ছয়
”সমু, তোর বিয়ের চিঠিটা পেয়ে খুব ভাল লাগল। এখনই বসে বসে ভাবছিলাম, জীবনে ভাল লাগার কত কি পিছনে ফেলে আসতে হয়। আমাকেও ফেলে আসতে হয়েছে সমু। পূর্বাশাকে বড় ভালবাসতাম, ওই শহরকে বড্ড ভালবাসতাম। তোদের বন্ধুত্ব আমাকে আমি তৈরি করেছে। তোকে, তোদের আজও ভালবাসি। আমার তোর বন্ধুত্ব কেড়ে নেয় কে? তুই পূজাকে বিয়ে করছিস জেনে আরোই খুশি হলাম। চলে এসেছিলাম ১৯৮৭—তে। এটা ১৯৯৩ পড়ে গেল। আমাদের সকলের বয়সই ছ’বছর বেড়ে গেল তাই না? সুজাতাদির সঙ্গে যোগাযোগ তো আছেই। তোদের কাজকর্ম কত বেড়েছে। ওখানে গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতির সঙ্গে তোরাও আছিস। এ সব ভাবলে আমার খুব গর্ব হয়।
আমার কথা তুই খুব জানতে চাস, তাই না? তাহলে বাড়ির কথাই বলি আগে। বাবা, দাদা, দিদি, সবাই খুব গর্বিত এখন আমার জন্যে। আমি তো জানি, কাগজে এত লেখালেখি না হলে ওরা এমন উচ্ছ্বসিত হতো না। দাদা লিখেছে, ঝুমা খুব গর্বিত, আর দাদা দেখছে, ডোনেশান তুলতে পারে কি না।
দিদি আর অমেয়দার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে জানিস বোধহয়। দিদি আবার বিয়েও করছে। ছেলেমেয়েরা নাকি বাবা—মা দুজনের কাছেই আসতে পারবে।
বাবা তো এখন দেওঘরে থাকে। কোনোদিন ধর্মে মন ছিল না। এখন নিজেকে বেশ মানিয়ে নিয়েছে। লিখেছে গভীর শান্তি পাই। তোমার জন্যে মনে দুশ্চিন্তা ছিল। তুমি মানব—সেবাব্রতে নিজেকে সমর্পণ করেছ, ভাবলে বড় শান্তি পাই।
ব্যাপারটা দেখ। ধর, আমি যদি কোনোদিন বিয়ে করি (করব বলছি না), তাহলে বাবা, দিদি, দাদা, সবাই হয়তো দুঃখই পাবে।
তোকে সব লেখা যায়, তাই বলছি, এখানে যাদের মধ্যে আছি, তাদের জীবন এমনই ভাঙাচোরা যে, নিজের কথা ভাবার সময়ই পাইনি। ওদের কথা জানার পর আর নিজের দুঃখ বা ক্ষতিকে বড় মনে হয় না। অনেক, অনেক মেয়ে আমার চেয়েও লাঞ্ছিত সমু, তাদের আমি জানিও না। কিন্তু এটা জানি যে, আমার মতো মেয়েরা অনেক। আমি তাদের একজন হয়তো। চরম সৌভাগ্যবতী একজন। আমাকে তো মুখ লুকিয়ে বেড়াতে হয়নি। আমি আরো বড় একটা কাজের মধ্যে মুক্তি পেয়েছি।
ক’বছর দেখা হয় না? ছ’বছর। তুই এখন আমাকে দেখলে চিনতে পারবি না। তুই রাগলে বলতিস, চড় মেরে মুখের ম্যাপ পালটে দেব। তা, আমার মুখের ম্যাপ পালটে গেছেই (কতগুলো আঁচড় কামড় বল তো?), আয়নার সামনে দাঁড়ালে নিজের আগেকার মুখ মনে করতে পারি না। বাঁ গালটা, কামড় সেলাই করেছিল বলে অদ্ভুত কোঁচকানো। কপালে একটা লম্বা সাদাটে দাগ। আর দাগগুলোর কথা নাই বললাম। চুলগুলো তখন ডাক্তার কেটেছিল, কেটেই ফেলেছি।
নিজের কথা ভাববার সময় দেয়নি নিশীথদা। আমাকে এনে ফেলল এখানে। প্রথমে কাজই হলো, যে দশজনকে নিয়ে উইন—এর (ফর উইমেন ইন নীড) সংসার শুরু হয়, তাদের কেস হিস্ট্রি লিখে ফেলা। আমার খুব ইচ্ছে, এ চিঠিটা তুই আমাদের বন্ধুদের পড়ে শোনাবি, আমার ভাল লাগবে। আচ্ছা, গুলতি এমন সাঁতারু ছিল যে, কম্পিটিশনে নামতে গেল। ও জলে ডুবে মারা গেছে, এ কথা এখনো ভাবতে খুব কষ্ট হয়। ওর মা কেমন করে সামলাবেন নিজেকে? এক ছেলে গেল বাস চাপা পড়ে, গুলতি গেল জলে ডুবে। তোরা তো ওর নামে ‘আবীর স্মৃতি পাঠাগার’ করেছিস।
কাদের পেলাম জানিস?
প্রথম মেয়ে বিদ্যুৎরানী পাল, ডাকনাম বিবি। শুনলাম বয়স তেইশ, দশ বছর জেলে ছিল এন. সি. এল. মেয়ে হিসেবে। রোগা হাড় বের করা কেঠো চেহারা, চুল উকুনে বোঝাই ছিল, এখানে ওষুধ দিয়ে সারিয়েছে। অবশ্য চুলে উকুন, আর উপযুক্ত খাদ্যের অভাবে সর্বাঙ্গে ঘা এদের সকলেরই ছিল। মাধবী আর গৌরী, আমাদের দুই স্বাস্থ্যকর্মী এদের ধরে ধরে পরিষ্কার করেছে।
বিদ্যুৎ তো বলতেই চায় না কিছু। অনেক সাধ্যসাধনার পর বলল, আমরা কর্মকার। বাপের নাম নারায়ণ কর্মকার। আমি স্কুলেও গেছি, পড়তেও পারি, জেলে তো বই পাইনি। জানি না ভুলে গেছি কিনা। আমাদের গ্রাম সুলাপুর, ডাক চাম্পাবাজার। বাড়িতে সৎমা, খুব মারত। তা একদিন সৎমার ভাই বলল, বাড়িতে মেরে মেরে মেয়েটাকে মেরে ফেলবে? আমি ওকে নিয়ে যাই। বাহিরগাছি থেকে ট্রেনে উঠব। ঠাকুরনগরে আমার শাশুড়ী থাকে। তিনি ওকে তিরিশ টাকা মাইনে দেবে, খাওয়া—পরায় থাকবে। তিনি মানুষ খুব ভাল, ওর বিয়েও দিয়ে দেবে।
আমাকে বাহিরগাছি স্টেশনে বলল, কানের ফুল আমায় দে। পথে বড় চোরের ভয়, তা দিলাম। তারপর ঠাকুরনগরে নেমে ‘রিকশা ডাকি’ বলে সেই যে পালায় আর তার দেখা নেই। সেখান থেকে রেলপুলিশ আমাকে থানায় জমা দিল। কত বললাম বাবার নাম এই, ঠিকানা এই, কিছু শুনল না জেলে ঢুকিয়ে দিল। তা কত বলেছি, বাবাকে খবর দাও। মেট্রন বলত, জেলখাটা মেয়ে ফেরত নিতে তাদের বয়ে গেছে।
মেট্রনের পা টিপতাম, গায়ে তেল মাখাতাম, তার কাপড় কাচতাম। পাগলীদের সঙ্গে থাকতাম, তবে আমার বিছানা ছিল।
বিদ্যুতের অনেক প্রশ্ন। এটাও কি জেল? পেট ভরে খেতে কেন দেয়? এই মেট্রন (রুচিরাদি) লাথি মারে না কেন? জামাকাপড় পরতে দিয়েছে, কেড়ে নেবে?
এই বিদ্যুতের বাবাকে চিঠি লিখেছি আমরা। শেষে নিশীথদা কাদের নিয়ে সুলাপুরেও গেল। নারায়ণ কর্মকার নাকি বসবাস তুলে কোথায় চলে গেছে।
এই বিদ্যুৎ আস্তে আস্তে নরম হলো। ও এখন মেটেলিতেই দর্জিদের কাছ থেকে কাজ আনে। কলে সেলাই করে। বইটইও পড়ে। আর সকলকে বোঝায়, এ খুব ভাল জায়গা। মন দিয়ে থাকো, ঠিক ভাল হবে তোমার! ওর চেহারাটাও পালটে গেছে।
অঞ্জু দাশ যখন আসে, ওর বয়স সাঁইত্রিশ। নদীয়া জেলায় শ্যামপুরে বাড়ি। কেষ্টনগরে পুজো দেখতে এসে স্বামী আর মেয়ের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। দু’দিন বাদে বাড়ি ফিরে যায়, কিন্তু স্বামী ওকে ফিরে নেয়নি। পঞ্চায়েতের বিচারে তবে ওকে নিল। কিন্তু স্বামী বরাবরই বড় বউদির বশ ছিল। বাড়িতে কষ্ট হঠাৎ বেড়ে গেল, অঞ্জু একটা টাকা চাইলে পায় না। শেষে অঞ্জুরা কয়েকজন মেয়ে ধানকলে কাজ করতে গেল।
অঞ্জুর মতে সে মহাপাপী। সেখানে আরেকজনের সঙ্গে ওর ভাষায় ”প্যাম হইল, লাব বলতে পারেন। হে খুব দরদ দেখাইত! আহা! সোয়ামি চক্ষে দ্যাহে না। আহা! হে তার বরবউদির হাতের বশ! ক্যান পইরা থাকবা চ্যালাকাঠের বারি খাইয়া? আমার লগে চল কলকাতা! মাইয়া পরে আইনা নিমু।”
এবং কলকাতায় তাকে শেয়ালদায় এনেই তার ‘টাকাটুকা বাসনকুসন, ছুটকেসটা লইয়া হে উধাও।” অঞ্জুদের জীবনের একটা অলিখিত হিসাব আছে সমু। সেই হিসাবে অঞ্জুও পৌঁছে গেল জেলখানায়।
অঞ্জু জেলখানা থেকে খুব তেজস্বিনী আর খানিকটা ছিটেল হয়ে এসেছিল। বলত, মারুম! কাটুম! জীয়ন্ত পোড়ামু অরে।
—কাকে অঞ্জুদি?
—সুধইন্য পালরে, যে আমারে লইয়া…
কখনো বলত, মাইয়ার বাপরে, যে আমারে এত কষ্ট…কিন্তু মাঝে মাঝেই বলত, জেলখানায় কি চলে তা যদি জানতা! মাগো! তার নাম করতে ডরাই। মাইয়াগো…বাপ রে! তার নিরশংস, নির্দয়।
শ্যামপুর থেকে কিন্তু ওর স্বামী চিঠি লিখেছিল। চিঠিটা রুচিরাদিকে লেখা। একবার আসতে চেয়েছিল।
আধা বৃদ্ধ, শুকনো চেহারার লোকটি যেমন ভীরু, তেমন কুণ্ঠিত। অঞ্জুর জন্যে ও গুড়, মোয়া একটি ঊষসী সাবান এনেছিল। ওদের বসিয়ে রেখে আমি বেরিয়ে আসি, কেন না অঞ্জুকে দেখেই লোকটি হো হো করে কেঁদে বলেছিল, বুনির মা রে! ক্যান তুই ঘর ছাইরা গেলি?
সসম্ভ্রম চাহনি ছিল ওর চোখে। ও তো ভাবেনি বাগান ঘেরা এমন এক দোতলা বাড়িতে ঢুকবে, এমন সাজানো ঘরে দেখা করবে তার বউয়ের সঙ্গে।
আমি, মাধবী আর গৌরী ভাবলাম, হয়তো ওরা কথাবার্তা বলছে তো বলছেই। হয়তো আমাদের ভাষায় ইন্টারঅ্যাকশানের একটা সূচনা হচ্ছে।
হয়নি। অঞ্জু সে ঘরে একাই বসেছিল, গৌরী যখন ওর স্বামী চা খাবে কিনা জানতে গেল। অঞ্জু বলল, হে বিয়া করছে বরো বউয়ের বুনরে। বুনিরে সে অযতন করে না। হেয়াগো আবুস্তা ফিরছে, সেলোয় চাষ করে, সেলো ভারা দেয়। দ্যাশে দশে জানে বুনির মা চইলা গিছে। অহন ফিরুম ক্যান। অগো বারা ভাতে ছাই দিতে? ভাল সংবাদ, ভাই ভাই আলাদা। বুনিদের ঘরে তার জেঠি পা দেয় না। বুন বুনের মুখ দেখে না।
অঞ্জুদি আয়া ট্রেনিং নিয়ে বারুইপুরে এক নার্সিংহোমে প্রাইভেট আয়ার কাজ করে, রাতে ডিউটি নেয় না। রাতে রান্নাঘরে বাসন্তীর মাকে সাহায্য করে।
মিনু যখন আসে, ওর বয়স বারো। একেবারে পাঁচবছরের মেয়েকে নিয়ে মা জেলে ঢুকেছিল কেন, তা মিনু জানে না। মিনু জেলের বাইরের কোনো জগৎ জানত না। ও কোনোদিন আস্ত জামা ইজের পরেনি, বেড়াল ও কাক ছাড়া কোনো পশুপাখি দেখেনি, কেমন জীবন ছিল বুঝতে পারেন, ওকে জেলের ভেতরে অন্য মেয়ে কয়েদীদের কেউ কেউ যৌন সম্পর্কে বাধ্য করত। মা—দিদি—মাসি—পিসি, এমন কোনো সম্পর্ক যে হয়, তাও ও জানত না।
ও সবসময় ফুলকুমারীর সঙ্গ খুঁজত। ফুলকুমারী একটি নেপালী মেয়ে। জগদ্দলের কোনো কারখানায় ওর স্বামী কাজ করত। কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে ওরা কলকাতায় চলে আসে। শেয়ালদার কাছে বস্তিতে গ্যাংরেপড হবার পর নেপালী মেয়ে ফুলকুমারী আর বিহারী মেয়ে জানকী (নৈহাটি থেকে একই কারণে কলকাতা আসে) দুজনকেই ধর্ষণকারীরা শাসিয়ে যায় যে বস্তির দখল ছেড়ে চলে না গেলে আবার ওরা গ্যাংরেপড হবে। জানকীর বর ছিল না, প্রেমিক ছিল। ফুলকুমারীর ছিল বর, মেয়ে, ছেলে।
ভাবতে পারিস, নৈহাটি—জগদ্দল এলাকার ওই ছাবিবশ ঘরকে তুলে দেবার জন্যে লোকাল মস্তানরা ওদের চার বার গ্যাংরেপ করেছে?
চার বার সমু! ওরা তাদের মুখ দেখেছিল, চিনত। আমি তো কাউকে দেখিনি।
শেষে স্থানীয় নাগরিক সমিতি এসে পড়ে। প্রচুর লেখালেখি হয়। মেয়েরা ”সেফ কাস্টাডি” লেবেল পেয়ে জেলে যায়। কেসও হয়। আসামীরা প্রমাণাভাবে খালাস পায়, আর এরা থেকে যায়।
এখানে যখন আসে, ফুলকুমারীর বয়স চল্লিশ আর জানকীর আটত্রিশ।
ওদের বাড়ির খবর তো নেওয়াই যায়নি। সেসব বস্তির জায়গায় ঘরদোর, দোকান—পাট। ওদের ছবি কাগজে দিয়েও খবর মেলেনি। ফুলকুমারী, বোধহয় নিজের মেয়ে ছিল বলেই, মিনুকে এত ভালোবাসত।
ওরা দুজনেই এখানে থেকে গেছে। লেখাপড়া শিখেছে। নিশীথদা ওদের দুজনকে নিজেদের ”মা ও শিশু” সেণ্টারে ট্রেনিং দিয়ে নিয়েছে, ওরা ওখানে কাজ করছিল, কিন্তু জানকী এখন ওখানকার দরোয়ানের বউ। এখানকার বউ। দেশেও দরোয়ানের বউ আছে।
বসিরহাটের দীপালি নস্কর এগারো বছর জেলে কাটিয়ে আটাশ বছর বয়সে এখানে এসেছিল। সুন্দর মুখ—চোখ, চেহারা দেখে মনে হয় না ওর কোনো ভীষণ অতীত আছে। অতীতটা ভীষণই। ওর সতেরো বছর বয়সে ওর মামা ওকে এক অবাঙালীর কাছে বেচে দেয় কলকাতায় এনে। সে অবাঙালী ওকে মাস আষ্টেক রেখে গর্ভপাত করিয়ে বেচে দেয় এক বাঙালী মহিলার কাছে। ইনি মধ্য কলকাতায় কোথাও নিজ বাড়িতেই ব্যবসা চালাতেন, কলগার্ল জোগান দিতেন। তাঁরই কোনো এজেণ্ট তাঁকে খুন করে পালায় এবং কলগার্লরা ধরা পড়ে। তারপর কোন আইনের কোন নিয়মে দীপালি থেকে যায় পুলিশ লকআপে এবং ধর্ষিতাও হয় বার বার, সে অঙ্ক জানতে চাস না।
দীপালি নিষ্প্রাণ জড় হয়ে গিয়েছিল। এখানে তো নিয়মিত আসেন সাইকিয়াট্রিস্ট। দীপালি চিকিৎসাধীন, হয়তো আজীবনই তাই থাকবে। সহ্য করতে পারে না বন্ধ জায়গা। বাগানে ঘোরে, খুব ঘোরে। কিন্তু গেট পেরিয়ে মেটেলির মাটিতে পায় দেয় না কখনো।
রামপুরহাটের শেলী আর বেলী সিং ”ইট ভাটায় কাজ করবি” পার্টির সঙ্গে, দিন বিশ টাকা মজুরির লোভে ট্রাকে চেপে বসেছিল। ওদের বাড়ি মহিষা, ডাক নামোপুর—খাসাড়া, বাবার নাম উমাকান্ত সিং। ওরা জাতে ডোম, শেলী আর বেলী, দুই বোনই বলে, ”আমরা ব্রহ্ম ডোম”—তার মানে কি, আমি জানি না।
ওদের মধ্যে শেলীর বিয়ে হয়েছিল, বেলী বিধবা হবার পর সাঙা করে। ওরা বলে, ”এখন পঞ্চাইত থেকে কাজ মেলে, মজুরিও বেড়েছে, তখন এমুন ছিল নাই।” শেলীর বর আর বেলীর সাঙা বরও সঙ্গে ছিল। কিন্তু ট্রাকটি বারাসাত নীলগঞ্জে পৌঁছে আরেকটি ট্রাকে চাপিয়ে দেয় এবং রাতে হুড়োহুড়িতে অপেক্ষমান দুটি ট্রাকের যে ট্রাকে ওরা ওঠে, তাতে বেলীর সাঙা বর ছিল না।
যে ইটভাটায় ওদের নিয়ে যায়, তার মালিকানা নিয়ে লড়াই চলছিলই, যা এদের জানার কথা নয়। দুই মালিকই লেবার আনে। তারা স্থানীয় লোক, দুজনেরই ছিল মস্তান বাহিনী। কাজ শুরু হবার আগেই হামলা শুরু হয়, মারামারি বোমবাজিতে একজনের মুনসী (ভাটায় সর্বশক্তিমানদের একজন) মারা যায়। মাতাল মস্তানরা কুলি ঝোপড়ি ভেঙে দেয়। শেলী ও বেলী আর ওন্দা থানার লক্ষ্মী দৌড়তে দৌড়তে বাসরাস্তায় গিয়ে ওঠে। সেখানে ওরা সারারাত জড়াজড়ি করে বসে থাকে। লক্ষ্মী বলে, এর চেয়ে বর্ধমান গেলে ভাল হতো। মাঠে কাজ পেতাম। শেলী আর বেলী (আসল নাম মিলন আর খেলন, কিন্তু যাত্রাপালা দেখে ওরা নাম পালটেছিল) এক রাতের কামারাদোরির ফলে গভীর বিশ্বাস পায় ও বলে যে ওরাও যাবে। খেটে টাকা নিয়ে ঘরে ফিরলে কে কি বলবে? ওদের আশা থাকে, সকালের মধ্যে অন্যরা এসে পড়বে।
সকালে যে আসে ওরা শুনল তার নাম রেণুবালা, সে অন্য ট্রাকে এসেছে। রেণুবালা বলে ওখানে খুব হ্যাংগামা, খুনের ব্যাপার, তাই বেটাছেলেদের বেরোতে দেবে না পুলিশ।
চল চল, তোদেরে আমি ভাল জায়গায় নে যাব বলে রেণুবালা ওদের একটি ট্রাকে তোলে।
অঙ্কের স্বাভাবিক হিসাবেই রেণুবালা (গোসাবায় ও রেণুবালা কলকাতায় ও রানী এবং বাংলাদেশে ও সালেহা) ওদের নিয়ে যায় ব্রথেলের উদ্দেশে। কোনো চায়ের দোকানে বসিয়ে চা কচুরি, মামলেট খাওয়াতে খাওয়াতে ব্রথেলের দালালের সঙ্গে যখন দরকষাকষি হয় (ওরা দূরের টেবিলে বসেছিল) তখন লক্ষ্মী কিছু আঁচ করে এবং ওদের দুজনকে নিয়ে পথে বেরিয়ে ফুটপাত ধরে দৌড়তে থাকে।
এদের দৌড়বার পথ, সে যেখান থেকেই হোক, প্রেসিডেন্সি জেলে গিয়েই শেষ হয়। ফুটপাথ ও প্রেসিডেন্সি জেলের মধ্যবর্তী সময়ে শেলী ও বেলী লক্ষ্মী থেকে ছিটকে যায়। সে সময়ে ওরা কি করেছে তা ওরা বলে না। কিন্তু জেলে দু’বছর থাকার পর লক্ষ্মীকেও ওরা পেয়ে যায়। শেলী ও বেলী ন’বছর, এবং লক্ষ্মী সাত বছর জেলে ছিল।
যেটা অবিশ্বাস্য, অথচ ঘটে, যে মিরাকাল বুঝিয়ে দেয় জীবনে অনেক ইতিবাচক দিক আছে, তা আমি ঘটতে দেখেছি তিন বছর ধরে।
লক্ষ্মীর মনে ভয়ানক গোলযোগ ঘটে গিয়েছিল। পুরুষ মানুষ দেখলেই বলত, জামা খুলব না কাপড় তুলব? সেই লক্ষ্মীর সাইকিয়াট্রিক ট্রিটমেণ্ট আজও চলছে। কিন্তু ওর বাবা বগাডিহা গ্রাম থেকে দু মাস বাদে বাদে আসে, কথা বলে এটা সেটা আনে! লোকটি ঋজু স্বভাবের, কঠিন মতামতের লোক। সে বলল, আমি তো মেয়েকে অনেক খুঁজেছি। এখন আমি একা পড়েছি। ছেলে খড়গপুরে কাজ করে, আসবে না। ওর মা কবে মরে গেছে। লোকের কথায় ‘বাঁকুড়া জনমত’ কাগজে বিজ্ঞাপনও দিয়েছিলাম। জেল থেকে একটা চিঠি দিলে…
ওর গ্রাম? ওর সমাজ?
ও বলল, বাঁকুড়া বড় দুঃখী জেলা গো মা! বছর বছর মেয়েরা নামালে যায় বর্ধমানে। সাঁওতাল মেয়ে…আমাদের মেয়ে…আমার মেয়েকে আমি নিয়ে যাব, কিছু বলবে কে?
তিন বছর হলো লক্ষ্মীকে ওর বাবা নিয়ে গেছে। যাক অঞ্জুর স্বামী, লক্ষ্মীর বাবা, এদের কথা ভাল লাগল না?
শেলী ও বেলীর বাড়িতে চিঠি লিখে, খবর দিয়েও উত্তর পাইনি আমরা। রুচিরাদির খুড়তুত ভাইয়ের ব্যবসা নানা মাপের খাম তৈরি করা। শেলী সেই কাজ করছে, থাকে ও খায় মালিকের বাড়ি। নিশ্চয় বাড়ির কাজ কিছু করতে হয়।
বেলীর বিষয়ে আমাদের অভিজ্ঞতাটা ভাল হলো না। কোনো ট্রেনিং নেবে না, সাজগোজ প্রসাধনে অত্যধিক মন। রুচিরাদি কত বোঝাল, ভাল হয়ে থাকো, কোনো কাজ করো, তাহলে হয়তো বিয়েও হবে। কিন্তু ও একদিন জাস্ট বেরিয়ে গেল।
দোকান থেকে সেণ্টারের সাবান, লবণ, আরো কি কি কিনবে বলে পঞ্চাশ টাকা ওকে দেওয়া হয়েছিল।
যাবার আগে ও বাসন্তীকে বলে গেছে, বয়স হলো আটাশ। খেয়ে মেখে গতর ফিরেছে, দেহের রোগবালাই গেছে। এখন বল, লাইনে দাঁড়ালে দিন চল্লিশ/পঞ্চাশ রোজগার। ব্যাণ্ডেজ পাকিয়ে বা বই বাধিয়ে কি পাব?
বাসন্তীকে রুচিরাদি খুব বকলেন। ও বলল, ও তো এমন কথা হরদম বলে, আবার সওদাও কিনে আনে। কেমন করে জানব যে মোটে আসবে না?
গোসাবার মনোরমার কাহিনী খুব সংক্ষিপ্ত। মনোরমা যখন আসে, বয়স চল্লিশ। দশ বছর জেলে কাটিয়েছে! ওর ভাষায় বারো বচরে বিয়ে, তিরিশ বচর অব্দি বাঁজা। সোয়ামি আবার বে’ করে। করবে নে? ছেলে চায় তো মানুষ। তা ধরো সতীন নে’ সাত বচর ঘর করিচি। আমারে তাইড়ে দেয়নে, খাটতাম, খেতাম। সোয়ামির শাগসবজির আবাদ, ধেনো জমিও দু’বিঘে।
তা ছেলেপুলে হয় নে, গতর খুব। হাট হতে ফিরতেছি, আমারই পাড়ার কজনে আমারে ইয়ে করে মাতায় বাড়ি দে’ গাঙে ফেলে পালায়। তা বাদে তুলল মিঞারা। তারা থানায় গেল, আমারে হাসপাতালে নিল পুলিশ। তা বাদে কি হাংনামা। পাশের গাঁয়ে আমাদের জ্ঞেয়াতি জন, খুব শত্তুরতা সম্পক্কো। তারা রইটে দিল হিঁদুর বউরে মোচনমানেরা ওই সব করেচে। কি সাজো সাজো, মারো মারো, শেষে বলে ও বলতেচে এরা ওরে ইজ্জত লুটেচে, মোচনমানে বাঁইচেছে, ওরে মেরে ফেলব। তাইতেই আমার জেলে আসা। পেরথম পেরথম সোয়ামি আসত, দেখে ঝেতু। তা বাদে আসে নে আর। এই তো কতা”।
মনোরমা আর মিনুর ভাব খুব। মিনু ইস্কুলে যায় এখানকার। মনোরমা পৌঁছে দেয়। ওকে শেখানো হচ্ছে নাইলন সুতোর থলি বানানো। ওর কাজে মন আছে।
এখানে এসে জানলাম, কত রকমে মেয়েদের গায়ে দাগ পড়ে, কত ভাবে তারা ব্যবহৃত হয়।
যাদের পুনর্বাসিত করা সহজ হবে, এমন দশজনকেই ১৯৮৭—তে আনা হয়েছিল।
তারপর যারা এসেছে, তাদের চার জনের কোনো কেস হিস্ট্রি নেই। স্রেফ রাস্তা থেকে কোনো কারণে তুলে নিয়ে আসে পুলিশ, ঢুকে যায় এন—সি—এল ওয়ার্ডে।
ওদের কথা অন্য কোনোদিন জানবি।
আমি তো মনে করি, এখানে না এলে, নিজের সর্বনাশকে বড় করে দেখতে দেখতে আমি মানসিক রোগী হয়ে যেতাম।
ওদের জেনে তবে যেন পায়ের তলার মাটি পেলাম। মনোরমা যখন বড় বড় অক্ষরে বাজারের হিসেব লেখে, সেটা আমাকে গভীর আনন্দ দেয়। ও তো নিরক্ষর ছিল।
আর মিনু! এই বয়সে ক্লাস ফাইভে পড়ছে সুনন্দাদির ননফর্মাল স্কুলে। কি যত্ন করে ও একটা চড়াই পাখির ভাঙা ডানা মেরামত করে, শালিকের বাচ্চাকে বাঁচায় বেড়ালের থাবা থেকে, আমার ঘরটাতে মাঝেমাঝেই হাসপাতাল বানিয়ে ফেলে। রুচিরাদি ওকে আমার ঘরে রেখেছেন।
আমার কাটাকুটি দেখলে বলত, জেলে খুব মারত মাসি? কেটে কেটে দিত?
জেলে এদের অভিজ্ঞতার কথা কি বলব বল?
মেয়েদের শরীরটার এমন বাজার! জেল থেকে জেলকর্মী রামদুলারী মেয়ে পাচার করত বলেই তো তার বিরুদ্ধে কেস করেছেন শিবশঙ্কর চক্রবর্তী। একটা কেস একজনের চেষ্টায়। কত রামদুলারী জড়িয়ে থাকে মেয়ে—পাচার চক্রের সঙ্গে, কত চান্দোয়া তাদের শিকার হয়, হিসেবে কোথায়?
জেলে মেয়েরা মেয়েদের কামুকতার শিকার হয় না? জয়া মিত্রের বইটা পড়ে নিস।
আমি খুব ভাল আছি সমু। ভালই থাকব। অবশ্য নিশীথদা বলে, এই শক থেরাপিটা আমার দরকার ছিল। ঠিকই বলে। ওর ওপর আমার মনে খুব নির্ভরতা এসে গেছে।
অমিত গঙ্গাদূষণের ওপর অমন একটা ডকু ফিলম করে ফেলল? ভাবা যায় না।
তুই তো তোর কথা রেখেছিস। সুধীনবাবুর জুনিয়ার। পূজা এখন আই—সি—ডি—এস—এ কাজ করে, স—ব খবর রাখি।
ভাল থাকিস, ভালবাসা নিস তোরা সবাই। তোদের সকলকে কত ভালবাসি এখন বুঝতে পারি। তোদের বিয়েতে কি প্রেজেণ্ট পাঠাব ভাবতে পারবি না—পুতলি (এখন কিন্তু আমি পল্লবী।)