুর বাড়িটি বিশেষ অবলম্বন ছিল। বহু বৎসর ওদের সংস্পর্শে থেকে অতীতকে ভুলেছিলাম। ওরা প্রথমে বড়ো বড়ো রসগোল্লা নিয়ে আসতো। পরে ওগুলো আকারে ছোট হতে থাকে। একদিন ওরা রসমুণ্ডি এনে দিল। কিন্তু—বোঁদের জন্যে আমি আর অপেক্ষা করি নি। ওরা আর আমার সংবাদ নেয় না। আমিও আর যাই না ওদের ওখানে। এমনটি যে হবে তা স্নেহশীলা শাশুড়ী ঠাকরুণ বুঝতে পেরেছিলেন। তাই মৃত্যুর পূর্বে তিনি আমাকে পুনর্বিবাহ করালেন। কিন্তু সেও বেশীদিন পৃথিবীতে রইল না। ওদের ল্যান্সডাউন রোডের বাড়ির পাশ দিয়ে মাঝে মাঝে যাই। বাড়িটা যেন আমাকে ডাক দিয়ে বলে,—‘ব্রাদার, তোমাকে আমি চিনেছি, তুমি কি আমাকে চিনতে পারো?’ দ্রুত গতিতে মোটর গাড়ি দূরে সরে যায়।]
[আজও সেই ছায়া শীতল পল্লীর স্মৃতি বারংবার অন্তরকে ব্যথাতুর করে তোলে। কলকাতায় থেকে উচ্চ শিক্ষা ও উচ্চপদ লাভ করে যে সম্মান আমি পেয়েছি তার চেয়ে বহুগুণ বেশী সম্মান গ্রামের দরিদ্র অল্পশিক্ষিত শরিকরা পেয়ে থাকে। বংশ পরিচয়ের গুণে তাদের এই সম্মান লাভ। সাত পুরুষ একসঙ্গে বাস করে সবাই যেন এক পরিবারভুক্ত হয়ে গিয়েছিল। কেউ অনাহারে থাকলে অন্য কেউ না কেউ সাহায্যের জন্যে এগিয়ে আসত। এখন বহিরাগতদের ভীড়ে জনবহুলতার জন্য তারা যে নিজবাসভূমে পরবাসীর মতো।]
উপরে রাষ্ট্রীয় পুলিশ-বিহীন গ্রামীণ সমাজের যে চিত্র তুলে ধরা হ’ল তা প্রায় সাম্প্রতিক কালের হলেও ব্রিটিশ কর্তৃক জমিদারী পুলিশ উচ্ছেদের সময় থেকে কিংবা শতাব্দীর প্রারম্ভ পর্যন্ত একই রকম ছিল। একে গভর্ণমেন্ট অব্ দি পিপল, বাই দি পিপ্ল এ্যাণ্ড ফর দি পিপ্ল বলা যায়। গ্রামীণ প্রশাসনে গ্রামের প্রতিটি ব্যক্তি সমান অংশীদার ছিল—প্রতিটি বয়স্ক ব্যক্তির অভিভাবকত্বে গ্রামের শিশুরা বড়ো হ’ত।
পথঘাট ও যানবাহনের উন্নতির সাথে সাথে গ্রামগুলিতে পুলিশের অনুপ্রবেশ তথা ব্রিটিশের বিচার-ব্যবস্থার প্রচলন হয়। বর্তমান শিক্ষা-দীক্ষার প্রভাবে সংঘাতময়তার ভেতর দিয়ে গ্রাম্য সমাজ ভগ্নদশা প্রাপ্ত হলে এ-কাজ আরও সহজসাধ্য হয়ে ওঠে। ফলে গ্রামের মানুষ আত্মরক্ষার জন্য এতদিন রাষ্ট্রীয় পুলিশের ওপর নির্ভরশীল হয়।
[শৈশবকালে মনুষ্যশিশু তার ইচ্ছানুরূপ কাজ করতে এবং ইচ্ছানুরূপ দ্রব্যাদি লাভ করতে চায়। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে উপলব্ধি করে যে, স্বীয় বাসনানুসারে কিছু পেতে হলে তা সৎভাবে পরিশ্রম দ্বারা উপার্জন করতে হয়। নতুবা চতুর্দিক থেকে প্রচণ্ড বাধা আসে। পরে অন্যের নিকট থেকে আসা বাধাকে নিজের ওপর আরোপ করতে দেখা যায়। কখনো অক্ষমতা ঢাকার জন্য ‘ম্যাল-এ্যাড্জাস্টমেন্ট’ প্রভৃতি উচ্চধ্বনিব্যঞ্জক শব্দাদী প্রয়োগে এর ব্যাখ্যা করা হয়। পরবর্তী অবস্থা মানিয়ে নিতে গ্রামীণ সমাজ শিশুদের সাহায্য করতে সক্ষম। এজন্য গ্রামে অপরাধীর সংখ্যা সাধারণত কম। কিন্তু জনপদ নয়, গ্রাম বা শহরের পর্যায়েও ফেলা যায় না এসব ক্ষেত্রে অবস্থা সংকটজনক হয়।]
পুলিশ দু’ধরনের হয়ে থাকে, যথা—(১) শাসক আরোপিত পুলিশ (২) জনগণ-সৃষ্ট পুলিশ। প্রথমটি ওপর থেকে শাসকগণ কর্তৃক আরোপিত হয়। এ হ’ল সমগ্র দেশ বা প্রদেশের জন্ম একই রূপ সংঘটন-সহ কেন্দ্রীভূত পুলিশ। শাসক-নিয়োজিত পুলিশ সম্প্রদায় শাসকদের স্বার্থে কাজ করায় তেমন জনপ্রিয় হতে পারে না। ভারত, ব্রহ্মদেশ, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি পূর্বতন কলোনিয়াল কান্ট্রিতে এদের প্রাধান্য। কিন্তু দ্বিতীয়োক্ত জনগণ-সৃষ্ট পুলিশ বিকেন্দ্রীকরণের ফলে স্থান ভেদে বিভিন্ন প্রকারের হয়। এরা জনগণের নিয়ন্ত্রণে জনগণের স্বার্থে কার্য করায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আমেরিকা ও য়ুরোপের বহু শহরে ও দেশে তাদের মিউনিসিপ্যালিটির অধীনে জনগণ-সৃষ্ট বিকেন্দ্রীভূত পুলিশ এখনো আছে।
ব্রিটিশ শাসনের ফলে ভারতব্যাপী জনগণ সৃষ্ট পুলিশ শাসকও আরোপিত পুলিশগণ কর্তৃক অপসারিত হয়। পরবর্তী পরিচ্ছেদে ঐ শাসক কুল-আরোপিত কেন্দ্রীভূত পুলিশের ইতিবৃত্ত বিবৃত করা হবে।
[প্রাচীন গ্রামীণ সংস্কৃতির কিছু কিছু নিদর্শন গ্রামে থেকে গেছে। যেমন, বিশেষ তিথিতে গহন বাগিচায় গিয়ে মহিলাদের পুরুষ বর্জিত বনভোজন। এটা বাঙলা দেশের একটি প্রাচীন প্রথার নিদর্শন। পূর্বকালে গ্রামের মহিলারা নৃত্যশিল্পে পারদর্শিনী ছিলেন। বরবধূ ও প্রতিমা বরণে ওঁদের হস্ত সঞ্চালন থাকলেও তৎসহ পদ সঞ্চালন আজও পরিত্যক্ত। আল্পনা ও কাঁথার ওপর নক্সা তোলার কাজে আজও এঁদের পারদর্শিতা লক্ষ্য করা যায়। সে-সময় গ্রামে অনাবিল শান্তি না থাকলে এ-সব সম্ভব হত না।]
তরবারি, লাঠি খেলা প্রভৃতি আজো গ্রামের পুরুষদের কাছে অতি প্রিয়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাল্যকালে আমাদের বাড়িতে তরবারি চালনা শিক্ষার জন্য প্রায়ই আসতেন। তাঁর ব্যবহৃত তিন শ’ বছরের পুরনো দুখানি তরবারি আমাদের অধিকারে আছে। এ-সব শিক্ষা প্রাচীন প্রজাদের কাছ থেকে গ্রহণ করতে ওঁর আপত্তি ছিল না।
কলিকাতা ও এর শিল্পাঞ্চল বাংলাকে নিজ দেশে প্রায় পরবাসী করেছে। মনে হয় এখন বাকি কাজটুকু চিত্তরঞ্জন, দুর্গাপুর, ও হলদিয়া সমাধা করবে। আশ্চর্য এই যে, বাঙালী মন্ত্রীদের নির্দেশে বাঙালী পুলিশের কর্মতৎপরতায় এ-কাজ সংঘটিত হবে। বাঙালিরা নিজেরা নিজেদের জন্য এ-সব গঠন করতে অক্ষম হলে তাদের বলতে হবে ও বলা উচিত—‘দাও ফিরে সে অরণ্য।’—বৃথা চাষের ভূমি হারাতে আমরা রাজী নই। কয়েক শতাব্দীর রণক্লান্ত বাঙালীর আত্মসংরক্ষণের প্রয়োজন সর্বাধিক।
বাংলার শিল্পাঞ্চলগুলি চাষের ভূমি নষ্ট করে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্রাইম সৃষ্টি করেছে। এর ফলে সামাজিক আবহাওয়া দূষিত হয়েছে। অপরাধীর সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু স্থানীয় লোকেদের কর্ম সংস্থান হয় নি। এমন কি খাদ্যাভাব আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে। এদিকে বাঙালী নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার কথা চিন্তা না করে আত্মধ্বংসী রাজনীতির চর্চায় মত্ত হয়ে আছে।
ব্রিটিশ শাসকরা প্রায়ই বলতেন—ভারতের হিতার্থে তারা ঈশ্বর-প্রেরিত দূত। বস্তুতঃ চন্দ্রগুপ্ত, অশোক, সমুদ্রগুপ্ত, বিজনগরের মহারাজা দেবপাল, মহীপাল ও আকবরের স্বপ্নকে তারা বাস্তবে রূপায়িত করে সমগ্র ভারতকে একসূত্রে গ্রথিত করেন। মানস-সরোবর সহ তিব্বত জয় করার পর তা ত্যাগ না করে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করলে আজ ব্রহ্মদেশের মতো তিব্বত স্বাধীন দেশ থাকতো। ইংরাজ পণ্ডিতরাই ভারতীয় বেদ ও ব্রাহ্মীলিপির পাঠোদ্ধার করেন। এমন কি জাতীয় কংগ্রেসের মূল ভিত্তি ওঁদেরই একজন স্থাপন করেছিলেন। ভারতবর্ষকে নানা দিকে সুসংগঠিত করে আমাদের হাতে তারা তুলে দেন। সে-সময় নেপাল, ভুটান, সিকিম ও সিংহলও ভারতের অন্তর্ভুক্ত হতে পারত। অবশ্য ‘ইকনমিক এক্সপ্লয়টেশন’-এর বিষয় এখানে উল্লেখ করবো না। ভারতের একটুকরো ভূমিও তারা বেদখল হতে দেয় নি। বহুকালের উৎপীড়িত ও রণক্লান্ত জাতি প্রথম শান্তি পেল। তাই বহু পূর্বে কলহরত গ্রামবালকেরা পিতা ও পিতৃব্যের মতো পরস্পরকে বলতো—‘কোম্পানীর রাজত্বে বাস করি—ভয় করি না বাপু! এটা মগের মুলুক নয়।’
[আমি পুলিশে চাকরী করে একটা অদ্ভুত বিষয় লক্ষ্য করতাম। এ্যাংলো সার্জেন্টরা দেশীর ইন্চার্জ কর্মীদের অধীন হলেও মেথর শ্রেণীর উৎপীড়িত বালকেরা ঐ লালমুখোদেরই সুবিচারার্থে বেছে নিত। তখনো তাদের ধারণা, বাবুদের চেয়ে ওরা ভালো বিচার করবে।]
একজন ইউরোপীয় ও একজন ভারতীয়ের বিচারে কিছু তারতম্য হত। কিন্তু একজন ভারতীয়ের সঙ্গে অন্য ভারতীয়ের তারা চুলচেরা বিচার করেছে। ইউরোপীয় অপরাধীরাও সব সময় রেহাই পেত না। তবে তাদের ক্ষেত্রে লঘুদণ্ড হত। ইংরাজ নাগরিকরা স্বভাবতঃই দেশীয়দের সঙ্গে সংঘাত এড়িয়ে চলত। তারা লক্ষ্য করেছিল যে দেশীয়রা ধর্মীয় কারণে বিদ্রোহী হয়। তাই তারা ধর্মীয় অধিকারে হস্তক্ষেপ করার পক্ষপাতী ছিল না। মুঘল সাম্রাজ্যের পতন ও সিপাহী বিদ্রোহের মূলে ছিল এই ধর্মীয় চেতনা। দোষে-গুণে ওদের যে সাম্রাজ্যের সূচনা হয়েছিল তার শেষভাগে কেবলই ‘ভেদনীতি’। এতে ব্রিটিশ ও ভারতীয় উভয়েরই সর্বনাশ ঘটে।
যেভাবে স্থল পথে রুশীয়ার [Russia] সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে জলপথে সেই একইভাবে ব্রিটিশরা তা করেছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ভগ্নদশাপ্রাপ্ত হলেও রুশ সাম্রাজ্য ভাঙে নি। বহুভাষা ও জাতিসম্বলিত রুশ সাম্রাজ্য আজও অন্য নামে অক্ষুণ্ণ আছে। বিশাল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একাংশ থেকে অন্যাংশে প্রেরিত খাদ্য ও বস্ত্র সুলভ ছিল। ভারতের বিভিন্ন দেশীয় নৃপতিদের সঙ্গে তারা ক্ষমতার ভাগাভাগি করে। কিন্তু বাংলার ভূঁইয়ার শাসকদের সঙ্গে অনুরূপ চুক্তিতে তারা সম্মত হয় নি। তাই তাদের বিচার ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে ফৌজ ও পুলিশ ওরা ভেঙে দেয়। এভাবে বাঙালীদের একাংশের সঙ্গে তাদের চির বিরোধ ঘটে। লর্ড কর্নওয়ালিশের সময় থেকেই তার সূত্রপাত। [প্রথম খণ্ড দ্রষ্টব্য] বাঙালীরাই ওদের ডেকে এনে ভারতের রাজতক্তে বসিয়ে ছিল। আবার বাঙালীরাই ওদের সাম্রাজ্যলোপের বীজ বপন করে। তা না হলে এত শীঘ্র ওদের এ-দেশ থেকে বিদায় নিতে হ’ত না। তবুও বেশ কিছুকাল স্বাধীনতাকামী বাঙালী তথা ভারতীয়দের মধ্যে একটা সুষুপ্তির অবস্থা তথা ‘লুসিড্ ইন্টারভ্যাল’ বিরাজ করে। এই সুযোগে ব্রিটিশরা অনেক কিছু গুছিয়ে নিতে সক্ষম হয়।
কিন্তু শ্মশানের মহাশান্তি যে কাম্য নয় তা বাংলার বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রথম উপলব্ধি করলেন। উনি লক্ষ্য করলেন যে, সাম্রাজ্যরক্ষার প্রয়োজনে রেলপথগুলি স্থাপিত হ’ল সমুদ্রের কিনারা ধরে। পরে এগুলি সৈন্য চলাচলের সুবিধার্থে সমগ্র দেশকে শৃঙ্খলিত করলো। এই রেলগাড়ি, স্টিমার এবং টেলিগ্রাফ প্রান্তিক বিদ্রোহ দমনে সহায়ক হবে। ভারতকে চিরপরাধীন রাখাই এর অন্যতম উদ্দেশ্য। উনি আরও লক্ষ্য করলেন যে ওরা প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যকে যথা সত্বর ভুলিয়ে দিতে চায়। এ্যাংলো ইণ্ডিয়ান সমাজ পূর্বেই সৃষ্টি হয়েছিল। অতঃপর এ্যাংলো-বাঙলো নামে এক নতুন ইংরাজীনবিশ দল সৃষ্টি হচ্ছে। এরা সগর্বে বলতে সুরু করেছে—‘উই থিঙ্ক ইন ইংলিশ, উই স্পিক্ ইন্ ইংলিশ, উই ড্রিম ইন ইন্ ইংলিশ।’ উপরন্তু ইংরাজ পণ্ডিতরা ‘বিভেদ-পন্থী’ গবেষণায় নিরত। একীভূত হিন্দু-সমাজকে নৃ-তত্ত্ব ও সমাজতত্ত্বদ্বারা বহু ভাগে বিভক্ত করাই ওদের ইচ্ছা। ওরা চায় না, মুশ্লিমরা নিজেদেরকে ধর্মে মুশ্লিম হয়েও জাতিতে হিন্দু ভাবুক। অথচ চিরকাল বাদশারাও তাদের দেশকে হিন্দুস্থান বলে এসেছে।
[বঙ্কিমচন্দ্র বিশ্বাস করতেন, আর্যরা আদি মানব-গোষ্ঠীরই একটি উন্নত শাখা। তাঁর মতে আদি মানবজাতির উদ্ভব হিমালয়ের পাদদেশে। কাশ্মীর ও হিমালয় থেকে আর্যরা পাঞ্জাব ও অন্য স্থানে পারস্য ও ইউরোপে বসবাস করে। ভারতের ঐ সমস্ত অঞ্চল শীত-প্রধান হওয়ায় তাদের গাত্রবর্ণ উজ্জ্বল ছিল। নিগ্রোয়িটরা ভেলায় করে সমুদ্রপথে ভারতে এসেছিল। আর্যরা অন্য স্থান থেকে এলে বেদে তার উল্লেখ থাকতো। ভারতে স্থানভেদে জলবায়ু আলাদা হওয়ায় মানুষও ভিন্ন ধরনের হয়েছে। পরে সকলে একত্রিত হয়ে অভিন্ন হিন্দু জাতি ও হিন্দু সভ্যতার সৃষ্টি করে। এই অভিন্নতা ইংরাজরা স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল। এটাই ইংরাজদের বিরুদ্ধে তাঁর প্রধান অভিযোগ।]
তাঁর মতে ইংরাজী শিক্ষা দেশের কোন উপকার করে নি। সামান্য সংস্কৃত জ্ঞানে সমগ্র ভারত ভ্রমণ সম্ভব ছিল। সরল ও কথ্য সংস্কৃত তৈরী শুরু হয়েছিল। জাপানী ও আরবরা ইংরাজী শিক্ষা ব্যতিরেকে জ্ঞানচর্চায় অনগ্রসর নয়। পাদ্রীরা আইন ও ডাক্তারী শাস্ত্র পর্যন্ত অনুবাদ করতে আরম্ভ করে। কিছু ইংরাজের হস্তক্ষেপে তা বন্ধ হয়ে যায়। কিছু সংখ্যক ইংরাজের সুবিধার্থে ইংরাজী ভাষার প্রচলন হয়। বঙ্কিমচন্দ্র এর কুফল বুঝে বাঙলা ভাষা তথা বাঙলা সাহিত্যের উন্নয়নে সচেষ্ট হন।
সংস্কৃত ছাড়াও আন্তঃরাজ্যে ব্যবহার্য কিছু মিশ্র ভাষাও মধ্য যুগেই তৈরী হচ্ছিল। বাঙলার রাজা কেদার রায়ের রাজ্য আক্রমণ কালে মানসিংহ উভয়ের বোধগম্য এ-ধরনের এক মিশ্রভাষায় তাঁকে চরম পত্র পাঠিয়েছিলেন। “মানসিংহ বিষম সমর সিংহা প্রষাতি। সুতরাং ত্রিপুর সম বাঙালী চাকলী সকল পুরুষমেতৎ ভাগী যাও পলাপয়ী।”
বঙ্কিমচন্দ্র এ-সমস্ত উপলব্ধি করে উদাত্ত কণ্ঠে গর্জে উঠেছিলেন—“তুলে নাও তোমাদের রেলপথ ও টেলিগ্রাফের স্তম্ভ।” [বঙ্কিম রচনা দ্রঃ] উপরন্তু তিনি ইংরাজ গবেষকদের ওপর খড়্গহস্ত হয়ে উঠলেন। স্নাতক হওয়ার পর তিনি পিতার আদেশক্রমে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের পদ গ্রহণ করেছিলেন। নতুবা হয়তো তাঁর নেতৃত্বেই দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ সুরু হতো। তাঁর প্রণীত পুস্তকাবলীর মধ্যেই স্বাধীনতা যুদ্ধের পরিকল্পনার বিষয় লিপিবদ্ধ আছে। উপযুক্ত প্রস্তুতির অভাবে তিনি স্বয়ং উহা রূপায়িত করতে পারেন নি। উহার ছত্রে ছত্রে ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রচ্ছন্ন আহ্বান উচ্চারিত। তিনি একটি জাতীয় সংগীতও সৃষ্টি করে গেছেন। পরবর্তীকালে তাঁরই প্রদর্শিত পন্থায় স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা হয়। শত সহস্র তরুণ তাঁরই সৃষ্ট “বন্দেমাতরম” ধ্বনি উচ্চারণ করে দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করে।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন আমাদের ঘোষাল পরিবারের দৌহিত্র বংশোদ্ভূত সন্তান। রায় বাহাদুর বঙ্কিমচন্দ্র আমাদের পিতামহ রায়বাহাদুর কমলাপতির মাসতুতো ভ্রাতা। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী প্রণীত বঙ্কিম-প্রসঙ্গ পাঠে জানা যায়, বঙ্কিমচন্দ্র পিতামহ কমলাপতির নিকট ইংরাজী শিক্ষা লাভ করেছিলেন। পিতামহ ফোর্ট উইলিয়ামের জুনিয়র ও সিনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। বঙ্কিমচন্দ্র কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্নাতক। রাজা দোলগোবিন্দ কর্তৃক পরিত্যক্ত সম্পত্তি তাঁর উত্তরাধিকারী রঘুদেব ঘোষালের মাধ্যমে উভয় পরিবারে বিভক্ত হয়।
আমাদের কুলপুরোহিত তাঁর হাতে-খড়ি দেন অর্থাৎ অক্ষর পরিচয় করান। এজন্য তিনি তাকে যথেষ্ট সমীহ করে চলতেন। এই মহাপণ্ডিত নিত্য গঙ্গা স্নানান্তে বঙ্কিম ভবন হয়ে স্বগ্রাম মাদ্রালে ফিরতেন। সেখানে কিছুক্ষণ অবস্থান পূর্বক বঙ্কিমচন্দ্র এবং তাঁর বন্ধুদের মুখে মুখে কবিতা শোনাতেন। একদিন তিনি অনুযোগ করে বঙ্কিমচন্দ্রকে বললেন—“আচ্ছা, বঙ্কিম! অক্ষয়, দীনবন্ধু প্রভৃতি সকলেই নানা বিষয়ে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। কিন্তু তুমি কোনদিন আমাকে কিছু প্রশ্ন কর না কেন?” তদুত্তরে বঙ্কিম বলেছিলেন: “ঠাকুর মশাই, আমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন হবে। আচ্ছা, তাহলে আপনি এই ছত্রটির পাদ পূরণ করুন তো।
‘আকাশেতে শিবা হুয়া হুয়া করে।’
পণ্ডিত মশায় তখুনি কবিতায় তার উত্তর শুনিয়ে সকলকে চমৎকৃত করে দিলেন। —জ্যোৎস্নালোকিত রাত্রিতে গৃহছাদে দম্পতি নিদ্রামগ্ন। হনুমান সে সময় অরণ্য সমাবিষ্ট গন্ধমাদন পর্বত স্বন্ধে আকাশপথ অতিক্রম করছেন। হঠাৎ বধূটি জাগ্রত হয়ে স্বামীকে ডেকে বলল: “ওগো শুনছ! আকাশেতে শিবা হুয়া হুয়া করে, ইত্যাদি।” উত্তর শুনে বঙ্কিমচন্দ্র সর্বপ্রথম তাঁর পিতামাতা ব্যতিরেকে অতিরিক্ত একজনের পদধূলি গ্রহণ করলেন।
বঙ্কিমচন্দ্রের প্রচ্ছন্ন ব্রিটিশ বিদ্বেষের উপর লক্ষ্য রাখার জন্য ভারতে সর্বপ্রথম গোপন নথি রক্ষা [C. C. Role] প্ৰথার সৃষ্টি হয়, এতে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে এ-কথাও লেখা ছিল যে, ঐ অসীম প্রতিভাধর পুরুষ ইংল্যাণ্ডে জন্মগ্রহণ করলে নামী ব্যক্তি হতেন। পরে এই গোপন নথিরক্ষা প্রথা সমগ্র পৃথিবীতে গৃহীত হয়। তার জীবদ্দশাতে গ্রামাঞ্চলে আধি-ব্যাধির প্রকোপ পরিলক্ষিত হয়। রেল লাইন স্থাপনের জন্যে খালগুলির মুখ ছিল বন্ধ। বঙ্কিমচন্দ্র বুঝেছিলেন যে এরূপ অবস্থার বাঙালীর লাঠি বেশীদিন তাদের ধন-প্রাণ-মান রক্ষণে সক্ষম হবে না। উনি স্বগ্রাম কাঁঠাল পাড়া, সংলগ্ন গ্রাম দেউল পাড়া, কুটুম্বগ্রাম মাদরাল ও শ্বশুরালয় নারাণপুর গ্রাম চতুষ্টয়কে একত্রিত করে সেখানে একটি স্থানিটেশান কমিটি নামক সংস্থা স্থাপন করেন। পুষ্করিণী সংস্কার, জঙ্গল পরিষ্কার ও পথ ঘাটের ব্যবস্থা সদস্যদের প্রদত্ত চাঁদায় সমাধা হতো। মাদরাল গ্রামে আমাদের বাড়িতে এর অফিস ছিল। জ্যেষ্ঠতাত রায়বাহাদুর কালিসদয় পাঠ্যদশায় এর শেষ সেক্রেটারী ছিলেন। এই বেসরকারী কমিটির একটি বাৎসরিক রিপোর্ট পেয়ে জেলা হাকিম গভর্ণমেন্টকে প্রতিবেদন পাঠালেন। এরই কিছুকাল পরে সমগ্র বাংলাদেশে বঙ্কিমচন্দ্র-নির্দেশিত পথে গভর্ণমেন্ট প্রবর্তিত ইউনিয়ন কমিটিগুলি স্থাপিত হ’ল। কিন্তু এর ফলাফল সামগ্রিকভাবে শুভ হয় নি। ভোটাভুটির ফলে গ্রামে স্বতঃস্ফূর্ত নির্বাচন বাতিল হ’ল। এর দ্বারা দলাদলি বৃদ্ধি পায় ও গ্রামীণ চিরাচরিত শান্তি বিঘ্নিত হয়।
কিন্তু ইউনিয়ন বেঞ্চগুলি সে-সময় এদের উপকারে আসে। তিনজন মানীগুণী ব্যক্তি অবৈতনিক হাকিম মনোনীত হতেন। প্রাথমিক বিচার সম্পর্কে তিনজন বা পাচজন বিচারকের একত্রে বিচারকার্য পরিচালনা প্রাচীন ভারতীয় প্রথা। তিন ব্যক্তিকে একত্রে প্রভাবিত করা সম্ভব নয়। এঁরা সম্ভবমতো মামলা মিটমাট করতে বাধ্য করাতেন। এদের বিচারের বিরুদ্ধে কম ক্ষেত্রেই আপীল হয়েছে। নগরে গ্রামে গঞ্জে পল্লীতে এগুলি পুনঃপ্রবর্তিত হলে উৎকোচ গ্রহণের পরিমাণ হাস পাবে। বহুক্ষেত্রে এরা একত্রে সরজমিন তদন্ত করে সত্যমিথ্যা প্রমাণ করতেন।
[বিঃ দ্রঃ] মৌর্যপূর্বে গ্রন্থকার বৃহস্পতির গ্রন্থে বিবৃত আছে যে ভারতে জনৈক বিচারক তিনজন মানীগুণীর সাহায্যে বিচার করতেন। উপরন্তু সেনানিবাসে সৈনিকদের বিচারের জন্য পৃথক বিচারালয় ছিল। ভারত কোষ দ্রষ্টব্য। বিচার করা অপরাধী, দোষী বা নির্দোষ বলে দিলে রাজা তাদের কম বেশী দণ্ড দান করতেন।]
[বাংলাদেশে জমিদারী শাসনকালে দু‘ধরনের আদালত ছিল, যথা—গ্রাম পঞ্চায়েত বা নিম্ন আদালত এবং ভ্রাম্যমাণ ব্রাহ্মণ উচ্চ আদালত। জমিদারদের ‘প্রধান দেওয়ান’শেষ আপিল শুনতেন। ইংরাজ প্রশাসকরা বিচার অধিগ্রহণ করে কিছুকাল এই ভ্রাম্যমাণ দেওয়ানী ও ফৌজদারী আদালত অক্ষুণ্ণ রেখেছিল। পরে এরা নির্দিষ্ট স্থানে একক বিচার-পদ্ধতির প্রচলন করে বিচার-বিভ্রাটের সৃষ্টি করে। অনুপোযুক্ত হওয়া সত্ত্বেও এখনো সেই বিদেশী বিচার পদ্ধতি এ-দেশে পরিত্যক্ত হয় নি।]
গ্রামের স্ব-নির্ভর লোকেরা কিন্তু দেশে কাদের রাজত্ব চলছে তার কোন খবরই রাখতো না। গ্রামে ব্রিটিশ পুলিশ তদন্তে এলে কিম্বা কেউ ওদের আদালতে বিচারপ্রার্থী হলে সমগ্র গ্রামের অপমান বলে ধরে নেওয়া হ’ত। ব্রিটিশ পুলিশ গ্রামে এলে কোন সাক্ষী পেত না। তখনো কৃষক সমাজের একটি চিরাচরিত অভ্যাস ছিল, গ্রামীণ বিবাদ গ্রামেতেই মিটিয়ে নিতে বাধ্য করা। গ্রামীণ সমাজ তখনো শক্তিহীন নয়। কেউ আঘাত হানলে তার প্রতিঘাত করার ক্ষমতা ছিল।
গ্রাম্য সমাজ-ব্যবস্থার রদবদল না হওয়ায় বাংলা প্রদেশ পুলিশের কোনও পরি বর্তন হয় নি। এরা কিছুটা নবাবী আমলের ঘাঁটি দখলকারী পুলিশের মতো থেকে যায়। দশ বিশ মাইল দূরে দূরে স্থাপিত ব্রিটিশ থানার জন বারো ঘাঁটি দখলকারী পুলিশ অতি অকিঞ্চিৎকর। আত্মরক্ষার জন্য গ্রামের মানুষ তাদের শরণাপন্ন হওয়া অবান্তর মনে করতো। কিন্তু শহরগুলির ক্ষেত্রে এ-ধারণা পোষণ করা যেত না। নগর-পুলিশ ক্রমান্বয়ে জটিল হয়ে ওঠে। কেউ শহরে এলে বুঝতে পারতো যে তারা পরাধীন জাতি। গ্রামীণ সমাজে পুলিশের কোন প্রয়োজন ছিল না। তারা বিনা পুলিশে আত্মরক্ষা করতে সক্ষম ছিল।
গ্রামীণ পুলিশ
চৌকিদার ও দফাদার প্রভৃতি গ্রামীণ পুলিশ নামে অভিহিত হ’ত। জমিদারদের পুলিশী ব্যবস্থা ব্রিটিশরা ভেঙে দিলেও চৌকিদারদের বহাল রাখে। ওরা স্থানীয় লোক হিসেবে গ্রামবাসীদের সমীহ করে। স্থানীয় ইউনিয়ন কমিটিগুলি এদের সামান্য বেতন দিত। কিন্তু ঐ চৌকিদার ও দফাদারগণ থানা ইন্চার্জদের হুকুম শুনতে বাধ্য। সমগ্র ভারতের পরিসংখ্যান তৈরির ভার এরা নেয়। এদের প্রেরিত পরিসংখ্যানের ওপর নির্ভর করে রাষ্ট্রীয় ভাবনা নির্ধারিত হ’ত। বরং উচ্চ বেতন, ভোগী রাজপুরুষদের সংগৃহীত পরিসংখ্যান বিশ্বাসযোগ্য হ’ত না। এজন্য ওদের উপহাস করে নিম্নোক্ত গণ-গল্পটির সৃষ্টি হয়।
“কোন এক জেলা হাকিমের ওপর তার এলাকার গাধার সংখ্যা নিরূপণের হুকুম হ’ল। কিন্তু ঐ পরিসংখ্যান পাঠানোর তারিখে ইংরাজ সাহেবের এ-কথা স্মরণে এলো। কৈফিয়ৎ এড়াতে উনি তার হেড ক্লার্কের শরণাপন্ন হলেন। ঐ হেড ক্লার্ক দশ মিনিটে সমগ্রে জেলার গাধার সংখ্যা তাঁকে জানালেন এবং বললেন, ‘গত সেনসাসে (Census) ধোপার সংখ্যা এত ছিল। ওদের মধ্যে ত্রিশ শতাংশ ধোপার গাধা না থাকার কথা। বাকি সত্তর শতাংশ ধোপার গাধার সংখ্যা এত হবে।’ সাহেব এতে খুশী হয়ে তাঁর ঐ হেড ক্লার্ককে বলেছিলেন, ‘চমৎকার!” তারপর উনি নিজের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললেন—‘এ্যাড, এ্যানাদার’। ‘অর্থাৎ আমিও আর একটি গাধা। এমন সহজ পন্থাটি তাই বুঝতে পারি নি।” প্রতি সপ্তাহে একদিন চৌকিদার থানায় এসে নিজ নিজ গ্রামের জন্ম মৃত্যু, জনসংখ্যা, উল্লেখ্য ঘটনা ও শক্ত উৎপাদনাদির সংবাদ জানাতো। এদের প্রদত্ত পরিসংখ্যানের ওপর নির্ভর করে বহু সরকারী পলিশি নির্ধারিত হয়েছে। লাট-সাহেবের স্পেশান ট্রেন পাহাবা দেবার জন্যে এদেরকে দিবারাত্রি রেল লাইনের ধারে থাকতে দেখা গেছে। এর জন্যে এদের অনেকে সর্প দংশনে বা ব্যাঙের আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছে। কেউ কেউ তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থার জন্য ট্রেনের দ্বারা চাপা পড়েছে। এভাবে এদের বাৎসরিক ভাগ্য নির্ধারিত হত।]
[তৎকালে গভর্ণর তথা লাটবাহাদুররা প্রায়ই কলকাতা থেকে নদী পথে ঢাকা পরিদর্শনে যেতেন। বাংলা পুলিশের দারোগাবাবুদের সফরের আগে মাসাধিককাল নিরাপত্তা নিরূপণের জন্য ষ্টিমারে কিংবা বোটে সুন্দরবনের জলপথে ঢাকা থেকে কলিকাতা যাতায়াত করতে হত]
দিনের বেলা চৌকিদার’রা নিজ নিজ গ্রামের শক্ত পাহারা দিত; গ্রামের ছাড়া গরু খোঁয়াড়ে দিয়ে সরকারের আয় বাড়াতো। রাত্রে চোর-বাতি হাতে এরা গ্রাম পাহারা দেওয়ার সময় চিৎকার করে বলতো—“ছোট বাবু! জাগলো-হো-ও-ও। ও ভট্টাচার্যমশাই! আপনি জেগে আছেন? ভয় নেই বাবু! আমরা পাহারায় আছি।” ওরা জমিদারী পুলিশে থাকাকালে নীলে ডোবানো পোশাক পরতো। এখনো তারা সেই নীল রঙা পোশাক পরে। আজও ওদের সেই আগেকার হাঁক ডাক আছে।
রেল প্রভৃতি যানবাহনের উন্নতির ফলে প্রদেশ পুলিশের দক্ষতা সম্ভবত বেড়ে যায়। এতে মূল কেন্দ্রের সঙ্গে জেলাগুলির যোগাযোগ সহজ হয়। তার ফলে গ্রামীণ পুলিশের স্ব-নির্ভর বিকেন্দ্রিত চরিত্র ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হল। প্রদেশের অভ্যন্তরে তারা বহুকাল অশ্ব, নৌকা বা পদযাত্রাকেই যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছে। ওদের পুলিশী পোশাক ছিল খাকী হাফ প্যান্ট ও সোলার হ্যাট। কলিকাতা পুলিশদের যানবাহনের অসুবিধা ছিল না। বাংলা পুলিশকে একটি ঘোড়া এবং কলিকাতা পুলিশকে একটি সাইকেল দেওয়া হ’ত। উপরন্তু কলিকাতার পুলিশদের জমকালো য়ুনিফর্ম ছিল।
কলিকাতা শহরে উল্লেখ্য রাজপথের সংযোগগুলিতে ফিড পয়েন্ট [Fixed point] কনস্টেবল কোমরে ব্যাটনসহ ডিউটি দ্বিত। অধিকন্তু রাত্রে দুটি ফিক্সড পয়েন্টের মধ্যবর্তী পথে দুজন সিপাই পদচারণা করত। বিটগুলির অলিগলিতে কিছু সিপাহী ঘোরাফেরা করত। প্রয়োজনে একজন অন্যজনকে হাঁক দিত “জুড়িদার হো!” বড় রাস্তার প্রত্যেক দোকানের তালা তারা টেনে পরীক্ষা করত। গভীর রাত্রে জেগে উঠে লোকে শুনতে পেত টহলদারী শাস্ত্রীর ভারী বুটের শব্দ। অন্যদিকে তাদের অফিসাররা সারারাত পালা করে বিটে বিটে রাউণ্ড দিয়েছে ও তাদের পকেটবুক চেক করে সই দিয়েছে। জমাদারগণ প্রায় পল্লীর ঝগড়া-বিবাদ মেটাতো। লাল পাগড়ী ও শ্বেত পোশাক পরা যষ্টিধারী সিপাইদের বেল্ট বা পেটী ছিল গর্বের বস্তু। কেউ সাসপেণ্ড হলে তাকে তাদের ঐ নম্বর যুক্ত বেন্ট খুলে দিতে হ’ত। এই সুন্দর পাহারার ব্যবস্থা স্বাধীনতার কিছুকাল পূর্ব পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। প্রয়োজন হলে লোকে বিট থেকেও সিপাহীদের ঘটনাস্থলে ডেকে নিয়ে যেত।
কলিকাতা শহরের তৎকালীন আরও কয়েকটি সুদৃশ্য অধুনা অস্তর্হিত। প্রতিটি বিকেলে একদল কর্পোরেশন কর্মী লম্বা পাইপযোগে পথিপার্শ্বে হাইড্রেনগুলি থেকে জল তুলে সমগ্র পথ ধৌত করে ধূলি মুক্ত করত। ঐ সকল কর্মী এবং হাইড্রেনগুলি এখন কোথায়? পথের ধারে দমকল ডাকার টেলিপোস্ট বসানো ছিল। কোথাও আগুন লাগলে লোকে ওদের মুখের কাচ ভেঙে ভিতরের হ্যাণ্ডেল ঘোরাতে।। পথের গ্যাস-বাতি জ্বালানোর জন্য কর্মীদের মই ঘাড়ে ছোটাছুটি নিত্যকার দৃশ্য ছিল। পোর্ট কমিশনারের মতো কলিকাতা কর্পোরেশনের ও ময়লা ফেলার জন্যে নিজস্ব রেলপথ ছিল। লোক জাগার আগে ঐ গাড়ি ময়লা নিয়ে ধাপার পথে পাড়ি দিত। ওদের পরিপূরক।ঘোড়ায় টানা ময়লার গাড়িগুলোর বিকল হবার সম্ভাবনা ছিল না। ওগুলোর পুনঃপ্রবর্তনের বিষয় ভেবে দেখা উচিত। রাস্তা ঘাটের সংখ্যা প্রায় একই আছে। এদের ট্যাক্স (tax) বিশ গুণ বেড়েছে। তৎকালে ভদ্রনারীরা জানলার খড়খড়ি তুলে ঘোড়ার গাড়িতে যাতায়াত করত। পুরুষের অবর্তমানে গৃহতল্লাসীর কাজ সাধারণতঃ এড়িয়ে যাওয়া হ’ত। নিতান্ত প্রয়োজনে পুরুষের সাহায্যে পুলিশ মহিলাদের সঙ্গে কথা বলেছে। মহিলাদের সাক্ষী বা আসামীরূপে আদালতে নেওয়া হ’ত না। হিন্দুনারীর এবং দেবতার সম্মান রক্ষণে ইংরাজ রাজপুরুষরা তখনো তৎপর ছিল। এ-দুটি গুণের জন্য ‘ওদের জনপ্রিয়তাও ছিল অপরিসীম।
কলিকাতা
পশ্চিম ভারতে ও অন্যত্র কানপুর, লক্ষ্ণৌ, মিরাট, এলাহাবাদ, আগ্রা, বেনারস, পাটনা, রাঁচী, গয়। প্রভৃতি প্রতিটি শহরই সর্ব বিষয়ে কেউ কারও চেয়ে ছোটো বা বড়ো নয়। এজন্য এদের চারপাশের গ্রামগুলি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়ে লাভবান হয়েছে। কিন্তু রাঢ় বঙ্গের দুর্ভাগ্য এই যে কলকাতা একটি মাত্র বৃহৎ নগর। চতুপার্শ্বের গ্রামগুলির রক্ত শোষণ করে এই বিরাট মহানগীর সৃষ্টি হল। এতে লাভ অপেক্ষ। সেখানে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির পরিমাণই বেশী। বহিরাগতদের খাদ্য ও অর্থ ঘুগিয়ে সাধারণ বাঙালী নিঃস্ব হল।
ইংরাজদের প্রথম দেওয়ান গোবিন্দরাম তৎকালীন কলিকাতা নগর রাষ্ট্রে তাঁর তিনজন নায়েব দেওয়ানের অধীনে স্থল ও জল পুলিশ, বিচার ব্যবস্থা ও পৌরসভা গড়ে তোলেন। অবশ্য ইউরোপীয়দের বিচার ব্যবস্থা যথাক্রমে বণিকদের এজেন্ট ও প্রেসিডেন্ট ও পরে কলিকাতার গভর্নরের দ্বারা সমাধা হতো। পরে কলিকাতায় প্রেরিত ইংরাজ মেয়র ও তাঁর অলডারম্যানরা ইংরাজদের বিচারের ভার নেন। ঐ সময়ে কলিকাতাতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পৌরসভা কেন্দ্রীয় পৌরসভার অধীনে থানা ওয়ারী ভাবে বিকেন্দ্রিত ছিল। প্রতিটি পল্লী তার থানা, পুলিশ, বিচার ও পৌরসভা সংক্রাস্ত ব্যাপারে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। আজও কলিকাতার প্রেসিডেন্সী হাকিমরা থানা পুলিশে নথি পাঠানোর সময় লিখে থাকেন—‘A’-টাউন বা ‘B’ টাউন টু এনকোয়ার। ‘A’ টাউন অর্থে শ্যামপুকুর থানা। ‘B’ টাউন অথে জোড়াবাগান থানা। ঐ ভাবে আজও বিভিন্ন টাউন অর্থে ‘C’= বটতলা, ‘D’ = বড়বাজার, ‘E’=জোড়াসাঁকে!, ‘F’= আমহার্স স্ট্রীট, K = পার্ক স্ট্রীট প্রভৃতি থানাকে বোঝানো হয়। অবশ্য এগুলির সঙ্গে যোগাযোগের জন্য উর্ধ্বতনদের অধীনে কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলি ছিল। সর্ববিষয়ে বিকেন্দ্রিত প্রশাসন প্রাচীন ভারতীয় প্রথা। তৎকালে থানা, পুলিশ, অগ্নিনির্বাপণ, পশু নিধন ও ধুতিকরণ বিচার ব্যবস্থা প্রায় অভিন্ন ছিল। এ বিষয়ে এই পুস্তকের প্রথম খণ্ডে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে]
