প্রথম অধ্যায় – পরিসংজ্ঞা

প্রথম অধ্যায় – পরিসংজ্ঞা

বাংলা ও কলিকাতা-পুলিশের এবং ভারতীয় পুলিশের ইতিহাস বিবৃত করার পূর্বে পুলিশের পরিসংজ্ঞা সম্বন্ধে কিছু বলা উচিত।

সৈন্যদলের মিনিমাম্ এ্যাকসন : ফায়ারিঙ [গুলিবর্ষণ] । অন্যদিকে পুলিশের ম্যাক্সিমাম্ এ্যাকসন : ফায়ারিঙ। কিন্তু সেই চরম মুহূর্ত এড়ানোর রীতিনীতি সৈন্যদল জানে না। সৈন্যদল শত্রুমিত্র বাছতে অক্ষম হওয়ায় শান্তিরক্ষাতে সক্ষম হয় না। তারা এজন্য মিত্রকে শত্রু করে কর্তৃপক্ষের অসুবিধা ঘটায়। হত্যা করতে পারলেও তারা রক্ষা করতে অক্ষম। পুলিশের মতো সংবাদ-সংগ্রহ করে গভর্নমেন্টকে সময় মতো সাহায্য বা সাবধান করতে সৈন্যদল অপারগ। মিলিটারীদের মতো পুলিশরা ক্যুপ বা বিদ্ৰোহ করে না। ইতিহাসের সর্পিল পথের কোন্ মোড়ে দাঁড়িয়ে নিয়োগকারীদের আদেশ অমান্য করতে হয় তা পুলিশ জানে না।

মৌর্য ও মোগল সাম্রাজ্যে সুগঠিত পুলিশ থাকায় সাম্রাজ্য দুটি দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল। কিন্তু গ্রীক ও রোম-সম্রাটদের পুলিশ না-থাকার জন্য তাদের সাম্রাজ্য দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। সৈন্যদ্বারা দেশ জয় করার পর পুলিশ দ্বারা উহা শাসন করার রীতি। ভারতে ইংরাজরা বহু বিষয় আমদানি করলেও, পুলিশ-প্রথা ওদের দ্বারা আমদানি বলা ভুল। য়ুরোপে পুলিশ সৃষ্টি সাম্প্রতিক ঘটনা। এদেশে বর্তমান পুলিশও ওদের সৃষ্টি নয়। ইংরাজের অধীন ভারতীয় কর্মচারী ও উপদেষ্টাদের দ্বারাই তার সৃষ্টি। তাদের নিজেদের দেশে [সমকালে] পুলিশের অভাব তার প্রমাণ।

১৬৬৭ খ্রীঃ ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুই প্যারী নগরীতে একদল চৌকিদার নিয়োগ করেন। তাদের ‘প্যারিস-ওয়াচম্যান’ বলা হতো। ফরাসীরা ও পর্টুগীজরা ওই সময় বাণিজ্য ও ধর্মপ্রচারের জন্য ভারতে আসে। তারা বাংলাদেশে প্রথম আসায় বাংলার গ্রামীণ চৌকিদারী পুলিশ সম্বন্ধে অবহিত হয়। ফরাসী ওয়াচম্যানরা হুবহু ভারতীয় চৌকিদারদের মতো ছিল না। বরং তারা বর্তমান দ্বারবানদের সমগোত্রীয়। ১৭৪২ খ্রীঃ প্রুসিয়াতে ফেড্রিক দি গ্রেট এই চৌকিদারীপ্রথার অনুকরণ করেন। ১৭৭৬ খ্রীঃ ফ্রান্সের অনুকরণে লণ্ডন শহরে কিছু প্যারিস-ওয়াচম্যান নিযুক্ত হয়। লণ্ডনে এই কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিদের ‘প্যারিস-ওয়াচম্যান’ বলা হতো। ১৮২২ খ্রীঃ লর্ড পিল কলিকাতার পুলিশের অনুকরণে লণ্ডনে প্রকৃত পুলিশ তৈরি করেন।   

সুগঠিত পুলিশ সহ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অধিকার করায় ব্রিটিশরা এদেশে সহজে কায়েম হয়। পুলিশ ভেঙে দেওয়া স্যাবোটেজের [অন্তর্ঘাত] প্রধান কর্ম। যুদ্ধে পশ্চাদপদ-সরণ-কালে তাই পুলিশকে সঙ্গে নেওয়া হয়। বিজেতাদের পুলিশের সাহায্যে শাসন স্থাপন করতে দেওয়া হয় নি।

সম্ভবত পলিশি কিংবা পলিটি [Polite] শব্দ হতে পুলিশ নামের উৎপত্তি। কারণ রাষ্ট্রীয় নীতি [State-Policy] পুলিশকেই আরোপ করতে হয়। গ্রীক-ভাষায় পলিটি শব্দের অর্থ : নগর। সেজন্য নগর রক্ষীদের পুলিশ বলা হয়েছে। প্রাচীন ভারতে পুলিশকে রক্ষীণ বলা হতো। জনগণকে যারা রক্ষা করে তারাই রক্ষী।

য়ুরোপের দেশগুলিতে মূলতঃ সৈন্যদ্বারা শান্তিরক্ষার কাজ সমাধা হতো। কলিকাতা-পুলিশের অনুকরণে আধুনিক লণ্ডন-পুলিশ [পিল রিফর্ম, ১৮২২ খ্রীঃ] সৃষ্টি হয়। লণ্ডন-পুলিশদের অনুকরণে য়ুরোপের অন্যান্য শহরে আধুনিক পুলিশ তৈরি হয়। ওদেশের পুলিশ সম্পর্কে এইরূপ একটি ধারণা সঙ্গতভাবেই করা যেতে পারে। কেহ কেহ বলেন যে লর্ড পিলের নাম মতো পুলিশ বাক্যটি তৈরি হয়।

পুলিশ দুই প্রকারের হয়ে থাকে, যথা : (১) জনগণ সৃষ্ট পুলিশ এবং (২) শাসক আরোপিত পুলিশ। গ্রামীণ-পুলিশগুলি সাধারণত জনগণ দ্বারা সৃষ্ট হতো। কিন্তু নগর-পুলিশগুলি শাসক-দ্বারা আরোপিত পুলিশ। এ দুটি যথাক্রমে জনগণ এবং শাসকদের দ্বারা নিযুক্ত ও নিয়ন্ত্রিত। প্রথমটি জনগণের স্বার্থে পরিচালিত হয়।

(ক) জনগণ-সৃষ্ট পুলিশ : ইহা স্থানীয় জনগণ হতে উদ্ভূত জনগণের পুলিশ। এরা সংখ্যা-বহুল এবং স্থানীয় ও বিকেন্দ্রিত পুলিশ। উহা নিচে হতে ধীরে ধীরে গঠিত হয়ে উপরে ওঠে। শুধু জনগণের স্বার্থেই এরা কাজ করে। বিকেন্দ্রিক ও স্থানীয় হওয়ায় এরা বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন প্রকারের হয়। এদের উচ্চ-নিম্ন পদগুলিও অনুরূপ কারণে বিভিন্ন নামের হয়ে থাকে। এদেশের বর্তমান চৌকিদার ও দফাদার প্রভৃতি পূর্বতন গ্রামীণ বিকেন্দ্রিত স্থানীয় পুলিশকে স্মরণ করায়।

(খ) শাসক-আরোপিত পুলিশ : ইহা একই কর্মকর্তার অধীনে সমগ্র দেশ কিংবা প্রদেশের, নগর বা রাজ্যের জন্য শাসক-আরোপিত একটি মাত্র কেন্দ্রীভূত পুলিশ। শাসকদের দ্বারা সৃষ্ট ও নিযুক্ত হয়ে তাদেরই স্বার্থে এরা কাজ করে। শাসকদের পছন্দ মতো এই বিভাগে কর্মী নিযুক্ত হয় এবং তাদের দ্বারা সম্পূর্ণরূপে ওরা নিয়ন্ত্রিত। এরা উপর হতে জনগণের উপর আরোপিত পুলিশ। এদের সংগঠনগুলি প্রায় একই আকারের ও প্রকারের হয়ে থাকে।

আমেরিকা ও য়ুরোপের স্বাধীন দেশগুলিতে জনগণ-সৃষ্ট পুলিশের প্রাধান্য বেশি। সেখানে বহু জেলায় কাউন্‌টি ও মিউনিসিপ্যালিটির নিজস্ব স্বাধীন পুলিশ আছে। স্থানীয় জনগণের সংস্থাগুলি তাদের নিয়ন্ত্রক। সরকারের প্রভাব মুক্ত সুনির্দিষ্ট আইনমতো তারা কাজ করে। ওইগুলি ভেঙে কেন্দ্রীয় একটি পুলিশ তৈরির চেষ্টা মধ্যে মধ্যে হয়। কারণ, এক-এলাকার অপরাধী অন্য-এলাকায় এসে কুকাজ করে। দ্রুতগতি যানবাহনের যুগে তারা সহজে গ্রেপ্তার এড়ায়। কিন্তু ওই রকম প্রস্তাব জনগণ প্রতিবার অগ্রাহ্য করে তা প্রতিরোধ করেছে। সেজন্য কয়েকটি রাষ্ট্রে সরকার কর্তৃক ফেডারেল পুলিশ গঠিত হয়েছে। তারা বিশেষজ্ঞ এবং সংযোগ-রক্ষী ও সাহায্যকারী পুলিশ। জনগণ-সৃষ্ট পুলিশের অপরাধ জনগণ মার্জনা করে, এদের বিরুদ্ধে পুলিশী অত্যাচারের প্রশ্ন কখনও ওঠে নি। এরা জনগণের কাছে সন্তানতুল্য আপনজন রূপে বিবেচিত হয়েছে।

কিন্তু ভারত ইন্দোনেশিয়া ব্রহ্ম ইন্দোচীন প্রভৃতি পূর্বতন কলোনিয়াল কান্‌ট্রি তথা ঔপনিবেশিক দেশগুলিতে কেন্দ্রীভূত শাসকদের দ্বারা সৃষ্ট ও নিয়ন্ত্রিত পুলিশেরই প্রাধান্য। ওই শাসক-দল কর্তৃক আরোপিত পুলিশ শাসকদের স্বার্থে কাজ করে। এজন্য তারা কোনও দিনই জনপ্রিয় হতে পারে নি। ভালো ব্যবহার দ্বারা এরা জনগণের সৎ ভৃত্য বা বন্ধুরূপে বিবেচিত হতে পারলেও সন্তানতুল্য আপনজন তারা কখনও হতে পারবে না। 

মধ্যযুগীয় ভারতে কয়েক স্থানে এই উভয় প্রকার পুলিশের সংমিশ্রণও দেখা যায়। পূর্বতন ভারতে নগর পুলিশ শাসক আরোপিত এবং গ্রামীণ-পুলিশ জনগণ সৃষ্ট ছিল। বাংলার ত্রিস্তর জমিদারী পুলিশ তথা জাতীয় পুলিশের সঙ্গে পূর্বোক্ত মিশ্র-পুলিশের তুলনা করা চলে। ভারতে ব্রিটিশরা জনগণ-সৃষ্ট বিকেন্দ্রিত স্থানীয় পুলিশগুলি ভেঙে দিয়ে সর্বত্র শাসক-আরোপিত কেন্দ্রীভূত পুলিশ তৈরি করে।

[ব্রিটিশদের একদল বাংলার জনগণ-সৃষ্ট জমিনদারী পুলিশ ভেঙে দিয়ে উহা অধিগ্রহণ করার পক্ষপাতী ছিলেন না। তাঁরা সমগ্র দেশ বা প্রদেশের জন্য একটি কেন্দ্রীয় তথা ফেডারেল তদারকি পুলিশ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষোক্ত দল তাতে সম্মতি না-দেওয়ায় শেষে জমিনদারী পুলিশ অধিগ্রহণ করে সেটি ওরা ভেঙে দেয়।]

আমি কলিকাতা পুলিশে ভর্তি হওয়ার পর প্রায়ই ভেবেছি : কোথা হতে আমরা এলাম? কার দ্বারা, কবে ও কেন পুলিশের সৃষ্টি? এই সম্পর্কে কবিগুরুর বিখ্যাত কবিতার একটি লাইন প্রায়ই মনে পড়তো। আমি বুঝতে পারি যে জনগণের ইচ্ছা হতেই পুলিশের সৃষ্টি। [‘ইচ্ছা হয়ে ছিলি মনের মাঝারে—’ রবীন্দ্রনাথ।]

