এক
মালা মণ্ডলকে ধর্ষণ ও হত্যার অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই—
—পুলিশ অপরাধীদের ধরছে না কেন?
—অপদার্থ ও. সি. জবাব দাও!
না, সুতানপুর থানার সামনের মাঠে মিটিং করে শ্লোগান দিয়েই ওরা থেমে যায়নি। পোস্টার মেরে এসেছিল সব জায়গায়। আর মালা মণ্ডলের ধর্ষণকারী চাঁদ যখন ধরা পড়ে, তখন আশ্চর্য উল্লাস হয়েছিল পুতলির।
—সুজাতাদি! ধরা পড়েছে লোকটা।
—ধরা পড়াই সব নয় পুতলি, এরপর কি হবে?
—শাস্তি হবে।
—তুমি এখনো অনেক ছেলেমানুষ আছ।
সুজাতাদির বয়স ষাট। রোগাটে চেহারায় এমন কিছু আছে যা সম্ভ্রম জাগায়। সবচেয়ে চোখে পড়ে এই বয়সেই ধপধপে সাদা হয়ে যাওয়া চুল, যে চুল উনি ছোট করে ছেঁটে ফেলেছেন।
—বাইশ বছর বয়সটা ছেলেমানুষের বয়স নয়।
—কিন্তু এখন তো খানিক বুঝবে!
—কি বুঝিনি?
—মালা তো মরেই গেছে। লোকটাকে কি অপরাধে শাস্তি দেবে পুলিশ?
—ধর্ষণ, তারপর খুন!
—ধর্ষণ, আইন অনুযায়ী কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপরাধ নয়। সমাজের বিরুদ্ধে অপরাধ। একমাত্র পুলিশ পারে কেস করতে।
—সত্যি, সুজাতাদি?
—খুব সত্যি। তারপর তাকে খুন। গোপাল যে খুন করেছে, তা নিয়ে পুলিশ কেস করবে?
— কেস করবে না?
—মালার বাবাই পিছিয়ে যাবে। ওর আরো তিনটে মেয়ে আছে। একটা ছোটখাট মুদী দোকান চালায়। ও কোন সাহসে চাইবে যে কেস হোক?
—বাপ হয়ে মেয়ের খুনের শাস্তি চাইবে না?
—তোমাকে তোমার পরিবার অসম্ভব অবাস্তব পরিবেশে বড় করেছে পুতলি। জানি তো তোমার বাবা—মাকে, বাস্তব নয়, কি হচ্ছে তা নয়, কি হওয়া উচিত সেই থিওরিটাই বুঝত তারা।
সুজাতাদি জানবেন। পুতলি তো শুনেছে সুজাতা, অশ্রুকণা আর নীহার ছিলেন সহপাঠী। বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনজনই ছিলেন পরস্পরের বন্ধু। তারপর অশ্রু আর নীহারের বিয়েতে সুজাতা ছিলেন অন্যতম সাক্ষী। তারপরেই সুজাতা স্কুলের কাজ নিয়ে চলে যায় শিলংয়ে।
পুতলির বাবা—মা দুজনেই এই শহরে চলে এলেন চাকরি নিয়ে। মা ঢুকলেন মেয়েদের কলেজে, বাবা ছেলেদের কলেজে। তখন ছিল না, এখনো এখানে কোনো কো—এডুকেশনাল কলেজ নেই।
সবচেয়ে অবাক কাণ্ড, সুজাতাও এলেন মেয়েদের স্কুলে। বললেন, বাধ্য হয়েই এলাম। মা কতদিন বা বাঁচবেন? ছোট ভাইও চলে গেল দিল্লী। বাড়িটা আছে, মা আছেন।
পুতলির মা—বাবা কি অবাক হয়েছিলেন!
—এই টাউনে তোমাদের বাড়ি?
—বরাবরই ছিল।
—কি আশ্চর্য, কোথায়?
—লাইনের ওপারে।
—বাড়ির কোনো নাম আছে?
—সিংহবাড়ি বললেই লোকে চিনবে।
—সুজাতা, ওটা তো মস্ত বাড়ি।
—তাই তো সমস্যা।
—কেন?
—ভাইরা থাকবে না, দিদি থাকবে না, বাড়িটার কি হবে?
—সত্যিই তো…
নীহার যেন পরিস্থিতিটা হালকা করার জন্যে বললেন, সম্পত্তি ব্যাপারটা এত ঘৃণা করতো সুজাতা, কিন্তু শেষ অবধি সম্পত্তির মালিকই হয়ে গেলো।
সুজাতা একটু হেসেছিলেন।
—বিশাল বাড়ি, পিছনে জমি, পাশে পুকুর।
পুতলি বলেছিল ও! পিকনিক বাড়ি, তাই না?
—কথাটা সত্যি। মানুষ তো পিকনিক করতেই যায়। মামা পিকনিক করতে দেন, মা খুশি হন।
—তোমার মামা আছেন?
—না না। ”মামা” বলে ডাকি। অনেকদিন আছেন, বাবার আমল থেকে। ওঁরাই তো দেখেন মাকে।
—বিশাল বাড়ি।
—হ্যাঁ, বাবারা তো জমিদার ছিল। বাড়িটা সত্যিই খুব বড়।
—এখন কি করবে?
—মা যতদিন বেঁচে আছেন বাড়ি থাকবে। কিন্তু মা আর কতদিন, চুরাশি পার হলো। আমি বাড়িটাকে একটা শিশু হাসপাতাল বা মেয়েদের হোম, যা হয় করে দিতে বলেছি। কিন্তু অন্যরা মত করলে তো। একলা আমার কথায় কি হবে?
এ তো ভাল প্রস্তাব। কিন্তু তুমি? তোমার তো একটা থাকার জায়গা চাই।
—ভাবনা হচ্ছে? ভেব না। আমার জন্যে আমিই ভাবি না, তোমরা ভাববে কেন?
—একদিন এসো আমাদের বাড়ি।
—দেখি, সময় পেলে যাব… তোমাদের মেয়েটি বেশ। আমাদের ‘পরিবেশদূষণ প্রতিরোধ’ ক্লাবে আসে তো, বেশ উৎসাহী।
—অশ্রুকণা সগর্বে বলেছিলেন, ওর দাদা আর দিদিও খুব ব্রাইট।
—ওর মতো উৎসাহী?
—না না, তারা দারুণ কেরিয়ার করেছে একেকজন। কুমার আর্কিটেকট, তার বৌ ঝুমাও তাই। ওরা দিল্লীতে থাকে। আমার বড় মেয়ে পিপলি আর ওর বর অমেয় দুজনেই মস্ত একটা বিজ্ঞাপন অফিসের হয়ে অ্যাড—ফিল্ম করে। ও এখনো তেমন সিরিয়াস নয়।
—নামগুলো তো স্মার্ট রেখেছ।
—না ভাই, মধুরা আর পল্লবী নাম রেখেছিলাম। ওরা পিপলি আর পুতলি হয়েই রইল।
কথা হচ্ছিল বইমেলায় দাঁড়িয়ে। সুজাতা ঘড়ি দেখে বললেন, চলি। অনেকক্ষণ স্টল ছেড়ে এসেছি।
—স্টলেও বসছ?
—নইলে তরুণরা কি ভাববে? দেখেছ আমাদের স্টল? একেবারে অন্যরকম।
‘পরিবেশদূষণ প্রতিরোধ’ স্টলে বিজ্ঞানচেতনার বই, নাগরিক অধিকারের বই, ‘সমাজে শিশুশ্রমিক কেন?’ ‘পণের বিরুদ্ধে লড়াই করুন’…
নীহার আর অশ্রুর মুখচোখ নিরুৎসাহ হয়ে যায়।
—না… দেখলাম না তো…চলি সুজাতা…
এরা চলে গেলে পুতলি বলেছিল, মা—বাবা আপনাকে সন্দেহ করবে এখন।
—কেন?
সমু বলেছিল, ওঁরা শুধু ভোট দেন। রাজনীতির মধ্যে যাদের সমর্থক হলে সবচেয়ে নিরাপদ থাকা যায়, ওঁরা তাদের ছাড়া সবাইকে এড়িয়ে চলেন।
পুতলি বলেছিল, এই, কি হচ্ছে?
—তুই অবশ্য কাচের ঘর থেকে বেরিয়েছিস…
—জানিস, সুজাতাদি, মা আর বাবা একসঙ্গে পড়তেন ইউনিভার্সিটিতে—
—তাই তো শুনলাম। তা বলে তুই যেন ওঁকে মাসি বা পিসি বলিস না।
সুজাতাদি বললেন, এই! বাদলের মা আসছেন। এখনো মেলায় আসেন!
বাদলের মা গীতাদিকে সুজাতাদি খুব শ্রদ্ধা করতেন। কি রকম মনের জোর। ছেলে মরে গেল জেলে গুলি খেয়ে, মেয়ে জামাই নাতনি একসঙ্গে প্লেন দুর্ঘটনায় মরল, হাসপাতালের মেট্রন গীতাদি রিটায়ার করে কেমন একলা মাথা তুলে থেকে গেলেন।
বইমেলাতেও আসেন, থিয়েটার দেখতেও যান, বাড়িতে ‘পরিবেশদূষণ প্রতিরোধ’ ক্লাব করতে দিয়েছেন, খুব মনের জোর!
বইমেলাতে সেবার যে এলেন, তার পরের বছরই উনি ক্যানসারে মারা যান।
.
সমু বলেছিল, কাচের বাড়ি তোদের।
ঠিকই বলেছিল, পুতলি তো কাচের দেয়ালের ভেতরেই থেকে যেত, যদি না একদিন ওর বন্ধু বুলির দাদা সৌম্য বা সমু ওকে না বলত, এই পুতলি! আমাদের ক্লাবের সরস্বতীপুজোয় ফাংশান করব। তুই একটা গান গাইবি?
পুতুলিদের পাড়ার নাম ভূদেবপাড়া।
ভূদেব রায় একসময়ে বুঝেছিলেন এ টাউনও বড় হবে, লোক বাড়বে, জমির দাম বাড়বে।
ভূদেব রায় তাঁর দশ বিঘা জমিকে প্লট করে করে তেমন সব লোককে বেচেন, যারা এখানে বাস করবে, শিক্ষিত ও রুচিবান লোক হবে। ‘কালচার লোক চাই, বুঝলেন?’ ভূদেব রায় সব সময়ে বলতেন।
সেই ভূদেব রায়েরই নাতি ওই সমু। ওদের বাড়ি অবশ্য শহরের মাঝামাঝি। এক সময়ে তো কেউ ভাবেনি শহর দক্ষিণে আর পুবে এমন করে ছড়াবে। দক্ষিণে রায়েদের জমি,পূবে ত্রিবেদীদের জমি, এ সবের মাঝে মাঝে ছিল আমগাছ, খেজুর আর পিটুলি গাছ, ঝোপঝাড় মাঠ।
সমুদের বাড়ির নাম মহাদেব ভবন। মহাদেব, ভূদেব, সুদেব, তারপর বুদ্ধদেব, সৌম্যদেব আর ধৌম্যদেব। বুদ্ধদেব অ্যাডভোকেট বিষ্টু রায়, সৌম্য তো সমু, আর ধৌম্য বা শংকর স্পোর্টসম্যান। ওর উচ্চাশা, ফুটবল খেলে রেলের চাকরিতে ঢুকবে।
নীহার বলতেন, এমন একটা উচ্চাশাহীন পরিবার আমি দেখিনি। ঠাকুরদার আমলেই জমিদারি চলে গেছে। কিন্তু জমিদারি মেজাজটা রেখে গেছে।
পুতলি ফোঁস করত, জমিদারি মেজাজ?
—ওই যে আলসেমি। প্রাণ থাকতে এ শহরের বাইরে যাব না। সুদেববাবু কি করে? বাবার রেখে যাওয়া বাড়িগুলো থেকে ভাড়া তোলে, বাজারের খাজনা তোলে। বুদ্ধ, ঐ বিষ্টুটার কি মাথা! সে এখানেই প্র্যাকটিস করছে। সমুর উচ্চাশা তো বোঝা যায় না। ছোটটা বল পেটায়।
অশ্রুকণা বলতেন, ঠাকুর্দার নামে রাস্তা, প্রপিতামহের নামে বাজার, মন্দির, শহরটা এখনো ওদের কাছে জমিদারি হয়ে আছে।
—সে ঐ সুদেবেরই। ওর ভাইরা তো কলকাতা চলে গেছে।—
—মেয়েটাকেও দেখো, পোঁটলার মতো চালান করে দেবে কারো ঘরে। বড় মেয়ের স্বামী, ছি ছি, প্রাইমারি মাস্টার। সমুর মায়ের বড় গর্ব যে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে ধানচাল অঢেল, গোয়ালে অনেক গরু।
—অ্যামবিশান চাই, অ্যামবিশান!
ও কথা ওঁরাই বলতে পারতেন। ছেলে কুমার তো পরিষ্কার বলে, এ রাজ্যে কিছু হয় না। বাঙালী কাজ করে না, রাজনীতি করে আর দলাদলি।
কলকাতা শহরকেই গ্রাম মনে হয় কুমারের, এ টাউনে তো তার কাছে কানা গলি।
বাস করার পক্ষে দিল্লী নাকি অনেক, অনেক ভালো। রাজধানী বলে কথা।
কুমার আর ঝুমার পক্ষে পশ্চিমবঙ্গে বেশি আসা সম্ভব নয়। ওদের মেয়ে লালী পড়ে ইণ্টারন্যাশনাল স্কুলে। বাংলা সে বোঝে না, বলে না, পড়ে না। দু’তিন বছরে একেকবার আসে ওরা।
প্রতি বছর ব্যাঙ্গালোরে যাবেই ওরা ‘স্বর্গ—হৃদয়’ আশ্রমে। সেখানে স্বর্গীয় শান্তি, আরাম আর আনন্দ আছে, আত্মশক্তিও বাড়ে।
কুমার আর ঝুমা, দুজনের দুটো গাড়ি, সফদরজঙ্গ এনক্লেভে ফ্ল্যাট, কেননা ওদের উচ্চাশা আছে। কুমার অবশ্য বাবা, মা, পুতলিকে কয়েকবার নিয়ে গেছে। রাজস্থান, হিমাচল, অনেক ঘুরিয়েছে। আর পুতলিকে বলেছে, পড়বি তো চলে আয়। ছোট শহরে থাকলে মানুষের মন সংকীর্ণ হয়ে যায়।
—তোমার মন কি সংকীর্ণ হয়েছে?
—তা হয়েছে পুতলি। এখন নিজের কাজ, ফ্যামিলি, এ সব ছাড়া আর কি ভাবি বল? কিচ্ছু না।
ঝুমা ঈষৎ হেসে বলেছিল, যা হোক, তোমার দাদার মন থেকে মফস্বলী সকীর্ণতাটা চলে গেছে। দিল্লী না এলে….
অশ্রুর কথাগুলো ভাল লাগত না। কিন্তু এ সংসার ঝুমারই সংসার। কুমার ঝুমার অনুগত প্রজা।
—তোরা বাংলা গান—টান শুনিস?
—না মা। সময় কোথায়?
—বাঙালী সমাজে মিশিস?
—চিত্তরঞ্জন পার্কে দুর্গাপুজো, ব্যস খতম। অবাঙালী সমাজটা মন্দ কিসের? যাক গে, বলো, একবার হিমালয়টা ঘুরিয়ে আনি।
—হবে, হবে, এত ব্যস্ত কেন?
দিল্লী দেখে দেখেই নীহারের বিস্ময় ফুরোত না। লালীর সঙ্গে ইংরিজিতে গল্প করা, সেও তো এক নতুন অভিজ্ঞতা।
অশ্রু বলতেন, মোটে বাংলা শিখবে না!
ঝুমা বলত, তোমার পিপলি তো কলকাতায় বসে আছে। জয় আর জয়িকে ঋষিভ্যালি পাঠাল কেন? তারাই কি বাংলা বলে, না পড়ে?
তারপর আদুরে গলায় বলত, মা! একটু বোঝো। তোমাদের সময় কেটে গেছে, তোমার ছেলেমেয়েদের সময়েও। ওনলি বেঙ্গলি নিয়ে ওয়েস্ট বেঙ্গলে পড়ে থাকলে আজ কেউ কেরিয়ার করতে পারবে না।
নীহার বলতেন, সে তো ঠিক কথাই বলছ। আমার কথা, একটু বাংলাও জানুক, বাংলা গান শুনুক, এমন ভাবে সব শিকড় কেটে গেলে…
ঝুমা আরো আদুরে গলায় বলত, আমরাই বলি না। সেই জন্যেই তো বলি যে তোমরা এলে একটা বাংলা বলার প্র্যাকটিস হয়। পুতলির জন্যে এত চিন্তা হয়!
—কেন?
—একেবারে বাঙালী হয়েই রইল।
—থাকুক না।
কুমার একটু হতাশ হয়ে বলেছিল, এই মানসিকতাটাই পশ্চিমবঙ্গকে মেরে ফেলেছে। তোমাদের অ্যাটিচ্যুডটা এমন, যেন বাঙালী ভারতবর্ষের সব জাত থেকে সুপিরিয়ার, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যটা ভারতের অন্যান্য রাজ্যের চেয়ে অনেক শ্রেষ্ঠ। এটা কিন্তু ভুল।
নীহার ঈষৎ হেসে বলেছিলেন। বুঝি রে! কি করব বল। আমরা বাঙালীই থেকে গেলাম, তোরা ভারতীয় হয়ে যাচ্ছিস।
ঝুমা বলল, সেটাই কি বলা যায়? হরদম দেখছি তো ভারতীয় ছেলেমেয়ে বিদেশ বেছে নিচ্ছে।
—হ্যাঁ…ভূগোলটা বড় হচ্ছে…
রাতে পুতলি নীহারের ঘরে খাবার জল রাখতে বলেছিল, ভেবো না বাবা। আমি একেবারে বাঙালী থেকে যাব। ওই রাজ্যের, ওই টাউনের মেয়ে হয়ে থেকে যাব।
—সমু যদি বাইরে চলে যায়?
—সে দেখা যাবে।
—ওর যদি ব্যবসায়ে মাথা থাকত…
—তাহলে বর্ডারে ক্রাইম করতে চলে যেত…
—কি যে যা তা বলিস!
নীহার যেন শিউরে উঠেছিলেন। ভীষণ, ভীষণ দুর্বলতা নীহার আর অশ্রুকণার ‘পূর্বাশা’ বিষয়ে। ওটা যেন বাড়ি নয়, তার চেয়েও বড় কিছু। ওঁদের রুচি, ওঁদের বিশ্বাস, সব কিছুর মূর্ত প্রতীক। রবীন্দ্রভক্ত নীহার ও অশ্রুকণা একতলায় অন্দর চাতালে বিশাল বিশাল সিমেন্টের টবে রক্তকরবী, কৃষ্ণচূড়া, শিউলী, ছাতিম, এমন কত গাছ রেখেছেন, তারা বনসাই হয়ে গেছে, ফুল আর ফোটে না। তবু গাছগুলি ওঁদের বড় প্রিয়।
ওখানে বসে নীহার আর অশ্রু ছুটির দিনে চা খান, কাগজ পড়েন।
ওই দুর্গ ওঁদের দুজনের স্বপ্নপ্রাসাদ যেন।
টাউনে বোমবাজি হলে দরজা—জানলা এঁটে দেন।
নিষ্প্রদীপ হলে ইনভার্টার জ্বালেন।
কথা হয় বই নিয়ে, গান নিয়ে।
কিন্তু কুমার আর পিপলি তো অন্যরকম জীবন বেছে নিল, তৈরি করে নিল।
কুমারের ফ্ল্যাটের কোনো নাম নেই।
পিপলি আর অমেয়র বাড়ির নাম ‘দি অর্কিড’। কেন, তা নীহার জানেন না। কিন্তু তাঁর দেওয়া ‘অরুণোদয়’ নামটা অনেক ভাল ছিল এ কথা বললেই পিপলি বলে, ‘অ’টা তো রেখেছি বাবা।
অমেয় বা পিপলি গান বাজনার ভক্ত নয়। ওরা বিজ্ঞানের ছবি বা ফিলম ইত্যাদি ছাড়া কিছু ভাবেই না। ওঁদের শেষ ভরসা পুতলি।
যদিও পুতলি ওঁদের খুব বাধ্য প্রজা নয়।
পুতলি সংস্কৃতি ক্লাবে যায়, পরিবেশদূষণ নিয়ে মিটিং করে, মেয়েদের উপর সমাজ ও পরিবারের নির্যাতন নিয়ে সুজাতার সঙ্গে সংগঠনে যায়। কিন্তু পুতলি এখনো জটিলতাগুলো বোঝে না। সমু বলে, আসলে তুই হাঁদা।
—একটা হাঁদা মেয়েকে বিয়ে করবি?
—আমিও তো হাঁদা।
—তুই করবিটা কি?
—আমি? সবাই যা করে।
—কি, চাকরি?
—যা হয় কিছু।
—কলেজে পড়াবি?
—অত বোকা নই চাঁদু।
—তা হলে?
—ভেবে রেখেছি।
—কি?
—ল’ পড়ব।
—উকিল হবি?
—বিধুবাবু মারা যাবার পর শহরে একটা উকিল নেই যে সাধারণ মানুষকে বা সংগঠনকে আইনি প্রতিকার পেতে সাহায্য করে।
—তোর দাদা তো উকিল।
—তাতে কি? না হয় জেরকস মেশিন বসাব, টিউটোরিয়াল হোম খুলব। মোট কথা, টাউন ছাড়তে বা চাকরি করতে পারব না। তোর বাবাই তো বলেন, আমাদের পরিবারে উচ্চাশা নেই।
—আমি কি করব?
—কাজ করবি। টাউন ছাড়ব না পুতলি, এখানেই থাকব। এখন ভেবে দেখ।
—কি ভাবব রে?
—তোর দাদা দিদি তো সরে গেছে।
—ওরা পারে। আমি একটা ভেতো বাঙালী, তাছাড়া এ শহর ছাড়া কোথাও স্বস্তি পাই না।…
—বাঁচা গেল।
—তার মানে?
—বুলিটা বিদায় হলেই…
—বুলিকে তোরা অন্যত্র বিয়ে দিবি?
—কি করা যাবে? সাগর তো তার বাবার বিরুদ্ধে যাবে না, আর সাগরের বাবাও ক্যাশে যৌতুকে পাঁচলাখ না দিলে ব্যাঙ্ক কেরানি ছেলের বিয়ে দেবে না।
—বুলিকে সাগর ভালবাসে না?
—সাগর প্র্যাকটিক্যাল ছেলে।
—সত্যি! ভাবলেও খারাপ লাগে।
—আমার বাবাকে তোর বাবা খুব আনকালচার্ড মনে করে তো! জানি। বাবা সত্যিই সাদামাটা মানুষ। কিন্তু ছেলের বিয়েতে পণ নেয়নি, মেয়েদের বিয়েতে পণ দেয়নি। ভুজঙ্গবাবু প্রতিবেশী, সে ছেলের বিয়েতে পণ নিল বলে বাবা বৌভাতে যায়নি।
—যাক গে, এ সব কথা থাক।
সমু সেদিন পুতলির মনে প্রশ্নের ঝড় তুলে দেয়। সত্যিই তো? পুতলিরা অনেক বিয়েবাড়ি যায়, যেখানে পণ দেওয়া—নেওয়া হয়।
বাবা—মা মুখে বলে, পণপ্রথা নিপাত যাক। কিন্তু তা বলে কোনো বিয়ে তো বয়কট করে না।
সমু বলেছিল, আমরা একটা সাদা রেজিস্ট্রি বিয়ে করব, দেখিয়ে দেব টাউনকে।
—তোদের বাড়ি শুনবে?
—শুনবে শুনবে। শোনাতে হবে।
—সত্যি, মানুষ কতরকম হয়! মা—বাবা…
—ছেড়ে দে তো। ও সব ভাবিস না। আমি উঠছি আজ।
—কোথায় যাবি?
—সুজাতাদির মা’র শরীরটা আবার খারাপ হয়েছে। রাতে ওখানে থাকব আমি আর গুলতি।
—সত্যি সুজাতাদি মা’র জন্যে কত করে!
—কার জন্যে করে না? একটা মানুষের মতো মানুষ। টাউনটা তো বোবা হয়ে যাচ্ছিল।
—যাঃ, কি যে বলিস!
দশ বছর আগে মালা মণ্ডলের ব্যাপার নিয়ে এত হইচই ভাবা যেত?
—এত খবরই বেরোত না কাগজে।
সমু, যে পুতলির চেয়ে মাত্র চার বছরের বড় সে গভীর স্নেহে তাকিয়েছিল পুতলির দিকে।
—সম্ভব ছিল না তখন। জরুরি অবস্থার পর মানুষ বেশি সোচ্চার হলো, আর সাতাত্তরে বামফ্রন্ট আসার পর এ রাজ্যেও মানুষ গলা খুলতে শিখেছিল, এটা ঘটনা।
—তার মানে?
—ধর্ষণ আগেও হতো, জানা যেত না। এখন বেশি হয়, জানা যায়। ব্যাপার তো তা নয়, হবার পরে উপায় কি?
—লোকটা ছাড়া পেয়ে যাবে?
—মনে হয়, প্রমাণাভাবে। স্বামী তাড়িয়ে দিয়েছিল, বাপের ঘরে থাকত, ব্রিজের মুখে সন্ধ্যায় বাজারে সবজি বেচত, ঘরে ফেরার পথে…ধর্ষণের সাক্ষী কে? হত্যার সাক্ষী কে?
—চাঁদ ওর পেছনে লেগেছিল না?
—লেগেছিল, সাক্ষী দেবে না কেউ।
—কিচ্ছু ভাল লাগে না আমার, এ সব ভাবলে।
—ভাবিস না। দেখ, নৌকাগুলোতে আলো জ্বালাচ্ছে। আপনার মেয়াদ উত্তীর্ণ। যান, পূর্বাশায় প্রত্যাবর্তন করুন। আমাকেও যেতে হবে।
পুতলি বাড়ি ফিরে এসেছিল। ফিরতে ফিরতে ওর আবারও মনে হয়েছিল, তাদের টাউনটা সত্যই খুব সুন্দর, এমন নদী, এমন পরিবেশ, আর টাউনের যত মাঠই নষ্ট হোক, ব্যারাকের মাঠটা তো থাকবেই। চিরদিন চিরকাল থাকবে। পুতলিও এই টাউনেই থাকবে।
এরকম সে ভেবেছিল ১৯৮৭ সালের জুন মাসে। সেই জুন মাসে এ টাউনে অনেক কিছু ঘটে যায় যা কিছুদিন আগেও ভাবা যেত না। ছোট ছোট ঘটনা, কিন্তু আজ, পাঁচ বছর বাদে পুতলির সেই সব ছোট ছোট কথাই বারবার ভাবতে ভাল লাগে। যেমন তারকবাবুর ছেলে বাবলু আর রাজ্যবিদ্যুৎ পর্ষদের দীপকবাবুর মেয়ে সরস্বতীর যুগলে আত্মহত্যা করা। বাবলু কলেজে কেমিস্ট্রির ডেমনস্ট্রেটর ছিল, সরস্বতী দীর্ঘদিন চাকরি খুঁজছিল, মাধ্যমিক পাশ করেই।
সেই সন্ধ্যায় ও যখন লাইব্রেরিতে আসে, পুতলি বলেছিল, বই নেবে না?
সরস্বতী খুব স্বাভাবিক গলায় বলেছিল, না আজ কলকাতা যাচ্ছি রাতের গাড়িতে।
—বিয়ের কেনাকাটা করতে?
—হ্যাঁ, বাবা যখন এত খরচই করবে, শাড়ি, জামাগুলো নিজে কিনি।
হ্যাঁ, বাবলুর সঙ্গে সরস্বতীর বিয়েতে দুজনের বিয়েতেই ঘোর আপত্তি ছিল। বাবলুরা নাকি বারুজীবী, আর সরস্বতী ব্রাহ্মণের মেয়ে। কতদিনের প্রেম, কতটা গভীর, তা কেউ জানত না। সরস্বতীর বিয়েও ঠিক হয়েছিল। পাত্র কেষ্টনগরে ব্যাঙ্কের অফিসার। আর দীপকবাবু ভি সি আরের, টেলিভিশনের দোকান এতই রমরমিয়ে চলে যে তিনি পাঁচ লক্ষ টাকার যৌতুক দিচ্ছিলেন, পণ নয়, তবে স্বর্ণময়ী রোডে চার কাঠা জমি।
—স্বাতী আর শ্বাশতীকে দিয়েছি, ওকেও দেব। ছোট মেয়ে তো! এমন নয় যে আমার ছেলে আছে।
—আজ খুব সেজেছ সরস্বতীদি।
—সাজব না কেন বল? এত শাড়ি, এত শাড়ি, রোজ একটা করে পরে নিচ্ছি।
পুতলিকে হঠাৎ দোকানে মিষ্টি খাওয়াল সরস্বতী। বলল, খা না! আজ আমি খুব খুশি।
—বাবলুদার কি হবে?
—বিয়ে করবে কাউকে। আর কি হবে?
এমন সব স্বাভাবিক কথাবার্তার পর টাউন থেকে দুজনেই নিরুদ্দেশ।
কলকাতাতেই শেয়ালদার কাছে এক হোটেলে ওদের মৃতদেহ পাওয়া যায়। আত্মহত্যার কোনো চিঠিও রেখে যায়নি। নিজেদের পরিচয়ও দিয়ে যায়নি।
বাবলুর বন্ধুরা কাগজে সব পড়ে কলকাতায় যায়। কি ভাবে ওদের দেহ টাউনে আনে, সে নাকি অনেক কথা। ওদের জেদেই শ্মশানে এক চিতায় দুজনকে দাহ করা হয়।
অনেক পরে সরস্বতীর মা পুতলির মাকে বলেছিলেন, আত্মহত্যা করল কেন? এ শহরে বাস করব কি করে তা একটু ভাবল না?
অশ্রুকণা বলেছিলেন, আত্মহত্যা করার সময়ে ও সব কথা কেউ ভাবে না।
—কি করে জানব ওই বাবলুকেই…
পুতলি বলেছিল, মা! ওঁর সঙ্গে কথা বলো কেন? আজকাল জাতবেজাতে বিয়ে সরকার আইন করে অনুমোদন করেছে।
—এ সব সংকীর্ণতা কি যায়?
—দাদা আর দিদি তো…
—স্বজাতে বিয়ে করেছে, বেজাত হলেও মেনে নিতাম। জাতিভেদের সংকীর্ণতার ওপরে উঠতে পারব না?
তারকবাবু বলেছিলেন, সিনেমা। সিনেমার প্রভাব এ সব। নইলে বাবলু…
সমু সব ছবি দেখে, ও যেগুলো দেখে উঠতে পারে না, সেগুলো গুলতি দেখে। গুলতি বলল, সব ফালতু বাত! হিন্দিতে ট্র্যাজিডি দেখায় কোথায়? সেই তো কয়ামত সে কয়ামত তক, এক দুজেকে লিয়ে, আর মিট্টি ঔর সোনা। আর সব ছবিই তো…
পুতলি আর সরস্বতীর লাইব্রেরিতে দেখা হয়েছিল, আর বাবলু সমুদের ক্লাবে আড্ডা দিতে গিয়েছিল। দুজনের একজনকে দেখেও বোঝা যায়নি যে আজকের দিনে ভালোবাসার জন্যে ওরা মরতে যাচ্ছে!
—ভালবাসলে সমাজকে কলা দেখিয়ে বিয়ে করে, মরে কেউ, সমু?
—যারা কলা দেখাতে পারে না তারা মরে। যদিও বাঁচাটাই বড় কথা।
মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল ওদের। সুজাতা খুব আঘাত পেয়েছিলেন। বলেছিলেন, কত, কতবার জিগ্যেস করেছি, সরস্বতী কিছু বলতই না। গীতাদি বলেছিলেন, কি অর্থহীন অপচয়। বুলিকে তো আমি ভাল বলি। আজকাল মেয়েরা প্রেমও করে, আবার পণ—যৌতুকও দিতে বাধ্য করে। আমার ননদকে তো তার মেয়ের প্রেমিককে দু’লাখ ক্যাশ, মারুতি গাড়ি দিয়ে বিয়ে দিতে হলো। মেয়েই আদায় করল। সুজাতাই ভাল আছে।
—বিয়েটা করে ওঠা গেল না। যাকে বিয়ে করব ভাবলাম, তার রাজনীতিক উচ্চাশা মন্ত্রী হবার। আমি কেটে পড়লাম।
সমু বলল, কি করলে। ইশ!
—মন্ত্রীর বউ হিসেবে আমি খুব উৎরোতাম না। সে লোক মন্ত্রী হয়নি, কিন্তু রাজনীতিকে কেরিয়ার করেছে।
—কে গো?
—কিছুটা অজানা থাক। যাক, সরস্বতীর ইস্যুতে একটা মিটিং করা দরকার। আজকের দিনে জাতপাতে বিরোধ একটা ইস্যু হলো?
আর গীতাদি বলেছিলেন, সব, সব ইস্যু থেকে গেছে সুজাতা।
—সেজন্যই তো প্রতিবাদ দরকার। পুতলি, কাঁদছ কেন? চোখ মোছ, কেঁদ না।
—সরস্বতী…এমন করে—কেন!
সমু বলেছিল, জাতপাত মানামানি এখনো খুব আছে। এটা ঘটনা।
সরস্বতী আর বাবলুর মৃত্যু টাউনকে একটা ছোটখাট নাড়া দিয়ে যায়।
কিন্তু জুন মাসেই টাউন থেকে অদূরে একটা বাস আর ড্রাইভার থেকে যাত্রী হঠাৎ জ্বলে যায়। বাসে বিস্ফোরক কিছু আনছিল কেউ। যে আনছিল সেও বাঁচেনি।
সরস্বতী আর বাবলু স্থানীয় কাগজে স্থানীয় সংবাদ হয়েছিল। বাস জ্বলে যাওয়াটা বড় কাগজে বড় খবর হয়ে যায়।
এটা খবর থাকতে থাকতেই সুজাতাদিদের বাড়ির কাছাকাছি অলকাপুরী নামে এক বিলাস হোটেলের ভিত গড়ে ওঠে। টাউনে ঢোকার আগেই পথের ধারে এমন হোটেল। সঙ্গে বার, এই নেহাৎ মধ্যবিত্ত ও কিছু উচ্চবিত্ত মানুষের শহরে এক চমকপ্রদ ঘটনা।
অবাঙালী মালিকানার অনুপ্রবেশ বলা যাবে না। কেন না মালিক বাঙালী, স্থানীয় হোক বা না হোক। রাণা সেন জমি কিনছিলেন, পেট্রল পাম্প বসাচ্ছিলেন। আধুনিক মোটর গ্যারেজ করছিলেন, কিন্তু এরকম একটা হোটেল করবেন, তা কেউ ভাবেনি।
এ হোটেলের কাছাকাছি যে সব বাড়ি, তার লোকরা আপত্তি জানিয়েছিল এম. এল. এ.—কে। পরিবেশ নষ্ট হবে, মানুষ প্রভাবিত হবে। জমির দাম বাড়বে।
সে আপত্তি ধোপে টেকেনি। কেননা রাণা সেনের রাজনীতিক খুঁটি নাকি শক্ত। তা ছাড়া এ পথ দিয়ে যারা যায় তারা এখান থেকে লালবাগ ইত্যাদি দেখে যাবে। টাউন বড় হচ্ছে, ভালো হোটেল দরকার। সরকারী বেসরকারী অনেক মিটিং হয়। থাকার পক্ষে ভাল জায়গা।
নীহার আর অশ্রুকণা বললেন, যাক এমন জায়গায় বাড়ি করেছি, চট করে কেউ আশপাশে এসব করতে পারবে না।
কুমার হঠাৎ একদিনের জন্যে এসেছিল, সে লম্বা লেকচার দিয়ে গেল।
—তোমাদের মানসিকতা বদলাও। নিছক রেসিডেনশিয়াল কোনো জায়গা থাকতে পারে না। এক সময়ে চেঞ্জের জায়গা, রিটায়ারমেণ্টের জায়গা ছিল হাজারীবাগ, মধুপুর, গিরিডি, দেওঘর। আজ আছে?
—সত্যি কথা, কিন্তু এ টাউন তো…
—একদা অন্যরকম ছিল, সময়ের প্রয়োজনে বদলাচ্ছে। লোকের পয়সা হয়েছে, খরচ করে যাবে। এটা হলে বহু ছেলে তো কাজও পাবে।
—জমির দামও তো বাড়বে।
—দেখ, সুজাতাদি হয়তো সব বেচে দিয়ে শহরের সবচেয়ে ধনী লোক হয়ে যাবে।
অশ্রুকণা বললেন, মনে হয় না। এ ছাড়া সুজাতা একা তো নয়।
—ভাইবোনদের বুদ্ধি থাকলে বেচতেই চাইবে। কি করবে? তারা আসবে না, থাকবে না। বাড়ি জমি বেচে দাও, যে যার টাকা নিয়ে নাও। এ বাড়িটার দাম এখন কত হবে?
নীহার হাসলেন, কি করে জানব। এখানে এখনো কেউ বাড়ি বেচেনি।
—তা ছাড়া, এক সময়ে আভিজাত্য ছিল, এখন টাউন তো উত্তরে আর পুবে ছড়াচ্ছে। তোমাদেরও এক সময়ে বাড়ি বেচার কথাই ভাবতে হবে।
—কেন?
—কে থাকবে?
পুতলি বলল, আমি তো থাকব।
—ঝুমা ঠিকই বলে। তোর সেই মফঃস্বল মানসিকতা আর গেল না।
—নাই বা গেল দাদা? তোমরা এক রকম, আমি আরেক রকম। সেটাই ভালো নয়?
নীহার অধ্যাপকীয় ভাষায় বা বইয়ের ভাষায় বলেছিলেন, বৈচিত্র্যই ঐক্য আনে।
—বাবা! এত বইয়ের ভাষায় কথা বলো!
কুমার বলেছিল, বাবা—মা যতদিন, ততদিন। তারপর তুই এখানে থাকলেও বাড়ি বিক্রিই হবে।
—আমি দেবই না বিক্রি করতে। কি সুন্দর বাড়ি দাদা! তোমরা কি করে বিক্রির কথা বলো!
নীহার সস্নেহে বলেছিলেন, বাড়িটাকে বড্ড ভালবাসিস। তাই না?
—নিশ্চয়। সেবার দিদির ওখানে গিয়ে টাইফয়েড হলো, আমি তো সব সময়ে বলতাম, ‘পূর্বাশা’ নিয়ে চলো, আমি ভাল হয়ে যাব। তা তো হলো না, সব কেমন অন্যরকম হয়ে গেল।
জুনের শেষ থেকে বর্ষা নেমেছিল। জুলাইয়ে বর্ষা আরো বাড়ল। টাউনে পৌরধর্মঘট অনেক মাস ধরে চলেছে। এমনিতেই জঞ্জালে রাস্তা বোঝাই। টাউনের ঘিঞ্জি, পুরনো এলাকায় নালা—নর্দমা উপছে একাকার হয়ে গেল সব।
বুলির বিয়ে ঠিক হয়ে গেল।
বুলি বলল, এমন বর্ষায় বিয়ে, ভাল লাগে?
পুতলি বলল, নভেম্বরে বিয়ে কর।
—আহা! বিয়ে করে হরিয়ানা নিয়ে যাবে না?
—তোর ভাল লাগছে?
—কি আর লাগবে? এ তো আমার মামাতো বোনের দেওর হয়। আগে দেখেছি। আমার বিয়ে হলে তোরাও বিয়ে করতে পারবি।
—দুজনেই রোজগার করব, তবে তো বিয়ে।
—কে জানে, চণ্ডীগড়ে কেমন করে থাকব।
—সেখান অনেক মেয়ে বিয়ে হয়ে চলে যায়। তারা যেমন করে থাকে, তেমনিই থাকবি।
বুলি বলল, ভাগ্যে তোর মতো ‘কাজ করব’, ‘পায়ে দাঁড়াব’ এ সব চিন্তা কোনোদিন নেই। টি. ভি. দেখব, ফ্যাশান ম্যাগাজিন পড়ব, সালোয়ার কুর্তা পরে বেড়াতে যাব, সেটাও তো জীবন।
—নিশ্চয়, যতদিন ভাল লাগে।
—ভাল লাগতেই হবে পুতলি। আমি তো একটা কথাই বলেছি, অনেক, অনেক দূরে সম্বন্ধ করো। এ টাউনে নয়, এ রাজ্যে নয়, অনেক দূরে।
—দূরেই তো…যাচ্ছিস।
—এখানে সাগর…ছি ছি, কি অপমান বল তো? পণ চেয়ে বসল, পণ?
—সে আর যোগাযোগ করে না তো?
—সাহস আছে তার? আমার সামনে দাঁড়াবার?
নরম, সাদাসিধে, অল্পে খুশি, অগভীর বুলির মুখে এমন কথা শুনে পুতলি বুঝেছিলেন সে মানুষ চিনতে শেখেনি।
বুলি একটু হেসে বলেছিল, তোরা তো এখানেই থাকবি। তোদের একটা বেড়াবার জায়গা হবে।
—হ্যাঁ…যাব। বিয়ে কবে?
—বাবারাই ঠিক করছে। হোক গে বৃষ্টি—বাদল, যত তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়, ততই ভাল। সাগরও জ্বলেপুড়ে মরবে বল? কি আর কাজ করে সে! এ তো অনেক, অনেক বড় ফার্মে অনেক বড় পোস্টে আছে। বিয়ে করবে না বলেছিল, তারপর বলেছে খুব গৃহস্থ ঘরের শান্ত, ভদ্র মেয়ে চাই। প্রথম শর্ত, অনেক চুল থাকা চাই।
—তা তোর আছে।
—আমাকে তো ও দেখেছে মাঝে মধ্যে।
—ভালই হবে, ভাল থাকবি।
—তুইও ভাল থাকবি। তোর বাবা—মা অবশ্য…
—বিয়েটা তো আমার, তাই না?
পুতলি জানত তার নির্বাচনে বাবা—মা খুব সুখী নয়। এটাও জানত, ছেলেমেয়েদের স্বাধীনতা দিয়ে মানুষ করেছে বলে বাবা—মা তার স্বাধীন ইচ্ছেতে বাধা দেবে না।
দিদি নিজে বিয়ে করেছে।
দাদা নিজে করেছে।
পুতলিও করবে।
বাবা—মার মনে মনে ক্ষোভ যা, তা হলো, দিদি আর দাদা তো টাউন ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে অনেক দেখে শুনে তবে বিয়ে করল।
পুতলি তা করল না। বাবা—মার মনে কি আশা ছিল, পুতলি যদি বাইরে বেরোত, আরেকটু দেখত জীবনটাকে, তাহলে হয়তো সমুকেই একমাত্র মনে করত না? আজকের দিনে, যখন জীবনে এত বিস্তার, নিজেকে বিকাশের এত দরজা খোলা, পুতলি একটা কূপমণ্ডুকের মতো জীবন বেছে নিল?
হ্যাঁ, তারা বাড়ি করেছেন। কিন্তু তাঁদের জীবন তো কেটে গেছে। এখন তো বোঝেন এখানে জীবন সীমাবদ্ধ। যে ছেলেটি একদা ওলিম্পিকে দৌড়বার স্বপ্ন দেখেছিল, সম্ভাবনাও ছিল যার, সে এখন একটি মুদী+স্টেশনার্স+আটা ভাঙাবার দোকান চালায়। প্রৌঢ় বয়সে সে ‘বয়স্কদের দ্রুত হণ্টন’ প্রতিযোগিতায় মেডেল নিয়ে এসেছে।
যে ছেলেটি পনেরো বছর আগেও ছিল প্রতিভাবান নাট্যকার ও পরিচালক, সে পৌরসভায় কেরানি হয়ে বসে আছে।
আর যার তুলিতে পোস্টার হতো আগুনের মতো সংক্রামক ও লকলকে, সে এখন এক প্রাইভেট বাস কোম্পানীর হিসাবরক্ষক।
এদের, আর এদের মতো অনেকের জীবন এই শহরেই সীমাবদ্ধ।
পুতলি তেমন জীবনই বেছে নিল কেন?
নীহারকে অশ্রুকণা নিভৃতে বললেন, আমার পিসির মতো। সেকালের ম্যাট্রিক পাশ পিসি বিয়ে করলেন একজনকে যাদের ক্ষেত খামার আছে, কালচার নেই। সারাজীবন মহানন্দে ধান সেদ্ধ করলেন, গোলা থেকে ধান বের করলেন, মুনিষদের ভাত রাঁধলেন।
নীহার পরিবেশটা হালকা করতে চাইলেন। বললেন, তোমার রমুপিসি তো? এখন তো ওঁরাই সুখী পরিবার। ওঁর ছেলে মাঝে মাঝে আসে শহরে। লবণ, কেরোসিন আর চিনি ছাড়া কিছু কেনে না। বাড়িতে ট্রাক্টর, তিনটে মোটরসাইকেল, বিরাট ব্যাপার ওদের।
—আমার ভালো লাগছে না। যাক গে, দুজনে রিটায়ার করলে বাড়ি বেচে কলকাতার কাছাকাছি একটা ছোট ফ্ল্যাট কিনব।
—শুধু বেড়াবে এখানে ওখানে।
—হ্যাঁ, তাই ভালো। এখান থেকে থেকে পুতলি বুলির মায়ের মতো একটা বোঁচকা হয়ে যাবে, সে আমি দেখতে পারব কেন?
—ওর কোনো উচ্চাশা নেই।
—কেন, কেন?
—নেই, কি করবে বলো? ‘পূর্বাশা’ ওর কাছে শ্রেষ্ঠ বাড়ি, টাউন এক শ্রেষ্ঠ টাউন,সমু ওর কাছে আদর্শ পুরুষ, সুজাতা ওর কাছে আইডিয়াল।
—ইংরিজিতে এত ভালো, এম. এ. পড়তে পারত ডক্টরেট করতে পারত!
—ভেবো না! তোমার তো প্রেসার বাড়ে।
—পুতলিই বাড়িয়ে দিল।
—ভেবো না, ঘুমোও। বর্ষাটা এবার বড্ড বেশি নেমেছে।
—লোডশেডিঙেই বুঝছি।
—কুমার ইনভার্টার কিনে দিয়ে বাঁচিয়েছে। ফোনটা পেয়েও নিজেদের অতটা নির্বাসিত মনে হয় না। ওদের সঙ্গে কথা বলা যায়।
—তা যায়।
.
কিন্তু ১৯৮৭—র জুন—জুলাইয়ে ওঁরা যে যা ভাবেন, সব তো আগস্টে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। অদূর ভবিষ্যৎটা কেউ দেখতে পাননি।
কত তাড়াতাড়ি, কিভাবে অতর্কিতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল সব।
পুতলিকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল ঝড়ে। এজন্য সুজাতাকে দোষ দেন নীহার।
দোষ দেয় পিপলি আর কুমার।
কিন্তু সুজাতা এমন কিছুই করেননি। ধারা বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে এসেছিলেন ‘পূর্বাশা’ বাড়িতে।
—তোমার কাছেই এলাম অশ্রু।
—এসো, ভেতরে এসো।
—না, না, ছাতাটা উলটে গেল, ভিজে গেছি, জল ঝরছে। তোমার ঘরদোর ভিজে যাবে।
—কিছু বলবে? একটু চা করে আনব?
—না না। বলছিলাম কি, মায়ের বড্ড বাড়াবাড়ি যাচ্ছে। এখানে তো হাসপাতাল বা নার্সিংহোম থেকে নার্স পাই না। আয়া রেখেছিলাম, সেও এই জলঝড়ে আসছে না। রাতে সমু, আবীর (গুলতির ভালো নাম), তাপস, অমিত, অভ্র, এরা পালা করে জাগছে। আমার কাছে পূজা, মীনাক্ষী, আমাদের ক্লাবের মেয়েরাই চার রাত থাকল। আজ অভ্র আর তাপস থাকবে। পুতলি কি দু’এক রাত আমার কাছে থাকতে পারে?
—পুতলি তো তোমার বাড়ি আগেও থেকেছে।
—সে তো একদিন। রিহার্সালে দেরি হয়েছিল বলে। আজ একটু বিশেষ দরকার…
অশ্রুকণা বললেন, তোমার ভাইবোনরা জানে?
—সবাই জানে। নিশীথ এসে পড়ল বলে রক্ষে। ও ডাক্তারী না পড়েও আধা ডাক্তার। হেলথ ফর অল—এ কাজ করে। ক’দিন থাকবে।
—না…বিপদে আপদে…
নীহারের নিমোনিয়ায়, অশ্রুকণার অ্যাপেনডিকস অপারেশনের সময় সুজাতা তাঁর ক্লাবের মেয়েদের পাঠাতেন, নিজে আসতেন, সমুরা রাতে জাগত হাসপাতালে, কিন্তু না, সুজাতা কোনো প্রতিদান দাবি করছেন না, ওঁর চোখে মিনতি।
—বেশ তো…যাবে…বড্ড বৃষ্টি যে।
—তাতেই তো একা থাকতে…এমন আমার কখনো হয়নি।
—নিরাপদও তো তোমার বাড়ি।
—অতগুলো রিকশাওলাকে থাকতে দিই। পাশে পুলিশ ফাঁড়ি। ঝড়ে জলে বিপন্ন হয়ে কাঠগোলায় বস্তির ক’ঘরও এসে উঠেছে। নিরাপত্তার কোনো অভাব নেই।
—তুমিই ভয় পাচ্ছ…
—ও থাকলে বেশ ভরসা পাই।
—বেশ তো, জলটা ধরলে যাবে।
—জল কি ধরবে?
—আমি নিয়ে যাব বিকেলে, ডাক্তার সোমকে যখন নিয়ে যাব ওঁর গাড়িতেই।
—ডাক্তার সোম যাচ্ছেন?
—হ্যাঁ…রোজই যান। আমি স্কুলে বলতে এলাম যে আসতে পারব না এখন।
—জামাকাপড় বদলাবে?
—আবার তো ভিজব। চলে যাই, রিকশায় এসেছি। খুব নিশ্চিন্ত করলে ভাই।
—এতগুলো লোক থাকছে, খাওয়াদাওয়া…
—সে তো যাঁকে মামা বলি…বাড়ির কেয়ারটেকার, কিন্তু অনেকদিন আছেন, ওঁরাই তো সব দেখেন। ওঁর পুত্রবধূ যে কলকাতায়। সে থাকলে এত একলা লাগত না।
—বসবে না, জামাকাপড়ও ছাড়বে না?
—না অশ্রু, আসি।
না, পুতলি এক রাত সুজাতার বাড়ি থাকবে বলে কিছু ভাবেননি অশ্রু।
—তুমি তো ফোন করলেই পারতে।
—ফোনে এ কথা বলা ঠিক হতো না। তা ছাড়া, লাইন তো সবসময়ে থাকছেও না।
সুজাতা যেন নিজেকেই বললেন, বাড়িটাও টাউনের প্রায় বাইরে, মা একা কি করে থাকতেন :
—পুতলি তোমার কম্প্যানিই হবে, রোগীকে দেখা তো…
—সেটুকু যে কতখানি!
সুজাতা বেরিয়ে গেলেন। পুতলি অবেলায় ঘুমোচ্ছিল, তাকে যখন বললেন অশ্রু, পুতলি বলল, বুঝেছি। সুজাতাদির নিজের শরীরটা আবার খারাপ হয়েছে।
—কি অসুখ ওর?
—ওই যে কি বলে, মিগ্রেইন না কি যেন। মাথার যন্ত্রণা যখন হয়, অজ্ঞান হয়ে যায়। মা! বাবাকে তো বললাম না।
—কত বলো!
—বাঃ, সব সময়ে বলে যাই। থিয়েটার গেলাম কেষ্টনগর, বলে যাইনি? সেবার ফরাক্কা গেলাম সম্মেলনে…
—আমি বলে দেব।
ঠিক সময়ে গাড়ি এসেছিল, ঠিক সময়ে চলে গিয়েছিল পুতলি। মোটা বিনুনি বাঁধা, বর্ষার জন্যে নাইলন পরা, মোটামুটি সুশ্রী কিন্তু বুদ্ধিতে উজ্জ্বল, ঝলমলে স্বাস্থ্য একটি মেয়ে।
বাড়ি ফিরে নীহার বলেছিলেন, এই বৃষ্টিতে?
—সুজাতা ওকে ডাক্তার সোমের গাড়িতে নিয়ে গেল। …আচ্ছা, মা মরে গেলে সুজাতা ওখানে থাকবে কি করে?
—সে সুজাতাই বুঝবে। কিন্তু এত বৃষ্টিতে…
—সুজাতা এমনিতে আসে না যায় না, কিন্তু তোমার অসুখে, আমার অপারেশনে যথেষ্ট করেছে।
—হ্যাঁ, একটা পাবলিক স্পিরিট আছে।
—ওদের ক্লাবের ছেলেমেয়েগুলোও ভাল।
—ভালই তো। আজ তাহলে আমি আর তুমি!
—আর কি!
—এত বর্ষায় বন্যা না হয়।
—যাক, একটু চা খাওয়া যাক। আজ কাগজটাও দেখিনি ভাল করে।
—পিপলি আর তোমার সেই বউদির চিঠি এসেছে।
—আবার টাকা চেয়েছে?
—না, মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে অনন্ত বসুর ছেলের সঙ্গে। অরূপ বসু নাকি নাম… ছেলে কেমন, জানতে চেয়েছে।
—আমাদেরই ছাত্র। চায়ের ব্যবসা করছে। ওর দোকান থেকেই চা কিনি।
—দোকানদার!
—খারাপ কি! স্বাবলম্বী ছেলে।
—লিখেছে পণটনের ব্যাপার আছে।
—ও সব লিখে লাভ নেই। দাদা নেই, নিজে চাকরি করছে, যে করে পারুক বিয়ে দিক।
—হ্যাঁ… যে সব সম্পর্ক উঠে গেছে, সেগুলো এ বয়সে আর না জড়ালেই ভাল।
—কে জড়াচ্ছে? আমি তো নয়।
নীহার চায়ে চুমুক দিয়ে স্টেটসম্যানে ডুবে গিয়েছিলেন। অশ্রু খুলেছিলেন এ সপ্তাহের ‘দেশ’—এর পাতা।
বৃষ্টি পড়ছিল, পড়ে চলছিল।