প্রতি চুয়ান্ন মিনিটে – ৩

তিন

একটা ছোট শহর, বড় শহর নয়। নয় কলকাতা। বড় হবার জন্যই হোক, বা অন্য কোনো গবেষণাযোগ্য কারণ থাকুক, কলকাতা ভয়ংকর ও বিধ্বংসী সব আঘাতের পর চলতে পারে। বিনোদ মেহেতা হত্যা, অথবা বানতলা—রাইটার্সে বোবা কালা ধর্ষিতা মেয়ে ফেলানী, অথবা বউবাজার, কলকাতা চলতে পারে, চলতে পারে।

একটা ছোট শহর পারে না এত আঘাত নিতে। তাকেও চলতে হয় সব কিছুর পরেও, জীবনের নিয়মেই চলতে হয়। কিন্তু আঘাতের ক্ষত বহন করতে বড় কষ্ট হয়।

শহরের আশপাশে নারীধর্ষণ ও হত্যা এমন বিরল কোনো ঘটনা নয়। এরকম হয়, মাঝে মাঝে হয়। কখনো প্রতিবাদ হয়, কখনো হয় না। অ্যাসেমব্লিতে পঠিত স্টেটমেন্ট কাগজে পড়ে আমরা ২/১ মিনিট ভাবিত হই। অতঃপর কাগজের মতো খবরটিও বাসি হয়ে যায়।

প্রতিবাদের প্রতিরোধের ছোট ছোট দ্বীপ দেখা যায় এখানে সেখানে। এখনো তা দ্বীপ, সম্মিলিত বিশাল ভূখণ্ড নয়।

সুজাতাকে সহ্যই করতে পারছিলেন না নীহার। আসলে কোনো আঘাত আসেনি জীবনে, পূর্বাশার ভেতরে ঢুকে গেলেই নিজেদের ভীষণ সুরক্ষিত মনে হতো। পুতলির বা সমুর উচ্চাশা নেই। ওরা এ—ওকে বিয়ে করবে, এর চেয়ে বড় দুঃখ ওঁরা পাননি। সুরক্ষিত, সুছন্দ, নিয়মবাঁধা জীবনযাত্রা।

হঠাৎ তাঁরা যেন নগ্ন, জনতার চোখের সামনে।

পুতলি গণধর্ষণের পর জীবন্মৃত এক নির্বাক শরীর মাত্র, হাসপাতালে পড়ে আছে।

এ আঘাত অশ্রুকণা নিতে পারলেন না।

কুমার ও পিপলি ও নীহার বললেন, সুজাতা ডেকে নিয়ে গেল কেন?

এস. পি. বললেন, আপনাদের মতে তিনিই দায়ী?

—নিশ্চয় দায়ী।

—বী রীজনেবল।

—এক গ্যাং ছেলেমেয়ে থাকতে…

—গ্যাং যদি বলেন, তাতে আপনার মেয়েও আছেন, আর ওরা তো ড্রাগ, পণপ্রথা, মেয়েদের ওপর নির‍্যাতন, পুকুর ডোবা দূষণ ইত্যাদি পাবলিক ইস্যুর বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন। কোনো রাজনীতিক স্বার্থ নেই।

কুমার বলে, বুঝলাম। এখন হবেটা কি?

—কেস হবে।

—কেস! পুতলি বাঁচে কি মরে…

—এখানে কি চিকিৎসা বা হবে…

—অফ দি রেকর্ড বলছি। নিয়ে যান না বোনকে। ভর্তি করুন কলকাতার কোথাও…

নীহার বলেছিলেন, খুনীদের কি হবে?

—মার্ডার? কোথায়?

—মার্ডার নয় এটা? আমার জীবন, সম্মান, সব খুন হয়ে গেল। আমার স্ত্রী…আমার স্ত্রী…এটা মার্ডার। আমার মেয়ে কোনোদিন স্বাভাবিক হবে? এতগুলো জীবন নষ্ট, এটা মার্ডার নয়?

এস. পি. সময়োচিত গাম্ভীর্য মুখে এনে মাথা নেড়ে সম্মতি জানান।

কুমারকে বলেন, এই তো হয়! কিন্তু পুলিশ তো চায় এভিডেনস।

—ট্রু।

—আপনার বোনকে এখনো জিজ্ঞাসা করলে উত্তর মিলছে না কিছু। কারা ধরল, কোন জায়গায় নিল, কাউকে চিনেছেন কি না…

কুমার তেতো বিরক্তিতে বলল, লোডশেডিংয়ে তুলে নিয়ে ক্লোরোফর্ম করলে ও চিনবে কাকে? গাড়িটা ট্রেস করেছেন?

—ও রাস্তায় গাড়ি ট্রেস?

—কি করছেন? একটা কিছু করুন।

—আগেও বলেছি, এখনো বলছি, আপনাদের শত্রু আছে কোনো, আপনার মেয়ের?

—না না না! আমরা লেফট ফ্রণ্টকে ভোট দিই, অ্যান্ড সেখানেই শেষ। কলেজে আমি বা আমার স্ত্রী, কোনোদিন কোনো রাজনীতিতে থাকিনি। ছেলে আর বড় মেয়ে তা বাইরে থাকে। শহরেও আমরা খুব বেরোই না।

—পুতুলি বেরোত বাবা।

—হ্যাঁ…ও খুব অ্যাকটিভ…পরিবেশ—দূষণ প্রতিরোধ, হেনতেন …টাউনের প্রোগ্রেসিভ একটা গ্রুপ…

—সুজাতা সিংহের সঙ্গে উনিও গিয়েছিলেন?

—কোথায়?

—সুতানপুর…মালা মণ্ডল…

—তা হবে। সব সময়েই তো…

—চাঁদের নামে অনেক চেঁচামেচি…

নীহারের ভেতরে বরফের তীর বিঁধতে থাকে, সব ঠাণ্ডা হয়ে আসে।

—মিস্টার সামন্ত?

—বলুন।

—সেই…চাঁদ কি…

এস. পি. ঈষৎ হাসেন।

—চাঁদকে আমরা জামিন দিতে বাধ্য হই…কিন্তু চাঁদ আর ওর সঙ্গী বলাই মোমিনপঞ্জে গণপিটুনিতে মরে গেছে দিন তিনেক আগে। চাঁদ এর মধ্যে ছিল কি না তা আর প্রমাণ করা যাবে না, বুঝলেন?

—এ অবস্থায়…আমি কি করব …গ্যাং রেপ…তার আসামী ধরবেন না?

—আপনি শোকাহত, আর এরকম ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হলো…আপনি জানেন না, ধর্ষণের কেস করতে পারে পুলিশ, কেন না ধর্ষণ হলো স্টেটের বিরুদ্ধে অপরাধ।

—স্টেট…ব্যক্তি নয়…পুতলি ধ্বংস হয়ে গেল…বাপ হয়ে আমি…

কুমার বলল, চলো বাবা, চলো।

রিকশায় বসে বলল, মার শ্রাদ্ধশান্তি সেরে পুতলিকে কোথাও ভাল নার্সিংহোমে রাখা…সেটা করে তুমি অমেয়র সাহায্যে বাড়ি বেচে দাও।

—বাড়ি বেচে দেব? এ বাড়ি তোমার মা আর আমি …তিলে তিলে…

—আচ্ছা আচ্ছা, সে পরে হবে এখন…

টাউনে পুতলিকে ঘিরে তখন কতকগুলো জীবনের কতগুলো বৃত্ত আবর্তিত হচ্ছিল, পুতলি তার কিছুই জানে না।

সমু ভূতে—পাওয়া মানুষের মতো হয়ে গিয়েছিল। প্রথমটা পাগলের মতো ছোটাছুটি করছিল, তারপর ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাকে পাওয়া গেছে সে যে পুতলি, তা সমু একবারও ভাবেনি।

—না না, পুতলি না। উলঙ্গ অবস্থায়…পথের ধারে…না ও পুতলি নয়।

গুলতি মাটিতে পা রেখে চলে, অতীব গদ্য প্রকৃতির ছেলে, গোদা বাস্তব বোঝে।

ও বলল, যা বাব্বা! তুমি ‘না’ বললে তো ‘না’ হয়ে যাচ্ছে না।

—না, পুতলি না।

সুজাতা বললেন, ও পুতলি সমু, আর এখনি ওর কাছে যাওয়া দরকার।

সমুর মা কাতর গলায় বললেন, ক্ষমা দিন আপনারা একটু। সে মেয়ের তো যা কপালে ছিল তা হলো। আমার মেয়ের বিয়ে যে ক’দিন বাদে। সেটা তো নষ্ট হয়ে যাবে।

—কেন? তা হবে কেন?

—তারাও তো জানে পুতলি এ বাড়ির বউ হয়ে আসবে। এখন এ কথা জানতে বাকি নেই কারো। এ সময়ে এ বাড়িতে পুতলিকে নিয়ে এত কথা, সমুকে নিয়ে টানাটানি… আহা। আমি মেয়ের মা, আমি বুঝি না পুতলির মায়ের বুকে কি হচ্ছে?

—আমরা জানিয়ে গেলাম শুধু।

সমু রক্তাভ চোখ মুছে বলল, চলুন আমি যাচ্ছি। আমি চোখে না দেখলে..

সুজাতা বললেন, চোখে দেখলেও বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে সমু, মনে জোর রেখো।

পুতলির অসাড়, বিবর্ণ ক্ষতবিক্ষত চেহারা দেখে সমু বমি করে ফেলেছিল, হো হো করে কেঁদেছিল, তারপর বলেছিল, কারা এ কাজ করল?

গুলতি বলল, জানি না। খুঁজে খুঁজে তোলপাড় করছি আমরা। পুলিশও খুঁজছে।

—পুলিশ কিছু করবে না।

—এ তো মালা মণ্ডল নয়, পুতলি চৌধুরী, চারদিকের চাপ আছে।

লোকাল কাগজ, নিজস্ব সংবাদদাতা মাধ্যমে বড় কাগজ খবরটিকে যথেষ্ট প্রচার করে।

ডি. এম. ও এস. পি.—র কাছে শহরের বিভিন্ন স্তর থেকে পুতলি সহ অন্যান্য নারী নির‍্যাতনকারীদের সমূহ শাস্তি দাবি করে মেমোরেনডাম আসে।

সুজাতারা সদর থানা ঘেরাও করে মিটিং মিছিলের প্রস্তুতি নেন।

এর মধ্যে অশ্রুকণার মৃত্যু ঘটে যায়।

টাউন থমকে যায়।

অনেকে বলতে থাকে, অভিশপ্ত পরিবার বলতে হবে। নইলে এমনটা ঘটে?

যাদের মেয়েরা এভাবে নিগৃহীত হয়নি, তারা বলতে থাকে, নীহার ও অশ্রু ওই মেয়েকে লাগামছাড়া স্বাধীনতা দিয়েছিলেন বলতে হবে। নইলে সুজাতা সিংহের মা মরছে বলে ওখানে গিয়ে থেকেই যায়? একা একা রওনা হয় অন্ধকারে?

এমন কথাও শোনা যায়, যেত তো অনেকেই। কিন্তু পুতলির স্বভাব ছিল…বাইরে থেকে দেখে মেয়েছেলেকে চেনা যায়?

অমিত সুজাতাকে বলে, বাজারে মারামারি করতে হলো। দিলীপ এমন সব কথা বলছিল…

সুজাতা বললেন, কত জনের মুখ বন্ধ করবে? এ দেশে তো এ ধারণা সর্বব্যাপী অমিত যে, যদি কোনো মেয়ে ধর্ষিতা হয়, এটা তারই অপরাধ!

—কেউ এরকম ভাবলে সে মানুষ নয়।

নিশীথ বলে, এটা কি বললেন ভাই? রেপ কেসে সমাজ তাই ভাবে, পুলিশ তাই ভাবে, এমনকি বিচারকরাও তাই ভাবে।

—তা হতে পারে?

—পারে না? শিবশঙ্কর চক্রবর্তীর কেস স্টাডি পড়েছেন? দেখবেন, কেস করলে কি হয়! আসামীরা ধরা পড়লেও, প্রমাণাভাবে খালাস পেয়ে যায়। মেয়েটা জেল হাজতে পচে। জেলের বাইরে রেপ হয়েছে, এখন জেলই ওর পক্ষে সেফ কাস্টডি।

—এ দেশের কি হবে!

—ভাবুন, কাজ করুন। আপাতত ভাবুন, মেয়েটার কি হবে!

—ওদের বাড়িতেও এমন সর্বনাশ হয়ে গেল, কিন্তু আমি যে পাশে দাঁড়াব, পুতলির দাদা, বাবা, দিদি তো তা দেবে না।

নিশীথ বলে, তোমার ওপরেই রাগ।

—সত্যি, ভাবলেও নিজেকে…

—দোষী মনে হচ্ছে?

—বুঝি না। পুতলির কথাই ভাবছি।

—আপাতত ওকে সরানো দরকার। অন্য কোথাও, কলকাতার কোনো নার্সিংহোমে।

—পুলিশ তা অ্যালাও করবে?

—কেন করবে না? ওর বাড়ির লোকরা স্বচ্ছন্দে নিয়ে যেতে পারে।

—বাড়ির লোকরা কি করবে, তা ভেবেও পাচ্ছে না। তাতে শ্রাদ্ধশান্তির ব্যাপার।

—স্বাভাবিক। যা শুনেছি, ওঁদের জীবনে আঘাত এই প্রথম এল, আর বলতেই হবে এরকম ভয়ংকর আঘাতের পর সামলানো খুব কঠিন। পুতলির যা হলো, সেটা তো সব হিসেবের বাইরে, তারপর ওর মা…ওর বাবা আত্মহত্যা করলেও অবাক হবার নেই কিছু।

—এত বড় স্ক্যানডাল সয়ে মাথা তুলে থাকা…পুতুলিকে নিয়ে কলকাতায় কোথাও রাখলেন, নীহারবাবুকে ছেলে বা মেয়ে কাছে রাখল…কিন্তু বলবে কে ওঁদের?