পলাশীর যুদ্ধের পর কলিকাতা সহ সমগ্র বাংলার প্রশাসন লর্ড ক্লাইভের প্রধান দেওয়ান রাজা নবকৃষ্ণ-র অধীন হয়। যুদ্ধকালে পলাতক ইংরাজ মেয়র ও তার অল্ডারম্যানগণ ফিরে এলে সমগ্র বাংলার শাসক দেওয়ান নবরুফের অধীনে নিযুক্ত হন। কলিকাতার পুলিশের বিচার ও পৌরসভা এঁদের অধীনস্থ হলেও প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রাজা নবরুষ্ণের হাতে থাকায় ওঁরা অনাচারী হন নি। কিন্তু বাংলার প্রধান দেওয়ান মহারাজা নবকৃষ্ণের বিদায়ের পর ওঁরা অত্যাচারী হলেন। গণ-বিক্ষোভের ফলে ওদের বিদায় নিতে হয়েছিল। ওঁরা বিদায় নিলে কলিকাতা পুলিশ, বিচার ও পৌরসভা জনৈক ইংরাজ চেয়ারম্যান ও তাঁর সহকর্মীদের তদারকিতে একটি কনসারভেন্সীর অধীন হ’ল। চব্বিশ পরগণার জমিদারী ও তার পুলিশ অধিগৃহীত হলে চব্বিশ পরগণার মতো কলিকাতা শহরকেও একটি ম্যাজিস্ট্রেটের অধীন করা হ’ল। এই ম্যাজিস্ট্রেটের নিয়ন্ত্রণে ‘জাষ্টিস অব পিস’-দের তিনটি সংস্থার অধীনস্থ পুলিশ, বিচার ও পৌরসভা থাকে। পরে পৃথক পৃথকভাবে ম্যাজিস্ট্রেটদের অধীনে বিচার বিভাগ, জনৈক চেয়ারম্যানের অধীনে কলিকাতা করপোরেশন এবং পুলিশ কমিশনরের অধীনে কলিকাতা পুলিশ নির্দিষ্ট হয়। এই পুস্তকের প্রথম খণ্ডে এ-বিষয়ের ধারাবাহিক বিষদ বিবরণ উল্লিখিত হয়েছে।
[বি. দ্র.-বাঙালী জমিদার তথা ভূইয়া শাসকদের ফৌজ লর্ড ক্লাইভ বাতিল করে দিয়েছিলেন। তাদের বিচার-ব্যবস্থা লর্ড হেস্টিংস এবং তাদের জাতীয় পুলিশ লর্ড কর্নওয়ালিশ রহিত করেছিলেন। এইভাবে ধীরে ধীরে বাঙালীদের সম্পূর্ণ পরাধীন জাতিতে পরিণত করা হয়।]
ট্রাফিক পুলিশ
কলিকাতায় প্রথম স্থল ও জ্বল পুলিশের স্রষ্টা বাবু গোবিন্দরাম। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীতে শহরে পৃথক ট্রাফিক পুলিশ না থাকায় ঐ সময় থানা পুলিশই স্ব স্ব এলাকায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করত। প্রধানতঃ ঘোড়ায় টানা ট্রামই তৎকালে শহরে পরিবহণের কাজে ব্যবহৃত হ’ত। ধর্মতলার মোড়ে গাড়ির অস্ট্রেলিয়ান হর্সগুলি বদল করা হ’ত। ঐ সঙ্গে কিছু পুস-পুস্ (Push) যান, ঘোড়ার গাড়ি, স্টেজক্যারেজ ও পালকী ছিল।
১৯০৪ খৃষ্টাব্দে ইংল্যাণ্ড থেকে ৫০টি মোটরকার কলকাতায় আমদানি হ’ল। কিছু পরে ঘোড়ায় টানা ট্রাম প্রথমে বাষ্পচালিত হয়। শহরে ইলেকট্রিক ট্রামের প্রচলন হয় অনেক পরে। গ্যাসবাতির আলো ম্যান্টেল যুক্ত করে আরো উজ্জ্বল হ’ল। ক্রমশঃ শহরে বৈদ্যুতিক পাখা ও আলোর ব্যবহার হতে থাকে। পুলিশের থানাগুলিতে রেড়ীর তেলের প্রদীপ উঠে গেল। তার জায়গায় গ্যাসবাতি ও ইলেট্রিক হ’ল। উচ্চশ্রেণীর লোকদের বাড়িতে ঝাড় লণ্ঠনের বদলে ইলেকট্রিক এ’ল। তাঁদের কক্ষস্থিত টানাপাখাগুলির স্থান অধিকার করল বৈদ্যুতিক পাখা। কলের জলের কল্যাণে গৃহস্থ বাড়িগুলির মতো থানার পাতকুয়াগুলি বুজিয়ে ফেলা হয়। ইলেকট্রিক ট্রাম সম্পর্কে নিম্নোক্ত গাল গল্পটি ঐ কালে রচিত হয়েছিল:-
‘চারজন মাপ ধনী তরুণ ঘোড়ার বগী গাড়ি করে বাড়ি ফিরছিল। হঠাৎ ঝড়-বৃষ্টিতে ঐ গাড়ির চাকা চারটি ট্রামের দুটি লাইনে আটকা পড়ে বসে গেল। ওদিকে বরা ছিড়ে গাড়ির ঘোড়াটিও গড়ের মাঠে দৌড় দিয়েছে। সহিস ও কোচ-ম্যান তাকে ধরবার জন্যে মাঠে নামল। মাপ তরুণ চতুষ্টয় নীচে নেমে গাড়িটি ঠেলতে থাকে। কিন্তু গাড়ি এগোয় না একচুলও। এক বৃহৎ টিকি তথা শিখাধারী ব্রাহ্মণ নামাবলী গায়ে চৌরঙ্গীতে হাঁটছিল। ঐ চার মাতাল তাকে বলপূর্বক গাড়ির ছাদে তুলে দাঁড় করাল। অতঃপর তারা ব্রাহ্মণের মস্তকের শিখাটি ওপরে ঝোলানো ট্রামের ইলেকট্রিক তারে ঠেকাতে চেষ্টা করল। তাদের ধারণা, ছাদে দণ্ডায়মান ব্রাহ্মণের শিখাটি ট্রামের বৈদ্যুতিক তারে ঠেকানে ঐ গাড়ি ট্রামের মতো চলবে। প্রহরারত পুলিশ ব্রাহ্মণের পরিত্রাহী চিৎকারে ছুটে এসে তাকে উদ্ধার করে।
খৃষ্টান পাদ্রীরা ইংরাজী শিক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের খৃষ্টধর্মে দীক্ষিত করতে তৎপর হ’ল। নব সৃষ্ট ব্রাহ্মধর্মের দ্বারা প্রভাবিত না হলে শিক্ষিত ধনীরা খৃষ্টান হ’ত। অন্যদিকে ইংরাজী শিক্ষার প্রভাবে অনেকে মদ্যপানে অভ্যস্ত হয়। ফলে থানায় পেটি কেসের সংখ্যা বেড়ে যায়। এর প্রতিবাদ স্বরূপ নিম্নোক্ত পপগল্পটির সৃষ্টি হয়।
‘এক জমিদারের ইংরাজী শিক্ষিত পুত্র স্বগৃহে মদ্যপান শুরু করল। জমিদার প্রমাদগুণে তাঁর কুলগুরুকে পুত্রের সংশোধনার্থে গৃহে আনলেন। ঠিক হ’ল পুজ মদ্যপান ত্যাগ করলে উনি এক সহস্র মুদ্রা পাবেন। লোভাসক্ত ব্রাহ্মণ তাকে নানা শাস্ত্রের বাণী শুনিয়ে মাপানে বিরত করাতে চাইলেন। শেষ পর্যন্ত তাকে পায়ে ধরে সাধলেন। ঐ তরুণ কুলগুরুর প্রতি দয়াপরবশ হয়ে তাঁর সঙ্গে শর্ত করলেন—গুরুদেব তিনদিন তিনরাত তরুণের গৃহে বসে মদ্যপান করলে তিনি মদ্য পান ত্যাগ করবেন। ঐ তরুণ মাপান থেকে বিরত হলেও গুরুর পক্ষে পানপাত্র ত্যাগ করা সম্ভব হয় নি।
স্যার সুরেন্দ্রনাথ
বৃহৎ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে সুরেন্দ্রনাথ পুরোভাগে এসে নেতৃত্ব দেন। সিভিলিয়ান বৃত্তিতে ইস্তফা দিয়ে তিনি দেশবাসীর মাঝখানে ঋজু বলিষ্ঠ পদক্ষেপে এগিয়ে এসে—–উদাত্ত কণ্ঠে গর্জে উঠলেন, ‘আই উইল সেক্ দি ফাউণ্ডেসন অব ব্রিটিশ এম্পায়ার,’ অর্থাৎ ‘আমি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মূল ভিত্তি নড়াবো।’ তাঁর হাত থেকে ‘নেশন ইন মেকিং’ গ্রন্থটি নেওয়ার সময় মহাত্মা গান্ধী স্বীকার করেছিলেন যে, বাল্যে ও যৌবনে তাঁর বক্তৃতা পাঠে তিনি দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ হন। অসহযোগ ও সশস্ত্র বিপ্লব দু‘টিই বঙ্কিমচন্দ্র প্রদর্শিত পন্থা ছিল। ক্রমে বিলাতী বস্ত্র বর্জন ও দহন এবং ইংরাজ পীড়ন শুরু হ’ল। আমি বিচিত্রা সম্পাদক উপেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলীর মুখে শুনেছি যে, একদিন সুরেন্দ্রনাথ সংবাদ শোনার জন্যে সবন্ধু এক স্থানে অপেক্ষা করছিলেন বঙ্গভঙ্গ রদের সঙ্গে খবর এল যে, রাজধানী কলিকাতা থেকে দিল্লীতে স্থানান্তরিত হ’ল। উপরন্তু বাংলার উল্লেখ্য অংশ বিহার ও আসামের অন্তর্ভুক্ত। এই বার্তা শুনে সুরেন্দ্রপথ ব্যাকুল হয়ে ‘হায় হায়’ করে উঠেছিলেন। সুরেন্দ্রনাথ বুঝলেন, তাঁদের সংযত হয়ে ধীর পদক্ষেপে অগ্রসর হতে হবে। সম্মুখের পঞ্চাশ বছরে কি ঘটবে তা বুঝতে পারা ব্যক্তিরাই প্রকৃত রাজনীতিবিদ, উনি বুঝেছিলেন যে, সাম্প্রদায়িক ভেদনীতির দ্বারা ব্রিটিশ বাংলাকে পঙ্গু করে দেবে। এজন্য সাময়িক ভাবে রাজ-নীতিতে মধ্যপন্থা দ্বারা সম্ভব মতো ক্ষমতা করায়ত্ত করা দরকার। কিন্তু উগ্রপন্থীরা তা না বুঝে তাঁর নেতৃত্বকে অস্বীকার করে বাঙালী হিন্দুদের চরম দুর্দশা ঘটায়। তিনি বুঝেছিলেন যে, অর্ধসংখ্যক জনগণের দ্বার। প্রকাশ্য বিদ্রোহ সহস। ফলপ্রসূ হবে না। তাঁরই প্রচেষ্টায় নতুন কর্পোরেশন আইনে কংগ্রেসীরা কর্পোরেশন দখল করেন। কিন্তু অকৃতজ্ঞ বাঙালীরা তাকে ভোট পর্যন্ত দেয় নি। বাঙালীরা চোখের জলে সে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছে। তিনি ধৈর্য সহকারে উপযুক্ত সময়ে অগ্রসর হওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। তাঁরই চেষ্টায় ভারতকে কিছু ক্ষমতা ইংরেজরা হস্তান্তরিত করে। দ্বৈতশাসনের মন্ত্রীরূপে কলিকাতার মেয়র পদটি তিনি পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করেন।
বঙ্গভঙ্গ রদের পূর্বে ব্রিটিশ সুরেন্দ্রনাথ প্রবর্তিত স্বদেশী আন্দোলনকে প্রচণ্ড দাপটে দমন করেছিল। কিন্তু তার ফল তাদের পক্ষে শুভ হয় নি। প্রকাশ্য আন্দোলন বঙ্কিমের পরিকল্পনা মতো গুপ্ত সশস্ত্র আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে অনতিবিলম্বে। সে-সময় উহা প্রস্তুতির পর্যায়ে থাকলেও বেশ কিছু পরে তার ক্ষমতা বোঝা যায়।
[লালবাজারে তখন কেবল পূর্ব ও উত্তর দিকের বিল্ডিং দুটি ছিল। প্রাচীর ঘেরা প্রশস্ত প্রাঙ্গণে পুলিশ ও দমকলের প্যারেড হ’ত। লর্ড কারমাইকেল অশ্বারোহণে এসে ঐ প্যারেড দর্শন ও স্যালুউট গ্রহণ করতেন। এর বহু পরে পশ্চিম দিকের বিল্ডং তৈরী হয়।]
সংযুক্ত তথা সুবা বাংলায় পুলিশ ট্রেনিং কলেজটি প্রথমে ভাগলপুরে ও পরে রাঁচীতে ছিল। সেখানে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার কর্মীদের সাথে কলকাতার পুলিশদেরও একত্রে ট্রেনিং দেওয়া হ’ত। ঊর্ধ্বতন পুলিশকর্মীদের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাও একই সঙ্গে ছিল। নিম্নপদী দেশীয় ইন্সপেক্টরদের উপর উচ্চপদী ইংরাজদের শিক্ষা হলেও উভয়ের মধ্যে প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্কের হেরফের হয় নি। এ-সম্পর্কে তৎকালে মধ্যপদী অফিসারদের দ্বারা বানানো একটি গণ-গল্প নিম্নে উদ্ধৃত করা গেল।
‘এক দেশীয় রাজ্যের রাজপুত্রকে শিক্ষাদানের জন্য গুরুমশাই নিযুক্ত হলেন। রাজপুত্র রাজছত্রের তলায় সিংহাসনে সমারূঢ় হয়ে পা দোলাতেন। গুরুমশাই নিম্নে হাটু গেড়ে বসে করযোড়ে তাঁকে বলতেন, ‘মহারাজ, ‘ক’ বলিতে আজ্ঞা হউক।’ দেশীয় অধীনকর্মীদের দ্বারা উচ্চপদীদের পড়ানো ঐ রকমই হ’ত।
[কিন্তু এতে খুব ক্ষতি বৃদ্ধি ছিল না। কোন এক অনগ্রসর শ্রেণীর তরুণ দৈবাৎ গ্র্যাজুয়েট হয়। গভর্ণমেন্ট ভেবেই পায় না, তাকে কি পদ দেওয়া হবে। প্রথমে তাকে এক সরকারী কলেজের অধ্যাপক করা হ’ল। অনতিবিলম্বেই সব দিক থেকে তার অক্ষমতা প্রমাণিত হ’ল। তখন তাকে কর্তৃপক্ষ ডেপুটী ম্যাজিস্ট্রেট করলেন। হাইকোর্ট থেকে পুনঃ পুনঃ স্ট্রিকচার হলে তাকে পুলিশ সুপার করা হ’ল। তখন তার কাজ হ’ল চিবিয়ে চিবিয়ে ইংরাজী বলা, শিকার ও ভ্রমণ করা এবং কয়েকটা টাইপ করা কাগজে সই করা। এবার আর চাকুরী রক্ষার অসুবিধা নেই। সাধারণতঃ বলা হ’ত, দেশীয় ধনীদের মূর্খ পুত্র সাব রেজিস্ট্রার ও ইংরাজ ধনীদের মূর্খ পুত্র পুলিশ সুপার হয়। অবশ্য এখানে মূর্খ বলতে অল্পশিক্ষিত।]
[বিঃ দ্রঃ-সাম্রাজ্য রক্ষা ও স্বজন পোষণের জন্য পুলিশ এদেশে তিনটি অর্ডার অফ, সার্ভিস তৈরি করেন। যথা-(১) অল ইণ্ডিয়া তথা ইমপিরিয়াল (২) প্রভিন্সিয়াল সার্ভিস (৩) সাব অর্ডিনেট সার্ভিস। ভারত ব্যতীত অন্য কোথাও এ ধরনের কর্ম-বিভেদ নেই। অন্যত্র সমগ্র পুলিশ মাত্র পুলিশ অফিসার ও পুলিশম্যানে বিভক্ত। একই রূপ শিক্ষা-দীক্ষা ও বংশ গরিমার ব্যক্তিদের এ-ধরনের শ্রেণী বিভাগ নিরর্থক ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত। ইউরোপীয় তরুণদের উচ্চ-পদ দেবার জন্যই এই নিয়ম সৃষ্টি হয়।]
বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার পরে বিহার উড়িষ্যা থেকে বিচ্ছিন্ন নতুন বাংলাদেশ সৃষ্টি হ’ল। তখন বাংলা প্রদেশ পুলিশের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপিত হ’ল পদ্মাপারে সারদাতে এবং কলকাতা পুলিশের প্রশিক্ষণ শিবির হ’ল পূর্বতন ডুলাণ্ডা গ্রামের পাগলাগারদ ডুলাণ্ডা হাউসে!
বিঃ দ্রঃ-মোটর ভিহিক্যাল ও হ্যাকনিক্যারেজ ডিপার্ট তখনো কলিকাতা পৌরসভার অধীনে ছিল। এঁরাই গাড়িগুলি রেজিস্ট্রেশন করতেন এবং আয়ের জন্যে লাইসেন্স ফি গ্রহণ করতেন। পরবর্তীকালে কতিপয় পৌরপিতা এঁদের বন্ধুবর্গ বহু সাইসেন্স ফিস্ বাকি রাখেন। ফলে অন্য নাগরিকরাও তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে। পৌরকর্মীরা লক্ষ লক্ষ টাকা ফিদ্ আদান করতে অনিচ্ছুক বা অক্ষম। বাধ্য হয়ে গভর্ণমেন্ট করপোরেশনের কাছ থেকে মোটর ভিহিক্যাল ও হ্যাকনিক্যারেজ ডিপার্ট অধিগ্রহণ করে সেগুলির ভার কলিকাতা পুলিশের হাতে অর্পণ করেন। কলিকাতা করপোরেশন তার আয়ের একটা প্রধান অংশ থেকে বঞ্চিত হ’ল। অবশ্য পূর্বের মতো গরুর গাড়ি ও ঠেলা গাড়ির লাইসেন্স কর্পোরেশনের অধীনেই থাকে।
[এ-সময় বর্তমান বাংলার স্রষ্টা ডঃ বিধানচন্দ্র রায়ের সঙ্গে পুলিশী কর্মকৃত্যের একটি সুন্দর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তখন ডাক্তার বিধানচন্দ্র কিছুদিন কলিকাতা পুলিশ ট্রেনিং কলেজে ফার্স্ট এইড পড়াতেন। লর্ড কিচনারের বাঙালী ড্রাইভারকে তিনি নিজ ড্রাইভার রূপে গ্রহণ করেন। পরে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দান করলেও স্বাধীনোত্তর বাংলায় তিনি পুলিশেরই ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী হন। কলিকাতা কর্পোরেশনের সঙ্গে তিনি বিশেষভাবে যুক্ত ছিলেন।]
স্বদেশী আন্দোলন দমনের জন্য ইউরোপীয় কনস্টেবলদের সার্জেন্ট পদ দেওয়া হ’ল। ওদের সংখ্যা বাড়িয়ে দেশীয় মধ্যপদী অফিসারদের সমান করা হ’ল। বর্ণবিদ্বেষ বাড়াবার জন্যে দৃশ্যতঃ তাদের অধিক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। অথচ এদের প্রায় সকলেই অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত ছিল। সামঞ্জস্য বিধানের জন্য দেশীয়দের ইনভেষ্টিগশন স্টাফ ও এ্যাংলোদের নন-ইনভেষ্টিগেশন স্টাফ, নামে অভিহিত করা হয়। ইউরোপীয় ও এ্যাংলো সার্জেন্টদের রিভলবার থাকলেও দেশীয় কনস্টেবল ও অফিসারগণ তা থেকে বঞ্চিত হলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েও থানায় লাঠি ছাড়া অন্য অস্ত্র ছিল না। সাজেন্টদের মূল দলটিকে লালবাজারের হেড কোয়াটার্সে রাখা হয়। তবে প্রত্যেক থানায় একজন করে সার্জেন্ট বহাল হ’ল। সেখানে তাদের পদমর্যাদা হেডকনস্টেবল ও A-S-I-দের উপরে এবং দেশীয় সাব ইন্সপেকটরদের নিম্নে। বহু থানার ইনচার্জ অফিসার এবং সাব ইন্সপেকটরগণ এ্যাংলো ও ইউরোপীয় ছিলেন।
থানায় নিযুক্ত এ্যাংলো সার্জেন্টদের অন্যতম কাজ ছিল কনস্টেবল ও হেডকনস্টেবল-দের খবরদারী করা ও রাজপথের বেওয়ারিশ কুকুরদের বিষ প্রয়োগে হত্যা করা। এজন্য ওদের প্রতি সপ্তাহে কিছু হালুয়া ও বিষ যোগানো হতো। নাগরিকদের কুকুর কামড়ালে ঐ কুকুরসহ দুই সপ্তাহ ডেপুটিদের নিকট হাজিরা দিতে হ’ত। উদ্দেশ্য, কুকুরের দাতে বিষ ছিল কিনা সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া। কুকুর-দংশিত লোকদের চিকিৎসা করানোর সকল দায়িত্ব তখন কলিকাতা পুলিশের। দেশীয় অফিসারদের ওপর গোপনে এদের কেউ কেউ লক্ষ্য রাখতো এবং তাদের মধ্যে ব্রিটিশ-বিরোধী ভাব দেখলে তারা ইংরাজ ঊর্ধ্বতনদের সংবাদ দিত। ফলতঃ প্রমোশনে বাধা কিম্বা মন্দ স্থানে বদলীর ব্যবস্থা হ’ত। কাণীপুর ও গার্ডেনরীচ থানা দুটি তখন পানিশমেন্টের স্থান। ওখানে বদলী হলে বাড়িতে কান্নাকাটি পড়ে যেত।
বাংলায় রেনেসাঁসের যুগ শেষ হয়ে গিয়েছিল। এ সময় দেশে একটা সন্ধিক্ষণ চলেছে। দিকে দিকে অধঃপতন ও আত্মধ্বংসী রাজনীতি। পূর্বে বড়ো সাহেব বলতে বাঙালীকে বোঝাতো। ইংরাঙ্গরা রাজ্য জয় করলে তা চালানোর ভার বাঙালীর। সমগ্র ভারতে ও বহির্ভারতে বাঙালীরা উচ্চপদে অধিষ্ঠিত। বাঙালীর। যেখানে গেছে সেখানে তারা কালীবাড়ি ও স্থানীয় লোকদের জন্যে লাইব্রেরী ও নাট্যাভিনয়ের ব্যবস্থা করবেই। তাদের জনহিতকর কার্যগুলি ইংরেজদের জনপ্রিয় করে তোলে। কিন্তু মুলুকী আইনে তৎপ্রদেশ থেকে ধীরে ধীরে দেশে ফিরে বাঙালী দেখল, যে তাদের পরিত্যক্ত বাণিজ্য অপরের কুক্ষিগত। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পর ইংরাজর। চাইল বাঙালীর ধ্বংস।
এ-সময় নবীন ইংরেজদের মধ্যেও অধঃপতন প্রকট হয়ে ওঠে। তাদের পূর্বপুরুষরা দেশীয়দের গৃহে বিবাহে, উপনয়নে, অন্নপ্রাশনে ও পূজাপার্বণে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতো। ছোটলাটবাহাদুর পর্যন্ত হঠাৎ রবিবারে বাঙালী ছাত্রদের মেসে এসে কথাবার্তা বলতেন। পরদিন সংবাদপত্র পাঠে জানা যেত ছাত্রদের মেসে হঠাৎ আাস। সাহেব আসলে ছোট লাট। পাত্রীরা সাইকেলে চড়ে গ্রামে গ্রামে বালকদের লজেন্স দিয়েছে। কিন্তু নবীন ইংরাজদের পৃথক বসবাস ও দেশীয়দের সংসর্গ ত্যাগ তাদের মানসিক অনুদারতাকেই প্রকট করে। দেশীয়দের প্রতি তাদের অবজ্ঞা ও দত্তভাব অসহনীয় হয়ে ওঠে। ওদের ব্যবহার কিভাবে শিশুমনকে পর্যন্ত কলুষিত করেছিল তা আমার নজেরই শৈশব স্মৃতি থেকে উদ্ধৃত করে বোঝাতে পারবো।
‘দিল্লীতে কোন এক বড়লাট বিীদের বোমা থেকে অল্পের জন্যে বেঁচে গেলেন। এ জন্যে উৎসব উপলক্ষে ইংরা ও দেশীয় রাজপুরুষেেদর শিশুরা লাটভবনে নিমন্ত্ৰিত হ’ল। অন্য শিশুদের সঙ্গে আমিও সে-উৎসবে উপস্থিত ছিলাম। টবের ভেতর কাঠের কুচির মধ্যে লুকানো চকোলেট তোলার সময় ইংরাজ শিশুদের সঙ্গে হুটোপাটি শুরু হ’ল। ওরা ঘুসিতে দক্ষ হলেও চড়ে কাবু। পরদিন ঐ অভিযোগে দেশী অফিসারদের পুত্রদের ওখানে যাওয়া নিষেধ হয়ে গেল। বাড়িতে পিতামহ জ্যেষ্ঠতাতকে অনুযোগ করে বললেন, ‘ছোটরা ওরকম কত মারপিট করে থাকে তার জন্যে তোকে কৈফিয়ত দিতে হবে কেন? ফরাসী, ওলন্দাজ ও দিনেমাররা তো ওরকর্ম ছিল না; বাঙালীরা ওদের তক্তে বসাল। দেখিস, ঐ বাঙালীরাই ওদের বিদেয় করবে।’
‘বড়লাট শোভাযাত্রাসহ রেসকোর্সে আসবেন। তাঁকে দেখবার জন্যে ইংরেজ বালকদের সঙ্গে আমরাও রেলিঙের ওপর চেপে বসলাম। হঠাৎ এক দেশীয় কনস্টেবল তেড়ে এসে বলল: ‘উতারো’। আমরা ইংরেজ বালকদের দেখালে সে খেঁকিয়ে উঠে বলল: ‘উ লোককো রাজ হ্যায়। তুহোর কি রাজ আছে?’ দূরে এক এ্যাঙলো সার্জেন্ট রুলের গুঁতো মেরে দেশীয় লোক নামাচ্ছে। আমার ছোটো ভাইটি তখন সবেমাত্র ছোটদের মহাভারত শেষ করেছে। সে সব দেখল, বুঝল এবং পরে বলল, ‘দ্যাখ, দাদা, আজ ভীম আর অর্জুন বেঁচে থাকলে ওদের একবাণে শেষ করতো।
‘বড় গীর্জার পাশে পাঁচিলঘেরা জায়গায় ইংরেজ বালকরা ক্রীড়ারত। ওখানে ফটকে লেখা ‘আছে—“ভগ স্ এ্যাণ্ড ইণ্ডিয়ানস নট এ্যালাউড।’ আমরা একটু উকি দিতেই ওরা মারমুখী হ’ল। জনৈক বাঙালী ভদ্রলোক আমাদের দূরে সরিয়ে এনে বলল, ‘ঝগড়া কোরো না। বড়ো হয়ে তোমরাও ক্লাব তৈরি করে ছয়ারে লিখে রেখো: ‘ইউরোপীয়ানস্ এ্যাণ্ড বুলস্ নট এ্যালাউড।’ ভারতীয়রা ভিক্ষা করলে আইনে তারা ভ্যাগাবও। ইউরোপীয়রা ভিক্ষা করলে তারা হয় ভেগরেন্ট। ওদের তখুনি ধরে এনে ভেগরেন্ট হোমে আশ্রয় দিতে হবে। এজন্যে পুলিশের অধীনে ভেগরেন্ট হোম স্থাপিত হয়েছিল। সার্জেন্টদের সুবিধার্থে আমহার্স্ট স্ট্রীট থেকে পুলিশ হাসপাতাল বেণীনন্দন স্ট্রীটে নির্মিত গৃহে স্থানান্তরিত হ’ল। ইউরোপীয়দের গৃহে বারগলারী হলে ঊর্ধ্বতন কর্মীদের তদন্তভার নিতে হবে। এই হুকুমং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও তার পরেও অব্যাহত ছিল।
কিন্তু তা সত্ত্বেও দেশে রাজভক্তের অভাব হয় নি। যুবরাজ অষ্টম এডওয়ার্ডের ভারত আগমন উপলক্ষে তাঁর সংবর্ধনার আয়োজন করা হয় গড়ের মাঠে। তাঁর মনোরঞ্জনার্থে সেখানে ‘সা-রে-গা-মা’ লাঞ্ছিত সাতটি গাড়িতে রাগ ও রাগিণীদের মূর্ত করা হয়। একজন রাজার দুই দিকে ছয় রাণী। (এক রাগ ছয় রাগিণী) শেষ গাড়িতে সর্বাঙ্গে শ্বেত বিভূতিমাখা জটাজুটধারী ভৈরবরাগ। গুগুলোর পেছনে এক এক দল গায়ক সানাই বাদনরত। অভিনেতা ও অভিনেত্রীরা সকলেই অভিজাত বাঙালী পরিবার থেকে সংগৃহীত। ঐ তরুণ চঞ্চল যুবরাজ রেসকোর্সে নিজেই ঘোড়ায় চড়বার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। তাঁর অবিভাবক জনৈক লর্ড তাঁকে বাধা দিলেন! অবশ্য এর বিপরীত দৃশ্যও কিছু কিছু দেখা যায়। যাদের পিতারা কুইন ভিক্টোরিয়ার মৃত্যুকে মাতৃবিয়োগ মনে করে গলায় কাছা নেন তাদের পুত্রও পৌত্ররা ‘বন্দেমাতরম্’ ধ্বনি তোলে এবং ইংরাজ নিধনে মত্ত হয়।
একবার এক গোরা সৈন্যের সঙ্গে মারামারি করে বাড়ি এলে ছোটো কাকু বললেন, “ওরা ব্যবসায়িক স্বার্থে এ-দেশে আছে। ওদের মিল, ফ্যাক্টরীর পাশে মিল, ফ্যাক্টরী বানাও। তাহলেই ওরা এদেশ থেকে বিদায় নেবে।” ছোটো কাকু এই হুকুম দিয়ে বায়োস্কোপ দেখতে গেলেন। কিন্তু আমরা ভেবেই পেলাম না যে, কি ভাবে তা কার্যকরী করা যাবে।
বিঃ দ্রঃ-এ-দিক থেকে বিচার করলে মাড়ওয়ারী ব্যবসায়ীরা ধন্যবাদাই। পুলিশের লোকদেরও বোধহয় এজন্য প্রশংসা প্রাপ্য। ভারতবাসী জাগছে না। ওরা ঠেঙিয়ে তাদের জাগিয়ে দিল। বন্ধুভাবে যেমন শত্রু ভাবেও তেমনি ভগবান লাভ হয়’। প্রকৃতপক্ষে ওদেরই দ্রুত তাড়নায় দুটি বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়।]
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ
ব্রিটিশ সুপরিকল্পিতভাবে বাঙালী জাতিকে ততদিনে অসামরিক সম্প্রদায়ে পরিণত করেছে। বাঙালীর প্রতিভা তখন সাহিত্য, বিজ্ঞান ও রাজনীতিতে {হুধা বিকীর্ণ। ঠিক এই সময় বিশ্বজুড়ে প্রথম যুদ্ধ আরম্ভ হ’ল। কিন্তু নতুন সেনাদলে বাঙালীদের তখনও স্থান নেই। এই যুদ্ধে বাঙালীরা এগিয়ে এলেও মাত্র এ্যাম্বুলেন্স বাহিনীতে তাদের স্থান হয়।
আদালতে একদিন বিখ্যাত ব্যারিস্টার রাসবিহারী ঘোষকে কলিকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ওয়েল! মিঃ রাসবিহারী, জার্মানরা কলিকাতায় উপস্থিত হলে তোমরা কি করবে?’ রাসবিহারী ঘোষ একটু ভাবলেন তারপর উত্তর দিলেন, ‘মী লর্ড! আমরা তাড়াতাড়ি একটা সভা করব। তারপর নকলে মালা হাতে চাঁদপাল ঘাটে গিয়ে তাদের অভ্যর্থনা জানাবো।’ বিচারপতি দস্মিত। তিনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আর ইউ সিরিয়াস?’ উত্তরে বাগ্মী ব্যারিস্টার বলেছিলেন, ‘এছাড়া আমাদের আর কি করবার আছে? বিগত দেড়শো ছির রাজত্বে তোমরা এইটুকু মাত্র আমাদের শিখিয়েছো।
এই বাদানুবাদে তৎকালীন কর্তৃপক্ষ একটু সচেতন হলেন। তাঁরা বুঝলেন যে বাঙালীদের যুদ্ধস্পৃহা অন্যদিকে বার করে না-দিলে পরে তা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধেই উদ্দীপিত হবে। আপাতত ওদের সেনাবাহিনীতে ভর্তি করা দরকার। তবে বাঙালী বিপ্লবীদেরও সেই সঙ্গে ভর্তি হওয়ার ভয় ছিল। ইতিমধ্যে ফরাসীরা চন্দননগরে বাঙালী সৈন্যবাহিনী তৈরি করে ফ্রান্সের রণক্ষেত্রে পাঠাচ্ছে। ফরাসীরা কিছু বাঙালীকে বিমান বাহিনীতেও নিযুক্ত করেছিল। ব্রিটিশরা এবার বাঙালী-পল্টন তৈরি করে মেসোপটেমিয়ায় পাঠালো। ভেদবুদ্ধিখ্যাত ব্রিটিশ তাদেরকে তুর্কিদের বিরুদ্ধে নিযুক্ত করলো। আশ্চর্য এই যে মুশ্লিম-সম্প্রদায় এতে কোনো আপত্তি করে নি।
বহু বাঙালীর সঙ্গে কলিকাতা ও বাংলা-পুলিশের কিছু তরুণ এই বাহিনীতে নাম লেখায়। আমাদের পরিবারের দুজন তাতে যোগ দিয়েছিল। কাজী নজরুল ইসলাম প্রভৃতি কবি-সাহিত্যিকও তাতে যোগ দেয়। কলিকাতা পুলিশের জনৈক ডেপুটি কমিশনার ক্যাপটেন উড় তাদের নেতৃত্ব দেন। পরে তিনি কর্নেলরূপে খ্যাত হন। এই বাঙালী-দরদী ডেপুটি পুলিশ-কমিশনার মেসোপটেমিয়ার রণ ক্ষেত্রে প্রাণ দিয়েছিলেন। বুদ্ধিমান বাঙালীদের সেনাবাহিনীতে গ্রহণ করা ব ইংরাজের পছন্দ ছিল না। প্রতিবাদ স্বরূপ ওদের ক্যাম্পে ক্যাম্পে নিম্নোক্ত গল্পটি শোনা যেত। কারো কারো মতে ঘটনাটির মধ্যে কিছু সত্যতা ছিল।
ইংরাজ মেজর বাঙালী সেনাবাহিনীকে হুকুম দিলেন, ‘বিশ কদম সামনে এগিয়ে গুলি ছোড়।’ বাঙালী সৈন্যরা তাতে তর্ক জুড়ে দিলো, বললে, ‘স্যার, এটা ঠিক কম্যাও নয়। সামনে এগোবার প্রয়োজন নেই। এখানেই এডজাস্ট করে রাইফেলের রেঞ্জ বাড়ালেই তো হয়।’ মেজর সাহেব সেইরকম কম্যাও করতে অবশ্য পারতেন। কারণ রাইফেলে এডজাস্টমেন্টের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু এই তর্ক বিতর্কের মধ্যে অহেতুক মূল্যবান সময় চলে যাওয়ায় প্রতিপক্ষ তুর্কিদল এে ওদের সবাইকে খতম করে।
[বাঙালীদের এই অহেতুক মগজ-ব্যবহার অন্য প্রদেশেও প্রবাদ হয়ে ওঠে। এর হিন্দিভাষী প্রৌঢ়ব্যক্তি তার পৌত্রসহ নদীতীরে গাছের তলায় বসে ছিলেন। এর সময় তিনি পৌত্রকে বললেন, ‘দেখো, এই গাছের পাতা জলমে পড়বে তো শের আর ডাঙ্গামে পড়বে তো কুমীর হোবে।’ তাঁর পৌত্র বিস্ময়ে চোখ ছানাবড়া কে চুপ করে রইলো। কিন্তু জনৈক বাঙালী তরুণ তা শুনে জিজ্ঞাসা করলো, ‘লেকিন ওহী পাতা আধা-ডাঙ্গামে আউর আধা পানিমে পড়বে তো ক্য। হোগী?’ প্রৌ তখনই বলে উঠেছিল, ‘বাপস্! তুম এতনা বুদ্ধি ধরত।? তব তুম জরুর বাঙালী হোগী।’]
মগজ ব্যবহারকারী বাঙালীরা নিজেদের বিরুদ্ধেও কম স্যাটায়ার তৈরি করে নি। মধুসূদনের অমিত্রাক্ষর ছন্দকে উপহাস করে তারা লিখলো, ‘টেরিলিল সূত্রধর কাঠালেরই কাঠে।’ জগদীশর বস্তুর ‘বৃক্ষের প্রাণ’ সম্পর্কিত গবেষণাকে কটাক্ষ করে তারা লিখলো, ‘বেলফুলকে উদ্দেশ্য করে মল্লিক। ফুল বললে, দিদি, ফুটবে: নাকি?’ এমন-কি রবীন্দ্রনাথকেও তারা বাদ দেয় নি। মনীষীদের ব্যঙ্গ করা এদেব বহুদিনের অভ্যাস। বিশ্বযুদ্ধ সম্বন্ধে বাঙালীরা নিম্নোক্ত গল্পটি ক্যাম্পে প্রায়ই বলতো।
এক ভদ্রলোক ডাক্তারের কাছে গিয়ে বললে যে তার ব্রেনটা খারাপ হয়ে গিয়েছে। ডাক্তার তার রেনটা বার করে স্পিরিটের বোতলে রেখে বললেন, ‘ঠিক আছে। এটা আমি মেরামত করে রাখবো। সাতদিন পরে এসে নিয়ে যেও কিন্তু সাতমাস পরেও ও লোকটি তার ব্রেন নিতে এলো না। একদিন বাজারে তাকে দেখে ডাক্তারবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘আরে, তোমার ব্রেনটা মেরামত করে রেখেছি। কই, তুমি তো নিতে এসে না?’ ‘আজ্ঞে ওটা আমার আর দরকার নেই, লোকটি নির্লিপ্ত স্বরে উত্তর দিলে, ‘কারণ ইতিমধ্যে আমি মিলিটারিতে চাকরি পেয়েছি।’
সেবার আমাদের অফিসার হবার পরীক্ষা হচ্ছিল। কর্নেল ঘোড়ার চড়ে পরীক্ষা। নিতে এলেন। আমাকে বলা হ’ল একটা সেকসনকে কম্যাণ্ড করতে। কিন্তু কিভাবে কমাণ্ড দেব তা বুঝতে পারছি না। হঠাৎ ছুটে গিয়ে একটা সিপাহীর মাথা চেপে ধরে খেঁকিয়ে উঠলাম, ‘উজবুক কাহাকে! তুম শির হিলাতা। আভি তুহর শির তোড়েগী। আউর দাঁত উত্তর লেগী।’ কর্নেল আমার দৌড় ঝাঁপে খুশি হয়ে বললেন, ‘ঠিক হ্যায়। যাও, পাশ।’ অর্থাৎ সে যতো বড়ো বুলি, সে ততো ভালো অফিসার।
বিঃ দ্রঃ-কলিকাতাতে টেরিটোরিয়াল কোর্স স্থাপিত হলে বছরে একমাস বেতনসহ গড়ের মাঠে ক্যাম্পে বাঙালী তরুণদের ট্রেনিং দেওয়া হ’ত। কিন্তু বহু বাঙালীর এই মামুলি ধরনের সমর-শিক্ষা পছন্দ নয়। বহু কৃষক শহরে গরু কিনতে এলে ওই ট্রেনিং-এ ভর্তি হয়ে একমাস পরে গরু-কেনার খরচ তুলে গ্রামে ফিরতো। এজন্য পরে শিক্ষিত বাঙালীদের জন্য য়ুনিভারসিটি ট্রেনিং-কোর্স খোলা হয়। আমি তখন ওই বাহিনীতে যোগদান করে ওদের একজন অফিসার হয়েছিলাম।
লালদীঘির জলে বিরাট একটা হাস ভাসছে। তার পিঠে বড়ো বড়ো দুটো ডিম। হাঁসের গায়ে বাংলায় লেখা: ‘ওয়ার-বও কেনো।’ অর্থাৎ ‘তাহলে ডিম্বলাভ হবে।’ বহু ব্যক্তির আশা যে ভবিষ্যতে হোমরুল পাওয়া যাবে। দেশীয় পত্রিকায় হোমরুলকে ভীমরুল বলা হ’ত। যুদ্ধ থামলো। ওদেরই ভবিষ্যত বাণী সত্য হ’ল। হোমরুল এলো না। বাঙালী বিপ্লবীরা এই যুদ্ধ কাজে লাগিয়েছিল। তাদের আশা, জার্মান ডুবোজাহাজ অ্যামডেন তাদের জন্য সুন্দরবনে অস্ত্র নামাবে। কিন্তু এই অ্যামডেন বঙ্গোপসাগরে কয়টি ব্রিটিশ জাহাজ ডুবিয়ে নিজেও ডুবলো।
স্বদেশী আন্দোলন বাংলাদেশে ও অন্যত্র থেমে গেল। বিদেশী বস্ত্র বর্জনে গুজরাটের মিল-মালিকরা লাভবান। তারা আপন স্বার্থে কংগ্রেসকে চাঁদা দেয় ও তাকে শক্তিশালী করে। তথনও কংগ্রেসের আশা, আলোচনা দ্বারা দেশ স্বাধীন হবে। ওদিকে কিন্তু বাংলাদেশে গুপ্ত-বিপ্লবীরা তখন শক্তিশালী হতে থাকে।
দেহচর্চার অজুহাতে এখানে-ওখানে খুব আখড়া স্থাপিত হচ্ছিল। আখড়াগুলিতে দাদারা প্রথমে কিশোরদের বিবেকানন্দের লেখা ও অন্যান্য বই পড়তে দিতো। এ ভাবে তাদের দেশাত্মবোধ উদ্বুদ্ধ হলে তাদেরকে দলে নেওয়া হ’ত। শাস্ত প্রকৃতি অথচ চতুর সভ্যদের উপর ইনটেলিজেন্সের কাজ থাকতো। তারা পত্রবহন, অস্ত্র-সংগ্রহ, নতুন কর্মী রিক্রুট ইত্যাদি কাজ করতে।। যারা অতি-সাহসী ও উগ্র-প্রকৃতি তাদের হত্যা ও ডাকাতি প্রভৃতি কাজে নিযুক্ত করা হ’ত। সত্যদের মনোবল রক্ষার জন্যে দাদারা বলতো যে সুন্দরবনে তাদের বহু ঘাঁটি আছে এবং সেখানে অজস্র তরুণকে অস্ত্রশিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। তারা দেহের রক্ত দিয়ে ভুজপত্রে প্রতিজ্ঞাবাণী লিখতো। কেউ-কেউ ডাকাতির পর রসিদ দিয়ে বলেছে যে দেশ স্বাধীন হলে ‘ওই’ অর্থ ও অলংকারাদি ফেরত দেওয়া হবে। এভাবে সংগৃহীত অর্থ বেহাত হলে নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি হয়েছে। ফরাসী চন্দননগর ও জাহাজীদের নিকট হতে অস্ত্র সংগ্রহ করা হ’ত। তারা বোমা বানাতো ও বোমার দল তৈরি করতো। পুলিশের চর সন্দেহে ওরা নিজেদের লোককেও গুলি করেছে?
প্রমাদ বুঝে ব্রিটিশ সরকার সাম্প্রদায়িক বোধ সৃষ্টি করতে এজেন্ট-প্রপোগেটর নিযুক্ত করলেন। তখনও ইন্দোনেশীয় মুশ্লিমদের মতো বহু বাঙালী-মুশ্লিমদেরও ভারতীয় নাম ও আচারবিচার। উভয়ের পালা-পার্বণে উভয়ে সানন্দে যোগ দিতো। মুশ্লিম-নারীরা তারকেশ্বরে হত্যা দেয়। হিন্দু-নারীরা পীরের দরগায় সিন্নি চড়ায়। দুর্গাপূজার সময় উভয় সম্প্রদায়ই কেনাকাটা করে ও ভাসান দেখতে বেরোয়। হিন্দুদের পৃষ্ঠপোষকতায় মহরমের জাঁক বাড়ে। মুশ্লিম কৃষকর। ব্রাহ্মণদের ঠাকুর বলে ডাকে ও শ্রদ্ধা করে।
দ্বিজাতিতত্ত্ব প্রমাণের জন্য এই-সব পরিহার করার ব্যবস্থা হ’ল। মুশ্লিমদের বোঝানো হ’ল যে তাদের অনগ্রসরতার জন্য হিন্দুরাই দায়ী। তারা জানলো না যে অনগ্রসর হিন্দু ও বৌদ্ধরা মুশ্লিম হওয়াই তার কারণ। কিন্তু উন্নত হিন্দুরাও তৎকালে মুশ্লিম হ’ত। ফলে, তারা এখনও উন্নত। বিহার ও লখনউ-এর মুশ্লিমরা অর্থে, জ্ঞানে ও মর্যাদায় সেই প্রদেশের হিন্দু অপেক্ষা উন্নত। বিদেশী মুশ্লিম-শাসকরা ধর্মান্তরিত মুশ্লিমদের একটুও সুবিধা দেয় নি। কারণ ধর্মের চেয়ে গুণের বিচারই তখন রীতি ছিল। ধর্ম তখনও পরিবর্তনশীল আচারমাত্র। নৃ-বিজ্ঞান, রক্ত-বিজ্ঞান ও সমাজ-বিজ্ঞান দ্বারা বোঝান হ’ল না যে ধর্মে মুক্সিম হলেও মূলতঃ জাতিতে ওরা হিন্দু তথা ভারতীয়। তাদের বোঝানো হ’ল না যে হিন্দুদের মতো তাদের পূর্বপুরুষরাও বিদেশী সাম্রাজ্যবাদীদের রুখেছে। তাদের এ-ও বলা হ’ল না যে বহু হিন্দুও তাদেরই মতো আজও অনগ্রসর এবং দরিদ্র। তাদের বলা হ’ল না যে ধনী-হিন্দুদের দ্বারা স্থাপিত গ্রামীণ উচ্চবিদ্যালয়ে তারা শিক্ষালাভের সুযোগ পেয়েছে। তারা জানলো না যে বিদেশী মৌলভীরাই তাদের ইংরাজি শিক্ষা-গ্রহণে বাধা দিয়েছিল।
[মুশ্লিমদের উঁচুতে তুলে হিন্দুদের সমান না-করে হিন্দুদের নামিয়ে মুশ্লিমদের সমান করার চেষ্টা হ’ল। তাতে বাঙালী-হিন্দুদের অধিকাংশই বেশি করে ব্রিটিশ-বিদ্বেষী হয়ে ওঠে।]
ভারতের অন্যত্র মধ্যবিত্তদের বদলে কৃষক-শ্রেণী হতে শ্রমিক ও নিম্নপদস্থ সৈনিক ও পুলিশ ভর্তি করা হয়। এজন্য গ্রামে-গ্রামে রিক্রুটিং-স্কোয়াড পাঠানো হ’ত। চতুর ব্রিটিশরা শহুরে মধ্যবিত্ত বাঙালীদের দেখিয়ে প্রচার করে যে বাঙালী জাতি শ্রম-বিমুখ। (অন্য প্রদেশের মধ্যবিত্ত ও ধনীরা কিন্তু তাই।) বাঙালী কৃষকদের মতে। হাঁটুজলে পাট কাচতে সক্ষম শ্রমিক-সম্প্রদায় পৃথিবীতে নেই। কাধে ভারী বোঝা নিয়ে দশ-বিশ ক্রোশ পথ হাটতে বাঙালীরাই সক্ষম। চতুর ব্রিটিশ এইভাবে ধীরে ধারে বাঙালীকে দুর্বল করে দিলো।
উপরোক্ত “জহাতে ব্রিটিশরা কিছুকাল আত্মবিশ্বত বাঙালীদের পুলিশের নিম্নপদে ও আমর্ড ফোর্স-সমূহেও ভর্তি করে নি। তবে মধ্যবর্তী পদগুলিতে শিক্ষিত বাঙালীকে তারা বাধ্য হয়ে নিতে।। তাড়াতাড়ি ইংরাজি না-শিখলে এই-সব পদ থেকেও তারা বঞ্চিত হ’ত। বাংলা দেশে ভূমিস্বত্ব আইন প্রথম প্রণীত হয়। তাতে ভূমিহীন স্লষকের কিছুটা অভাব ঘটে। এদেশে তার ফল বিশেষ শুভ হয় নি। এ কারণে বাঙালীর বদলে স্টেশনের কুলি ও মুটে-মজুরের কাজগুলি অন্য প্রদেশের লোক দখল করে নেয়। অপরদিকে জমি টুকরো-টুকরো হওয়ায় কৃষিকাজও অ-লাভজনক হতে থাকে। ছোট-ছোট জমি চাষের জন্য লাঙল ও বলদ রাখা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
পুলিশ-কমিশনার হেলিডে
কমিশনার হেলিডে (১৯১০-১৯১৫) কলিকাতা-পুলিশের কমিশনার ছিলেন। এই বিভাগ পত্তনের কাল থেকে যাবতীয় কাজকর্ম বাংলায় সমাধা হ’ত। ইনি কর্মভার গ্রহণ করে বাংলার বদলে ইংরাজীতে উহ! সমাধা করার হুকুম দিলেন। ইনি রিক্রুটিং-স্কোয়াড পাঠিয়ে বিহার ও উত্তরপ্রদেশ হতে কলিকাতা পুলিশের জন্য কনস্টেবল ভর্তি করতেন।
তাঁরই নেতৃত্বে শহর কলকাতায় ও দেশের সর্বত্র বাঙালী বিপ্লবীদের দমনে পুলিশ সবিশেষ মনোযোগ দিয়েছিল। কমিশনার হেলিডে-র সময়ে কলিকাতা-পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের সর্বপ্রথম প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ ঘটে। ১৯১৩ খ্রীঃ ইনি স্বয়ং হিন্দু হোস্টেলে খানাতল্লাসীতে গিয়েছিলেন ভোররাত্রে। কিন্তু তৎকালীন ইংরাজ হোস্টেল-সুপারিনটেনডেন্টের নেতৃত্বে ছাত্ররা বাধা সৃষ্টি করায় তাঁকে সকাল না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। পরে তাঁকে বিপ্লবী মনে-করা ছাত্রটির দ্রব্যাদি মাত্র তল্লাস করতে দেওয়া হয়েছিল। শুধু সন্দেহের কারণে ছাত্রটিকে গ্রেপ্তার করতে দেওয়া হয় নি। বিনা অনুমতিতে বিশ্ববিদ্যালয়-হোস্টেলে প্রবেশের জন্য তাঁকে ক্ষমা চাইতে হয়। ভুল সংবাদ-দাতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যও তিনি প্রতিশ্রুতি দেন। হেলিডে পার্ক সম্ভবতঃ তাঁরই স্মৃতিস্মারক। তবে বাংলা ও কলিকাতার বিপ্লবী-দমনে ইনি ব্যর্থ হয়েছিলেন। এঁরই আদেশে এই কসমোপলিটন শহরে কাজের সুবিধার জন্য একজন করে কাবুলি ও পাঞ্জাবি এবং কিছু দেশওয়ালী অফিসার নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়। তৎকালে পাওয়া যায় নি বলে মাড়োয়ারী কর্মী নিযুক্ত করা হয় নি।
[এর মধ্যে কতো বোমার ষড়যন্ত্র মামলা আদালতে উঠলো এবং নিষ্পত্তি হ’ল। কতো উল্লাসকর দ্বীপান্তরে উন্মাদ হ’ল, কতো বিপ্লবী ফাঁসিতে ও সম্মুখ-যুদ্ধে প্রাণ দিলো। বারীন ঘোষ, ক্ষুদিরাম, শ্রী অরবিন্দ প্রমুখের রাজনৈতিক ইতিহাস এখানে আলোচ্য নয়। পুস্তক-বোমা, কলম-পিস্তল প্রভৃতি বিপ্লবীদের ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্রদি ও তাঁদের তরুণ-বয়সের ফটোচিত্রগুলি কলিকাতা-পুলিশ মিউজিয়মে সযত্নে রক্ষিত আছে।]
বিঃ দ্রঃ-প্রথম মহাযুদ্ধ ১৯১৪-১৮ খ্রী: পর্যন্ত চলেছিল। বাঙালীদের পক্ষপাত সম্পূর্ণ জার্মানীদের পক্ষে ছিল। জার্মানীদের পরাজয়ে বহু বাঙালী বিমর্থ হয়েছে। সরকারী খরচে পুলিশ-কোয়ার্টারগুলি আলোকমালায় সজ্জিত করা হয়। বাল্যে আমরাও না-বুঝে ছাদের উপর বিরাট বোর্ডে লিখেছিলাম: ‘ব্রেভো দা এলাইস’। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে গান্ধীজী ইংরাজদের সাহায্য করেছিলেন আফ্রিকা থাকাকালীন। তাঁর আশা ছিল, ইংরাজরা ভারতকে স্বায়ত্তশাসন দেবে। কিন্তু তা হ’ল না। উনি আশাহত হয়ে অহিংস-সংগ্রামে লিপ্ত হলেন। রাউলাট এ্যাক্টের বিরুদ্ধে তাঁর প্রথম সংগ্রাম-ঘোষণ।। এই এ্যাক্টকে উনি ‘রাক্ষুসী আইন’ আখ্যাবিভূষিত করলেও এরকম আইন কিন্তু সাধারণ আইনেও ছিল। এই উপলক্ষে গড়ের মাঠে সর্বপ্রথম লক্ষাধিক লোকের প্রতিবাদ সভা হয়। ফলে কলকাতায় যে-আন্দোলনের উৎপত্তি তার নিষ্পত্তি হ’ল পাঞ্জাবে জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডে। এই সময় থেকে কলিকাতা-পুলিশকে রাজনৈতিক আন্দোলন দমনে অধিক মনোযোগী হতে হ’ল।
গান্ধীজী কংগ্রেসকে আবেদন-নিবেদনের পথ ত্যাগ করতে নির্দেশ দিলেন। তার কয়েকটি ‘অহিংসা-আন্দোলন সমগ্র ভারতকে প্রভাবিত করেছিল। ১৯২১-২২ খ্রীঃ অসহযোগ আন্দোলনে তিনি ভাবপ্রবণ বাঙালীদেরই বেছে নিলেন। তিনি জানতেন যে বাংলায় ঢেউ উঠলে তা সমগ্র ভারতে ছড়িয়ে পড়বে। উপরন্তু বাঙালীদের বিলাতী বস্ত্র বর্জনে ও দহনে অভিজ্ঞতা আছে। প্রখর মেধার অধিকারী চিত্তরঞ্জন দাশ তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করায় সকলে বিস্মিত। এতে একদিনেই গান্ধীজী সমগ্র ভারতের স্বীকৃতি পেলেন। তাঁর ‘মহাত্মা’ উপাধিটিও বাঙালীদেরই দেওয়া।
[গান্ধীজী সহিংস বিপ্লবের চির-বিরোধী। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখলের সংবাদে উনি বললেন, ‘চিটাগাঙ রিডস এ স্যাড রিডিং।’ চিত্তরঞ্জন প্রথমে সশস্ত্র বিপ্লবের সমর্থক ছিলেন। হঠাৎ তিনি গান্ধীবাদী হওয়ায় লোকে রটালো যে ওঁরা দুরাত্রি একত্রে কংগ্রেস-ক্যাম্পে ছিলেন, সেই সুযোগে গান্ধীজী তাঁকে সম্মোহিত করেছেন। বাংলাদেশে এই দুই নেতার প্রচেষ্টায় অসহযোগ আন্দোলন ও বিদেশী বস্ত্র-বর্জন তীব্ৰ হ’ল। তরুণেরা দলে দলে স্কুল-কলেজ ত্যাগ করে এই আন্দোলনে সামিল হোল। পার্কে পার্কে মিটিং ও গ্রেপ্তার বরণ। বিগার্তী বস্ত্র বর্জন এবং উহা দহনও চললো সেই সঙ্গে।]
বিঃ দ্রঃ-চিত্তরঞ্জনের ডাকে অন্যদের সঙ্গে আমিও স্কুল হতে বেরোই। তার বাড়িতে গুর্খা দারোয়ান বিনা বাধায় ভিতরে ঢুকতে দিলো। আমরা প্রথমে বাগানের পিয়ারা গাছের সব কটি পাকা ফল পেড়ে শেষ করি ও পরদিন স্কুলে ফিরি। আমাদের বহু বন্ধু ক্লাশে না এসে সোজাসুজি আন্দোলনে লিপ্ত হ’ল। তবু চিত্তরঞ্জনের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও ভক্তি অটুট রইলো। উনি তখন স্থানে-স্থানে ছোট সভা করতেন। বাল্যে এরকম এক সভায় তাকে নিকট হতে দেখি ও বক্তৃতা শুনি। তাঁর বক্তৃতা হুবহু উদ্ধৃত করা আজ মোটেই সম্ভব নয়। উহ! মোটামুটি এই-রকম ছিল: নেতারা তোমাদের বিষয় ভাবেন। তোমাদের দেশের কথা ভাববার সময় নেই। তাই নেতাদের সুচিস্তিত নির্দেশ তোমরা গ্রহণ করে।। বহু সভায় তাঁর উগ্র বক্তৃতাও আমি শুনেছি।
[দক্ষিণ-কলিকাতা হাজরা, পার্কে প্রথম আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হ’ল। একজন করে বক্তৃতা দিতে উঠলে উপস্থিত ঊর্ধ্বতন পুলিশ তাকে হাতের ইশারা করতেন। অমনি বক্তৃতাকারী নেমে এসে গ্রেপ্তার বরণ করতো। হঠাৎ সংবাদ এলো, বাসন্তী দেবী গ্রেপ্তার! জনৈক তরুণ ক্ষেপে উঠে চীৎকার করে বললে, ‘এখনও চুপ করে কেন? প্রতিশোধ নিন ও ওদের রক্ত নিন।’ সুশিক্ষিত কংগ্রেস কর্মীরা ছুটে এসে তাকে নিরস্ত করেছিল।]
এ সময় কংগ্রেসী তরুণদের অদ্ভুত নিয়মতান্ত্রিকতা ও ভদ্রতাবোধ দেখেছি। কটূ বাক্যে ও প্রহারে তারা স্মিতহাস্য করেছে। লোকমান্য তিলকের মৃত্যুকালে তারা পথচারীদের জুতো খুলে মুছে সশ্রদ্ধভাবে তাদের হাতে তা তুলে দিয়েছে। আন্দোলনের এই নম্র-শান্ত প্রকৃতি পরবর্তী প্রতিটি ক্ষেত্রে অব্যাহত ছিল। অথচ তার মাত্র ক’বছর পরে বিয়াল্লিশের ‘আগস্ট আন্দোলনে’ তরুণরা পথচারীদের মাথার হ্যাট উপড়িয়ে গলার টাই ছিড়ে তাদেরকে দৌড় করাতেও দেখেছি। তাদের দুর্ভোগে বিজাতীয় উল্লাসে অন্যেরা করতালি দিয়েছে।
আন্দোলনের জন্য গান্ধীজীর বাংলায় আসা কিছু বাঙালীর পছন্দ নয়। তাদের মতে গান্ধীজী বাঙালী জাতির ভাবপ্রবণতার সুযোগ নিতে চান। আগেও উনি তাই নিয়েছেন। এবার তিনি এলে ব্রিটিশদের রোষ বাঙালীদের আরও ক্ষতি করবে। সত্যাগ্রহ করে তারা বাড়ি ফিরে দেখবে যে অন্যদের সঙ্গে পুলিশরা ‘ একযোগে সর্বস্ব লুণ্ঠন করেছে। নারীদের সম্মান ও মর্যাদা নেই। তাদের অভিযোগ শুনে লাটসাহের আবার বললেন, ‘এটা কলোসল হোক্স।’ সরোজিনী নাইডু ও অন্য-নেতার। আর-একবার টাউন হলে মিটিং করবেন ও লাটসাহেবকে গাল পাড়বেন, তারপর চলে যাবেন। ব্যস, ওই পর্যন্ত। বহু ব্যক্তির আশঙ্কা, একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবারও বাধানো হবে।
[স্বাধীনতা ত্বরান্বিত করার জন্য স্যার আশুতোষ মুখার্জির পরোক্ষ দান কম নয় তৎপুত্র সহপাঠী বামাপ্রসাদের মাধ্যমে আমি তাঁর সংস্পর্শে আসি। তিনি আমাদের মিত্র ইনস্টিটিউশন-এ এসে ছাত্রদের উৎসাহিত করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমেও তিনি অসংখ্য শিক্ষিত ‘স্বাধীনতা-যোদ্ধা’ সৃষ্টি করেছিলেন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে গভর্ণরকে তিনি একবার বলেছিলেন, ‘ফ্রিডম ফার্স্ট’, ফ্রিডম সেকেণ্ড, ফ্রিডম লাস্ট।’
স্থার আশুতোষের এই বিশ্ববিদ্যালয়টি অসংখ্য শিক্ষিত বেকার সৃষ্টি করেছিল। তাঁর ইচ্ছা, চাকুরীর অভাবে শিক্ষিত বেকারেরা ব্যবসায় নামবে। কিন্তু পরিবর্তে তারা রাজনীতিক্ষেত্রে যোগ দিতে থাকে।]
সুপারী গাছের বালদো হতেও হন তৈরী করে ওরা আইন ভেঙেছে। এদিকে সুপরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক কর্মী-নিয়োগ সরকারী কাজে হিন্দুর সংখ্যা কমানো হয়েছে। ইংরাজ সওদাগররাই শুধু তাদের কাজে বাঙালী নিয়োগ করতো। তা না-হলে বাঙালীদের বেকারত্ব আরও বেড়ে গিয়ে ইংরাজ রাজত্বের পতন ত্বরান্বিত করতো। বাঙালীদের কাজ-কর্মে নিযুক্ত না-করলে তারা অন্যভাবে নিযুক্ত হবেই। শহরের অন্যান্য পার্কে সভা সেরে নেতারা হরিশ পার্কে এলেন। বাল্যে এই সভায় আমি উপস্থিত ছিলাম। গান্ধীজী বক্তৃতা-প্রসঙ্গে বললেন, ‘অফিস আদালত স্কুল ছাড়ে।। বিদেশী দ্রব্য বর্জন ও স্বদেশী দ্রব্য গ্রহণ করে।। সকলে ট্যাক্স বন্ধ করো। ‘দেন স্বরাজ উইল বা অবটেও টু-ডে।’—মহম্মদ আলী ও শওকত আলী গর্জে উঠে বললেন, ‘জর্জ ফিপ্থ কিং অব ইংলণ্ড, পারহ্যাপস্ স্টিল এম্পারার অব ইণ্ডিয়া।—অন্য একজন আরও বিশদভাবে বললেন ‘একটা কামানের গোলা বিশ মাইল মাত্র যায় ও সেই স্থান ধ্বংস করে। কিন্তু এই চরকা দশহাজার মাইল দূরে ম্যানচেস্টার ধ্বংস করবে।’ তারপর শুরু হ’ল বিলাতী বস্ত্র দাহন। চিত্তরঞ্জন দাশ চিৎকার করে বললেন, ‘আরও চাই আরও চাই। আধখান। বিলাতী বন্ধ পরে থেকে বাকী আধখানা আগুনে ফেল।’ ভাবপ্রবণ তরুণের দল জামা ও গেঞ্জি আগুনে ছুঁড়লো। আমাদের বাড়ির অভিভাবকদের বকুনির ভয় ছিল, তবু পকেটের বিলাতী রুমালট। আগুনে ছুঁড়ে আমরা দু‘ভাই বাড়ি ফিরে এলাম। [কলিকাতা-পুলিশ এ্যাক্ট-এ পাবলিক প্লেসে কোনো ফায়ার নিষিদ্ধ। ওটা দোলযাত্রার নেড়া-পোড়া বন্ধের জন্য তৈরি। কিন্তু শ্রদ্ধানন্দ পার্কে বস্ত্র-দহনের জন্য গান্ধীজী অভিযুক্ত হলেন। তাঁর তরফে আদালতে এক অজ্ঞাত ব্যক্তি জরিমানা দিয়েছিল।]
হাজরা পার্ক হরিশ পার্ক শ্রদ্ধানন্দ পার্ক ওয়েলিংটন স্কোয়ার শ্যাম পার্ক—এই কটি তখন রাজনৈতিক পীঠস্থান। রাউলাট বিল তথা রাক্ষুসে আইনের প্রতিবাদে সর্বপ্রথম গড়ের মাঠে বিরাট মিটিং হয়েছিল। রাখীবন্ধন-খ্যাত বিহারের লিয়াকত হোসেন এবং বর্তমানে পণ্ডিচেরী আশ্রমবাসী অনিলবরণ তৎকালে বিশিষ্ট সুবক্তা। অনিলবরণ বাৰু আশ্রমবাসী না-হলে বাংলার উল্লেখযোগ্য নেতা হতেন।
রেজিনেও ক্লার্ক
স্থার রেজিনেও ক্লার্ক (১৯২০-২৫) কলিকাতার উল্লেখযোগ্য পুলিশ-কমিশনার হয়েছিলেন। দেশবাসীর প্রতি তাঁর অনুরাগ ও সহনশীলতা অত্যন্ত বেশি। এই সুযোগ বাংলার বিপ্লবীদল গ্রহণ করেছিল। তাঁর সময়ে এঁরা কলকাতায় কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘাঁটি করে।
এই ভদ্রলোকের পরিচ্ছন্নতা ও সৌন্দর্যবোধ আজও প্রবাদ। তিনি সকল শ্রেণীর পুলিশ-কর্মীর উদীর ও আবাসের যথেষ্ট উন্নতি করেন। কোনো পুলিশ-কর্মীর নিকট একটি সুন্দর ফাউনটেন পেন দেখলে তিনি প্রশংসা করতেন। তাঁর সময়ে থানাগুলি বেশ পরিচ্ছন্ন ও উদ্যানশোভিত হয়। তবে কিছু দেশীয় কর্মী ও কনট্রাকটারদের যোগসাজসে অর্থব্যয় সত্ত্বেও কিছুসংখ্যক পুলিশ-কোয়ার্টার তাঁর মনোমত তৈরি হয় নি। তিনি কলিকাতা-পুলিশের বেতন বৃদ্ধি করে প্রায় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের (তৎকালীন মান মতো) সমান করেন। এজন্য বহু ব্যক্তি সাব-ডেপুটি না-হয়ে কলিকাতা পুলিশে সাব-ইনস্পেক্টর হয়েছে। তিনি অভিজাত পরিবারের গ্র্যাজুয়েট যুবকদের সাব-ইনস্পেক্টর নিযুক্ত করতেন। এজন্য তিনি কলেজগুলির য়ুরোপীয় প্রিনসিপ্যালদের সঙ্গে স্বয়ং সংযোগ করতেন। তাঁর সময়ে উর্ধ্বতন পুলিশ-কর্মীর| (আই-পি) সকলেই ইংরাজ হতেন। তিনি গভর্ণমেন্টকে একজন দেশীয় ডেপুটি কমিশনার নিয়োগে রাজী করালেন।
রায়বাহাদুর পূর্ণচন্দ্র লাহিড়ীকে সহকারী কমিশনার পদ হতে উন্নীত করে একমাত্র ভারতীয় ডেপুটি কমিশনার নিযুক্ত করা হ’ল। তখনও কলিকাতা পুলিশে সহকারী পুলিশ-কমিশনার ও থানা ইনচার্জের মধ্যে ইংরাজ ও অ্যাংলোই বেশি। কমিশনার ক্লার্ক এই পদগুলির দেশীয় করণ করলেন। তিনি কলিকাতা পুলিশে আভিজাত্য রক্ষার জন্য বদ্ধপরিকর। নিম্ন ও মধ্যপদগুলিতে বাংলা-পুলিশ অপেক্ষা কলিকাতা-পুলিশের বেতন, উর্দির ঔজ্জ্বল্য ও অন্য সুযোগ-সুবিধা বেশি হ’ল। কলিকাতা-পুলিশে কনস্টেবল-অফিসার নির্বিশেষে উর্দিতে সাদা জিনের ফুলপ্যান্ট, গলাবন্ধ কোট ও নিকেল বোতাম। মাথায় ক্রাউন-মার্কা নিকেল ব্যাজ যুক্ত হেলমেট ও কাধে স্ট্রাপ-সহ ব্যাজ ও চিহ্ন। গ্রীষ্মে কালো বনাতের টিউনিক কোট ও ফুলপ্যান্ট। মাথায় সুদৃশ্য ব্যাজ সহ হেলমেট। প্রয়োজন হলে তাতে রৌপ্যোজ্জ্বল পাইস্ ও চেইন লাগানো হ’ত। ইনস্পেকটরদের কাধে রৌপ্যোজ্জ্বল পাকানো কর্ড লাগানো থাকতো! অ্যাসিসটেন্ট ও ডেপুটিকমিশনারদের তরবারি সহ উর্দি প্রায় জেনারেলদের মতো জমকালো।
কমিশনার ক্লার্ক কলিকাতা পুলিশে তিনটি অর্ডার অফ সার্ভিস (ইম্পরিয়াল, প্রভিনসিয়াল ও সাব-অরডিনেট) বাতিল করে লণ্ডন-পুলিশের মতো দুটি ভাগ যথা পুলিশ মেন [কনস্টেবল ও হেড কনস্টেবল] এবং তদুর্ধ্বদের অফিসার রূপে চিহ্নিত করতে চাইলেন। কিন্তু সেকালে ডেপুটি কমিশনারগণ ইংরাজ হওয়ায় গভর্ণমেন্ট রাজী হয় নি। একই শিক্ষা-দীক্ষা ও বংশ-গরিমার কর্মীদের পদমর্য্যাদাগত বিভেদ তাঁদের পছন্দ নয়। অধিকন্তু বয়স ও তদজনিত অভিজ্ঞতার উপর তিনি প্রাধান্য দিতেন। তাঁর নির্দেশে তরুণ ইংরাজ-উর্ধ্বতনরা অধীনস্থ প্রধান কর্মীদের কাছে পরামর্শ নিতেন। পুলিশ-কর্মীদের জনগণের প্রতি সামান্ততম অসৎ ব্যবহার করলে তিনি কঠোর দণ্ড দিতেন। পরিচ্ছন্ন, দক্ষ এবং জনপ্রিয় কর্মীদের খুঁজে বার করে প্রমোশন দেওয়া হ’ত।
পুলিশের নিজস্ব আদালত তথা রিপোর্ট রুমে বিবাদমান নাগরিকদের ডেকে তাদের বিবাদ মিটানোর জন্য তিনি ডেপুটিদের নির্দেশ দিতেন। সেকালে আদালতও একই উদ্দেশ্যে প্রাইভেট মামলা সমূহের তদন্তের জন্য পুলিশ-বিভাগে পাঠাতেন। সেগুলি পুলিশী স্তরেই মিটে যাওয়ায় আদালতের কাজ হালকা হ’ত। এবং পল্লীর শাস্তি ও বন্ধুত্ব অটুট থাকতো। পুলিশী তদত্ত পছন্দ না হলে হাকিমরা পুনরায় তদন্তের জন্য পল্লীর মানী গুণীর নিকট সেগুলি পাঠাতেন। সরেজমিন তদন্তে সত্যমিথ্যা তখনই ধরা পড়তো। এতে মিথ্যা মামলায় কারো হায়রানি হয় না। প্রয়োজনীয় সাক্ষীদের তদন্তকারীরা নিজেরাই খুঁজে বার করতেন। তার ফলে মিথ্যা সাক্ষী তৈরি হ’ত না এবং সত্য সাক্ষীরাও দায়িত্ব এড়াতে পারতেন না। এই ব্যবস্থার নাগরিকরা নিরাপদ ও সুখী ছিলেন। পদনির্বিশেষে কোনো পুলিশ-কর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে উর্ধ্বতনরা তৎক্ষণাৎ তা তদন্ত করতেন। অসৎ ও পক্ষপাতদুষ্ট হাকিমদের উপর প্রধান-হাকিম স্বয়ং লক্ষ্য রাখতেন। দূর দূরান্তরে পুনঃ পুনঃ বদলী ও উচ্চ আদালতের ভয়ে হাকিমরা সর্বদা সতর্ক থাকতেন। জুডিসিয়ারী সুবিধা দৃশ্যতঃ তাঁদের রক্ষাকবচ হলেও সর্বক্ষেত্রে কার্যকর হয় নি। [এজন্য ভারতীয়রা পূর্বে একক বিচার পছন্দ করে নি।]
কলিকাতা-পুলিশে তখন টিবিল চেকিং ব্যবস্থা বর্তমান। প্রত্যহ সান্ধ্যভিজিটে অ্যাসিসটেন্ট কমিশনাররা স্ব স্ব এলাকায় প্রতিটি থানা পরিদর্শনে বাধ্য ছিলেন।
তাঁরা হাজতঘর, মালখানা, গার্ডরুম ও অফিস পরিদর্শন করতেন। প্রত্যেক আসামীকে তাঁর কাছে পেশ করা নিয়ম। আসামীদের প্রত্যেককে অভাব-অভিযোগ সম্বন্ধে তাঁরা জিজ্ঞাসাবাদ করতেন। কারো বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ থাকলে তা তৎক্ষণাৎ ডায়োরীতে লিপিবদ্ধ করে তদন্ত করার নিয়ম। আহতদের হাসপাতালে না পাঠালে বা জামীনযোগ্য অপরাধীদের জামীন দেওয়া না-হলে তারজন্য থানা-ইনচার্জদের কৈফিয়ৎ তলব হোত। জামীনযোগ্য অপরাধে জামীনের জন্য পুলিশই তাদের বাড়ি হতে জামীনদার ডেকে আনতো। কাউকে গ্রেপ্তারের পর তার বাড়িতে সংবাদ দিতে পুলিশ বাধ্য ছিল। অফিসাররা প্রতিটি মামলার ডায়েরী খুঁটিয়ে পড়ে মন্তব্য সহ নির্দেশ দিতেন।
উক্ত প্রাথমিকচে কিং-এর পর দ্বিতীয় চেকিং পরদিন সকালে ডেপুটি কমিশনারদের নিজস্ব আদালত তথা রিাপার্ট রুমে হ’ত। সেখানে ডেপুটি সাহেবদের রেলিং ঘেরা নিজস্ব এজলাস। প্রতিটি থানার ইনচার্জ অফিসার আসামী ও নথীপত্র সহ সেখানে আসতেন। ডেপুটি কমিশনার তাঁর অ্যাসিসট্যান্ট কমিশনারের সাহায্যে সমস্ত মামলা বুঝতেন ও আসামীর পক্ষের বক্তব্য শুনতেন। তাদের সাক্ষী সেখানে এলে তাঁরা জিজ্ঞাসাবাদ করতেন। উভয় পক্ষের উকিলরা সেখানে থেকে সওয়াল করত। উচিত বুঝলে ডেপুটীরা আইন ক্ষমতার বলে আসামীদের তৎক্ষণাৎ মুক্তি দিতেন। সন্দেহ হলে, অন্য অফিসার দ্বারা মামলা পুনঃ তদন্ত করা হ’ত। এমনকি প্রয়োজনে নিজেরাও সরেজমিন তদন্তে বেরুতেন। অফিসারদের গাফলতি বা দোষ প্রমাণিত হলে তাঁর। শাস্তি পেতেন। থানার অফিসাররা নিজেরা কোর্টে কোনো মামলা পাঠাতে পারেন নি। (এরপর তৃতীয় চেকিং আদালতে হ’ত।) কোনো নিরপরাধী ব্যক্তির হায়রানি ও অর্থকষ্ট তাতে সম্ভব ছিল না।
বিঃ দ্রঃ-প্রাথমিক, আকস্মিক ও জুভেনাইল অপরাধীরা অনুতপ্ত হলে পুলিশ-গ্রাহ মামলাতেও তাদের রিপোর্ট-রুমে পুত্তর-ফাণ্ডের জন্য কিছু চাঁদা নিয়ে মুক্তি দেওয়া হ’ত। হেড-কোয়ার্টারসে একটি পুওর ফাণ্ড ছিল। সেই তহবিল হতে দুঃস্থদের মাসিক সাহায্য ও দরিদ্র ছাত্রদের পুস্তক দান করা হ’ত। দরখাস্ত পেলে পুলিশী তদন্তের পর ওই অর্থ হতে সাহায্য দেওয়া হয়েছে। বার্থ-আত্মহত্যাকামীদের রিপোর্ট এনে তাদের সাবধান করে ছেড়ে দেওয়া হ’ত। এই-সব ক্ষেত্রে জেলে পাঠানোর নিয়ম ছিল না। স্বাধীনতার পর বহু হিতকর ব্যবস্থার মতে। এটিও পরিত্যক্ত হয়। সেকালে গৃহস্থ-বাড়িতে নাইট-মার্চ এড়ানোর নিয়ম ছিল। (ফ্রেঞ্চ চন্দননগরে তো বেআইনী)। পুরুষদের অবর্তমানে বাড়িতে প্রবেশ করা হ’ত না। মহিলাদের সাক্ষী বা আসামী করা হ’ত কম। প্রতিদিন থানা-প্যারেডের পুলিশ-কর্মীদের একত্রিত করে কর্তব্য সম্বন্ধে সচেতন করা হয়েছে। কোনো মামলা থানায় এলে দশ-মিনিটের মধ্যে তা গ্রহণ করা চাই। মামলা বার্কিং (Barking) বা এড়ানো জঘন্য অপরাধ। প্রতিটি উত্তম-কর্মের জন্য পুরস্কার ছিল। মামলা মিথ্যা প্রমাণ করলেও তাঁরা পুরস্কার পেতেন। বিনা প্রমাণে নির্বিচারে গ্রেপ্তার করলে পুলিশের দণ্ড হ’ত। শহরে পুলিশের জীবন তখন মসৃণ ছিল না। দুই রাত্রি দুই ঘণ্টার রাউণ্ডের পর একরাত্রি বিশ্রাম মিলতো। চব্বিশ ঘণ্টাই তাদের ডিউটি। সামান্যতম গাফলতি হলে তাদের ক্ষমা নেই। বাইরে বেরুলে তা লিখে বেরুতে হ’ত। ফেরার সময়টিও তারা লিখতে বাধ্য। মধ্যবর্তীকালে রুং কাজের হিসাব দিতে হ’ত।
(ইংরাজ ডেপুটি কমিশনার ও দেশীয় থানা ইনচার্জরা সাধারণত কম বয়স্ক। এরাই দাঙ্গা-হাঙ্গামা কালে রাজপথে বার হ’ত। কিন্তু অ্যাসিসটেন্ট কমিশনারগণ প্রমোটেড হওয়ায় সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে মধ্য বয়স্ক। এজন্য তাদের বাইরের ডিউটিতে আহ্বান করা হ’ত না। তবে এদের পরামর্শ সব সময় গ্রহণ করার নিয়ম ছিল। বয়স ও অভিজ্ঞতার সম্মান দেওয়া সেকালের রীতি। উর্ধ্বতনরা বয়স্ক ও অভিজ্ঞ হেড কনস্টেবলেরও পরামর্শ নিতেন।]
এই সুবন্দোবস্তের জন্যে ব্রিটিশ-শাসনের অনুগামীদের সংখ্যা বাড়ে। অসন্তোষের কোনো কারণ নেই। প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি তখনও সুলভ্য। কর্মীরা জানতে! যে তাদের মৃত্যু হলে একটি পুত্রের চাকরি নিশ্চয়ই হবে। বংশানুক্রমে সরকারী কর্মীরা স্বভাবতই দক্ষ ও অনুগত। এজন্য বিপ্লব-আন্দোলনে বেশি সমর্থক ছিল না। শাস্তি ও নিরাপত্তাই সাধারণ মানুষের কাম্য। ভূমিস্বত্ব শ্রমিক আইনে কৃষক ও শ্রমিক-স্বার্থ রক্ষিত। এটি কৃষক সম্প্রদায় পূর্বে কল্পনাও করে নি। বেশি লোক জমির মালিক হওয়ায় বহিরাগত শ্রমিকদের প্রাধান্য ঘটে। অন্যদিকে ভাগ-বাঁটোয়ার ফলে ভূমির পরিমাণ সংকীর্ণ হয়ে যাওয়ায় রুষির ক্ষতিও হয়। (সাম্প্রতিক জবর-দখল জমি-বণ্টনে ফল শুভ হয় নি।)
কিন্তু চিত্তরঞ্জন দাশ ও মতিলাল নেহেরু গান্ধীবাদ হতে সরে গিয়ে স্বরাজ দল গঠন করলেন। ওঁরা কাউনসিলে ঢুকে কাউনসিল ভাঙতেন। এই কাজে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের সাহায্য প্রয়োজন। চিত্তরঞ্জন সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়কে খুশি রাখার জন্য বললেন, ‘শতকরা পঞ্চান্নটি চাকরি তোমাদের রইল।’ কিন্তু লোভে লাভ ও হিংসায় হিংসা বাড়ে। একমাত্র ত্যাগ দ্বারাই স্বাধীনতা সম্ভব। চতুর ইংরাজরা তখন তাদের শতকরা আশি শতাংশ চাকরি দিতে প্রস্তুত। বিপ্লবীদল বুঝেছিল যে কতিপয় ত্যাগী তরুণই স্বাধীনতা আনতে সক্ষম। নইলে ভাগাভাগি ও রেষারেষির অন্ত থাকবে না। দেশের জন্য মরণ-পণ আত্মত্যাগে তারা এগিয়ে এলো। পথে-ঘাটে ইংরাজ ও দেশীয় রাজপুরুষরা নিহত হতে থাকে। গোয়েন্দা বিভাগের কর্মীরা সকালে বেঙ্গলে সন্ধ্যায় ফেরার নিশ্চয়তা নেই। উভয় পক্ষের বহু ব্যক্তি প্রতিদিন শহীদ হতে থাকে। ক্রমাগত নিহত হওয়ার সংবাদ। বাসস্থানের চতুর্দিকে তারের জালের বেড়া দেওয়া হ’ল। সামনে-পিছনে সশস্ত্র পাহারা। তাদের সঙ্গে সশস্ত্র ছদ্মবেশী রক্ষী। তবুও বিপ্লবীদের আক্রমণ হতে সবাইকে রক্ষা করা যায় নি।
হাতপাতাল হতে মধ্যে মধ্যে পুষ্পাচ্ছাদিত শবাধার বার হয়। সামনে-পিছনে ঊর্ধ্বতন ও অন্যদের সশস্ত্র মিছিল। কোয়ার্টারের সামনে শবাধার কিছুক্ষণের জন্য নামানো হয়। আলুথালু সদ্যবিধবা স্ত্রী ছুটে এসে শববক্ষে লুটিয়ে পড়ে। বাড়ির লোক অতিকষ্টে তাঁকে তুলে ভিতরে নিয়ে যায়। চতুর্দিকে বুক-চাপড়ানি ও ক্রন্দনরোল। উর্দিপরা শবানুগামীদের চোখের পাতা সিক্ত হয়। শ্মশানে লাস্ট বিউগিল বাজলে তারা একে-একে স্যালুট করে ফিরে আসে। কিন্তু এতসত্ত্বেও কোনো বাঙালী-অফিসার কর্মত্যাগ করে নি। গোয়েন্দা-বিভাগ হতে বদলীর চিন্তাও নেই। ইংরাজরা ভীরু বলবে এ-অপবাদ তাদের অসহ্য।
[পরে উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিপিনবিহারী গঙ্গোপাধ্যায়, বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, মাখনলাল ঘোষ ও লোকনাথ বল প্রভৃতির মুখে শুনেছি যে এজন্য তাঁরা দুঃখিত। পুলিশ-কর্মীদের বীরত্বে ও সাহসে তাঁরাও মুগ্ধ। তবে থানা-কর্মীরা তাঁদের লক্ষ্য ছিল না কখনও। … দুর্বৃত্ত দমনে উর্দিপরা পুলিশও নিহত হ’ত বটে কিন্তু তাদের পরিবারের সুযোগ-সুবিধা নেই। পূর্বোক্তদের কন্যার বিবাহ, পুত্রের শিক্ষা ও চাকুরি এবং বিধবার ভায় সরকার নিতো।]
জনৈক গোয়েন্দা-কর্মীর গৃহে এক মূর্খ তরুণ ভৃত্যরূপে নিযুক্ত হ’ল। এই কর্মীটির কন্যা ও পুত্রের নিকট সে ইংরাজি শিক্ষা করলো। ওদিকে বিপ্লবীরা যথারীতি গোপন সংবাদ পাচ্ছিল। এই-সব সংবাদের গোপন কেন্দ্র হিসাবে, সন্দেহবশত, অবশেষে গোয়েন্দা-গৃহেই থানা-তল্লাস। জানা গেল, ওই তরুণ গ্র্যাজুয়েট এবং ধনীপুত্র। বাড়ির কন্যাটি পরে তার বধূ হয়।
এর বিপরীত ঘটনাও বহু ঘটেছে। গৃহস্থ বাড়িতে এক তরুণ পাচকরূপে নিযুক্ত হ’ল। বাড়ির বড়োমেয়ের পাতে সে বেশি করে মাছ দিতো। মেয়েটি এজন্য ভৎ সনা করে। সমবয়স্ক তরুণেরা কিন্তু তার অনুগত হয়ে পড়ে। প্রকৃতপক্ষে ওই ভৃত্য একজন গ্র্যাজুয়েট পুলিশ-কর্মী। মায়াবদ্ধ হয়ে সে দুর্বলতা স্বীকার করে এবং কর্মে ইস্তফা দেয়। তার পক্ষে ওদের সর্বনাশ করা সম্ভব নয়। পরে ওই কন্যার সঙ্গে তার বিবাহ হয়েছে।
বহু সরকারী কর্মীর বাড়িতে ছেলেরা গোপনে চরকা আনে। গান্ধীজীর ও আলী-ভ্রাতৃদ্বয়ের ফটো ঘরে রাখে। কাজী নজরুলের ‘অগ্নিবীণা’ কিনে আনে। উচ্চপদস্থ পুলিশ-পিতা তাই দেখে চরকা আছড়ে ভাঙলেন। তারপর মুষ্টিবদ্ধ করে গান্ধীজীর ফটোর পানে দৌড়লেন। ফটোর কাছে গিয়ে মুঠি শিথিল, থমকে দাঁড়ালেন। আঘাত হানা সম্ভব হল না। ভদ্রলোক গজরাতে গজরাতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
এই রকম বহু বাড়িই প্রকাশ্যে বা গোপনে আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট। মাঝে-মাঝে আমরাও সংযুক্ত হয়েছি। কিন্তু অভিভাবকদের ভয়ে বেশিদূর অগ্রসর হই নি।
পরীক্ষায় প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানলাভ করা তরুণরাই সাধারণত ডেটিনিউ হ’ত। ফলে সর্বভারতীয় পরীক্ষায় বাঙালী পিছিয়ে পড়েছিল। কোনো-এক উর্দিপরা পুলিশ-কর্মীর পুত্রের ধারণা হ’ল যে তার পিতা বিপ্লব-মন্য সহপাঠীদের উৎপীড়ন করছেন। প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে সে পিতাকে একটি পত্র লিখে হোস্টেলে আত্মহত্যা করলো। সংবাদ পেরে ভদ্রলোক ছুটে এসে ওই পত্র দেখে রেগে বললেন, ‘এঃ, বেটা আবার উপদেশ দিয়েছে!’…বলছেন আর গাল বেয়ে অশ্রু ঝরে পড়ছে। এই ভদ্রলোককে অবসর নেওয়ার পর কাশী বিশ্বনাথ-ঘাটে মালাজপ করতে দেখা যেতো।
এ সময়ে আমি ও আমার ভাই হিরণ্মময় সাহিত্য-সেবায় ব্রতী হই। স্বদেশপ্রেমের এ-ও এক বিকল্প পন্থা। ভ্রাতৃবন্ধু প্রতুলচন্দ্র গুপ্তের হস্তলিখিত ‘কণা’ পত্রিকায় লিখলাম। এঁর পিতা অতুলচন্দ্র গুপ্তকে দেশভক্তির অপরাধে হাইকোর্টের জাজয়তী করতে দেওয়া হয় নি। ওই বাড়ির কন্যাকে জনৈক সিভিলিয়ান বিবাহ করলে গভর্নমেন্ট বিরূপ হন। তখন সিভিলিয়ান-স্বামী বলেছিলেন যে স্ত্রীকে তিনি যোগ্য-পত্নীরূপে গড়ে তুলবেন।
নিজেরাও পরে হস্তলিখিত পত্রিকা ‘সাজি’ বার করলাম। ততদিনে সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, নরেন্দ্র দেব, রাধারাণী দেবী ও শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় প্রভৃতি সাহিত্যিকের সংশ্রবে এসেছি। সাহস করে ‘কল্লোল’ পত্রিকায় একটি লেখা পাঠালাম। দীনেশরঞ্জন সেন ও গোকুলচন্দ্র নাগের লেখাটি (নীচের সমাজ) পছন্দ হওয়ায় পত্রস্থ করেছিলেন। উল্লেখ্য এই-যে একবার মহিলার ছদ্মনামে আমি লেখা পাঠাই। সেটি ছাপা হবে জেনে স্বনাম ব্যবহারের অনুরোধ জানাতে পত্রিকা অফিসে গেলাম। এক সাহিত্যিক-ভদ্রলোক তাই শুনে বলে ওঠেন, ‘খোকা, উনি তো তোমার দিদি…তাঁকে বোলো একদিন আলাপ করবো।’ আমি প্রবলবেগে ঘাড় নেড়ে ওটা আমারই লেখা বলায় তিনি বেশ লজ্জিত হয়েছিলেন।
যারা সোজাসুজি দেশোদ্ধারে ব্রতী হতে সাহসী হতেন না তাঁরাই সে-সময়ে বিকল্প পন্থা সাহিত্য-কর্মে আত্মনিয়োগ করতেন। (কিছুকাল পরে অচিন্ত্যকুমার, বুদ্ধদেব বসু ও প্রেমেন্দ্র মিত্র প্রমুখের সঙ্গেও পরিচিত হলাম।) ডঃ সত্যচরণ লাহা, বিমল লাহা, ডঃ নরেন লাহা ও ডঃ বিনয় সরকারের সঙ্গে আলাপ হয়।আমার বিজ্ঞান-সম্পর্কিত একাধিক প্রবন্ধ ডঃ লাহা সম্পাদিত ‘প্রকৃতি’-তে প্রকাশিত হয়। এ সবই আমার দেশ-সেবার নিরাপদ প্রকাশ বলে মনে করেছি। সাউথ-সুবারবর্ণ কলেজে (এখন আশুতোষ কলেজ) স্টুডেন্ট-ইউনিয়ন স্থাপিত হলে তার প্রথম সেক্রেটারি হই। তখন তা ছিল সাহিত্য ও দেহচর্চাতেই মাত্র সীমাবদ্ধ। তবুও আমি গোয়েন্দা-পুলিশের নজরে পড়ে গেলাম। সরকারী-কর্মীদের ছেলেদের উপর দৃষ্টি রাখা তখন রীতি। আমার জ্যেষ্ঠতাত উচ্চপদস্থ পুলিশ-কর্মী হওয়া সত্ত্বেও তিনি তা জানতে পারেন নি। কিন্তু আমাদের কলেজের প্রিনসিপ্যাল পঞ্চানন সিংহ মহাশয় তা জানতে পেরেছিলেন।
[বহুপরে, এক-পয়সা ট্রামভাড়াবৃদ্ধিকালে সশস্ত্র পুলিশ সহ ফুটের এপারে দাঁড়িয়ে আছি। ওয়ারলেসে আশুতোষ কলেজে প্রিনসিপ্যালের সঙ্গে দেখা করার হুকুম এলো। তখন চতুর্দিকের ছাদগুলি হতে ইষ্টক বর্ষণ হচ্ছে। ছাত্ররা কিছু সংগত কারণে বিক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ। তাদের কাছে গেলে লাঞ্ছিত হওয়ার সম্ভাবনা। তবু হুকুম যখন এসেছে তখন ইষ্টক বর্ষন ভেদ করেই কলেজের গেটে গিয়ে পৌঁছুলাম। ছাত্ররা আমাকে ঘেরাও করে ফেললো। প্রিনসিপ্যাল সোমেশ্বরবাবু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আরে, ইনি আমাদের কলেজের একজন প্রাক্তন কৃতী ছাত্র। এই কলেজ-ইউনিয়নের ইনি প্রথম সেক্রেটারি।’ শুনে ছাত্রছাত্রীরা সমাদর করে আমাকে ভিতরে নিয়ে গেলেন এবং চা-পানে আপ্যায়ন করলেন। ওঁরা আমার সাহিত্য রচনার সঙ্গে পরিচিত। এখন আমার পূর্ব বিবরণ শুনে তাঁদের মনে বিস্ময়। আমি যে একজন পুলিশ-অফিসার তা তাঁরা বিশ্বাসই করতে চান না।]
ম্যালেরিয়া
স্বদেশী আন্দোলন বন্ধের ব্যাপারে ম্যালেরিয়া-রোগ ইংরাজদের প্রভূত সাহায্যে এসেছিল। এই রোগের প্রবল প্রকোপে শহরাঞ্চল ব্যতীত গ্রামাঞ্চলে কোনো ব্রিটিশ-বিরোধিতা প্রসারলাভ করে নি। অন্তত পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলকে এই রোগ বিশেষভাবে পঙ্গু করে রেখেছিল। এজন্য সেই সময়ে গভর্নমেন্টের পক্ষ হতে ম্যালেরিয়া-দমনে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় নি।
বিঃ দ্রঃ—সড়ক নির্মাণকালে বর্ধমানে কিছু বাঙালী শ্রমিক এই রোগে আক্রান্ত হয়। পুরাতন জেলা-গেজেটে একে ‘বর্ধমান ব্যাধি’ বলা হয়েছে।
হাইটালি কমিশন তাঁদের রিপোর্টে মন্তব্য করেছিলেন: ম্যালেরিয়া প্রপীড়িত পশ্চিমবঙ্গ হতে শ্রমিক সংগ্রহ করা যেন না হয়। বাঙালী শ্রমিকের বদলে বহির্বঙ্গ হতে শ্রমিক আনা হ’ল। ব্রিটিশ সামরিক বিভাগের রিপোর্টে একাধিকবার উল্লেখ আছে যে ম্যালেরিয়া রোগগ্রস্ত অঞ্চল হতে সেনা-সংগ্রহ করা বন্ধ হোক।
[এ-সব কিন্তু অজুহাত মাত্র।তাঁরা জানতেন বাঙালী শ্রমিকদের উপর উৎপীড়ন অসম্ভব। আত্মসম্মানবোধ তাদের প্রখর। সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, নীল, কৃষক ও পাইক-বিদ্রোহের স্মৃতি ওঁরা ভোলেন নি।]
এই ব্যাধির জন্য বাংলাদেশে পরিবার-পরিকল্পনার প্রয়োজন হয় নি। ব্যবসায়ী জমিদারগণের চিন্তা: তারা মারা গেলে জমি খাস হবে। উপরন্তু, বাংলা প্রদেশ-পুলিশের কর্মীরাও এতে পর্যুদস্ত। ভয়ে রাজপুরুষরা জেলায় প্রবেশ করতে চান না। অবস্থাপন্ন ব্যক্তিরা গ্রাম পরিত্যাগ করে শহরে আশ্রয় নেয়। নেতৃত্বহীন গ্রাম-সমাজ অন্ধকারে ডুবে থাকে। এই ব্যাধির অসহনীয় ভয়াবহতা নিম্নোক্ত গণ-গল্পটিতে পরিস্ফুট।
উলো-গ্রামের জমিদারের কুস্তিগীররা তখন ভারতে অপরাজেয়। কিন্তু এই সময় ম্যালেরিয়া রোগে তারা শক্তিহীন ও দুর্বল। এক নামী পশ্চিমী পালোয়ান গ্রামে এসে তাদের সংগ্রামে আহ্বান করলো। জমিদার তখন প্রমাদ গুণে বলেন, ‘ঠিক হ্যায় পালোয়ানজি। হামার পালোয়ান মহাল মে গয়া। কুছ রোজ বাদ উনে লোটবে। আভি আপ খাও দাও আউর পুকুরমে আস্নান করে।।’—কদিন পর ওই পরদেশী পালোয়ান জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে এসে বললে, ‘হুজুর, এ মেরা ক্যা হুয়া?’ একটু হেসে জমিদারবাবু বলেন, ‘মেরি পালোয়ান আব তুমকো পাকড় লিয়া। আভি তুম জান তো পয়লা বাঁচাও।’
প্রত্যেক গ্রামীণ পরিবারের আবালবৃদ্ধবনিতা পর্যায়ক্রমে জ্বরে ভুগে কম্বল মুড়ি দিয়ে ওষুধের শিশিহাতে কাপতে কাপতে ডাক্তারবাড়ি দৌড়োয়। কোনও গ্রামে পাশ-করা ডাক্তার নেই। অন্যদিকে ডি. গুপ্ত কোম্পানীর মালিক ওষুধ বিক্রি করে লক্ষপতি হন। হাড়জিরজিরে পেট-মোটা শিশুরা সংখ্যাহীন। নীল শিরায় তাদের দেহ ঢাকা। ক্ষীণ গলদেশে একরাশ মাদুলি। নোংরা একটি মাদুলি মুখে পুরে তারা চোষে। … বুড়োশিবের মাথায় ঢালা জল চরণামৃত হয়ে নালা বেয়ে গর্তে জমেছে। মায়েদের বিশ্বাস ওই থকথকে পোকাপড়া পাদোদক শিশুদের পান করালে তারা ব্যাধিমুক্ত হবে। বহু গ্রামের নাম তখন তে-এ টে গ্রাম। অর্থাৎ একজন মরলে পর-পর তিন ব্যক্তি মরবে। কলেরা-রোগীর কাপড় পানীয় পুষ্করিণীর জলে ধৌত করতে বাধা নেই। বসন্তের টীকা নেওয়া বা দেওয়ার প্রশ্ন সেখানে ওঠে না।
বিঃ দ্রঃ-বাঙালী কিন্তু ওই মহামারীতে মরে নি। তাদের শরীরে জীবাণু সম্পর্কিত ইমামিউনিটি তথা প্রতিষেধক ব্যবস্থা সৃষ্টি হয়। অবশ্য এজন্য দু-পুরুষ অপেক্ষা করতে হয়েছিল। বহিরাগত ব্যক্তিরা গ্রামাঞ্চলে এলে মৃত্যু অনিবার্য ছিল।— ধন্যবাদ! ডাক্তার গোপাল চট্টোপাধ্যায়কে ধন্যবাদ। তিনি একক প্রচেষ্টায় গ্রামে-গ্রামে ম্যালেরিয়া-নিবারণ-সমিতি স্থাপন করেন। ছাত্রাবস্থায় আমি এ কাজে তাঁর অন্যতম সহকারী ছিলাম।
তাঁর পত্রিকা ‘সোনার বাংলা‘র আমি অন্যতম লেখক। নিজেদের গ্রাম সহ বহু গ্রামে ম্যালেরিয়া-নিবারণ-সমিতি স্থাপন করেছি। তরুণদের সংঘবদ্ধ করে জঙ্গল সাফ করেছি ও পুকুরে কেরোসিন তেল ঢেলেছি। এটিকে আমি আজও এক গর্বের বিষয় বলে মনে করি। ডাক্তার চট্টোপাধ্যায় গ্রামীণ সংস্কারগুলিতে বাধা দিতে মানা করতেন। তাঁর নির্দেশে শিবের চরণামৃতের গহ্বর ও তৎসংলগ্ন নানা সিমেন্ট দিয়ে পাকা করে প্রতিদিন ওই জল বদলানোর ব্যবস্থা করা হয়। গ্রামে-গ্রামে দাই-ট্রেনিং ও কালাজ্বর নিবারণ-কেন্দ্র স্থাপন করি। কলেরা ও কালাজ্বরের ইনজেকশনের ব্যবস্থা হয়। ডাক্তার, ঔষধ ও আনুষঙ্গিক ব্যয়বাবদ বা-কিছু খরচ তার অর্থ ডাক্তার চট্টোপাধ্যায় নিজে বহন করতেন। বক্তৃতায় পারদৰ্শিতার জন্য আমাকে তাঁর পছন্দ হয়েছিল।
[সেই কালে গুরুসদয় দত্ত মহাশয়ের সংস্পর্শে এসে বহু মহিলা-সমিতি স্থাপন করি। সরোজ-নলিনী ইনস্টিটিউটে স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত আমি কাৰ্যনিৰ্বাহক সমিতির সদস্য ছিলাম। ওদের পত্রিকা ‘বঙ্গলক্ষ্মী’-তে বেনামে লিখতাম। ডাক্তার চট্টোপাধ্যায়ের হোমক্র্যাফট এসোসিয়েশনেরও আমি কর্মী। এজন্য কলেজ স্ট্রীট মার্কেটে সবজির দোকান নেওয়া হ’ত।প্রত্যেক গৃহস্থের বাগানের তরকারি ও পোলট্রি-জাত দ্রব্য এই দোকানে পাঠানো হ’ত।]
এতেও কিন্তু প্রতিবন্ধকতার অন্ত ছিল না। পুকুরের পানা তুললে মালিক হুংকার দিয়েছে: ‘কার হুকুমে পানা তুলছো? এ পানা আবার পুকুরে ফেল। ম্যালেরিয়ানিবারণী সমিতির সভার আলোচ্য বিষয় সমূহের আলোচনা এক বাড়িতে না হয়ে অন্য-বাড়িতে হ’ল কেন? ইত্যাদি।ওই সময়ে আমি গ্রামে একটি নাইট স্কুল, কিছু টিউবওয়েল, গ্রন্থাগার ও দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করি। এই স্কুল দুটির একটি পরে সরকার কর্তৃক অধিগৃহীত হয়। মাদরাল-নারাণপুর ইউনিয়ন ৰোর্ডের নাম পরিবর্তন করে মাত্র নারাণপুর করা হলে আমি ডিসট্রিক্ট বোর্ডের মেম্বারদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে পূর্বনাম বহাল করি। তখন জানা যায় যে জয়নগর-মজিলপুর প্রভৃতি বহু যুগ্ম নামের পৌরসভা ও ডাকঘর আছে। ওই কালে আমার উল্লেখ্য কাজ: স্বগ্রাম মাদরাল হতে নৈহাটী পর্যন্ত দু-মাইল দীর্ঘ রাস্তা তৈরি। নিজেদের বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত এজন্য ভূ-দান রূপে আমাকে দিতে হয়।
সে সময়ে সামান্য ভুলে আমার জীবনের গতিপথ সম্পূর্ণ বদলে গেল। আমি ও আমার ভ্রাতা হিরণ্ময় হুগলীতে কাজী নজরুলের সঙ্গে দেখা করি। আমরা জানতাম না যে কাজীর বাড়িতে পুলিশ-পর্যবেক্ষণ আছে। যখন কলকাতায় ফিরলাম, উচ্চপদস্থ পুলিশ-কর্মী জ্যেষ্ঠতাত চিৎকার করে বললেন, ‘আমি এখানে সশরীরে উপস্থিত রয়েছি, কাজীর বাড়ি যাবার আগে একবার জিজ্ঞাসা করতে পারলে না?’—পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্ট স্বয়ং তাঁর কৈফিয়ৎ চান। জ্যেষ্ঠতাত বলেন যে ওদের দুজনকে আর গ্রামের বাড়িতে পাঠাবো না। টেগার্ট মন্তব্য করলেন, ‘নো নো। ঘ্যাট ডট্ সল্ভ্ প্রবলেম। পুট দেম ইন্ট্রু পুলিশ।’ [গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর আমি সর্বভারতীয় তৃতীয় হয়েছিলাম। কিন্তু সাম্প্ৰদায়িক নিয়োগে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানাধিকারী বর্ণহিন্দু চাকুরি পেলো। আমার বহু নিম্নস্থান হতে খৃস্টান, অ্যাংলো ও মুশ্লিমদের নেওয়া হ’ল। অথচ আমার তখন চাকুরি প্রয়োজন। সবে এম-এস-সি পাশ করে ডঃ গিরীন্দ্রশেখর বসুর অধীনে গবেষণা শুরু করেছি হেনকালে টেগার্ট সাহেবের ইচ্ছায় ও জ্যেষ্ঠতাতের নির্দেশে আমাকে কলিকাতা পুলিশে ঢুকতে হ’ল। তবে ভ্রাতা হিরণ্ময় (পরে ডক্টর) সিভিলিয়ন হওয়ার অজুহাতে রেহাই পেয়ে গেল।
তৎকাল পুলিশ-ট্রেনিং স্কুলে জাত-বিচার ছিল অত্যধিক। অ্যাংলা সার্জেন্টদের সঙ্গে দেশীয় অফিসারদের যথেষ্ট প্রভেদ। পুলিশ-ট্রেনিং স্কুলে অ্যাংলো ঊর্ধ্বতনরা শিক্ষার্থীদের নানাভাবে ক্লেশ ও জঘন্য গালি দিতো। দাস-মনোভাবে অভ্যস্ত করার জন্যেই এ-সবের প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের প্রতিদিন দশ মাইল দৌড় করানো হ’ত। অ্যাংলোরা মদ্যপানজনিত বাড়তি এনার্জির অধিকারী। তাই তারা শারীরিক পরিশ্রম কিছু বেশি সহ্য করতে পারে। উপরন্তু তাদের পড়াশুনা না থাকায় যথেষ্ট বিশ্রাম পায়। অত্যাচারের ফলে বহু দেশীয় কর্মী কাজে ইস্তফ। দিতো। জাত তুলে গালি দেওয়ায় আমিও তাই করি এবং অভিযোগে মুখর হই। চার্লস টেগার্ট আমাকে ডেকে পাঠালেন এবং আনুপূর্বিক সব শুনলেন। তারপর থেকে প্যারেডের ভার অ্যাংলোদের পরিবর্তে এক দেশীয় সুবাদারের উপর অর্পিত হ’ল। কনডেড ও সাটেনডেড শিক্ষক-অফিসারদের বদলে দক্ষ কর্মীদের আইনের শিক্ষক করা হ’ল। টেগার্ট সাহেব আমাকে সরাসরি বড়বাজার থানার অফিসাররূপে বহাল করলেন। এই রকম প্রত্যক্ষভাবে আমার পুলিশী জীবন শুরু হল।
[একালে রায়বাহাদুর কালীসদয় ঘোষাল, বৈদ্যনাথ মুখার্জি, কুঞ্জবিহারী মুখার্জি, পান্নালান ব্রহ্মচারী, নারায়ণ চ্যাটার্জি, গগনেন্দ্রনাথ, রায়বাহাদুর নলিনী মজুমদার, রায়বাহাদুর বনবিহারী মুখার্জি, খানসাহেব মহম্মদ ইসমাইল, শামসুদ্দীন জোহা, রায়সাহেব জগৎ বাগচি প্রভৃতি উল্লেখ্য অফিসার। এঁদের অনেকেই তখন অবসরগ্রাহী ও অন্যেরা একে-একে অবসর নিচ্ছেন। এঁরা প্রায় সকলেই ডেপুটি ও অ্যাসিসটেন্ট কমিশনার হন।]
চার্লস টেগার্ট
ইনি কলিকাতা-পুলিশের সর্বাপেক্ষা উল্লেখ্য পুলিশ কমিশনার ছিলেন (১৯২৫-৩২)। এ সময় কলকাতার সমস্যা অধিকতর জটিল হয়। বিপ্লবীদের গোপন সংগঠন আরও জোরদার। এই বিপ্লবীদের রুখতে শান্ত-প্রকৃতির পূর্বতন কমিশনার ক্লার্ক সাহেব সক্ষম হন নি। চার্লস টেগার্ট পুলিশ কমিশনার হওয়ার পর তাঁদের দমনে আত্মনিয়োগ করলেন। প্রদেশ পুলিশের (আই-বি) বিপ্লবী দমন বিভাগও তাঁর আজ্ঞাধীন। বাংলা-পুলিশের ইনস্পেক্টর জেনারেল লোম্যান সাহেব ও তাঁকে সমীহ করতেন। বিপ্লবীরা এই লোম্যান সাহেবকে নিহত করে। কিন্তু বহুবার চেষ্টা সত্ত্বেও টেগার্ট সাহেবের মৃত্যু ঘটাতে পারে নি। স্যার চার্লস টেগার্টের আক্বতি ও প্রকৃতি দেখে একটিমাত্র উপমা মনে আসে, পুরুষ-শার্দুল। একটা অদ্ভুত-দর্শন কুকুর সর্বদা লেজ তুলে তার সঙ্গে থাকে। এই জীবটি তাঁর আগে-আগে চলে। বিপদের গন্ধ পেলে সে তার লেজ নামায় এবং সকলকে সতর্ক করে দেয়। বাঙালী বিপ্লবীদের আক্রমণ থেকে এই কুকুর বহুবার তাঁকে রক্ষা করেছে।
তিনি মৌর্য-সাম্রাজ্যের সময় গুপ্তচর সংগঠনের পদ্ধতি ও প্রণালী সম্বলিত বহু ইংরাজি পুস্তক পাঠ করেন এবং তদানুযায়ী কলিকাতা পুলিশে স্পেশাল ব্রাঞ্চে ও বাংলা-পুলিশে ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চে পরিবর্তন আনেন। বিপ্লবীদের মধ্য হতে অর্থ দ্বারা চর-সংগ্রহের আধুনিক রীতির তিনি স্রষ্টা। ওয়াচ করা তথা নজরবন্দী, ফলো করা তথা অনুসরণ, সোর্সদের সহিত গোপনে সাক্ষাতের রাজনীতি ডিসাই+ফারিং বিদ্যা, গুপ্তলিপি ও সংকেতলিপি প্রভৃতির তিনি প্রবর্তক। এই গুপ্তবিদ্যার ফলিতজ্ঞান পুলিশ-কর্মীদের তিনি উৎসাহ দিতেন। বাঙালী অফিসারদের এ বিষয়ে মগজ-ব্যবহারের স্বীকৃতিও দিতেন। তল্লাসীকালে কোটের নিচে লৌহবর্ম ও হস্তে ঢাল পিস্তল রাখার ব্যবস্থা তিনি করেন। অফিসারদের সহিত সশস্ত্র আর্দালি রাখা তাদের বাড়িতে সশস্ত্র প্রহরা, বাড়ির জানালা লৌহজালে আবৃত করার সুবন্দাবস্ত করেন। গুপ্তচরদের প্রাপ্য অর্থ সংগ্রহকারী কর্মী ঠিকমতে। দিচ্ছে কিনা তা তিনি নিজে পরীক্ষা করতেন। এই সংবাদ সরবরাহকারী চরদের নাম ও নম্বর সংশ্লিষ্ট অফিসার (সংগ্রহকারী) ও তাঁদের ঊর্ধ্বতন ডেপুটিরা মাত্র জানতেন। বিভিন্ন সোর্স ও বিভিন্ন সূত্র হতে সংগৃহীত সংবাদ একরূপ হলে তা বিশ্বাস্য হ’ত। তখন তার উপর ভিত্তি করে সংশ্লিষ্ট বিপ্লবীকে আটক বা ডেটিনিউ করা হ’ত। একসপোজড চরদের কিছু অর্থদান করে বাতিল করার নিয়ম। কখনও জেলে রেখে তাদের রক্ষা করা হয়েছে (ভারত রক্ষা আইনে)। বিভিন্ন দিনে বিভিন্ন স্থানে গুপ্তচরদের সাথে সাক্ষাতের নিয়ম হয়।
এ বাদে আরও একটি উপায় টেগার্ট সাহের আবিষ্কার করেছিলেন। তখন অনুশীলন ও যুগান্তর পার্টি দুটি পরস্পর বিবদমান ছিল। কোনো একদলের লোককে গ্রেপ্তার করা হ’ত না। কিংবা গ্রেপ্তার করেও তৎক্ষণাৎ জামীন দেওয়া হ’ত। (জামীনে মুক্তির পর গোপনে তার অনুসরণ করা হ’ত।) কিন্তু অন্যদলের লোকদের প্রায়ই গ্রেপ্তার করা হ’ত এবং জামীন পেত না। এতে একদল অন্যদলকে গুপ্তসংবাদদাতারূপে সন্দেহ করতো এবং তার ফলে পরস্পর পরস্পরের প্রতি ক্রুদ্ধ হয়ে পুলিশকে সংবাদ দিয়েছে।
কিন্তু ও-রকম পন্থায় ফল শুভ হয় নি। কিছু দুষ্ট কর্মী একই সংবাদ স্ব স্ব সোর্সের মুখে দিতো। কিছু ক্ষেত্রে সোর্সরা (এজেন্ট প্রপোগেটর) নিজেরাই দল তৈরি দলের তরুণদের ধরিয়ে দিতো। নিজেদের আদর্শবান দলনেতাকে সন্দেহ করে তারা পৃথক দল তৈরি করতো। তখন শত চেষ্টাতেও কর্তৃপক্ষ আর তাদের সংবাদ পেতেন না। একসপোজড চরেরা চাকুরি না-পেলে পুলিশের গতিবিধি ও ঘরোয়া তথ্য বিপ্লবীদের জানিয়ে দিতো। এই ব্যবস্থায় কিছু নির্দোষী তরুণ বাঙালী ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। হিসাববিহীন সোর্স মানিই (Scorce money) অফিসারদের দুর্নীতিগ্রস্ত করে। এর প্রতিবাদে জনসাধারণ নিম্নোক্ত গণ-গল্পটি সৃষ্টি করেছিল। ক-বাৰু খ-বাবু গ-বাবু তিন গোয়েন্দা। ক-বাবু বললেন, ‘ভাই খ, তুই প্রতিদিন কর্ত সংবাদ সংগ্রহ করিস। আমি তো কিছুই পারি না।’ খ-বাবু: ‘তুই কফি-খানায় গেলে বহু সংবাদ পাবি।’ ক-বাবু: ‘আরে ভাই আমি ওখানে বহুবার গিয়েছি। কিন্তু আমাকে দেখলেই ওরা চুপ করে যায়।’ খ-বাবু: ‘আমাকে দেখেও ওরা তাই করে। কিন্তু আমি নিজেই বহু বিষয়ে কথা বলে ওদের দিকে তাকাই, জিজ্ঞাসা করি, ‘কি মশাইরা, আমি ঠিক বলেছি?’ যে ব্যক্তি হু বলে আমি তার নামেই ওই কথাগুলি চালাই।’ গ-বাবু চুপচাপ সব শুনছিলেন এবার তিনি বললেন, ‘আমি কিন্তু অত কষ্ট করি না। সকালবেলা খবরের কাগজ পড়েই জানতে পারি কোন্ কোন্ নেতা শহরে উপস্থিত রয়েছে। তারপর তাদেরই নামে সত্য-মিথ্যা সংবাদ উপরে পাঠিয়ে দিই। এতে আমি প্রতিমাসেই বহু রিওয়ার্ড পেয়েছি।’
স্যার চার্লস টেগার্ট পোস্ট অফিসে পত্র ইন্টারসেপ্ট প্রথার প্রবর্তক। ভেপারের সাহায্যে সন্দেহজনক ব্যক্তির খাম খুলে পত্র বার করে তা পড়ে আবার আঁটা হ’ত। এতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা কিছু জানতে পারতো না, মাঝখানে চিঠি পড়া হয়ে যেতো। এই ব্যবস্থা ব্যাপক ভাবে চালু হলে অসন্তুষ্ট জনগণ নিম্নোক্ত গণ-গল্পটি প্রতিবাদস্বরূপ তৈরি করে।
আয়ারল্যাণ্ডে আইরিশ-বিপ্লবীদের ভয়ে ইংরাজরা অতিষ্ঠ। তবুও প্রথম বিশ্বযুদ্ধে (বাঙালীদের মতো) কিছু আইরিশ তরুণ ইংরাজপক্ষে ফ্রান্সের রণক্ষেত্রে লড়ছে যায়। এক আইরিশ তরুণ-সৈন্য দেশ হতে স্ত্রীর পত্র পেলো। তাতে লেখা আছে যে সমর্থ যুবক প্রায় সকলেই যুদ্ধে চলে গেছে, আমরা মেয়েরা জমি চষতে তো পারি না শুধু চযা-জমিতে আলু বুনতে পারি। এবার আলুর চাষ করা সম্ভব হ’ল না। আইরিশ স্বামী তৎক্ষণাৎ লিখে পাঠালো: ‘খবরদার: জমি থোড়াখুঁড়ি কদাচ নয়। আমাদের ক্ষেতে বহুস্থানে বিপ্লবী-বন্ধুরা বোমা ও পিস্তল পুঁতে রেখেছে।’ কদিন পরে স্ত্রীর নিকট হতে স্বামী ভদ্রলোক আবার এক পত্ৰ পেলেন: ‘ওগো মহাসর্বনাশ! গতকাল ভোর হতে ট্রাকটার এনে পুলিশ সমস্ত জমি চষে বেড়াচ্ছে। আমরা ব্যাপার তো কিছুই বুঝছি না।’—স্বামীর উত্তর: ‘তোমাদের বোঝবার কিছু দরকার নেই। ওরা চলে গেলে তোমরা জমিতে শুধু আলু বুনে দিও।’
বাংলার বিপ্লবীদের টেগার্ট সাহেব নির্মমভাবে প্রদমিত করেছিলেন। কিন্তু এর ফলাফল বিশেষ শুভ হয় নি। বহু বিপ্লবী গান্ধীবাদে বিশ্বাসী হন। প্রকৃতপক্ষে কতিপয় বিপ্লবীর কয়টি বোমা ও পিস্তলকে ব্রিটিশরা ভয় করেন নি। তাঁদের সাম্রাজ্যের বিপুল বাহিনীর নিকট তারা নগণ্য। ব্যক্তিগতভাবে মাত্র কজন ব্রিটিশ ও দেশীয় ক্ষতিগ্রস্ত। এতে ব্রিটিশরা উদ্যস্ত হতে পারে, ভয় পেতে যাবে কেন? গান্ধীজীব অহিংস আন্দোলন ব্যাপকভাবে জনগণের মনে শিকড় গাড়লে দূরদর্শী ব্রিটিশ প্রভুরা ভয় পেলো! এই আন্দোলন সমগ্র দেশে প্রসার লাভ করতে বেশি দেরি হয় নি।
১৯২৬ খ্রী: কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হ’ল। সেই সঙ্গে যা-কিছু রাষ্ট্রনৈতিক আন্দোলন নিস্তব্ধ। একটু সময় পেলে রাজনীতির ক্ষেত্রে সমস্ত দেশের চেহারা অন্যরকম হয়ে যেতো। কিন্তু ব্রিটিশ বিরোধীরা তখন আত্মরক্ষার্থে ব্যস্ত। আন্দোলনের তাবৎ নেতৃবৃন্দ সাময়িকভাবে পিছু হটে এলেন। (এ রকম বাংলাদেশে বহুবার ঘটেছে।) ইংরাজদের ইচ্ছা বিনা-আয়াসে সিদ্ধ হ’ত কিন্তু তাতে বাঁধ সাধলেন জনৈক দেশীয় উর্ধ্বতন পুলিশ-কর্মী।
[গভর্নরের কাউনসিলের প্রতিজন সদস্য পূর্বের মতো ইংরাজ সিভিলিয়ন। দুজন দেশীয় ব্যক্তিকে কাউনসিলে কো-অপ্ট করা হয়। তাঁদের একজন কৃষ্ণনগরের মহারাজা এবং অন্যজন স্থার আবদার রহমন। শেষোক্ত ব্যক্তি ওই দেশীয় পুলিশ-ঊর্ধ্বতনের উপর বিরূপ হলেন। কৃষ্ণনগরের মহারাজা তাঁকে রক্ষা করতে অক্ষম। তাঁর একমাত্র সমর্থক স্যার চার্লস টেগার্ট। টেগার্ট সাহেব সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিষ্প্রয়োজন মনে করতেন। তাঁর মতে উভয়পক্ষই এতে গভর্নমেন্টকে দায়ী করে।]
পূর্ণচন্দ্র লাহিড়ী
রায়বাহাদুর পূর্ণচন্দ্র লাহিড়ী কলিকাতা পুলিশের প্রথম দেশীয় ডেপুটি কমিশনার সমগ্র ভারতেও তিনি প্রথম ঊর্ধ্বতন দেশীয় পুলিশ সাহেব। তিনি কনস্টেবলের পদ হতে দ্রুত প্রমোশনে এতো উপরে ওঠেন। ওই যুগে এটা ছিল এক বিরাট বিশ্বয়। উত্তর কলকাতার উত্তর-বিভাগে তিনি তখন কর্তা (শহরের সর্বাংশ)। তাঁর অধীন থানা পুলিশে তখন বন্দুক ছিল না। গভর্নমেন্টের মতামতের অপেক্ষা না-করে শুধু লাঠির সাহায্যে ওই দাঙ্গার মূলোচ্ছেদ করলেন। এমন-কি তিনি প্রকাশে বললেন যে গান্ধী আন্দোলন দমনের জন্য ওই দাঙ্গা বাধানো হয়েছে। জ্যেষ্ঠতাত রায়বাহাদুর কালীসদয় ঘোষাল সেই একই প্রতিবেদন দিলেন। এতে পূর্ণচন্দ্র লাহিড়ীকে চট্টগ্রামের (পদাবনতি) অ্যাডিশন্যাল সুপার করা হ’ল। এই বরেন্দ্র ব্রাহ্মণ উদাত্তকণ্ঠে বললেন যে, চাকুরির শর্তানুযায়ী কলকাতার বাহিরে তিনি যাবেন না এবং পদাবনতি তিনি মানতে রাজী নন। তাঁকে পেনসন নিতে না দিলে তিনি আদালতে যাবেন। তাঁকে অবসর গ্রহণে বাধ্য করা হ’ল। রায়বাহাদুর কালীসদ্বয়েরও ভবিষ্যৎ-প্রমোশন বন্ধ।
তদবধি সমস্যা সংকুল উত্তর কলকাতায় শুধু ইংরাজ ডেপুটি কমিশনার থাকতেন। পূর্ণচন্দ্রের পদে রায়বাহাদুর ভূপেন ব্যানার্জি প্রমোটেড হলেও তাঁকে দক্ষিণ-কলকাতার ডেপুটি করা হয়। ভূপেন ব্যানার্জি পণ্ডিত ও গবেষক ব্যক্তি। পূর্ব-সিভিলিয়নদের মতো কলিকাতা-পুলিশের ইতিবৃত্ত সম্বন্ধে নথী উদ্ধার করেন।
[মধ্যে মধ্যে বাংলার অন্যত্রও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানো হয়েছে। ফলে জাতীয়-ভাব বদলে বারে বারে সাম্প্রদায়িকতার সৃষ্টি হয়েছে। মুশ্লিমদের বোঝানো হয়েছে যে হিন্দুরা দেশ স্বাধীন করলে তাদের বিপদ। জাতীয়তাবাদী মুশ্লিমরা সংখ্যালঘু। অথচ হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা হিন্দুদেরই পছন্দ নয়। এই সম্পর্কে প্রতিটি প্রচেষ্টাতেই বাঙালী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে দেশ-বিভাগ প্রশস্ত হলেও স্বাধীনতা আটকায় নি।]
এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় বড়োবাজারের ব্যবসায়ীরা আত্মরক্ষার জন্য বহু মির্জাপুরী গুণ্ডা কলকাতায় আনে। প্রথম মহাযুদ্ধের ফলে তাদের হাতে বিপুল অর্থ। আমড়াতলা প্রভৃতি স্থানের মুশ্লিম ব্যবসায়ীরা একই উদ্দেশ্যে গাজীপুরী গুণ্ডাদের শহরে আমদানি করে। কিন্তু দাঙ্গা-উত্তরকালে তারা কেউই ওদের ভরণপোষণ করে নি। এবার উভয় সম্প্রদায়ের গুণ্ডাদের মধ্যে দারুণ ভাব! তারা দেশে না ফিরে পথচারীদের অর্থ ও দ্রব্য কেড়ে নেয় এবং নগর-জীবন বিপর্যস্ত করে তোলে। তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী বা ফরিয়াদী হলে নিশ্চিত মৃত্যু। নিম্নোক্ত ঘটনাবলী হতে তার ভরাবহতা বোঝা যাবে।
জনৈক মীনার পেশোয়ারীর নামে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা ও তৎসহ হুলিয়া বার হয়। ব্যারিস্টার সুরাবর্দি সাহেব তাকে টেগার্টের ঘরে আনলেন। অভিযোগ, ইনস্পেক্টর প্রভাতনাথ মুখার্জি তাকে উৎপীড়ন করেছে। প্রভাত মুখার্জি বললেন, ‘এই সেই জেলা খারিজ প্রক্লেমড অফেণ্ডার কুখ্যাত গুণ্ডা।’ গ্রেপ্তার এড়াতে মীনার পেশোয়ার দৌড়ে বার হ’ল। পশ্চাৎধাবনকারীদের উদ্দেশ্যে মুহুর্মুহু গুলিবর্ষণ করে নেমে সে অদৃশ্য হয়ে গেল। সুরাবর্দি সাহেব (তাকে সৎব্যক্তি বলার জন্য) ক্ষমা চান ও তা তিনি পান।
একদিন এক গুণ্ডা আহীর নিরেট মাথার ঢুঁ মেরে জমাদারের মাথা ফাটিয়ে দিলো। পল্লীর গুণ্ডার বিরুদ্ধে এক মানী ব্যক্তি দরখাস্ত পাঠান। পরদিন ওই গুণ্ডা পুলিশ-অফিসে পাঠানো দরখাস্তটি তার চোখের সামনে মেলে ধরে বললে, ‘বাবুসাব, এ কেয়া বাত? হামিলোক অপকা লেড়কা।’—এরা মাথার ঢুঁ ও পদাঘাতে পুলিশ কর্মীদের ধরাশায়ী করতো। নিভৃতে চুরিহাতে একগুণ্ডা জনৈক উকিলকে পাকড়াও করলো। কিন্তু তাকে উকিল বুঝে ব্যাগ সমেত ২.. টাকা ফেরৎ দিলো। পরে সেই উকিলের বাড়িতে সে একদিন সাহায্যপ্রার্থী হয়। উকিলবাবু ফি চাইলে সে বলে, ‘কী? কি তো সেদিন ময়দানে আপনাকে দিয়েছি।’
[কিন্তু নিজপল্লীতে কাউকে উৎপীড়ন না করে তাদের নিরুপদ্রবে রেখেছে। জেলাথারিজ হলে নিজ পল্লীর বাড়ি বাড়ি ঘুরে গলবস্ত্র হয়ে বিদায় নিয়েছে। কুলনারীদের ও শিশুদের তারা যথেষ্ট মর্যাদা দিতো। অন্যদিকে নিজেদের পল্লীর গৃহস্থদের রক্ষার্থে প্রাণপণ করেছে। এইজন্য মান্যগণ্যদের নিকট হতে প্রায়ই তারা প্রশংসা-পত্র পেয়েছে।]
স্যার চার্লস টেগার্ট বিপ্লবীদের মতো গুণ্ডাদেরও নির্মমভাবে প্রদমন করেন। এজন্য তিনি সরকার কর্তৃক গুণ্ডা-এক্ট পাশ করান। লালবাজারের প্রখ্যাত অফিসার প্রভাতনাথ মুখার্জির অধীনে গুণ্ডা-ডিপার্টমেন্ট স্থাপিত হ’ল। গুণ্ডা-আইনে সাক্ষীরা আসামীর অসাক্ষাতে গোপন সাক্ষী দেবার অধিকারী। অপরাধ প্রমাণিত হলে অপরাধীকে জেলা-খারিজ তথা একস্ট্যাণ্ড করে বাংলার বাইরে পাঠানো হ’ত। তারা বিনা অনুমতিতে ফিরে এলে কঠোর সাজা।
এই গুণ্ডাদমনে টেগার্ট সাহেব জনগণের মধ্যে জনপ্রিয় হলেন। জব চার্নকের মতো তিনি বাঙালীর নিকট ‘হিরো’। হঠাৎ চতুর্দিকে গুজব রটে তিনি ছদ্মবেশে ধুতি পরে ঘোরেন। কিন্তু এর মধ্যে সত্য ছিল না। তিনি এভাবে বেরুতেন না। অহেতুক বিপদের ঝুঁকি নেওয়া ট্যাক্টলেস কাজ। তবে প্রয়োজনে তিনি অসম সাহসিকতা দেখাতেন। একবার তাঁর রটে যে আইরিশম্যান হওয়ায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তিনি প্রতিবাদ করে বলেন যে তিনি আইরিশম্যান নন, গুণ্ডা দমনার্থে বহাল তবিয়তেই আছেন।
টেগার্ট সাহেব বিপ্লীদের অর্থকরী প্রশিক্ষণের জন্য কয়েকটি কর্মপদ্ধতি ছকে রাখেন। দমদম ক্লাইভ-হাউসের ডেটিনিউদের ওরূপ কর্মশালা আমি নিজে দেখেছি। জ্যেষ্ঠতাত কালীসদয় ঘোষাল অবসর গ্রহণের পর তাঁদের অধিকর্তা হয়েছিলেন। জার্মানী হতে মূল্যবান মেসিন এনে তাদের সেগুলির মালিক করা হয়। বহু বিপ্লবী তরুণকে উচ্চশিক্ষার জন্যে তিনি সুদূর ইউরোপেও পাঠান। তিনি ওই-সব দেশপ্রেমিক বিপ্লবীদের বোঝাতেন, ভারত সাম্প্রদায়িক-দোষে দুষ্ট এক বিরাট দেশ। এক অঞ্চলের সৈন্যদ্বারা অন্য অঞ্চল দমানো যায়। একবার কেউ এদেশ দখল করলে তাদের হঠানো কঠিন। তাই এভাবে দেশের স্বাধীনতা আনা কোনদিনই সম্ভব নয়। তিনি তাদের এও বলেছিলেন যে তিনি ভারতীয় হলে এই একই কাজ করতেন।
টেগার্ট সাহেব ফরাসী-চন্দননগরে অবৈধ প্রবেশ করে পলাতক চট্টগ্রাম-বিপ্লবীদের ঘাঁটি দখল করেন। তাঁকে হত্যা করতে গিয়ে ভুলে এক নিরীহ ইংরেজকে হত্যা করেন বিপ্লবী গোপীনাথ। বিপ্লবীদের দ্রুত বিচারের জন্য ট্রাইবুন্যাল -প্রথা তাঁর আদেশেই সৃষ্ট হয়।এইরূপ আদালতের প্রেসিডেন্ট সর্বক্ষেত্রে একজন ইংরাজ হতেন।
[বিঃ দ্রঃএকটি রিক্রুটিং বোর্ডের সভাপতি ছিলেন তিনি। আমি একবার তাঁর সাক্ষাৎপ্রার্থী হই। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘হোয়াট ইজ ইওর ন্যাশানাল সঙ?’ —আমাদের জাতীয় সংগীত নেই কিংবা ‘গড সেভস দি কিঙ’ই আমাদের জাতীয় সংগীত বললে তিনি ধরে নিতেন আমাদের মধ্যে ব্যক্তিত্বের অভাব। তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলাম: ‘ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা।’ আবার প্রশ্ন: ‘হোয়াই নট বন্দে মাতরম্?’ প্রত্যুত্তর: ‘এটি একটি রাজনৈতিক পার্টির সংগীত। কিন্তু ‘ধন ধান্য’ সকল শ্রেণীর নাগরিকের গ্রহণযোগ্য। অন্য দুজন মেম্বারের মতামত তোয়াক্কা না করে তিনি বললেন, ‘ওয়েল বয়, আই হ্যাভ টেকেন ইউ।’ বস্তুতপক্ষে তাঁর ব্যক্তিত্ব অসাধারণ ছিল।
[শীঘ্রই বৃহত্তর কর্মক্ষেত্রে তাঁর ডাক পড়ল। প্যালেস্টাইনে ইহুদী ও আরব বিপ্লবীদের দমনে তিনি নিযুক্ত হলেন। প্যালেস্টাইন বিভক্ত করার উদ্দেশ্যে তিনি উভয় সম্প্রদায়ের অবস্থান-ক্ষেত্রের মাঝামাঝি ‘টেগার্ট-ওয়াল’ তৈরি করেন। কিন্তু সম্প্রসারণকামী ইহুদীরা ওই টেগার্ট-ওয়াল বারুদের সাহায্যে উড়িয়ে দিলো।]
টেগার্ট সাহেব বাংলায় ও প্যালেস্টাইনে বিপ্লবী দমনের জন্য খ্যাত। অন্যদের মতে দুই স্থানেই তিনি বিপ্লবী-দমনে ব্যর্থ হন। ভারত-ত্যাগের পূর্বে তিনি আমাকে কলিকাতা পুলিশে পুনর্নিয়োগ করে যান।
[বিঃ দ্রঃ—এইকালে মহিলা-পুলিশ অকল্পনীয় ছিল। অপরাধিনী স্ত্রীলোকের দেহ-তল্লাসীর কাজে পথ থেকে ভুজাওয়ালীকে ডাকা হত। এ সময়ে বিপ্লবিনী তরুণীরাও হত্যাকার্যে লিপ্ত হয়। চট্টগ্রাম ইংরাজ-ম্যাজিস্ট্রেটকে ওরাই হত্যা করে। কলকাতায় কনভোকেশন হলে গভর্নরকে লক্ষ্য করে বীণা দাস গুলি ছোড়েন। এই ঘটনার সময় আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। বোঝা গেল যে তরুণী বীণা দাস পিস্তল ছোড়ায় ঠিক অভ্যস্তা নন কিংবা এই প্রথম পিস্তল ছুড়লেন। তাঁর হাত কাঁপছিল বলে পিস্তলের প্রতিটি গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হচ্ছিল। এ অবস্থায় তাঁকে গ্রেপ্তার করার মধ্যে সাহসের বিশেষ প্রয়োজন হয় না। তবু বহু ব্যক্তি খেতাব অর্জনের জন্য দাবীদার হয়। পুলিশের জনৈক ঊর্ধ্বতন কর্মীকে পুলিশ-কমিশনারের কাছে বলতে শুনেছিলাম, ‘আই হ্যাভ গট হার, স্যার!’—ভাইস-চ্যানসেলর সুরাবর্দি সাহেব ওই গ্রেপ্তারের জন্য দাবীদার হয়েছিলেন।
মহিলা-পুলিশ না-থাকায় পুলিশ-কর্মীদের আলোক-প্রাপ্তা কজন বন্ধুকে পর বৎসর ওখানে ছাত্রী ও অন্য মহিলাদের মধ্যে বসানো হচ্ছিল। এঁরা ছাত্রী ও তরুণীদের পরিক্রমণের উপর লক্ষ্য রাখতো। এজন্য প্রতি বৎসর এঁদের সরকার হতে এক-জোড়া করে সোনার দুল উপহার দেওয়া হ’ত। কিন্তু এত চেষ্টা সত্ত্বেও প্রভুদের রাজত্ব আমরা শেষ পর্যন্ত রক্ষা করতে পারি নি।]
১৯৩০ খ্রীঃ কলিকাতা-পুলিশের এলাকা ৩০৮ স্কোয়ার মাইল। ১১,৬৩,৪১ ব্যক্তির সেখানে বসবাস। অফিসার ও কর্মীর সংখ্যা ৫৭৪৭ জন। তাদের জন্য বাৎসরিক ব্যয় ৪৬,১২,৩০৪ টাকা। একজন কমিশনার, ৭ জন ডেপুটিকমিশনার। ১০ জন অ্যাসিসট্যান্ট কমিশনার। ৬৫ জন ইনস্পেক্টর, ১১৬ জন সাব-ইনস্পেক্টর। ২১৮ জন অ্যাংলো সার্জেন্ট। ১৫২ জন অ্যাসিসটেন্ট সাব-ইনস্পেক্টর ৪৩৩ জন হেড-কনস্টেবল (৫ জন অশ্বারোহী), ৪১৫৬ জন কনস্টেবল (৪৮ জন অশ্বারোহী) দ্বারা কলিকাতা-পুলিশ গঠিত। দুটি করে ডিভিশন-সহ কলকাতা-নর্থ ও সাউথ দুটি ডিসট্রিক্ট। তদতিরিক্ত ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট, স্পেশাল ব্রাঞ্চ, হেড-কোয়ার্টারস, ট্রাফিক ডিপার্টমেন্ট ওপোর্ট-পুলিশ পৃথক ডিসট্রিক্টরূপে বিবচিত। কলিকাতা পুলিশের ‘পুলিশ-পাইক’ তথা কনস্টেবলের ১৭৫২ খ্রীঃ ২ টাকা, ১৮৪৫ খ্রীঃ ৫ টাকা মাসিক বেতন ছিল। প্রথম মহাযুদ্ধের প্রারম্ভে কনস্টেবলদের মাসিক বেতন ১১ টাকা এবং ১৯৩১ খ্রীঃ তা বেড়ে ২৫ টাকা হতে ২৯ টাকা গ্রেড হয়। ঊর্ধ্বতন পুলিশ-কর্মীরা কালানুযায়ী যথাক্রমে পালকি, টমটম, ঘোড়াগাড়ি ও মোটর-যোগে তদারকে যাবার জন্য ব্যবহার করেছেন। তাঁরা পূর্বে মাথায় খাটো পাগড়ি বা টুপি, ছোট বা লম্বা ঘণ্টি-বাঁধা কোর্তা, লাঠি ও তরবারি, বন্দুক পৱে পিস্তল দ্বারা সজ্জিত হতেন। মধ্যবর্তী কর্মীদের কাঁধে রূপালি কর্ড বা স্ট্র্যাপের উপর নিকেল বোতাম, হেলমেট, নিকেল ও চেন-তরবারি দেওয়া হয়। আরও ঊর্ধ্বতনদের উর্দি জেনারেলদের মতো জমকালো ছিল। এই ঐতিহ্য হতে কলিকাতা-পুলিশকে অধুনা বঞ্চিত করা হয়েছে।
এ সময়ে (১) কলিকাতা থানা-পুলিশ নর্থ ও সাউথ দুটি ডিসট্রিক্ট-এ বিভক্ত। —প্রতিটি ডিসট্রিক্ট একজন ডেপুটি কমিশনারের অধীন। প্রতি ডিসট্রিক্ট-এর দুটি করে ডিভিসন—একজন অ্যাসিসটেন্ট কমিশনারের অধীন। (২) পোর্ট-পুলিশ ডিসট্রিক্ট—জনৈক ডেপুটি কমিশনারের অধীনে মাত্র দুটি থানা। (৩) হেডকোয়ার্টারস রিজার্ভ ফোর্স। এর অধীনে পুলিশ-ট্রেনিং স্কুল। (৪) ট্রাফিক মাউন্টেড পুলিশ। (৫) ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট। (৬) স্পেশাল ব্রাঞ্চ (রাজনৈতিক), সিকিউরিটি কনট্রোল (বিদেশী সম্পর্কিত)। (৭) আর্মড বা সশস্ত্র পুলিশ। (৮) শার্মড এ্যাক্ট বিভাগ —এরা অস্ত্রশস্ত্রের লাইসেন্স দেন। (৯) পাসপোর্ট বিভাগ।— বিদেশ গমনেচ্ছুকদের ছাড়পত্র দেন। (১০) মোটর-ভিহিকল।—এঁরা ট্যাকসি ক্যারেজ ও মোটর গাড়ির হিসাব রাখেন ও তাদের লাইসেন্স দেন। (১১) মালখানা ও পাশ সেকসন।—এঁরা হোটেল ও কারখানার লাইসেন্স দেন। (১২) এনফোর্সমেণ্ট বিভাগ।-এঁরা মজুতদারী, ভেজাল ও মুনাফা বন্ধ করেন। (১৩) সিটি আর্কিটেক্ট—এঁরা বেআইনী গৃহনির্মাণ বন্ধ করেন। এ ছাড়া পুলিশের অধীন দুটি ডগ, পাউণ্ড ও দুটি ক্যাটেল পাউণ্ড আছে।