জনগণের অপেক্ষা অতিরিক্ত ক্ষমতার অধিকারী পুলিশ নন। গৃহ-তল্লাসী প্রভৃতি কয়েকটি ক্ষেত্র বাদে পুলিশের প্রতিটি ক্ষমতা জনগণেরও আছে। কেবল অসৎ পুলিশ-কর্মীরাই জনগণ অপেক্ষা বেশি ক্ষমতা দাবী করে থাকে। চোখের সমুখে কোনও পুলিশ-গ্রাহ্য অপরাধ সংঘটিত হতে দেখলে পুলিশের মতো জনগণও তা নিবারণ করতে বাধ্য। সেই ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয়তায় উভয়েই দণ্ডযোগ্য অপরাধী হবে। আদালতের করণীয় কাজ স্বহস্তে গ্রহণ করলে জনগণের মতো পুলিশেরও দণ্ড হয়ে থাকে। পুলিশের মতো জনগণও সাংঘাতিক অপরাধের অপরাধীকে গ্রেপ্তার করার অধিকারী। প্রভেদ এই যে জনগণ কর্তৃক ধৃতকৃত আসামীকে তৎক্ষণাৎ পুলিশ-হেপাজতে দিতে হবে। কিন্তু—পুলিশের ক্ষেত্রে অপরাধীকে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে উপস্থিত করা নিয়ম। অপরাধের তদন্ত কাজে ও তার নিরোধে পুলিশের মতো জনগণেরও সমান অধিকার।

[বিবৃতির একটু হেরফেরে জনগণও গৃহতল্লাসী করতে সক্ষম। সেক্ষেত্রে বলতে হবে যে, অপরাধী অনুরোধ করে স্বেচ্ছায় আমাদের কয়জনকে তার গৃহে নিয়ে গিয়েছিল। তারপর আমার হাতে অন্যদের সমক্ষে নিজেই বাক্স খুলে ওই চোরাই দ্রব্যটি তুলে দেয়। পুলিশের নিকট স্বীকারোক্তি আইনত গ্রাহ্য হয় না। কিন্তু পুলিশের অবর্তমানে জনগণের নিকট ওই স্বীকৃতি প্রমাণরূপে বিবেচিত হয়। আইনানুযায়ী পুলিশদের অপেক্ষা জনগণের ইহা একটি অতিরিক্ত সুবিধা রূপে স্বীকৃত।]

জনগণ নিজেদের পক্ষে করণীয় কাজ করার জন্য এক শ্রেণীর বেতনভুক ব্যক্তিকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা দিয়ে উর্দি ভূষিত করেছে। কারণ, জনগণকে বহুবিধ ব্যক্তিগত কাজে ব্যস্ত থাকতে হয় বলে নিজেদের পক্ষে সর্বক্ষণ পুলিশী কাজ করা সম্ভব নয়। তবে একথাও ঠিক যে মানুষের বিবেকই মানুষের প্রথম পুলিশ।

এই পুস্তকে আমি পর পর ভারতের প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় পুলিশের ইতিহাস ও সংগঠন বিবৃত করবো। এতে পাঠান ও মোগল-পুলিশেরও বিবরণ থাকবে। তারপর, বাংলার শাসন, বিচার ও পুলিশ সম্বন্ধে বলবো। তবে বাংলার পুরনো জমিনদারী পুলিশ এবং ব্রিটিশ পুলিশের সংগঠন ও বিবর্তন এই পুস্তকের মুখ্য আলোচ্য বিষয়। এই সব কয়টি পুলিশের তুলনামূলক আলোচনা এ-পুস্তকে থাকবে।

এই পৃথিবীতে ভ্যাকুয়াম অর্থাৎ শূন্যের কোনও স্থান নেই। তাই রাষ্ট্রীয় পুলিশ তার করণীয় কাজ না-করলে জনগণ তাদের পল্লীতে প্রাইভেট পুলিশ সৃষ্টি করে। সাম্প্রদায়িক মহাদাঙ্গার কালে আমরা তা দেখেছি। সেক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় শিক্ষার অভাবে তারা ভুল করে। কিছু বিপথগামী তরুণও এইভাবে প্রাইভেট পুলিশে ঢুকে পড়ে। এজন্য আপতকালে নিষ্ক্রিয় থাকা রাষ্ট্রীয় পুলিশকেই দায়ী করা উচিত।

সময়ে সাহায্যে না-পাওয়ায় সিনেমার মালিক ও বেশ্যাপল্লীর নারীরা লড়াকু ব্যক্তি বা গুণ্ডাদের দ্বারা বেতনভুক প্রাইভেট-পুলিশ তৈরি করে। ফ্যাক্টরি ও মিল প্রভৃতিতে সিকিউরিটি সংস্থা প্রকারান্তরে বৈধ প্রাইভেট-গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠান দ্বারা নাগরিকগণ অনুসন্ধান ও তদন্ত আদি করান। এইগুলি রাষ্ট্রীয় পুলিশ সুষ্ঠুভাবে করলে জনগণ নিশ্চয় তাদের দ্বারস্থ হতেন না। [তবে বাংলা, কলিকাতা ও ভারতীয় পুলিশ এই সকল দোষ হতে মুক্ত।]

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *