পৌরাণিক নট-নটী
১
‘‘Drama is based on the Mistake. I think someone is my friend when he really is my enemy, that I am free to marry a woman when in fact she is my mother, that this person is a chambermaid when it is a young nobleman in disguise, that this well-dressed young man is rich when he is really a penniless adventurer, or that if I do this such and such a result will follow when in fact it results in something very different. All good drama has two movements, first the making of the mistake, then the discovery that it was a mistake.”
–W.H. Auden
The Complete Works of W. H. Auden :
Prose, Volume III : 1949-1955
আজকে আসুক তোর বাবা! অফিস থেকে ফিরুক একবার! এই ভয় দেখানোর পর দিনমণি অস্তাচলে গেলেন এবং সেই দুরূহ বাবা ফিরে এলেন ঘরে। মা কথা বলা আরম্ভ করলেন—দ্যাখো, তোমার এই গুণধর ছেলের জন্য আর আমি খাটতে পারবো না। ওকে তুমি হস্টেলে দেওয়ার ব্যবস্থা করো ইত্যাদি ইত্যাদি…। মায়ের মুখে কথা চলতে থাকল। তর্জনী চালানোর সঙ্গে মুখে ফুটে উঠল বিরক্তির ভ্রূকুটি, গাল হয়ে উঠল লাল এবং ইত্যাদি ইত্যাদি। বাবাটি একটু শাসন করলেন ছেলেকে, পরিশেষে স্নেহময়ী জননীকে বললেন—ওকে হস্টেলে দিলে তুমি একা থাকতে পারবে এই বাড়িটার মধ্যে? মা তখন কান্নায় ভেঙে পড়লেন, ছেলে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরল। তারপরেই সেই মায়ের রান্না করা সুস্বাদু রাতের খাবার। এইভাবে শুক-সারীর দ্বন্দ্ব মিটে গেল। এবার সবাই মিলে বাহু তুলে হরি-হরি বলো। বলো হরিবোল হরিবোল।
এই তো নাটক—আমরা ছোট্ট একটু স্ক্রিপ্টের মধ্যে বাৎসল্য-জনিত দাম্পত্যের ন্যূনতম কলহ উচ্চারণ করেছি বলেই পার্শ্ববর্তী গৃহগুলির জানালা খুলে যায়নি, কিন্তু এটা যদি সত্যি একটা জব্বর ঝগড়া হত স্বামী-স্ত্রীর, যদি সেখানে একতরের লুকোনো জীবনকথা অথবা অন্যতরার গোপন প্রেম উচ্চারিত হত উচ্চতর গলায়, তাহলে পাশের বাড়িগুলির সমস্ত জানালা খুলে যেত এবং তাতে দর্শক-শ্রোতার কোনো অভাব হত না। দৃশ্য এবং শ্রব্যকাব্যের সমস্ত গুণ তাঁরা আস্বাদন করতেন নাটক দেখার অভিনিবেশ নিয়ে।
আমরা বলতে চাই নাটক তো এইভাবেই আরম্ভ হয়েছিল ভারতবর্ষে। ভারতীয় নাটকের যখন উপাদান খোঁজা হয়, তখন ঋগবেদ থেকে পুরূরবা-উর্বশীর সংলাপ এবং যম-যমীর সংলাপগুলিকেই নাটকীয় বিষয়বস্তুর প্রধান এবং প্রথম উপাদান হিসেবে গ্রহণ করেন গবেষকেরা। ঋগবেদের এই সংলাপগুলিই যে নাটকের প্রথম উচ্চারণ সেটা তো খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতেই নাট্যশাস্ত্রকার ভরতের কথা থেকে একেবারে পরিষ্কার। নাটকের বৈদিক মূল দেখাতে গিয়ে তিনিই তো লিখেছিলেন—জগ্রাহ পাঠ্যং ঋগবেদাৎ—অর্থাৎ নাটকের পাঠ কীরকম হবে, তার দৃষ্টান্ত গ্রহণ করা হয়েছে ঋগবেদ থেকে। অথচ দেখুন, ঋগবেদের অধিকাংশ মন্ত্রই কিন্তু যজ্ঞের কাজে ব্যবহৃত হয় এবং প্রক্রিয়া-অংশের মধ্যে একটা বিরাট ভূমিকা আছে অভিনয়ের। আপনি মন্ত্র পড়ে দেবতাকে ডাকছেন যজ্ঞবেদিতে যজমানের দেওয়া আহুতি গ্রহণের জন্য—দেবতা আসছেন কি আসছেন না, সেটা বড় কথা নয়, কিন্তু অন্তর দিয়ে আপনি ডাকছেন এবং আপনি ভাবছেন তিনি আসছেন, তার মধ্যে অভিনয় নেই? যজ্ঞ করছেন ইন্দ্রের জন্য; আহুতি দিচ্ছেন আগুনে। এখানে অগ্নিকে দেবতাদের মুখ হিসেবে কল্পনা করে ‘ড্রামাটিক সিমবল’ মেনে নিচ্ছেন কিনা? তা ছাড়া যজ্ঞকর্ম যাঁরা করতেন, যাঁদের নাম ছিল অধ্বর্যু, তাঁদের অনেক প্রক্রিয়াই ছিল অভিনয় বা নাটকই। পণ্ডিতেরা ‘মহাব্রত’ অথবা অশ্বমেধ যজ্ঞের কথা বলে থাকেন, বিশেষত মহাব্রতের কাজের মধ্যে সাজানো ঝগড়া, গালাগালি ইত্যাদি বেশি থাকায় এই যজ্ঞক্রিয়াকে নাটকের আদিম ভাবনা হিসেবে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন পণ্ডিতেরা।
‘‘Symbols are nothing but the natural speech of drama.’’– Tennessee Williams
এখানে একটাই কথা বলার আছে আমাদের। সেটা হল, মহাব্রত, কিংবা অশ্বমেধ নয়, বৈদিক যাগযজ্ঞের প্রক্রিয়ার মধ্যে অনেকটাই জুড়ে আছে অভিনয়। পুরাতন যে-সমস্ত অলৌকিক বিশ্বাস, সেগুলিকে লৌকিকভাবে সম্পন্ন করতে গেলেই একটা অভিনয় লাগে। এই যেমন ধরুন, বৈদিককালেই এই প্রাচীন বিশ্বাস চালু ছিল যে। সোম বা সোমলতা আসলে গন্ধর্বদের সম্পত্তি। দেবতারা কৌশল করে গন্ধর্বদের ভুলিয়ে সোমলতা নিজেদের অধিকারে এনেছিলেন। তাঁরা কুমারী বাগদেবীকে গন্ধর্বদের কাছে পাঠান। স্ত্রীপ্রিয় গন্ধর্বরা বাগদেবীর রূপমোহে সব ভুলে গেল। বাগদেবী সোম সংগ্রহ করে নিজেও পালিয়ে এলেন। এই তো গেল বিশ্বাস, ‘মিথিক’ বিশ্বাস। কিন্তু বাস্তবে যখন সোমযাগ হয়, তার প্রস্তুতিতে ‘সোমক্রয়’ হয়, অর্থাৎ সোম কেনার একটা প্রক্রিয়াধর্মী অংশ থাকে এবং তার সবটাই অভিনয়। সোমবিক্রমী পাহাড়-পর্বত খুঁজে সোমলতা সংগ্রহ করে এনে যজ্ঞশালার বাইরে বসে থাকত। যজ্ঞের ঋত্বিকদের সঙ্গে যজ্ঞকর্তা যজমান এবার একটা বাছুর নিয়ে সোম কিনতে যাবেন যজ্ঞশালার বাইরে। বাইরে যে সোমবিক্রয়ী বসে আছে তাকে কিন্তু গন্ধর্ব বলে ভাবতে হবে আর যজমান যে-বাছুরটা সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন, তার মধ্যে কুমারী বাগদেবীর আরোপ করতে হবে। খানিকক্ষণ দরদস্তুর করে সোম কেনার পর মূল্য হিসেবে বাছুরটিকে দেওয়া হয় সোমবিক্রয়ীর হাতে। সোম যেই হাতে এসে গেল, তখনই ঋত্বিক-যজমানের পিছন থেকে লাঠিসোঁটা বেরিয়ে পড়ে। তাঁরা লাঠি দিয়ে সোমবিক্রয়ীকে ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেন এবং বাছুরটাকে দিয়ে সোমলতা নেওয়া হল ভুলিয়ে। তারপর বাগদেবীও পালিয়ে এলেন, সোমলতাও এসে গেল ঘরে।
এই ঘটনাটা সম্পূর্ণ অভিনয়ের মাধ্যমেই একেবারে সাজানো একটা রূপক এবং বৈদিক কালেই আরও এইরকম অন্তত কুড়িটা উদাহরণ দিতে পারি, যাতে বোঝা যায়—সেই কালেই অভিনয় ব্যাপারটা বেশ রপ্ত ছিল। হয়তো এই কারণেই ভরতমুনিকে লিখতে হয়েছে—যজুর্বেদাদ অভিনয়ম। অর্থাৎ নাটক সৃষ্টির আগে ভগবান ব্রহ্মা অভিনয়ের অংশটা গ্রহণ করেছিলেন যজুর্বেদ থেকে, কেননা যজুর্বেদের পুরোহিত অধ্বর্যুই কিন্তু বেশিরভাগ সময়ে এই প্রতীকী অভিনয়গুলি করান এবং নিজেও করেন। এইভাবে নাটকের মধ্যে যে নাচগানের অংশ আছে, সেটাও এসেছে সামবেদ থেকে। হয়তো এই কারণেই এক প্রাচীন কবি নাটক ব্যাপারটাকেই দেবতাদের তৈরি করা একটি যজ্ঞ হিসেবেই কল্পনা করেছেন। দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দীতে কাশ্মীরবাসী কলহনের সংগ্রহ করা একটি শ্লোকে বলা হয়েছে—নাটক হল দেবতাদের দ্বারা সম্পন্ন প্রত্যক্ষ এক শান্ত যজ্ঞ—দেবানামিদমামনন্তি শান্তং ক্রতুং চাক্ষুষম।
সাহেব-সুবোদের অনেক থিয়োরি আছে আমাদের নাটক নিয়ে। সবারই বক্তব্য, সঠিক নাটক ব্যাপারটা আমরা জানতাম না, আমাদের নাটক এসেছে ছায়া-নাটকের সূত্র ধরে অথবা পুতুল-নাটকের সূত্র ধরে। অথবা আমরা কিছুই জানতাম না, গ্রিক নাটকের প্রভাবে আমাদের নাটক তৈরি হয়েছে। আমি এ-সব বিষয়ে বেশি কথা বলতে চাই না, তবে কিনা সব কিছুর ওপরে আমাদের মুখের ওপর জবাব হল আমাদের নাট্যশাস্ত্র, যার কাল প্রায় অবিসংবাদিতভাবে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী। আমরা যেহেতু এখন ‘কলোনিয়াল সেট-আপ’ থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছি, অতএব ‘কলোনিয়াল’দের তর্কযুক্তির ওপর সবচেয়ে বড়ো কথা যেটা বলার, সেটা হল—যেমন আগে ভাষা তারপর ব্যাকরণ, যেমন আগে সুর তারপর সুর সপ্তক, তেমনই পুরোদস্তুর নাটক না তৈরি হয়ে থাকলে নাট্যশাস্ত্র তৈরি হত না। আবার নাট্যশাস্ত্রের কথা থাক, নাট্য বা নাটকই তৈরি হত না নট কিংবা নটী না থাকলে।
২
‘‘A pig will usually make a ham of himself if he takes up acting.’’– Anthony T. Hincks
প্রথম কথাটা ‘নট’-শব্দটা নিয়েই, কেননা এই শব্দ থেকেই নাট্য বা নাটক শব্দ এসেছে। অনেকে মনে করেন—সংস্কৃত ‘নৃৎ’ ধাতু থেকে (যার অর্থ নাচা) নট, নাট্য, নাটক—এইসব শব্দগুলি এসেছে। সেটা একেবারেই ঠিক নয়। পাণিনীয় ধাতুপাঠে ‘নট’ বলে একটা ধাতু রয়েছে এবং তার অর্থ বলা হয়েছে ‘নট অবস্কন্দনে’ অর্থাৎ অবস্কন্দন ব্যাপারটাই ‘নট’ ধাতুর অর্থ। জিজ্ঞাসা হবে, তাহলে অবস্কন্দন ব্যাপারটা কী? এমনিতে অবস্কন্দন মানে হল আক্রমণ করা, লণ্ডভণ্ড করা, অপমান করা,—যেমন প্রয়োগ আছে—পুরীমবস্কন্দ লুনিহি নন্দনম—স্বর্গের রাজধানী আক্রমণ কর, সব লুটে নে এখান থেকে। অবস্কন্দন মানে যদি এই হয় এবং নট ধাতুর অর্থ যদি অবস্কন্দন হয়, তাহলে কেমন মনে হয়—কিছুই মিলল না। আসলে অবস্কন্দন শব্দের ব্যঞ্জনাটুকু এখানে ধরতে হবে, ধরতে হবে উপসর্গ বাদ দিয়ে ‘স্কন্দ’ ধাতুর অর্থও। সব মিলিয়ে অর্থ দাঁড়াবে তোলপাড় করা, লোকবৃত্তকে দর্শকের মনের মধ্যে ছুঁইয়ে দেওয়া এবং এ-কাজটা যাঁরা করেন, তাঁরাই হলেন ‘নট’। ধাতুগতভাবে ‘নট’ প্রত্যয় সাধনের পর ‘নট’-শব্দের মধ্যে নট-নটী দুজনেই সমানাধিকারে আছেন। আমাদের দিক থেকে যেটা বলার, সেটা হল—একটা নাটকের মধ্যে সংলাপ, হাব-ভাব, পরিচালনা, প্রযোজনা—যত কিছুই থাক না কেন, প্রধানত একটা নাট্য-নাটকের কেন্দ্রবিন্দু হলেন নট-নটীরা, যাঁরা নিজস্ব অভিনয়শৈলীতে সমস্ত দর্শক-হৃদয় তোলপাড় করে তোলেন, তাঁদের হৃদয়ের মধ্যে চুঁইয়ে দেন লোকবৃত্তের সুখ-দুঃখ, ভয়-যন্ত্রণা, জীবন।
কথাটা একটু পরিষ্কার করে বলি। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে পাণিনির ব্যাকরণ লেখা হয়ে গেছে বলে অধিকাংশ পণ্ডিতের ধারণা। সেই পাণিনি তাঁর সূত্রগ্রন্থ লেখার পরে তাঁর সময় পর্যন্ত চালু ক্রিয়াপদগুলির একটা লিস্টি দিয়েছেন, যাকে বলে ধাতুপাঠ। এই ধাতুপাঠের মধ্যে ‘নট’ ধাতুর অর্থ করা হয়েছে ‘অবস্কন্দন’। অবস্কন্দন শব্দের মূল অর্থ যাই থাক, তার একটা semantic change হয়ে গেছে সেই খ্রিস্টপূর্ব শতাব্দীতেই। তাতে অবস্কন্দন শব্দের সম্পূর্ণ একটা ব্যঞ্জনা যখন তৈরি হয়ে গেল, তখন এর মধ্যে থেকে মূল অর্থগুলি গেল হারিয়ে। অবস্কন্দন মানে দাঁড়াল অপরকে বশীভূত করা, বিমোহিত করা overpowering, overwhelming, বাল্মীকি রামায়ণে লিখেছেন—স্নেহাবস্কন্দহৃদয়া—স্নেহের দ্বারা অবস্কন্দিত, আকুল এক হৃদয়। তার মানে পাণিনি যখন লিখলেন, ‘নট অবস্কন্দনে’ তখন সাধারণ শব্দবোধ এইরকম দাঁড়ায় যে, একজন নট—যাঁর ভাবটাই নাট্য-নাটক-নাটিকা—সেই নট অপরপক্ষকে এক্কেবারে আকুলিত, বিমোহিত করে দিতে পারে নিজের নটকার্যের মাধ্যমে এবং এতাবৎ পর্যন্ত, অন্তত ব্রেখট সাহেব না আসা পর্যন্ত নটের কাজ নাট্য-নাটকের কাজটা তো তাই-ই ছিল—স্বয়ং তাঁরই ভাষায় একজন নট বা ‘অ্যাকটর’ কীভাবে দর্শককে অভিভূত করত? By means of hypnosis. They go into trance and take the audience with them.
এ কথা অনস্বীকার্য যে, আমাদের দেশের দর্শন, মনন, আচার, ব্যবহার সবই তো ব্রাহ্মণায়িত, অথবা ব্রাহ্মণ্য ভাবধারায় গঠিত। যেখানে এই নট শব্দটাই একটা ভয়ংকর ব্যতিক্রম। কারণ এফ.বি.জে. কুপারের (Kuiper) মতো পণ্ডিত বলেছেন—’নট’ শব্দটা এসেছে দ্রাবিড় ভাষাগোষ্ঠী থেকে। আমাদের দ্বিতীয় মতটাই সবচেয়ে সম্ভাব্য মনে হয়। এই শব্দের সংস্কৃতায়ন ঘটেছে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীরও অনেক আগে, অন্তত পাণিনিরও আগে। তবে এই শব্দের সংস্কৃতায়ন নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই, কেননা আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস—ব্রাহ্মণায়িত কোনো ভাবনা থেকে নট-নটীরাও তাঁদের ‘অবস্কন্দন’ আরম্ভ করেননি এবং আর্যায়িত সমাজের কোনো মানুষও নটক্রিয়ার মধ্যে প্রবেশ করেননি। নাটকের ভাবনা তৈরি হয়েছে একেবারে সাধারণ মানুষের স্তর থেকে এবং তা তৈরি হয়েছে একেবারে বিভিন্ন সাধারণ উপাদানের মাধ্যমে।
পণ্ডিতেরা জৈন ‘কল্পসূত্রে’র মতো একটা প্রাচীন খ্রিস্টপূর্বাব্দীয় গ্রন্থ উল্লেখ করে বলেছেন যে, সেই কালে ভ্রাম্যমাণ কিছু শিল্পীগোষ্ঠী ছিল, যারা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে নিজেদের শিল্পকর্ম প্রদর্শন করত। আশ্চর্য ঘটনা হল, এইসব শিল্পীদের যে নামগুলি পাওয়া যায়, সেগুলি একটাও কোনো সংস্কৃত নাম নয়, এমনকি সেগুলি কোনো তথাকথিত ‘ভদ্রলোক’ সামাজিক গোষ্ঠীরও নাম নয়। জৈনকল্পসূত্রের এই নামগুলি ধরেছেন জার্মান পণ্ডিত Hillebradt এবং সেই নামগুলির প্রথমেই আছে ‘নট-নট্টগ’। শব্দটার সংস্কৃত রূপ হল-নর্তক। নট-নটীর অভিনয়ের সঙ্গে নাচের ব্যাপারটা অনুষঙ্গে আসে বলেই নট-নর্তক কথাটা সেকালে একসঙ্গে উচ্চারিত হত প্রায়ই। বাল্মীকি রামায়ণেই আছে—যে রাজ্যে রাজা বলে কিছু নেই, সে-রাজ্যে নট-নর্তকরা মোটেই খুশি থাকে না—নারাজকে জনপদে প্রহৃষ্টা নট-নর্তকাঃ। কিন্তু কল্পসূত্রের ভাষায়—’নট্টগ’—এই প্রাকৃত কল্প শব্দের সঙ্গে ‘নট’ শব্দের প্রয়োগ থেকে বুঝতে পারি নট-শব্দটাও সংস্কৃত নয়।
বিশেষত নট-নর্তকেরা এখানে একত্রে দাঁড়িয়ে আছেন। সেইসব ভ্রাম্যমান শিল্পীদের সঙ্গে যাঁদের নাম হল ‘ঝল্ল’, অর্থাৎ যারা দড়ির খেলা দেখায়, দড়ির উপর দিয়ে যাওয়ার সময় ‘ব্যালান্স’ রাখার জন্য যে অঙ্গভঙ্গি করতে হয় তাতেই সেটা নাচের মতো লাগে। মল্ল-মুঠঠিয়—মল্লরা কুস্তিগির আর মুঠঠিয় কথাটার সংস্কৃত হল মুষ্টিক অর্থাৎ যারা মুষ্টিযুদ্ধের মজা দেখাত। এঁদের সঙ্গে আছেন কথগ, অর্থাৎ গল্প বলিয়ে কথকঠাকুর, পাঠক অর্থাৎ স্তুতিপাঠকেরা, বাদ্যযন্ত্রীরা এবং আরও অনেকে যাঁরা লৌকিক জীবনের অলস সরসতা থেকে উঠে এসেছিলেন। আমরা বলতে চাইছি—এই অনেক শিল্পীর মেলায় নটনর্তকেরাও হলেন সেই গোষ্ঠী, যাঁরা কোনো অভিজাত বিদ্যার পরিশীলন থেকে উঠে আসেননি, জাতিবর্ণের কোনো উচ্চতাও এখানে সেইভাবে কাজ করছে না। ব্রাহ্মণ্য প্রভাবে যে সমাজ গড়ে উঠেছিল, সন্ধ্যা-আহ্নিক, ব্রত-হোম যে সমাজের সামগ্রিক চর্চার বিষয়, সেই সমাজ থেকে যাঁরা নট-নটীর বৃত্তি গ্রহণ করলেন, তাঁরা শিল্পের মাধুর্যেই শিল্পী হয়েছি—এই ভাবিনী ভাবের ভাবুক এবং তাঁরা প্রায় সকলেই তৎকালীন দিনের চতুর্থ সমাজের মানুষ, প্রধানত শূদ্র।
৩
‘‘But what are kings, when regiment is gone,
But perfect shadows in a sunshine day?”
–Edward II, 5.1
_ Christopher Marlowe
কলা হিসেবে নাট্য-নাটকের উদ্ভব রামায়ণ-মহাভারতের কালে তেমন পরিণতি লাভ না করলেও অভিনয় এবং নট-নটীর অবস্থান যে সে কালেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তার সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ আছে আদিকাব্য রামায়ণে। সেখানে রাজা দশরথের মৃত্যুর পর যে অরাজক অবস্থার সূচনা হয়েছিল, তখন ঋষিরা কুলপুরোহিত বশিষ্ঠের সামনে অরাজক জনপদের নানা সমস্যার কথা বলতে বলতে নট-নর্তক-অভিনেতাদের কথা জানিয়ে বলেছিলেন—কোনো দেশে যদি রাজা না থাকেন, তাহলে নট-নর্তকেরা মোটেই খুশি থাকে না, আর তাতে সামাজিক উৎসবগুলিও প্রাণ পায় না—
নারাজকে জনপদে প্রহৃষ্টা নটনর্তকাঃ।
উৎসবাশ্চ সমাজাশ্চ বর্ধন্তে রাষ্ট্রবর্ধনাঃ।।
একই শ্লোকের মধ্যে নট-নর্তকদের সঙ্গে উৎসব এবং সমাজের উল্লেখ থাকায় রামায়ণের কালে নাটকের প্রচলন সম্বন্ধে একটা অনুমান অবশ্যই হয়। সবচেয়ে বড়ো কথা, দশরথের মৃত্যু হয়েছে, রামচন্দ্র বনবাসে আছেন, এই অবস্থায় রাজপুত্র ভরতকে অযোধ্যায় নিয়ে আসার জন্য বশিষ্ঠমুনির দূতেরা এসে পৌঁছোলে ভরতকে দেখা যাচ্ছে যে তিনি ভীষণ খারাপ একটা স্বপ্ন দেখে মনমরা হয়ে বন্ধুদের কাছে এসে পৌঁছেছেন। তখন তাঁর মন ভাল করার জন্য বন্ধুরা কেউ নাচগানের মতো বিনোদনের ব্যবস্থা করলেন, কেউ নানা অভিনয়ে নাটক উচ্চারণ করতে থাকলেন তাঁর সামনে—
বাদয়ন্তি তদা শান্তিং লাসয়ন্ত্যপি চাপরে।
নাটকান্যপরে স্মাহুর্হাস্যানি বিবিধানি চ।।
এই শ্লোক থেকে এটা বোঝা যায় যে, ভরতের বন্ধুরা নটের ভূমিকায় একটা পূর্ণ নাটক অভিনয় করছেন না এখানে, কিন্তু নাটকোচিত অভিনয় সহকারে এমন সব সংলাপ বলছেন, যাতে নাটকের মতো একটা কিছু হচ্ছে, এটা বেশ বোঝা যায়। বিশেষত রামায়ণের উত্তর কাণ্ডে রামচন্দ্রের দুই পুত্র কুশ-লবের রামায়ণ-গান প্রসঙ্গে কুশীলব শব্দের প্রয়োগটাও গুরুত্বপূর্ণ। সন্দেহ নেই যে, দুই রামপুত্র কুশ এবং লব রামচন্দ্রের সামনেই শুধু নয়, তাঁরা চতুষ্পথে মুনিদের আশ্রমে, যজ্ঞভূমিতে, ব্রাহ্মণগৃহে সর্বত্রই রামায়ণ গান করার নির্দেশ পেয়েছিলেন এবং রামায়ণের গান যেহেতু হস্ত-পদ-চক্ষু ইত্যাদির অভিনয় ছাড়া সম্পন্নই হয় না, তাই অভিনেতার পর্যায়শব্দ হিসেবে কুশীলব নামটিও নট-নটীর অবস্থানের ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে।
মহাভারতেও আমরা এমন কোনো প্রমাণ পাইনি যাতে বলতে পারি যে, নাট্য-নাটক তার পূর্ণরূপ লাভ করেছিল। কিন্তু এখানেও অভিনেতা নটদের খবর পাচ্ছি ভালো রকম। মহাভারতে দ্রৌপদীর স্বয়ংবর-পর্বে উৎসুক ব্রাহ্মণরা স্বয়ংবর সভায় যোগ দিতে যাচ্ছেন নানান আমোদ উপভোগ করার জন্য এবং সেই আমোদের অন্যতম উপকরণ—তাঁরা সূত, মাগধ, বৈতালিকদের সঙ্গে নটদেরও দেখতে পাবেন—
নটা বৈতালিকাস্তত্র নর্তকাঃ সূতমাগধাঃ।
নিবোধকাশ্চ দেশেভ্যঃ সমেষ্যন্তি মহাবলাঃ।।
দ্রৌপদী-স্বয়ংবরের জন্য পাঞ্চাল-রাজ্যে যে অতিথি-সৎকারের ব্যবস্থা হয়েছিল, সেখানে অতিথিরা অনেক দিন আগে থেকে এসে থাকছিলেন বলেই সেখানে প্রতিদিনের একটা ‘সমাজ’ তৈরি হয়ে গিয়েছিল, যেখানে অতিথিরা প্রতিদিনই নট-নর্তকদের কর্ম দর্শন করতেন—
তত সমাজো ববৃধে স রাজন দিবসান বহূন।
রত্ন-প্রদানবহুলঃ শোভিতো নটনর্তকৈঃ।।
যে-কোনো উৎসব-মুখর পরিবেশেই নট-নর্তকদের দেখতে পাওয়া যেত মহাভারতের কালে। দ্রৌপদীর সঙ্গে বিয়ের পর নিয়মভঙ্গ করে অর্জুন যখন তীর্থে তীর্থে ঘুরে বেড়ালেন, তখন দ্বারকায় কৃষ্ণের ভবনে পৌঁছে অর্জুন নট-নর্তকদের দেখেছেন—দৃষ্টবান নট-নর্তকান। আবার ইন্দ্রপ্রস্থ নগরে যুধিষ্ঠিরের রাজসূয়-দীক্ষার সময়েও ব্রাহ্মণরা আতিথেয়তা গ্রহণ করার সময় নানা কথার আমোদ বিনোদনশীল নট-নর্তকদের দেখেছেন—
কথয়ন্তঃ কথা বহ্বীঃ পশ্যন্তো নট-নর্তকান।
তবে নট-নর্তকদের এই আমোদিনী ভূমিকা সত্ত্বেও অথবা আমোদ-প্রমোদের সময় তাদের ক্রিয়াকর্ম মানুষকে খানিক প্রমোদ আসক্ত করত বলেই মহাভারতের শান্তিপর্বে রাজধর্ম ব্যাখ্যার সময় জনপদ সুরক্ষিত রাখার নানান উপায়ের মধ্যে অভিনেতা, নট-নটীদের নগরের বাইরে রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে—ক্লীবোন্মত্তান কুশীলবান… বাহ্যান কুর্য্যান্নরশ্রেষ্ঠ…। এটা ঠিক যে, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের খুব একটা ভাল চোখে দেখত না সেকালের সমাজ, হয়তো বা তাঁদের জীবনযাপনের উপায়গুলিও সামাজিক দৃষ্টিতে খুব শোভন ছিল না। ফলত অভিনেতা-অভিনেত্রীরা অনেক সময়েই সমাজের চোখে নিন্দনীয় হতেন—দোষায় স্যুর্হি তে’ন্যথা। কিন্তু অভিনেতা অভিনেত্রীদের ওপর এই আরোপ সত্ত্বেও শান্তিপর্বের রাজধর্ম সংক্রান্ত ওই একই অধ্যায়ে নট-নর্তকরা কিন্তু নাগরিক আমোদের উৎস এবং নগরের শোভা বলে কথিত হয়েছেন—
নটাংশ্চ নর্তকাংশ্চৈব মল্লান মায়াবিনস্তথা।
শোভয়েয়ু পুরবরং মোদয়েয়ুশ্চ সর্বশঃ।।
সাধারণ মানুষের চোখে নট-নর্তক পুরুষ-মহিলাদের এমন একটা আকর্ষণীয় ভূমিকা ছিল যে, অনেক সময় ব্রাহ্মণরাও স্বজাতীয় বৃত্তি যজন-যাজন অধ্যয়ন অধ্যাপনা ছেড়ে নটবৃত্তি অবলম্বন করতেন। মহাভারত অবশ্য এইরকম নটবৃত্তি পুরুষদের শুধুমাত্র ব্রাহ্মণের ঘরে জন্মেছেন বলেই তাঁদের সম্মান করতে বলেছেন।
নাট্যশাস্ত্রকার ভরতমুনি কথাটা বলেছেন অন্যভাবে। যখন নাট্যকর্ম রীতিমতো শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত, রাজ-রাজড়া এবং অন্যান্য অভিজাতজনেরা মনন-বিনোদনের জন্য যখন নাট্য-নাটকের সমাদর করতে আরম্ভ করলেন, তখনই ভরতমুনি তাঁর নাট্যশাস্ত্র লিখছেন। অভিনব নতুন এক সমাদৃত কলাসৃষ্টির মাহাত্ম্য আছে বলেই নাটককে পঞ্চম বেদ বলে চিহ্নিত করেছেন ভরতমুনি—নাট্যাখ্যং পঞ্চমং বেদং সেতিহাসং করোম্যহম—কিন্তু যতই পঞ্চম বেদ হোক, অভিনয়-প্রধান এই নাট্যকলার কলাকুশলীরা যে সমাজের অভিজাত ভাগ থেকে আসেননি সে-কথা ভরতমুনি বলেছেন বরদান এবং অভিশাপের কৌশলে।
লক্ষণীয়, পুরাকালে ইন্দ্র প্রভৃতি দেবতারা যখন দেখলেন যে, শূদ্রের বেদপাঠে অধিকার নেই, তখন সর্ব বর্ণের জন্যই পঞ্চম বেদ সৃষ্টি করার জন্য পিতামহ ব্রহ্মাকে অনুরোধ করলেন। ব্রহ্মা চার বেদ থেকে সার সংগ্রহ করে নাট্যবেদ সৃষ্টি করলেন এবং ভরতমুনিকে সামনে দেখে তাঁকেই নাটক পরিচালনা করার আদেশ দিলেন। এই নাটক নিয়ে দেবতা এবং দৈত্যদের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হয়ে উঠল। কিন্তু এ সবই দেবলোকের কথা। মনুষ্যলোকে নাটক উৎপত্তির কাহিনি থেকে আমরা নাটকে নিম্নবর্গীয় মানুষের সংক্রমণ বুঝতে পারি। প্রথম নাটক করার সময় ভরতমুনির একশো ছেলে (আমাদের মতে নাট্যকলার শিষ্য, অভিনেতা) নাটকে অভিনয় করেছিল। কিন্তু একসময় ভরতমুনির ওই ছেলেরা তপস্বী মুনিদের ব্যঙ্গ করেছিল। ফলে তাঁরা অভিশাপ দেন যে, ভরতমুনির ছেলেরা সমাজপতিত হয়ে শূদ্রত্ব লাভ করবে।
সকলেই নাট্যশাস্ত্রের এই উল্লেখটুকু বর্ণনা করেন বটে, কিন্তু কী অবস্থায়, কোন প্রসঙ্গে এই অভিশাপ নেমে এসেছিল সেটা বলেন না। ব্যাপারটা এইরকম হয়েছিল—তপস্বী মুনিদের নানান আচার-আচরণ নিয়ে ভরতমুনির অভিনেতা ছেলেরা একটা নাটকই তৈরি করে ফেলেছিল,—ঋষীণাং ব্যঙ্গকরণং কর্বদ্ভির্গণসংশ্রয়ম। এবং তাই শুধু নয়, তারা বোধহয় এই নাটকটা স্টেজে দেখিয়েও দিয়েছিল—নিষ্ঠুরং চাপ্রস্তুতং চ কাব্যং সংসদি যোজিতাম। ঠিক যেমন একালেও হয়—সরকারের অথবা অচলায়তন সংরক্ষণশীল সমাজের সমালোচনা করে নাটক তৈরি করি আমরা—ঠিক সেইভাবেই ব্রাহ্মণ্য সমাজের আচার-আচরণ নিয়েই হয়তো সমালোচনা বা ব্যঙ্গমূলক নাটক তৈরি করেছিল ভরতমুনির ছেলেরা। তার ফলেই ‘এস্টাব্লিশমেন্ট’ যেভাবে প্রতিক্রিয় হয়, ঠিক সেইভাবেই ঋষিদের অভিশাপ নেমে এল ভরতপুত্রদের ওপর। তাঁরা বললেন—তোমরা হোম-ব্রতহীন শূদ্রাচারী হয়ে থাকবে পৃথিবীতে। তোমরা হবে অপাঙক্তেয়, অধম, কুৎসিত। তবে তোমাদের বংশজাত ছেলেরা সকলেই নর্তক হবে এবং তোমাদের নাটক তোমাদের নাটক থাকবে, সেটার কোনো ক্ষতি হবে না—নচৈতদ্ধি বিনশ্যতি।
বরদান এবং অভিশাপের দর্শন এবং মনস্তত্ত্ব নিয়ে যতটুকু ভেবেছি, তাতে দেখেছি—এগুলির মাধ্যমে পৌরাণিক অভিসন্ধিগুলি সিদ্ধ করা হয়। এই নাটক ব্যাপারটাই তৎকালীন অভিজাত সমাজের পছন্দ হচ্ছিল না, অথচ তার জনপ্রিয়তাও রোধ করা যাচ্ছিল না। এই অবস্থাতেই কিন্তু অভিশাপ দিয়েও তার অস্তিত্বের ব্যবস্থা করতে হয়েছে। আর অভিনেতা-অভিনেত্রীদের জীবনটাই তাঁদের স্বখাত কর্মশৈলীর যন্ত্রণায় এমনভাবে বাঁধা থাকত, যাতে মানুষের পঙক্তিতে বসে খোশ গল্প করা তাদের পক্ষে সম্ভব হত না। বিশেষত অভিনেতা-অভিনেত্রীরা যেহেতু বেশিরভাগই সমাজের নিম্নবর্গ থেকে উঠে এসেছিলেন, সেই সত্যটাকে সামাজিক স্বীকৃতি জানানোর জন্যই কিন্তু ঋষিদের অভিশাপে শূদ্রাচারের ব্যবস্থা। আসলে তাঁরা শূদ্রাচারীই বটে। নাটক নিয়ে ভাবতে বসে ব্রত-নিয়ম, সন্ধ্যা-আহ্নিকের বহর চলে না কোনো মতেই। অথবা নট-নর্তকের জীবনে স্ত্রী-পুরুষের অভিনয়-নিবন্ধনে যে নৈকট্য তৈরি হয়, তাতে তাদের যৌন জীবনেও বাধা-বন্ধনের শিথিলতা তৈরি হয়। এই শিথিলতা যেহেতু সময়কালে বেপরোয়া ভাবও তৈরি করে, তাই চলমান সমাজের মানুষ অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কলা-কৌশলে মুগ্ধ হলেও তাদের জীবন চলার পথটাকে শ্রদ্ধা করতে পারেনি কখনও। এখনও অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সঙ্গে অথবা তাদের ছেলেমেয়ের সঙ্গে সাধারণ সমাজের মানুষেরা বৈবাহিক সম্পর্ক তৈরি করতে ভয় পায়। এর কারণ মিথিক্যাল ঋষির অভিশাপ, নাকি, নট-নর্তকের চিরকালীন জীবন যেখানে বসন্ত আসার অনেক আগেই বড়ো বেশি কোকিল চলে আসে?
৪
Your clothes should be tight enough to show you’re
a woman but loose enough to show you’re a lady.
–Marilyn Monroe
১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই আগস্ট। স্থান : বেঙ্গল থিয়েটার, ৯ বিডন স্ট্রিট, কলকাতা। মাইকেল মধুসূদনের ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক মঞ্চস্থ হল। স্ত্রীচরিত্র রূপায়ণে বারাঙ্গনাদের মধ্যে থেকে অভিনেত্রী গ্রহণ করা হল। বেঙ্গল থিয়েটার কর্তৃপক্ষ এই প্রথম চারজন বারাঙ্গনাকে অভিনয়ের কাজে নিয়োগ করলেন, যাঁদের নাম শ্যামা, গোলাপ, এলোকেশী এবং জগত্তারিণী। গোলাপ যদিও পরবর্তীকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়িকা, কিন্তু ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটকে দেবযানীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন এলোকেশী এবং দেবিকার ভূমিকায় জগত্তারিণী।
তৎকালীন বেঙ্গল থিয়েটারের পরিচালন-গোষ্ঠীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন মহামতি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। মনেপ্রাণে অত্যন্ত প্রগতিশীল হওয়া সত্ত্বেও বারাঙ্গনাদের অভিনয়ে নিযুক্ত করার এই প্রয়াসের ভীষণ বিরোধী ছিলেন বলে বিদ্যাসাগর বেঙ্গল থিয়েটারের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেন। স্ত্রীচরিত্রে অভিনয় করার জন্য সাধারণ সামাজিক গৃহের গৃহস্থ মহিলারা—যাঁরা ‘ভদ্রলোক’ বলে পরিচিত ছিলেন—তাঁরা সেকালে থিয়েটারে যোগ দিতেন না। কিন্তু অভিনয়ের সাবলীলতা এবং নীতিবোধের দ্বৈরথে বিদ্যাসাগরের মতো আধুনিকতম মানুষও সেদিন নীতিবোধের রক্ষণশীল প্রকোষ্ঠে পা রেখেছিলেন। কিন্তু মোটামুটি একশো পঁচিশ/তিরিশ বছর আগেও যে-কথা ভাবা যায়নি, সেটা কিন্তু পাঁচশো বছর আগে ভাবা গিয়েছিল। মহাপ্রভুর অন্তরঙ্গ রায় রামানন্দ দেবদাসীদের দিয়ে তাঁর ‘জগন্নাথবল্লভ’ নাটক করিয়েছিলেন এবং দেবদাসীদের তিনি ‘মেকআপ’ করিয়েছিলেন স্বহস্তে। চৈতন্যদেবের মতো বাইরে-ভিতরে বৈরাগীও এই নাটকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন অর্থাৎ পাঁচশো/সাড়ে পাঁচশো বছর আগেও সংরক্ষণশীলতা নাটকের বাধা সৃষ্টি করেনি। কিন্তু এখানে করল।
বিশেষত, আমি যে সময়ের কথা বলছি, সেটা মোটামুটি দু-হাজার বছর আগেকার কথা। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয়/চতুর্থ শতাব্দীতে ভরতমুনির সময় ধরলে, তাঁর ‘মিথিক্যাল’ বিবরণ অনুযায়ী ভারতবর্ষের নাট্যমোদী সহৃদয় মানুষেরা স্ত্রীচরিত্র রূপায়ণের জন্য স্বর্গসুন্দরী বারাঙ্গনাদের বেছে নিয়েছিলেন। তবে শুধু এই স্ত্রীচরিত্রে অভিনয়ের কথাই বা বলছি কেন—সাবলীল অভিনয়ের জন্য যেখানে যাকে প্রয়োজন, সেখানেই উপযুক্ত মানুষটিকে নিয়োগ করাটা প্রাচীন নাট্যতাত্ত্বিকদের আকাঙ্ক্ষিত অভিমত ছিল। নাট্যশাস্ত্রের বিবরণে দেখছি—ভগবান ব্রহ্মার আদেশে ভরতমুনি তাঁর একশত পুত্র বা শিষ্যকে নাট্যতত্ত্বের প্রয়োগবিদ্যা শেখানোর পর এমন মন্তব্য করছেন—তিনি যে-রকম কাজে যেমন যোগ্য তাঁকে সেই কাজেই নিয়োগ করা হয়েছে—যো যস্মিন কর্মণি যথা-যোগ্য স্তস্মিন স যোজিতঃ।
যাকে যেখানে প্রয়োজন, সেখানে তাকেই নিয়োগ করে নাটকের কাজ আরম্ভ হল বটে, কিন্তু বিশ্বজনীন সমস্ত রসভাবনাতেই সমানভাবেই সমানভাবে যে-কথাটা স্বীকৃত হয়েছে, তা হল—নাটক তো কবি-সাহিত্যিক-সামাজিক কারও একার কোনো বিষয় নয়। নাট্যশাস্ত্রের টীকাকার অভিনবগুপ্ত তাঁর অসামান্য টীকা অভিনবভারতীর মধ্যে এই মুহূর্তেই মন্তব্য করেছেন যে, নাটকীয় রস-ভাবের ভাবনা বস্তুটা হল এক পরম ব্যাপ্তির ভাবনা, এটা কবি-নাট্যকার, নট এবং সামাজিক দর্শকের হৃদয়-ব্যপ্ত ভাবনা—রসানাং ভাবো ভাবনা কবি-নট-সামাজিক-হৃদয়ব্যাপ্তিঃ।
বস্তুতঃ এই হৃদয়ব্যাপ্তি ব্যাপারটা খুব সহজ কথা নয়, এ এক অদ্ভুত অচিন্ত্য-ভেদাভেদবাদ। বিচিত্র ভিন্ন বস্তু একটা সুচিন্তিত ঐকতান। কথ্য সংলাপ, নট-নটীর অভিনয়, সাসপেন্স—এত কিছুর সঙ্গে তথাকথিত জড় কতকগুলি বস্তু—সিন, সেট, আলো, সুর, বাদ্য—এই সমস্ত কিছুকে, অথবা কিছু বাদ দিয়ে অন্যতর কিছুকে সমতায় নিয়ে আসাটা খুব সহজ কথা নয়, বিশেষত ঘটনার বিচিত্র বিন্যাসটাকে সমতার তুঙ্গ বিন্দুতে নিয়ে যাওয়ার জন্য নাট্যকার, নট-নটী এবং সহৃদয় দর্শক-শ্রোতার হৃদয়-সংবাদই কিন্তু সার্থক নাটক তৈরি করে। কালিদাস তাঁর নাটকের মধ্যেই বলেছিলেন শকুন্তলার প্রেমকল্প প্রকাশ করার জন্য শুধু শকুন্তলা-দুষ্মন্ত হলেই চলে না। সেখানে স্রোতোবহা মালিনী নদীর মধ্যে দুটি হাঁসের ভেসে চলা দেখাতে হয়। দেখাতে হয় হিমালয়ের পাদদেশে অলসে হেঁটে চলা হরিণদের, গাছে গাছে শুকোতে দেওয়া ঋষিদের বাকল। এইসব কিছু নিয়ে তবে শকুন্তলা-দুষ্মন্ত। নাটকও সেইরকম এক হৃদয় ব্যাপ্তি, কবি-নট-নাট্যকার-দর্শকের হৃদয়-সংবাদ।
এই হৃদয়-সংবাদের প্রক্রিয়া তৈরির জন্য, সংবাদ ঘটানোর জন্য ভরতমুনির চেষ্টার অন্ত ছিল না। নাটকের কথা বা সংলাপের প্রয়োজন, তার জন্য তিনি কথার ব্যবস্থা করলেন—নাট্যশাস্ত্রের পারিভাষিকতায় সেটাকে বলা হয় ভারতী বৃত্তি। নাটকের মধ্যে বিভিন্ন অংশে উৎসাহ, উদ্দীপনা, ত্যাগ, শৌর্য, দয়া, সরলতা ইত্যাদি পরিবেশন করতে হবে বিভিন্ন রসের পরিপোষক হিসেবে—নাট্যাচার্য ভরত তারও ব্যবস্থা করেছেন। দেখাতে হবে মায়া, ইন্দ্রজাল, সংগ্রাম, ক্রোধ, হিংসা, হত্যা, কারাগার—তারও ব্যবস্থা করেছেন ভরত। সব ব্যবস্থা করে ভরত যখন নাটক সৃষ্টি করার জন্য প্রস্তুত হয়ে ভগবান ব্রহ্মার কাছে বিদায় নিচ্ছেন, তখন সুরগুরু বৃহস্পতি তাঁকে বললেন—বাছা! তুমি নাটকের মধ্যে কৈশিকী বৃত্তিটাও যোগ কর, সেটা নইলে নাটক হবে কী করে—অথাহ মাং সুরগুরুঃ কৈশিকীমপি যোজয়।
‘কৈশিকী বৃত্তি’ কথাটাও পারিভাষিক। এই পরিভাষার সম্পূর্ণ পরিচয় দেওয়ার আগে নাট্যশাস্ত্রের অসামান্য টীকাকার অভিনবগুপ্তের বক্তব্যটা বলে নিই। অভিনবগুপ্ত বলেছেন—নাটকের মধ্যে কোমল তথা ললিতগুণ সম্পন্ন যা কিছু আছে, তার সবটাই আছে কৈশিকী-বৃত্তির মধ্যে। ললিতগুণসম্পন্ন কোনো কিছু নাটকের মধ্যে আধান করতে হলে, তার জন্য দরকার নৃত্যগীত, অভিনয়, সুন্দর বেশ এবং কামোপভোগের অনুকূল বিলাস তথা উপচার। আসলে এগুলি সব স্ত্রী পুরুষের প্রেমভাবসমন্বিত শৃঙ্গাররসের উপাদান। যে কারণে অভিনবগুপ্ত বলেছেন—কৈশিকী বৃত্তি ছাড়া শৃঙ্গার রসের কোনো নাটকীয় প্রতিবেদনের কথা ভাবাই যায় না। আর শুধু শৃঙ্গার কেন, রৌদ্র বীর ইত্যাদি রসেও কৈশিকী বৃত্তিই হল প্রাণস্বরূপা—
এবং যৎকিঞ্চিল্লালিত্যং তৎসর্বং কৈশিকী-বিজৃম্ভিতম।
বেশ বোঝা যায়—কৈশিকী বৃত্তির মধ্যে যে ললিতকলার বিলাস-কৌতূহল ছিল, ‘সেটা শুধু পুরুষের দ্বারা মেটানো সম্ভব নয়। অথচ প্রথম নাট্যকার ভরতের পক্ষে লোক-পিতামহ ব্রহ্মার কাছে এটাও বলা সম্ভব ছিল না যে, আপনি স্ত্রীলোকের ব্যবস্থা করুন, নইলে এই কৈশিকী বৃত্তির কাজটুকুই বাকি থেকে যাবে। অনেক বিবেচনা করে ভরতমুনি ব্রহ্মাকে বললেন—ঠাকুর! আপনি এমন উপযুক্ত সুন্দর বস্তুর ব্যবস্থা করুন যাতে নাটকে কৈশিকী বৃত্তির প্রয়োগ ঘটতে পারে, ব্যবস্থা হতে পারে নৃত্য-গীত-বৈচিত্র্যের, অভিনয়ে যোগ হতে পারে মধুর-মন্থর আবর্তন, ভ্রূবিক্ষেপ, কটাক্ষ। এগুলিকে ভরত এক-কথায় বলেছেন—রসভাব-ক্রিয়াত্মিকা।
ভরতমুনি এইসব ভাসা-ভাসা কথা বলেই থামলেন না। তাঁকে স্পষ্ট করে বলতেই হবে তিনি কী চান। একটু ভণিতা করে বললেন—আমি নটরাজ নীলকণ্ঠ মহাদেবকে নৃত্য করতে দেখেছি। নৃত্যকালে তিনি যেমন করে তাঁর জটাচূড় বেঁধে নিয়েছিলেন, যেমন বিচিত্র অঙ্গহার ধারণ করেছিলেন, তাতে বোঝা যায় তিনি কৈশিকী বৃত্তি আশ্রয় করেছিলেন এবং শৃঙ্গাররসের অভিনয়-প্রয়োজনেই সেই বৃত্তির প্রয়োজন হয়। এবারে ভরতমুনি স্পষ্ট জানিয়ে বললেন—প্রভু আমার! নাটকে যদি কৈশিকী বৃত্তির প্রয়োগ ঘটাতে হয়, তাহলে শুধু পুরুষ-মানুষ দিয়ে মোটেই কাজ হবে না, অভিনয়ের জন্য স্ত্রীলোক লাগবে, স্ত্রীলোক ছাড়া সম্ভবই নয়—
অশক্যা পুরুষৈঃ স্থাতুং প্রযোক্তুম স্ত্রীজনাদৃতে।
ব্রহ্মা ভরতমুনির নিবেদন শুনে সৃষ্টি করলেন স্বর্গসুন্দরী অপ্সরাদের। অপ্সরাদের নামের তালিকায় ঊর্বশী-মেনকা-রম্ভার মতো নামী-দামি তারকারা ছিলেন না বটে, তবে মঞ্জুকেশী-মিশ্রকেশী অথবা সৌদামিনী-সুলোচনারা ছিলেন এবং তাঁরা প্রত্যেকেই নাট্যালঙ্কারের সমস্ত বৈচিত্র্য, লীলা-বিলাসে চতুর। ব্রহ্মা তাঁদের তুলে দিলেন নাট্যাচার্য ভরতমুনির উপযুক্ত তত্ত্বাবধানে—নাট্যালঙ্কার-চতুরাঃ প্রাদান্মহ্যং প্রয়োগতঃ।
আমরা যে এতক্ষণ সময় ধরে ভরতমুনির নাট্যপ্রয়োগের প্রাথমিক প্রেক্ষাপটটুকু বর্ণনা করলাম, তা শুধু এইজন্য যে, নাট্যকর্মে যাঁরা পটীয়সী, নাটকের প্রাণস্বরূপ কৈশিকী বৃত্তির প্রয়োগ ঘটানোর জন্য যাঁরা নিরূপিত হলেন, সেই স্বর্গসুন্দরী অপ্সরাদের সঙ্গে বেলগাছিয়া নাট্যমঞ্চের শ্যামা, গোলাপ, এলোকেশী, জগত্তারিণীদের কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই। কেননা সৌন্দর্য এবং রমণীয়তার দিক থেকে অপ্সরা-রা প্রজাপতি ব্রহ্মার মানসসম্ভবা হলেও চারিত্রিক দিক দিয়ে তাঁদের ব্যবহার তৎকালীন সামাজিকতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। আরও স্পষ্ট করে বললে বলা যায়—বাংলা রঙ্গমঞ্চের ইতিহাস যদি বেশ্যাদের অভিনয়ে প্রথম সমৃদ্ধ হয়ে থাকে, তবে সংস্কৃতে ভরতমুনির নাট্যশালাও পুষ্ট হয়েছিল স্বর্গবেশ্যা অপ্সরাদের অভিনয়ে। আর অপ্সরাদের গায়ে যতই স্বর্গের সৌগন্ধ লেগে থাকুক তাঁরা যে একভাবে বেশ্যাই ছিলেন সেকথা প্রমাণ হয় গুপ্তযুগের অভিধানকার অমরসিংহের প্রতিশব্দ-নির্বাচনে। অপ্সরাদের পরিচয় দেওয়ার সময় তিনি লিখেছেন—ঊর্বশী, মেনকা, রম্ভার মতো অপ্সরারা সকলেই স্বর্গবেশ্যা—স্ত্রিয়াং বহুষ্পপ্সরসঃ স্বর্বেশ্যা ঊর্বশীমুখাঃ।
বঙ্গদেশের প্রসিদ্ধ টীকাকার বৃহস্পতি রায়মুকুট উপরোক্ত অমরকোষের টীকা করতে গিয়ে ‘স্বর্বেশ্যা’ শব্দটির অর্থ করেছেন—”স্বঃ স্বর্গস্য বেশ্যাঃ স্বর্বেশ্যাঃ’ অর্থাৎ অপ্সরারা হলেন স্বর্গের বেশ্যা। অন্যত্র ‘অপ্সরঃ’ শব্দের টীকায় তিনি আরও পরিষ্কার করে লিখেছেন—অপ্সরারা হলেন দেবলোকের বারবনিতা, যেমন ঊর্বশী, মেনকা ইত্যাদি। রামায়ণ, মহাভারত এবং পুরাণগুলির মধ্যে ঊর্বশী-মেনকা-রম্ভাদের বহুতর নাটক এবং নৃত্যকর্মে অংশগ্রহণ করতে দেখা যাবে, কিন্তু তাঁদের অসাধারণ শিল্পকর্মের সঙ্গে তাঁদের চারিত্রিক স্খলন-পতন ত্রুটিও একাধারে লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠবে। হয়তো এই চারিত্রিক স্খলন অথবা, আরও একটু উদারভাবে বলতে গেলে, তাঁদের সামাজিক ব্যবহারের শিথিলতার কারণে সমগ্র নট-সমাজই মানুষের চোখে খানিকটা হীন প্রতিপন্ন হয়েছিল। আশ্চর্য ব্যাপার হল—অভিনেতা-অভিনেত্রীদের চারিত্রিক শিথিলতা বা সামাজিক হীনতা যাই থাকুক না কেন, তার জন্য অভিনয়-কর্মের কদর কিছু কম ছিল না—তার কারণ প্রাচীন ভারতবর্ষে সংস্কৃত নাটক কম লেখা হয়নি এবং শিল্পরসিক রাজা-রাজড়াদের দরবারে অভিনয়ও কিছু কম হয়নি।
৫
Female performers were officially acknowledged in the patents issued to killingrew and Devenant in 1662 and 1663–
The Woman plays today, mistake me not, No Man in Gown, or Page in Petty-Coat.
Their morality automatically suspect, they were commonly equated with prostitutes, an association which hanted female performers for generations to come.
– Joanne Lafler
‘‘Theatre and the female presence”
In the Cambridge History of British Theatre,
Volume 2, 73-74
স্ত্রীচরিত্রে তাঁদের অভিনয়ের ক্ষেত্রে বারাঙ্গনারাই যেহেতু প্রাধান্য পেতেন, তাই তাঁদের সঙ্গে অতিরিক্ত সাহচর্যের ফলে নাটকের পুরুষ অভিনেতারাও নিজেদের সামাজিক চরিত্র খুব শুদ্ধ-সরল রাখতে পারতেন না। অবশ্য অভিনেত্রী বারাঙ্গনারাই তাঁদের চরিত্রহীনতার জন্য দায়ী, সে-কথা কখনোই বলা যায় না, কেননা সেটা বড়োই পারস্পরিক ব্যাপার।
প্রাচীনকালে বারাঙ্গনারা যেভাবে নিজেদের তৈরি করতেন, যেভাবে তাঁরা শিক্ষিত করে তুলতেন নিজেদের, সেটা প্রায় অভিনয় শিক্ষারই নামান্তর। অর্থাৎ শরীর রক্ষার পদ্ধতি এবং মানসিক দীক্ষা—দুটোই ছিল অভিনেত্রীদের আছে আদর্শ। সপ্তম শতাব্দীতে যিনি সংস্কৃত গদ্যে দশকুমারের ভ্রমণবৃত্তান্ত লিখে বিখ্যাত হয়েছিলেন, সেই দণ্ডীর লেখা একটি চরিত্রে এক বেশ্যাজননী বলছে—দেখুন, আমাদের কাজ হল—জন্মের সময় থেকেই মেয়ের চেহারা ঠিক রাখার জন্য যথাযথ ভাবনা করা এবং সেই ভাবনা অনুসারে ব্যবস্থা করা। মেদ এবং রক্তের সমতা বিধান করে এমন পরিমিত আহারের বন্দোবস্ত করতে হয় আমাদের, যাতে করে শরীরটি হয়ে ওঠে নৃত্যকর্মের উপযোগী। শারীরিক শক্তি, লাবণ্য এবং মেধার সঙ্গে রোগোপশমের উপাদানও থাকবে খাবারের মধ্যেই। পড়াশোনার জায়গাটাও খুব সহজ নয়। কতকগুলো বিষয়ে সাধারণ জ্ঞান এবং কতকগুলো বিষয়ে বিশেষ জ্ঞানলাভ করতে হয় গণিকা হতে গেলে। সাধারণ জ্ঞানের মধ্যে বিভিন্ন লিপি-জ্ঞান এবং অসাধারণ ভাষণ কুশলতা তো অবশ্যই প্রয়োজন। তার সঙ্গে জানতে হবে ব্যাকরণ, তর্কযুক্তি ইত্যাদি অন্তত এগুলির ‘ওয়ার্কিং নলেজ’ তো লাগবেই। বিশেষ জ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রধান হল—নৃত্য, গীতি, বাদ্য এবং নাট্যকলার সবিশেষ পরিচয়—যা তাঁকে একদিন খ্যাতি-কীর্তির কেন্দ্রেই শুধু স্থাপন করবে না, বস্তুত সেই গুণেই তিনি একদিন অখিল যুব সমাজের প্রার্থিত হয়ে উঠবেন এবং তখন তিনি নিজের জন্য ভালো রকম দর হাঁকতে পারবেন—যুবজন মনোরথ-লক্ষ্যভূতাযাঃ প্রভূতমনেন শুল্কেনাব-স্থাপনম।
বারাঙ্গনাদের কলাকুশলতার বোধ, নৃত্য-গীত-নাট্যের চর্চা—এগুলি এমনভাবে ব্যাখ্যা করা যেতেই পারে যেন ভবিষ্যতে নাগরিক পুরুষের মন ভোলাতে হবে বলেই এ-সব প্রয়োজনভিত্তিক আয়োজন। কিন্তু প্রাচীনকালের গণিকাবৃত্তি সম্বন্ধে যাঁদের গভীর ধারণা আছে, তাঁরা জানবেন যে, সেকালে এক-একজন গণিকার কলা-বিলাস-বৈচিত্র্য এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছোত, যেখানে তাঁদের ব্যক্তিজীবনের কালিমা, পুরুষমোহিনী কামাচার—এগুলি চাপা পড়ে যেত। গণিকাদের বিদ্যাশিক্ষার তালিকা এতটাই বড়ো ছিল—জৈন গ্রন্থ বৃহৎকল্পের বর্ণনা অনুযায়ী সে-তালিকার মধ্যে গণিত এবং কাব্যরচনার ক্ষমতাও স্বীকৃত—তাতে করে এই গণিকাদের সামাজিক অবস্থান এবং মানসিক উৎকর্ষের তুলনা করা যায় সে-কালের ফ্রান্সের ‘সাঁলো’ গুলির অধিকর্ত্রীদের সঙ্গে অথবা জাপানের ‘গেইশা’ নারীদের সঙ্গে। প্রাচীন বৌদ্ধগ্রন্থ ললিতবিস্তরের মধ্যে দেখি—কপিলাবস্তুর অধীশ্বর রাজা শুদ্ধোদন তাঁর পুত্র সিদ্ধার্থের বিবাহের জন্য এমন একটি মেয়ে খুঁজছেন যাঁর কলা-প্রবেশ একজন গণিকার মতো—শাস্ত্রে বিধিজ্ঞকুশলা গণিকা যথৈব।
গণিকাদের এত গুণ ছিল বলেই সেকালের রঙ্গমঞ্চে অভিনয়ে অবতীর্ণ হতেন গণিকারাই। সংস্কৃতে যে ‘নটী’ শব্দটা আছে, তার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হওয়া উচিত—নটের স্ত্রী অর্থাৎ নাট্য-নাটকের সঙ্গে যার যোগ আছে এমন একজন পুরুষ-নটের স্ত্রী; অথবা খুব উদার হলে এমন অর্থ বড়োজোর করা যেতে পারে—যে স্ত্রীলোক সোজাসুজি নাট্যকর্মের সঙ্গে যুক্ত তিনিই নটী। কিন্তু তা নয়, ‘নটী’ শব্দটি গণিকার বহুতর প্রতিশব্দের মধ্যে একটি। মনে রাখতে হবে—নটী শব্দের মধ্যে যতই গণিকাত্বের প্ররোচনা মিশ্রিত থাকুক, এই শব্দের মূল কিন্তু নট। নাটকের যাঁরা পুরুষচরিত্রের অভিনয় করতেন, তাঁরা সমাজের উচ্চশীল মান্য শ্রেণি থেকে আসতেন না।
সাধারণ বুদ্ধিতেই এটা বলা যায় যে, একটা বিশেষ জাতি বা বর্ণ থেকে নট-নর্তকদের জোগান আসত—এমনটা হতেই পারে না। কেননা শিল্পরসিক নট সমাজের কোন শ্রেণি থেকে উদ্ভূত হবেন—এটা ভবিষ্যদবাণীরও বিষয় নয় এবং সেখানে কোনো বিশেষ জাতিবর্ণও নির্দিষ্ট থাকার কথা নয়। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর পরিশীলিত মানবাধিকার-বোধে এটা যতই অবাস্তব মনে হোক, এ-কথা মানতেই হবে যে, প্রাচীন সমাজ নাট্যকর্ম, নৃত্য-বিনোদনের ব্যাপারে যতই আগ্রহী থাকুক, এমনকী নট-নাট্যের প্রশংসার কথাটাও আমাদের কাছে একটু অস্বাভাবিক লাগে—কেননা উচ্চশ্রেণির মানুষদের মধ্যে কাউকেই আমি নট হতে দেখি না। অমন যে নটরাজ শিব যিনি নৃত্যাবাসনে নব পঞ্চবার ঢক্কাশব্দ করে আমাদের স্বরব্যঞ্জনের বর্ণমালা সৃষ্টি করেছিলেন, তিনি কিন্তু দেবতা হিসেবে প্রথমত তেমন কুলীন ছিলেন না। আর যিনি ‘গোপবেশ বেণুকর, নবকিশোর নটবর’, তিনি যে শারদ রাসে ‘পাদন্যাসৈর্ভুজবিধুতিভিঃ সস্মিতৈ ভ্রূবিলাসৈঃ’ শত গোপীদের নাচিয়েছিলেন, তাঁকেও গম্ভীর দার্শনিকেরা লাম্পট্যের চিহ্নে চিহ্নিত করেছেন। ঘটনা হল—নাটক-নৃত্য সকলে পছন্দ করে, কিন্তু উচ্চকুলীন মানুষ নট-নটী হয়ে উঠুক—এটা কেউ চাইত না।
আমার ধারণা—পুরুষদের মধ্যে যাঁরা নট-জীবন বেছে নিতেন, তাঁদের মধ্যে একটা প্রবল ইচ্ছে তো কাজ করতই, আর কাজ করত এক বেপরোয়া ভাব, হয়তো এই ভাব তাঁদের মধ্যে কাজ করত পুরুষানুক্রমেই। নট-নর্তকদের জাতি-বিচার কেউ করেননি, করা কঠিনও ছিল। একমাত্র মনুমহারাজ তাঁর সংহিতা গ্রন্থে তৎকালীন দিনের যে সামাজিক বর্ণবিচার করেছেন, তার মধ্যে এক জায়গায় তিনি বলছেন—ব্রাত্য ক্ষত্রিয়দের সবর্ণা স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তানেরা ঝল্ল, মল্ল, করণ, নট এবং দ্রবিড় নামে চিহ্নিত হতেন—নটশ্চ করণশ্চৈব খসো দ্রবিড় এব চ। বস্তুত ব্রাত্যেরা হলেন সমাজের সেই শ্রেণি, যাঁরা ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের মতো কুলীন বংশে জন্মগ্রহণ করা সত্ত্বেও ব্রাহ্মণোচিত উপনয়নাদি সংস্কার লাভ করেননি—তান সাবিত্রী-পরিভ্রষ্টান ব্রাত্যা ইতি বিনির্দিশেৎ।
এইভাবে ক্ষত্রিয়ের বংশে জন্মেও যাঁরা ক্ষত্রিয়োচিত ব্রাহ্ম সংস্কার লাভ করেননি বা লাভ করতে ইচ্ছা করেননি, সেইসব ক্ষত্রিয় ব্রাত্যের বংশোদ্ভূত ছিলেন নটেরা। মনুর কথা শুনে এমন ভাবার কারণ নেই যে ক্ষত্রিয়-ব্রাত্যের পুত্রমাত্রেই নট-জীবিকা গ্রহণ করতেন। বাস্তবে এটা হতেই পারে না, কারণ এটা জাতিসংজ্ঞা মাত্র। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র এবং বাৎস্যায়নের কামশাস্ত্রে কুশীলব নট-চারণদের সবাইকেই শূদ্র-জাতির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আমাদের বক্তব্য হল—এই জাতীয় সংজ্ঞা থেকে প্রমাণ হয়—নট-নর্তকদের কোনো উচ্চশীল জাতির মধ্যে গণ্য করা হত না সেকালে এবং হয়তো যিনি নটবৃত্তি গ্রহণ করতেন তাঁকেই বরং ব্রাত্য পুত্রের সংজ্ঞায় অভিহিত করা হত।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে কথাটা পাওয়া যায় আরও একটু উদারভাবে! সেখানে নট-নর্তক ছাড়াও আরও একটা বৃহৎ উদার শব্দ পাওয়া যায় যাকে বলা হয়েছে রঙ্গোপজীবী, অর্থাৎ রঙ্গমঞ্চকে আশ্রয় করেই যাঁরা জীবিকানির্বাহ করেন। এই রঙ্গোপজীবীদের সঙ্গে কৌটিল্য যাঁদের নাম এক নিঃশ্বাসে উচ্চারণ করেছেন তাঁদের একজনের নাম গণিকাপুত্র এবং অন্য-জন ‘তালাবচর’। ‘গণিকাপুত্র’ কথাটা পরিষ্কার, অর্থাৎ গণিকার ছেলে, আর ‘তালাবচর’ হলেন তাঁরাই, যাঁরা সংগীতের সঙ্গে তাল রেখে নৃত্য বা অভিনয় করেন। কৌটিল্য বলেছেন-গণিকাপুত্র এবং রঙ্গোপজীবীদের রাজা আচার্য হিসেবে নিয়োগ করবেন। তাঁরাই অন্য ‘তালাবচর’দের অভিনয় শিক্ষা এবং নৃত্যশিক্ষা দেবেন। মেয়েরা যারা অভিনয়, নৃত্য, নাট্য, গীত, বাদ্য শিখবে—তাদের মধ্যে প্রধান হল গণিকা, দাসী, রঙ্গোপজীবিনী। তাদেরও শিক্ষাগুরু কিন্তু ওই গণিকাপুত্র অথবা রঙ্গোপজীবী ব্যক্তি। রাজা নিজের রাজকোষ থেকে এঁদের বৃত্তির ব্যবস্থা করে আচার্যের দক্ষিণা মেটাতেন বটে, কিন্তু সময়মতো তাদের ব্যবহার করতেন গুপ্তচরবৃত্তিতে, এমনকী রঙ্গোপজীবী আচার্যের স্ত্রীদেরও তিনি গুপ্তচরবৃত্তি, গুপ্তহত্যা ইত্যাদি গোপন অথচ প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করতেন।
৬
Actresses had ceased being a novelty, but their bodies and their sexuality continued to claim attention. The hedonistic culture of the restore Stuart court was partly responsible, but—as the critics of Elizabethan theatre who decried the sexual attractions of body actors in female dress understood full well-theatre is a fundamentally eroticized enterprise. It is not surprising that actresses (most famously, Nell Gwyn) were sought after as mistresses by members of the royal family and the aristocracy, as well as by playwrights, fellow-actors and assorted gentlemen who came backstage to mingle with them. Although some actresses lived chastely, or at least unremarkably, few escaped the attention of gossipmongers and writers of scurrilous lampoons. Discretion, wealth and fame, far from offering protection, served to incite scandal. Circumspect in the conduct of her private life, Anne Bracegirdle was nevertheless the object of speculation about liaisons with actors and a secret marriage to playwright William Congreve. In the eighteenth century actresses became the subject of gossipy biographies.
–Joanne Lafler
‘‘Theatre and the Female presence”
In the Cambridge History of British Theatre,
Volume 2, 73-74
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে যেটা খুব সহজেই চোখে পড়ে, সেটা হল—গণিকা বা বারবধূদের জন্য যে অর্থ মান, দায়, দণ্ড এবং ভোগের ব্যবস্থা, নট-নর্তক-গায়ক-বাদকদের জন্যও সেই একই ব্যবস্থা। ইতরবিশেষ যা আছে, তা শুধু স্ত্রীজনোচিত ভোগ বা আয়-ব্যয়ের ব্যাপারে। আর একটা লক্ষণীয় ব্যাপার হল—গণিকাপুত্র বা রঙ্গোপজীবী যাঁরা হতেন, তাঁদের স্ত্রীরাও চারিত্রিকভাবে শুদ্ধ বা ভালো থাকতে পারতেন না। হয়তো ভালো থাকার মতো পুরুষেরা এঁদের বিবাহও করতেন না আবার যদি বা বিবাহ করতেন তাঁদের ভালো থাকার উপায় ছিল না। কৌটিল্য উপদেশ দিয়েছেন যাতে স্বয়ং রাজা গণিকাপুত্র, রঙ্গোপজীবী এবং তালাবচরদের স্ত্রীদের ব্যবহার করে স্বকার্যসাধনের জন্য। এই স্বকার্যসাধনে দুষ্য-দুষ্ট ব্যক্তিকে প্রলোভিত করে ভ্রষ্ট করাটা খুব সাধারণ প্রক্রিয়া, বরঞ্চ তাঁদের গুমখুন করা বা তাদের জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনার জন্যই যে প্রধানত ব্যবহার করা উচিত—এটাই কৌটিল্যের নির্দেশ।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র এবং অন্যান্য প্রাচীন গ্রন্থ থেকে যেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, সেটা হল—রঙ্গোপজীবিনীরা যেখানে অভিনয়ের ওপরেই জীবিকানির্বাহ করা ছাড়াও গণিকাবৃত্তির ওপরেও জীবিকানির্বাহ করতেন, রঙ্গোপজীবী নটও সেখানে অভিনয় ছাড়াও তাঁদের স্ত্রীদের ব্যবহার করতেন গণিকাবৃত্তিতে এবং অন্যান্য জঘন্য কর্মে। এককথায় নট-নর্তকেরা তাঁদের স্ত্রীদের ব্যবহার করে জীবিকানির্বাহ করতেন বলেই হয়তো তাঁদের একটা সংজ্ঞা ছিল ‘জায়াজীব’। গণিকা সমাজের সঙ্গে নট-নর্তকদের আন্তরিক মেলামেশা থাকায় অভিনেতাদের স্ত্রীরা যদি বা গণিকা চরিত্রের বৈশিষ্ট্যগুলি প্রথম থেকে আত্মসাৎ নাও করতেন, অভিনেতাদের ব্যক্তিগত নীতিহীনতাই সে কাজটি করে দিত।
অভিনেতাদের ব্যক্তিগত নৈতিকতা কোন ধরনের ছিল তার খুব স্পষ্ট উদাহরণ পাওয়া যাবে রামায়ণ মহাকাব্যে। অভিনেতারা যে নিজের পরিণীতা স্ত্রীদেরও অন্যের ভোগার্থে ছেড়ে দিতেন, অথবা বলা উচিত—অর্থের বিনিময়ে ভাড়া দিতেন, সে-কথা প্রমাণিত হবে স্বয়ং সীতার বক্তব্য থেকে। রামচন্দ্র তখন পিতৃসত্য পালনের জন্য বনগমন করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। কৌশল্যা জননীকে তিনি কোনোক্রমে বোঝাতে পেরেছেন, কিন্তু সীতাকে তিনি কিছুতেই বনগমন থেকে নিবৃত্ত করতে পারছেন না। বনের মধ্যে প্রচুর বিপদ-আপদ এবং আরও কত কারণ দেখিয়ে সীতাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলেন রামচন্দ্র। কিন্তু ভরতের তত্ত্বাবধানে অযোধ্যার রাজধানীতে থাকতে সীতা রাজি হলেন না। তৃতীয় প্রস্থ চেষ্টার পর সীতা এবার একটু ক্ষিপ্তই হয়ে উঠলেন। এমনও বললেন যে, আমার বাবা জনক তোমাকে একটু অন্যরকম মানুষ ভেবেছিলেন কিন্তু তুমি একেবারে পুরুষের বেশে স্ত্রী। এরপরই সেই চরম কথাটা। সীতা বললেন—তুমি তো শৈলূষ নটদের মতো কাজটা করছ। তারাই তো নিজেদের বিবাহিতা স্ত্রীকে অন্যের কাছে রেখে জীবিকা-নির্বাহ করে। কুমারী অবস্থায় তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে। এতদিনের সহবাস-পরিচয় তোমার সঙ্গে। আর সেই স্ত্রীকে তুমি নটের মতো অন্যের হাতে রেখে যেতে চাইছ—শৈলূষ ইব মাং রাম পরেভ্যো দাতুমিচ্ছসি?
এখানে যে শব্দটি নট-অভিনেতা অর্থে প্রয়োগ করা হয়েছে, সে শব্দটা হল ‘শৈলূষ’। ‘অভিনেতা’ কিংবা ‘নট’ অর্থে ‘শৈলূষ’ শব্দটা কিন্তু খুব প্রাচীন। রামায়ণের অযোধ্যাকাণ্ডের এই অংশ কোনোভাবেই খ্রিস্ট-জন্মের পরবর্তী সময়ে লেখা হয়নি। খ্রিস্টীয় চতুর্থ/পঞ্চম শতাব্দীতে এই শব্দের সঙ্গে নট-অভিনেতা অর্থে ‘শৈলূষ’ শব্দের গণনা করেছেন সেই শব্দগুলি খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে বৈয়াকরণ পাণিনিও ব্যবহার করেছেন সর্বপ্রাচীন নটসূত্রকারদের নাম হিসেবে। পাণিনি সূত্র করেছেন—পারাশর্য-শিলালিভ্যাম এবং কমন্দ-কৃশাশ্বাদিনিঃ। পরপর দুটি পাণিনি-সূত্রে উল্লিখিত শিলালী এবং কৃশাশ্ব—দুজনেই পাণিনি-পূর্ব নটসূত্রের লেখক। অর্থাৎ বোঝা যায়—খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীরও বেশ কিছু আগে আচার্যেরা নট-অভিনেতাদের প্রয়োজনে ‘গাইড-বুক’ রচনা করেন। এই প্রাচীন ‘নটসূত্র’-গুলি হারিয়ে গেছে আমাদের দেশ থেকে, কিন্তু শিলালী (শিলালিন) অথবা কৃশাশ্বের এতটাই অবদান এবং প্রভাব ছিল যে তাঁদের নামে অভিনেতৃ সম্প্রদায় তৈরি হয়, যাঁদের বলা হয়েছে ‘শৈলালিন’ এবং ‘কৃশাশ্বিন’।
এর পরে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে অমরসিংহ যখন তাঁর কোষ-গ্রন্থ রচনা করেন, তখন নট-অভিনেতা পর্যায়বাচী শব্দগুলি সংকলন করার সময় লেখেন—
শৈলালিনস্তু শৈলূষা জায়াজীবাকৃশাশ্বিনঃ।
ভরতা ইত্যাপি নটাশ্চারণাস্তু কুশীলবাঃ।
অর্থাৎ ‘নট’ শব্দের প্রতিশব্দগুলি হল—শিলালী সম্প্রদায়ভুক্ত লোকগুলি, শৈলূষ, জায়াজীব, কৃশাশ্বের সম্প্রদায়ভুক্ত কৃশাশ্বীরা, ভরত এবং নট। অমরকোষের প্রসিদ্ধ টীকাকার বৃহস্পতি রায়মুকুট ‘শৈলূষ’ শব্দটির ব্যুৎপত্তি নির্ণয় করবার সময় বলেছেন—’শিলূষ’ নামে এক ঋষির পুত্র অথবা শিষ্যরা হলেন শৈলূষ। এর অর্থ নটের প্রতিশব্দ হিসেবে পুরাতন নটসূত্রকার শিলালী, কৃশাশ্বী এবং শিলূষের সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষেরা নটবৃত্তি গ্রহণ করেছিলেন ভরতের সম্প্রদায় চালু হওয়ার পূর্বে কিন্তু শৈলালী, কৃশাশ্বী শৈলূষ ভরত—এদের সকলের প্রতিশব্দের মধ্যে অমরকোষ যখন ‘জায়াজীব’ কথাটি বসিয়ে দিলেন, তখনই পরিষ্কার হয়ে গেল এঁরা সকলেই যেমন নাট্যজীবী, রঙ্গোপজীবী, তেমনই এঁরা জায়াজীবীও বটে অর্থাৎ এঁরা জায়া বা স্ত্রীদের মাধ্যমেও জীবিকা অর্জন করতেন—জায়রা জীবন্তি জায়াজীবঃ।
নটবৃত্তির কারণে অভিনেতাদের এখানে-সেখানে যেতে হত, এমনকী নিজের দেশ ছেড়ে ভিনদেশেও যেতে হত। এরও প্রমাণ আছে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে। ভিনরাজ্যের নট-নটী, অভিনেতা-অভিনেত্রী, গণিকা কিংবা এই ধরনের মানুষেরা রাজ্যে এলে কৌটিল্য তাদের কাছ থেকে রাজকর নিতে বলেছেন তাদের বিনোদন-বিক্রয়ের মূল্য হিসেবে। এতে বোঝা যায় যে, নাট্যাভিনয় সেকালের অত্যন্ত জনপ্রিয় বিনোদন ছিল বলেই, এমনকী তার জন্য ভিন দেশে রাজকর দেওয়াও পোষাত বলেই নট-নটীদের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করতে হত এবং এই ভ্রমণের সময়েও নট-অভিনেতারা তাঁদের স্ত্রীদের নিয়ে যেতেন সঙ্গে। এ-কথার প্রমাণও পাওয়া যাবে রামায়ণের অযোধ্যা-কাণ্ডেই। রামানুজ ভরত যখন সৈন্যসামন্ত, দল-বল, পাত্র-মিত্র নিয়ে রামচন্দ্রকে বন থেকে ফিরিয়ে আনার মন করলেন, তখন হাজারো পুরবাসীদের মধ্যে বহুতর বৃত্তির মানুষ যেমন তাঁর সঙ্গে চললেন, তেমনই চললেন রঙ্গোপজীবীরাও—রজকাস্তুন্নবায়াশ্চ তথা রঙ্গোপজীবিনঃ। রঙ্গোপজীবীদের কথা উল্লেখ করা সত্ত্বেও পরের শ্লোকে বলা হয়েছে—অযোধ্যায় যত শৈলূষেরা ছিলেন, তাঁরাও অন্যদের সঙ্গে ভরতের অনুযাত্রী দলের পিছন পিছন চললেন নিজের নিজের স্ত্রীদের নিয়ে—শৈলূষাশ্চ সহ স্ত্রীভির্যান্তি কৈবর্তকাস্তথা।
পর পর এই দুটি শ্লোকের মধ্যে ‘রঙ্গোপজীবী’ এবং ‘শৈলূষ’ এই দুই নটশ্রেণির উল্লেখে কয়েকটা প্রশ্ন ওঠে। প্রথমত উল্লেখ করা প্রয়োজন।—যাঁদের সঙ্গে এই রঙ্গোপজীবী এবং শৈলূষেরা একত্র উল্লিখিত হয়েছেন, তাঁরা হলেন সমাজের নিম্নবর্গের কারুজীবী মানুষ, ইংরেজিতে বলা যায় ‘আর্টিজানস’। মণিকার, সূত্রকর্মবিশেষজ্ঞ, পাখি ধরে এমন মানুষ, মায়ূরক, রজক, গন্ধকার, তন্তুবায়, কৈবর্ত, ধূপক, কম্বলকার—এইসব শিল্পীশ্রেণির সঙ্গে রঙ্গোপজীবী এবং শৈলূষদের উল্লেখ করা হয়েছে রামায়ণে। মনু-মহারাজ নটেদের সূক্ষ্মজাতি নির্ণয় করার চেষ্টা করেছেন, সেটা যত না বাস্তব, তার থেকে এটা অনেক স্পষ্ট যে কৈবর্ত, ধূপক, মায়ূরক, তন্তুবায়—এঁরা প্রধানত শূদ্রবর্ণ অথবা ততোধিক কোনো অন্ত্যজ শ্রেণির মধ্যে পড়বেন। আভিধানিক অমরসিংহ তাঁর কোষগ্রন্থেও রঙ্গোপজীবী, শৈলালি, কৃশাশ্বী, শৈলূষ, ভরত, নটদের শূদ্রবর্গের মধ্যেই উল্লেখ করেছেন এবং সেখানেও আগে-পরে আছেন পূর্বোক্ত ধরনের শিল্পীশ্রেণির মানুষেরাই। তার মানে খ্রিস্টপূর্ব কাল থেকে অন্তত চতুর্থ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্তও এঁদের শ্রেণিবিভাগ ছিল এইরকম অর্থাৎ শূদ্রবর্গের মধ্যেই এঁদের অন্তর্ভুক্তি ছিল।
দ্বিতীয় প্রশ্ন—উপরোক্ত রামায়ণ-শ্লোকে একবার রঙ্গোপজীবী এবং আর একবার রঙ্গোপজীবী এবং আর একবার ‘শৈলুষ’ শব্দটি উল্লিখিত হওয়ায় রামায়ণের প্রাচীন টীকা ‘অমৃতকতক’ যিনি সম্পাদনা করেছেন, সেই বিদ্বান বরদাচার্য মহোদয় টিপ্পনী করেছেন—’রঙ্গোপজীবী’দের কথা উল্লেখ করার পরেও আবার যে অন্য শ্লোকে ‘শৈলূষ’ কথাটির উচ্চারণ হল, তার কারণ হয়তো রঙ্গোপজীবীরা শৈলূষদের থেকে পৃথক বৈশিষ্ট্যযুক্ত অন্য কোনো অভিনেত্রী-গোষ্ঠী। এই প্রসঙ্গে আমাদের নিবেদন হল—প্রথমত রামায়ণের অন্য সংস্করণগুলিতে পৃথকভাবে ‘রঙ্গোপজীবিনঃ’ পাঠ পাওয়া যায় না। পূর্বোক্ত শ্লোকের পাঠ এইরকম—
রজকাস্তুন্নবায়াশ্চ গ্রামঘোষমহত্তরাঃ।
শৈলূষাশ্চ সহ স্ত্রীভির্যান্তি কৈবর্তকাস্তথা।
এখানে বরদাচার্যের সংস্করণস্থিত রঙ্গোপজীবীর স্থান নিয়েছে ‘গ্রামঘোষ-মহত্তরাঃ’। ‘রঙ্গোপজীবিনঃ’ শব্দটি পূর্বশ্লোকেও নেই, যা বরদাচার্যে আছে। রামায়ণের অতিপ্রামাণ্য তিনটি প্রাচীন টীকাতেও ‘রঙ্গোপজীবিনঃ’ পাঠটি নেই, তাঁরা শৈলূষ শব্দের ওপরেই টীকা রচনা করেছেন। এদের মধ্যে আবার তিলকটীকা ‘গ্রামষোষমহাত্তরাঃ’ শব্দটিকে ‘শৈলূষ’-শব্দের বিশেষণ হিসেবে ব্যাখ্যা করে বলেছে—গ্রাম এবং আভীর পল্লীর মধ্যে মহত্তর সম্মানে ভূষিত শৈলূষেরা। বেশ বোঝা যায়—নাট্যশিল্পের প্রতি অধিকতর শ্রদ্ধাতেই তিলক-টীকাকার গ্রামে এবং আভীর পল্লীর মধ্যে বসতিকারী শৈলূষ-নটদের শ্রেষ্ঠতর বলেছেন। অন্যদিকে রামায়ণের শিরোমণি টীকা এই শ্রদ্ধার মধ্যেও যাননি, আবার শৈলূষদের স্ত্রী-সঙ্গী হয়ে অনুযাত্রার মধ্যেও কিছু দোষ দেখেননি। কিন্তু তীক্ষ্নদ্রষ্টা গোবিন্দরাজ শৈলূষ নটেদের ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যটুকু ঠিক খেয়াল করেছেন। আরও খেয়াল করেছেন এইজন্য যে, হাজারো জাতীয় মানুষের মধ্যে কৈবর্ত, মণিকার, কম্বলকার, রজক, তুন্নবায় কেউ তাঁদের স্ত্রীদের সঙ্গে নিচ্ছেন না, কিন্তু শৈলূষদের কথা উঠতেই ক্রৌঞ্চবিরহী কবি যেন সরল মনে বলেছেন—আর শৈলূষ-নটরা চললেন তাঁদের স্ত্রীদের সঙ্গে নিয়ে—শৈলূষাশ্চ সহ স্ত্রীভির্যান্তি কৈবর্তকাস্তথা। টীকাকার গোবিন্দরাজ বুঝিয়ে দিলেন—সহজ কবির কথাটা অত সরল নয়। নাটকের বিভিন্ন নাম-ভূমিকায় যাঁরা অভিনয় করেন, তাঁরা যে স্ত্রীদের ব্যবহার বা অপব্যবহার করে কিছু অর্থ উপার্জনের কথা মন থেকে দূরে রাখেননি। গোবিন্দরাজ এই প্রসঙ্গে আভিধানিক অমরসিংহের শৈলূষ-প্রতিশব্দ ‘জায়াজীব’ কথাটিও প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
একটা প্রশ্ন তো অবশ্যই আসবে যে, নট-গণিকাদের আর্থিক অবস্থা কি তাহলে খুব খারাপ ছিল? সেই রামায়ণের যুগ থেকে অমরসিংহের কাল পর্যন্ত, অর্থাৎ গুপ্তযুগ পর্যন্ত? নাকি এই রঙ্গোপজীবী মানুষগুলির নৈতিক অবস্থান ভালো ছিল না বলেই সামাজিক অবস্থানটাও নিম্নস্তরে চলে গেছে? প্রথমটা ঠিক মনে হয় না। কারণ গণিকা কিংবা নট-সম্প্রদায়ে পুরুষদের চাহিদা কম ছিল না এবং রাজা-রাজড়া এবং নগরের ধনী সম্প্রদায় যেহেতু নাট্যকলার অনুরাগী ছিলেন, তাই তাঁদের উদবৃত্ত অর্থের ভাগ রঙ্গোপজীবীরা অবশ্যই পেতেন। এটাও মনে রাখতে হবে যে, নটী-গণিকারা এবং নট-তালাবচরেরা তাঁদের শিক্ষাকালীন সময়েও রাজনির্ধারিত বৃত্তি পেতেন এবং অনেক ক্ষেত্রেই গণিকাপুত্র এবং রঙ্গোপজীবী জন অভিনয়-নৃত্যশিক্ষায় আচার্য হিসেবে নিযুক্ত হতেন বলে অর্থের অভাব তাঁদের খুব ছিল না। কৌটিল্য লিখেছেন—নট, নর্তক, গায়ক এবং বাদকেরা বিদেশে গিয়ে তাঁদের প্রদর্শিত অভিনয়ের জন্য প্রত্যেক প্রদর্শনী বাবদ রাজাকে পাঁচ পণ কর দেবেন।
আমাদের বক্তব্য, যাঁরা ভিনদেশে গিয়ে রাজকর দিয়ে প্রদর্শনী করতেন তাঁদের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ ছিল না। নিতান্ত যশঃপ্রার্থী হয়ে যদি নাট্যশিল্পের কল্যাণেও এমন ব্যবহার করা হত, তবু বলতে হবে নট-নর্তক-গায়ক-বাদকেরা খুব অভাবী মানুষ ছিলেন না। আর নটী-গণিকারা তো ননই। অভিনয় ছাড়াও তাঁদের অর্থ উপার্জনের অন্য ব্যবস্থা ছিল এবং তখনকার দিনে তাঁদের সামাজিক সম্মানও কিছু কম ছিল না। সম্মান মানে ঠিক সেই অর্থে নয়, কিন্তু শহরের ধনী-মানী-গুণী ব্যক্তিদের কাছে তাঁদের মূল্য ছিল, বিনিময়মূল্যও ছিল। এঁদের আর্থিক অবস্থান বোঝাতে গেলে পৃথক প্রবন্ধের প্রয়োজন হবে। অতএব সে প্রসঙ্গে যাচ্ছি না। তবে অর্থের প্রসঙ্গে এই কথাটাও বলা দরকার যে, নাটক এবং অভিনয় যেহেতু নগরের ধনী-মানী-গুণীদের বিলাস ছিল, অতএব নগরবাসী নট-নর্তক-গায়ক-বাদক বা রূপজীবিনীদের অর্থাভাব কিছু ছিল না। যে-কোনো একটা উৎসবের হেতু উপস্থিত হতেই নট-নটীদের চাহিদা আরও বাড়াত।
মহাভারতে নট-নর্তক অভিনেতাদের নগরের শোভা বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে—একটা নগর রাজধানীর মধ্যে নট-নর্তক, মল্ল আর মায়াবী ম্যাজিশিয়ানদের থাকার ব্যবস্থা করলেই তবে পুরশোভা তৈরি হয়, নগরবাসীরাও আনন্দিত হন। নাটক, নৃত্য-গীতের কোনো প্রাচীন আসরে নট এবং গণিকারা থাকবেন—এটা তো স্বাভাবিক, কারণ সেখানে মনোরঞ্জনের ব্যাপার থাকে, অভিনয় আর নৃত্য-গীত-বাদ্যেরও ব্যাপার থাকে। কোথাও এঁরা থাকতেন নিতান্ত প্রয়োজনবশত। যেমন মহাভারতের উদ্যোগপর্বে, যেখানে উভয়পক্ষেই যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হচ্ছে, সেখানে দুই সেনাবাহিনীর পুচ্ছভাগেই যান, বাহন, চিকিৎসক, শিল্পী—এদের সঙ্গে বেশযুবতীদেরও দেখা যাবে। এটা বোঝা যায় যে, এখানে বেশ যুবতীরা নাটক অথবা নৃত্যগীতের প্ররোচনায় আসেননি, বরঞ্চ সৈন্যবাহিনীর মানসিক এবং দৈহিক চাপ স্তিমিত করাটাই তাঁদের অন্যতম উদ্দেশ্য। কিন্তু যেখানে রামচন্দ্রের যৌবরাজ্যের প্রসঙ্গে উৎসবে মেতে উঠল অযোধ্যার জনগণ, সেখানে বশিষ্ঠ-বামদেবের মতো ঋষিরা সচিবদের আদেশ করছেন—আপনারা পতাকা উড়িয়ে দিন আকাশে, জলসিক্ত করুন রাজপথ, তালাবচরগণ এবং নটীগণিকারা সালংকারে অবস্থান করুক রাজবাড়ির দ্বিতীয় কক্ষে। এই দ্বিতীয় কক্ষ কিন্তু রাজন্তঃপুরের দ্বিতীয় কক্ষ, যার জায়গা রামচন্দ্রের অভিষেক স্থানের পরেই। প্রথম কক্ষে ব্রাহ্মণেরা বসবেন, দ্বিতীয় কক্ষেই নট-নর্তক-গায়ক তালাবচর এবং নটী-গণিকাদের অবস্থান। সম্মানের দিক থেকে অথবা নাট্য-নৃত্য-বিনোদনের গুরুত্বের দিক থেকে ব্রাহ্মণদের বসতিকক্ষের পরেই নট-তালাবচর এবং গণিকাদের অবস্থান সে যুগের শিল্প-চেতনার পরিচয় যেমন বহন করে, তেমনই নটগণিকাদের আর্থসামাজিক স্বাচ্ছন্দ্যেরও আভাস দেয়।
অতএব ধরেই নেওয়া যায়—নাট্যজগতের অভিনেতা নট এবং অভিনেত্রী গণিকাদের খুব একটা অর্থাভাব ছিল না, তাহলে নটদের এই ভাবনাটা কোথা থেকে আসত? কেনই বা তাঁরা স্ত্রীদের ব্যবহার করে রুজি-রোজগার করতেন অথবা বাড়তি রোজগার করতেন? এই প্রশ্নের উত্তর কঠিন, তবু এর উত্তর নিহিত আছে তৎকালীন দিনের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মানসিকতার মধ্যেই। প্রথমত বোঝা দরকার যে, আমাদের পূর্ববর্তী আলোচনা থেকে তিনটি নির্দিষ্ট শ্রেণি পাওয়া গেল—নট, গণিকা এবং নটের স্ত্রী। নটদের মধ্যে আমরা রঙ্গোপজীবী, নর্তক, গায়ক, শৈলূষ, শিলালী, কৃশাশ্বী এবং তালাবচর সবাইকেই ধরলাম। স্ত্রীলোকের মধ্যে ধরলাম গণিকাদের, যাঁরা অভিনেত্রী, নর্তকী সবই হতেন একাধারে। কিন্তু নটের স্ত্রী যিনি হতেন, তাঁর মধ্যে বেশ কতকগুলি অসম্ভাবনা আছে, অর্থাৎ তিনি প্রথমত নর্তকী বা নটী নাও হতে পারেন, দ্বিতীয়ত তিনি গণিকা নাও হতে পারেন।
সম্ভাবনার দিক থেকে বিচার করলে বলতে হয়—উপরের দুটি কল্প অধিকাংশ নটের ক্ষেত্রেই অসম্ভাবিত ছিল না, হয়তো বা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাঁরা স্ত্রী সংগ্রহ করতেন নাট্যনৃত্যে পটীয়সী নটী বা গণিকাদের। এ-সব ক্ষেত্রে শিল্পকলার অতিরিক্ত যে রূপজীবিত্ব—সেটা পূর্বাভ্যস্ত থাকায় বাড়তি রোজগার করার ক্ষেত্রে নট-অভিনেতারা তাদের কাজে লাগাতে কখনোই দ্বিধাবোধ করতেন না। কিন্তু যে-সব ক্ষেত্রে নটের স্ত্রী পূর্বেই গণিকা বা নর্তকী না হতেন, সেখানেও কিন্তু নটেরা খুব ভালো ছিলেন না। আমাদের ধারণা—তাঁরা নিজের স্ত্রীদের এমনভাবেই আপন শাসনে তৈরি করে নিতেন যাতে তাঁরা নটী এবং গণিকাবৃত্তিতে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য হতেন। বস্তুত নটেদের ব্যক্তিগত চরিত্রই তাঁদের স্ত্রীচরিত্র কলুষিত করে দিত।
ইতিহাস-পুরাণ-অর্থশাস্ত্র এবং নাট্যশাস্ত্র—সর্বত্রই নাটক, নৃত্য এবং তদবিষয়িনী শিল্পকলার অনেক গুণগান আছে। পুরাতন নাট্যকারেরা—ভাস, কালিদাস, শূদ্রক, বিশাখদত্তরা যে-সব অসাধারণ নাটক লিখেছেন, সে-সব জায়গাতেও নট-নটী-নর্তকীদের নানা প্রশংসা আছে তাঁদের শিল্পাভিনয় কৌশলের সূত্র ধরেই। কিন্তু নট-নটী-নর্তকীদের ব্যক্তিগত চরিত্রের ওপর প্রাচীনদের খুব একটা বিশ্বাস ছিল না। মহাভারত-রামায়ণের উদার মহাকাব্যিক পরিবেশে নট-নটীদের আমরা নগর-শহরের মধ্যেই অবস্থিতি করতে দেখেছি, কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতেই মহামতি কৌটিল্য নট-নটী-গায়ক-বাদকদের শহরের মধ্যে রাখতে চাননি। তিনি তাঁদের স্থান নির্দেশ করছেন নগরের প্রান্তদেশে, যাতে নগরের নাগরিকদের তাঁরা কলুষিত করতে না পারেন অথবা তাঁদের সময় নষ্ট না করেন। কৌটিল্য এই সমাজটার নাম দিয়েছেন ‘বাহিরিক’, যাঁদের মধ্যে আছেন—দ্যূতকার (পাশা-খেলোয়াড়) ধূর্ত-বঞ্চক-প্রতারক, নট-নর্তক এঁরা সবাই। কৌটিল্য বলেছেন—নট, নর্তক ধূর্তেরা নগর এবং জনপদের উপঘাতক অর্থাৎ এরা পুরবাসী এবং জনপদবাসীদের কাজের বিনাশ ঘটায়। যদি এইসব লোককে আশ্রয় দিতেই হয় তবে রাজা জনপদের সীমান্তে তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করবেন এবং এই থাকাটুকুর জন্যই তাঁদের কাছ থেকে সবরকম কর আদায় করবেন। নগর-জনপদের বাইরে থাকবেন বলেই এঁরা ‘বাহিরিক’।
লক্ষণীয়, এই বাহিরিক’দের মধ্যে কিন্তু গণিকা, নটী কিংবা নর্তকীরা নেই। কৌটিল্যের আমলের অনেক আগে থেকেই এঁদের সকলের নিবাসভূমি রাষ্ট্রের প্রাণকেন্দ্র শহরগুলিতেই। কিন্তু নট-শৈলূষদের সামাজিক অবস্থান এদের থেকে একটু আলাদা। গণিকার বৃত্তি খুব স্পষ্ট। তাঁরা রূপজীবী, কিন্তু নটের বৃত্তি আরও খারাপ, তাঁরা জায়াজীবী। কৌটিল্য তাঁদের ‘বাহিরিক’ বলেছেন নাগরিক সুস্থতা রাখার জন্য, কিন্তু কৌটিল্যের সময়ে যা চলেছে, আমরা দেখেছি নবম/দশম খ্রিস্টাব্দে এসেও নট সম্বন্ধে সেই ধারণা পরিবর্তিত হয়নি। এই সময়ে প্রসিদ্ধ কাশ্মীরী নৈয়ায়িক জয়ন্তভট্ট, তাঁর ন্যায়মঞ্জরী শেষ করার পর কোনো মুক্ত অবসরে, ‘আগমডম্বর’ নামের একখানি নাটক লিখেছিলেন। গম্ভীর নৈয়ায়িক নাটক লেখার বিলাসটুকু আত্মসাৎ করেছেন, কিন্তু রঙ্গমঞ্চের অভিনেতা নটকে তিনি কোনোমতেই সহ্য করতে পারেননি। অন্য কোনো নাটকেরই স্বয়ং অভিনেতা নট সম্বন্ধে এমন কটূক্তি কেউ করেননি যেমন জয়ন্তভট্ট করেছেন। ক্ষুরধার এই নৈয়ায়িক কাউকেই তেমন ছেড়ে কথা বলেননি, কিন্তু নিজে নাটক লিখে সেই নাটকেরই প্রস্তাবনায় অভিনেতা নটকে গালাগালি দেওয়ার ঘটনা হয়তো সেই প্রথম এবং সেই শেষ। জয়ন্ত লিখেছেন—নটেদের পেশাটাই হল জঘন্য, এটা যেমন উৎকট, তেমনই অসম্ভব কপট এই পেশা। নিজের পরিবার-পরিজন-কুটুম্ব পোষণ করার কৌশল ছাড়া নটবৃত্তির মধ্যে আর কিছু নেই।
জয়ন্তভট্টের এই কটূক্তিতে শিল্পকলা হিসেবে নাটকের ওপর অবিচার হল কিনা তা বলা কঠিন, কেননা জয়ন্ত নিজে নাটক লিখেছেন; কিন্তু নাটক পছন্দ করলেও নাট্যকার যে অভিনেতা-নটদের চরিত্র পছন্দ করেন না, সেটা বেশ প্রমাণ হয়। পছন্দ না করার কারণ হয়তো লুকিয়ে আছে ওই দুটি শব্দের মধ্যে ‘উৎকট’ এবং ‘কপট’। শৈলূষ-নটেরা বিভিন্ন নাটকীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন—এর মধ্যেও উৎকট ব্যাপারও কিছু নেই, কপটতাও নেই। কিন্তু ওই যে তাঁরা নিজেদের স্ত্রীদের নিযুক্ত করতেন গণিকাবৃত্তিতে, এটাই হয়তো গম্ভীর নৈয়ায়িকের ক্রোধের কারণ হয়েছে। শৈলূষ, নটেরা নিজেদের স্ত্রীদের যে জেনে-বুঝে পুরুষচারিতায় নিয়োগ করতেন, সে-কথা দেড়শ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ষোড়শ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত একইভাবে সত্য। প্রমাণ হিসেবে প্রথমে বলতে হবে মহাভাষ্যকার পতঞ্জলির কথা।
পতঞ্জলির মতো অসামান্য বৈয়াকরণ ভূ-ভারতে নেই। পুষ্যমিত্র শুঙ্গের আমলে তিনি তাঁর মহাভাষ্য লিখেছেন। স্বরব্যঞ্জন বর্ণের বিষয়ে একটি পাণিনি সূত্রের ওপর আলোচনা করার সময় পতঞ্জলি বলছিলেন—ব্যঞ্জনবর্ণগুলি নিতান্তই পরাধীন; অ, আ, ই, ঈ ইত্যাদি স্বরবর্ণরাশির যখন যার সঙ্গে ইচ্ছে, ব্যঞ্জনবর্ণ তারই অধীনতা স্বীকার করে। এই প্রসঙ্গে একেবারে বাস্তব একটি উপমা ব্যবহার করলেন পতঞ্জলি। বললেন—ব্যঞ্জনবর্ণগুলি হল নটভার্যাদের মতো—ব্যঞ্জনানি হি নটভার্যাবদ ভবন্তি। পতঞ্জলি তখনও যা দেখেছেন তাঁর সমাজে, সেই অভিজ্ঞতাই যেন পরিষ্কার করে বললেন—অভিনয় সাঙ্গ হওয়ার পর অভিনেতা-নটের স্ত্রীদের যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে—তুমি কার ঘরনী গো? তখন তারা বলে—কেন, তোমারই তো, আমি তোমারই। পতঞ্জলি বললেন—ব্যঞ্জনবর্ণের ব্যবহারও এইরকম নট-স্ত্রীদের মতো, যে স্বরবর্ণ কাছে এল, সে তারই হয়ে যায় সাময়িকভাবে—এবং ব্যঞ্জনান্যপি যস্য যস্যাচঃ কার্যমুচ্যতে তং তং ভজন্তে।
নট-শৈলূষদের এই ব্যাধি যে কী আকার ধারণ করেছিল এবং স্ত্রীদের দিয়ে বেশ্যাবৃত্তি করানোটা যে নটদের পক্ষে কতটা স্বাভাবিক ছিল, সেটা আরও দৃঢ়ভাবে বোঝা যায় তৎকালীন দিনের আইনি পদ্ধতিতে। খ্রিস্টীয় প্রথম/দ্বিতীয় শতাব্দীতে লেখা যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতা পুরোপুরি আইনের বই। ভারতবর্ষে বহুকাল আইনের বই হিসেবে এটাই চলেছে, এমনকী ব্রিটিশ আমলেও হিন্দু আইন নতুন করে তৈরি করার সময় যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতা এবং তার বিখ্যাত টীকা মিতাক্ষরার সাহায্য নেওয়া হয়েছে। যাই হোক, এ-হেন আইনের বইতে পরিষ্কারভাবে বলা হচ্ছে—গোপ, সুরাকার, নাট্যজীবী শৈলূষ, রজক এবং ব্যাধের স্ত্রীরা যদি কারও কাছ থেকে টাকা-পয়সা বা অন্য কিছু ধার করে, তবে সে ধার শোধ করার দায় তাদের স্বামীদের। এরা যেহেতু স্ত্রীর সাহায্যেই নিজেদের জীবন এবং জীবিকানির্বাহ করে অতএব স্ত্রীদের ধার শোধ দেওয়ার দায় এদেরই।
এ-কথা অবশ্যই মনে হতে পারে যে, গোপালক গোপ জাতি, সুরাকার, নাট্যজীবী, রজক বা ব্যাধের আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো ছিল না বলেই এরা স্ত্রীদের অন্য পুরুষচারিতায় নিয়োগ করত। কিন্তু আমাদের ধারণা—আর্থিক অবস্থার থেকেও যেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সেটা বোধহয় এই জাতীয় সমাজের নৈতিক শিথিলতা এবং সমাজ ব্যবহারের শিথিলতা। হয়তো এই শিথিলতা আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণেও তৈরি হয়ে থাকতে পারে, কারণ আর্টিজান বা শিল্পীশ্রেণির আর্থিক অস্বচ্ছলতার কথা ইতিহাস বলে থাকে। কিন্তু একইসঙ্গে এইসব জন-গোষ্ঠীর সামাজিক বন্ধনের শিথিলতার কথা সমসাময়িক বিভিন্ন উপাদান থেকেই এতই দৃঢ়ভাবে প্রমাণ করা যায় যে, সমাজের আর্থিক বিন্যাসের চেয়েও সামাজিক নীতিবোধের শিথিলতাই এখানে প্রধানত বিবেচ্য।
কথাটা এইজন্য আমরা বলছি যে, খ্রিস্টপূর্ব প্রথম/দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে নবম/দশম কিংবা দ্বাদশ/ত্রয়োদশ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পূর্বোক্ত জনগোষ্ঠীগুলির আর্থ-সামাজিক বিন্যাসে তারতম্য ঘটেছে; কিন্তু যে শিথিলতার কথা আমরা বলেছি, সেই শিথিলতা অপরিবর্তিত রয়েছে খ্রিস্টপূর্ব কাল থেকে ত্রয়োদশ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। আর একটা মাত্র উদাহরণ দিয়ে আমরা বুঝিয়ে দেব যে, সেকালের গণিকাশ্রেণির পরিচয় নটী-নর্তকী হিসেবে অনেক স্পষ্ট, কিন্তু নট-অভিনেতারা বংশ বংশ ধরে অভিনয়ের সঙ্গে নিজেদের স্ত্রীদের অন্যভাবে ব্যবহার করে আসছেন। সুদূর অতীতে সেই মহাভাষ্য রচনার সময় নট-অভিনেতাদের যে চরিত্র ছিল খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ/ষোড়শ শতকেও সেই চিত্র ভেসে উঠেছে সেকশুভোদয়া নামক গ্রন্থটিতে।
সেকশুভোদয়া গ্রন্থটি মোটামুটি ষোড়শ খ্রিস্টাব্দের লেখা হলেও গ্রন্থবর্ণিত চরিত্রগুলি সব দ্বাদশ/ত্রয়োদশ খ্রিস্টাব্দের। তার মানে দ্বাদশ/ত্রয়োদশ খ্রিস্টাব্দে যে সামাজিক অবস্থা ছিল গ্রন্থলেখক ষোড়শ খ্রিস্টাব্দেও পরিবর্তন ঘটাতে চাননি। এখানে এক নটীর পরিচয় পাই, তার নাম বিদ্যুৎপ্রভা। সে গঙ্গোনটের পুত্রবধূ এবং তার স্বামীর নাম জয়নট। সর্বতোভাবে এক নট-পরিবারের বধূ হয়ে এসেছে বিদ্যুৎপ্রভা এবং তার নৃত্য-গীতের ক্ষমতা এতটাই যে, তার গানের সুর শুনে আনমনা এক বণিক-বধূ কলসী বাদ দিয়ে তার বাচ্চা ছেলের গলায় দড়ি বেঁধে কুয়োয় নামিয়ে দিয়েছিল। এমনিতে বিদ্যুৎপ্রভা যথেষ্টই প্রতিভাময়ী। গৌড়েশ্বর লক্ষ্মণসেন এই নর্তকীকে খাতির করেন রীতিমতো। কিন্তু প্রতিভার সঙ্গে এই নটী-নায়িকার ছল-চাতুরীরও অভাব নেই। স্বয়ং রাজমন্ত্রীকেও সে দেহোপভোগের মিথ্যা অপবাদ দিয়ে রাজসভায় লাঞ্ছিত করে। এমনও বলে যে, যথেচ্ছ রমণের বিনিময়ে সে পাঁচ শত মুদ্রা চেয়েছিল, কিন্তু মন্ত্রী তাকে মাত্র কুড়িটি মুদ্রা নিয়ে সন্তুষ্ট হতে বলেছিল। বিদ্যুৎপ্রভা লক্ষ্মণসেনকে বলে—সে এক পয়সাও নেয়নি এবং এই সমস্ত ঘটনা সে নিজের শ্বশুর-শাশুড়িকেও জানিয়ে রেখেছে।
আমরা বলতে চাই—নটী-নর্তকী বিদ্যুৎপ্রভা যা করছে, যেভাবে সে লোক ঠকাচ্ছে, সে-কথা তার শ্বশুর-শাশুড়ি এবং স্বামীর জানা আছে। অন্য একটি কাহিনিতে বিদ্যুৎপ্রভা তন্তুবায় শ্রেণির চার-চারটি নিরীহ ব্যক্তির বিরুদ্ধে রাজদরবারে নালিশ করছে এবং সেখানে আগে-পরে তার শ্বশুর গঙ্গোনট এবং তার স্বামী জয়নট প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করছে। নিজের বৃত্তি নিয়ে সে কোনো সংকোচও বোধ করে না। রাজসভার নৃত্য-গীতে সে যেমন দক্ষ শিল্পী তেমনই অন্য পুরুষচারিতার কালে সে নির্দ্বিধায় নিজেকে গণিকার পর্যায়ভুক্ত করে নীতিশাস্ত্রের শ্লোক আউড়ে বলে—গণিকার আবার লজ্জা! লজ্জা থাকলে সে গণিকার জীবন শেষ, ঠিক যেমন নির্লজ্জ হলে কুলবধূর জীবন—সলজ্জা গণিকা নষ্টা নির্লজ্জাশ্চ কুলস্ত্রিয়ঃ। বিদ্যুৎপ্রভার মুখে কোনো কথা আটকায় না, এমনকী গ্রন্থের নায়ক শেখ জালাল—যাঁর বুদ্ধি এবং বিদ্যাবত্তার কদর করেন সকলে, সেই শেখকেও নিজের প্রগলভ আচরণে বিদ্যুৎপ্রভা রীতিমত ঠকিয়ে দেয়। নট-পরিবারের বধূ হওয়া সত্ত্বেও প্রকাশ্য পথের মধ্যে সে নিজের শারীরিক বৈভব প্রকট করতে লজ্জা পায় না, অথচ চতুর বুদ্ধিদীপ্ত আলাপনেও তার জুড়ি নেই। সেকশুভোদয়ার আরম্ভ-কাহিনিতেই নর্তকী বিদুৎপ্রভার আবির্ভাব ঘটেছে এবং শেষ কাহিনিতেও সে সফল অংশীদার। গঙ্গোনটের পুত্রবধূ এবং জয়নটের স্ত্রী বিদ্যুৎপ্রভার প্রধান পরিচয়—সে নটী, কিন্তু শ্বশুর-শাশুড়ি এবং স্বামীর অনুমোদনেই সে গণিকাবৃত্তির অংশীদার এবং তার স্বামী-শ্বশুরও আপন নট-জীবিকা ছাড়াও গৃহবধূর কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে।
৭
‘‘Has anybody ever seen a drama critic in the daytime? Of course not. They come out after dark, up to no good.”
– P.G. Wodehouse
আমরা স্বর্গরাজ্যের নাট্য-নাটকের অভিনয়ে স্বর্গবেশ্যা অপ্সরাদের অংশগ্রহণ করতে দেখেছি এবং মর্ত্যভূমির নাটকে সেইকাল এইকাল পর্যন্ত ধ্রুপদী সংস্কৃত নাটকে নট-নায়কদের সামাজিক অবস্থান বিচার করলে দেখা যাবে যে, তাঁরাও গণিকা-নায়িকাদের পুরুষ সংস্করণ। নাট্যশিল্পের জনপ্রিয়তা এবং নাট্যকারের সম্মোহনের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের চরিত্র নিয়ে ভারতবর্ষের রক্ষণশীল সমাজ একটু-আধটু মাথা ঘামিয়েছেন বটে, কিন্তু তাঁদের অভিনয়-কুশলতার মর্যাদা দিতেও ভোলেননি তাঁরা। কৌটিল্য নটী-নটদের যেখানেই অবস্থান নির্দেশ করুন না কেন, রামায়ণ কিংবা মহাভারতে অথবা বৌদ্ধ গ্রন্থগুলিতে নট-নটী অভিনেতা-অভিনেত্রীরা কিন্তু পুর-নগরীর শোভা। এবং একইসঙ্গে জানাতে চাই যে, অতি প্রাচীন যুগে—একেবারে বাজসনেয়ী সংহিতা অথবা তৈত্তিরীয় সংহিতার যুগে (আনুমানিক খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ/সপ্তম শতাব্দী) নট-নটীদের আর্থিক অবস্থা যদি বা খারাপ থেকেও থাকে, ভারতবর্ষে মৌর্য যুগের কাল থেকেই যে উন্নত নগরায়ণ ঘটেছে, তাতে রঙ্গোপজীবীদের আর্থিক অবস্থা ক্রমান্বয়ে উন্নত হয়েছে, কিন্তু নট-নটীদের স্বভাবটা ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্তও পাল্টায়নি।
আর্থিক অবস্থানের কথায় নগরায়ণের কথাটা ভীষণভাবে আসে। বিশেষত কামসূত্রকার বাৎস্যায়ন নাগরক-বৃত্ত বর্ণনা করার সময় এটা বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, দেশ-কাল-নির্বিশেষে প্রত্যেক সমৃদ্ধ রাজ্যেই এমন একটা শ্রেণি তৈরি হয়, যাঁদের হাতে উদবৃত্ত অর্থ থাকে এবং তাঁরাই শহরের বাবুশ্রেণি, বাৎস্যায়নের ভাষায় ‘নাগরক’। নাগরকের কোনো জাত নেই। যিনি যে বৃত্তিতে আছেন, সেই বৃত্তি থেকেই উপার্জিত অর্থ যদি উদবৃত্তের সম্ভাবনা তৈরি করে, তার ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র সকলের পক্ষেই নাগরক-চরিত্র অনুসরণ করা সম্ভব, অন্তত বাৎস্যায়নের তাই মত। এই নাগরকবৃত্তের মধ্যে যে বিলাসিতা আছে, আমরা তার অনুপুঙ্খ বিবরণে যাচ্ছি না। কিন্তু মৌর্য যুগ থেকে গুপ্ত যুগ পর্যন্ত ভারতবর্ষে যে সার্থক নগরায়ণ ঘটেছিল, তাতে রাজা-রাজড়া থেকে আরম্ভ করে শহরের ধনী-মানী লোকের মধ্যে নাগরক বিলাসী চরিত্রের সম্প্রসারণ ঘটেছিল এবং সে নাগরক ভাবনার মধ্যে নাট্য-নাটক, নৃত্য-গীত-বাদ্য একেবারে অপরিহার্য হওয়ায় এই শৈলূষ-কুশীলব এবং নট-গণিকারাও নগর সভ্যতার অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে পড়েছিল।
এটা মানতেই হবে যে, নগর সভ্যতার অঙ্গ হয়ে ওঠার ফলেই নট-নটী গণিকাদের হাতে অর্থের অভাব ছিল না এবং হয়তো অতিরিক্ত অর্থই তাঁদের স্বভাব খানিকটা নষ্ট করে রেখেছিল। তবে একইসঙ্গে এটাও মানতে হবে যে, নট-নটীর এই চারিত্রিক অবস্থান অথবা স্বভাব-দোষ বলে যে বলছি, সেটা ভীষণ রকমের আপেক্ষিক। বিশেষত তাঁদের জীবনযাত্রার ক্ষেত্রেও অদ্ভুত একটা ‘ডিকটমি’ আছে। যে নট-নটীরা, অভিনেতা-অভিনেত্রীরা অভিনয়ের সূত্রে মানুষের অকুণ্ঠ প্রশংসার পাত্র হয়ে উঠেছেন, সেই মানুষগুলিরই ব্যক্তিজীবনের ইচ্ছা-অভিলাষ-আকাঙ্ক্ষাগুলি মানুষ কিন্তু ভালো চোখে দেখে না, এমনকি নিন্দাও করে। তার ওপরে তথাকথিত চারিত্রিক দোষের ক্ষেত্রটাও ভীষণ আপেক্ষিক। বৃত্তির কারণেই স্ত্রী-পুরুষের অঙ্গস্পর্শের সুযোগ এখানে আপনিই আসে আর অভিনয়ের মধ্যেও শুধু যান্ত্রিকতা থাকলেও চলে না। শৃঙ্গার রসের অভিব্যক্তির জন্য যান্ত্রিকতার মধ্যেও আপ্লুতি চাই। ফলে শৃঙ্গার-বস্তু রূপায়িত করার জন্য এই অনাসক্ত আসক্তি, এটা নীতিগতভাবে পরম প্রত্যাশিত হলেও বাস্তবে নট-নটী এবং বিভিন্ন পার্শ্বচরিত্রের মনের মধ্যে অহরহ এক নৈকট্য তৈরি করে। এই নৈকট্য যে সরসতা তৈরি করে তাতে একদিকে যেমন অভিনয় প্রক্রিয়ায় সরসতা তৈরি করে তেমনই কখনো কখনো ব্যক্তিজীবনেও তার প্রভাব এসে পড়ে। আমরা সাধারণ মানুষ দূর থেকে এই নৈকট্য ব্যাখ্যা করি। অপব্যাখ্যা করি, দুর্ব্যাখ্যাও করি।