পোকা
বিজ্ঞান আকাদেমির সভাপতি ক্রাউস তার দুই হাত মুষ্টিবুদ্ধ করে ভিডি স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করছেন স্বাভাবিক থাকার জন্যে কিন্তু একটু ভালো করে লক্ষ করলেই বোঝা যাচ্ছে তার হাত দুটি কাঁপছে। ভিডি স্ক্রিনের ভেতর থেকে একটি রাক্ষুসে পোকার ত্রিমাত্রিক ছবি তার ঘরের ভিতরে ঢুকে গেল। এটি সত্যি নয়—এটি শুধু একটি ছবি, তারপরও তিনি তার মাথা সরিয়ে এই পোকাটির কাল্পনিক স্পর্শ থেকে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করলেন।
ক্রাউসের ব্যক্তিগত সহকারী মেয়েটি তার দিকে তাকিয়েছিল, সে নরম গলায় বলল, “মহামন্য ক্রাউস, আমি ভিডি স্ক্রিনটা বন্ধ করে দেই?”
বিজ্ঞানী আকাদেমির সভাপতি ক্রাউস কাঁপা গলায় বললেন, “না লানা, বন্ধ কোরো না। আমি দেখতে চাই।”
“এখানে দেখার বিশেষ কিছু নেই মহামান্য ক্রাউস। পঙ্গপালের আরেকটি ঝাঁক উত্তরাঞ্চলে হানা দিয়েছে। শস্য খেতের সব শস্য খেয়ে ফেলছে। এর মাঝে দেখার মতো নতুন কিছু নেই।”
“আছে। পঙ্গপালের এই প্রজাতিটি রাক্ষুসে প্রজাতি। এটি অনেক বেশি বড়ো, অনেক বেশি আগ্রসী। এটি অনেক দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে।”
“সেটি নতুন তথ্য নয় মহামান্য ক্রাউস। আপনি দুই বৎসর আগে এই নতুন প্রজাতির পঙ্গপালের অস্তিত্বের কথা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন।”
বিজ্ঞান আকাদেমির সভাপতি ক্রাউস মাথা ঘুরিয়ে তার দীর্ঘদিনের ব্যক্তিগত সহকারী লানার দিকে তাকালেন, নিচু গলায় বললেন, “আমি বিজ্ঞান আকাদেমির সভাপতি, আমার অশুভ ভবিষ্যদ্বাণী করার কথা নয়, আমার দায়িত্ব অশুভ ভবিষ্যৎ থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করা।”
“আপনি চেষ্টা করেছিলেন মহামান্য ক্রাউস। পৃথিবীর আবহাওয়া পরিবর্তনে অসংখ্য নতুন কীটপতঙ্গের জন্ম হয়েছে, সেগুলো বংশবৃদ্ধি করেছে, আপনার কিছু করার ছিল না।”
বৃদ্ধ ক্রাউস দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “তুমি দেখেছো লানা, আমি চেষ্টা করেছিলাম। পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত করার ঝুঁকি নিয়েও আমরা কীটনাশক কেমিক্যাল ব্যবহার করেছি। আমরা কীট ধ্বংস করার জন্য বিশেষ ভাইরাস তৈরি করে সেগুলো ব্যবহার করেছি। কীটপতঙ্গরা যেন বংশবৃদ্ধি করতে না পারে সে জন্য আমরা জিনেটিক প্রক্রিয়ায় তাদের ক্লীব করে দিয়েছি। কিন্তু তারপরেও তাদের পরাস্ত করতে পারিনি।”
কথা বলতে বলতে বিজ্ঞান আকাদেমির সভাপতির গলা ধরে এলো, তিনি প্রায় ভেঙে পড়লেন এবং তাকে একজন পরাজিত মানুষের মতো দেখাতে লাগল। লানা কী বলবে বুঝতে না পেরে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল।
বিজ্ঞান আকাদেমির সভাপতি ক্রাউস দীর্ঘ সময় চুপ রইলেন, তারপর বললেন, “আমি পৃথিবীকে রক্ষা করতে পারিনি লানা। পঙ্গপালের ঝাঁক পৃথিবীর এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে, একটি শস্য খেতের পর আরেকটি শস্য খেত উজাড় করে দিচ্ছে। গত বছর ফসল বলতে গেলে কিছু হয়নি। এই বছর যেটুকু হয়েছিল সেটি গত কয়েক সপ্তাহে শেষ হয়ে গেছে। পৃথিবীতে কোনো শস্য নেই। গুদামজাত শস্য দিয়ে মানুষ বেঁচে আছে। অনেক জায়গায় এর মাঝে দুর্ভিক্ষের মতো অবস্থা। ভবিষ্যতে কী হবে আমি সেটা চিন্তা করতে ভয় পাচ্ছি। আমি এটা সহ্য করতে পারছি না লানা।”
লানা বলল, “আপনি এই পুরো বিপর্যয়টিকে কেন নিজের ব্যর্থতা হিসেবে নিচ্ছেন? এটি একটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়। আপনার নেতৃত্বে পৃথিবীর জ্ঞান- বিজ্ঞান-প্রযুক্তি অনেক এগিয়েছে, কিন্তু প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে আপনার হাত নেই মহামান্য ক্রাউস। আমরা অতীতে অনেকবার দেখেছি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ে নগরী ধুলোয় মিশে গেছে, ভয়ংকর ভূমিকম্পে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা গেছে, মহাকাশ থেকে ছুটে আসা উল্কার আঘাতে সভ্যতা ধ্বংস হয়ে গেছে, ভয়ংকর ভাইরাস পৃথিবীর জনসংখ্যার অর্ধেক নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে— এটিও সে রকম একটি বিপর্যয়। অন্য বিপর্যয় থেকে এটি ভিন্ন, কারণ আপনি এর ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, পৃথিবী প্রস্তুতি নিয়েছিল, প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু পারেনি। আমরা এখনো প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করা শিখিনি। আমাদের প্রকৃতির পাশাপাশি থাকতে হয়, প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ক্ষমতা আমাদের নেই।”
বৃদ্ধ ক্রাউস কষ্ট করে হাসার চেষ্টা করে বললেন, “লানা, ছোটো শিশুকে যেভাবে বোঝানো হয় তুমি আমাকে সেভাবে বোঝানোর চেষ্টা করছো—”
লানা অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, “আমি খুব দুঃখিত প্রফেসর ক্রাউস, আমি খুব লজ্জিত। আপনার মতো একজন মানুষকে কিছু বলার মতো ধৃষ্টতা আমার নেই। আপনাকে এ রকম ব্যাকুল হতে দেখে আমি এ রকম নির্বোধের মতো আচরণ করেছি।”
“না। তুমি মোটেও নির্বোধের মতো আচরণ করছো না। এ রকম একটা সময়ে মানুষকে যেভাবে সান্ত্বনা দিতে হয়, সাহস দিতে হয়, তুমি ঠিক সেভাবেই সাহস দিচ্ছ, সান্ত্বনা দিচ্ছ! তোমাকে ধন্যবাদ লানা।”
বৃদ্ধ ক্রাউস ভিডি টিউবের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সামনে একটি বিশাল শস্য খেতকে দেখা যাচ্ছে। আকাশে কালো মেঘের মতো পঙ্গপালের ঝাঁক ছুটে আসছে। কীটনাশক তাদের ওপর কাজ করে না, ভাইরাস তাদের স্পর্শ করে না, জিনেটিক প্রযুক্তিকে হার তারা মানিয়ে বংশবৃদ্ধি করছে। ভিডি স্ক্রিনে প্রথমে একটি-দুটি পতঙ্গকে দেখা গেল, তারপর শত শত পতঙ্গ নিচে নেমে এলো। হিংস্র শ্বাপদের মতো সেগুলো শস্য খেতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। কর্কশ শব্দ করে সেগুলো শস্যের কচি দানা খেতে থাকে, সেই দৃশ্যটি দেখে বৃদ্ধ ক্রাউসের শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে। তিনি দুর্বলভাবে বললেন, “আমি আর সহ্য করতে পারছি না লানা।”
লানা এগিয়ে এসে বলল, “ভিডি টিউবটি বন্ধ করে দেই?”
“দাও, বন্ধ করে দাও। আমি এই কুৎসিত পোকাটি আর দেখতে পারছি না।”
লানা ভিডি টিউবটি বন্ধ করে দেবার সাথে সাথে ঘরে একধরনের নীরবতা নেমে এলো। বৃদ্ধ ক্রাউস একটা নিশ্বাস নিয়ে বললেন, “কীটপতঙ্গের প্রতি আমার একধরনের ভীতি আছে। এটি আসলে একটি ফোবিয়া। আমি কখনো ভাবিনি এই কীটপতঙ্গই আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো অভিশাপ হয়ে দাঁড়াবে।”
লানা কোনো কথা বলল না। বৃদ্ধ ক্রাউস বললেন, “সেই শৈশব থেকে আমি পোকামাকড়-কীটপতঙ্গকে দেখে আমি একধরনের তীব্র আতঙ্ক, তীব্র ঘৃণা অনুভব করি। জীববিজ্ঞানের ক্লাসে পোকামাকড় সম্পর্কে পড়তে গিয়ে যখনই তার ছবি দেখেছি, মডেল দেখেছি আমি আতঙ্কে শিউরে উঠেছি। ল্যাবরেটরিতে যখন নানা পোকামাকড় মাইক্রোস্কোপের নিচে দেখতে হয়েছে আমার গা গুলিয়ে এসেছে।”
লানা বলল, “মহামান্য ক্রাউস, আপনি আমার থেকে অনেক ভালো করে জানেন অনেক মানুষের ভেতরেই এ রকম ফোবিয়া আছে। কেউ সাপ দেখে ঘৃণায়-আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে যায়, কেউ মাকড়সাকে ভয় পায়, কেউ উঁচু জায়গায় উঠতে পারে না। এগুলো ফোবিয়া।”
“হ্যাঁ। আমার ফোবিয়া হচ্ছে কীটপতঙ্গ। একটা জীবন্ত পোকা যদি আমার দিকে এগিয়ে আসে আমি আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে যাই। এমনকি একটা মৃত পোকা দেখলে আমার গা গুলিয়ে আসে। আমি সেটার দিকে তাকাতে পারি না!”
লানা কিছু বলল না, একধরনের মমতা নিয়ে অনেকটা শিশুর মতো এই জ্ঞানতাপস বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে রইল।
বিজ্ঞান আকাদেমির সভাপতি ক্রাউস একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “আর কয়েক দিনের ভেতরেই এই পঙ্গপালের ঝাঁক নগরে প্রবেশ করতে শুরু করবে। সেই দৃশ্য আমি সহ্য করতে পারব না। কুৎসিত পতঙ্গের ঝাঁক আমার বাগানের ফুল গাছ, সবুজ পাতা কচকচ করে খেতে থাকবে, সেই দৃশ্য দেখে আমি পাগল হয়ে যাব। তাই আমি ঠিক করেছি—” বিজ্ঞানী ক্রাউস কথা শেষ না করে হঠাৎ থেমে গেলেন।
লানা জিগ্যেস করল, “কী ঠিক করেছেন?”
“আমি শীতল ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে যাব।”
“শীতল ঘরে ঘুমিয়ে যাবেন?”
“হ্যাঁ।”
“কতদিনের জন্যে ঘুমিয়ে যাবেন?”
“আমি সেটা ঠিক করিনি। পৃথিবীর মানুষ যখন এই কীটপতঙ্গের সমস্যা মিটিয়ে ফেলতে পারবে আমি তখন আবার জেগে উঠব। যখন দুর্ভিক্ষ বন্ধ হয়ে যাবে, মানুষ আবার পেট পুরে খেতে পারবে, কোথাও কোনো অভুক্ত-ক্ষুধার্ত মানুষ থাকবে না, আমি তখন জেগে উঠব।”
লানা বিষণ্ণ দৃষ্টিতে বিজ্ঞান আকাদেমির সভাপতি ক্রাউসের দিকে তাকিয়ে রইল।
* * * *
হালকা একটি সংগীতের শব্দ শুনতে শুনতে ক্রাউস চোখ খুলে তাকালেন। ছোটো ক্যাপসুলের ভেতর একধরনের মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি শীতল ঘরে ক্যাপসুলের ভেতর ধীরে ধীরে জেগে উঠছেন। আবছা আবছাভাবে তার মনে পড়ল তিনি এই শীতল ঘরে ঘুমিয়ে গিয়েছিলেন। ভয়ংকর কীটপতঙ্গ-পোকামাকড়ের আক্রমণে সারা পৃথিবী যখন দিশেহারা তখন তিনি শীতল ঘরে ঢুকেছিলেন। কথা ছিল পৃথিবীর মানুষ যখন আবার এই ভয়ংকর কীটপতঙ্গ-পোকামাকড় পঙ্গপালের হাত থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারবে, দুর্ভিক্ষের ছোবল থেকে উদ্ধার পাবে তখন যেন তাকে জাগিয়ে তোলা হয়। তাকে এখন জাগিয়ে তোলা হচ্ছে, যার অর্থ পৃথিবী তার সমস্যার সমাধান করেছে। কতদিন সময় লেগেছে? দশ বছর? একশ বছর? হাজার বছর? ক্রাউস ক্যাপসুলের ভেতর তাকালেন, সামনে প্যানেলের দিকে তাকালেন। অনেক রকম আলো, অনেক রকম বাতি, স্ক্রিন, জ্বলছে- নিভছে, সংখ্যা পাল্টে যাচ্ছে, এর মাঝে তিনি অতিক্রান্ত সময়টা খুঁজে পেলেন না। ক্রাউস একটু অবাক হলেন, তিনি ভেবেছিলেন শীতল ঘরের ঘুমন্ত মানুষ যখন দীর্ঘ একটা নিদ্রা থেকে জেগে উঠবে তখন সে প্রথম জানতে চাইবে কতদিন থেকে সে ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু এই ক্যাপসুলে শুয়ে সেটি সহজে বোঝার উপায় নেই।
ক্রাউস অনুভব করলেন একটা আরামদায়ক উষ্ণতা খুব ধীরে ধীরে তার শরীরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। তিনি ধীরে ধীরে তার হাত, পা, মাথা, ঘাড়, শরীর, অনুভূতি ফিরে পেতে শুরু করেছেন। ক্রাউস চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলেন। একটু পরেই ক্যাপসুলের দরজা খুলে যাবে—তখন তিনি কী দেখবেন?
ক্যাপসুলের দরজা খুলতেই তিনি দেখলেন বেশ কয়েকজন মানুষ তার উপর ঝুঁকে পড়ল। একজন হাসি মুখে বলল, “মহামান্য ক্রাউস, উষ্ণ পৃথিবীতে আপনাকে আমন্ত্রণ। শীতল ঘরে আপনার নিদ্রাটি নিশ্চয় শান্তিপূর্ণ হয়েছিল।”
মানুষটির উচ্চারণ নিখুঁত, পৃথিবীতে দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হলে উচ্চারণ পরিবর্তন হতো। যার অর্থ পৃথিবী খুব অল্প সময়েই তার সমস্যার সমাধান করেছে। মানুষটি তাকে মহামান্য ক্রাউস বলে সম্বোধন করছে, ঠিক যেভাবে তাকে পৃথিবীতে সবাই সম্বোধন করত। মনে হয় মানুষটি তাকে চেনে।
সাদা পোশাক পরা মানুষগুলো তার দুই হাত ধরে ক্যাপসুল থেকে বের করে আনল। শীতল ঘর থেকে বের হওয়ার পর কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যাপার আছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করলেন। তার খুব জানতে ইচ্ছে করল কত বছর তিনি শীতল ঘরে ঘুমিয়েছিলেন। কিন্তু ঠিক কী কারণ কে জানে তার সেটা জিগ্যেস করতে একটু সংকোচ হলো। পৃথিবী দুঃসময়ে সেখান থেকে পালিয়ে শীতল ঘরে ঘুমাতে চলে যাওয়া নিয়ে তার ভেতরে কোথায় জানি একটু হীনম্মন্যতা আছে। মনে হয় সে জন্যেই তিনি সহজভাবে কথা বলতে পারছিলেন না।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে উষ্ণ পানিতে তিনি দীর্ঘ সময় নিয়ে গোসল করলেন, তাকে নূতন কাপড় পরিয়ে আবার পরীক্ষা কেন্দ্রে নিয়ে আসা হলো। সেখানে খাবার টেবিল, টেবিলে খাবার সাজানো। টেবিলকে ঘিরে বেশ কয়েকজন মানুষ বসে আছে। ক্রাউস টেবিলের উপর সাজানো খাবারের দিকে তাকালেন। কী চমৎকার খাবার, দেখে তার চোখ জুড়িয়ে গেল। পৃথিবী নিশ্চয়ই আগের অবস্থায় ফিরে গেছে, তা না হলে এত চমৎকার খাবার কোথা থেকে এলো?
ক্রাউস তার জন্যে রাখা চেয়ারে বসে প্লেটটি নিজের কাছে টেনে আনলেন। ডিশ থেকে খানিকটা খাবার নিজের প্লেটে তুলে নিলেন। চামচ দিয়ে খাবারটা মুখে তুলে তিনি মুগ্ধ হয়ে গেলেন। মনে হলো সারা জীবনে তিনি এত সুস্বাদু খাবার খাননি।
ঠিক তখন দরজা খুলে একটি মেয়ে এসে ঢুকল—তিনি মেয়েটিকে দেখে অবাক হয়ে গেলেন, তার ব্যক্তিগত সহকারী লানা। ক্রাউস অবাক হয়ে বললেন, “লানা! তুমি?”
“হ্যাঁ, মহামান্য ক্রাউস! আমি এই মাত্র খবর পেয়েছি আপনাকে শীতল ঘর থেকে বের করা হচ্ছে। খবর পেয়েই আমি ছুটে এসেছি।”
“আমি কতদিন শীতল ঘরে ঘুমিয়েছিলাম?”
“তিন মাস। ঠিক করে বললে দুই মাস আটাশ দিন।”
“এত কম সময়? এত কম সময়ে পৃথিবী কীটপতঙ্গ পঙ্গপালের সমস্যা সমাধান করে ফেলেছে?”
লানা হাসি মুখে বলল, “আপনি ঠিকই বলেছেন।”
ক্রাউস অবাক হয়ে জিগ্যেস করলেন, “কীভাবে তারা পোকামাকড় পঙ্গপালকে নিশ্চিহ্ন করে দিলো?”
লানার হাসি আরো বিস্তৃত হলো, বলল, “খেয়ে।”
“কী বললে?”
“পৃথিবীর মানুষ পোকামাকড় খাওয়া শুরু করেছে। কীটপতঙ্গ-পোকামাকড় অসম্ভব সুস্বাদু আর পুষ্টিকর। এই টেবিলের সবকিছু পোকামাকড় দিয়ে তৈরি। আপনি আপনার প্লেটে যেটা নিয়েছেন সেটা পঙ্গপালের ডিম থেকে
বের হওয়া ছোটো লাভার একটা স্যুপ! কী চমৎকার খেতে। তাই না?”
ক্রাউস বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলেন।
লানা বলল, “এখন যখন আকাশ থেকে পঙ্গপালের ঝাঁক কোথাও ঝাঁপিয়ে পড়ে, মানুষের আনন্দের সীমা থাকে না। এটা বিশুদ্ধ প্রোটিন। পৃথিবীর মানুষের খাবারের সমস্যা চিরদিনের মতো মিটে গেছে। আর কখনো আমাদের খাবার নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।”
লানা তার পকেট থেকে একটা প্যাকেট বের করে সেখান থেকে বড়ো একটা পোকা বের করে—তেলে ভাজা মুচমুচে, কচকচ করে সেটা খেতে থাকে।
ক্রাউস তার দীর্ঘদিনের সহকারীর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন।