প্রতিশ্রুতি

প্রতিশ্রুতি

‘Even after all this time
The sun never says to the earth,
“You owe Me”
Look what happens with
A love like that,
It lights the Whole sky’

জোনাথনদাদু কফির কাপটা নামিয়ে বলল, ‘জানিস মালি, কতরকম যে সম্পর্ক হয় পৃথিবীতে! মানুষকে যে কত রকমের সম্পর্ক পেরিয়ে আসতে হয় জীবনে! আমি দেখেছি, মানুষ ভালবেসে বিয়ে করে তারপর দু’জন দু’জনকে কষ্ট দেয়। আবার এ-ও দেখেছি, দু’জন দু’জনকে সারাজীবন ভালবাসলেও কাছে আসতে পারে না। স্পর্শ করতে পারে না। শুধু দূর থেকে ভালবেসে যায়। অনেকটা পৃথিবী আর সূর্যের মতো। দু’জন দু’জনকে ছাড়া থাকতে পারে না, কিন্তু দেখ, আছেও আসতে পারে না। পৃথিবী ছাড়া এই সৌরমণ্ডলের কি সেই ম্যাজিক থাকবে? থাকবে না। আর উলটোদিকে সূর্য না থাকলে তো পৃথিবীরও অস্তিত্ব থাকত না। একে অন্যকে কী অদ্ভুতভাবে জড়িয়ে রাখে। কিন্তু দেখ, কাছে আসতে পারে না তারা, এক হতে পারে না। তাই না?’

মালিনী উত্তর দিল না কোনও। আসলে উত্তর দেওয়ার কিছু নেই। জোনাথনদাদু উত্তর পাওয়ার জন্য সব কথা বলে না। এমনিই বলে। ছোটবেলা থেকেই দাদুকে দেখে এসেছে মালিনী। প্রায় কুড়ি বছর হয়ে গেল। চুলের রং সাদা হওয়া ছাড়া আর কিছু পালটায়নি লোকটির। সেই একইরকম ভঙ্গিতে কাঠের বারান্দায় বসে থাকা। সেই একইভাবে বারান্দায় হেলিয়ে রাখা ম্যান্ডোলিন। সেই একই সন্ধের মুখে হাতে ধরা কফির কাপ।

মালিনী এখন আর এখানে থাকে না। ছুটিতে ঘুরতে আসে মাঝে মাঝে। ওদের চা-বাগানের এক দিকটায় কাঠের বাড়িতে থাকে জোনাথনদাদু। সঙ্গী বলতে একটি ল্যাব্রাডর আর হুড খোলা জিপ।

জোনাথনদাদু সম্পর্কে কিচ্ছু জানে না ওরা। জোনাথনদাদু নিজে কক্ষনও কিছু বলে না, জিজ্ঞেস করলে শুধু হাসে। বলে, ‘আমি ভুলে গিয়েছি সব কিছু। আমার আর কিচ্ছু মনে নেই। বোধহয় অ্যামনেশিয়া হয়েছে।’ বলে, ‘আর তোরাই বা জানতে চাস কেন? আমি মানুষটাই কি যথেষ্ট নয়?’

অফিস থেকে ছুটি পেলে শিলিগুড়ির বাড়িতে এক-দু’দিন থেকেই রাবাংলার এই চা-বাগানে চলে আসে মালিনী। কলকাতায় থাকতে থাকতে ওর আর শহর ভাল লাগে না। এত মানুষ, গাড়ি, লম্বা স্কেলের মতো বাড়িঘর, ছাই রঙের আকাশ, চিৎকার, হুল্লোড়-একদম ভাল লাগে না ওর। দমবন্ধ হয়ে আসে মালিনীর। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায় আচমকা। মনে হয় কে যেন চেপে ধরছে ওর গলা। শ্বাস নিতে পারছে না। মালিনী ঘরের জানলা খুলে দেয়। এসি বন্ধ করে ফ্যান চালিয়ে দেয়। তবু শ্বাস নিতে পারে না যেন। ও পালাতে চায় তখন। সব কিছু ছেড়ে পালাতে চায়। কিন্তু তবু পারে না। রাতের কলকাতা তাড়া করে ওকে। ছাইমাখা চাঁদ তাড়া করে। ওকে তাড়া করে সেই মুখটা!

তবে মালিনী এবার আর কলকাতায় ফিরবে না। যাবে চণ্ডীগড়। কলকাতা ওকে কষ্ট দিয়েছে খুব।

মালিনী পাহাড়ের দিকে তাকাল। আগস্টের তেরো তারিখ আজ। বর্ষা চলছে। সারাদিন বৃষ্টির পর এখন একটু শান্ত হয়েছে আকাশ। দূরে মেঘও ভেঙেছে কোথাও কোথাও। আর সেইসব ভাঙা জায়গা দিয়ে সূর্য তার আলোর চাদর মেলে দিয়েছে। চায়ের পাতলা লিকারের মতো আলোয় ডুবে আছে চারদিক। বারান্দার পাশের অর্কিডের পাতা চুঁইয়ে টপটপ শব্দে জল পড়ছে। ঝিঁঝিরাও ক্রমশ জেগে উঠছে একে একে।

এখানে এলে মালিনীর মনে হয় যেন তাড়া নেই কোনও। যেন যেতে হবে না কোথাও। মনে হয়, এখানে সারা জীবন বসে থাকা যায়। মনে হয়, জীবনে কিছু না হলে কী-ই বা এসে যায়!

মালিনী জানে, এ সবই ক্ষণিকের চিন্তা, অবাস্তব চিন্তা। শহর তার মুখ খুলে রেখেছে। শহর তার পেটের ভেতরের মণি-মাণিক্য আছে দেখিয়ে ডাকছে সকলকে। সেই বিশ্বজোড়া ‘হাঁ’-এর ভেতর মাথা গলাতেই হবে মানুষকে।

অবশ্য, শুধু এটুকুই নয়। পাহাড়ও পালটাচ্ছে দ্রুত। এই যে নিস্তব্ধতা মালিনী দেখছে চারদিকে, তাও তো সারা জীবন থাকবে না। এই যেমন এখনই তো তার হাওয়া লেগেছে। গত দশ মাস আগে শেষবার যখন মালিনী এসেছিল, তখন দেখেছিল এখানে ফ্যাক্টরি তৈরি হচ্ছে।

সেই ফ্যাক্টরির প্রস্তুতি এবারে এসে সম্পূর্ণ হয়েছে দেখেছে মালিনী। ওই উঁচু জলের রিজার্ভার, রাক্ষসের মাথার মতো টিনের শেড, বৃদ্ধ নাবিকের চুরুটের মতো চিমনি-পাহাড়ের স্কাইলাইন বদলে ফেলেছে অনেকটা। চারদিকে কোলাহল বেড়েছে। ফ্যাক্টরির ভোঁ বাজছে। চিমনি দিয়ে বুড়ির চুলের মতো ধোঁয়াও বেরোচ্ছে।

‘কী রে মালি, কী চিন্তা করছিস? তোর মনখারাপ?’

‘কই না তো!’ মালিনী হাসল।

‘সত্যি বলছিস?’ জোনাথনদাদু ঝুঁকে বসল চেয়ারে, ‘তোকে ছোট থেকে দেখছি। আগে তো বকবক করে মাথা খারাপ করে দিতিস। আর এখন কেমন যেন অন্যমনস্ক থাকিস! কেন? বাবা-মায়ের সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে?’

‘ধ্যাৎ, আমি বুঝি খুব ঝগড়ুটে?’

‘না রে, তোর চোখ দুটো কেমন হয়ে গেছে। তাই বলছিলাম।’ জোনাথনদাদু ফাঁকা কাপটি বারান্দায় কাঠের রেলিং-এর ওপর রাখল, ‘নাকি, অন্য কেউ দুঃখ দিয়েছে তোকে? কী রে, কেউ দিয়েছে দুঃখ?’

‘সত্যি, তুমি না…’ মালিনী বেতের চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। আচমকা বহু দূরের একটা মুখ ঝলসে উঠল চোখের সামনে। একটা পাথর বাঁধানো বৃষ্টির রাস্তা ঝলসে উঠল, ঝলসে উঠল ডান গালের লাল তিল। নিজের অজান্তেই মোবাইলের দিকে চোখ গেল ওর। অপদার্থ, ঠান্ডা একটা যন্ত্র। নিস্তব্ধ একটা যন্ত্র। মালিনী জানে আর কোনওদিন ফোন আসবে না।

মালিনী বলল, ‘বুড়ো হলে সত্যিই ভীমরতি ধরে মানুষের। আর নিজের কথা কিছু বলবে না, শুধু অন্যের সব কথা শুনে নেওয়ার চেষ্টা, না? বাদ দাও, আর এক কাপ কফি হবে নাকি?’

‘আর এক কাপ?’ জোনাথনদাদু মাথার স্ট্র হ্যাটটা খুলে চুলে আঙুল ডোবাল, ‘হয়ে যাক, যখন বলছিস। তবে চিনিটা কম দিস। তোর হাত এমনিতেই এত মিষ্টি যে, চিনির প্রায় দরকারই পড়ে না।’

‘হুম, এই বয়সেও খুব কথা বলো তুমি! মেয়েদের মন ভেজাতে ওস্তাদ। যখন ইয়ং ছিলে, কত মেয়ের যে মাথা চিবিয়েছ!’ মালিনী হাসল।

‘আমি এখনও ইয়ং,’ জোনাথনদাদু চোখ পাকাল, ‘আয়্যাম সেভেনটি ফাইভ ইয়ার্স ইয়ং। আর মাথা খাওয়া? তুই জানিস না আমি নিরামিষাশী!’

‘খালি কথা! দাঁড়াও আমি কফি করে আনছি।’ বারান্দার রেলিং থেকে কাপটা তুলে ঘরের ভেতরে চলে গেল মালিনী।

এ বাড়িটা একতলা। কাঠ আর পাথর দিয়ে তৈরি। বারান্দা থেকে ঢুকলেই বসার ঘর। তার দেওয়ালে নানা দেশের মুখোশ ঝোলানো। সেই ঘর পেরিয়ে স্টাডি আর তার পাশেই কিচেন। সুন্দর ছিমছামভাবে সাজানো।

মালিনী দু’কাপ কফি তৈরি করে কিচেন থেকে বেরোতেই বারান্দায় কথা শুনতে পেল। আরে, এরই মধ্যে কারা এল? কুলিবস্তির কিছু মানুষজন জোনাথনদাদুর কাছে আসে হোমিওপ্যাথির চিকিৎসা করাতে। তারা এল কি? নাকি বাচ্চারা এল গল্প শুনতে? কিন্তু বাচ্চাদের গলা তো এমন নয়!

ডাইনিং টেবিলের ওপর কফির কাপ দুটো রেখে বারান্দায় বেরিয়ে এল মালিনী।

সন্ধে গাঢ় হয়ে এসেছে আরও। জোনাথনদাদু বারান্দায় ঝোলানো সব আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে। সেই আলোতেই মালিনী দেখল পাঁচজনের দলটাকে। তিনটে মেয়ে আর দুটো ছেলে। সবারই কাঁধে হ্যাভারস্যাক। কোমরে পাউচ। পরনে জিন্‌স আর উইন্ডচিটার। বয়স কুড়ি-একুশ।

সবার মুখে-চোখেই ক্লান্তির ছাপ। দীর্ঘ পথযাত্রার ছাপ। ওদের কাঁধের ব্যাগ কাঁধেই আছে। শ্বাস পড়ছে দ্রুত। অর্থাৎ সামান্য সময় আগেই ওরা এসেছে।

মালিনীকে দেখে রোগামতো যে-ছেলেটি জোনাথনদাদুর সামনে দাঁড়িয়েছিল, সে কিছু বলতে গিয়েও যেন থমকে গেল। ছেলেটির চোখে মুগ্ধতা দেখতে পেল মালিনী। এটি নতুন কিছু নয়। গড়পড়তা সব ছেলেরাই মালিনীকে দেখলে মুগ্ধ হয়।

মালিনী সেই দৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়ে বলল, ‘কী হয়েছে? তোমরা কারা?’

ছেলেটি হাসল। পাতলা দাড়ির ফাঁক দিয়ে দুটো লম্বা লম্বা টোল জেগে উঠল গালে। পিছনে থেকে একটি মেয়ে এগিয়ে এল এবার। মেয়েটিকে দেখে সামান্য অস্বস্তি হল মালিনীর। মেয়েটি ভীষণ সুন্দরী। আর কেন কে জানে, মালিনীর চেনা মনে হল মেয়েটিকে। মনে হল, কোথায় যেন দেখেছে। কিন্তু মনে করতে পারছে না কে মেয়েটি! এরাই বা কারা! কেন এই পাহাড়ে এসেছে এরা এমন সময়ে?

মেয়েটি হাঁপধরা গলায় কাতরভাবে বলল, ‘প্লিজ, আপনাদের একটা হেল্‌পের খুব দরকার।’

‘হেল্‌প?’ মালিনী অবাক হল।

মেয়েটি কোমরের পাউচ থেকে একটা ছবি বের করে মেলে ধরল ওদের সামনে। তারপর বলল, ‘একে আপনারা চেনেন?’

মালিনী ভাল করে দেখার আগেই জোনাথনদাদু ছবিটা ছোঁ মেরে নিয়ে নিল। তারপর এক পলক দেখেই বলল, ‘এই ছবি তোমরা কোথায় পেলে?’

‘আপনি চেনেন?’ মেয়েটির গলার স্বরে এমন কিছু ছিল যে, অবাক হল মালিনী। এই আলোতেও ও বুঝল মেয়েটির মুখ লাল হয়ে উঠেছে। কিন্তু সেটা উত্তেজনায় না চোখের জলে, সেটা ঠিক বুঝল না।

মেয়েটি কাঁধের ব্যাগটা রেখে হাঁটু গেড়ে চেয়ারের হাতল ধরে বসল জোনাথনদাদুর সামনে, ‘প্লিজ, বলুন না কোথায় থাকে এ? আপনি জানলে প্লিজ বলুন, আমার খুব দরকার।’

জোনাথনদাদু মেয়েটির ব্যাকুল মুখের দিকে তাকিয়ে হাসল, তারপর খুব আস্তে জিজ্ঞেস করল, ‘বলছি, তার আগে বলো তো, তুমি সূর্য, না পৃথিবী?’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *