দুই
বৃষ্টি কমে তার পরদিন বিকেলে। বৃষ্টির জোরটা কমে। আর তার পরদিন আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ, এই আছে, এই নেই।
তার পরদিন একেবারে নির্মেঘ আকাশ উজ্জ্বল রোদ। সব যেন আলোয় ভেসে যাচ্ছে।
অথচ কি অন্ধকার, কি গাঢ় তমিস্রা নেমেছিল এই টাউনে, কি অশুভ কালো ছায়া।
সুজাতার মার অবস্থা এতই খারাপ ছিল যে পুতলি পরদিন আসতে পারেনি। বিকেলে যখন বৃষ্টি কমল, তখন তো ওঁর শেষ অবস্থা।
পুতলিই সুজাতাকে হাত ধরে নিয়ে এল। সুজাতা কপালের দু’রগ টিপে আস্তে আস্তে এলেন। তারপর বললেন, এত কষ্ট কেন পাচ্ছে মা?
ডাক্তারকে বললেন, মা তো থাকবেই না, এই যন্ত্রণাটা কমানো যায় না?
ওঁর মামা বললেন, এ যন্ত্রণা কে কমাবে মা? জানি না শ্বাসকষ্ট কতক্ষণ পাবেন দিদি।
পুতলি অবাক, বিস্ফারিত চোখে দেখছিল। এমনি করেই মরে যায় মানুষ? খাটে ওই যে বৃদ্ধা শীর্ণ মানুষটির চোখ ঠেলে উঠছে, নিশ্বাসের জন্যে হাঁকপাঁক করছেন, ওঁরই ছবি ঘরের দেয়ালে?
বিয়ের পর স্টুডিওতে তোলানো ছবি, বোর্ন অ্যানড শেপার্ডে। চোদ্দ বছরের বউ, কুড়ি বছরের বর।
তারপর নানা বয়সের ছবি। ছেলে মেয়েদের সঙ্গে, শিশু সুজাতাকে কোলে নিয়ে। কাটা কাটা মুখ চোখ, কোঁকড়া চুলে খোঁপা বাঁধা, সিলক বা ঢাকাই বা তসর পরনে। জামার হাতে গলায় লেস।
ওঁর সঙ্গে বিছানায় শুয়ে থাকা মানুষটির কোনো সাদৃশ্য নেই।
পুতলি মুখে আঁচল গুঁজল, ওর কান্না পাচ্ছিল। সমু, গুলতি, তাপস, অমিত, সব দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে। নিশীথই সুজাতার পাশে দাঁড়িয়েছিল।
ডাক্তার সোম মাথা নেড়ে এক সময়ে উঠে দাঁড়ালেন। সুজাতা মায়ের মুখের ওপর ঝুঁকে বসে থাকলেন। সমু এগিয়ে এল, পুতলি, বাইরে চল।
—মাসিমা…মাসিমা কি…
—হ্যাঁ, চল।
বাইরে এসে পুতলি কেঁদে ফেলল।
—কাঁদছিস কেন?
—মাসিমা…এত…
—মাসিমা বেঁচে গেলেন, মুক্তি পেলেন বল। যুক্তি দিয়ে বোঝ পুতলি, যেমন কষ্ট পাচ্ছিলেন, সুজাতাদিকে যত কষ্ট দিচ্ছিলেন, সেটা একটা অসহ্য অবস্থা। সুজাতাদির পক্ষে দেখা আর সহ্য করাটা কি কষ্টকর তাই বল।
—সত্যি সমু, সত্যি, তবু…
—তুই কাউকে মরতে—টরতে দেখিসনি, তাই না? তাই এত…
মানে…
পুতলি সজোরে মাথা নাড়ল।
না, সে দেখেনি কাউকে মরতে, দেখতে চায় না।
—আমরা তো বুঝেছিলাম, টাইমটা দেখছিলাম শুধু…কতক্ষণ কষ্ট পান।
গুলতি আর তাপস বেরিয়ে এল। গুলতি সবচেয়ে অভিজ্ঞ এসব বিষয়ে।
আকাশের দিকে চেয়ে বলল, বিকেল বিকেল মারা গেল, সুজাতাদি ‘রাতেই দাহ হবে’ না বললে বাঁচি। শ্মশান জাব হয়ে আছে মাইরি, কাঠফাট সব ভিজে, রাস্তায় কাদা।
পুতলি বলল, ওঃ গুলতি! এখন এ সব কথা…
—যা বাব্বা, কি হলো?
—সুজাতাদি শুনলে…
—আরে দাহ করতে হবে…
সমু বলল, তুই বাড়ি যাবি না?
—এখনি কি করে যাব? একটা ফোন করি বাড়িতে…মা—বাবা বুঝবে যে এখন যাওয়া চলে না।
পুতলি ফোন করেছিল।
মা—বাবা বুঝেছিলেন।
অশ্রু, বলেছিলেন, কাল চলে এসো। সুজাতার ওখানে তো অনেক লোক। ওর ভাইবোনও আসবে।
ডাক্তার সোম ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দিয়ে, সুজাতাকে ‘বি ব্রেভ’ বলে চলে গেলেন।
পুতলিরা ও ঘরে ঢুকল। সুজাতা হেলান দিয়ে বসে আছেন। মামীমা, বাড়ির পুরনো কাজের লোক দু’জন মৃদু গুঞ্জনে কাঁদছেন। সুজাতার মার মুখ এখন শান্ত ও অন্যরকম দেখাচ্ছে।
নিশীথকে পুতলি আগে দেখেনি। কালো, বলিষ্ঠ, মাঝামাঝি লম্বা চেহারার মানুষ। চুল ছাঁটা, পরনে পাঞ্জাবি ও জিনসের প্যান্ট। নিশীথই যেন বুঝল, ওকে এখন পরিস্থিতির দায়িত্ব নিতে হবে।
—সুজাতাদি।
—বলো নিশীথ।
—ভালই গেছেন মাসিমা। এ অবস্থায় বেঁচে থেকে কষ্ট পাচ্ছিলেন।
—হ্যাঁ…শান্তি পেয়েছেন।
—রনোদা, জয়, সুচেতাদি, এদের তো খবর দিতে হয়।
—হ্যাঁ…
—আর, আজ তো ফিউনেরাল হচ্ছে না?
—নিশীথ, আমি কিছু ভাবতে পারছি না। পুতলি কোথায়?
—এই তো সুজাতাদি!
—আজ থাকবে?
হ্যাঁ, সুজাতাদি।
নিশীথ বলল, দ্যাটস গুড। আপনি থাকলে সুজাতাদির একটু…
—থাকব। মাকে বলেছি।
হাতঘড়িটা দেখে নিশীথ বলে, একটু চা অর্গানাইজ করে ফেলুন তো!
সুজাতাদিকে বলে, চলো, ও ঘরে। শুয়ে থাকো। কাল থেকে জেগে আছ।
সুজাতাদি বলেন, চলো।
ওঁকে ধরে ধরে নিয়ে যায় নিশীথ। পুতলি চলে যায় চা করতে। তাপস বলে, চল, আমি তোর সঙ্গে যাচ্ছি।
ওরা চা খায় সুজাতার ঘরে বসে। নিশীথ নিচু গলায় বলে, আমি ওঁর ভাইকে খবর দিচ্ছি। জানি না লাইন পাব কি না।
গুলতি বলে, বডি রাখবেন তো?
—রাখতেই হবে। কাল সকাল দশটা নাগাদ এসে যাবেন। আপনারা আজ বাড়ি গিয়ে রেস্ট নিন; আপনারাই তো সব করবেন।
—বরফ দিয়ে রাখতে হবে?
—কোথায় পাবেন বরফ এখন? এ দিকটা আমি সামলে নেব। লোক তো আছে। এত রিকশাওলা, বস্তির লোক…
সমু বলে, পুতলি যেন রাতে একটু ঘুমোয়।
নিশীথ ঈষৎ হাসে ও আঙুল তোলে।
—সব আমার উপর ছেড়ে দিন তো।
—সুজাতাদিকে আপনি অনেক দিন চেনেন?
—অনেক দিন। আপনাদের কথা কত বলেছে আমাকে। কলকাতা গেলে তো আমার ওখানেই ওঠে। কতবার বলেছে, আপনাদের পেয়ে ওঁর বাঁচার ইচ্ছেটা ফিরে এসেছে।
অমিত বলে, আমাদের…খুব আপনজন।
—তাই তো দেখলাম। আপনাদের সঙ্গে দেখা হয়নি। নইলে দু’বছরে তিন বার ঘুরে গেছি মাসিমার কাছে।
মামীমা বললেন, আরে নিশীথের বোনকেই তো বিয়ে করেছে সুজয়, ওদের ছোটভাই।
নিশীথ বলল, সুজাতাদি আর মাসিমার সঙ্গে সম্পর্কটা অন্য রকম…যাক গে। মামীমা, এ বাড়িতে তো আজ রান্না হবে না, তাই না?
সুজাতা ক্ষীণ স্বরে বললেন, ও সব মানামানি করে কি হবে নিশীথ?
—তুমি থামো।
—তোমরা…
—ছেলেরা চলে যাক আজ। দু’রাত জেগেছে। কাল আসুক দশটা নাগাদ।
—তুমি কল বুক করো।
গুলতি বলে, আমি টেলিফোন আপিস থেকে বরং সহজে লাইন পাব, যদি পাই।
—দেখ!
নিশীথ বলে, হয়ে যাবে সব।
—মাকে একটু পরিষ্কার…
—তুমি থামবে? শোও, শুয়ে থাকো। মামীমা একটু ধুনো দিন ঘরে ঘরে, এ ঘরে মশার ধূপ জ্বেলে দিন। সবই তো করতে হবে, কিছু তো থেমে থাকবে না।
মামীমা বলেন, তুমিই এ সময়ে এসে পড়লে, এটা মস্ত ভরসা…
—সুজাতাদি ডেকেছিল।
সমু পুতলিকে বলে, আমরা যাচ্ছি তবে। তুই কিন্তু রেস্ট করিস।
—হ্যাঁ…কাল কখন আসবি?
—সকালেই।
ছেলেরা চলে গিয়েছিল। জহর রিকশাঅলাকে পাঠিয়ে নিশীথ পথের ধার থেকে রুটি তরকারি আনাল। সুজাতাকে হরলিকস খাওয়াল, ঘুমের ওষুধ। বলল, আমি থাকব ওঁর ঘরে।
ভরসা, একটা মস্ত ভরসা।
ট্রাঙ্ককল বুক করে নিশীথই মাসিমাকে গা মুছিয়ে, ধোয়া কাপড় জামা পরিয়ে, বিছানায় ফর্সা চাদর পেতে শুইয়ে দিল। গায়ে চাদর ঢেকে ফ্যানটা খুলে দিল, ধূপ জ্বেলে দিল ঘরে।
মামীমাকে বলল, ছোঁয়ালেপা হেনতেন বলবেন না। স্নান আমি করব।
—দেখ! তিনিও তেমন মানত না, এরা তেমন মানে না, সুজাতা তো বিশ্বাসই করে না কিছু। কিন্তু যেটুকু নিয়ম…
—সব হবে।
ট্রাঙ্কে লাইন পেতে পেতে রাত দশটা হলো।
—রণোদা, আমি নিশীথ…হ্যাঁ, তিনটে দশে…ঘুমোচ্ছে, ওষুধ দিলাম…কয়েক রাত জেগেছে…। ও! শেষ খবর দিচ্ছি কেন? তোমায় তো বলে এসেছিলাম, মাসিমা সিরিয়াস। সুজাতাদি ডেকেছে। তুমি তো ট্যুরে গেলে।…এলে আসবে, তুমি বা জয়…কাল এগারোটা নাগাদ বেরোতে হবে, আর রাখা যাবে না। কি? রিচুয়ালস? ও সব আমি জানি না। তোমরা যা হয়…এঃ, এ কি হলো?
রিসিভার নামিয়ে নিশীথ বলল, কেটে গেল।
মামীমা বললেন, ওরা আসবে? খবর তো সুজাতা বারবার দিয়েছে।
—সিংহদের ব্যাপার! আমি রণোদাকে বললাম, ছেলেরা জয়কে বলবে, রাতে গাড়ি নিয়ে বেরোলেও সকালে পৌঁছে যাবে। না এলেও আটকাবে না। ওরা যে আসবেই, তা আপনি জানেন, আমিও জানি।
—জানি…সম্পত্তি…
—ছেড়ে দিন ও সব কথা। এই যে, পুতলি। আসুন, কিছু খেয়ে নিন।
পুতলি নীরবে এসে দাঁড়াল।
—বসুন। আপনি না খেলে আমি বা খাই কি করে?
—আমার নাম পল্লবী।
—বেশ নাম। নিন, খান।
—ভাল লাগছে না।
—ভাল লাগার কি আছে?
—ভাল লাগার কি আছে? এটা প্রয়োজন। মামীমা, আপনারা কি করবেন?
—আমরা আছি এরা আছে…খাব যা হয়। রক্তের সম্পর্কই নেই, নইলে ওর মা…
—জানি। দেখছি তো এত বছর…
পুতলি বলল, আমরা কেউ আপনাকে দেখিনি।
—না, সন্ধ্যায় পৌঁছতাম…পরদিন চলে যেতাম…সুজাতাদি তো ডাকে সবসময়ে…
—আমার মা’র সঙ্গে পড়তেন…
—ওকে ‘দিদি’ বলি, মায়ের কাজ করেছে।
—আপনার বোন ওঁর…
—ওটা আমার বোন আর ওঁর ভাইয়ের ব্যাপার। তাই বাইরেই আমার সম্পর্কটা…
—অনেক দিনের?
—অনেক দিনের। আমার বয়স ত্রিশ। বলতে পারেন আমার জন্ম থেকেই ওঁকে দেখেছি। মানে…একদা উনি আমার কাকীমা হবেন এমন সম্ভাবনা ছিল। তা হয়নি। কিন্তু আমাদের সঙ্গে ওঁর একটা আলাদা সম্পর্ক…
—আপনার মায়ের নাম মনীষা? যাঁর কথা সুজাতাদি বলেন?
—ঠিক বলেছেন। নিন, শেষ করুন। আমি স্নান করব, মাসিমার ঘরে থাকব।
মামীমা বললেন, স্টোভের পাশে কেটলি, কফি, সব আছে ‘নিশীথ’।
—করে নেব। যান তো, শুয়ে পড়ুন।
মামীমা চলে গেলে নিশীথ বলে, মাসিমা এত বছর অসুস্থ যে, ভাবিনি এত বছর বাঁচবেন।
—সুজাতাদি যা যত্ন করত…
—সিংহ বংশে পুরুষ তো ও একা। দিদি, দুই ভাই, সব কলকাতাতেই থাকে। আসবে সবাই…বাড়ি…বাগান…সম্পত্তি…
—সুজাতাদি যাবে না।
—না গেলেই ভাল। যান, শুয়ে পড়ুন।
সুজাতাদির পাশে শুয়ে পড়েছিল পুতলি। ওঁর গায়ে হাত রেখে ঘুমিয়েও পড়েছিল। জানতও না যে এটাই অনেক দিনের মতো শেষ নিশ্চিন্তে ঘুম হবে ওর।
পরদিন সুজাতাদির দু’ভাই এসেছিল, সুনন্দ আর সুজয়।
ওরাই শ্মশানে গেল, সুজাতা থেকে গেলেন। নিশীথও গেল।
সুজাতা বললেন, এখন ওরা করুক।
পুতলি বলল, তুমি একা থাকবে?
—একা কিসের? মামীমারা আছেন, তুই চলে যা বেলা থাকতে থাকতে।
—না, ওরা ফিরুক।
মামীমা কাছের কলোনি থেকে ডেকে আনলেন কাদের। বাড়ি ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করা নিয়ম। পুতলি স্নান করল, সুজাতাও।
সুজাতাদির জামা কাপড় পরে মামীমার ঘরে গিয়ে পুতলি ভাত খেয়ে এল।
—তুই যাবি না পুতলি?
—একটু শুয়ে থাকি তোমার কাছে।
—শ্মশান বহুদূর, চন্দনপাড়া কি এখানে? ওদের ফিরতে দেরি হবে।
—রিকশায় চলে যাব আমি আর সমু।
—স্কুল থেকে, ক্লাব থেকে, সব শ্মশানেই যাবে। এত দূরে কে আসবে?
—তোমার দিদি এলেন না?
ঈষৎ তিক্ত গলায় সুজাতা বললেন, আসবে। সুচেতা রায় আসবে। নিজের কন্ট্রাক্টর স্বামী, রণো আর জয়ের বউরা, সব নিয়ে আসবে। মার শ্রাদ্ধশান্তিতে কত জাঁক হবে দেখিস?
ঘুম ঘুম গলায় পুতলি বলেছিল, তোমার মতো খালি খালি তো ওদের লাগবে না।
তারপর ঘুমিয়ে পড়েছিল।
ঘুম ভাঙতে সন্ধ্যা।
সুজাতা বললেন, কি করবি এখন? অশ্রু বারবার ফোন করছে।
—সন্ধ্যা হয়ে গেল?
—ভীষণ ঘুমিয়েছিস।
—ওরা ফেরেনি?
—একটায় তো বেরোল, এবার ফিরবে বোধহয়।
—আমি আর দেরি করব না, চলে যাই।
যেতে পারবি?
—কত বার গেছি! রাস্তায় গেলেই তো রিকশা পেয়ে যাব।
চুলে এলো খোঁপা জড়িয়ে নিয়ে পুতলি বেরিয়ে পড়েছিল। খানিকটা এগোলেই বড় রাস্তা, রিকশা পেয়ে যাবে। বাড়িতে মা—বাবা ভাবছে নিশ্চয়। ইশ, এতটা ঘুম পেয়ে গেল কেন?
বড় রাস্তা দেখা যাচ্ছে, দেখা যাচ্ছে, হঠাৎ সব ঘুটঘুটে হয়ে গেল।
লোডশেডিং! টর্চ তো নেই!
ফিরে যাবে আবার?
না, সাবধানে এগোলেই তো বড় রাস্তা। যে হোটেল তৈরি হচ্ছে, তার পাশে পৌঁছেই লোডশেডিংটা হলো?
একটা গাড়ি দাঁড়াল সামনে, ঘ্যাঁচ করে।
টর্চের আলো পুতলির মুখে।
হাতে মুখ আড়াল করে পুতলি এগোল।
গাড়ির পাশ কাটিয়ে আরো একটু, আর খানিকটা এগোলেই…
গাড়ির দরজা খুলে কারা নামল।
পুতলি পাশ কাটিয়ে চলে যাবে, চলে যাচ্ছে, অসম্ভব পেশাদারী দক্ষতায় কারা ওর মুখ চেপে ধরল, টেনে তুলল গাড়িতে।
গন্ধ, মদের গন্ধ। একজন মুখ চেপে আছে, আরেকজনের লোলুপ হাত ওর হাত দুটো চেপে আছে।
—স্পীডে বেরিয়ে যা!
কে বলল?
.
অশ্রু আর নীহার, আর শ্মশানযাত্রীরা নিষ্প্রদীপ অন্ধকারেই এসেছিলেন সুজাতাদের বাড়ি।
—পুতলি! পুতলি কোথায়?
—সে তো চলে গেছে কখন?
—কখন?
—লোডশেডিং হলো ও বেরোবার কিছুটা বাদেই। সে তো…
—এক ঘণ্টা হয়ে গেল?
—বাড়ি যায়নি?
—না সুজাতা, না! কেন, কেন এত দেরিতে একা ছেড়ে দিলে?
—ও ঘুমিয়ে…
—কেন একা যেতে…
—পড়েছিল, বললাম, শ্মশান থেকে…
—দিলে, এই বয়স ওর…এ দিকটা…
—ওরা ফিরুক, তবে যাস, ও জেদ করে…
—এমন বিচ্ছিরি, টাউনের বাইরে…
—সমু চেঁচিয়ে বলল, গুলতি, তাপস, আয়।
ওরা দুপ দুপ করে ছুটে গেল। পুতলি! পুতলি! পুতলি! সমুর আর্ত ডাক।
আলো জ্বলে উঠল হঠাৎ।
.
না, সেদিন পুতলিকে পাওয়া যায়নি, তার পরদিন না, তার পরদিনও না।
চারদিন পরে নদীর ওপারে গৌরীপুর থানা এলাকাধীন নন্দচক বাজার পেরিয়ে একটি কালভার্টের পাশে সম্পূর্ণ নগ্ন একটি মেয়েকে পাওয়া যায়। প্রভাতে মাঠে মলত্যাগ উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল, এমন কয়েকটি লোক ওটিকে মৃতদেহ মনে করে এবং একজন গামছা দিয়ে তাকে ঢাকতে গিয়ে বলে, বেঁচে আছে।
এরাই মেয়েটিকে নিকটস্থ থানায় নিয়ে যায় একটা কাপড় জড়িয়ে। ভদ্দরঘরের মেয়ে, হাতে ঘড়ির দাগ আছে, বয়সও বছর কুড়ি। থানা থেকে স্বাস্থ্যকেন্দ্র। খবর ঘুরতে থাকে, ঘুরতে থাকে। অবশেষে সদর থানায় খবর যায়, এবং নিরুদ্দেশ হবার আটদিনের মাথায় গণধর্ষিতা পুতলিকে সদর হাসপাতালে আনা হয়।
হাসপাতালে আঁচড়েকামড়ে ক্ষতবিক্ষত পুতলির অস্বাভাবিক চাহনি ও গাড়ি থেকে ফেলে দেবার ফলে থেঁৎলানো কপাল দেখে অশ্রুকণার মাথায় অন্ধকার নামে।
কে? কারা? কতজন?
পুতলি বোবা চোখে চেয়ে থাকে। তারপর হঠাৎ আতঙ্কে সিঁটিয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়।
ডাক্তার বলতে বাধ্য হন, এ সময়ে আপনারা না এলেই ভালো, একটু ধাতস্থ হোক আগে।
পুতলিকে তুলে নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণ, এ ভাবে তাকে ফেলে যাওয়া, টাউনের মানসিকতায় ভীষণ ঝড় তোলে।
পুতলি আর কিছুই জানেনি। ভয়ঙ্কর শকে, ব্রেনসেলে ও মনে, ও জীবন্মৃতের মতো হয়ে গিয়েছিল।
যেমন জানেনি অশ্রুকণার অতর্কিত রক্তচাপ বেড়ে সেরিব্রাল অ্যাটাক ও মৃত্যুর কথা।