পৌরাণিক আড্ডাখানা
প্রাচীনকালের রীতিনীতির সঙ্গে যাঁদের কিঞ্চিৎ পরিচয় আছে তাঁরা মনু-মহারাজকে চেনেন না—এ হতে পারে না। মানবজীবনের সম্ভাব্য-অসম্ভাব্য সমস্ত বিষয়েই নির্দিষ্ট বচন দেওয়া মনু-মহারাজের ব্যক্তিগত অভ্যাস, যদিও তিনি নিজে কোনও বচন সহ্য করতে পারেন না। তাঁর মতে বৃদ্ধেরা ধর্মকথা বলতে পারেন, ব্রাহ্মণেরা উপদেশ দিতে পারেন, কিন্তু উলটে ঐ ধর্মকথাই যদি কোনও শূদ্র ব্রাহ্মণকে বলে তবে সেটি হবে ঔদ্ধত্য এবং তার কানে-মুখে গরম তেল ঢালার ব্যবস্থা। মেয়েদের বাপ-ভাই, স্বামী এবং ছেলে ছাড়া অন্য পুরুষের সঙ্গে কথা বলা মানেই ঘৃতাগ্নি সমিন্ধনের ব্যবস্থা করা। আবার ধরুন, কোনো ব্রহ্মচারী যুবক প্রচুর সাবিত্রীমন্ত্র জপ করে ক্লান্ত হয়ে কিঞ্চিৎ গুষ্টিসুখ অনুভব করার আয়োজন করছে, ব্যাস, মনু একটি জব্বর বচন দিয়ে তাকে একেবারে প্রাচীন বংশমণ্ডপের আড়ালে সাবিত্রীগৃহে পাঠিয়ে দেবেন। ক্ষেত্রবিশেষে যুবকদের মনে মনে কথা বলাতেও মনুর বারণ আছে। যেমন ধরুন, গুরুগৃহে কোনো বিংশতি বর্ষীয় যুবক মনুরই বচন অনুসারে যুবতী গুরুপত্নীর চরণ-বন্দনা করতে গেছেন। নিরীহ শিষ্য কোনো কথাও বলেনি, ভাবখানা শুধু—’ও দুটি চরণ শীতল’ জানিয়া শরণ লইনু আমি।’ কিন্তু হায়, এই মনে মনে এতটুকু কথাও নিষ্ঠুর মনু সহ্য করেননি; তিনি নিজেরই বচন নিজে অ্যামেন্ড করে বললেন—গুরুপত্নী যুবতী হলে চরণ বন্দনার কোনো প্রয়োজন নেই, কারণ এই পাদস্পর্শের গুণ এবং দোষ কি তা নাকি ঐ শিষ্য জানে। মনুর অজস্র কড়া কড়া বচনের ভাবে বুঝি বৃদ্ধ ব্রাহ্মণদের ধর্মকথা এবং সদ্যোজাত শিশুর কান্না ছাড়া অনর্থক কথা বলা মানেই মনুর কুনজরে পড়া, যা আমরা সকলেই পড়ে গেছি।
কিন্তু এ যুগের কবি রবি ঠাকুর ‘মনুর শাস্ত্র শুধরে দিয়ে নতুন বিধান’ জারি করেছেন। কবির দুঃখ—”উপদেশের কথা যে রাস্তা দিয়া চলে মনুর আমল হইতে তাহা বাঁধা” এবং তাঁর মতে বাজে কথাতেই যেহেতু ”মানুষ আপনাকে ধরা দেয়”, তাই আমরা মনুকে মাথায় রেখে শিবঠাকুরের আপন দেশেই যে কত রকম সর্বনাশা আড্ডাখানা ছিল তার খোঁজেই বেরিয়ে পড়েছি।
মনুকে আমরা যতই উড়িয়ে দিই না কেন, আদিমানব মনুর কাছে আমাদের ঋণের অন্ত নেই। কেননা আমরা যাকে আড্ডা বলি সে কথাটি প্রায় তাঁরই সৃষ্টি। আড্ডা কথাটি যদি সংস্কৃত অট্যা>অট্টা—এর থেকে এসে থাকে তবে বলব মনু ব্যবহার করেছেন ‘বৃথাট্যা’ শব্দটি, যার মানে বৃথা ঘোরাঘুরি। আমরা জানি, অনর্থক ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে অবশ্যই আড্ডার প্রবৃত্তি আসে। অবশ্য আরও মজার কথা হল সংস্কৃতে ‘অডড’ বলেও একটি ক্রিয়া আছে যার অর্থ অভিযোগ, তর্ক, ঘোঁট পাকানো। পণ্ডিতেরা বলেন বেদে ব্যবহৃত অত ধাতু অট ধাতুর (যার থেকে অট্যা) পূর্বসূরি, ঠিক সেইভাবে অড্ডা ধাতু, অট ধাতুর উত্তরসূরি নয়তো?
ভাষাতত্ত্বের কচকচি থাক, আসল কথা আজকের দিনের আড্ডার মধ্যে যে আমেজটুকু আছে তা যেমন শুধু খোশগল্পই নয়, আবার শুধু চরে বেড়ানোও নয়, শুধু তক্কাতক্কিই নয়, আবার শুধু ঘোঁট পাকানোও নয়—অথচ সত্যিকথা, এ সব কিছুই, তাই আডডা হল অত অট, অডড—এসব কিছুর যোগফল। একটা ঠিক, সুপ্রাচীন বৈদিকযুগে আডডার আজকের রূপটি মোটেই ধরা পড়বে না, তবে সেকালের গণ্ডিতে তাঁদের নিজেদের মতো করে এক ধরনের আড্ডা বৈদিক মানুষেরাও দিতেন। কেউ যদি বলেন বৈদিকযুগে আবার আড্ডা—এতো বড় অশাস্ত্রীয় কথা, তবে আমরা বলব, জীবন মনুর মতে চলে না, শত শত মন্ত্রোচ্চারণের মাঝে যখন যজ্ঞধূমে ঋষিদের দৃষ্টি হত অকূল, তখন মন্ত্রের সুর হয়ে যেত হালকা, আর মেজাজটাও হত কিঞ্চিৎ লঘু। ভাবুন তো এক বছর ধরে যে সত্রযাগ চলবে, তার এক ফাঁকে যদি ঋষিরা বৃষকপি সূক্তের যৌন কথাবার্তাগুলি উচ্চৈঃস্বরে পড়তে থাকেন তাহলে দোষ দেব কি! দোষ দেব না তবুও যদি কুন্তাপ সূক্তের নরনারী সম্পর্কিত অশ্লীল কথাগুলি সত্রযাগেই চলে। অশ্বমেধের এলাহি কাণ্ডকারাখানার মধ্যে পাটরানী যদি যজ্ঞীয় অশ্বের সঙ্গে মিলনরূপকে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন তবে ঋষিরাই লঘু ছন্দে নিন্দা-প্রতিনিন্দায় অংশ নেন পাটরানীর সঙ্গে। বলতে পারি এতো আড্ডা নয়, এ শুধু হালকা সুরে কথা কওয়া, তাহলে সত্রযাগের মহাব্রত অংশে যেখানে মেয়েরা মাথায় কলসি নিয়ে নাচছে, সঙ্গে চলছে গান-বাজনা, এক ব্রাহ্মণ সামনে বসে থাকা এক শূদ্রকে যথেচ্ছ গালাগালি দিচ্ছে, সেই শূদ্র আবার ব্রাহ্মণের চরিত্র তুলে তাকে নাস্তানাবুদ করছে—এ সব কিছুই কিন্তু ঋষিদের সামনেই হত এবং আমরা কি বিশ্বাস করব যে তাঁরা এই অনর্থক কথালাপে অংশগ্রহণ করতেন না; আমাদের বিশ্বাস, অবশ্যই করতেন কেননা তাহলে মহাব্রত অংশে এমন নিয়ম কেন যে, এগুলো করতেই হবে। আসলে ঋষিরাও তো মানুষ, গভীর মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যে রসালাপের এই লঘু ছন্দ তাই স্বাভাবিক। এমনকী এ যুগের বন্ধুবান্ধবদের আড্ডাখানায় যেমন ধাঁধা চালাচালি হয়, তেমনি যজ্ঞশেষে এক ঋষি বলছেন—বলতো, কে একাকী চলে, আর কেই বা পুনরায় জন্মায়? অন্যজন বললেন, ”সূর্য একাকী চরতি, চন্দ্রমা জায়তে পুনঃ।” বেশ বুঝি, এসব ধাঁধা নিতান্তই নিরীহ, কিন্তু তবুও এগুলাকে আড্ডার আঙ্গিকের মধ্যে ধরতে হবে বইকি! তবে একথাও ঠিক, মুনিঋষিরা খাপছাড়াভাবে যতই আড্ডার মেজাজে থাকুন না কেন, আড্ডার একটা নির্দিষ্ট চেহারা এযুগে খুঁজে পাওয়া মুশকিল, যদিও হাইনরিখ জিমারের মতো পণ্ডিত দেখিয়েছেন যে, বৈদিকযুগের ‘সভা’ শব্দটির মধ্যেই এ যুগের আড্ডাখানা তথা ক্লাব-হাউসের মূল লুকিয়ে আছে। জিমারের ধারণা সরকারি কথাবার্তা শেষ হলেই আড্ডার একটা মেজাজ চলে আসত। সভায় যে আড্ডা জমত তার আরও একটা প্রমাণ হল, পরবর্তীকালে বাৎসায়ন বলেছেন সমাজের ভালো মেয়েরা আড্ডা দিতে গেলে সেটা সমাজের চোখে পছন্দসই ছিল না। ঠিক এই কথার একইরকম প্রতিধ্বনি শুনতে পাই একটা বৈদিক বাক্যে—তস্মাৎ পুমাংসঃ সভাং যান্তি, ন স্ত্রিয়ঃ। ‘সভা’ শব্দের এই প্রয়োগে বুঝি আড্ডা ছিল, আড্ডা আছে—সে সভাতেই হোক কিংবা সমাজে, বেশ্যাগৃহেই হোক কিংবা বিদগ্ধ নাগরকের আপন গৃহে, কেননা বাৎস্যায়ন এই সব জায়গাতেই আড্ডার বন্দোবস্ত করেছেন ভালোভাবে। বৈদিক যুগের ঠিক পরেই কিন্তু একটি সার্থক প্রতিশব্দ পাই, যার নাম গোষ্ঠী। গেলডনার কিংবা হুইটনী এই শব্দের জের টেনেছেন ‘গোষ্ঠ’ থেকে আর সর্বশেষে সৈয়দ মুজতবা আলি সাহেব গুষ্টিসুখের রস—কীর্তন করে বুঝিয়ে দিয়েছেন—আড্ডার সঙ্গে গোষ্ঠীর তফাত নেই কোনো। গোষ্ঠী অর্থে সমাজ কথাটি অবশ্য আরও পুরানো, কেননা পালিগ্রন্থ ছুল্লবগ্গ কিংবা সিগালবাদ সূত্ততে দেখা যাবে যে, যাকে আমরা সমাজ (পালি সমাজ) বলি তাতে নাচ-গানের ব্যবস্থা ছাড়াও গল্প করা (অকখান) ম্যাজিক দেখানো—এ সব ব্যবস্থাই আছে। খোশগল্পের এই সমাজটি আসলে যে আড্ডাখানা তার প্রমাণ হল, মহাভারতের কুরুবৃদ্ধ পিতামহ রাজনীতির উপদেশে বলেছেন—বহিঃশত্রুর চরদের খুঁজে বার করতে হলে ঢুঁড়তে হবে এই সমাজগুলোতে, কেননা বুদ্ধিমান চরেরা মিলে মিশে থাকে এই সব আড্ডাখানায়। সমাজ আর গোষ্ঠী যে একই কথা সে বিষয়ে আরেক প্রমাণ হল—অমরকোষ এই শব্দ দুটিকে একই পর্যায়ে ফেলেছে, কথাটি অবশ্য সমাজ নয়, সমজ্যা। সভা, সমাজ, গোষ্ঠী—শব্দ পেলাম অনেক; মজায় মেজাজে আজকের আড্ডাখানার সঙ্গে গোষ্ঠীর যে কোনো বেমিল নেই তা বলে দিয়েছেন হর্ষচরিতের টীকাকার শংকর। সমান বিদ্যা, সমান বিত্ত, সমান চরিত্র, সমান বুদ্ধি এবং সমান বয়সি লোকেদের, এক জায়গায় বসে আলাপই হল গোষ্ঠী—আড্ডাও কি তাই নয়।
মানুষ যেমন হরেকরকম, তাদের আড্ডাও তেমনি হরেকরকম। ঋষিরা যেখানে শাস্ত্রগোষ্ঠী করবেন সেখানে কথাগোষ্ঠী হবে না, আবার যেখানে নৃত্যগোষ্ঠী হবে সেখানে অস্ত্রশস্ত্রের কসরৎ দেখিয়ে বীরপুরুষেরা বীরগোষ্ঠী করতে পারবেন কি? পুরাকালে মুনি ঋষিদের যে শাস্ত্রগোষ্ঠী ছিল তাতে যদিও ধর্মকথাই প্রধান ছিল তবুও ঠাট্টা-ইয়ার্কি যে একেবারেই চলত না তা মোটেই নয়। রাজর্ষি জনক যখন ব্রহ্মজ্ঞদের শাস্ত্রসভায় ঘোষণা করেছিলেন শ্রেষ্ঠ ব্রহ্মবিৎ দান পাবেন শতসহস্র গোরু, মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য তখন বিনা বাক্যে শিষ্যকে বললেন গোরুগুলি সংগ্রহ করতে। সমবেত ব্রাহ্মণেরা হইহই করে বললেন, ”কে হে তুমি নিজেকে শ্রেষ্ঠ ব্রহ্মবিৎ বলে জাহির করছ।” যাজ্ঞবল্ক্য লঘু সুরে বললেন, ”ঠাকুর তোমার পায়ে নমো নমঃ, আমার আসলে গোরুগুলোই দরকার—নমো বরং ব্রহ্মিষ্ঠায় কুর্ম্মো গোকামা এব বয়ং স্ম।” এই লঘু কথার শেষ কিন্তু কট্টর শাস্ত্রালোচনাতে—যার পরিণতি বৃহদারণ্যকের একাংশ।
শাস্ত্রগোষ্ঠীর গাম্ভীর্য আর কাব্যগোষ্ঠীর মাধুর্য নিয়েই গড়ে উঠেছিল বিদ্যাগোষ্ঠী কিংবা বিদগ্ধগোষ্ঠী। মহাকবি বাণভট্ট রাজা হর্ষের সঙ্গে পরিচয়ের আগে রাজভ্রাতা কৃষ্ণের কাছ থেকে আমন্ত্রণ পেলেন, রাজসভায় যাবার জন্য। কৃষ্ণ ছিলেন বাণের গুণমুগ্ধ, কাজেই মেখলকের মাধ্যমে যখন আমন্ত্রণ এল তখন বাণ ভাবলেন—এখন কি করি, একদিকে নিষ্কারণ বন্ধু কৃষ্ণের আমন্ত্রণ অন্যদিকে রাজকুল—সে বড় কঠিন জায়গা। রাজা-মহারাজের অনুবর্তিতা—সেও বড়ই কষ্টের। না আছে বংশগৌরব, না আছে পূর্বপুরুষের জমিয়ে রাখা রাজ্যপ্রীতি। না আছে বিদ্যা, না জানা আছে বিদ্বদগোষ্ঠীতে কাব্য বাঁধার কৌশল—ন বিদ্বদগোষ্ঠী-বন্ধবৈদগ্ধ্যম! বাণভট্টের এই অভিমানের মধ্যে সেকালের বিদ্যাগোষ্ঠীর ক্রিয়াকলাপ খানিকটা বোঝা যায় বইকি। একালের দিনে কবিসম্মেলন হয় জানি, সেকালের কবিদের কাব্যগুলি সহৃদয় বিদ্যাগোষ্ঠীর বৈদগ্ধ্যের নিকষে বিচার করা হত। কিছু উদ্ভাবনীশক্তি কিংবা কাব্য আলোচনার ক্ষমতা না থাকলে বিদগ্ধগোষ্ঠীতে আমল পাওয়া যেত না, কেননা মহাকবি দণ্ডী লিখেছেন কবিত্বশক্তি যাঁদের অল্প তাঁরাও যদি অনলস যত্ন করেন কবিতা-সরস্বতীর আরাধনায়, তাহলে তাঁরাও বিদগ্ধগোষ্ঠীতে বিহার করতে পারেন। এই সব বিদগ্ধগোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতা করতেন রাজা-মহারাজারা, কখনও বা বিশিষ্ট নাগরিক, এমনকি—রুচিশীলা বিদগ্ধা মহিলারাও। অবন্তীসুন্দরী কথায় দেখেছি এক উৎসবের দিনে এমনই এক বিদগ্ধগোষ্ঠীতে কাব্যচাতুর্যের পরিচয় মিলছে অনুচ্চার্য শব্দের মেলবন্ধনে, যাকে পরিভাষায় বলে, দুর্বাচক যোগ, আরও ছিল ম্লেচ্ছাক্ষরে তৈরি কবিতা, প্রহেলিকা, কাব্যবন্ধের আরও নানা কৌশল।
দশকুমারচরিতের রাজপুত্রেরা এক বছর পরে নিজেরা এক জায়গায় বসে নিজেদের যাবতীয় পুরানো অভিজ্ঞতার কথা, ঘটনা-দুর্ঘটনার কথা যেভাবে বলেছিল তাকে কথাগোষ্ঠী বলতে অসুবিধে নেই। কথাগোষ্ঠীতে শুধুই গল্প আর গল্প। কাল্পনিক, ঐতিহাসিক, ব্যবহারিক কোনো গল্পই বাদ যায় না। পাঠক যদি দণ্ডীর অবন্তীসুন্দরী কথার নাম শুনে থাকেন, তবে বলব এটি কথাগোষ্ঠীরই ফল।
গোষ্ঠী আছে আরও, তাতে যাত্রী আছে নানা—কারও গান ভালো লাগে, কারও নাচ, কারও বা কিঞ্চিৎ পান-ভোজন। মনে আছে মৃচ্ছকটিকের সেই নায়কটির কথা যে রাত্রিশেষে ফিরছিল গান শুনে আর গাইয়ের নাম ধরে বাহবা দিচ্ছিল বন্ধু মৈত্রেয়র কাছে—বেড়ে গেয়েছে ভাই রেভিল ঠাকুর। মৈত্রেয় ঠাট্টা করে বলল—আমার বাপু দুটো জিনিসে হাসি পায়। মেয়েমানুষ যখন সংস্কৃত পড়ে আর পুরুষমানুষে যখন গান গায়। মেয়েমানুষ যখন সংস্কৃত পড়ে তখন নতুন-দড়ি-পরানো নতুন বিয়োনো গাইটার মতো সু-সু শব্দ করে আর পুরুষমানুষ যখন গান গায় তখন মাথায় শুকনো জুঁই ফুলের মালা-জড়ানো বুড়ো পুরুতের মন্তর পড়ার মতো শোনায়। এই ঠাট্টায় উত্তেজিত হবার লোক নন চারুদত্ত, কাজেই সংগীতগোষ্ঠীর শেষ রাগিণীর রেশটুকু ধরে বলেই চললেন চারুদত্ত, বলেই চললেন।
গানের জলসা যেমন, তেমনি ছিল নাচের আসর এবং এতে নাচ-গান দুই চলত। দশকুমারের অপহারবর্মা যেখানে হাজারো নাগরিকের মধ্যে রাগমঞ্জরীর নাচ দেখতে গিয়েছিল, দণ্ডী সেই জায়গার নাম বলেছেন পঞ্চবীরগোষ্ঠী, যার অর্থ সর্বসাধারণের আড্ডাখানা—তৎপঞ্চবীরগোষ্ঠন্তু যত্তু জানপদংসদঃ—রামায়ণে একেই বলেছে জনপদসমাজ। এখানে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এবং নিষাদ—কেউ কারও জাতের জন্য উৎকর্ষ কিংবা অপকর্ষবোধ করত না; এ ছাড়া শুধুই নাচের জন্য নৃত্যগোষ্ঠীর উল্লেখ পাই বাণের হর্ষচরিত। আজকের দিনে নাচ, গান এবং গান যেহেতু অনেকক্ষেত্রেই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, তাই এই উত্তরাধিকারের কারণ জানতে হলে আমাদের সাক্ষী মানতে হবে সদা সত্যাশ্রয়ী বুদ্ধদেবকে। এই মহাপুরুষ নাকি এক সোনার সকালে শ্রাবস্তীতে প্রবেশ করে দেখেন গোষ্ঠীপ্রেমিক পুরুষেরা মদের নেশায় প্রায় বেহুঁশ হয়ে বীণা আর মৃদঙ্গের লহরা বাজাচ্ছে, আর তাদের গায়ে-কাপড়ে চেপটে রয়েছে কমলকলির দল—নেশায় উত্থান-পতনের ফল আর কি। অবদানশতকে ভগবান বুদ্ধের সামনে এ ঘটনা না ঘটলেই ভালো হত কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি মদের আড্ডার গুণ অনেক। বন্ধু হয় তাড়াতাড়ি—মজামৌজ নির্ভেজাল। একথা কালিদাস পর্যন্ত বুঝেছিলেন না হলে অমন যে স্ট্যাটাসওয়ালা রাজার শালা, সেও জেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব-পাতানোর জন্য মদের দোকানে ঢুকেছে। বেমালুম ভুলে গেল একটু আগে এই জেলেকেই সে চরম অপমান করেছে রাজার আংটি নিয়ে, আর এখন বলে নাকি—আজ থেকে তুমিই ভাই আমার বন্ধু, আর আমাদের প্রথমসখ্যের সাক্ষী হবে মদ। এই একই কালিদাসের প্রশ্রয়ে রঘু সৈনিকেরা কলিঙ্গ জয় করে রাস্তার মধ্যেই মদের আড্ডা জমিয়েছে, এমনকী উপযুক্ত পানপাত্রের অভাব থাকায় কালিদাস স্বয়ং তাম্বুল দলে পানপাত্র তৈরি করে হাতে তুলে দিয়েছেন নারিকেলের আসব। এ যুগের মদের আড্ডায় মদের গেলাসে প্রিয়তমার মুখচ্ছবি দেখতে পাওয়া যায়, কিন্তু শিবের বিয়ের আগে হিমালয়ের রাজধানী ওষধিগ্রন্থের পানগোষ্ঠীতে নিরীহ কালিদাস পানপাত্রে প্রতিফলিত দেখেছেন আকাশের তারা। রাজসভার কবি। ভাবে বুঝি পানগোষ্ঠীর অভিজ্ঞতা থাকা অসম্ভব নয়।
একটু ভিন্নরুচির আড্ডায় যখন চলেই এলাম তবে এই সঙ্গে তাস-পাশার আড্ডাও সেরে নেওয়া যাক। তাসপাশার আড্ডা বড় সর্বনেশে আড্ডা। বৈদিক অক্ষসূক্তের বিখ্যাত সেই পাশারুর কথা ছেড়েই দিলাম, আমরা হলফ করে বলতে পারি স্বয়ং ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির নিয়মিত পাশার আড্ডায় যেতেন, কেননা শকুনির কাছে ভাই-বউ-রাজ্য-সম্পদ খুইয়ে তাঁর কোনো লজ্জাই হয়নি। গালাগালিও খেয়েছেন যথেষ্ট, কিন্তু বিরাট রাজার সভায় অজ্ঞাতবাসের কথা যখন উঠল, পাশা-না-খেলার দুঃখে ধর্মরাজ বললেন, ”আমার নাম হবে বেশ কঙ্ক, আমি বেশ পাশা খেলব বিরাট রাজার সঙ্গে।” নেশাটি ঝালিয়ে নেবার এই অসামান্য সুযোগ যুধিষ্ঠির ছাড়েননি এবং বারো বচ্ছর পরেও কৃষ্ণ এবং লোহিতবর্ণের অক্ষগুটিকা যথাস্থানে সন্নিবেশ করার জন্য তাঁর মন আঁকুপাঁকু করছে। নিজেকে দ্যূতপ্রিয় ব্রাহ্মণ সাজাতে বউ-ভাইয়ের সামনে একটুও লজ্জা হয়নি। তবে যুধিষ্ঠিরকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, পাশার আড্ডার নেশা পুরোপুরি বৈদিক, কেননা স্বয়ং পুরোহিত-যজমানের সঙ্গে পাশাখেলায় মেতে উঠতেন এবং তাও একটি গোরু বাজি রেখে। আবার এই আড্ডা নাকি সভ্যাগ্নি স্থাপনের একটি অঙ্গ। বৈদিক সভাশব্দের মানেই অনেকে করেছেন পাশাখেলার আড্ডা আর এ আড্ডা এমনই জমপেশ ছিল যে এই আড্ডাখানা চালানোর জন্য নির্দিষ্ট মালিক থাকতেন, সায়নাচার্য যার নাম খুঁজে বার করেছেন ‘সভাবিন’ বলে। পরবর্তীকালের আড্ডাখানার মালিক সভিকের সঙ্গে এই শব্দের কোনো মিল আছে কিনা ভাষাতাত্ত্বিকরা তা খুঁজে বার করুন, কিন্তু তাকে ধাওয়া করতে দেখব মৃচ্ছকটিকের এক পাকা জুয়াড়ি সংবাহকের পেছনে। পাশাখেলাকে কেন্দ্র করে যেহেতু জুয়োর আড্ডা চলে এবং উড়ো টাকার লেনদেন হয় তাই সেকালের রাজারাও সুযোগ বুঝে কামিয়ে নিলেন কিছু এবং সেই হিস্যা আদায়ের জন্যই রাখা হত সভিককে। মৃচ্ছকটিকের দুর্দান্ত সেই পাশার আড্ডার স্বাদ যাঁরা পাননি, তাঁদেরকে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য অনুরোধ করব দণ্ডীবর্ণিত চম্পানগরীর সেই দূতসভায় যেতে, যেখানে অক্ষধূর্তেরা পঁচিশ কিসিমে পাশা খেলে। তা ছাড়া শেখা যাবে দান ফেলার কায়দা, প্রতারণা, অশ্লীল কথা, সগর্ব আস্ফালন, রাগ দেখানো। অক্ষনিপুণরা এখানে ভালো দানে বাহবা দেবে, নিজের দলে টানবে। এখানেই অপহারবর্মা একজনের ভুল দান ফেলা দেখে হেসেছিল আর-সঙ্গে সঙ্গে প্রতিপক্ষ বলল—’হেসে দান শেখানো হচ্ছে, তবে এই আনাড়ীকে বাদ দিয়ে তোর সঙ্গেই খেলব।’ এই পাশায় অপহারবর্মা জিতেছিল ষাট হাজার দিনার, সেই সঙ্গে ভালো খেলার জন্য স্বয়ং সভিকের বাড়িতে ‘লাঞ্চ’ খাওয়ার নিমন্ত্রণ।
অপকর্মের আরেক আড্ডাখানা হল বিটগোষ্ঠী। বিট হল সেই, যে শৌখিনতার দরুন টাকাপয়সা খুইয়েছে, কিন্তু মানুষটি গুণী, অনেক কলায় অভিজ্ঞ এবং আড্ডাখানায় কথা কইতে পারে অপূর্ব। বিট কথাটি পূর্বে খারাপ অর্থে ব্যবহৃত হত না কেননা বাণের মতে হর্ষের রাজধানীকে বিদগ্ধ পুরুষেরা নাকি বিটগোষ্ঠীর সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা বলে মনে করতেন। পরবর্তী সময়ে এই বিটেরাই কিন্তু সংযোগ ঘটাতে আরম্ভ করে নাগরিকের সঙ্গে গণিকার। বাংলাভাষায় বিটলে, বিটলেমি—এই শব্দগুলি বিটদের দয়ায় তৈরি কিনা জানি না, তবে মহাকবি ভাস তাঁর নায়ক অবিমারককে রাত্রির রাজপথে বার করে আমাদের হদিশ দিয়েছেন শৃঙ্গাটকস্থ সেই বিটসভার। শৃঙ্গাটক মানে চৌরাস্তার মোড়, যেখানে বাস বিটগোষ্ঠীর রসিক পুরুষেরা মনের মানুষের খবর দিতেন।
হরেকমানুষের হরেক রকম আড্ডাখানা পেলাম কিন্তু এর কোনোটাতেই আমাদের মতো মানুষের রসদ মেলা ভার। আমরা যারা অনর্থক রসালাপে গুষ্টিসুখ অনুভব করতে চাই তাদের ফিরে তাকাতে হবে চতুষ্পদের সেই সব সন্ধিস্থলে যেখানে সমান বয়সি, সমান বিত্তবুদ্ধির বন্ধুবান্ধবেরা একসঙ্গে আড্ডা জমিয়েছে। বাৎস্যায়ন বলে দিয়েছেন কারও বিদ্যেবুদ্ধি বেশি থাকলেও এখানে সংস্কৃত ভাষা খেলিয়ে আঁতলামির চেষ্টা করা চলবে না, আবার চলবে না একেবারে দেশিভাষাও যাতে আড্ডার সমতা নষ্ট হয়। বিকেলবেলা একটু সেজেগুজে বেরিয়ে পড়লেই হল—গৃহীত-প্রসাধনস্যাপরাহ্নে গোষ্ঠীবিহারাঃ। এ এমনই এক নির্ভেজাল আড্ডা যেখানে মূল্য দিতে হবে শুধু মধুর হাসিটি, কেননা ভাস বলেছেন গোষ্ঠীষু হাস্যম। গোষ্ঠীর মূল উদ্দেশ্য যদিও মজামৌজ আর হাসাহাসি তবু হাসার জন্যই শুধু গোষ্ঠী নয়, গোষ্ঠীর বন্ধুবান্ধবদের সমব্যথা এমনই যে, রামায়ণে ভরত যখন পিতার মৃত্যুস্বপ্ন দেখে বিহ্বল হয়েছিলেন, তখন আড্ডার বন্ধুরাই প্রথম চেষ্টা করেছে নানা প্রসঙ্গ তুলে তাকে ভুলিয়ে দেবার। গানবাজনাও বাদ যায়নি, বাদ যায়নি বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গিতে প্রহসনের চেষ্টা, কিন্তু গোষ্ঠীহাস্যানি কুর্বদ্ভির্ন প্রাহৃষ্যত রাঘবঃ—ভরতের মন শান্ত হয় না। তখন আড্ডার মধ্যেও পরমপ্রিয় প্রাণের বন্ধুটি জিজ্ঞাসা করে—কী হয়েছে রে তোর, এত হাসাচ্ছি তবুও হাসছিস না যে—সুহৃদ্ভিঃ পর্যুপাসীনঃ কিং সখে নানুমোদসে। আড্ডাখানার অনেক বন্ধুর মাঝে একদম প্রাণের বন্ধুও তৈরি হয়ে যায় দু/একটি। বাৎস্যায়ন পুরুষমানুষের বেশি আড্ডাবাজি পছন্দ করেননি কারণ বৌরা নাকি তাতে ক্ষেপে যায়, কিন্তু এরকম বন্ধু যদি দু-একটি থাকে, তক্কাতক্কি, চুলোচুলি যাই হোক না, সহস্রবার বিদায় নিয়ে আবার তার কাছেই ফিরে যেতে হয়। মনে পড়ে, রাজশেখরের কর্পূরমঞ্জরীতে মধুর এক বসন্তদিনে কপিঞ্জল ব্রাহ্মণ ভারি রাগ করেছিল রাজার ওপরে; রাজার নাকি মদ আর পঞ্চগব্যে এক দৃষ্টি, কাঁচ আর মাণিক্যে এক আদর। চেঁচিয়ে বলল—”অমন রাজকুল দূরে থাকুক, রাজা বন্ধু খুঁজে নিন আরও, আমি আপন ব্রাহ্মণীর পদসেবা করে ঘরেই দিন কাটাব।” এত চেঁচামেচিতে স্বয়ং রাজার পাটরানী টিপ্পনী কেটে বললেন—অজ্জউও, কপিঞ্জল ছাড়া আবার আড্ডা, কাজলকটাক্ষ ছাড়াই কি প্রসাধন সম্ভব—কীদৃশী কপিঞ্জলেরন বিনা গোষ্ঠী? কীদৃশী নয়নাঞ্জনেন বিনা প্রসাধন লক্ষ্মী : অর্থাৎ যথেষ্ট হয়েছে, কালকেই তো আবার দুজনে আড্ডা দিতে বসবে। আর আমি বসে থাকব চাঁদের পানে চাওয়া চকোরীর মতো।