—সমুর অবস্থাও ভয়ংকর…

—হ্যাঁ…

সুজাতা বড় দুঃখে ক্ষীণ হেসে বললেন, নীহারবাবুর সরে যাবার জায়গা আছে, সমু কি করবে? ওদের বাড়ি এখানে, ওর বোনের বিয়ে সামনে, ওর মনের জোর, সততা, সব আছে। কিন্তু গ্যাংরেপের শিকার যে মেয়ে, তাকে বিয়ে করে এ টাউনে থাকবে কি করে?

—বিয়ে বা করবে কি করে সুজাতাদি? অনেক, অনেক বাধা আসবে দুজনের মনের ভেতর থেকে, এটা ঘটনা। মেয়েরাই কি তা ভুলতে পারে? নীরা তো পারেনি। আমি বিয়ে করতে চেয়েছিলাম, বলেছিলাম, কতকগুলো জনোয়ার তোমাকে থানায় নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করেছে, সেজন্য আমরা কেন বিয়ে করব না?

—জানি, ও মাঝে মাঝে চিঠি লেখে।

—জেল থেকে বেরিয়ে বিদেশে চলে গিয়ে ভালই করেছে। এখন বুঝি। কাজ করছে, ভাল স্বামী জেকব, ভাল আছে।

—নীরার জন্যে এখনো কষ্ট হয়, নিশীথ?

—না সুজাতাদি। আর হয় না, একদা হতো। কিন্তু পুতলির কি হবে? সমুর কি হবে? এত কম বয়স ওদের…এরকম ভাঙা ভাঙা জীবন নিয়ে কেউ বাঁচে, কেউ মরে, দেখতে আর পারি না।

—আমাকে ওর মধ্যে ধর না নিশীথ, আমার জীবন পূর্ণতায় ভরা।

—ভাবতে ভাল লাগে। তোমাদের বাড়ির বিষয়ে কিছু ঠিক হলো?

—ভাবেভঙ্গিতে বুঝলাম, ওরা বেচেই দেবে।

—তুমি কি করবে?

—আমি বাধা দিলে বেচতে পারবে না, কিন্তু আমি তা করব না। আমারও আটান্ন হলো, কতদিন বাঁচব? যা চায় করুক… স্বচ্ছন্দে এটা বাবা—মার নামে কোনো ভাল কাজে দিতে পারত। মামারা আছেন…ওঁদের ব্যবস্থা অবশ্য আমি আমার শেয়ার থেকে করে দেব…পুতলি আমাকেও অসম্ভব…অসম্ভব দায়ী করে রেখে দিল।

—দায়ী? তুমি দায়ী?

—না না, তা নয়। ভাবনার দায়িত্ব দিল, কাজের দায়িত্ব। এমন তো কত মেয়ের হয়,, তারপর? সকলকে তার পরিবারে শেলটার দেয় না, সমাজ ক্ষমা করে না, মেয়েটার মনে দগদগে ঘা হয়ে যায়। এ সব মেয়েরা কোথায় যায়, কি করে, সে কথা ভাবতে শেখাল পুতলি। এ চিন্তা বহন করাটা দায় নয়?

—বুঝেছি। চল তো আমার সঙ্গে ক’দিন থাকবে।

—পুতলি এখানে, আমি চলে যাব? তুমিও কি রণো, জয় আর দিদি হয়ে গেলে? তারা জন্মে যেতে বলে না, এবার বলল, মা নেই, একলা থাকবি? তা ছাড়া থাকলেই ওই স্কানডালে জড়িয়ে পড়বি, চল কলকাতা।

—বেশ, থাকো। থাকলে টাইমে পেটভরে খাবে, প্রেসার দেখাবে, ওষুধ খেয়ে ঘুমোবে। এটুকু অন্তত দেখে যাই। নিজে শক্ত না থাকলে ওকে, দরকার পড়লে সাহায্য করবে কি করে?

—যাক, মা যে চলে গেলেন, পুতলির জন্যে সে কথা ভাবতেই পারি না যেন।

মামীমা নিশীথকে বললেন, মা তো জীবন্মৃত হয়ে পড়েছিল। সে শোক বাজবে, পরে বাজবে। মেয়েটার জন্যেই ভেবে পাগল হচ্ছে। কি লাভ বল? তার কপালে ছিল অভিশাপ…মেয়ে জন্মই তো কপালের নির্দেশে চলে, হক কথা।

শুধু কপাল বা ভাগ্য নয়। সুজাতার বাড়ি থেকে ভরা বর্ষায় পূজা আর মীনাক্ষী টাউনে ফিরেছে তাদের কিছু হলো না কেন?

যারা ধর্ষণ করল, তারা পুতলিকে বেছে নিল কেন? পুতলি তো চোখে পড়ার মতো সুন্দরীও নয়।

মেয়েটাই ওই গর্বিত, দেমাকী পরিবারকে ভেঙেচুরে দিল। কারো সঙ্গে মিশি না, কোথাও যাই না, কারো বিপদে দাঁড়াই না, ঝামেলা এড়িয়ে চলি, টাউনে কাউকে মেশার যোগ্য মনে করি না।

এখন কি করবি? তোর মেয়েই রেপ হলো, তোর বউই মরল, এ যে লঙ্কাকাণ্ড হয়ে গেল।

এমন অনেক কথা হতে থাকল, অনেক কথা।

শেষ অবধি সুজাতা মরিয়া হয়ে পূর্বাশায় গেলেন।

পিপলি বলল, আসুন।

পিপলি বাইরে থাকে, যথেষ্ট সফিস্টিকেড, সুজাতার ওপর ও মোটেই প্রসন্ন নয়। কিন্তু তাঁকে দরজা থেকে তাড়িয়ে দেওয়া বুদ্ধির কাজ নয়, সেটা ও বোঝে।

কুমার বলল, ওঁকে ভেতরে বসালে?

—বসালাম। টাউনে বাবাদের কোনো পাবলিক রিলেশান নেই। কত কম লোক এসেছে এত বড় ঘটনার পর। ক্রিমিনালদের ধরার জন্য পুলিশে এরাই যাচ্ছে, মাকে শ্মশানেও নিয়ে গেল পুতলির বন্ধুরাই।

—বাবা জানলে…

—বাবা জানবে কেন? ফ্রাংকলি কুমার, ম্যাডেনেস অনেক হয়েছে। তুমি দিল্লী ফিরে যাবে, আমিও থাকব না। এখন প্র্যাকটিকালি কি করা যায়, তা ভাবতে হবে, করতেও হবে। ওঁর সঙ্গেই কথা বলি?

—আমিও বলব।

—এসো, বাবা বা বোন আমার একার নয়।

সুজাতা অশ্রুকণার ছবিটার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। ওঁরা ঢুকতে বললেন, বিয়ের সময়ে অশ্রুর চেহারা খুব ভালো ছিল, এ ছবি অনেক পরের।

—হ্যাঁ…গত বছরের…

—তোমরা কি করবে কিছু ভেবেছ?

—কেস করব।

—তুমি তো দাদা ওর…রেপকেসে কেস করতে পারে শুধু পুলিশ। পুলিশকে দিয়ে কেস করানোর প্রসেস অসম্ভব জটিল, সময়সাধ্য। আর কেসটা হবে এখানে, তোমরা তো বাইরে থাকো।

—তা বলে কতকগুলো ক্রিমিনালকে….

—দেখ!

পিপলি বলল, আপনি তো কেস একটা… কি যেন…পুতলি বলেছিল…

—মিতালি দাস। পুলিশকে অনেক চাপ দিয়েও পারিনি। রেপকেসে সামনের সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে দেখা যায় আসামী প্রমাণাভাবে বেরিয়ে গেল।

—ইশশ! দিল্লীতে সহেলী কিন্তু…

—এখানে তেমন সংগঠন গড়ে তোলা যায়নি। গড়ে উঠেছিল, এ ব্যাপারে প্রচণ্ড ঘা খেল। যাক গে, ওঁদের কি ব্যবস্থা করবে, পুতলির আর তোমাদের বাবার?

—তাই তো ভাবছি। আমরা তো এখানে থাকব না। ফিরে যেতেই হবে।

—আমি একটা কথা বলব?

—বলুন।

—পুতলিকে তোমরা কলকাতা নিয়ে যাও, কোনো ভালো জায়গায় ভর্তি করো। ওর সুস্থ হতে অনেকদিন লাগবে। তোমার বাবাকেও নিয়ে যাও। এখানে থাকবেন কি করে? রেপকেস বলো, স্বামী তাড়িয়ে দিলে বলো, পরিবারের লোকজনের সহানুভূতিটা একেবারে ওষুধের কাজ করে।

—কলকাতায়…কোন নার্সিংহোমে?

—সে তোমার ভাবতে হবে না কুমার। আমার বন্ধুরই নার্সিংহোম আছে।

—তুমি ওকে নিয়ে গেলে, বাবাকে আমি…অবশ্য আমরা বাড়ি থাকি না।

—বাবা এখন কলকাতা চলুক, পরে দেখা যাবে। বাড়িটা নিয়ে অবশ্য সমস্যা…

—তোমরা যদি বলো, আমি বাড়িতে থাকার বিশ্বাসী লোক দিতে পারি।

—বাবার কলেজের কোনো স্টাফ, না হয় বন্ধ থাকবে।

—কবে যাবে তোমরা?

—তাড়াতাড়িই যাব।

—এখানে থাকলে…

কুমার সঘৃণায় বলল, শুধু কথা। শুধু গসিপ। এখানে বাড়ি রাখারই মানে হয় না কোনো। বাবাই বা পরে থেকে কি করবে? পুতলিও তো বার্ডেন হয়ে যাবে একটা। নর্মাল হতে পারবে?

—পারবে, যদি তোমরা পাশে থাকো।

পিপলি সদুঃখে বলল, এ শহরকে সবচেয়ে ভালবেসেছে পুতলি। বাইরে থাকতেই চাইত না।

—জানি। আমি উঠি।

দাঁড়িয়ে সুজাতা বললেন, তোমাদের সামনে আসার মুখ নেই আমার, তবু বিশ্বাস করো, মায়ের শোক আমি ভুলে গেছি, সব ভুলে গেছি, শুধু পুতলির কথা ভেবে। তোমাদের আগে দেখিনি আজ দেখলাম। খুব শান্তি নিয়ে গেলাম মনে, খুব শ্রদ্ধা…সব পরিবার যদি এমন হতো…

সুজাতা বেরিয়ে গেলেন।

কুমার বলল, যাক নিশ্চিন্ত হওয়া গেল।

—হ্যাঁ…কিন্তু বাড়িটা আগলাবার জন্যে ওদের বললেই ভাল হতো। ওদের এ বাড়ি দখল করবার চেষ্টা থাকবে না।

—ওদের ফেভার নেব?

—ওরা প্রত্যেকে মনে মনে জ্বলে আছে। আমাদের জন্যে এটুকু করতে পারলে…

—দেখ! তুমি যা হোক কলকাতায় আছ। পুতলিও তোমার বাড়িতে থাকছে না এখন। আমার কাছে বাবা থাকবে…আমরা দুজন থাকব কাজে…ঝামেলাটা আমাদের বেশি।

পিপলি আস্তে বলল, থাক কুমার। বাবা—মা আমাদের জন্যে কম করেনি। কোনোদিন বার্ডেন হয়নি। আমি আর তুমি ছাড়া কে দেখবে ওদের? পুতলি আমাদের বোন!

—বাড়ি দেখার জন্যে ওঁকেই খবর দিতে হয়।

—তাই দেব।

—বাবা একটু ধাতস্থ হলে এ বাড়ি বিক্রি করে কলকাতায় কোথাও…

—ধাতস্থ হোক আগে। বাবা চলে গেলে মা সামলে নিতে পারত। বাবার পক্ষে…মার ওপর এত নির্ভর করত…কি রকম হয়ে গেছে বাবা। ঘর থেকে বেরোয় না, কথা বলে না…আমি অমেয়কে ফোন করে সব ব্যবস্থা করতে বলি।

নিয়ে যেতে…পুলিশ কিছু…

.

ওরা যখন সুজাতার বাড়ি গেল, সুজাতা বললেন, গুলতি, তাপস, ওরা থাকবে কেউ না কেউ। এখানেও সিকিউরিটি সার্ভিস হয়েছে, তাদের কাছেও লোক নিতে পার। পুলিশ কি করবে? যদি…যদি কোনোদিন ধরা পড়ে লোকগুলো…তখন পুতলিকে দরকার হতে পারে শনাক্ত করার জন্যে।

পিপলি বলল, সে দেখা যাবে।

পিপলি আর কুমার সুজাতার বাড়ি অবাক হয়ে দেখছিল। শ্বেতপাথরের টেবিল, সেকেলে ভারি ভারি আসবাব, আলমারি ভরা বই, বাগান থেকে কি সব ফুলের গন্ধ আসছিল।

—এ তো বিশাল ব্যাপার…

—হ্যাঁ…ঠাকুরদার তৈরি…ওঁরা তো জমিদার ছিলেন…আর কোনো সাহায্য চাই?

—অমেয়কে বলেছি নার্সিংহোম ঠিক করতে।

—ওকে নিয়ে যাবার সময়ে তোমাদের যদি এদিকে ব্যবস্থা করতে দু’একদিন থাকতে হয়, আমি আর নিশীথ অ্যাম্বুলেন্সে যেতে পারি।

—সেটা খুব উপকার হবে, সত্যি। আমি থেকে বাড়িটা বন্ধ করব, লোক থাকার ব্যবস্থা করব, কুমার বাবাকে নিয়ে যাবে।

নিশীথ মৃদুস্বরে বলল, সব এক সঙ্গেই হোক না? অ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে গাড়িও নেওয়া হোক। আমার সঙ্গে যাব।

—পুতলি এখনো কথা বলছে না।

নিশীথ নরম গলায় বলল, অসম্ভব শক লেগেছে মনে, তবে ফেলে দেয় যখন, কাদায় পড়েছিল বলে মাথায় তেমন ইনজুরি হয়েছে মনে হয় না। কলকাতায় সব চিকিৎসাই হবে।

সুরভিত, ঝকঝকে, ছোট করে চুল ছাঁটা পিপলি কপাল কুঁচকে বলল, পুতলির নখে চামড়া, মাংস, ও ফাইট করেছিল, তাই না?

সুজাতা বললেন, হ্যাঁ…

—কি করে করল তাই ভাবি…অত ছেলেমানুষ…অত নরম মেয়ে…মাগো!

সুজাতার চোখে পর্দা নেমে এল, খুব সাহস ওর, খুব পিওর, খুব ইনোসেন্ট…ঠিক এই মুহূর্তে ছেলেরা অপরাধীদের পেলে খুন করতে রাজী আছে। ওকে সবাই এত ভালবাসে…

—সেদিন যদি কেউ সঙ্গে যেত…

—সবাই শ্মশানে ….মানা করলাম বারবার… ছেলেরা সাইকেলেই পৌঁছে দিত…শুনল সে কথা? জেদও আছে খুব…আর অশ্রুর জন্যে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। হতভাগী জানেও না…

পিপলি বলল, না। শক কেটে গেলেও জানানো যাবে না। তাতে…আমরা উঠি তাহলে।

ওরা চলে গেলে সুজাতা বললেন, ওরা সমুর নামও করল না।

—না সুজাতাদি। কেউই ওদের কাছে ম্যাটার করে না। ভেব না।

—সে ছেলে কেমন করে বুলির বিয়ের আয়োজন করছে?

—জানি না। গুলতিরা তো আছে।

—যাক, তবু আমাদের কথাগুলোয় রাজী হলো। সাহায্য নিতে এত ভয় পায় কেন? সাহায্য ছাড়া চলে মানুষের কখনো?

—তোমাদের বাড়ি দেখে ওদের সমীহ হয়েছে। কিন্তু এ টাউনে পড়েছে, আগে আসেনি কখনো?

—কে জানে! আমি থাকতাম না, মা বেরোত না, কার কাছে আসবে? ওই বাগানে পিকনিক করতে আসত…গাছে আম পাকলে আসত…ওরা নাকি জানি না, শহরের ছেলেপিলে যত। শুনেছি, টাউনে যাঁরা স্বদেশী করতেন, তাঁরা এখানে লুকিয়ে মিটিংও করেছেন, শোনা কথা, দেখিনি।

—তুমিও এখানেই ছিলে ছোটবেলা।

—হস্টেলে পড়তাম, ছুটিতে আসতাম, ওই গাছটা, যেটা মা মরতে কাটা হলো, ওটা একসময়ে ফল দিত। ও গাছে দোলনা টাঙিয়ে দুলেছি।

—এ বাড়িও তো থাকবে না।

—মানুষ চলে যায় নিশীথ, বাড়ি দিয়ে কি হবে?

—তুমিও ছেড়ে চলে যাবে?

—হোক না বিক্রিবাটা। আমার নিজস্ব দশ কাঠা আছে না, স্বর্ণময়ীতে? একটা ছোট বাড়ি করে নেব বা কিনে নেব ওটা বেচে, আমার শেয়ারের টাকা দিয়ে। আমাদের সংগঠনের স্থায়ী ঘর হবে, মামা মামী থাকবে। ভাবলেও অনেক মুক্ত লাগছে। এ বাড়ি বলে বড্ড আসক্তি ছিল। পুতলি বুঝিয়ে দিল জীবিত মানুষই সব।

—ভাগ্যি কাকাকে বিয়ে করনি তখন! ভাল কথা, আমি যে ফ্ল্যাট কিনছি।

—সে কি?

—ক্রিস্টোফার রোডে আমার ফ্ল্যাটটা কি ভাল বলো? একেবারে কোণের দিকে তেতলায়, সামনে দিয়ে ট্রেন যায়, বলো?

—তাই তো! অমন বাড়ি থাকতে…

—সরকার বলছে কিনে নাও। জলের দামে পেয়ে যাব, কিনেও নেব।

—বাঁচা গেল।

—একটা কাজ করবে আমার সঙ্গে?

—যা করব, এখানে…

—বলব, পরে বলব। এখন এখানে পুতলির সমস্যা খানিকটা মিটুক।

—সমুটা যদি একটু আসত।

.

সমু এসেছিল।

সুজাতার কাছে বসেছিল কপালে হাত রেখে। কয়েকদিনে বয়স বেড়ে গেছে ওর, চোখের নিচে কালি পড়েছে।

—পুতলিকে তোমরা নিয়ে যাচ্ছ সুজাতাদি?

—ওর দিদি নিয়ে যাচ্ছে সমু, সঙ্গে যাচ্ছি। এখানে না হবে তেমন চিকিৎসা, আর শকের অবস্থা কেটে গেলে চেনা পরিবেশ, চেনা মানুষ, ওর মনে আবার শক লাগতে পারে।

—কোনোদিন কি ফিরবে এখানে?

—সে কি বলা যায়?

—কেন ফিরবে না? মাথা উঁচু করে ফিরবে। ও তো কোনো দোষ করেনি।

—তুমি গিয়েছিলে তো!

—গিয়েছিলাম…ডাকলাম…ও চিনতে পারল না।

—এখন দীর্ঘকাল চিকিৎসা দরকার, প্রথমত শরীরের, তারপর মনের…

—আমি কি করব?

—আমরা যা করছিলাম, তাই করব। কিন্তু এক বছরে আটাশটা রেকর্ডেড নারীধর্ষণ, এ নিয়ে ঝড় তুলতে হবে আমাদেরই।

—পুলিশের বিরুদ্ধে।

—ধর্ষিতা মেয়েদের ট্রাজিডি কি জান? কেস থেকে সুবিচার পাবার পথ অতীব ঘোরাল। ট্রাজিডি হলো সমাজ আগেভাগেই রায় দিয়ে রাখে ধর্ষিতা মেয়েটিই দোষী। পুলিশ বা জজ বা উকিল, এই সমাজেরই লোকজন। তাই ধর্ষিতা মেয়েটি মানবিক বিচার পায় না।

—পুতলির বেলাও তাই হবে?

—সমাজের চোখে পুতলিতে বা মালা মণ্ডলে কোন তফাত নেই।

—জানি। কিন্তু পুতলি যদি সব কিছুর পর রাজী থাকে, আমি ওকে বিয়ে করব।

—খুব বড় কথা সমু, কিন্তু আগে ও শরীরে মনে সুস্থ হোক।

—এদিকে বুলির বিয়ে…

—হ্যাঁ, সেটা হোক…

—সব ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল সুজাতাদি, যখন সবাই বলে, ওর নাম করব না, আমার আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করে।

—ছিঃ সমু!

—আমি যাই সুজাতাদি। আপনি, আপনি ওকে দেখবেন। নিশীথদাকেও বলবেন।

—সমু, আমি তোমার সঙ্গে আছি, তুমি একলা নও…

—জানি, কিন্তু একটা নিষ্পাপ, অসামান্য মেয়েকে ভালবেসে এতদিন…ওদের বাড়ি বিরূপ…আমার বাবা—মার সঙ্গেও কম কথা বলতে হয়নি। ওদের কালচার এক রকম। আমরা নেহাৎ গেরস্ত সংসারের লোক… দেশের বাড়িতে পুজো হয়…আগেই শুনতাম বেজাতে বিয়ে করব, আমার জ্ঞাতি জ্যাঠা কাকাদের মেয়েদের বিয়ের সময়ে কথা হবে। আজ বাবা বলছে, এত সবের পরেও তাকে বিয়ে করলে আমাদের সঙ্গে যোগ থাকবে না।

—তুমি তো ওকেই চাও…

হ্যাঁ…চাই…পরিবারে ও বড় একলা…

—দেখা যাবে সমু। এখন ওর ভাল হয়ে ওঠা দরকার। সবে তো কয়েকদিনের ব্যাপার।

—এখানেই ছেড়ে দেব না আমি, পুলিশকে দিয়ে কেস করিয়ে ছাড়ব।

—শান্ত হও, শান্ত হও সমু।

নিশীথ বেরিয়ে এল।

—আমি ওর সঙ্গে যাই। টেলিফোন অফিস থেকে একটা ফোন করব। চলো সমু।

এর পরে পরেই, একদিন কাকভোরে একটা অ্যাম্বুলেন্স ও একটি অ্যামবাসাডর কলকাতা রওনা হয়ে গেল।

পুতলি ইনজেকশনের ঘোরে ঘুমোচ্ছিল।

‘পূর্বাশা’য় ‘মান্না’জ সিকিউরিটি সার্ভিসের লোক মোতায়েন হয়ে যায়। একজন দিনে, একজন রাতে। শোনা যায় সুজাতাও সঙ্গে গেছেন।

সমু বন্ধুদের বলে, বুলির বিয়ে মিটে যাক। দেখব, পুলিশ কেমন কেস না করে।

গুলতি বলে, অন্তত জোরদার মিটিং দরকার, লাগাতর। যাতে অন্য মালা, অন্য পুতলিরা বেঁচে যায়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *